বাতাসবাড়ি জ্যোৎস্নাবাড়ি – ২

দুই

ইদানীং এইটা হয়েছে। ছেলে মেয়েরা তাঁকে বন্দি করতে চাইছে মনে হয়। অনুপম মুক্ত হতে চান। একা থাকার আলাদা এক আনন্দ আছে। তা নষ্ট হতে দেবেন না অনুপম। টের পেলেন মেয়ে ফোন রেখে দিয়েছে। চুপ করে বসে থাকলেন অনুপম। রাস্তার ওপারের ব্যালকনি কখন ভরে গেছে জানেন না। সেই প্রৌঢ়া বসে আছেন চেয়ারে। তাকিয়ে আছেন এদিকে। অনুপম উঠে ঘরের ভিতরে গেলেন। ফ্লাক্সে চা আছে। পেয়ালায় ভরে নিতে নিতে কী মনে হল, বাম হাতের আঙুলে বিদিশার নম্বর ডায়াল করলেন। বেজে যাচ্ছে। বাজতে বাজতে থেমে গেল। খুব রেগে গেছে মেয়ে। তিনি নিশ্চিন্তে বসলেন সোফায়। 

সারাদিন তাঁর কাজ কী? খবরের কাগজ, টিভি, ল্যাপটপ-এ ইন্টারনেট সার্চ, ফেসবুক, ইউটিউবে গান, সিনেমা এবং লাইব্রেরি থেকে আনা বই। তিনি দুপুরে ঘুমতে পারেন না। মাইক্রো ওভেনে ভাত তরকারি গরম করে নিজেই ভাত বেড়ে নেন। একটু বেশি ভাত রাঁধতে বলেন আনুর মাকে। কেন? না এইটা ছিল কুন্তলার অভ্যাস। একজনের মতো বেশি। সেই ভাত বিকেলে এসে খায় রুকসানা মাসি। রুকসানার আগে কাজ করত গীতা, তার জন্যও এই ব্যবস্থা ছিল। তিনি করেছিলেন। তার আগে মেনকা ছিল। কুন্তলা তার জন্য ভাত রেখে দিত। তিনি সেই অভ্যাসটা বজায় রেখেছেন। রুকসানা এসে বাসন ধুয়ে কিচেন পরিষ্কার করে খেতে বসেছে কিচেনের মেঝেয়। নিঃশব্দে খেয়ে নেয়। মাছ আর ভাত। শীর্ণকায় বছর চল্লিশের রুকসানা, সমস্ত মুখে অপুষ্টির চিহ্ন। স্বামী একটি ব্যবসা করে। রেডিমেড জামাকাপড় হাওড়া এবং মেটিয়াবুরুজের কারিগরদের কাছ থেকে নিয়ে এসে দোকানে সাপ্লাই দেয়। তার খুব শখ নিজেই একটা দোকান দেবে তাদের মহল্লায়। হয়ে উঠছে না। 

রুকসানা যখন খায় তিনি ঘর থেকে বের হন না। রুকসানা লজ্জা পায়। সকালে কাজে বের হয়। সারাদিন এবাড়ি ওবাড়ি করে সাড়ে তিনটে নাগাদ এই ফ্ল্যাটে ফিরে আসে বাসন ধুতে আর কিচেন পরিষ্কার করতে। কোনও দরকার হয় না, পরের দিন সকালে একজনের খাওয়া থালা বাসন ধুতেই পারে, সঙ্গে কড়াই, হাতা খুন্তি, ডেকচি। সকালে সে আনুর মায়ের আগে আসে। কিন্তু সে বিকেলেই আসে এইটুকু কাজ করতে। না এলে ভাত পাবে না। সপসপ করে ভাত মাছ খেয়ে সে বেরিয়ে যায় বাইরে থেকে দরজা টেনে দিয়ে। আনুর মা সকালে দু-বেলার রান্না করে যায়। রুকসানা অবশ্য সপ্তাহে দুদিন কাঁচাকাচি করে। আগে ওয়াশিং মেশিনে ওটি করত কুন্তলা। কিন্তু রুকসানা ওয়াশিং মেশিন চালাতে পারে না। কাঠের একটা ব্যাটন দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে কাঁচে। জামাকাপড় ইস্ত্রি করে এনে দেয়। অনুপম বোঝেন এমনি সে ভাত নিতে চায় না। যখন অনুপম মেয়ের কাছে যান রুকসানার খুব অসুবিধে হয়। অসুবিধে হয় যখন তিনি বেড়াতে যান কোনও প্রাক্তন কলিগের বাড়ি, রানাঘাট কিংবা শিলিগুড়ির দিকে, কিংবা যখন যান দাঁড়ের মাঠ গ্রামে। সাত-আট দিন হয়ে যায় ফিরতে। দুপুরের ভাত তার খুব দরকার। অনুপম মাছও কেনেন তার জন্য। তিনি যেদিন যেখানেই যাত্রা করেন, রুকসানা জিজ্ঞেস করে, কবে ফিরবে, তাড়াতাড়ি চলে এসো দাদা, বাড়িতে বিশ্রাম নেবে, ভালো থাকবে, এত বয়স হল, এখন এত ঘুরাঘুরি ঠিক না। 

রুকসানা গেছে, তিনি ভাবলেন বিদিশার রাগ ভাঙাতে হয়, ডায়াল করলেন। বিদিশা ধরল। খুব গম্ভীর। অনুপম বললেন, মেয়েকে নিয়ে তুই কদিন আয়। 

না বাবা, আমরা ভাবছি পুরী যাব, তুমি কি যাবে আমাদের সঙ্গে? 

উঁহু, আমি তো জানুয়ারিতেই পুরী ঘুরে এলাম। 

আবার যেতে অসুবিধা আছে? 

তিনি বললেন, আমি পরের মাসেই ডুয়ার্স যাব, এখন বেরব না। 

বাবা, তুমি আমাদের সঙ্গে ডুয়ার্স গেলে না তখন, পুজোয় গেলাম। 

অনুপম বললেন, তোদের সঙ্গে কেন যাব বল দেখি, আমার বন্ধুদের সঙ্গে তো আমি যাব। 

কেন আমরা তোমার বন্ধু হতে পারি না? বিদিশা রাগ করল। অনুপম চুপ করে থাকলেন, তারপর খুব শান্ত গলায় বললেন, তোর সমস্যাটা কী বলতে পারিস? 

বিদিশা বলল, বাবা, তুমি সিক্সটি সিক্স রানিং, তুমি একা থাকো, আমার আর দাদার এইটা সমস্যা। 

সমস্যা তৈরি করলে সমস্যা, যখন তোর মা নার্সিং হোমে গেল, তোর দাদা ইউএস, তুই দিল্লি, আমি কি একা সব করিনি? অনুপম শান্ত গলায় বললেন, তখন থেকেই তো আমি একা থাকি। 

বাবা, ওসব কথা বাদ দাও, কথায় কথা বাড়বে, মায়ের চিকিৎসা ঠিকভাবে কি হয়েছিল? 

তিনি বললেন, খুব খারাপ লাগে তোদের এই কথা শুনতে, তুই পুরী ঘুরে আয়, আমাকে আমার মতো থাকতে দে। কথাটা বলে তিনি তৈরি হতে আরম্ভ করলেন। বিকেলে তিনি একা। বিকেলের অনেক আড্ডা আছে। কোথাও তিনি নেই। একা একা পশ্চিমে হাঁটেন তিনি। পশ্চিমে গঙ্গা আছে। গঙ্গা অবধি হেঁটে যান বিটি রোড পেরিয়ে। ওদিকটা পশ্চিমাদেরই মহল্লা। বেশিরভাগ হিন্দিভাষী। মিলে কাজ করে, গোডাউনে কাজ করে। কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরির শ্রমিক মহল্লা এদিকে। তাঁর ফ্ল্যাটে একটি লোক আসত বাসন বেচতে। বাসনের ঝাঁকার ভিতরে ছোট জ্যারিকেনে গঙ্গাজল। কুন্তলা নিত। লোকটাকে গঙ্গাজল বলে ডাকত কুন্তলা। কুন্তলার মৃত্যুর পর সে আর আসে না। কেন আসে না কে জানে? লোকটা বুড়ো হয়েছিল। দেশ ছিল পাটনা পুবে ২৫ মাইল দূরে এক গ্রামে। সেও গঙ্গার ধারে। গঙ্গাজল কি দেশে ফিরে গেছে? ওর নাম জানা নেই। বাসন ফেরি করত। বাসন ফেরি করা একটা লোক, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ময়লা শার্ট আর ধুতি, মাথার চুলের অনেকটাই সাদা, এমনি বর্ণনা করলে কি তার হদিশ পাওয়া যাবে? হয় নাকি? তিনি গ্যালিফ স্ট্রিট ধরে গঙ্গার ধারে চলে এলেন। এদিকে আগে ট্রাম চলত। বন্ধ হয়ে গেছে। লাইন পড়ে আছে। এমনই তিনি দেখেছিলেন শিবপুরে। ট্রাম ডিপো নামটি এখনও আছে। লাইন ক্রমশ পিচের নীচে চলে গেছে। তিনি গঙ্গার পাড়ে একটি বেঞ্চে বসলেন। ওপারে বেলুড় হবে। হাওড়া জেলা। ওপারে সব চিমনির ধোঁয়া এখনও বন্ধ হয়নি। একটি লোক এল। বেঞ্চের প্রান্তে বসল। লম্বা। গাল ভর্তি না কামানো দাড়ি। চোখ ঝিমঝিমে। সিগারেট পুড়ছে ওর হাতে। জামাকাপড় পরিষ্কার। বছর ষাটের লোকটা তার দিকে তাকিয়ে হাসে, আপনি স্যার তো একা থাকেন। 

কে বলল? তিনি বিরক্ত হলেন। 

সবাই বলে আপনি একা থাকেন, আর আপনাদের ফ্ল্যাট বাড়িটাও কেমন যেন। লোকটি হেসে বলল। 

অনুপম জিজ্ঞেস করলেন, কেমন? 

যারা কিনেছে তারা কেউ থাকে না, আপনি একটা কিনেছেন এবং থাকেন। 

আপনি তো সবই জানেন দেখছি। 

জানি স্যার, এনআরআইদের কেনা, তারা দু বছরে একবার ইন্ডিয়ায় আসে, কিন্তু এই ফ্ল্যাটে ওঠে না, তাদের আরও ফ্ল্যাট আছে কলকাতায়। 

অনুপম চুপ করে থাকলেন। তাঁর সব খোঁজ রাখে এই লোকটা। বলছে, আপনি খুব লাকি স্যার। 

লাকি কেন? তিনি অবাক হলেন। 

লোকটা বলল, আমিও আপনার মতো হতে চাই স্যার, আমার নাম ভবতোষ কুণ্ডু। 

অনুপম জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথায় থাকেন? 

রানি রোড, আপনার রাস্তার পেছনের রাস্তা, জ্ঞানবিতান বইয়ের দোকানের পাশ দিয়ে গিয়ে প্রথম নয় দ্বিতীয় বাঁক, তিনটে বাড়ি পরে। 

বাড়িতে কে কে আছে? 

দুই ছেলে এক বোন, বিয়ে হয়নি, খুব কালো, ইস্কুল টিচার, পৈতৃক বাড়িতে তার অংশ আছে, ছেলেরা বিয়ে করেছে, আমার বাড়ি একটা হাট স্যার। 

অনুপম চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, আমি বাধ্য হয়েছি একা থাকতে, এখন এইটাই ভালো লাগে। 

জানি স্যার, আমি আপনার খোঁজ রাখি, আপনার ছেলে ফরেনে, ওয়াইফ…, ভবতোষ গড়গড় করে বলে যেতে থাকে। অনুপম হাত তুলে থামাতে চাইলেন। কিন্তু ভবতোষ তাঁর জীবনপঞ্জি শেষ করে থামে। একটু দম নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ভুল বললাম স্যার? 

অনুপম বললেন, না, কিন্তু আপনি ঘরে আমার অজান্তে উঁকি দিয়েছেন, একে তো ভালো মনে নিতে পারলাম না। 

আপনার বাড়িতে কাউকে দেখি না, আপনি ওই সাততলা বাড়িতে একা থাকেন, আমার দারুণ লেগেছিল শুনে, সেই কারণে আমি একটু জেনেছি। 

কে বলেছে? অনুপম জিজ্ঞেস করলেন। 

বলা যাবে না স্যার, আমি আপনার সব জানি, আপনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, ফার্স্ট পোস্টিং…। 

অনুপম বললেন, আপনি চুপ করুন। 

ইয়েস স্যার, চুপ করছি, বাট আমি সেই অমল সেনগুপ্তর বাড়িও দেখে এসেছি, বাড়িটা এখন এক পুলিস অফিসারের, সেকেন্ড ওয়াইফকে কিনে দিয়েছেন, মানে অফিসারের দুটো বিয়ে, সেকেন্ড ওয়াইফ ইয়াং। 

কৌতূহলী হলেন অনুপম। কিন্তু কৌতূহল নিবৃত্ত করলেন। এ কি পুলিসের চর? এত কথা জেনে বসে আছে! যাই হোক, তাঁর জানার দরকার নেই। নিস্পৃহ হয়ে বসে থাকলেন। একা বসেছিলেন। মাথার উপর নিমের ছায়া। লোকটা কি তাকে অনুসরণ করে এসেছে? তবু কী মনে হল, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, গঙ্গাজলকে চেনেন? 

হকচকিয়ে গেল ভবতোষ, বলল, আজ্ঞে গঙ্গার সামনে বসে আছি, ওই তো গঙ্গার জল। 

মাথা নাড়লেন অনুপম, উঁহু, তাঁর মানে আপনি সব জানেন না, সব খবর নিতে পারেননি। 

তাহলে স্যার, আচ্ছা বুঝেছি, এইটা তো হুগলি রিভার।

উঁহু, আমি তা বলছি না। 

গঙ্গাজল তো বয়ে যাচ্ছে। 

আপনি সব জানেন না। বললেন অনুপম। 

অনেকটা জানি স্যার, আপনি ফরেনে যেতে চান না, আপনি নিজের মতো থাকতে চান…। 

আচ্ছা, এসব পুরনো কথা। 

আমার খুব হিংসে হয় আপনাকে দেখে, কী আনন্দে আছেন, আমার নিজের একটা আলাদা ঘর নেই পর্যন্ত, ছেলেরা যে নির্দেশ দেয়, আমাকে তা করতে হবে, আমি একটা ঘর খুঁজছি, আলাদা থাকব, একা থাকব। বলতে বলতে ভবতোষ তাঁর দিকে সরে এল, এনআরআই-দের ঠিকানা দেবেন স্যার, আমি চিঠি লিখব, কিংবা ফোন করব, মেল করব, আমি যদি থাকতে পারি একটা ফ্ল্যাটে। 

আমার কাছে নেই। বলে উঠলেন অনুপম। তিনি এসেছিলেন একা গঙ্গার সামনে বসতে। এমন তিনি প্রায়ই আসেন। কিন্তু আজ খুব বিব্রত করছে এই লোকটা। একাকিত্ব নষ্ট করে দিচ্ছে। তিনি হাঁটতে আরম্ভ করলেন। বললেন, আমার পিছনে আসবেন না। 

ইয়েস স্যার, কিন্তু গঙ্গাজল কী, মানে গঙ্গাজল সিনেমার কথা বলছেন? 

নো, প্লিজ, লিভ মি অ্যালোন। অনুপম বিরক্ত হয়ে বললেন। ওকে স্যার, কিন্তু গঙ্গাজল বুঝতে পারলাম না। ভবতোষ হাত কচলে বলল। 

বুঝতে হবে না, দেখতে পাচ্ছেন না গঙ্গার জল! বলে তিনি হাঁটতে আরম্ভ করলেন গঙ্গার ধারের রাস্তা দিয়ে। চক্ররেলের লাইন বাঁ পাশে। ডানদিকে কাশী মিত্তির শ্মশানঘাট। খোল কত্তালে কীর্তন হচ্ছে একটি মৃতদেহকে ঘিরে। তিনি পেছনে তাকান। না ভবতোষ আসছে না। কিন্তু লোকটা কি সবই সত্য বলেছে? সত্যই তো। তাঁর সম্পর্কে জানে প্রায় সবটা। যেন তাঁর জীবনীকার। কিন্তু গঙ্গাজলকে চেনে না। জানেই না তার সম্পর্কে। এখানেই তাঁর কিংবা গঙ্গাজলের জিত। ফেরিওয়ালা ঢুকতে পারে না তাঁর আবাসনে। লোকটা আবাসনে এসে কী বেচবে? প্রায় সব ফ্ল্যাটই তো তালা বন্ধ। এক সিকিউরিটির বউ তাকে ডেকে বাসন দরাদরি করত। একদিন কুন্তলার চোখে পড়ে যায়। কুন্তলা তার ফ্ল্যাটে আসতে বলেছিল। এই নিঃঝুম আবাসনে তার কথা বলার লোক ছিল না। গঙ্গাজলকে খেতেও দিত কুন্তলা। তাকে একবার শীতে সস্তার কাশ্মীরি শাল দিয়েছিল সে। দু-বছর পুজোয় ধুতি জামা দিয়েছিল। তারপর তো অসুস্থই হয়ে পড়ল। গঙ্গাজল তার মেয়ের বিয়েতে দু-বেলা খেয়েছিল। প্যাকেটে করে মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিল। কুন্তলা অসুস্থ হতে খোঁজ নিত। কুন্তলার মৃত্যুসংবাদে মাথায় হাত দিয়ে সিকিউরিটি প্রশান্ত হালদারের কোয়ার্টারের সামনে বসেছিল লোকটা। পরে এসেওছিল। তারপর আসা বন্ধ করল। ঘুরতে ঘুরতে তিনি ফিরে এলেন পাড়ায়। তখন রাত আটটা। রুটি নিয়ে ঢুকবেন। রুটির দোকানেই আবার ভবতোষ কুণ্ডু, যেন তাঁর অপেক্ষায় বসে ছিল, এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করল, স্যার, এতক্ষণে ফিরলেন? 

কেন? অনুপম বুঝতে পারছিলেন এই লোকটা তাঁকে বিব্রত করবে। গায়ে পড়ে আলাপ করতে আসা লোক কোনও সময়েই সন্দেহের ঊর্ধে নয়। উদ্দেশ্য আছে কোনও। ভবতোষ বলে, আপনার সব রুটিন ধরা স্যার, ডেইলি এই সময়েই আসেন এখানে, আমি এখানে সবদিনই থাকি, কিন্তু আপনি আমাকে খেয়াল করেননি, কেন করবেন স্যার, আমি কে? কিন্তু আজ সকালেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আপনার সঙ্গে আলাপ করব। আমি জানি, সকাল পাঁচটা চল্লিশে মর্নিংওয়াকে বের হন, আটটা কুড়ি নাগাদ ফেরেন ফ্ল্যাটে,… বলেই যাচ্ছে লোকটা। হুবহু বলে যাচ্ছে তাঁর জীবনপঞ্জি মুখস্থ প্রায় খোঁচড়ের মতো। সব জেনেই তাঁর কাছে এসেছে। কত রকম লোকই না হয়! 

রাতের রুটি নিয়ে ফিরে এলেন অনুপম। সব্জি রাঁধা আছে, গরম করে নেবেন। মিষ্টান্ন আছে শেষ পাতের জন্য। সুগার নেই তাঁর। ব্লাড প্রেশার আছে, তার ওষুধ রাতেই খান। হৃদয়ঘটিত একটু অসুবিধে আছে। ঘুমের আগে ইকো-স্পিরিন জাতীয় একটি ওষুধ খেতে হয়। আর প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের ওষুধ খেতে হয় নিয়মিত। রাতে একবার ঘুম ভাঙে। এই রুটিন তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করে। আটটার পর বাড়ি ফিরে টিভি দেখেন। সমস্ত দেশের খবর। খুব জরুরি খবর না থাকলে, টেলিভিশনে পুরনো দিনের সাদা কালো কিংবা গেভা কালার, ইস্টম্যান কালারের হিন্দি ছবির গান শোনেন। তা যদি পছন্দ না হয়, ল্যাপটপ খুলে ইউটিউবে গান শোনেন। একটা গান খুব প্রিয়, অশোককুমার সুচিত্রা সেন অভিনীত ছবিতে লতা মুঙ্গেশকরের গান, রহো রহেনা হম…। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর খুব প্রিয়। কণ্ঠসুধাতেই মজে থাকেন। আজ তিনি গানই শুনছিলেন। ১৯৫১ সালে নবীন লতা মুঙ্গেশকরের গান, সাড়ে নটা নাগাদ ফোন এল। অচেনা নম্বর। তিনি যা আন্দাজ করেছেন, ঠিক তাই। ভবতোষ কুণ্ডু। স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব আনন্দ হয়েছে, কতদিন ধরে আপনার কথা শুনছি, কিন্তু আলাপ করতে সাহস হতো না, অতবড় একটা ফ্ল্যাটে একা থাকেন, আমার কাছে তা স্বপ্ন, হ্যাঁ, স্যার স্বপ্নই, আমি যেন একটা রেল জেলখানার কয়েদির একা থাকার সেলে থাকি স্যার, হাত-পা মেলার জায়গা নেই, আমি খেলা দেখতে চাই, কিন্তু বাড়ির মেয়েছেলেরা সিরিয়াল দেখবে ‘ময়না কথা কও’, এ জীবনে আমার কোনও সাধ মেটেনি স্যার। 

আচ্ছা, পরে কথা হবে। তিনি এড়াতে চাইলেন। 

অনুপম ফোন কেটে দিয়েছিলেন। কিন্তু লোকটা পরদিন সকালে ফ্ল্যাটেই চলে এসেছে। কী বিপদ! তাড়িয়ে তো দিতে পারেন না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *