প্ৰথম দিন – সন্ধ্যা

সন্ধ্যা ৬ টা 

মনে তীব্র উৎকণ্ঠা থাকা সত্ত্বেও স্টিয়ারিং হুইলে অসাবধানতাঃবশত আঙুল চালাচ্ছে না ক্যামিল। হাত পা স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট হওয়ার কারণে তার গাড়ি বিশেষভাবে তৈরি করা। পুরো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা স্টিয়ারিং হুইলের মাঝ বরাবর। আর এই ধরনের গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে হাত দেয়ার সময় আপনাকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে; ছোট একটা ভুলের জন্য অনেক বড় মাশুল গুণতে হতে পারে। এদিকে আঁকাআঁকির দক্ষতার কথা বাদ দিলে, নিজ হাতের উপযুক্ত ব্যবহার বেশিরভাগ সময়ই করতে পারে না ক্যামিল। 

হাসপাতালের বাইরে গাড়ি রেখে হাঁটা শুরু করলো ক্যামিল। ডাক্তারকে কী বলবে তা মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে-সেই গাম্ভীর্যপূর্ণ কথামালা, যা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দিয়ে আপনি ঠিকমতো সাজিয়ে নেন, কিন্তু যখন বলার দরকার ঠিক তখনি মাথা খালি হয়ে যায়। সকালে যখন এসেছিল ক্যামিল রিসেপশনে তখন তিল পরিমাণ জায়গা ছিল না। তাই দেরি না করে অ্যানির রুমে চলে গিয়েছিল সে। এবার তা করলো না। রিসেপশন ডেস্কটা ঠিক তার চোখ বরাবর। ঘুরে গিয়ে কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ‘অনুমতি ব্যতিত প্রবেশ নিষেধ’ লেখা দরজা খুলে ফেলল। 

“আরে, কী সমস্যা?” চিৎকার করে উঠলো রিসেপশনিস্ট। “চোখে দেখেন না আপনি?” 

“আপনি নিশ্চয়ই দেখেন?” নিজের ওয়ারেন্ট কার্ড দেখিয়ে বলল ক্যামিল। ।

সাথে সাথে রিসেপশনিস্ট মহিলা হেসে উঠলো 

“আপনি তো বেশ রসিক মানুষ!” 

কৃষ্ণকায় মহিলার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। অনুসন্ধিৎসু চোখ আর রোগা পটকা দেহের অধিকারী সে। অ্যান্টিলস থেকে এসেছে। নেম-ট্যাগ অনুযায়ী তার নাম ‘অপেলিয়া’। পরনে অদ্ভুত ধরনের ব্লাউজ আর চশমা। চশমাটা দেখে মনে হচ্ছে প্রজাপতি পাখা মেলে আছে। গা থেকে সিগারেটের গন্ধও আসছে। হাত দিয়ে ইশারা করে ক্যামিলকে বসতে বলল সে। ফোনে কথা শেষ করে ক্যামিলের দিকে মনোযোগ দিলো। 

“দেখুন, আপনি তো খুব একটা লম্বা না? মানে আমি বলতে চাইছি… পুলিশে যোগ দেয়ার জন্য তো ন্যূনতম একটা উচ্চতা প্রয়োজন, তাই না?” 

এই ধরনের প্রশ্নে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে ক্যামিল। যদিও এখন এইসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করছে না, তবুও মহিলার অভিব্যক্তির কারণে হেসে উঠলো সে। 

“আমি বিশেষ সুবিধা পেয়েছিলাম,” উত্তর দিলো ক্যামিল। 

“আপনার জন্য ওপর থেকে কেউ কলকাঠি নেড়েছে, বুঝতে পেরেছি!” 

তিক্ততা থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে গড়াতে পাঁচ মিনিটও লাগলো না দুজনের। পুলিশ অফিসার সামনে থাকা সত্ত্বেও বেশ নির্বিকার মনে হলো রিসেপশনিস্টকে। অ্যানিকে যে ডাক্তার দেখভাল করছে তার সাথে কথা বলতে চাইলো ক্যামিল। 

“রাতের এই সময়ে তো তাকে পাওয়া যাবে না। তবে ওই ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা ডাক্তারের সাথে কথা বলতে পারেন।” 

মাথা নেড়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসলো ক্যামিল। 

“রোগির খবর নেয়ার জন্য কেউ ফোন করেছিল?” 

“আমার জানামতে তো কেউ করেনি….” 

“আপনি পুরোপুরি নিশ্চিত?” 

“আমার কথা মন দিয়ে শুনুন। ওই ওয়ার্ডের কোনো রোগিই কল ধরার মত অবস্থায় থাকে না।” 

কিছু না বলে আবার লিফটের দিকে হাঁটা ধরলো ক্যামিল 

“এই যে, এই যে শুনছেন!” 

হলুদ রঙের একটা কাগজ পাখার মত করে নাড়াচ্ছে সে, যেন তার চেয়ে লম্বা কাউকে বাতাস দিচ্ছে। ক্লান্তিকরভাবে তার দিকে হেঁটে গেল ক্যামিল। অপেলিয়ার মনে ঝড় উঠলেও, চোখে মুখে তা প্রকাশ পেতে দিলো না সে। 

“আপনার জন্য ছোট্ট একটা চিঠি। সময় নিয়ে দেখবেন…” 

সাথে সাথে তা পকেটে চালান করলো ক্যামিল। এরপর, লিফটে করে ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে গিয়ে পৌছালো সে। রেজিস্টার দেখতে চাইলে, উপস্থিত একজন জানালো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। 

*** 

এ অ্যান্ড ই’র সামনে যেন গাড়ির মেলা বসেছে। লুকানোর জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা হয় না। বেশিক্ষণ না থাকলে, একটা গাড়ি আলাদা করে কারো চোখে পড়বে না। তবে সর্বদা চোখ কান খোলা রাখতে হবে। 

পাশে যদি লোডেড একটা মসবার্গ থাকে, তাহলে মনে অন্যরকম শান্তি বিরাজ করে। বিপদের বন্ধু তো সাথে রইলোই। 

এখন শুধু ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সাজানো বাকি। 

মহিলাকে হাসপাতাল থেকে সরানো পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতে পারে। এটাই সবচেয়ে সহজ সমাধান। অ্যাম্বুলেন্সে গুলি চালানো জেনেভা কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন-যদি না তাতে আপনার কিছু আসে যায়। মূল দরজার সামনের সিসিটিভি ক্যামেরা কোনো কাজেরই না : সম্ভাব্য কোনো চোরকে শনাক্ত করার জন্য হয়তো আছে, কিন্তু কাউকে গুলি চালানো থেকে থামানোর জন্য কিছুই নেই। 

পুরো ব্যাপারটাতে একটাই বাঁধা। অ্যাম্বুলেন্সের চারপাশে নিরাপত্তা বলয়ের কারণে আশেপাশে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। অবশ্য নিরাপত্তা বলয় ভেঙে নিরাপত্তা রক্ষীদের গুলি করা যায়—জেনেভা কনভেনশনে এই ব্যাপারে কিছু বলাও নেই, কিন্তু এটা মোটেও শান্তিপূর্ণ কোনো সমাধান নয়। 

তাহলে আরেকটা কাজ করা যেতে পারে। নিরাপত্তা বলয় থেকে অ্যাম্বুলেন্স বের হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অ্যাম্বুলেন্সে ডানে ঘুরে কিছু সময়ের জন্য ট্রাফিক সিগন্যালে পড়বে। ঠিক তখনি সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। এমন সময়েই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কোনো বন্দুকধারী এগিয়ে আসতে পারে। বাকি কাজ মাত্র তিন সেকেন্ডের। এক সেকেন্ডে দরজা খুলে আরেক সেকেন্ডে লক্ষ্য স্থির করা হয়ে যাবে। শেষ সেকেন্ড গুলির জন্য বরাদ্দ। ঘটনার আকস্মিকতায় অ্যাম্বুলেন্সে থাকা লোকজন আর পথচারী যতক্ষণ হতবিহবল থাকবে, ততক্ষণে নিজ গাড়িতে চড়ে কমপক্ষে চল্লিশ মিটার দূরে সরে যাবো। কাজ শেষ। ছোট ভুলটাও ঠিক করে ফেলতে পারলে আর কোনো চিন্তা নেই। আহ্! আমি এখনই অর্থকড়ির ঘ্রাণ পাচ্ছি। 

তবে পুরো বিষয়টাই হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার ওপর নির্ভর করছে। হয় সে ছাড়া পাবে কিংবা অন্য কোথাও পাঠানো হবে। যদি এমনটা না হয় তাহলে অন্যকিছু ভাবতে হবে আমাকে। 

হোম ডেলিভারির ব্যাপারটা ভুলে গেলে চলবে না। বাড়িতে পৌঁছে ভদ্রভাবে দরজায় নক করে ফুলের তোড়া দিয়েই বেরিয়ে আসা যায়। তবে এক্ষেত্রে সময় খুবই গুরুত্বপুর্ণ। কিংবা, গুলি চালাতে চালাতে ভেতরে ঢোকা যায়। প্রত্যেক পদ্ধতিরই আলাদা আলাদা সুবিধা আছে। প্রথমক্ষেত্রে, খুব দক্ষতার সাথে কাজটা করতে হবে। মানসিক শান্তিও পাওয়া যাবে। কিন্তু বড্ড নার্সিসিস্ট লাগবে নিজেকে, শিকারের চেয়ে শিকারির গুরুত্ব বেড়ে যায়। খুব বেশি স্বার্থপরের মত হবে কাজটা। অন্যদিকে এলোপাথাড়ি গুলি চালানোটা বরং বেশ গণতান্ত্রিক, উদার মনের পরিচায়ক। প্রায় মানব সেবার কাছাকাছি কোনো কাজ হবে। 

দিনশেষে পারিপার্শ্বিক অবস্থাই মাঝে মাঝে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে আমাদের। পরিস্থিতি বুঝে কাজ করতে হয়। আর এটাই তুর্কি ভ্রাতৃদ্বয়ের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। দুজনে বেশ শক্ত সামর্থ্য হলেও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে একদমই কাঁচা। মাতৃভূমি ছেড়ে ইউরোপের বড় কোনো দেশে অপরাধের উদ্দেশ্য আসার পূর্ব শর্তই হলো দারুণ একটা পরিকল্পনা। ওরা দুই ভাই তা করেনি। রয়সি বিমানবন্দরে নেমে এমন ভাব নিচ্ছিল, যেন দেখে মনে হয় বড় কোনো গ্যাংস্টার এসেছে। হায় ঈশ্বর! চ্যাপেল মেট্রো স্টেশনের এক বেশ্যার চাচাতো ভাই ছিল এই দুইজন। আংকারার কয়েকটা দোকান আর কেসকিনের পেট্রোল স্ট্রেশনে ডাকাতিই ছিল ওদের সবচেয়ে বড় কাজ। তবে আমার কাজের জন্য বিশেষজ্ঞ কাউকে না লাগলেও, এদের মত গাধা ব্যবহার করা রীতিমতো অপমানজক। 

এদের কথা ভুলে যাওয়াই ভালো। মৃত্যুর পূর্বে অন্তত প্যারিসের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরেছে। এর জন্য আমাকে একটা ধন্যবাদ তো দিতে পারতো। 

সবুরে মেওয়া ফলে। এখন ঠিক এই কথাটাই মনে পড়ছে আমার। খাটো পুলিশটা গাড়ি রেখে হাসপাতালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তার থেকে তিন কদম এগিয়ে আমি। বাকি সময়টাও এভাবেই এগিয়ে থাকতে চাই। রিসেপশন ডেস্কের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় লোকটাকে দেখলাম। ডেস্কের ওপাশে যেই থাকুক না কেনো, পুলিশের টাক ছাড়া আর কিছু দেখতে পারছে না, এব্যাপারে আমি একদম নিশ্চিত। পায়ে ভর দিয়ে উঁচু হলো লোকটা। তাতেও কোনো কাজ হলো না দেখে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। 

খাটো হলেও নিজের ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে তাকে। 

সময় মতো এর সাথেও দেখা করে নেবো। 

চারপাশটা ঘুরে দেখার জন্য গাড়ি থেকে বের হলাম। এখন একটাই কাজ, যত দ্রুত সম্ভব মহিলাকে খতম করে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া। 

.

সন্ধ্যা ৬টা ১৫ 

ঘুমিয়ে আছে অ্যানি। কপালের চারপাশের ব্যান্ডেজে হলদেটে দাগ, দুধ সাদা ত্বক, ফুলে থাকা চোখের পাতা, আর ঠোঁট…স্কেচ করার জন্য প্রত্যেকটা অংশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ক্যামিল। দরজায় উঁকি দিয়ে কেউ কথা বলতে চাইলে বাঁধাগ্রস্ত হয় সে। তখন বাইরে যেয়ে কথা বলে নেয়। 

উপস্থিত ডাক্তারের চেহারা বেশ গাম্ভীর্যপূর্ণ। চোখে গোল রিমের চশমা। নেম ট্যাগে বিশাল বড় এক নাম। তার চোখের সামনে ওয়ারেন্ট কার্ড তুলে ধরলো ক্যামিল। এ অ্যান্ড ই’তে পুলিশ আসা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা না। তবে ক্রিমিনাল ব্রিগেড থেকে এই প্রথম কেউ এলো। 

“ম্যাডাম ফরেস্টিয়ের শরীরের অবস্থা ভালোমতো জানতে হবে আমার। কিছুক্ষণ পর ম্যাজিস্ট্রেট আসবে প্রশ্ন করতে…” জানালো ক্যামিল। 

ডাক্তার জানালো, এব্যাপারে একমাত্র কন্সালট্যান্টই সিদ্ধান্ত নেবে যে রোগি কখন কথা বলতে পারবে। 

“বুঝতে পেরেছি…” মাথা নাড়লো ক্যামিল। “কিন্তু, সে কী…এখন কেমন আছে?” 

অ্যানির এক্স-রে আর অন্যান্য তথ্যের ফাইল ডাক্তারের হাতে, কিন্তু তার মুখ থেকে কিছু শুনতে হলো না ক্যামিলের। প্রিয় মানুষটার কী অবস্থা তা সে ভালোমতোই জানে-নাকটা পুরো ভাঙা, একটা কলারবোনে চিড় ধরেছে,, পাঁজরের দুটো হাড় ভেঙে গেছে, বাম হাতের কবজি আর পায়ের গোড়ালি মচকানো, দুটো আঙুল একদম ভাঙা। হাত, পা আর পেট জুড়ে অসংখ্য কাটাছেড়া আর কালশিটে দাগ। ডান হাতে গভীর একটা ক্ষত থাকলেও কোনো স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, ফিজিওথেরাপি লাগতে পারে। আর মুখের ক্ষতটা শুকিয়ে গেলেও স্থায়ী ছাপ রেখে যাবে। যদিও প্রাথমিক রিপোর্ট বেশ আশাব্যঞ্জক। 

“বেশ ভালো, খুশির খবর হচ্ছে স্নায়ুতন্ত্র একদম ঠিক আছে। খুলিতেও কোনো চিড় ধরা পরেনি, যদিও দাঁতের অপারেশন করতে হবে। প্লাস্টার কাস্ট লাগতে পারে…এখনো তা নিশ্চিত নয়। আগামীকাল এম.আর.আই স্ক্যানের পর নিশ্চিতভাবে বলা যাবে।” 

“রোগির ব্যথা কি অনেক বেশি?” জানতে চাইলো ক্যামিল। “এই প্রশ্নটা করার কারন আছে। যদি ম্যাজিস্ট্রেট রোগির সাথে কথা বলতে চায়…” 

“ব্যথা কমানোর জন্য যা যা করা দরকার আমরা সব করছি। আপনি এই ব্যাপারে একদম চিন্তা করবেন না।” 

জোর করে মুখে হাসি আনলো ক্যামিল। ডাক্তারকে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে তার কথা আটকে গেল। কৌতুহলী দৃষ্টিতে ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে আছে ডাক্তার। পুলিশরা সাধারণত এতো আবেগী হয় না, মনে মনে ভাবলো সে। ক্যামিলের পেশাগত দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ইচ্ছা করছে তার। শেষমেশ, সব বাদ দিয়ে সমবেদনা জানানোর সিদ্ধান্ত নিলো সে। 

“পুরোপুরি সেরে উঠতে সময় লাগবে তার,” বলল ডাক্তার, “কালশিটে দাগগুলো চলে যাবে, দুই একটা ক্ষতচিহ্ন থাকতে পারে। কিন্তু ম্যাডাম…( ফাইলে চোখ বুলালো সে) ম্যাডাম ফরেস্টিয়ে এখন পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত। আমার মতে শারীরিক ক্ষত এখন মুখ্য বিষয় নয়। মানসিক ধাক্কা কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে আসাটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আরো দুয়েকদিন উনার অবস্থা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবো আমরা। তারপর হয়তো মানসিক শক্তি জোগানোর জন্য কাউকে প্রয়োজন হবে তার।” 

ডাক্তারকে আবারো ধন্যবাদ জানালো ক্যামিল। আর কিছুই করার নেই, এখন চলে যাওয়া উচিত তার। কিন্তু প্রিয়তমাকে রেখে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। 

*** 

হাসপাতালের ডানপাশে ঢোকার কোনো দরজা নেই। তবে বামপাশের চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। ইমার্জেন্সি এক্সিট স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এর সাথে গ্যালারি মনিয়েরের ওই দরজার বেশ মিল আছে। 

কিছুক্ষণ দরজায় কান পেতে রইলাম। যদিও তাতে কোনো লাভ হলো না। কেন না দরজাটা বেশ পুরু। যাই হোক, কোনো ব্যাপার না। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দরজার হাতল ঘুরালাম। নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা করিডোরে। একদম শেষ মাথায় আরেকটা করিডোর। হাঁটা শুরু করলাম আমি। 

আমার ডানপাশের দেয়ালে জরুরি নির্গমনের পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে। বিল্ডিংয়ের নকশা বেশ জটিল, কিছু অংশ নতুন করে করা হয়েছে। নিরাপত্তা রক্ষীদের ভালোই খাটুনি হয়, বোঝা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষজন অফিসিয়াল সাইনের দিকে খুব একটা নজর দেয় না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মাঝেমাঝে কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ব্যতিত ফায়াল ড্রিল করা উচিত। এতে করে মানুষ জরুরি নির্গমনের পথটা অন্তত চিনতে পারবে। আর হাসপাতালের এমন কর্মকাণ্ডে মানুষের ভরসাও বাড়বে। বিশেষ করে খুন করার জন্য শটগান হাতে যদি কেউ আক্রমণ চালায়, তাহলে তো আরো বেশি কাজে দেবে। 

এতে আমার কী? 

মোবাইল বের করে ছবি তুলে নিলাম। 

গাড়িতে বসে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে। বিপদের কথা না ভেবেই কোনো পরিকল্পনা করা বোকামী ছাড়া কিছুই না। বিজয়ের মুখে যেয়ে যেন পরাজয় বরণ করতে না হয়। সেজন্যে, আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। 

.

সন্ধ্যা ৬ টা ৪৫ 

অ্যানির রুমের লাইট না জ্বালিয়েই বসে রইলো ক্যামিল। সবকিছু কেমন দ্রুত ঘটছে, তাই ভাবছে সে। 

নিচু স্বরে নাক ডাকছে অ্যানি। কীভাবে শুয়ে আছে, তার উপর নির্ভর করে নাক ডাকার তীব্রতা। তবে যখনি বুঝতে পারে, তখনি কিছুটা লজ্জিত হয় সে। এখন মুখ জুড়ে কালশিটে দাগ থাকলেও লজ্জা পেলে মুখটা আরো লাল হয়ে যায় তার। তখন আরো বেশি সুন্দর লাগে অ্যানিকে। 

“তুমি নাক ডাকো না, বরং একটু ঘন ঘন শ্বাস নাও,” তাকে আশ্বস্ত করলো ক্যামিল। “আর দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।”

চুল দিয়ে মুখের গোলাপী আভা ঢাকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো অ্যানি।

“জানি না কবে আমার ভুলগুলো তোমার চোখে পড়বে,” মুচকি হেসে বলল সে, “হয়তো ততোদিনে আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে।” 

মজার ছলে প্রায়ই এই কথাটা বলে অ্যানি। আবার বিয়ের পর দুজনে মিলে কী কী করবে তা নিয়েও আলাপ করে। যদিও এই দুয়ের মাঝে খুব বেশি পার্থক্য থাকে না। এতে করে মানসিক শান্তি পায় ক্যামিল। বিপত্নীক আর হতাশাগ্রস্ত মানুষ এতেই ভরসা খুঁজে নেয়। তবে এখনও হতাশ কি না সেব্যাপারে নিশ্চিত নয় ক্যামিল। কিন্তু এখনো বিপত্নীকই আছে। অ্যানির আগমনের পর থেকে সবকিছু কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে তার জীবনে। আগের মত সহজ সরল আর নেই। দুজনে মিলে অনন্ত এক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সময় অজানা, অনিশ্চিত। 

“আমাকে মাফ করে দিয়ো, ক্যামিল।” 

কেবলই চোখ খুলল অ্যানি। প্রতিটা শব্দ বেশ জোর দিয়ে বলছে সে। মুখ ঢেকে কথা বলা সত্ত্বেও তা স্পষ্ট বুঝতে পারলো ক্যামিল। 

“পাগল হয়ে গেলে না কি? তুমি কেন ক্ষমা চাইছো?” 

নিজের ক্ষতবিক্ষত শরীরের দিকে আঙুল তাক করলো অ্যানি। 

“সবকিছুর জন্য…”

তার চোখের গভীর শূন্যতা যেন হাজার হাজার মানুষের কথা মনে করিয়ে দেয়, যারা একই পরিণতি বরণ করেছে। প্রিয়তমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো ক্যামিল, কিন্তু আঙুলে থাকা স্প্লিন্টার ছাড়া আর কিছুই অনুভব করতে পারলো না। “তোমার এখন বিশ্রাম দরকার। আর কোনো চিন্তা নেই। তোমার পাশেই আছি আমি।” ভেতরে ভেতরে অসহনীয় যন্ত্রণায় জর্জরিত হলেও, পেশাগত কারণে তা দমিয়ে রাখলো সে। তবে অ্যানিকে মারার জন্য লোকটা এতো উঠেপড়ে কেন লেগেছিল, এই প্রশ্নটা কোনোভাবেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলো না। এতোটাই মরিয়া ছিল যে, চার চারবার অ্যানিকে মারার চেষ্টা করেছে। হয়তো পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় মাথা কাজ করছিল না। তবুও… 

“জুয়েলারিতে ডাকাতির সময় তুমি কি অন্য কিছু দেখেছিলে কিংবা শুনেছিলে?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল। 

“অন্য কিছু বলতে… কী বোঝাতে চাচ্ছো?” 

“না। কিছু না।” 

হাসার চেষ্টা করলো ক্যামিল, কিন্তু তা মোটেও সন্তোষজনক হলো না। এখন অ্যানির ঘুমানো দরকার। তবে যত দ্রুত সম্ভব এই বিষয় নিয়ে কথা বলা দরকার। খুঁটিনাটি সব তথ্য জানতে হবে ক্যামিলের। হয়তো, আপাত দৃষ্টিতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। কিন্তু, ছোটখাটো কোনো তথ্যও কেসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। সেটাই এখন খুঁজে বের করতে হবে। 

“ক্যামিল…” 

অ্যানির দিকে ঝুঁকে গেল সে। 

“আমাকে ক্ষমা করে দিও…” 

“অনেক হয়েছে, বাদ দাও তো এইসব। এখন ঘুমানোর চেষ্টা করো।” হাসপাতালের আধো আলোতে ক্ষত বিক্ষত অ্যানিকে খুবই কুৎসিত লাগছে। অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছে। কালশিটে দাগগুলো ধীরে ধীরে নীলচে থেকে হালকা গোলাপী বর্ণ ধারণ করছে। মন না চাইলেও এখন চলে যেতে হবে ক্যামিলের। তবে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয় অ্যানির অশ্রুভেজা চোখ। এমনকি মাঝে মাঝে ঘুমন্ত অ্যানির গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। 

উঠে দাঁড়ালো ক্যামিল। এবার যাবার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সে। তাছাড়া, এখানে থেকেই বা কী করতে পারবে সে। বের হওয়ার সময় খুব সতর্কতার সাথে দরজা চাপিয়ে দিলো। যেন ভেতরে কোনো শিশু ঘুমিয়ে আছে। 

.

সন্ধ্যা ৬ টা ৫০ 

বেশিরভাগ সময় কাজের চাপে দম ফেলার সময় পায় না রিসেপশনিস্ট। তবে একটু ফুরসত পেলেই দুই একটা সিগারেট ফুঁকে নেয়। বিষয়টা অবাক করার মতো। হাসপাতালের কর্মীদের কাছে ক্যান্সার অনেকটা সহকর্মীর মতো, যার সাথে প্রতিনিয়ত দেখা হয়। বাইরে দাঁড়িয়ে মনের সুখে বিষাক্ত ধোঁয়া ফুসফুসের ভেতরে নিচ্ছে সে। 

এটাই মোক্ষম সুযোগ। বিল্ডিঙয়ের অন্যপাশে গিয়ে ইমার্জেন্সি এক্সিট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। সুইচবোর্ড অপারেটর এখনো আসেনি। কাচের দরজার ওপাশে কিছু একটা করছে। তিনকদম এগিয়ে গিয়েই আমার কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেয়ে পেলাম। রোগি ভর্তির ফাইল। চাহিবামাত্রই ইহা আপনাকে দিতে বাধ্য থাকিবে কর্তৃপক্ষ। 

ওষুধপত্র সব ক্যাবিনেটের ভেতরে তালাবদ্ধ থাকে। কিন্তু রোগির ফাইল একদম চোখের সামনে। অবশ্য এতে কোনো ভুল নেই : নার্স হিসেবে আপনার দায়িত্ব রোগির যাতে কোনো রকমের ইনফেকশন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা। সে তো আর কোনো ডাকাতির ভয় করবে না। 

ঘটনাস্থল : গ্যালারি মনিয়ের, আট নাম্বার উপশহর, প্যারিস 

অ্যাম্বুলেন্স : এল আর-৪৫৩ 

পৌঁছানোর সময় : সকাল ১০ টা ৪৪ 

নাম : ফরিস্টিয়ে, অ্যানি 

রুম : ২৪৪ 

জন্ম তারিখ : অজানা 

ঠিকানা : ২৬, ফন্টেইন সড়ক 

ছাড়পত্র/ স্থানান্তর : সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি 

।পরীক্ষা : এক্স-রে, সি.টি. স্ক্যান

ডাক্তার : এখনো ঠিক হয়নি। 

গাড়ির কাছে চলে এলাম আমি। রিসেপশনিস্ট আরেকটা সিগারেট ধরাচ্ছে। ভাগ্য এতো সুপ্রসন্ন হবে জানলে পুরো ফাইল ফটোকপি করে আনতাম। 

দ্বিতীয় তলার ২২৪ নাম্বার রুম। 

গাড়িতে উঠে মসবার্গটা কোলে নিলাম। ভেবেছিলাম রোগিকে কখন ছাড়বে সে ব্যাপারে জানতে পারবো। কিন্তু কাজের কাছ কিছুই হয়নি। মূল্যবান কিছু সময় নষ্ট হলো। 

অনেক কিছু নির্ভর করছে এর উপর। এতো সাধের পরিকল্পনা কোনোমতেই বিফলে যেতে দিবো না। শেষ মুহূর্তে এসে মনোযোগ হারানো যাবে না। 

মোবাইল বের করে বিল্ডিঙয়ের নকশার দিকে নজর দিলাম। করিডোর আর হাঁটা চলার জায়গার মাঝে যে বেশ কয়েকটা রাস্তা আছে, তা কারো চোখেই পড়বে না। অনেকটা ‘ম্যাজিক আই’-এর মত, একদিকে ঘুরালে ভাঁজ করা তারার মত লাগে, আবার অন্যদিকে নিলে হয়ে যায় বহুভুজ। হাসপাতালের ক্ষেত্রে এমন লুকোচুরির ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হলো না আমার। 

যাই হোক, এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। আশা করি ইমার্জেন্সি এক্সিট দিয়ে খুব সহজেই দোতলায় চলে যেতে পারবো। আর ২২৪ নাম্বার রুম ওখান থেকে মাত্র দশ মিটারের পথ। তবে বের হওয়ার সময় একটু কৌশলী হতে হবে-তিনতলায় উঠে করিডোর ধরে এগিয়ে গেলেই হাতের বামে সিঁড়ি। চারতলায় সিঁড়ি দিয়েই উঠতে হবে। এরপর একে একে নিউরোসার্জারি বিভাগ আর তিনটা দরজা পেরোলেই লিফট লিফটে করে নিচে নামলেই রিসেপশন ডেস্ক। আর সেখান থেকে বিশ কদম দূরেই আমার গাড়ি। জাঁকজমকপূর্ণ আগমনে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে বিদায়বেলায় এতো হৈ চৈ পছন্দ করি না। 

তাকে অন্য কোথাও সরানোর সম্ভাবনা একদম বাতিল করে দেয়া যায় না। সেজন্য তো নিচে আছিই আমি। এখন যেহেতু নামটাও জানি, তাই চাইলেই খোঁজখবর নিতে পারবো। 

হাসপাতালের নাম্বার বের করে কল করলাম। 

১ চাপুন, ২ চাপুন-পুরো বিরক্তিকর ব্যাপার। এর চেয়ে মসবার্গই ভালো। 

.

সন্ধ্যা ৭ টা ৩০ 

সারাদিন অফিসে যেতে না পারায় লুইসকে ফোন করলো ক্যামিল। তার টিম বেশ কয়েকটা কেস নিয়ে কাজ করছে। এক ট্রান্সভেসটাইট, যাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। জার্মান এক পর্যটক, হয়তো আত্মহত্যা করেছে। মারামারি এক পর্যায়ে অজ্ঞাত লোককে খুন করেছে এক ড্রাইভার। বাস্তুহীন এক লোক, যার লাশ পাওয়া গেছে জিমনেশিয়ামে। আর সুয়ারেজ লাইনে ভেসে উঠেছে এক কিশোরের লাশ। একাত্তর বছর বয়সি এক লোক কিশোরকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। সবকিছু শুনে কী করতে হবে সে ব্যাপারে পরামর্শ দিলো ক্যামিল। যদিও তার অনুপস্থিতি কিছুটা হলেও ভোগাবে। তবে আশার বিষয় হচ্ছে পরিস্থিতি সামলে নেবার জন্য লুইস আছে। 

ফোন রাখার সাথে সাথে এতোক্ষণ ধরে কী নিয়ে কথা বলছিল, তা মনে করতে পারলো না ক্যামিল। তার মনে ভেসে উঠছে অ্যানির ক্ষত বিক্ষত ছবি। 

 চোখ বন্ধ করে নিজের বর্তমান অবস্থা নিয়ে চিন্তা করলো সে। কমিশনারের কাছে ইনফর্মার নিয়ে যা বলেছে, সবই মিথ্যা। এমনকি ভুয়া এক নামও দিয়ে এসেছে। অস্তিত্বহীন এই ইনফর্মার ছাড়া কোনো উপায় ছিল না তার। কোনোভাবেই যেন এই কেস অন্য কারো হাতে না যায়, এর জন্য যা যা করা দরকার সবই করেছে সে। 

ডাকাত দলের নৃশংসতার শিকার অ্যানি হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। সশস্ত্র ডাকাতির এই কেসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীও সে। এর আগেও এক ডাকাতির সময় একজনকে হত্যার অভিযোগ আছে এদের বিরুদ্ধে। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে ভিক্টিমের সাথে তার সম্পর্ক। 

পুরো ঘটনাপ্রবাহ ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে বোঝা যায়, একের পর এক বেপরোয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্যামিল। তার মতো যোগ্য একজন অফিসারের কাছ থেকে এটা মোটেও কাম্য নয়। তার মনে হচ্ছে, নিজ প্রবৃত্তির জালে নিজেই বাঁধা পড়েছে। পুরো বোকার মত কাজ করেছে। তার ব্যবহারে মনে হচ্ছে, সহকর্মীদের উপর বিন্দুমাত্র আস্থা নেই তার। নিজের উপরেই যার আত্মবিশ্বাস কম, এমন সিদ্ধান্ত তার জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। তার সবচেয়ে বড় সম্পদ অন্যদের থেকে আলাদাভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা। এই কেসে তা বিসর্জন দিয়ে জায়গা দিয়েছে আবেগ, খামখেয়ালিপনা আর ক্রোধকে। 

এই কেসে জটিলতাও খুব একটা বেশি না। আর এই কারণেই তার ব্যবহার বেশ আজগুবি মনে হচ্ছে। সশস্ত্র একদল লোক ডাকাতির জন্য জুয়েলারির দোকানে হানা দেয়। কাকতালীয়ভাবে সেখানে অ্যানিও উপস্থিত ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীকে মেরে অজ্ঞান করে জুয়েলারির সামনে ফেলে রাখে ডাকাত দলের এক সদস্য। একজন তার পাহারায় থাকে যাতে পালানোর মত বোকামি না করে। যদিও পরবর্তীতে অ্যানি ঠিক সেই চেষ্টাই করে। হতবাক হয়ে পাহারায় থাকা লোকটা গুলি চালালেও লক্ষ্যভেদে সে ব্যর্থ হয়। পরেরবার গুলি চালানোর সময় তার সঙ্গী বাঁধা দেয়। এদিকে মাথা না ঘামিয়ে নিজেদের কাজ শেষে বেরিয়ে যায় তারা। গাড়ি দিয়ে পালানোর সময়, শটগান হাতে থাকা লোকটার সামনে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে শেষ একটা সুযোগ চলে আসে। কিন্তু সেবারও সঙ্গীর সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়ানোর কারণে বেঁচে যায় অ্যানি। 

লোকটার হিংস্রতা আসলেই ভীতিকর। কিন্তু আদতে সে পরিস্থিতির শিকার। অ্যানিকে হত্যাচেষ্টার একমাত্র কারন, তার অসময়ের উপস্থিতি। 

এখন আর থামার উপায় নেই। যা শুরু হয়েছে, তা শেষ করতে হবে ক্যামিলের। 

এতোক্ষণে অনেক দূরে চলে গিয়েছে তারা। যে পরিমাণ লুট করেছে তাতে যেখানে খুশি যেতে পারবে। 

তাদের ধরার উপায় একটাই। আর তার জন্য অ্যানির সুস্থ হওয়া 

প্রয়োজন। যদি সে একজনকেও শনাক্ত করতে পারে, তাহলেই হবে। এমনিতেই ক্রিমিনাল ব্রিগেডে লোকবল সংকট, হাতে কেসও অনেকগুলো। প্রতিনিয়ত তা বেড়েই চলছে। তাতে করে খুব শীঘ্রই তাদের ধরার সম্ভাবনা কম আর খুঁজে বের করার সম্ভাবনা তো আরো কম। প্রতিদিন শত শত ডাকাতি হচ্ছে। যদি ঘটনাস্থলে তাদের ধরা না যায় আর যদি এ কাজে তারা দক্ষ হয়, তাহলে কোনো প্রমাণ ছাড়াই গায়েব হয়ে যেতে পারবে। সেদিক থেকে চিন্তা করলে এই কেস এখানেই শেষ। আজীবনের জন্য ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে থাকবে। 

তাই এই কেস যাতে কোনোভাবেই হাতছাড়া না হয়, সে ব্যবস্থা নিলো ক্যামিল। কেননা, লা গুয়েনের চেয়ে উর্ধ্বতন কারো হাতে পড়লে আর কিছুই করার থাকবে না। তা ঠেকানোর জন্যই মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছে ক্যামিলের। পরবর্তীতে নিজের বন্ধুকে সব বুঝিয়ে বললেই হবে। যদি সঠিক পথে আগানো যায়, তখন কমিশনারের সাথে কথা বলে নেবে লা গুয়েন। বসকে খুশি করতে কে না চায়। একটা সময় তো তারও প্রয়োজন হতে পারে বসের সাহায্যের-আর নিঃসন্দেহে বলা যায়, তা হবেই। নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সায় জানাবে কমিশনার। জুজ পেরেইরা নাক গলানোর আগেই কিছু করতে হবে ক্যামিলের। 

নিজের সিদ্ধান্তে বেশ সন্তুষ্ট হলো সে। 

এই কেসটা ছেড়ে দেবে। 

ডাকাত দলের খোঁজ অন্য কেউ করুক। তার সহকর্মীরা এই কাজের জন্য যথেষ্ট। অ্যানির দেখভাল করা, তার সাথে সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলো ক্যামিল। এই মুহূর্তে তার সঙ্গই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অ্যানির। তাছাড়া সে এমন কী করতে পারে যা তার সহকর্মীরা পারে না? 

“একটু শুনবেন…”

রিসেপশনিস্টের দিকে এগিয়ে গেল ক্যামিল। 

“কয়েকটা বিষয় নিয়ে কথা বলার ছিল,” বলল সে। “একটু আগে আপনাকে একটা ভর্তি ফরম দিয়েছিলাম। সাথে সাথেই তা পকেটে পুরেছিলেন। আমি জানি, এইসব নিয়ে মোটেও মাথা ঘামান না আপনি। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে বেশ সংবেদনশীল।” 

পকেট থেকে ফরম বের করলো ক্যামিল। দ্রুততার সাথে পূরণ করে তা রিসেপশনিস্টের দিকে এগিয়ে দিলো সে। 

“কিছু মনে করবেন না, আরেকটা বিষয়ে কথা ছিল।” আকর্ষণীয় এক হাসি দেবার চেষ্টা করলেও, চূড়ান্তরূপে ব্যর্থ হলো রিসেপশনিস্ট। “গাড়ি পার্কিংয়ের টিকেট তো আছেই, তাই না?” 

এই বালের চাকরি ঘৃণা করে ক্যামিল । 

ক্লান্ত ক্যামিল হাত বাড়িয়ে দিলো। মুহূর্তের মাঝেই ড্রয়ার খুলল রিসেপশনিস্ট। কমপক্ষে চল্লিশটা জরিমানার টিকেট উঁকি দিচ্ছে। ক্যামিলের হাতে টিকেট দেয়ার সময় চওড়া এক হাসি দিলো সে, যেন কোনো ট্রফি তুলে দিচ্ছে। হাসির ফলে তার বাঁকা দাঁতও বেরিয়ে এসেছে। 

“ব্যাপারটা হলো,” মিষ্টি কথার ভোলানোর চেষ্টা করলো সে। “আজকে রাতে ডিউটি আছে আমার, কিন্তু সবদিন এমন… 

“সমস্যা নেই, আমি বুঝতে পেরেছি,” বলল ক্যামিল। 

এই বালের চাকরি ঘৃণা করে ক্যামিল। 

পার্কিং টিকেটে তার এক পকেট ভরে গিয়েছে। তাই উপায় না দেখে সব বের করলো সে। দুইভাগ করা ছাড়া আর উপায় নেই। যতবার কাচের ওই স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে, ততবারই ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা লাগে তার মুখে। তবে এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। 

ক্যামিলের শরীর একদমই চলছে না। 

*** 

তাকে ছাড়পত্র দেয়া কিংবা সরানোর কোনো সম্ভাবনাই নেই, অন্তত আগামী কয়েকদিনের মাঝে তো একদমই না। ফোনের ওপাশে থাকা মেয়েটার সাথে কথা বলে এতোটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে। এখানে দুইদিন বসে থেকে মাছি মারার ইচ্ছাও নেই আমার। অনেক অপেক্ষা করেছি। আর না। 

প্রায় আটটা বাজে। ওই পুলিশ তো যাওয়ার নামই নিচ্ছে না। বের হয়েও কী মনে করে যেন দাঁড়িয়ে গেল। কিছু একটা নিয়ে ভাবছে। কাঁচের দরজায় উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। আশা করি খুব শীঘ্রই চলে যাবে। 

আর তারপর শুরু হবে খেলা! 

গাড়িটা ইমার্জেন্সি এক্সিটের কাছাকাছি রাখলাম। ঈশ্বরের কৃপায় এদিক দিয়েই পালাবো আমি। আর তারও কৃপা হওয়া উচিত, তা না হলে কী করবো আমি নিজেও … 

জায়গামত গাড়ি রেখে ভেতরে ঢুকে গেলাম। 

কেউ নেই ভেতরে। 

হলওয়েতে আসতেই ছোট্ট পুলিশকে দেখতে পেলাম, উল্টোদিকে ঘুরে আছে। কোনো বিষয়ে গভীর ধ্যানে মগ্ন সে। 

খুব শীঘ্রই আরো গভীর ধ্যানে বসতে হবে ওর। আমার তো ইচ্ছা আছে ওকে স্ট্রাটোস্ফিয়ারে পাঠাবো, যাতে কেউ ধ্যানে বাঁধা দিতে না পারে। 

.

সন্ধ্যা ৭ টা ৪৫ 

গাড়ি কাছাকাছি যেতেই, সকাল বেলার ফোন কলের কথা মনে পড়লো ক্যামিলের। অ্যানির নিকটাত্মীয় ভেবেই তাকে ফোন করেছিল। যদিও তা ঠিক না, কিন্তু হাসপাতাল থেকে সর্বপ্রথম তার সাথেই যোগাযোগ করা হয়। তাই অ্যানির পরিবারকে জানানোর দায়িত্ব এখন তার উপরেই বর্তায়। 

পরিবার? ভাবলো সে। মাথায় চিন্তার ঝড় তুললেও, কোনো লাভ হলো না। অ্যানির পরিবারের কাউকে সে চেনে না। দুয়েকজন সহকর্মীর সাথে অবশ্য দেখা হয়েছিল। চল্লিশোর্ধ্ব এক মহিলার কথা মনে পড়ছে তার। “আমার সহকর্মী…” বলেছিল অ্যানি। নাম মনে করার চেষ্টা করলো ক্যামিল। চারাস? চারোন? চারোই? এইতো, এটাই। একসাথে রাস্তা পার হচ্ছিল দু-জন। তার পরনে ছিল নীল কোট। অ্যানিকে বিদায় জানানোর কেমন একটা চক্রান্তমূলক হাসি দিয়েছিল। বিষয়টা ক্যামিলের নজর এড়ায়নি। বিদায় দিয়ে ক্যামিলের দিকে ঘুরেই অ্যানি বলল, “আস্ত শয়তানের হাড্ডি…” 

সবসময় অ্যানির ফোনেই কল করে ক্যামিল। হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার আগে অফিসের নাম্বার নিয়ে নিলো। আটটা বেজে গেছে। কিন্তু কে জানে কেউ থাকতেও পারে অফিসে। 

“হ্যালো, ভাটিগ অ্যান্ড শুইন্ডেল থেকে বলছি। আমাদের অফিসের…” 

শরীরের মাঝে উত্তেজনা অনুভব করলো ক্যামিল। এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো, ওটা অ্যানির কণ্ঠস্বর। মুহূর্তেই বিষাদে ছেড়ে গেল তার মন। আইরিনের সময়ও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল। আইরিনের মৃত্যুর এক মাস পর ভুল করে বাসার নাম্বারে ফোন করেছিল ক্যামিল। ওপাশ থেকে ভেসে আসে আইরিনের কন্ঠ : “হ্যালো, ক্যামিল আর আইরিন ভেরহোভেন বলছি। এই মুহূর্তে আমরা বাইরে…” হতবাক ক্যামিল, কান্নায় ভেঙে পড়লো। 

গলা ভারি হয়ে আছে, কথা আটকে যাচ্ছে তার। “অ্যানি ফরস্টিয়ের ব্যাপারে ফোন করেছি আমি। আপাতত সে হাসপাতালে আছে। আর কাজে আসতে পারবে না…মানে আমি বলতে চাইছি, দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে সে…খুব একটা গুরুতর না…সত্যি বলতে অবস্থা সংকটাপন্ন (কীভাবে যে বলি?), যত দ্রুত সম্ভব ফোন করে জানাবে অ্যানি…যদি তা করতে পারে।’ এলোমেলোভাবে কথা শেষ করলো ক্যামিল। 

নিজের প্রতি ঘৃণার এক তীব্র ঢেউ জন্ম নিলো তার মনে। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *