আমার মমতাময়ী মা এবং স্নেহশীল বোন
আজ থেকে বহুদিন আগে, (বেশ কয়েক বছর) আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম। কবিতার নাম ‘আমার মা’। কবিতাটি হলো-
মা,
এই সুবিশাল সমুদ্রের প্রতিটি স্রোত, এই মৃত্তিকার সোনালি বালুকণা, তীর্থযাত্রার অভিযাত্রীদের দৃঢ় সংকল্প, রামেশ্বরম মসজিদের সেই পবিত্র রাস্তা, এই সবকিছুই যেন তোমার মাঝে মিশে এক হয়েছে। আমার জীবনে তুমি এক স্বর্গীয় আশির্বাদ। জীবনযুদ্ধের সেই কঠিন দিনগুলোর কথা আমার এখনও মনে পড়ে।
মনে পড়ে, আকাশে সূর্যের প্রথম কিরণ উকি দিলেই, কয়েক মাইল পথ পাড়ি দিয়ে মন্দিরের কাছে আমার ফেরেশতার মতো শিক্ষকের কাছে পড়তে যাওয়ার কথা। এরপর আবার কয়েক মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আরবি শিখতে যাওয়ার কথা।
মনে পড়ে, স্টেশন রোডের সেই পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে সংবাদপত্র সংগ্রহ করে তা সবার মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার কথা। সূর্যোদয়ের কিছু সময় পরেই আবার স্কুল, এরপর সারাটা সন্ধ্যার কর্মব্যস্ততার পড়ে রাতে আবার পড়াশুনা করার পালা।
সেই দুর্ভাগা কিশোরের কষ্টগুলোকে, মা তুমি পরিণত করেছ শক্তিতে, সৃষ্টিকর্তার কাছে দিনে পাঁচবার মাথা নত করে। সর্বশক্তিমানের করুণা চেয়ে। মাগো, তোমার ভক্তি, তোমার সন্তানের সবচেয়ে বড় শক্তি। তুমি সর্বদা সকলকে কেবল দিয়েই গেছ। সৃষ্টিকর্তার ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রেখে বিলিয়ে দিয়েছ নিজেকে।
তখন আমার বয়স মাত্র দশ। তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলাম আমি। তোমার কোলে আমাকে ঘুমাতে দেখে ভাইবোনদের হিংসা হচ্ছিল তখন। সেদিন ছিল জোৎস্না রাত, আর আমার সমগ্র দুনিয়া ছিল কেবল তোমাকে নিয়ে মা। শুধুমাত্র তোমাকে নিয়ে।
মাঝরাতে যখন আমি চোখে পানি নিয়ে জেগে উঠেছিলাম, তখন তুমি ঠিকই তোমার সন্তানের কষ্ট বুঝতে পেরেছিলে। তোমার হাতের উষ্ণ ছোঁয়ায় আমার সব কষ্ট দূর হয়ে যেত।
তোমার ভালোবাসা, তোমার স্নেহ, তোমার বিশ্বাস আমাকে শক্তি দিয়েছে। আমি নির্ভীকচিত্তে জগতের সকল সংগ্রামের মুখোমুখি হতে পেরেছি। বিচারের দিনে আবার তোমার সাথে দেখা হবে মা।
আমার শ্রদ্ধেয় মায়ের স্মরণে
.
শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত আমার যত স্মৃতি আছে তার প্রায় সবগুলোই রামেশ্বরামকে নিয়ে। রামেশ্বরামের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে। আর এই বেড়ে ওঠার সময়টাতে আমার জগতের মধ্যমণি ছিল দুজন-তারা হলেন আমার মা এবং বাবা।
আমি বেড়ে উঠি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। আমার বাবা ছিলেন রামেশ্বরামের মসজিদের ইমাম। এছাড়া বাড়তি আয়ের জন্য বাবা কিছু ব্যবসায়ের সাথেও জড়িত ছিলেন। ছোটখাট ব্যবসা। আমার মায়ের নাম আশিয়ানা। আমার মা বংশগত দিক দিয়ে খানদানি। আমার মা যে পরিবার থেকে এসেছেন, সেই পরিবার ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ‘বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিল। অনেক আগেই তারা এ-উপাধি পায়। আমার মা একজন অত্যন্ত বিনয়ী এবং ধার্মিক মহিলা। মা ও বাবার মতো একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান। মা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই সময়মতো আদায় করতেন। আমার মনে পড়ে না যে, মায়ের কখনও এক ওয়াক্তের নামাজও কাযা হয়েছিল। নামাজের সময় মায়ের মধ্যে এক ধরনের নিষ্ঠা এবং শান্তিপূর্ণতা বিরাজ করত। আমাদের বিশাল পরিবারের দেখাশুনা মা একাই করতেন। আর পরিবারের দেখাশোনা করতে গিয়েই মা নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে দিতেন। আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, আমাদের ছিল একান্নবর্তী পরিবার। আমাদের পরিবার গঠিত ছিল আমি, আমার ভাইবোন, আমাদের কিছু নিকট আত্মীয়, আমার দাদা-দাদি, চাচা-চাচি এবং তাদের সন্তানদের নিয়ে। আমরা সবাই একই বাড়িতে থাকতাম। এই বিশাল পরিবারের সবার চাহিদা মেটানো কখনই সম্ভব ছিল না। সামান্য হলেও, অভাব লেগেই থাকত। আমাদের সবার জন্য কোনো কিছুই প্রচুর পরিমাণে ছিল না। আমার বাবার নৌকা তৈরির ব্যবসা, ফেরী ব্যবসা এবং নারকেলের বাগান ছিল। তার আয় বেশ ভালোই ছিল। তবে তার আয়ের সম্পূর্ণ অংশই খরচ হতো আমাদের প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে। আমাদের পক্ষে বিলাসিতা করার কোনো সুযোগ ছিল না।
এই প্রেক্ষিতে মা ছিলেন বাবার জন্য যথোপযুক্ত সঙ্গিনী। আমার মা মিতব্যয়ীতার মর্ম বুঝতেন এবং তিনি নিজেও মিতব্যয়ী ছিলেন। আর মিতব্যয়ীতার মাধ্যমে সংসার চালাতে গিয়ে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও বিরক্ত হতেন না বা রাগও করতেন না। এমন কি আমাদের জীবনযাপন নিয়ে তার সামান্যতম কোনো অভিযোগও ছিল না।
প্রায় প্রতিদিনই পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি অতিথিরাও আমাদের সাথে খাবার খেতেন। আমাদের বাড়িতে অতিথিদের ভীষণ যত্ন করা হতো। আর কোনো অতিথি কোনো স্বল্প সময়ের জন্য বা কোনো কাজে এলেও আমরা তাদেরকে না খাইয়ে যেতে দিতাম না। এতে পরিবারের সদস্যরাও সন্তুষ্ট হতো এবং অতিথিরাও। এখন যে কথা মনে পড়লে আমি বুঝতে পারি, মাকে প্রতিদিন দ্বিগুণ রান্না করতে হতো। কারণ অতিথির সংখ্যাও পরিবারের সদস্য সংখ্যার সমান থাকত। তবে মা খুব স্বাভাবিকভঅবেই রান্নার কাজ করে যেতেন। তিনি কখনও এটিকে বাড়তি চাপ বা উটকো ঝামেলা হিসেবে বিবেচনা করতেন না। এক সময় গোটা ভারতবর্ষই আতিথিয়তার জন্য বিখ্যাত ছিল।
আমার শৈশব কাটে আনন্দের মধ্য দিয়ে। আমার শৈশব ছিল নিরাপদ। আমার শৈশবের স্মৃতির একটি বিশেষ অংশ জুড়ে আছে মায়ের সাথে খেতে বসা। আমরা রান্নাঘরের মেঝেতে খাবার খেতাম। খাবার খেতাম কলাপাতায়। আমাদের কমন খাবারের আইটেম ছিল ভাত, আর বাড়িতে তৈরি চাটনি এবং নারকেলের চাটনি। আমার মায়ের রান্নার হাত ছিল সাধারণ তবে অতুলনীয়। মায়ের হাতের তৈরি খাবারের যে স্বাদ লেগে আছে তা আমি আর কোথাও পাইনি। মায়ের তৈরি এই খাবারে টক এবং মসলার মধ্যেকার ভারসাম্য ছিল একদম যথাযথ। খাবারের কথা বলাতে আরেকটা গল্প মনে পড়ে গেল। এই গল্পও খাবারের সাথে সম্পৃক্ত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কথা। আমরা রেশনের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য কিনতাম। তবে যুদ্ধের কারণে খাবারের সরবরাহ কমে যায়। তাই সবসময় ঘাটতি লেগে থাকত। কখনই পরিমাণে পর্যাপ্ত কিছু কেনা যেত না। আমার মা এবং দাপিজান সবকিছু ঠিকভাবে চালিয়ে নেয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। একই সাথে খাবার যতটা সম্ভব সংরক্ষণ করা যায় তারা সেই চেষ্টাও করতেন। তারা এই বিষয়েও খেয়াল রাখতেন যাতে খাবারের অপচয় না হয়। তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যেন পর্যাপ্ত খেতে পায় তারা সেজন্য নিজেদের ভাগের খাবারও কোনো অভিযোগ ছাড়াই সন্তানদের মাঝে ভাগ করে দিতেন। একদিন মা ভাতের বদলে চাপাতি বানালেন। চাপাতি এক ধরনের শক্ত রুটি। সেদিন খেতে বসে আমি তৃপ্তির সাথে একের পর এক চাপাতি খেতে থাকলাম। মাও চাপাতি দিয়ে যাচ্ছিলেন। আর আমিও খেয়ে যাচ্ছিলাম। কী আর করা! অনেক ক্ষুধা পেয়েছিল যে। আমার খাওয়া যখন শেষ হলো, আমি আমার কলাপাতার প্লেট হাতে উঠে গেলাম। প্লেট পরিষ্কার করলাম। রাতে আমার ভাই যখন যখন বাড়িতে এলেন, তিনি আমার সাথে কথা বলার জন্য ঘরের এক পাশে নিয়ে গেলেন। জীবনে প্রথমবারের মতো তিনি আমাকে বকা দিলেন। তিনি বলা শুরু করলেন- তুমি কীভাবে এ-কাজ করলে? তুমি কী চোখে দেখতে পাও না?’
প্রথমে আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম-তিনি আমাকে বকা দিচ্ছেন কেন? আমার দোষ কী? আমি বোকার মতো তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার অবস্থা দেখে তিনি নরম হয়ে গেলেন। এরপর তিনি ব্যাখ্যা করলেন- ‘তুমি কী জানতে যে আমাদের প্রত্যেকের ভাগে মাত্র দুটি কি তিনটি চাপাতি বরাদ্দ? মা কখনই তোমাকে মুখ ফুটে কিছু বলবেন না। যেহেতু তুমি খেয়েই যাচ্ছিলে, মা তোমাকে একের পর এক চাপাতি দিয়ে যাচ্ছিলেন। আর এখন পর্যন্ত মা না খেয়ে আছেন। খাওয়ার জন্য ঘরে আর কিছুই নেই।’
আমার মায়ের ক্ষুধার্ত শুকনো মুখের ছবি আমার মনে ভেসে উঠেছিল। আমার মা শতকষ্টেও মুখ ফুটে কিছু বলবেন না। আর নিজের সন্তান হলে তো মরে গেলেও কিছু বলবেন না। লজ্জায় এবং কষ্টে আমার হৃদয় ভেঙে পড়ল।
আমি নীরবে কাঁদলাম। লজ্জায় আমি কারো সামনে গেলাম না। এই ঘটনার কয়েকদিন কেটে যাবার পর আমি মায়ের মুখোমুখি হতে পেরেছিলাম।
এই ঘটনা ছিল আমার জন্য বড় এক শিক্ষা। আমি শিখলাম যে নিজের কাছের মানুষদের কথা কখনই ভুলে যাওয়া চলবে না। মা তার সন্তানের প্রতি ভালোবাসার কারণে একবারও চিন্তা না করে তার নিজের খাবার আমার পাতে তুলে দিয়েছিলেন। আর আমার ভাই আমার সামনে সেই সত্য তুলে ধরেছিলেন। এরপর থেকে আমি খেতে বসলে নিশ্চিত হয়ে নিতাম যে পরিবারের সবার জন্য উপযুক্ত খাবার আছে কি না। বিশেষ করে, মা এবং দাদিজানের।
.
আমি কোনো বড় শহরে পড়ালেখা করতে চাইছিলাম। তাই আমাকে বেশ অল্পবয়সেই ঘর ছাড়তে হয়েছিল। ফলে আমার পক্ষে বেশিদিন আমার মমতাশীল মায়ের কাছে থাকা হয়ে উঠেনি। যেমনটা আমার বন্ধুরা পেয়েছিল।
তবে আমার মায়ের মমতা এবং যত্নশীলতা আমার অন্তরে চিরকাল গেঁথে থাকবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আমি সংবাদপত্রের ‘ডেলিভারি বয়’-এর কাজ করি। আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, আমি কিভাবে এই কাজ পাই। আর কিভাবে এই কাজ চালিয়ে গেছি। তখন আমার বয়স ছিল আট বছর। আমার দিন শুরু হতো সেই ভোরবেলায়। ভোরবেলায় উঠে আমাকে গণিত শিক্ষকের কাছে পড়তে যেতে হতো। এরপর কোরআন পাঠের জন্য যেতে হতো। তারপর সংবাদপত্র বিলি। তারপর স্কুল এবং স্কুল শেষে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে এসে আবার পরবর্তী দিনের জন্য পড়া তৈরি করতে হতো। আর এই সকল কাজে মা ছিলেন আমার একমাত্র আস্থা। মা ছায়ার মতো আমার সাথে থাকতেন। ভোরবেলায় মাকে আমার আগে ঘুম থেকে উঠতে হতো। মা আমার গোসলের পানির ব্যবস্থা করে আমাকে ঘুম থেকে উঠাতেন। মা আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে আর ঘুমাতেন না। আমার ফেরার অপেক্ষায় থাকতেন। এক কি দু ঘন্টা পর আমি ফিরে এলে, বাবার হাত ধরে কোরআন শিখতে যেতাম। দিনের বেলা আমাকে এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় যেতে হতো। আমি ঘরে এলে কেবল খাওয়ার সময়টুকু পেতাম। সেই খাবার সুন্দরভাবে আমার জন্য পরিবেশন করা থাকত। মা কখনও বলেননি, তবু আমি জানি যে, মা বহুবার তার নিজের ভাগের খাবারটুকুও আমাকে দিয়েছেন যাতে আমি পেট পুরে খেতে পারি। আমি একবার মাকে এ-নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। মা আমার দিকে তাকিয়ে শুধু হেসেছিলেন। মা আমাকে বলেছিলেন-
তুমি এখন বাড়ন্ত বয়সের একটি ছেলে। এই বয়সেই তোমাকে অনেক কাজ করতে হয়।” আমার মা এমনই। তিনি আমাকে অপ্রত্যক্ষভাবে বোঝাতে চেয়েছিলেন, ‘আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না।’
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসার পর মা আবার আমাকে পরবর্তী দিনের প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করতেন।
আমার সকল ভাইবোনদের মাঝে আমিই মায়ের সাথে সবচেয়ে বেশি সময় কাটাতাম। একটা ঘটনা আমার মনে পড়ে। একবার আমি মায়ের কোলে হাত রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমার মা চুপচাপ বসে আমার মাথায় এবং গালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি নিজেও বুঝতে পারিনি ঠিক কখন আমার হৃদয় অশ্রুসিক্ত হয়ে গেছে। সেই অশ্রুবিন্দু হৃদয় ভেদ করে চোখে ঠাঁই নিয়েছে। আমি কিছু করতে পারার আগেই আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। আমার চোখ তখনও বন্ধ ছিল। তবে তাতে অশ্রুবিন্দুর কোনো সমস্যা হলো না। সেই অশ্রুবিন্দু মায়ের হাঁটুতে এবং শাড়িতে গড়িয়ে পড়ল। তবে মা আমার চুলে এবং গালে হাত বোলানো বন্ধ করলেন না। মা জানতেন সেই অশ্রুবিন্দু ঠিক কী কারণে দেখা দিয়েছে। কারণটি হলো-একটি বাচ্চা ছেলের প্রচণ্ড ক্লান্তি। যে কিনা এই ছোট্ট বয়সেই শিশু থেকে পুরুষ হওয়ার চেষ্টায় মত্ত। মায়ের নরম আঙুল আমার চুল এবং গাল স্পর্শ করছিল। সেই স্পর্শে রয়েছে শান্তি, সেই স্পর্শে রয়েছে নিজের সন্তানের কষ্ট উপলব্ধি করার অনুভূতি।
আমার মা খুবই সাধারণ একজন মহিলা। যে বেড়ে উঠেছে ভারতের দক্ষিণের ছোট্ট একটি শহরে। তবে তার মমতার তুলনা হয় না। মায়ের এই মমতা এবং ভালোবাসাকে যদি সাগরের সাথে তুলনা করা হয়, তবে সাগরের তল পাওয়া যাবে কিন্তু মায়ের মমতা বা ভালোবাসার তল পাওয়া যাবে না। আর কেবল আমার মা নয়, দুনিয়ার সকল মা এরকম। আমার মা কখনও বাড়ির বাইরে বের হয়ে শহরের ঘটনাবহুলতায় অংশ নেননি। এমন কি তিনি
কখনও কোনো পেশার সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন না। যেমনটা আজকালকার মায়েদের মধ্যে দেখা যায়। তার কাজের পরিধি ছিল তার পরিবার এবং ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে তারপরও মা আত্মত্যাগ এবং পরম নিষ্ঠার সাথে সৃষ্টিকর্তা এবং পরিবারের সকলের সেবা করে গেছেন। আমার মায়ের জীবন থেকে আমি যে শিক্ষা পেয়েছি তা হলো-
‘তোমার কর্মক্ষেত্র বড় হোক বা ছোট হোক, তা কোনো ব্যাপার নয়। তোমাকে তোমার জন্য নির্ধারিত কাজের প্রতি সংকল্পবদ্ধ থাকতে হবে।’
.
আমার বাবা ১০২ বছর পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। তিনি যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন তার ঘরে ১৫ নাতি-নাতনি। বাবার মৃত্যু আমাকে ভীষণ নাড়া দেয়। আমি তখন টুম্বায় কর্মরত ছিলাম। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে আমি তৎক্ষণাৎ বাড়ি ফিরে আসি। বাড়ি এসে এসে দীর্ঘসময় আমি মায়ের পাশে বসেছিলাম। আমি যখন ফিরে আসব মা ভরা গলায় আমাকে আশির্বাদ করলেন। আমি তখন এস.এল.ভি-৩ রকেট বানাচ্ছিলাম। তখনও অনেক কাজ বাকি। তাই মা একবারের জন্যও আমাকে থেকে যেতে বলেননি। আমার কী মাকে সঙ্গ দেওয়া উচিত ছিল?
আমার কী উচিত ছিল না নিজের কর্মব্যস্ততা ফেলে এই বৃদ্ধ মহিলার সাথে কিছুটা সময় কাটানো, যাকে আমি আর কোনোদিন দেখতে পাইনি। আমি বহুবার নিজেকে এই প্রশ্ন করেছি। তবে কোনো উত্তর পাইনি।
বাবার মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই মাও মারা গেলেন। এ-কথা বললে বেশি মানাবে যে-মা আর বেশিদিন বাঁচতেনও না সেই মানুষটাকে ছাড়া। যার সাথে তিনি দীর্ঘ ৮০টা বছর কাটিয়েছেন।
মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে আমি আবার রামেশ্বরামে এলাম। মায়ের অগণিত স্মৃতি আমাকে ঘিরে ধরল। যে দুজন মানুষ আমাকে তৈরি করেছেন, আমার চিন্তা চেতনা এবং ব্যক্তিত্ব গড়ে দিয়েছেন-তাদের কেউই আর নেই। তাদেরকে ছাড়াই আমাকে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে। তবে আমি জানতাম
তাদের একজনকে ছাড়া অন্যজন বাঁচতে পারবে না। আর এই কথা ভেবেই আমি স্বস্তি পেলাম। আমি মসজিদে গেলাম। এই মসজিদেই আমি আমার বাবার কাছে পড়তে শিখেছি। আযানের ধ্বনি শোনা গেলেই বাবা-মা পুরো পরিবারকে জড়ো করে নামাজে পাঠাতেন। আর এগুলো এখন কেবল স্মৃতি।
আমার সুন্দর শৈশব, কালের গর্ভে বিলীন পিতা-মাতা, একজন মমতাশীল মা-যিনি নিজের সন্তানের গভীর অনুভূতি বুঝতে পারতেন, সবই এখন স্মৃতি হয়ে এই হৃদয়ে গেঁথে আছে।