বাতাসবাড়ি জ্যোৎস্নাবাড়ি – ১৫

পনেরো

আমি অন্য জায়গায় চলে যাব কাকু। চিনি বলল। 

চলে যাবে, কেন থাকা যাচ্ছে না? অনুপম জিজ্ঞেস করলেন। এমন রটিয়েছে যে কেউ আমার সঙ্গে প্রায় কথা বলে না, আমি কী করে থাকব কাকু? 

কিন্তু কথা বলে না কেন? 

আমি নাকি উইচ, তন্ত্র সাধনা করি, আমি পুরুষ লোককে প্রলোভিত করি, মা বাবাকে আমিই মেরেছি জাদু করে, জনে জনে সব রটিয়ে আমাকে এক ঘরে করে দিয়েছে, আমি কী করেছি বলুন, আবাসনের দোকান জিনিস দেয় না, আমি কী করব কাকু? চিনি বলল, আমি আমার মাসির বাড়ি চলে যাচ্ছি, ওদিকে একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনব, কলকাতা শহরে এমন হতে পারে? 

অনুপম মনে মনে বললেন, তুমি তো বিশ্বাস করো তোমার ঠাকুরের প্রয়াণ হয়নি, অথচ তাঁকে দাহ করা হয়েছিল রীতিমতো, তার ছবি বেরিয়েছিল সংবাদপত্রে, তুমি বিশ্বাস করো না যে তাঁর মৃত্যু হতে পারে। 

না, তাঁর। মৃত্যু হতে পারে না। চিনি বলল, তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী।

তাহলে এই সব কথা তৈরি হতে পারে, মৃত্যুকে গৌতম বুদ্ধও জয় করতে পারেননি, কুশীনগরে শালবনে তাঁর প্রয়াণ হয়েছিল, জানো তা? 

আমার গুরুর মৃত্যু হয়নি, সব রটনা। 

দেখো একটা কথা থেকে যেমন আর একটা কথা জন্মায়, এক বিশ্বাস থেকে আর এক বিশ্বাস, এক অন্ধতা থেকে আর এক অন্ধতা, এক অন্ধই আর এক অন্ধকারে ডুবে যায়, তুমি বুঝতে পারছ তুমিই তো অলৌকিকতায় বিশ্বাস করো। 

এইটা মেনে নিতে হবে তাই? 

কোনওটাই মানতে হবে না। অনুপম বললেন। 

কিন্তু কাকু আমার ঠাকুর ভগবান, অবতার, তিনিই কৃষ্ণ…

চিনি অনেক সময় ফোন ছেড়ে দিয়েছে। ভয়ানক বিশ্বাস তার। বছরে একবার ঠাকুরের জন্মোৎসব করে। অনেককে নিমন্ত্রণ করে। যারা ভূরিভোজ খেয়ে আসে তারাই নানা খুঁত ধরে। তারা কেউ ওর সঙ্গে থানায় যায়নি যে তা নয়, কিন্তু থানার অফিসারের সঙ্গে এক মত যে একটি মেয়ের একা থাকা উচিত নয়। বিয়ে না করলেও তার একজন পুরুষ গার্জেন থাকা উচিত। তার জন্য আত্মীয়-স্বজনের নিকটে যাওয়া উচিত। একা থাকলে নানা কথা জন্মাতে পারে। তা সত্য কি অসত্য সে বিচার করবে কে? গ্রামে তো এমন হয়। পরে দেখা গেছে ঘটনা সত্যি। মেয়েদের ভিতরে এক একজনের ডাকিনীর ক্ষমতা থাকতে পারে। অনুপম থানায় যাননি। সমস্তটাই জট পাকানো। থানা অফিসার বলেছে, মানুষ কী ভাববে, কী বলবে, তা নিয়ে থানার কোনও মাথাব্যথা নেই। থানা দেখবে আইনশৃঙ্খলা ঠিক আছে কি না। কারও কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না। 

শোভন নেই। তিনি নিশ্চিন্ত। দিন সাত কোনও সাড়া নেই শোভনের। রাস্তায় এক বিকেলে ভবতোষের সঙ্গে দেখা। সে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, আপনার ভাগ্নের খবর পেয়েছেন স্যার? 

না তো, আর ও আমার ভাগ্নে নয়। 

ভবতোষ বলল, ফোন করেছিল স্যার, ফিরে আসবে, ওর নাম নেই পুলিসের তদন্তে। 

নতুন খবরের পিছনে চলে গেছে ধর্না ভাঙার খবর। খবর বাসী হয়ে হারিয়ে যায়, তাই গেছে। এর ভিতরে দুটি ধর্ষণ, হাসপাতালের অবহেলায় শিশুমৃত্যু, বাস দুর্ঘটনায় নব দম্পতির মৃত্যু কত হৃদয়বিদারক ঘটনা যে ঘটে গেছে। মানুষের স্মৃতি দুর্বল। নতুন কথা এসে পুরনো কথাকে ঢেকে দেয়। ভবতোষের কথা শুনে চিন্তিত হলেন অনুপম। আবার ফিরে আসবে? এর ভিতরে অবন এসেছিল। অবন নিশ্চয় শুনেছে তন্দ্রিমার কাছে কিছুটা। আবার যদি ফিরে আসে শোভন, তা খারাপ হবে। শোভন সেই বর্ধমান থেকে তন্দ্রিমাকে মেসেজ করছে কি না জানেন না অনুপম। খুব সাহস ওর। মায়ের মতো বেপরোয়া। অনুপম উদ্বিগ্ন হলেন। তিনি চাইছেন না সে এখানে ফিরুক। ভবতোষকে বললেন, ওকে জায়গা দেখে নিতে বলবেন। 

কী যে বলেন স্যার, ওর কত জায়গায় জানাশোনা, ও অনেক বড় হবে, এবার ও টিকিট পাবে ওর টাউনে কাউন্সিলর ইলেকশনে, পলিটিক্স করছে, দেখবেন ও একদিন মন্ত্রী হবে। 

তিনি ফ্ল্যাটে ফিরলেন সন্ধ্যার পরে। বিব্রত বোধ করছিলেন। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তখন ফোন এল তন্দ্রিমার। নিজের ফ্ল্যাট থেকেই ফোন করছে। আঙ্কেল ফ্ল্যাটে আছেন? 

আছি তো, কী হয়েছে? তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

ওই ছেলেটা আবার মেসেজ করেছে আমাকে, ও কি আসছে? 

অনুপম বিব্রত হলেন। বললেন, আমি দেখছি কী করা যায়, অবন জানে? 

পুরোটা বলতে পারিনি আঙ্কেল, ভয় করছে, ও এমন ভাবে বলছে যেন আমিই ওকে প্রলুব্ধ করেছি, খুব মিথ্যেবাদী, নোংরা মনের ছেলে। 

তুমি ভয় পেয়ো না, আমি দেখছি। 

বলছে কোন মন্ত্রী ওর চেনা, তাঁর বাড়িতেই আছে, কলকাতায় আসছে আবার। 

অনুপম বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন। সেদিন অনেক রাত অবধি ঘুম আসছিল না। সুমির ছেলে আবার এসে উঠবে এখানে। মেসেজ পাঠাবে তন্দ্রিমাকে। এই বিল্ডিংয়ে দুটি ফ্ল্যাটে মানুষ আছে। শোভনের ভিতর আগ্রাসী মনোভাব আছে। ভয়ডর কম। ভদ্রতা শালীনতা বোধ কম। পড়াশোনা কম। কিন্তু তা স্বীকার করে না। যে কোনও ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। তার জন্যই ওর রাজনীতি। রাজনৈতিক আদর্শবোধ কী তা ও জানে না। ও আবার আসছে। অনেক রাতে ঘুমের ভিতরে আবার ফিরে এল সুমি। সেই আমবাগান আর জ্যোৎস্না রাত। আকাশে চৈত্র পূর্ণিমার চাঁদ। বাবা সংসার সাজিয়ে নিচ্ছেন এপারে। খুব খাটতে পারতেন। মাস্টারি করতেন। কিন্তু তার মাইনে সামান্য। তবু মুখে সব সময় হাসি। ছাত্র পড়াতেন সাইকেলে ঘুরে ঘুরে। আহা, তার ভিতরই জ্যোৎস্না রাতে ছেলে মেয়েদের নামিয়ে দিতেন উঠোনে। যা খেল। এমন চাঁদের আলো! সুমির চুলে খোঁপা। সুমি তার হাত ধরেছে, বাবলুদা আমার ভয় করছে…। 

ভয় করছে তো এলি কেন এখানে?

কথাগুলো বলতে।

কী কথা? 

আমার ছেলে বাবলুদা, ওকে তোমার কাছে দিয়েছি, তুমি ওকে আগলে রেখো। বলতে বলতে সুমি তাঁকে আঁকড়ে ধরে। বাবলুদা প্লিজ! ওর বাবা পারেনি, দুঃখে চলে গেছে, আমি জানতাম তুমি পারবে, নিরীহ বাবাকে ও রেয়াত করত না, বলত তার বাবা কোনও পুরুষমানুষ না, মিন মিন করে। বাবলুদা আমার কথা রাখো, প্লিজ, ওকে ভালো করে দাও। 

কেমন করে মানুষ করেছিস ওকে? 

বাবলুদা তুমি ওকে দেখো প্লিজ, ওর বাবা পারেনি, তুমি পারবে। 

স্বপ্নটা অনেক সময় ধরে তাঁকে ঘিরে রয়েছে। সমস্ত রাত ধরে সেই বাগানে, ছায়ার ভিতরে, পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় অন্ধকারে ঘুরছে যেন অনুপম আর সুমিত্রা। ফিসফিস করছে সুমি, বাবলুদা বাবলুদা ছেলের জন্য আমার খুব ভয় করছে, তুমি আমাকে ধরে থাকো। 

অনুপমকে দুহাতে যেন পিষ্ট করে ফেলছে সুমিত্রা। ছাড় ছাড়, ছেড়ে দে সুমি। অনুপম আর্তনাদ করে উঠলেন। তিনি যেন চাপা পড়ে যাচ্ছেন আচমকা ভেঙে পড়া গাছের নীচে। ভেঙে পড়া উড়াল পুলের নীচে। পুরনো দালানের নীচে। পাঁজর গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। সুমি তাঁকে ছাড়ছে না তবুও। দম আটকে আসছে তাঁর। বিড়বিড় করছে সুমি, আমার পায়ে ব্যথা, হাঁটতে গেলে দম আটকে যায়, ভয় করছে খুব বাবলুদা, ছেলে শোনে না, এই শহরে ঢুকতে পারছে না…। 

সুমির অজগর-বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে গিয়ে বারবার আটকা পড়ে যাচ্ছেন তিনি। হাঁ মুখে গিলে খাবে যেন সুমি। অজগর ভয়ের ভিতরে ঘুম ভেঙে গেল অনুপমের। ঘুম ভাঙার পর বহুক্ষণ অনুপম চুপচাপ শুয়ে ছিলেন। মনে হচ্ছিল গ্রামের বাড়ি যান। সেই আম আর পেয়ারার বাগান, অবারিত মাঠ, যেতে হবে এখন। সেই বসিরহাট ছাড়িয়ে দাঁড়ের মাঠ। ইছামতী পার হয়ে। কাটিয়াহাট। তার কাছে দাঁড়ের মাঠ। ওখান থেকে ঘোজাডাঙা বর্ডার খুব কাছে। সুমির ছেলে আসবে আজ অথবা কাল। সুমি আবার মাঝেমধ্যে ফোন করবে। এরপর হয়তো চলেই আসবে কলকাতায়। খুব সাহসী নারী। ছেলে তেমনি হয়েছে। স্বামীকে সুমি খুব ভুগিয়েছে নিশ্চয়। ছেলে তা দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। তিনি সকালটা ভয়ে ভয়ে থেকে দুপুরে রওনা হলেন দাঁড়ের মাঠের দিকে। দরজায় তালা। শোভন এসে ঢুকতে পারবে না। 

অনুপম দমদম জংশন স্টেশনে গেলেন রিকশয়। জংশন থেকে হাসনাবাদ লোকাল। অনেকদিন এই পথে যাননি। টুটুল বিদেশ যাওয়ার আগে তাকে নিয়ে গাড়ি করে গ্রামে গিয়েছিলেন অনুপম। কুন্তলাও ছিল। ভোরে বেরিয়েছিলেন। সময়টা ছিল ফেব্রুয়ারির শেষ কিংবা মার্চের প্রথম। সমস্ত রাস্তা ছিল আমের বৌলের গন্ধে ভুরভুরে। আহা, মনে পড়ে গেল তাঁর। সে যেন ছিল জীবনের সুখের সুবাস। সেই স্মৃতি সুরভিত পথ। ছেলে বিদেশ যাবে, মেয়ে জামাই এসেছিল দিল্লি থেকে। মনে আছে টাটা বোলেরো ভাড়া নিয়েছিলেন একটি। তখন টুটুলের বিয়ে হয়নি। মা খুব খুশি হয়েছিলেন। সারাদিন থেকে সন্ধেয় ফেরা। মা কিছুতেই আসবে না কলকাতায়। কুন্তলার মৃত্যুতে মা খুব কষ্ট পেয়েছে। কুন্তলা তার শাশুড়ি মায়ের ভালোবাসা পেয়েছিল যদিও শাশুড়ি গ্রাম ছেড়ে তার কাছে এসে দীর্ঘদিন থাকেননি কখনও। দুপুরের ট্রেনে ভিড় তেমন নেই। জানালার ধারে বসেছিলেন তিনি। বারাসাত ছাড়ার পর অবারিত মাঠ, মাছের ভেড়ি, নারকেল, আম, জাম, অশ্বত্থ, বট। ট্রেন ভর্তি হকার। কাঁচাগোল্লা সন্দেশ থেকে ফল, বিস্কুট, রুমাল, গামছা, শাড়ি, সব হেঁকে বেড়াচ্ছে হকার। ঝলমল করছে মানুষের মুখ। তিনি ভাবছিলেন ক’দিন থাকবেন। তাড়াতাড়ি ফিরবেন কি ফিরবেন না? সুমির ছেলে আসবে বলেই কি ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে বেরন? কিন্তু সে তো আজ বা কাল আসছে না। কিন্তু তাঁর মনে হচ্ছিল সে এসে যাবে দু- একদিনের ভিতর। 

তাঁর ছোটভাই বিশ্বনাথ প্রাইমারি টিচার ছিল, আর একটা কাপড়ের দোকান করেছিল হাটে। খুব বিষয়ী ছিল সে। বাড়ি পাকা করেছে। বাস্তু ভিটে আর জমিতে নিজের অংশ আছে অনুপমের, কিন্তু তা ছোটভাইয়ের অধিকারেই ছিল। এখন তার বউয়ের। বসিরহাটের মেজভাই তার অংশ বিক্রি করে দিয়েছে। ওপার থেকে আসা একটি পরিবার কিনেছে। বাস্তু ভিটে অবশ্য বেচতে পারেনি। অংশ রেখে দিয়েছে। বাইরের মানুষ তো তাদের ভিটেবাড়িতে এসে বাস করতে পারে না। ছোটভাই কিনবে কিনবে করে কঠিন অসুখে পড়ে গেল। মারা গেছে বছর দেড়। শীতকাল ছিল। দাহ শেষে শীতের রাতে বিশ্বনাথের দুই ছেলে ইছামতী থেকে স্নান করে উঠল। কাঁপছিল হুহু করে। মনে পড়ল তাঁর। বিশ্বনাথের বাৎসরিক কাজ গেল। তিনি আসেননি। কিছু টাকা তপতীর অ্যাকাউন্টে দিয়েছিলেন। মায়ের জন্য একটা টাকা তাঁকে প্রতি মাসে ফেলতে হয়। বিশ্বনাথের কথা মনে পড়ল। ছোটভাই তো। তার বউ তপতী বলেছিল, ভিটেতে মেজদার অংশ কিনে নিতে চেষ্টা করবে। এর ভিতরে কি কিনতে পেরেছে? কিনলে তিনি জানতেন। অনুপম বসিরহাট স্টেশনে নামলেন তখন সাড়ে তিনটের মতো। কাজের শহর গমগম করছে বটে কিন্তু সে তো কোর্ট আর সরকারি অফিস চত্বরে। বসিরহাটের কোথায় মেজভাই নিরুপম থাকে তিনি ঠিক জানেন না। গৃহপ্রবেশে যেতে বলেছিল, তিনি তখন হলদিয়া টাউনশিপে। জমি অধিগ্রহণ নিয়ে ওদিকে গোলমাল আরম্ভ হয়েছে সবে। ছুটি পাননি। স্টেশন সংলগ্ন মিষ্টির দোকান থেকে কাঁচাগোল্লা সন্দেশ এক কেজি কিনে অনুপম টোটো ভাড়া করলেন। বর্ডার যাচ্ছে কয়েকটি পরিবার। ঘোজাডাঙা পার হয়ে বাংলাদেশ যাবে। সাতক্ষীরে। তাঁদের পূর্ব পুরুষের দেশ। তাদের ভিতরে একটি হিন্দু পরিবার। স্ত্রীলোকের হাতে শাঁখা সিঁথিতে সিঁদুর দেখে বোঝা গেল। গা শিরশির করে উঠল। টোটো চলছে। টোটো এক অদ্ভুত গাড়ি, টোটো কোম্পানির মতো শহরময় ঘুরেই বেড়ায়। শহর থেকে দূরে যেতে হবে তাঁকে। সেই ইছামতীর সেতু পার হয়ে ক্রমশ সীমান্তের দিকে। সত্তরের দিকে অগ্রসরমান অনুপম এক অদ্ভুত শিহরন অনুভব করছেন। টুটুল বছর নয় গেছে ইউএস। তাকে নিয়ে আসার পর ছোটভাই বিশ্বনাথ মারা গেলে এসেছিলেন। ছোটভাইয়ের কাজে আসা তো ভয়ানক অভিজ্ঞতা। কদিন থাকতে হয়েছিল মায়ের জন্য। আচ্ছা, তার নাম কেন বিশ্বনাথ দিয়েছিলেন বাবা, তা জানেন না অনুপম। অনুপম, নিরুপম, মিলিয়ে নাম খুঁজে পাননি বাবা। আসলে বড়, মেজ, দুজনের নাম রেখেছিলেন বাবার মাস্টারমশায় রাখালবাবু। বিশুর জন্মের সময় রাখাল মাস্টারমশাই বেঁচে নেই। ওপার থেকে এসে বসিরহাটের পাশে শাঁকচুড়োয় আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। ছাত্র পড়িয়ে দিন গুজরান করতেন। মাঝে মাঝে দাঁড়ের মাঠে আসতেন পুরনো ঝরঝরে একটি সাইকেল চালিয়ে। সাইকেলটি এপারে আনতে পেরেছিলেন। এসে ছাত্রের সঙ্গে সন্ধেবেলায় গল্প করতেন ওপারের। স্বাধীনতা আর দেশভাগের জন্য আপশোস করতেন। বলতেন এমন অবস্থা থাকতে পারে না। দেশ কি জমি- জিরেত যে ভাগ হয়ে যাবে? গান্ধী নেহরুর মুণ্ডপাত করতেন, নেতাজি সুভাষের জন্য হা-হুঁতাশ করতেন। সুভাষ ফিরে এলেই দেশ আবার জোড়া লেগে যাবে এই প্রত্যয় ছিল তাঁর। ছেলেবেলায় একদম ভালো লাগত না মানুষটিকে। একজন মাঝে মাঝে আসেন, খালি হাতে। একটা কদমা, কিংবা বিস্কুটও হাতে করে আনেননি কোনওদিন। পরে শুনেছিল মায়ের কাছে, উনি খুব দুঃখী মানুষ। মেয়ে বিয়ে করেছে ওদেশেরই এক মুসলমান যুবককে। ছেলে তিন জন। তারা এপারে এসে ছড়িয়ে গেছে নানা দিকে। বাপ-মাকে কেউ দেখে না। শেষের দিকে আপশোস করতেন ওপারে থেকে গেলেই হতো। জামাই মানে তাঁর ছাত্র মনিরুল থাকতে বলেছিল। তিনি লজ্জায় আর সংস্কারে আর থাকেননি। পরে মনে হয়েছিল, দেশই যদি ভাগ হতে পারে, তবে মেয়ে শেফালি মুসলমান হলে কী আর হয়েছিল। অবস্থাপন্ন ঘর তাদের। যুগীপোতায় বিঘের পর বিঘে জমি। রাখাল মাস্টারমশাই বাংলাদেশ দেখে যাননি। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, তারপর খাদ্য আন্দোলন, সেই অভাবের দিনেই নাকি আসা বন্ধ করেছিলেন। বাবা একবার শাঁকচুড়ো যাবেন ভেবেছিলেন, খুব দূরে তো নয়, কিন্তু সময় করে উঠতে পারেননি। এখন মনে হয় বাবা যাননি, ভেবেছিলেন মাস্টারমশায়ের অভাবের সংসার মানে গুরু মা এবং গুরুকে নিয়ে আসতে হবে দাঁড়ের মাঠে। সেই ভয়েই বাবা যাননি। মাস্টারমশায় বেঁচে আছেন না মরে গেছেন, তা জানতেন না বাবা। দায়িত্বের ভয়ে জানার চেষ্টা করেননি। প্রবীণ মানুষটিকে বাড়ির কেউই খুব পছন্দ করত না। কেউ না। সুমিও না। টোটো দাঁড়িয়ে পড়েছিল। টোটোর সামনে মালবাহী এক অতিকায় ট্রাক। তার সমুখে এসে পড়েছে একটি প্রাইভেট কার। তাঁর টোটোর ডান দিক দিয়ে সাইকেল, মোটর সাইকেলের সারি। তারা ওদিক থেকে এদিকে আসছে। বসিরহাট যাবে। চমকে ওঠে অনুপম। রাখালবাবু না! অপরাহ্ণ বেলায় ঝরঝরে র‍্যালে সাইকেল ঠেলে বাড়ি ফিরছেন দাঁড়ের মাঠ থেকে। সেই সময় খেয়া পার হয়ে আসতেন সাইকেল নিয়ে। এই সেতু হয়েছে পরে। তিনি ডাকলেন, স্যার, মাস্টার দাদু। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *