সকাল ৭ টা ১৫
দুইদিন প্রায় নির্ঘুম কাটিয়েছে ক্যামিল। বনের এক কোণায়, মায়ের স্টুডিওতে বসে আছে সে। হাতে ধোঁয়া উঠা কফির মগ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মন্টফোর্টের এই স্টুডিওতে, ছবি এঁকে সময় কাটিয়েছে তার মা। এরপর থেকেই পরিত্যক্ত এই জায়গা। এখন ছিচকে চোর আর নেশাগ্রস্ত লোকের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। কোনো এক অজানা কারণে স্টুডিওর মায়া ছাড়তে পারেনি সে। তাই বিক্রিও সম্ভব হয়নি
আইরিন মারা যাবার কয়েক মাস পর মায়ের সবকিছুই বেচে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। একটা ক্যানভাস পর্যন্ত রাখেনি। যা মনের মাঝে পুষে রাখা এক ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ-মায়ের লাগামহীন ধূমপানের কারণেই, তার উচ্চতা চার ফুট এগারোতে আটকে গেছে।
কয়েকটা পেইন্টিঙের ঠাঁই হয়েছে বিদেশী জাদুঘরে। পেইন্টিং বিক্রির সমস্ত অর্থ দান করার সিদ্ধান্ত নিলেও, শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে উঠেনি। আইরিনের মৃত্যুর কয়েক বছর পর্যন্ত, সব ওভাবেই পড়ে ছিল। শেষমেশ নিজের জীবন আর বনের ধারে থাকা স্টুডিও পুনরায় সাজানোর উদ্যোগ নেয় সে।
স্টুডিওর প্রতিটা কোণা নতুন করে সাজায় ক্যামিল। মেঝেতে থাকা নড়বড়ে টাইলসগুলো পরিবর্তন করে নতুন করে বসানো হয়। দোতলায় ছোট একটা ঘর বানিয়ে নিয়েছে নিজের জন্য। আর নিচতলায় বসার জন্য সুবিশাল জায়গা। ঠিক তার পাশেই পরিপাটি রান্নাঘর। দেয়ালের একটা অংশ জুড়ে স্বচ্ছ কাচে মোড়ানো বিশাল জানালা। সেদিকে তাকালেই চোখে পড়ে বনের একাংশ।
বনের দিকে তাকালে নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে ক্যামিলের। মায়ের আঁকাআঁকি দেখতে দেখতে কত বিকেল যে পার হয়ে গিয়েছে! সেইসব দিনের কথা মনে পড়লে এখনো তার মনে মিশ্র এক অনুভূতি জন্ম নেয়। তবে একটা জিনিসের কথা ভাবলেই নস্টালজিয়ায় ভুগে সে। কাঠ পোড়ানোর জন্য লোহার তৈরি একটা স্টোভ ছিল তার মায়ের। পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকাকালীন সময়ে কেউ চুরি করে ওটা।
ছাদের বেশিরভাগ অংশে স্বচ্ছ কাচ বসানোর ব্যবস্থা করেছে ক্যামিল, যাতে করে সবসময় আকাশটা দেখা যায়। উপরে তাকালেই মনে হয় মেঘ আর বৃষ্টি এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর তুষারপাতের দৃশ্য। সে সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করার মত না। এছাড়া ছাদের ওই অংশ তেমন কোনো কাজে লাগে না, যদিও এর কারণে ঘরের মাঝে আলোর পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। তবে তা না হলেও চলতো। এমনিতেই যথেষ্ট আলো আছে ঘরে। লা গুয়েনের মত বাস্তবধর্মী লোকও এব্যাপারে প্রশ্ন করেছে।
“কী বলতে চান আপনি?” বলল ক্যামিল। “হতে পারে আমি বামন, কিন্তু চাঁদটা ঠিকই ছুঁয়ে দিতে পারি।”
সময় পেলেই এখানে ছুটে আসে ক্যামিল। ছুটির দিনগুলো এখানেই কাটিয়ে দেয়। কিন্তু খুব কম সময় বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসে। এমনিতেও তার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা হাতেগোণা কয়েকজন। লুইস, লা গুয়েন আর আরম্যান্ড এসেছিল। এ যেন কোনো গোপন আস্তানা। এখানে আসলে আঁকাআঁকি করেই সময় পার করে ক্যামিল। চারিদিকে ছড়িয়ে আছে কাগজের বিশাল স্তূপ। এরমাঝে রয়েছে অসংখ্য স্কেচ। যাদেরকে গ্রেফতার করেছে, যাদের হত্যাকান্ডের ব্যাপারে তদন্ত করেছে, যে ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে কাজ করেছে এবং একদিনের সহকর্মীরও পোর্ট্রেট আছে ওই স্তূপের মাঝে। যে সকল সাক্ষীকে সে জেরা করেছে, তাদের প্রতি আলাদা দূর্বলতা আছে তার। তাই। এদের স্কেচও বাদ যায়নি। সবকিছুই আছে এখানে। দুই থেকে তিন হাজার পোট্রেটের এক বিশাল গ্যালারি বানিয়ে ফেলেছে। যেন কোনো চিত্রশিল্পী ‘ক্রিমিনাল বিগ্রেডের এক অফিসারের দৈনন্দিন জীবন’ শিরোনামে ছবি এঁকেছে। তার আঁকা অতুলনীয় পোর্ট্রেট, এক বিরল প্রতিভার সাক্ষ্য দেয়। এমনকি ক্যামিলও প্রায়ই বলে, তার চেয়েও বুদ্ধিদীপ্ত এই পোর্ট্রেটগুলো। কথাটা একদম ফেলে দেয়ার মত না। পোর্ট্রেটগুলোর পাশে যে কোনো ছবিকে ম্লান মনে হয়। একবার সল হোটেলে, অ্যানিকে এতোটাই সুন্দর লাগছিল, যে তাকে নড়তে চড়তে নিষেধ করে ক্যামিল। দ্রুত মোবাইল বের করে ছবি তুলে নেয়। এরপর থেকে যতবারই কল দেয় অ্যানি, ততবারই ওই ছবিটা ভেসে উঠে ফোনের পর্দায়। পরবর্তীতে ওই ছবির স্থানে জায়গা পায় নিজের আঁকা স্কেচের স্ক্যান করা ছবি, যা আরো জীবন্ত মনে হয় তার কাছে।
সেপ্টেম্বরের শীত এখনো জাঁকিয়ে বসেনি। সন্ধ্যার সময় পৌঁছেছে ক্যামিল। তাই স্টোভে কয়েকটা কাঠের টুকরা দিয়ে দিলো।
বিড়ালটাকে সাথে করে নিয়ে আসা উচিত ছিল। কিন্তু শহরের এদিকটা পছন্দ করে না দুদুশে; ওর জন্য হয় প্যারিস নইলে কোথাও না। ক্যামিলের অনেকগুলো স্কেচেই স্থান পেয়েছে দুদুশে। গতরাতে শোয়ার আগে আরম্যান্ডের সব পোর্ট্রেট খুঁজে বের করেছিল সে। হাসপাতালের বিছানায় মারা যায় আরম্যান্ড। ওই অবস্থার একটা স্কেচ খুঁজে পায় ক্যামিল। মৃত মানুষের অভিব্যক্তিহীন মুখখানা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে স্কেচটার মাঝে
ঠিক সকাল ৭ টা ১৫ মিনিটে ক্যামিলের ফোন বেজে উঠলো। এক হাতে কফির মগ তাই খালি হাতে ধরলো ফোনটা। সাত সকালে ফোন করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলো লুইস।
“ঠিক আছে। কোনো ব্যাপার না। কী হয়েছে, বলো।”
“ম্যাডাম ফরেস্টিয়ে, হাসপাতালে নেই …”
এরপরেই নেমে এলো পিনপতন নিরবতা। যদি কেউ কখনো ক্যামিলের জীবনী লেখার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে বেশিরভাগ অংশ জুড়ে থাকবে তার নিরবতা। এদিকে লুইস এখনো বুঝতে পারছে না, ক্যামিলের জীবনে এই নারীর ভূমিকা কী। সাম্প্রতিক সময়ে তার বসের এই অদ্ভূত আচরণের পেছনে কি এই নারীই দায়ি? সত্যিটা যাই হোক, ভেরহোভেনের নিরবতা তার দূর্দশাগ্রস্ত অবস্থার কথাই জানান দেয়।
“কতক্ষণ আগে বেরিয়েছে?”
“এখনো ঠিক জানি না। তবে রাতের কোনো এক সময়েই হবে। রাত দশটায় সময় এক নার্সের সাথে কথা হয়েছে তার। নার্সের ভাষ্যমতে, তাকে বেশ শান্তশিষ্ট দেখাচ্ছিল। কিন্তু একঘণ্টা আগে কর্তব্যরত নার্স যেয়ে দেখে রুম খালি। ব্যবহার্য জিনিসপত্র সব ঠিকঠাকই ছিল। দেখে মনে হয় আশেপাশেই হাঁটতে বেরিয়েছে সে। তাই রোগি যে হাসপাতালের কোথাও নেই তা বুঝে উঠতে বেশ সময় লেগেছে তাদের।”
“রুমের সামনে অফিসার ছিল না?”
“ওর প্রোস্টেটের সমস্যা আছে। তাই টয়লেটে গেলে একটু বেশিই সময় লাগে।”
কফির মগে চুমুক দিলো ক্যামিল।
“ভিক্টিমের অ্যাপার্টমেন্টে এখনই কাউকে পাঠাও।”
“আপনাকে কল করার আগে আমি নিজেই গিয়েছিলাম,” বলল লুইস। “কেউই দেখেনি তাকে…”
বনের দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে আছে ক্যামিল। তার চোখে গভীর শূন্যতা।
“উনার পরিবারের কাউকে চেনেন?”
ডানে বামে মাথা নাড়লো ক্যামিল। আসলে অ্যানির এক মেয়ে আছে, যে শহরের দিকে থাকে। মেয়েটার নাম মনে করার চেষ্টা করলো ক্যামিল। আগাথা। তবে অ্যানির মেয়ে কিংবা ভাই কারো কথাই না বলার সিদ্ধান্ত নিলো সে।
“যদি কোনো হোটেলে উঠে থাকে তাহলে খুঁজে বের করতে কিছুটা সময় লাগবে,” বলল লুইস, “কোনো বন্ধু-বান্ধবীর বাসায়ও যেতে পারে। এ ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছি আমি।”
“না, বাদ দাও,” দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ক্যামিল। “এটা আমিই দেখছি। তুমি বরং হ্যাফনারের ব্যাপারটা দেখো। নতুন কিছু পেলে?”
“এখনো তেমন কিছুই না। মনে হচ্ছে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ওর সব আস্তানায় খোঁজ নিয়েছি। কোনো চিহ্নমাত্র নেই। আর সাঙ্গপাঙ্গদের সাথেও কথা বলেছি। জানুয়ারির পর ওর টিকিটাও দেখেনি কেউ।”
“ডাকাতির পর থেকে?”
“ওই সময়ের আশেপাশেই হবে।”
“হয়তো দেশ ছেড়ে পালিয়েছে?”
“সাঙ্গপাঙ্গদেরও একই ধারণা। তবে কেউ কেউ অবশ্য বলেছে হ্যাফনার বেঁচে নেই। কিন্তু উপযুক্ত কোনো প্রমাণ মেলেনি। আবার এমনও শোনা যাচ্ছে, সে গুরুতর অসুস্থ। বেশ কয়েকজন একথা বলেছে। কিন্তু গ্যালারি মনিয়েরে যে তাণ্ডব চালিয়েছে, আমার মতে সুস্থ সবলই আছে। এখনো খোঁজ চলছে, তবে আমি খুব একটা আশাবাদী না…”
“রাভিচের ময়নাতদন্ত রিপোর্টের কী খবর?”
“কালকে সকালেই পাওয়া যাবে।
এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইলো লুইস। তার এমন নিরবতার বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। যখনই সামনে থাকা লোকটাকে সবচেয়ে অস্বস্তিকর প্রশ্ন করতে হয়, তখনি এমন নিরবতা পালন করে সে।
“ম্যাডাম ফরেস্টিয়ের ব্যাপারটা…” শুরু করলো সে। “কমিশনার ম্যাডামকে আপনিই জানাবেন না কি আমি?”
“তোমার কষ্ট করতে হবে না। আমিই জানিয়ে দেবো…”
অনেকটা প্রতিক্রিয়াঃবশত উত্তর দিলো ক্যামিল। সিঙ্কের পাশে কফির মগটা নামিয়ে রাখলো। বাকি অংশ শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে লুইস।
“লুইস, অ্যানির ব্যাপারটা আমিই দেখছি।”
চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো লুইস।
“আশা করি আমিই খুঁজে বের করতে পারবো…শীঘ্রই পারবো।”
“বুঝতে পেরেছি,” সায় জানালো লুইস।
স্পষ্ট বার্তা দিয়ে দিলো ক্যামিল। কমিশনার মিচার্ডকে কিছুই বলা যাবে না।
“আমি এখন বের হবো। এক জায়গায় যেতে হবে। কাজ শেষ করে, যত দ্রুত সম্ভব চলে আসবো,” এই বলে বেরিয়ে গেল ক্যামিল।
মেরুদণ্ড বেয়ে ঘামের শীতল স্রোত নামছে। তা স্পষ্ট অনুভব করছে ক্যামিল। তবে, এর পেছনে রুমের তাপমাত্রা দায়ি নয়।
.
সকাল ৭ টা ২০
দ্রুত কাপড় পরে নিলো ক্যামিল। কিন্তু এভাবে তো আর যাওয়া যাবে না। প্রতিবার বের হওয়ার আগে সব তালা একবার করে পরীক্ষা করে সে। সব কাজ একাই করতে হয়। এতে কিছুটা বিরক্ত বোধও হয় তার।
পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে।
“আমি এখনো জেগেই আছি…”
ঘুরে গিয়ে, বিছানার এক কোণায় বসলো ক্যামিল “আমি কি নাক ডাকছিলাম না কি?” মুখ না ঘুরিয়েই জিজ্ঞেস করলো অ্যানি।
“ভাঙা নাক নিয়ে আর কী আশা করো?”
অ্যানির অবস্থা দেখে কিছুটা বিমর্ষ সে। এমনকি হাসপাতালেও মুখ ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতো অ্যানি।
আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকায়ও না। ওর ধারণা ওকে রক্ষা করার ক্ষমতাও নেই আমার।
“এখন আর ভয়ের কিছু নেই। কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না তোমার।”
মাথা নাড়লো অ্যানি। তবে এর মানে কি হ্যাঁ না কি না, তা বলা মুশকিল।
তবে এর উত্তর পেয়ে গেল ক্যামিল।
“আমাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে আসবে ওই খুনি।”
“অসম্ভব অ্যানি। কেউই জানে না তুমি এখানে আছো।”
আবারো মাথা নাড়লো অ্যানি। তবে, এবারের অর্থ বেশ স্পষ্ট। তোমার যা মন চায় বলো। কিন্তু আমাকে খুন করতে আসবেই সে। যত সময় গড়াচ্ছে, এই ভয় আরো চেপে ধরছে অ্যানিকে। তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো ক্যামিল।
“তোমার সাথে যা ঘটেছে, তাতে ভয় পাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু, তোমাকে কথা দিচ্ছি…”
এবার যেন মাথা নেড়ে বলতে চাইছে, কীভাবে যে বোঝাবো তোমাকে? কিংবা বলতে চাইছে : থাক, বাদ দাও।
“যেতে হবে,” ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল ক্যামিল। “তোমার যা যা দরকার, সবকিছু নিচতলায় রাখা আছে…”
স্টুডিওর প্রতিটা কোণা অ্যানিকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে সে। কফিমেকার থেকে শুরু করে বাথরুমও বাদ যায়নি। আর এক কোণায় অ্যানির জন্য ছোটখাট একটা ফার্মেসিই বানিয়ে ফেলেছে। হাসপাতাল ছাড়ার ব্যাপারে মোটেও রাজি ছিল না ক্যামিলকে দেখাশোনা করবে অ্যানির, আর কে বা সেলাই খুলে দেবে? কিন্তু কোনো উপায়ও ছিল না। হাসপাতালে আর এক মুহূর্ত না থাকার ব্যাপারে নাছোড়বান্দা অ্যানি। এমনকি একা একা নিজের বাসায় চলে যাওয়ার হুমকিও দিয়েছে। ওখানে যে কেউ ওত পেতে আছে, সে কথা বলার সাহস পায়নি ক্যামিল। আর কী বা করার ছিল? এখানে ছাড়া আর কোথায় নিয়ে যেতো তাকে?
তারপর থেকে এখানেই আছে অ্যানি।
এর আগে কোনো নারীর পদধূলি পড়েনি এখানে। সাথে সাথে এই চিন্তা বাদ দিলো ক্যামিল। নিচতলায়, দরজার ঠিক কাছেই খুন হয়েছিল আইরিন। চার বছরে সবকিছু বদলে গেছে। সংস্কার করা হয়েছে প্রতিটা কোণা। তবুও যেন কিছু বদলায়নি। নিজেকেও বদলে নিয়েছে ক্যামিল। বেয়াড়া স্মৃতিগুলো সুযোগ পেলেই মাথাচড়া দিয়ে উঠে ।
“তোমাকে যা বলেছি ঠিক তাই করবে,” অ্যানিকে বলল সে, “দরজাটা বন্ধ…”
ক্যামিলের হাতের উপর হাত রাখলো অ্যানি। যেন বলতে চাইছে, এই কথা একবার বলেছো। আর বলতে হবে না। এখন কাজে যাও।
বেরিয়ে গেল ক্যামিল। যাওয়ার আগে দরজার তালা আরেকবার দেখে নিলো সে।
.
সকাল ৮ টা
বন জঙ্গল আমার কখনোই ভালো লাগে না। সবসময় কেমন একটা মন খারাপ করা আমেজ থাকে। আর এটার অবস্থা তো আরো খারাপ। ক্ল্যামার্ট, মিউডন, পৃথিবীর নিকৃষ্টতম জায়গায় আপনাকে স্বাগতম। এই জায়গা নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। নব্য ধনীদের সৌখিন বাড়ি তৈরি কাজ চলছে পুরোদমে।
বাড়িগুলো পার হলেই, যত দূর চোখ যায় শুধু গাছগাছালি আর গাছগাছালি। আমার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যস্থল খুঁজে পেতে, জি.পি.এস সিস্টেমেরও অনন্তকাল লেগে গেছে। আর কারো মনোযোগ এড়িয়ে গাড়ি রাখা প্রায় অসম্ভব। তাই দূরে এক জায়গায় গাড়ি রেখে আবার পিছিয়ে এসেছি আমি।
শরীরে আর এক ফোঁটা শক্তি অবশিষ্ট নেই। খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো না হওয়ার কারণে খুব ক্লান্ত লাগছে। একসাথে অনেক দায়িত্ব মাথায় নিয়ে ফেলেছি। হাঁটাহাঁটি বরাবরই অপছন্দ করি আমি। বিশেষ করে বন জঙ্গলে…
ছোট্ট রাজকন্যার আর একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে। খুব শীঘ্রই তার কাছে পৌঁছে যাবো আমি। আর মনের ভাব প্রকাশের জন্য যা যা দরকার, সবই সাথে করে নিয়ে এসেছি। কাজ শেষ হলেই এমন কোথাও যাবো, যেখানে কোনো বন জঙ্গল নেই। এমনকি আশেপাশের একশো কিলোমিটারের মাঝে কোনো গাছগাছালিও নেই। আমার দরকার সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ, একটা কড়া ককটেল আর কয়েক রাউন্ড পোকার। এতো উত্তেজনা আর সইতে পারছি না। একটু বিশ্রাম দরকার। এদিকে বয়সও বাড়ছে। হাতে যতটুকু সময় আছে, তার যথোপযুক্ত ব্যবহার তো করতে হবে। কিন্তু তার জন্য মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। বিশেষ করে এই বনের মাঝে এর প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি। এই সময়েও এখানে মানুষজনের কোনো কমতি নেই।
যতই গভীরে ঢুকছি, মানুষজনের সংখ্যা ততই কমছে। বাড়িটা রাস্তা থেকে প্রায় তিনশ মিটার দূরে। রাস্তায় কাঁদা থাকার কারণে, পায়ের ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
স্নাইপার রাইফেলের জায়গা হয়েছে স্পোর্টস ব্যাগে। আপাতত বাড়তি মনোযোগ আকর্ষণের কোনো ইচ্ছা নেই।
বিগত কয়েক মিনিট ধরে কোনো মানুষের দেখা পেলাম না। এদিকে জি.পি.এস. ও কাজ করছে না। তবে কাঁদায়, পায়ের ছাপ ঠিকই দেখা যাচ্ছে।
আর কিছুক্ষণের মাঝে মিলিত হবো আমরা দুজন। এবার হিসেব চুকিয়ে ফেলার পালা।
.
সকাল ৮ টা ৩০
প্রতিটা দরজা বাড়ি খাওয়ার শব্দ, হলওয়ে জুড়ে প্রতিটা পদক্ষেপ, অতি উৎসাহী কয়েকজোড়া মুখ—সবকিছু যেন চেপে ধরছে তাকে। ভেতরে ভেতরে ভয়ে কাঁপছে ক্যামিল। অনেক আগেই তার মনে হয়েছিল, কখনো না কখনো এখানে আসতে হবে। তবে এই চিন্তা তখনি বাতিল করে দেয়। কিন্তু শেষমেশ তাই হলো। সমুদের ঢেউ একসময় না একসময় তীরেই আছড়ে পড়ে। অপেক্ষা ছিল উপযুক্ত সময়ের।
তার সামনে, পেছনে, চারপাশে, কেন্দ্রীয় কারাগারের ভারি দরজাগুলো খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে।
পাখির মত ছোট কদমে এগুচ্ছে ক্যামিল। বমি করার ইচ্ছা খুব কষ্টে দমন করলো সে।
ক্যামিলের সাথে যে গার্ড দেয়া হয়েছে, তাকে দেখে বেশ তটস্থ মনে হচ্ছে। উপরের মহল থেকে এমন বিশেষ অনুরোধ তো আর সচরাচর আসে না। তাই ক্যামিলকে একটু বেশিই সম্মান দেখাচ্ছে সে।
পরপর দুটো বিশাল রুম পার হতেই ওয়েটিং রুম। লোহার টেবিলগুলো স্ক্রু দিয়ে মেঝের সাথে লাগানো। একটা টেবিল বেছে নিলো ক্যামিল। তার হৃৎপিণ্ড যেন পাগলা ঘোড়ার মত ছুটছে, গলাটাও শুকিয়ে আসছে। হাতদুটো টেবিলের উপর রাখতেই কাঁপুনি চোখে পড়লো তার। তাই, হাতদুটো টেবিলের নিচে লুকিয়ে ফেলল সে।
রুমের শেষ প্রান্তে একটা দরজা খুলে গেল। শুরুতে হুইলচেয়ারে একজোড়া চকচকে কালো জুতো ছাড়া কিছুই চোখে পড়লো না ক্যামিলের। এরপর যেন চলতে শুরু করলো হুইলচেয়ার। একে একে দৃশ্যমান হলো পা আর মাংশল একজোড়া হাত। আর এক মিটার এগুতেই ক্যামিলের নজরে এলো কাঙ্ক্ষিত লোক।
এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল লোকটা। রুমে ঢোকার সাথে সাথে, ক্যামিলের দিকে একনজরে তাকিয়ে আছে সে।
হুইলচেয়ারের জায়গা দেয়ার জন্য কয়েকটা চেয়ার সরিয়ে দিলো গার্ড। ক্যামিলের হাতের ইশারায় চলে গেল সে।
আরেকটু এগিয়ে এলো হুইলচেয়ারে থাকা লোকটা।
অবশেষে একে অপরের মুখোমুখি হলো দুজন।
চার বছরের মাঝে প্রথমবারের মতো, আইরিনকে নৃশংসভাবে খুন করা লোকটার সামনাসামনি হলো ক্রিমিনাল ব্রিগেডের কম্যান্ড্যান্ট, ক্যামিল ভেরহোভেন।
চার বছর আগের সেই লোক আর এর মাঝে বিস্তর ফারাক। লম্বা আর হাড় জিরজিরে লোকটার চেহারায় কামুক ভাব ছিল সুস্পষ্ট। কিন্তু, ক্যামিলের সামনে যে কয়েদি বসে আছে, তার স্বাস্থ্যের বেশ উন্নতি হয়েছে। কামুক ভাবটা মাংশল গালের নিচে চাপা পড়েছে। মাথার চুল বেশ লম্বা আর এলোমেলো। চোখে ধূর্ততার ছাপ এখনো সুস্পষ্ট।
“এটাই নিয়তির লিখন।” বেশ উঁচু স্বরেই বলল বুসন, গলা কাঁপছে তার। “সেই সময় চলে এসেছে,” কথাটা এমনভাবে বলল, যেন আলোচনার সমাপ্তি টানছে সে।
নিজের স্বর্ণালী সময়ে, এই ছোট ছোট বাক্যবাণ নিয়ে বেশ গর্ববোধ করতো সে। এক অর্থে, এই বাক্যবাণে অন্যকে বিদ্ধ করার স্বাদ পেতেই, সাত সাতটা খুন করেছে। ক্যামিল আর তার মাঝে চলেছে মনস্তাত্ত্বিক এক লড়াই। আর, ইতিহাস ঘাটলেই পরবর্তি ফলাফল সম্পর্কে জানা যায়। কিন্তু, এখন পুরোনো কাসুন্দি ঘাটার সময় নয়।
“হ্যাঁ,” স্বাভাবিকভাবেই বলল ক্যামিল। “সেই সময় চলে এসেছে।”
কণ্ঠস্বর একটুও কাঁপলো না ক্যামিলের। বুসনের বিপরীতে বসে নিজের সহজাত বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে সে। মুখোমুখি এমন বাকযুদ্ধের প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে তার। সে ভালোমতোই জানে, মাথা ঠাণ্ডা রেখেই কাজ করতে পারবে। সামনে থাকা লোকটাকে কল্পনায় অগণিত বার কষ্টে জর্জরিত অবস্থায় মরতে দেখেছে সে। কিন্তু সামনাসামনি পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বুসনের প্রতি শত্রুতা অনুভব করলেও, সেখানে আবেগের আতিশয্য নেই। বছরের পর বছর, আইরিনের খুনির প্রতি তীব্র ঘৃণা আর ক্ষোভ পুষেছে মনের ভেতর, কিন্তু এখন আর কিছুই নেই।
কারন, বুসনের জীবন শেষ।
কিন্তু, ক্যামিলের জীবন, তার গল্প, এখনো ফুরোয়নি।
আইরিনের মৃত্যুর জন্য এখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি ক্যামিল। এই বোঝা সারজীবন বইতে হবে তার। সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাড়া করে বেরায় তাকে। এই সহজ সত্য, যা অন্য সব কিছুকে তুচ্ছ করে দেয়।
এসব ভাবতেই ক্যামিলের চোখ ছলছল করে উঠলো। সময়ের সাথে সাথে তার বয়স বাড়ছে; কিন্তু আইরিন চিরযৌবনা। আইরিনের প্রতিটা স্পর্শ এখনো অনুভব করতে পারে সে। এই স্মৃতিটুকু তার নিজস্ব সম্পদ। আর বুসন চাইলেও এর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
এক অদৃশ্য ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে ক্যামিল।
স্থির হয়ে বসে আছে বুসন। শুরু থেকেই ভয়ে কুঁকড়ে আছে সে।
তীব্র মানসিক যন্ত্রণা দ্রুতই কাটিয়ে উঠলো ক্যামিল। বুসনকে এসবের কিছুই বুঝতে দিতে চায় না সে। দুজনেই চুপচাপ বসে আছে, যেন চোখে চোখে বাক্য বিনিময় করছে। তবে এই নিরবতা দুজনের জন্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে, স্ত্রীর খুনির সাথে বেশি সময় কাটানোর ইচ্ছা নেই ক্যামিলের। তাই নাক ঝেড়ে টিস্যুটা পকেটে রাখলো সে। এরপর টেবিলের উপর কনুই রেখে হাত দুটো ভাজ করে, মুখের ভারটা তালুর উপর দিয়ে দিলো।
গতকাল থেকেই এই সময়ের অপেক্ষায় ছিল বুসন। যখনই জানতে পেরেছে মলুদ ফাউইয়ের সাথে দেখা করেছে ক্যামিল, তখনই বুঝতে পেরেছে এবার তার পালা। সারারাত এপাশ ওপাশ করেছে। একফোঁটা ঘুম হয়নি তার। কোনোভাবেই যেন ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার মৃত্যু এখন শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র। শহরের আনাচে কানাছে ছড়িয়ে আছে ফাইউয়ের গুপ্তচর বাহিনী। একটা তেলাপোকাও এদের থেকে লুকিয়ে থাকতে পারবে না। যার কারণে ফাউইয়ের এই দুর্দশা, তার নাম জানার বিনিময়ে ক্যামিলের সাথে যদি বোঝাপড়া হয়েই যায়-তাহলে কয়েকটা পথই খোলা থাকবে বুসনের সামনে। হয়তো ডাইনিং হল থেকে বের হবার পথে পেছনে থেকে কেউ জাপটে ধরে গলায় ছুড়ি ঢুকিয়ে দেবে কিংবা তৃতীয় তলা থেকে কেউ ধাক্কা দিয়ে হুইলচেয়ারসহ নিচে ফেলে দেবে। ম্যাট্রেস দিয়ে শ্বাসরোধ করার সম্ভাবনাও বাদ দেয়া যাবে না। উপর মহলের নির্দেশের উপর সবকিছু নির্ভর করবে। তবে কোনোটাই তার জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
চোখের সামনে নিজের মৃত্যু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বুসন। এতো দ্রুত মরতে চায় না সে।
এতোদিনে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, প্রতিশোধের জন্য ফিরে আসবে না ক্যামিল। বহু বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা ভয়ের অনুভূতি যেন বন্যার জলের মত ভেসে আসছে। বছরের পর বছর জেলে থেকে অনেক কিছু সহ্য করেছে সে। কয়েদিদের মাঝে সম্মানজনক অবস্থায় তৈরি করে ফেলেছে। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে ভেরহোভেন। ফাউইয়ের সাথে একবার দেখা করেই নিজ ক্ষমতার জানান দিয়েছে ক্যামিল। এদিকে বুসনও বুঝতে পেরেছে, তার জীবনের গল্পের সমাপ্তি সন্নিকটে। ইতোমধ্যে কয়েদিদের মাঝেও নানা ধরনের কথাবার্তা শুরু হয়ে গিয়েছে। অনেকেই বুসনের দিকে বাকা নজরে তাকানো শুরু করেছে।
কিন্তু এখন কেন? এই প্রশ্নটাই তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।
“শুনলাম, খুব নাকি বড় নেতা হয়েছিস…”
চিন্তায় মগ্ন বুসন। একবার ভাবলো, এটাই কি তার প্রশ্নের উত্তর। পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝতে পারলো সে। কথাবার্তা শুরুর চেষ্টা করছে ক্যামিল। প্রখর বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন বুসন। পালানোর সময় লুইসের একটা গুলি তার মেরুদণ্ড বরাবর লাগে। যার কারণে আজ সে হুইলচেয়ারে বন্দি। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত পুলিশকে বাঁদর নাচ নাচিয়েছে। জেলখানার পৌঁছানোর আগেই তার কুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। ক্রিমিনাল ব্রিগেডকে এতোদিন যাবত ঘোল খাওয়ানোর কারণে কয়েদিদের মাঝে রাতারাতি তারকা বনে যায় সে। এই খ্যাতি কাজে লাগিয়ে নিজেকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যেতেও সময় লাগেনি তার। বিভিন্ন দলের মারামারি থেকে সবসময় নিজেকে দূরে রেখেছে। কয়েদিদের জন্য ছোটখাটো কাজ করে দিয়েছে। জেলখানার তার মতো বুদ্ধিমান আর চতুর লোকের দেখা খুব একটা মেলে না। কয়েক বছরের মাঝেই জেলখানার ভেতর বাহিরে শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। গত বছরেই, দুল দলের মাঝে সম্ভাব্য এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঠেকাতে মধ্যস্থাকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তার। জেলখানার ভেতরে কোনো অবৈধ কাজকর্মে জড়িত না থাকলেও সব খবরই রাখে। আর বাঘা বাঘা কয়েকজন অপরাধীর সাথেও ভালো সম্পর্ক আছে তার। একারণে, অন্যতম শক্তিশালী এক লোকে পরিণত হয়েছে সে।
কিন্তু, ক্যামিলের একটা সিদ্ধান্তের কারণে সব কিছুই এখন অর্থহীন লাগছে বুসনের কাছে। হয়তো আগামী কয়েকদিনের মাঝেই তার লাশ খুঁজে পাওয়া যাবে।
“তোকে বেশ চিন্তিত লাগছে?”
“না, আমি অপেক্ষা করছি।”
নিজের শেষ কথাটার জন্য অনুতাপ বোধ করলো বুসন। শুরুতে চ্যালেঞ্জের মত শোনালেও, এখন পরাজয়ের অপেক্ষাই মনে হচ্ছে। হাত তুলল ক্যামিল, যেন বলতে চাইছে, সমস্যা নেই, বুঝতে পেরেছি।
“আসলে আমি বলতে চাইছি…”
“না,” বলল ক্যামিল, “কোনো ব্যাখ্যা শুনতে ইচ্ছুক না আমি। পরবর্তী পরিস্থিতি কেমন হবে শুধু সেটাই বলতে এসেছি।”
বুসনের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। এমনকি ভেরহোভেনের অস্বাভাবিক রকমের ঠাণ্ডা মেজাজও তার কাছে হুমকির মত লাগছে। খুব অসহায়বোধ হচ্ছে তার।
“জানার অধিকার তো আমার আছে!” গর্জন করে উঠলো বুসন।
শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও অহংকার এক ফোঁটাও কমেনি তার। পকেট থেকে একটা ছবি বের করে টেবিলের উপর রাখলো ক্যামিল।
“ভিনসেন্ট হ্যাফনার। এই লোক…”
“আমি জানি সে কে…” কথাটা এমনভাবে বলল, যেন অপমানিত বোধ করছে। একইসাথে একটু প্রশান্তিও অনুভব করলো। এক মুহূর্তের জন্য যেন আশার আলো দেখতে পেল বুসন।
নিজ কণ্ঠের সহজাত বৈশিষ্ট্য ধরে রাখলো ক্যামিল। কিন্তু কোনো মন্তব্য করলো না। এমনটাই আশা করেছিল বুসন।
রক্ষণাত্মক কৌশল অবলম্বন করলো সে।
“ব্যক্তিগতভাবে তাকে চিনি না আমি…তেমন কোনো বড় খেলোয়াড় না হলেও হেলাফেলা করার মতোও কেউ না। তবে মাঝে মাঝেই… হিংস্র হয়ে উঠে সে।”
“গত জানুয়ারিতে নিখোঁজ হয় হ্যাফনার,” বলল ক্যামিল। “মাসের পর মাস পার হয়ে গিয়েছে। কেউ ওর খবর জানে না। এমনকি সাগরেদরাও না। যেন ভোজবাজির মত মিলিয়ে গিয়েছে। তারপর হঠাৎ করেই দেখা মিলল তার। নিজের পুরোনো রূপে ফিরে এলো।”
“এখানে অবাক হওয়ার কী আছে?”
“ভোজবাজির মত গায়েব হয়ে যায়। আবার ধূমকেতুর মত ছুটে আসে। বিষয়টা আমাকে ভাবাচ্ছে। এই ধরনের অপরাধীর আবার ফিরে আসার ব্যাপারটা ঠিক মিলছে না।”
“তারমানে, কোনো একটা ঝামেলা আছে।”
ক্যামিলের মুখে যেন আঁধার নেমে এলো। তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে, নিজের উপর কিছুটা বিরক্ত।
“এভাবেও বলা যায়, কোনো একটা ঝামেলা আছে। কিংবা কিছু একটা আমার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে।”
বুসনের মুখের ক্রুর হাসি দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো ক্যামিল। বুঝতে পারলো, বুসনের মাত্রাতিরিক্ত দাম্ভিকতার উপর বিশ্বাস করে ভুল করেনি সে। এই অহংকারী মনোভাবের কারণেই, একের পর এক খুন করেছে সে। এমনকি শেষ পর্যন্ত ধরাও খেয়েছে। ঠিক এই কারণেই জেলের ভেতর পঁচে মরবে সে। এতো কিছুর পরেও নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়নি। এই অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী মনোভাব অতল এক খাঁদের মত। বুসনকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করার অপেক্ষায় আছে। “কিছু একটা আমার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে।” ক্যামিলের এই বুদ্ধিদীপ্ত বাক্য বিশেষ উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হয়েছে। তা বেশ দ্রুতই সফলতার মুখে দেখলো।
“হয়তো পকেট ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। দ্রুত তা পূরণ করা দরকার…
নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো ক্যামিল। বুসনের ছলচাতুরি সহ্য করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে ক্যামিলের। এখনই বুসনের টুটি চেপে ধরতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু এই মনোভাব আপাতত প্রকাশ করতে চাইছে না। তাই মুখ তুলে বুসনের দিকে এমনভাবে তাকালো, যেন মনোযোগ দিয়ে শুনছে সে।
“ভাসা ভাসা খবর শুনেছি, হ্যাফনার নাকি বেশ অসুস্থ…” ধীরে ধীরে বলল বুসন।
যুদ্ধে নামলে তার শেষ দেখে নেওয়া ক্যামিলের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য।
“তাহলে তো ভালো, আশা করি খুব শীঘ্রই মৃত্যু সংবাদও পাওয়া যাবে,” বলল ক্যামিল।
“সহজ জিনিসটা চোখে পড়ছে না?” বিজয়ীর ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠলো বুসন। “হ্যাফনার এখন ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে আছে। এক মেয়ের সাথে জড়িয়ে পড়েছে…আর এমনই এক বেশ্যার সাথে জড়িয়েছে, যে উনিশ বছরের মাঝেই নিজের রূপ আর শরীর দিয়ে, শহরের অর্ধেকটা কব্জা করে ফেলেছে। পুরুষকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোতে ওর জুড়ি মেলা ভার। হ্যাফনারের এমন অস্বাভাবিক আচরণের কারন, এছাড়া আর কী বা হতে পারে…”
বুসনের এমন ব্যাখ্যায় বিস্মিত হলো ক্যামিল ।
“ওই বেশ্যার মনের খবর তো জানি না। তবে হ্যাফনার যে প্রেমে পড়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ভালোবাসা বড্ড শক্তিশালী জিনিস, তাই না, কম্যান্ড্যান্ট? আর যদ্দুর মনে পড়ে, এই বিষয়ে আপনার জানাশোনাও কম না…”
ভেতরটা চুরমার হয়ে গেল ক্যামিলের। যদিও তা প্রকাশ করলো না। আইরিনের খুন নিয়ে উচ্ছ্বসিত বুসনকে দেখে, তার কষ্টের মাত্রা আরো বেড়ে গেল। “ভালোবাসা, কম্যান্ড্যান্ট…”
কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে বুসন। তার মুখের উচ্ছ্বসিত হাসি মুছে গেল।
“হ্যাফনার যদি গুরুতর অসুস্থ হয়েই থাকে,” কথা চালিয়ে গেল সে, “মৃত্যুর পর তার ভালোবাসার মানুষটা যেন অর্থকষ্টে না পড়ে সেই ব্যবস্থাই করছে চাচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ মানুষটাও ভালোবাসার জন্য কী না করতে পারে…”
এই খবর ক্যামিলকে আরো আগেই দিয়েছে লুইস। খবরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বেশ বড় মাশুলই গুণতে হলো ক্যামিলের। তবুও তার কষ্ট স্বার্থক। শত অন্ধকারের মাঝেও, আশার আলো দেখতে পাচ্ছে সে। ক্যামিলের চোখে মুখের স্বস্তি বুসনের চোখ এড়ায়নি। ইতোমধ্যে তার মনের মাঝে নানা ধরনের প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। কম্যান্ড্যান্টের কাছে এই ব্যাপারটা এতো গুরুত্বপূর্ণ কেন? হ্যাফনারের ভূমিকাই বা কী? কী এমন হলো, যার কারণে এখানে ছুটে আসতে বাধ্য হলো কম্যান্ড্যান্ট? এই পরিস্থিতির ফায়দা কীভাবে নেয়া যায়, তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করলো বুসন।
তাকে সময় দিলো না ক্যামিল।
“যে করেই হোক হ্যাফনারকে চাই আমি। এখনই চাই। তোর হাতে ঠিক বারো ঘণ্টা সময় আছে।”
“এ-এটা অসম্ভব!” করুণ এক আর্তনাদ, বুসনের গলাতেই আটকে গেল। ক্যামিল উঠে দাঁড়াতেই, জীবন বাঁচানোর শেষ সুযোগটাও হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হলো তার। হুইলচেয়ারে ঘুসি মারলো সে। এদিকে ক্যামিলের মুখ অভিব্যক্তিহীন।
“বারো ঘণ্টার এক সেকেন্ডও বেশি না। সময়সীমা বেঁধে দিলেই দ্রুত কাজ আগায়। অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে।”
দরজায় টোকা দিলো ক্যামিল। দরজা খোলার জন্য গার্ড এগিয়ে আসতেই, বুসনের দিকে ঘুরলো সে।
“সবকিছু শেষ হওয়ার পরে আমি চাইলেই খুন করতে পারি তোকে। “ কথাটা বলার পর দুজনেই বুঝতে পারলো, এটা শুধু বলার জন্যেই বলা। এমনটা হওয়ার থাকলে, ইতোমধ্যেই খুন হয়ে যেতো বুসন। আর কাউকে হত্যার সমন জারি করা ক্যামিলের মত কারো পক্ষে সম্ভব না।
এদিকে বিপদ কেটে যাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো বুসন। একইসাথে ভেরহোভেনের কাজটাও শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলো।
জেলখানা থেকে বেরিয়ে অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করলো ক্যামিল। যেন ডুবন্ত জাহাজ থেকে বেঁচে ফেরা একমাত্র যাত্রী সে।
.
সকাল ৯ টা
এমনিতেই হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত আমি। এরমাঝে কনকনে শীতে অবস্থা আরো খারাপ। হাত একদম জমে গেছে। এমন অবস্থায় লক্ষ্যভেদ করা প্রায় অসম্ভব। তবে আশার কথা হচ্ছে, জায়গাটা বেশ নীরব। বিল্ডিংটা বেশ বড়। ছাদটাও উঁচু। সামনে একদম পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। বাড়ির বাইরের দিকে, ছোট একটা ছাউনির পাশে আশ্রয় নিলাম আমি। দেখে মনে হচ্ছে কোনো এক সময় খরগোশের আবাসস্থল ছিল এটা।
স্নাইপার রাইফেলটা সুবিধাজনক জায়গায় রেখে, ওয়ালথার আর হান্টিং নাইফ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আশপাশটা ঘুরে দেখতে হবে। রেকি করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পারিপার্শ্বিক ক্ষয়ক্ষতি যতটা কম হয়, ততই ভালো। একবারেই লক্ষ্যভেদ করতে পারলে তো সোনায় সোহাগা। একদম নিখুঁত কাজ। কী যেন বলে ওটাকে? ওহ, হ্যাঁ, “সার্জিকাল স্ট্রাইক”। এখানে মসবার্গ ব্যবহার করা, অনেকটা মশা মারতে কামান দাগানোর শামিল
বাড়ির ঠিক ডান পাশেই টিলার মত উঁচু এক জায়গা। বৃষ্টির কারণে মাটি ধুয়ে যাওয়ায় ভাঙা ইট, পাথরকুচি বেরিয়ে এসেছে। বাড়ি তৈরির পর এগুলো পরিস্কার করে ফেলার কথা। কেউ না কেউ তো দায়িত্বে অবহেলা করেছে। এসব নিয়ে এতো ভাবার সময় নেই। আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি আমার। স্নাইপার বসানোর জন্য জায়গাটা মোটেও উপযুক্ত না, কিন্তু অন্য কোন উপায়ও নেই। এখান থেকে বাড়ির অনেকাংশই দেখা যাচ্ছে। গুলি করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আমার।
ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার শিকারের দেখা পেয়েছি। কিন্তু দ্রুতই অন্য ঘরে চলে যাচ্ছে সে। আমি অবশ্য খুব একটা বিরক্ত হচ্ছি না। তাড়াহুড়োর কিছুই নেই। তারচেয়ে, কাজটা ঠিকমতো শেষ করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
***
বিছানা ছেড়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল অ্যানি। ঠিকমতো তালা লাগানো আছে কি না তা দেখে নিলো। এই বাড়িতে বেশ কয়েকবার চুরি হয়েছে। এমন নির্জন জায়গায় চুরির ব্যাপারটা অবাক করার মত। এরজন্য লোহার দরজা লাগিয়েছে ক্যামিল। আর জানালাতেও ব্যবহার করা হয়েছে উচ্চ আঘাত সহনশীল কাচ।
“এটা অ্যালার্মের কোড,” অ্যানির হাতে একটা কাগজ দিয়ে বলেছিল ক্যামিল। “প্রথমে হ্যাশ, তারপর এই নাম্বার, শেষে আবার হ্যাশ। এটা চাপলেই অ্যালার্ম বন্ধ হয়ে যাবে। স্থানীয় থানায় কোনো সংকেত যাবে না। আর বাজবেও সর্বোচ্চ এক মিনিট। আপাতদৃষ্টিতে খুব একটা কাজের মনে না হলেও বিশ্বাস করো, এতেই ভয় পেয়ে পালাবে চোরের দল।”
নাম্বারটা হলো ২৯০৯১৫৭১। এর মর্মার্থ জানার ইচ্ছে হয়নি অ্যানির।
“কারাভাজিও’র জন্মদিন…” নিচু স্বরে বলল ক্যামিল। “নাম্বারটা যথেষ্ট নিরাপদ মনে হয়েছে আমার কাছে। এই ব্যাপারে খুব বেশি মানুষ জানে না। কিন্তু যেমনটা বলছিলাম, আশা করি এটা লাগবেও না তোমার।”
বিল্ডিঙয়ের পেছন দিকটাও ঘুরে এলো অ্যানি। একটা লন্ড্রি আর বাথরুম আছে ওখানে। বাইরের দিকের একমাত্র দরজাটা স্টিলের তৈরি। দরজাটা চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এসব শেষে গোসল সেরে নিলো সে। আঙুলের বর্তমান অবস্থার কারণে মাথার চুল ভালোমতো পরিস্কার করা প্রায় অসম্ভব। দুই একবার যে চেষ্টা করেনি, তাও না। তবে অসহ্য ব্যথার কারণে গুমরে কেঁদে উঠেছে অ্যানি। আঙুলের এই করুণ দশার কারণে, ছোট কোনো জিনিস তুলতেও কালোঘাম ছুটে যাচ্ছে তার। বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির অবস্থা বেশি খারাপ। তাই ডান হাতেরটা দিয়েই টুকটাক কাজ চালিয়ে নিচ্ছে সে।
***
সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছে ক্যামিল। একটু বেশিই সতর্কতা অবলম্বন করছে সে। রাস্তার এই দিকটা নির্জন হওয়ায় চালকেরা প্রায়ই গতি বাড়িয়ে দেয়। অন্যমনস্ক হয়ে আছে সে; এদিকে মূল সড়কে ওঠার আগে গাড়ির গতি ক্রমশই কমছে। পেছন থেকে ধেয়ে আসছে হর্নের বিকট শব্দ, অশ্রাব্য গালিগালাজ। একটা বিষয় মাথা থেকে কিছুতেই দূর করতে পারছে না। গত রাত যে নারীর সাথে কাটিয়েছে, তার সম্পর্কে কী জানে সে? একজন আরেকজনকে কতটুকুই বা চেনে?
সাথে সাথে মনে করার চেষ্টা করলো, তার সম্পর্কে কী কী জানে অ্যানি। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোই জানিয়েছে অ্যানিকে। আইরিন, তার মা আর বাবা। ক্যামিলের জীবনটা খুব সাধারণ। আইরিনের মৃত্যুই আর দশটা সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা করেছে তাকে।
অ্যানির ব্যাপারে খুব বেশি কিছু জানে না সে : কর্মস্থল, বিয়ে, একমাত্র ভাই, বিবাহ বিচ্ছেদ আর একটা বাচ্চা।
এই বিষয়ে ভাবতে ভাবতে মাঝের লেনে ঢুকে পড়লো ক্যামিলের গাড়ি। পকেট থেকে মোবাইল বের করলো সে। এরপর চার্জে দিয়েই ব্রাউজার চালু করলো। মোবাইলের স্ক্রিন বেশ ছোট। চশমা খুঁজতে গিয়ে হাত থেকে ফসকে গেল মোবাইল। প্যাসেঞ্জার সিটের নিচে হাতড়ে বেড়ালো কিছুক্ষণ। চার ফুট এগারো ইঞ্চির লোকের জন্য কাজটা মোটেও সহজ নয়।
মোবাইল খোঁজার সুবিধার্থে গাড়ির গতি আরো কমিয়ে দিলো ক্যামিল। এক মুহূর্তের জন্য থামেনি তার চিন্তাভাবনা।
অ্যানির ব্যাপারে কতটুকু জানে সে?
একটা ট্র্যাভেল এজেন্সিতে কাজ করে। এক মেয়ে আর এক ভাই আছে।
এছাড়া আর কী?
হুট করেই কেমন একটা অনুভূতি হলো তার। মনের মাঝে সতর্ক সংকেত বেজে উঠলো।
তার মুখের ভেতরটাও কেমন শুকিয়ে আসছে।
শেষমেশ মোবাইলে উদ্ধারে সফল হলো ক্যামিল। সাথে সাথে ‘ভার্টিগ অ্যান্ড শুইন্ডেল’ লিখে সার্চ দিলো ।
কিছুটা ঘাবড়ে গেছে ক্যামিল। ওয়েবসাইট লোড হওয়ার অপেক্ষায় আছে। পাম গাছ আর সমুদ্রের ছবি দেখা যাচ্ছে। এমন সময়ে বিকট শব্দ করে আর্টিকুলেটেড এক লরি তার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। একটু কেঁপে উঠলেও স্ক্রিন থেকে চোখ সরলো না তার। “সি.ই.ও. এর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছাবার্তা, আমাদের ওয়েবসাইটে স্বাগতম।” অবশেষে কোম্পানির কর্মকর্তাদের নাম ভেসে উঠলো। ব্যবস্থাপক, জন-মাইকেল ফাই, বয়স ত্রিশের কাছাকাছি, মেদবহুল শরীর, চেহারায় আত্মতুষ্টির ছাপ স্পষ্ট।
অ্যানির খোঁজে ওয়েবপেজে স্ক্রলিং শুরু করলো ক্যামিল। বেশ কয়েকটা ছবি চোখে পড়লো তার। হুট করেই সাইরেনের শব্দ কানে এলো। মোটরসাইকেলে থাকা এক পুলিশ তাকে গাড়ি থামানোর ইশারা করলো। ক্যামিলের হাত থেকে মোবাইলটা আবারো পড়ে গেল। ধ্যাত্তেরি।
একটু সামনে নিয়ে গাড়ি থামালো ক্যামিল। যন্ত্রণা দেয়াই যেন পুলিশের একমাত্র দায়িত্ব।
***
ক্যামিল একা থাকার কারণে স্টুডিওতে মেয়েদের নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছুই নেই। এমনকি একটা আয়নাও নেই। চায়ের তৃষ্ণা হওয়াতে একটা মগ তুলে নিলো অ্যানি। চায়ের মগে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু একটা লেখা।
মেয়াদ উত্তীর্ণ হারবাল চায়ের একটা প্যাকেট খুঁজে পেল সে।
সাথে সাথেই বুঝতে পারলো এই বাসায় প্রতিটা পদক্ষেপ ভেবে চিন্তে নিতে হবে। সবচেয়ে সহজ কাজটা করতেও একটু বেশি পরিশ্রম করতে হবে। চার ফুট এগারো ইঞ্চির এই লোকের বাসায় সবকিছুই স্বাভাবিকের থেকে একটু নিচু। দরজার হাতল, ড্রয়ার, লাইটের সুইচ…তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে—কয়েক রকমের টুল আর মই। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, কোনোটাই ক্যামিলের উচ্চতার সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ না। ভবিষ্যতে কারো সাথে থাকার সম্ভাবনা পুরোপুরি বাতিল করেনি ক্যামিল। তাই সবকিছু এমনভাবে তৈরি করা, যাতে ভবিষ্যতের সঙ্গীর কোনো অসুবিধা না হয়।
বিষয়টা বুঝতে পারার সাথে ভিন্ন এক অনুভূতি হলো অ্যানির। কেউ যেন তার হৃৎপিণ্ডে ছুরি চালিয়েছে। ক্যামিলের প্রতি কখনোই করুণা বোধ করেনি সে। কিন্তু, এখন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো। অপরাধবোধে ছেয়ে গেল তার মন। অন্য সময়ের চেয়ে এখনো আরো বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো সে। কিছুক্ষণের মাঝে নিজেকে সামলে নিলো।
কান্নাকাটি অনেক হয়েছে। এবার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা করলো সে।
হারবাল চা সিংকে ফেলে দিলো সে। নিজের উপর খানিকটা বিরক্ত।
অ্যানির পরনে বেগুনি রঙের পায়জামা আর পোলো গলার জাম্পার। কাপড় বলতে এই দুটোই আছে এখানে। হাসপাতালে যাওয়ার পর, রক্তাক্ত জামাকাপড় ওখানেই ফেলে দিয়েছে। আর বাসা থেকে যে কাপড় নিয়েছিল, তা হাসপাতালেই রেখে আসার সিদ্ধান্ত নেয় ক্যামিল। যাতে করে মনে হয়, অল্প সময়ের জন্য আশেপাশে কোথাও গিয়েছে অ্যানি। এরপর ক্যামিলের পরিকল্পনা অনুসারেই রিসেপশন ডেস্কের পেছন দিয়ে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় চলে আসে অ্যানি। বাকি দায়িত্ব সুচারুভাবেই সম্পন্ন করে ক্যামিল।
আজকে রাতে ফেরার সময় কিছু কাপড়চোপড় আনার কথা বলেছে ক্যামিল। কিন্তু রাত যেন এখনো অনন্তকাল দূরে। যুদ্ধরত সৈনিকদের মাথায় হয়তো সারাক্ষণ একই প্রশ্ন ঘুরপাক খায় : আজই কি আমার শেষ রাত?
ক্যামিলে যেহেতু বলেছে, তার মানে সে আনবেই। এটা ভালোমতোই জানে অ্যানি। প্রশ্ন শুধু একটাই; কখন? ক্যামিল যাবার পর থেকেই সময় যেন থমকে আছে। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে হাঁটাহাঁটি করছে অ্যানি। বনের অসীম নিরবতা যেন আঁকড়ে ধরেছে তাকে।
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে, বনের রূপ একদম বদলে গেল। সন্ধ্যার রহস্যময় আলোয় বনটাকে পরাবাস্তব কিছু মনে হচ্ছে অ্যানির। তাই মুখ ঘুরিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল সে, কিন্তু বারবারই এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে টেনে ধরে রাখছে। হুট করেই ‘দি টার্টার স্টিপ’ বইয়ের দ্রোগোর কথা মনে পড়লো তার। পরিত্যাক্ত নির্জন এক ভূমির এক কোণায়, শত্রুর জন্য অপেক্ষা করছে দ্রোগো।
***
পুলিশরা মোটেও বোকা না।
গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে ক্যামিলকে চিনতে পারলো, মোটর সাইকেলে থাকা পুলিশ অফিসার। সাথে থাকা এক সহকর্মীকে নিয়ে কিছুটা পথ এগিয়ে দেবার প্রস্তাবও জানালো। অবশ্য তার আগে সতর্কবাণী শোনাতেও ভুলল না, “আপনি তো বোঝেনই, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ব্যবহার করা অত্যন্ত বিপজ্জনক, কম্যান্ড্যান্ট। ক্রিমিনাল ব্রিগেডের গোয়েন্দা হওয়ার কারণে সবকিছু তো বৈধ হয়ে যায় না। আপনার জন্য একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। যত জরুরি কাজই থাকুক না কেন, এমনটা করা যাবে না।”
তবে অফিসার দুজনের সাহায্যের কারণে রাস্তায় প্রায় আধা ঘণ্টা সময় বাঁচলো ক্যামিলের। এই সময়েও মোবাইলের স্ক্রিন থেকে তার চোখ সরেনি। তবে এবার আরেকটু সতর্কতা অবলম্বন করলো। কিছুদূর আসার পর তাকে বিদায় জানালো পুলিশ অফিসার। প্রায় দশ মিনিট খোঁজাখুঁজির পর বুঝতে পারলো, ‘ভাটিগ অ্যান্ড শুইন্ডেল’ কোম্পানির কর্মচারির তালিকায় অ্যানি ফরেস্টিয়ের নাম নেই। সন্দেহ দূর করার জন্য আবার খোঁজার সিদ্ধান্ত নিলো সে। বুঝতে পারলো, ২০০৫ সালের পর এই ওয়েবসাইট আপডেট করা হয়নি। আর সেই সময় লিওতে থাকতো অ্যানি।
গাড়ি থেকে নেমে অফিসের দিকে এগিয়ে গেল ক্যামিল। সিঁড়িতে পা দিতেই তার ফোন বেজে উঠলো।
গুয়েরিন। উল্টো ঘুরে বাইরের দিকে চলে এলো ক্যামিল। সে চায় না, এই কথোপকথন অন্য কেউ শুনে ফেলুক।
“দ্রুত ফোন করার জন্য ধন্যবাদ,” উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জবাব দেয়ার চেষ্টা করলো ক্যামিল।
ঘুরিয়ে পেচিয়ে না বলে, সরাসরি মূল বিষয়ে চলে এলো ক্যামিল। সহকর্মীকে দুশ্চিন্তায় ফেলার কোনো ইচ্ছা নেই তার। কিন্তু তাই বলে, সত্যিটাও এড়ানো যাবে না : আমার একটা দরকারেই ফোন করেছি। বিষয়টা একটু খুলেই বলি। কিন্তু তার কোনো দরকার নেই। গুয়েরিন ইতোমধ্যেই সব জেনে গেছে। হয়তো একই কারণে, কমিশনার মিচার্ড ফোন দিয়ে না পাওয়ায় তাকে ভয়েস মেসেজ দিয়ে রেখেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই হয়তো কমিশনারকে ফোন দেবে। একটা পর্যায়ে বলতে বাধ্য হবে, ক্যামিলকে গ্যালারি মনিয়েরের ডাকাতির ব্যাপারে জানানো তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব না :
“গত চারদিন ধরে ছুটিতে আছি, বন্ধু…এখন সিসিলিতে। দারুণ সময় কাটছে।”
হায় ঈশ্বর! নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছে ক্যামিল।
“চিন্তার কিছু নেই। এমনিই খোঁজ খবর নেয়ার জন্য ফোন দিয়েছিলাম, “ এই বলে ফোন রেখে দিলো ক্যামিল। চিন্তার ঝড় শুরু হয়েছে তার মাথায়। কেননা, গুয়েরিনের সাথে কথা বলার পরেও তার দুশ্চিন্তা কমেনি।
“শুভ সকাল, কম্যান্ড্যান্ট!” সম্ভাষণ জানালো তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট।
চমকে উঠলো ক্যামিল। মাথাটা কেমন ঘোরাচ্ছে তার। মনে হচ্ছে গত দুইদিন প্রচণ্ড গতিতে ঘূর্ণনশীল বিশাল এক স্পিনিং টপের মাঝে কাটিয়েছে সে। এখনো সেই ঘোর কাটেনি তার।
“মঁসিয়ে লা জুজ…”
চওড়া এক হাসি দিলো ক্যামিল। জুজ পেরেইরার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে ভেবেই নিতো, তার সাথে দেখা করার জন্য আকুল হয়ে ছিল ক্যামিল। কিছুক্ষণের মাঝেই হয়তো তাকে খুঁজতে যেতো। আর এই আকস্মিক আগমন যেন ক্যামিলের জন্য শান্তির সুবাতাস বয়ে এনেছে। সামনে হাত বাড়িয়ে দিলো ক্যামিল। ভাগ্যক্রমে দেখা হওয়ার বেশ খুশি সে। তাই যেন প্রকাশ করতে চাচ্ছে।
তবে, জুজ পেরেইরার মুখভঙ্গি যেন অন্য কিছু বলছে। নির্লিপ্তভাবে ক্যামিলের সাথে হাত মেলালো সে। আর কিছু না বলে, সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল জুঁজ পেরেইরা। ভাবভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে, বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে অনিচ্ছুক সে।
“মঁসিয়ে লা জুজ?”
থেমে গেল জুজ পেরেইরা। ঘুরে দাঁড়িয়েই অবাক হওয়ার ভান করলো সে।
“আপনার কি সময় হবে? গ্যালারি মনিয়েরের ডাকাতির ব্যাপারে কিছু কথা ছিল…” বলল ক্যামিল।
***
গোসলখানার আরামদায়ক উষ্ণতার পর ঘরের তীব্র শীতল আবহাওয়া যেন বাস্তব জগতে প্রবেশের কথা মনে করিয়ে দেয়।
লোহার তৈরি স্টোভ কীভাবে ব্যবহার করতে হবে তা বেশ কয়েকবার খুঁটিনাটিসহ বুঝিয়ে দিয়েছে ক্যামিল। কিন্তু কোনোভাবেই তা মনে রাখতে পারে না অ্যানি। লোহার একটা হাতল দিয়ে স্টোভের ভারি ঢাকনা উঠালো সে। কিন্তু আকারে বড় হওয়ায়, কাঠ দিতে দেরি হয়ে গেল তার। ইতোমধ্যে ধোঁয়ায় ভরে গেছে পুরো ঘর। তার চোখ জ্বালাপোড়া করতে লাগলো। এক কাপ কফি বানানোর সিদ্ধান্ত নিলো সে।
তীব্র শীতে হাড় পর্যন্ত কাঁপুনি ধরে গেছে তার। কোনোভাবেই শরীর গরম করতে পারছে না। পানি গরম হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। বনের অমোঘ মায়া আবারো কাছে টেনে নিলো তাকে। একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে অ্যানি।
এরপরে সোফায় বসে ক্যামিলের স্কেচগুলোতে চোখ বুলাতে শুরু করলো সে। রুম ভর্তি হাজারো স্কেচ। হুট করেই পুলিশের পোশাক পরা একজনের স্কেচ তার চোখে পড়লো। মোটা গড়নের লোকটার চেহারায় কেমন একটা বোকা বোকা ভাব। চোখের নিচে কালো দাগও দেখা যাচ্ছে। এই সেই লোক, যে হাসপাতালে তার পাহারায় নিয়োজিত ছিল। আর পালানোর সময় বিকট স্বরে নাক ডাকছিল। স্কেচে দায়িত্বরত অবস্থাতেই দেখা যাচ্ছে তাকে। ক্যামিলের নিপুণ হাতে দৃশ্যটা দারুণভাবে ফুটে উঠেছে।
পোট্রেটগুলো একদম জীবন্ত লাগছে। কিন্তু তাতে আবেগের ছিটেফোঁটাও নেই।
হুট করেই টেবিলে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখলে পেল অ্যানি। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠার জুড়ে তার ছবি। তবে কোনোটাতেই তারিখ দেয়া নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার কথা ভেবে এই ছবিগুলো এঁকেছে ক্যামিল। এসব ভাবতেই, অ্যানির চোখ ভিজে উঠলো। আবেগের মাত্রা আরো বেড়ে গেল তার। ছবির নারীর সাথে তার বর্তমান অবস্থার কোনো মিলই নেই। এখন যা আছে, তা যেন শুধুই ধ্বংসাবশেষ। অথচ একটা সময় দেখতে অপূর্ব ছিল সে। একেকটা ছবি একেক মুহূর্তের। তবে, কোনটা কোন মুহূর্তের ছবি দেখে তা বোঝা কষ্টসাধ্য। কিন্তু প্রতিটা ছবি দেখার সাথে সাথে, সেই স্মৃতি অ্যানির মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। একটাতে দেখা যাচ্ছে মুখ চেপে হাসছে অ্যানি। চেজ ফার্নান্ডে যেদিন দেখা হয়েছিল, সেদিনের ছবি এটা। আরেকটায় দেখা যাচ্ছে, ক্যামিলের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অ্যানি। পুরোনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে ভালোই লাগছে তার। এইতো লা ভার্দুনে বসে আছে অ্যানি। সম্পর্কের একদম শুরুর দিকে দ্বিতীয়বার দেখা করেছিল এখানে। হ্যাট মাথায় খুব প্রাণবন্ত লাগছে অ্যানিকে।
চোখ মোছার জন্য টিস্যু খুঁজতে লাগলো সে। তখনি নিজের সম্পূর্ণ পোর্ট্রেট চোখ পড়লো তার। অপেরার কাছে এক রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে যে। ‘ম্যাডাম বাটারফ্লাই’ নাটকের টিকেট এনেছিল ক্যামিল। আর অ্যানি এগিয়ে যাচ্ছে তার দিকে।
সম্পর্কের শুরু থেকে এই পর্যন্ত যতদিন দেখা হয়েছে, কোনোকিছুই বাদ দেয়নি ক্যামিল। পেন্সিলের আচড়ে সকল সুখস্মৃতি অমলিন হয়ে আছে। কয়েকটা ছবিতে কান্নারত অ্যানিকে দেখা যাচ্ছে। এতে করে একটু অস্বস্তি বোধ করলো সে। যদিও ভালোবাসা থেকেই এগুলো এঁকেছে ক্যামিল, তাও বুঝতে পারলো অ্যানি। হাত বাড়িয়ে টিস্যুও বক্স ধরার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সে। উঠে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই তার।
টিস্যু বক্সের কাছাকাছি পৌঁছুতেই আচমকা একটা বুলেটের আঘাতে, সামনে থাকা কাঁচের টেবিলটা বিস্ফোরিত হলো।
ঘুম থেকে উঠার পরেই, অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি হচ্ছিল অ্যানির। ভয়ংকর কিছু ঘটার আশংকা করছিল সে। কিন্তু হুট করে এমন আক্রমণে সে অবাক হয়ে গেল। গুলির আঘাতে এমন শব্দ হলো, যেন বাড়ির সামনের অংশ ধসে পড়ছে। হাতের ঠিক নিচে থাকা কাঁচের টেবিলটা গুড়ো গুড়ো হয়ে গেছে। ভীষণ ভয় পেল অ্যানি। শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে এক চিৎকার দিলো সে। এরপর যতটুকু সম্ভব শজারুর মতো শরীরটাকে বাঁকিয়ে ফেলল। বাইরের দিকে উঁকি দিতেই চোখে পড়লো, জানালাটা পুরোপুরি ভাঙেনি। তবে গুলির আঘাতে বিশাল এক গর্ত ঠিকই হয়েছে। চারদিকে ফাটল ধরেছে। এভাবে আর কতক্ষণ টিকতে পারবে সে?
সাথে সাথেই বুঝতে পারলো, সহজ এক শিকারে পরিণত হয়েছে সে। অদম্য স্পৃহায় সোফার পেছনের দিকে, নিজেকে ছুঁড়ে দিলো সে। কোথা থেকে এমন শক্তি পেল অ্যানি, তা বলা অসম্ভব। ভাঙা হাড়ে চাপ পড়তেই, ব্যথায় চিৎকার করে উঠলো সে। কিন্তু দমে গেল না। এই ব্যথা, বেঁচে থাকার সুতীব্র ইচ্ছার কাছে কিছুই না। তাই সব তুচ্ছ করে সোফার পেছনে আশ্রয় নিলো সে। তখনি বুঝতে পারলো, এই সোফা গুলি থেকে তাকে বাঁচাতে পারবে না। চাপা আতঙ্ক গ্রাস করলো তাকে। হৃৎপিণ্ড এমনভাবে লাফাচ্ছে, যেন বিস্ফোরিত হয়ে যাবে। তার পুরো শরীর এমনভাবে কাঁপছে, যেন হিমঘরে শুয়ে আছে।
দ্বিতীয় গুলিটা, তার মাথার উপর দিয়ে শিস কেটে চলে গেল। দেয়ালে গিয়ে আঘাত করলো সেই গুলি। প্রতিক্রিয়াঃবশত মাথা নিচু করলো অ্যানি। তার মাথায় যেন প্লাস্টারের বৃষ্টি শুরু হলো। মাথায় হাত দিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লো সে। গ্যালারি মনিয়েরে যখন মেরে আধমরা করছিল তাকে, তখনও এভাবেই পড়ে ছিল সে।
একটা মোবাইল। ক্যামিলকে ফোন করতে হবে। এখনই। নয়তো পুলিশকে জানাতে হবে। কাউকে না কাউকে দরকার। খুব দ্রুত দরকার।
পরিস্থিতি খুব নাজুক। তা ভালোমতোই বুঝতে পারছে অ্যানি। উপরের তলায়, বিছানার পাশে রাখা আছে মোবাইল। কিন্তু, তার আগে, এই রুম পার হতে হবে।
সেক্ষেত্রে শত্রুর সহজ লক্ষ্যে পরিণত হবে সে।
তৃতীয় গুলিটা লোহার স্টোভে লাগার ফলে বিকট এক শব্দ হলো। সাথে সাথে হাত দিয়ে কান চেপে ধরলো অ্যানি। তার মনের মাঝে একের পর এক ছবি ভেসে উঠছে। গ্যালারি, হাসপাতালে তার রুম, ক্যামিলের মুখ-অতীতের সমস্ত স্মৃতি এক ঝলকেই দেখে নিলো। সম্ভবত তার মৃত্যু আসন্ন।
সম্ভবত সেটাই হতে চলেছে। বন্দুকধারী তো আর বারবার লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হবে না। এবার অ্যানি একদমই একা। এমনকি কেউ যে রক্ষা করতে আসবে, সেই আশাতেও গুড়েবালি।
ঢোক গিলল অ্যানি। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে থাকা যাবে না; খুনি একটু পরেই ঘরে ঢুকে যাবে। কীভাবে ঢুকবে তা জানা নেই তার। কিন্তু ঘরে যে ঢুকবে, এব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত সে। যেভাবেই হোক ক্যামিলের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। কোনো বিপদ হলে অ্যালার্ম বাজানোর কথা বলে গিয়েছিল ক্যামিল। কিন্তু সিকিউরিটি কোড লেখা কাগজটা আরেক রুমে।
মোবাইলটা উপরের তলায়। সেখানে যেতে হবে তার।
মাথা উঁচু করে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো অ্যানি। মেঝে জুড়ে প্লাস্টারের টুকরো পড়ে আছে। কাজ লাগার মত কিছুই নেই। এখন নিজের পথ নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। উপুড় হয়ে পরনে থাকা জাম্পার খুলে ফেলল অ্যানি। তিন পর্যন্ত গুণে সোফায় হেলান দিয়ে বসলো। জাম্পারটা পেটের কাছে ধরে রেখেছে। এখনই যদি সোফা বরাবর গুলি চলে, তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য ।
হাতে খুব বেশি সময় নেই।
ডান দিকে তাকালো সে; উপরের তলার সিঁড়ি, দশ মিটার দূরে। ফোনে কারো সাহায্য চাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই তার : হয় ক্যামিল কিংবা পুলিশ, কারো না কারো সাহায্য লাগবে। দ্বিতীয় কোনো সুযোগ পাবে না সে। পা দুটো ভাঁজ করে জাম্পারটা একদিকে ছুঁড়ে মারলো। মনে মনে প্রার্থনা করছে, জাম্পারটা যেন বাতাসে ভেসে অন্যদিকে গিয়ে পড়ে। এরপর যেই না দৌড়ানোর জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে, সাথে সাথে আরেকটা গুলির শব্দ তার কানে এলো।
***
পালাক্রমে গুলি করার কৌশলটা অনেক আগেই শিখেছি আমি। আপনার সামনে দুটো লক্ষ্যবস্তু; একটা ডানে, আরেকটা বামে। দ্রুততম সময়ে দুটোতেই আঘাত হানতে হবে। রাইফেলটাও সেভাবেই প্রস্তুত রেখেছি। জাম্পার দেখার সাথে সাথে গুলি চালালাম। যদি ওই জাম্পার আরো পরার ইচ্ছা থাকে, তাহলে কারো বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দিয়েছি। ওটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এদিকে ঘুরতেই দেখতে পেলাম, আমার শিকার সিঁড়ির দিকে দৌড়াচ্ছে। লক্ষ্যস্থির করে গুলি চালাতেই তা শিকারের ঠিক পেছনের সিঁড়িতে গিয়ে আঘাত হানলো।
বাজির দর বাড়ানোর সময় হয়ে গিয়েছে। শিকারকে যেখানে চেয়েছিলাম, ঠিক সেখানে পেতে খুব একটা কষ্ট করতে হলো না। ভেবেছিলাম অনন্তকাল লাগবে। দিনশেষে একটু পথ দেখিয়ে দিতেই কাজ হয়ে গিয়েছে। এবার যাবার পালা। কোনোকিছুই সহজে অর্জন করা যায় না। আজ হোক কিংবা কাল, ব্যাপারটা বুঝতে পারবে মেয়েটা।
কিন্তু সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক চললে, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে ওর আগেই পৌঁছে যাবো আমি।
***
অ্যানির ঠিক পেছনেই সিঁড়ির প্রথম ধাপটা বিস্ফোরিত হলো।
অ্যানির মনে হচ্ছে পুরো সিঁড়িটা যেন এখনই ভেঙে পড়বে। তাই একরকম উড়েই জায়গাটা পার হলো সে। বেডরুমের দরজায় বাড়ি খেয়ে কপালের কিছু অংশ কেটে গেল তার।
এরইমাঝে উঠে দাঁড়িয়েছে অ্যানি। সিঁড়ির রেলিংয়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে যাচাই করলো খুনি তাকে দেখতে পাবে কি না। যেহেতু দেখতে পারবে না, তাই গুলি চালানোও সম্ভব না। আপাতত এখানে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো সে। কিন্তু তার আগে ক্যামিলকে ফোন করতে হবে। একের পর এক ড্রয়ারে, মোবাইলে খুঁজতে শুরু করলো সে। উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছে। কোথাও খুঁজে পেল না মোবাইল। তখনই মনে পড়লো, শোয়ার আগে মোবাইলটা চার্জে দিয়েছিল। বিছানায় এলোমেলো কাপড়ের স্তূপ ঘাটতে শুরু করলো সে। ভাগ্যক্রমে মোবাইলটা পেয়েও গেল। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকানি আরো বেড়ে গেছে। মোবাইল চালু হতেও যেন অনন্তকাল সময় লাগছে। চালু হতেই ক্যামিলকে ফোন করলো।
ফোনটা ধরো, ক্যামিল। দয়া করে ফোনটা ধরো…
রিং বাজছে…
দয়া করে ফোনটা ধরো ক্যামিল। আমাকে বাঁচাও, অন্তত বলে দাও কী করবো আমি…..
এখনো হাত কাঁপছে অ্যানির।
“হ্যালো, এই মুহূর্তে কল ধরতে না পারার…”
ফোন রেখে দিলো অ্যানি। ভয়েসমেইল দিয়ে রাখলো।
“ক্যামিল, ওই লোকটা এখানেও চলে এসেছে! দয়া করে, ফোনটা ধরো। আমাকে বাঁচাও…”
***
বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে পেরেইরা। মনে হচ্ছে তার সাথে কথা বলতে বেশ বেগ পেতে হবে। এমনিতেই ব্যস্ত মানুষ সে। এমন অঙ্গভঙ্গি যেন স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে ক্যামিলকে, এই কেস থেকে তাকে সরিয়ে দেয়া হবে। এতো এতো মিটিং করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে পেরেইরা। চিন্তাভাবনা শেষ করলো ক্যামিল : হয়তো তার পুরো টিমকেই এই কেস থেকে সরিয়ে দেয়া হবে। আর নিজের গা বাঁচাতে স্বাধীন তদন্ত কমিশনের কথা বলে সটকে পড়বে কমিশনার মিচার্ড। এসব ঘটনা যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন।
সময় দিতে পারলে যেন খুশিই হতো জুজ পেরেইরা। একটু দ্বিধান্বিত সে। আবারো ঘড়ির দিকে তাকালো। মুখভঙ্গি দেখে মনে হলো, যেন বলতে চাইছে, দুঃখিত, আজ আর সময় দিতে পারছি না। ক্যামিলকে অতিক্রম করে কিছুদূর যাওয়ার পর থেমে গেল সে। দোটানায় ভুগছে সে। কাউকে মুখের উপর না বলা তার স্বভাবে নেই। শেষমেশ, নিজের নৈতিকতার কাছে হার মানতেই হলো তার।
“তোমার সাথে পরে কথা বলছি, কমান্ড্যান্ট। কিছুক্ষণ পর কল দেবো তোমাকে…”
হাত বাড়িয়ে দিলো ক্যামিল। “ধন্যবাদ।” মাথা নাড়লো পেরেইরা। “ধন্যবাদের কিছু নেই।”
ক্যামিল বেশ ভালোমতোই বুঝতে পারছে এটাই তার শেষ সুযোগ। লা গুয়েনের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আর ম্যাজিস্ট্রেটের দয়ালু মনোভাব হয়তো শেষবারের মত তাকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। এই আশায়ই বুক বেঁধে আছে সে। ক্যামিলের মুখ দেখেই তা বুঝতে পারলো পেরেইরা।
“অনেক ধন্যবাদ,” বলল ক্যামিল।
অস্পষ্ট এক ইশারা করে চলে গেল পেরেইরা।
***
হুট করে মাথা তুলে তাকালো অ্যানি। লোকটা গুলি চালানো বন্ধ করে দিয়েছে। কোথায় আছে এখন?
ভয়ে ভয়ে লন্ড্রি রুমের দিকে এগিয়ে গেল অ্যানি। সেখানে গিয়ে ভূত দেখার মত চমকে উঠলো সে। সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা । সাইলেন্সার লাগানো এক পিস্তল, তার দিকে তাক করে আছে। ব্যারেলটা অস্বাভাবিক রকম লম্বা।
অ্যানিকে দেখার সাথে সাথেই গুলি চালালো সে।
***
পেরেইরা চলে যাওয়ার সাথে সাথে উপরে উঠলো ক্যামিল। চলতি পথে লুইসের সাথে দেখা হলো।
“এখন তোমার সাথে কথা বলার সময় নেই, লুইস। আমি দুঃখিত…”
হাত নেড়ে ইশারা করলো লুইস, যেন বলতে চাইছে-সমস্যা নেই, আপনার কাজ শেষ করুন আগে। পথ থেকে সরে দাঁড়ালো সে।
অফিসে ঢুকেই, পরনে থাকা কোটটা চেয়ারের দিকে ছুড়ে মারলো ক্যামিল। ‘ভাটিগ অ্যান্ড শুইন্ডেল এর অফিসে কল করলো। ঘড়িতে সময়টা দেখে নিলো : ৯ টা ১৫ বাজে। ওপাশ থেকে কেউ জবাব দিলো। ।
“আমি কি অ্যানি ফরেস্টিয়ের সাথে কথা বলতে পারি?”
“একটু লাইনে থাকুন,” ওপাশ থেকে বলল, “আমি দেখছি…”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ক্যামিল।
“দুঃখিত…নামটা যেন কী বললেন?” জিজ্ঞেস করলো ওপাশে থাকা তরুণী। “আমি এখানে নতুন তো, দুঃখিত।”
ঢোক গিলল ক্যামিল। তার গলা আবারো শুকিয়ে আসছে।
“অ্যানি ফরেস্টিয়ে।”
“কোন বিভাগে কাজ করে, জানেন আপনি?”
“উম…অ্যাকাউন্ট ম্যানেজম্যান্ট কিংবা এই ধরনের কিছু হবে।”
“দুঃখিত, এই নামে তো কেউ নেই এখানে…আরেকটু লাইনে থাকুন, আপনাকে আরেকজনের সাথে কথা বলিয়ে দিচ্ছি।”
কিছুক্ষণ পর আরেক নারীর কণ্ঠ শোনা গেল : “নামটা মোটেও পরিচিত মনে হচ্ছে না। এখানে কর্মরত বাকিদেরও জিজ্ঞেস করে দেখেছি, এই নামে কাউকে চেনে না তারা। আপনি যদি চান, আমি আবারো দেখতে পারি। নামটা ঠিক আছে তো? এই ব্যাপারে অন্য কারো সাথে কথা বলতে চান? কী কারণে খুঁজছেন, তা কী জানতে পারি?”
ফোন রেখে দিল ক্যামিল।
গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে তার। এই মুহূর্তে এক গ্লাস পানি বিশেষ দরকার। কিন্তু, তার হাতে একদমই সময় নেই। এদিকে হাতও কাঁপছে।
কম্পিউটার চালু করেই ‘অ্যানি ফরেস্টিয়ে’ লিখে সার্চ দিলো সে। অনেকগুলো তথ্য চলে এলো। তাই আবারও সার্চ দিলো, ‘অ্যানি ফরেস্টিয়ে, জন্মতারিখ…
জন্ম তারিখ সহজেই মনে করতে পারবে ক্যামিল। মার্চের শুরুর দিকে, অ্যানির সাথে প্রথম দেখা হয় তার। তিন সপ্তাহ পরেই জানতে পারে, সামনে তার জন্মদিন। সেই উপলক্ষ্যে চেজ নিনেজে নিয়ে যায় তাকে। তাড়াহুড়োর কারণে গিফটও কিনতে পারেনি ক্যামিল। অবশ্য তা হেসেই উড়িয়ে দেয় অ্যানি। ডিনারটাই তার জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার বলে জানায় সে। টিস্যুতে একটা স্কেচ এঁকে উপহার দেয় ক্যামিল। এভাবেই স্বর্গীয় সময় কাটিয়েছে দুজন।
মোবাইলের ক্যালেন্ডার বের করলো ক্যামিল। ২৩শে মার্চ। বর্তমানে অ্যানির বয়স বিয়াল্লিশ। তার মানে ১৯৬৫ সালে জন্ম। জন্ম কি লিওনে? হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। জন্মদিনের সেই সন্ধ্যার কথা মনে করার চেষ্টা করলো ক্যামিল। জন্মস্থানের ব্যাপারে কিছু বলেছিল অ্যানি? নিশ্চিত না হওয়ায় জন্মস্থানের জায়গা ফাঁকা রেখেই সার্চ দিলো সে। দুজন অ্যানি ফরেস্টিয়ের নাম ভেসে উঠলো। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই : একই জন্মতারিখে, জমজ ভাই বোনের নামও চলে আসে।
প্রথম যে অ্যানির নাম ভেসে উঠেছে, তাকে বাদ দিলো ক্যামিল। সেই অ্যানি মারা গেছে ১৯৭৩ সালে। দ্বিতীয়জনকেও একই কারণে বাদ দিতে হলো। ১৬ই অক্টোবর, ২০০৫ সালে মারা গিয়েছে সে।
ক্যামিলের কাছে ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক ঠেকলো। তার গোয়েন্দা মন কেমন যেন নাড়া দিয়ে উঠলো। আর এসব বিষয়ে, তার চেয়ে অভিজ্ঞ মানুষ খুব কমই আছে। ছোটখাটো অস্বাভাবিকতা কোনোভাবেই তার নজর এড়ায় না। আর তার নিজের অস্বাভাবিক আচরণও যে অনেকের চোখে পড়েছে, তা সে ভালোমতোই বুঝতে পারছে।
দ্বিধায় পড়ে গেল সে।
কেনই বা লড়ছে সবার বিরুদ্ধে?
কার জন্য লড়ছে?
অনেকেই নিজের জন্মতারিখের ব্যাপারে মিথ্যা বলে। অ্যানিকে তো তেমন মনে হয় না। কিন্তু কার মনে কী থাকে, তা তো সবসময় বলা যায় না।
টেবিলের পাশে থাকা ফাইল ভর্তি ক্যাবিনেট খুলল ক্যামিল। ধুলোর আস্তর পড়ে আছে এখানে। কেউ কখনো পরিষ্কার করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। কাঙ্ক্ষিত ফাইলটা খুঁজে বের করতে কয়েক মিনিট সময় লাগলো। তাকে সাহায্য করার জন্য, আশেপাশে কেউ নেই।
টেবিলে মাথা রেখে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলো সে। না, এটা কোনোভাবেই সম্ভব না। একটা কাগজ আর পেন্সিল দরকার তার। স্কেচ করা শুরু করলো সে। পুরো বিষয়টা মনে করতে বেগ পেতে হচ্ছে তার। সোফায় বসে আছে অ্যানি। “আমার কথাটা অন্যভাবে নিয়ো না। কিন্তু এই জায়গাটা বেশ…বেশ…ঘিঞ্জি। তোমার জন্য মোটেও উপকারী না,” বলল ক্যামিল। কথাটা এমনভাবে বলতে চেয়েছিল যাতে অ্যানি কোনো কষ্ট না পায়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না।
“তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না,” উত্তেজিত কণ্ঠে বলল অ্যানি। “ডিভোর্সের পর সবকিছু থেকে দূরে থাকতে চাই আমি।”
স্মৃতিগুলো আরো স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে ক্যামিলের কাছে। ডিভোর্সের ব্যাপারে কী বলেছিল অ্যানি, তা মনে করা দরকার। যদিও এ ব্যাপারে কিছুই বলতে চাচ্ছিল না অ্যানি। কিন্তু নাছোড়বান্দা ক্যামিল, হাল ছাড়েনি।
“দুই বছর আগে ডিভোর্স হয় আমাদের,” শেষমেশ মুখ খুলল অ্যানি।
ক্যামিলের হাত থেকে পেন্সিলটা পড়ে গেল। সামনে থাকা ফাইলটা থেকে কয়েকটা নির্দেশনা পড়ে নিলো। এবার কম্পিউটারে খোঁজার পালা। ২০০৫ সালে অ্যানি ফরেস্টিয়ে নামে কারো বিয়ে কিংবা ডিভোর্স হয়েছে কি না, সেই ব্যাপারে সার্চ দিলো। স্ক্রলিং করে নিচের দিকে নামতেই, তার চোখে পড়লো : “ফরেস্টিয়ে, অ্যানি, জন্ম- ২০ শে জুলাই, ১৯৭০। বয়স : ৩৭… পরের লাইন দেখে, নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারলো না ক্যামিল : ‘ জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতার-২৭শে এপ্রিল, ১৯৯৮।”
পুলিশের খাতায় নাম আছে অ্যানির।
তথ্যটা হজম করতে বেশ কষ্ট হলো ক্যামিলের। পুলিশের খাতায় নাম। বাকিটুকু পড়ে গেল সে। চেক জালিয়াতি আর জাল কাগজপত্র তৈরির অভিযোগ আছে অ্যানির বিরুদ্ধে। ক্যামিল এতোটাই বিস্মিত হয়েছে যে, রেনের জেলখানার কয়েদিদের লিস্টে থাকা অ্যানির নাম তার নজরে আসতে বেশ সময় লাগলো।
এটা তার অ্যানি হতেই পারে না। অন্য কেউ হবে, ভিন্ন কোনো অ্যানি ফরেস্টিয়ে।
যদিও…এখানকার তথ্যমতে, প্যারোলে মুক্তি পেয়েছিল অ্যানি। কবে? এখানকার তথ্য কী হালনাগাদ করা আছে? নিশ্চিত হওয়ার জন্য ছবি দেখা দরকার। ঘেমে ভিজে উঠেছে ক্যামিল। কম্পিউটারের পর্দায় এক নারীর ছবি ভেসে উঠলো। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সে এশিয়ান বংশোদ্ভূত।
জন্মস্থান : ডা নাং।
একটু স্বস্তিবোধ করলো ক্যামিল। অ্যানি, তার প্রিয়তমা, পুলিশের নথিভুক্ত কোনো আসামী না। কিন্তু, তার পরিচয় খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও, বুকটা কেমন ভারি ভারি লাগছে ক্যামিলের।
***
লোকটাকে দেখার সাথে সাথেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো অ্যানি। গুলিটা তার মাথার কয়েক ইঞ্চি উপর দিয়ে, দরজায় গিয়ে বিধলো।
মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে চারপাশে পাগলের মত ছুটতে লাগলো অ্যানি। এই ঘর থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজছে। কিন্তু তার মাথা কাজ করছে না। কাকতালীয় হলেও সত্য, দুইদিন আগে ঠিক একই দৃশ্য মঞ্চায়িত হয়েছে গ্যালারি মনিয়েরে। আবারও জান বাঁচানোর জন্য হামাগুড়ি দিচ্ছে অ্যানি …
হাতে চাপ পড়ায় অসহনীয় ব্যথা শুরু হলো। এখন সেদিকে মনোযোগ দেয়ার সময় নেই তার। জীবন বাঁচানোই একমাত্র লক্ষ্য।
আরেকটা গুলি অ্যানির কাঁধ ছুঁয়ে দরজায় গিয়ে বিধলো। অসহ্য ব্যথায় গুমরে কেঁদে উঠলো সে। হুট করেই, অনেকটা অলৌকিকভাবে নিজেকে দেয়ালের পেছনে আবিষ্কার করলো সে। কিছুক্ষণের জন্য নিরাপদবোধ করলো। লোকটা কি বাড়ির ভেতরে ঢুকতে পারবে? কীভাবে?
সৌভাগ্যক্রমে, মোবাইলটা এখনো তার সাথেই আছে। সিঁড়ি দিয়ে নেমেই লন্ড্রি রুমের দিকে এগিয়ে গেল সে। হাতের মাঝে মোবাইলটা দেখে মনে হচ্ছে, কোনো বাচ্চা তার আদরের টেডি বিয়ার আঁকড়ে ধরে আছে।
লোকটা এখন কী করছে? দেখার তীব্র ইচ্ছা থাকলেও, তা দমন করলো অ্যানি। পরবর্তী গুলিটা যে কপাল ফুটো করবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। হয়তো লোকটা সেই অপেক্ষায় আছে।
দ্রুত কোনো সমাধান বের করার চেষ্টা করলো সে। এরইমাঝে ক্যামিলকে ফোন দিয়েছিল। লাভ হয়নি।
স্থানীয় থানায় ফোন করবে? স্থানীয় থানা এখান থেকে কত দূরে কে জানে? তাছাড়া পুলিশকে পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতেও সময় লাগবে। শেষমেশ বোঝাতে সক্ষম হলেও, তাদের আসতে কতক্ষণ লাগবে? এরমাঝে মরে ভূত হয়ে যাবে অ্যানি। খুনি, দেয়ালের ঠিক ওপাশেই দাঁড়ানো।
একমাত্র কারাভাজিওই তাকে বাঁচাতে পারবে।
***
স্মৃতি বড় অদ্ভুত জিনিস। হুট করেই সবকিছু মনে পড়ছে ক্যামিলের। অ্যানির মেয়ে আগাথা, বোস্টনে এম.বি.এ. পড়ছে। এব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত সে। কেননা অ্যানির মুখে বেশ কয়েকবার শুনেছে বোস্টনের কথা।
এই তথ্যের জন্য অন্য আরেক ডাটাবেজে খুঁজতে হবে। ম্যানুয়াল দেখে তা জেনে নিলো ক্যামিল। সার্চ দেয়ার সাথে সাথেই ফলাফল চলে এলো। বোস্টন ইউনিভার্সিটি, চার হাজার অধ্যাপক আর ত্রিশ হাজার ছাত্রছাত্রী। সবার তথ্য আলাদাভাবেপরীক্ষা করা সম্ভব না। তাই নাম দিয়ে সার্চ করার ব্যবস্থা করে নিলো সে।
ফরেস্টিয়ে নামে কেউ নেই। হয়তো অ্যানির মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে? কিংবা সে বাবার নাম ব্যবহার করে? তাই নামের প্রথমাংশ দিয়ে সার্চ করার সিদ্ধান্ত নিলো ক্যামিল। আগাথা নামের তিনজনকে পাওয়া গেল।
আগাথা থমসন, বয়স ২৭, কানাডিয়ান। আগাথা লেন্ড্রো, বয়স ২৩, আর্জেন্টিনিয়ান। আগাথা জ্যাকসন, আমেরিকান। ফ্রান্সের কেউই নেই।
প্রথমে অ্যানিকে পাওয়া গেল না। এখন আগাথাকেও পাওয়া যাচ্ছে না।
আগাথার বাবাকে খোঁজার সিদ্ধান্ত নিলো ক্যামিল।
“প্রায় চল্লিশটা কোম্পানিতে কোষাধ্যক্ষের কাজ করেছে সে। একদিন সবার ভান্ডার খালি করে পালিয়েছে। এরপর কেউ তার টিকিটাও দেখেনি।”
এই ঘটনা বলার সময় উচ্চ স্বরে হাসছিল অ্যানি। এতো কম তথ্য দিয়ে কাউকে খুঁজে বের করা বেশ কষ্টসাধ্য। এক দোকানে মালিক ছিল, কিন্তু কী বিক্রি করতো? থাকতোই বা কোথায়? আর কবেই বা পালিয়েছিল? কিছুই জানা নেই।
তাহলে বাকি রইলো অ্যানির ভাই, নাথান। পেশায় গবেষক, তবে বিষয়টা ঠিক মনে নেই ক্যামিলের। অ্যাস্ট্রোফিজিকস কিংবা এই ধরনের কিছু একটা হবে। তার মানে, অনলাইনে কোনো না কোনো রিসার্চ পেপার থাকবেই।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, নাথান ফরেস্টিয়ে নামে কোনো গবেষক নেই। সবচেয়ে কাছাকাছি যে নামটা এলো, নাথান ফরেস্ট, বয়স ২৭, নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী।
ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করলো ক্যামিল। লিও আর প্যারিসে অবস্থিত, সবগুলো ট্রাভেল এজেন্সিতে খবর নিলো। অ্যানির ল্যান্ডলাইন নাম্বার খুঁজে বের করলো। এর ফলে তার উত্তেজনা কিছুটা কমলো। যদিও, ফলাফল কী হবে তা আগে থেকেই জানতো সে।
বৈধ গ্রাহকদের লিস্টে নাম্বারটা নেই। তাই নিয়মের বাইরে গিয়ে খবর নিলো সে। এর জন্য বাড়তি সময় লাগলেও, কাজটা খুব একটা কঠিন না।
ম্যারিস রোমান নামের কাউকে লিজ দেয়া হয়েছে ল্যান্ডলাইনটা। ঠিকানা : ২৬, ফন্টেইন সড়ক। তার মানে, অ্যানির অ্যাপার্টমেন্টের মালিক তার প্রতিবেশী। সবকিছুই প্রতিবেশীর নামে। সম্ভবত জিনিসপত্রগুলোও তার-টেলিফোন লাইন, আসবাবপত্র, এমনকি বুকশেলফটাও।
ভাড়া দিয়ে থাকছে অ্যানি।
চাইলে আরো তদন্ত করতে পারতো ক্যামিল। আশেপাশে খোঁজখবর নেয়ার জন্য কয়েকজন অফিসারকে পাঠানো যেতো। কিন্তু, তাতে কোনো লাভ নেই।
যেদিক থেকেই চিন্তা করুক না কেন, শেষমেশ একটা সিদ্ধান্তেই উপনিত হয় সে। অ্যানি ফরেস্টিয়ে নামে কেউ নেই ।
তাহলে কাকে মারার জন্য এতো উঠেপড়ে লেগেছে হ্যাফনার?
***
মোবাইলটা ফ্লোরে রাখলো অ্যানি। হামাগুড়ি দিয়ে আগানোর কারণে, অসহ্য ব্যথা শুরু হয়েছে তার কনুইতে। রুমের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত এভাবেই এগিয়ে যেতে হলো তার। শেষমেশ সিকিউরিটি কোড সম্বলিতে কাগজটার কাছে পৌঁছাতে পারলো।
#২৯০৯১৫৭১#
অ্যালার্ম বাজার সাথে সাথে কানে হাত চেপে বসে পড়লো অ্যানি। মনে হচ্ছে তার খুলিতে কেউ ড্রিল মেশিন দিয়ে ছিদ্র করছে।
লোকটা কোথায়? দরজার পাশ দিয়ে, উঁকি দিলো অ্যানি। কাউকে দেখতে পেল না। একবার কান থেকে হাত সরালেও অ্যালার্মের তীক্ষ্ণ শব্দে আবার চেপে ধরতে বাধ্য হলো। এই অবস্থাতেই জানালার দিকে এগিয়ে গেল সে।
লোকটা চলে গেছে? অ্যানির গলা এখনো শুকিয়ে আছে। এমন তো
হওয়ার কথা না। এভাবে চলে যাওয়ার লোক সে না। কোনো না কোনো সমস্যা তো অবশ্যই আছে।
***
দরজায় উঁকি দিলেও লুইসকে খেয়াল করলো না ক্যামিল। এমনকি দরজায় টোকাও দিয়েছে লুইস। কোনো লাভ হয়নি।
“পেরেইরা আসছে…” ।
এখনো ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেনি ক্যামিল। এর শেষ দেখে ছাড়তে বেশ সময় লাগবে। এর জন্য দরকার ঠাণ্ডা মাথা আর নিরপেক্ষ চিন্তাভাবনা। এমন অবস্থাতেই সে নেই।
“বুঝলাম না?”
পুনরাবৃত্তি করলো লুইস।
“ঠিক আছে,” নিচু স্বরে বলল ক্যামিল। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে, জ্যাকেটটা হাতে নিলো।
“আপনি কি ঠিক আছেন?” জিজ্ঞেস করলো লুইস।
কথাটা ক্যামিলের কানেই গেল না। মোবাইল বের করতেই একটা ম্যাসেজ চোখে পড়লো তার। ফোন করেছিল অ্যানি। সাথে সাথে ভয়েসমেইল চালু করলো। “ক্যামিল, ওই লোকটা এখানেও চলে এসেছে! দয়া করে ফোনটা ধরো। আমাকে বাঁচাও…” এরইমাঝে দরজার কাছে চলে এসেছে ক্যামিল। লুইসকে ধাক্কা দিয়ে করিডোরের দিকে এগিয়ে গেল সে। যাওয়ার পথে এক নারীকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় ফেলেই দিচ্ছিল। সেই নারী আর কেউ না, স্বয়ং কমিশনার মিচার্ড। জুজ পেরেইরাকে সাথে নিয়ে ক্যামিলের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিল কমিশনার। কমিশনার মুখ খুললেও এক মিলিসেকেন্ডের জন্যেও থামল না ক্যামিল। তবে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় চিৎকার করে বললঃ
“পরে সবকিছু বুঝিয়ে বলবো।”
“ভেরহোভেন!” গর্জন করে উঠলো কমিশনার মিচার্ড।
কিন্তু এরইমাঝে নিচে নেমে গেছে ক্যামিল। কোনোমতে গাড়িতে উঠেই, পুলিশ লাইট আর সাইরেন চালু করে দিলো সে।
গাড়ি চালানো অবস্থাতেই অ্যানির নাম্বারে ফোন করলো ক্যামিল।
ফোনটা ধরো অ্যানি।
ফোনটা ধরো!
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। দুজনের গলায় একই সুর। কিন্তু, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
***
আবারো উঠে দাঁড়ালো অ্যানি। অপেক্ষা করছে সে। হঠাৎ করে কোনো সাড়াশব্দ না পাওয়ার কারন বুঝে উঠতে পারছে না। এটা কোনো চালাকি হতে পারে। কিন্তু বেশ কিছু সময় পার হবার পরেও কিছু ঘটল না। এরইমাঝে অ্যালার্ম থেমে গেল। অ্যালার্মের তীক্ষ্ণ শব্দের পরিবর্তে জায়গা করে নিলো বিষণ্ণ নিরবতা।
জানালার দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল অ্যানি। এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, যেন কোনো বিপদ দেখলেই ছুটতে পারে।
ঠিক এমন সময়ে তার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো লোকটা।
আঁতকে উঠলো অ্যানি।
দুই মিটারেরও কম দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে দুইজন। মাঝে রয়েছে শুধু কাঁচের জানালা।
লোকটার হাতে কোনো অস্ত্র নেই। সরাসরি অ্যানির দিকে তাকিয়ে আছে। এই অবস্থাতেই সামনের দিকে এগিয়ে এলো লোকটা। হাত বাড়ালেই জানালা ছুঁতে পারবে সে। অ্যানির দিকে তাকিয়ে ক্রুর এক হাসি দিলো সে। এই দেখে এক পা পিছিয়ে এলো অ্যানি। হাত দুটো উপরের দিকে তুলল লোকটা।
যেন অ্যানিকে বলতে চাইছে, দেখলে কোনো অস্ত্র নেই আমার কাছে। এরপর স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে অ্যানির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো সে। ভয়ে অ্যানির হাত পা অসাড় হয়ে গেছে। খাঁচায় আটকে পড়া খরগোশের মত লাগছে নিজেকে। একইসাথে মৃত্যুর প্রহর গুণতে শুরু করেছে সে।
এখনো অ্যানির দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। এক পা এক করে দরজার দিকে এগিয়ে আসছে সে। আলতো করে, দরজার হাতল ঘোরানোর চেষ্টা করলো।
বাইরের দিকে নজর দিলো অ্যানি। লোকটার জ্যাকেট নজর কাড়লো তার। পিস্তলের বাঁট আর হান্টিং নাইফটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এদিকে পকেট হাতড়ে অ্যানিকে দেখালো লোকটা।
দেখলে? আমার হাতেও কিছু নেই। পকেটেও নেই।
দুই পা এগিয়ে গেল অ্যানি। এদিকে দরজার সামনেই অপেক্ষারত লোকটা।
আগুনে ঝাঁপ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো অ্যানি। আর এক পা এগিয়ে দরজা খুলে দিলো।
দরজার খোলার সাথে সাথে ভেতরে ঢুকলো লোকটা। তড়িঘড়ি করে পিছিয়ে এলো অ্যানি।
“শুয়োরের বাচ্চা!” চিৎকার করে বলল অ্যানি। “শুয়োরের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা, জানোয়ারের বাচ্চা…”
এই বলতে বলতে, আরো পেছনে সরে এলো অ্যানি।
“একটু দম নাও…”
কিছুটা বিরক্তবোধ করলো লোকটা। কৌতুহলী চোখে চারপাশে তাকাচ্ছে। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে অ্যানির। সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে।
“গালি দেয়া শেষ? এবার একটু শান্তি লাগছে?” জিজ্ঞেস করলো লোকটা।
“আমাকে খুন করার জন্য উঠেপড়ে লাগলি কেন?” কাঁদতে কাঁদতে বলল অ্যানি।
“কী…এসব কী বলছো? এতকিছু থাকতে, এমন কেন মনে হচ্ছে তোমার?”
লোকটার কণ্ঠে হতাশার সুর। হয়তো একটু রাগও করেছে।
রাগে ফেটে পড়লো অ্যানি। হুট করে তার সমস্ত ভয় যেন উধাও হয়ে গেল। সেখানে জায়গা করে নিলো ভয়ানক ক্রোধ। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল সে। তীব্র ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই অনুভব করছে না।
“আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছেন আপনি!”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল লোকটা…
“এমন তো কোনো কথা ছিল না!”
মাথা নাড়লো লোকটা। এমন ছেলেমানুষিপনায় কিছুটা হতাশ সে।
“আহারে, কিন্তু, কথা তো এমনি ছিল।”
যেভাবে শ্বাস নিচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছিল, আর কথা বলতে পারবে না অ্যানি। কিন্তু এখনো হার মানতে রাজি না সে।
“না, এমনটা মোটেও ছিল না! ধাক্কা দিয়ে এক পাশে ফেলে দেয়ার কথা ছিল! আপনিই তো বলেছিলেন, “আমি শুধু একটু ধাক্কা দিবো”!”
“কিন্তু…” এতো সহজ জিনিসও ব্যাখ্যা করতে হবে, এই ভেবে বোকা বনে গেল লোকটা। “কিন্তু ব্যাপারটা তো বিশ্বাসযোগ্য করা দরকার ছিল। বুঝলে না?”
“কিন্তু আপনি তো আমার পেছনে ছায়ার মত লেগে আছেন!”
হেসে উঠলো লোকটা। যা অ্যানির রাগ আরো বাড়িয়ে দিলো।
“এমন কথাও তো ছিল না, শুয়োরের বাচ্চা।”
“ঠিক আছে। বুঝতে পারছি। কয়েকটা বিষয় অবশ্য তোমাকে জানানো হয়নি…কিন্তু ভুলেও আর গালি দেবে না। নইলে এক থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দেবো।”
“শুরু থেকেই আমাকে মারার চেষ্টা করছেন আপনি।”
এবার হাত তুলে, থামার ইশারা করলো লোকটা।
“তোমাকে মারার চেষ্টা?” গর্জন করে বলল সে, “না, না, সোনামণি। যদি সত্যিই তাই করতাম তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে গালি দিতে পারতে না। আমি তো শুধু ব্যাপারটাকে বিশ্বাসযোগ্য করার চেষ্টা করছিলাম! এই দুয়ের মাঝে পার্থক্য আছে! আর এটাও জেনে রাখো, যতটা সহজ মনে করো, কাজটা ততটা সহজ না। এমনকি হাসপাতালের ওই ছোট্ট নাটকটার জন্যও, কম বুদ্ধি খরচ করতে হয়নি।
তর্কযুদ্ধ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে অ্যানি।
“আমার মুখের বারোটা বাজিয়েছেন! চুরমার করেছেন আমার দাঁত! আপনি…”
“মানলাম, তোমার মুখটা আর মোনালিসার মত নেই। [ হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছে সে।] কিন্তু, এসব তো ঠিক করা যাবে। প্লাস্টিক সার্জারি তো অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছে। শোনো, যদি জ্যাকপটটা জিতে যাই, তাহলে আমার ভাগ থেকে তোমাকে কিছু দিয়ে দেবো। দুটো সোনার দাঁত লাগিয়ে নিয়ো। চাইলে রূপারটাও লাগাতে পারো। যেটা তোমার পছন্দ। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি স্বামীর সংসার করার ইচ্ছা থাকে তাহলে সোনার দাঁত লাগানোই ভালো।”
“শয়তানের বাচ্চা…”
“উহু, আর গালাগালি না…” লোকটা চারপাশে এমনভাবে তাকালো, যেন বাড়িটা তার নিজের। “এতো উত্তেজিত হওয়া যাবে না। সবকিছু পরিকল্পনা মত চললে লক্ষী বাচ্চার মত ঘরে ফিরতে পারবে।”
উপরের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলো লোকটা।
“বাড়িটা একদম খারাপ না, কী বলো? ক্যামিলের রুচি আছে বলতে হয়। (ঘড়ির দিকে তাকালো সে।) ঠিক আছে, এখন যেতে হবে।”
এই বলে অ্যানির দিকে এগিয়ে গেল লোকটা। দেয়ালের সাথে মিশে যেতে চাইছে অ্যানি।
“তোমাকে স্পর্শ করবো না। চিন্তার কিছু নেই!”
“এক্ষুণি বের হন!” চিৎকার করে বলল ভীতসন্ত্রস্ত অ্যানি।
মাথা নাড়লো লোকটা। হাঁটা শুরু করলেও হুট করে থেমে গেল সে। কিছু একটা চোখে পড়েছে তার। গুলি লেগে ফুটো হয়ে যাওয়া জানালার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।
“বাহ, দেখতে তো বেশ সুন্দর লাগছে! কী বলো?” অ্যানির দিকে ঘুরলো লোকটা।
“বের হ…!”
“একদম ঠিক। আজকের দিনের জন্য যথেষ্ট হয়েছে। আমাদের টিমটা কিন্তু দারুণ, কী বলো? আশা করি (বিভিন্ন জায়গার গুলির চিহ্নের দিকে ইশারা করলো লোকটা), বাকিটা পরিকল্পনামাফিকই চলবে।”
বাইরে গিয়ে জ্যাকেটটা হাতে নিয়ে, আবারো এলো লোকটা। জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা খাম বের করলো।
“এই যে নাও,” খামটা বাড়িয়ে দিলো অ্যানির দিকে। “সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক চললে, এটা খুলবে। আর দোয়া করো তাই যেন হয়। আমার জন্য বলছি না, তোমার ভালোর জন্যেই এটা দরকার। যাই ঘটুক, আমার অনুমতি ছাড়া এক পা নড়বে না, মনে থাকবে? নইলে, কী হতে পারে আশা করি তা এতোদিনে বোঝাতে পেরেছি।”
উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলো না লোকটা।
মোবাইল থেকে কয়েক মিটার দূরে বসে আছে অ্যানি। হুট করে মোবাইলটা বেজে উঠলো। অ্যালার্মের বিকট শব্দের পর এই শব্দ তার কাছে বাচ্চাদের খেলনার মত লাগছে।
ক্যামিল ফোন করেছে। রিসিভ করলো অ্যানি।
“যা বলছি তাই করো। কিছুই হবে না তোমার।”
“চলে গেছে…” হতাশা জড়ানো কণ্ঠে বলল অ্যানি।
“অ্যানি?” গর্জন করে উঠলো ক্যামিল। “তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি না। অ্যানি?”
ক্যামিলের কণ্ঠে আতঙ্কের ছাপ সুস্পষ্ট।
“ওই লোকটা বাসায় এসেছিল। আমি অ্যালার্ম বাজাতেই সে ভয়ে পালিয়ে যায়…” বলল অ্যানি।
ওপাশের কথা শুনতে বেশ কষ্ট হচ্ছে ক্যামিলের। সাইরেন বন্ধ করে দিলো সে।
“তুমি ঠিক আছো তো? আমি আসছি। খালি এইটুকু বলো, তোমার কোন ক্ষতি হয়নি তো…”
“আমি ঠিক আছি, ক্যামিল,” বেশ জোর দিয়েই বলল অ্যানি। “সবকিছু ঠিক আছে।”
***
গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়ে বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিলো ক্যামিল। চাপা উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে তার মাঝে।
“পুরো ঘটনা খুলে বলো আমাকে। কী কী হয়েছে?”
দুই হাতে মুখ চেপে ধরে গুমরে কেঁদে উঠলো অ্যানি।
এর চেয়ে মরে যাওয়ার ভালো ছিল। মনে মনে সে কথাই বলল অ্যানি।
.
সকাল ১০টা ৩০
সাইরেন বন্ধ করে একটু প্রশান্তি অনুভব করলো ক্যামিল। একটু পরেই আবার সাইরেন চালু করলো। এই কেসে অনেকগুলো জটিলতা তৈরি হয়েছে। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার সময় দরকার। কিন্তু সবকিছু খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছে। এদিকে আবেগের বেড়াজালে আবদ্ধ তার মন। তাই চিন্তাভাবনা গুছিয়ে উঠতে পারছে না।
গত দুই দিন ধরে নড়বড়ে এক তক্তার উপর দাঁড়িয়ে আছে ক্যামিল যার দুই পাশে গভীর খাঁদ। এদিকে তার পায়ের ঠিক নিচে বিশাল এক গর্ত খুঁড়েছে অ্যানি।
ক্রিমিনাল ব্রিগেডে তার ভবিষ্যৎ সুতোর উপর ঝুলছে। ভালোবাসার মানুষটাকে মারার জন্য গত দুইদিনে তিনবার হামলা হয়েছে। আর সেই ভালোবাসার মানুষটাই মিথ্যা পরিচয়ে বাস করছে। এই কেসে তার কী ভূমিকা, তাও ঠিকমতো বুঝতে পারছে না। অনেকগুলো প্রশ্ন ক্যামিলের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে একটা চিন্তাই তার মনকে আচ্ছন্ন করে রাখছে। তার জীবনে অ্যানির কী ভূমিকা?
এরসাথে অবশ্য আরো আরেকটা সম্পূরক প্রশ্নও আছে। যদি শেষ পর্যন্ত অ্যানির পরিচয় মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাহলেই বা কী করবে?
কয়েক মিনিটের মাঝেই এক নারীর সাথে দেখা হবে, যে নিজেকে অ্যানি ফরেস্টিয়ে বলে পরিচয় দেয়। মাসের পর মাস সেই নারীর সাথে কাটিয়েছে সে। ক্যামিলের মাথা যেন শূন্য হয়ে আছে। কোনো কিছুই স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে পারছে না।
অ্যানির মিথ্যা পরিচয়ের সাথে গ্যালারি মনিয়েরের ডাকাতির কী সম্পর্ক?
কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কেউ একজন এই নারীকে মারার চেষ্টা করছে।
এই নারীকে আর চিনতে পারছে না ক্যামিল। কিন্তু এতোটুকু ঠিকই বুঝতে পারছে, রক্ষা করার দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।
***
স্টুডিওতে ঢুকতেই অ্যানিকে দেখতে পেল ক্যামিল।
এতো ঝামেলার মাঝে অ্যানির বর্তমান অবস্থায় কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল ক্যামিল। তার মনে অন্য এক অ্যানির ছবি ভাসছিল। সেই অ্যানি, যে হাসলে গালে টোল পড়তো, যেই হাসিতে কুপোকাত হয়েছিল সে।
আবেগের রাশ টেনে ধরলো ক্যামিল। এক চুলও নড়লো না অ্যানি। সামনের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন কেউ তাকে সম্মোহিত করেছে।
“তুমি ঠিক আছো, লক্ষী?” এমনভাবে এগিয়ে গেল ক্যামিল, যেন কোনো পশুকে বশ মানাতে যাচ্ছে। নিচু হয়ে অ্যানির হাতটা ধরলো।
“ওহ, ক্যামিল…”
ক্যামিলের কাঁধে মাথা রাখলো অ্যানি।
এখন কেয়ামত হলেও কোনো আফসোস থাকবে না দুজনের।
কিন্তু এখনো সেই সময় আসেনি।
“বলো আমাকে।
প্রথমে ডানে, পরে বামে তাকালো অ্যানি। দেখে মনে হচ্ছে, কোথা থেকে শুরু করবে তা বুঝতে পারছে না সে।
“একাই এসেছিল? নাকি দলবল সাথে নিয়ে?”
“না, একাই…”
নিচু স্বরে জবাব দিলো অ্যানি।
“হ্যাফনার? যাকে তুমি ছবিতে শনাক্ত করেছিলে?”
মাথা নাড়লো অ্যানি। “হ্যাঁ, ওই লোকই ছিল।”
“কী হয়েছিল? খুলে বলে আমাকে।”
পুরো ঘটনার বর্ণনা দিতে বেশ কষ্ট হলো অ্যানির। কোনো বাক্যই সে পুরোপুরি শেষ করতে পারলো না। তবে তা থেকেই সম্ভাব্য ঘটনা অনুমান করে নিলো ক্যামিল। প্রথম গুলি। কফি টেবিলের পাশে পড়ে থাকা কাঁচের টুকরোর দিকে চোখ পড়লো ক্যামিল। দেখে মনে হচ্ছে এই জায়গায় উপর দিয়ে টর্নেডো বয়ে গেছে। অ্যানির কথা শুনতে শুনতেই জানালার দিকে এগিয়ে গেল। গুলির কারণে যে ছিদ্র হয়েছে, তা তার ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে গুলির গতিপথ কল্পনা করে নিতে খুব একটা কষ্ট হলো না তার।
“তারপর…” বলল ক্যামিল।
এরপর দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল সে। সিঁড়ির দিয়ে বেশ কয়েকবার উঠানামা করলো। সিঁড়ির প্রথম ধাপে যেখানে গুলি লেগেছিল, সেখানে হাত বুলিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলো।
“এরপর কী হলো?” জানতে চাইলো সে।
বাথরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ক্যামিল; এখান থেকে অ্যানির কথা শোনাই যাচ্ছে না। এদিকে একটু একটু করে ঘটনাটা নিজের মাথায় সাজিয়ে নিচ্ছে ক্যামিল। হতে পারে এটা তার বাড়ি, কিন্তু এখন ক্রাইম সিন। অনুমান, পর্যবেক্ষণ, সিদ্ধান্ত।
জানালাটা অর্ধেক খোলা। ঘরে ঢুকলো অ্যানি। এদিকে অপেক্ষারত হ্যাফনার জানালার ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিলো। হাতে সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল। দরজায় লেগে থাকা গুলিটা খুঁজে পেল ক্যামিল। শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল সে।
চুপ করে আছে অ্যানি।
“হয়েছে তো…” বলল সে। “এখন আর ভয়ের কিছু নেই…”
কাচুমাচু ভঙ্গিতে তার দিকে এগিয়ে গেল অ্যানি
“অন্য কোথাও নিয়ে যাবো তোমাকে।”
ডানে বামে মাথা নাড়লো অ্যানি।
“কী সমস্যা?” ।
এই ধ্বংসযজ্ঞের পরেও অ্যানির মানা করার কারন বুঝে উঠতে পারলো না ক্যামিল ।
“আমার মনে হয়…”
“না,” তাকে থামিয়ে দিলো অ্যানি।
আপাতত অ্যানিকে আর মানসিক চাপ দিতে চাইলো না ক্যামিল। যেহেতু বাসায় ঢুকতে ব্যর্থ হয়েছে হ্যাফনার, সেহেতু আজকে আরেকবার চেষ্টা করার সম্ভাবনা খুব কম। কালকে পর্যন্ত চিন্তাভাবনা করার সময় পাওয়া যাবে। গত তিন দিনে যেন এক বছর পার হয়েছে। আগামীকাল আসতে অনেক দেরি।
এছাড়া, পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ক্যামিল।
একটু সময় অবশ্য লেগেছে। মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর উঠে দাঁড়াতে জাত যোদ্ধারও কিছুটা সময় লাগে।
সেই মুহূর্তের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে ক্যামিল।
দুই এক ঘণ্টা লাগবে তার। বড়জোর আরো কয়েক ঘণ্টা। এরমাঝে, পুরো বাড়ি সুরক্ষিত করে ফেলবে সে।
চুপচাপ বসে আছে দুজন। নিরবতা ভেঙে ক্যামিলের মোবাইলটা বেজে উঠলো। দেখার দরকার নেই। সে ভালোমতোই জানে কে ফোন করেছে।
এমন এক মানুষের হাত ধরে আছে, যাকে পাশে নিয়ে বাকিটা জীবন পার করার কথা ছিল ক্যামিলের। অথচ কয়েক ঘণ্টা আগেই মানুষটা কেমন অপরিচিত হয়ে গেল। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত ঠেকলো ক্যামিলের কাছে। সে ভালোমতোই বুঝতে পারছে, প্রশ্ন করার সময় চলে এসেছে। কিন্তু, তার অপেক্ষার প্রহর আরেকটু দীর্ঘায়িত হলো। এর আগে আরো কয়েকটা কাজ সারতে হবে তার।
***
হুট করেই বেশ ক্লান্ত অনুভব করলো ক্যামিল। বুকের মাঝে বিশাল বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে সে। নরম বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে তার। কিন্তু, তার বদলে অ্যানির কথায় মনোযোগ দিলো সে।
“তুমি কি ওই লোকটাকে খুঁজে বের করবে?” প্রায় ফিসফিস করে বলল অ্যানি।
“হ্যাঁ, অবশ্যই।”
উত্তরটা একদম সাথে সাথে এলো, অনেকটা প্রতিক্রিয়াঃবশত; এতোটা নিশ্চয়তার সাথে বলল ক্যামিল, অ্যানিও অবাক হয়ে গেল।
“ওকে খুঁজে পাওয়ার সাথে সাথেই আমাকে জানাবে। বলো, জানাবে না?”
ভ্রূ কুঁচকে গেল ক্যামিলের, “কেন?”
“এমনি। তখন একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারবো। মনে থাকবে তো?”
“অবশ্যই…”
কথাটা এমনভাবে বলল, যেন ক্ষমা চাচ্ছে সে।
***
এরপরে পুরো পরিবেশ যেন থমকে গেল। গভীর শূন্যতা আঁকড়ে ধরলো দুজনকে। হাতে পেন্সিল থাকলে কয়েকটা স্কেচ করো ফেলতো ক্যামিল।
যাবার সময় হয়েছে। এবার আসল ঘটনা খুঁজে বের করতে হবে।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে ক্যামিল। দেখে মনে হচ্ছে, শিকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কোনো শিকারি।
সিঁড়ি দিয়ে উঠেই শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল ক্যামিল। মেঝেতে শুয়ে পড়লো সে। এরপর সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে একটা বাটনে চাপ দিতেই গোপন এক কুঠুরি বেরিয়ে এলো। ধুলো জমে আছে জায়গাটায়। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করে আনলো সে। ভেতরে বেশ মোটা একটা ফাইল। এটা এভাবেই পড়ে ছিল সেই….
আশেপাশে তাকিয়ে, একটা বালিশের কভারের মাঝে ফাইলটা ঢুকিয়ে নিলো ক্যামিল। এরপর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল সে।
ছয় মিনিট পর অ্যানির জন্য ছোট একটা চিঠি লেখছে ক্যামিল।
“একটু বিশ্রাম নাও। প্রয়োজন হলেই কল দিয়ো। যত দ্রুত পারি চলে আসবো।”
লেখা শেষ করেই পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখলো সে। সবগুলো দরজার তালা আরেকবার পরীক্ষা করে দেখলো। যাওয়ার আগে সোফায় শুয়ে থাকা অ্যানির দিকে নজর পড়লো তার। অ্যানিকে একা রেখে যেতে বেশ কষ্ট
হচ্ছে তার।
কিন্তু থাকারও উপায় নেই।
এবার যেতে হবে। এক হাতে বালিশের কভারে মোড়ানো ফাইল নিয়ে বের হলো ক্যামিল।
গাড়ির কাছে গিয়ে একবার থামলো সে। বাড়ির ভেতরে ঘুমন্ত অ্যানির কথা মনে পড়লো তার।
ক্যামিল গাড়ি চালু করতে না করতেই চোখ খুলল অ্যানি।
.
সকাল ১১টা ৩০
প্যারিসের দিকে এগিয়ে চলছে গাড়ি। এদিকে ক্যামিলের মাথায় চিন্তার জট খুলতে শুরু করছে। কী ঘটছে তা ঠিকমতো বুঝতে না পারলেও, কী প্রশ্ন করতে হবে তা সে ভালোমতোই জানে।
সঠিক প্রশ্ন করাটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ।
সশস্ত্র ডাকাতির সময় অ্যানি ফরেস্টিয়ে নামের এক নারীকে আহত করে এক খুনি। যদিও ওই নারীর আসল পরিচয় এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এদিকে খুনি ওই নারীকে খুঁজতে খুঁজতে ক্যামিলের স্টুডিও অবধি চলে আসে।
ডাকাতির সাথে অ্যানির মিথ্যা পরিচয়ের কী সম্পর্ক?
যদিও সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হবে, ভুল সময়ে ভুল জায়গায় উপস্থিত ছিল ওই নারী। ক্যামিলের নাম খোদাই করা একটা ঘড়ি নেয়ার জন্যেই গিয়েছিল সেখানে। আপাতদৃষ্টিতে এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হলেও, কোনো না কোনো সংযোগ তো অবশ্যই আছে। ঘটনা দুটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এ ব্যাপারে অ্যানির কাছ থেকেও কিছু জানতে পারেনি ক্যামিল। এমনকি অ্যানির আসল পরিচয়টা পর্যন্ত জানে না সে। তাই অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে তার। এই রহস্যের মূলটা খুঁজে বের করতে হবে।
মোবাইল বের করলো সে। স্ক্রিনে লুইসের তিনটা মিসকল উঠে রয়েছে। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কোনো ভয়েসমেইল দেয়নি সে। এর বদলে মেসেজ পাঠিয়ে রেখেছে, “কোনো সাহায্য দরকার?”
তিন তিনটা ভয়েসমেইল দিয়ে রেখেছে লা গুয়েন। অবাক করার বিষয় হলো, তিনটা ভয়েসমেইলের সারমর্ম একই, শুধু সুরটা ভিন্ন। “শোনো, এখনই কল করো আমা-” মেসেজ ডিলিট করে দিলো ক্যামিল। “কী ব্যাপার…এখনো কল করলে না তু-” এটাও ডিলিট করে দিলো সে। পরের মেসেজে, লা গুয়েনের কণ্ঠস্বর বেশ কঠোর শোনালো। সত্যি বলতে, ক্যামিলের আচরণে, সে হতাশ। “যদি আমাকেই পাত্তা না দাও, আমার পক্ষে কোনো সাহায্য করা সম্ভব না।”
তাহলে
মাথা থেকে অন্য সব চিন্তা দূরে ঠেলে দিলো ক্যামিল। কোনোমতেই মনোযোগ হারানো যাবে না।
স্টুডিওতে ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনাটা চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হবে তার। ক্ষতি যে হয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবুও অবাক না হয়ে পারলো না ক্যামিল।
বিশ মিটার প্রশস্ত এক জানালার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে অ্যানি। আর বাইরে ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ খুনি। অ্যানির পাশ কাটিয়ে গুলি চলে যাওয়াটা অবিশ্বাস্য কোনো ব্যাপার না। কিন্তু লক্ষ্য থেকে মাত্র ছয় মিটার দূরে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার ব্যাপারটা যথেষ্ট সন্দেহজনক। মনে হচ্ছে গ্যালারি মনিয়েরে পর থেকেই কোনো এক অজানা শক্তি বাঁধা দিচ্ছে খুনিকে। কিংবা কোনো এক অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে। যদি তাই হয়, তাহলে একটা যুক্তিযুক্ত কারন বাকি থাকে। পুরো ঘটনাটাই সাজানো। বারবার এমন লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়াটা মোটেও কাকতালীয় না….
একইসাথে আরেকটা প্রশ্ন উঁকি দিলো তার মনে।
মনফর্টের এই স্টুডিও কীভাবে খুঁজে বের করলো খুনি?
গতরাতে প্যারিস থেকে এই পথেই ফিরেছিল ক্যামিল। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত অ্যানি পৌঁছানোর সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ে।
রাস্তায় প্রচুর যানজট। সন্ধ্যাবেলায় সচরাচর এতো বাজে অবস্থা থাকে না। এরমাঝেই বেশ কয়েকবার গাড়ি থামালো ক্যামিল। আশেপাশের কয়েকটা অলিগলিতে বেশ কয়েকবার চক্কর দিলো।
হুট করেই একটা চিন্তা মাথায় এলো ক্যামিলের। সার্বিয়ানদের ডেরায় হানা দিয়ে খুনিকে রাভিচের কাছে পৌঁছে দিয়েছে সে; আর এখন অ্যানির কাছে!
সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য তত্ত্ব এটাই। ক্যামিলেরও তাই মেনে নেয়ার কথা। কিন্তু তা সম্ভব নয়। অ্যানির মিথ্যা পরিচয়ের ব্যাপারে জেনে গেছে সে। এই কেসের ব্যাপারে এতোদিন পর্যন্ত যা যা ভেবেছে, সবকিছুই এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য তত্ত্বটাই, এখন সবার আগে বাদ দিতে হচ্ছে।
কেউ যে পিছু নেয়নি, এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত ক্যামিল। তার মানে অ্যানির মন্টফোর্টে থাকার ব্যাপারটা কেউ আগে থেকেই জানতো।
ব্যাপারটা ভিন্ন দিক থেকে চিন্তা করতে হবে তার।
কেউ একজন আছে, যে ক্যামিলের খুব কাছের মানুষ। এতোটাই কাছের যে তার মায়ের স্টুডিওর ব্যাপারে জানে।
এমনকি জুয়েলার্সে নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীর সাথে তার সম্পর্কের ব্যাপারেও সে অবগত।
মস্তিষ্কে চিন্তার ঝড় তুলল ক্যামিল। হাতেগোণা কয়েকজনের নাম এলো। এরমাঝে আরম্যান্ডকে বাদ দিতেই হবে। দুইদিন আগে তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে।
এই লিস্টে হ্যাফনারও নেই। এই লোকের সাথে জীবনে দেখাই হয়নি ক্যামিলের।
সম্ভাব্য ফলাফলের কথা ভাবতেই মাথাটা ঘুরে উঠলো ক্যামিলের।
ইতোমধ্যেই অ্যানির মিথ্যা পরিচয়ের কথা জেনে গেছে সে। এখন মোটামুটি নিশ্চিত, হ্যাফনারের পরিচয়ও নকল।
তার মানে পুরো তদন্ত আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হবে।
যেখান থেকে শুরু করেছিল, আবার সেখানেই ফেরত এলো ক্যামিল।
আর গত কয়েকদিনে ক্যামিল যা করেছে, এতে করে তার সম্ভাব্য গন্তব্যস্থল; জেলখানা। সরাসরি জেলখানা।
***
ওইতো বাট্টু পুলিশ অফিসারকে দেখা যাচ্ছে। ধেড়ে ইঁদুরের মত প্যারিস আর নিজ বাসার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। সবসময়ই কিছু না কিছুর পেছনে ছুটছে। আশা করি এতো কষ্ট বৃথা যাবে না। আমি অবশ্য ওই পুলিশ অফিসারের কথা বলছি না। কী ঝামেলায় যে জড়িয়েছে, তা সে নিজেও জানে না। তবে খুব শীঘ্রই জানতে পারবে। আশা করি, আমার কষ্ট বৃথা যাবে না।
এতেদূর এসে হাল ছাড়ার লোক না আমি ।
নিজ দায়িত্ব ভালোমতোই পালন করেছে মেয়েটা। হয়তো নিজের রক্তমাংসের বিনিময়েই করেছে। কিন্তু, এ ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই। এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছে।
এবার বাকি কাজটা সেরে ফেলতে হবে। আমার সুযোগ্য বন্ধু রাভিচ আর আমি পালানোর নাটকটা ভালোই করেছিলাম। যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে এ ব্যাপারে নির্দ্বিধায় সাক্ষী দিতো ও। তবে সবগুলো আঙুল হারানোর ফলে, বাইবেল ছুঁয়ে শপথ করতে কিছুটা সমস্যা তো হতোই।
ওইদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে আমার। সত্যি বলতে, ওর প্রতি বেশ সদয় ছিলাম আমি। মাথায় বুলেট ঠুকে দিয়ে এক প্রকার দয়াই করেছি। কসম কেটে বলছি, সার্বিয়ানরাও একদম তুর্কিদের মত। এরা যে পাতে খায়, সে পাতেই ফুটো করে। এটা ওদের সংস্কৃতির অংশ। ধন্যবাদ নামক শব্দটাই ওদের অভিধানে নেই। সব উজাড় করে দিলেও, এদের অভিযোগের ফিরিস্তি কখনো শেষ হয় না।
এখন এইসব ভাবার সময় নেই। গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ এখনো বাকি। অবশ্য তার জন্য কিছুটা ভাগ্যের সহায়তাও প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত ভাগ্যদেবীর কাছে হাত পাতিনি। এবার তো একটু আশা করতেই পারি।
এদিকে ভেরহোভেন যদি নিজের কাজটা ঠিকঠাক মতো করে, তাহলে আর চিন্তার কিছু নেই।
আপাতত আমার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। আসল খেলা যখন শুরু হবে, তখন আর থামার সময় পাবো না।
.