অ্যা ব্রাশ উইথ ফায়ার

অ্যা ব্রাশ উইথ ফায়ার

আগের অধ্যায়গুলোতে আমি আমার ব্যর্থতা এবং হতাশার ঘটনাগুলোর কথা উল্লেখ করেছি। প্রতিটি ব্যর্থতা বা হতাশার সাথে সাথে জীবন আমাকে নতুন একটি শিক্ষা উপহার দিয়ে গেছে। এখন আমি বুঝতে পারি প্রতিটি হতাশা কেটে যাওয়ার পর মানুষ একটি ভিন্ন আঙ্গিক লাভ করে। লব্ধ অভিজ্ঞতাকে ভিন্ন আঙ্গিকে দিতে চিন্তা করে এবং আমাদের চিন্তা-চেতনায়ও পরিবর্তন আসে। একই সাথে আমাদের আত্মাও প্রভাবিত হয়। আমার তাই বিশ্বাস। আমার আরও বিশ্বাস, আমরা প্রতিটি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতে পারি। যখন আবারও আমরা এই ধরনের অভিজ্ঞতার সামনে পড়ব তখন আমাদের উচিত পালিয়ে না গিয়ে তার মুখোমুখি হওয়া। বিগত অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা যে, এর আগে কীভাবে এর সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছিল। আর কোথায় ভুল হয়েছিল। এর সাথে আরেকটি প্রশ্নের সমাধান জরুরি, প্রশ্নটি হলো-সমস্যাটা কি নিজ থেকেই আমাদের ওপর এসেছিল? নাকি আমরা নিজেরাই ইচ্ছা করে বা নিজেদের ভুলে সমস্যায় জড়িয়ে ছিলাম? এই কথা বলার প্রয়োজন রাখে না যে, প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো বিশেষ ঘটনাই আমাদের মাঝে বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটায়।

বিশেষ করে যখন আমরা আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী জীবনযাপন করতে পারি না। উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলো আমাদের কাছে অতীব মূল্যবান অথবা এমন কিছু সাথে জড়িত হতে পারি না যার প্রভাব সার্বজনীন বা জীবন অথবা মৃত্যুর পরিস্থিতি। সাধারণত এই সকল পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেই আমাদের মাঝে গভীর পরিবর্তন সাধিত হয়।

আমার কর্মজীবন থেকে আমি এরকম কিছু পরিস্থিতির কথা স্মরণ করতে পারি। যখন আমি SLV (Satellite launch vehicle) এবং অগ্নি (ভারতের নিজস্ব তৈরি প্রথম মিসাইল) তৈরির প্রজেক্টের নেতৃত্ব দিলাম। তখন আমি এবং আমার দলের সবাইকে নিয়ে ভারত সরকার এবং জনগণের প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বি। আমাদের কাজের মিডিয়া কভারেজ (প্রচার)। যদিও বৰ্তমান সময়ের তুলনায় কিছুই না, ছিল তীব্র।

SLV-3 প্রজেক্ট এবং অগ্নি উভয়ই প্রথমবার ব্যর্থ হয়। অনেক ধরনের সমস্যার পাশাপাশি প্রাথমিক নিক্ষেপণের অসুবিধাও ছিল। এই অসুবিধার কারণে আমি এবং আমার দলের ওপর বিরাট চাপ ছিল এবং বিপর্যয়ের সম্ভাবনাও ছিল অনেক বেশি। প্রথমবারের চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ায় আমাদের প্রাক্তন অনেক সাফল্যের কথাও তেমন পাত্তা দেওয়া হলো না। তখন আমরা আবার পুনরায় অনুসন্ধান শুরু করলাম এবং ব্যর্থ হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ শুরু করলাম। সেই দিনগুলোর কথা আমার চিরকাল মনে থাকবে। মোটকথা, আমার স্মৃতিতে গাঁথা থাকবে।

তবে তার প্রভাব থাকবে তাদের কথা ভেবে। যাদের সাথে আমরা কাজ করেছি এবং আমাদের ধারণা এবং ডিজাইন সরবরাহের জন্য যাদের ওপর নির্ভর করেছি। তাদের নিষ্ঠা এবং ভোগান্তি। আমি আমার কর্মজীবনে বহুবার এমন ধরনের অনুভূতি পেয়েছি। এবং প্রত্যেকটিরই এই অনুভূতি আমার হৃদয় স্পর্শ করে গেছে।

.

১৯৬০ এবং ৭০-এর দশকে আমি কাজ করছিলাম Thumba Equatorial Rocket Launching Station (TERLS) -এ। প্রজেক্টের নেতৃত্বে ছিলেন ভিকরম সারাভাই। আমরা নিজেরাই নিজেদের রকেট এসএলভি এবং স্যাটেলাইট তৈরি করছিলাম। একই সাথে আমার দেশের বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে রকেটের জন্য পেলোড তৈরি করে বেরাচ্ছিলাম। রকেটের পরিপূর্ণ গঠন প্রক্রিয়ার এই পেলোডগুলো খুবই প্রয়োজনীয় বস্তু। এই পেলোড প্রস্তুত ল্যাবরেটরিতে আমার এক সহকর্মী কাজ করছিল। তার নাম সুধাকর। একবার আমরা একটি প্রি-লঞ্চ শিডিউলে কাজ করছিলাম। আমরা বিপজ্জনক এক মিশ্রণ সোডিয়াম এবং থারমাইন্ট-এর মিশ্রন নিয়ে কাজ করছিলাম। এবার একটু আমাদের ল্যাবরেটরি এবং আশেপাশের এলাকার বিবরণ দিয়ে রাখি। থুম্বা পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। এখানকার আবহাওয়া বরাবরের মতোই উষ্ণ এবং স্যাতস্যাতে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সুধাকর এবং আমি অনেকক্ষণ যাবত কাজ করেছি। চারদিকে অসহনীয় গরম। তবে আমাদের আবহওয়ার দিকে একটুও খেয়াল ছিল না। এই ধরনের ছয়টি মিশ্রণ পূর্ণ করার পর আমরা একবার পেলোড রুমে গিয়ে কাজের তদারক করে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম, পেলোডে এই ছয়টি মিশ্রন যথাযথভাবে ভরা হয়েছে কি না। কাজে নিমগ্ন থাকার কারণে আমরা একটা মৌলিক বৈজ্ঞানিক বিষয় খেয়াল করিনি। সেটি হলো, মৌলিক সোডিয়ামের সাথে পানির সংস্পর্শ ঘটলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমি আর সুধাকর ঝুঁকে বসে মিশ্রণগুলো পরীক্ষা করছিলাম, এমন সময় সুধাকরের কপাল বেয়ে এক ফোটা ঘাম মিশ্রণে পড়ল। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিস্ফোরণের ধাক্কায় ছিটকে পড়লাম। রুম-এ শক ওয়েভও ভীষণভাবে নড়ে উঠেছিল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমি একদম জমে গিয়েছিলাম। আর সেই কয়েক সেকেন্ডেই বিস্ফোরণ থেকে আগুন ‘ লেগে গেল। আমাদের ভীতসন্ত্রস্ত চোখের সামনেই পুরো ল্যাবরেটরিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। এই আগুন লেগেছে সোডিয়ামের কারণে। তাই পানি ব্যবহার করে এ-আগুন নেভানো যাবে না। উল্টো পানি দিলে আগুন আরও ভয়ানক রূপ নেবে। ল্যাবরেটরি আমাদের চোখের সামনেই নরক আগুনে জ্বলছিল-পরে যখন আমি এই ঘটনা নিয়ে চিন্তা করেছি, প্রতিটি ঘটনা-দুর্ঘটনা, বিস্ফোরণ, আগুন লাগার কারণ বুঝতে পেরেছি। তবে বাস্তবে এই সবগুলো ঘটনা ঘটেছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ডে।

আমি কোনোমতে উঠে দাঁড়ালাম। তবে সুধাকর তার উপস্থিত বুদ্ধির প্রমাণ দেখাল। সে পেলোড রুমের জানালা ভেঙে ফেলল। খালি হাতেই সে এ-কাজ করেছিল। এরপর সে এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে প্রথমে আমাকে জানালার বাইরে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে গেল। এরপর সে নিজে লাফিয়ে এলো। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে এ-কাজ করে ফেলল। তবে তীব্র বিস্ফোরণ এবং আগুনের প্রচণ্ড তাপে সুধাকরের প্রথমে বাচার উপায় চিন্তা করতে এবং পরবর্তীতে আমাকে বাঁচিয়ে নিজে বের হয়ে আসতে গিয়ে গুরুতর আহত হলো। আগুনের তাপে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গা পুড়ে গিয়েছিল। এবং খালি হাতে কাঁচ ভাঙতে গিয়ে তার হাত থেকে আমার রক্ত পড়ছিল। এরপর আমরা কোনোমতে টেনে- হিঁচড়ে আগুনের লেলিহান শিখা থেকে দূরে সরে গেলাম। আমার জীবন বাঁচানোর জন্য সুধাকরকে ধন্যবাদ জানালাম। তীব্র ব্যথা স্বত্ত্বেও সুধাকর আমার দিকে তাকিয়ে হাসল এবং আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করল। জখম সারিয়ে উঠতে সুধাকরকে বহুদিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল। এই দুর্ঘটনা কেবল আমার জীবনের ভয়ানক দুর্ঘটনার মধ্যে একটি নয়, এই দুর্ঘটনায় একই সাথে একজন টিকে থাকা মানুষের অনুভূতি পাওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করলাম আমি। জেনে- শুনে কেউ একজন নিজের জীবন বিপন্ন করে আমার জীবন রক্ষা করল। আমার জীবনের সবচাইতে সম্মানজনক মুহূর্তগুলোর একটি ছিল এটি। যে সকল মানুষকে প্রাত্যহিক জীবনের চরম দুর্ঘটনাগুলোতে টিকে যায় এবং তাদের রক্ষা করা হয়, তাদের মাঝে এক ধরনের মিশ্র অনুভূতির জন্ম নেয়। এই অনুভূতির মাঝে মিশে থাকে স্বস্তি, আত্মগ্লানি এবং সম্মান। আমার ক্ষেত্রে এই একই অনুভূতি “হয়েছিল। আমার মাঝে একই সাথে তীব্র দায়িত্ববোধই জেগে উঠল I যদি সুধাকর মনে করে থাকে আমার জীবন রক্ষা করা তার জীবনের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ, তবে আমার কর্তব্য হলো, আমরা যে-কাজ করছিলাম তা যেন কোনো কারণেই না পিছিয়ে সঠিক সময়ে সম্পন্ন হয়।

সুধাকরের এই নির্ভীক পদক্ষেপ আমার জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করল। যখন জীবনে নিজেকে আমার ক্ষুদ্র মনে হয়, আমি অনুপ্রেরণা হারিয়ে ফেলি এবং শত-কোটি মানুষের মধ্যে নিজেকে অতি-নগণ্য এবং এই মহাবিশ্বের অতি তুচ্ছ একটি বিন্দু মনে হয়, তখন আমি এই অসাধারণ মানুষটির কথা স্মরণ করি। সুধাকরও বাকি সকল বিজ্ঞানীদের মধ্যে একজন, যে নিজের কাজ করে গেছে, তারপর সে নিজের ভয়কে কাটিয়ে উঠে মহৎ এক কাজ করেছে। অনেক জীবন রক্ষা করা এমন একটি মহৎ কাজ যার মহত্ব ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না।

এরকম আরেকটি ঘটনা আছে, যা আমার হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি করে গেঁথে আছে। যখন আমি এই দুর্ঘটনার কথা চিন্তা করি, তখন আমার মন ব্যথা এবং গ্লানিতে ভরে ওঠে। একটা হলো ১৯৯৯-এ Arakkonam accident. এই দুর্ঘটনা আমাকে ব্যথায় ভারাক্রান্ত করে তোলে। এই দুর্ঘটনা ঘটার পর আমি এর গুরুত্ব ঠিকই উপলব্ধি করতে পারি। তবে আমি আমার সকল অনুভূতি তখন রাজ্যের বোঝায় চাপা দিয়ে রাখি। এর কয়েক বছর পর আমি আর আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিলে একটি বই লিখছিলাম। তখন সেই দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ায় আমার মন দুঃখ এবং অনুশোচনায় ভরে ওঠে।

ঘটনা ঘটে ১৯৯৯ সালের ১১ জানুয়ারি। দুটো এয়ারক্রাফট ব্যাঙ্গালোর – থেকে চেন্নাইয়ের আরাক্কোনাম যাচ্ছিল। দুটো এয়ারক্রাফটই Airborne Surveillance Platform (ASP)-এর সাইন্টেফিক মিশনে যাচ্ছিল। তারই একটি এয়ারক্রাফটের নাম ছিল অভ্র। এর সারভেইলেন্স সিস্টেম ছিল Motodome (এক ধরনের ডিমের মতো আকৃতি এর গঠনের সাথে যুক্ত ছিল)। এটা মাটির ১০০০০ ফুট উপর দিয়ে যাচ্ছিল এবং চেন্নাইয়ের বোস্টলাইনের দিকে এর কোস্টলাইন নির্ধারণ করে। সেই কোস্টলাইনের কোনো একটি জায়গায়ই রাডার টেস্টিং গবেষণা চলছিল। অভ্র যাত্রা করার পনের মিনিট আগে একটি A.N-32 এয়ারক্রাফট যাত্রা করে। AW-32 এয়ারক্রাফটটি ছিল রাডার টেস্টিংয়ের টার্গেট এয়ারক্রাফট। এই এয়ারক্রাফট ব্যাঙ্গালোর থেকেই যাত্রা শুরু করে। প্রায় এক-দেড় ঘন্টা যাবত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলল। আর রাডারের সিস্টেমের কার্যকারিতা পর্যক্ষেণ করে সবাই অনেক খুশি ছিল। বিকেল ৫টার দিকে AN-32 আরাক্কোনামে অবতরণ করে। আর অভ্রও এরকম সময়ই আরাক্কোনামে অবতরণে কোস্ট সেট করেছিল। প্রথমে অভ্র ১০০০০ থেকে ৫০০০ ফুটে নেমে আসল। সবকিছুই ঠিকঠাক। কিন্তু অভ্র যখন এয়ারফিল্ড ৫ নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল এবং ৩০০০-৫০০০ ফুটে অবস্থান করছিল তখন এর মটোডোম পড়ে গেল। আর হঠাৎ ভারসাম্যহীন ঘটায় এয়ারক্রাফট অস্থিতিশীল হয়ে তৎক্ষণাৎ ভূপতিত হলো। এয়ারক্রাফটে মোট ৮ জন লোক ছিল। তাদের প্রত্যেকেই মারা যায়। আমি তখন দক্ষিণ ব্লকে Defense Research Council-এর সাথে মিটিং-এ ছিলাম। এমন সময় আমার কাছে দুঃসংবাদ পৌছাল। আমি মাঝপথেই মিটিং থেকে উঠে ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

এয়ার চিফ মার্শাল এ. ওয়াই টিপনিসও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হৃদয়বিদারক একটি দিন কাটল। আমি যাত্রীদের পরিবার পরিজনের ও তাদের যুবতি স্ত্রী এবং বাচ্চাদের সাথে দেখা করেছিলাম। তাদেরকে আমার কী জবাব দেয়ার ছিল? তাদের ভালোবাসার স্বামীরা defence preparedness-এর কারণে মারা গেছে-এই কী বলতাম? মানুষের দুঃস্বপ্ন যখন বাস্তবে রূপ নেয় তখন কী এরকম কোনো সান্ত্বনা দেয়া যায়? এক যুবতি মা তার বাচ্চাকে দেখিয়ে আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন—এই বাচ্চাটির দেখাশুনা এখন কে করবে? আমি তার প্রশ্নে নির্বাক হয়ে রইলাম। আমার বলার মতো কোনো ভাষা ছিল না। আরেকজন মা আমাকে আরেকটি প্রশ্ন করেছিলেন। সেই প্রশ্ন এখনও আমাকে দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে বেড়ায়। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি আমাদের সাথে কেন এমন করলেন?

সেই প্লেন ক্র্যাশ এতটাই মারাত্মক ছিল যে, আমরা সেই ৮ জনের কোনো চিহ্নও খুঁজে পেলাম না। আমরা কেবল তাদের পরিবারকে সান্ত্বনা দানের জন্য কিছু কফিন জোগাড় করলাম।

সেই কফিনগুলো এয়ারফোর্স হলে রাখা হলো। আমি কোনোমতে একটি বক্তৃতা দিতে পারলাম; ‘এ-বিদায় এই ৮ জন দুঃসাহসিক সৈন্যদের, যারা নিজেদের কাজের মাঝেই চিরতরে বিদায় নিল। আর ফিরে এলো না।’

আমি দুঃখ-দুর্দশা এবং আত্মগ্লানিতে ভারাক্রান্ত হয়ে রাতে আমার রুমে ফিরে আসি। আমি আমার ডায়রিতে লিখলাম-

‘আলোর উৎস ভিন্ন
তবে প্রতিটি আলোই এক
দুনিয়াকে এনে দিলে আনন্দের রেশ
তবে তুমি রয়ে গেলে নিঃশেষ।’

.

এই ঘটনার পরও বছর স্বাভাবিকভাবেই কেটে গেল। আমিও সাউথ ব্লক থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনের দায়িত্ব নিলাম। তবে সেখানে গিয়েও আমার মাঝে সেই বিধবাদের কান্না, পিতা-মাতার আকুল নয়ন এবং সন্তানদের আহাজারি রয়ে গেল। যখনই আমি ভাবি যে, তাদের পরিবার পরিজনরা শেষবারের মতোও তাদের দেখতে পেল না! কেবল প্রতিকী কফিন দিয়েই তাদের অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। তখন আর আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না।

যখন সাইন্টিফিক এবং ডিফেন্স টেকনোলজি নিয়ে বড় কোনো পরিকল্পনা করা হয়, তখন কী ক্ষমতাধীন লোকেরা একবারও ভেবে দেখেন যে, এর জন্য ল্যাবরেটরি এবং ফিল্ডে কর্মরত বহুলোককে আত্মোৎসর্গ করতে হবে?

কেবল রাজনীতি দিয়েই একটি জাতি তৈরি হয় না। একটি জাতি তৈরি হয় হাজারো লোকের উৎসর্গের মধ্য দিয়ে। তাদের মেধা দ্বারা। এভাবেই তৈরি হয় একটি জাতি।

যখন আমরা অন্যদের ওপর কর্তৃত্বের ক্ষমতা অর্জন করি, তখন আমরা মনে করি যে, আমরা সাফল্যের চূড়ান্ত শিখায় পৌছে গেছি। তবে তখন আমাদের পেছনে ফিরে তাকানো উচিত এবং দেখা উচিত যে, আমরা কাদের উৎসর্গ এবং অবদানের কারণে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে পেরেছি। যখন আমি আমার বন্ধু, অরুণ তিওয়ারির সাথে এই ঘটনা নিয়ে কথা বলেছিলাম, সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এই ঘটনা দিয়ে কী বলতে চাও? আমার উত্তর ছিল, ভালো হওয়ার ভান করার দরকার নেই। সৎ হতে চেষ্টা করো। সেবা করার নিগূঢ় ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করো।

আমরা রাজনীতির বহির্মুখীরূপে আটকে আছি। আর এই রাজনীতিই দেশ গড়ছে ভেবে ভুল করে বসে আছি। যে সকল উৎসর্গ, মেধা এবং নিষ্ঠা চোখে পড়ছে মূলত তারা গড়ে তুলছে এই দেশকে

এখনও আমি সেই ঘটনাগুলোর কথা চিন্তা করি। কেবল তাৎক্ষণিক ঘটনাটুকুই নয়। এরপরে যা ঘটেছে, সবসহ। সুধাকরকে হাসপাতালে নেয়া, সেই ৮ জনের দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্থ পরিবারের মুখের কথা। তারা সরকারের কাছ থেকেও সাহায্য পেয়েছিল। এই ঘটনাগুলো ভাবার এক পর্যায়ে আমার মধ্যে এক ধরনের একাকিত্ব জায়গা করে নেয়। যখন আপনি কষ্টের মাঝে থাকবেন যখন আপনার নিজেকে একামনে হবে, তখনই আপনি নিজের প্রকৃত স্বত্ত্বাকে চিনতে পারবেন। আমি আমাকে খুঁজে পেয়েছি এক বড় চেতনার মাঝে। সেই চেতনার মাঝে, যে চেতনা, প্রকৃতি এবং টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্নগুলোর সমাধানের পথে নতুন জ্ঞানের জন্ম দেয়।

আমাদের সবাইকেই বহুবার হৃদয় ভাঙার অনুভূতির মধ্য দিয়ে পার হতে হয়। আমরা সবাই একদিন মৃত্যুর মুখোমুখি হব। তবে আমার জীবনের দীর্ঘ আট যুগে আমি যা শিখেছি তা হলো-এই মুহূর্তগুলোই আমাদের সত্যিকারের বন্ধু।

আমরা সবাই কেবল সুখ খুঁজে বেড়াই। তবে সত্যিকারের সুখ আসে তীব্র কষ্টের মধ্যে দিয়ে। যখন আমরা আয়নার মুখোমুখি হই এবং নিজের প্রকৃত রূপ দেখতে পাই, তখন আসে সত্যিকারের সুখ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *