সবুজের কান্না
অশোক পত্রনবিশ আমার টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গম্ভীর মুখে বলল, ‘স্যার, একটা কথা বলার আছে।’ অশোক এমনিতে খুব হাসিখুশি যুবক, তা ছাড়া বুদ্ধিমানও বটে। বেশিরভাগ সময়েই সে নিজের অদ্ভুত পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সুতরাং তার এখনকার হাবভাব যে একটু বেমানান তাতে সন্দেহ নেই।
‘বলো, কী বলতে চাও।’ কৌতূহলী চোখে অশোকের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম।
‘স্যার…একটা গাছকে কেউ কষ্ট দিচ্ছে। যন্ত্রণায় সেটা চিৎকার করছে, ছটফট করছে। আমার যন্ত্রে সব ধরা পড়েছে।’ অশোক পত্রনবীশের কণ্ঠস্বর আবেগে থমথম করছে।
আমি অর্ধেক অবিশ্বাস ও অর্ধেক সংশয় নিয়ে চুপ করে রইলাম। বিপদগ্রস্ত গাছকে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই তৈরি হয়েছে আমাদের সরকারি সংগঠন—‘সবুজ সংরক্ষণ সংস্থা’। আমি এই সংস্থার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর।
সবুজ নিয়ে সংকট প্রথম দেখা দিয়েছিল বিংশ শতাব্দীতে। কলকারখানা, যানবাহন, তেজস্ক্রিয় আবর্জনা ইত্যাদির প্রকোপে সজীব গাছপালা ক্রমশ নির্জীব হয়ে পড়তে থাকে। তার ওপরে ছিল আমাদের এই সভ্যতার দুরন্ত গতিবিস্তার। ফলে লক্ষ-লক্ষ অক্সিজেনদায়ী গাছ ধরাশায়ী করা হয়েছে নিষ্ঠুরভাবে। যখন মানুষ বুঝতে পারল গাছ তাদের একান্ত বন্ধু, যাকে ছাড়া তাদের সভ্যতা শেষও হয়ে যেতে পারে, তখন তারা উঠে-পড়ে উদ্যোগী হল সবুজ সংরক্ষণে। সরকারের তরফ থেকে জনসাধারণের কাছে অনুরোধ করা হতে লাগল, তারা যেন সুযোগ পেলেই ‘বৃক্ষরোপণে উৎসাহী’ হয়। সে-যুগের একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী অঙ্ক কষে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, একটা গাছ সারা জীবনে মানব সভ্যতার যে-উপকার করে, তার দাম বেশ কয়েক লাখ টাকা। এরকম নানান প্রচেষ্টায় জনসাধারণের কিছু অংশকে সচেতন করা গেলেও বিপদের বড় অংশটা থেকে গেল। মানুষ খুশিমতো গাছ কাটছে, পাতা ছিঁড়ছে, ফুল ছিঁড়ছে। এর ওপর সমস্যা পরিবেশ দূষণের। সুতরাং সবদিক বিবেচনা করে সরকারি উদ্যোগে তৈরি হল ‘সবুজ সংরক্ষণ সংস্থা’। শহর ও শহরতলির প্রতিটি এলাকায় এর অফিস রয়েছে। আর সঙ্গে রয়েছে নতুন মহাকাশ-যুগের নতুন-নতুন সব যন্ত্রপাতি। ফলে কেউ সরকারি অনুমোদন ছাড়া কোনও গাছের ক্ষতি করছে, এ-খবর পেলেই আমরা সরাসরি সেই অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারি। নতুন সবুজ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী নিজের বাগানের গাছেরও কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। সুতরাং আমরা যথাসম্ভব নিজেদের কর্তব্য করে যাচ্ছিলাম। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাস—প্রতিদিন অন্তত বারচারেক অতি সূক্ষ্মভাবে মেপে, বা বাতাসের গতিবিধির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আমরা আঁচ করার চেষ্টা করি, সবুজের ক্ষতি করে সরকারি আইন কেউ লঙ্ঘন করছে কি না। এরই মধ্যে এক নতুন অফিসার যোগ দিয়েছে আমাদের সংস্থায়। নাম তার অশোক পত্রনবিশ। সে নাকি গাছপালার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্যে একাই গবেষণা করে। গাছের কথা শোনার জন্যে, গাছের অভিব্যক্তি ও আচরণ বোঝার জন্য সে নানান পদ্ধতিতে চেষ্টা করছে। কখনও ইলেকট্রনিক পদ্ধতি, কখনও বা টেলিপ্যাথি। এই মুহূর্তে সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে চাইছে, একটা গাছের আর্তনাদ তার যন্ত্রে ধরা পড়েছে। তবু ভালো যে টেলিপ্যাথিতে ধরা পড়েনি, কারণ টেলিপ্যাথি জিনিসটাই আমার মতে ডাহা বুজরুকি—তার ওপর আবার গাছের সঙ্গে!
কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর আমি অশোককে প্রশ্ন করলাম, ‘গাছটা কোন জায়গায় আছে বুঝতে পেরেছ?’
আমার প্রশ্নে অশোক উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠল, ‘উত্তর-পূর্ব দিকে দু-তিন মাইলের মধ্যে, স্যার। আমার টেলিপলিগ্রাফ যন্ত্রে যেটুকু ধরা পড়েছে তাতে মনে হচ্ছে গাছটা ব্যথা পাচ্ছে, তার কষ্ট হচ্ছে। গ্রাফে সংকেতের কাঁপা-কাঁপা ছবি দেখে যা বুঝেছি, তাতে গতকাল ভোর থেকে কেউ সেটাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে—দিনে প্রায় সাত-আটবার করে।’
এ আবার কেমন লোক যে গাছকে ইচ্ছে করে যন্ত্রণা দেয়, যন্ত্রণা দিয়ে আনন্দ পায়! অশোক পত্রনবিশ কি পারবে এই অত্যাচারীকে খুঁজে বের করতে?
একটু চিন্তিতভাবেই বললাম, ‘তা তুমি এখন কী করবে ঠিক করেছ?’ অশোক বলল, ‘একটা মানিপ্ল্যান্ট আর আমার টেলিপলিগ্রাফ নিয়ে গাড়ি করে বেরিয়ে পড়ব।
‘মানিপ্ল্যান্ট! মানিপ্ল্যান্ট দিয়ে কী হবে?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলাম। অশোক ছোট্ট করে হাসল, বলল, ‘স্যার, মানিপ্ল্যান্ট জাতীয় বড়-বড় পাতাওয়ালা কোনও লতানো গাছ আমার টেলিপলিগ্রাফের অ্যান্টেনা হিসেবে কাজ করতে পারে। আহত গাছটার যন্ত্রণা-তরঙ্গ প্রথমে ধরা পড়ে মানিপ্ল্যান্টের ভেতর। তখন ওই লতানে গাছটা নিজেই ছড়িয়ে দেয় এক সহানুভূতিশীল প্রতিক্রিয়া তরঙ্গ। সেটা আমার টেলিপলিগ্রাফ তার রেকর্ডারের চার্টে এঁকে ফেলে।’
আমি ক্রমশ যে অবাক হচ্ছিলাম সেটা বোধহয় অশোকের চোখে ধরা পড়ল। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘অন্য কোনও মানুষের যন্ত্রণার চিৎকার শুনলে আমাদের মনে যেমন সহানুভূতির সৃষ্টি হয়, এটাও অনেকটা সেই ধরনের, স্যার। …যাই হোক, যতই আমরা গাড়ি নিয়ে লক্ষ্যের দিকে এগোব, টেলিপলিগ্রাফের সিগন্যাল ততই জোরদার হয়ে উঠবে।’
গাছের অনুভূতি আছে। এটা গত শতাব্দীর বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু প্রমাণ করে গেছেন। সেই কারণেই কি অশোক গাছকে অনুভূতিশীল প্রাণী বলে সম্মান করে? গাড়িতে তার সঙ্গী থাকবে মানিপ্ল্যান্ট। সেইজন্যই কি সে বলল, “…যতই আমরা গাড়ি নিয়ে এগোব…।’
টেবিলে বারকয়েক টোকা মেরে আমি বললাম, “ঠিক আছে, তুমি তোমার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাও। কাল তোমার সঙ্গে এ-বিষয়ে কথা বলব।’
অশোক সামান্য হতাশ হয়ে চলে গেল। আমি বসে-বসে ভাবতে লাগলাম, কী করা যায়। পত্রনবিশের কাজে আমি খুব একটা বাধা দিই না, কারণ ছেলেটির প্রতিভা আছে। কিন্তু এইমাত্র যা শুনলাম সেটা যে বিশ্বাস করা শক্ত। সে সরাসরি কারও দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলবে, ‘নমস্কার, আপনি কি কোনও গাছের ওপর অত্যাচার করছেন?’ এটা ভাবতেই আমার আশঙ্কা হচ্ছে। কারণ, অপরাধ প্রমাণ করতে না পারলে সেই লোক আমাদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে পারে।
ভাবনাচিন্তায় কতক্ষণ সময় কেটেছে জানি না, হঠাৎই ভিডিয়োফোনে স্থানীয় নিরাপত্তা বিভাগের ক্যাপ্টেনের ছবি ফুটে উঠল। তিনি জানালেন, এক ভদ্রমহিলা সিকিওরিটি বিভাগে এক অদ্ভুত অভিযোগ করেছেন। তাঁর প্রতিবেশীর বাগান থেকে নাকি গাছের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। গাছটা যন্ত্রণায় কাঁদছে, প্রাণপণ আর্তনাদ করছে। মহিলার পক্ষে ঘরে বাস করাই দায় হয়ে উঠেছে। তাঁর মতে, চিৎকারটা দেবদারু গাছের কান্না। স্বভাবতই নিরাপত্তা বিভাগ তদন্তে রাজি হয়নি। তারা এই কেস তুলে দিচ্ছে সবুজ সংরক্ষণ সংস্থার হাতে—অর্থাৎ, আমাদের হাতে।
খবরটা পেয়ে মনে-মনে হাসিই পেল আমার। এই মামলাটা হাতে পেলে অশোক নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। একটু আগে সে তো এই ধরনেরই একটা অভিযোগ এনেছিল আমার কাছে। মনে হল, ওই ভদ্রমহিলার মেজাজের সঙ্গে অশোক পত্রনবিশের মেজাজ বেশ খাপ খাবে। সুতরাং তক্ষুনি তাকে ডেকে কাজের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলাম। সে মোবাইল ইউনিট নিয়ে রওনা হয়ে গেল।
অফিস বন্ধ হওয়ার সময়, সন্ধে সাতটা নাগাদ, অশোক পত্রনবিশ ফিরে এল। প্রচণ্ড উত্তেজনায় তার মুখ লালচে দেখাচ্ছে। টেলিপলিগ্রাফের সাদা চার্টটা সে আমার চোখের সামনে মেলে ধরল। তাতে শুধু একটা আঁকাবাঁকা রেখা, মাঝেমাঝে ওপরে নীচে লম্বা-লম্বা খোঁচা রয়েছে। গাছের যন্ত্রণার তরঙ্গ।
চার্টটা দেখিয়েই পত্রনবিশ একেবারে ফেটে পড়ল, ‘স্যার, লোকটার নাম হরিচরণ চক্রবর্তী। একটা আস্ত দাগি শয়তান! দেখেছেন চার্টটা, গাছটাকে নিয়ে কী অত্যাচার সে করছে! যে করে হোক লোকটাকে জেলে পুরতেই হবে!’
আমি একটু ক্লান্তভাবেই বলতে গেলাম যে, এখন থাক, আগামীকাল বিস্তারিত কথা হবে। কিন্তু আমার মনের অবস্থা বা অভিব্যক্তিকে একটুও আমল না দিয়ে অশোক এক নিশ্বাসে বলে চলল, ‘এখন মনে পড়ছে, এই লোকটা কয়েক সপ্তাহ আগে আমার ল্যাবরেটরি দেখতে এসেছিল। তখন আমাকে পনেরো মিনিট ধরে নানান প্রশ্ন করেছিল। বিশেষ করে জানতে চেয়েছিল, কী করে গাছের প্রতিক্রিয়ার সাইকো-সিগন্যাল মাপা যায়। এখন সেইসব তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে সে নিজের বিকৃত উল্লাস মেটাচ্ছে। আর বেচারা দেবদারু গাছটার কী করুণ অবস্থা!’
দেবদারু গাছের করুণ অবস্থা! বেশ বুঝতে পারছি গাছের সঙ্গে অশোকের একটা আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে।
হাতের চার্টটা আবার তুলে ধরল অশোক। বলল, ‘এই রেকর্ডিং চাৰ্টটা আমি তৈরি করেছি ওই ভদ্রমহিলার বাড়িতে গিয়ে। এই যে লম্বা-লম্বা খোঁচাগুলো দেখছেন, এগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছে হরিচরণ কখন-কখন গাছটার ওপরে অত্যাচার করেছে। ঘণ্টাদুয়েক আমি সেখানে ছিলাম। তার মধ্যে একবার গাছের ছাল তুলেছে ছুরি দিয়ে। গাছের পাতা অ্যাসিডে ডুবিয়ে পুড়িয়েছে। আর সবশেষে— এই যে, সবচেয়ে লম্বা যে-খোঁচাটা, এটা রেকর্ড করেছি যখন হরিচরণ গরম লোহার শিক চেপে ধরেছে গাছের গুঁড়িতে। লোকটা নির্ঘাত এক ভয়ঙ্কর পাগল!’ নানান তথ্যে দিশেহারা হয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘কিন্তু অশোক, ভদ্রমহিলা তো রিপোর্ট করেছিলেন যে, তিনি গাছের কান্না শুনেছেন!
‘এসব ওই শয়তান হরিচরণের কীর্তি।’ অশোক ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, ‘গাছের পাতার সঙ্গে ইলেকট্রনিক পিক-আপ লাগিয়ে আমি যেমন টেলিপলিগ্রাফ যন্ত্রে সিগন্যাল রেকর্ড করি, সেও অনেকটা তাই করেছে। শুধু টেলিপলিগ্রাফের বদলে একটা অ্যাম্পলিফায়ার আর স্পিকার লাগিয়ে দিয়েছে। তারপর হরেক কারিকুরি করে এমন করেছে যাতে আহত হলেও গাছের অনুভূতি মানুষের কান্নার মতো শব্দের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে।’
‘কিন্তু কী করে হরিচরণকে শায়েস্তা করা যায়? যদি আমরা তার বাড়িতে হানা দিই তা হলে সে তো সমস্ত প্রমাণ লোপাট করে ফেলবে—।’
আমার কথায় অশোক কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘আমি একটা পথ ভেবেছি, স্যার। আজ রাতটা অফিসের ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে পারলে ভালো হয়। কাল সকালে হরিচরণ চক্রবর্তীর ব্যবস্থা করছি।’
আমি হেসে বললাম, ‘স্বচ্ছন্দে থাকতে পারো। আমার কোনও আপত্তি নেই। আশা করি, তুমি হরিচরণকে এমন শায়েস্তা করবে যাতে সারাজীবন সে গাছের গায়ে হাত দিতে পর্যন্ত ভয় পায়।’
এ-কথা বলে আমি অফিস ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।
পরদিন বিকেলে অশোক পত্রনবিশ আমার কাছে এল। চোখে-মুখে খুশি উপচে পড়ছে। খুশি আমিও। কারণ, একটু আগেই নিরাপত্তা বিভাগ থেকে খবর পেয়েছি। সুতরাং অশোক কিছু বলে ওঠার আগে আমিই তাকে সুখবরটা শোনালাম। বললাম, ‘অশোক, এইমাত্র খবর পেলাম আমাদের হরিচরণ চক্রবর্তী সটান নিরাপত্তা বিভাগে গিয়ে হাজির হয়েছে। কাঁদতে-কাঁদতে তাদের জানিয়েছে সে গাছের ভয়ে পালাচ্ছে। একটা দেবদারু গাছ নাকি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে তাকে তাড়া করেছে। সে নিরাপত্তা বিভাগে আশ্রয় চায়। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড কী জানো! হরিচরণ বলেছে, গাছটা তাকে মানুষের ভাষায় কথা বলে শাসিয়েছে। এখন তাকে মানসিক চিকিৎসার জন্যে হসপিটালে পাঠানো হয়েছে। ওঃ, আমাদের ঝামেলা তা হলে মিটল।’
আমি থামতেই অশোক হেসে বলল, ‘স্যার, আমার পরীক্ষা বেশ ভালোই কাজ দিয়েছে। আসলে, ঠিক যে-কম্পাঙ্কে হরিচরণ গাছের কান্না শুনছিল সেই কম্পাঙ্কটা আমি পরীক্ষা করে বের করি। তারপর একটা ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ওই দেবদারু গাছের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি। আজ সকালে হরিচরণ যেই একরাশ উইপোকা গাছটার গুঁড়ির ওপর ছেড়ে দিয়েছে, অমনই আমি ট্রান্সমিটারে কথা বলি। গাছের চিৎকারের স্বরের সঙ্গে মিল রেখে ওকে ভয় দেখাই। বলেছি, মাথায় ভেঙে পড়ে ওকে শেষ করে দেব। গাছের রস থেকে তার ক্যান্সার হতে পারে। তা ছাড়া, প্রতি মুহূর্তে আমি ওকে তাড়া করব বলে প্রতিজ্ঞা করেছি। প্রথমত, দেবদারু গাছের কাছ থেকে মানুষের ভাষায় কথা শুনেই হরিচরণ দারুণ ভয় পেয়ে যায়। তার ওপর যখন ওইসব ভয় দেখিয়েছি তখন আর সে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। সোজা গিয়ে সারেন্ডার করেছে।’
অশোকের কথা শেষ হতে আমি বললাম, ‘হরিচরণ চক্রবর্তী লোকটা শয়তান হলেও তার প্রতিভা ছিল। আচ্ছা, অশোক, সত্যিই কি কোনও গাছ মানুষের ওপরে প্রতিশোধ নিতে পারে?’
অশোক উত্তর দিল, ‘না, স্যার। আমাদের ব্রেনের মতো গাছের কোনও সেন্ট্রাল কন্ট্রোল সিস্টেম নেই। ওদের একটা কোষ থেকে আর একটা কোষে খবর আদানপ্রদান হয় ঠিকই, কিন্তু ওরা চিন্তা করতে পারে না, বা ডালপালা ইচ্ছেমতো নাড়াতে পারে না।’
অশোক পত্রনবিশের বুদ্ধি ও প্রতিভা আমাকে সবসময়েই অবাক করে, এখনও করল। কিন্তু একটা প্রশ্ন বরাবর আমার মনে খোঁচা দিয়ে চলেছে যার উত্তর আমি এখনও পাইনি। সুতরাং সুযোগ পেয়ে সেই প্রশ্নটা করলাম অশোককে, ‘অশোক, একটা কথার জবাব দাও তো। নিরাপত্তা বিভাগের খবর আসার আগেই তুমি কেমন করে ওই দেবদারু গাছের কান্নার খবর পেলে?’
অশোক নরম সুরে বলল, ‘স্যার, আগেই তো বলেছি, গাছেরা পরস্পরের মধ্যে অনুভূতি আদানপ্রদান করতে পারে। তবে আহত গাছের খুব কাছাকাছি যেসব গাছ থাকে তারাই সহানুভূতিবশত প্রতিক্রিয়া দেখায় বেশি। বড়-বড় পাতাওয়ালা লতানে গাছ এসব ক্ষেত্রে খুব ভালো অ্যান্টেনার কাজ করতে পারে। আপনি তো জানেন, স্যার, আমার বাড়িতে একটা ছোট্ট বাগান আছে। সেখানে লতানে লাউ গাছের পাতাই আমাকে দেবদারু গাছের বিপদের কথা প্রথম জানিয়ে দেয়।’
অশোক বিদায় নিয়ে চলে গেল। এই প্রথম আমি ওর নামটা ভালো করে খতিয়ে দেখলাম : অশোক পত্রনবিশ। শব্দ দুটো যেন গাছের সঙ্গে তার ঘন আত্মীয়তার ইঙ্গিত দেয়।