বাতাসবাড়ি জ্যোৎস্নাবাড়ি – ১৩

তেরো

তাইই তো হবার কথা, মেয়ে জামাই আর অপেক্ষা করতে পারছিল না, জামাই শেষে শাশুড়ি মাকে একটা ছোট ফ্ল্যাটে ঢুকিয়ে দিয়ে বাড়ি প্রমোটারের হাতে দিয়ে দিল। ভবতোষ হাত কচলে বলল। হাত কচলানো ওর স্বভাব। বলছে, জামাই খুব ভালো, এ পাড়ারই ছেলে, থাকে লাতুর জেলা শহরে। মহারাষ্ট্র। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ, ও জীবনে ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হয়নি, জামাই শাশুড়ি মাকে নিয়ে যেতে চায়, কিন্তু শাশুড়ি মা যাননি। মেয়ের কাছে গিয়ে না থাকতে বলে গিয়েছিলেন ওঁর স্বামী। তাই না গিয়ে বাড়ি নিয়েই ছিলেন। নিজে পেনশন পান, স্বামীর জমানো টাকাও আছে। কিন্তু কী হল, জামাই-মেয়ে ওঁকে এখান থেকে সরাতে পারছিল না। বৃদ্ধা জানতেন মেয়ের কাছে গেলে ফিরে এসে আর দেখতে পাবেন না বাড়ি। দেখতে আর কী পাওয়া? ক্ষীণ দৃষ্টি। কিন্তু বাড়িকে চেনেন স্পর্শে। গন্ধে। ভবতোষ বলল, মহিলা খুব ঠেটা, বলেন দেওয়ালে হাত ঘষলে স্বামীর ছোঁয়া পান, ছেলের ছোঁয়া পান, এখন কী করবেন? 

ঠিক হয়নি এইটা। অনুপম বললেন। 

তাই বলে দেওয়ালে হাত ঘষার জন্য বাড়িটা আটকে রাখবে, আমার ঘর নেই নিজের, কত লোকের ঘর নেই, আর অতবড় বাড়িটা একা নিয়ে বসে থাকবেন? ভবতোষ বলল, প্রোমোটার লাখ আট টাকা দেবে আর দুটো ফ্ল্যাট। 

অনুপম বললেন, থাক ভবতোষবাবু, আর কিছু বলতে হবে না। 

একা মানুষের ওয়ান রুমই যথেষ্ট, ওঁর সঙ্গের কাজের মেয়েটি অবশ্য ভালো, ওকে চিনি আমি, মরিয়ম, কেউ নেই ওর। 

শোভন উৎসাহিত হয়ে বলল, যত বয়স হয়, মানুষ তত ঠেটা হয়, কী করতে বাড়ি আগলে ছিলেন উনি, ক’দিন আর বাঁচবে বুড়ি। 

আহ্, চুপ করবে, আমি বেশি কথা পছন্দ করি না। অনুপম বললেন। 

তখন ভবতোষ বলল, বুড়ির আচার-বিচার ভালো না, জামাইয়ের আপত্তি সত্ত্বেও মরিয়মকে ছাড়াননি উনি, আমি জানি সব, আমি বলেছিলাম আমি বরং লোক দেখে দিচ্ছি, মরিয়মকে ছাড়িয়ে দিন, আমি না হয় থাকব, কিন্তু উনি বড় ঠেটা, না করে দিল, ওঁর পুজোর ফুল আনবে মরিয়ম, শনি পুজো দিতে যাবে মরিয়ম, এ হয়? ভবতোষ বলল।

ঠিকানা এনেছেন? জিজ্ঞেস করলেন অনুপম।

আপনি যাবেন কাশীপুর? 

না, কিন্তু রেখে দেওয়া ভালো, প্রতিবেশী তো।

বাইশের বি চন্দ্র মল্লিক লেন, সোজা খুব, চন্দ্রমল্লিকা ফুলের ম্যাস্কুলিন জেন্ডার। বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতে লাগল শোভন, মামা, মল্লিক থেকে তো মল্লিকা? 

অনুপম বিরক্ত হয়ে জবাব দিলেন না। বললেন, ঠিকানাটা নোট করে রাখো, দরকার লাগতে পারে, মেয়ে জামাই মহারাষ্ট্রতে, তাদের মাকে বাড়ি থেকে তুলে অন্য জায়গায় নিয়ে চলে গেল, বাড়ি ভাঙবে, এটা ঠিক হয়নি মনে হয়। 

ভবতোষ বলল, ঠিকই হয়েছে, এ পাড়ায় আর একটা ফ্ল্যাট বাড়ি হবে, উন্নয়ন, আপনি কতকাল ভাড়াবাড়িতে থাকবেন, লালুদাকে বলে কমে করিয়ে দেব, বলেন তো লালুদাকে নিয়ে আসব এখেনে। 

অনুপম প্রসঙ্গ বদলে দিয়ে বললেন, আর কবছর বাঁচতেন উনি? 

দেখুন স্যার, কর্পোরেশন থেকে প্ল্যান পাশ হয়েছে, মেয়ে জামাই আর কত অপেক্ষা করবে, কাউন্সিলর সব জানেন, তাঁর ভাই করছে তো। 

আপনি কি ওই বাড়িতে থাকার কথা ভেবেছিলেন? জিজ্ঞেস করেন অনুপম। 

না, তা ঠিক নয়। বলল ভবতোষ, আমি যাই স্যার, দেরি করে গেলে ভাতে জল দিয়ে দেবে। বলতে বলতে ভবতোষ বেরিয়ে যায়। শোভন তার ঘরে যায়। অনুপমের মন খারাপ হয়ে যায়। অনেক সময় তিনি বসেই থাকেন। সেদিন বেলা পড়তে তাঁর মনে হয় চন্দ্র মল্লিক লেনে যাবেন। কিন্তু যাওয়া হয় না। অনুপম সেদিন বের হন না। মনে হচ্ছিল তিনি বেরলেই ভবতোষ আর শোভন মিলে জোর আড্ডা বসাবে, পাড়ার আর কেউ কেউ আসবে। এখন ভাত খেয়ে ঘুম মারছে শোভন। তাকে রেখে যাওয়া মানে চাবি তার কাছে রেখে যাওয়া। চাবির আরও দুই সেট আছে। কিন্তু তা বের করবেন না তিনি। চাবি হাতে পেলে শোভন তার অবস্থান পাকা করে ফেলবে। শোভন ঘুম থেকে উঠল যখন বেলা পড়ে গেছে। উঠে বিস্মিত হল, তুমি বেরোওনি মামা? 

তিনি বই মুখে ইজিচেয়ারে এলিয়ে ছিলেন। শোভন উত্তরের অপেক্ষা না করে বলল, পড়তে পড়তে বুঝতে পারোনি তো বেলা পড়ে গেছে। 

অনুপম বললেন, তুমি তো বেরবে? 

হ্যাঁ, সন্ধের শো দেখতে যাব লেকটাউন জয়া সিনেমায়, ‘কলঙ্কিনী রাই’, আমি আর ভবতোষদা। 

শোভন চলে যেতে তিনি নিশ্চিন্ত হলেন। তিনি ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলেন বাড়িটি টিনে ঘেরা হয়ে গেছে সামনের দিক, রাস্তার একটুখানি অধিকার করে নিয়েছে প্রোমোটার। বাড়িটি ভাঙার আয়োজন সম্পূর্ণ। এই যে আবাসনে আছেন তিনি, এও ছিল এক ধনী ব্যক্তির বাগান বাড়ি। অনেকখানি জমি, পুকুর, বাগান। শুনেছেন তিনি। সুতরাং সামনের বাড়ি যে ভাঙা হতে পারে এ নতুন কিছু নয়। কিন্তু তিনি কেমন বিব্রত বোধ করছিলেন। তাঁর একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল ব্যালকনিতে বসা। প্রায় অন্ধ নারী এবং তিনি পরস্পরের দিকে চেয়ে থাকতেন। শোভন আসার পর সব কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। শোভন এসেই যেন সামনের বাড়ি ভাঙার ব্যবস্থা করল। এতদিন আটকে ছিল। চিনি এতদিন তো কিছুই বলেনি। হাসিখুশি মেয়েটি তার গুরুদেবের মন্ত্র নিয়ে নিশ্চিন্ত ছিল। এখন তার নামে যে অপবাদ রটছে…চিনি ফোন করছে। তিনি ফোন বেজে যেতে দিলেন। তিনি বেরিয়ে পড়বেন ভাবলেন। সন্ধে হয়ে গেল প্রায়, তবু। চন্দ্র মল্লিক লেনেই যাওয়া স্থির করলেন। ফ্ল্যাটে তালা দিতে দিতে বুঝতে পারলেন, শোভনের জন্যই এত সময় বেরতে পারেননি। নীচে নেমে বড় রাস্তায় গিয়ে অটো ধরলেন। কাশীপুর জায়গাটি শ্রমিক অধ্যুষিত। রেল ইয়ার্ড, ধুলোবালি। বিহারি মজুরটোলি এখানে। এখানেই এক বস্তি পুড়িয়ে বছর কুড়ি আগে যে আবাসন তৈরি হয়েছিল তাই চন্দ্ৰ মল্লিক লেন। সন্ধ্যা হয়েছে। কিন্তু কলরব খুব। ফ্ল্যাট নং ২২/১৩, বড় আবাসনে খুঁজতে খুঁজতে ২২/১৩ পেয়ে গেলেন। সাত মানে চারতলায়। এই বহুতল বাড়িটি বস্তি-উচ্ছেদ গরিব মানুষ আর শ্রমিকদের জন্য তৈরি হয়েছিল। তাদের ফ্যামিলিতে দশ জন থাকলেও ওয়ান রুম। এক একটি তলায় যেখানে দুটি ফ্ল্যাট থাকার কথা একই বিল্ডিঙে চারটি। সরু সিঁড়ি, মিটমিটে আলো। যাদের দেওয়া হয়েছিল এইসব ফ্ল্যাট, তারা তা বিক্রি করে কোথায় হারিয়ে গেছে। দেশে চলে গেছে কিংবা আর ঝুপড়ির বাসিন্দা হয়েছে। চারতলা অবধি উঠতে তাঁকে থামতে হল কয়েকবার। সিঁড়িভাঙা তাঁর অভ্যেসে নেই। তাঁদের আবাসনে লিফটিকে জায়গায় দাঁড়িয়ে মহম্মদ রফির গান শুনলেন। জাপান…লাভ ইন টোকিও। লে গয়ে দিল, গুঁড়িয়া জাপান কি, পাগল মুঝে কর দিয়া…। তিনি গান শুনতে শুনতে উপরে উঠে এলেন। এখনও এখানে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগের গান বাজে। কোনও বৃদ্ধ হয়তো শুনছেন। তিনি চারতলায় এসে দাঁড়ালেন। নীচের গান উপরে উঠে আসছে। একটি ফ্ল্যাটের গায়ে চক দিয়ে লেখা, নীরজ মাহাতো। সবগুলির নাম রয়েছে। একটিতে নেই। তিনি আন্দাজ করে সেই ফ্ল্যাটে টোকা দিলেন। ডোর বেল নেই। কয়েকবার টোকার পর দরজা খুলেছে যে তাকে তিনি চেনেন। মরিয়ম। আধ ময়লা সাদা শালোয়ার কামিজ পরা। মরিয়ম তাঁকে দেখে অবাক, এ কী বাবু আপনি যে? 

তোমরা চলে এলে এখানে। বলতে বলতে অনুপম ঢুকলেন ভিতরে। মরিয়ম বলল, আগের দিন বলল, আমাদ্দের টায়েম দেয়নি, দুদিন আগে ভোর রাতে এসে দিয়ে গেছে, মা’র জামাই এয়েছিল, বলল, গঙ্গার ধারে ফেলাট, বারান্দায় বসে গঙ্গা দেখা যায়, দক্ষিণেশ্বর মন্দির দেখা যায়, মিথ্যেবাদী। 

অনুপম দেখলেন তিনি কালো চশমা চোখে বসে আছেন একটি চেয়ারে। সামনে পাঁচ ফুট দূরে দেওয়াল। অনুপম ঘুরে তাঁর সমুখে যান, বললেন, আমি উলটো দিকে থাকি, শুনে এলাম। 

তিনি বললেন, জানি, ব্যালকনিতে অনেক সময় বসে আমাকে দেখো। 

হ্যাঁ, আপনিও আমাকে দেখেন মনে হয়। 

তিনি বললেন, আমার মনে হতো কেউ আছে রাস্তার ওপারে। সে কে, তা জানতাম না। 

মরিয়ম বলল, অতবড় বাড়ি, অমন বারান্দা, এ জায়গা কি থাকার উপযুক্ত? 

জামাই চলে গেছে? অনুপম জিজ্ঞেস করেন। 

শাউড়ি মারে উচ্ছেদ করতি এয়েছিল প্লেনে চেপে, প্লেনে চেপে চলে গেছে শাউড়ি মারে পেন্নাম করে। মরিয়ম খরখর গলায় বলল। 

অনুপম বললেন, বাড়ি তো আপনার? 

আমার স্বামীর, এখেনে এ দেওয়ালে তাঁরে পাব না। বলতে বলতে বৃদ্ধা চুপ করে গেলেন। 

মরিয়ম বলল, ঠাকমা দেয়ালে হাত ঘষত, তেনার সোয়ামীর করা বাড়ি তো, দেয়ালে নাকি তাঁর গা ছুঁয়া যেত। 

অনুপম কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। বৃদ্ধা চুপ করে থাকলেন। মরিয়ম বলল, আল্লার এ কী বিচার, একটা বারান্দা ছিল, তাও কেড়ে নেছেন, এত অধর্ম কোনও ভগবান সহ্য করবে না। 

অনুপম বললেন, আমার সঙ্গে যাবেন, আমার ফ্ল্যাটে থাকবেন। 

বৃদ্ধা মাথা নাড়লেন, বললেন, মেয়ে জামাইয়ের মান থাকবে না, আর চোখের সামনে বাড়িটা ভাঙবে, সহ্য করতি পারব না, তুমি বারান্দা বন্ধ করে রেখে দিও। 

দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে তিনি বসে থাকলেন। বেরিয়ে আসবেন যখন অনুপমকে ডাকলেন বৃদ্ধা, বললেন, আমি ভালো আছি, ভালোই আছি, এখেনে বসে পুরনো গান শোনা যায়, ওখেনেও তোমার ঘর থেকে ভেসে আসত, এখেনেও তা আছে, মহেন্দ্র কাপুর, কিশোরকুমার, মহম্মদ রফি, এই যে এখন মহেন্দ্ৰ কাপুর বাজছে। 

অনুপম অবাক। মহেন্দ্র কাপুরের গান। কিন্তু ঘরে তো শোনা যাচ্ছে না। মরিয়ম যেন তাঁর কথা বুঝল। বছর চল্লিশের মরিয়ম বলল, ঠাকমাই শুধু শুনতে পায়, উনি তো সন্ধে থেকে শুনছেন। 

সত্যি গান শুনছেন? অনুপম জিজ্ঞেস করল গলা বাড়িয়ে। তিনি বললেন, হামরাজ, মহেন্দ্র কাপুর, এ নীলে গগন কি তলে…বড় ভালো, আমার এসব রেকর্ড ছিল, আমাদের দুজনের খুব গান শোনার শখ ছিল। 

কিন্তু ঘরে তো শোনা যাচ্ছে না। 

শুনতে পাচ্ছি। বলে বৃদ্ধা থামলেন। অনুপম বেরিয়ে এসে শুনতে পান। হ্যাঁ, মহেন্দ্র কাপুর। অনুপম মহেন্দ্র কাপুর শুনতে শুনতে নেমে আসেন। কী অদ্ভুত! মহেন্দ্র কাপুরের গান তার সঙ্গে চলতে থাকে। বাড়ি ফিরতে রাত সাড়ে নটা। দেখলেন আবাসনের সামনে শোভন দাঁড়িয়ে। শোভন বলল, তুমি তো বললে বেরবে না, কোথায় গিয়েছিলে মামা? 

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সিনেমা দেখেছ? 

না, ভবতোষদা শেষ অবধি যায়নি, বাড়িতে ক্যাঁচাল হয়েছে। অনুপম বললেন, আমার ফেরা তো এমনি হয়, তুমি কী করবে তুমি ঠিক করো। 

আমি বাইরেই থাকব, কিন্তু ডুপ্লিকেট চাবি নেই মামা? অনুপম লিফটে উঠতে উঠতে বললেন, আছে, তিনটে চাবি মোট। 

তাহলে তো চিন্তা নেই, আমাকে একটা দিও। 

নেই, একটা টুটুলের কাছে, আর একটা বুবুলের কাছে, আমার এই একটাই। 

অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে শোভন। বিশ্বাস করেনি। লিফ্ট থেকে নেমে বলল, টুটুলদা আমেরিকায় চাবি নিয়ে গেল, তা হয় নাকি মামা? 

ফ্ল্যাট খুলতে খুলতে অনুপম বললেন, ওর মায়ের মৃত্যুর পর এসেছিল তো, তখন চাবি নিয়ে বেরত, ফিরে যাবার সময় নিয়ে গেছে ভুল করে। 

শোভন আর কোনও কথা বলল না। কিন্তু অবিশ্বাস করেছে তা স্পষ্ট। অনুপমের মনে হল তাঁর অজ্ঞাতে শোভন চাবি হাতিয়ে নিতে পারে। তখন তো অন্য চাবি বের করতে হবে। তিনি ঠিক করলেন চাবি নিজের কাছেই রাখতে হবে। রাতে কোনও কথা হয়নি দুজনের ভিতর। শোভনের অস্বাভাবিক নীরবতা তাঁকে উদ্বিগ্ন করল। পরদিনও শোভন কিছু বলল না। টুটুলের কাছে জিজ্ঞেস করলেই টুটুল বলবে, তার বাবার কোথাও ভুল হচ্ছে। চাবি কি হারিয়ে গেল? ক’দিন বাদে শোভন সকালেই বের হতে হতে বলল, আজ বাইরে লাঞ্চ, আজ ফাইনাল হবে মামা। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *