তিনটি মহৎ হৃদয় মিলে করল একটি সমস্যার সমাধান

তিনটি মহৎ হৃদয় মিলে করল একটি সমস্যার সমাধান

আমার শৈশব কাটে রামেশ্বরামে। আর রামেশ্বরাম ছোট একটি দ্বীপ। রামেশ্বরামের সর্বোচ্চ চূড়া হলো গান্দামাদান পর্বত। সেখানে দাঁড়িয়ে পুরো রামেশ্বরাম শহরটাকে দেখা যাবে। আপনি সহজেই দেখতে পাবেন পুরো শহর জুড়ে কিভাবে নারকেলের বাগান বেড়ে উঠেছে। দেখতে পাবেন দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র। আরও দেখতে পাবেন সুবিশাল রামনাথস্বোয়ামি মন্দিরের আকাশচুম্বি গপুরাম। রামেশ্বরাম তখন এক অসাধারণ শহর ছিল।

শহরের অধিকাংশ লোক মাছ ধরে বা নারকেল চাষের মাধ্যমে এবং মন্দিরের কারণে আসা পর্যটক এবং পুণ্যার্থিদের সেবার মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করত। অনেক ভারতীয়দের কাছে রামেশ্বরাম পবিত্রতম ধর্মীয় স্থান। আর তাই এই শহর বছরের প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই পর্যটক এবং পুণ্যার্থিদের আগমনে ভরপুর থাকত।

শহরের ক্ষুদ্র জনসংখ্যার মধ্যে হিন্দু জনগোষ্ঠী ছিল সংখ্যায় বেশি এবং স্বল্পসংখ্যক মুসলমান এবং খৃষ্টান লোকের জন্মভূমি ছিল এই অঞ্চল। প্রতিটি সম্প্রদায়ের মানুষের পারস্পারিক সম্পর্ক ছিল খুবই ভালো।

বাইরের দুনিয়ায় যে ধরনের বিভেদ এবং জাতিবিদ্বেষ দেখা যায় তার ছিটেফোঁটাও এখানে ছিল না। সকল সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে শান্তি পূর্ণভাবে জীবনযাপন করত।

প্রতিদিনের পত্রিকা খুললেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং সংঘর্ষের সংবাদ দেখা যেত। প্রায় সমগ্ৰ দেশ জুড়েই মানুষের মাঝে এই দাঙ্গা লেগে থাকত। তবে আমাদের রামেশ্বরামে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে শান্তি বিরাজমান ছিল। প্রজন্মের পড় প্রজন্ম ধরে এই শান্তির ধারা অব্যাহত আছে।

আমার বাবা আমাদেরকে প্রায়ই একটি গল্প বলতেন। গল্পটা আমাদের দাদার দাদাকে (পরদাদা) নিয়ে। বাবা এই গল্প বলতে ভালবাসতেন। আমাদের পরদাদা একবার একটি প্রতিমা উদ্ধার করেছিলেন। গল্পটা এরকম- এক উৎসবমুখর দিনে, মন্দিরের প্রতিমা কোনো একটা বিশেষ প্রথা পালনের জন্য এক পবিত্রস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। স্থানটি মন্দিরের পাশাপাশি। মন্দিরের আশেপাশে অনেকগুলো কূয়া আছে। আর এই সব কূয়ার পাশ কাটিয়েই সেই প্রতিমা নিয়ে যেতে হবে। সেই ধর্মীয় যাত্রার কোনো এক সময়ে (এখন আর কারোই সঠিক মনে নেই, ঠিক কোন সময়ে) প্রতিমা একটা কূয়ায় পড়ে যায়। প্রতিমা পড়ে যাওয়া এক ভয়াবহ দুঃসংবাদ। সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রতিমা ফেলে দেওয়ায় ভগবান যে শীঘ্রই তাদের ওপর বিপর্যয় নিয়ে আসবে, তারা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল। কেউ ভয়ে সামান্যতম নাড়াচড়াটুকুও করছিল না। এমন সময় একজন লোক বুদ্ধির পরিচয় দিলেন। তিনি হলেন আমার পরদাদা। তিনি কৃয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রতিমা উদ্ধার করলেন। মন্দিরের পুরোহিতরা এবং সাধারণ লোকজন তাকে অশেষ ধন্যবাদ জানালেন। তাদের আনন্দের আর সীমা রইল না। আর হ্যাঁ, আমার পরদাদা মুসলমান ছিলেন।

যারা কথায় কথায় জাত জাত করে এবং জাত বিশুদ্ধতা নিয়ে অতিমাত্রায় চিন্তিত তারা এই ঘটনার প্রচণ্ড নিন্দা জানালেন। কারণ একটা পবিত্রতম প্রতিমা অন্য ধর্মের কোনো একজন লোক ছুঁয়ে ফেলেছে, যার কি না এই প্ৰতিমা স্পর্শ পর্যন্ত করার অধিকার নেই। কিন্তু, রামেশ্বরামের কেউই এই ধরনের মনোভাব পোষণ করলেন না। উল্টো তারা আমার পরদাদাকে গভীর সম্মাননা প্রদান করলেন। তিনি বীরের মর্যাদা পেলেন।

মন্দির কর্তৃপক্ষ আবার ঘোষণা করল যে, এরপর থেকে প্রতি বছরই আমার পরদাদাকে মুদাল মারায়াদাই (MuqalMarayadi) দেওয়া হবে। এটা হিন্দু ধর্মালম্বিদের জন্যই বিরল এক সম্মানের ব্যাপার। আর সেদিকে অন্য ধর্মাবলম্বি হলে তো কথাই নেই। মুদাল মারইয়াদা মানে হলো, প্রতি বছর আমার পরদাদাকে মন্দির থেকে সর্বপ্রথম সম্মাননা দেওয়া হবে। আমার পরদাদাকে বহু বছর ধরে এ-মর্যাদা দেওয়া হয়। বহু বছর ধরে এ-প্রথা চলতে থাকে এবং পালাক্রমে আমার বাবাও মন্দির থেকে মর্যাদা পেয়ে থাকেন।

পরবর্তী বছরগুলোতেও এই সাম্প্রদায়িক ঐক্যের ধারা অব্যাহত থাকে। আমি একটা অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি যে, আমার বাবা ফেরী পারাপারের ব্যবসা করতেন এবং সেই ফেরী মূলত পুণ্যার্থিদের আনা নেয়ার কাজ করত। আমার বাবা একজন মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও, পুণ্যার্থিদের বাবার ফেরীতে করে ধনুশকরি যাওয়া নিয়ে কোনো সংকোচ ছিল না। আর বাবাও পুণ্যার্থিদের পৌছে দেয়া নিয়ে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক মনোভাব পোষণ করতেন না। এমনকি মন্দির কর্তৃপক্ষও প্রয়োজন হলে আমাদের ফেরী ব্যবহার করত।

আমার বাবা রামেশ্বরামের মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান এবং একজন নিবেদিতপ্রাণ মুসলমান। আল্লাহ তাআলা এবং কোরআন শরীফের ওপর আমার বাবার অগাধ বিশ্বাস। তিনি তার সন্ত নিদের মাঝে একজন প্রকৃত মুসলমান হওয়ার সকল গুণাবলি সার্থকভাবে বপন করতে পেরেছেন। শুধুমাত্র সন্তান বললে ঠিক হবে না। তিনি তার পুরো পরিবারকেই এই শিক্ষা’ দিয়েছিলেন। শহরের মানুষ তাকে একজন দার্শনিক এবং দিকনির্দেশক বলে বিবেচনা করত। যার কাছে সকল বিপদ আপদে সাহায্য পাওয়া যাবে। সে বিপদ জাগতিক হোক বা আধ্যাত্মিক হোক।

রামানাথস্বোয়ামী মন্দিরের পুরোহিত বাবার খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। তার নাম পাকশি লক্ষ্মণ শাস্ত্রী। তিনি কেবলমাত্র একজন পুরোহিত ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন শিক্ষিত, জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি বৈদিক জ্ঞানে দীক্ষিত ছিলেন। তার চেহারা এবং অঙ্গভঙ্গি এখনও আমার পরিষ্কার মনে আছে। তিনি সবসময় সনাতন পুরোহিতদের বেশে থাকতেন। তিনি ধুতি এবং অঙ্গবস্ত্র পরিধান করতেন। তার মাথায় ব্রাহ্মণদের মতো টিকিও ছিল। কেননা মাথায় টিকি রাখা ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের জন্য অত্যাবশ্যক। আমার দেখা নিরিহ এবং দয়ালু ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি অন্যতম।

আমাদের ক্ষুদ্র জনজীবনে তৃতীয় আরেকজন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে বাবা এবং পুরোহিত শাস্ত্রীর মতো সমান গুরুত্বের অধিকারী। তিনি হলেন ফাদার বোডাল। তিনি ছিলেন শহরের চার্চের পাদ্রী। তিনিও বাবা এবং শাস্ত্রীর মতো জনকল্যাণ এবং রামেশ্বরামে শান্তি এবং একতা রক্ষার জন্য এক নিবেদিতপ্রাণ।

এই জ্ঞানী লোকদের স্মৃতি এখনও আমার মনে গেঁথে আছে এবং আজীবন থাকবে। আমি এদেরকে এখনও কল্পনায় দেখতে পাই। আমি আমার বাবাকে দেখতে পাই, ইমামের নির্ধারিত কুর্তা পরিহিত অবস্থায়। তার মাথায় থাকে টুপি। শাস্ত্রীকে দেখতে পাই তার ধুতি পরনে এবং ফাদারকে তার পাদ্রীর পোশাক পরিহিত অবস্থায়। এই তিন মহৎ ব্যাক্তি প্রতি শুক্রবার মিলিত হতেন। বিকাল চার কি সাড়ে চারটার দিকে তারা একসাথে মিলিত হয়ে আলোচনা করতেন। ধর্ম এবং এলাকার অবস্থা নিয়ে আলোচনা।

মাঝেমধ্যে মানুষজন তাদের কাছে কোনো নির্দিষ্ট ঝামেলার মিমাংসার জন্য আসত। এই তিন মহৎ ব্যাক্তি খেয়াল রাখতেন যে, এলাকায় বিরাজমান শান্তির পথে যাতে কোনো ধরনের হুমকি বা প্রতিবন্ধকতা না এসে পড়ে এবং শান্তি অক্ষুণ্ণ থাকে ও সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে একতা থাকে। তাই কোনো ধরনের ভুল বোঝাবুঝি বা গুজব ছড়ালে তারা সেগুলোর সমাধান করতেন। যাতে করে সেগুলো বিপজ্জনক কিছু ঘটাতে না পারে।

এই তিন মহত্মার কৃতিত্বে এলাকার মানুষের মাঝে সবসময় সুষ্ঠু যোগাযোগ বজায় থাকত। তারা শান্তিপূর্ণ যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য তাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করে গেছেন। যাতে করে কারও মাঝে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না ঘটে। তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। যেমন-কিভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন দেশকে এক নতুন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ সরকার জাতীয়তাবাদীদের ওপর কিরূপ আচরণ করছে। আর তাদের এই আচরণ কিভাবে আমাদের ওপর প্রভাব ফেলছে। এই সকল বিষয় নিয়ে তারা গভীর চিন্তা ভাবনা করতেন। তারা নীরব যোদ্ধার মতো তাদের আশেপাশের সমাজে শান্তি এবং একতা বজায় রাখতেন। আর সমাজের সকল স্তরের লোকজন নির্বিঘ্নে তাদের সাথে আলোচনা করতে পারত। তারা সবার কথাই মন দিয়ে শুনতেন। কাউকেই ফিরিয়ে দিতেন না বা কোনো ধরনের বৈষম্য করতেন না।

.

আমার শৈশবে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার মাধ্যমে এই মানুষগুলোকে আমি বুঝতে পারি। আমার বয়স তখন আট। আমি তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। আমার তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, রামনাথ শাস্ত্রী, অরবিন্দ এবং শীবপ্রকাশন। ওরা সবাই হিন্দু ধর্মের অনুসারী এবং জাতে ব্রাহ্মণ। বিশেষ করে রামনাথ হলো, পাকশি শাস্ত্রীর ছেলে। আমরা সবাই একই স্কুলে পড়তাম। তাই আমদের সারাটাদিনই কাটত একসাথে। ক্লাসরুমে এবং ক্লাসরুমের বাইরে উভয় সময়ই। আমাদের মধ্যে একজন অনুপস্থিত থাকলে আমরা মনমরা হয়ে থাকতাম। তখন আমাদের দিন ভালো কাটত না। এই বয়সের ছেলেদের জীবনে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে তা খুঁটিনাটিসহ একে অপরকে না জানালে আমাদের পেটের খাবার হজম হতো না। ক্লাসরুমেও আমরা চারজন আশেপাশেই বসতাম। রামনাথ এবং আমি বসতাম একই বেঞ্চে।

মূল ঘটনা শুরু করার আগে, আমার স্কুলের বর্ণনাটা দিয়ে নেই। এই স্কুলে নিয়ে কত স্মৃতিই না আছে! কত দুষ্টামিই না করেছি এখানে! আমার স্কুলের নাম ছিল রামেশ্বরাম পঞ্চায়েত প্রাইমারি স্কুল। আমি ১৯৩৬-১৯৪৪ সাল পর্যন্ত এই স্কুলে পড়াশুনা করি। স্কুল বিল্ডিং সমুদ্র তীরের কাছাকাছি ছিল। স্কুল বিল্ডিং শহরের ছিমছাম বিল্ডিংগুলোর একটা ছিল না। বিল্ডিংয়ের কিছু অংশ ইটের তৈরি। কিন্তু বিল্ডিংয়ের ছাদ খড় দিয়ে তৈরি। এই স্কুলই ছিল রামেশ্বরামের একমাত্র স্কুল। তাই শহরের সব ছেলে-মেয়েই লাইন বেধে এই স্কুলেই আসত। আমাদের মোট ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০০। হ্যাঁ, আমাদের স্কুলের বিশেষ কিছু নেই, এমনকি সুযোগ-সুবিধাও খুবই সামান্য। তবে এই স্কুল আমার ভীষণ পছন্দের একটা জায়গা ছিল।

ছাত্র-ছাত্রীরা সকল শিক্ষকদেরই অসম্ভব ভালোবাসত। বিশেষ করে, যারা ইতিহাস, ভূগোল এবং বিজ্ঞান পড়াতেন তাদেরকে। এখন অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, ‘কেন?’ কারণ, তারা শিক্ষকতা ভালোবাসতেন এবং খেয়াল রাখতেন যে, তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের উন্নতি হচ্ছে কি না। প্রতিটি ক্লাসে ৫৫ জনের মতো ছাত্র থাকত। সেই ৫৫ জনের প্রতি সমান মনোযোগ দেওয়া কোনো সহজ ব্যাপার নয়। আমাদের শিক্ষকরা চাইতেন আমি যেন ভালো নম্বরের পাশাপাশি, যে বিষয় নিয়ে পড়ছি, সেই বিষয়ে আগ্রহ খুঁজে পাই। আমরা আমাদের শিক্ষকদের মাঝে এক ধরনের পবিত্রতা অনুভব করতে পারতাম।

যদি কোনোদিন একজন মাত্র ছাত্রও অনুপস্থিত থাকত, তাহলেও শিক্ষকরা সেই ছাত্রের বাড়ি যেতেন। তাদের বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতেন এবং তাদের অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইতেন। আমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেত, শিক্ষকরা তার বাড়ি গিয়ে তার বাবা-মাকে সেই খবর সবার আগে দিতেন। আমার স্কুল ছিল আমার ভীষণ পছন্দের একটি স্থান। আমরা যারা নিজেদের শিক্ষাজীবন এই স্কুলে শুরু করেছি, তারা সবাই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এই স্কুলেই পড়ালেখা করেছি। আমি এমন কোনো ছাত্রের কথা মনে করতে পারছি না, যাদেরকে ফেল করে একই শ্রেণিতে দ্বিতীয়বার থাকতে হয়েছিল।

বর্তমানে আমি যখন কোনো স্কুলে যাই, তা ছোটই হোক কিংবা বড়ই হোক, সেখানে আমি কিছু কথা বলি। আমি বলি যে, ভালো স্কুল বিল্ডিং বা সুযোগ-সুবিধা কিংবা ব্যাপক প্রচার দ্বারা স্কুলের মান নির্ধারণ করা যায় না। স্কুলের মান তখনই ভালো হবে, যখন শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভালোবেসে কোনো কিছু শেখাবেন।

এবার মূল গল্পে ফিরে আসি। তখনকার দিনে স্কুলে, বিশেষ করে ছোট স্কুলগুলোতে কোনো ইউনিফর্ম থাকত না। আমার স্কুলও এর ব্যতিক্রম ছিল না। আমরা যে কোনো কিছু পরেই স্কুলে যেতে পারতাম। এমনকি ধর্মীয় পোশাক পরে গেলেও কোনো সমস্যা হতো না। আমার বন্ধু রামানাথও ওর বাবার মতো মাথায় টিকলি রেখেছিল (পরবর্তীতে ও প্রাপ্তবয়স্ক হলে, ওর বাবার মতোই মন্দিরের পুরোহিতের কাজ করে)। আমি স্কুলে যেতাম মাথায় টুপি পরে। শহরের সকল মুসলমান ছেলেরাই টুপি পরে স্কুলে যেত। আমাদের মধ্যে কারোই এসব নিয়ে কোনো মাথা-ব্যথা ছিল না। এমনকি আমরা খেয়াল পর্যন্ত করতাম না, কে কি পরছে বা না পরেছে।

আমরা যখন তৃতীয় শ্রেণিতে তখন আমাদের জীবনে এক নতুন ঘটনা ঘটল। আমাদের স্কুলে এক নতুন শিক্ষক এলেন। যেকোনো ছোট শহরেই নতুন কারো আগমন উত্তেজনার ব্যাপার। এবং এ নিয়ে সবার মাঝে আলোচনা হয়। আমরা ছাত্র-ছাত্রীরা উত্তেজনায় ফেটে পড়ছিলাম যে-আমাদের নতুন শিক্ষক কেমন হবে। তিনি কি অনেক কঠোর হবেন নাকি নরম স্বভাবের হবেন? আমরা তার ক্লাসের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে রইলাম।

প্রথমদিন আমাদের শিক্ষক ক্লাসে এলেন। আমরা সবাই তখন উত্তেজনার তুঙ্গে। আমাদের নতুন শিক্ষক একজন হিন্দু ধর্মালম্বী ছিলেন। জাতে ব্রাহ্মণ। তিনি ক্লাস রুমে প্রবেশ করেই আমাদের সকলের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন। মূলত তিনি আমাদের পোশাকের বৈচিত্র্যতা দেখছিলেন। আমাদের নতুন শিক্ষক দ্রুত ব্যস্ত হয়ে পরলেন। তিনি ক্লাসের সামনে এসে দাঁড়ালেন। প্রথমেই তার চোখ পড়ল রামনাথ এবং আমার ওপর। আমি আর রামনাথ ছিলাম ক্লাসের সেরা ছাত্র। আমরা সবসময়ই নতুন কিছু শেখার জন্য সদা-আগ্রহি থাকতাম। আমরা প্রথম বেঞ্চে বসতাম। আমাদের শিক্ষকের দৃষ্টি আমার টুপি এবং রামনাথের টিকলির দিকে নিবদ্ধ হলো। তার চেহারায় এক ধরনের বিরক্তি এবং অবিশ্বাসের ছায়া পড়ল। তিনি কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের দুজনের নাম জানতে চাইলেন। আমি যখন আমার নাম তাকে জানালাম, তিনি আমাকে দ্রুত আমার বইপত্র গুছিয়ে পেছনের সারিতে বসতে বললেন। তিনি কেন এমন করলেন, তার কারণ শুধুমাত্র তিনি নিজেই জানেন। এখন যখন আমার এই ঘটনার কথা মনে হয়, আমি পরিষ্কার দেখতে পাই, আমাদের নতুন শিক্ষক ক্লাসে ঢুকে একটা বিষয় দেখতে পাননি। তা হলো, আগ্রহি বাচ্চাদের মুখে হাসি। যা না দেখেও তিনি কেড়ে নিতে সফল হয়েছিলেন।

এই ঘটনায় আমি অনেক কষ্ট পেলাম। আমার নিজেকে অপমানিত মনে হলো। আমি ভাবছিলাম, তিনি কেন এমন করলেন। রামনাথের চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। আমি এখনও সেই দৃশ্য পরিষ্কার মনে করতে পারি। আমি আমার বইপত্র গুছিয়ে পেছনের সারিতে যাচ্ছি আর রামনাথের বড় বড় চোখ বেয়ে পানি বেয়ে পড়ছে। তবে আমরা কেউই এই ধরনের আচরণ মেনে নিলাম না। আমি আমার বাবাকে এই ঘটনা জানালাম। রামনাথও তার বাবাকে জানাল। আমাদের দুজনের বাবাই আমাদের কথা শুনে বিস্মিত হলেন। তারা আমাদের এই ছোট সমাজটাকে যেভাবে গড়ে তুলেছেন, এই আচরণ তার সম্পূর্ণ বিপরীত। যে ব্যাক্তির দায়িত্ব আমাদেরকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা এবং আমাদের মানসিকতার নব-দ্বার উন্মোচন করা, তিনি ঠিক তার উল্টোটা করছেন। তারা দ্রুত নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিলেন। এবং ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন।

.

পরবরতী শুক্রবার, বরাবরের মতোই তারা সন্ধ্যায় মিলিত হলেন। ফাদার ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমাদের নতুন শিক্ষককেও সেখানে ডাকা হল। তিনিও এসে উপস্থিত হলেন। সন্ধ্যার আধারে আমার বাবা এবং পণ্ডিত শাস্ত্ৰী তাকে বোঝালেন—গোটা ভারতবর্ষে যে ধর্মীয় বিভাজন এবং গোড়ামির কারণে দাঙ্গা চলে তা এখানে চলবে না। তারা তাদের সন্তানদেরকে কোনো বিভাজন বা পরধর্মের প্রতি তিক্ত অনুভূতি পোষণের শিক্ষা পেতে দেবেন না। আর এই বিভাজনের শিক্ষা যদি কেউ দিতে চায়, তবে তারা তার আচরণও সহ্য করবেন না। তারা চান না যে সমাজের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যদের মাঝে কোনো বিভাজন বা এ-জাতীয় অনুভতি তৈরি হোক।

আর এই সব কিছু তাকে অত্যন্ত ভদ্রভাবে জানানো হয়েছিল। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, তিনি কি নিজেকে এমন এক ব্যক্তি মনে করেন কি না, যার হাতে দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়েছে? আমাদের শিক্ষক সেখানে নীরবে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছিলেন। অবশেষে তিনি মুখ খুললেন। তিনি নিজের দোষ স্বীকার করলেন। তিনি বললেন যে, তিনিই ছেলে দুটোকে আলাদা বসতে বলেছেন। তিনি এর পরিণতি না ভেবেই এই কাজ করেছেন। তিনি এতদিন ধরে তার চারপাশের সমাজকে এভাবেই দেখে এসেছেন। আর তিনিও তাই সেই নিয়মের অন্ধ অনুকরণ করেছেন। কেউ তাকে কোনোদিন ঐক্যের শিক্ষা দেয়নি। তিনি বরাবরই বিভাজন দেখে এসেছেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, তিনি যে কাজ করেছেন, পরবর্তী দিন তা শুধরে নেবেন। এবং তিনি তাই করেছিলেন।

এভাবেই আমার প্রথম এবং সরাসরি অভিজ্ঞতা হলো-এই তিনটি মহৎ- হৃদয় নিয়ে। তিন জন ধর্ম-নেতা খোলাখুলিভাবে কিন্তু দৃঢ়তার সাথে একটি সমস্যার সমাধান করলেন। তারা এই সমস্যা ছড়িয়ে পড়ার আগেই, তা দূর করলেন। এটি উত্তম ব্যবস্থপনার একটি অংশ। আমি পরবর্তীতে এর শিক্ষা পাই।

এই সময় আমার মনে আরেকটি নতুন চিন্তা উঁকি দেয়। তা হলো—আমাদের ভেতরের বিশ্বাস এবং লালিত রীতিনীতির দ্বারাই আমাদের আচরণ নির্ধারিত হয়। বহিরাগত শক্তি, প্ররোচণা এবং পরামর্শ, সব সময়ই আমাদের পাশে থাকবে। তবে আমাদের মধ্যে যারা ভালো এবং ন্যায়ের ওপর নিজেদের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, তারাই আমাদের মাঝে শান্তি বয়ে আনতে পারবে। আমাদের দেশে এমন নাগরিকের প্রয়োজন, যে নিজের অন্তরের সত্যটাকে বিশ্বাস করবে। যাদেরকে কোনো ধরনের প্ররোচণা দ্বারা বিভ্রান্ত করা যাবে না।

.

আর আমার ধর্ম নিয়ে যদি আমাকে কিছু বলতে হয়, তাহলে আমি কিছু কথা খোলাখুলিভাবে বলতে চাই। রামেশ্বরাম থেকে আমি নিজের ভাগ্যকে অনুসরণ করে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ভূবনে প্রবেশ করি। আমি সবসময়ই বিজ্ঞানের বিশ্বাসী ছিলাম। তবে বিজ্ঞানে বিশ্বাসী বলে, আমি কখনই আধ্যাত্মিকতা ভুলে যাইনি। তা আমার মাঝেই রয়ে গেছে।

আর সৃষ্টিকর্তা নিয়ে ভিন্ন মতবাদ থাকার বিষয়টাও আমি বুঝতে পারি। আমি বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে অনেক জ্ঞান লাভ করেছি। আমি কুরআন থেকে শুরু করে গীতা, বাইবেলও পড়েছি। আর এই তিন ধর্মাবলম্বীর মানুষ নিয়েই মূলত আমাদের দেশ। এক ধরনের বৈচিত্রময় ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে, যা আমাদের দেশের স্বতন্ত্রতা প্রকাশ করে। যদি আমাকে কেউ প্রশ্ন করে, এ- দেশে একজন মুসলমান নাগরিক হিসেবে আমি কেমন বোধ করি, তাহলে আমি আমার বাবা; পণ্ডিত শাস্ত্রী, ফাদার বোডাল এবং আরও অনেকের কথা উল্লেখ করব। এঁদের সান্নিধ্যেই আমি বেড়ে উঠেছি। এঁরা সবাই আমাদের দেশের ধর্মীয় চেতনা এবং নৈতিকতাবোধের আদর্শ মাপকাঠি। তাঁরা সবাই তাদের নিজেদের মতো করে এ-দেশের প্রত্যেক ধর্মের মানুষের মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে গেছেন, যেন মানুষে মানুষে কোনো বিবাদ-বিভাজন না থাকে। হ্যাঁ, আমরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছি। তবে এই দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম যদি আমার পরদাদা এবং একজন ইমাম, পাদ্রি ও ফাদারের ঐক্যের গল্প মনে রাখে, তবে জাতি হিসেবে আমরা অটুট থাকব। একটি সেক্যুলার গণতন্ত্রের মতো আমাদের উন্নয়ন ঘটবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *