বাতাসবাড়ি জ্যোৎস্নাবাড়ি – ১২

বারো

শোভন রয়েছে। কবে যাবে ঠিক নেই। তিনি জিজ্ঞেস করতে পারছেন না। শোভন বলছে, মামা এ পাড়ায় তোমার হেবি প্রেস্টিজ, সকলে অদ্ভুত চোখে দেখে, একা এতবড় একটা ফ্ল্যাটে থাকেন কী করে তা জিজ্ঞেস করে আমাকে। এত বড় একটা হাউজিং, সব ফ্ল্যাটে তালা। শুধু চারতলায় কারা থাকে শুনেছি, এক ফ্যামিলি, তাদের গলাও শোনা যায় না। 

হ্যাঁ, তাই। ছেলে আর বুড়ি মাকে বউয়ের কাছে রেখে অবিন পুরুলিয়া। পনেরো দিনে একবার আসে। ছেলে স্কুলে যায়। অবিন থাকে ওর দাদার ফ্ল্যাটে। দাদা থাকে ইতালি। কবে ফিরবে ঠিক নেই। অবিনের বউ কখনওই নীচে তাঁর ফ্ল্যাটে নামে না। অবিন বলে যায় তার ফ্যামিলিকে অনুপমের কাছে রেখে যাচ্ছে সে। কিন্তু তা কথার কথা। অবিনের মা বেশ শক্ত-সমর্থ আছেন। শোভন এসে একদিন উপরে গিয়ে আলাপ করে এসেছে। শোভন বলে, উপরের বউদি খুব ভালো, আমি বউদিকে নিচে আসতে বলেছি, একা একা থাকে, কী সুন্দর কফি খাওয়াল। 

অনুপম জিজ্ঞেস করেছেন, তোমার কাজ মিটবে কবে?

একটু সময় লাগবে, ওদের একটু চান্স দিচ্ছি, যদি কেস তুলে নেয়, না নিলে তো জ্যোতি আর নুরুলভাই একদিনে অবস্থান মঞ্চ ভেঙে কলকাতা থেকে সকলকে তাড়িয়ে দেবে। 

অনুপম বললেন, তাহলে তুমি এখন ফিরে যাও। 

আমি অন্য একটা সার্ভিস পেতে পারি মামা, বিনয়জেঠু বলেছে, এইটা তো আটকে আছে, আর এই চাকরি হলেও জেলায় হবে, বিনয়জেঠু বলেছে আমাকে কলকাতায় থাকতে হবে, আমার কলকাতা ছাড়া চলবে না। 

টুটুল বলেছে, সে ইউএসএ ছেড়ে আসবে না। মনে পড়ল অনুপমের। তিনি বলতে গেলেন, ‘কলকাতায় থাকবে কোথায়?’ কিন্তু বলতে পারলেন না। তাঁর মনের ভাব আন্দাজ করে শোভন বলল, আমি কটা টিউশনি করব ভাবছি মামা, তোমাকে কিছু দেব, একেবারে ফ্রিতে তো থাকা যায় না। 

অনুপম ভিতরে ভিতরে রাগে গরগর করছিলেন। কিন্তু কিছু বলতে পারছিলেন না। শোভন তখন বলল, মামা কাল অনেক রাত অবধি টুটুলদার সঙ্গে ফেসবুক চ্যাট হল, টুটুলদা খুব খুশি, বলল, চিন্তা গেছে, খুব চিন্তা করত তোমার জন্য, একা মানুষ, এত বয়স, কবে কী হয়ে যায়। 

অনুপম বললেন, ওকে নিজের কথা ভাবতে বলো, চলে আসুক দেশে। 

কী যে বলো তুমি মামা, আমেরিকা বলে কথা, টেক্সাস, হলিউড, প্যাসিফিক, আটলান্টিক, পৃথিবীর রাজা ওরা, সে দেশে গেলে কেউ আসে! 

কথা বাড়ান না অনুপম। খুব বকতে পারে ছেলেটা। কিস্যু জানে না। বলছে মেটিয়াবুরুজে থাকে কে এক নুরুল আর খিদিরপুরে থাকে জ্যোতি, তারা একসঙ্গে কাজ করে, ঝাড়খণ্ডের লোক দুজনেই, কী বাড়ি মামা, দেওয়ালেও মার্বেল পাথর, বলল, ওসব তুলে দিতে কয়েক ঘণ্টা, থানাকে আগে বলে রাখতে হবে, এমন ধোলাই দেবে আর সাতজন্মে এসব করতে সাহস পাবে না। 

অনুপম উঠে গেলেন। তাঁর মনে হচ্ছে এই ছেলেটাকে কাউকে দিয়ে এই শহর থেকে তাড়ানো দরকার। ভাবলেন বটে এমন, কিন্তু তা নিয়ে অগ্রসর হতে পারলেন না। আসলে কতদূরে থাকে! প্রান্ত কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে এই দেশে। জেলার একটি ব্লক যেমন সদরের দিকে তাকিয়ে থাকে, জেলা সদর স্বপ্ন দেখে রাজধানী কলকাতার, কলকাতা থেকে দিল্লি কি মুম্বই, তারপর বিদেশ। এক দেশ আর এক দেশ করতে করতে সুদূর পশ্চিম। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকাই যেন বেহেস্ত, স্বর্গ। তার কত নাম, ক্যালিফোর্নিয়া, ওয়াশিংটন, নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি…। এই ছেলে একদিন সেই দিকে পাড়ি দেবে এমন স্বপ্ন নিয়েই কলকাতায় প্রবেশ করেছে। যে ভাবেই হোক যাবে। যে ভাবেই হোক, ঢুকে পড়বে যেমন ঢুকেছে এই ফ্ল্যাটে। বেরিয়ে গেল শোভন। মনে হয় ভবতোষ ফোন করেছিল। যাচ্ছি বলে পায়জামার উপরে পাঞ্জাবি গলিয়ে বেরিয়ে গেল। একে অবলম্বন করেছে ভবতোষ, আবার ভবতোষকে এ। তিনি ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। তখন ফোন এল বুবুলের। বুবুল জিজ্ঞেস করল, বাবা, কী করছ? 

একই প্রশ্ন। তিনি বললেন, কিছু না।

বাবা তুমি কেন ফোন করো না? 

তিনি বললেন, তুই তো ফোন করিস, আমি সেই জন্য করি না।

তুমি করো না বলেই আমাকে করতে হয়। বুবুল রাগ করে বলল। 

অনুপম বললেন, যে কেউ ফোন করলে তো হয়, তুই করলে আমার ভালো লাগে। 

শোভনদা আছে? প্রসঙ্গ বদল করে জিজ্ঞেস করল বুবুল।

বেরিয়েছে। 

খুব ভালো হয়েছে বাবা, তুমি যে একা থাকতে, আমাদের খুব চিন্তা ছিল, এখন তা গেছে, শোভনদা কাল ফোন করেছিল। 

অনুপম জিজ্ঞেস করলেন, কেন? 

এমনি, খুব ভালো ছেলে, আমরা অনেক দিন ফেসবুকের বন্ধু, কিন্তু আমি জানতাম না শোভনদা আমাদের পিসির ছেলে। 

চুপ করে থাকলেন অনুপম। বুবুল আরও খবর দিল, পিসিও ফোন করেছিল, পিসি খুব ভালো বাবা, মা চলে গেছে জানতই না পিসি, বলল, তাঁকে কোনও খবরই দেওয়া হয়নি। 

অনুপম বললেন, এত কথা হয়েছে? 

বুবুল বলল, তোমাদের বসিরহাটের বাড়িতে নাকি এক বছরের উপর ছিল। 

অনুপম এবার কঠিন হলেন, আমাদের নিজেদের কেউ তো নয়। 

নিজেদের চেয়ে দূরের আত্মীয়ই ভালো, আমার খুড়শ্বশুর তো মামলা করেছে জমি নিয়ে, অথচ আমার শ্বশুরমশায় ভাইদের জন্য কত কিছু করেছেন, তাদের পড়িয়েছেন উনি। 

একই কথা। একই রকম। সব পরিবারে এমন কথা আছে। তিনি বিরক্ত হলেন। এখন একটু নিজের ভিতরে ডুব দিতে ইচ্ছে করছে। বুবুল একদিন বলেছিল, তার দাদার অভিযোগ, মায়ের চিকিৎসা খুব ভালো করে হয়নি, টাকার দরকার হলে বাবা চাইতে পারত, অতি সাধারণ নার্সিংহোমে দেওয়ার জন্যই তাদের মা চলে গেছে। কলকাতার সেরা হাসপাতালে কেন দেওয়া হয়নি তাদের মাকে? শুনে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন মেয়েকে, তার মত কী? বুবুল বলেছিল বড় নার্সিংহোম কিংবা হাসপাতালে হয়তো মা সেরে যেত। তার মানে তারও সেই বিশ্বাস। বাবা চিকিৎসা করেনি ঠিক মতো। তারা কেউ হাজির ছিল না। বুবুল দিল্লি থেকে এসেছিল। কিন্তু সে তো দেখতে আসা। জামাই আসতে পারেনি। টুটুল আসতে পারেনি। অত দূর থেকে আচমকা চলে আসা তো যায় না। টাকা পাঠিয়েছিল। কিন্তু টাকা তো তাঁর নিজেরও ছিল। অবসরের পর পাওয়া টাকা ব্যাঙ্কে ঘুমিয়ে আছে। তিনি জানতেন কালান্তক সেই অসুখে কেউ ফেরে না। ধন্বন্তরি হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের চেম্বারে ছ-ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রোগ যন্ত্রণা কমাবার ওষুধ নিয়ে এসেছিলেন তিনি। বড় ডাক্তারদের বিশেষভাবে ডেকে এনে দেখিয়েছিলেন। 

তিনি বললেন, তোদের এত চিন্তা কেন আমাকে নিয়ে?

কী বলছ বাবা, তুমি সত্যিই বদলে যাচ্ছ। বুবুল বলল।

এই শোভনকে কি টুটুল পাঠিয়েছে?

বুবুল বলল, কেন, কী হয়েছে?

ছেলেটা এখানে থাকবে? 

থাকলে কী হয়েছে, কলকাতায় তো কোনও শেল্টার নেই শোভনদাদের। 

কলকাতায় আমাদের শেল্টার কবে হল, এই সেদিন, ও আমার সঙ্গে থাকবে কেন, বাড়ি ভাড়া করে থাকুক। 

কী যে বলো বাবা, পিসি একবছর ছিল আমাদের বাড়ি, আর তার ছেলে এসে থাকতে পারবে না? অবাক কণ্ঠে বুবুল বলল, ওপারে তোমাদের বাড়িতে কত লোক এসে থাকত বলেছ, কত পাত পড়ত! 

তিনি বললেন, ছেলেটা ভালো না। 

কী করেছে সে, চাকরির জন্য এসেছে, ভালো না বলছ কেন, আমরা তাকে সাহায্য করব না? 

অনুপম বললেন, ও ফিরেছে, থাক এখন। বলতে বলতে ফোন কেটে দিলেন তিনি। শোভন ফেরেনি। চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তার মানে পাড়ায় একটা জায়গা করছে সে। সঙ্গে ভবতোষ। অনুপম চেয়ারে বসে থাকলেন। তিনি আজ আর বাইরে নেই। ভিতর থেকে ব্যালকনিতে আসেননি বৃদ্ধা। কোথাও গেলেন? ব্যালকনির দরজা বন্ধ। অনুপম উদ্বিগ্ন হলেন। জানালাও বন্ধ। তাহলে? অসুস্থ হলেন নাকি? অসুস্থ হতেই পারে। তিনি বসে থাকলেন ব্যালকনিতে। একটু বাদে শোভন ফিরল। সঙ্গে ভবতোষ। ভবতোষ টুটুলের ঘর মানে যা এখন শোভনের ঘর হয়েছে, সেখানে ঢুকে গেল। এর মানে শোভন চাবি নিয়ে গিয়েছিল সঙ্গে। শোভন বুদ্ধিমান। যেন সে তাঁর মনের ভাবটি আন্দাজ করতে পেরেছে। কিন্তু এই চাবি নিয়ে বেরনো শোভনের অনধিকার। চাবি তিনি নিজের কাছে রেখে দেবেন। শোভন ব্যালকনিতে এল, বলল, আমি অঙ্ক করাতে পারি ক্লাস টেন অবধি, মাধ্যমিকে লেটার ছিল, তারপর কমার্স নিলাম, কিন্তু আমার টিউশনি পেতে অসুবিধে হবে না মামা, ভবতোষদা দেখছে কলকাতায় রেটও ভালো, আমাদের ওখানে দামই নেই টিউশনির 

আমি তো বেরিয়ে পড়ি মাঝেমধ্যে, তখন তোমাকে তো বাড়ি ফিরতে হবে। অনুপম বললেন। 

কেন মামা, আমাকে চাবি দিয়ে যেও, আমি ফ্ল্যাট দেখব। তিনি চুপ করে থাকলেন কিছু সময়, তারপর বললেন, তুমি তো এগজামের জন্য আসবে বলেছিলে। 

পরিস্থিতি বদলে গেছে, টুটুলদাও চায় আমি তোমার সঙ্গে থাকি, নাহলে টুটুলদা তোমাকে ইউ এস এ নিয়ে যাবে। 

অনুপম ক্রুদ্ধ হয়েছেন। মনে হচ্ছে ছেলেটি তাঁকে শাসাচ্ছে। কী একটা বলতে গিয়ে নিজেকে সংবরণ করলেন অনুপম। তারপর নরম গলায় বললেন, এই ফ্ল্যাটে টিউশনি করা তো হবে না। 

না মামা, ব্যাচে পড়াব একজনের বাড়িতে, এখানে পড়ালে অবশ্য ভালো হতো, কত জায়গা। 

ঠিক হয়ে গেছে? জিজ্ঞেস করলেন অনুপম।

ভবতোষদা বলল তাই, এখানে সুবিধে হতো অনেক, কিন্তু তোমার অসুবিধে হবে মনে হয়, তাই বাইরেই পড়াব। 

অনুপম হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, সামনের বাড়ির দোতলায় একজন থাকেন জানো? 

ওল্ড লেডি, উনি কি ব্লাইন্ড? 

কেন, তোমাকে কেউ বলেছে কিছু? 

ভবতোষদা বলছিলেন, ব্লাইন্ড লেডি ব্যালকনিতে বসে বোঝাতে চান উনি ব্লাইন্ড নন। 

এভাবে কথা বলে না, যাও তো খোঁজ নিয়ে এসো, ক’দিন উনি ব্যালকনিতে আসেননি। 

কী খোঁজ নেব? শোভন অবাক। 

উনি কেন ব্যালকনিতে নেই, অসুস্থ হলেন?

ভবতোষদাকে নিয়ে যাই? শোভন বলল। 

ভবতোষকে নিয়ে গেল শোভন। তিনি ব্যালকনিতে বসে দেখলেন ওরা নিচে নেমে বাড়িটির গায়ের গলিপথে ঢুকে গেল। সামনে একতলায় যে বারান্দা তার গ্রিলগেটে তালা। এই বারান্দা বহুদিন বন্ধ। একতলায় আগে ভাড়াটে ছিল। তারা চলে গেছে আট-ন’মাস আগে। তারপর থেকেই বন্ধ। ওরা ভিতরে গিয়ে বেশ কিছু সময় বাদে ফিরল। ফিরে এই ফ্লাটে এল না। মনে হয় চা খেতে গেল। ওদের ফিরতে একঘণ্টার উপর লেগে গেল। ভবতোষকে নিয়েই ফিরল শোভন, বলল, মামা সব জেনে এলাম, ভবতোষদা সবাইকে চেনে তো। 

ভবতোষকে ডাকল শোভন। ভবতোষ একটু কুঁজো হয়েই এল। বলল, স্যার, ওই বাড়ি প্রোমোট হবে জানেন না, আপনি ফ্ল্যাট নেবেন, এটা তো ভাড়াবাড়ি। 

কিন্তু উনি কোথায় গেলেন? 

ভবতোষ বলল, কাউন্সিলরের ভাই প্রমোট করছে, লালুদা। 

বিরক্ত হলেন অনুপম, বললেন, কিন্তু ওঁর কি 

শরীর ভালো নেই? 

চলে গেছেন, বাড়ি ভিতরে ভিতরে ভাঙা হবে, আগে দোতলা, বাইরে থেকে বোঝা যাবে না প্রথমে, ‘লেবার’ এসে গেছে। 

তার মানে? বাড়িটা ভেঙে দেবে? 

ইয়েস স্যার, সেই জন্য ওঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে দুদিন আগে। 

অনুপম জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওঁকে? 

কাশীপুরের দিকে। ভবতোষ বলল, মেয়ে জামাইয়ের ব্যবস্থা, কতদিন তারা ওয়েট করবে? 

শুনেছি ওঁর আপত্তি ছিল? 

আপত্তি করে লাভ আছে, ওই অতবড় বাড়ি নিয়ে উনি করবেন কী? 

ফ্ল্যাটটা ভালো? জিজ্ঞেস করলেন অনুপম। 

ছোট, ওয়ান রুম, দেখে এলাম। 

দেখে এলেন মানে? 

কাশীপুর গেলাম অটো ধরে, খুপরির মতো ওয়ানরুম, আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে সব সময়। 

ব্যালকনি আছে, গঙ্গা তো ওদিকে? 

গঙ্গার দিকের জানালা পাশের বাড়িতে আটকে গেছে, নো ব্যালকনি স্যার। কোনও ব্যালকনি নেই এই ফ্ল্যাটে। ভবতোষ বলল স্তিমিত গলায়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *