আমার শিক্ষক : আহমেদ জালালউদ্দীন

আমার শিক্ষক আহমেদ জালালউদ্দীন

আমার জীবনের বিশেষ কিছু মুহূর্তে বিশেষ কিছু লোকের দিক নির্দেশনা পাই। এরা আমার জীবন গঠন এবং চিন্তাভূবনে বিরাট ভূমিকা পালন করেন। এমন কি অনেক সময় এদের সহযোগিতায় আমার জীবন ভিন্ন মাত্রা পেয়ে নতুন পথে পরিচালিত হতে থাকে। আমার গড়ার পেছনে এই সকল শিক্ষক স্থানীয় লোকদের অবদান সবচাইতে বেশি। আমি এদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। আমি যদি অনেকটা সময় পেতাম তাহলে আমি সেই পুরোটা সময়ই এদের কথা চিন্তা করে ব্যয় করতাম। তারা প্রত্যেকেই সূর্যের মতো। এদের আলিঙ্গনে জীবন এক নতুন উষ্ণতা এবং শক্তি পায়।

এমনই একজন শিক্ষক হলেন-আহমেদ জালালউদ্দীন। আমি যখন ছোট ছিলাম। আমার বাবা নতুন একটা ব্যবসা শুরু করতে চাচ্ছিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি নৌকা তৈরি করে ফেরী পারাপারের ব্যবসায় করবেন। নিজের সামনে নৌকা তৈরি হতে দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। একের পর এক কাঠ জোড়া লাগানো হচ্ছিল। আর প্রতিটি কাঠ

যথাপযুক্ত স্থানে বসানোর সাথে সাথে। নৌকার অবয়ব পরিষ্কার হয়ে আসছিল। যখন আমি নৌকার কাজ দেখতে, নৌকা তৈরির স্থানে যেতাম। সেখান থেকে সরতে চাইতাম। আমি এক মনে নৌকা তৈরির প্রক্রিয়া দেখতে থাকলাম।

জালালউদ্দীন তখন রামেশ্বরামে। তিনি বাবাকে সাহায্য করতে এসেছিলেন। নৌকা তৈরিতে সাহায্য। তিনি নৌকার প্রতি আমার আগ্রহের ব্যাপারটা লক্ষ করেছিলেন। তিনি মোটেও অন্যসব বয়ষ্ক লোকের মতো ছিলেন না।

অধিকাংশ বয়ষ্ক লোকই তাদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এতটাই ব্যস্ত যে, কাজ করার সময় ছোটদের সাথে কোনো কথা বলার প্রয়োজন মনে করেন না। কেউ আগ্রহবোধ করলেও না। তবে জালালউদ্দীন ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমার সাথে কিছুটা সময় কাটাতেন। তিনি নৌকার কাজ নিয়েই আলোচনা করতেন।

আমরা নৌকা নিয়ে বিভিন্ন আলাপ আলোচনা করতাম। কেমন করে নৌকা তৈরি হবে। কীভাবে রং করা হবে। আর কী কী কাজ বাকি আছে এইসব। এভাবেই একটি ছোট ছেলে এবং একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক লোকের মধ্যে গড়ে ওঠে অদ্ভুত রকমের বন্ধুত্ব। জালালউদ্দীন বয়সে আমার থেকে ১৫ বছরের বড় এবং তার জ্ঞানও আমার তুলনায় অনেক বেশি।

জালালউদ্দীনও রামেশ্বরামে থেকে গেলেন। আর আমাদের বয়সের পরিবর্তনে সাথে সাথে, আমাদের আলোচনায়ও ভিন্নতা আসতে থাকল। দিন কেটে বছর পেরোল। জালালউদ্দীনের সাথে আমার বোন জোহরার বিয়ে হলো। আমাদের সম্পর্ক আরও বেশি গভীরতা পেল।

জালালউদ্দীনের কথা যদি মনে করি, তবে আমার প্রথম মনে পড়বে আমাদের দুজনের রামেশ্বরামের রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোর কথা। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমরা হাঁটতে বের হতাম। আমাদের বাড়ি ছিল মস্ক স্ট্রিটে। যেখানে থেকেই আমরা পথচলা শুরু করতাম। হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের তীরে পৌঁছে যেতাম। শহর এ-সময় ব্যস্ত থাকত। মন্দিরে পূণ্যার্থিদের আসা-যাওয়া লেগে থাকত।

আমাদের প্রথম যাত্রাবিরত পড়ত শিবমন্দিরে। এখানে আমাদের গতি কিছুটা কমে যেত। পূণ্যার্থিদের ভিড়ের কারণে গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে আসত। পূণ্যার্থিদের কেউ হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করতে বসত। আবার কেউ কেউ মন্দিরে প্রতিটি সিঁড়ির ধাপে হাত ঠেকাতে ঠেকাতে আসত। যারা সাথে করে বৃদ্ধ মা- বাবা বা আত্মীয়স্বজন নিয়ে এসেছেন, তারাও সাবধানে ধীরে ধীরে পথ চলত।

মন্দির এলাকায় পূণ্যার্থিদের মাঝে এলেই আমাদের চিন্তা ভাবনা এবং আলাপ আলোচনার বিষয়ে পরিবর্তন আসত। আমাদের মাঝে তখন আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা শুরু হয়ে যেত। অধিকাংশ সময়ই আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু থাকত সৃষ্টিকর্তা।

সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে জালালউদ্দীনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল কিছুটা ভিন্ন। মূলত আমাদের বাবার যেমনটা ছিল, সেরকম ছিল না।

.

আমার বাবা ছিলেন একজন ধার্মিক লোক। তিনি ধর্মের প্রতিটি নিয়মকানুনই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করতেন। কেবল সৃষ্টিকর্তার বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি ইবাদত করতেন না। তিনি পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতেন, তার নিজের জন্য তার ইবাদত করা প্রয়োজন।

শ্বাস-প্রশ্বাস এবং খাদ্যগ্রহণ যেমন মানুষের স্বাভাবিক প্ররোচণা, নামায- রোজাও আমার বাবার কাছে ততটাই স্বাভাবিক ছিল।

জালালউদ্দীনও একজন নিষ্ঠাবান ধার্মিক লোক। তবে তিনি সৃষ্টিকর্তাকে বন্ধু বলে বিবেচনা করতেন। যেমন করে আমরা বন্ধুর সাথে কথা বলে থাকি তিনি তেমনভাবে সৃষ্টিকর্তাকে নিজের অসুবিধা এবং সমস্যাগুলো জানাতেন। জালালউদ্দীনের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তিনি যদি সৃষ্টিকর্তাকে তার সমস্যার কথা জানান, সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই তার সমাধান দেবেন।

মন্দির পার হওয়ার সময় আমি সমান মনোযোগে পূণ্যার্থিদেরকে নিজেদের প্রথা পালন করতে দেখতাম। আবার জালালউদ্দীনের কথাও শুনতাম। আমার মাথায় এই দু ধরনের বিশ্বাস একত্রে মিলে যেত।

রামেশ্বরামে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আগত পূণ্যার্থি, যারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছে এবং ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় প্রার্থনা করে তাদের এবং রামেশ্বরামে বসবাসরত লোকজনের প্রার্থনা কি একাধিক সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছায়? কারণ, এক এক সম্প্রদায়ের বিশ্বাসও এক এক ধরনের। না এমনটা সম্ভব হবে না। আমি বিশ্বাস করি যে, মানুষের ধর্ম যাই হোক না কেন, সৃষ্টিকর্তা এক এবং অদ্বিতীয়। তবে আমি মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হই আমার বন্ধুর বিশ্বাস দেখে। অবশ্য আমার অবাক হওয়ার বিষয়টা আমি তার কাছে গোপন রেখেছি। আমার বন্ধু, জালালউদ্দীনের সাথে সৃষ্টিকর্তার কী কোনো বিশেষ সম্পর্ক আছে। যার কারণে সে সৃষ্টিকর্তাকে সর্বত্র খুঁজে পায়। এবং অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দের সাথে তাকে নিজের সমস্যার কথা বলে যায়।

জালালউদ্দীন মোটেই উচ্চশিক্ষিত নয়। তিনি কেবল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। নিজের পরিবারটাকে টিকিয়ে রাখতে তাকে কাজে নামতে হয়। তাই আর তার পড়ালেখা করা হয়ে ওঠেনি।

কিন্তু, তিনি রামেশ্বরামের হাতেগোনা কিছু লোকজনদের মধ্যে ছিলেন। ইংরেজি ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান রাখতেন। তিনি ইংরেজি ভাষা লিখতে ও পড়তে পারতেন। তাই এলাকার মানুষের তাকে প্রয়োজন ছিল। এলাকার মানুষজন জালালউদ্দীনের কাছ থেকে দাপ্তরিক চিঠিপত্র লিখিয়ে নিত। এলাকার লোকজন তাকে ভীষণ সম্মান করত। আর মানুষজনের চোখে তার জন্য সম্মান দেখে আমিও তার মতো হতে চাইতাম। এবং অনেক পড়ালেখা করতে চাইতাম। আর যদি জালালউদ্দীনের দিক থেকে দেখি, তাহলে আমি বলব শিক্ষিত হওয়ার কারণে জালালউদ্দীন আমার মাঝে কৌতূহল এবং জ্ঞানের স্পৃহা ধরতে পেরেছিলেন। সেই দিনগুলো সবকিছু, আন্তরিক অর্থেই সবকিছুর প্রতি আমার আগ্রহের সীমা ছিল না। আর জালালউদ্দীনই সেই ব্যক্তি যিনি আমার সকল প্রশ্নের জবাব দিতেন। আমি তাকে এক নাগাড়ে প্রশ্ন করতেই থাকতাম। তিনি অত্যন্ত ধৈয্য সহকারে আমার কথা শুনতেন এবং আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেন। তিনি প্রাত্যাহিক জীবনধারার বাইরে যা আছে তা সম্পর্কে আমাকে জানাতেন। যেমন, প্রকৃতি, মহাকাশ, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, বই এবং বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব এভাবেই তিনি আমার জ্ঞানের চক্ষু খুলে দেন।

আমি প্রায়ই নিজেকে কিছু প্রশ্ন করতাম। তা হলো—কী সে আমাদের ব্যক্তিত্ব তৈরি হবে? প্রকৃতি মানুষকে কতটা গড়ে দেয়। আর মানুষ জন্মগতভাবে কতটা বিশেষত্ব নিয়ে আসে? আমি যদি সেই দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকাই তবে আমি আঙুল দিয়ে কাছের মানুষগুলোর গুণাগুণ চিহ্নিত করতে পারব। আর তাদের এই সকল গুণাবলিই তাদের সঙ্গের কারণে আমার মাঝে স্থানান্তরিত হয়েছে। আমার মা বাবার কাছে থেকে আমি সততা, নিয়মাবর্তিত, ভক্তি এবং পরোপকারি হবার শিক্ষা পেয়েছি। আর জালালউদ্দীন এবং আমার আরেক চাচাত ভাই শামসউদ্দীনের কাছে আমি শিখেছি—’প্রতিটি মানুষই বিশেষ কিছু গুণাবলি নিয়ে জন্মায়। এগুলো তার মাঝে নিহিত থাকে। এরা আমার মাঝে এক ধরনের জ্বলন্ত শিখা দেখতে পায়।’ আমাকে তারা উৎসাহ দেয় এবং গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

তারা মোটেও জটিল মানুষ ছিলেন না। তারা ছিলেন সহজ সরল এবং স্পষ্টভাষী কিছু মানুষ। আমার অনেক কিছুই যেমন-চিন্তা ভাবনা, তাদেরকে বলা লাগত না। তারা নিজে থেকেই বুঝতে পারতেন। তারা সেগুলোকে আমার ভেতর থেকে বের করে এনে আমার জীবনের লক্ষ্য সুন্দর করে গড়ে তুলতে সহায়তা করতেন।

আমি যখন বেড়ে উঠতে থাকি, জালালউদ্দীন প্রথম আমাকে রামেশ্বরামের গণ্ডি ভেদ করে বেরিয়ে আমার উৎসাহ দিয়েছিলেন। যখন আমি আরোও বড় শহরে, ভালো স্কুলে আমার পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাপোষণ করলাম। তিনিই তার ব্যবস্থা করে দেন।

এমন কি তিনি আমার সাথে রামনাথপুরে পর্যন্ত গিয়েছিলেনও। আমি রামনাথপুরের Schwartz High School-এ মানিয়ে নেয়ার পর তিনি রামেশ্বরামে ফিরে গিয়েছিলেন। যে সকল ছেলেরা আগে কোনো বড় শহরে বাস করেনি। অর্থাৎ নিজ স্থান ছেড়ে অন্য কোথাও বাস করার অভিজ্ঞতা নেই তাদের জন্য জায়গা পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। তাই রামনাথপুরে এসে অমি বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্মুখিন হয়েছিলাম।

আমার পরিবারকে ছেড়ে অন্য একটি জায়গায় বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। আমার বাড়ি, রামেশ্বরামের মনোরম পরিবেশ, মা, মায়ের হাতের রান্নার কথা বার বার মনে পড়ছিল। সেই সময় জালালউদ্দীন জাদুকরের মতো ভূমিকা পালন করলেন। তিনি আমাকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন হতে শেখালেন। তিনি বললেন, ভালো স্কুলে পড়াশুনা করতে হলে আমাকে নিজের আবেগ অনুভূতির ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। যখনই আমার বাড়ির কথা মনে পড়ত বা খারাপ লাগত, তার উপদেশবাণি মনে করতাম। আমি নতুন করে উদ্যোগ এবং অনুপ্রেরণা পেতাম। আমি নিজেকে এই সকল ছেলেমেয়েদের সাথে বিবেচনা করতাম যারা বোর্ডিং স্কুলে থেকে লেখাপড়া করে।

আমি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত এই মানুষটি আমাকে সাহায্য করে গেছেন। প্রাপ্তবয়স্ক বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি নিজের সিন্ধান্ত নিজে নেওয়ার সক্ষমতার পর্যায়কে। আমার পথে তিনিও আমার সাথে থেকে আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। আমি যখনই হোঁচট খেয়েছি, তিনি আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করেছেন। যখন আমার মনে হচ্ছিল, ‘আমি পারব না’, তখন আমার মাঝে উদ্যমের সঞ্চার করেছেন তিনি।

আমি এমন কিছু করেছিলাম যা মাত্র ২০ বছর আগেও রামেশ্বরামে কেউ করার স্বপ্ন পর্যন্ত দেখতে সাহস পায়নি। আমি একটি ট্রেনিং প্রোগ্রামে জাভায় যাচ্ছিলাম। ট্রেনিং প্রোগ্রাম চলেছিল ৬ মাস। জালালউদ্দীন এবং সামসউদ্দীন বোম্বের (বর্তমান মুম্বাই) সান্টা ক্রুজ এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আমার সঙ্গে আসে। এই স্মৃতি আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। ততদিনে আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেছি। Indian National Committee for Space Reasearch (INCOSPA)-এ একজন রকেট সায়েন্টিস্ট হিসেবে যোগদান করেছিলাম। তারাই আমাকে যুক্তরাষ্ট্রের NASA-তে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠাচ্ছিল। জালালউদ্দীন এবং সামসউদ্দীন আমাকে বিদায় জানাতে এয়ারপোর্টে পর্যন্ত আসেন। আমার উত্তেজনা তাদের মাঝেও সঞ্চারিত হচ্ছিল। তারপরও তারা নিজেরা শান্ত থেকে আমাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। আমার মনে পড়ে এয়ারপোর্টে একেবারে শেষমুহূর্তে আমি তাদের দিকে ফিরে তাকাই। আমি তাদের চোখে স্পষ্টভাবে আশাবাদ ও অনুপ্রেরণা দেখতে পাই। তাদের সেই অনুভূতি আমাকেও ছুঁয়ে যায়।

তারা এমন দুজন মানুষ যারা আমার মাঝের ভালোটাই বের করে আনতে পেরেছেন এবং আমাকে সর্বদা সঠিক পথে পরিচালিত করতে পেরেছেন। সেখানে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আমি আর আমার আবেগ এবং তাদের প্রতি আমার ভালোবাসা চেপে রাখতে পারলাম না। আমরা চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল। ভেজা চোখ নিয়েই আমি তাদেরকে একে একে আলিঙ্গন করেছিলাম। তখন জালালউদ্দীন আমাকে বলেছিলেন, ‘ আব্দুল, আমরা সবসময়ই তোমাকে ভালোবাসা দিয়ে গেছি। তোমার ওপর আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস আছে। আমরা তোমাকে নিয়ে গর্বিত।’ তার এই কথাগুলো ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

.

এখন সেদিনগুলোর কথা মনে পড়লে, আমি জালালউদ্দীনের অবদান বুঝতে পারি। তিনি কেবল আমাকে হাত ধরে হাঁটতে শেখাননি, তিনি আমাকে শিখিয়েছেন কী করে বাঁচতে হয়। তার প্রভাবের বশবর্তী হয়েই আমি একজন সম্পূর্ণ মানুষ হতে পেরেছি। নিজের বুদ্ধি এবং সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে শিখেছি। যখন আমি আমার পরিবার থেকে অনেক অনেক দূরে ছিলাম, তখনও তার প্রভাব আমার মাঝে রয়ে গিয়েছিল। আমি এই দুনিয়ার নিজের পথ করে নিতে সক্ষম হয়েছি।

তিনি যে শুধু আমাকে জীবনের শিক্ষা দিয়েছেন তাই কিন্তু নয়। তিনি আমাকে কঠিন বাস্তবতা ‘মৃত্যু’র শিক্ষাও দিয়েছেন। যখন আমি Indian Space Research Organization (TSPO) -এর SLV-3 প্রজেক্টে কাজ করছিলাম। তখন খবর এলো আমার বন্ধু, দিক-নির্দেশক আর এ-দুনিয়াতে নেই। তার মৃত্যুতে আমি বড় ধরনের ধাক্কা খেলাম। জালালউদ্দীনের এখনও মৃত্যুর বয়স হয়নি। আমি তাই এই খবর শুনে নির্বাক হয়ে রইলাম। এমনটা কীভাবে হলো? আমরা সবাই বেঁচে থাকতে এই লোকটা কেন মারা গেল? তার মৃত্যুর পর আমি কি প্রলাপ বকেছি তা আর মনে নেই। একটা সময়ের জন্য আমি অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছিলাম। অবশেষে আমি নিজেকে শক্ত করলাম। আমার সহকর্মীদের জানালাম যে, আমি রামেশ্বরামে যাব।

বাড়ি ফেরার পরে আমি বাসে যাচ্ছিলাম। পাথুরে শহরে রাস্তায় শত শত লোকের কোলাহল এবং প্রকৃতির গুঞ্জনের মাঝে আমার নিজেকে একা মনে হতে লাগল। সম্পূর্ণ একা। আমাদের সবার জীবনেই এমন একটা সময় আসে যখন আমাদেরকে নিজেদের শৈশব পেছনে ফেলে সামনে এগোতে হয়। আমার জন্য সেই সময়টাই সামনে এগোনোর সময় ছিল।

জালালউদ্দীনের সাথে সাথে আমার জীবনের বড় একটা অংশের সমাপ্তি ঘটেছে। সেই আমার মাঝের ছেলেটিও চিরতরে হারিয়ে গেল। যার কি না দিক নির্দেশনার দরকার ছিল, যে কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে প্রশ্ন করতেই থাকত। যে জানত যে তাকে নির্দেশনা দেয়ার জন্য একজন বিশেষ লোক রয়েছে।

যখন আমি নিজের চোখ বন্ধ করলাম, আমার চোখের সামনে সকল স্মৃতি ফিরে আসল। আমি স্পষ্ট দেখছিলাম জালালউদ্দীনকে, আমার বই কেনার জন্য টাকার ব্যবস্থা করেছেন-সান্টা ক্রুজ এয়ারপোর্টে আমাকে বিদায় জানাচ্ছেন, আমার চোখ বেয়ে পানি পড়তে শুরু করল। এই কান্না কেবল তারাই কাঁদতে পারবে যাদেরকে ছোটবেলায় কেউ গভীর ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছিল। আমি আবারও স্মৃতির ভূবনে চলে গেলাম। দেখতে পেলাম যে, তিনি আমার সাথে আমাদের ছোট্ট শহরে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। তিনি আকাশের চাঁদ-তারার দিকে আঙুল তুলে দেখালেন। আমাকে ব্যাখ্যা করলেন কেন সূর্য এবং চাঁদ আকাশে দেখা যায় এবং কীভাবে অস্ত যায়।

আমি বাড়ি পৌঁছে দেখলাম আমার বোন আকুল নয়নে কাঁদছে। তার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল আমার ছোট্ট মেহবুব। মেহবুব আমার ভাতিজী। তার বাবার অকাল মৃত্যুর ছায়া তার মাঝেও দেখা যাচ্ছিল। আমি আমার বাবার সাথে দেখা করলাম। বাবার বয়স তখন একশ হবে। বাবাকে দেখে প্রথমবারের মতো আমার মনে হচ্ছিল, বাবার বয়স হয়ে গেছে। তার আদরের জামাইয়ের মৃত্যুর শোক রাতারাতি এই বয়স বৃদ্ধির জন্য দায়ী। আমরা জালালউদ্দীনকে কবর দিলাম। তাকে কবর দিয়ে আসার পর আমি আর নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, আমি আমার স্মৃতিমহলে ঘোরের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছি! চারদিক ঘন কুয়াশা।

কবর দিয়ে বাড়ি ফিরে আসার পর আমার বাবা আমার পাশে বসলেন। তিনি আমার হাত ধরলেন। আমি প্রথমবারের মতো লক্ষ করে দেখলাম যে বাবার চোখেও পানি। এবং তিনি তার কান্না লুকানোর কোনোরকম চেষ্টাই করছিলেন না। বাবা বললেন-

‘কালাম, তুমি কী ছায়ার নড়াচড়া দেখতে পাও? সৃষ্টিকর্তা যদি চাইতেন ছায়া নড়াচড়া করতে পারত না। কারণ তার ইচ্ছার বাইরে কিছুই সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি কী করেছেন জানো? তিনি সূর্যকে দিয়ে ছায়াকে নিয়ন্ত্রণ করেন। বেলা যত বাড়তে থাকে ছায়া ততই কমতে থাকে। তিনি রাত সৃষ্টি করেছেন আমাদের বিশ্রামের জন্য।’

সৃষ্টিকর্তা জালালউদ্দীনকে এক গভীর নিদ্রায় শায়িত করেছেন। এক স্বপ্নবিহীন নিদ্রায় আছেন জালালউদ্দীন। বিশ্রাম করছেন তিনি। সৃষ্টিকর্তা না চাইলে কোনো কিছুই সম্ভব না। আর মানুষ জন্মমৃত্যু নিয়েই এই পৃথিবীতে আসে। তাই সৃষ্টিকর্তার ওপর আমাদের বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।

আমি বসে বসে বাবার জ্ঞানের কথাগুলো ভাবছিলাম। মৃত্যুকে ভয় পেলে চলবে না। আমি কখনই মৃত্যুকে ভয়ের চোখে দেখিনি। জন্ম-মৃত্যু দুটোই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবুও, মৃত্যুর কারণে যে দুঃখ হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে ফেলে তা থেকে সহজে নিস্তার লাভ করা সম্ভব নয়। আমাদের সবাইকেই এক সময় না এক সময় মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তবে জালালউদ্দীনের মতো যারা অল্পবয়সে মারা যান, যে কিনা নিজের সন্তানদের বড় হতে দেখেনি, নিজের সন্তানদের বিয়ে হতে দেখেনি, নাতি-নাতনির সুখ পায়নি—তাহলে সেই মৃত্যু এক ধরনের শোকের ছায়া ফেলে হৃদয়ে। আর সেই শোকই বাস্তবতায় রূপ নেয়। সেই কঠিন বাস্তবতা নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়।

আমার বন্ধু জালালউদ্দীন একজন সাধারণ মানুষ তবে শিক্ষক এবং বন্ধু হিসেবে তিনি অসাধারণ। তিনি ভালোবাসা, সরলতা এবং বোধগম্য দ্বারা তার চারপাশের মানুষগুলোর জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতেন। প্রতিটি শহরে, গ্রামে এবং দেশে তার মতো কিছু মহৎপ্রাণ লোক থেকে থাকে। আমি অনেক ভাগ্যবান যে, আমি তার সান্নিধ্য পেয়েছি। তিনি না হলে আজকের আমি আর আমি হতে পারলাম না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *