বিজ্ঞানের মাঝে জীবন

বিজ্ঞানের মাঝে জীবন

১৯৯৮ সালে ভারতে, পোখরায় দ্বিতীয়বারের মতো পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো হয়। এই পরীক্ষায় আমি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখি। এই পরীক্ষণের পর আমাকে বিভিন্ন উপাধি দেওয়া হয়। এই উপাধিগুলোর একটা আমার নামের সাথে বহু বছর ধরে জুড়ে দেওয়া হয়। এমনকি আমার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবার পরও। সেই উপাধি হলো ‘মিসাইল ম্যান’। আমাকে যখন এই উপাধিতে সম্বোধন করা হয়, তখন আমার অনেক মজা লাগে। এই উপাধির কারণে একজন বিজ্ঞানীর বদলে নিজেকে বাচ্চাদের সুপার-হিরো বলে বেশি মনে হয়। তবে সেটা কোনো ব্যাপারই নয়। এই দেশের বহু লোক, এই উপাধি দ্বারা আমার প্রতি তাদের ভালোবাসা এবং সম্মানের প্রকাশ করে থাকে। আর একই সাথে এই উপাধির মাধ্যমে বিজ্ঞানের জগতে এবং রকেট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জগতে আমি নিজের আলাদা স্বত্বা খুঁজে পাই। তাই আমার কাছে এই উপাধি এক ধরনের প্রতীকের মতো।

বিজ্ঞানের জগতে আমার এই যাত্রা বহু আগে শুরু হয়। আমাকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এই পথ এতটাই দীর্ঘ যে, মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে ভাবি, আমার জীবন কি আসলেই এতটা ঘটনাবহুল? নাকি আমি কোনো গল্পের বই পড়ছি। তবে এ সবই সত্য। কোনো কল্পনা নয়। এই দীর্ঘ পথের কারণেই আমি একজন সফল ব্যক্তি হতে পেরেছি, যে বিজ্ঞানের পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আর এই দীর্ঘ পথের কথা যখন আমি স্মরণ করি তখন নিজেকে একটি নৌকায় দেখতে পাই। যে উৎস থেকে যাত্রা শুরু করে স্রোতের অনুকূলে এগিয়েই যাচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছানোর আগ পর্যন্ত এগিয়েই যাচ্ছে। নিজের জীবনের পথ খুঁজে বেরাচ্ছে।

আমার প্রকৃত শিক্ষা শুরু হয়, রামেশ্বরাম ত্যাগ করার পর। যখন আমি হাই স্কুলে পড়ালেখা করার জন্য রামনাথপুরে চলে আসি। আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, সেবারই প্রথম আমি রামেশ্বরামের বাইরের জগতে প্রবেশ করি। রামেশ্বরামের পরিবেশ, আমার মা এবং পরিচিত সকল কিছু থেকে দূরে। আমি তখন আর পাঁচ-দশটা ছোট শহরে মানুষ হওয়া ছেলের মতোই লাজুক ছিলাম। কথা বলতে ভয় লাগত।

রামনাথপুরের Schwartz High School এই প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানের অসামান্য অবদানগুলোর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। আর আমার কাছে এই অবদানগুলো এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হয় যে, আমার তা বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি। সেই স্কুলে একজন শিক্ষক ছিল। তার নাম রেভেরেন্দ ইয়াদুরাই সলোমন। তার সাথে আমার গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। সেই সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের বিশ্বাস বিদ্যমান ছিল। তার মাঝে আমি একজন পথ-প্রদর্শকের ছায়া দেখতে পেতাম। যে আমাকে সামনে এগোবার পথ বাতলে দেবে।

আমি পাখিদের আকাশে ওড়া দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে এই দৃশ্য দেখতাম। আমার কোনো ক্লান্তি ছিল না। পাখিদের ওড়ার ধরণ, তাদের গন্তব্য সবই আমি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতাম। এই পাখিদের দেখতে দেখতেই খুব ছোট বয়স থেকেই আমার মাঝে আকাশে উড়ে বেরানোর আকাঙ্ক্ষার জন্ম নেয়। একদিন আমি আকাশে উড়ে বেরানো নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা পড়ছিলাম। এমন সময় আমাদের শিক্ষক মি. সলোমন আমাদের কিছু ছাত্রকে সমুদ্র তীরে নিয়ে এলেন। সেখানে তিনি আমাদেরকে আঙুল তুলে কিছু পাখি দেখালেন। আমরা সবাই সমুদ্র তীরে দাঁড়িয়ে, আমাদের কানে আসছে সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন। সেই গর্জন ছাপিয়ে কানে আসছে, বক এবং সিগালের মায়াবি কান্না। তারা আকাশের বহু উপর দিয়ে উড়ে বেরাচ্ছে।

আমাদের শিক্ষক এই পাখির উড়ে বেরানোর কায়দার দিকে নির্দেশ করে আমাদের অ্যারোডিনামিক্স, অ্যারোনেটিকাল ডিজাইন জেট স্টিম এবং এয়ার ফ্লোস ব্যাখ্যা করলেন। আমাদের মোট ১৫ জনের একটি দলকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন। আমিও তার একজন ছিলাম। এবং আমার কাছে এই ক্লাসটি ছিল বিজ্ঞান নিয়ে এ-যাবৎ করা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস। আমার কাছে যা ছিল বিস্ময় এবং আকর্ষণের ব্যাপার, তা নিখুঁতভাবে আমার কাছে ব্যাখ্যা করা হচ্ছিল। পরিষ্কার ব্যাখ্যা। আমার কাছে মনে হলো, এতদিন আমার সামনে এক স্তর মেঘ জমেছিল। আজ সে মেঘের স্তর সরে গেছে। আমি আমার জ্ঞান- পিপাসু চোখ দিয়ে পরিষ্কারভাবে আমার সামনের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। আমি আরও জানতে চাচ্ছিলাম। আমার তৃষ্ণা তখনও মেটেনি।

.

আমি স্কুল ছেড়ে কলেজে উঠলাম। আমার কলেজের নাম ছিল সেন্ট জোসেফ। আমার জন্য আরও অনেক বিস্ময়কর মুহূর্ত অপেক্ষা করছিল। আমি আগেই অনুধাবন করেছি যে, নিজের মস্তিষ্ক এবং চোখ-কান সব সময় খোলা রাখতে হবে। এভাবে করে আমার মস্তিষ্ক আরো ধারাল হলো এবং আমার মনোযোগ- শক্তিও বৃদ্ধি পেল। তাই এমন কিছুই রইল না, যা আমি শিখতে এবং পর্যবেক্ষণ করতে পারতাম না।

সেন্ট জোসেফ কলেজে প্রফেসর চিন্নাদুরাই এবং প্রফেসর কৃষ্ণমূর্তি সাব- অ্যাটোমিক ফিজিক্সের বর্ণনা দেন। আমার কাছে এই বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ নতুন। আমার কাছে প্রথমবারের মতো ‘ম্যাটার’ এবং ‘ডিকেই’-এর গুপ্ত দুনিয়া উন্মোচিত হলো। আমি এই দুটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করা শুরু করলাম। আমি বিভিন্ন পদার্থের ‘রেডি?-এক্টিভ ডিকেই’ এবং ‘হাফ লাইফ পিরিয়ড’ সম্পর্কে শিখলাম। আমার কাছে এই নতুন ভুবন আগের থেকে অনেকটা ভিন্ন মনে হলো আগের সলিড গঠনের চেয়ে।

আমি বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার দ্বৈততা নিয়েও চিন্তা করলাম। এই দুটি জিনিস কি সত্যিকার অর্থেই একে অন্যের থেকে ভিন্ন (যেমনটা ভাবা হয়ে থাকে)? যদি সাব-অ্যাটোমিক লেভেল সকল পারটিকেলসকে অস্থিতিশীল এবং সংকুচিত করা যায়, তবে মানব জীবন থেকে এগুলোকে কিভাবে দূরে সরানো যাবে?

বিজ্ঞান সকল প্রাকৃতিক ঘটনার উত্তর খুঁজে বেড়ায় আর আধ্যাত্মিকতা আমাদেরকে বুঝতে সহায়তা করে যে, মহাবিশ্বের ঠিক কোথায় আমার অবস্থান। বিজ্ঞান জগতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষণ করে সলিড সম্ভাবনা এবং বিভিন্ন গাণিতিক সূত্র দ্বারা। আর আধ্যাত্মিকতা এর বিশ্লেষণ করে মানুষের মনের গুপ্তপথ উন্মোচনের মাধ্যমে। তার হৃদয় এবং মনের ধারণকৃত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিজের গভীর থেকে গভীরতর স্বত্বার অনুসন্ধানের মাধ্যমে। আমার কাছে ধীরে ধীরে ব্যাপারটা পরিষ্কার হচ্ছিল। ধীরে ধীরে আমি যেই ভুবনে প্রবেশ করছিলাম এবং আমার বাবা আমাকে যে ভুবনের মাঝে গড়ে তুলেছেন, তারা মোটেই একে অপরের থেকে দূরে নয়। তারা নিকটবর্তী এবং এদের মধ্যে যোগ-সংযোগ রয়েছে।

.

কলেজ জীবন শেষে আমি MIT-তে আরনেটিকাল ইঞ্জিনিইয়ারিং নিয়ে পড়ালেখা করি। এখানে দুটো বাতিল এয়ারক্রাফট ছিল। এই এয়ারক্রাফট দুটো দেখে আমি পাইলট হবার স্বপ্ন দেখি।ওড়া-উড়ি নিয়ে আমার আগ্রহ আরো দৃঢ় হয়। মধ যেমন আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়, আমিও তেমনিভাবে এই এয়ারক্রাফট দুটোর প্রতি আকৃষ্ট হতাম। এবং একটা সময় আমি বিশ্বাস করতে শুরু করি, মানুষের তৈরি এই আকাশযানেই আমি আমার ক্যারিয়ার গড়ব। এছাড়া আমি আর কিছুই চাই না।

MIT-এর তিনজন শিক্ষক আমার এ-স্বপ্নের আকৃতি গড়ে দেন। এবং এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের পথ বাতলে দেন। প্রফেসর স্পন্ডার। তিনি একজন অস্ট্রিয়ান। তিনি আমাকে টেকনিক্যাল এরোডায়নামিক্স শেখান। প্রফেসর নরসিংহ রাও। তিনি আমাকে থিওরেটিক্যাল এরোডায়নামিক্স শেখান। প্রফেসর পান্ডালাই। তিনি আমাকে এরোস্ট্রাকচার ডিজাইন এবং অ্যানালিসিস শেখান। এই তিনজন শিক্ষকের কারণেই আমি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, অ্যারোনেটিক্সের জগত কতটা বিচিত্রপূর্ণ হতে পারে। যে সকল বিষয়কে আমরা মুভমেন্ট এবং ফ্লো হিসেবে আখ্যায়িত সেগুলো তাদের কম্পনেন্টসে ভাঙা হয়। আর এর মাধ্যমেই ব্যাখ্যা পাওয়া যায় যে, আকাশে কোনো বস্তু কেন এবং কিভাবে নড়াচড়া করে। আমি ফ্লুইড ডিনামিক্স, মুডস অব মোশন, শক ওয়েভ এবং শক ওয়েভ ড্রাগ-এর জটিল দুনিয়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেলি। একই সময়ে এরোপ্লেন-এর গঠনমূলক বৈশিষ্ট্যগুলো আমার কাছে পরিষ্কার হয়। আমি বাইপ্লেন, মনোপ্লেন, টেইললেসপ্লেন নিয়ে এবং আরো অনেক বিষয় নিয়ে প্রচুর পড়াশুনা করি।

MIT-তে অধ্যয়নকালে এমন অনেক সময় ছিল, যখন আমি বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্র অনুসন্ধান নিয়ে পুরোপুরি নিমগ্ন থাকতাম। এমন সময় দেশের ইতিহাসেও নতুন যুগের সূচনা হয়। আর এই সূচনা হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর মাধ্যমে। তিনি দেশের বিজ্ঞানের ক্ষেত্রগুলোর উন্নয়নের ওপর অধিক জোর দেন। প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই, বিশেষ করে আমি যে প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করছিলাম, এমন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিবর্তন আসছিল। আমি লক্ষ্য করলাম, আমাদের পুরনো ধাঁচের চিন্তা-ভাবনা এবং ধ্যান-ধারণা ছেড়ে নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য অধিক উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।

.

বিজ্ঞান আমাদের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী হবে যখন আমরা জ্ঞান অর্জনের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারব। রামেশ্বরামের আধ্যাত্মিক পরিবেশের মাঝে বড় হওয়ার কারণে আমাকে এমনটা করতে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। তারপরও আমি লক্ষ্য করলাম, আমি ঠিকভাবেই বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার মৌলিকতার ওপর প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিতে পারছি। আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না, আমরা যা কেবল আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করতে পারি কেবল তাই সঠিক, বাকি সব মিথ্যা।

আমি এমন একটি পরিবেশে বেড়ে উঠেছি, যেখানে আমাকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, সত্য, এই বাস্তবিক জীবনের বাইরে অবস্থান করে। আধ্যাত্মিক ভুবনে। আর প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব আত্মনুসন্ধানের মাধ্যমে। তবে আমি ধীরে ধীরে এমন একটি জগতের অংশে পরিণত হচ্ছিলাম, যে জগত প্ৰমাণ, পরীক্ষণ এবং সূত্র নির্ভর। তবে শেষপর্যন্ত এই বিষয়ে আমি নিজের ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। কিন্তু এই ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে আমার অনেকটা সময় লেগেছে। বেশ কয়েক বছর সময়।

অবশেষে আমি MIT-তে থেকে একজন ইঞ্জিনিয়ারের মর্যাদা পাই। এবং MIT জীবনের ইতি টানি। তবে তখনও রকেট এবং মিসাইল নিয়ে আমার অনেক কিছু শেখা বাকি। কারণ এই রকেট এবং মিসাইলের জগতেই আমি আমার ক্যারিয়ার গড়তে চলেছি। আমি তখন কেবল এটুকুই জানতাম যে, আমার সামনে পুরো দুনিয়াটা পড়ে আছে। আমার এই দুনিয়ায় অনুসন্ধান করে বেরাতে হবে। আর আমি সংকল্পবদ্ধ ছিলাম, আমি এই দুনিয়ার আকাশে উড়ে বেরানোর মাধ্যম অনুসন্ধান করব।

DTD&P (Air)-এ কয়েক বছর কাজ করার পর আমি ব্যাঙ্গালোরের Aeronautical Development Establishment (ADE)-এ কাজ করি। DTD&P (Air)-এ মূলত আমার কাজ ছিল, বিভিন্ন সিস্টেম ডিজাইন এবং নির্মাণ করা। আর এই সকল সিস্টেমের মধ্যে ভারটিকাল ল্যান্ডিং থেকে শুরু করে টেকঅফ প্লাটফর্ম-এমনকি হট ককপিঠ নির্মাণও অন্তর্ভুক্ত। তবে Aeronautical Development Establishment (ADE)-এ এসে আমি বুঝতে পারলাম, আমার হাতে বড় একটা সুযোগ এসেছে। নতুন কিছু তৈরি এবং পর্যাপ্ত জ্ঞান লাভের সুযোগ, যা আমার ক্যারিয়ার গড়ায় সহায়ক হবে।

Aeronautical Development Establishment (ADE)-এ আমার গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং ইকুয়েপমেন্ট-এর জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে, একটি Ground Equipment Machine (GEM) তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। ADE-এর ডিরেক্টর ড. মেডিরাত্তা, চারজনের একটি ছোট দল গঠন করলেন। তিনি আমাকে এই দলের প্রধানের দায়িত্ব দিলেন। আমাদের দলের জন্য এই GEM তৈরি ছিল বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। এই প্রযুক্তি নিয়ে তেমন কোনো বইপত্রও নেই। এমনকি আমাদের এই প্রযুক্তি তৈরিতে সহযোগিতা করার মতো কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তিও ছিল না। এর আগে এই প্রযুক্তি নিয়ে কোনো ডিজাইন তৈরি হয়নি। তাই আমাদের কাজে লাগার মতো কোনো রেকর্ডও হাতে ছিল না। সত্যি কথা বলতে, আমাদের দলের কাছে নির্দেশ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সফলভাবে এই ফ্লাইং মেশিন তৈরির নির্দেশ এবং আমাদেরকে সময়ের মধ্যেই তা সম্পন্ন করতে হবে। এখন যদি চিন্তা করি তাহলে মনে হয়, আমরা যে ইঞ্জিনিয়াররা এই দায়িত্বে ছিলাম, যারা ফ্লাইং মেশিন তো দূরের কথা, কোনো ধরনের মেশিন নির্মাণেরই বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই, তাদের কাছে এই কাজটি ছিল অসম্ভব এক চ্যালেঞ্জ।

আমাদেরকে প্রজেক্ট শেষ করার জন্য তিন বছর সময় দেয়া হয়। আমাদের প্রথম কয়মাস পার হয় শুধু কি করব, তার ভাবনা-চিন্তা নিয়ে। তবে এক পর্যায়ে এসে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের হাতে যে যন্ত্রপাতি আছে, তা নিয়েই কাজ শুরু করে দিতে হবে। এবং কাজ করতে করতে নতুন কিছুর প্রয়োজন হলে, তা এনে নিতে হবে। মাথার ওপর এত বড় বোঝা থাকা সত্ত্বেও এই প্রজেক্ট আমার খুবই ভালো লেগেছিল। কারণ এই প্রজেক্টে আমি আমার কল্পনাশক্তির পূর্ণ ব্যবহার করতে পারব। পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে আমরা ডিজাইন তৈরি করে নির্মাণ কাজে হাত দিলাম।

এর মাঝে আমি বেশ ইতিবাচক এবং আত্মবিশ্বাসী একজন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছি। তবে তার জন্য আমার বেড়ে ওঠা সেই মধ্যবিত্ত পরিবারের শিকড়কে আমি ভুলে যাইনি। তা আমার মাঝে সর্বদা থেকে যাবে। ধরুন, কাউকে যদি নতুন এক দুনিয়ায় ফেলে আসা হয়, যেখানে তাকে অন্যদের কাজের নির্দেশনা দিতে হবে, সেক্ষেত্রে তাকে জ্যেষ্ঠ সহকর্মীদের সন্দিহান দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তার অবস্থা হবে অনেকটা আগুনে পোড়া লোহার মতো তপ্ত। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল। যারা আমার মতো মিশুক স্বভাবের নয়, বরং লাজুক স্বভাবের এবং ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে এসেছে, যা কোনোক্রমেই তাদের বড় শহরে মানুষ হওয়া সহকর্মীদের সাথে যায় না, তারা আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। যতক্ষণ পর্যন্ত না চাপের সম্মুখীন হয়ে তাদের সবার মাঝে আসতে হয়। আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমাকেও এখন সবার সামনে আনা হয়েছে। আর আমি আমার জ্ঞান এবং সৃজনশীলতা ব্যবহার করে, এই হোভারক্রাফট প্রজেক্টে সফলতা অর্জনের জন্য সংকল্পবদ্ধ ছিলাম।

প্রতিষ্ঠানে এমন অনেক লোক ছিল, যারা এই প্রজেক্টের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। প্রশ্ন তুলেছিল, এর পেছনে এতটা সময় এবং অর্থ ব্যয় করার কারণ নিয়ে। তারা এই প্রজেক্টে আমার জড়িত থাকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল। তবে আমি আর আমার দল সেদিকে কান না দিয়ে আমাদের কাজ করে গেলাম। ধীরে ধীরে এবং ধাপে ধাপে আমাদের প্রোটোটাইপ আকার পেতে লাগল। MIT-তে পড়ার সময় একবার যখন প্রফেসর শ্রীনিভাসন আমার ডিজাইন বাতিল করে দিয়েছিলেন এবং যার কারণে আমাকে আবার সেই ডিজাইন তৈরি করতে হয়েছিল, তখন আমার মস্তিষ্ক যতটা সাবলীলভাবে কাজ করছিল, এবারও তাই হতে লাগল। আমার কাজের গতি সত্যিই অবিশ্বাস্য ছিল। আমি যেরকম করতে চাইছিলাম, ঠিক সেরকমই করতে পারছিলাম। আর একবার যদি আপনি আপনার মস্তিষ্কের দ্বার উন্মোচন করতে পারেন, তবে আর আপনার সামনে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। আর আপনার নিজের প্রতি যে বিশ্বাস জন্মাবে, তা কেউ আপনার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না।

তবে এই প্রজেক্ট কোনো সাধারণ প্রজেক্ট ছিল না। তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভি. কে. কৃষ্ণ মেনন স্বয়ং এই প্রজেক্টের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, ভারতের প্রতিরক্ষার উন্নয়নের সূচনা হবে এই প্রজেক্টের মধ্যদিয়ে। তিনি এক বছর যাবত আগ্রহ নিয়ে আমাদের কাজের তদারকি করলেন। তিনি যখন আমাদের কাজের অগ্রগতির অনুসন্ধান করতে এলেন, তখন তিনি ড. মেডিরাত্তাকে বলেন, ‘কালাম এবং ওর দলের সাফল্য নিশ্চিত।’

হ্যাঁ, আমরা সফল হয়েছিলাম। তিন বছর শেষ হওয়ার আগেই আমাদের প্রোটোটাইপ তৈরি হয়ে গেল। আমরা আমাদের সাফল্য প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে দেখানোর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কৃষ্ণ মেনন নন্দীতে এলেন। আমি নিজ হাতেই তাকে সব কিছু দেখালাম। তবে এ-বিষয়ে তার নিরাপত্তারক্ষীরা তেমন একটা খুশি ছিল না। যাই হোক, প্রথমবারের মতো আমার মাঝে এক ধরনের অনুভূতি জন্মাল। জ্ঞান এবং দলগত মেধা কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু তৈরি করার খুশির অনুভূতি। এমন একটা প্রোটোটাইপ তৈরি, যা এই দেশে প্রথম।

তবে এই অধ্যায়ের শুভ সমাপ্তি ঘটেনি। কৃষ্ণ মেনন ক্ষমতা ত্যাগ করার পর তার পরবর্তী মন্ত্রী, এই হোভারক্রাফট ব্যবহারে তার মতোন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেননি। এটা একটা সমালোচিত বিষয়ে পরিণত হলো। এবং এক সময় এর অবসান ঘটল। যদি আমার জীবনে কোনো কিছু আমাকে শেখায় যে-সব স্বপ্ন বাস্তবতা পায় না, তা হলো এই ঘটনা থেকে পাওয়া কঠোর শিক্ষা। প্রায়ই আমাদের এমন বাস্তবতার শিকার হতে হয়। এই বাস্তবতা হলো, আপনার নিজের চেয়েও বড় এবং ক্ষমতাশালী লোক রয়েছে যারা আপনার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসলের ফলাফল নির্ধারণ করবে নিজের স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যদিয়ে।

এই ঘটনা থেকে আমি আরেকটা শিক্ষা পেলাম। তা হলো, এমন অনেক ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে আমার বিচরণ এবং কোনো প্রভাব নেই। আমি কেবল আমার সেরাটুকু দিয়ে কাজ করে যেতে পারি, তবে এই কাজের ফলাফল নির্ধারিত হবে অন্য কারো হাতে। আর কে-ই বা সঠিকভাবে বলতে পারবে যে, আমাদের কাজের ফলাফল ঠিক কিভাবে আসবে?

আমি তখনও হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। নন্দী যে উদ্দেশ্য তৈরি হয়েছে, সেই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত না হওয়ার হতাশা। এমন সময় কিছু ঘটনা ঘটে যায়। আর এই ঘটনার জের ধরেই TIFR-এর অধ্যাপক এম.জি. কে. মেনন আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। আর এই ঘটনা প্রবাহের সমাপ্তি ঘটে আমার INCOSPAR-এ রকেট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগদানের মধ্যদিয়ে। সেখানে ড. ভিকরম সারাভাইয়ের তত্ত্বাবধানে আমি কাজ শুরু করলাম।

.

আমি INCOSPAR এবং এরপরে ISRO-তে কাজ করি। সেখানে আমাকে বিভিন্ন রকেট এবং মহাকাশযান তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে সাউন্ডিং রকেট থেকে শুরু করে রকেটের পে-লোড এবং satellite launch vehicles(SLV)-ও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ড. ভিকরম সারাভাইয়ের স্বপ্ন ছিল- ভারতের স্পেস প্রোগ্রামের উন্নয়ন। আর এই উন্নয়ন কেবল একটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। ভিন্ন ভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম একই সাথে সম্পন্ন করা হবে। আর আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি, আমি এরকম বহু প্রজেক্টের অংশ হতে পেরেছি।

যাই হোক, এই প্রজেক্টগুলোর মধ্যে যে প্রজেক্টটি আমার কাছে সবচেয়ে জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছিল তা হলো, SLV তৈরি। আমি এই প্রজেক্টের প্রধান ছিলাম। এবং আমি নিজেই এর নির্দেশনা দিচ্ছিলাম। এই প্রজেক্টে মূলত এমন একটি লঞ্চিং ভেহিক্যাল তৈরি করতে হয়েছিল, যা পৃথিবী এবং ভিন্ন ভিন্ন গ্রহের কক্ষপথে স্যাটেলাইট নিক্ষেপণ করতে পারবে। এই প্রজেক্টর সফলতা কেবল, পৃথিবীর বুকে ভারতকে উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর দেশ হিসেবে মর্যাদা এনে দেবে না, বরং এর মাধ্যমে আয়ও হবে। যে সকল দেশ পৃথিবী এবং অন্য গ্রহের কক্ষপথে নিজেদের স্যাটেলাইট নিক্ষেপণ করতে চাইছে, কিন্তু নিজেদের প্রযুক্তি না থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না, তাদের কাজ করে দিয়ে প্রচুর আয়ের সম্ভাবনাও তৈরি হবে। আমি আমার ‘উইংস অব ফায়ার’ বইটিতে এই স্যাটেলাইট তৈরির বিশদ বর্ণনা দিয়েছি। বিভিন্ন কারণে এই প্রজেক্ট সফলভাবে সম্পন্ন করতে গিয়ে ভালো রকমের জটিলতা পোহাতে হয়েছিল।

এরকম বড় মাপের প্রজেক্ট সফলভাবে সম্পন্ন করতে গেলে হাজারও জটিলতা দেখা দেয়। এবারও আমাদেরকে একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয়। এবং প্রয়োজনীয় অর্থও বাজেট করে দেয়া হয়। আর আমার দায়িত্ব ছিল এই বেঁধে দেওয়া বাজেটের মধ্যে সফলভাবে প্রজেক্ট সম্পন্ন করা। আর এই সময়কালটায় আমি নিজের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়েও জর্জরিত ছিলাম। মাত্র তিন বছরের মধ্যে আমি আমার তিনজন প্রিয় মানুষকে হারিয়েছি—আহমেদ জালালউদ্দিন, আমার বাবা এবং আমার মাকে। নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রেখে এবং কাজের ফলাফল নিয়ে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধতার মাধ্যমে আমি এই প্রজেক্টের সফলতার মুখ দেখতে পেয়েছিলাম।

এখন যদি কেউ আমাকে প্রশ্ন করে যে, SLV তৈরি করতে গিয়ে আমি কি শিক্ষা পেয়েছি, তাহলে আমার উত্তর হবে, ‘তিনটি শিক্ষা’। প্রথমটি হলো, একটি দেশের উন্নয়নে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণা এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অতুলনীয় ভূমিকার প্রমাণ। SLV তৈরিতে যে দলগুলো কাজ করছিল, সেই দলের সদস্যরা হয় বিজ্ঞানী, নয়তো গবেষক কিংবা ইঞ্জিনিয়ার। কে, কি করবে এবং কিভাবে করবে, দলনেতা হিসেবে সেই নির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার। আমি উপলব্ধি করতে পারলাম যে, বিজ্ঞান ওপেন-এন্ডেড এবং ব্যাখ্যামূলক। একজন অভিযাত্রী অজানা কোনো গন্তব্যে গেলে, যেভাবে অনুসন্ধানের মাধ্যমে উত্তর খুঁজে বার করে, বিজ্ঞানও ঠিক তাই করে। বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে, বিজ্ঞান নিজেই হলো এক অজানা গন্তব্য, যেখানে সকল কিছু সম্ভব। এবং একদিন বিজ্ঞান সবকিছুই ব্যাখ্যা করতে পারবে এবং সবকিছুই সম্ভব করবে। বিজ্ঞান হলো গভীর আনন্দ এবং আবেগ।

অপরদিকে উন্নয়ন হলো, জোড়া দেওয়া সুতোর মতো। উন্নয়ন, বিজ্ঞানীদের সম্পাদিত কাজ গ্রহণ করে, একে আর কিছুটা সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। এখানে কোনো ভুল বা অনুসন্ধানের সুযোগ নেই। বরং উন্নয়ন ভুলকে কাজে লাগায়, নতুন করে সজ্জিতকরণে। তাই বিজ্ঞানীরা যখন আমাদেরকে নতুন সব উপায় বাতলে দিয়ে এবং ডিজাইন তৈরি করে লঞ্চিং ভেহিক্যাল তৈরির সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছিল, ইঞ্জিনিয়াররা তখন আমাদেরকে বেঁধে দেওয়া সময় এবং সম্পদ ব্যবহার করে ফলাফলের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এই ধরনের প্রজেক্টে সফলতা পেতে হলে সকল কাজই অতি সূক্ষ্মভাবে সম্পন্ন করতে হয়। সূক্ষ্ম এবং নিখুঁত। ঠিক যেমন অর্কেস্ট্রার প্রতিটি সুরের মধ্যে সমন্বয় আনা হয়।

দ্বিতীয় যে শিক্ষাটা আমি পাই তা হলো, সংকল্পবদ্ধতা। সেই বছরগুলোতে আমার মাথায় প্রজেক্ট ছাড়া আর কোনো চিন্তাই ছিল না। আর শুধু আমি না, আমার মতো আরও অনেকেই এই প্রজেক্টের পেছনে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং দৃঢ় সংকল্প উজাড় করে দিতে থাকে। এই বিষয়ে ওয়ের্নহার ভন ব্রাউন যে জ্ঞানের বাণী আমাকে শোনান, তার সমতুল্য কিছু আমি কোনোদিন কারো কাছ থেকে শুনতে পাইনি। ভন ব্রাউন হলেন রকেট-এর ভুবনের কিংবদন্তি। তিনি v-2 মিসাইলের নির্মাতা। আর এই v-2 মিসাইলের আঘাতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লন্ডন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি NASA-র রকেটারি প্রোগ্রামে যোগদান করেন। সেখানে তিনি জুপিটার মিসাইল তৈরি করেন। জুপিটার মিসাইল হলো, বিশ্বের প্রথম লং-রেঞ্জ মিসাইল। তিনি একাধারে একজন বিজ্ঞানী, ডিজাইনার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসক এবং টেকনোলজি ব্যবস্থাপক। তাকে ‘আধুনিক রকেট ভুবনের জনক’ বলা হয়ে থাকে। তিনি যখন ভারতে আসেন, তখন তার সাথে আমার সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়। আমি চেন্নাইয়ে তাকে স্বাগতম জানাই। সেখান থেকে তাকে থুম্বায় নিয়ে আসি। তিনি রকেট বিজ্ঞানীদের কাজের ধরণ নিয়ে আমাকে যা বলেছিলেন, তা এখনও আমার কানে বেজে ওঠে। তিনি বলেছিলেন, ‘একটা কথা সবসময় মনে রাখবে, আমরা কেবল সফলতা দিয়ে নিজেদের গড়ে তুলি না, আমরা ব্যর্থতা দ্বারাও নিজেদের গড়ে তুলি।’ এই পেশার মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং কাজের প্রতি নিষ্ঠা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘রকেটারির জন্য কেবল কঠোর পরিশ্রমই যথেষ্ট নয়। এটা কোনো খেলা নয় যে, কেবল কঠোর পরিশ্রমই তোমাকে সম্মান এনে দেবে। এখানে, শুধুমাত্র লক্ষ্য থাকলেই চলবে না, লক্ষ্যের পাশাপাশি সেই লক্ষ্য দ্রুত অর্জনের কৌশলও প্রয়োজন। দৃঢ় সংকল্প বলতে কেবল কঠোর পরিশ্রমকে বোঝায় না। দৃঢ় সংকল্প বলতে বোঝায়, তুমি তোমার কাজের সাথে কতটা জড়িত, তার মাধ্যমে। এর মধ্যে আবার লক্ষ্য নির্ধারণও আছে। দৃঢ় সংকল্প হলো, সামনে লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, যার মাধ্যমে তোমার কাজের ফলাফল অসাধারণ হবে। সবকিছুকে ছাপিয়ে যাবে।’

আর আমার বিশ্বাস, তার পরবর্তী কথাগুলো আমি ঠিকই অনুসরণ করেছিলাম। ‘রকেটারিকে কেবল তোমার পেশা বা জীবিকা হিসেবে চিন্তা কোরো না। রকেটারিকে নিজের ধর্ম, নিজের মিশন হিসেবে চিন্তা কর।’

জীবনের সেই সময়টাতে SLV প্রজেক্টের পেছনে আমি আমার সবটুকু বিলিয়ে দেই। আমি আমার ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো কীভাবে সামলাব, তা শিখে ফেলি। আপনার লক্ষ্য অর্জনের পথে যে সকল সমস্যা দেখা দেয়, আপনার মস্তিষ্ক এভাবেই তার সমাধান করে থাকে। আমি বিশ্বাস করি যে, কোনো মিশনের সফলতা উপভোগ করার জন্য, এই সমস্যাগুলো থাকা উচিত।

আর আমার তৃতীয় শিক্ষা হলো, বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হয়ে, এর মোকাবিলা করা এবং এর থেকে শিক্ষা নেয়া। সবাই জানে যে, SLV-3-এর প্রথম পরীক্ষণ বিপর্যয়ে রূপ নেয়। কারণ সেই ভেহিক্যাল সাগরে আছড়ে পড়ে। এই পরীক্ষণের প্রথম ধাপ সফল হয়। তবে দ্বিতীয় ধাপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মাত্র ৩১৭ সেকেন্ডের জন্য ভেহিক্যালটি টিকে থাকতে সক্ষম হয়। আর চতুর্থ ধাপে ভেহিক্যাল-এর পে-লোডসহ, শ্রীহরিকোটা থেকে ৫৬০ কিলোমিটার দূরে সাগরে আছড়ে পড়ে।

আমার চোখের সামনে যে ঘটনা ঘটেছিল, আমার তা বিশ্বাস হচ্ছিল না। হ্যাঁ, এর আগেও আমি বহুবার বার্থতার স্বাদ গ্রহণ করেছিলাম। তবে বছরের পর বছর হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর এমন ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা, সত্যিই কষ্টদায়ক। আমার মাথার ভেতর একটি প্রশ্নই বারবার বেজে উঠছিল, “কোথায় ভুল হলো?’ তবে আমি কোনো উত্তর পাচ্ছিলাম না। আমি শারীরিক এবং মানসিক, উভয়দিক দিয়েই চূড়ান্ত পর্যায়ে অবস্থান করছিলাম, আর এই সবকিছুই যখন বৃথা গেল, তখন নিজেকে বা আমার আশেপাশে যারা ছিল তাদেরকে আর বলার কিছু রইল না।

আমি কেবল তখন একটা জিনিস নিয়েই চিন্তা করতে পারছিলাম। তা হলো, ‘ঘুম’। আমাকে আবারও সবকিছু নিয়ে বিশ্লেষণ শুরুর আগে অবশ্যই ঘুমিয়ে নিতে হবে। আমার মনে আছে, আমি অনেকটা সময় ঘুমিয়েছিলাম। ড. ব্রহ্ম প্রকাশ আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। তখন তিনি আমার বস ছিলেন। তবে সেই মুহূর্তে তিনি ছিলেন আমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী, যিনি আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তার সাথে নিয়ে গেলেন। আমরা এক সাথে খাবার খেয়েছিলাম। খাওয়ার সময়টাতে তিনি লঞ্চিং ভেহিক্যাল নিয়ে একটা শব্দও তোলেননি। যদিও পরবর্তীতে বিশ্লেষণ এবং মিশন পুনরায় শুরু করা হয়। তবে সেই মুহূর্তে ছিলাম আমরা এমন দুজন লোক, যারা অভাবনীয় ক্লান্ত। তবে আমরা জানতাম, আমাদের ব্যর্থতা বৃথা যাবে না। আমরা জানতাম, সামনের দিনগুলোতে আমরা এর চেয়েও বড় সফলতা অর্জন করব। তবে সেই মুহূর্তে ড. ব্রক্ষ্ম আমার সাথে যে ব্যবহার করেছিলেন, তা কেবল পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের সাথে করে থাকেন। যখন তাদের সন্তান কোনো প্রতিযোগিতা হেরে যায়। বাবা-মা তখন তাকে নিজ হাতে খাবার তুলে দেন। এবং তার পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে তাকে চিন্তা-ভাবনা করতে দেন।

আমরা SLV-3 প্রজেক্টে ঠিকই সফল হয়েছিলাম। এখান থেকে বিজ্ঞানের পথে আমার যাত্রা আরও গভীর থেকে গভীরতর পথ খুঁজে পায়। ISRO থেকে আমি DRDO-তে গেলাম। সেখানে আমি আমার দলের সাথে ভারতের প্রথম নিজস্ব মিসাইল, ‘পৃথ্বি’, ‘ত্রিশূল’, ‘নাগ’ এবং ‘অগ্নি’ তৈরি করলাম। সেগুলো কীভাবে তৈরি করা হয়েছিল, তার বর্ণনা এর আগেই আমি দিয়েছি। এই প্রজেক্টে কাজ করার সময় আমি, রকেটারি এবং বিজ্ঞানের নতুন ক্ষেত্র নিয়ে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি, উদ্ভাবন করতে শিখে ফেলি। দক্ষভাবে নেতৃত্ব প্ৰদান আয়ত্ত করে ফেলি। সফলতা-ব্যর্থতা উভয়ের মুখোমুখি হতে শিখে ফেলি।

.

আমি এই গল্পগুলো কেন বলছি? কারণ আমার মনে হয়েছে এই ঘটনাবহুলতার মধ্যদিয়ে পার হতে গিয়ে এবং যে সকল লোকের সাথে আমি কাজ করেছি, তার মাধ্যমে আমি জীবনের প্রায় সকল ধরনের পরিস্থিতিরই মুখোমুখি হয়েছি। আমি সেই পরিস্থিতির মাঝে নিজের পথ করে নিতে পেরেছি। আর আমার এই গল্প শুনে, অন্যরা যদি নিজেদের বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে, তাহলে আমি বুঝতে পারবে যে, আমি কেবল নিজের জন্য এতটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দেইনি। অসংখ্য মানুষের জন্য দিয়েছি।

আমি এই মমতাময়ী দেশের একটি কূপ
আমি এ-দেশের তরুণ প্রজন্মের দিকে চেয়ে আছি
আমার কাছ থেকে নেবার অপেক্ষায়
চারিদিকে এক স্বর্গীয় মহিমা বিরাজ করবে
এবং তার আশির্বাদ ছড়িয়ে পরবে
যেমন করে এই কূপ থেকে পানি নেওয়া হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *