তৃতীয় দিন – রাত

রাত ৯টা 

এখনো স্টুডিওতেই আছে অ্যানি। এটা কি সাহসিকতা নাকি কাপুরুষতা, তা নিজেও জানে না। কিন্তু এখনো অপেক্ষা করে আছে সে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় বয়ে যাচ্ছে আর ক্লান্তি যেন আরো চেপে ধরছে তাকে। তার মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর এক অগ্নিপরীক্ষা কোনো মতে পার করলেও, এখন সামনে যাবার কোন শক্তিই অবশিষ্ট নেই। 

মন্টফোর্টের ট্যাক্সি ড্রাইভার ফোন করে জানালো সে ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছে না। তার কণ্ঠ শুনে এশিয়ান মনে হচ্ছে। 

শোবার ঘরের লাইট জ্বালিয়ে ম্যাপটা বের করলো অ্যানি। এরপর ড্রাইভারকে ঠিকানা বলে দিলো। চার্চের পাশে এসে যেন অপেক্ষা করে, তাও জানিয়ে দিলো সে। এতে করে ড্রাইভারকেও বেশ খুশি মনে হলো। এরপর কোনো কথা না বলে কল কেটে দিলো অ্যানি। তারপর সোফায় গিয়ে বসলো। 

আর মাত্র কয়েক মিনিট, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো সে। যদি আর পাঁচ মিনিটের মাঝে ফোন বেজে ওঠে…যদি কোনো কল না আসে তাহলে? 

এভাবেই কয়েক মিনিট কেটে গেল। আবারো ফোন করলো ড্রাইভার, অধৈর্য হয়ে পড়েছে সে। বুঝতে পারছে না অপেক্ষা করবে না কি চলে যাবে। 

“আরেকটু অপেক্ষা করুন। আমি আসছি,” ড্রাইভারকে আশ্বস্ত করলো অ্যানি। 

মিটার চালু করার কথা অ্যানিকে জানিয়ে দিলো ড্রাইভার। 

“দশটা মিনিট সময় দিন আমাকে। মাত্র দশটা মিনিট…” 

দশ মিনিট। এরপর ক্যামিল আসুক বা না আসুক, চলে যাবে অ্যানি।

তারপর? তারপর কী হবে? 

ঠিক এমন সময়ে তার মোবাইল বেজে উঠলো। 

ক্যামিল ফোন করেছে। ।

*** 

ধ্যাত্তেরি, অপেক্ষা করতে আমার একদমই ভালো লাগে না। 

দেয়ালের ওপাশে ব্যস্ত রেস্তোরার শোরগোল শোনা যাচ্ছে। ফারনান্ড যা কামাচ্ছে দিনশেষে তা আমার পকেটেই ঢুকবে। এতে অবশ্য আমার খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু আমি তো এইসব চাই না। এতো কষ্ট করলাম যার জন্য … 

সময় যত গড়াবে, কাজটা তত কঠিন হয়ে পড়বে। যদি হ্যাফনার বাহামায় পালিয়ে যায়, তাহলে বিপদ আরো বাড়বে। এদিকে বাতাসে শোনা যাচ্ছে ও নাকি অসুস্থ, হাতে খুব বেশি সময় নেই। হয়তো নিজের শেষকৃত্যানুষ্ঠান, সমুদ্রের ধারেই করতে চায়। কে জানে! তাও আবার আমার অর্থকড়ি নিয়ে! আমার অর্থকড়ি নিয়ে সুখে শান্তিতে দিন কাটাবে, এটা তো হতে পারে না। 

কিন্তু এখনও যদি ফ্রান্সে থাকে ও, তাহলে একবার খালি ঠিকানাটা পাই। পুলিশের কানে যাওয়ার আগেই ওর সাথে কথাবার্তা সেরে ফেলতে পারবো। 

শুধু আমি, হ্যাফনার আর একটা রো টর্চ থাকবে। এরমাঝে, পনেরো বছরের পুরোনো মল্ট গ্লাসে ঢেলে নিলাম। 

*** 

স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে ক্যামিল। যে কোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত আছে সে। সবকিছুই তার পরিকল্পনা অনুসারেই শেষ হবে। সন্দেহের বিষয় শুধু একটাই। শেষ পর্যন্ত সে ভেঙে পড়বে না তো? 

দোকানের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চওড়া এক হাসি দিলো আরব দোকানদার, টুথপিক চাবাচ্ছে সে। অ্যানির সাথে মধুর সম্পর্কের স্মৃতি রোমন্থন করার চেষ্টা করলো ক্যামিল কিন্তু এই মুহূর্তে তার মাথায় কিছুই এলো না। সামনে কী ঘটবে, তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় ভুগছে। 

ম্যালেভালের হাত থেকে মুক্তি চাইছিল অ্যানি। এজন্যেই ক্যামিলের পেছনে গোয়েন্দাগিরি শুরু করে সে, যাতে করে ম্যালেভালের হাতে হ্যাফনারের ঠিকানা তুলে দিতে পারে। 

একমাত্র ক্যামিলই সাহায্য করতে পারে অ্যানিকে। কিন্তু এতে করে দুজনের মধ্যকার সম্পর্ক চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে তার চাকরির বারোটা বেজে গিয়েছে। দুশ্চিন্তা বোধ করলো ক্যামিল। 

যা হওয়ার হবে, নিজেকে প্রবোধ দিলো সে। মোবাইল বের করে, অ্যানিকে কল করলো। মুহূর্তের মাঝেই অ্যানির কণ্ঠস্বর শোনা গেল। 

“ক্যামিল…” 

এক মুহূর্তের নিরবতা। 

“হ্যাফনারকে খুঁজে পেয়েছি আমরা। তোমার আর চিন্তা করতে হবে না…” 

এইতো। কাজ হয়ে গেছে। 

গলার স্বর যতোটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো ক্যামিল। যাতে করে অ্যানির মনে কোনো সন্দেহ না জাগে। “কী? আবার বলো? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আসলেই পেয়েছো?” 

“হ্যাঁ, সত্যি বলছি।” একটা শব্দ কানে এলো ক্যামিলের, কারো শ্বাস- প্রশ্বাসের শব্দ। “কোথায় তুমি?” 

“বাড়ির বাইরে।” 

“তোমাকে না বাড়ি বাইরে যেতে মানা করেছিলাম!” 

ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না অ্যানি। তার কণ্ঠস্বর কাঁপছে।

“ওকে ধরে ফেলেছো?” 

“না, অ্যানি। বিষয়টা এরকম নয়। কেবল ওর ঠিকানা খুঁজে পেয়েছি। খবরটা পাওয়ার সাথে সাথে তোমাকে জানালাম। তুমিই তো কল দিতে বলেছিল। দেখো, বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবো না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হচ্ছে-” 

“হ্যাফনার এখন কোথায়, ক্যামিল?” 

একটু দ্বিধান্বিত বোধ করলো ক্যামিল। 

“একটা সেফ হাউজে খুঁজে পেয়েছি…” 

হুট করে বনের দিকে থেকে খচখচ শব্দ আসা শুরু হলো। অ্যানির চারপাশটা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। তার কানে বাতাসের শো শো শব্দ হচ্ছে। বাড়ির লাইটগুলো জ্বলতে নিভতে শুরু করলো। এখন ক্যামিলকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা উচিত তার। সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে বলতে পারে, হ্যাফনার ঠিকানা আমার জানা দরকার। এই বাক্যটাই অনেক দিন থেকে অনুশীলন করছে সে। কিংবা : আমার মনটা কেমন কেমন করছে, আমার মনের অবস্থা তুমি বুঝতে পারছো না? নিজেকে আরো বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করতে হবে তার, কোনো সেফ হাউজের কথা বলছো? কোথায় ওটা? যদি এতেও কাজ না হয়, একটু উত্তেজিত হতে হবে তার : তুমি বলছো যে হ্যাফনারকে খুঁজে পেয়েছো, কিন্তু জানোই না কোথায় আছে ও? আমাকে বলতে কী সমস্যা? কিংবা ভিন্ন আরেক পন্থা অবলম্বন করতে পারে : আমি এখনো ভয় পাচ্ছি, ক্যামিল, তুমি তো বুহতেই পারছো, তাই না? কিংবা ক্যামিলকে মনে করিয়ে দিতে পারে : আমাকে প্রায় আধমরা করে ফেলেছিল ওই লোক, মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে আমাকে, তাহলে আমারও তো জানারও অধিকার আছে! 

কিন্তু, বাস্তবে এসবের কিছুই বলতে পারলো না অ্যানি। মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না তার। 

শেষবারের মত অ্যানিকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলো ক্যামিল। 

“১৫, স্কুদিয়ে সড়ক, গ্যাগনিতে খুঁজে পেয়েছি। শহর থেকে জায়গাটা বেশ দূরে। আশেপাশেও খুব বেশি বাড়িঘর নেই। কতদিন ধরে ওখানে আছে, তা এখনো জানা যায়নি। ওখানে এরিক বার্জিও নামে লুকিয়ে আছে, এতোটুকুই জানি।” 

আবারো নিরবতা নেমে এলো দুজনের মাঝে 

ক্যামিল ভাবছে, হয়তো শেষবারের মতো অ্যানির কণ্ঠ শুনলাম। কিন্তু, 

আদতে তা হলো না। 

“তো, এখন কী করবে?” 

“হ্যাফনার খুব বিপজ্জনক লোক। তুমি তা ভালোমতোই জানো, অ্যানি। জায়গাটায় চিরুনি অভিযান শুরু করবো আমরা। সাথে কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গও থাকতে পারে। যথোপযুক্ত টিম ছাড়া কোনো অভিযানে যাওয়া সম্ভব না। একইসাথে সময়ের ব্যাপারটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। যেহেতু ঠিকানা জেনে গেছি, এবার আর চিন্তার কিছু নেই। আর যাতে কারো ক্ষতি করতে না পারে সেই ব্যবস্থাই করা হবে। ঠিক আছে?” 

“হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।” 

“শোনো, এখন যেতে হবে। পরে কথা বলবো।” 

“ঠিক আছে।” 

.

রাত ৯ টা ৪৫ 

এতোক্ষণে আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম কিন্তু নিরাশ হতে হয়নি! হ্যাফনারের খোঁজ পাওয়া গেছে। 

“মঁসিয়ে বার্জিও’ নামে লুকিয়ে ছিল এতোদিন। এজন্যেই খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। লোকটাকে সেই কবে থেকে চিনি। একসময়ের শহর কাঁপানো গ্যাংস্টার। নির্মমতা আর হৃদয়হীনতার জন্য যার বিশেষ কুখ্যাতি ছিল। কিন্তু এমন একটা নাম নিজের গলায় ঝুলিয়েছে, ভাবতেই কষ্ট হয় আমার। এমনটা মোটেও আশা করিনি। 

কিন্তু ভেরহোভেন যেহেতু নিশ্চিত, আমারও কোনো সন্দেহ নেই। 

অসুস্থ থাকার যে খবর ছিল, সবই সত্যি। আশা করি সবকিছু কেমো থেরাপির পেছনে শেষ করে ফেলেনি। আমার এতো প্রচেষ্টার সঠিক 

মূল্য দেয়ার মত অর্থ এখনো বাকি আছে। নইলে আমি যা করবো তার থেকে ক্যান্সারে মৃত্যুও শ্রেয়। 

দেরি না করে গাড়িতে উঠে পড়লাম। যত দ্রুত সম্ভব গ্যাগনি পৌঁছাতে হবে আমার। 

ভিনসেন্ট হ্যাফনারের মত লোককে এই ভাগাড়ে কল্পনা করতেও কষ্ট হচ্ছে। দেখা হলেই ব্যাপারটা জানাতে হবে। নিজ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে সে। শহর থেকে অনেক দূরে, সুইমিং পুলে গোসল করছে হ্যাফনার, দৃশ্যটা ভাবতেই কেমন যেন লাগছে আমার। অবশ্য সাথে এক নারী থাকলে মন্দ হয় না। কোনো এক নারীর টানেই হ্যাফনার আজকে মঁসিয়ে বার্জিও। 

এই ব্যাপারগুলোই জীবন নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। সারাজীবন ছন্নছাড়া জীবন কাটিয়েছে হ্যাফনার। একের পর এক নির্মমতার সাক্ষ্য রেখে কাজ করেছে। অথচ সে কি না আজ এক নারীকে ভালোবেসে সংসার পেতেছে। 

এতে অবশ্য আমার লাভই হয়েছে। যে কোনো উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে, নারী জাতির চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র আর নেই। স্ত্রীর আঙুল ভাঙা শুরু করলে সারাজীবনের সঞ্চয় নির্দ্বিধায় তুলে দেবে আমার হাতে। নারীর প্রতিটা অঙ্গ, আমার কাছে স্বর্ণসম। 

বাচ্চাকাচ্চার উপরে আর কিছু নেই। একথা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিতে হবে। সত্যিই যদি জরুরি ভিত্তিতে কিছু প্রয়োজন হয়, তাহলে শিশুর সাথে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না। 

গ্যাগনি পৌঁছেই আশেপাশে একটু চক্কর দিলাম। জায়গাটা সম্পর্কে ধারণা তো নিতে হবে। পুরো জায়গা ঘিরে ফেলতে খুব একটা কষ্ট হবে না পুলিশের, শুধু কয়েকটা ব্যারিকেড হলেই চলবে। কিন্তু বাড়িতে অভিযান চালাতে বেশ কষ্ট হবে। প্রথমেই তাদের নিশ্চিত হতে হবে হ্যাফনার বাড়িতেই আছে, সাথে কোনো সাঙ্গপাঙ্গ নেই। পুলিশের চৌকস বাহিনীর গাড়ি আশেপাশেই রাখতে হবে। আর এদিকের যা অবস্থা, গাড়ি রাখার সাথে সাথেই কারো না কারো নজরে পড়বে। সাদা পোশাকের কয়েকজন দিয়ে রেকি করাতে পারলে সবচেয়ে ভালো হবে। কিন্তু, সেটাও তো কয়েক দিনের ব্যাপার। 

এখন হয়তো, পুলিশের চৌকস বাহিনী পুরো অপারেশনের ছক কষছে। ম্যাপের উপর কাটাকুটি করছে। তাড়াহুড়োর কিছুই নেই। পুরো পরিকল্পনা সাজানোর জন্য সারারাত সময় আছে তাদের হাতে। ভোর ছয়টার আগে এমনিতেও কিছু করতে পারবে না। অপারেশন শেষ করতে দুই তিন দিন লাগতে পারে। 

স্কুদিয়ে সড়ক থেকে দুইশো মিটার দূরে গাড়ি রাখলাম। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বাগানের পাশ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। ঘেউ ঘেউ করে ওঠা কয়েকটা কুকুরকে থামানোর জন্য পেশিশক্তির প্রয়োজন হলো। বাড়ির বাসিন্দারা টিভি দেখতে ব্যস্ত। বাগানকে পৃথক করা রেলিংয়ের ওপাশেই দেখা যাচ্ছে ১৫ নাম্বার বাড়ির পেছনের অংশ। এখান থেকে মাত্র ত্রিশ মিটার দূরে। 

উপরের তলায় নীলাভ আলো দেখা যাচ্ছে। এছাড়া পুরো বাড়ি ডুবে আছে অন্ধকারে। তিনটা ঘটনা হতে পারে। হয় উপরের তলায় টিভি দেখছে হ্যাফনার, কিংবা বাসায় নেই, অথবা ঘুমিয়ে আছে। আর ওর স্ত্রী টিভি দেখছে। 

যদি বাইরে থাকে হ্যাফনার, তাহলে স্বাগতম জানানোর জন্য আমি প্রস্তুত। 

আর বিছানায় থাকলে অ্যালার্ম ক্লকের কাজটাই না হয় করলাম। 

আর যদি টিভি দেখে, তাহলে অনুষ্ঠানের বাকিটা দেখার ইচ্ছা মাটি করতে হবে। কেন না, আমার নিজস্ব অনুষ্ঠানের আলাদা পরিকল্পনা আছে। 

দূরবীন দিয়ে জায়গাটা ভালো মতো দেখে নিলাম। এবার হ্যাফনারকে সারপ্রাইজ দিতে হবে। ভাবতেই ভালো লাগছে আমার। 

ধ্যান করার আদর্শ জায়গা হলো বাগান। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। যা ভেবেছিলাম, তার চেয়েও ভালোভাবে চলছে। এমনিতে তাড়াহুড়োর অভ্যাস থাকলেও এবার ধৈর্য্য ধরার সিদ্ধান্ত নিলাম। ইচ্ছা করছে দরজার সামনে গিয়ে প্রিয় মসবার্গটা ব্যবহার করি। কিন্তু কষ্ট করে এতোদূর আসার পর আর কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি না। একটু মাথা গরমের কারণে হয়তো সমস্ত পরিশ্রমই বৃথা যাবে। তাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে মাথা ঠাণ্ডা রাখা। আধা ঘণ্টা এভাবেই অপেক্ষা করলাম। অস্বাভাবিক কোনো কিছু না ঘটায় জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। আগে চারপাশটা ঘুরে দেখতে হবে। কোনো অ্যালার্ম লাগানো নেই। এসব করে আশেপাশের কারো নজর কাড়তে চায়নি হ্যাফনার। 

আবারো গাছের পাশে গিয়ে বসে দূরবিনে চোখ রাখলাম। 

শেষমেশ, রাত সাড়ে দশটার দিকে টিভি বন্ধ হলো। অল্প সময়ের জন্য মাঝের ছোট একটা জানালায় আলো দেখা গেল। অন্য ঘরের চেয়ে বেশ কম আলো। টয়লেট হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর হয় না। উঠে দাঁড়ালাম আমি। এবার খেলা শুরু। 

ত্রিশের দশকের আর দশটা বাড়ির মতোই, বাড়ির রান্নাঘরটা নিচতলায় এক কোণায়। বাগানের পাশ দিয়ে একটু এগুলেই ছোট একটা দরজা। শব্দ না করে, সেদিকে এগিয়ে গেলাম। তালাটা মোচড় দিতেই খুলে গেল। হ্যাফনারের কাছ থেকে এতোটা অসতর্কতাও আশা করিনি। 

দরজার ওপাশে অজানা এক জগৎ। 

ব্যাগটা বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। তাই সাইলেন্সার লাগানো ওয়ালথারের জায়গা হলো আমার হাতে। আর, আমার প্রিয় হান্টিং নাইফটা কোমরে গোঁজা আছে। 

ভেতরে ঢুকতেই বুক ধুকধুক করতে শুরু করলো। রাতের বেলা বাড়ির পরিবেশ একদমই অন্যরকম থাকে। আগে আমার হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকানি কমাতে হবে। নইলে কিছুই শুনতে পাবো না। 

অনেক সময় দাঁড়িয়ে থেকে চারপাশটা দেখে নিলাম। যে কোনো শব্দের জন্য সদাপ্রস্তুত রইলো কান। 

কিন্তু কোনো শব্দই পেলাম না। 

টাইলসের মেঝেতে ধীর পায়ে এগুতে থাকলাম। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে হলওয়েতে চলে এলাম। হাতের ডানে সিঁড়ি, সদর দরজা নাক বরাবর আর বাম দিকে হয়তো শোবার ঘর। 

সবাই উপরের তলায়। সতর্কভাবে দেয়ালে গা ঘেঁষে এগিয়ে চললাম। ওয়ালথারটা দুধতে শক্ত করে ধরে আছি। কখন কী হয়, বলা তো যায় না। 

সিঁড়ির দিকে এগুতেই, কিছু একটা চোখে পড়লো আমার। বাম দিকের শোবার ঘরটা কালিগোলা অন্ধকারে ডুবে আছে। কিন্তু একদম শেষ মাথায়, স্ট্রিটলাইটের হালকা আলোয়, হ্যাফনারকে দেখা যাচ্ছে। সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। 

এতোটাই ভড়কে গেলাম যে আমার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল, যেন পায়ে শেকড় গজিয়েছে। 

একটা আর্মচেয়ারে বসে আছে হ্যাফনার। ঠিক যেভাবে রকিং চেয়ারে বসে থাকতো মা বার্কার। 

মসবার্গটা আমার দিকে তাক করে আছে সে। 

আমাকে দেখার সাথে সাথে গুলি চালালো হ্যাফনার। 

আবন্ধ ঘরে বিকট এক শব্দ হলো। এইরকম শব্দ যে কাউকে মুহূর্তের মাঝে হতভম্ব করে দিতে পারে। সেকেন্ডের মাঝেই, দরজার পেছনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমি। কিন্তু একটু দেরি হয়ে গেল। আমার পা ভেদ করে বেরিয়ে গেল গুলি। 

আমার অপেক্ষায় ছিল হ্যাফনার। গুলি লাগলেও এখনো বেঁচে আছি আমি। 

সবকিছু এতো দ্রুত ঘটছে, মাথা কাজ করছে না আমার। তবে আমিও কম যাই না। এমন সময়ে, যা কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করবে না, তাই করে বসলাম আমি। 

পরিস্থিতি বিচার না করেই, তার মুখোমুখি হলাম। হ্যাফনারের মুখের অভিব্যক্তি দেখে অন্তত এইটুকু বলতে পারি, পায়ে গুলি লাগার পর আমার কাছ থেকে এমন প্রতিক্রিয়া আশা করেনি সে। ওয়ালথারটা এখনো আমার হাতেই আছে। 

প্রথম গুলিটা হাফনারের গলা চিরে বেরিয়ে গেল। আর দ্বিতীয়টা, দুই চোখের ঠিক মাঝ বরাবর। এমন অবস্থাতে নিশানায় কোনো হেরফের না হওয়ায় বেশ সন্তুষ্ট বোধ করলাম আমি। ট্রিগার চাপার সময়ও পেল না হ্যাফনার। পরপর পাঁচটা গুলি ওর বুক ছিদ্র করে বেরিয়ে গেল। গলাকাটা মুরগির মত ছটফট করে মারা গেল হ্যাফনার। 

এরমাঝে নিজের অবস্থার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। একইসাথে এটাও মাথায় এলো না, হ্যাফনারের মৃত্যুর সাথে সাথে আমার সকল প্রচেষ্টাও বিফলে গেল। হুট করে মাথার পেছনে বন্দুকের নলের অস্তিত্ব টের পেলাম। এদিকে আমার ওয়ালথার একদম খালি। 

আমার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল। কোনো কথা না বলে ওয়ালথারটা ফেলে দিলাম। 

লোকটার হাত একটুও কাঁপছে না। বন্দুকটা শক্ত হাতে ধরে আছে। মাথার পেছনে বন্দুকের নল আরো চেপে বসলো। এর মানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ওয়ালথারটা দূরে 

ঠেলে দিতে হবে। নীরবে, তাই মেনে নিলাম। ফাঁদে পড়ে গেছি আমি। এখন আর কিছুই করার নেই। আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিলাম। মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে উল্টো দিকে ঘুরলাম। 

কে আমাকে খুন করতে চায়, তা নিয়ে খুব বেশি ভাবতে হলো না। ছোট জুতো জোড়া দেখার সাথে সাথে, আমার সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হলো। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে ঝড়ের বেগে চলছে মস্তিষ্ক। কিন্তু একটা বিষয় কিছুতেই বুঝতে পারছি না। আমার আগে কীভাবে পৌঁছালো সে? 

কীভাবে কী হয়েছে, তা নিয়ে চিন্তা করে, সময় নষ্ট করলাম না আমি । আমি চিন্তা করতে যতোটা সময় পার হবে, ততোক্ষণে আমার ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। 

“শুভ সন্ধ্যা, ম্যালেভাল,” দৃঢ়কণ্ঠে বলল ভেরহোভেন। 

তার পরনে ওভারকোট আর মাথায় হ্যাট। এক হাত কোটের পকেটে ঢুকানো, দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি কিছু বের করবে। 

তার চেয়েও দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, গ্লাভস হাতে সে বন্দুক ধরে আছে। তীব্র আতঙ্কে ছেয়ে গেল আমার মন। যাই করি না কেনো, ভেরহোভেন একটা সুযোগ পেলেই আমি শেষ। ইতোমধ্যে অনেক রক্তক্ষরণ হওয়ায়, আমার দৌঁড়ে পালানোর সম্ভাবনাও ক্ষীণ। 

এটা বেশ ভালোমতোই জানে ভেরহোভেন। 

আমার দিকে বন্দুক তাক করে এক পা পিছিয়ে গেল সে। হাতটা একটুও কাঁপলো না তার। লক্ষ্য পূরণে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। 

হাঁটু গেড়ে বসে আছে আমি। হয়তো এটাই আমার শেষ সুযোগ। হাতের কাছেই আছে সে। 

“বাহ, তোমার হার না মানার মানসিকতা, এখনো আগের মতই আছে, বাছা।” 

“বাছা…” ভেরহোভেন বরাবরই পিতৃসুলভ আচরণ করেছে। তার উচ্চতার সাথে ব্যাপারটা মোটেও খাপ খায় না। আমার কাছে বরাবরই হাস্যকর লেগেছে। কিন্তু, এই বামনের মস্তিষ্ক ক্ষুরধার। 

“যাই হোক, আজ তো কিছু হারাতেই হবে তোমার। এতো কষ্ট আর পরিশ্রমের পর হারলে কার বা ভালো লাগে। ব্যাপারটা খুব পীড়াদায়ক। যদি ব্যাগভর্তি নোটের জন্য এসে থাকো, তাহলে জেনে খুশি হবে ব্যাগটা এখানেই ছিল। এক ঘণ্টা আগে বেরিয়ে গেছে হ্যাফনারের স্ত্রী। এমনকি, ট্যাক্সি ডাকার কাজটা আমিই করেছি। আমাকে তো ভালোমতোই চেনো তুমি। অসহায় লোকজনের বিপদ দেখলে আমি ঠিক থাকতে পারি না। বাচ্চা কোলে নিয়ে একজন নারীর পক্ষে এতো ভারি ব্যাগ টানা তো বেশ কষ্টসাধ্য। তাই, ট্যাক্সি পর্যন্ত আমিই দিয়ে এলাম।” 

বন্দুক লোড করা। এতো কাছ থেকে লক্ষ্য ভেদে ব্যর্থ হবে না ভেরহোভেন। আরেকটা জিনিস আমার নজর কাড়লো। ক্রিমিনাল ব্রিগেডের কেউ তো এমন বন্দুক পায় না। তার মানে এটা… 

“একদম ঠিক ধরেছো,” বলল সে, যেন আমার মনের কথা পড়তে পারছে। “বন্দুকটা হ্যাফনারের। উপরের তলায় আরো কত অস্ত্রশস্ত্র যে আছে, নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমাকে এটাই বেছে দিলো হ্যাফনার। ব্যক্তিগতভাবে, এমন পরিস্থিতিতে যে কোনো একটা বন্দুক হলেই হলো।” 

এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে। একবারের জন্যেও চোখ সরাচ্ছে না। একসাথে কাজ করার সময়ের কথা মনে পড়লো আমার। 

“হয়তো ভেবে অবাক হচ্ছো, কীভাবে আগে পৌঁছে গেলাম আমি তবে, তোমার মস্তিষ্কের বড় একটা কাজ করছে এখান থেকে পালানোর উপায় খুঁজে বের করতে। তুমি ভালোমতোই জানো, ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছি আমি।”

কথাগুলো বলার সময় তার মুখের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করলাম আমি। 

“একইসাথে অপমানিত বোধ করছি,” বলল ভেরহোভেন। “এই অপমান বোধটাই সবকিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। আমার মত মানুষের জন্য, এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ক্রোধ নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। সময়ের সাথে সাথে ক্রোধের মাত্রাও কমতে থাকে। কিন্তু যখন তার সম্মানে আঘাত লাগে, তখন সে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে, সেই মানুষটার যদি হারানোর কিছু না থাকে। যেমন, আমার মত কেউ। এখন, যে কোনো কিছুই করতে পারি আমি। একবারের জন্যেও হাত কাঁপবে না আমার।” 

বড় করে ঢোক গিললাম আমি। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না আমার। 

“যে কোনো মুহূর্তে তুমি পালানোর চেষ্টা করতে পারো। তা আমি ভালোমতোই জানি।” এই বলে সে হাসলো। 

“তোমার জায়গায় থাকলে আমিও তাই করতাম। এমন পরিস্থিতিতে, দুজনের চিন্তাভাবনায় কত মিল, তাই না? এজন্যেই তো, আজকের এই দিনে আমরা মুখোমুখি।” 

বাজে বকবক করলেও, মনোযোগ হারায়নি সে। পকেট থেকে বাম হাতটা বের করলো। 

কোন দিক থেকে আঘাত আসতে পারে, তা বোঝার চেষ্টা করলাম আমি। 

এবার দুই হাতে বন্দুক ধরে আছে সে, আমার দুই চোখের মাঝ বরাবর তাক করা। সবসময়ই আমার ঝুলিতে কোনো না কোনো সারপ্রাইজ তো থাকেই। ভেরহোভেন আশা করছে, হয় তার দিকে ছুটে যাবো নয় আশেপাশে ঝাঁপ দেবো আমি আদতে, এমন কিছুই হবে না। আমি পেছন দিকে ঝাঁপ দেবো। 

হুট করেই ক্ষীণ শব্দ শোনা গেল। 

বন্দুক থেকে এক হাত সরিয়ে কানের কাছে নিয়ে এলো সে।

“শোনো… 

কান পাতলাম আমি। সাইরেনের শব্দ। দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে। বিজয়ের স্বাদ পেল না, ভেরহোভেন। তাকে বিষণ্ণ মনে হচ্ছে। 

এমন বাজে অবস্থায় না থাকলে সমবেদনা জানাতাম তাকে। 

“তিন তিনটা খুন,” ফিসফিস করে বলল সে, কণ্ঠস্বর এতোটাই নিচে, যে শুনতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে আমার। “সশস্ত্র ডাকাতি, জানুয়ারির ডাকাতির সময়, খুনে সহযোগিতা…আর রাভিচের কেসে বীভৎস নির্যাতন আর হত্যা। লম্বা সময় জেলের ঘানি টানতে হবে তোমার। ভাবতেই খারাপ লাগছে। সত্যিকার অর্থেই খারাপ লাগছে।” 

সাইরেনের শব্দের তীব্রতা আরো বেড়ে গেল। কমপক্ষে পাঁচটা গাড়ি আসছে। এরচেয়ে বেশিও থাকতে পারে। 

দৌড়াদৌড়ির শব্দ শুনতে পেলাম। হুট করে সামনের দরজাটা যেন বিস্ফোরিত হলো। দেখার জন্য ঘুরলাম আমি। 

লুইস। আমার পুরোনো বন্ধু লুইস, সবার আগে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলো। এমন সময়েও সে একদম ফিটফাট। 

“আরে, লুইস…” 

“কী অবস্থা, জ্যঁ ক্লদ…” এগিয়ে গেল লুইস। 

এরইমাঝে ভেরহোভেন যেন গায়েব হয়ে গেছে। তার দেখা পেলাম না। 

.

রাত ১০ টা ৩০ 

প্রতিটা বাড়িতে আলো জ্বলে উঠেছে। বাড়ির লোকজন সব দরজায় সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একে অপরের সাথে চিৎকার করে কথা বলছে। কী ঘটছে, কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। একসাথে এতো পুলিশের গাড়ি দেখে, ঘাবড়ে গেছে সবাই। এমন পরিস্থিতির সাথে তারা অভ্যস্ত নয়। 

ওভারকোটের পকেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন। 

“তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি, লুইস।” ধীরে ধীরে কথা বলছে ক্যামিল, যেন তার সারা শরীরে ক্লান্তি ভর করেছে। “তোমাকে না জানিয়েই, এতোকিছু করার জন্য আমি দুঃখিত। হয়তো তোমার মনে হয়েছে, তোমাকে আর বিশ্বাস করি না আমি। কিন্তু, বিষয়টা মোটেও এমন না। আর, তুমি তা ভালোমতোই জানো, তাই না?” 

এই ধরনের প্রশ্নে উত্তর নিষ্প্রয়োজন। 

“অবশ্যই,” হাসিমুখে বলল লুইস। 

লুইস ম্যারিয়ানি আরো কিছু বলতে চাইছিল। ইতোমধ্যে মুখ ঘুরিয়ে ফেলেছে ভেরহোভেন। অবশ্য এতে অবাক অবাক হওয়ার কিছু নেই। দুজনের মাঝে সম্পর্কটাই এমন। হাজারো কথোপকথন শুরু হলেও শেষ হয়েছে হাতেগোনা কয়েকটা। কিন্তু এবার ব্যাপারটা পুরোপুরি আলাদা। দুজনেরই মনে হচ্ছে, একে অপরের সাথে এই শেষ দেখা। 

এই চিন্তাই চিরাচরিত রীতি ভাঙতে বাধ্য করলো লুইসকে। 

“ওই নারীর…” বলল সে। 

“না, লুইস, দয়া করে এমন কিছু ভেবো না!” রাগান্বিত না হলেও, কোনো কারণে তাকে উত্তেজিত মনে হলো। যেন অন্যায়ভাবে, তার ওপর দোষারোপ করা হচ্ছে। “যখনই তুমি ‘ওই নারীর’ কথাটা বললে, শুনে মনে হচ্ছে, আমি যেন ব্যর্থ ভালোবাসার আঘাতে জর্জরিত কোনো মানুষ।”

বেশ লম্বা সময় ধরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলো ক্যামিল “ভালোবাসার জন্য এমনটা করিনি। যা করার, সময়ের প্রয়োজনেই করেছি।” 

পরিবেশটা কেমন যেন গুমোট হয়ে আছে। 

“এতোকিছুর পরে,” কথা চালিয়ে গেল ক্যামিল, “ভেবেছিলাম, আইরিনের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে পারবো। কিন্তু, সত্যিকার অর্থে, বুকের ভেতরে থাকা আগুন, ধিকিধিকি করে ঠিকই জ্বলছিল। ম্যালেভাল শুধু অসময়ে তা উসকে দিয়েছে। সত্যি বলতে, তোমার মন্তব্য অনুযায়ী ‘ওই নারীর’, এখানে তেমন কোনো ভূমিকাই নেই।” 

“তবুও,” মুখ খুলল লুইস। “এই মিথ্যা, বিশ্বাসঘাতকতা…” 

“ওহ, লুইস, এগুলো শুধু বলার জন্য বলা…যখন আসল ঘটনা বুঝতে পেরেছি, তখন চাইলেই তা থামাতে পারতাম। তখন মিথ্যারও প্রয়োজন হতো না। বিশ্বাসঘাতকতার প্রশ্নও থাকতো না।”

“তাহলে?” জানতে চাইলো লুইস। 

“সত্যিটা হলো…” 

লুইসের দিকে ঘুরলো ক্যামিল, কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। 

“…আমি এর শেষ দেখতে চাইছিলাম। কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়। একবারের মত সব ঝামেলা ঝেড়ে ফেলতে চাইছিলাম। আমার মনে হয়…বিশ্বস্ততার খাতিরেই কাজটা করেছি। আর ওই নারী…তার উদ্দেশ্য অসৎ মনে হয়নি আমার। যদি তাই হতো, তাহলে ঘটনাস্থলেই, তাকে আটক করতাম। যতক্ষণে আসল ঘটনা বুঝতে পেরেছি, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। আমি জানতাম, কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে এতোটা অত্যাচার আর কষ্ট কেউ সহ্য করে না। পরবর্তিতে আমার ধারণাই সত্য প্রমাণিত হয়। ভাইয়ের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছিল সে। আমি জানি কথাটা বেশ অদ্ভুত শোনাচ্ছে। ইদানিং এমন ভালোবাসার দেখা পাওয়া যায় না। হ্যাফনারকেই দেখো, ও তো কোনো ফেরেশতা ছিল না। কিন্তু স্ত্রী আর সন্তানের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করলো। ঠিক একই কাজ ভাইয়ের জন্য করেছে অ্যানি…এমন মানুষজন এখনো বেঁচে আছে, লুইস।” 

“আর আপনি?” 

“আমি!” 

দ্বিধান্বিত বোধ করলো ক্যামিল। 

“জীবনে তো সবকিছুই হারিয়েছি। যখন বুঝতে পারলাম জীবনে এখনো এমন কেউ আছে, যার জন্য মূল্যবান কিছু ত্যাগ করা যায়। তখন খুব একটা খারাপ লাগেনি। এই স্বার্থপরতার সময়ে, এইটুকু তো করাই যায়, কী বলো?” 

কিছুই বলল না লুইস। 

 “ঠিক আছে, আজ আর কথা না বাড়াই। এখনো পদত্যাগ পত্র লেখা বাকি। এদিকে, ঠিকমতো ঘুমও হয়নি….” 

চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সে। 

“লুইস!” 

হ্যাফনারের বাড়ির ভেতর থেকে এক ফরেনসিক অফিসার ডাকলো তাকে। 

হাত দিয়ে ইশারা করলো ক্যামিল : যাও, লুইস। 

“এক্ষুণি আসছি আমি,” এই বলে এগিয়ে গেল লুইস। কিন্তু, ফিরে এসে, ক্যামিলের দেখা পেল না সে।

.

রাত ১ টা ৩০ 

স্টুডিওতে লাইট জ্বলতে দেখে একটু চমকে উঠলো ক্যামিল। ইঞ্জিন বন্ধ করে গাড়ির ভেতরেই বসে রইলো সে। কী করা যায় তা নিয়ে ভাবতে লাগলো। 

অ্যানি চলে এসেছে। 

এই সময়টায় একা থাকা প্রয়োজন ক্যামিলের। 

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোটটা হাতে নিলো সে। প্লাস্টিকে মোড়ানো ফাইলটার কথাও ভুলল না। অ্যানির প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, কী বা বলবে তাকে, কীভাবে বলবে, এই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল। 

সদর দরজা আধখোলা। 

হালকা আলোয় ভেতরটা দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে। এই অন্ধকারে অ্যানির অবস্থান অনুমান করাও কষ্টসাধ্য। ফাইলটা সিঁড়ির গোঁড়ায় রাখলো সে। 

“অ্যানি…কোথায় তুমি?” 

উত্তরটা ভালোমতোই জানা আছে তার। 

স্টোভের দিকে এগিয়ে গেল সে। বাড়িতে ঢুকে এটাই তার প্রথম কাজ। স্টোভে একটা কাঠের ঠুকরো ছুড়ে দিলো। 

কাপবোর্ডের ঢাকনা খুলে চিন্তা করলো, হুইস্কি, কগন্যাক? 

আজকে কগন্যাকই চলুক। এরপর সিঁড়ির গোঁড়া থেকে ফাইলটা নিয়ে এলো। বাড়িটা ভীষণ পছন্দ তার। চারপাশের পরিবেশটা তাকে আপন করে নিয়েছে। 

ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত। কিন্তু এই মুহূর্তে মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে তার। মায়ের স্পর্শ পেতে খুব ইচ্ছে করছে। আবেগ ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে ক্যামিলের। 

অনেক কষ্টে কান্না আটকে রাখলো। একা একা কেঁদেই বা কী হবে। 

এরপর ফাইলটা হাতে নিলো ক্যামিল। এখানে আইরিনের শেষ মুহূর্তের কয়েকটা ছবি আছে। 

কিন্তু, সেদিকে তাকালো না ক্যামিল। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। ফাইলটা তুলে স্টোভের দিকে ছুড়ে দিলো। আগুনে পুড়ছে ফাইলটা। আগুনের শিখা যেন হুট করেই বদলে গেল। ওই দিকে তাকিয়ে সে সম্মোহিত হয়ে পড়লো। স্ত্রীর সমস্ত স্মৃতি ভেসে উঠছে তার মনে। 

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *