আমার বোন জোহরা

আমার বোন জোহরা

আমি আগেই বলেছি আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ছিল। সেই একান্নবর্তী পরিবারের দশ ভাইবোনের একজন আমি। এছাড়াও পরিবারে অনেক চাচাত ভাইবোন ছিল। শুধু এখানেই শেষ নয়। আমাদের সাথে অনেক নিকট আত্মীয়ের বাচ্চাকাচ্চারাও থাকত। আমরা কখনই তাই একাকিত্ব বা একঘেঁয়েমি নামক কোনো অনুভূতি কী তা বুঝতেও পারিনি। সারাটা সময় জুড়েই আমরা কিছু না কিছু করতেই থাকতাম। এই উঠলাম গাছে, আবার কিছুক্ষণ পরেই কোনো খেলা জুড়ে দিতাম। আবার কোথাও পিকনিকে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে বসতাম।

আমরা ছিলাম একদল চঞ্চল, দুষ্টু ছেলেমেয়েদের দল। আমরা সবসময়ই আনন্দে থাকতাম। এবং যে কোনো প্রয়োজনে একে অপরের পাশে থাকতাম।

আমার বড় বোনের একজন হলেন জোহরা। আমাদের দেশের আর পাঁচ দশটা মেয়ের মতোই ও বেড়ে ওঠে। জোহরা স্কুলে গিয়েছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও অর্জন করেছে। পাশাপাশি জোহরা ঘরের কাজেও মা ও দাদিজানকে সাহায্য করত। আর আমার মায়ের একমাত্র সার্বক্ষণিক সঙ্গ ছিল জোহরা। মা মেয়ের সম্পর্ক ধীরে ধীরে বন্ধুত্বে পরিণত হয়। সংসারের যাবতীয় কাজ যেমন-ধোয়া মোছা, রান্না-বান্না, ছোটদের দেখাশোনা সব কিছুই মা এবং জোহরা মিলে সামলাত। মায়ের মতো জোহরাও আমাকে একটু বিশেষভাবে পছন্দ করত। এর পেছনের একটা কারণ হলো আমি কিছুটা ব্যতিক্রম দেখতাম। আমি স্বপ্ন দেখতাম এবং আমার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চাইতাম। আমি আমার এবং সঙ্গি সাথিদের মতো অতটা অহংকারি ছিলাম না। প্রায়ই সময়ই আমি কোনো দুষ্টুমির ফন্দি না এঁটে কোনো বই বা পত্রিকা পড়ে সময় পার করতাম। জোহরা তার সাধ্যমতো আমার যত্ন করত। সে খেয়াল রাখত যাতে তার আদরের ছোট্ট ভাইটি দুষ্টু ছেলেদের সাথে মিশে দুষ্ট না হয়ে যায়।

.

আমি যখন ছোট ছিলাম তখনই আমার এক চাচাত ভাই আমাদের পরিবারের সাথে জড়িয়ে পরে। তার নাম আহমেদ জালালউদ্দীন। আমাদের ছোট্ট এলাকায় সে মুক্ত বাতাসের মতো প্রভাব ফেলতে থাকে। সে ভালোই পড়ালেখা করেছে। এবং সে ইংরেজি পড়তে ও লিখতে পারে। এলাকার সবাই পরিবারের সবাই তার ওপর ভরসা করতে পারত। জীবন নিয়ে তার বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। রামেশ্বরামের বাইরেও যে আরো সুন্দর জীবন অপেক্ষারত আছে তা তিনি জানতেন এবং সেই অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত রাখতেন। তিনি আমাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এবং এক সময়ে আমাদের পরিবারের অংশ হয়ে যান।

জালালউদ্দীন আমাকে অনেক পছন্দ করতেন। জালালউদ্দীন আমার কৌতূহলের প্রশংসা করতেন। এবং আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন। আমার মাথায় সারাদিনই আশেপাশের জিনিস নিয়ে প্রশ্ন জাগত। যেমন-পাখি কেন ওড়ে? বৃষ্টি কীভাবে তৈরি হয়? ইঞ্জিন কীভাবে কাজ করে? এরকম নানান প্ৰশ্ন।

জালালউদ্দীনই প্রথম বুঝতে পারেন যে, রামেশ্বরাম স্কুলে থেকে আমার পক্ষে আমার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তিনি আমার বাবার সাথে এ-বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি আমার বাবাকে পরামর্শ দেন, আমাকে রামনাথপুরে পাঠানোর। সেখানে আরো বড় এবং ভালো স্কুল আছে। এভাবেই আমার জীবন এক নতুন দিকে মোড় নিল। আমি রামনাথপুরে চলে গেলাম। রামনাথপুরে পড়ালেখা শেষ করে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই)-এ চলে আসব। সেখানে মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (MTT)-তে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব। আমি রামনাথপুরে থাকাকালীন সময়েই জোহরা এবং আহমদ জালালউদ্দীনের বিয়ে হয়। আমার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের ক্ষেত্রে এই দুজনের অবদান সবচাইতে বেশি।

জোহরা সংকল্পবদ্ধ ছিল আমাকে নিয়ে। যেন আমি আমার স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষাকে দৃঢ়ভাবে গড়ে তুলতে পারি। আর জালালউদ্দীন আমার দিক নির্দেশক হিসেবে কাজ করতেন।

আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা বেশি ভালো ছিল না। আমাদের পরিবার তখনও আমার বাবার আয়ের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। এই অবস্থায় আমার MTT-তে ভর্তির জন্য ৬০০ রূপি কীভাবে জোগাড় হবে?

বর্তমান সময়ে ৬০০ রূপি টাকা কোনো বড় অঙ্কের টাকা না। খুবই সামান্য পরিমাণ টাকা। তবে সেই সময়ে এই ৬০০ রূপিই ১ লাখ রূপির সমতুল্য ছিল।

এই পরিস্থিতির সামনে এসে আমি আমার বোনকে সত্যিকার অর্থেই চিনতে পারলাম। তার এক কথা যে, তার ছোটভাইকে কোনো কিছুই আটকাতে পারবে না। সে তার স্বামীকেও একই কথা বলল। আমার বাবা-মা জোহরার বিয়ের সময় ওকে দেয়ার জন্য কিছু গহনা রেখে দিয়েছিলেন। ভারতের মহিলারা ঐতিহ্য অনুযায়ী ঘরে গহনা পড়ে থাকে। আর অনেকেই এই স্বর্ণের গহনাপাতি বিপদের জন্য রেখে দেয়। যাতে বিপদ এলে ভরসা পাওয়া যাবে। তাই হঠাৎ খারাপ দিন এলে এই গহনা জামানত হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

আমার বোন সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্ত দেরি করেনি। একটিবার ইতস্তত পর্যন্তও করেনি। একবারও ভাবেনি যে, তার নিজের পরিবারের জন্য এ-গহনা দরকার হতে পারে। জোহরার তখন নিজের আলাদা পরিবার আছে। সে একজন স্বর্ণকারের কাছে যায়। সেখানে তার গহনা বন্ধক রেখে আমার MTT – তে ভর্তির টাকা এনে দেয়।

এই ঘটনা আমার হৃদয় স্পর্শ করে যায়। আমার জন্য যারা আত্মত্যাগ করেছেন তার মধ্যে জোহরাই প্রথম। জোহরাই আমার ভর্তির সমস্যার সমাধান

করে দেয়। ও ওর সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করে গিয়েছে। জোহরা জানে ওর ভাই কঠোর পরিশ্রম করবে। তার ভাইয়ের ওপর পূর্ণ আস্থা ছিল। সে জানত যে, তার ভাই একজন সেরা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে।

জোহরার গহনা বন্ধকের টাকা দিয়ে আমি MIT-তে ভর্তি হলাম। আমি উপার্জন শুরু করার পরই প্রতিজ্ঞা করলাম যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি জোহরার গহনা ছাড়িয়ে এনে দেব। এবং আমি তা করতে পেরেছি। আমি ভালো ফলাফলের জন্য একই সাথে বৃত্তি স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম।

মায়ের মতো, জোহরাও পুরোটা জীবনই রামেশ্বরামে কাটে। জোহরা একজন সাধারণ ভারতীয় নারী। প্রতিটি ভারতীয় নারীর মতো জোহরাও সহ্যশক্তি এবং মমতার প্রতীক। আর পাঁচটা ভারতীয় নারীর মতো জোহরাও কখনও নিজেকে নিয়ে ভাবেনি। যে ভেবে গেছে তার পরিবার, তার ভাই এবং তার স্বামীর স্বপ্ন নিয়ে। সে তার ভাই, স্বামী, পিতার আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্ন পূরণ করে গেছে। তবে একটিবারের জন্যও নিজের স্বপ্ন বা নিজেকে নিয়ে ভাবেনি।

আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি, জোহরার কী কোনো স্বপ্ন ছিল না?

নিয়তি, অবস্থা এবং প্রথা তাদেরকে বারবার পরীক্ষা করতে থাকত। এবং বরাবরের মতো তাকে তা ত্যাগ তিতিক্ষা সংরক্ষণ এবং তৈরি করে যেতে হবে। তারপর সে তার পরিবারের জন্য ভালোবাসার অভাব হতে দেবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *