আমার জীবনের ব্যর্থতাগুলো
আমার ঘটনাবহুল জীবনে আমি অকল্পনীয় সাফল্য অর্জন করেছি। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যে সকল আবিষ্কার আমাদের দেশের উন্নয়নে বিরাট অবদান রেখেছে আমি তার অংশ হতে পেরেছি। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ অফিসের প্রধান হওয়ার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে। আমার জীবনের এই সাফল্যগুলোর অনেকগুলোই একান্তই আমার। আবার অনেকগুলো দলীয়। আর যে দল সাফল্য অর্জন করেছে, আমিও তার অংশ ছিলাম। সেই দলগুলো ছিল অসামন্য সব মেধা নিয়ে গঠিত।
তারপরও আমি বলব যে, কেউ যদি জীবনে ব্যর্থতার তিক্ত অনুভূতি লাভ না করে, তার পক্ষে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন কখনই সম্ভব হবে না। জীবন নামক মুদ্রার উভয় পিঠ দেখার অভিজ্ঞতা আমি লাভ করেছি। আমার জীবনের এমন অনেক মুহূর্ত আছে যখন আমি ব্যর্থতার হতাশায় ডুবে ছিলাম। জীবনের এই কঠিন বাস্তবতা থেকে আমি অনেক প্রয়োজনীয় শিক্ষা লাভ করেছি। সাফল্যের পাশাপাশি, ব্যর্থতা থেকে লব্ধ শিক্ষাও আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ, এই শিক্ষাগুলোর কারণেই আমি জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছি। অতঃপর সাফল্যের আসনে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছি। এই ব্যর্থতার একটি ঘটনা ঘটে, যখন আমি MIT-তে পড়ালেখা করছিলাম। আমি এরোনেটিক্স-এর ছাত্র ছিলাম। আর আমার ‘ডিজাইন’-এর শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক শ্রীনিভাসন। তিনি ছিলেন আবার MIT-এর প্রধান একবার আমাদেরকে চার জনের এক একটি দলে ভাগ করা হয়েছিল। আর আমাদের দলের কাজ ছিল, একটা লো-লেভেল অ্যাটাক এয়ারক্রাফটের ডিজাইন তৈরি করা। আমার দলে আমার কাজ ছিল এরোডিনামিক-এর ডিজাইন তৈরি। আমরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে কঠোর পরিশ্রম করে গেলাম। আমার দলের অন্যান্য সদস্যরা কাজ করছিল বাকি জিনিসগুলো নিয়ে। যেমন—প্রপালশন, এয়ারক্রাফট-এর গঠন, কন্ট্রোল, যন্ত্রপাতি এ সব নিয়ে। আমাদের অন্য সকল কোর্সের পড়ালেখা তখন শেষ। তাই আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা গবেষণা এবং ডিজাইন নিয়ে আলোচনা করতাম। আমরা সবাই আমাদের শিক্ষককে আমাদের ডিজাইন দেখিয়ে আকৃষ্ট করতে চাইছিলাম। আমরা ধীরে ধীরে কাজও গুছিয়ে ফেললাম।
কয়েক সপ্তাহ পর অধ্যাপক শ্রীনিভাসন আমাদের ডিজাইন দেখতে চাইল। আমি আমার প্রজেক্ট অর্থাৎ ডিজাইন প্রফেসরকে দেখালাম, তিনি তা সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করে দেখলেন। অতি সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম একটি।
আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রজেক্ট নিয়ে তার মতামত শোনার অপেক্ষায় রইলাম। আমি এখনও মনে করতে পারি–তিনি যেভাবে ভ্রূ কুঁচকে তার সামনে ছড়িয়ে রাখা কাগজগুলো পরীক্ষা করে দেখছিলেন। এরপর তিনি আমার দিকে ফিরে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তার মুখ থেকে বের হওয়া প্রতিটি শব্দ যেন আমাকে আঘাত করল। তিনি বলেছিলেন, ‘এই প্রজেক্ট ভালো হয়নি কামাল!’ এরপর তিনি আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার বললেন, ‘তোমার কাছ থেকে আমি আরো বেশি কিছু আশা করেছিলাম। এটা একটা ছন্নছাড়া কাজ হয়েছে। আমি হতাশ। আমি ভাবতে পারছি না তোমার মতো মেধাবী একজন লোকের কাজ এতটা খারাপ কেন হবে।’
আমি হতবুদ্ধি হয়ে প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি বরাবরই আমার ক্লাসের সেরা ছাত্রদের একজন। আমার কোনো শিক্ষক তখন পর্যন্ত আমার কোনো ভুল ধরতে পারেনি। কিংবা আমার কোনো কাজে কখন অসন্তুষ্ট হননি। তাই এই লজ্জাজনক অভিজ্ঞতা আমার জন্য নতুন ছিল। আর আমি কোনোভাবেই এই অভিজ্ঞতাকে মেনে নিতে পারছিলাম না। প্রফেসর মাথা নেড়ে আমাকে বললেন যে, আমাকে আবারও পুরো ডিজাইন নতুন করে তৈরি করতে হবে। আমার ধারণাগুলোকে আবার নতুন করে সাজিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। আমিও সম্মতি জানালাম।
এরপর তিনি পরবর্তী দুঃসংবাদটি জানালেন। আমাকে পুরো কাজ নতুন করে তৈরি করতে হবে। এবং মাত্র তিন দিনের মাঝে আমাকে কাজ শেষ করতে হবে। তিনি বললেন, ‘আজ শুক্রবার। তোমাকে সোমবার সন্ধ্যার ভেতর কাজ শেষ করতে হবে। সোমবার সন্ধ্যার ভেতর যেন আমি তোমাকে অভিনন্দন জানাতে পারি। যদি তুমি সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারো, তবে তোমার স্কলারশিপ বন্ধ হয়ে যাবে।
আমি আবারও বোকার মতো তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। একমাত্র স্কলারশিপ-এর মাধ্যমেই আমি MIT-তে পড়তে পারছিলাম। স্কলারশিপ ছাড়া আমার পক্ষে খরচ বহন করা সম্ভব হবে না। আমার পড়ালেখের ইতি ঘটবে।
আমার নিজের আকাঙ্ক্ষা, আমার বাবা-মায়ের স্বপ্ন, আমার বোন এবং জালালউদ্দীনের স্বপ্ন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি দেখলাম, সেই স্বপ্নগুলো সব চুরমার হয়ে যেতে চলেছে। আমি ভাবতেই পারছিলাম না যে, আমার প্রফেসরের কয়েকটি শব্দের কারণে আমার কাছে নিজের ভবিষ্যৎ ঝাপসা হয়ে যাবে।
.
এবার আমাকে সবকিছু ঠিকভাবে করতে হবে। নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। সেদিন রাতে আমি কিছু খেলাম না। সারারাত ড্রইং বোর্ড-এর সামনে কাটালাম। আগের বার যখন ডিজাইন করছিলাম, তখন ডিজাইনের উপাদানগুলো আমার মাথায় ছাড়া ছাড়া ভাবে এসেছিল। তবে এবার আমার ভাবনাগুলো বেশ গোছানো ছিল। আমি স্বচ্ছন্দে কাজ করতে পারছিলাম। আমার মনযোগের কারণে আমি কাজে এতটাই ডুবে ছিলাম যে, আমার মাথায় আর অন্য কোনো চিন্তা রইল না। আমি এক মনে কাজ করে গেলাম। সকাল হলো। পরদিনও আমি যন্ত্রের মতো কাজ করে গেলাম। আমি কিছু সময়ের বিরতি নিলাম। হাত-মুখ ধুয়ে হালকা খাবার খেয়ে নিলাম। খাওয়া শেষ করে আবারও কাজে ফিরে গেলাম। রবিবার সন্ধ্যা নাগাদ আমি আমার কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছি। আমার এবারের ডিজাইন পরিষ্কার এবং আকর্ষণীয়। আমি আমার ডিজাইন নিয়ে গর্বিত এবং আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। আমি আমার কাজ প্রায় শেষ করে নিয়ে এসেছি। তখন কেবল শেষ মুহূর্তের কিছু কাজ বাকি ছিল। এমন সময় আমি সেই রুমে অন্য কারো উপস্থিতি টের পেলাম। আমার প্রফেসর এসেছেন, আমার কাজের তদারকি করতে। তিনি টেনিস খেলার পোশাক পরিহিত ছিলেন। খেলা শেষ করে ক্লাব থেকে বাড়ি ফেরার পথে এখানে এসেছেন। তিনি ঠিক কতক্ষণ আগে এসেছেন আমি বলতে পারব না। তবে তিনি সেখানে এসে নীরবে দাড়িয়ে ছিলেন এবং আমাকে দেখছিলেন। আমাদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হলো। তিনি এগিয়ে আসলেন। তিনি আবারও সূক্ষ্মভাবে আমার ডিজাইন পরীক্ষা করে দেখলেন। বেশ সময় নিয়েই দেখলেন। তারপর তিনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, আমি জানি, আমি প্রথমবার তোমার কাজ বাতিল করে তোমাকে বেশ চাপে ফেলে দিয়েছিলাম। আমি তোমাকে যে সময় দিয়েছিলাম, তার মধ্যে কাজ শেষ করা অসম্ভব ব্যাপার। তারপরও তুমি তোমার কাজ শেষ করতে পেরেছ। আর তোমার ডিজাইন দেখে আমি কেবল একটা শব্দই বলব, ‘অসাধারণ’। তোমার শিক্ষক হিসেবে আমার দায়িত্ব হলো, তোমার সুপ্ত প্রতিভাকে বের করে আনা। যাতে করে তুমি নিজের যোগ্যতা এবং ক্ষমতা বুঝতে পারো।’
দুই দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পরে প্রফেসরের শব্দগুলো আমার কানে মধুর সংগীতের মতো লাগছিল। আমি আবারও আমার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। সেদিন আমি দুটো শিক্ষা পেলাম। প্রথমটি, যে শিক্ষক তার ছাত্র-ছাত্রীদের অগ্রগতি নিয়ে চিন্তিত থাকেন, তার চেয়ে ভালো বন্ধু কেউ হতে পারে না। কারণ তিনি জানেন, কিভাবে তার ছাত্র-ছাত্রির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। দ্বিতীয়টি হলো, ইম্পসিবল ডেডলাইন’ বলতে আসলে কিছুই নেই। আমি অনেক কঠিন অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে কাজ করেছি। এর মধ্যে কোনো কোনোটায় আবার দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতারা আমার কাজের তদারকিতে ছিলেন। তবে প্রফেসর শ্রীনিভাসনের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষার জন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে উপলব্ধি করিয়েছেন। আর সেই অভিজ্ঞতা আমার জীবনের পরবর্তী সময়গুলোতেও আমাকে সহায়তা করেছে।
.
MIT-তে পড়ালেখা শেষ করে আমি কর্মজীবনে প্রবেশ করলাম। আমি তখনও জানতাম না, ভবিষ্যৎ আমার জন্য কিছু কঠিন শিক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। আমি ব্যাঙ্গালোরের Hindustan Aeronautics Limited (HAL) কাজ করছিলাম। সেখানে কাজ করতে গিয়ে এয়ারক্রাফট, ডিজাইন এবং প্রযুক্তি সম্পর্কে আমি অনেক কিছু শিখি। আমি ঠিক করেছিলাম যে, আমি এই এয়ারক্রাফটের ক্ষেত্রেই কাজ করব। Hindustan Aeronautics Limited (HAL) থেকে অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে গ্রাজুয়েশন করার পর আমি দুটো চাকরির প্রস্তাব পেলাম। প্রথমটি ছিল, এয়ার ফোর্সের। আর দ্বিতীয়টি হলো, Directorate of Technical Development and Production (DTD&P[Air]) প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে। দু জায়গায়ই সাক্ষাতকারের জন্য আমাকে যেতে বলা হলো। প্রথম চাকরি ছিল দেরাদুনে আর দ্বিতীয়টি দিল্লিতে। আমি অনেক আশা নিয়ে আমার যাত্রা শুরু করলাম।
MIT-তেই আমি প্রথমবারের মতো এয়ারক্রাফট সামনা-সামনি দেখতে পাই। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে এয়ারক্রাফটের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং দেখানোর জন্য সেখানে দুটো বাতিল এয়ারক্রাফট রাখা হয়েছে। সেই এয়ারক্রাফট দুটোর প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণ ছিল। আমি বারবার সেই এয়ারক্রাফটগুলোর সামনে ছুটে আসতাম। আমি সেই এয়ারক্রাফট দুটোকে দেখতাম ভিন্ন আঙ্গিকে। আমার কাছে এয়ারক্রাফট দুটো ছিল মানুষের যোগ্যতার প্রতীকের মতো। নিজের কল্পনার বাইরে চিন্তা করার যোগ্যতা।
অনেকটা নিজের স্বপ্নে পাখা জুড়ে দেওয়ার মতো। আকাশে উড়তে পারার প্রতি তীব্র আকর্ষণের জন্যই আমি অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ালেখা করি। এবং এই আকর্ষণের কারণেই নিয়ে বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম করে যাই। এয়ারক্রাফট চালানোর স্বপ্ন ছিল আমার। বায়ুমণ্ডলের উচু থেকে উঁচু স্তরে আমার এয়ারক্রাফট উঠতে থাকবে আর তার নিয়ন্ত্রণ থাকবে আমার হাতে-এই ছিল আমার স্বপ্ন। আর এই স্বপ্নই আমি লালন করে আসছিলাম। আর এখন আমি পাইলট হওয়ার শেষ ধাপে পৌছে গিয়েছি।
তামিলনাড়ু থেকে দেরাদুন বেশ অনেকটা পথ। কেবল ভৌগলিক দিক দিয়েই নয়, দুরত্বের দিক দিয়েও। আর আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমি আমার এই মায়াবী অঞ্চল থেকে হিমালয়ের পাদদেশে যাত্রা করছিলাম। সেখানে অপেক্ষা করছিল আমার পুরষ্কার। আমার পাইলট হবার স্বপ্ন।
.
প্রথমে আমি দিল্লিতে থামলাম। DID&P-এর ইন্টারভিউ এর জন্য। আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে এই ইন্টারভিউ কঠিন হবে না। বরং সহজ হবে। আমাকে নিজের জ্ঞানের পরিধির বাইরে চিন্তা করতে হবে না। আমি দিল্লিতে এক সপ্তাহ কাটালাম। তারপর রওনা দিলাম দেরাদুনে। এয়ার ফরস সিলেকশন বোর্ডের ইন্টারভিউয়ের জন্য। বলে রাখা ভালো যে, তখন আমার বয়স বিশের ঘরে। দুনিয়ার সামনে নিজেকে কিভাবে উপস্থাপন করতে হয়, সে বিষয়ে আমার জ্ঞান খুবই সামান্য। যখন আমি প্রথম রামেশ্বরাম থেকে পড়ালেখা করতে বড় শহরে যাই, আমি একজন লাজুক, স্বল্পভাষী বালক ছিলাম। আমার ব্যক্তিত্বের ইতিবাচক দিকগুলো ফুটিয়ে তুলতে আমাকে পরিশ্রম করতে হয়েছিল। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সাথে যোগাযোগ এবং কথাবার্তার মাধ্যমে আমি এমনটা করতে পেরেছিলাম। এটা মোটেও কোনো সহজ কাজ নয়। এই কাজে সক্ষম হবার জন্য আমাকে বহু হতাশার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। যাই হোক, তখন আমার পড়ালেখাও শেষ। আমিও চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য যাচ্ছি। আর তখন আমি তামিল এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে সক্ষম।
এবার আসি এয়ার ফরস ইন্টারভিউ সিলেকশন বোর্ডের কথায়। ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে আমাকে যে যে প্রশ্ন করা হলো, আমি তার সবগুলোর উত্তর দিয়ে গেলাম। আমি বুঝতে পারলাম যে, এখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বৈষয়িক জ্ঞানের পাশাপাশি স্মার্টনেসে’-র ওপরও জোড় দেওয়া হচ্ছে। প্রার্থীদের শারীরিক ক্ষমতা এবং আত্মপ্রকাশের ক্ষমতাই মূলত তারা খুঁজছিলেন। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম। এই চাকরি পাওয়া হবে আমার কাছে স্বপ্ন পূরণের মতো। আমি একই সাথে আত্মবিশ্বাসী, উদ্বিগ্ন, সংকল্পবদ্ধ এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলাম। অবশেষে ফলাফল প্রকাশিত হলো। আমি আমার ব্যাচে নবম স্থান অর্জন করি। কিন্তু পদ সংখ্যা মাত্র আটটি। আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আমি পাইলট হতে পারলাম না।
আমি এখনও আমার সেই ব্যর্থতার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারি। আমি প্রথমে বুঝতেই পারছিলাম না, আমার সাথে এ কি হয়ে গেল! যখন কারো দীর্ঘদিনের কোনো স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, তখন হতাশা আর শুন্যতা ছাড়া সে আর কিছু অনুভব করতে পারে না। আর স্বপ্নভঙ্গের এ বেদনা খুবই কষ্টকর। ফলাফল দেখার পর আমি আর ঘরের চার দেয়ালের মাঝে থাকতে পারলাম না। আমাকে মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নেয়ার জন্য বাইরে বের হতে হলো। কারণ ঘরে থাকলে আমার মনে হতো, ঘরের দেওয়াল চারিদিক দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
বাইরে বের হয়ে আমি একটি উচু চুড়ার কিনারায় উঠে নিচে তাকালাম। আমি নিচের লেকের টলমলে পানির দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম-এখন আমি কি করব? আমার পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে। আবার নতুন করে সবকিছু নির্ধারণ করতে হবে। আমি সিধান্ত নিলাম আমি কয়েকদিনের জন্য ঋষিকেশ যাব। সেখানে গিয়ে এক নতুন সূচনা নির্ধারণ করব।
.
পরদিন সকালে আমি ঋষিকেশ পৌছালাম। আমি গঙ্গায় স্নান করলাম। এই নদী সম্পর্কে আমি অনেক কিছু শুনেছি। তবে জীবনে প্রথমবারের মতো আমি নিজ চোখে এই নদী দেখলাম এবং স্নান করার অভিজ্ঞতা লাভ করলাম। আমাকে শিভানন্দ আশ্রমের কথা বলা হয়েছিল। আশ্রমটা একটা পাহাড়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। আমি সেখানে গেলাম। হেঁটেই পৌছালাম সেখানে। সেখানে প্রবেশ করা মাত্রই আমি নিজের মধ্যে এক ধরনের অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি পেলাম। এক ধরনের শান্তি আমার বেদনায় ব্যথিত হৃদয়ে জায়গা করে নিল। আশ্রমে সাধুরা ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ছিল। আমি আশা করছিলাম যে তাদের মধ্যে কেউ একজন হয়ত আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে। কেউ একজন আমার সকল দুশ্চিন্তা এবং হতাশার লাঘব করবে।
আমি স্বয়ং স্বামী শিভানন্দের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। আমি মুসলমান এ- নিয়ে তার কোনো সমস্যাই ছিল না। উল্টো তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন যে, আমি কি নিয়ে এতটা হতাশ। আমি অবাক হয়ে গেলাম। অবাক হলাম এই ভেবে যে-আমি তাকে কিছু বলার আগেই তিনি কিভাবে বুঝতে পারলেন যে, সম্প্রতি আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার কারণে আমি হতাশায় জর্জরিত। তিনি প্রথমে মনোযোগ দিয়ে আমার সব কথা শুনলেন। তারপর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আমি অনুভব করতে পারছিলাম যে, তার সামান্য একটু হাসিতে আমার যত দুশ্চিন্তা আছে তা দূর হয়ে গেছে। এবং সেই স্থান দখল করে নিয়েছে এক গভীর প্রশান্তি। তার পরবর্তী কথাগুলো আমার জীবনে পাওয়া শ্রেষ্ঠ সব উপদেশগুলোর মধ্যে একটি। এখনও তার সেই ব্যক্তিত্বসুলভ ভারি কন্ঠ আমার কানে বেজে ওঠে।
‘নিজের ভাগ্যকে গ্রহণ করো এবং ভাগ্যকে মেনে নিয়েই জীবনে সামনে এগিয়ে যাও। এয়ার ফোর্স পাইলট হওয়া তোমার ভাগ্যে নেই। তুমি যেই অবস্থানে যাবে, তা এখনও তুমি জানো না। তবে তোমার অবস্থান পূর্বনির্ধারিত। এই সাময়িক ব্যর্থতা ভুলে যাও। এই ব্যর্থতা তোমাকে তোমার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য দরকারি ছিল। তোমার জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য খুঁজে বের কর।…নিজেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে বিলীন করে দাও।’
এই শিক্ষা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করল। সত্যিই তো, আমরা কেন নিজেদের ভাগ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি? আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, সৃষ্টিকর্তা আমার জন্য যে লক্ষ্য নির্ধারণ করে রেখেছেন, এই ব্যর্থতা তারই একটি অংশ। আমি এই ব্যর্থতার কথা ভুলে গিয়ে সামনে বাড়লাম। আমি দিল্লিতে ফেরত আসলাম। সেখানে আমি জানতে পারলাম যে, আমাকে DTD&P-এর সিনিয়র সাইন্টিফিক অ্যাসিস্টেন পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আমি আমার পাইলট হওয়ার স্বপ্নের ইতি টানলাম। আমি বুঝতে পারলাম যে, আমার অন্য আরো অনেক কাজ করার আছে। আর আমাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আমি আমার সেরাটা দিয়ে সেই দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করব।
এভাবেই আমি আমার কর্মজীবন শুরু করি। আমার মতো যারা একটা নির্ধারিত লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে, তাদেরকেও সেই লক্ষ্য পূরণে অনেক অপ্রত্যাশিত বাধা-বিপত্তির সম্মুখিন হতে হয়। তখন আমাদেরকে পুনরায় আমাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের পথগুলোকে পুনরায় সাজাতে হবে। প্রতিটি ব্যর্থতাই আমাদেরকে নতুন শিক্ষা দেয় এবং জীবন সম্পর্কে নতুন কিছু জানার সুযোগ করে দেয়। এই পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের ব্যক্তিত্বেরও পরিবর্তন ঘটে। যখন আমরা আমাদের জীবনের বাধা- বিপত্তিগুলোর মুখোমুখি হই, আমরা আমাদের লুকায়িত সাহস এবং সহনশীলতা খুঁজে পাই। আমাদের জানা থাকে না যে, আমাদের মাঝে এতটা সাহস এবং সহনশীলতা আছে। তাই এই ব্যর্থতার মধ্য দিয়েই আমরা এই অমূল্য গুণাবলিগুলোকে নিজেদের মাঝে আবিষ্কার করতে পারি। আমাদের সেগুলোকেই নিজের পথের পাথেয় করে জীবনে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।