ইনস্পেক্টর রনি ও অলৌকিক সার্কাস
সার্কাসের বাঘের খেলা থেকেই যত গোলমালের শুরু। সার্কাস দেখতে গিয়েছিলাম। একাই। কিন্তু সার্কাস দেখতে আমার এখন আর ভালো লাগে না। কারণ, সার্কাস দেখতে গেলে মনে পড়ে যায় আমার মেয়ে টুসির কথা। ওকে সঙ্গে নিয়ে বেশ কয়েকবার সার্কাস দেখেছি। ও বাঘ-সিংহের খেলা দেখতে ভালোবাসত। লাল-নীল-সবুজ রঙের ম্যাকাও পাখির কেরামতি দেখে ছোট-ছোট হাতে খুব হাততালি দিত। কতই বা বয়েস ছিল তখন ওর—বড় জোর আট। এখন যদি ও আমার পাশে থাকত তা হলে বয়েসটা আরও দু-বছর বেশি হত।
বাঘের খেলা দেখাচ্ছিল রিং-মাস্টার। পরনে সোনালি রঙের পোশাক, হাতে বৈদ্যুতিক চাবুক। তাকে ঘিরে ন’টা হিংস্র ডোরা-কাটা বাঘ ভিজে বেড়ালের মতো বসে আছে। দেখে কে বলবে, এদের থাবার এক ঘায়ে এরকম আড়াইজন রিংমাস্টার খতম হয়ে যেতে পারে!
সার্কাসটা একটু নতুনরকমের। বাঘের খেলা বা সিংহের খেলা দেখানোর সময়ে এরা কোনওরকম লোহার রেলিং ব্যবহার করে না। তার বদলে কাজে লাগায় অদৃশ্য ফোর্স ফিল্ড। সেটা পেরিয়ে জন্তু-জানোয়ার বা মানুষ, কেউই দর্শকদের নাগাল পাবে না। এ ছাড়া, দর্শকদের সুবিধের জন্যে প্রায় দোতলা-সমান উঁচুতে টাঙানো রয়েছে চার-চারটে বিশাল মাপের লিকুইড ক্রিস্টাল টিভি পরদা। তাতে বাঘ আর রিং-মাস্টারের মুখের ক্লোজ আপ ছবি দেখা যাচ্ছিল।
আমার ঠিক পাশেই বসেছিল বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা মেয়ে। গায়ের রং কালো, তবে মুখখানা ভারী মিষ্টি। মাথা-ভরতি কোঁকড়া চুল। তাতে আবার লাল ফিতে বাঁধা। পরনে গোলাপি রঙের ফ্রক। সব মিলিয়ে ঠিক যেন একটা পুতুল।
বাচ্চা মেয়েটা হাত-পা নেড়ে ফুরফুর করে কথার খই ফোটাচ্ছিল। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে বাবা-মাকে একেবারে নাজেহাল করে দিচ্ছিল। প্রশ্নের বিষয়ও যথারীতি বহুমুখী। যেমন, বাঘের লেজ কেন রাস্তার কুকুরের মতো গোল পাকিয়ে থাকে না, বাঘ যদি সিংহের মতো দেখতে হত তাহলে কী হত, ডোরা-কাটা বাঘা বেড়ালের সঙ্গে বাঘের সত্যি-সত্যিই কোনও আত্মীয়তা আছে কি না, ইত্যাদি।
মেয়েটার বাবা শেষ পর্যন্ত আর না পেরে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘কী সাংঘাতিক মেয়ে দেখেছেন! কোথায় মন দিয়ে বাঘ দেখবে, তা না, খালি উদ্ভট সব প্রশ্ন।
আমি হাসলাম। মুখের পেশিতে সামান্য টান লাগল। একটা স্বাভাবিক জবাব দেওয়া দরকার। ভদ্রলোক যেন কিছুতেই বুঝতে না পারেন আমার বুকের ভেতরে রয়েছে একটা মাইক্রোপ্রসেসর চিপ, আর মস্তিষ্কের খানিকটা অংশ জুড়ে রয়েছে অর্ধপরিবাহী স্মৃতিকোষ।
তাই অনেকক্ষণ সময় নিয়ে তারপর জবাব দিলাম, ‘তোমার তো বেশ বুদ্ধি আছে দেখছি! কী নাম তোমার?’
মেয়েটা চটপট বলে উঠল, ‘আমার নাম শর্বরী। শর্বরী মানে রাত্রি—।’ ওর জবাব দেওয়ার ঢং দেখে আমরা তিনজনেই হেসে উঠলাম। ঠিক তখনই জোরালো সুরে বাজনা বেজে উঠল, আর সেটা ছাপিয়ে শোনা গেল বাঘের গর্জন। সাধারণ সার্কাসে বাঘ-সিংহের খেলা দেখানোর সময় কোনওরকম মিউজি
বাজানো হয় না। কিন্তু এই সার্কাসের সবই একটু অন্যরকম।
এক-দুই গুনতে পারো?’ ও ঝটিতি ছোট্ট মাথাটাকে কাত করে, প্রায় কাঁধে ঠেকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ—।’
আমি শর্বরীকে বললাম, ‘তুমি
‘তা হলে তুমি বাঘ গুনতে থাকো- ‘
টুসিকে শান্ত করার জন্যে এই কৌশলটা মাঝে-মাঝে কাজে লাগাতাম আমি। আমার কথায় শর্বরী ছোট্ট হাতের তর্জনী উঁচিয়ে ‘এক-দুই’ করে বাঘ গুনতে শুরু করল।
শর্বরীর মা হঠাৎ জিগ্যেস করলেন, ‘আপনি একাই সার্কাস দেখতে এসেছেন?’
আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে জবাব দিলাম, ‘হ্যাঁ— এই অপরিচিত মানুষ দুজনকে কী করে আমি বলি, আমার আর কেউ নেই! টুসিকে নিয়ে শেষ যখন সার্কাস দেখতে এসেছিলাম তখন সঙ্গে সুনন্দা ছিল। এই শর্বরীর মতো টুসিও এসেছিল ওর মা-বাবার সঙ্গে। তারপর হল সেই মারাত্মক দুর্ঘটনা। আমাকে নিয়ে চলল যমে-মানুষে টানাটানি। শেষপর্যন্ত মানুষ জিতল বটে, তবে টুসি আর সুনন্দা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। রোবট গবেষণায় তাক লাগিয়েদেওয়া এক বৃদ্ধ বিজ্ঞানী ডক্টর অভিজিৎ মজুমদার আমাকে নতুন জীবন দিলেন। ব্যাটারি, তার, মাইক্রোপ্রসেসর, আই সি চিপ, ধাতুর পাত এইসব কেমন করে যেন ঢুকিয়ে দিলেন আমার শরীরের নানা জায়গায়। সেইসঙ্গে কীসব জটিল প্রোগ্রাম চালু করে দিয়েছিলেন। ব্যস! লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অপারেশন ডিভিশনের ইন্সপেক্টর রনি সরকার নতুন জীবন ফিরে পেল। কিন্তু কী অদ্ভুত আমার এই নতুন জীবন! থেমে যাওয়া জীবনকে আবার প্রাণের জোগান দিল ইলেকট্রনিক্স, আর বিশ্বকর্মা ডক্টর মজুমদার— আমার ঈশ্বর, আমার জীবনদাতা। প্রতি মাসে আমি একবার করে ওঁর কাছে যাই, রুটিন চেক আপের জন্যে।
আমার পুরোনো স্মৃতির প্রায় সবটুকুই মুছে গিয়েছিল, কিন্তু ধীরে-ধীরে সেগুলো ফিরে পাচ্ছি। টুসি আর সুনন্দার খোঁজ এখনও করিনি। ডক্টর মজুমদার বলেছেন, ‘এখনও সময় হয়নি— তুমি এখন শতকরা পঞ্চাশ ভাগ যন্ত্র, আর পঞ্চাশ ভাগ মানুষ। তোমার স্বাভাবিক হয়ে উঠতে আরও সময় লাগবে। সেই সময়টা যাতে কম লাগে তার জন্যে তোমাকে স্বাভাবিক সব কাজকর্ম করতে হবে। আগের জীবনে যা যা করতে সেইসব কাজ করবে—।’
ডক্টর মজুমদারের পরামর্শেই আমার আজ সার্কাস দেখতে আসা। অফিস থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়েছি বিশ্রামের জন্যে। আজ তার দ্বিতীয় দিন।
শর্বরীর বাবা চশমার ফাঁক দিয়ে তখনও আমাকে দেখছিলেন। শর্বরীর মাও আড়চোখে দেখছেন আমাকে। আমি একটু অস্বস্তি পেলাম। কারণ আমার অভিব্যক্তিগুলো এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। ওঁরা সেটা ধরে ফেলেননি তো! তা ছাড়া, আমার গলার স্বরে সামান্য মেটালিক আওয়াজ থেকে গেছে। ফলে ওঁদের সঙ্গে যত কম কথা বলা যায় ততই মঙ্গল।
কিছু একটা ভেবে বলতে যাব, তার আগেই শর্বরী হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠল,
‘আমি বাঘ গুনতে পারব না। একবার আটটা হচ্ছে, একবার ন-টা হচ্ছে—। আমি এবার একটু হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বললাম, ‘বাচ্চা মেয়ে তো, ভালো করে গুনতে শেখোনি।’
আমার কথায় শর্বরী একেবারে চোখ গোল-গোল করে চেঁচিয়ে উঠল, ‘না, আমি হানড্রেড পর্যন্ত কাউন্ট করতে জানি। বিশ্বাস না হয়— ‘
তখনই বিশ্বাস হল আমার। দেখলাম, রিং-মাস্টার আটটা বাঘ নিয়ে খেলা দেখাচ্ছে। অথচ একটু আগেই ন-টা বাঘ ছিল— আমি নিজে দেখেছি। আমার শরীরের ভেতরে রাখা ডিজিটাল কাউন্টারে সেই সংখ্যাটা ধরাও পড়েছিল। কিন্তু এখন আটটা। এটা কি ডক্টর মজুমদার বিশ্বাস করবেন? নাকি আমার প্রোগ্রাম বা সার্কিটের গোলমাল বলে ধরে নেবেন?
‘দেখেছেন, ওই বাঘটা মাপে কীরকম বড়!’ একটা বাঘের দিকে আঙুল তুলে মন্তব্য করলেন শর্বরীর বাবা। চোখের চশমাটা একবার নেড়েচেড়ে ঠিকঠাক করে বসালেন।
বাঘটাকে আমিও দেখলাম। সত্যিই মাপে বেশ বড়। আর গায়ের ডোরাকাটা দাগগুলোও যেন একটু অন্যরকম। আর একই সঙ্গে লক্ষ করলাম, বাঘের সংখ্যা এখন আবার নয়।
শর্বরীর বাবা-মা দুজনেই এটা লক্ষ করেছিলেন। চারপাশে তাকিয়ে বুঝলাম, আরও কয়েকজন যে ব্যাপারটা খেয়াল করেননি তা নয়। আর আমার অপ্টোইলেকট্রনিক চোখে রিং-মাস্টারের অসহায় হতভম্ব অভিব্যক্তি স্পষ্ট ধরা পড়ল। চার পাশে আলোর ফোয়ারা, বাজনার ছন্দ, টিভি-পরদায় বাঘের ছবি, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও কোথায় যেন তাল কেটে গেছে। দেখলাম, সার্কাস-কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট গ্যালারিতে বেশ ভিড়। দু-একজন কর্তাব্যক্তি আঙুল তুলে এরিনার দিকে দেখাচ্ছেন। বাঘের গোলমালটা ওঁদেরও নজরে পড়েছে।
কী করব ভেবে ওঠার আগেই সেই প্রকাণ্ড বাঘটা হঠাৎই ফোর্স ফিল্ডের অদৃশ্য দেওয়াল লক্ষ করে লাফ দিল। সাধারণভাবে ফোর্স ফিল্ডে বাধা পেয়ে বাঘটার থেমে যাওয়ার কথা। কিন্তু কিছুই হল না। ওটা দিব্যি এসে পড়ল দর্শকদের এলাকায়।
আর সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হয়ে গেল হইচই।
চিৎকার-চেঁচামেচি-ছুটোছুটি। মাইকে বারবার ঘোষণা করা হতে লাগল, ‘আপনারা শান্ত হন। বাইরে যাওয়ার সবক’টা দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা কাজে নেমে পড়েছে…।’
কিন্তু কে শোনে কার কথা! চেয়ার উলটে পড়ল, গ্যালারি ভেঙে পড়ল। আর বেপরোয়া ছুটোছুটি চলতেই থাকল। অথচ বাঘটাকে তখন আর কোথাও দেখা যাচ্ছিল না।
বাইরে যাওয়ার আটটা দরজাই দর্শকদের ভিড়ে ঠাসা। সেখান দিয়ে বাঘটা যে বেরিয়ে যাবে তার কোনও উপায় নেই। আর রিং-মাস্টারের কাছে চুপচাপ বসে আছে আটটা ডোরা-কাটা পশু।
শর্বরীর বাবা-মা ভয়ে চিৎকার করছিলেন। বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে কোথা দিয়ে পালাবেন বুঝতে পারছিলেন না। আমি শর্বরীকে কোলে তুলে নিলাম। মেয়েটা পালকের মতো হালকা। মাকে কাঁদতে দেখে ওরও মুখ কাঁদো-কাঁদো। ওকে কোলে নিয়ে এগোতে এগোতে বললাম, ‘আপনারা আমার পেছনে-পেছনে আসুন—।’ সবুজ ইউনিফর্ম পরা নিরাপত্তাকর্মীর দল তখন তাঁবুর চারপাশটা ঘিরে ফেলেছে। তাদের হাতে হাই ভোল্টেজ ইলেকট্রিক শকার। ওরা হন্যে হয়ে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া বাঘটাকে খুঁজছে। আর বেয়াদব দর্শকদের শাসন করছে। কিন্তু বাঘের কোনও দেখা নেই। কোথায় গেল অত বড় জন্তুটা?
ভিড় ঠেলে এগোচ্ছিলাম। আর একইসঙ্গে চারপাশে চোখ বুলিয়ে অবস্থাটা দেখছিলাম। ছুটোছুটি-ধাক্কাধাক্কি-হইচই যেমন চলছিল তেমনই চলছে। রিং-মাস্টার আটটা বাঘ নিয়ে চলে যাচ্ছে এরিনা ছেড়ে। মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে অবিরাম। নিরাপত্তাকর্মীরা দিশেহারা দর্শকদের নিয়ন্ত্রণে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
স্বাভাবিক কারণেই দর্শকের ভিড় দরজার কাছেই বেশি। আমি সেদিকে না গিয়ে দুটো দরজার মাঝ বরাবর একটা ফাঁকা জায়গা লক্ষ করে এগোলাম। শর্বরীর বাবা অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘এখান দিয়ে কী করে বেরোবেন?’
আমি কোনও উত্তর দিলাম না। উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থা বা সময় কোনওটাই ছিল না। টের পেলাম, শর্বরীর মা আমার শার্টের পিঠের দিকটা খামচে ধরে আছেন।
সার্কাসের গোটা এলাকাটা প্লাইউড আর টিন দিয়ে ঘেরা ছিল। তবে সুন্দর গোলাপি রঙের আস্তর থাকায় সেটা বোঝা যাচ্ছিল না। বোঝা গেল দেওয়ালে একটা ঘুসি বসিয়ে দেওয়ার পর।
শর্বরীকে ডানহাতে সামলে রেখে আমি প্রথম ঘুসিটা মেরেছিলাম বাঁ-হাতে। তাতেই বেশ বড়সড়ো একটা গর্ত হয়ে ফেটে গেল প্লাইউডের দেওয়াল। তার ওপাশের টিনও গেল তুবড়ে। কিন্তু এখান দিয়ে বেরোতে গেলে ভাঙতে হবে অনেকটাই, আর হাতেও খুব বেশি সময় নেই। তাই শর্বরীকে ওর মায়ের কোলে দিয়ে পরের ঘুসিটা মারলাম ডান হাতে। আর তারপরই ডানপায়ের দুটো জোরালো লাথি।
বেশ জোরে শব্দ হল। প্লাইউডের দেওয়াল ফেটে চৌচির হয়ে ওপাশের একটা টিন ভেঙে পড়ে গেল। শর্বরীদের ডেকে নিয়ে বেরোতে যাব, কোথা থেকে একজন নিরাপত্তাকর্মী ছুটে এল আমাদের সামনে। আমার দিকে শকার উঁচিয়ে বলল, ‘ফ্রিজ! আপনাকে আমার সঙ্গে অফিসে আসতে হবে। আপনি কোম্পানির প্রপার্টি ড্যামেজ করেছেন—।’
আমি জামার বুকপকেট থেকে ম্যাগনেটিক আইডেনটিটি কার্ডটা বের করে লোকটির দিকে উঁচিয়ে ধরলাম। কার্ডে আমার হলোগ্রাফিক ফটো রয়েছে। রয়েছে পরিচয়।
কার্ডটা ওর চোখের সামনে নেড়ে বললাম, ‘ইনস্পেক্টর রনি সরকার অপারেশন ডিভিশন, লালবাজার! সরি অফিসার, এখন আপনার সঙ্গে যাওয়ার সময় নেই—পরে এসে কথা বলব—।’ কার্ডটা আবার রেখে দিলাম পকেটে। কিন্তু আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই লোকটা শকার ফায়ার করতে যাচ্ছিল, তাই আমি বাঁ-হাতের তর্জনী শক্ত করে ওর কপালের ঠিক মাঝখানে এক টোকা মারলাম। প্রচণ্ড জোরে শব্দ হল। জানা কথা—হবেই। কারণ আমার বাঁ-হাতের আঙুলগুলো ইস্পাতের রড দিয়ে তৈরি। লোকটা কাত হয়ে পড়ে যেতেযেতে কোনওরকমে টাল সামলে নিল। আর একই সঙ্গে শকারটা মুগুরের মতো ঘুরিয়ে চালিয়ে দিল আমার মুখ লক্ষ্য করে। আমি আড়াআড়িভাবে বাঁ-হাত তুলে সেটা রুখে দিলাম। ধাতুর সঙ্গে ধাতুর সংঘর্ষের শব্দ হল। আর সংঘর্ষের প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লোকটার হাতে গিয়ে পৌঁছোল। ও শকার ছেড়ে দিয়ে হাত ঝাঁকাতে লাগল। অবাক হয়ে দেখতে লাগল আমাকে।
শর্বরী ততক্ষণে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিয়েছে। আর দেওয়ালের ফোকর দিয়ে লোকজন বাইরে বেরোতে শুরু করেছে। আমি নিরাপত্তাকর্মীর গাল টিপে ধরলাম বাঁ-হাতের দু-আঙুলে। ওর চোখ দেখে বুঝলাম, দু-গালে লোহা টের পেতে ওর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। বললাম, ‘এই দেওয়াল ভাঙা নিয়ে আমরা পরে কখনও কথা বলব, অফিসার। আমার নামটা মনে আছে তো! রনি সরকার, অপারেশন ডিভিশন, লালবাজার ওকে ছেড়ে দিয়ে আমি দেওয়ালের ফোকর দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। তাতে ফাঁকটা বোধহয় আরও খানিকটা বড় হয়ে গেল। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, শর্বরীরা আমার ঠিক পিছনেই আছে। ওদের পিছনে অন্যান্য লোকজনের ভিড়।
বাইরের খোলা মাঠে বেরোতেই ঠান্ডা বাতাস টের পেলাম। আমার শরীরের টেম্পারেচার সেন্সরগুলো ঠিকমতো কাজ করছে তা হলে! মাঝে-মাঝে ওগুলো গোলমাল করে। ওপরে তাকিয়ে দেখি অন্ধকার আকাশে লালচে মেঘ জমেছে। দূরে হয়তো কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। শর্বরীর বাবা চেঁচিয়ে বললেন, ‘টালা পার্কের দরজার কাছে আমাদের গাড়ি রয়েছে— ‘
আমি বললাম, ‘আপনারা জলদি চলে যান। শর্বরীকে সামনে রাখবেন।’ ভদ্রলোক আমার হাত চেপে ধরলেন। তাঁর চোখেমুখে কৃতজ্ঞতা। একটা ভিজিটিং কার্ড গুঁজে দিলেন আমার বুকপকেটে। বললেন, ‘একদিন সময় করে এলে সত্যি খুব খুশি হব।’
শর্বরীর মা ছোট্ট করে ‘আসি’ বললেন। ওঁর কাঁধে এলিয়ে-থাকা শর্বরী কচি গলায় বলল, ‘টা টা, আঙ্কল—।’
আমি হাত নাড়লাম। ওঁরা একরকম ছুটে চলে গেলেন।
সার্কাস এলাকার বাইরেটা খোলা মাঠ। তার একটা পাশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে পাকা রাস্তায়। সার্কাস থেকে বেরিয়ে সেই ঢাল বেয়ে মানুষের ভিড় ছুটে চলেছে রাস্তার দিকে। সার্কাসে ঢোকার সময়ে দেখেছিলাম, বাইরেটায় ঘুগনি, ফুচকা, ভেলপুরি, গ্যাস বেলুন এসব বিক্রি হচ্ছে। এখন সেসব চোখে পড়ার উপায় নেই। শুধু দেখি তিনটে লাল-হলদে গ্যাস বেলুন সুতো-ছেঁড়া অবস্থায় ভেসে যাচ্ছে আকাশে।
আমি নীচের রাস্তায় নেমে এসে একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ালাম।
এদিকটা অন্ধকার। সার্কাস এলাকার হ্যালোজেন বাতির আলো এতদূর এসে পৌঁছোতে পারেনি। পেছনের পকেট থেকে মিনি সেলুলার ফোন বের করে অপারেশন ডিভিশনে যোগাযোগ করলাম। বললাম, ‘টালা পার্কের কাছে “রকেট সার্কাস’-এ একটা ঝামেলা হয়েছে।’
ওপাশে ফোন ধরেছিলেন সার্জেন্ট রমাতোষ নন্দী। ভদ্রলোকের বুদ্ধি
কম,
তবে পরিশ্রম দিয়ে সেটা পুষিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। আর বয়েস প্রায় পঞ্চাশ হলেও দেখায় পঁয়ষট্টির মতো।
নন্দী জিগ্যেস করলেন, ‘সরকার, আপনি ওখানে কী করছিলেন?’ সত্যি কথাটাই বললাম, ‘সার্কাস দেখছিলাম।’
কয়েক সেকেন্ড ওপাশে হাসির ফোয়ারা ছুটল। শুধু রমাতোষ নন্দী কেন,
হেড কোয়ার্টারের প্রায় সকলেই জানে আমার সঙ্গে সার্কাস দেখার মতো কেউ নেই। আসল রনি সরকারের ছিল। রনির সেই পুরোনো জীবনের সঙ্গে নতুন জীবনের কোনও সম্পর্ক নেই। ওরা এখন আমাকে বলতে গেলে মানুষ বলেই মনে করে না। কিন্তু সম্পর্ক যে সত্যি একটা আছে সেটা মানি শুধু আমি আর ডক্টর অভিজিৎ মজুমদার।
অনেকক্ষণ পর নন্দী বললেন, ‘আপনি তো এখন ছুটিতে রয়েছেন— ‘ ‘আমি এই মুহূর্তে লিভ ক্যান্সেল করছি। আপনি বসকে জানিয়ে দেবেন। আর এখানে জলদি কাউকে পাঠান। দুজন হলে কাজের সুবিধে হয়। আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।’
নন্দী কী একটা অজুহাত দেখাতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই আমি টেলিফোনের সুইচ অফ করে দিয়েছি।
পরের টেলিফোনটা করলাম আর জি কর হাসপাতালে। ফোন করে ‘রকেট সার্কাস’-এর গোলমালের কথা বলতেই ওরা বলল, একটু আগেই খবর পেয়েছে। এক্ষুনি ওরা অ্যাম্বুলেন্স পাঠাচ্ছে।
ফোনটা অফ করে পকেটে রেখে ‘রকেট সার্কাস’-এর দিকে তাকালাম। বিশাল উঁচু তাঁবু। তাকে ঘিরে নানা রঙের আলোর নকশা। সার্কাসের কয়েকটা রুদ্ধশ্বাস খেলার মডেলও তৈরি করা হয়েছে আলো দিয়ে। আর তার সঙ্গে তার মন-মাতানো বাজনা।
বাইরেটা এত জমকালো, অথচ ভেতরে আতঙ্ক! ফোর্স ফিল্ডকে অগ্রাহ্য করে একটা বাঘ এরিনার বাইরে পালিয়েছে এবং চোখের পলকে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
হইচই এখন অনেক কমে গেছে। লোকজনের ছুটোছুটিও নেই। শুধু এখানেওখানে নানা জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। তারই মধ্যে সার্কাসের নিরাপত্তাকর্মীরা ঘোরাফেরা করছে। আহত ক্ষতবিক্ষত মানুষদের ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। ভিড়ের চাপে পায়ের নীচে পিষে কেউ মারা গেছে কি না কে জানে!
আমি ভারী-ভারী পা ফেলে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। পকেট থেকে রিমোট ইউনিট বের করে বোতাম টিপতেই গাড়ির অটোমেটিক দরজা খুলে গেল। আমি ভেতরে ঢুকে বসতেই দরজাটা নিজে থেকে আবার বন্ধ হয়ে গেল। ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলের সুইচ টিপে গাড়ির মাথায় বসানো ঘুরপাক খাওয়া লাল-নীল বাতি জ্বেলে দিলাম। এর ফলে লালবাজার থেকে যে-ই আসুক, আমাকে চট করে খুঁজে পাবে।
আমি ছুটিতে থাকলেও অফিস আমাকে গাড়িটা সবসময় ব্যবহার করতে দেয়। যেমন, এই মুহূর্তে আমার ঊরুর লাগোয়া সিকিওরিটি চেম্বারে একটা হেভি ডিউটি জেনারেটর গান রয়েছে। এটাও অফিস আমাকে সবসময় ব্যবহার করতে দেয়।
আমি গাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ঘরে এয়ারকুলার চলছিল। লুকোনো হলদে আলো সুদৃশ্য ঘরটাকে সমানভাবে আলোকিত করে রেখেছে। আমার সামনে সাদা ধবধবে টেবিল। টেবিলে পৃথিবীর একটা রঙিন ছবি। ছবিটা থেকে-থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে রং পালটাচ্ছে। বোধহয় ক্রেমোস্ক্যান টেকনিক ব্যবহার করা হয়েছে।
টেবিলটা মাপে বেশ বড়। তার একদিকে আমি আর সার্জেন্ট সন্দীপ বর্মন। হেড কোয়ার্টার থেকে ওকেই পাঠিয়েছে। ও আমাকে এখনও ঠিক সহজভাবে নিতে পারে না, কিন্তু খুব একটা অপছন্দও করে না।
সন্দীপ বর্মন একটু আগেই এসে পৌঁছেছে। ওকে সঙ্গে নিয়ে সার্কাসের তাঁবুতে ঢুকতে-ঢুকতে আমি ব্যাপারটা মোটামুটি ওকে খুলে বলেছি। ‘রকেট সার্কাস’-এর নিরাপত্তাকর্মীরা এখনও আটটা দরজায় শকার নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। অস্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে আহত মানুষদের কাতর আর্তনাদ। এই নিরাপত্তাকর্মীরাই সম্ভবত ত্রাণের কাজে হাত লাগিয়েছে। ওদের একজনকে ডেকে জানালাম আমাদের পরিচয়। বললাম, সার্কাসের মালিকের সঙ্গে দেখা করতে চাই। তাতে সন্দেহমাখা নজরে আমাদের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে দুজন অফিসার আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। চলার পথে দেওয়ালের ভাঙা জায়গাটা বর্মনের চোখে পড়ল। সেখানে একজন নিরাপত্তা কর্মী পাহারায় ছিল। ও সেদিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘সরকার, এটা দেখেছেন?’
আমি ছোট্ট করে বললাম, ‘আমি ওখান দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম।’ আমার কথা শুনে আমাদের সঙ্গের দুজন লোক অবাক হয়ে আমাকে খানিকক্ষণ দেখল, কিন্তু কিছু বলল না।
বর্মন পকেট থেকে সিগারেট বের করে ফস করে লাইটার জ্বেলে ধরাল। একটু ধোঁয়া ছেড়ে আমার দিকে সরাসরি না তাকিয়ে বলল, ‘দেখবেন, বসকে যেন আবার ফস্ করে বলে দেবেন না। তা হলে আমার চাকরিটা লস হয়ে যাবে।’ আমি ঘাড় নাড়লাম। বর্মনের এই একটা মারাত্মক দোষ। ভীষণ সিগারেটের নেশা। অন ডিউটি অফ ডিউটি মানে না।
একটু পরেই আমরা একটা অফিসঘরের সামনে এসে হাজির হলাম। কানে এল বাঘ অথবা সিংহের গর্জন। আর তারপরই হাতির ডাক। একজন নিরাপত্তা কর্মী বলল, ‘আপনারা এখানে একটু ওয়েট করুন—।’ তারপর সবুজ রঙের একটা প্লাস্টিকের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। দরজার নেমপ্লেটে ঝকঝকে তামার ওপরে টানা-টানা সুন্দর হরফে লেখা রয়েছে—ড. পি. বিজয় রাঘবন। প্রোপ্রাইটার, রকেট সার্কাস।
বর্মন চাপা গলায় আমাকে বলল, ‘কী-কী জিগ্যেস করবেন ভেবে রেখেছেন?’
আমি বর্মনের ঠোঁটের দিকে দেখলাম। ঠোঁট নড়া দেখে আমি কথা বুঝতে পারি। চাপা গলায় কেন, ফিশফিশ করে বললেও কারও কথা বুঝতে আমার একটুও অসুবিধে হয় না। বর্মনের কথার উত্তরে বললাম, ‘এখনও কিছুই ভাবিনি।’ এমনসময় ভেতর থেকে ডাক এল। বর্মন সিগারেটটা ফেলে দিল একপাশে।
তারপর আমরা দুজনে ডক্টর রাঘবনের চেম্বারে ঢুকলাম।
সুন্দরভাবে সাজানো ঘর। ঘরের চার দেওয়ালেই সার্কাসের নানা খেলার রঙিন ফটোগ্রাফ। ড. রাঘবন লম্বা-চওড়া স্বাস্থ্যবান একটি লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমাদের ঢুকতে দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে দু-হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি আলতো করে ওঁর হাত ধরলাম, যাতে ব্যথা না লাগে। একই সঙ্গে ওঁকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম।
রাঘবন বেশ মোটাসোটা লোক। মাথার চুল প্রায় কদমছাঁট। গায়ের রং মাঝারি। ছাই রঙের একটা কোট পরে রয়েছেন—সেটা বোধহয় ঘরের তাপমাত্রার জন্যে। কপালে সাদা আর লাল টিপের ছোঁওয়া। গলায় চর্বির থাক।
পরিচয় দিয়ে আমি আর বর্মন বসলাম রাঘবনের মুখোমুখি চেয়ারে। আমি বেশ সাবধানেই বসেছি, কিন্তু তাও স্টিল ফ্রেমের চেয়ারে ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ হল। গদিটাও যেন বসে গেল অনেকটা।
রাঘবন নিজের চেয়ারে বসলেন। তারপর সামনে দাঁড়ানো লম্বা-চওড়া মানুষটিকে বললেন, ‘কৃষ্ণন, তুমিও বসো, কথা আছে।’
রিং-মাস্টার কৃষ্ণনকে আমি আগেই চিনতে পেরেছি। এখন ওর পোশাকআশাক পালটে গেছে, কিন্তু উপায় কী! কোনও মুখ একবার দেখলে সেটা আমি আর ভুলি না। তবে আমার এই অদ্ভুত ক্ষমতার সবটুকু কৃতিত্বই ডক্টর অভিজিৎ মজুমদারের।
কৃষ্ণন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। লক্ষ করলাম, ওর চোখেমুখে কেমন একটা বেপরোয়া রুক্ষ ভাব। হয়তো সবসময় বাঘ-সিংহ নিয়ে খেলা দেখায় বলে একটা আলগা অহংকার লেগে আছে।
রাঘবন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইন্সপেক্টর সরকার, আমি আর কৃষ্ণন ওই বাঘের গোলমালের ব্যাপারটা নিয়েই আলোচনা করছিলাম। আমাদের বাঘ ন’টা। কিন্তু কয়েকদিন যাবৎ আটটা বাঘ নিয়েই কৃষ্ণন শো করছে। কারণ আমাদের একটা ফিমেল বাঘ পদ্মিনী চারদিন আগে খাঁচায় মারপিট করে চোট পেয়েছে।’
রাঘবনের কথার খেই ধরে কৃষ্ণন বলল, ‘নাকের পাশে আর কাঁধের কাছটায় বেশ চোট পেয়েছে। অনেকটা রক্ত পড়েছে। আমাদের দলের ডাক্তার ওষুধপত্র দিয়েছেন, ইনজেকশানও দিয়েছেন। এ ক’দিন ধরে পদ্মিনী আলাদা খাঁচায় রয়েছে। একটু আগেই ওকে দেখে এলাম। এরিনায় ও আসেনি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, নটা বাঘ আমিও দেখেছি। তক্ষুনি কীরকম যেন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’
আমি কিছু বলে ওঠার আগেই টেলিফোন বেজে উঠল। সঙ্গে রঙিন আলোর ঝলকানি এবং ভিডিও টেলিফোনের পরদায় একজন নিরাপত্তাকর্মীকে দেখা গেল। তার চোখেমুখে উত্তেজনা ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
রাঘবন গম্ভীর থমথমে গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘কী ব্যাপার, মনসুর?’ ‘স্যার, হাসপাতাল থেকে লোকজন নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এসে পড়েছে। উন্ডেডদের আমরা গাড়িতে তুলে দিয়েছি। আর বাকিদের ফার্স্ট এইড দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু—
‘কেউ মারাটারা যায়নি তো!’
‘না, স্যার। টেন্ট এখন বলতে গেলে ফাঁকা। শুধু আমরাই চারপাশ গার্ড দিচ্ছি। আর তিনজন সুইপার টেন্ট ঝাঁট দিয়ে সাফ করছে।’
‘গুড।’ রাঘবন তৃপ্তির শব্দ করলেন জিভে। তারপর বললেন, ‘তোমরা সবদিকে কড়া নজর রাখো। লালবাজার থেকে পুলিশ অফিসাররা এসেছেন। আমি ওঁদের সঙ্গে কথা বলছি। কৃষ্ণনও আমার কাছে আছে। লক্ষ রাখবে, টেন্ট থেকে অচেনা কেউ যেন তোমাদের নজর এড়িয়ে বেরোতে না পারে। আর উটকো কোনও লোককে ভেতরে ঢুকতে দেবে না। দিস ইজ মাই অর্ডার।’
‘ওকে স্যার।’ মনসুর ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে নিল। লোকটা যে ভয় পেয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন?
‘কিন্তু একটা কথা ছিল, স্যার—।’
রাঘবন ভিডিয়ো ফোন অফ করতে গিয়ে থমকে
গেলেন। ‘কী কথা, মনসুর?
‘টেন্টের মধ্যে কিছু একটা ছুটোছুটি করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওটার চলার আওয়াজ পাচ্ছি, বুঝতেও পারছি, কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।’
রাঘবন যে ঢোঁক গিললেন সেটা স্পষ্ট বোঝা গেল। তাঁর চোখ দুটো বড় হতে চাইছিল, কিন্তু তিনি ঝটিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেন। উত্তেজিত গলায় বললেন, ‘হোয়াট দ্য হেল ডু য়ু মিন?’
‘যা বলছি, সব সত্যি, স্যার। আমরা একটু নার্ভাস হয়ে গেছি।’
রাঘবন আমার দিকে তাকালেন। বললেন, ‘ইন্সপেক্টর সরকার, কিছু বুঝতে পারছেন?’
আমি মাথা নেড়ে ‘না’ বললাম। তবে এটা বুঝলাম, মনসুর মিথ্যে বলছে না। কারণ ঘণ্টাখানেক আগে, সার্কাস চলার সময়ে, বাঘটা যখন ফোর্স ফিল্ড অগ্রাহ্য করে লাফ দেয়, তখন আমি দেখেছি। লাফ দেওয়ার পরে বাঘটাকে আর দেখা যায়নি।
রাঘবনকে বললাম, ‘মনসুর ঠিকই বলছে। চলুন, ওখানে গিয়ে দেখা যাক।’ ডক্টর রাঘবন ভিডিওফোনে বললেন, ‘ওকে, মনসুর, আমি যাচ্ছি। তুমি চ্যাটার্জিকে বলো, স্ট্রং ফোর্স ফিল্ড অ্যাপ্লাই করে গোটা তাঁবুটাকে ঘিরে ফেলতে আর তোমরা প্রত্যেকে অ্যালার্ট থাকো।’
ফোন অফ করে দিলেন রাঘবন। আর তখনই কৃষ্ণন চাপাগলায় বলে উঠল, ‘ওটা বাঘ নয়। হয়তো কোনও অপদেবতা, জিন।’
আমি অবাক হয়ে কৃষ্ণনকে দেখলাম। ও সত্যিই ভয় পেয়েছে। নইলে এরকম হাস্যকর কথা কখনও বলত না। ছেলে-ভোলানো গল্প তৈরি করতেই একমাত্র অপদেবতা-জিনজাতীয় বস্তুগুলো কাজে লাগে। বাস্তবের ডিকশনারিতে এদের নাম নেই, কখনও ছিল না।
আমরা চারজন উঠে দাঁড়ালাম প্রায় একই সঙ্গে। দরজার কাছে যেতেই দরজাটা নিজে থেকে খুলে গেল। দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় বর্মন আমার প্রায় কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, ‘সরকার, এই প্রবলেম সল্ভ করতে গেলে পুলিশ দিয়ে কোনও কাজ হবে না, ম্যাজিশিয়ান দরকার।’
আমি বর্মনের দিকে তাকিয়ে হাসতে চেষ্টা করলাম। মুখের পেশিতে যথারীতি টান লাগল। তবে এটা ভেবে ভালো লাগল যে, আমি রসিকতা বুঝতে পারছি। ডক্টর মজুমদার বলেছেন, রসিকতা বোঝাটা কোনও যন্ত্রমানুষের পক্ষে অসম্ভব। একমাত্র সুস্থ মানুষই রসিকতা বুঝতে পারে। তা হলে আমি কী?
প্লাস্টিকের পাতে তৈরি মসৃণ রাস্তা ধরে আমরা এরিনার দিকে এগিয়ে গেলাম। জন্তু-জানোয়ারের চাপা গর্জন কানে আসছে। সার্কাসের খেলোয়াড়রা এখানে-ওখানে জটলা করছে। এরিনার এলাকায় ওদের ঢোকা এখন বারণ। তাই সিকিওরিটি গার্ডদের কাছ থেকে শোনা কথার ওপর নির্ভর করে যে যার মতো গল্পগুজব করছে।
চলার পথে একজন লোক আমাদের দলে যোগ দিল। পরনে তার নিরাপত্তা কর্মীদের সবুজ ইউনিফর্ম। বুকে একটা লাল রঙের ব্যাজ লাগানো। তার চারপাশে নীল বর্ডার।
ডক্টর রাঘবনের পাশাপাশি হাঁটতে-হাঁটতে সে বলল, ‘স্যার, ফোর্স ফিল্ড চালু হয়ে গেছে। তবে ফোর্স ফিল্ড দিয়ে ওই ইয়েটাকে বোধহয় ঠেকানো যাবে না।’
রাঘবন আমার আর বর্মনের সঙ্গে লোকটার পরিচয় করিয়ে দিলেন। অনুদীপ চট্টোপাধ্যায়—‘রকেট সার্কাস’-এর সিকিওরিটি চিফ। আমি চ্যাটার্জির সঙ্গে হাত মেলালাম। টের পেলাম, ওর গায়ে চিফ হওয়ার শক্তি আছে।
আমাদের দু-পাশে ছোট-ছোট তাঁবু। তার দরজায় দরজায় কৌতূহলী চোখমুখ। হ্যালোজেন বাতির আলোয় সেইসব মুখে ভয়ের ছাপও স্পষ্ট চোখে পড়ছে। বর্মন চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখছিল। রঙিন ফাইবার গ্লাসের খুঁটি, হ্যালোজেন বাতি, ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে—‘রকেট সার্কাস’-এর জাঁকজমকের কোনও খামতি নেই। ডক্টর রাঘবন কত টাকা ঢেলেছেন কে জানে!
ঘড়ি দেখলাম। রাত প্রায় এগারোটা। কিন্তু কারও চোখে ঘুম নেই। আমার তো স্লিপ সার্কিট ‘অন’ না করলে ঘুম পায় না। সুতরাং যখন-তখন ঘুম পাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই।
একটা দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম আমরা। অনুদীপ চ্যাটার্জি পকেট থেকে একটা রিমোট কন্ট্রোল ইউনিট বের করে কয়েকটা বোতাম টিপল। বোধহয় ফোর্স ফিল্ড ‘অফ’ হয়ে গেল। তখন চ্যাটার্জি আমাদের আহ্বান জানিয়ে বলল, ‘আসুন, ভেতরে আসুন—
ইলেকট্রিক শকার হাতে তিনজন নিরাপত্তাকর্মী দরজার মুখে দাঁড়িয়েছিল। ওরা সরে গিয়ে আমাদের পথ করে দিল। আমরা ভেতরে ঢুকে পড়তেই চ্যাটার্জি আবার রিমোট কন্ট্রোল ইউনিট বের করে তার বোতাম টিপতে লাগল।
আমি আর বর্মন তখন এরিনা ও তার আশপাশটা খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেছি।
ডক্টর রাঘবন কোটটা খুলে নিলেন গা থেকে। সেটা বাঁ-হাতের ওপরে ঝুলিয়ে চ্যাটার্জিকে বললেন, ‘সব লাইট অন করে দিতে বলো—
তার দু-তিন সেকেন্ডের মধ্যে সার্কাসের ভেতরটা চোখের পলকে দিন হয়ে গেল। সার্কাস চলার সময় আলোর বেশিরভাগটাই থাকে এরিনার মধ্যে। দর্শকদের বসার অংশে সেরকম একটা আলোর ব্যবস্থা থাকে না। কিন্তু এখন তফাত বোঝার উপায় নেই। গোটা তাঁবুটাই হ্যালোজেন আলোয় ঝকঝক করছে।
এখন কোনও মিউজিক বাজছে না। তবে ওপরে তাকিয়ে দেখলাম, চারটে টিভি-পরদা জীবন্ত। তাতে তাঁবুর বিভিন্ন অংশ ধরা পড়েছে। একটা পরদায় কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মীকে দেখা যাচ্ছে। ভয়ার্ত মুখ। হাতের শকার যে কোনও মুহূর্তে খসে পড়তে পারে।
তাঁবুর মাথাটা ছুঁচোলো হয়ে কত ওপরে উঠে গেছে কে জানে! অদ্ভুত ধরনের এক পলিমার দিয়ে তাঁবুটা তৈরি। সেটা দেখতে অনেকটা ঘষা কাচের মতো। তাঁবুর ভেতরটা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। তবে ডক্টর রাঘবনের ঘরের মতো অত ঠান্ডা নয়। চারপাশের অসংখ্য ফাইবার গ্লাসের খুঁটিতে লাইট এমিটিং ডায়োড দিয়ে তৈরি বহুরকমের রোলিং ডিসপ্লে। তার কোনওটায় লেখা ‘ধূমপান নিষেধ’, আবার অন্য কোনওটায় লেখা ‘রকেট সার্কাস যদি না দেখে থাকেন তা হলে আপনি রকেট কাকে বলে জানেন না, আর সার্কাস কাকে বলে তাও জানেন না।’
সন্দীপ বর্মন আবার সিগারেট ধরাল। ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘সরকার, আমি আগে কখনও সার্কাস দেখিনি।’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘আমরা এখানে সার্কাস দেখতে আসিনি।’ টের পেলাম, কথাটা বলার সময় গলার স্বরে ধাতব ছোঁয়াটা মাথাচাড়া দিল।
তাঁবুর ভেতরে মোট বাইশজন নিরাপত্তাকর্মী আমার চোখে পড়ল। ওরা এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনুদীপ চ্যাটার্জিকে দেখেই ওরা খানিকটা তটস্থ হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করল।
আমি কৃষ্ণনকে জিগ্যেস করলাম, ‘আপনি কখন প্রথম গোলমালটা টের পেয়েছিলেন?’
কৃষ্ণন বিরক্তভাবে আমার দিকে তাকাল। বোধহয় এর আগে ডক্টর রাঘবনও ওকে একই কথা জিগ্যেস করে থাকবেন।
একটু চুপ করে থাকার পর ও বলল, ‘আপনি তো খেলা দেখেছেন। রেখা যখন উঁচু টুলটায় উঠল, তখনই আমি একটা বাড়তি বাঘ টের পেলাম। কারণ, তখন রেখার দু-পাশে তিনটে আর চারটে—মোট সাতটা বাঘ থাকার কথা। কিন্তু দেখলাম, আটটা—মানে মোট ন-টা। তার মধ্যে আবার একটা বাঘ সাইজে বেশ বড়।’
অনুদীপ চ্যাটার্জি আমাদের ছেড়ে নিরাপত্তা কর্মীদের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ একটা হুড়োহুড়ির শব্দ কানে এল। সেইসঙ্গে কারও চিৎকার।
তাকিয়ে দেখি, অনুদীপ আর তিনজন নিরাপত্তাকর্মী এদিক-ওদিক ছিটকে পড়েছে। আর ছ-সাতটা চেয়ার উলটে গেছে। দুজন কর্মী শকার চার্জ করেছে। কারণ শূন্যে বিদ্যুতের ঝলক দেখা গেল। কিন্তু আর কিছু চোখে পড়ল না।
তাঁবু এলাকার মেঝেটা নকশা-কাটা প্লাস্টিকের তৈরি। ফলে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। কিন্তু আমার শরীরের যা ওজন তাতে এর ওপর দিয়ে দৌড়োনো ঠিক হবে না। বর্মন ব্যাপারটা আঁচ করল। এক ঝটকায় সিগারেট ছুড়ে ফেলে দিয়ে হোলস্টার থেকে জেনারেটর গান বের নিল। সেটা উঁচিয়ে ছুটে গেল চ্যাটার্জির দিকে।
‘মাই গড!’ বলে ডক্টর রাঘবনও ছুটলেন সন্দীপ বর্মনের পিছু-পিছু।
কৃষ্ণন চেঁচিয়ে উঠল। বলল, ‘হাওয়া-জিন ওদের ধাক্কা মেরেছে। আমি বাঘের সঙ্গে লড়তে ভয় পাই না, কিন্তু জিনের সঙ্গে তো আর জোর চলে না।’ বলে কৃষ্ণন তাঁবু থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল।
আমি ওকে ডেকে বললাম, ‘যাবেন না, কৃষ্ণন, দরজায় স্ট্রং ফোর্স ফিল্ড রয়েছে। তারচেয়ে আসুন, আমরা সবাই মিলে ওটাকে পাকড়াও করার চেষ্টা করি।’ কৃষ্ণন দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি অটোমেটিক লক খুলে সিকিওরিটি চেম্বার থেকে হেভি ডিউটি জেনারেটর গানটা বের করে নিলাম। লেসার গানের তুলনায় এই বন্দুকে নিরাপত্তা অনেক বেশি।
স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, একটা কিছু তাঁবুর ভেতরে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। তাকে চোখে দেখা যাচ্ছে না। ডক্টর রাঘবন কয়েকটা খুঁটির আড়ালে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করছেন। অনুদীপ চ্যাটার্জি নিজেকে সামলে নিয়ে রাঘবনের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আর নিরাপত্তাকর্মীরা আতঙ্কে গোলাপি দেওয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বিপদের আশংকা যে ঠিক কতটুকু তা ওরা বুঝতে পারছে না।
এই নাম-না জানা প্রাণীটা যদি অদৃশ্য হয় তা হলে সে কি অন্ধ! কারণ আলোকবিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুসারে অদৃশ্য প্রাণীকে অন্ধ হতেই হবে। তার শরীরের প্রতিটি অংশকেই হতে হবে বায়ুর মতো— অর্থাৎ, তার শরীরের প্রতিসরাঙ্কের মান হতে হবে প্রায় ১.০। তার চোখের বেলাতেও তাই। সেইজন্যেই ওই চোখে বায়ুমাধ্যম দিয়ে আসা আলোকরশ্মি কোনও প্রতিবিম্ব গঠন করতে পারবে না।
এই প্রাণীটাও কি সেইরকম? কিন্তু এ যে মাঝে-মাঝে দিব্যি চোখে-দেখাযায় এমন বাঘ হয়ে যাচ্ছে!
আমি আর কৃষ্ণন সামনে এগিয়ে গেলাম। এরিনার চারপাশ থেকে ফোর্স ফিল্ড তুলে নেওয়া হয়েছিল। কৃষ্ণন আমাকে বলে সেদিকে উঠে গেল। আর ঠিক তখনই একটা অর্ধেক বাঘ আমার চোখে পড়ল।
আমি কিছুতেই দৃশ্যটাকে মেনে নিতে পারছিলাম না। ঠিক পেটের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে একেবারে লেজের ডগা পর্যন্ত। শুধু এইটুকুই দেখা যাচ্ছে। এবং সেই অসম্পূর্ণ প্রাণীটা তিরবেগে ছুটছে।
ছুটতে-ছুটতেই সেটা সটান এসে ধাক্কা মারল কৃষ্ণনকে। সেই ধাক্কায় কৃষ্ণন ছিটকে পড়ল হাত-পাঁচেক দূরে, আর ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল। আমি জেনারেটর গান তাক করে ফায়ার করলাম—একবার, দু-বার।
আমি কখনও লক্ষ্যভ্রষ্ট হই না। এবারও হলাম না। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমাকে স্তম্ভিত করে দিল।
জেনারেটর গানের হাই লেভেল ফায়ারিং-এ প্রাণীটা একটুও বিচলিত হল না। বরং চোখের পলকে ওটা আবার অদৃশ্য হয়ে গেল।
জেনারেটর গানের হাই লেভেল ফায়ারিং-এ ভীষণ উচ্চশক্তিসম্পন্ন আহিত কণার স্রোত বেরিয়ে আসে। তার মধ্যে ভারী মৌলিক পদার্থের নিউক্লিয়াসও থাকে। এই ফায়ারিং-এর তেজ সহ্য করার ক্ষমতা পৃথিবীর কোনও প্রাণীর নেই। অন্তত আমি তাই জানতাম। তাই স্তম্ভিত হয়ে ভাবতে চেষ্টা করলাম, এই বিচিত্র অদৃশ্য প্রাণীটা এল কোথা থেকে!
সন্দীপ বর্মন দূর থেকে চিৎকার করে আমার নাম ধরে ডাকছিল। আমি ওর ডাকে সাড়া না দিয়ে ডক্টর রাঘবনকে চেঁচিয়ে বললাম, ‘ডক্টর রাঘবন, এক্ষুনি একটা বড় জালের ব্যবস্থা করুন। নইলে এই জন্তুটাকে ধরা যাবে না। ওটা বাঘ নয়।’
কৃষ্ণন উঠে দাঁড়িয়েই ছুটে গেল এরিনার কিনারার কাছে। সেখানে একটা ফাইবার পোলের গায়ে একটা নাইলন দড়ির মই জড়ানো ছিল। সেটা খুলে নিয়ে ও তরতর করে ওপরে উঠে যেতে লাগল। ওর হাতের পেশি, চোয়ালের হাড় ফুলে উঠেছে।
আমি নীচ থেকে চেঁচিয়ে ওকে ডাকলাম, কিন্তু ও শুনল না। দড়ির মই বেয়ে ওপরে উঠে একটা ট্র্যাপিজের ওপরে বসে পড়ল।
ততক্ষণে রাঘবন অনুদীপ চ্যাটার্জিকে নির্দেশ দিয়েছেন জাল নিয়ে আসার জন্যে। দুজন নিরাপত্তাকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে চ্যাটার্জি তাঁবুর একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। অন্যান্য নিরাপত্তাকর্মী এপাশ-ওপাশ ছুটোছুটি করছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।
সন্দীপ বর্মন ছুটে এল আমার কাছে। হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল, ‘সরকার, হেড কোয়ার্টারে খবর দিন। ওরা দু-গাড়ি ফোর্স পাঠাক—।’
একটা ব্যাপার আমাকে বেশ অবাক করেছিল। সেটা হল, অজানা এই প্রাণীটার আচরণ। এ-পর্যন্ত ওটা কারও কোনও ক্ষতি করেনি। ওটা যদি সত্যিসত্যি একটা বাঘ হত, তা হলে এর মধ্যে ক’জন যে ওটার হাতে খতম হত কে জানে! বোধহয় কৃষ্ণনকে দিয়েই শুরু হত খতমের খেলা। সুতরাং এটা বলা যায়, প্রাণীটা আর যাই হোক, বিপজ্জনক নয়।
সন্দীপ বর্মনের কথার জবাবে বললাম, ‘ফোর্সের কোনও দরকার নেই।
এখানে বিশ-বাইশ জন সিকিওরিটি গার্ডই তো আমাদের সাহায্যের জন্যে রয়েছে। তা ছাড়া, প্রাণীটাকে আমি মারতে চাই না — ওটাকে জ্যান্ত ধরতে চাই।’ ‘কিন্তু এরকম একটা ভয়ংকর প্রাণীকে আপনি—।’
বর্মনের কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি বাধা দিলাম, ‘এটাই তো সবচেয়ে বড় গোলমাল, বর্মন। যে-প্রাণী আমাদের চোখে অদৃশ্য, তাই আমাদের কাছে ভয়ংকর। যে-প্রাণী কখনও আমরা চোখে দেখিনি, তাকে সামনাসামনি হঠাৎ দেখতে পেলে আমাদের প্রথম কাজই হচ্ছে কোনও অস্ত্র দিয়ে তাকে ঘায়েল করা। অথচ সেই প্রাণীটা হয়তো নিরীহ, অসহায়।’ একটু থেমে আমি আরও বললাম, ‘আসল গোলমালটা কোথায় জানেন? মানুষই সবচেয়ে বেশি হিংস্র, বিপজ্জনক। আপনার যদি এখানে ভয় করে তা হলে রাঘবনের চেম্বারে চলে যান। সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করুন। ইচ্ছে হলে মাঝে-মাঝে ফোনে খবর নেবেন।’
এইসব কথা বলার সময় আমার উত্তেজনা বাড়ছিল। আর সেইসঙ্গে ধাতব সুর ক্রমশ প্রকট হয়ে পড়ছিল।
বর্মন অপমানিত মুখে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ‘আপনিই জিতলেন’ বলে আবার ফিরে গেল ডক্টর রাঘবনের কাছে।
অদৃশ্য প্রাণীটার নড়াচড়া বা ছুটোছুটি বোধহয় থামেনি। কারণ, শব্দ কানে আসছিল, দর্শকদের জন্যে সাজানো চেয়ার থেকে-থেকেই উলটে পড়ছিল, ছিটকে পড়ছিল। নিরাপত্তাকর্মীরাও তাদের ভয়ার্ত ব্যস্ততা বজায় রেখেছে। নিজেদের মধ্যেই চ্যাঁচামেচি করে কীসব বলছে।
এমনসময় চ্যাটার্জি ফিরে এল। সঙ্গে সেই দুজন নিরাপত্তাকর্মী ও চারটে ‘মাউস মোবাইল’ বা ‘মোমো’। চারটে মোমো বয়ে নিয়ে আসছে প্রকাণ্ড একটা নাইলনের জাল। বিশেষ ধরনের নাইলনের সুতোয় বোনা।
মোমোর আকৃতি অনেকটা বাচ্চাদের প্র্যামের মতো। কিন্তু চলে হাই পাওয়ার ব্যাটারিতে। গাড়িগুলোর রং কমলা আর কালো। সামনে হাতের মতো চারটে ধাতব রড বেরিয়ে আছে। আর পিছনে লেজের মতো একটা ক্র্যাঙ্ক চলার তালে-তালে নড়ছে। ঠিক যেন একটা নেংটি ইঁদুর। সেইজন্যেই নাম মাউস মোবাইল।
মোমোর ড্রাইভাররা বসে আছে গাড়ির পেটের ভেতর সেঁধিয়ে। তারা চারজন পাশাপাশি চালিয়ে নিয়ে আসছে গাড়ি। সামনে বেরিয়ে থাকা ষোলোটা রডের ওপরে রাখা আছে নাইলনের জালটা। রং তার সাদা, কিন্তু শঙ্খের মতো চিকচিক করছে। এরকম নাইলন আমি চিনি— খুব হালকা অথচ শক্তিশালী।
আমি চ্যাটার্জিকে বললাম, তাঁবুর একপাশ থেকে জালটা ঘিরে ধীরে-ধীরে টেনে নিয়ে আসতে। ঠিক যেমন করে পুকুরে ঘেরা জাল দিয়ে মাছ ধরে।
সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হয়ে গেল ব্যস্ততা। চারটে মোমো আর জনাদশেক নিরাপত্তাকর্মী চ্যাটার্জির নির্দেশমতো কাজ শুরু করে দিল। তবে প্রত্যেকের মুখেই আতঙ্কের ছাপ।
আমি জেনারেটর গান সিকিওরিটি চেম্বারে রেখে দিলাম। ওটা যে এখন কোনও কাজে লাগবে না তা একটু আগেই বোঝা গেছে। ওপরে তাকিয়ে দেখি কৃষ্ণন এখনও ট্র্যাপিজের ওপরে বসে। ভূত-প্রেতের অহেতুক আতঙ্কই ওর বারোটা বাজিয়েছে।
সন্দীপ বর্মন আর ডক্টর রাঘবন ব্যস্তভাবে জাল টানার তদারকি করছিলেন। যে-দেওয়াল ভেঙে আমি সার্কাসের বাইরে বেরিয়েছিলাম, সেদিকটা থেকেই শুরু হয়েছিল জাল টানার কাজ। আর আমি এরিনার এপাশে ঠিক ওদের বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছি।
মোমোর ইঞ্জিনের গোঁ-গোঁ শব্দ আর লোকজনের হইচই শব্দের তীব্রতা প্রায় ১১০ ডেসিবেলে নিয়ে গেল। কিন্তু এইসব শব্দের মধ্যে আর-একটা শব্দও শোনা যাচ্ছিল। সেটা ওই প্রাণীটার ছোটাছুটির শব্দ। এই জালের ফাঁদে প্রাণীটাকে ধরা যাবে তো!
আমাদের কপালে যে আরও দুঃখ আছে সেটা একটু পরেই বোঝা গেল। জাল টানার কাজ আধাআধি হতেই আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, প্রাণীটার ছোটাছুটির শব্দ শোনা যাচ্ছে জালের ওপিঠ থেকে। অথচ জাল যেভাবে টানা হচ্ছে তাতে জালের পাশ দিয়ে প্রাণীটার সটকে পড়ার কোনও পথ নেই। অন্তত পৃথিবীর কোনও প্রাণী হলে পারত না। তা ছাড়া, জালের ফুটোগুলোর মাপ এক বর্গইঞ্চির বেশি হবে না। তার ভিতর দিয়ে কি গলে বেরিয়ে যেতে পারে এই অদ্ভুত প্রাণী?
জাল টানার কাজ যতই শেষ হয়ে আসছে, আতঙ্কের মাত্রা তার সমানুপাতে বাড়ছে। একটা আস্ত ডোরা-কাটা বাঘ দিয়ে যার শুরু, তার শেষ যদি এইরকম হয় তা হলে ভয় পাওয়ারই কথা।
লোকজনের হইচই-চ্যাঁচামেচি চলছিল। আমি চিৎকার করে বললাম, ‘ডক্টর রাঘবন, জাল টেনে আর লাভ নেই। ওটা এভাবে ধরা পড়বে না। জাল গুটিয়ে ফেলতে বলুন—।
সুতরাং চারটে মোমো আর নিরাপত্তাকর্মীরা ক্ষিপ্রগতিতে জালটাকে আবার ভাঁজটাজ করে ষোলোটা ধাতব হাতের ওপরে সাজিয়ে দিল। ইঞ্জিনের গর্জন তুলে মোমোগুলো বেরিয়ে গেল তাঁবুর বাইরে। রওনা হল রকেট সার্কাসের অন্দরমহলের দিকে।
ওপর থেকে চিৎকার করে বলল, ‘ইন্সপেক্টর সরকার, দেখলেন, আমার কথা ঠিক হল কি না!’
আমি শুধু একবার ওর দিকে তাকালাম। কিছু বললাম না। তখন আমি ভাবছি, কীভাবে প্রাণীটাকে অন্তত একবার চোখের দেখা দেখা যায়।
ডক্টর রাঘবন আমার কাছে এলেন। হাতের কোটটা কখন যেন একটা চেয়ারে নামিয়ে রেখেছেন। এই শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত পরিবেশেও সামান্য ঘেমেছেন। কপালের টিপ ধেবড়ে গেছে। হাঁফাতে-হাঁফাতে আমাকে প্রশ্ন করলেন তিনি, ‘হোয়াট নেক্সট?’
সন্দীপ বর্মন গম্ভীর মুখে হেঁটে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল আমার সামনে। ওর চোখেমুখে তাচ্ছিল্যের ভাব। বোধহয় আমার দৌড় দেখতে চায়।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বর্মন বলল, ‘তা হলে এবার হেডকোয়ার্টারে ফোন করে ফোর্স চেয়ে পাঠাই। ওদের বলি দুটো অ্যানিহিলেটর কামান নিয়ে আসতে—।’
আমি চমকে বর্মনের দিকে তাকালাম। অ্যানিহিলেটর কামান! ওটাই আমাদের সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্র। ওটা কোনও জিনিসের দিকে তাক করে ফায়ার করলে পলকে তার তাপমাত্রা ৩০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যায়। প্রায় সব ধাতু ওই তাপমাত্রায় গলে যায়, কোনও প্রাণী তো কোন ছার! অ্যানিহিলেটর ব্যবহার করা মানে এই বোবা প্রাণীটা তৎক্ষণাৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
ততক্ষণে আর-একটা মতলব মাথায় এসে গেছে আমার। বর্মনকে বললাম, ‘একটা শেষ চেষ্টা করে দেখি। তাতে কোনও কাজ না হলে হেডকোয়ার্টারে খবর দেব, ওরা অ্যানিহিলেটর কামান নিয়ে আসবে।’ আমি চোখ ফেরালাম ডক্টর রাঘবনের দিকে, ‘আপনার কাছে রং করার স্প্রে-গান আছে?’
‘হ্যাঁ, আছে। সার্কাসের যত পেইন্টিং-এর কাজ সবই আমাদের নিজের লোকেরা করে।’
‘ক’টা স্প্রে-গান হতে পারে??
‘তা দশ-বারোটা তো হবেই।’
আমি বললাম, ‘তা হলে চটপট লোক লাগিয়ে ব্যবস্থা করুন। আমি ওই অদৃশ্য প্রাণীটার গায়ে সাদা রং স্প্রে করে ওর চেহারাটা অন্তত দেখতে চাই।’
অনুদীপ চ্যাটার্জি চোয়াল শক্ত করে পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। আমার কথা শেষ হতেই হইহই করে দলবল নিয়ে কাজে নেমে পড়ল। লোকটার উৎসাহের প্রশংসা করতে হয়।
বড়জোর মিনিট পনেরো। তারমধ্যেই দেখলাম ওরা তৈরি হয়ে নিয়েছে। মনে হল, প্রাণীটা যে নিরীহ এটা বোধহয় ওরা সকলেই আন্দাজ করেছে।
এবারে কাজে নেমে পড়ল সাতটা মোমো আর চারজন নিরাপত্তাকর্মী। ফলে মোট এগারোটা স্প্রে-গান ধোঁয়ার মতো সাদা রং ওড়াতে লাগল বাতাসে। কর্মীরা সকলেই নাকে-মুখে রুমাল বেঁধে নিয়েছে। মোমোর ড্রাইভাররাও মুখ ঢেকে নিয়েছে কাপড়ে।
শুধু তাদের কপাল আর চোখ দেখা যাচ্ছে। তাদের প্রায় কাঁধের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে একজন করে নিরাপত্তাকর্মী স্প্রে-গান চালাচ্ছে।
সাদা ধোঁয়া উড়তে লাগল তাঁবুর বাতাসে। স্প্রে-গানের শব্দ, মুখ-ঢাকা অবস্থায় জড়ানো কথার হইচই, আর সাতটা মোমোর ইঞ্জিনের গর্জন বোধহয় শব্দের তীব্রতা ১২০ ডেসিবেলে নিয়ে গেল। আমি দরকারি বোতাম টিপে আমার শ্রবণ ক্ষমতা কিছুটা কমিয়ে নিলাম। নইলে কানে বড় লাগছিল।
ডক্টর রাঘবন রুমালে মুখ ঢেকে আমার কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, ‘ইন্সপেক্টর সরকার, প্রাণীটাকে দেখার পর আমরা কী করব?
আমি বললাম, ‘জানি না। তবে যদি সম্ভব হয়, ওটার কয়েকটা খেলা আপনার সার্কাসের শো-তে কাল থেকে জুড়ে দেবেন।’
ডক্টর রাঘবন হাসলেন না। অনেকটা আপনমনেই বললেন, ‘জুওলজি নিয়ে ডক্টরেট করেছি—এরকম কোনও প্রাণী যে পৃথিবীর কোথাও জন্ম নিতে পারে তা কখনও কল্পনাও করিনি। আমার বাবা এই রকেট সার্কাসের পত্তন করেছিলেন। তাঁর ভয়ডর বলতে কিছু ছিল না। আমারও ওই ব্যাপারটা বেশ কম—।’
আমি আঙুল তুলে ওপরে কৃষ্ণনের দিকে দেখালাম।
ডক্টর রাঘবন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, বললেন, ‘ও রিং-মাস্টার হিসেবে খারাপ নয়। আগে আর-একটা কোম্পানিতে ট্র্যাপিজের খেলা দেখাত। সেখানে বাঘ-সিংহ নিয়ে তালিম নিত। ওই কোম্পানিতে রিং-মাস্টার হঠাৎই হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়—শো চলার সময়। তখন কৃষ্ণন সেই শো চালিয়ে দেয়। সেই থেকেই সার্কাসের সার্কিটে ওর নাম খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে। আমার কাছে ও আছে চার বছর। কিন্তু কখনও এরকম ভয় পেতে দেখিনি
এমনসময় বাড়তি একটা জোরালো শব্দ হল। চমকে তাকিয়ে দেখি কিছু একটার সঙ্গে ধাক্কা লেগে একটা মোমো উলটে পড়ে গেছে। সাদা ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে অস্পষ্টভাবে ওটাকে দেখা গেলেও ওটার ইঞ্জিনের গোঁ-গোঁ শব্দ, চাকার ভনভন, স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। মোমোর দুজন মানুষই ছিটকে পড়েছে গাড়ি থেকে। ওরা ওঠার চেষ্টা করছে। আর ওদের সাহায্যের জন্যে ছুটে এসেছে চার-পাঁচজন নিরাপত্তাকর্মী।
রকেট সার্কাসের তাঁবু এখন বিচিত্র চেহারা নিয়েছে। রঙিন যা কিছু ছিল ফাইবারের খুঁটি, চেয়ার, নাইলনের দড়ি, ইলেকট্রনিক রোলিং ডিসপ্লে—সবই সাদা রঙের পোশাক পরে নিয়েছে। দশটা স্প্রে-গান চলছে তো চলছেই। স্প্রে-গানের ক্যানের রং ফুরিয়ে গেলে দুজন কর্মী তিনটে রঙের ড্রাম থেকে তড়িঘড়ি রং ভরতি করে দিচ্ছে ক্যানে। প্লাস্টিকের মেঝে, এরিনা, দেওয়াল, সব রঙে মাখামাখি।
নিরাপত্তাকর্মীদের আলাদা করে চিনে নেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অনুদীপ চ্যাটার্জিকে আমি খুঁজে পেলাম না। শুধু সন্দীপ বর্মনকে চট করে চিনতে পারলাম ওর হাতে ধরা জেনারেটর গানের জন্যে।
ডক্টর রাঘবনও রঙের হাত থেকে রেহাই পাননি। আর আমার অবস্থাও প্রায় একইরকম।
হঠাৎই এক তীব্র চিৎকার শোনা গেল। চিৎকারটা করেছে একইসঙ্গে অন্তত তিনজন। ডক্টর রাঘবন আমার হাত খামচে ধরলেন উত্তেজনায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই হাত সরিয়ে নিলেন। অবাক চোখে দেখলেন আমার হাতের দিকে।
আমি সবসময় ফুলহাতা শার্ট পরি। তাই বাইরে থেকে ধাতুর কারিকুরি কিছু বোঝা যায় না। সুতরাং রাঘবনও কিছু বুঝতে পারলেন না। শুধু কোনওরকমে চাপা গলায় বললেন, ‘ওরা বোধহয় প্রাণীটাকে দেখতে পেয়েছে!’
রাঘবনের কথাই যে ঠিক সেটা বুঝতে পারলাম লোকজনের পরিত্রাহি ছুটোছুটি দেখে। তবে বাকিরা খানিকটা দূরত্ব থেকে কিছু একটা দেখতে চেষ্টা করছে।
অকুস্থলটা এরিনার ডানদিকে, ঠিক পাশ ঘেঁষে।
আমি এগিয়ে চললাম সেদিকে। টের পেলাম, ডক্টর রাঘবন আমার পিছনেই রয়েছেন।
সাদা ধোঁয়ার মেঘ সরিয়ে খানিকটা এগোতেই প্রাণীটা নজরে পড়ল আমার। কী বিচিত্র তার চেহারা! তবে চেহারার নির্দিষ্ট কোনও বর্ণনা দেওয়া মুশকিল। কারণ, প্রতি মুহূর্তেই তা পালটাচ্ছে।
লম্বায় প্রায় কুমিরের মতো। লেজের অংশটার তিনটে মুখ রয়েছে। সারা গায়ে আর্মাডিলোর মতো বড়-বড় আঁশ। মাথাটা থ্যাবড়া মতো। গলার কাছে আটদশটা ভাঁজ। পা কিংবা হাতের সংখ্যা ছয়। তাতে দুটো করে আঙুল মাঝে-মাঝেই আঙুলের সংখ্যা বেড়ে চারটে হয়ে যাচ্ছে। প্রাণীটার নাক বেশ বড়, তাতে বিশাল দুটো ফুটো। নাকটা ডাইনে-বাঁয়ে নড়ছে। নাকের দু-পাশে দুটো চোখ। এক-একটা চোখ যেন চার ইঞ্চি ব্যাসের মার্বেল। তার ওপরে সাদা রঙের আস্তরণ থাকা সত্ত্বেও নড়াচড়া করছে। হয়তো সবকিছু দেখতেও পাচ্ছে। মুখটা বন্ধ করে রাখলেও কী করে যেন একটা কালো জিভ বারবার বাইরে বেরিয়ে আসছে।
প্রাণীটা মাঝে-মাঝে নিজের শরীরটাকে ভাঁজ করে নিচ্ছিল। ওটার নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছিল ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অথবা রঙের রাসায়নিক ওকে অবশ করে দিয়েছে।
সব ক’টা স্প্রে-গান থেমে গেছে। মোমোগুলোও দাঁড়িয়ে পড়েছে ছড়িয়েছিটিয়ে। একটু আগের হইচই শব্দ হঠাৎই কমে গিয়ে নেমে এসেছে স্তব্ধতা। শুধু শোনা যাচ্ছে চাপা আলোচনা, গুঞ্জন।
বর্মন আমার কাছে এগিয়ে এল। বলল, ‘সরকার, নিন, কাজ গুছিয়ে এবার চলুন।’
আমি তখন ভাবছিলাম, এটা ভিনগ্রহের প্রাণী নয়তো?
‘কনট্যাক্ট’ নামে একটি সংস্থা প্রায় দশ-বারো বছর ধরে ভিনগ্রহী প্রাণী নিয়ে গবেষণা করছে। কলকাতায় গত বছরেই ওদের একটা সম্মেলন হয়ে গেছে। সেখানে ওরা কম্পিউটার গ্রাফিক্সে তৈরি করা অন্তত পঞ্চাশরকমের ভিনগ্রহী প্রাণীর ছবি দেখিয়েছিল। আমাদের ডিপার্টমেন্টকে ওরা সেই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এ সি বিকাশ মিত্র ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে আমাকে পাঠিয়েছিলেন। ভিনগ্রহীদের সেই গ্রাফিক্স ছবিগুলো আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। এখন, এই প্রাণীটাকে দেখে, সেই ছবিগুলো আমার মনে পড়ে গেল। ছবিগুলোয় দেখা কয়েকটা বৈশিষ্ট্য এটার মধ্যে যেন দেখতে পাচ্ছি।
‘কনট্যাক্ট’ সংস্থাকে পৃথিবীর সব দেশই বেশ গুরুত্ব দেয়। কারণ, তার সদস্যদের মধ্যে রয়েছে দুদে কল্পবিজ্ঞান লেখক, মনোবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ভাষাতত্ত্ববিদ, প্রযুক্তিবিদ, পরিবেশবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, প্রাণীবিজ্ঞানী, পুরাপ্রাণীবিদ ও নৃতত্ত্ববিদ। ওদের দীর্ঘদিনের গবেষণার ফসল ওরা সম্মেলনে প্রকাশ করে। সুতরাং মনে-মনে খুঁজে পাওয়া মিলগুলো বেশ কয়েকবার খতিয়ে দেখে আমি জোরের সঙ্গে বললাম, ‘ডক্টর রাঘবন, এই প্রাণীটা হয়তো অন্য কোনও গ্রহ থেকে কোনওভাবে আমাদের এখানে এসে পড়েছে। আমাদের এখুনি ‘কনট্যাক্ট’-এ খবর দেওয়া দরকার।’
‘কনট্যাক্ট?’ অনুদীপ চ্যাটার্জি একটুকরো কাপড় দিয়ে মুখের রক্ত মুছছিল। অবাক হয়ে কথাটা বলল।
আমি জবাবে কিছু একটা বলতে যাব, ঠিক তখনই একটা তীক্ষ্ণ ভ্রমরগুঞ্জন শোনা গেল। মিহি শব্দটা এত তীক্ষ্ণ যে সকলেই চমকে উঠে এপাশ-ওপাশ তাকাতে লাগল। প্রাণীটার মধ্যেও যেন হঠাৎই একটু চাঞ্চল্য লক্ষ করলাম। আর তখনই ভেসে বেড়ানো আলোর বিন্দুটা আমাদের নজরে পড়ল।
এরিনার ঠিক মাঝখানে উড়ন্ত জোনাকিপোকার মতো একটা উজ্জ্বল আলোর বিন্দু পাক খাচ্ছে দুরন্ত গতিতে, ওঠা-নামা করছে নির্দিষ্ট ছন্দে। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শোনা যাচ্ছে ভ্রমরগুঞ্জনের শব্দ।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই, আমাদের অবাক চোখের সামনে, আলোর বিন্দুর ঘিরে-রাখা জায়গায় একটা অবয়ব দেখা দিল। প্রথমে ঝাপসা, তারপর ক্রমেক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠল সেই অদ্ভুত চেহারা। গলানো রুপোর মতো নমনীয় হয়ে নড়তে লাগল বেহিসেবিভাবে। যেন ঠিক করতে পারছে না, শেষপর্যন্ত কোন আকৃতি নেবে।
একটু পরেই মানুষের চেহারা নিয়ে স্থির হল সেই অবয়ব। তার সারা শরীর রুপোর পাতের মতো ঝকঝক করছে। ধারালো নাক-মুখ-চোখ। স্পষ্ট হাত-পায়ের পেশি।
অদ্ভুত মানুষটা সম্পূর্ণ রূপ নিতেই আলোর বিন্দুটা অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপরই পরিষ্কার গলায় কেউ যেন বলে উঠল, ‘আপনাদের ধন্যবাদ জানাই, নিভিয়ালটাকে এতক্ষণ এখানে আটকে রাখার জন্যে। আমার আসতে আর-একটু দেরি হলেই ওটা হয়তো এখান থেকেও পালাত৷’
আমরা সকলেই হতবাক। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছি রুপোলি মানুষটার দিকে। সে তার চকচকে চোখ মেলে অনেকক্ষণ ধরে আমাদের দেখল। তারপর আবার বলল, ‘আমাকে দেখে অবাক হবেন না। ভয়ও পাবেন না। আমি আসছি বহুদূরের এক নক্ষত্রের একটি গ্রহ থেকে। এই নক্ষত্রটিকে আপনারা জিটা অরিওনিস নাম দিয়েছেন। আমরা খুব সহজে মনের কথা পড়ে ফেলতে পারি, মস্তিষ্কের সঙ্গে মস্তিষ্কের যোগাযোগে ভাবের আদান-প্রদান করতে পারি। আর অন্য কোনও প্রাণীর স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা নিজেদের স্মৃতিকোষে সঞ্চয় করে নিতে পারি যখন-তখন। তাই আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।’
রুপোলি মানুষের চেহারা-নেওয়া ভিনগ্রহী প্রাণীটি নেমে এল এরিনা থেকে। তার শরীর থেকে কেমন এক অদ্ভুত আলোর আভা বেরোচ্ছে। ডক্টর রাঘবনের কাছে এসে সে বলল, ‘ডক্টর, আপনার মতো আমিও একটা সার্কাসের মালিক। নানা গ্রহে ঘুরে-ঘুরে আমি সার্কাসের শো করি। আমার দলে হরেকরকম বিচিত্র জীবজন্তু রয়েছে। মাঝে-মাঝে এইসব প্রাণী সংগ্রহের জন্যে আমি অন্যান্য গ্রহে চলে যাই। সেখানকার পাহাড়ে, সমুদ্রে, জঙ্গলে, ঘুরে বেড়াই—
আমি কিছুটা ধাতস্থ হয়ে জিগ্যেস করলাম, ‘এই নিভিয়ালটাকে কোথায় পেয়েছেন?’
‘আপনাদের সৌরজগতের ছ-নম্বর গ্রহটির পঞ্চম উপগ্রহে—।’
‘শনির উপগ্রহ—রিয়া?’
‘হ্যাঁ, আপনারা ওই নামই দিয়েছেন ওটাকে। আপনারা ওটা আবিষ্কার করেছেন প্রায় ৩২০ বছর আগে। আর আমরা ওটার সন্ধান জেনেছি প্রায় ১০০০ বছর আগে। রিয়ার ব্যাস প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার। বরফে ঢাকা। তাতে জমাটবাঁধা কার্বন ডাই অক্সাইড আর মিথেনই বেশি। কিছুদিন আগে সেখানে আমরা একটা অভিযান চালিয়েছিলাম। তখন একটা অদ্ভুত ধরনের সিন্দুক দেখতে পাই। সিন্দুকে একটা সতর্কবাণী লেখা ছিল—
‘কী লেখা ছিল?’ ডক্টর রাঘবন প্রশ্ন করলেন।
সঙ্গে-সঙ্গে নিভিয়ালটার কাছ থেকে উত্তেজিত কথাবার্তা শোনা গেল। নিরাপত্তাকর্মীরা ‘নড়ছে, নড়ছে!’ বলে চিৎকার করে উঠল।
রুপোলি মানুষটি ‘কোনও ভয় নেই’ বলে এগিয়ে গেল প্রাণীটার কাছে। ডান হাতটা শূন্যে তুলে ধরল অদ্ভুত ভঙ্গিতে। পরের মুহূর্তেই একটা সবুজ আলোর সুতো বেরিয়ে আসতে লাগল মানুষটির তর্জনীর ডগা থেকে। বিদ্যুতের রেখার মতো এঁকেবেঁকে সেই সবুজ প্রতিপ্রভ সুতো জালের মতো জড়িয়ে যেতে লাগল নিভিয়ালটার গায়ে।
প্রাণীটাকে এখন লক্ষ করে বেশ অবাক হলাম। ওটা শুধু যেন নড়ছে তাই নয়, ওটার গায়ের সাদা রং অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। আর শরীরের কোনওকোনও অংশের রং হালকা নীল প্লাস্টিকের মেঝের সঙ্গে প্রায় মিশে গেছে। ফলে হঠাৎ করে প্রাণীটাকে জায়গায় জায়গায় খাপছাড়াভাবে অদৃশ্য মনে হচ্ছে। তা ছাড়া, প্রাণীটার শরীরের আকৃতিও এখন বেশ পালটে গেছে। লেজটা অনেক খাটো হয়ে গেছে। মাথাটা হয়ে গেছে সরু, লম্বা। হাত বা পায়ের সংখ্যা ছয়ের বদলে এখন চার।
প্রাণীটা নড়াচড়া করছিল, তবে মুখ দিয়ে কোনও শব্দ করছিল না। এখনও পর্যন্ত ওর কোনও গর্জন শোনা যায়নি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাণীটা সবুজ আলোর সুতোয় আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দি হয়ে গেল। কাজ শেষ করে রুপোলি ভিনগ্রহী ফিরে তাকাল আমাদের দিকে। ঠোঁট প্রসারিত করে হাসতে চেষ্টা করল।
‘কী লেখা ছিল ওই সিন্দুকের গায়ে?’ ডক্টর রাঘবন অধৈর্য হয়ে জিগ্যেস করলেন আবার।
হাত তুলে ডক্টর রাঘবনকে আশ্বস্ত করল সে। বলল, ‘বলছি। এবারে একটু নিশ্চিন্তে কথা বলা যাবে। নিভিয়ালটাকে আমি হাই পাওয়ার লেসার লক দিয়ে বন্দি করেছি, এখন ঘণ্টাখানেকের জন্যে নিশ্চিন্ত।’
আগন্তুকের বাঁ-কাঁধের কাছটা কেমন যেন গলে গিয়ে বিকৃত হয়ে যাচ্ছিল। সেটা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে সে বাঁ-হাতটা শূন্যে তুলে বিচিত্র ভঙ্গিতে নাড়াল। সঙ্গে-সঙ্গে গলিত রুপো যেন সুষম স্রোতে প্রবাহিত হয়ে কাঁধের আকার আবার মেরামত করে দিল।
‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম।’ আগের কথার খেই ধরে বলতে শুরু করল সে, ‘ওই সিন্দুকের গায়ে সাংকেতিক ভাষায় লেখা ছিল, একটা আশ্চর্য প্রাণী বন্দি রয়েছে এই সিন্দুকের মধ্যে। নাম নিভিয়াল। একে ক্ষতিকর মনে হওয়ায় কোনও এক অজানা গ্রহ সিরা-টু-র বাসিন্দারা এই প্রাণীটাকে বন্দি করে চিরকালের জন্যে নির্বাসন দিয়েছে। ওরা প্রাণীহত্যা করে না। তাই এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেউ যেন এই সিন্দুকের কম্বিনেশন লক না খোলে।’
‘আপনারা সেই লক খুললেন?’ প্রশ্নটা করল সন্দীপ বর্মন। কখন যেন সে আমাদের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। ওর হাতে-মুখে স্প্রে-গানের সাদা রং লেগে রয়েছে
আগন্তুক জবাব দিল সঙ্গে-সঙ্গেই, ‘হ্যাঁ, খুললাম। আমাদের দলে একজন তালা খোলার ওস্তাদ ছিল। সে-ই খুলে দিল লকটা। তখন প্রাণীটাকে বের করে আমরা মহাকাশযানে তুলে নিয়ে রওনা হলাম। আমাদের দলের সবাই তো খুব খুশি। এই প্রাণীটাকে নিয়ে বেশ কয়েকটা নতুন খেলা চালু করা যাবে আমাদের সার্কাসে।
‘প্রাণীটার কতকগুলো অদ্ভুত ব্যাপার আমরা লক্ষ করলাম। ওটা ইচ্ছেমতো নিজের গায়ের রং খুব তাড়াতাড়ি পালটে ফেলতে পারে। আর ওটার আশ্চর্য ক্ষমতা হচ্ছে, পরিবেশ বা পটভূমির সঙ্গে গায়ের রং হুবহু মিলিয়ে দিতে পারে। ফলে তখন প্রাণীটাকে অদৃশ্য মনে হয়। ধরুন, কোনও দেওয়ালের সামনে ওটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর দেওয়ালটায় এলোমেলোভাবে পাঁচরকম রং লাগানো রয়েছে। ওই অবস্থায় ইচ্ছে হলেই এই নিভিয়ালটা দেওয়ালের রঙের নকশা হুবহু কপি করে ফেলতে পারে নিজের গায়ে। তখন ওকে আপনি দেখতেই পাবেন না। অদৃশ্য হয়ে গেছে বলে মনে হবে।’
উন্নত ধরনের বহুরূপী? রুপোলি আগন্তুকের কথা শুনে অন্তত তাই মনে হল। কিন্তু সিরা-টু-র বাসিন্দারা এই নিভিয়ালটাকে ক্ষতিকর মনে করেছিল কেন? সে-কথা জিগ্যেস করতেই আগন্তুক বলল, ‘সেটা ঠিক জানি না, তবে আন্দাজ করতে পারি। নিভিয়ালটা আপনাদের এখানে এসে কোনও শব্দ করেনি, তাই না??
আমরা মাথা নেড়ে জানালাম, তাই।
‘আসলে ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। ওটা প্রায় সবসময় চিৎকার করে, কিন্তু তার সবটাই খুব হাই ফ্রিকোয়েন্সিতে—সুপারসনিক লেভেলে। এই কম্পাঙ্কের শব্দ সিরা-টু-র বাসিন্দারা বোধহয় সহ্য করতে পারেনি। এতে হয়তো ওদের শরীরের ক্ষতি হত। সে যাই হোক, নিভিয়ালটাকে আমাদের খাঁচায় বন্দি করে ইলেকট্রনিক কম্বিনেশন লক এঁটে দিয়েছিলাম। তার বাইরে থেকে প্রাণীটাকে আমরা কয়েকজন খুঁটিয়ে লক্ষ করছিলাম। তাতে দেখলাম, ওটা খুশিমতো নিজের চেহারা পালটাচ্ছে। আবার কোনও জিনিসকে পছন্দ হলে তাকে হুবহু কপিও করে ফেলছেľ
আমি ডক্টর রাঘবনের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এবারে বুঝলেন তো আপনার টাইগার মিস্ট্রি! আর অর্ধেক বাঘের ব্যাপারটাও বোঝা যাচ্ছে। কৃষ্ণনকে এবার ওপর থেকে নেমে আসতে বলুন।’
ডক্টর রাঘবন হেসে এরিনার মাঝে এগিয়ে গেলেন। ওপরে তাকিয়ে হাত নেড়ে কৃষ্ণনকে নেমে আসতে বললেন। বেশ কিছুক্ষণ বিতর্কের পর কৃষ্ণন দড়ির মই বেয়ে নামতে শুরু করল।
রুপোলি আগন্তুক তখনও কথা বলছিল, ‘নিভিয়ালটাকে পেয়ে আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম। ওটার অদৃশ্য হওয়া, সুপারসনিক চিৎকার, যখন-তখন চেহারা পালটানো, সবকিছুই আমাদের সার্কাসের পক্ষে ভালো। কিন্তু শুধু একটা ব্যাপারেই সমস্যা দেখা দিল—
আগন্তুকের চকচকে রুপোলি কপালে ভাঁজ পড়ল। চিন্তার সুরে সে বলল, ‘কিছুতেই আমরা নিভিয়ালটাকে বন্দি করে রাখতে পারছি না। আর পারছি না বলেই হাইপারস্পেস দিয়ে আমাদের গ্রহে ফিরে যাওয়ার সময় কীভাবে যেন ওটা লক খুলে পালিয়ে গেছে। তারপর হঠাৎ করে আপনাদের সার্কাসে এসে হাজির হয়েছে। এখানে ওটার এসে পড়াটা নেহাতই একটা অ্যাকসিডেন্ট। স্পেস কার্ভেচার আর স্পেস হোলের ব্যাপার—যেমন করে হোক এসে পড়েছে। তারপর ওর কো-অরডিনেট হিসেব করে এখানে এসে পৌঁছোতে আমারও বেশ সময় লেগে গেল। এখন ওকে নিয়ে একটা স্পেস হোল দিয়ে আমি বেরিয়ে যাব, ফিরে যাব আমাদের স্পেসক্র্যাফটে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই নিভিয়ালটাকে হয়তো ছেড়েই দিতে হবে।’
‘কেন, ছেড়ে দেবেন কেন?’ আমি জিগ্যেস করলাম।
‘কিছুতেই ওটাকে কম্বিনেশান লক দিয়ে আটকে রাখতে পারছি না। ওই সিন্দুকের কম্বিনেশান লকের গায়ে “প্রাইম লক” কথাটা লেখা ছিল। তার একটাই অর্থ হতে পারে। ওই কম্বিনেশানের নম্বরটা একটা মৌলিক সংখ্যা—প্রাইম নাম্বার।’ বর্মন আমার কাছে সরে এসে চাপা গলায় জিগ্যেস করল, ‘সরকার, প্রাইম নাম্বার ব্যাপারটা কী বলুন তো?’
আমি নীচু স্বরে জবাব দিলাম, ‘একটা পূর্ণসংখ্যা, যাকে ১ আর সেই সংখ্যাটা দিয়ে ভাগ করলে মিলে যায়—এ ছাড়া অন্য কোনও পূর্ণসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে মেলে না। যেমন ১৩, ৫৯, ১৪৯, ৩৩৩১। কেন, এগুলো পড়েননি? ইস্কুলে ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ানো হয়।’
বর্মন হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, ‘ওই একটা ব্যাপারেই আমি একটু বেশি উইক।’
আগন্তুক বলছিল তখনও, ‘তারপর থেকে আমরা এমন একটা প্রাইম নাম্বার বের করার চেষ্টা করছি যেটা অন্তত দশ অঙ্কের হবে। কারণ সিন্দুকের প্রাইম লকে দশটা কম্বিনেশন ডিজিট ছিল। আমরা আন্দাজে একটা দশ অঙ্কের সংখ্যা দিয়ে কম্বিনেশন লক সেট করেছিলাম, কিন্তু সেটা এই নিভিয়ালটা উৎপাদকে ভেঙে ফেলেছে। অর্থাৎ, সংখ্যাটা মৌলিক সংখ্যা ছিল না। ফলে উৎপাদকে ভেঙে ফেলামাত্রই লকটা খুলে ফেলেছে প্রাণীটা।’
‘কী সংখ্যা দিয়েছিলেন?’ ডক্টর রাঘবন এর মধ্যে কৃষ্ণনকে সঙ্গে নিয়ে আবার আমাদের কাছে ফিরে এসেছিলেন। উনিই কৌতূহলে প্রশ্নটা করলেন। আগন্তুক বলল, ‘42949৬৭২৯৭।
আমি একটু ভেবে নিয়ে বললাম, ‘এর উৎপাদক হল ৬৪১ আর ৬৭০০৪১৭। এই দুটো সংখ্যার গুণফল ওই দশ অঙ্কের সংখ্যাটা। তবে এই উৎপাদক দুটো কিন্তু মৌলিক সংখ্যা।’
আড়চোখে দেখি বর্মন অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রুপোলি মানুষটা আমার দিকে এক-পা এগিয়ে এল। অনুনয়ের সুরে বলল, ‘একটা দশ অঙ্কের মৌলিক সংখ্যা বলে দিয়ে আমাকে বাঁচান। এই নিভিয়ালটাকে আমি কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাই না।’
লক্ষ করলাম, সকলেই আমার দিকে প্রত্যাশা-ভরা চোখে তাকিয়ে আছে। আমি একটা দশ অঙ্কের সংখ্যা ভেবে নিয়ে ওটাকে “প্রাইম টেস্ট” প্রোগ্রামে ঢুকিয়ে দিলাম। সঠিক উত্তর বেরোতে অন্তত দশ মিনিট লাগবে। আমি আগন্তুককে বললাম, ‘দশ মিনিট অপেক্ষা করুন।’
এগারো মিনিট পর পরীক্ষা শেষ হল। তখন আমি মৌলিক সংখ্যাটা জানালাম : ‘৫76321১৮৯৭৷’
আগন্তুক সংখ্যাটা একবার শুনে নিয়েই বলল, “থ্যাঙ্ক য়ু, আর ভয় নেই। আমি তা হলে এবার নিভিয়ালটাকে নিয়ে ফিরে যাই?’
আমরা সবাই পিছিয়ে দাঁড়ালাম। আগন্তুক নিভিয়ালটার কাছে গেল। ডান হাতটা শূন্যে তুলে নতুন ধরনের একটা ভঙ্গি করল। সঙ্গে-সঙ্গে তাকে আর প্রাণীটাকে ঘিরে একটা লাল আলোর রেখা দ্রুতবেগে ঘুরতে লাগল। সেকেন্ড দুয়েকের মধ্যেই ওদের ঘিরে একটা প্রতিপ্রভ আলোর জালে তৈরি ঘনক দেখা গেল। নিভিয়ালটার চেহারা তখনও একটু-আধটু পালটাচ্ছে।
রুপোলি আগন্তুক আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে হাসল। বলল, ‘সুযোগ হলে আমাদের সার্কাস আপনাদের একদিন দেখাব—।’
কৃষ্ণন বিড়বিড় করে বলল, ‘তার আর দরকার নেই। এর মধ্যেই ঢের সার্কাস দেখা হয়ে গেছে আমাদের।’
হঠাৎ লাল ঘনক সমেত ওরা অদৃশ্য হয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। শুধু আমরা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
একটু পরেই সংবিৎ ফিরে পেয়ে ডক্টর রাঘবন সবাইকে সবকিছু গুছিয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। আবার শুরু হল কর্মব্যস্ততা।
রাঘবন আমাদের ডেকে নিয়ে চললেন ওঁর অফিসঘরে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় পাঁচটা।
রাঘবনের সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে আমি আর সন্দীপ বর্মন বেরিয়ে এলাম রকেট সার্কাসের বাইরে।
বর্মন বলল, ‘সরকার, এই ব্যাপারটার রিপোর্ট আপনি নিজে লিখবেন, ও আমার দ্বারা হবে না।’
ঢালু জায়গাটা বেয়ে নামতে-নামতে আমি বললাম, “ঠিক আছে—।’ ‘এখন তাড়াতাড়ি চলুন, ঘুমে আমার চোখ ঢুলে আসছে।’
‘আমারও—’ কথাটা বলেই আমি অবাক হলাম। আমার ঘুম পাচ্ছে! অথচ স্লিপ সার্কিট আমি ‘অন’ করিনি। ব্যাপারটা ডক্টর অভিজিৎ মজুমদারকে জানাতে হবে। আমার স্বাভাবিকভাবে ঘুম পাচ্ছে!
গাড়ির কাছে এসে আমি পকেট থেকে রিমোট ইউনিট বের করলাম। বোতাম টিপতেই গাড়ির দরজা খুলে গেল। চোখ পড়ল আকাশের দিকে। চারদিক ফরসা হয়ে আসছে।
শর্বরীর কথা মনে পড়ল। বুকপকেটে হাত রাখতেই ভিজিটিং কার্ডটা টের পেলাম। শর্বরীদের বাড়িতে একদিন যাব। ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার দুঃখকষ্টের অন্ধকার রাতগুলো একদিন যেন শেষ হয়ে যায়।