বাতাসবাড়ি জ্যোৎস্নাবাড়ি – ৫

পাঁচ

সুমি আবার ফোন করেছে। শোভনও। দুদিন বাদে শোভন না, সুমি একা। সুমি বলছে, বাবলুদা, তোমাকে আমার ছেলে এখানে নিয়ে আসবে। অনেক দিনের সাধ, তোমাকে যত্ন করে রেঁধে খাওয়াই। আসবে তো বাবলুদা? কোচবিহার খুব সুন্দর শহর। রাসমেলায় এসো। 

সুমির ফোন আসছে যখন তখন। ক’দিন বাদে মনে হল ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরবেন। মেদিনীপুর শহরে যাবেন। কেন মনে হল? মনে হচ্ছিল, সুমির ছেলের আসার দেরি নেই খুব। সে তাড়াতাড়ি এসে পড়বে। সুমি নিজেই ফোন করে, শোভন করেনি দুদিন। হয়তো আজ রাতেই ট্রেনে চেপে আগামীকাল ভোরে নেমে পড়বে শিয়ালদা। তিনি অস্বস্তি বোধ করছেন। টুটুল এইটা ঠিক করেনি। টুটুল না জিজ্ঞেস করে ঠিকানা, ফোন নম্বর দিল কেন? এর ভিতরে ওরা ফোন করবে, কিন্তু পাবে না। টুটুল কি তখন তাঁর মোবাইল নম্বর ওদের দেবে? তিনি অচেনা নম্বর ধরবেন না। অনুপমের মনে হল একবার দেখে আসেন। সেই মিশন কম্পাউন্ড, অমল সেনগুপ্তর বাড়ি, তিনি সংসার পেতেছিলেন সেখানে। জীবনের সেই সময়টুকু গিয়েছিল অপূর্ব। তিনি তিরিশ, কুন্তলা বাইশ। কুন্তলার বাপের বাড়ি মগরা। আদি সপ্তগ্রাম পেরিয়ে কুন্তি নদীর ধারে। অনেক পুরনো জনপদ। কুন্তলাদেরও অনেক বড় পরিবার। প্রাচীন দালান কোঠা রয়েছে সেখানে। চুন সুড়কির সেই বুড়ো অট্টালিকা, তার কিছুটা ভেঙেও গেছে। কুন্তলার ঠাকুরদা ছিলেন বড় ভূম্যধিকারী। এদেশি। জমিদার। জমি-জমা ছিল। ভাগ ভাগ হয়ে সব এখন ফুরিয়ে গেছে। এখনও কেউ কেউ থাকে সেখানে। যারা থাকে তাদের না থেকে উপায় নেই। বেরতে পারেনি। ইস্কুলের মাস্টারি, ছোট ব্যবসা এই সব করে কুন্তলার খুড়তুতো, জেঠতুতো ভাইরা। শুধু তার এক দাদা, অমলেন্দু থাকেন সেখানে। তিনি সরকারি চাকরি করতেন, সমস্ত জীবন বাইরে বাইরে কাটিয়েছেন। অবসরের পর ফিরে এসেছেন নিজের বাড়িতে। কুন্তলার অসুখের সময় তিনি কয়েকবার এসেছিলেন, মৃত্যুর পর যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কুন্তলার আর এক ভাই কমলেন্দু দিল্লিতে সেটলড। মাঝে মাঝে ফোন করে। ইদানীং অনেকদিন কোনও ফোন আসেনি। ছেলের কাছে ম্যানিলা-ফিলিপিনস-এ গিয়েছে হয়তো। অমলেন্দুর এক মেয়ে, বিয়ে হয়ে ভোপালে থাকে। অর্পিতা মেয়েটি ভালো। মাঝে মাঝে তাঁকে ফোন করে। বলে ভোপাল এসো পিসে। পাঁচমারি, ভীম বৈঠকা, সাঁচি স্তূপ, বিদিশা দেখে যাও। তিনি কুন্তলাকে নিয়ে ঘুরেছেন ওদিকে একবার। কুন্তলার এক মাসি থাকে উজ্জয়িনী। গিয়েছিলেন। তখন হোটেল খরচা করে ঘোরাঘুরি তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। যখন জীবনটাকে ভোগ করার সময় ছিল, তখন দিন গেছে কঠোর যাপনে। যখন হাতে পয়সা এল, তখন কুন্তলা চলেই গেল। অনুপম তাই যাবেন যাবেন করে কোথাও তেমন যান না। যেতে পছন্দ করেন সেখানেই, যেখানে তিনি কুন্তলাকে নিয়ে গেছেন। দুই সমুদ্র, দীঘা এবং পুরী। উজ্জয়িনী। একবার দিল্লি। উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং। আরও কত জায়গা আছে এই ভারতে। তাঁরা শুধু পরিকল্পনাই করতেন। শেষ অবধি যাওয়া হতো না। গেলেও সাঁইথিয়ায় বন্ধুর বাড়ি কিংবা শান্তিনিকেতন। অনুপম ঠিক করলেন বেরতে হবে। অমল সেনগুপ্তর বাড়িতে যাবেন মেদিনীপুরে। গভীর রাতে তাঁর মনে হল, কুন্তলা সেখানে গিয়ে যেন বসে আছে। কিন্তু সেই যে উল্টোদিকের বাড়ির মেয়েটি! তপোমায়া বসু। ইস্কুল টিচার। সেও কি আছে? তাকে সহ্য করতে পারত না কুন্তলা। কেমন গায়ে পড়া ভাব। দাদা দাদা করত। সাহিত্য নিয়ে আলাপ করতে চাইত। সেই তপোমায়া কবিতা লিখত। তাতে কুন্তলা আরও ক্রুদ্ধ হতো যেন। মনে হতো মেয়েটি যেন অনুপমকে অধিকার করতে আসছে। অনুপম বাংলায় এমএ। অনুপম গল্প লিখত কলেজে পড়ার সময়। কিন্তু তা একবার ব্যতীত দু’বার ছাপা হয়নি। ক’বছর প্রত্যাখ্যাত হয়ে নিজেকে বুঝে বন্ধ করেছিল লেখা। সেই অপূর্ণ সাধ উস্কে দিতে এসেছিল তপোমায়া। মেয়েটি বিয়ে করেনি। করতে পারেনি। অনুপমের মনে পড়ল সেই গৌরী কন্যাটিকে। কুন্তলা সেই সময় খুব সতর্ক হয়ে থাকত। তখন তার পেটে টুটুল এসেছে। অনুপমের মনে হয়েছিল আবার লিখতে আরম্ভ করে। তপোমায়া স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ করবে। সে নিজেও একটা ম্যাগাজিন বের করবে ঠিক করেছে। সেই পত্রিকায় অনুপম লিখুক না কেন? না। কুন্তলা না বলায় ইচ্ছে থাকলেও অনুপম লেখেননি। সেই ডায়েরি কি আছে? অনেক বছর বাদে কুন্তলা খুঁজে পেয়েছিল, তখন তিনি সপরিবারে বাঁকুড়ার ন’পাহাড়ি ব্লকে। কুন্তলা তাঁর লেখা গল্প বের করে বলেছিল, “তোমার লেখা, লিখেছিলে তা বলোনি তো।” 

ডায়েরিতে লিখেছিলেন তিনি। সেই ডায়েরি কি নেই এই ফ্ল্যাটের কোথাও? খুঁজে দেখবেন নাকি? কুন্তলা তা বয়ে নিয়ে গিয়েছিল ন’পাহাড়িতে। কিন্তু নিয়ে আসেনি কি ন’পাহাড়ি থেকে? ন’পাহাড়ি থেকে উত্তরের আলিপুরদুয়ার, সেখান থেকে হলদিয়া, হলদিয়া থেকে বারাসত, বসিরহাট, আলিপুর। আলিপুর থেকে অবসর। ডায়েরির লেখাগুলির প্রতি তাঁর কোনও মায়া ছিল না। কুন্তলার কথায় তিনি মনে মনে দুঃখিত হয়েছিলেন। বিদ্রুপের মতো মনে হয়েছিল। সেই মিশন কম্পাউন্ডে যখন সন্তান এল কুন্তলার গর্ভে, কে যেন তাঁকে বুঝিয়েছিল গর্ভবতী মায়ের মনের যত্নও নিতে হয়। তিনি বুঝতে পারছিলেন তপোমায়ার দাক্ষিণ্যে তার গল্পের প্রকাশ কুন্তলাকে দুঃখ দেবে। কুন্তলার মনে সন্দেহের বাতাবরণ সৃষ্টি করবে। যা ক্ষতি করতে পারে মাতৃগর্ভে আশ্রয় নেওয়া ভ্রূণের। তপোমায়া অবশ্য কুন্তলার চেয়ে অনেক বড় ছিল। তিনি তখন বত্রিশ পার। তপোমায়া তিরিশ-একতিরিশ। তপোমায়া মা বাবার প্রথম সন্তান। সংসার ঠেলতে হতো। বাবার তেমন আয় ছিল না। দুটি ভাই বড় হচ্ছিল। তারা যখন বড় হয়ে উঠবে, তপোমায়ার বয়স চল্লিশ হয়ে যাবে। এসব তিনি জানতেন। ফলে মেয়েটির প্রতি তাঁর মমতা তৈরি হয়েছিল। তার একটা অবলম্বন চাই। অবলম্বন হল কবিতা। পত্রিকা। 

সেই তপোমায়া কি কবি হয়ে উঠেছে? নাকি তিনি চলে আসার পর তার কবিতা চর্চা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি কয়েকটি সাহিত্য সাময়িকী নেন নিয়মিত। দেখেছেন কি না বলতে পারবেন না। অনুপম পরদিন সকালে হাত ব্যাগে পায়জামা, পাঞ্জাবি, শার্ট আর দুদিনের ভ্রমণের উপযোগী টুকিটাকি জিনিস নিয়ে দুপুরে বেরিয়ে পড়েন। ধর্মতলা থেকে মেদিনীপুরের অনেক বাস। ৬নম্বর জাতীয় মহাসড়ক এখন আর সেই আমলের ‘বম্বে রোড’ নেই। ১৯৭৮-এর বন্যায় রাস্তা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সেই বন্যা হল সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে, তিনি চাকরিতে ঢুকেছিলেন এপ্রিলে। তখন বিয়ে করেননি। লোয়াদা নামে এক গঞ্জে থাকতেন। কংসাবতী নদী সেই গঞ্জের ধারে। সব মনে পড়ে যাচ্ছে। এখন ৬নম্বর জাতীয় মহাসড়ক বিদেশের রাস্তার মতো। মনে হচ্ছে টুটুল যেন এই রাস্তা ধরে সাউথ ক্যারোলাইনা থেকে ওয়াশিংটন সিটি গিয়েছিল, ব্লু রিজ পর্বতমালার পাশ দিয়ে, বাতাসবাড়ি (হাই উইন্ড এরিয়া) আর কুয়াশাবাড়ি (ফগি এরিয়া) ছুঁয়ে। পাহাড় পাহাড় আর পাহাড়, আর উপত্যকা, বরফে ছেয়ে আছে বনভূমি আর পাহাড়ের গা। সেই কথা বলেছে সে টেলিফোনে। অনলাইন ভিডিও কলিং-এ। বাসের জানলার ধারে তাঁর সিট। বাসটি এসি। জানালার কাঁচ দিয়ে হাইওয়ের ধারের জনপদ দেখা যাচ্ছে। সন্ধে ছটা নাগাদ মেদিনীপুরে পৌঁছনোর কথা। এই রাস্তার ধারেই আষাঢ়ির মোড়। আষাঢ়িদহ। আষাঢ়িদহের মোড় থেকে বাস ঘুরে যেত লোয়াদার দিকে। হল্কা ক্যাম্প অফিস। জমি জরিপ সেই অফিসের কাজ। ভবানী মাইতি পেশকার আর নিখিল প্রধান গ্রুপ-ডি। আষাঢ়ির মোড় ডান দিকে রেখে অনেকটা গিয়ে ডেবরায় দাঁড়াল গাড়ি। দুজন নামার ছিল। কেউ উঠল না। মেদিনীপুর আর খুব দূর নয়। তিনি কি ডেবরায় নেমে যাবেন? এখান থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে আষাঢ়ির মোড় দিয়ে কংসাবতীর তীরে লোয়াদা। আমিনবাবু সুদাম মণ্ডলের বাড়ি ছিল কংসাবতী পেরিয়ে অনেকটা ভিতরে ত্রিলোচনপুর গ্রামে। তিনি লোয়াদায় জমি কিনেছিলেন বাড়ি করবেন বলে। ১৯৭৮-এর বন্যায় লোয়াদাও ভেসেছিল। কংসাবতীর কী রোষ! ডিসেম্বরের আরম্ভেই ২২ অঘ্রান ভবানী মাইতি আবার একটি বিয়ে করল। আগের পক্ষকে ফেলে এসেছিল পুরুলিয়া। কী সব মানুষ! কী তাদের সাহস! তখন সে চল্লিশ পার। মনে পড়ে যাচ্ছিল অনুপমের। ভবানী খুব ধার করত। শেষ অবধি ধার রেখে পালিয়েছিল শেষ রাতে বউ আর আগের পক্ষের মেয়ে নিয়ে। বদলির আদেশ করিয়েছিল হেড অফিস থেকে। সুদাম লোয়াদাতেই বাড়ি করেছিল। তাকে খুঁজে পাবেন না তিনি? এখন যদি যান, সুদাম কি তাঁকে চিনতে পারবে না? তাঁরই বয়সি ছিল। শুনেছেন কংসাবতীর ওপারে ব্রিজ হয়ে গেছে। একবার সুদাম তাঁকে তার বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। সাত মাইল রাস্তা মাটির। কোথাও খোয়া পড়েনি পর্যন্ত। বর্ষাকালে এক হাঁটু কাদা। পিছল। অগম্য হয়ে যায়। তিনি গিয়েছিলেন সুদামের সাইকেলের পিছনে বসে। বড় গৃহস্থ। অনেক জমি। মাটির দোতলা। ইট পুড়বে শীতের সময়। তার বাবা বললেন, দালান করবেন। আরও কী কী বলেছিলেন, সব মনে নেই। তবে বিয়ে করেছে কি না অফিসার সাহেব তার খোঁজ নিয়েছিল। সুদাম পরদিন ভোরে তাঁকে নিয়ে রওনা হয়েছিল পাঁশকুড়ার দিকে। সোজা ঘাটাল দাসপুরের দিকে কংসাবতীর আর এক শাখার বাঁধের রাস্তা ধরে গ্রাম আর গাছ- গাছালির ছায়া আর রৌদ্রের ভিতর দিয়ে কী অসামান্য ছিল সেই যাত্রা। সুদাম তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল স্টেশনে। তিনি কলকাতা এসেছিলেন। এই কথাটি বললে কি সুদাম তাঁকে চিনবে না? 

বাস ছুটছিল। চোখ জুড়িয়ে আসছিল। সুদামের কি মনে আছে, পথে তাঁরা দেখেছিলেন একটি স্বর্ণগোধিকা। হলুদ। কাঁচা সোনার মতো তার রং। সুদাম বলেছিল, স্বর্ণগোধিকা দেখা মানে সৌভাগ্যের সূচনা, কালকেতু একে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল বাড়িতে। 

মা লক্ষ্মী। 

তাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন। বাঁধের রাস্তার নীচে একটি জলাশয়। তার পাড়েই শুয়েছিল সে। তখন শরৎকাল। কাঁচা সোনার মতো উজ্জ্বল হলুদ ছিল তার সর্বাঙ্গ। তার উপরে পড়েছিল আশ্বিনের রোদ। নিস্পন্দ ঘুমের ভিতরে ছিল বুঝি সে। অনুপম দেখেছিলেন অতুল ঐশ্বর্য স্তব্ধ হয়ে আছে। মনে পড়ল। সুদাম বলল, স্যার, আপনিই তো দেখেছিলেন প্রথম। 

হ্যাঁ, কিন্তু তেমন সৌভাগ্য কিছু হয়নি, সমস্ত জীবন খুব কষ্ট করেছি। 

কেন আপনার পুত্র বিদেশে, মেয়ের ভালো বিয়ে হয়েছে।

কুন্তলা যখন সুখের মুখ দেখবে, তখন অসুখে পড়ল, চলেও গেল। 

স্যার, আপনাকে আমি চিনেছি দেখা মাত্র। 

সুদাম তুমি খুব বুড়ো হয়ে গেছ। 

নানা অসুখ আমাকে খেয়ে ফেলেছে, বুকে মেশিন বসেছে, পেস মেকার। 

ছেলে মেয়ে? 

মেয়ের বিয়ে দিয়েছি ঘাটালে, জামাই পি ডব্লু ডি-তে সরকারি চাকরি করে, খুব ঘুষ খায়, সাসপেন্ড হয়ে গিয়েছিল, বারণ করলে শোনে না। 

ছেলে? অনুপম জিজ্ঞেস করলেন। 

সুদাম চুপ করে থাকে। অন্ধকারের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। ছেলে রাজনীতি করে। দল বদল করেছে ন’মাস আগে। অনেক পয়সা করেছে। মেদিনীপুরে বাড়ি, গাড়ি। খুব মোটা হয়েছে। গায়ে সাদা পাঞ্জাবি এঁটে থাকে। ছেলে টাকা দিতে চায়। সুদাম নেয় না। তার পেনশন আছে। বউ খুব ভালো। তাঁকে খুব যত্ন করে বাঁচিয়ে রেখেছে। শুনতে শুনতে তিনি বললেন, আমি পারিনি, সুদাম এখন কাঁসাইয়ে জল নেই? 

না স্যার, জলের শব্দ শুনতে পেতেন তাহলে। 

অন্ধকারের নদীর দিকে তাকিয়ে তাঁর সব মনে পড়ে যাচ্ছিল। স্বর্ণগোধিকা টের পেয়েছিল তাঁদের উপস্থিতি। সরসর করে নেমে গিয়েছিল জলে। এখন মনে হয় আর কিছু সময় শুয়ে থাকলে সে হয়তো মা লক্ষ্মীর রূপ ধারণ করত। স্বর্ণকমল হাতে পদ্মাসীনা দেবী। মা কমলা। সুদাম বলল, কোনও মানুষের জীবনেই সব ভালো হয় না স্যার, সুখ দুঃখ নিয়েই তো জীবন। 

সেই ভবানী মাইতি, পেশকারবাবু? জিজ্ঞেস করলেন অনুপম।

শুনেছিলাম তার দ্বিতীয় পক্ষ তাঁকে ছেড়ে পালিয়েছিল, শেষ জীবন খুব কষ্টে গেছে।, পরে আর একটা বিয়ে করেছিল তমলুকে। সুদাম বলে। 

লোকটা যেখানে যেত বিয়ে করত, যেন নিয়তি-তাড়িত মানুষ, হাতের লেখা সুন্দর ছিল, কথা বলত ভালো। অনুপম বললেন। 

ওর পাশে কেউ ছিল না শেষজীবনে, ভিখিরি হয়ে মরেছিল নাকি। সুদাম বলে। 

নিখিল প্রধান? জিজ্ঞেস করতে করতে সেই ভাঙাচোরা মানুষটির মুখ মনে পড়ল অনুপমের। খুব অভাবী ছিল। রাতে মুড়ি খেয়ে থাকত অনেকদিন। জীবনের আরম্ভে একসঙ্গে মেস করে থাকা হতো সেই গঞ্জে। জরিপের কানুনগো, আমিন, মোহরার, পেশকার, পিয়ন…সবাই। নিখিল প্রধান সকলের নীচে। ডি-গ্রুপ কর্মচারী, বয়স তখন পঞ্চাশ। কাঁথির দিকে গ্রামে মস্ত সংসার। সারামাস গ্রামের বাবুবাড়ি থেকে চাল ডাল, নারকেল, এটা ওটা সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে যেত। ঘুমের ঘোরে কাঁদত। অনুপমকে ‘বাবু’ বলত। যেন অনুপমবাবু আর সে ছিল তার বাঁধা মুনিষ। 

কাঁথিতে চলে গেল বদলি হয়ে, আর জানি না স্যার। সুদাম বলল। 

নিখিল প্রধান রাত্তিরে কাঁদত, তুমি জানো? 

জানি না স্যার, মেসে তো আমি ছিলাম না, খুব অভাবী মানুষ ছিল জানি, হেঁটে ত্রিলোচনপুর গিয়ে আমার বাবার কাছ থেকে নারকেল, আম নিয়ে এসেছিল একবার, তা বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল, মুড়ি আনত মায়ের কাছ থেকে। 

এখন কি বেঁচে আছে? 

জবাব পেলেন না তিনি। অন্ধকারের নদী পার হয়ে বাতাস আসছিল। সেই গোলগ্রাম, করা, ত্রিলোচনপুর, সোনামুই, কাঁটাগেড়্যা, বগলাশুনি…। এই জীবনের এক এক বিন্দু সেখানে ফেলে এসেছেন যেন। বাস যখন মেদিনীপুর পৌঁছল, সন্ধে হয়ে এসেছে। স্টেশনের কাছে একটা বোর্ডিং হাউস ছিল। আর ছিল আবাসিক হোটেল। তিনি বাস টারমিনাসে নেমে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন চারদিকে। এ যেন অন্য শহর। এত আলো, এত হাঁকডাক এই শহরে এই গ্রীষ্মের সন্ধ্যায়, তা অভাবিত। সেই শান্ত, নির্জন শহর, বিদ্যাসাগর লাইব্রেরি, ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরির পথ, রিকশর টিং টিং শব্দ…, লোহার একট দণ্ড রিকশর হ্যাঁন্ডেলে বাজিয়ে বাজিয়ে সে শহর ভেদ করতে লাগল। মনে হচ্ছিল নতুন কোনও শহরে এসেছেন। রিকশয় উঠে বললেন মিশন কম্পাউন্ড চেন? বার্জ টাউন? 

চিনি। রিকশওয়ালা বলল। 

তিনি বললেন, আগে হোটেল, ভালো হোটেল, কাল ভোরে যাব। 

আচ্ছা স্যার। 

রিকশ চলল। তাঁর মনে হল পথে তপোমিতাকে দেখতে পাবেন। তপোমিতা আর কুন্তলা হাসতে হাসতে ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরির দিকে হাঁটছে। কী বই? পার লাগেরকভিস্টের বারাবাস। দুজনেই বারাব্বাস পড়বে। আচ্ছা হেড না টেল? এমন কি হয়েছিল কোনওদিন? হয়েছিল প্রথমে। নাকি হয়ইনি। তিনি হাসলেন নিজের মনে। শহরে অনেক মানুষ। এই শহরে কি তাঁর কোনও বন্ধু আছে? একটা লোক, দেবেন মল্লিক, তার বাড়ি এই শহরেই। দেখা হয়েছিল বাঁকুড়ায়। দেবেন খুব রাজনীতি করত। শাসক ঘনিষ্ঠ। সে তাঁকে খুব বিপদে ফেলেছিল। শাসক দলের সমর্থক ইউনিয়নে মাথা মুড়োতে বলেছিল। তিনি চুপ করে থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ তৈরি করে মেরুদণ্ডহীন উপরওয়ালাকে দিয়ে কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়েছিল, কেন তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করা হবে না। সেই দেবেন মল্লিক এই শহরে মস্ত দালান করেছে গ্রাম থেকে উঠে এসে। দেবেনের মুখেই তা শুনেছিলেন তিনি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন রিকশওয়ালাকে, দেবেন মল্লিকের বাড়ি চেন? 

কোন দিকে? 

তিনি বললেন, মহুয়া সিনেমার দিকে হবে হয়তো। 

দেখলে চিনতে পারব, ফোন করেন, জিজ্ঞাসা করেন কোন বাড়ি, কত নম্বর, বাড়ির রং কী? 

তিনি বললেন, তা তো বলতে পারব না ভাই। 

কাল সকালে হুইসল ফুকে দেব ছার, এখন খুঁজি লাভ নেই। রিকশওয়ালা হাসতে হাসতে বলল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *