ঝামেলা ও লম্ফমান ফুটবল
খেলতে-খেলতেই ঘটে গিয়েছিল আশ্চর্য ব্যাপারটা।
কলকাতা শহরে তখন চাঁদি-ফাটা ঝাঁ ঝাঁ গরম। মাঠে-মাঠে ফুটবল, আর ঘরে-ঘরে টিভি-তে ক্রিকেট। খেলা নিয়ে তুমুল হইচই নানা জায়গায়, সকলের মুখে শুধু খেলার কথা। এমনকী বাচ্চা রোবট ঝামেলাও খেলা নিয়ে মেতে উঠেছে।
একদিন সন্ধেবেলা বাড়িতে বসে ভারত-পাকিস্তানের একটা ওয়ান-ডে ম্যাচ দেখছিল যমজ দু-ভাই চন্দ্রকান্ত আর ইন্দ্রকান্ত-যাদের ডাকনাম ঝালা-পালা। ওদের সবসময়ের সাথি তিনফুট হাইটের পিকিউলিয়ার রোবট ঝামেলা দু-ভাইয়ের গা ঘেঁষে বসে টিভির দিকে তাকিয়ে ছিল। শচীন তখন একটা ঝোড়ো ইনিংস খেলছিল। কোনও বলকে তোয়াক্কা না করে শুধু চৌকো আর ছক্কা লাগাচ্ছিল। ঝালা-পালা বারবার খুশিতে চিৎকার করে উঠে হাততালি দিচ্ছিল।
ঠিক তখনই ঝামেলা ওর মিহি গলায় মন্তব্য করল, ‘এই সাহসী ছেলেটা তোমাদিগের তুলনায় যারপরনাই উন্নত প্রাণী। বিবর্তনের পথে তিরবেগে ছুটে অস্বাভাবিক অগ্রসর হইয়াছে। আর কিঞ্চিৎ সুযোগ পেলে আমার ন্যায় সুপারম্যানকেও হয়তো বা স্পর্শ করিয়া ফেলিবে।’
ঝামেলার এই এক দোষ। যখন-তখন জ্ঞান দিতে শুরু করে। ওর ধারণা, বানর থেকে এসেছে মানুষ— আর মানুষ থেকে বিবর্তন হয়ে এসেছে রোবট। তাই ও নিজে হল সুপারম্যান। সেইজন্যই ও মাঝে-মাঝে ঝালা-পালাকে শুনিয়ে দেয়, ‘কোন আদ্যিকালে তোমরা পড়ে আছ ভাবিলে বড় সরো হয়। সরো মানে যে দুঃখ সেই তথ্যটি অবগত আছে তো!’
ঝামেলার ভাষা ভারী অদ্ভুত। কথ্য ভাষা, সাধু ভাষা, ইংরেজি, হিন্দি, সংস্কৃত মিশিয়ে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ভুলভাল যা খুশি বলে যায়। আবার উচ্চারণ কঠিন হলে আটকেও যায়।
ঝামেলার জ্ঞানগর্ভ মন্তব্য শুনে ইন্দ্ৰকান্ত বলল, ‘অতই যখন নিজেকে বড় ভাবো, তা হলে শচীনের বদলে ইন্ডিয়া টিমে ঢুকে পড়লেই পারো!’
ঝামেলা এ-কথায় বিন্দুমাত্রও বিচলিত না হয়ে বলল, ‘আমি ব্যাট ধরিলে ক্রিকেট হিস্টিরিয়া নূতন করিয়া লিখতে হবে।’
‘ও বোধহয় হিস্ট্রি বলতে চাইছে।’ ইন্দ্ৰকান্ত বলল।
ঝামেলা রিনরিনে গলায় হেসে উঠল, তারপর চন্দ্রকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমাদিগকে লইয়া যে কী করি! এই সহজ ওয়ার্ডটিরও মানে জানো না!’ ইন্দ্র বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ঝামেলা স্ট্যাচু!’
সঙ্গে-সঙ্গে ঝামেলা যেন পাথরের স্ট্যাচু হয়ে গেল।
ফোঁস করে শ্বাস ফেলে ইন্দ্ৰ বলল, ‘এ চিজকে ট্রেনিং দেওয়া কি সহজ কথা!’
ঝামেলাকে জটিল প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করেছে ঝালা-পালার ছোটকা প্রসেনজিৎ চৌধুরী। ইলেকট্রনিক্সবিদ্যায় ছোটকার জুড়ি নেই। ছোটকা চাকরি করে ভারত সরকারের গোপন তদন্ত বিভাগে। নানান কাজে ওকে সবসময়েই দেশেবিদেশে উড়ে বেড়াতে হয়। এখন, কিছুদিন হল, কলকাতার অফিসে আছে।
ঝালা-পালা ছোটবেলায় ভীষণ কান্নাকাটি চেঁচামেচি করত, সকলের কান একেবারে ঝালাপালা করে দিত। তাই ছোটকা আদর করে ওদের নাম দিয়েছে ঝালা-পালা। আর উপহার দিয়েছে এই বাচ্চা রোবট ঝামেলা। ছোটকা বলেছে, ‘তোরা রোবটটাকে ভালো করে ট্রেনিং দে।’ কিন্তু ট্রেনিং ওরা দেবে কী, উলটে ঝামেলার কাছেই ওদের ট্রেনিং নেওয়ার মতো অবস্থা দাঁড়িয়েছে।
গত কয়েকদিনেই ঝামেলা কী করে যেন খেলা-পাগল হয়ে উঠেছে। ঝালাপালা যখন বিকেলে মাঠে খেলতে বেরোয় তখন ঝামেলা বরাবরই হেলেদুলে ওদের সঙ্গ নেয়। কিন্তু কোনওদিনও ‘খেলব’ বলে বায়না ধরেনি। আজ বিকেলে দু-ভাই যখন কেড্স জুতো পরে ফুটবল খেলার জন্য তৈরি হচ্ছে, তখনই ঝামেলার আবদার শুরু হল।
‘আমিও ফুটবল ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করব। ছোটকাকে বলে আজকেই আমাকে তোমাদিগের ন্যায় কম্বলের জুতা কিনিয়া দাও।’
ঝামেলার ভাষায় ‘আজকে’ মানে ‘এখনই’। আর কম্বলের জুতো মানে যে কেড্স জুতো সেটা ঝালা-পালা স্পষ্ট বুঝতে পারল। ওরা ঝামেলাকে অনেক করে বোঝাল যে, ফুটবলের মতো বাজে খেলা আর হয় না। ফুটবল খেলায় বিপদের অনেক ঝুঁকি। যে-কোনও সময় হাত-পা ভাঙতে পারে।
এতসব ভয়ঙ্কর কথা শোনার পরেও ঝামেলার সেই এক গোঁ : ‘পেলে যদি নির্ভয়ে খেলিস্যান্তি তা হলে আমিও পারন্তি।’ অর্থাৎ, ‘পেলে যখন নির্ভয়ে খেলতে পেরেছে তখন আমিও পারব।’
‘ঠিক আছে, ছোটকা অফিস থেকে বাড়ি ফিরুক, তখন একটা ব্যবস্থা করব।’ ইন্দ্রকান্ত ঝামেলার ন্যাড়া মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করল। চন্দ্রকান্ত ওকে ক্যাডবেরি খাওয়াবে বলে আশ্বাস দিল।
অনেক ‘বাবা-বাছা’ করার পর ওরা ঝামেলাকে রাজি করিয়ে রাস্তায় বেরোল। ওদের সঙ্গে হেলেদুলে যেতে যেতে ঝামেলা বারবারই জিগ্যেস করতে লাগল, ‘ছোটকাবাবু কব আয়েগা? তাঁহাকে অফিসে টেলিফোন করিয়া দাও।’
যখন ওরা ফুটবল খেলার মাঠের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে তখন ঝামেলা হঠাৎ একটা লাফ দিয়ে উঠল। ওর কপালের লাল- -নীলল-হলুদ বাতিগুলো জ্বলতে নিভতে শুরু করল। ও হাততালি দেওয়ার চেষ্টা করে মিহি গলায় উল্লাসের সুরে বলতে লাগল, ‘ফুজিয়ামা! ফুজিয়ামা! ব্রায়ান লারা একটি ফোর আঘাত করিয়াছে!’
ঝালা-পালা বুঝতে পারল লারা এইমাত্র একটা বাউন্ডারি মেরেছেন। আজ ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর অস্ট্রেলিয়ার ওয়ান-ডে খেলা। টিভিতে তারই লাইভ টেলিকাস্ট চলছে। আশেপাশের কোনও বাড়ির টিভির ধারাবিবরণী নিশ্চয়ই ঝামেলার কানে এসে পৌঁছেছে। ওর কান এমনভাবে তৈরি যে, বহুদূরের শব্দ ও স্পষ্ট শুনতে পায়, আর আলট্রাসনিক শব্দও ওর কান এড়িয়ে যেতে পারে না। এ ছাড়া ওর চোখ দুটো পুঞ্জাক্ষি—দেখে মনে হয় কাচের তৈরি টেনিসবলঠেলে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। অনেক জটিল লেন্স জুড়ে তৈরি এই চোখ দিয়ে ও প্রায় একমাইল দূর পর্যন্ত দেখতে পায়।
ঝামেলার এই অদ্ভুত ক্ষমতাকে দু-ভাই হিংসে করে। একদিন ইন্দ্ৰকান্ত ছোটকাকে বলেছিল ওদের কান আর চোখ ঝামেলার মতো পাওয়ার ফুল করে দিতে। তাতে ছোটকা হেসে গড়িয়ে পড়েছিল, বলেছিল, ‘তা কখনও হয়! তোরা হলি মানুষ, আর ঝামেলা হল মেশিন। তা ছাড়া তোদের ওইরকম কান আর চোখ করে দিলে সুবিধের চেয়ে অসুবিধেই বেশি হবে।’
মাঠে পৌঁছে ঝালা-পালা দেখল খেলা শুরু হয়ে গেছে। ওদের বন্ধুর দল একটা ফুলবল নিয়ে দিব্যি পেটাপিটি করছে আর নিজেদের মধ্যে হইচই চিৎকার করছে।
মাঠের একপাশে সুন্দর ফুলের গাছ। তার গা ঘেঁষে সরু পিচের রাস্তা। অনেকে সেখানে পায়চারি করছে। কেউ-কেউ বসে আছে ঘাসের ওপরে। বেশ কয়েকজন তাদের পোষা রোবট সঙ্গে করে বেড়াতে বেরিয়েছে।
চন্দ্রকান্ত ঝামেলাকে বলল, ‘তুমি অন্য রোবটদের সঙ্গে খেলা করো। দেখো, আবার যেন কোনও ঝামেলা পাকিয়ো না।’
ঝামেলা তৎক্ষণাৎ হেলেদুলে হাঁটতে শুরু করল। সামনেই একটা লম্বা রোবট ঝুঁকে পড়ে ফুলের গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করছিল। সে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই ঝামেলা অবাক হয়ে তার মাথার দিকে তাকিয়ে রইল। কী লম্বা রোবটরে বাবা! মনে-মনে ভাবল ঝামেলা।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ঝামেলা লম্বা রোবটটাকে প্রশ্ন করল, ‘তুই এত লং কেন রে?
রোবটটা তার ধাতব ঠোঁট চওড়া করে বোধহয় হাসতে চেষ্টা করল। তারপর বলল, ‘আমার বাড়ি শিলং, তাই —। কিন্তু তুই এরকম ন্যাড়া কেন?’
ঝামেলাকে কেউ ন্যাড়া বললে ও ভীষণ চটে যায়। ও খেপে গিয়ে কী একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু ঠিক তখনই ফুটবল খেলার মাঠের দিক থেকে একটা প্রচণ্ড হইহই শোনা গেল।
ঝামেলার সব ব্যাপারেই কৌতূহল বড় বেশি। সুতরাং ঝগড়া মুলতুবি রেখে ও হেলেদুলে রওনা হল ঝালা-পালার দলবলের দিকে।
মাঠে তখন একটা বিচিত্র কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। ঝালা-পালাদের ফুটবলটা
মাঠে একনাগাড়ে ড্রপ খেয়ে চলেছে।
ফুটবল যে শূন্যে উঠলে আবার মাটিতে পড়বে, ড্রপ খেয়ে আবার শূন্যে লাফিয়ে উঠবে, এর মধ্যে আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু নেই। আর এটাই স্বাভাবিক যে, ফুটবলটার লাফ ক্রমশ কমে আসবে এবং একসময় তার লাফালাফি একেবারে থেমে যাবে।
কিন্তু ঝালা-পালাদের ফুটবলটার বেলায় সেরকম কিছু হচ্ছে না। ফুটবলটা ঠিক যতটা উঁচু থেকে নীচে এসে পড়ছে, ড্রপ খেয়ে আবার ঠিক ততটাই শূন্যে লাফিয়ে উঠছে।
ঝামেলা অবাক হয়ে এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখতে লাগল।
লাফানো বলটাকে ঘিরে তখন ভিড় জমে গেছে। খেলতে আসা ছেলের দল তো বটেই, এ ছাড়া রয়েছে নানানবয়েসি লোকজন–সবাই একজোট হয়ে হাঁ করে বলটার কীর্তিকলাপ দেখছে। কয়েকটি মেয়ে নিজেদের মধ্যে হাত নেড়ে উত্তেজিতভাবে কীসব বলাবলি করছে। বোধহয় বলটাকে নিয়েই আলোচনা করছে।
চারপাশের চিৎকার, গুঞ্জন, হাসাহাসি মিলেমিশে এক জটপাকানো কোলাহল তৈরি হয়েছে বলটাকে ঘিরে।
ওই ডামাডোলের মধ্যে চন্দ্রকান্ত আর ইন্দ্রকান্ত কী করে যে ঝামেলাকে খুঁজে বের করল কে জানে! ওদের ডাক শুনে ফিরে তাকিয়েই ঝামেলা দ্যাখে দু-ভাই ওর ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে।
ওদের কাছেই পুরো ব্যাপারটা শুনল ঝামেলা।
দিব্যি নাকি ফুটবল খেলা চলছিল। হঠাৎই ওদের এক বন্ধু বুবু জোরে একটা স্কাই শট মারে। তাতে বলটা প্রায় তিনতলার সমান শূন্যে উঠে যায়। বলটা মাটিতে নেমে আসার সময় ওদের আর একজন বন্ধু অপু ছুটে যায় বলটাকে শট মারতে। কিন্তু কীভাবে যেন ওর শট ফসকে যায়। তখন সবাই অবাক হয়ে দ্যাখে যে, বলটা আবার তিনতলার সমান উঁচুতে উঠে গেছে। এই ব্যাপার দেখে সবাই বেশ ভয় পেয়ে যায়। কে একজন বলে যে, বছর পনেরো আগে একজন ফুটবল খেলোয়াড় মাঠের ধারের একটা বকুলগাছে গলায় দড়ি দিয়েছিল। এ নাকি তারই প্রেতাত্মার কারসাজি। এ-কথা শুনে সবাই সরে যায়, আর বলটা আপনমনে তিনতলার সমান লাফাতে থাকে। এখন কী করা হবে কেউ ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
সব কথা শোনার পর বুকে হাত ঠুকে ঝামেলা বলল, ‘একটি লম্ফমান ফুটবলকে ভয় পাওয়ার যে কী কারণ থাকিতে পারে তাহা কিছু বুঝতে পারছি না। রবিঠাকুর বলে গেছেন, বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা। তোমরা কি তাহা জানো না??
ইন্দ্রকান্ত ঝামেলার ‘রণং দেহি’ ভাবসাব দেখে বলল, ‘তুমি কি জানো,
কে যেন বলে গেছেন, হাতি-ঘোড়া গেল তল/মশা বলে কত জল?’
‘আমাকে ব্যঙ্গ করিয়া কোনও প্রফিট হইবে না।’ ঝামেলা গম্ভীরভাবে মন্তব্য করল এবং হাঁটা দিল লম্ফমান ফুটবলের দিকে।
হাঁটতে-হাঁটতেই পিছন ফিরে ও চন্দ্র-ইন্দ্রকে বলল, ‘দেশের কাজে যাচ্ছি। দয়া করে যেন “ঝামেলা, স্ট্যাচু” বলে আমাকে বাধা দিয়ো না। তোমাদিগকে ভরসা করা বড়ই কঠিন।’
এই কথা বলে এঁচোড়ে পাকা রোবট রওনা দিল বলের দিকে, আর ঝালাপালা ওকে অনুসরণ করল। এই অদ্ভুত বিপদে কী করবে ওরা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিল না। এই সময় ছোটকা থাকলে খুব ভালো হত! ওরা মনে-মনে ভাবল। ভিড় ঠেলে চক্রব্যূহের ভেতরে ঢোকার সময় লোকজনের নানান মন্তব্য শোনা যাচ্ছিল।
‘মনে হচ্ছে কোনও ফুটবল প্লেয়ারের প্রেতাত্মা ফুটবলটার ওপরে ভর করেছে।’
‘বলটার ভেতরে কোনও স্প্রিং ফিট করা নেই তো!’
‘বলটার ভেতরে মনে হয় কোনও বাচ্চা ক্যাঙারু ঢুকে পড়েছে।’ ওরা তিনজনে মাঝের গোল ফাঁকা জায়গাটায় পৌঁছে থমকে দাঁড়াল। ঝামেলা লক্ষ করল, নানান মানুষজনের ভিড়ে বেশ কয়েকটা রোবটও দাঁড়িয়ে আছে। তারাও হাঁ করে লাফানো বলের কাণ্ডকারখানা দেখছে।
হঠাৎই ষোলো-সতেরো বছরের একটা মোটাসোটা ছেলে ছুটে গেল বলটার দিকে। বলটা তখন নীচে নেমে আসছিল। বলটা ড্রপ খাওয়ামাত্রই ছেলেটা একটা চিৎকার করে বলটাকে জাপটে ধরল।
আর সঙ্গে-সঙ্গেই অদ্ভুত একটা কাণ্ড হল।
ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়েই বলটা লাফিয়ে উঠল শূন্যে। আগের মতোই তিনতলার সমান উচ্চতায় পৌঁছে গেল অনায়াসে।
মাঠের কৌতূহলী দর্শকরা প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠল। সেই চিৎকার ছাপিয়ে
কে পল্টু আকাশ থেকে এই পরামর্শ শুনতে পেল কি না বোঝা গেল না। তবে স্পষ্ট দেখা গেল, ওর মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। আর ও প্রাণপণে বলটাকে আঁকড়ে ধরে আছে।
যেন ডেকে বলল, ‘পল্টু, ভয় পাস না। বলটাকে চেপে ধরে রাখ।’
এইবার বলটার নেমে আসার পালা ।
পল্টুসমেত বলটা নেমে আসতে লাগল।
অত উঁচু থেকে মাটিতে এসে পড়লে পল্টু যে আর আস্ত থাকবে না সেটা সকলেই বুঝতে পারল। এমনকী ঝামেলাও। তাই বাচ্চা রোবটটা কখন যেন এগিয়ে গেছে লাফিয়ে ওঠা বলটার ঠিক নীচে। তারপর বল এবং পল্টু যখন নেমে এল তখন পঞ্চাশ কেজি ওজনের ঝামেলা ওর ইস্পাতের লিকলিকে হাত পেতে ক্যাচ লোফার মতো লুফে নিল পল্টুকে।
চারপাশ থেকে এমন চিৎকারের রোল উঠল যেন শচীন তেন্ডুলকর শোয়েব আখতারের ছ’বলে ছ’টা ছক্কা হাঁকিয়েছে।
ঝামেলা পল্টুকে বাঁচাল বটে কিন্তু বলটাকে ধরে রাখতে পারল না। বল ওর হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে আবার উঠে গেছে শূন্যে।
ছ’-সাতজন ছেলে ছুটে গেল পল্টুর কাছে। ও তখন মাটিতে অসাড় হয়ে শুয়ে আছে—বোধহয় এত ভয় আর টেনশনে অজ্ঞান হয়ে গেছে। ঝামেলা শূন্যে লাফানো বলটাকে কয়েকপলক দেখল। তারপর হেলেদুলে ফিরে এল ঝালা-পালার কাছে। ন্যাড়ামাথা এপাশ-ওপাশ নেড়ে মিহি গলায় বলল, ‘কেস একেবারে নটবর। কিচ্ছু করার নেই। ছোটকাবাবুকে দ্রুত অফিসে ফোন করিয়া দাও। আমি লম্ফমান বলের নিকটে হার মানিলাম।’
ঝালা-পালাও বুঝল গতিক সুবিধের নয়। তাই ওরা ঝামেলাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে বলে ছুটল ছোটকাকে ফোন করতে।
একটা পেল্লায় মাপের জিপে চড়ে ছোটকা যখন ‘অকুস্থলে’ এসে হাজির হল তখন বিকেলের আলো মরে এসেছে। কিন্তু লম্ফমান ফুটবল তার গুরুত্বপূর্ণ কাজে এতটুকুও ক্ষান্তি দেয়নি।
ছোটকার সঙ্গে নানান যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট। কালো রোগা চেহারার ছোটখাটো মানুষ। ছোটকা তাকে ‘বর্মন’ বলে ডাকছিল।
চন্দ্র আর ইন্দ্র টেলিফোনেই গোটা ব্যাপারটা ছোটকাকে জানিয়েছিল। ছোটকা সব শুনে ওদের সাবধান করে দিয়ে বলেছে, ‘তোরা সবাই চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে থাক। বলটাকে মোটেই ডিসটার্ব করবি না। আমি অফিস থেকে লোকজন আর যন্ত্রপাতি নিয়ে যাচ্ছি। ব্যাপারটা খুব পিকিউলিয়ার ফেনোমেনন।’
ছোটকাকে লটবহর নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে ভিড় করে থাকা লোকজন গলা ফাটিয়ে হইহই করে উঠল।
ঝামেলা ‘ফুজিয়ামা! ফুজিয়ামা!’ বলে হেলেদুলে লাফাতে লাগল। ওর কপালের লাল-নীল-হলুদ বাতিগুলো দপদপ করে জ্বলতে-নিভতে লাগল। খুব খুশি হলে অথবা উত্তেজিত হলে ঝামেলা এইরকম করে। জাপানের আগ্নেয়গেরির সঙ্গে ওর উল্লাসের যে কী সম্পর্ক তা ও-ই জানে!
ছোটকার নানান সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ চলতে লাগল। সকলে একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে ছোটকার কার্যকলাপ খুঁটিয়ে লক্ষ করতে লাগল।
ছোটকা একটা যন্ত্র চোখে দিয়ে বলটাকে ভালো করে দেখল। সবুজ রঙের কী একটা রশ্মি ফেলল বলটার গায়ে। তারপর সেটাকে লক্ষ্য করে খুদে-খুদে এক ঝাঁক মিসাইলের মতো কী যেন ছুড়ে দিল।
কিন্তু কোনওটাতেই কোনও ফল হল না। বলটা একরোখাভাবে লাফাতেই লাগল ।
ঝামেলা ভেবেছিল ছোটকা বলটাকে থামাতে পারবে। কিন্তু ছোটকাকে ব্যর্থ হতে দেখে সে ‘ফোঁসফোঁস’ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল আর বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘আমার বুকফাটা দীর্ঘশ্বাসগুলি যথেষ্ট সুদীর্ঘ হইতেছে না।’ ধীরে-ধীরে সন্ধের ছায়া নেমে এল মাঠে।
ছোটকা বর্মনকে যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিয়ে জিপে উঠতে বলল। তারপর জমায়েত মানুষজনকে লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনারা যে যার বাড়ি চলে যান। এ-লাফানি সহজে থামবে না। নিজে থেকেই যেমন আচমকা শুরু হয়েছিল, দেখবেন, নিজে থেকেই হঠাৎ থেমে যাবে।’
‘তা বলে সারা রাত ধরে বলটা একা-একা অমন লাফাবে?’ ইন্দ্ৰকান্ত জিগ্যেস করল।
‘তাতে তোর কী!’ ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল ছোটকা।
ওরা যখন দল বেঁধে বেরিয়ে আসছিল তখন মাঠের চারপাশে নানা জায়গায় লাগানো ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে।
সেই মলিন আলোয় ফুটবলটা দিব্যি একমনে লাফিয়ে চলেছে।
ঝালা-পালা আর ঝামেলাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ছোটকাকে ভীষণ আনমনা দেখাচ্ছিল। বোধহয় বল লাফানোর রহস্যের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিল। ঝামেলা হঠাৎই ছোটকার দিকে মুখ তুলে বলল, ‘বল উল্ল – উল্ল উল্ল—।’
‘উল্লম্ফন।’ ছোটকা ওকে ধরিয়ে দিল ।
‘হ্যাঁ, বল উল্লম্ফনের পশ্চাতে প্রেতাত্মার কোনওরূপ ইয়ে নাই তো?’ এ-প্রশ্নে ছোটকা হাসল না। বরং বেশ সিরিয়াস মুখে বলল, ‘এইভাবে লাফানোর একটাই মাত্র কারণ থাকতে পারে…।’
‘কী কারণ?’ ঝালা-পালা একসঙ্গে প্রশ্ন করল।
‘কোথাও থেকে এনার্জি এসে ঢুকে পড়ছে বলটার ভেতরে। তোরা তো জানিস, একটা বল লাফাতে শুরু করলে ক্রমশ তার লাফের মাপ কমতে থাকে। এইভাবে লাফানোর উচ্চতা কমে যাওয়ার অনেক কারণ আছে : যেমন, ঘর্ষণ, মাধ্যাকর্ষণ, বাতাসের বাধা। ফলে, শুরুতে যে-শক্তি নিয়ে বলটা লাফাতে শুরু করে, এইভাবে শক্তি খরচের জন্যে ক্রমেই তার লাফানোর শক্তি কমতে থাকে। যদি বাইরে থেকে কোনওভাবে ক্ষয়ে যাওয়া শক্তিটুকু সাপ্লাই করা যায়, তা হলে বলটার লাফের উচ্চতা আর একটুও বদলাবে না। শুধু ওটার কাইনেটিক এনার্জি পালটে যাবে পোটেনশিয়াল এনার্জিতে, আবার পোটেনশিয়াল এনার্জি পালটে যাবে কাইনেটিক এনার্জিতে। এইভাবে গতিশক্তি আর স্থিতিশক্তির রূপবদল হয়। তবে লাফানোর সময় যে-কোনও পজিশনে বলটার গতিশক্তি আর স্থিতিশক্তির যোগফল একই থাকে।’
‘বলটাকে ক্ষয়ে যাওয়া এনার্জির জোগান দিচ্ছে কে?’ চন্দ্ৰকান্ত প্রশ্ন করল। ছোটকা খানিকটা আনমনাভাবে বলল, ‘ফানেল দিয়ে যেমন তেল ঢালে, সেইরকমভাবে বলটার মধ্যেও কেউ এনার্জি ঢেলে দিচ্ছে। যেহেতু ব্যাপারটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না, সেহেতু মনে হচ্ছে, ফোর্থ ডায়মেনশনের কোনও একটা বিন্দু থেকে আমাদের থ্রি ডায়মেনশনের দুনিয়ায় একটা এনার্জি টানেল তৈরি হয়ে গেছে। ঠিক আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজের মতো-ব্ল্যাক হোল আর হোয়াইট হোলকে যে-ব্রিজ জুড়ে দেয়। যাক গে, বাদ দে-ওসব বিজ্ঞানের কচকচি তোরা বুঝবি না। শুধু এটুকু বুঝে নে, সেই অদৃশ্য এনার্জি টানেলের একমাথায় আছে একটা উৎস, আর এই মাথায় রয়েছে এই ফুটবলটা। বলটা ফোর্থ ডায়মেনশন থেকে এনার্জি সাপ্লাই পেয়ে চলেছে। তবে টানেলের এ-প্রান্তে বলটা যে কী করে হঠাৎ জুড়ে গেল তা বলতে পারব না। যখন টানেলটা আবার বল থেকে সরে যাবে, তখন এনার্জি সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাবে-তা হলেই বলটা স্বাভাবিক নিয়ম মেনে থামবে। তার আগে নয়।’
‘ওঃ ব্বাবা! একটা বল লাফানোর পেছনে এত কাণ্ড!’ ইন্দ্ৰকান্ত অবাক হয়ে বলল।
ছোটকা গালে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘সত্যি-সত্যি এত কাণ্ড আছে কি না জানি না। আমি শুধু সায়েন্সের দিক থেকে একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলাম।’
ঠিক তখনই ঝামেলা মিহি গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘এইমাত্র একটি চারের সাহায্যে ব্রায়ান লারার সেঞ্চুরি পূর্ণ হইল। ফুজিয়ামা! ফুজিয়ামা!’