চোর ধরল ঝামেলা
কোনও রোবটের পুজোর জামা কেনা যে কীরকম ঝকমারি সেটা এবার | হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল ছোটকা। তার ওপর যদি সেই রোবট বাচ্চা খোকা হয়, আর তার নাম হয় ঝামেলা, তা হলে তো কথাই নেই।
যমজ দুই ভাইপো, চন্দ্রকান্ত আর ইন্দ্রকান্তকে পুজোর জামা-প্যান্ট কিনে দেবে বলে ছোটকা ওদের নিয়ে রওনা হচ্ছিল। কিন্তু কোথা থেকে হেলে দুলে হাঁটতে-হাঁটতে সামনে এসে হাজির হল তিনফুট মাপের বাচ্চা রোবট ঝামেলা। রিনরিনে মেয়েলি গলায় বলল, ‘টুইন দুই ব্রাদারের সহিত আমিও পূজার জামা কিনিতে যাব…কিনিতে যাব…কিনিতে যাব…।’
ঝামেলার ‘কিনিতে যাব…’ ব্যাপারটা আর থামছিল না বলে ছোটকা ওর ন্যাড়া ধাতব মাথায় মারল এক চাঁটি। তারপর বলল, ‘ওর ভেতরের সার্কিটে বোধহয় কোনও গণ্ডগোল হয়েছে। পরে দেখে দেব, বুঝলি, ঝালা-পালা–।’
শেষ কথাগুলো ছোটকা বলেছে চন্দ্ৰকান্ত আর ইন্দ্রকান্তকে লক্ষ্য করে। ছোটবেলায় এই যমজ জুটি কান্নাকাটি, চিৎকার, চেঁচামেচি করে বাড়িসুদ্ধ সবার কান ঝালাপালা করে দিত। তাই ছোটকা ওদের নাম রেখেছিল ঝালা-পালা। তবে এ-নামে আর কেউ ওদের ডাকলে দু-ভাই ভীষণ খেপে যায়।
ঝামেলার ঝকঝকে মাথাটা পাঁচ নম্বর ফুটবলের মতো প্রকাণ্ড। হাত-পাগুলো কাঠির মতো সরু লিকলিকে। তবে আঙুলগুলো খুব নিখুঁতভাবে তৈরি। সবসময় ও জামা-প্যান্ট পরে থাকে। ছুটতে পারে না, হেলে দুলে হাঁটতে পারে। ইচ্ছেমতো কথা বলতে পারে, কিন্তু গলার স্বরটা মিহি মেয়েলি। সব মিলিয়ে ঠিক যেন একটা কথা-বলা পুতুল।
পঞ্চাশ কেজি ওজনের এই ‘বাচ্চা’ রোবটটা ছোটকাই তৈরি করে দু-ভাইকে উপহার দিয়েছে।
ছোটকার চাঁটি খেয়ে ঝামেলা চুপ করে গিয়েছিল—তবে সে মাত্র মিনিট দুয়েকের জন্য।
ঝালা-পালা যখন পুজোর জামা কিনতে যাওয়ার আনন্দে হইহুল্লোড় শুরু করে দিয়েছে তখন ঝামেলা গম্ভীরভাবে বলে উঠেছে, ‘এত লম্ফঝম্পপূর্ণ উল্লাসের কী হইয়াছে? সেই কোন আদিম যুগে পড়ে আছ। বিবর্তন হয়ে আমার জায়গায় পৌঁছোলে বুঝতে সভ্যতার আর এক নাম সংযম। আমাকেই অবলোকন করো না। আনন্দ কি আমারও হইতেছে না? কিন্তু আমি কি শাখামৃগের ন্যায় জাম্প দিচ্ছি?
ঝামেলার এই একটাই গোলমাল। এখনও শুদ্ধ বাংলা বলতে শেখেনি। সাধুচলিত আর ইংরেজির জগাখিচুড়ি তৈরি করে যা প্রাণ চায় বলে বেড়ায়। যদিও অবশ্য ওর ‘প্রাণ’ বলতে ঘাড়ের কাছে লুকিয়ে রাখা ব্যাটারি।
ছোটকা বলে, ঝালা-পালার কাছে ঝামেলার এখন ট্রেনিং পিরিয়ড চলছে। চন্দ্রকান্ত ঝামেলাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ঝামেলা, স্টপ!’ ওর নির্দেশে ঝামেলা নীরব স্ট্যাচু হয়ে গেল।
ছোটকা হেসে বলল, ‘ঝামেলা তোদের পোষা রোবট, না গার্জেন!
ঝালা-পালা কোনও কথা না বলে ছুটল মায়ের কাছে। মাকে খুশির খবরটা বলে ঝটপট তৈরি হয়ে নিতে হবে।
ছোটকা সেই ফাঁকে ঝামেলার নানান পার্টস চেক করে নিতে লাগল। ঝালা-পালা তৈরি হয়ে আসতেই ওরা চারজন রওনা হয়ে পড়ল। ইন্দ্ৰকান্ত বলল, ‘ঝামেলা, স্টার্ট—।’
সঙ্গে-সঙ্গে ঝামেলার কপালে লাগানো লাল-নীল-হলদে-সবুজ রঙের ছোট ছোট বাতিগুলো জ্বলে উঠল। তারপর দপদপ করে জ্বলতে আর নিভতে লাগল। ঝামেলা খুশি হলে বা উত্তেজিত হলে এই বাতিগুলো এইরকম জ্বলে-নেভে।
ঝামেলা চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘তাই-তাই-তাই, পুজোর জামা চাই।’ ছোটকা একটা ট্যাক্সি ডাকতেই সবাই তাতে উঠে পড়ল। ট্যাক্সি ছুটে চলল ধর্মতলার দিকে।
রাস্তায় অনেক লোকজন, যানবাহন। চারপাশে ছড়িয়ে আছে শরতের রোদ্দুর। মাথার ওপরে ঝকঝকে নীল আকাশ।
এপাশ-ওপাশ মাথা ঘুরিয়ে সবকিছু দেখতে-দেখতে ঝামেলা মন্তব্য করল, ‘বাতাসে কেমন একটা পূজা-পূজা স্মেল। তোমরা টের পাইতেছ?’
ছোটকা হেসে বলল, ‘হ্যাঁ পাইতেছি। কিন্তু তুমি দয়া করে একটু চুপ করবে? নইলে তোমার পুজোর জামা কিনে দেব না—।’
ব্যস, সঙ্গে-সঙ্গে ঝামেলা চুপ।
কিন্তু ঝামেলাকে নিয়ে ঝামেলা শুরু হল রেডিমেড জামাকাপড়ের বিশাল মাপের দোকানটায় ঢুকতেই।
না, ঝামেলা রোবট বলে নয়। কারণ আজকাল অনেকেই নানা মাপের নানা ঢঙের রোবট সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় বেরোয়। বহু কোম্পানি রোবট তৈরি করে, টিভিতে তারা ইনস্টলমেন্টে রোবট বিক্রির বিজ্ঞাপনও দেয়।
দোকানে ঢুকে জামাকাপড় পছন্দ করার সময় ঝামেলা হঠাৎ ছোটকার কাছে এসে চাপা গলায় বলল, ‘আমি একজন তস্করকে দেখিতে পেয়েছি।’
ছোটকা এবং ঝালা-পালা তিনজনেই অবাক হয়ে ঝামেলার দিকে তাকাল। কারণ, ঝামেলার দেখা ও শোনার ব্যাপারটা যে মোটেই সাধারণ নয় সেটা ওরা জানে। ঝামেলার টেনিসবল সাইজের কাচের গুলির মতো চোখ দুটো পুঞ্জাক্ষি— অনেকগুলো লেন্স মিলিয়ে তৈরি। এই চোখ দিয়ে ঝামেলা একমাইল দূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পায়—ঠিক টেলিস্কোপের মতো। আর ওর কানের জায়গায় রয়েছে স্রেফ দুটো ফুটো। কিন্তু তার ভেতরে এমন সব কলকবজা আছে যে, ও আলট্রাসনিক—মানে, শব্দোত্তর তরঙ্গ—পর্যন্ত শুনতে পায়।
চন্দ্রকান্ত ঝামেলার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করল, ‘কী দেখতে পেয়েছ?’
‘তস্কর, তস্কর। সাদা বাংলায় থিফ-মানে, চোর।’
কথা বলার সময় ঝামেলার কপালের বাতিগুলো দপদপ করে জ্বলে উঠতে লাগল। ঝালা-পালা বুঝল ঝামেলা উত্তেজিত হয়ে পড়েছে।
ছোটকা ঝামেলার কথা মোটেই উড়িয়ে দিতে পারল না। কারণ, রোবটটা ওর নিজের হাতে তৈরি। তা ছাড়া রোবট কখনও মিথ্যে কথা বলে না। অবশ্য কোনও ঘটনার ভুল ব্যাখ্যা করাটা রোবটের পক্ষে অসম্ভব নয়।
ছোটকা দোকানের চারদিকে তীক্ষ্ণ নজর বুলিয়ে নিল।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দোকানটায় জামাকাপড়ের যেমন স্টক তেমনই খদ্দেরের ভিড়ে একেবারে গিজগিজ করছে। প্রচুর সেল্সম্যান ও সেল্সগার্ল এদিক-ওদিক নানান কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে। স্টিরিও স্পিকারে গমগম করে মিউজিক বাজছে। দোকানের বিশাল-বিশাল দেওয়ালে নানা রঙের ইলেকট্রনিক রোলিং ডিসপ্লে। তাতে নামি কোম্পানির জামা-প্যান্টের বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে পুজোর স্পেশাল ডিসকাউন্টের ঘোষণা পর্যন্ত রয়েছে। দোকানের দরজার পাশে এক কোণ ঘেঁষে দশ বাই দশ মাপের একটা কাচের ঘর। সেখানে তিনটে কম্পিউটার নিয়ে ক্যাশিয়ারবাবুরা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে।
ওই ভিড়ের মধ্যেই ছোটকা ঝামেলাকে একপাশে ডেকে নিল। তারপর চাপা গলায় বলল, ‘ঝামেলা, ঝটপট বলো, কোথায় তুমি চোর দেখলে—।’ ঝামেলা বলল, ‘আমার সঙ্গে ওদিকটায় চলো, মেয়েটাকে দেখাইয়া দিতেছি। আমার পু…পু…’
ছোটকা ঝামেলার মাথায় এক চাঁটি মারতেই ও বলল, ‘পু…পুঞ্জাক্ষিকে ফাঁকি দেওয়া বড়ই সুকঠিন।’
ছোটকা ঝালা-পালাকে বলল, ‘তোরা এই কাউন্টারেই থাক—জামা-প্যান্ট পছন্দ কর—আমি এক্ষুনি আসছি…।’
ঝালা-পালাকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ছোটকা ঝামেলাকে সঙ্গে নিয়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল ।
ভিড় ঠেলে একটা কোণের দিকে পৌঁছেই ঝামেলা ছোটকাকে ইশারায় থামতে বলল। তারপর ফিশফিশে গলায় বলল, ‘তোমার পশ্চাৎদিকে তিরিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কেয়ারফুলি তাকাও। হলুদ টপ এবং কালো স্কার্ট পরা ফরসা মেয়েটিকে লক্ষ করিতেছ? উনিই হলেন শ্রীমতী তস্কর।’
ঝামেলার কথা মতো ধীরে-ধীরে পিছনে ফিরল ছোটকা। তারপর মোটামুটি তিরিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে নজরটা ঘোরাতেই মেয়েটিকে দেখতে পেল।
মেয়েটির গড়ন সুন্দর ছিপছিপে। বয়েস বড়জোর ষোলো কি সতেরো হবে। ওর হাতে একটা ছোট মাপের সাইডব্যাগ। ব্যাগটার রং নীল আর কালোয় তৈরি দাবার ছক—তবে বেশ মলিন। বিশেষ করে মেয়েটির চেহারা ও পোশাকের সঙ্গে একেবারেই বেমানান।
ঝালা-পালা কিন্তু ছোটকার পিছু ছাড়তে চায়নি। বিশেষ করে ঝামেলার ‘তস্কর দর্শন’ রহণ্য ওদের কৌতূহলী করে তুলল।
সুতরাং ভিড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে যমজ জুটি সামান্য চেষ্টাতেই পৌঁছে গেল ছোটকার কাছে। দোকানের বেশ কয়েকজন ক্রেতা অবিকল একই চেহারার একই পোশাক পরা দুই ভাইকে বারবার অবাক নজরে দেখেছিল। কিন্তু ঝালা-পালার সেদিকে কোনও খেয়াল ছিল না। ওরা শুধু ঝামেলাকে দেখছিল।
ঝালা-পালাকে দেখে ছোটকা শাসনের সুরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই ঝামেলা ওর শক্ত হাতে ছোটকার পেটে চোরা চিমটি কাটল, আর একইসঙ্গে মিহি গলায় বলল, ‘লুক! লুক! অপহরণ করছে— ‘
ছোটকা এবং ঝালা-পালা তিনজনেই স্পষ্ট দেখতে পেল ব্যাপারটা। প্রমাণ মাপের একটা জিন্সের প্যান্ট কাউন্টার থেকে তুলে নিয়ে ছোট সাইডব্যাগটার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে লাগল মেয়েটি। এবং ওদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্যান্টটা অনায়াসেই ঢুকে গেল ব্যাগের ভেতরে।
বড়সড়ো ব্যাগ বা ঝোলা নিয়ে দোকানে ঢোকা নিষেধ। তাই দরজার কাছেই রয়েছে ব্যাগ জমা দেওয়ার কাউন্টার। কিন্তু পার্স বা ছোট সাইডব্যাগ জমা রাখার কোনও দরকার নেই। সেগুলো সঙ্গে নিয়ে সবাই ঢুকতে পারে দোকানের ভেতরে—যেমন এই মেয়েটি ঢুকেছে।
পার্স বা ছোট সাইডব্যাগে জামাকাপড় লুকিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। সে-কথা মাথায় রেখেই দোকানের নিরাপত্তাকর্মীরা মেয়েটিকে ওই ছোট ব্যাগসমেত দোকানে ঢুকতে দিয়েছে। কিন্তু ছোটকারা চোখের সামনে যে-ঘটনা দেখল তা একেবারেই অবিশ্বাস্য।
ছোটকা কিছু একটা মন্তব্য করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই ঝামেলা বলে উঠল, ‘এইরূপ জামাকাপড় প্রচুর লইয়াছে এবং ওই ব্যাগের ভেতরেই সব ঠেসে ঢুকিয়ে দিয়েছে—।’
ঝালা-পালা প্রায় একসঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে বলল, ‘ছোটকা, ঝামেলার সার্কিটে মনে হয় বেশ বড় রকমের গোলমাল হয়েছে। তাই ও উলটোপালটা দেখছে আর ভুলভাল বকছে। ওইটুকু ব্যাগে কখনও এত জামাকাপড় ঢোকে!’
ঝামেলা রেগে গিয়ে বলল, “তোমরা কী করে বুঝিবে! বানর থেকে মানুষ হওয়ার পর সেই কোন আদিমকালে পড়ে রয়েছ! যদি আমাদের মতো রোবট হতে তা হলে বুঝিতে!’
ঝামেলার বিশ্বাস, মানুষ থেকে বহু বিবর্তনের পর এসেছে রোবট। তাই ও মাঝে-মাঝেই ঝালা-পালাকে আদিমযুগের মানুষ বলে খোঁটা দেয়।
হঠাৎই ছোটকা ঠোঁটে আঙুল তুলে ওদের চুপ করতে ইশারা করল। তারপর চাপা গলায় বলল, ‘ওই দ্যাখ মেয়েটা আবার চুরি করছে!’
তারপর ওদের চোখের সামনেই রীতিমতো অলৌকিক ঘটনা ঘটতে লাগল। মেয়েটি বেশ কয়েকটি জামাকাপড় সেল্সম্যান-সেল্সগার্লদের চোখ এড়িয়ে
পটাপট ঢুকিয়ে ফেলল ওর ব্যাগে।
ছোটকা আপনমনেই বলল, ‘মেয়েটা ক্লেপ্টোম্যানিয়াক নয় তো?’ চন্দ্রকান্ত অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, ‘ক্লেপ্টোম্যানিয়াক মানে?’ ইন্দ্ৰকান্তও বলে উঠল, ‘সেটা আবার কী?’
ছোটকা বলল, ‘ক্লেপ্টোম্যানিয়া মানে হল চুরি করার অসুখ। মেয়েটার সেরকম কোনও অসুখ নেই তো!’
ঝামেলা বলল, ‘ব্যাপার বড়ই বিপত্তারিণী।’
ঝালা-পালা ভুরু কুঁচকে ঝামেলার দিকে তাকাতেই ছোটকা বলল, বোধহয় বলতে চাইছে, ব্যাপার বড়ই বিপজ্জনক।’
আরও দু-এক মিনিট মেয়েটিকে লক্ষ করার পর ছোটকা বলল, ‘দাঁড়া, আমি ওর কাছে গিয়ে ব্যাপারটা একটু খুঁটিয়ে দেখি। তোরা এখানেই থাক, কোথাও যাস না কিন্তু—।’
ছোটকা ভারত সরকারের গোপন তদন্ত বিভাগে চাকরি করে। সুতরাং গোয়েন্দাগিরির অভ্যেস তো ওর আছেই, সেইসঙ্গে নানা অস্ত্রশস্ত্রও নাড়াচাড়া করতে পারে। ওরা দেখল, ছোটকা দিব্যি ভালোমানুষ-ভালোমানুষ মুখ করে এদিকওদিক ঘুরে-ফিরে মেয়েটির ঠিক পাশটিতে গিয়ে দাঁড়াল।
মেয়েটির ব্যাগের মুখটা খোলাই ছিল। উঁকি মেরে ব্যাগের ভেতরে তাকিয়ে ছোটকার তো চক্ষু চড়কগাছ। ব্যাগের ভেতরটা শূন্য! কোনও জামাকাপড়ই সেখানে নেই!
তা হলে এতক্ষণ ধরে মেয়েটি যে জামাকাপড়গুলো ব্যাগের মধ্যে ঢোকাল সেগুলো গেল কোথায়!
ছোটকা আর থাকতে পারল না। পকেট থেকে অফিসের আইডেন্টিটি কার্ডটা বের করে শক্ত গলায় মেয়েটিকে বলল, ‘তোমাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে।’ সঙ্গে-সঙ্গে মেয়েটির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। চোখে-মুখে ফুটে উঠল ভয়ের ছাপ। আমতা-আমতা করে ও বলল, ‘আমি…আমি… মানে…।’
ছোটকা ওর কথায় কান না দিয়ে একজন সেল্সম্যানকে ডেকে জিগ্যেস করল দোকানের মালিক বা ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করা যাবে কি না। উত্তরে সেল্সম্যানটি আঙুল তুলে ক্যাশিয়ারদের কাচের ঘরটা দেখিয়ে বলল,
‘আমাদের মালিক মিস্টার আস্থানা ওই ঘরে আছেন—।’
ছোটকা তখন মেয়েটিকে জিগ্যেস করল, ‘তোমার সঙ্গে আর কে আছে?’
মেয়েটি হোঁচট খেয়ে কোনওরকমে জবাব দিল, ‘আমার দু-বন্ধু। ওরা এসব কিছু জানে না। ওরা ওইদিকটায় জিন্সের শার্ট দেখছে। প্লিজ, ওদের কিছু বলবেন না।’
ছোটকা দু-চার সেকেন্ড কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ‘আমি ওই কাচের ঘরটায় যাচ্ছি। তুমি বন্ধুদের যা-হোক কিছু একটা বলে ওখানে চলে এসো। ভুলেও পালানোর চেষ্টা কোরো না। আর এই সাইডব্যাগটা আমাকে দিয়ে যাও—।
মেয়েটি শুকনো মুখে ছোটকার আদেশ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করল। বন্ধুদের খবর দিয়ে একমিনিটের মধ্যেই ও চলে এল কাচের ঘরের সামনে।
ছোটকা মিস্টার আস্থানার সঙ্গে কথা বলছিল। মেয়েটিকে দেখতে পেয়ে ইশারায় ওকে ভেতরে আসতে বলল।
অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও ছোটকার কথাবার্তা ঝামেলা সবই শুনতে পাচ্ছিল। আর সেগুলো ও মিহি চাপা গলায় রিলে করে শোনাচ্ছিল যমজ দুভাইকে। মেয়েটি কাচের ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়তেই ঝামেলা বলে উঠল, ‘এবার গ্লাসঘরের নিকটে চলো। নহিলে কিছু শুনতে পাইব না। আমার ভেরি কিউরিয়োসিটি হইতেছে, তৎসহ উত্তেজনা। ফুজিয়ামা! ফুজিয়ামা!’
ঝামেলার কপালের রঙিন বাতিগুলো দপদপ করে জ্বলতে নিভতে লাগল। অনেক সময় আনন্দে বা উত্তেজনায় ঝামেলা ‘ফুজিয়ামা! ফুজিয়ামা’! বলে চেঁচিয়ে ওঠে। ওর আনন্দ বা উত্তেজনার সঙ্গে জাপানের এই আগ্নেয়গিরিটির যে ঠিক কী ধরনের সম্পর্ক সেটা ঝালা-পালা বা ছোটকা এখনও আবিষ্কার করে উঠতে পারেনি।
ওরা তিনজনে কাচের ঘরের খুব কাছটিতে এসে দাঁড়াল। ঝালা-পালা সবকিছুই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। আর ওদের শোনার সমস্যার সমাধান করে দিল আলট্রাসনিক কানের মালিক ঝামেলা।
দোকানের মালিক মিস্টার আস্থানা মোটাসোটা প্রৌঢ় মানুষ। মাথায় টাক। ঘাড়ের কাছে কয়েক গোছা সাদা চুল। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। তাঁকে সব ঘটনা খুলে বলল ছোটকা।
ব্যাপার-স্যাপার শুনে ভদ্রলোক খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। ছোটকা ব্যাগটা খুলে আগেই দেখেছিল, এখন মিস্টার আস্থানাকে দেখাল।
ব্যাগের ভেতরটা কালো, অন্ধকার—জামাকাপড়ের চিহ্নমাত্রও সেখানে নেই! ছোটকা ব্যাগের ভেতরে হাত ঢোকাল।
কিন্তু অবাক কাণ্ড! ছোটকার হাত ব্যাগের কোনও তল খুঁজে পেল না! ব্যাগের মুখটায় নিকেল করা ধাতুর পটি লাগানো ছিল। সেটার উষ্ণতা স্বাভাবিক মনে হলেও ছোটকা টের পেল যে, ব্যাগের ভেতরটা ভীষণ ঠান্ডা। ঠিক যেন দার্জিলিং।
মিস্টার আস্থানা হতভম্ব হয়ে ছোটকাকে দেখছিলেন। আর মেয়েটিও মুখ কাঁদো-কাঁদো করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে সব লক্ষ করছিল।
মিস্টার আস্থানার টেবিল থেকে একটা বলপয়েন্ট পেন তুলে নিল ছোটকা। সেটা টুপ করে ফেলে দিল ব্যাগের ভেতরে। পেনটা যথারীতি অদৃশ্য হয়ে গেল। ব্যাগের ভেতরে হাতড়ে ওটাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। অথচ বাইরে থেকে ব্যাগটার গভীরতা সাত-আট ইঞ্চির বেশি মনে হয় না।
ছোটকা একজন ক্যাশিয়ারের টেবিল থেকে একটা মেটাল স্কেল তুলে নিল। স্কেলটার দৈর্ঘ্য একফুট। অথচ সেটা খাড়াভাবে ব্যাগে ঢোকাতেই স্কেলটা বিনা বাধায় তলিয়ে গেল ব্যাগের অতলে।
মিস্টার আস্থানা অবাক হয়ে ছোটকাকে জিগ্যেস করলেন, ‘এ তো ভারী পিকিউলিয়ার মিস্টিরিয়াস ব্যাপার! আপনি কি কিছু বুঝতে পারছেন?’
ছোটকার ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল। ব্যাগটার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে ও গভীরভাবে কিছু ভাবছিল। কিছুক্ষণ পর বারকয়েক মাথা নেড়ে ছোটকা জবাব দিল, ‘একটু একটু আঁচ করতে পারছি।’
তারপর ছোটকা মেয়েটিকে জিগ্যেস করল, ‘তোমার নাম কী? কোথায় থাকো?’
মেয়েটি কাঁদো কাঁদো স্বরে উত্তর দিল, ‘আমার নাম রূপালি-রূপালি চ্যাটার্জি। সল্টলেকে বিডি মার্কেটের কাছে থাকি।’
‘এই ব্যাগটা তুমি কোথায় পেয়েছ?’
‘সল্টলেকে বাস স্টপেজের কাছে কুড়িয়ে পেয়েছি।’
রূপালির কথা থেকে জানা গেল, ব্যাগটা যখন ও কুড়িয়ে পায় তখন আশেপাশে কেউ ছিল না। তাই ও ব্যাগটা নিয়ে বাসে উঠে পড়ে। কাঁকুড়গাছির কাছে ওর বন্ধু রীতার বাড়ি। সেখানে ওদের আর-এক বন্ধু রঙ্গনার আসার কথা। তারপর তিন বন্ধুতে মিলে ধর্মতলায় পুজোর ড্রেস কিনতে রওনা হবে এইরকমই ঠিক করা ছিল।
বাস থেকে নেমে রীতার বাড়ি যাওয়ার সময় ও কী ভেবে ওর ছোট্ট পার্স আর রুমালটা এই ব্যাগটায় রাখে। কিন্তু তারপরই দ্যাখে যে ওগুলোর আর কোনও হদিস নেই। তখন ও অবাক হয়ে ঢিল-পাটকেল, গাছের পাতা, চায়ের ভাঁড়, অনেক কিছুই ব্যাগটার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় এবং দ্যাখে যে, সেগুলোও বেমালুম অদৃশ্য হয়ে যায়। প্রথমটায় ও ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপরই ওর মনে হয়, ব্যাপারটা খুব মজার। তাই রীতা আর রঙ্গনাকে ও কিছুই জানায়নি। শুধু বলেছে, বাস থেকে নামার পর ওর পার্সটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তারপর এই দোকানে ঢুকে ও স্রেফ মজা করার জন্যই বেশ কিছু জামাকাপড় ব্যাগটায় ঢুকিয়ে অদৃশ্য করে দেয়। কিন্তু ওগুলো যে কোথায় গেছে ও তার বিন্দুবিসর্গও জানে না।
কথা শেষ করে রূপালি কেঁদে ফেলল। ছোটকাকে বারবার করে অনুরোধ করল ওর বাড়িতে যেন কিছু না জানানো হয়।
ছোটকা মালিকের কাছ থেকে একটা প্যাডের কাগজ নিয়ে খসখস করে একটা রিপোর্ট সই করে দিল। তারপর তিন জায়গায় ফোন করে মিনিটকয়েক ধরে কথাবার্তা বলল।
কথাবার্তা শেষ হলে ছোটকা রূপালিকে বলল, ‘তোমার আর কোনও চিন্তা নেই—তুমি যাও। শুধু জেনে রেখো, আজ তুমি সাংঘাতিক বিপদ থেকে বেঁচে গেছ। কারণ এই ব্যাগটা আসলে ব্যাগ নয়…একটা টানেল।’
রূপালি কাচের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চোখ মুছতে মুছতে বন্ধুদের খোঁজে চলে গেল।
মিস্টার আস্থানার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে ব্যাগটা নিয়ে ছোটকাও বেরিয়ে এল কাচের ঘর থেকে।
ছোটকা বেরিয়ে আসতেই ঝামেলা জিগ্যেস করল, ‘কী হল, সল্ভ হইল?’ ছোটকা হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, হইল।’ তারপর ঝালা-পালাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এখন চটপট তোদের প্যান্ট-জামা পছন্দ কর তো।’
চন্দ্রকান্ত আবদারের সুরে বলল, ‘ব্যাগটার মিস্ট্রিটা আমাদের খুলে বলো, ছোটকা।’
‘আগে কেনাকাটা সেরে নে, তারপর যেতে-যেতে বলছি।’
কেনাকাটা সেরে রাস্তায় বেরোনোর সময় একটা লম্বা রোবট ঝামেলাকে লক্ষ করে মন্তব্য করল, ‘ন্যাড়া খোকা।’
সেটা শুনে ঝামেলা তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে উঠে তেড়ে গেল লম্বা রোবটটার দিকে। বলল, ‘টুডে তোর ওয়ান ডে কি আমার ওয়ান ডে!’
ঝালা-পালা কোনওরকমে ঝামেলাকে টেনে ধরে সামাল দিল। ছোটকা অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, ‘ও কী বলল একটু ঝুঝিয়ে দে তো!’ চন্দ্র বলল, ‘ঝামেলা বলল, আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।’ ইন্দ্র বলল, ‘ওসব বাদ দাও। তুমি আগে ব্যাগের মিস্ট্রিটা বলো দেখি।’ ছোটকা বলল, ‘শোন তা হলে বলছি। ব্যাপারটা বিজ্ঞানের খুব জটপাকানো ব্যাপার, তোরা সহজে বুঝবি না—তবুও সহজ করে বোঝাতে চেষ্টা করছি—।
‘আমরা যে দুনিয়ায় বাস করি সেটা হল ত্রিমাত্রিক দুনিয়া বা থ্রি ডাইমেনশন্যাল ওয়ার্ল্ড। সেইজন্যেই আমাদের তিনটে মাপ আছে—দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতা। এইবার কল্পনা কর যে, একটা দ্বিমাত্রিক দুনিয়া, মানে টু ডাইমেনশন্যাল ওয়ার্ল্ড আছে। সেখানকার প্রাণীদের শুধু দুটো মাপ থাকবে—দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ। অর্থাৎ, প্রাণীগুলো হবে চিঁড়েচ্যাপটা চেহারার, আর ওরা দ্বিমাত্রিক কোনও সমতলে লেপটে চলাফেরা করবে। শুধু কি তাই! ওদের দেখার কাজটাও হবে ওই দ্বিমাত্রিক সমতল বরাবর। ফলে ওদের জগতে—মানে, ওই সমতলে—যদি একটা ফুটো করে দেওয়া যায় তা হলে ওরা সেটাকে একটা অন্ধকার গর্ত হিসেবে দেখবে। কারণ, ওদের দেখার অভ্যেসটা সমতল বরাবর—তাই ওরা ফুটো দিয়ে কিছু দেখতে পাবে না। আর দেখতে না পাওয়া মানেই অন্ধকার। একটা কাগজের পৃষ্ঠা নিয়ে তাতে একটা ফুটো করে ব্যাপারটা ভাবলে অনেক সহজে বোঝা যাবে।’
‘তা হলে শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াল? ওই ফুটোটা হল দ্বিমাত্রিক জগৎ আর ত্রিমাত্রিক জগতের মধ্যে যাতায়াতের একটা পথ—মানে, টানেল। দ্বিমাত্রিক জগৎ থেকে যা কিছু ওই ফুটো দিয়ে ঢুকবে তা সরাসরি চলে যাবে ত্রিমাত্রিক দুনিয়ায়। ফলে দ্বিমাত্রিক জগতের প্রাণীরা দেখবে জিনিসগুলো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কাগজের পৃষ্ঠায় একটা ব্যাগের ছবি এঁকে তার মধ্যে একটা ফুটো করে নিলে ব্যাপারটা আরও সহজে বোঝা যাবে। দ্বিমাত্রিক প্রাণীরা ভাববে ব্যাগটার কোনও শেষ নেই। ঠিক আমার হাতের ব্যাগটার মতো।’ কথাটা বলে রূপালির কাছ থেকে নেওয়া ব্যাগটা ছোটকা ওদের দেখাল। তারপর বলল, ‘এইবার ত্রিমাত্রিক আর চতুর্মাত্রিক দুনিয়ার মধ্যে ঠিক একইরকম জিনিস কল্পনা করে দ্যাখ। রূপালির ব্যাগটার মধ্যে কেউ হয়তো এমন একটা ফুটো করে দিয়েছে যাতে ব্যাগের মুখটা ত্রিমাত্রিক আর চতুর্মাত্রিক দুনিয়ার মধ্যে একটা টানেল তৈরি করে ফেলেছে। ওই ফুটো দিয়ে যা কিছু ঢোকানো হচ্ছে তা সরাসরি চলে যাচ্ছে ফোর ডাইমেনশন্যাল ওয়ার্ল্ডে।’
‘কিন্তু ফুটোটা তৈরি হল কীভাবে?’ চন্দ্রকান্ত জিগ্যেস করল।
হাতের ব্যাগটার দিকে একবার তাকিয়ে চিন্তিত মুখে ছোটকা বলল, ‘সেটাই তো তখন থেকে ভাবছি। দেখি, অফিসে গিয়ে ব্যাপারটা জানাই। তারপর আমাদের রিলেটিভিটি ল্যাবরেটরিতে ব্যাগটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে।’
ঝামেলা উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠল, ‘সবই সম্পূর্ণরূপে বুঝিলাম। তবে কিছু সামথিং ঝাপসা রয়ে গেল।’
ঝালা-পালা হেসে জবাব দিল, ‘তোমার কাছে ঝাপসা থাকাই ভালো। তুমি বেশি বুঝে গেলে আর এক বিপদ হবে। এখন চুপচাপ বাড়ি চলো, নইলে তোমাকে ওই টানেলে ঢুকিয়ে ফোর ডাইমেনশন্যাল ওয়ার্ল্ডে পাচার করে দেব।’
ঝামেলা মাথা নেড়ে বলল, ‘সে যা-ই বলো, আজ আমার জন্যেই তস্করং ধৃতং হস্তনস্ত।’
চন্দ্রকান্ত অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, ‘শেষের কথাগুলোর মানে?’ ঝামেলা বলল, ‘ওগুলো হল মডার্ন সংস্কৃত—তোমরা বুঝবে না। সেই কোন আদিম যুগে পড়ে আছ! তস্করং ধৃতং মানে চোর ধরা পড়ল।’ ‘আর হস্তনস্ত মানে?’ ইন্দ্রকান্ত প্রশ্ন করল।
ছোটকা হেসে জবাব দিল, ‘হস্তনস্ত মানে বোধহয় হাতেনাতে। কী রে, ঝামেলা, ঠিক বলিনি?
ঝামেলা মিহি গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘ফুজিয়ামা! ফুজিয়ামা!’ সেই সঙ্গে ওর কপালের লাল-নীল-হলদে-সবুজ বাতিগুলো দপদপ করে জ্বলতে-নিভতে লাগল।