আমার শিক্ষক–ড. ভিকরম সারাভাই

আমার শিক্ষক–ড. ভিকরম সারাভাই

আমাদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষকদের আবির্ভাব ঘটে। শৈশবকালে আমি আর মা-বাবাকেই শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করতাম। এরপর আমার জীবনে এলো আমার বন্ধু এবং ভগ্নিপতি আহমেদ জালালউদ্দীন। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমার জীবনে আসেন। তখন আমি শৈশব ছেড়ে প্রাপ্তবয়সে পরিণত হচ্ছিলাম। ঘটনার পরিক্রমায় আমার কর্মজীবন শুরু হলো। আর আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে, আমার কর্মজীবনের শুরুর পর্যায়ে আমি ড. ভিকরম সারাভাইয়ের সান্নিধ্য পেয়েছি। তিনি একাধারে বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, প্রতিষ্ঠাতা এবং পথপ্রদর্শক। তিনি আধুনিক ভারতের একজন অন্যতম চিন্তাবিদ এবং কর্মী। তার মাঝে সূক্ষ্ম-জ্ঞান থেকে শুরু করে একজন নেতার সকল গুণাবলিই বিদ্যমান। গোটা ভারতবর্ষ তার কাছে কৃতজ্ঞ যে, তাকে স্বাধীনতার পর স্পেস প্রোগ্রামের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

তার সম্পর্কে বহু কিছু লেখা হয়েছে। তিনি ISRO প্রতিষ্ঠা করে ভারতের স্পেস মিশনের পরিধি বর্ধন করেন। তিনি পারমাণবিক শক্তি কমিশন-এর চেয়ারম্যান ছিলেন। একাধিক প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই আহমেদাবাদে Indian Institute of Management (IIM)-এর স্থাপন করেন। আমি তাকে দেখি একজন কিংবদন্তির রূপে। তিনি আমার মতো একজন রকেট ইঞ্জিনিয়ারের কাছে কেবল একজন বীরের মতো ব্যক্তিই ছিলেন না, বরং তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু ছিলেন।

আমার সাথে তার প্রথম পরিচয় হয় যখন আমাকে INCOSPAR-এ রকেট ইঞ্জিনিয়ার পদের জন্য সাক্ষাতকারের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই আমন্ত্রণ আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। এই আমন্ত্রণ আসে প্রফেসর এম. জি. কে মেনন, Tata Institute of Fundamental Research (TIFR)-এর অধ্যাপক যখন আমাকে নন্দি হোভারক্রাফট-এর কাজ করতে দেখেন তারপর।

সাক্ষাতকারে আমাকে কী জিজ্ঞাসা করা হবে আর কে সেই সাক্ষাতকার নেবেন, তা সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। আমি এও জানতাম না যে, আমাকে কীভাবে পরীক্ষা করা হবে এবং আমার জ্ঞানের ঠিক কোন বিষয়গুলো এখানে কাজে লাগবে। আমি কোনো কিছু প্রত্যাশা না করেই সে সাক্ষাতকার দিতে গেলাম। আমি ইতোমধ্যে জীবন থেকে শিক্ষা পেয়েছি যে-বিজয়ের মূলমন্ত্র হলো, বিজয় নিয়ে চিন্তা না করে বরং নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া।

আমরা সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন ড. সারাভাই, প্রফেসর মেনন এবং মি. সারাফ। মি. সারাফ অটোমেটিক এনার্জি কমিশন-এর সহকারী সচিব। এই তিনজন ব্যক্তির প্রত্যেকেই বিজ্ঞানের জ্ঞানভাণ্ডার। তারপর তারা অমাকে যে উষ্ণতা উপহার দিয়েছিলেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এই সাক্ষাতকারের মধ্য দিয়েই আমার সাথে ড. ভিকরম সারাভাইয়ের ব্যক্তিগত সম্পর্কের শুভ সূচনা হয়।

সাক্ষাতকারে তিনি আমার চিন্তা-প্রক্রিয়া নিয়ে বেশি পরীক্ষা করেছিলেন। তিনি কেবল আমার জ্ঞানের মাত্রা খতিয়ে দেখেননি, একই সাথে আমি কেমন মানুষ, আমার জীবনের লক্ষ্য কী এবং পেশাদার মানুষ হিসেবে আমার সম্ভাবনা কতটুকু—সবকিছু খতিয়ে দেখছিলেন। তিনি আমাকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছিলেন। তিনি খুবই মনোযোগ সহকারে আমার কথা শুনছিলেন। আমি তখনই বুঝতে পারছিলাম, তিনি কেবল একজন ইঞ্জিনিয়ার খুঁজছিলেন না, তিনি এমন একজনকে খুঁজছিলেন, যার ভবিষ্যত সম্ভাবনা আছে। যার মাঝে তিনি নির্দিধায় তার সময় এবং দেশের মহান স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ব্যয় করতে পারবেন।

.

আমার পেশাদার জীবনে আমি প্রথমবারের মতো তার পর্যায়ের কোনো ব্যক্তির সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। যিনি দেশের স্পেস প্রোগ্রাম নিয়ে নিজের বৃহৎ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমার চিন্তাগুলোও জুড়ে দেবেন। আমি INCOSPAR-এ যোগ দিলাম। এখানে কাজ করতে পারা আমার স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হওয়ার মতো ব্যাপার। আমার পেশাদার জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ একটি মোড় নিল। আমি আমার দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর দেখলাম, এই প্রতিষ্ঠান এবং এর কর্মীরা কীভাবে কাজ করে। আমি অবাক হলাম, আমার প্রাক্তন কর্মক্ষেত্র আর এই প্রতিষ্ঠানের কাজ কতটা ভিন্ন।

কাজের পরিবেশ খুবই ভালো এবং পদ বা জবাবদিহিতা এখানে অতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এর কিছুদিন পরই আমি জানতে পারলাম কীভাবে সারাভাই থুম্বা ইন্টান্যাশনাল রকেট লঞ্চিং স্টেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমি এই গল্প বলতে কখনই ক্লান্ত হই না। আমার কাছে এই গল্প হলো বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়। যে দুটোর মধ্য দিয়ে আমার জীবন চলে আসছে।

ঘটনা ১৯৬২ সালের। ড. ভিকরম সারাভাই একটি স্পেস রিসার্চ স্টেশন প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা খুঁজছিলেন। তিনি বেশ কিছু জায়গা পরিদর্শন করলেন। দক্ষিণ ভারতের কেরালার থুম্বাকে রিসার্চ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচন করা হলো। কারণ এই জায়গা গবেষণা চালানোর জন্য সবচাইতে উপযোগি। সুবিধাজনক পরিবেশের পাশাপাশি আরেকটা দিকও মাথায় রাখা হয়েছে। যখন ড. সারাভাই এই এলাকা পরিদর্শন করেন, তখন এখানে মাত্র কয়েকটি গ্রাম ছিল। সেই গ্রামে হাজার খানেক জেলের বাস। এই অঞ্চলে একটি প্রাচীন চার্চও ছিল। St Mary Magdalene Church। আর চার্চের কাছেই বিশপের বাড়ি। ড. ভিকরম সারাভাই বহু রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে এখানে রিসার্চ প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমতি পান। সবশেষে তাকে বিশপের সাথে দেখা করতে বলা হলো। বিশপের নাম ফাদার এ. পিটার বার্নার্ড পেরেইরা। এক রবিবার দিনে ড. সারাভাই বিশপের সাথে দেখা করলেন। ড. সারাভাই আগের দিন অর্থাৎ শনিবারেই বিশপের কাছে গিয়েছিলেন। তবে বিশপ তাকে দেখে হাসলেন এবং পরবর্তী দিন দেখা করতে বলেছিলেন।

রবিবার চার্চের কার্যক্রম শেষ করে ফাদার তার ধর্মসভায় বলেছিলেন, ‘মাই চিল্ড্রেন, আমার সাথে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী আছেন। তিনি এই চার্চ এবং আমার থাকার জায়গাটাকে চাচ্ছেন। একটি স্পেস সাইন্স রিসার্চ ইনস্টিটিউট- এর জন্য। ডিয়ার চিল্ড্রেন, বিজ্ঞান সত্যকে খুঁজে বের করে বুদ্ধির মাধ্যমে। একদিক দিয়ে বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতা উভয়ই কল্যাণের জন্য কাজ করে। মাই চিল্ড্রেন, আমরা কী ঈশ্বরের এই বাসস্থানটা সাইন্টিফিক মিশনের জন্য উৎসর্গ করতে পারি?’

সেই ধর্মসভার সবাই একত্রে উত্তর দিয়েছিল-’আমেন।’

এভাবেই এ. পিটার বার্নার্ড পেরেইরা ভারতের জাতীয় লক্ষ্য-ISRO প্রতিষ্ঠার জন্য চার্চের বিল্ডিংটি প্রদান করার মহৎ সিদ্ধান্ত নেন। আর এই চার্চ বিল্ডিংই ছিল আমাদের ডিজাইন সেন্টার। এখানেই আমরা রকেট অ্যাসেম্বলি করি এবং ফিলমেন্ট উইন্ডিং মেশিনের ডিজাইন তৈরি করি। আর বিশপের বাড়িটি ছিল আমাদের বিজ্ঞানীদের থাকার জায়গা। গভীর ভালোবাসা এবং যত্ন সহকারে চার্চ বিল্ডিংটার যত্ন নেয়া হয়। আর এই চার্চ বিল্ডিং একই সাথে আমাদের রিসার্চ প্রোগ্রামের যাত্রার চিহ্ন বহন করে। বর্তমানে এই বিল্ডিংটাকেই ইন্ডিয়ান স্পেস জাদুঘর বানানো হয়েছে। পরবর্তীতে TERLS-এর মাধ্যমে Vikram Sarabhai Space Centre (VSSC) এবং দেশব্যাপী আরবান স্পেস সেন্টার স্থাপন করা হয়।

যখন আমি এই ঘটনা মনে করি, তখন আমি পরিষ্কার দেখতে পাই, ধৰ্মীয় এবং বৈজ্ঞানিক নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে আরো বড় লক্ষ্য অর্জনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। পরবর্তীতে খুবই কম সময়ের মধ্যে এই এলাকায় একটি নতুন স্কুল এবং চার্চ তৈরি করে দেয়া হয়।

TERLS এবং VSSC-এর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারত বিশ্বমানের রকেট সিস্টেমের ডিজাইন এবং তৈরির সক্ষমতা অর্জন করেছে।

ভারত geo-synchronous, sun synchronous এবং meteorology spacecraft, তৈরি এবং নিক্ষেপণের সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে। এর মাধ্যমে দ্রুত যোগাযোগ, আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং পানির নতুন উৎস খোঁজা খুবই সহজ হয়ে গেছে।

ড. সারাভাই এবং পিটার বার্নার্ড কেউই আর আমাদের মাঝে নেই। তবে আমি তাদেরকে দেখতে পাই যখন দেখি, ফুল তার নিজের সৌন্দর্য দ্বারা অন্যকে পুলকিত করছে। গীতায় বর্ণিত আছে-

‘ফুলকে দেখ/ একবার ফুলের দিকে তাকাও
নিঃস্বার্থভাবে যে সুগন্ধ ছড়ায় এবং মধু দিয়ে যায়, যখন এর কাজ শেষ হয় –
এ নিঃশব্দে ঝরে যায়।
ফুলের মতো হওয়ার চেষ্টা করো
এর গুণাগুণগুলো নিজের মাঝ বপন করো।’

.

আমরা যেভাবে একটি রকেট লঞ্চিং ফ্যাসিলিটি পেয়েছি তা সকল প্রজন্মের জন্যই একটি অনুপ্রেরণামূলক গল্প’। এটি হলো কিছু মনের সমন্বয়। পৃথিবীর অন্য কোথাও কখনও কোনো চার্চ কর্তৃপক্ষ রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠার জন্য চার্চ দিয়ে দেয়নি। শুধুমাত্র ভারতেই এটা সম্ভব হয়ে। এই খবর প্রচার পেতেই হবে। এর মূলশিক্ষা হলো ধর্মের সর্বোত্তম উপাদানকে আধ্যাত্মিকতার রূপান্তর বা সমাজ গঠনে সহায়ক।

যাই হোক, মূল ঘটনায় ফিরে আসি। ISRO-তে আমি আমার দায়িত্ব পালন করছিলাম। এদিকে ড. সারাভাইয়ের সাথে প্রায়ই আমার যোগাযোগ হতে লাগল। তিনি দেশের স্পেস প্রোগ্রাম নিয়ে তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করছিলেন। প্রথমে তিনি থুম্বায় প্রতিষ্ঠা করেন স্পেস রিসার্চ ফ্যামিলি এরপর তিনি সরকারকে রাজি করাচ্ছিলেন ভারতে নিজস্ব এসএলইউ (স্যাটেলাইট লঞ্চিং ভেহিক্যাল) প্রতিষ্ঠা করাতে এবং একই সময়ে একটি Rocket- Assisted Take-Off System (RATO) তৈরি করতে। এর মাধ্যমে শত দুরাবস্থার মধ্যেও মিলিটারি এয়ারক্রাফট টেক অফ করতে পারবে। আমি তার চিন্তা এবং সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা দেখে অবাক হতাম। তিনি সূক্ষভাবে চিন্তা করতে পারতেন এবং তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অসাধারণ। আমরা যা দেখতে পেতাম না তিনি সেই সম্ভাবনা পরিষ্কার দেখতে পেতেন এবং যা বাস্তবে রূপদান করার সামর্থ্য রাখতেন।

ড. সারাভাইয়ের নেতৃত্ব এতটাই প্রবল ছিল যে, তিনি সংস্থার সর্বজ্যেষ্ঠ কর্মীকেও উদ্দেশ্য অর্জনের পথে পরিচালনা এবং প্রেরণা দিতে পারতেন। আমার মতে, তার কিছু মৌলিক গুণাবলির জন্য তিনি একজন ভালো নেতা হতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমি একে একে তার সেই গুণাবলির সবগুলো বলছি।

প্রথমত, তিনি সর্বদা শুনতেও প্রস্তুত থাকতেন। ভারতের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের উন্নতির মূল অন্তরায় হলো ক্ষমতাসীন পদে থাকা লোকজনের নিজেদের অধীনস্থদের কথা শোনার অনিচ্ছা। এক ধরনের বিশ্বাস বিরাজমান যে, যত সিদ্ধান্ত এবং ধারণা সব উপর থেকে নিচে, এই সাংগঠনিক কাঠামো অনুসারে আসবে। ভালো নেতৃত্ব এবং গোয়ার্তুমির মাঝে এটি একটি স্বচ্ছ সীমারেখা। আমরা প্রায় সময়ই অবাক হতাম এই ভেবে যে, ড. সারাভাই আমাদের সবাইকে কী পরিমাণ বিশ্বাস করেন।

INCOSPAR-এ আমরা ছিলাম একদল তরুণ এবং অনভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার, যারা উদ্যোম এবং আগ্রহে ভরপুর। তিনি আমাদের মাঝে একধরনের অদম্য স্পৃহা গড়ে তোলেন। তিনি এমনটা করেছেন, আমাদেরকে নিজের পরিকল্পনার অংশ করে নিয়ে এবং আমাদের সবাইকে একটি বৃহৎ লক্ষ্যের অংশীদারে পরিণত করে। তিনি থুম্বায় পরিদর্শনে আসলে অক্লান্ত দিন কাটাতেন। কারণ আমরা সবাই তাকে নতুন কাজগুলো দেখাতে চাইতাম। সেটা কোনো নতুন ডিজাইন হোক বা নতুন কোনো নির্মাণ অথবা কোনো প্রশাসনকি পদ্ধতি। তিনি আমাদের সবাইকেই নিজেদের মতো নেতা হওয়ার মনোযাগ নিয়ে গড়ে তুলেছেন।

আমার মতে একজন আদর্শ, নেতার মাঝে দ্বিতীয় যে গুণটি থাকা উচিত তা হলো—সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনা। যা ড. সারাভাইয়ের অন্যতম সেরা গুণগুলোর একটি। যখন তিনি একই সাথে এসএলভি এবং র‍্যাটো তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন, আমরা কেউই এই দুটোর মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য খুঁজে পেলাম না। প্রাথমিকভাবে কোনো সামঞ্জস্য না পেলেও পরবর্তীতে প্রমাণ হয় যে, এই দুটো জিনিস তৈরি একে অপরের সাথে গভীরভাবে জড়িত। আমি খুব দ্রুত সামঞ্জস্যগুলো ধরতে পেরেছিলাম। তাই আমি আগে থেকেই নিজে প্রস্তুত করে নিতে পেরেছি। প্রস্তুতি এই জন্য যে, আমার ল্যাবরেটরি থেকে আমার ওপর অতি জরুরি কিছু কাজের দায়িত্ব দেয়া হবে। আরও বৃহৎ ক্ষেত্রে ড. সারাভাই ভারতের স্পেস প্রোগ্রামের মাঝে একই সাথে রকেটে স্যাটেলাইট লঞ্চিং ভেহিক্যালস এবং লঞ্চিং ফেসিলিটির সমন্বয়ের কথা ভেবে রেখেছিলেন। একই সাথে আহমেদাবাদের Space Science and Technology Centre and Physical Research Laboratory-তে রকেট জ্বালানি, প্রোপুলেশন সিস্টেম, অ্যারোনটিক এবং অ্যারোস্পেস ম্যাটারিয়াল ও ট্র্যাকিং সিস্টেমের জন্য বিস্তর পরিধির কাজ হাতে নেয়া হয়।

যখন ড. সারাভাই ভারতের নিজস্ব রকেট তৈরির স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেছিলেন তখন রাজনৈতিক নেতাবৃন্দের সাথে তাকেও প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়েছিল। প্রশ্ন ছিল-ভারত যখন দারিদ্রতা এবং ক্ষুধার পাশবিক শক্তির সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে, এমন অবস্থায় এই ধরনের প্রোগ্রামের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু?

শত প্রশ্নের মুখেও তিনি জওহরলাল নেহেরুর সাথে চুক্তি বজায় রেখেছিলেন যে-ভারত বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বের সাথে তখনই তাল মেলাতে পারবে যখন প্রতিটি ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করতে পারবে।

একই সাথে জীবনের নানা সমস্যা সমাধানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবে। আমাদের স্পেস প্রোগ্রাম কখনই কেবল জাতির অভিজাত সমাজের জন্য ছিল না-এমনকি অন্য কোনো দেশের সাথে প্রতিযোগিতা করার সাথেও এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এই প্রোগ্রাম ছিল উন্নত ভারতের টেলি কমিউনিকেশন, মিটারোলজি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয়।

তৃতীয় যে গুণটি আমি ড. সারাভাইয়ের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলাম, তা হলো, দল তৈরি করার ক্ষমতা। তার এই গুণাবলিটি আমি নিজের মাঝে বপন করার চেষ্টা করেছি। ড. সারাভাই সবসময় সঠিক কাজের জন্য সঠিক মানুষটিকে খুঁজে বের করে নিতেন। এরপর তিনি সেই লোককে উপযুক্ত করে নিতেন। কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা থাকা বা না থাকার ওপর তিনি খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন না।

সবার মাঝে উৎসাহ জাগিয়ে তোলা তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। একজন আদর্শ নেতার মাঝে এই গুণাবলি খুবই দরকারি। বিশেষ করে আমাদের কর্মক্ষেত্রে। কেননা আমাদের প্রায়ই দুরাবস্থা এবং ব্যর্থতার সম্মুখিন হতে হয়। প্রয়োজনের সময় জীর্ণ চিত্রপট তিনি আলোকিত করে প্রদর্শন করতে পারতেন। তিনি আমাদের প্রশংসা করতেন যদি তিনি আমাদের কাজে সন্তুষ্ট হতেন। আমরা অনেক সময় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ব্যর্থ হলেও তিনি আমাদের কাজের প্রশংসা করতেন। আর স্বাচ্ছন্দ্য পরিবেশ বজায় রাখার জন্য এবং আমাদের দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য তিনি মজা করতেও কার্পণ্য করতেন না। এইসব গুণাবলি দ্বারা তিনি নিজের দল এবং প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। যারা তার প্রতি এবং তার স্বপ্নের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, প্রতিটি মানুষই জানে যে, কিছু না কিছু অবদান রাখতে পারবে। আর তার এই অবদানের স্বীকৃতি দেয়া হবে এবং মূল্যায়ন করা হবে।

.

অবশেষে তার আর একটি গুণ বলে শেষ করতে চাই। তা হলো, ব্যর্থতাকে অতিক্রম করতে পারার ক্ষমতা। আমার একটি ঘটনা মনে পড়ে এ বিষয়ে। একবার পরিদর্শনের জন্য থুম্বায় এসেছিলেন। আমরা তখন এসএলভি স্টেজ-এর কাজ করছিলাম। আর আমাদের কাজের অগ্রগতির জানানোর জন্য তাকে কার্যপ্রদর্শন করি। বিষয়টা এমন যে, ড. সারাভাই যখন একটি সুইচ টিপবেন তখন টাইম সার্কিটের মাধ্যমে পাইরো সিস্টেম চালু হবে। তবে তিনি যখন সুইচ টিপলেন তখন কিছুই ঘটল না। আমি প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। আমার সহকর্মী প্রমদ কালীও ভীষণ ধাক্কা খেল। কারণ টাইমার সিস্টেম ডিজাইন তার করা এবং তিনি নিজেই এই সার্কিট তৈরি করেছিলেন। আমরা দ্রুত টাইমার সার্কিটের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে পাইরো সিস্টেমের সাথে সরাসরি সংযোগ দিলাম। কারণ আমাদের ধারণা ছিল, সমস্যা মূলত টাইমার সার্কিটের। যখন সারাভাই আবার সুইচ টিপলেন তখন যা হবার কথা তাই হলো। পাইরোতেও আগুন জ্বলে উঠল এবং নোসকন অগ্রসর হলো। ড. সারাভাই আমাদের সাফল্যের জন্য আমাদেরকে অভিনন্দন জানালেন তবে আমাদের বিদায় জানাবার সময় পরে কেমন যেন চিন্তিত দেখাচ্ছিল।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা কেভোলাম প্যালেস হোটেলে আমাকে তার সাথে দেখা করতে বলা হয়। আমার এক ধরনের অস্বস্তি লাগছিল। তিনি উষ্ণভাবে আমাকে স্বাগতম জানালেন এবং রকেট লঞ্চিং স্টেশন নিয়ে কথা বললেন। এরপর তিনি সকালের কথা তুললেন। আমি কঠিন কিছু কথা শোনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলাম। তবে কঠিন কথা তো দূরের কথা তিনি আরও গভীর বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেন। তিনি জানতে চাইলেন, আমরা কাজ করে আনন্দ পাচ্ছি কী? এবং এই কাজ আমাদের জন্য উপযুক্ত কাজ কি না। অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলে আমরা সকালের ব্যর্থতার কারণ খুঁজে বের করলাম। তিনি আমাকে ভুলের কারণ ব্যাখ্যা করলেন। এরপর অনেক রাত পর্যন্ত ড. সারাভাই নতুন ডিপার্টমেন্ট ‘দ্য রকেট ইঞ্জিনিয়ার সেকশন’ নিয়ে অনেক আলোচনা করলেন।

আমি আগেই বলেছি সফলতা এবং ব্যর্থতা উভয়ই প্রতিটি কাজের অংশ। বিশেষ করে, আমাদের কাজগুলো যেখানে অনেকগুলো সিস্টেম নিয়ে এক সাথে কাজ করা হয়। আর একেক সিস্টেমের দায়িত্ব থাকে এক এক দলের। এমতাবস্থায় কোনো একটি দলের সামান্য ভুলের কারণে বছরের পর বছর করা কঠোর পরিশ্রম নিমিষেই শেষ হয়ে যেতে পারে।

ড. সারাভাই ভুলগুলোকে কাজে লাগাতে জানতেন। তিনি এই ভুলগুলো ব্যবহার করে নতুন পদ্ধতি তৈরি করতেন। ব্যর্থতাকে বিশ্লেষণ করে এর কারণ এবং পরবর্তী ধাপ বের করার তার স্বাতন্ত্র্য ক্ষমতা ছিল। তিনি ভুল হতে তার প্রশ্রয় দিতেন এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানান চেষ্টা করতেন, কীভাবে সেগুলো ঠিক করা যায়। এতে করে আমরা স্বস্তিতে কোনো প্রজেক্ট সম্পন্ন করতে পারতাম। ব্যর্থতা নিয়ে আমাদের কোনো ভয় ছিল না।

.

ISRO বর্তমানে যত স্পেস প্রযুক্তিসম্পন্ন দেশগুলো তার সমপর্যায়ে উপনিত হয়েছে। ISRO বিশ্বমানের স্যাটেলাইটস, স্যাটালাইট এবং রকেট লঞ্চার তৈরি করেছে। এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার, টেলিকম্যুনিকেশন আবিষ্কার এবং শিক্ষাক্ষেত্রে দেশকে অমূল্য সেবা দিয়ে আসছে।

ISRO চাঁদে একটি অরবিটার পাঠিয়েছে। এর নাম চন্দ্রযান-১। এবং অতি শীঘ্রই মঙ্গলেও মহাকাশযান পাঠানো হবে। আর এই সবই সম্ভব হয়ে ড. সারাভাইয়ের জন্য। যাকে সহযোগিতা করেছেন সতীশ ধাওয়ান, সতীশ ধাওয়ান এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান।

ড. সারাভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক অনেকটা আবেগপ্রবণ এবং মানসিক। নানা সময়ের মধ্যে তিনি আমার ওপর অগাধ বিশ্বাস এবং গভীর আস্থা রেখেছেন, যাতে করে আমি দলগুলোকে নির্দেশনা দিয়ে যেতে পারি। নতুন ডিজাইন এবং মেকানিজম তৈরির নির্দেশনা। এর মাধ্যমে ভারত সামনে এগিয়ে যাবে এবং বিজ্ঞান ও প্রতিরক্ষার দিক দিয়ে সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠবে।

তিনি একজন তরুণ ইঞ্জিনিয়ারের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন, সেই তরুণ ইঞ্জিনিয়ার সততার সাথে পরিষ্কারভাবে তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছিল এবং তার নিজের রকেট এবং মিসাইল তৈরির স্বপ্ন তাকে জানিয়ে ছিল।

তিনি সবসময় আমার পাশে ছিলেন। আমার ব্যর্থতা, সফলতা, অনিশ্চয়তা সকল মুহূর্তে আমাকে পথ-প্রদর্শন করেছেন। আঙুল তুলে সঠিক পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, যখন আমি দ্বিধায় ভুগছিলাম। তিনি ছিলেন একজন উচ্চমানের মানুষ। আর তার ছায়ায় গড়ে উঠতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করি।

.

ড. সারাভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ আমাকে নিষ্ঠুরভাবে হতাশ করে ফেলে। কারণ এ ধরনের সংবাদ ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে দিল্লি থেকে তার সাথে আমার কথা হয়। আমি দিল্লিতে একটা মিসাইল প্যানেল মিটিং-এ ছিলাম। সেই সম্পর্কেই তাকে জানাচ্ছিলাম। তিনি ছিলেন তখন থুম্বায়। তিনি তার সাথে ত্রিভান্ডাম এয়ারপোর্টে দেখা করতে বললেন। আমি দিল্লি থেকে ল্যান্ড করব আর তিনি

সেখান থেকে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) যাবেন। তবে আমাদের আর দেখা হয়নি। আমি ঠিকই এয়ারপোর্টে তার অপেক্ষায় ছিলাম। কয়েক ঘন্টা পর জানলাম, তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আমি জানতে পারলাম যে, আমাদের কথা হবার এক ঘন্টার মধ্যেই তিনি মারা গেছেন।

যে ব্যক্তি তরুণ বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়ারদের গড়ে তুলছেন, সে ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ সব বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রধান। যিনি একজন স্বনামধন্য নেতা, তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। তবে দুনিয়া ত্যাগ করার পূর্বে তিনি আমাদেরকে তার জ্ঞান দিয়ে সজ্জিত করে গেছেন। আমাদেরকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলেছেন। যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার উপযুক্ত করে দিয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের জন্য তার সবচেয়ে বড় অবদান হলো- আমাদের সম্ভাবনাকে তিনি আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছিলেন। সেই প্রথম থেকেই আমার জীবনে এ-ঘটনা নতুন নয়। যারা আমার কাছের মানুষ, তারা সবাই হঠাৎ করেই আমাকে ছেড়ে চলে যায়। কোনো কিছু না জানিয়েই।

এর থেকে আমি কী শিক্ষা পেলাম? প্রতিটি মানুষের মৃত্যুর সাথে আমার ভারাক্রান্ত মনে দুঃখের নতুন একটি স্তর যোগ হচ্ছিল। আর প্রতিবারই তাদেঁর স্মরণ করে তাদের কিছুটা আমি নিজের মাঝে আনার চেষ্টা করেছি। সেটা ভালোভাবেই হোক বা নিষ্ঠার সাথে হোক।

ড. সারাভাইয়ের ক্ষেত্রে আমি লাভ করেছি সামনে দেখার ক্ষমতা। পরিকল্পনার নকশা করার ক্ষমতা। তৈরি করা ক্ষমতা। যদি আমি নিজের বিভিন্ন দায়িত্বের মধ্যে দিয়ে সামান্য কিছু অর্জন করতে পারি, আমি সেই অর্জনকে বিবেচনা করব ভারতকে নিয়ে তার বৃহৎ প্রত্যাশার অংশ হিসেবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *