আট বছরের এক ছেলের গল্প

আট বছরের এক ছেলের গল্প

প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজের এক বড় স্তূপ আমার কাছে পৌছে যায়। এই খবরের কাগজের অধিকাংশই ইংরেজি এবং তামিল। আমি যখন বিদেশ ভ্রমণে থাকি তখনও আমি ভারতের বিভিন্ন সংবাদ সম্পর্কে ওয়াকেবহাল থাকি। দেশের বাইরে থাকাকালীন অনলাইনে বিভিন্ন খবরের কলাম এবং সম্পাদকীয় পাতায় চোখ বুলিয়ে নেই। এই প্রযুক্তি এক কথায় অসাধারণ। মাত্র একটি ক্লিকেই অগণিত তথ্য পেয়ে যাবেন আপনি। আর এই তথ্যভাণ্ডার আমাকে বিস্মিত করে। যেহেতু আমি ইঞ্জিনিয়ারিং জগতের সাথে সম্পৃক্ত, প্রযুক্তির উন্নয়নে আমার বিস্ময় বোধ করা উচিত না। কিন্তু আমি যখন বর্তমান সময়ের সাথে ৭০ বছর আগের সময়কালটা তুলনা করি আমি বিস্মিত না হয়ে পারি না। বৰ্তমান সময়ে থেকে ৭০ বছর আগে একটি দক্ষিণ ভারতীয় শহরের জীবনের কথা চিন্তা করতে গিয়ে আমি চমকে উঠি।

আমার জন্ম ১৯৩১ সালে। যখন আমার বয়স আট, তখন শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ব্রিটেইন, হিটলারের নাজি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। ভারতের কংগ্রেস কোনো ধরনের যুদ্ধে জড়াতে চাইছিল না। কিন্তু ভারত তখন একটি ব্রিটিশ কলোনি। তাই যুদ্ধের বিরোধিতা করা সত্ত্বেও ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে রেকর্ড সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য মোতায়েন করা হয়।

তবে সাধারণ মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে যুদ্ধের তেমন কোনো প্রভাব পড়ল না। বিশেষ করে আমরা যারা দেশের দক্ষিণ প্রান্তে ছিলাম, তাদের জীবন সাধারণ নিয়মেই চলছিল। আমি আগেই বলেছি, ১৯৪০-এর দিকে রামেশ্বরামও আর পাঁচ দশটা সাধারণ ছোট শহরের মতোই ছিল। তবে এই শহর জীবন নিজ রূপ ফিরে পেত পুণ্যারথি এবং পর্যটকদের আগমনে। রামেশ্বরামের স্থানীয় লোকেরা পেশায় ছিল সাধারণ ব্যবসায়ী। অধিকাংশ লোকই ছোট ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ছিল।

শহরের প্রাণকেন্দ্র ছিল একটি শিবমন্দির। তবে শহরে ভিন্ন ধর্মালম্বীদের উপাসনার জন্য একটি মসজিদ ও চার্চও ছিল। স্থানীয় লোকজনের পারস্পরিক সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। সবাই মিলেমিশে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বসবাস করত। স্বাভাবিকভাবেই মানুষজনের মধ্যে মাঝেমাঝে ঝগড়া-বিবাদ হতো। এরকমটা সব জায়গায়ই হয়ে থাকে। কিন্তু কোনোদিন গুরুতর কোনো ঝামেলা হয়নি।

বহির্বিশ্বের সাথে আমাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল সংবাদপত্র। যে এজেন্সি রামেশ্বরামে সংবাদপত্র বিতরণ করত তার মালিকের নাম শামসউদ্দীন। শামসউদ্দীন সম্পর্কে আমার চাচাত ভাই। জালালউদ্দীনের পাশাপাশি শামসউদ্দীন আমার জীবনে অনেক বড় ভূমিকা রাখেন। শামসউদ্দীন লিখতে ও পড়তে পারতেন। তবে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। শামসউদ্দীন আমাকে ভীষণ পছন্দ করতেন। তিনি আমাকে নানাভাবে উৎসাহ দিতেন। এভাবেই তিনি আমার জীবনের ওপর প্রভাব বিস্তারকারীদের একজন হয়ে ওঠেন। এই দুইজন ব্যক্তি আমার গভীর চিন্তাভাবনা এবং আবেগ- অনুভূতি খুব সহজেই বুঝে ফেলতেন। তাদেরকে আমার মুখ ফুটে কিছু বলা লাগত না। তারা নিজ থেকেই ধরে ফেলতেন। আমিও তাদেরকে দেখতাম ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে। আমার কাছে তারা ছিল, দুজন আগ্রহী মানুষ যারা নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনধারা এবং ব্যবসা থেকে বের হয়ে এই বিরাট পৃথিবী দেখার সুযোগ পাননি।

শামসউদ্দীনের সংবাদপত্র বিতরণ এজেন্সিই ছিল শহরের একমাত্র সংবাদপত্র বিতরণ সংস্থা। শহরে প্রায় হাজারের অধিক শিক্ষিত লোক ছিল। তাদের সকলের কাছেই সংবাদপত্র পৌছে দেয়া হতো। সংবাদপত্রে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন সংবাদ ছাপা হতো। তখন এই ধরনের সংবাদ বহুল আলোচিত সংবাদ।

এই সংবাদগুলো মানুষজন মন দিয়ে পড়ত এবং উৎসাহ নিয়ে আলোচনা করত। সংবাদপত্রে বিশ্বযুদ্ধের খবরও থাকত। হিটলার এবং তার নাৎসি সেনা সম্পর্কেও। এছাড়াও অন্যান্য সংবাদ তো থাকতই। যেমন, রাশি সংবাদ এবং বিভিন্ন পাথরের গুনাগুণ। এই সংবাদগুলোও সমান আগ্রহ নিয়ে আলোচিত হতো। সেই সময়কার সবচেয়ে জনপ্রিয় তামিল সংবাদপত্র ছিল “দিনামানি’।

এই সংবাদপত্রগুলো যে পদ্ধতিতে পাঠকদের হাতে পৌছাত, তাও বেশ স্বতন্ত্র। সংবাদপত্রের বান্ডিল সকালের ট্রেনে করে রামেশ্বরামের স্টেশনে পৌঁছাত এবং এজেন্সির লোক না যাওয়া পর্যন্ত স্টেশনেই রাখা হতো। এরপর স্টেশন থেকে সেই বান্ডিল সংগ্রহ করে পাঠকেদের কাছে পৌছে দেওয়া হতো। এই সংবাদপত্রগুলো পাঠকদের হাতে পৌছে দেয়াই ছিল শামসউদ্দীনের ব্যবসা। সে কোনো ঝামেলা ছাড়াই সহজভাবে তার কাজ করে আসছিল।

.

যাই হোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পুরোদমে শুরু’ হওয়ার পর আমরা আর বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলাম না। আর এই অবিচ্ছন্নতা আমার জীবনে এবং সংবাদপত্র বিতরণ ব্যবসায় অদ্ভুতভাবে প্রভাব ফেলে। ব্রিটিশ সরকার অনেক ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের ওপর স্যাংশন জারি করল। বর্তমানেও কোনো জরুরি অবস্থার প্রেক্ষিতে এ-ধরনের স্যাংশন বা অবরোধ জারি করা হয়। আমাদের সুবিশাল পরিবারেও তখন নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে অসুবিধার সম্মুখিন হলো। খাদ্যদ্রব্য, পোশাক-আশাক, বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এবং গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ কমে যাওয়ায় এগুলো সংগ্রহ করা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। আমাদের পরিবারে আমরা ছিলাম পাঁচ ভাইবোন। আমার চাচাদেরও সবার পাঁচ সন্তান। আমাদের সবাইকে ভালো পোশাক-আশাক দিতে এবং দুবেলা পেট পুরে খাবার দেওয়ার জন্য আমার দাদিজান এবং মাকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করতে হতো। যুদ্ধের কারণে এভাবেই আমরা নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়েছিলাম।

অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। এমন সময় শামসউদ্দীন নতুন এক প্রস্তাব নিয়ে আসল। তার প্রস্তাব শুনে আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। সরকার রামেশ্বরাম স্টেশনে ট্রেন থামানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এখন প্রশ্ন হলো-ট্রেন না থামলে সংবাদপত্র আসবে কোথা থেকে? কীভাবেই বা সেগুলো সংগ্রহ করে পাঠকদের কাছে পৌছানো হবে? এদিকে পাঠকরাও সংবাদপত্রের জন্য উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করবে। শামসউদ্দীন একটা উপায় বের করল। সংবাদপত্র আগে থেকেই বড় বান্ডিল করা থাকবে। আর যেই ট্রেন রামেশ্বরাম-ধনুশকরির রাস্তায় উঠবে, তখন চলন্ত ট্রেন থেকেই সেই বান্ডিল প্লাটফর্মে ছুঁড়ে ফেলা হবে। আর এখান থেকেই আমার ভূমিকা শুরু। আমাকে চলন্ত ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলা পেপার সংগ্রহ করে শহরের পাঠকদের কাছে সময়মতো পৌছে দিতে হবে। শামসউদ্দীনের কাছ থেকে এই কাজের প্রস্তাব পাওয়ার পর আমার আনন্দের সীমা রইল না!

আমার বয়স তখন মাত্র আট বছর। আর এই ছোট বয়সেই আমি আমার স্বল্প আয়ের দ্বারা কিছুটা হলেও পরিবারে সাহায্য করতে পারব। আমি অনেক দিন ধরেই একটা ব্যাপার লক্ষ করছিলাম। পরিবারের সবাইকে পেটপুরে খাওয়াতে গিয়ে আমার দাদিজান এবং মায়ের প্লেটে খাবারের পরিমাণ দিনকে দিন কমেই যাচ্ছিল। তারা নিজেরা না খেয়ে তাদের খাবার আমাদের সবাইকে ভাগ করে দিতেন। বিশেষ করে বাচ্চাদের সবসময়ই পরিমাণমতো খাবার দেয়া হতো। আমি পরিষ্কার মনে করতে পারি, আমাদের বাচ্চাদের কারোই এক বেলা না খেয়ে দিন কাটাতে হয়নি। এর পুরো অবদানই বাড়ির মহিলাদের। তারা নিজেদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি আমাদেরকে ভাগ করে দিচ্ছিলেন।

আমি খুশি মনেই শামসউদ্দীনের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। আমার প্রতিদিনের রুটিন ঠিক রেখেই আমাকে এই নতুন কাজ করতে হয়েছিল। কাজের জন্য আবার পড়ালেখা এবং স্কুলের প্রতি অবহেলা করলে চলবে না। এগুলো আগের মতোই চালিয়ে যেতে হবে। এর সাথে সাথেই সংবাদপত্র আনা-নেয়ার কাজ করতে হবে।

আমার ভাইবোন এবং চাচাত ভাইবোনদের তুলনায় ছোটবেলা থেকেই আমি গণিতে অধিক দক্ষ ছিলাম। তাই আমার বাবা আমার জন্য আলাদা গণিতের শিক্ষকের ব্যবস্থা করলেন। আমি ছাড়া আমার শিক্ষকের আরও চারজন ছাত্র ছিল। আমার গণিত শিক্ষকের একটাই শর্ত ছিল। তা হলো—তার সকল ছাত্রকে গোসল করে ভোরবেলা, অর্থাৎ সূর্যোদয়ের আগেই তার বাড়িতে উপস্থিত থাকতে হব। তিনি এক বছর আমাদেরকে পড়াবেন। আর এই একবছর এই শর্ত পালন করে যেতে হবে। তাই আমার দিন শুরু হতো বাইরে অন্ধকার থাকতে থাকতে। আমার মা আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিতেন। আর আমাকে তুলে দেওয়ার জন্য আমার মাকে আমার আগে ঘুম থেকে উঠতে তো। তিনি আমার আগে ঘুম থেকে উঠে আমার গোসলের ব্যবস্থা করে রাখতেন। আমি উঠলে মা আমাকে গোসল করিয়ে দিতেন। গোসল শেষে আমাকে আমার গণিত শিক্ষকের কাছে পাঠাতেন। সেখানে এক ঘন্টার মতো

পড়ানো হতো। ভোর ৫টা নাগাদ আমি বাড়ি ফিরে আসতাম। এরমধ্যে বাবাও ঘুম থেকে উঠে যেতেন। আর আমি বাসায় ফিরে আসার পর বাবা আমাকে আরবি শেখার স্কুলে নিয়ে যেতেন। সেখানেই আমি কোরআন শরীফ পাঠ করা শিখি। কোরআন পাঠ শেষে, আমি তড়িঘড়ি করে রেল স্টেশনে ছুটতাম। সেখানে আমি ট্রেন আসার অপেক্ষায় থাকতাম। চোখ কান খোলা রেখে ট্রেনের অপেক্ষা করতে হতো। তবে আশ্চর্যজনক একটা বিষয় হলো, মাদ্রাজ-ধনুশকরি মেইল কখনও সময়মতো পৌছায়নি। এখনকার প্রায় সকল ট্রেনই সময়মতো পৌছে যায়। তবে তখনকার মাদ্রাজ-ধনুশকরি মেইল সবসময় দেরি করত।

অপেক্ষার এক পর্যায়ে দূরে ট্রেনের ইঞ্জিনের ধোয়া দেখতে পেতাম। আর ট্রেনের হর্ণের শব্দ গর্জনের মতো কানে বিধত। ট্রেন স্টেশনে না থেমেই সাবলীল গতিতে এগিয়ে যেত। আমি সংবাদপত্র বান্ডিল কোথায় ছুঁড়ে ফেলা হলো তা সহজেই দেখার জন্য একটা ভালো জায়গা খুঁজে বের করেছিলাম। ক্লকওয়ার্কের মতো করেই সংবাদপত্রের বান্ডিলগুলো প্লাটফর্মে ছুঁড়ে ফেলা হতো। তবে কোনো অবস্থাতেই ট্রেন থামানো হতো না। ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার পথে শামসউদ্দীনের লোক আমাকে হাত নেড়ে বিদায় জানাত। যখন ট্রেনের আর কোনো চিহ্ন থাকত না, এমনকি ট্রেনের হুইসেলও শোনা যেত না, তখন শুরু হতো আমার কাজ। আমি প্লটফর্ম থেকে সংবাদপত্রের বান্ডিলগুলো তুলে নিতাম। এরপর সেগুলোকে ব্যাচ অনুযায়ী ভাগ করতাম। অর্থাৎ, কোন বাড়িতে কোন পত্রিকা পৌছাবে, সেই অনুসারে ভাগ করতাম। ভাগ করা শেষ হলে শুরু হতো বিতরণের কাজ। পরবর্তী এক ঘন্টা ধরে আমি রামেশ্বরামের বাড়িতে বাড়িতে সংবাদপত্র বিলি করতে থাকতাম। সংবাদপত্র কাঙিক্ষত পাঠকদের কাছে পৌছে যেত।

শীঘ্রই আমি সংবাদপত্রের মাধ্যমে লোকজনকে মনে রাখা শুরু করি। অনেকেই আমার অপেক্ষায় থাকত যে, আমি কখন সংবাদপত্র নিয়ে যাব। সংবাদপত্র বিলি করার সময় প্রায় সকল গ্রাহকদের সাথেই দু একটা কথা হতো। অনেকেই আমাকে বলত, “তাড়াতাড়ি কর। না হলে তোমার স্কুলের দেরি হয়ে যাবে।” আমার মনে হয় আট বছরের এক ছেলের কাছ থেকে সংবাদপত্র নিতে সবার ভালোই লাগত। তারা আমাকে খুব সহজেই মেনে নিয়েছিল।

সকাল ৮টা নাগাদ আমার সংবাদপত্র বিলি করার কাজ শেষ হয়ে যেত। আমাদের শহর ছিল পূর্ব উপকূলে। তাই সূর্যও খুব তাড়াতাড়ি দেখা যেত। আর আমার কাজ শেষ হতে হতে সূর্য থাকত একদম মধ্য আকাশে। কাজ শেষ আমি সোজা বাড়ি চলে আসতাম। আমার মা নাস্তা নিয়ে আমার অপেক্ষায় থাকতেন। খুবই সাধারণ নাস্তা পরিবেশন করা হতো। তবে কাজ সেরে আসার পর আমার প্রচণ্ড ক্ষুধা পেত। তাই সেই সামান্য খাবারই আমার কাছে

অসামান্য মনে হতো। আমার মাও খেয়াল রাখতেন যেন আমি খাবারে শেষ টুকরোটাও খেয়ে নিয়েছি কি না। নাস্তা শেষে সোজা স্কুলে যেতাম।

তবে এখানেই আমার কাজের সমাপ্তি নয়। স্কুল শেষ হলে, সন্ধ্যায় আমি আবার সামসউদ্দীনের গ্রাহকদের কাছে বিল ওঠানোর জন্য চক্কর লাগাতাম। বিল নেয়া শেষ হলে, আমি তার সাথে দেখা করতাম। তিনি বিল বুঝে পেয়ে দিনের হিসেব সম্পন্ন করতেন।

দিনের হিসেব শেষে আমরা সমুদ্র তীরে কিছুটা সময় কাটাতাম। চারিদিকে মৃদু বাতাস বইতে থাকত। এক অসাধারণ পরিবেশ বিরাজ করত। কখনও আমার সাথে থাকত শামসউদ্দীন আবার কখনও জালালউদ্দীন। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আমরা দিনের পত্রিকা খুলে বসতাম। আমরা সবাই দিনামানি পত্রিকার কালো অক্ষরের ওপর ঝুঁকে পড়তাম। তাদের মধ্যে কেউ হয়ত কোনো একটা সংবাদ শব্দ করে পড়ত। এরপর আমাদের মধ্যে সেই সংবাদ নিয়ে আলোচনা এবং বিশ্লেষণ শুরু হয়ে যেত। গান্ধী, কংগ্রেস, হিটলার, ই.ভি. রামজিদের নিয়ে আলোচনায় সন্ধ্যার বাতাস মুখরিত হয়ে উঠত।

আমি আঙুল দিয়ে এই সকল বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের ছাপা ছবি এবং তাদের নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের কালো অক্ষরে হাত বুলিয়ে অবাক হয়ে ভাবতাম। ভাবতাম যে, এখান থেকে বের হয়ে বৃহৎ দুনিয়ায় এই সকল ব্যক্তিদের সাথে একসাথে থাকতে কেমন লাগবে!

আমি একা একা ভাবতাম, আমিও একদিন মাদ্রাজ, বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই), কলকাতার মতো বড় শহরে পাড়ি জমাব। আরও ভাবতাম, যদি কখনও গান্ধী বা নেহেরুর সাথে আমার দেখা হয়ে যায় তাহলে আমি তাদের সাথে কি নিয়ে কথা বলব? তবে আমার বন্ধুরা আমাকে খেলতে ডাকলেই এ- বিষয় নিয়ে আর চিন্তা করা হতো না। খেলা শেষে বাড়ি ফিরে রাতের খাবার খেয়ে নিতাম। খাবার শেষে আবার বাড়ির কাজ নিয়ে বসতে হতো। বাড়ির কাজ করার পর আমার শরীরে আর বিন্দুমাত্র শক্তিও অবশিষ্ট থাকত না। রাত ৯টা নাগাদ আমি গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পরতাম। পরবর্তী দিন আবার আমাকে পড়াশুনা করতে হবে। কাজে যেতে হবে।

প্রায় এক বছর যাবত এই রুটিন অনুসারেই আমার জীবন এগিয়ে চলল। এই এক বছরে আমি শারীরিকভাবে আগের তুলনায় লম্বা হলাম। আমার ত্বকও আগের তুলনায় অধিক বাদামি হয়ে গেল। আর এই সময়ে আমি হিসেব-নিকাশ শিখে গেলাম। আমি সঠিকভাব হিসেব করে বলে দিতে পারতাম যে, পত্রিকার বান্ডিল হাতে, প্রতিটি বাড়িতে পত্রিকা পৌছে দিতে আমার ঠিক কত সময় লাগবে। আর আমি প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় সংবাদপত্র পৌছে দিতাম। কখনও সময়ের হেরফের হতো না বললেই চলে। আর সামসউদ্দীন কোনো গ্রাহকের কাছ থেকে কত টাকা পাবে তাও আমি মনে মনে হিসেব কষে বলে দিতে পারতাম। আবার কোনদিন কোন গ্রাহক টাকা দেয়নি তাও আমার মনে থাকত।

মূলত আমি এই এক বছরে শিখে ফেলেছি যে, একজন কর্মজীবী লোকের জীবন কেমন হয়। একজন কর্মজীবী লোকের জীবনে যা কিছুই ঘটুক না কেন, তাকে দিনের কাজ শেষ করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। বাড়ির কাজ, শিক্ষকের কাছে সময়মতো পড়তে যাওয়া, নামাজ সব ঠিকভাবেই চলছিল। এদিকে মাদ্রাজ-ধনুশকরি মেইলও বরাবরের মতো আমার অপেক্ষায় থাকত না। আমাকে তাই যথাসময়ে রেল স্টেশনে উপস্থিত থাকতে হতো এবং যথাসময়েই ছুঁড়ে ফেলা সংবাদপত্রের বান্ডিল সংগ্রহ করতে হত।

.

এভাবেই আমি প্রথম নিজ কাঁধে দায়িত্ব নিতে শিখি। এই দায়িত্ব আমি এক মুহূর্তের জন্যেও অবহেলা করিনি। পাশাপাশি আমি শামসউদ্দীনকে দেয়া কোনো প্রতিজ্ঞাও কখনও ভঙ্গ করিনি। যা কিছুই বলি না কেন, আমি আমার এই কাজের প্রতিটি মুহূর্ত দারুণ উপভোগ করেছি। সারাদিন কাজের পর রাতের প্রচণ্ড ক্লান্তিও কখনও আমাকে দমাতে পারেনি। মা প্রায়ই আমাকে এই অতিরিক্ত চাপ নিতে বারণ করতেন। আমার কষ্ট মা সহ্য করতে পারতেন না। তবে আমি মাথা নেড়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসতাম। আমি জানতাম আমার উপার্জন সামান্য হলেও, তা পরিবারের কাজে আসছে। আর মাত্র আট বছর বয়সে নিজের কাঁধে দায়িত্ব নেয়ায় মা আমাকে নিয়ে গর্ব বোধ করত। তবে এ নিয়ে মা মুখে কিছু বলতেন না। আমিও কিছু না বলে, মুখে হাসি নিয়ে আমার দায়িত্ব পালন করছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *