দ্বিতীয় দিন – দুপুর

দুপুর ১২টা 

ইদতিতে জুডিশিয়েঁ থেকে আগত অফিসার পোলিশ বংশোদ্ভূত; কেউ ডাকে ক্রিস্টোভিয়াক, বাকিরা ক্রিস্টোউইয়াক; একমাত্র ক্যামিলই তার নামের শুদ্ধ উচ্চারণ করতে পারে : ক্রিজটোফিয়াক। তার গালে উলভারিনের মত দাঁড়ি। দেখতে অনেকটা সোনালি যুগের রকস্টারদের মত। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একটা অ্যালিমিনিয়াম ফ্লাইট কেসে করে সবসময় নিজের সাথেই রাখে। 

ডা. ডেইনভিলের কাছ থেকে এক ঘণ্টা সময় পেয়েছে দুজন। বড়জোর আর এক ঘণ্টা সময় বাড়তে পারে। তবে ক্যামিল ভালোমতোই জানে, কমপক্ষে চার ঘণ্টা লাগবে। ক্রিজটোফিয়াক ফরেনসিক অফিসার হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছে, সে বুঝতে পারছে ছয় ঘণ্টার আগে কোনোভাবেই সম্ভব না। এমনকি দুইদিনও লাগতে পারে। 

তার সংগ্রহে থাকা হাজারো ছবির মাঝ থেকে খুব সতর্কতার সাথে কিছু ছবি আলাদা করতে হবে। মূল উদ্দেশ্যই হলো যত কম ছবি দেখানো যায়। একটা সময়ে দেখা যায়, সাক্ষীর কাছে সব ছবিই একরকম লাগা শুরু হয়। তখন সব প্রচেষ্টাই বিফলে যায়। পুলিশ ডাটাবেজে থাকা সকল সার্বিয়ানের ছবি আলাদা করলো সে। 

এরপর অ্যানির দিকে ঝুঁকলো। 

“শুভ দুপুর, ম্যাডাম…” 

ক্রিজটোফিয়াকের কণ্ঠস্বর বেশ আকর্ষণীয়। আচার আচরণেও বেশ ভদ্র সে। কাজের ব্যাপারেও তার দক্ষতা প্রশংসনীয়। অ্যানির মুখটা এখনো ফুলে আছে। প্রায় এক ঘণ্টা ঘুমিয়েছে সে। সতর্কভাবে হাসলো যাতে করে ভাঙা দাঁত দেখা না যায়। এদিকে অ্যালুমিনিয়াম ফ্লাইট কেস খুলে কয়েকটা ফাইল বের করে আনলো ক্রিজটোফিয়াক। আর তারপর নিজের চিরাচরিত বুলি আওড়ানো শুরু করলো, যা ইতোমধ্যে ক্যামিলের মুখস্থ হয়ে গেছে। 

“সবকিছু খুব দ্রুত শেষ হতে পারে। বলা তো যায় না, ভাগ্যদেবী কখন কার দিকে মুখ তুলে তাকায়।” 

চওড়া আর উৎসাহব্যঞ্জক হাসি উপহার দিলো ক্রিজটোফিয়াক। কাজের শুরুতে এভাবেই পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করে সে। তার কাজই এমন মানুষদের সাথে, যারা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার কিংবা সাক্ষী, ধর্ষিত নারী কিংবা খুনের সাক্ষী ।

“কিন্তু মাঝে মাঝে…” কথা চালিয়ে গেল সে, “…মাঝে মাঝে একটু সময় লাগে। যদি আপনি ক্লান্ত বোধ করেন, নির্দ্বিধায় আমাকে জানাবেন, ঠিক আছে? তাড়াহুড়োর কোনো দরকার নেই….” 

মাথা নাড়লো অ্যানি। আশেপাশে তাকিয়ে ক্যামিলকে খুঁজছে। 

অ্যানির সম্মতি পেয়ে খুশি হলো সে। 

“ঠিক আছে। শুরুতেই বলে রাখি কী কী করতে হবে আপনার।” 

.

দুপুর ১২টা ১৫ 

কমিশনার মিচার্ডের কর্মকাণ্ড নিয়ে কিছু রসিকতা প্রচলিত আছে সহকর্মীদের মাঝে। হুট করেই তা মনে হলে হাসি পেল ক্যামিলের। যদিও এসবের মন মানসিকতা এখন একদমই নেই। অ্যানিকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য যে অফিসারকে পাঠানো হয়েছে, তাকে বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে ক্যামিলের। গতকালকেই লম্বা চওড়া এই অফিসারের সাথে গ্যালারি মনিয়েরে দেখা হয়েছিল তার। চোখের নিচের কালো দাগ, মনে হয় কেবলই কবর থেকে উঠে এসেছে। কুসংস্কারে বিশ্বাসী হলে এটাকে খারাপ লক্ষণ হিসেবেই দেখতো ক্যামিল। অ্যানির দরজার সামনে দৈত্যাকৃতির এই জোম্বিকে দেখে নিজের মেজাজ ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে ক্যামিলের। 

স্যালুট দেবার আগেই তাকে থামিয়ে দিলো ক্যামিল। 

“ভেরহোভেন,” পরিচয় দিলো সে। 

“কম্যান্ড্যান্ট!” ক্যামিলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো অফিসার। 

প্রায় ছয় ফুট এক ইঞ্চি লম্বা হবে এই অফিসার, ধারণা করলো ক্যামিল। হুকুমে পারদর্শী। ইতোমধ্যে ওয়েটিং রুম থেকে সবচেয়ে আরামদায়ক চেয়ারটা নিজের জন্য আনিয়ে নিয়েছে। দেয়াল ঘেষে নীল রঙের একটা ব্যাকপ্যাক রাখা। হয়তো তার স্ত্রী কয়েকটা স্যান্ডুইচ আর এক ফ্লাস্ক কফি বানিয়ে দেয়। কিন্তু এতোকিছুর মাঝে সিগারেটের গন্ধ পেল ক্যামিল। দুপুর না হয়ে রাত আটটা হলে, সাথে সাথে বাসায় পাঠিয়ে দিতো লম্বুকে। প্রথমবার যখন সিগারেট ফুঁকতে নিচে নামবে, তার উপর নজর রাখবে কেউ। দ্বিতীয়বারে, খুনের উপযুক্ত সময় ঠিক করে ফেলবে খুনি। আর তৃতীয়বারে অফিসার আসার আগেই অ্যানির খুলি উড়িয়ে পালাবে সে। মিচার্ড হয়তো সবচেয়ে লম্বা অফিসারকেই পাঠিয়েছে। কিন্তু তার বুদ্ধি সব হাঁটুতে বলেই মনে হলো ক্যামিলের। আপাতত, এটা কোনো সমস্যা না। এতো দ্রুত ফিরে আসবে খুনি, এমনটা ক্যামিলও ভাবে না। এমন দিনে দুপুরে তো অবশ্যই না। 

রাতের সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই সেটা রাতেই দেখার সিদ্ধান্ত নিলো ক্যামিল। তবে মৌখিকভাবে সতর্ক করার প্রয়োজন বোধ করলো সে। 

“এই জায়গা থেকে এক চুলও নড়বে না, মনে থাকবে?” 

“জি, কম্যান্ড্যান্ট!” পরিস্কারভাবে বলল অফিসার। ।

এমন জবাবে যে কারো রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। 

.

দুপুর ১২টা ৪৫ 

করিডোরের শেষ মাথায় ছোট একটা ওয়েটিং রুম, যা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত। তবে রুমটার উদ্ভট অবস্থানে ক্যামিলও বেশ অবাক হলো। নার্স ফ্লোরেন্স জানালো, শুরুতে এখানে অফিস বানানোর কথা থাকলেও পরবর্তিতে সে সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। তাই কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুসারে, রুম থাকলেও তা কোনো কাজে লাগছে না। কিন্তু নিয়ম তো মানতেই হবে। হাজার হলেও ইউরোপের দেশ তো, নিয়ম না মানলে চলে কী করে। তাই জায়গার অভাবে এটাকেই স্টোর রুম বানিয়েছে নার্সরা। যখনই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরিদর্শনে আসে, তখনই ট্রলিতে করে সবকিছু নিচ তলায় নামিয়ে ফেলে। তবে তা ততোক্ষণের জন্য, যতক্ষণ পরিদর্শন চলে। কর্তৃপক্ষও খুশি মনে সিল মেরে চলে যায়। 

দেয়াল ঘেষে থাকা বাক্স সরিয়ে দুটো চেয়ার বের করে আনে ক্যামিল। এরপর কফি টেবিলের পাশে লুইসকে নিয়ে বসলো। হাতে থাকা কেস সম্পর্কে আপডেট দিতে শুরু করলো লুইস। জার্মান পর্যটক আত্মহত্যাই করেছিল; আর ওই সন্দেহভাজন ড্রাইভারকে চিহ্নিত করা গেছে। এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে, দুই একদিনের ভেতরেই ধরা পড়বে; আর একাত্তর বছর বয়সি ওই বৃদ্ধ খুনের কথা স্বীকার করেছে, ঈর্ষান্বিত ছিল সে। এসব শেষ হওয়ার পর অ্যানির বিষয়ে আলোচনা শুরু করলো ক্যামিল। 

“যদি হ্যাফনারকে শনাক্ত করতে পারে ম্যাডাম ফরেস্টিয়ে…” বলতে শুরু করলো লুইস। 

“চিনতে না পারলেই বা সমস্যা কোথায়,” থামিয়ে দিলো ক্যামিল, “তার মানে এই না, যে ওটা হ্যাফনার ছিল না।” 

একটু বিরতি নিলো লুইস। এমনিতে তার বস রগচটা স্বভাবের নয়। কিন্তু এই কেসে অন্য কোনো ব্যাপার আছে। আর তা ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছে। এই কথা বসকে বলা খুব একটা সহজ কাজ হবে না। 

“অবশ্যই,” সায় জানালো লুইস, “যদি ম্যাডাম ফরেস্টিয়ে চিনতে নাও পারেন, তবুও হ্যাফনার হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেক্ষেত্রেও একটা সমস্যা থেকে যায়। লোকটা তো পৃথিবীর বুক থেকে একদম গায়েব হয়ে গেছে। গত জানুয়ারির ডাকাতির কেসটা নিয়ে আমি সংশ্লিষ্ট অফিসারদের সাথে কথা বলেছি। অবশ্য আরেকটা ছোট ঝামেলা হয়েছে। কেসটা ওদের কাছে কেন পাঠানো হয়নি তা জানতে…” 

হাত দিয়ে ইশারা করে, পাত্তা না দেয়ার ভঙ্গি করলো ক্যামিল। 

“জানুয়ারির পর থেকে লাপাত্তা হ্যাফনার। কেউই জানে না কোথায় গেছে। অবশ্য গুজব প্রচলিত আছে-দেশ ছেড়ে পালিয়েছে কিংবা রিভেইরায় গিয়েছে। এমনিতেই তার উপর খুনের অভিযোগ আছে। তাই দেশ থেকে পালালে, অবাক হওয়ার কিছু নেই। এমনকি তার সবচেয়ে কাছের লোকও, কিছু জানে বলে মন হয় না…” 

“…কাছের লোকও জানে না?” 

“হ্যাঁ। আমার মাথায় প্রথমেই এই চিন্তা আসে। কেউ না কেউ তো কিছু জানবে। একটা জলজ্যান্ত লোক তো আর রাতারাতি গায়েব হয়ে যেতে পারে না। আর এইরকম অবস্থায় আরেকটা কাজে জড়িয়ে পরার ব্যাপারটাও, ভাবাচ্ছে আমাকে। কিছুটা অবাকও লাগছে। যে কেউ এমন সময়ে গা ঢাকা দিয়েই থাকতে চাইবে।” 

“গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু জানতে পারলে?” 

অনেক ধরনের তথ্যই তো পাওয়া যায়। তথ্য পাওয়া এবং দেয়ার অধিকার সবারই আছে। ছিঁচকে চোররা অল্পবিস্তর তথ্য নিয়েই কাজে নেমে পড়ে। কিন্তু এ পেশায় দক্ষ লোকজন, সম্পূর্ণ তথ্য ছাড়া কাজ করে না। যে কোনো সময় বিপদ হতে পারে। তাই ঝুঁকি নেয়া উচিত হবে কি না, তা আগেই যাচাই করে নেয়। 

গ্যালারি মনিয়েরের কেসে যে মেয়েটা দেরি করে কাজে এসেছিল, তাকে সন্দেহভাজনের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। তাই এখন বাকি থাকলো… 

“ম্যাডাম ফরেস্টিয়েকে জিজ্ঞেস করতে হবে, ওখানে কী করতে গিয়েছিল,” বলল ক্যামিল। 

শুধু নিয়ম রক্ষার খাতিরেই প্রশ্নটা করা হবে। উত্তর না পাবার সম্ভাবনাই বেশি, ক্যামিল তা জানে। কিন্তু প্রশ্নটা করতেই হবে। অ্যানির জায়গায় অন্য যে কেউ হলে, একই প্রশ্নের মুখোমুখি হতো। অ্যানির সময়সূচি সম্পর্কে খুব একটা জানে না ক্যামিল। কাজের সুবাদে একেক দিন একেক জায়গায় যেতে হয় অ্যানির। এটা মেনেই সম্পর্কে জড়িয়েছে সে। তাই, যখনই দেখা হয়, তাতেই খুশি থাকে ক্যামিল। 

কিন্তু লুইস ম্যারিয়ানি, খুবই ভালো মানের অফিসার। সুবিবেচক, বুদ্ধিমান, সংস্কৃতিমনা, অতিসতর্ক আর…সন্দেহপ্রবণ। সাহসী। যা একজন ভালো অফিসারের অত্যাবশ্যকীয় গুণ। 

যেমন, কমিশনার মিচার্ড যখন প্রশ্ন করে হ্যাফনার অ্যানির রুমে ঢুকেছিলা কিনা, তা শুধু জানার খাতিরেই করে। কিন্তু এই কেসে ক্যামিলের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে, তার মনে সন্দেহ ঢুকেছে। আর যখন ক্যামিল চিন্তা করে অ্যানি ডাকাতের মুখ ছাড়াও আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেখেছিল কি না, তখন তার মনেও সন্দেহ জাগে। 

আর লুইস যখন কোনো এক কেসে কাজ করে যেখানে ডাকাত দল এক নারীকে নৃশংসভাবে আঘাত করে, তখন তার মনে প্রশ্ন জাগে ঘটনার সময় ভিক্টিম ওখানে কী করছিল। ওইদিন তো তার অফিসে থাকার কথা। দোকান কেবলই খুলছিল, হয়তো দুই একজন পথচারীও ছিল। কিন্তু, ভিক্টিম ছাড়া আর কোনো ক্রেতাই ছিল না। সরাসরি ভিক্টিমকেই প্রশ্নটা করতে পারতো সে। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে সেই সুযোগটা কেবল তার বস ভেরহোভেনই পেয়েছে। 

আর তাই সরাসরি ভিক্টিমকে কিছু জিজ্ঞাসা করলো না লুইস। পরোক্ষ উপায়ই বেছে নিলো সে। 

পরবর্তি বিষয়ে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলো ক্যামিল। কিন্তু, তার চোখ পড়লো লুইসের দিকে, নিচু হয়ে ব্রিফকেসে কিছু একটা খুঁজছে সে। বিলের মত দেখতে একটা কাগজ বের করে আনলো। অল্প সময়ের জন্য চোখে চশমা নিলো লুইস। চালশে তো এতো দ্রুত ধরার কথা না, মনে মনে ভাবলো ক্যামিল। কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, লুইসের বয়স কত? লুইসের ব্যাপারটা অনেকটা নিজ সন্তানের মত, যার বয়স কখনোই মনে থাকে না। বছরে অন্তত তিনবার লুইসকে একই প্রশ্ন করে সে। 

বিলের একটা ফটোকপি ক্যামিলের সামনে মেলে ধরলো লুইস। চশমাটা চোখে দিয়ে পড়তে শুরু করলো ক্যামিল : ‘অ্যানি ফরেস্টিয়ে। প্রায় আটশো ইউরোর এক ঘড়ির অর্ডার দিয়েছিল অ্যানি। 

“দশদিন আগে ঘড়িটা অর্ডার দিয়েছিল ম্যাডাম ফরেস্টিয়ে। ওটাই আনতে গিয়েছিল সেদিন।” 

নাম খোদাইয়ের জন্য দশদিন সময় চেয়েছিল দোকানের মালিক। কোন ভুল যাতে না হয়, তাই বড় হাতের অক্ষরে স্পষ্ট করে নামটা লিখে নেয়। এতো দামি জিনিসে একবার ভুল হলেই সর্বনাশ, একবার খালি ক্রেতার মুখের কথা কল্পনা করুন। আর তাই ম্যাডাম ফরেস্টিয়েকে নিজ হাতে নামটা লিখে দিয়ে আসতে হয় যাতে পরবর্তিতে কোনো ঝামেলা না হয়। অ্যানির হাতের লেখা দেখেই চিনতে পারলো ক্যামিল। 

ঘড়িতে খোদাইয়ের জন্য নাম : ক্যামিল 

কিছু সময়ের জন্য নিস্তদ্ধ হয়ে গেল দুজন। 

দুজনে প্রায় একইসাথে চশমা নামিয়ে রাখলো। মাথা নিচু অবস্থাতেই লুইসের দিকে কাগজটা এগিয়ে দিলো ক্যামিল। 

“অ্যানি…আমার বন্ধু।“ 

মাথা নাড়লো লুইস। বন্ধু। ঠিক আছে, কোনো সমস্যা নেই।

“খুব কাছের বন্ধু।” 

কাছের বন্ধু। তাহলে তো ভালোই। এতোক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারলো লুইস। ক্যামিলের জীবনের কিছু অংশ তার অজানাই রয়ে গেছে। কিন্তু এমনটা কখন ঘটলো তাই মনে করার চেষ্টা করলো সে। 

চার বছর আগের কথা চিন্তা করলো লুইস। আইরিনকে চিনতো সে, দুজনের মাঝে সম্পর্কও বেশ ভালো ছিল। তাকে ‘আদরের ছোট্ট ভাই’ বলে ডাকতো আইরিন। আর যৌনজীবনের কথা জিজ্ঞেস করে প্রায়ই লজ্জায় ফেলতো। আইরিনের মৃত্যুর পর এলো এক নতুন অধ্যায়-মানসিক হাসপাতাল, যেখানে প্রায়ই ক্যামিলকে দেখতে যেতো সে। কিন্তু একটা সময় ক্যামিল জানায়, একা থাকতেই পছন্দ করে সে। তবে, এরপরেও দূর থেকে ক্যামিলকে দেখে চলে এসেছে লুইস। ধূর্ত লা গুয়েনের তীব্র প্রচেষ্টার ফলে দুই বছর পরে ক্রাইম স্কোয়াডে এক প্রকার বাধ্য হয়েই ঢোকে ক্যামিল। এরপরেই লুইসকে তার দলে পুনঃনিয়োগ দেয়ার আবেদন জানায় সে। এরপর ক্যামিলের ব্যক্তিগত জীবনে কী ঘটেছে, সে ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই লুইসের। কিন্তু ক্যামিলের মত শিষ্টাচার সমন্বিত কারো জীবনে হুট করে কোনো নারীর আগমন ঘটলে, তা বোঝায় অসংখ্য উপায় আছে। আচার আচরণে পরিবর্তন, দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে অস্বাভাবিকতা। আর ঠিক এই বিষয়গুলোতেই সবসময় নজর থাকে লুইসের। আজকের আগ পর্যন্ত ভেরহোভেনের জীবনে কোনো নারীর আগমনের ঘটনা অলস মস্তিষ্কের কল্পনা বলেই তুচ্ছজ্ঞান করতো সে। তার মতো হতাশাগস্ত এক বিপত্নীক মানুষের পক্ষে সত্যিকারের ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়াটা ভূমিকম্পের মতই বিশাল ঘটনা। কিছু একটা ঠিক মিলছে না, পুরো ব্যাপারটা গোলমেলে লাগছে লুইসের কাছে। 

টেবিলে থাকা চশমার দিকে তাকিয়ে আছে লুইস, যেন ব্যাপারটা এখন পরিষ্কার বুঝতে পারবে। তার মানে, ‘কাছের এক বন্ধু’ আছে ক্যামিলের, যার নাম অ্যানি ফরেস্টিয়ে। গলা খাকারি দিলো ক্যামিল। 

“এসবের মাঝে তোমাকে জড়াতে বলছি না, লুইস। আর আমি নিয়মনীতির বিরুদ্ধে যেয়ে কাজ করছি। এ ব্যাপারে ভালোমতোই জানা আছে। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। একথা কাউকে মনে করিয়ে দিতে হবে না। আর এমন ঝুঁকির মাঝে তোমাকে টেনে আনতে পারি না, লুইস! ( সহকারীর দিকে তাকালো সে।) আমি শুধু একটু সময় চাচ্ছি। আর কিছু না। কেসটা খুব দ্রুত শেষ করতে হবে আমার। মিচার্ডের কাছে মিথ্যা বলে এই কেস হাতে নিয়েছি। সে টের পাওয়ার আগেই যা করার করতে হবে। যদি ডাকাত দলকে এর মাঝে ধরে ফেলতে পারি, এসব আর কোনো সমস্যাই হবে না তখন। অন্তত কোনো একটা উপায় বের হবে। কিন্তু আমরা যদি ধরতে ব্যর্থ হই আর কেসটা অন্য কারো হাতে যায়, এবং সত্যটা বেরিয়ে আছে…তাহলে? তুমি তো মিচার্ডকে ভালোমতোই চেনো, বেশ বড় মাশুল গুণতে হবে। আর আমার ভুলের জন্য তুমি কেন ভুগবে!” 

গভীর চিন্তায় ডুবে গেল লুইস, তার মনে যেন অন্য কোথাও পড়ে আছে। চারপাশে এমনভাবে তাকাচ্ছে, যেন খাবার অর্ডার দেয়ার জন্য কোনো ওয়েটারকে খুঁজছে। টেবিলে থাকা কাগজটার দিকে ইশারা করলো লুইস। 

“এটা তো তদন্তে খুব একটা কাজে লাগবে না, তাই না?” বলল সে। তার কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে, কোনো গুপ্তধন আবিষ্কার করে আরো বিষণ্ন হয়ে পড়েছে। “আমি বলতে চাচ্ছি যে, ক্যামিল তো খুবই পরিচিত নাম। আর এটা কী ছেলে না মেয়ের নাম তা জানারও কোনো উপায় নেই….” 

“তাহলে এটা কী করবে?” জানতে চাইলো ক্যামিল। 

কোনো জবাব না দিয়ে টাই ঠিক করে নিলো লুইস। 

বাম হাত দিয়ে চুল পেছনে ঠেলে দিলো। 

কাগজটা টেবিলে রেখেই উঠে দাঁড়ালো লুইস। কাগজটা মুড়িয়ে বলের মত বানিয়ে, পকেটে চালান করলো ক্যামিল। 

.

দুপুর ১টা ১৫ 

ইদতিতে জুডিশিয়েঁ’র অফিসার নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে বিদায় নিয়েছে। 

“অনেক ধন্যবাদ, ম্যাডাম ফরেস্টিয়ে, অনেক সাহায্য করেছেন আপনি.” এই বলে বেরিয়ে যায় সে। ফলাফল যাই হোক, সবসময় এই কথা বলেই বিদায় নেয় সে। 

অবশ্য এসব শেষ করার পর, অ্যানির বেশ ক্লান্ত লাগছে। বিছানা ছেড়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজ ক্ষতের বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার লোভ সামলাতে পারলো না। মাথার ব্যান্ডেজ খুলে ফেলার কারণে নিজের লম্বা চুলের দিকে নজর পড়লো তার। একইসাথে মাথার সেলাইও দেখলো পেল। মুখটা এখনো ফুলে আছে। চোয়াল বরাবর কয়েকটা সেলাই দেখা যাচ্ছে। অবশ্য ফুলে থাকা মুখের ব্যাপারে ডাক্তার বারবার বলেছে, প্রথম কয়েকদিন এমনই থাকবে। অ্যানি সবই জানে, সবই শুনেছে, কিন্তু দেখতে যে হবে; তা তো কেউ বলেনি। বেলুনের মত ফুলে গেছে মুখ, মদ্যপ ব্যক্তির লক্ষণ ফুটে উঠেছে তার চেহারায়। প্রচণ্ড রকমের অসহায় বোধ করলো অ্যানি। চূড়ান্ত অবিচারের শিকার হয়েছে সে। 

আঙুল দিয়ে গাল ছোঁয়ার চেষ্টা করলো সে। সাথে সাথে মৃদু ব্যথা অনুভূত হলো তার, আর সেই ব্যথা যেন অনন্তকালের জন্য ওখানেই বাসা বাঁধলো। 

আর দাঁতের কথা ভাবেলেই নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয় তার, কেন হয় তা নিজেও জানে না; যেন ম্যাস্টেকটোমি করা হয়েছে, মনে মনে ভাবলো সে। যেন তার সৌন্দর্যের উপর সরাসরি আঘাত হেনেছে কেউ। চাইলেও আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে না। কিছুদিন পর তার ডেন্টাল ইমপ্ল্যান্ট করা হবে। কিন্তু এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি তো মিলবে না। 

এইতো কিছুক্ষণ আগেই, ঘণ্টাব্যাপী কয়েক ডজন ছবি দেখতে হয়েছে। যেভাবে বলা হয়েছে, সেভাবেই কাজ করেছে সে। কোনো রকম আবেগের আতিশয্য ছাড়াই, বাধ্য ছাত্রীর মত শিক্ষকের আদেশ মেনেছে। আর কাঙ্ক্ষিত লোকটাকে চিনতে পারার সাথে সাথে তর্জনী দিয়ে তাকে দেখিয়ে দিয়েছে। 

এইতো। এই লোকটাই।

কিন্তু এর শেষ কোথায়? 

একা ক্যামিলের পক্ষে, তাকে রক্ষা করা সম্ভব না। তাহলে আর কার উপর ভরসা করতে পারে সে? 

হয়তো ক্যামিলও চায়, এই দুঃস্বপ্নের প্রহর কেটে যাক। উপায় ভিন্ন হলেও দুজনের চাওয়া একই। 

চোখের পানি মুছলো অ্যানি। টিস্যুর জন্য আশেপাশে তাকালো। ভাঙা অবস্থায় নাক ঝাড়া, বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে না। 

.

দুপুর ১টা ২০ 

পূর্ব অভিজ্ঞতা বিবেচনা করলে, আমি যা চাই শেষমেশ তা হাসিল করেই ছাড়ি। ঠিক এই মুহূর্তে কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এর পেছনে আংশিকভাবে দায়ি সময় সল্পতা। আর বাকি অংশের জন্য দায়ি আমার স্বভাব। কারন আমি দুর্বার, দুর্দমনীয়। 

আমার এখন অর্থকড়ি দরকার। আর তাই, রক্ত পানি করা সম্পদ যেনতেনভাবেহারাতে পারি না। ভবিষ্যতের জন্যও তো কিছু দরকার। আর আমার ভবিষ্যতের উপর খবরদারি করার অধিকার কারো নেই 

তাই দ্বিগুণ পরিশ্রম শুরু করলাম। 

এলাকার প্রতিটি কোণা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিলাম। প্রথমে পায়ে হেঁটে, তারপর গাড়িতে করে। প্রায় বিশ মিনিট জুড়ে চলল এই কর্মযজ্ঞ। মানুষজনের কোনো চিহ্নই নেই। তবুও দূরবীন দিয়ে আরো দশ মিনিট পর্যবেক্ষণ করলাম। নিজের উপস্থিতির কথা ম্যাসেজের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। ফ্যাক্টরি পার হতেই একটা ভ্যান চোখে পড়লো। 

পরিত্যক্ত এক শিল্প এলাকায় ভ্যানটা রাখা। আমি বুঝি না, এই লোকগুলো সবসময় এমন জায়গা কীভাবে খুঁজে বের করে? অস্ত্র ব্যবসার বদলে ছবির লোকেশন খুঁজে বের করার কাজ করলেও পারতো। 

ভ্যানের ভেতরটা একদম সাজানো গোছানো, যেন কোনো কম্পিউটার অ্যানালিস্টের কাজ। 

আমার বন্ধু সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভুল করলো না। সুদসহ বেশ বড় অঙ্কই দাবি করলো সে। অবশ্য যাবতীয় কর্মকাণ্ডে একটা বুলেট তার প্রাপ্য হয়ে গেছে। কিন্তু, বাতাস এখন উল্টো দিকে বইছে। হাতে একদমই সময় নেই। আপাতত মসবার্গকে দূরে ঠেলে ৩০৮ ক্যালিবারের এম৪০ সেমি অটোম্যাটিক স্নাইপার রাইফেল বেছে নিলাম। একইসাথে সাইলেন্সার, টেলিস্কোপ সাইট আর দুই বক্স অ্যামুনিশন। দূর থেকে খুলি উড়ানোর মজাই আলাদা। হ্যান্ডগান হিসেবে ওয়ালথার পি৯৯ আমার বেশি পছন্দ। দারুণ কার্যকরী সাইলেন্সারের কথা নাই বা বললাম। আর সবশেষে একটা হান্টিং নাইফ নিয়ে নিলাম, যা সবসময়ই কাজে দেয়। 

ওই বেশ্যা তো আমার প্রতিভার ঝলক কিছুটা হলেও দেখেছে। 

কিন্তু, এবার ঝলকানি আরো বেশি হবে; আরো বেশি চমকে উঠার সুযোগ পাবে ও। 

.

দুপুর ১টা ৩০ 

ভিনসেন্ট হ্যাফনারই। 

“প্রত্যক্ষদর্শী এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত,” ক্যামিল আর লুইসের সাথে যোগ দিয়েছে ক্রিজটোফিয়াক। “তার স্মৃতিশক্তির প্রশংসা করতে হয়।” 

“যদিও খুব অল্প সময়ের জন্য মুখ দেখতে পারার কথা তার…” মতামত জানালো লুইস। 

“অল্প সময়েও কাজ হতে পারে। সবকিছু পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। কিছু প্রত্যক্ষদর্শী আছে, যারা অনেকক্ষণ দেখার পরেও মনে রাখতে পারে না। কিন্তু এমনও আছে, যে একবার দেখেই হুবহু বর্ণনা দিতে পারে। এর কারন আমি নিজেও বুঝি না।” 

কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখালো না ক্যামিল; যেন তার বিষয়েই কথা বলছে উপস্থিত দুজন। মেট্রোতে কাউকে এক নজর দেখলেও, এক দুইমাস পর নিখুঁত স্কেচ আঁকতে কোনো সমস্যাই হয় না তার 

“মাঝে মাঝে, প্রত্যক্ষদর্শীর কিছুই মনে থাকে না,” কথা চালিয়ে গেল ক্রিজটোফিয়াক, “কিন্তু কেউ আপনাকে অমানবিকভাবে মারবে, নির্বিচারে গুলিও চালাবে-তার চেহারা তো আর সহজে ভোলা যায় না।”

কথাটা মজা করার উদ্দেশ্যে বলল কি না, তা লুইস কিংবা ক্যামিল কেউই বুঝতে পারলো না। 

“বয়স, শারীরিক গঠনসহ আরো কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই ছবি দেখিয়েছি। হ্যাফনারের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ম্যাডাম ফরেস্টিয়ে।” 

ল্যাপটপের পর্দায় একটা ছবি ভেসে উঠলো। লম্বা চওড়া লোকটার বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। আগেরবার গ্রেফতার হওয়ার পরেই ছবিটা তোলা। ক্যামিলের মতে, উচ্চতা পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি। 

“আসলে, ছয় ফুট,” হাতে থাকা ফাইলের পৃষ্ঠা উল্টানোর সময় বলল লুইস। ক্যামিলের মনের কথাও যেন বুঝতে পারে সে। 

শর্টগান হাতে উদ্ধত ডাকাতের সাথে ছবির লোকটাকে মেলানোর চেষ্টা করছে ক্যামিল। কালো কাপড়ে ঢাকা মুখ, অ্যানির দিকে এগিয়ে আসছে। এরপরেই শুরু হলো অমানবিক অত্যাচার। অ্যানির মাথা, পেট…বরাবর একের পর এক আঘাত। এসব কল্পনা করেও শিহরণ বোধ করলো ক্যামিল।

লুইস খেয়াল করলো, তার বসের হাত কাঁপছে। 

“বাকি দুজনের কী খবর?” জিজ্ঞেস করলো লুইস। 

আরেকজনের ছবি বের করলো ক্রিজটোফিয়াক। মুখ ভর্তি দাঁড়ি, আর পুরুষ্ট ভ্রূ লোকটার। 

“ম্যাডাম ফরেস্টিয়ে অবশ্য এর ব্যাপারে একটু দ্বিধান্বিত ছিলেন। তবে, এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। একটা সময় পর সবাইকেই এক রকম মনে হয়। কয়েকটা ছবি দেখে এই লোকটাকে চিহ্নিত করে ম্যাডাম ফরেস্টিয়ে । এরপর, আরো কিছু ছবি দেখতে চায়। কিন্তু ঘুরেফিরে এখানে এসেই থামছিল। ডুসান রাভিচ, সার্বিয়ান। ডাকাতি ঘটনায় এর জড়িত থাকার সম্ভাবনা প্রচুর।” 

এতোক্ষণ মাথা নিচু থাকলেও, এবার মুখ তুলে তাকালো ক্যামিল। লুইসের পাশে চলে এলো বাকি দুজন। পুলিশের ডাটাবেজে তথ্য খুঁজতে শুরু করলো লুইস। 

“১৯৯৭ সালে ফ্রান্সে এসেছে। খুবই ধূর্ত প্রকৃতির অপরাধী। দুইবার গ্রেফতার হলেও, খুব দ্রুত ছাড়া পেয়ে যায়। হ্যাফনারের সাথে তো কাজ করতেও পারে। দেশে ছিঁচকে চোর, ডাকাতের তো কোনো অভাব নেই। কিন্তু দক্ষ লোক পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য।” 

“তো, এই লোক এখন কোথায়?” 

অস্পষ্ট এক ইঙ্গিত করলো লুইস। জানুয়ারির পর থেকে কোনো খোঁজ নেই, একদম গায়েব হয়ে গেছে। জানুয়ারির ওই ডাকাতি আর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পর পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেকদিন গায়েব থাকার যথাযথ কারনও আছে। হুট করে ওই দল সরব হওয়াটা বিস্ময়কর। ইতোমধ্যে এক খুনের মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পরেও আবার এমন কাজ! রীতিমতো আগুন নিয়ে খেলা শুরু করেছে। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। 

অ্যানির বিষয়ে ফিরে এলো সবাই। 

“তার বক্তব্য কতোটা নির্ভরযোগ্য?” জানতে চাইলো লুইস। 

“বরাবরের মতই বলতে হয়। প্রথম ছবির ব্যাপারে পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য। দ্বিতীয়টা মোটামুটি। আর তৃতীয় কেউ যদি থেকেও থাকে, তার অবস্থান নিচেই থাকবে।” 

দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে ক্যামিলের। কথাবার্তা চালানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে লুইস, যাতে করে তার বস এর মাঝে স্বাভাবিক হতে পারে। শেষমেশ ফরেনসিক অফিসার বিদায় নিলো। লুইসও বুঝতে পারলো, তার প্রচেষ্টা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। 

“এই লোকগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে আমার,” ক্যামিলকে বেশ শান্ত দেখাচ্ছে। “এখনই বের করতে হবে।” 

আবেগের বশবর্তী হয়েই এসব বলছে ক্যামিল। মাথা নাড়লো লুইস। কিন্তু বসের এই অন্ধ আক্রোশের কারন খুঁজে পেল না। 

গভীর মনোযোগে ছবির লোক দুজনকে পর্যবেক্ষণ করছে ক্যামিল। “এই লোক”-হ্যাফনারের ছবির দিকে ইঙ্গিত করলো সে। “আগে একে খুঁজে বের করতে হবে। নাটের গুরুর ব্যাপারটা আমি দেখছি।” 

একমনে কথাগুলো বলে গেল ক্যামিল। বসকে বেশ ভালোভাবেই চেনে লুইস, তাই আসন্ন বিপর্যয় আঁচ করতে কোনো সমস্যাই হলো না তার। 

“শুনুন…” বলতে শুরু করলো লুইস। 

“তুমি,” তাকে থামিয়ে দিলো ক্যামিল, “এই সার্বের দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। মিচার্ডের সাথে দেখা করে ওয়ারেন্ট বের করছি আমি। এর মাঝে দায়িত্বে থাকা সব অফিসার জড়ো করো। জর্ডানকে ফোন দিয়ে ওর টিম রেডি করতে বলো। হ্যানোলের সাথেও যোগাযোগ করো। পরিচিত যে যে আছে, কাউকে বাদ দেবে না। যত বেশি লোক পাওয়া যায়, তত ভালো।” 

এতোগুলো কঠিন দায়িত্বের মুখোমুখি হয়েও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না লুইস। শুধু সামনে চলে আসা চুল পেছনে ঠেলে দিলো সে। তবে, ইঙ্গিতটা ঠিক ধরতে পারলো ক্যামিল। 

“যা বলছি তাই করো,” নিচু স্বরে বলল সে। “কোনো ঝামেলা হলে, সেটা আমি দেখবো। তোমাকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।” 

“তা নিয়ে ভাবছি না। শুধু বলতে চাইছি, পুরো ব্যাপারটা জানতে পারলে, আদেশ পালন করতে সুবিধা হয়।” 

“আমি কী বলছি, তা তুমি ঠিকই বুঝতে পারছো লুইস। আর কী জানতে চাও?” 

ক্যামিলের কন্ঠস্বর এতোটাই নেমে এসেছে, যে শুনতেও বেগ পেতে হচ্ছে লুইসের। সহযোগীর কাঁধে হাত রাখলো ক্যামিল। “এই কেসে ভুলের কোনো সুযোগ নেই আমার… বুঝতে পারছো? সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে আমাদের।” 

মাথা নাড়লো লুইস। যেন বলতে চাইছে, ঠিক আছে। তবে পুরোপুরি বুঝতে পেরেছি বলে মনে হয় না। কিন্তু, যা বলছেন, তাই করবো। 

“ইনফর্মার, মাগির দালাল, বেশ্যা, সবাই। কাউকে বাদ দেবে না। কিন্তু, আমি চাই তুমি অবৈধ অভিবাসীদের দিয়ে শুরু করো।”

এই ‘অবৈধ’ বলতে তাদেরকেই বোঝাচ্ছে, যাদেরকে পুলিশ দেখেও না দেখার ভান করে। যে কোন বিষয়ে তথ্যের জন্য এদের জুড়ি মেলা ভার। হয় কথা বলবি, নইলে প্লেনে করে বাড়ি ফিরবি-এই ধরনের হুমকি বেশ কাজে দেয়। এদের কারো সাথে যদি ওই সার্বের কোনো মেলামেশা থাকে-আর একা একা টিকতেও পারবে না সে, তাহলে তাকে খুঁজে বের করা মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। ডাকাতির কাজ সেরেছে দুইদিনও হয়নি। যদি 

এরমাঝে ফ্রান্স ছেড়ে না পালায়, তারমানে এখানে থাকার যথাযথ কারন আছে তার। 

“তুমি টিম তৈরি রাখো। যে কোনো মুহূর্তে ডাকলেই যেন পাওয়া যায়। সবুজ সংকেত পেলেই কল দেবো আমি। যত দ্রুত সম্ভব চলে আসবে। এরমাঝে, কোনো দরকার হলে ফোন তো আছেই।” 

.

দুপুর ২টা 

কম্পিউটারের সামনে বসে আছে ক্যামিল। 

পুলিশ ফাইল : ভিনসেন্ট হ্যাফনার। 

বয়স: ষাট বছর। বিভিন্ন অভিযোগে প্রায় চৌদ্দ বছর জেল খেটেছে। যুবক অবস্থাতেই নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়েছে (চুরি, চাঁদাবাজি, মাগির দালালি)। কিন্তু ১৯৭২ সালে, পঁচিশ বছর বয়সে, নিজের সত্যিকারের প্রতিভার সন্ধান পায়। পিটোতে, সশস্ত্র এক ডাকাতিতে অংশ নেয়। তবে ঠিক সময়ে পুলিশ চলে আসায় সমস্যার সম্মুখীন হয়। আহত অবস্থায় উদ্ধার হয় একজন। আট বছরের সাজা হলেও, পাঁচ বছরে বেরিয়ে আসে। পরবর্তীতে নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগায় আর এতোদিনে নিজের পছন্দসই পেশাও খুঁজে পায়। একটাই ভুল ছিল তার : অসতর্কতা। তাই আবার ধরা না খাওয়ার ব্যাপারে পণ করে। কিন্তু, সবকিছু তো আর পরিকল্পনা মাফিক চলে না। এরপরেও বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছে সে। কিন্তু বেশি সাজা হয়নি, এখানে দুই বছর, তো ওখানে তিন বছর। মোটামুটিভাবে সফলতার সাথেই কাটিয়েছে নিজের পেশাগত জীবন ।

তবে, ১৯৮৫ সালের পর আর গ্রেফতার হয়নি হ্যাফনার। সেই সময়টাতে ক্ষমতার একদম চূড়ায় ছিল সে। আলাদাভাবে এগারোটা ডাকাতির ঘটনায় সন্দেহভাজন হলেও, কোনো প্রমাণ মেলেনি। প্রতি কেসেই শক্ত অ্যালিবাই আর নির্ভরযোগ্য সাক্ষী থাকার কারণে, গ্রেফতার করাও সম্ভব হয়নি। সত্যিকারের এক শিল্পী ।

অপরাধ জগতের মূল হোতাদের মধ্য অন্যতম হলো হ্যাফনার, পুলিশের ফাইল অন্তত সেটাই বলে। হেলাফেলা করার মত ব্যক্তি সে না। বুদ্ধিমান হওয়ার কারণে তার জানাশোনাও অনেক। নিখুঁত পরিকল্পনা ছাড়া কোনো কাজ করে না, প্রয়োজনে কঠিন পথ বেছে নিতে দ্বিধা করে না তার দল। ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজনকে নৃশংসভাবে আঘাত করতে পিছ পা হয় না। যার ফলাফল সারাজীবন বয়ে বেড়ায় আক্রান্ত লোকজন। ভিক্টিমদের অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, আবার অনেকে বছরের পর বছর, ফিজিওথেরাপি নিয়ে হাঁটা চলার শক্তি অর্জন করে। খুবই সহজ কৌশল : ঘটনাস্থলে যার সাথে প্রথম দেখা হবে, তাকে মেরে দৃষ্টান্ত স্থাপন করো, যাতে বাকিরা সাবধান হয়ে যায়। বাকি কাজ নিয়ম মতোই চলতে থাকে। 

দুর্ভাগ্যক্রমে, গতকালকের ঘটনায় সেই প্রথম ব্যক্তিটাই ছিল অ্যানি ফরেস্টিয়ে। 

গ্যালারি মনিয়েরে ডাকাতি হ্যাফনারের পক্ষেই সম্ভব। আগের কর্মকাণ্ডের বর্ণনায় নজর দিলো ক্যামিল। 

কয়েক বছর ধরে, বারোজন লোকের ছোট একটা দল থেকেই নিজের সহযোগী বেছে নিয়েছে হ্যাফনার। বাছাইয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়েছে তাদের দক্ষতা আর প্রাপ্যতার উপর। দ্রুত একটা হিসাব করে ফেলল ক্যামিল। যে কোনো সময়ে, গড়ে কমপক্ষে তিনজন জেলে, রিমান্ডে কিংবা প্যারোলে থাকবে। কিন্তু, হ্যাফনার সবসময় ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকেছে। তার গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি। অপরাধও অনেকটা ব্যবসার মতো, দক্ষ আর বিশ্বস্ত কর্মী পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। কিন্তু সশস্ত্র ডাকাতিতে লাভের পরিমাণ অনেক বেশি। আর এরা সবাই নিজ পেশায় একেকজন দক্ষ শিল্পী। কয়েক বছরের মধ্যেই হ্যাফনারের দল থেকে ছয়জন চলে যায়। দুইজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, আর দুইজন বন্দুকযুদ্ধে নিহত ( যমজ দুই ভাই, মৃত্যুর সময়েও তাদের বন্ধন ছিন্ন হয়নি।)। পঞ্চমজন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হুইলচেয়ারে বন্দি। আর ষষ্ঠজন কর্সিকান উপকূলে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিখোঁজ। এতে বেশ বড়সড় ধাক্কা খায় হ্যাফনার। এরপরে অনেকদিন নিজের কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখে সে। মানুষজন ভাবতে শুরু করে শেষমেশ সব ছেড়েই দিয়েছে হ্যাফনার। অঢেল সম্পদ নিয়ে বাকি জীবন সুখে শান্তিতে কাটানোর আশায় দূরে কোথাও চলে গেছে। এদিকে পুরো ফ্রান্স জুড়ে জুয়েলারির মালিক ও কর্মচারীবৃন্দ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। 

তবে জানুয়ারিতে পরপর চারটা ডাকাতির ঘটনা খুবই আশ্চর্যজনক। বিশেষত, হ্যাফনারের অন্যান্য কাজের সাথে একদমই মিল ছিল না এই ডাকাতিতে। একটা ডাকাতির জন্যেই যথেষ্ট পরিমাণ শারীরিক আর মানসিক শক্তির প্রয়োজন। বিশেষ করে, নিজের কাজে নৃশংসতা আর পেশি শক্তির প্রদর্শন, হ্যাফনারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যে কোনো পরিস্থিতি মোকবেলা করার জন্য শুরু থেকে শেষ অবধি নিখুঁত পরিকল্পনা করে সে। তাই একই দিনে পরপর চারটা ডাকতির জন্য নিজ লক্ষ্য সম্পর্কে সুনিশ্চিত থাকতে হবে। ঘটনাস্থলের দূরত্বও বেশি হওয়া চলবে না। আর…সত্যি বলতে, অনেকগুলো বিষয় জড়িত ছিল এখানে। কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই এতোকিছু অর্জন প্রায় অসম্ভব। তাই ওই ডাকাতির ঘটনা খারাপ দিকে মোড় নেয়ায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। 

ভিক্টিমদের ছবির দিকে মনোযোগ দিলো ক্যামিল। 

প্রথমে, জানুয়ারিতে দ্বিতীয় আক্রমণের সময় আহত এক নারীর ছবি। রেঁনের এক জুয়েলারি দোকানের কর্মী, বয়স পঁচিশের কাছাকাছি। ডাকাত দলের দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় তার মুখের এতোটাই করুণ অবস্থা হয়েছিল যে, তার পাশে অ্যানিকে নববধূর মত লাগবে। চারদিন কোমায় ছিল সে। 

তৃতীয় ঘটনার সময় এক লোক আহত হয়। লোকটা সাধারণ এক ক্রেতা হিসেবেই উপস্থিত ছিল, কিন্তু মুখ দেখে তা বোঝার উপায় নেই। দেখে মনে হচ্ছ যুদ্ধফেরত কোনো সৈনিক। তার মেডিকেল ফাইলে লেখা ‘সংকটাপন্ন অবস্থা’। মুখের এই অবস্থা দেখলে ( এই লোককেও অ্যানির মত রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল) যে কেউ এই ব্যাপারে সম্মতি জানাবে। 

আর সর্বশেষ ভিক্টিমের দেহ রক্তে ভেসে আছে। বুকে দুটো গুলি। 

এটাও হ্যাফনারের পেশাগত জীবনের অন্যান্য ঘটনার সাথে ঠিক মেলে না। এই ঘটনার আগ পর্যন্ত, কোনো ভিক্টিমই হত্যার শিকার হয়নি। নিজের পুরোনো দল না পেয়ে, নতুন দল বানাতে হয়েছে তার। তাই, সার্বিয়ানদের দলে নিয়েছে সে। হয়তো বাধ্য হয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তার। কেননা, ওরা ভয়ডরহীন হলেও, রগচটা স্বভাবের। 

গভীর চিন্তায় মগ্ন ক্যামিল। কয়েকটা বিষয় তাকে ভাবাচ্ছে। 

প্রথমত, অবসর ভেঙে হ্যাফনার কেন ফিরে এলো। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়া, এমন ঠেকার কাজ চালানো দল নিয়ে মাঠে নামার কথা না তার। হয়তো হাত খালি হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া আর কী কারন থাকতে পারে, তা অনুমান করাও বেশ কষ্টসাধ্য। 

দ্বিতীয়ত, শুধু শুধু নিজের পুরোনো দিনে ফিরে যাবে না হ্যাফনার। বিপদের কথা মাথায় রেখেই, পরপর চারটা ডাকাতি করলো। যার ফলাফলও ছিল অনিশ্চিত। 

তৃতীয়ত, জানুয়ারির ওই ঘটনায় তার ভাগে অন্তত ২০০০০০- ৩০০০০০ ইউরো থাকার কথা। কিন্তু ছয় মাস পরেই আবার কাজে নামতে হলো তার। আর এবার যদি তার ভাগে কিছু কম পড়ে, তাহলে আবারো একই কাজ করবে। অনেক নিরীহ লোকের জীবন সংকটাপন্ন। তাই, যত দ্রুত সম্ভব হ্যাফনারকে থামাতে হবে। 

যে কেউ বুঝতে পারবে, পুরো ঘটনায় কিছু একটা ঠিক নেই। খুঁজে বের করতে না পারলেও এব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত ক্যামিল। ঠাণ্ডা মাথার লোক হওয়ায় ক্যামিল বেশ ভালোমতোই বুঝতে পারছে, হ্যাফনারকে ধরতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। তাই এখন তার সহযোগী, রাভিচকে খুঁজে বের করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। হয়তো এই সার্বের কাছ থেকে হ্যাফনারের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। 

আর এর উপর অ্যানির বাঁচা মরা নির্ভর করছে। 

.

দুপুর ২টা ১৫ 

“আর তোমার মনে হয় এসব… প্রাসঙ্গিক?” ফোনের অন্য প্রান্তে থাকা জুজ পেরেইরার কণ্ঠে সন্দেহের সুর। “কথা শুনে তো মনে হচ্ছে, তুমি গণহারে গ্রেফতার করার অনুমতি চাইছো।”

“মোটেই না, মঁসিয়ে, এমন কিছুই হবে না।”

হাসতে ইচ্ছে করলেও, লোভ সংবরণ করলো ক্যামিল : এতো দ্রুত এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধান্বিত বোধ করছে মঁসিয়ে পেরেইরা। আবার, ক্যামিলের মত দক্ষ অফিসারের কর্মপন্থা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারছে না। 

“তাছাড়া, খুব সতর্কতার সাথেই অপারেশন পরিচালিত হবে, মঁসিয়ে। তিন চারজনের খোঁজ পেয়েছি আমরা। জানুয়ারির ওই ঘটনার পর, রাভিচ হয়তো এদের কারো কাছেই সাহায্যের জন্য গিয়েছিল। আমাদের শুধু অনুমতি দরকার, ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য।”

“কমিশনার মিচার্ড কী বলে?” 

“আমার সাথে সম্পূর্ণরূপে একমত উনি।” 

এখনো কমিশনারের সাথে কথাই বলেনি ক্যামিল। কিন্তু মিচার্ডের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, তা সে ভালোমতোই বুঝতে পারছে। অনেক পুরোনো আমলাতান্ত্রিক কৌশল। ক কে বলো যে খ ইতোমধ্যেই অনুমতি দিয়েছে। আবার, একই কথা এবার খ কে বলো। হাজারো গতানুগতিক কৌশলের মত, এটা বেশ কার্যকরী। সত্যি বলতে, সতর্কতার সাথে প্রয়োগ করতে পারলে, এর ফলাফল বিস্ময়কর। 

“ঠিক আছে, কম্যান্ড্যান্ট, যেটা ভালো মনে হয় করো।” 

.

দুপুর ২টা ৪০ 

মোটা পুলিশ অফিসার, নিজের মোবাইলে গেম খেলায় ব্যস্ত। পাশ কেটে একজন যাওয়ার সময়, তার হুশ হলো। যাকে পাহারা দেয়ার কথা, পাশ দিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছে। এরপরেই তড়িঘড়ি করে দৌড় শুরু করলো, “ম্যাডাম!”-নামও মনে করতে পারছে না। “ম্যাডাম!” সাড়া দিলো না অ্যানি। তবে নার্স স্টেশনের সামনে এসে বিরতি নিলো সে। 

“এখন আমি যাচ্ছি।” 

এতে আরো দমে গেল পুলিশ অফিসার। আরো উঁচু স্বরে ডাকতে শুরু করলো। 

“ম্যাডাম…” 

ডেস্কের পেছন থেকে এগিয়ে এলো ফ্লোরেন্স। আজকে তার ডিউটি পড়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্বও তার। নার্সিং স্কুলে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করার শিক্ষা পেলেও ছয়মাস হাসপাতালে কাজ করার পর, যে কোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইতে নিতে শিখে গেছে সে। 

পেছন থেকে অ্যানির হাত টেনে ধরলো নার্স ফ্লোরেন্স। এমন কিছুরই অপেক্ষায় ছিল অ্যানি। নার্সের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো সে। আর নার্স, ভালোমতোই জানে রোগির মানসিক অবস্থা কেমন। তাই কৌশলের আশ্রয় নিলো সে। 

“আপনি যদি যেতেই চান, তাহলে সেলাইগুলো খুলতে হবে।” 

গালের কাছে হাত নিয়ে এলো অ্যানি। 

“না। এগুলো না। এই ক্ষত ঠিক হতে আরো সময় লাগবে। আমি এই দুটোর কথা বলছি।”

অ্যানির মাথায় সেলাইয়ের উপর হাত বুলিয়ে দিলো নার্স। পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করছে সে। অ্যানির হাসি দেখে বুঝতে পারলো, পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়েছে। একটু পর অ্যানিকে নিয়ে নিজের রুমের দিকে চলল। বসের কাছে কী জবাব দেবে, তাই ভাবছে পুলিশ অফিসার। 

নার্স স্টেশনের বিপরীত দিকে, ছোট একটা রুমে ঢুকলো দুইজন।

“বসুন…” যন্ত্রপাতি খুঁজছে নার্স। “প্লিজ, বসুন।” 

করিডোরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ। একটু পরপর রুমের দিকে উদ্ভট ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে। যেন ওরা দুইজন টয়লেটে ঢুকেছে। 

“উহহহহ…”

আঁতকে উঠলো অ্যানি। যদিও তার ক্ষতে এখনো হাতই দেয়নি নার্স। 

“অনেক ব্যথা করছে?” উদ্বিগ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো সে। “এমন তো হওয়ার কথা না। এখানে চাপ দিলে কেমন লাগে? আর এখানে? আমার মনে হয়, সেলাই খোলার আগে একবার ডাক্তারের সাথে কথা বলা উচিত। আরেকটা এক্স-রে দিতে পারে। গায়ে জ্বর আছে আপনার?” 

এই বলে অ্যানির কপালে হাত দিলো সে। 

“মাথা ব্যথা করে?” 

অ্যানি বুঝতে পারলো, আটকানোর জন্যেই তাকে এখানে নিয়ে এসেছে নার্স : চুপচাপ এই রুমে বসে থাকতে হবে। কিছুক্ষণের মাঝেই, আবার কেবিনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। আর তাই, লাগাম টেনে ধরলো অ্যানি। 

“না, কোনো ডাক্তার লাগবে না, এক্স-রেও না। আমি এখনই বের হবো,” এই বলে উঠে দাঁড়ালো অ্যানি। 

রেডিওর দিকে হাত বাড়ালো পুলিশ অফিসার; পরিস্থিতি যাই হোক, উপরের নির্দেশ ছাড়া তো কিছু করতে পারবে না। হুট করে যদি খুনিও হাজির হয়, তাহলেও একই কাজ করবে সে। 

“এমন করবেন না। আপনার ভালোর জন্যেই বলছি। যদি কোনো ইনফেকশন থাকে…” নার্সকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। 

কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না অ্যানি। আসলেই কোনো সমস্যা আছে, নাকি ভয় দেখানোর জন্য বলছে নার্স। 

“ওহ, আরেকটা কথা…( হুট করেই প্রসঙ্গ বদলালো নার্স।) আপনার অ্যাডমিশন ফর্মও তো পূরণ করেননি, তাই না? মেডিকেলের কাগজ আনতে কাউকে পাঠিয়েছেন? আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি। এক্ষুণি এক্স-রে করে, আপনাকে ছেড়ে দেয়া হবে।” 

এমন পরিস্থিতিতে, এর চেয়ে ভালো সমাধান আর হয় না। 

ক্লান্ত অ্যানি আর কোনো তর্কে গেল না। নিজের রুমের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। হুট করেই কিছু একটা মনে পড়লো তার। হাঁটা থামিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। 

“বন্দুক হাতে ওই লোকটাকে তো আপনিই দেখেছিলেন?” 

“এক লোককে দেখেছিলাম। কোনো বন্দুক না।”

এই প্রশ্নটাই আশা করছিল নার্স। উত্তরটা খুব দায়সারা গোছের হয়েছে। ডেস্কের সামনে রোগিকে দেখেই বুঝতে পেরেছিল, কোনো সমস্যা আছে। রোগির চোখ মুখ জুড়ে আতঙ্কের ছায়া সুস্পষ্ট। এখান থেকে বের হওয়াটা মুখ্য উদ্দেশ্য না। কিছু একটা থেকে পালাতে চাইছে সে। 

“বন্দুক দেখলে আমি স্বীকার করতাম। আর ওটা যদি বন্দুক হতো, তাহলে তো আপনার এখানে থাকার কথা না। ভুল বললাম আমি?” 

বয়স কম হলেও, পেশাদারিত্বের কোনো ঘাটতি নেই নার্সের। তবে, তার একটা কথাও বিশ্বাস করলো না অ্যানি। 

“না,” বলল অ্যানি। এরপর, নার্সের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইলো, যেন তার মনের কথা পড়তে পারছে, “কী দেখেছেন, সে ব্যাপারে আপনার মনে এখনও সন্দেহ আছে, তাই না?” 

রুমে ফেরার পরপরই মাথা ব্যথা শুরু হলো অ্যানির। শরীরে আর এক ফোঁটা শক্তি নেই তার। এখন ঘুম দরকার। 

দরজা বন্ধ করলো নার্স। চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছে তাকে। পুরোনো প্রশ্নটা আবারো তার মনের কোণে উঁকি দিলো। ওই লোকের কোটের নিচে লম্বা, মোটা জিনিসটা কী হতে পারে? 

.

দুপুর ২টা ৪৫ 

নিজের বেশিরভাগ সময় মিটিংয়ে পার করে কমিশনার মিচার্ড। একবার তার ডায়েরি দেখার সুযোগ হয়েছিল ক্যামিলের। বিরতিহীন অ্যাপয়েনমেন্টে ভরপুর ডায়েরির পাতা। এটাই মোক্ষম সুযোগ। এক ঘণ্টার ব্যবধানে তার ভয়েসমেইলে সাতটা ম্যাসেজ দিয়ে রাখলো ক্যামিল। গুরুত্বপূর্ণ। জরুরি। সংকটময়। প্রতিটা ম্যাসেজে গতানুগতিক কথাই বলেছে ক্যামিল। একইসাথে এটাও আশা করছে, মিচার্ড যখন ফোন করবে তখন আরেকদফা কথা কাটাকাটি হবে। কিন্তু তার পরিবর্তে কমিশনারের কণ্ঠস্বর বেশ শান্ত আর সহানুভূতিশীল শোনা গেল। দেখে যা মনে হয়, তার চেয়েও বেশি বিচক্ষণ সে। টেলিফোনে ফিসফিস করে কথা বলছে সে, “ম্যাজিস্ট্রেট অনুমতি দিয়েছে?” 

“অবশ্যই,” জোর দিয়ে বলল ক্যামিল। 

“সন্দেহভাজন ঠিক কতজন, কমান্ড্যান্ট?” 

“তিনজন। কিন্তু আপনি তো জানেনই, কান টানলে মাথা আসে। তাই ঝোপ বুঝে কোপ মারতে হবে।” 

যখনই যুক্তিযুক্ত কিছু পায় না, তখনই প্রবাদবাক্যের সাহায্য নেয় ক্যামিল। 

“ওহ আচ্ছা, ‘ঝোঁপ’…” দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল কমিশনার। 

“আরো কয়েকজন লোক লাগবে আমার।” 

শেষমেশ, সবকিছু এখানে এসেই আটকায়। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মিচা। আর যে জিনিসের চাহিদা বেশি তার যোগান সবসময় থাকে না। 

“বেশিক্ষণের জন্য না, সর্বোচ্চ তিন থেকে চার ঘণ্টা।”

“তিনজনকে ধরার জন্য?” 

“না, ঝো…” 

“হ্যাঁ, ঝোপ বুঝে কোপ মারার জন্য তো, বুঝতে পেরেছি কম্যান্ড্যান্ট। কিন্তু, এতো লোক নিয়ে যাওয়ার সমস্যা তো বুঝতেই পারছো নাকি?” 

এসব কীভাবে কাজ করে, মিচার্ড তা ভালোমতোই জানে। অপারেশন যত বড়, অপরাধীর কাছে তথ্য যাওয়ার সুযোগ তত বেশি। এরপর শুরু হয়, পুলিশের সাথে ইঁদুর বিড়াল খেলা। যত বেশি সময় পুলিশের খোঁজাখুঁজি চলে, অপরাধীকে গ্রেফতারের সম্ভাবনাও তত কমে যায়। 

“এর জন্যেই তো বেশি লোক দরকার।”

এই দর কষাকষি ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলতে পারে। সত্যি বলতে, ক্যামিল কী চায়, তাতে কিছুই যায় আসে না কমিশনারের। তার মাথায় একটাই চিন্তা, নিজের জায়গা ঠিক রাখতে হবে। পরে কোনো ঝামেলা হলে যেন বলতে পারে “তোমাকে ঠিক এই কথাটাই বলেছিলাম তখন।” 

“ঠিক আছে, জুজ পেরেইরা যেহেতু অনুমতি দিয়েছে…” শেষমেশ বলল সে। “তোমার সহকর্মীদের সাথে কথা বলে নাও।” 

*** 

সশস্ত্র ডাকাতি অনেকটা অভিনয়ের মত; বেশিরভাগ সময় শ্যুটিং স্পটে থাকতে হয়। আর সারাদিনের কাজ মাত্র কয়েক মিনিটে শেষ হয়ে যায়। 

তাই, এখানে বসে অপেক্ষা করছি। 

সাক্ষীর মনের জোর যদি ঠিকঠাক থাকে, তাহলে খুব দ্রুতই পুলিশ তাকে জেরা করবে। আজ না হোক, কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার মাত্র। পরিচিত কয়েকজন অপরাধীর ছবি দেখাবে। আর সাক্ষীর স্মৃতিশক্তি খুব বেশি খারাপ না হলে, এতোক্ষণে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে তারা। আপাতত, তাদের মূল কাজ হবে রাভিচকে খুঁজে বের করা। তাদের জায়গায় থাকলে, আমি তাই করতাম। কেননা এটাই সবচেয়ে সহজ আর কার্যকরী পন্থা। আমার জন্য করিডোরে ফাঁদ পাতবে। ওদিকে রাবিচের খোঁজে থাকবে আরেক দল। পুলিশের গতানুগতিক কৌশল, সবই আমার জানা আছে। 

ট্যাঙ্গার রোডের লুকাস বিস্ট্রো থেকে অভিযান শুরু হবে। অপরাধ জগতের সব সার্বিয়ান এখানেই জড়ো হয়। কেউ কার্ড খেলে সময় কাটায়, কেউ জুয়া খেলে। 

.

দুপুর ৩টা ১৫ 

সবাইকে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছে ভেরহোভেন। যেভাবে সম্ভব তথ্য জোগাড় করতে হবে। একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে সব কিছু। 

কমিশনারের অনুমতি পেয়ে জায়গায় জায়গায় ফোন দিচ্ছে ক্যামিল। এদিকে লুইসও বসে নেই। পুরোনো সহকর্মীদের সাথে যোগাযোগ চালাচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে এক দুইজন অফিসার পাওয়া যাচ্ছে। এভাবে কয়েকটা দলও তৈরি হয়ে গেল। কম্যান্ড্যান্টের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে কেউই ঠিকমতো জানে না। কিন্তু আদেশ পালনে সবাই প্রস্তুত। সব দলের সাথে সমন্বয়ের দায়িত্ব নিলো ক্যামিল। সন্দেহভাজন সব গাড়িতে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। এতে করে বখাটে ছেলেপেলে, ছিচড়ে চোর, মাদক চোরাচালানকারী, মাগির দালাল কেউই বাদ পড়ছে না। আর এই দায়িত্বে থাকা লোকজনও বেশ উপভোগ করছে এই কাজ। এই অপারেশন লাগাতার কয়েক ঘণ্টা চলবে। এরপর সবাই বাড়ি ফিরতে পারবে, এমনটাই জানিয়েছে ক্যামিল। 

কিছু সহকর্মী অবশ্য সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। কিছু একটা লুকাচ্ছে ক্যামিল, সে আত্মপক্ষ সমর্থন করলেও সহকর্মীরা এতে সন্তুষ্ট হলো না। চিন্তার বিষয় হচ্ছে, ফোনে যেমনটা বলা হয়েছিল, বাস্তবে এই অপারেশন মোটেও তেমন মনে হচ্ছে না। নির্দিষ্ট কাউকে গ্রেফতার করার জন্য একইসাথে কয়েকটা অপারেশন চলবে, এমন বিশ্বাস নিয়েই এসেছিল তারা। কিন্তু এখন ক্যামিল যা বলছে, তা যতটা কঠিন তার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। 

“সবাই এদিকে মনোযোগ দাও,” বলল ক্যামিল, “যদি কাঙ্ক্ষিত লোকটাকে আমরা ধরতে পারি, তাহলে বিজয় আমাদের সবার। সবচেয়ে সাহসী অফিসাররা পুরস্কৃত হবে। তাছাড়া, এটা তো মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। তাই যত দ্রুত শেষ করবে, তত দ্রুত বাড়ি ফিরতে পারবে।” 

কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট ছিল। অভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল বেশ কয়েকটা গাড়ি। ক্যামিলের নেতৃত্বে সবাই রওনা দিলো। টেলিফোনে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্বে রইলো লুইস। 

অপারেশন ভেরহোভেনকে কখনোই বিচক্ষণতার নিদর্শন হিসেবে দাঁড় করানো যাবে না। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য ঠিকই পূরণ হলো। এক ঘণ্টা পর প্যারিসের কোনো অপরাধীর জানার বাকি রইলো না, রাভিচকে পাগলের মত খুঁজছে পুলিশ। 

কোথাও না কোথাও তো লুকিয়ে আছে সে। প্রতিটা অলিগলিতে চিরুনি অভিযান চলল। 

সবাই হতচকিত হয়ে পড়লো। 

সাইরেনের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ, পুলিশের গাড়ি। শহরের একটা অংশে যাবতীয় গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তিনজন পালানোর চেষ্টা করে। ফলে তারা গ্রেফতার হয়। গাড়িতে হেলান দিয়ে সবই দেখছিল ক্যামিল। 

এসব নিয়ে ভাবলে হয়তো নস্টালজিক বোধ করতো ক্যামিল। সেই ব্রিগেড ভেরহোভেনের স্বর্ণালী সময়ে যখন অফিসে বসে কেস ফাইল সামলাতো আরম্যান্ড। কেস সম্পর্কিত শত শত নামে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরে উঠতো। আর দুই দিন পর হাজির হতো শুধুমাত্র দুটো নাম নিয়ে, যা কেসে কাজে লাগবে। এরইমাঝে লুইস ঘুরে দাঁড়ালেই, নিজের কাজ শুরু করতো ম্যালেভাল। অপরাধীদের মুখ থেকে কথা বের করায় তার দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। 

কিন্তু এসব নিয়ে ভাবছে না ক্যামিল। আপাতত এই অভিযানেই পূর্ণ মনোযোগ দিচ্ছে। 

শহর থেকে সাত মাইল দূরে, এক বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছে চারজন অফিসার। বাড়ির ঠিকানা নিশ্চিত হওয়ার জন্য লুইসকে ফোন দিলো। এরপর ঝড়ের গতিতে অভিযান চালিয়ে, দুইশ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার করলো তারা। এখানের কেউ ডুসান রাভিচের নামও শোনেনি। পুরো পরিবারকে আইনের আওতায় আনা হলো। 

ঝড়ের গতিতে চলছে গাড়ি। মনে হচ্ছে, ফর্মুলা-ওয়ানের কোনো প্রতিযোগী গাড়ি চালাচ্ছে। কানের সাথে ফোন ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে ক্যামিলের। লুইসের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করছে সে। একের পর একে আদেশ দিয়ে যাচ্ছে ফোনে। ভেরহোভেনের রাগ খুবই ভয়ংকর। 

এক থানায় তিনজন কসোভানকে উঠিয়ে আনা হয়েছে। ডুসান রাভিচ? নাম শুনে বেশ অবাক হলো তারা। এরইমাঝে, তিনজনকে হালকা ডলা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হলো, যাতে বাইরে গিয়ে খুশির সংবাদটা দিতে পারে : রাভিচকে খুঁজছে পুলিশ। 

আরেক থানা থেকে ফোন এলো ক্যামিলের কাছে। পুজাভাক-এর দুই পকেটমারকে আটক করেছে তারা। খবর পেয়ে সার্বিয়ার মানচিত্র নিয়ে বসলো লুইস। পুজাভাক শহরটা উত্তর-পূর্ব দিকে। এদিকে রাভিচ এসেছে আরো উত্তরের শহর এলেমির থেকে। আরো জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিলো ক্যামিল। ভয় ছড়ানোটাই মূখ্য উদ্দেশ্য। 

এদিকে ক্রিমিনাল ব্রিগেডের অফিসে, ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করছে লুইস। মনে মনে প্যারিসের মানচিত্র থেকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো চিহ্নিত করছে। যেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। 

পাশ থেকে নিচু স্বরে কেউ একটা পরামর্শ দিলো। একটু সময় নিয়ে তাতে সায় জানালো ক্যামিল। সাথে সাথে কাজে নেমে পড়লো কয়েকজন অফিসার। মেট্রো স্টেশনের আশেপাশে যত ভ্রাম্যমান শিল্পী আছে, সবাইকে পুলিশ ভ্যানে নিয়ে জেরা শুরু হলো। ডুসান রাভিচ? কোনো জবাব না পেলেই কলার চেপে ধরছে উপস্থিত কোনো অফিসার। ভয়ে তাদের মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হয় না। 

এদিকে মেট্রোর আশেপাশে ফোনের সিগন্যাল না পেয়ে, বেশ বিরক্ত ক্যামিল। কী হচ্ছে তা জানা দরকার। চিন্তিত ভঙ্গিতে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর ভাবছে, কখন তার টুটি চেপে ধরবে কমিশনার মিচা। 

*** 

প্রায় এক ঘণ্টা আগে, লুকাস বিস্ট্রোতে অভিযান চালিয়ে একজনকে আটক করেছে পুলিশ। কী অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে সেটা জানলেও, লোকটা নিজের পরিচয় জানে কি না, সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আর এসবের একটাই উদ্দেশ্য-আতঙ্ক ছড়ানো। সবে তো শুরু। আমার হিসাব তাহলে ঠিকই ছিল : আর এক ঘণ্টার মাঝে সার্বিয়ানদের আবাসস্থলে তোলপাড় চলবে। ইঁদুরের মত পালাতে শুরু করবে লোকজন। 

অবশ্য, একটা ইঁদুর হলেই চলবে আমার। ডুসান রাভিচ। 

এখন যেহেতু পুরোদমে অপারেশন চলছে, তাই আর সময় নষ্ট করা উচিত হবে না। 

শার্শিয়ার রোড আর ফার্ডিনান্ড রোডের মাঝে দিয়ে এগিয়ে চলছি আমি। একটা বাড়ি চোখে পড়লো। যেটার নিচতলার জানালা, দেয়াল তুলে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মূল দরজা অনেক আগে থেকেই অচল। কোনো তালা নেই, হাতলও নেই। ঘুণে ধরা প্লাইউডের একটা বোর্ড, বাতাসের সাথে সাথে দেয়ালে বাড়ি খাচ্ছে। অবশ্য এতে করে মানুষের আনাগোনার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এই জায়গা অবৈধ অভিবাসীদের আখড়াখানা। নানান কারণে, বিভিন্ন সময়ে এখানে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে আমার, তাই এই জায়গা আমার হাতের তালুর মতোই চেনা। কিন্তু এর প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে কয়েক কেজি জেলিগনাইট দিয়ে পুরো এলাকা উড়িয়ে দেই। 

শতাব্দীর সেরা ডাকাতির পরিকল্পনার সময় ডুসান রাভিচকে এখানেই নিয়ে এসেছিলাম। বাড়ির ভেতরে ঢোকার পর বিশ্রিভাবে হাসা শুরু করেছিল ও। রাভিচের মোটা লাল ঠোঁট দেখে আমার মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। 

“কোনো ছুকরি পেলে এখানে নিয়ে আসবো।” 

“ছুকরি’…হায়রে। কয়েক যুগেও এই শব্দ কেউ ব্যবহার করেনি, একমাত্র তোর মতো সার্বিয়ানের পক্ষেই সম্ভব। 

“ছুকরি,” বললাম আমি, “কিসের ছুকরি?” 

প্রশ্নটা করার সাথে সাথে, চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। কী ধরনের মেয়েকে এখানে নিয়ে আসতে পারে, তা ধারনা করতে, আমার খুব বেশি কষ্ট হলো না। কোথায় পাবে আর কী করবে, সে ব্যাপারেও স্পষ্ট ধারণা পেলাম। রাভিচের মত রুচিশীল মানুষ কমই দেখেছি! 

“একটা ছুকরির কথা বলছি না তো,” বলল রাভিচ। নিজেকে পাকা খেলোয়াড় হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছে। বিস্তারিত বলতে পছন্দ করতো ও। কিন্তু মূল ঘটনা ছিল খুবই সাধারণ। এই বলদের বাচ্চা কোথা থেকে একটা ম্যাট্রেস জোগাড় করেছে। যাতে যেখানে খুশি, সেখানে মজা… 

পরবর্তীতে অবশ্য রাভিচের যৌন জীবনে ভাটা পড়ে। অনেকদিন ধরে এখানে আসার সময় পায় না ও। আর এখানে থাকার সুবাদে, আমি ভালোমতোই জানি-স্বেচ্ছায় এখানে আসবে না রাভিচ। ছুকরি থাকুক আর না থাকুক—কেউই এখানে আনন্দ ফুর্তির জন্য আসে না। পালানোর কোনো পথ না থাকলে, এখানে আশ্রয় নেয় গুটিকয়েক মানুষ। আর এখন, যদি আমার ভাগ্য সহায় হয় আর নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করে পুলিশ, তাহলে এখানেই আসতে হবে ওর। 

সার্বিয়ানদের আবাসস্থলে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। রাভিচ খুব দ্রুত বুঝতে পারবে, এই নরকে আসা ছাড়া কোনো উপায় নেই তার। 

সাইলেন্সার খুলে ওয়ালথার পি৯৯ জায়গামতো রেখে দিলাম। কোনো ক্যাফেতে ঢুকে চট করে একটা ড্রিংক নেয়ার জন্য হাতে যথেষ্ট সময় আছে। কিন্তু আধা ঘণ্টার মাঝেই ফিরতে হবে। যদি রাভিচ চলেই আসে, তাহলে সবার আগে স্বাগতম জানাতে চাই আমি। 

বন্ধুর জন্য এইটুকু তো করতেই পারি। 

*** 

জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দশাসই এক লোককে আলাদা রুমে রাখা হয়েছে। কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেল, তার আসল বাড়ি বুজানোভাকে; সার্বিয়ার দক্ষিণে ছোট একটা এলাকা, মানচিত্র দেখে নিশ্চিত করলো লুইস। ডুসান রাভিচ, তার ভাই কিংবা বোন? পুলিশের এতে কিছুই আসে যায় না, আপাতত যে কোনো তথ্য হলেই চলবে। দশাসই লোকটা প্রশ্ন বুঝলো না। ওমনি তার মুখে উপর্যুপরি ঘুসি চলল। কিছুক্ষণ পর আবার জিজ্ঞেস করা হলো, ডুসান রাভিচ? এইবার বুঝতে পারলো সে। মাথা নেড়ে জানালো এই নামে কাউকে চেনে না। পুলিশের লোকজন আবারো মারতে শুরু করে। তাদেরকে থামিয়ে দেয় ক্যামিল। “ছেড়ে দাও। এ কিছুই জানে না।”

পনেরো মিনিট পরের ঘটনা। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তিন সার্বিয়ান। এদের মাঝে দুইজন মেয়ে, সবার বয়স সতেরোর নিচে। কারো কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, লা চ্যাপেল বন্দরে আনন্দ দানের কাজ করে এরা। কনডম ছাড়া পারিশ্রমিক দ্বিগুণ। সবারই হাড় জিরজিরে অবস্থা। ডুসান রাভিচ? মাথা নাড়লো ওরা। মাথা নেড়ে লাভ নেই। যতক্ষণ উত্তর না পাবে, ততক্ষণ আটকে রাখার কথা বলল ক্যামিল। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসলো মেয়ে দুটোর। এদিকে মেয়েদের সাথে উপস্থিত দালাল ও হকচকিয়ে গেল। বেশি সময় আটকে থাকলে ব্যবসায় ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। তার এখন রাস্তায় নামা দরকার। ডুসান রাভিচ? আবারো মাথা নাড়লো ওরা, পুলিশের গাড়ির দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে ক্যামিল ইশারা করলো : ছেড়ে দাও। 

রাজধানীর অসংখ্য থানার করিডোর জুড়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়েছে। হালকা পাতলা ফ্রেঞ্চ বলতে পারা লোকজন তো দূতাবাসে ফোন করার হুমকি দিচ্ছে, যেন কোনো সাহায্য পাবে ওখান থেকে। স্বয়ং পোপকে ফোন দিলেও কোনো লাভ নেই এখন। 

কান থেকে ফোন নামানোর সুযোগ পায়নি লুইস। একের পর এক আদেশ দিয়ে যাচ্ছে সে। বিভিন্ন দলের মাঝে সমন্বয়ের দায়িত্ব এখন তার কাঁধে। শহরের অলিগলি চেনা থাকার কারণে, বিভিন্ন জায়গায় একেকটা দল পাঠাচ্ছে। এদিকে গাড়িতে উঠে বসলো ক্যামিল। এখনো রাভিচের টিকিটার দেখাও পাওয়া যায়নি। 

সব মহিলাই কি অস্থিসার? না, মোটেও না। অন্তত ঘেরাওকৃত এই বাড়ির মহিলা তো মাত্রাতিরিক্ত মোটা, বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। বাড়ির পেছনে অন্তত আটজন বাচ্চাকাচ্চা কিচিরমিচির করছে। মোচওয়ালা স্বামীর গা থেকে বিশ্রি গন্ধ আসছে। সব পুরুষেরই মোচ থাকে—খুব বেশি লম্বা না হলেও, মাথা ঝুঁকে ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। ড্রয়ার থেকে কাগজপত্র এনে দিলো। পুরো পরিবার প্রোক্টপলে থেকে এসেছে; টেলিফোনের অন্য পাশে থেকে লুইস জানালো, সার্বিয়ার একদম মাঝামাঝি একটা এলাকা। ডুসান রাভিচ? লোকটা কিছুই বলল না। একটু পর কসম কাটলো, সে কিছুই জানে না : তাকে হাতকড়া পড়িয়ে দিলো পুলিশের লোকজন। শার্টের হাতা ধরে কাঁদতে শুরু করলো বাচ্চাকাচ্চারা। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, কয়েক ঘণ্টা পর এরাই মায়ের সাথে রাস্তায় নেমে আসবে। হাতে থাকবে হিজিবিজি লেখা সম্বলিত একটা প্ল্যাকার্ড। 

তথ্যের ব্যাপারটা বিবেচনা করলে, লুকাস বিস্ট্রোতে কার্ড খেলা লোকদের জুড়ি মেলা ভার। সারাদিন এখানেই পার করে তারা। আর তাদের স্ত্রী নানান জায়গায় কাজ করে বেড়ায়। যুবতী মেয়েরা চলে যায় আরেক ধান্দায়। ক্যামিলের সাথে তিনজন অফিসারকে দেখে একটু বিচলিত হয় তারা। চিন্তিত ভঙ্গিতে টেবিলে কার্ড ছুড়ে মারে-একই মাসে এই নিয়ে চতুর্থবারের মতো এলো পুলিশ। কিন্তু, নতুন করে এইবার বামনটাও যোগ দিয়েছে। উপস্থিত প্রত্যেকের চোখে চোখ রাখছে ক্যামিল। তাকানোর ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে, এবারের খোঁজটা একান্তই ব্যক্তিগত। রাভিচ? অবশ্যই এরা চেনে। কিন্তু একে অপরের দিকে অস্পষ্ট ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে, “তুই কি দেখেছিস?”

“না, তুই?” ক্যামিলকে লক্ষ্য করে ক্ষমাসূচক হাসি দিলো। যেন বলতে চাইছে, সাহায্য করার ইচ্ছা থাকলেও… 

“হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি,” এই বলে সামনে থাকা এক তরুণকে ডাক দিলো ক্যামিল। মনে হচ্ছে, লম্বা তরুণকে ইচ্ছা করেই বেছে নিয়েছে ক্যামিল। একটু পরেই হাত বাড়িয়ে ছেলেটার অন্ডকোষ চেপে ধরলো। সাথে সাথে, বিকট চিৎকার দিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো তাগড়া যুবক। রাভিচ? যেহেতু এখনো কিছু বলছে না, তার মানে কিছু জানে না এই হতভাগা যুবক। “কিংবা ও অক্ষম,” ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলল একজন অফিসার। এই কথা শুনে বাকিরা হেসে উঠলো। চোখ মুখ গরম করে, ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এলো ক্যামিল। “সবকটাকে ঘাড়ে ধরে নিয়ে যাও।” 

এক ঘণ্টা পরে, বিশাল আকৃতির এক সেলারে ঢুকলো কয়েকজন অফিসার। মেঝে থেকে সিলিঙের উচ্চতা পাঁচ ফুটের বেশি হবে না। থরে থরে সাজানো চুরাশিটা সেলাই মেশিন, তার মানে চুরাশিজন অবৈধকর্মী। এখানকার তাপমাত্রা ত্রিশ ডিগ্রির চেয়ে কম হবে না। সবাই খালি গায়ে কাজ করছে। কারো বয়সই বিশের বেশি হবে না। হুট করে পুলিশ অফিসারদের আনাগোনা দেখে, এগিয়ে এলো মালিক। কথা বলার চেষ্টা করলে, তাকে থামিয়ে দিলো এক অফিসার। ডুসান রাভিচ? তবে মালিকের উপর কোন অত্যাচার করা হলো না। প্রায়ই পুলিশকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সাহায্য করে সে। কিন্তু এবার মাথা চুলকাতে শুরু করলো-কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেনকে কল করার পরামর্শ দিলো উপস্থিত এক অফিসার। 

কিছুক্ষণের মাঝেই চলে এলো ক্যামিল। একমাত্র তারই নিচু হয়ে ভেতরে ঢুকতে হলো না। মালিকের বাড়ি সার্বিয়ার উত্তর দিকের গ্রাম রেনজানিনে। রাভিচের গ্রাম থেকে খুব বেশি দূরে নয়। রাভিচ? “কখনো নামই শুনিনি,”বলল লোকটা। “আপনি নিশ্চিত তো?” জোর দিয়ে বলল ক্যামিল। ।

মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, একের পর এক ব্যর্থতা কুরে কুরে খাচ্ছে ক্যামিলকে। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *