বাতাসবাড়ি জ্যোৎস্নাবাড়ি – ১৬

ষোলো

রাখালবাবু চোখ তুলে দেখলেন। তারপর মাথা নামিয়ে নিলেন। দাঁড়ানোর কোনও উপায় নেই। পিছনের মোটর সাইকেলওয়ালা তাড়া দিচ্ছে। খুব জোরে তার হর্ন বেজে উঠল। রাখালবাবু। একেবারেই সেই বুড়ো লোকটি। সেই পপলিন কাপড়ের ময়লা সাদা শার্ট। ধুতি। ঘামে মুখখানি ভিজে ভিজে। অনুপম ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন পেছনে। তিনি সামনে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে এক মুহূর্তের জন্য পেছনে ফিরলেন। কী বিস্ময় তাঁর চোখে। টোটো এগিয়ে গেল। ধীরে ধীরে জট কাটল। তাঁকে নিয়ে টোটো ছুটতে লাগল। টোটোর ভিতরে গান বাজছে, ঠান্ডি হাওয়াঁয়ে লেহরাতি আয়ে…, কত কাল আগের গান। কী সিনেমা? নও জওয়ান, লতা মুঙ্গেশকরের গান, খুব গাইত সুমি। সুমি। বেলা পড়ে আসছে। রেখে যাচ্ছে সেই গান। সুমি ওই গান পেল কী করে? গানটি ১৯৫০-৫১-র। ইউটিউবে শুনেছেন অনুপম। সুমি তাঁর চেয়ে বছর ছয়-সাত ছোট ছিল। এই গানের কথা কবি শাহির লুধিয়ানির, শচীন দেববর্মণের সুর। কোমর নামানো লম্বা ঝুলের ফ্রক, মাথা ভর্তি চুল, চুল খুলে দিলে পায়ের গোড়ালি ছুঁয়ে যেত। সুমি বলেছিল রেডিওয় শুনেছে। তখন রেডিও কোথায় ছিল? সুমি বলেছিল তাদের তালা গ্রামে পাশের বাড়ির মান্নান সাহেবের বাড়িতে ছিল মস্ত রেডিও। রেডিওতে ইন্ডিয়া শোনা যেত খুব ভালো। মান্নান স্যার ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিল। তার ছেলে মহসিন ঢাকায় গিয়েছিল সিনেমা করতে। সুমিকে সিনেমায় নামাবে বলেছিল। মহসিন তার দিকে নজর দিয়েছে, সেই ভয়ে তাকে এপারে পাঠিয়ে দিল। মহসিন এতদিনে হয়তো হিরো হয়ে গেছে। অবাক হয়ে সুমির কথা শুনত অনুপম। সুমি বলত, পাকিস্তানে থাকলে সে হিরোইন হয়ে যেতই। মহসিন বলেছিল করাচি নিয়ে গিয়ে উর্দু সিনেমায় নামিয়ে দেবে সুমিকে। খুব দাম হবে হিন্দু হিরোইনের। 

এই গান কি সিডিতে বাজছে? জিজ্ঞেস করলেন অনুপম।

ইয়েস স্যার, বন্ধ করে দেব? বেস্ট অফ লতা মুঙ্গেশকর। টোটো ড্রাইভার বলল। 

না না, বন্ধ করবে কেন? অনুপম বললেন। 

কেউ কেউ স্যার শুনতে চায় না। টোটো ড্রাইভার বলল, তখন বন্ধ করে দিতে হয়। 

আস্তে বাজাবে, তাহলে ভালো লাগে, এইটা ১৯৫১ সালের গান। 

জানি স্যার, সবই আগের জন্মের, রহে না রহে না হাম…….এই গানটা, সুচিত্রা সেন অশোককুমার, ধর্মেন্দ্র, আমার দারুণ লাগছে, শুধু শুনছি। 

কথা বলছিল তরুণ টোটো ড্রাইভার গাড়ির গতিবেগ কমিয়ে দিয়ে। ধীরে ধীরে চলছিল গাড়ি। সে বলছিল গতকাল একটা প্যাসেঞ্জার নিয়ে সে বর্ডার থেকে কাটিয়াহাট গিয়েছিল, একটা মেয়ে, একুশ-বাইশ, সিডিটা দিয়ে বলল, — এইটা চালাও, তুমি শুনো, কেউ শুনতে চাইলে শুনিও, স্যার আমাকে এমনি দিয়ে নেমে গেল কেটে ( কাটিয়াহাট ) বাজারে। 

কেমন দেখতে? অনুপম মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

মাজা মাজা গায়ের রং, দেখলে মনে হয় খুব ঠান্ডা ওই মেয়ে, কী সুন্দর, হিরোইনের মতো, মাথায় অনেক চুল। 

কত চুল? জিজ্ঞেস করলেন অনুপম।

বলল পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত।

তুমি জিজ্ঞেস করলে? 

না স্যার, তিনিই বললেন,তাঁর চুল দেখতে কতজন আসে, সাতক্ষীরেয় অমন চুল কাউর নেই, মনটা কত ভালো বলেন। 

হুঁ। চুপ করে থাকলেন অনুপম। গা শিরশির করছে। কাটিয়াহাট গঞ্জ এসে গেল। বেলা এখন নেই-ই প্রায় আর এখান থেকে দাঁড়ের মাঠ তিনি হেঁটে যাবেন। মিনিট কুড়ি লাগবে। সন্ধের আগে বাড়ি 

গঞ্জ এখন চেনা যায় না। মঙ্গল শনি, হাটের দু’দিন জমজম করত কেটে। এখন সব দিন, সমস্ত দিনই সেই অবস্থা। এই হাটে নাকি পার্টিশনের আগে সাতক্ষীরে থেকেও লোক আসত। তাঁর বাবাও এসেছেন পুজোর বাজার করতে। সাতক্ষীরে বসিরহাটের চেয়ে একটু সস্তা ছিল নাকি। পার্টিশনের পরেও আসত ওপারের লোক। বাবা কতদিন বাড়ি ফিরে বলেছে, অমুকের সঙ্গে দেখা হল। জিজ্ঞেস করলাম, গ্রামের কথা, কেডা কেমন আছে। অদ্ভুত লাগত। তাহলে তারা চলে এল কেন? কিন্তু আস্তে আস্তে সেই আসাও বন্ধ হয়ে গেল। তিনি হাঁটতে লাগলেন। কোথা থেকে এক খণ্ড মেঘ এসেছে, বড় একখানি ছায়া তাঁর মাথায়। আহা! যেন তাঁর বাবা জীবনকুমার সেন, ঠাকুরদা সুধীরকুমার সেন ছায়া মেলে আছেন মাথার উপর। ঠাকুরদা বুড়ো হয়েছিলেন। কেটের কাছে দাঁড়ের মাঠ তিনি চিনতেন, এখানে পার্টিশনের আগে কয়েকবার এসেছেন সাইকেলে। দাঁড়ের মাঠ সাতক্ষীরে থেকে আর কতটা! তাঁদের ধারণা ছিল এই পার্টিশন থাকবে না। কিন্তু থেকে গেল। কী সুন্দর ঠান্ডা বাতাস আসছে। জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর। সেই প্রান্তর এখন ভরেই গিয়েছে প্রায়, তবু খালি জায়গা অনেক। তিনি দেখলেন সেই বট। কতকালের সেই বট। নিশিদিশি দাঁড়ায়ে আছ মাথায় লয়ে জট। বটের পেছন দিকে হাজরা ঠাকুরের থান। অনুপমের ছোটভাই বিশ্বনাথ জন্মের পর মরেই যাচ্ছিল। হাজরা ঠাকুরের কাছে মানত করে নাকি বাঁচানো হয়েছিল। হাজরা ঠাকুর শিবের অনুচর। হাজরা ঠাকুর বাঁচিয়েছিল বলে, ওর নাম বিশ্বনাথ। আর ডাকনাম বিশু ছাড়াও আর একটি ছিল, হাজু। বিশু বেঁচে থাকতে পারল না। আকাশ থেকে এক দুই ফোঁটা জল পড়ল। অনুপম দূরে, সেই ছায়াময় বটের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বিশুও তাঁকে ছায়া দিয়েছে। দু’ফোঁটা জল। তিনি আকাশে তাকালেন। দুচোখ ভরে এল জলে। বৃষ্টি আসবে নাকি? আসুক। এই মেঘ ছিল না। কোন পার থেকে যে এল বটের ছায়া নিয়ে! 

চৈত্র সংক্রান্তিতে হাজরা ঠাকুরের থানে বড় পুজো পাঠ হয়। কোথা থেকে এক রক্তবস্ত্র পরিহিত পুরোহিত এসে পড়ত যে তা কেউ জানত না। নানা রকম অনুমান করত। যশোর জেলার ঝিনাইদহর কাছে বেগবতী নদীর ধারে কালীগঞ্জের হাজরা ঠাকুরের মন্দিরের সাত পুরোহিত-তান্ত্রিকের একজন সে, তাকে ঠাকুরই ডেকে আনত এপারে। ঠাকুর-দেবতার কি বর্ডার আছে? দিন তিনেক আগে থেকে ধুনি জ্বলত। তিনি দাঁড়িয়ে পড়েছেন। পেঁচোয় ধরেছিল বিশুকে। হাজরা ঠাকুর রক্ষা করেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। তিনি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। ওই যে বটের ছায়া আর অন্ধকারে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। বিশু, বিশ্বনাথ! বালক দাঁড়িয়ে ওই দূরের ছায়ায়। অনেকদিন বাদে গ্রামে এলেন। বিশুই দেখেছিল বাগানে সুমি আর অনুপমকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায়। তখন সে বছর আট-নয়। তাকে বুলু ময়রার দোকানের চিট- কদমা কিনে দিয়ে তবে রক্ষে। আবার এক ফোঁটা জল। আনন্দের না কান্নার! তিনি হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি এলেন। ভেরেন্ডা গাছের বেড়া দিয়ে ঘেরা বাড়ি। কত লোক ছিল এক সময়। পরে দুই কাকা চলে গেল কদম্বগাছি আর বারাসত। এখন আর তেমন যোগাযোগ নেই খুড়তুতো ভাইদের সঙ্গে। সেই কলকল শুনতে পেলেন অনুপম। ঝাঁপিয়ে এল যেন সুমি আর বিশু। নিরুপম তেমন ছায়া রেখে যায়নি। বাল্যকাল থেকেই সে আলাদা আলাদা। তিনি স্পষ্ট দেখলেন চুল খুলে উঠনে দাঁড়িয়ে আছে সুমি। ছায়া নেমেছে তাকে ঘিরে। আর ছায়া ঘিরে আছে সবাই। এ কি সত্য, সত্য সকলি সত্য! অনুপম ডেকে উঠলেন, মা। 

মা তো বারান্দায় বসে আছে মাদুরে। কে? ডাক দিয়ে যেন মাজা ভাঙা অথর্ব বনতরু মাথা তুলে তাকাল। তাকাল সেই সুমি। বাবলুদা, আরে তুমি, আমি সুমি। বাবলুদা! ঝকঝকে চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আহা! মোর নয়নের বিজলী উজল আলো! যেন ঈশান কোণের ঝটিকার মতো কালো। এ কি সত্য! সাতক্ষীরে থেকে রবীন্দ্রনাথের গান শিখে এসেছিলি তুই। তাদের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের গানের চিহ্ন ছিল না। সুমিই নিয়ে এসেছিল। মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, বাবলু তুই? 

হ্যাঁ, মা, আমি বাবলু। 

বড়দা আপনি? ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে তপতী। বিশ্বনাথের বিধবা। দুই ছেলে দুই মেয়ে। এক মেয়ের পর দুই ছেলে, তারপর আর এক মেয়ে। বড় মেয়ে বিয়ে হয়ে বনগাঁ। মেয়ে মায়ের আঁচল ধরে আছে সব সময়। জেঠাকে ভালো চেনে না। 

হ্যাঁ, চলে এলাম। অনুপম বসলেন চেয়ারে। কোমর ভারী। মাটিতে বসতে কষ্ট হয়। বললেন, চলে এলাম তপতী, মন টানল, মা। 

মা সাড়া দিল, তুইও কি আমেরিকায় চলে যাবি বলে দেখা করতে এইচিস বাবলু, যা তোরা সবাই চলে যা। 

কী যে বলো মা! অনুপম মাকে জাপটে ধরলেন আমি ইন্ডিয়া ছেড়ে যাব না। 

বিশুর এক ছেলে কাটিয়াহাট বাজারে কাপড়ের দোকান চালায়। দোকান তার বাবার রেখে যাওয়া। বছর চব্বিশ। তার বিয়ে দেবে তপতী। তপতী এখন বছর পঁয়তাল্লিশ। বেশিও হতে পারে। কালো পাড় শাড়ি পরে। সাদা ব্লাউজ। মাথা থেকে কাপড় নামায় না। তপতী বলল, আমার ছোটটার খুব মাথা, ইস্কুলের স্যাররা বলেছিল সায়েন্স নিতে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতাম, কিন্তু আর্টস পড়ছে, আপনি একটু বলবেন দাদা, যেন ইঞ্জিনিয়ার করতে পারি। 

ইলেভেন তো? 

হ্যাঁ, টিউশন দিতাম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য, কিন্তু সে জোর করে আর্টসে ঢুকল, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লে সেও আমেরিকা চলি যেতি পারত। তপতী বলল লো ভোল্টেজের আলোর ভিতরে দাঁড়িয়ে। 

মা বলল, তুই একটু বুঝা, তোর কাছে থেকে না হয় পড়বে।

ছেলেটির নাম অভ্রনীল। অভ্রনীল সেন। তার দাদার নাম অদ্রিনীল সেন। নাম তাঁর দেওয়া। বিশু বলেছিল, দাদা, তুমি ভালো নাম দাও মিলিয়ে মিলিয়ে। বিশু বেশিদূর পড়েনি। ব্যবসায় মন হল। অদ্রিনীল দুপুরে ফেরে না। সারাদিন কেনা বেচা। ফিরতে রাত হয়। অভ্র কৃষ্ণকায়। বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে জেঠাকে দেখছিল। বছর সতেরো হবে। তাঁর তখন এই বয়স। সুমি গুনগুন করছে, মোর মধুর অধর বধূরও নবীন অনুরাগ সম সত্য। চ বাবলুদা পেয়ারা পেড়ে দিবি। 

অনুপম জিজ্ঞেস করলেন, বিজ্ঞান পড়লে না কেন, বিজ্ঞান এক সমুদ্র, তার কিছু পেতে। 

আঠেরো বছরের সদ্য যুবক বলল, আমি কবিতা লিখব জ্যাঠামশায়, কবি হব।

কবিতা লিখো, কিন্তু কবিতার সঙ্গে বিজ্ঞানের তো বিরোধ নেই। 

অভ্র চুপ করে থাকে। 

মোবাইল বাজল, শোভন ডাকল, মামা, ও মামা, আমি ফিরছি। 

তিনি ভাবলেন খুব ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চলে এসে। তিনি বললেন, ব্যস্ত। 

মামা তোমার জন্য বর্ধমানের সীতাভোগ নিয়ে যাচ্ছি, তুমি নাকি খেতে ভালোবাসো? 

তিনি চুপ করে থাকলেন। 

মা বলল, তাই নিয়ে যাচ্ছি, ল্যাংচাও নিয়েছি।

ব্যস্ত আছি, বলে তিনি ফোন কেটে দিলেন। 

অদ্রিনীল ফিরতে রাত আটটা। তখন চাঁদ উঠে গেছে। তিনি উঠোনে বসে ছিলেন। জ্যোৎস্নায় উঠোন ভেসে যাচ্ছে। কতদূর দেখা যাচ্ছে। অনুপম জিজ্ঞেস করলেন, আজ কি পূর্ণিমা? 

মা বনতরু বললেন, কাল পুন্নিমে, তুই এলি, কাল কি সত্যনারায়ণ দেব? 

কেন? 

মা বনতরু বললেন, তোদের সকলের জন্য, তোরা দুই ভাই, তোদের ছেলে মেয়ে নাতি, বিশুর ছেলে মেয়ে, সকলের জন্য। 

কী মনে হল অনুপমের, বললেন, দাও, ঠাকুরমশায় আছেন কেউ, আগে যে ভটচায্যি মশায় করতেন, তাঁর ছেলেরা কি করে? 

সে ব্যবস্থা অদ্রি করবে, বিশু চলে গেল, এক বছর কাল অশৌচ গেল, তারপর মনে হয়নি। বিনবিন করে মা বললেন। 

অদ্রি বলল, বলল, ভালো হবে, অনেকদিন সত্যনারান হয়নি।

রাতে ভাত খেয়েছেন অনুপম। শুক্তো, মুগের ডাল, বেগুন ভাজা, চুনো মাছের চচ্চড়ি, পারশে মাছের মাখো মাখো ব্যঞ্জন। তপতীর রান্নার হাত ভালো। তপতীরা পানিতর গ্রামের। পানিতর বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে, বহু প্রাচীন গ্রাম। পানিতরেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম বিবাহ। প্রথম পক্ষ গৌরী ওলাওঠা হয়ে মারা গিয়েছিলেন। তপতী দেখেছে সেই শ্বশুরবাড়ি। পানিতরের মুখুজ্জেরা সুখ্যাত পরিবার। অনুপম অনেকবার ভেবেছেন যাবেন একবার পানিতর। যাওয়া হয়নি। দেখা হয়নি, একটি ধানের শিষে এক বিন্দু শিশির। তিনি বিভূতিভূষণ পড়তে ভালোবাসেন। সীমান্তের ওপারে তাঁদের পূর্বপুরুষের দেশ। খাওয়ার পর বারান্দায় গিয়ে বসলেন অনুপম। মা বসে আছে বারান্দার অন্ধকারে। বাইরে উঠোনে চাঁদের অফুরন্ত আলো। তপতী এসে বসল শাশুড়ি মায়ের পাশে। অভ্রনীল পড়ছিল ভিতরে। বেরিয়ে এসে আচমকা জিজ্ঞেস করেছে, তুমি কাল পানিতর যাবে, বিভূতিভূষণের বাড়ি? 

নিয়ে যাবি? তিনি অভ্রর মাথায় হাত রাখলেন। 

তখন তপতী জিজ্ঞেস করল, টুটুল কি ওদেশেই থেকে যাবে?

অনুপম দায়সারা উত্তর দিলেন, কিছু বলেনি। 

মা অন্ধকার থেকে আবার জিজ্ঞেস করল, তুই কি ওদেশে যাবিনে ওদের দেখতি? 

হাসলেন অনুপম। মা এই রাগ করছে সে ওদেশে যাবে বলে। আবার বলছে, সে একবার গিয়ে দেখে আসুক ওরা ওদেশে কেমন আছে। বিদেশ-বিভূঁই তো। কতই বা বয়স তাঁর নাতিটার। সেদেশে নাকি খুব শীত পড়ে। আহা, মা একটা কাঁথা বুনতে পারত যদি, নাতিকে দিত। কিন্তু এখন আর পারে না। তবে আছে একটা, একজনের ওমের মতো, বাবলুর নাতি গায়ে দিয়ে শোবে। সারা বছর শীত। সে দেশে মানুষ থাকে কী করে? 

যান দাদা, ঘুরে আসুন, দেখে আসুন, ছেলে বলে বিরাট দেশ, দেখার মতো। তপতী বলল, সকলেই ধনী। 

মা তা শুনে উলটো কথা বলল এবার, গেলি তো আর ফেরবে না। 

অনুপম বললেন, না বলেননি, কথাটা নিয়ে মনের ভিতরে খেললেন, কে বলেছে তোমাকে এ কথা? 

তপতী বলল, কেন ফেরবে না মা।? 

মা বলল, কেডা ফিরেছে বলো, আমার নাতি নাত বউ ফিরল? 

তপতী চুপ করে থাকে। কী বলবে ঠিক করে উঠতে পারে না।

মা বলে, আমি তো দেখতিছি যে যায় সে ফেরে না, সে নাকি এমন দেশ, ফিরবে কেউ তা ভাবতিই পারে না, জাদুর দেশ, গাছে গাছে হিরে মোতির ফল, সেই যে গল্প আছে না, সেই জাদুতে মজেছে মানুষ। 

তুমি যে কত দেখবে মা? মনে মনে বললেন অনুপম, তিনি মায়ের কথায় খুব খুশি হচ্ছিলেন না। 

কিছু বলতিছিস? মা জিজ্ঞেস করল।

কিছু না মা। অনুপম বললেন। 

সত্যি আমার কত দেখতি হবে, কবে আমি নিজি যাব। মা বিড়বিড় করল। 

অনুপমের কী খেয়াল হল, জিজ্ঞেস করলেন, মা, তোমার সইয়ের মেয়ে সুমি ফোন করেছিল। 

কার কথা বলতিছিস? 

যে সুমি এখেনে ছিল, তার মা তোমার সই ছিল ওর মা, তৃপ্তিমাসি। 

সেই মেয়েডা, সেই নচ্ছারডা। মা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। চোখে রাগ ফুটে উঠল। প্রাচীন এবং পুঞ্জীভূত ক্রোধ, সে তোরে ছাড়েনি এখনও, বুঝতি পারতিছি, বউমা ওই জন্যি অকালে চলে গেছে, টুটুলও তাই মনের দুঃখে আমেরিকা চলে গেল, তুই যা, তুই টুটুলের কাছে গে থাক, ও যেন আর খোঁজ না পায় তোর। শয়তানি 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *