বাতাসবাড়ি জ্যোৎস্নাবাড়ি – ১০

দশ

সন্ধে সাতটা নাগাদ শোভন ফিরল। সঙ্গে ভবতোষ। ভবতোষের মুখে হাসি। দেখা করতে এসেছে, বলল, স্যার খুব ঘুরলেন? 

অনুপম জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় দেখা হল? 

এই তো স্যার, আপনি বেরননি বিকেলে? ভবতোষ জিজ্ঞেস করল। 

অনুপম জিজ্ঞেস করলেন, শোভন তোমার কাজ হল?

হয়েছে মামা, তবে আসল কাজ তো বাকি।

মানে ভয় দেখানো? 

না, ধর্না ভেঙে দেওয়া, কোর্ট কেস তুলে নেওয়া।

ভবতোষ বলল, খুব এফিসিয়েন্ট আপনার ভাগ্নে, পারবে, আমিও গিয়েছিলাম ওর সঙ্গে। 

ও বলেনি তো আপনি যাচ্ছেন। 

উনি তেমন চেনেন না, আমি বললাম যাব, আমার বোন ক’দিন ছুটি নিয়েছে, সারাদিন ঘরে বসে টিভি দেখে, আমি কোথায় যাব সারাদিন? 

শোভন বলল, উনি কলকাতার সব রাস্তা চেনেন, এমনকী ফনী মিস্ত্রি লেন পর্যন্ত। 

কোথায় তা? 

আজ্ঞে নারকেলডাঙা, আমার এক কলিগ থাকে। ভবতোষ বলল। 

শোভন বলল, সুইনহো স্ট্রিট ওঁর কাছে জলভাত।

ভবতোষ বলল, আপনি কিছু চিন্তা করবেন না স্যার, ভাগ্নে হারাবে না, ভাগ্নে দারুণ ছেলে, হেবি কানেকশন, উন্নতি করবে অনেক। 

শোভন বলল, কী যে বলো তুমি ভবদা, হারাবো কেন, মোবাইল ইন্টারনেটের যুগে কেউ হারায়? 

হারাবে না কিন্তু হয়রান তো হবে। ভবতোষ বলল। 

অনুপম অবাক হচ্ছিলেন ভবতোষ এবং শোভনের কথাবার্তায়। ওদের ভিতরে রীতিমতো বন্ধুতা। ভবতোষের সঙ্গে যাবে তা বলেনি কেন শোভন? তারপর ভাবলেন, বলেনি তো কী হয়েছে, এখন চলে গেলে তিনি নিশ্চিন্ত হন। 

শোভন বলল, মেটিয়াবুরুজে যাব, ওখেনে অবশ্য আমি কিছু চিনি না, মানে হারিয়ে যেতে পারি। 

পারো, সব পুরনো বাড়ি, গায়ে গা লাগানো, মোবাইলে টাওয়ার থাকে না, নেটও থাকে না। ভবতোষ বলল, পোর্ট এরিয়া তো। 

কে বলেছে? জিজ্ঞেস করলেন অনুপম। 

ভবতোষ বলল, আমার এক কলিগ থাকে ওখানে, বাড়ির ছাদে এসে ফোন করতে হয় ওকে। 

শোভন হেসে বলল, ভবতোষদার কলিগ সারা কলকাতায় ছড়িয়ে, ওই জন্য ভবতোষদা কলকাতার সব চেনে। 

ভবতোষ বলল, কর্পোরেশনে কাজ করতাম তো, আমাদের বদলি হতো ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে, এক নম্বর থেকে ১২০ নম্বর সব ওয়ার্ডে ঘুরেছি আমি, সবই চিনতাম। 

মেটিয়াবুরুজে যেতে হবে আনোয়ার আলি নামের একজনের কাছে। বলল শোভন। 

কত নম্বর ওয়ার্ড? ভবতোষ জিজ্ঞেস করল। 

তা তো জানি না। 

হে হে, ওয়ার্ড নাম্বার জানবে কী করে, অ্যাড্রেস আছে তো?

আছে, কিন্তু তোমাকে যেতে হবে ভবতোষদা।, আমি তো কোনওদিন খিদিরপুরই যাইনি, মেটিয়াবুরুজ তো আরও ভিতরে।

ভবতোষ বলল, আমি আছি, স্যারের ভাগ্নে তুমি, তোমার কোনও অসুবিধে হবে না। 

অনুপম উঠে গেলেন। এত কথায় বিরক্ত লাগছে। অন্ধকার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন। ভিতরে ভবতোষ এবং শোভন কথা বলতে লাগল। হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসতে লাগল। জোরে জোরে। অনুপম যে ওদের থামতে বলবেন, পারলেন না। কিন্তু এইটা তো সত্য, এই নিঝুম ফ্ল্যাট এত কথা শোনেননি অনেক দিন। তিনি দেখলেন অন্ধকারে রাস্তার ওপারের ব্যালকনিতে বৃদ্ধা বসে আছেন চেয়ারে। ওই ব্যালকনিতে আলো জ্বলছে। বৃদ্ধা এদিকে তাকিয়ে। কী দেখেন অন্ধকারে ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখে? ভবতোষ এবং শোভন টুটুলের ঘরে ঢুকে গেছে। সেখানে তুমুল কথাবার্তা চলছে। শোনা যাচ্ছে ব্যালকনিতে বসেও। ভবতোষ এমনই চেয়েছিল। নিজের বাড়িতে জায়গা নেই, এখানে প্রবেশ করতে চায়। শোভনকে ধরে ঢুকে পড়েছে। অনুমতির প্রয়োজন হয়নি। তিনি ব্যালকনির চেয়ারে বসে রাস্তার ওপারের ব্যালকনিতে চেয়ে থাকলেন। ওই বৃদ্ধা যদি অন্ধ হন, উনি দেখবেন অন্ধকারই। অনুপম দেখলেন আলোর ভিতরে প্রায় অন্ধকার এক স্তূপ। অন্ধ চোখই আলোর ভিতরে ব্যাপ্ত হয়ে উঠেছে। তিনি অন্ধকারে, ওপারের উনিও। 

শোভন এল ব্যালকনিতে, বেরচ্ছি মামা, রুটি নিয়ে ফিরব।

দিয়ে যাবে, আমি টাকা দিয়ে এসেছি। 

আচ্ছা, ও কি সব দিন দিয়ে যাবে? 

বললে দিয়ে যায়। 

শোভন বলল, আমি গরম রুটি নিয়ে আসব, তোমার চিন্তা নেই। 

তুমি ক’দিনের জন্য এসেছ, তোমাকে এসব করতে হবে না, সব দিন আমিই নিয়ে আসি, আজ বলে এসেছি। অনুপমের গলার স্বর একটু কঠিন। 

শোভন চুপ করে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর চলে যায়। ভবতোষকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। অনুপম কেমন নিশ্চিন্ত বোধ করেন। ওরা দরজা বাইরে থেকে টেনে দিয়ে গেছে। এখন ভিতর থেকে না খুললে খুলবে না। আর যদি চাবি নিয়ে যায় খুলবে। তিনি দেখলেন চাবি নিয়ে যায়নি। চাবি রয়েছে দেওয়ালের রিঙেই। তিনি এখন বেরিয়ে পড়তে পারেন দরজায় চাবি দিয়ে। অথবা ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। শোভন ডোর বেল দিয়েও সাড়া পাবে না। সুমির ছেলেটিকে তাঁর ভালো লাগছে না একদম। ভবতোষকেও না। আসলে তিনি একা থাকতে চান। সমস্ত জীবন কোলাহলে কাটিয়েছেন। পরিবার, অফিস, গ্রাম-গঞ্জের মানুষ নিয়ে কেটেছে জীবন। এখন সমস্ত কিছু থেকে বিমুক্ত হয়ে নিজের একটা স্বাধীন সত্তা নিয়ে কাটাতে চান। ভুল না ঠিক জানেন না। কিন্তু এই জীবনে যে সুখ আছে তা তিনি টের পাচ্ছেন। পুরাকালে পরিবার পরিজন ফেলে রেখে মানুষ বাণপ্রস্থে যেত। স্ত্রী থাকলে তিনি সহগামিনী হতেন। না থাকলে একা। একা হয়ে যেতেই অরণ্যবাসী হওয়া। অরণ্যবাসী হওয়ার ভিতরে আলাদা আনন্দ নিশ্চয় ছিল। তিনি একা ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে চাইছেন সকলের থেকে। জনারণ্য থেকে আলাদা। ফোন এল তাঁর মোবাইলে। বলছি, কে? 

সুমি গো বাবলুদা, তোমার সুমি।

তিনি বললেন, কেন? 

কেন আবার, কথা কি বলা যায় না রজ্জাক।

কদিন আগে মারা গেছে। 

হুঁ, ফেসবুকে দেখেছি, এত কষ্ট হল বাবলুদা, আমার ফেবারিট হিরো।, সেই তখন রজ্জাককে আমি সব দিতে পারতাম। 

উফ! থাম সুমি। বলতে গিয়ে অনুপম চুপ করে থাকলেন। কথায় কথা বাড়ে। তিনি বলতেন হয়তো, কিন্তু শোভন যখন শুনবে, উৎসাহিত হয়ে উঠবে। মায়ের সঙ্গে ওর নিশ্চয় কথা হয়। একটু আগেও হয়েছে। ও বলেছে মামা একা রয়েছে ফ্ল্যাটে, তুমি ফোন করো মা। শোভন আন্দাজ করে মায়ের এই সম্পর্কের কথা? 

হ্যাঁ গো বাবলুদা তুমি ফেসবুকে নেই কেন? সুমি জিজ্ঞেস করল। 

ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড, সেখানে আরও বেশি মানুষ। 

সেই জন্যই তো ফেসবুকে আসা, ফেসবুক না থাকলে তোমাকে খুঁজে পেতাম? একা বসে কী করো?

কিছু না। অনুপম সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন।

কিছু না আবার কী কথা, এখন কী করছ? 

কিছু না। বিরক্ত হতে গিয়েও হলেন না। সুমির কণ্ঠস্বর ছিল মিঠে। বাতাসের মতো নির্ভার যেন। গীতা দত্তর গলার মাদকতা ছিল। মুগ্ধ হওয়ার মতো। মনে আছে। এখনও তেমন আছে। থাকুক। তিনি বললেন, এখন আমি গান শুনব সুমি। 

কী গান শুনবে, বাঁশুরী সিনেমার সেই গান, ও বাঁশি, বাঁশিরে দিনদুপুরে অমন কইর‍্যা আর ডাইক্য না। 

তাঁর মনে পড়ে গেল, রজ্জাক, করবী, তিনি সেই প্রথম একজনের মুখে রজ্জাকের নাম শুনলেন। সীমান্তের ওপারে যে দেশ সেখানে সব আলাদা। সিনেমা থেকে গানও। অদ্ভুত লাগত! মেয়ে ওপারের সিনেমার গান মুখে নিয়ে ঘোরে। 

সুমি বলল, চুপ করে থাকো বাবলুদা, আমি তোমাকে শোনাই গান। 

মোবাইলে গান শোনা যায় না। 

তুমি হোয়াটস আপ খোলো, আমি তোমাকে ভয়েস ক্লিপ পাঠিয়ে দেব, গান, ফিসফিস। 

অনুপম বলল, সুমি আমি এখন রাখছি। 

না রাখবে না, একা অতবড় একটা ফ্ল্যাটে বসে কী করো, কথা বললে কী হয়? সুমি মুখঝামটা দেয়। 

আমি রাখছি, পরে কথা বলব।

পরে কখন, রাতে? 

চুপ করে থাকলেন অনুপম। সুমির বয়স হয়নি? রাতে ফোন করবে কেন। চারদিক সব বদলে গেছে। কবে কখন বদলাল তিনি ধরতে পারেননি। নাহলে সুমির কোনও সম্ভাবনাই ছিল না তাঁকে খুঁজে বের করা। সুমি ডাকল, হ্যালো বাবলুদা, তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো? 

কী মনে হল, তিনি বললেন, তোমার ছেলে তো এগজাম দিতে আসেনি। 

তাই, দরকারেই তো গেছে কলকাতা। 

আমাকে মিথ্যে কথা বলেছিল। অনুপম বললেন। 

না, গিয়ে সব বলবে বলেছিল বাবলুদা, বুঝিয়ে না বললে তুমি বুঝবে না। 

সে যে কারণে এসেছে, তা ঠিক না। 

আচ্ছা, আমি তো সব জানি না, কিন্তু ও তোমাকে বিব্রত করবে না, তোমার ছেলে টুটুল, সূর্যনীলই তো বলল তোমার কাছে যেতে। 

সে কি জানে ও কেন এসেছে? 

সুমি আচমকা ফুঁসে উঠল, আমার কি কোনও অধিকার নেই বাবলুদা, মনে আছে কি, আমি কী বলেছিলাম চলে আসার সময়? 

মনে পড়ে। কিশোরীর চোখে জল। চলে যাচ্ছি, কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমি সুখী হব না বাবলুদা। তারপর সে হারিয়ে গেল। 

সুমি বলল, আমার ছেলে তোমার ফাঁকা ফ্ল্যাটের এক কোণে থাকবে ক’দিন, আমাদের তো কোনও শেল্টার নেই কলকাতায়। অনুপম বললেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তোর কথা সুমি। 

সুমি উল্লসিত হয়ে উঠল, ঠিক যেন সেই অনেকদিন আগের বাবলুদা, তুই করে বলতে আমাকে, মনে হয় কত জন্মের আগের কথা, আমি যেন সেই দিনে ফিরে গেছি বাবলুদা। 

অনুপম বললেন, আমি রাখছি, তোর ছেলেকে এসব না করে পড়াশোনা করতে বল, কিছুই জানে না, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রজনীকান্ত আলাদা করতে পারে না, অজ্ঞান যুবক। 

এমন বলো তুমি বাবলুদা, আচ্ছা পড়ে কী করবে, এমএ পাশ ছেলে এখন ঝাড়ুদারের চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই করছে, চাকরি এখন দাদাদের হাতে, কত টাকায় বিক্রি হচ্ছে জানো তো, ছেলেগুলো কী করবে বলো দেখি, রবি ঠাকুর, নজরুল কি চাকরি দেবে? 

তিনি বললেন, ওকে ফিরে যেতে বলিস, যদি কোনও খারাপ ব্যাপারে জড়িয়ে যায়, বেরতে পারবে না, আমি সাহায্য করতে পারব না। 

এমন কথা তুমি বললে বাবলুদা, তা হবে কেন, ওকে সকলে খুব ভালোবাসে, ওর কিছু হবে না, ও খুব বুদ্ধিমান ছেলে। 

তখন উদ্বিগ্ন অনুপম বললেন, ও যা করতে এসেছে, তা খুব রিস্কি। 

যদি তোমার মনে হয় ও খারাপ কাজ করতে গেছে, ফ্ল্যাটে ঢুকতে দিও না আর, বাবলুদা, তুমি সব ভুলে গেছ, মেয়েদের জীবনের কোনও দাম নেই পুরুষমানুষের কাছে, আমি কী করে বেঁচে আছি তা যদি জানতে। 

অনুপম বিব্রত হয়ে চুপ। সুমি সেই তার দাঁড়ের মাঠের দিনগুলির কথা বলতে লাগল। সাতক্ষীরে থেকে প্রথমে পার করে দিয়েছিল ওর বাবা মেয়েকে, ইন্ডিয়া নিয়ে এসেছিল। সকলে চলে আসবে, কিন্তু তার জন্য ভূসম্পত্তি বেচতে হবে। বিনিময়ের পরিবার খুঁজছে। বর্ধমানে যোগাযোগ হয়েছে। কিন্তু সব হতে ছ-মাস লাগবে। এর ভিতরে মেয়ে যদি কিছু করে বসে। ক’দিন মেয়েটা চুপ করে বসে ছিল। বলা যায় না, সিনেমার টানে করাচি চলে গেলে আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না। সুমি বলতে থাকে কেমন ছিল সেই দিনগুলি। বাবলুদা, তুমিই আমার দুঃখের সাথী হয়েছিলে। আমার তো মনে হচ্ছিল পালিয়ে যাই, মনের ভিতরে কান্না চেপে বসে থাকতাম…। এতদিন পর তুমিও একা, আমিও একা বাবলুদা। কথাগুলো শোনো। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *