দ্বিতীয় দিন – সকাল

সকাল ৬টা 

এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি। ক্যামিলের মনের অবস্থা কীভাবে যেন টের পায় দুদুশে। 

গতরাতে স্টেশনে গিয়েছিল ক্যামিল। সারাদিনে যা যা কাজ জমেছিল, তা শেষ করে বাড়ি ফিরেছে সে। এতোটাই ক্লান্ত লাগছিল যে জামা কাপড় খোলারও শক্তি পায়নি। ওই অবস্থাতেই সোফায় শুয়ে পড়ে সে। একটু পর দুদুশে গুটিশুটি মেরে তার পাশে জায়গা নেয়। ক্যামিল কোনো খাবার না দিলেও টু শব্দ করলো না দুদুশে। মনিব কখন চিন্তিত থাকে তা সে ভালোমতোই জানে। 

খুব বেশিদিন আগের কথা না। এমন নির্ঘুম, চিন্তামগ্ন, নিরানন্দময় রাত কাটতো আইরিনের জন্য। একটা সময় তো আইরিনও পাশে থাকতো। একসাথে কত স্বপ্ন দেখেছে দুজন। সারাদিনের সব ক্লান্তি এভাবেই দূর হয়ে যেতো। কিন্তু স্ত্রীর অকাল মৃত্যু তার ভাবনার জগতকে এলোমেলো করে দিয়েছে। 

সারাদিনের কথা ভাবলো ক্যামিল। কোন বিষয়টা তাকে বেশি নাড়া দিয়েছে? অ্যানিকে হারানোয় ভয় না কি তার বিধ্বস্ত মুখাবয়ব। কিংবা এটা বুঝতে পারা যে ভাবনা চিন্তার জগতের দখল এখন অ্যানির কাছে। এক নারী থেকে আরেক নারীতে আত্মসমপর্ণের মাঝে এক ধরনের পাগলামী আছে। নতুন জীবনের কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি সে। কিন্তু ভাগ্যই এখানে নিয়ে এসেছে তাকে। এতোকিছুর পরেও আইরিনের মুখটা এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। হয়তো সারাজীবন তাই করবে। 

কোনোভাবেই এই ফিরে আসা থামানো সম্ভব না। সময়ও এই ক্ষত ভুলিয়ে দিতে পারে না। নতুন এক নারীর সদর্প বিচরণও এই স্মৃতির কাছে হার মানে। 

স্ত্রীকে হারানোর পরে নতুন বন্ধনে জড়ানোর কোনো ইচ্ছাই ছিল না ক্যামিলের। এদিকে অ্যানির ঘনিষ্ঠ কেউ মারা গিয়েছিল। তাই একে অপরের পাশে দাঁড়ানো থেকেই সম্পর্কের শুরু। কেউ কারো প্রতি দায়বদ্ধ ছিল না। কিন্তু নিয়তির অমোঘ পরিণতি আটকানোর সাধ্য কার। একটা সময় অ্যানিই তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। 

মার্চ মাস কেবল শুরু হয়েছে, এমনি এক বসন্তে তাদের প্রথম দেখা। প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারানোর চার বছর আর ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির দুই বছর পরের ঘটনা। স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য প্রতিনিয়ত নিজের সাথে যুদ্ধ চালিয়েছে ক্যামিল। বেশিরভাগ মানুষ যেখানে একাকীত্বের কাছে হার মেনে নেয়, সেখান থেকে ফিরে এসেছে ক্যামিল। তবে নতুন কারো সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া তার জন্য বরাবরই কষ্টসাধ্য। 

নতুন কারো দেখা পাওয়া তো রীতিমতো বিস্ময়কর। 

এমনিতে অ্যানি বেশ শান্ত প্রকৃতির। তবে জীবনে সে শুধুমাত্র একবার তীব্র ক্ষোভে ফেটে পরে এক রেস্টুরেন্টে ( ক্যামিলের কাছে শপথ করে তাই বলেছে )। ঘটনার দিন ‘শেঁ ফারনা’ রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খাচ্ছিল ক্যামিল। হুট করেই উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় তুমুল ঝগড়ায় রূপ নেয়। এরই মাঝে শোনা যায় অপমানজনক কথাবার্তা, প্লেট ভাঙার আওয়াজ আর মেঝেতে আছড়ে পড়া চামচের শব্দ। উপস্থিত লোকজন জায়গায় দাঁড়িয়ে এমন ঘটনার প্রতিবাদ জানায়। তাদেও মাঝে কেউ একজন পুলিশকে খবর দেয়। কিছুক্ষণের মাঝে রেস্টুরেন্টের মালিক ফারনান্ড এসে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। হুট করেই চিৎকার থামিয়ে দেয় অ্যানি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখে উচ্চস্বরে হেসে উঠে। তার এমন আচরণে সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। 

ক্যামিলের দিকে চোখ পড়ে তার। 

বড় করে শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ায় ক্যামিল। 

ওয়ারেন্ট কার্ড বের করে নিজের পরিচয় দেয়। কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন, ক্রিমিনাল ব্রিগেড। 

যেন শূন্য থেকে উদয় হলো সে। হাসি থামিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো অ্যানি। 

“ভাগ্য ভালো আপনি ছিলেন!” বিজয়ের উল্লাস রেস্টুরেন্টের মালিকের কণ্ঠে। একটু পরেই তার গলায় দ্বিধার সুর, “ক্রিমিনাল ব্রিগেড এর কথা বললেন, তাই তো?” 

মাথা নাড়লো ক্যামিল। মালিকের হাত ধরে তাকে একটু দূরে নিয়ে গেল। 

দুই মিনিট পর অ্যানিকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো ক্যামিল। অ্যানি এখনো বুঝতে পারছে না, সে কী অবাক হবে না কি নিশ্চিন্ত। এখন সে মুক্ত। আর বেশিরভাগ স্বাধীন মানুষ যেমন জানে না এই স্বাধীনতা নিয়ে কী করবে, তারও একই দশা। তবে ক্যামিল ভালোমতোই জানে তার মনে এখন কী চলছে। এতোবড় ঋণ কীভাবে শোধ করবে তাই ভাবছে সে। 

“ওই মালিককে আপনি কী বলেছেন?” জিজ্ঞেস করলো অ্যানি।

“বললাম যে আপনাকে গ্রেফতার করবো।” 

একদম নির্জলা মিথ্যা। প্রতি সপ্তাহে রেস্টুরেন্টে অভিযান চালানোর হুমকি দেয় ক্যামিল, যতদিন না রেস্টুরেন্ট বন্ধ হবে ততদিন পর্যন্ত। নিজ ক্ষমতার সুস্পষ্ট অপব্যবহার। এতে সে কিছুটা লজ্জিত। তবে একটা রেস্টুরেন্টের তো ভালোমানের প্রফিটারোল পরিবেশন করা উচিত 

অ্যানিও জানে কথাটা মিথ্যা। কিন্তু এতে বেশ মজা পেল সে। 

রাস্তার শেষ মাথায় পৌঁছাতেই পুলিশের একটা গাড়ি তাদের অতিক্রম করে রেস্টুরেন্টের দিকে গেল। এমন সময়ে নিজের ভুবন ভোলানো হাসিটা দিলো অ্যানি-টোল পড়লো তার গালে, সবুজ চোখের চারপাশেও সেই হাসির রেখা ছড়িয়ে পড়েছে…হুট করেই খেয়াল করলো, তার হাসি পুলিশ অফিসারকে কাবু করে ফেলেছে। 

“আপনি কি ট্রেনে যাবেন?” স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছাতেই প্রশ্ন করলো ক্যামিল। 

চিন্তার জন্য সময় নিলো অ্যানি 

“একটা ট্যাক্সি নিয়ে নেবো।” ।

অ্যানির জবাবে বেশ সন্তুষ্ট মনে হলো ক্যামিলকে। যদিও সে আগেই ঠিক করে রেখেছিল অ্যানির উল্টো পথে হাঁটবে। 

নিজের স্বভাবসুলভ ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে বিদায় নিলো ক্যামিল। ঠিক পরের রাতে একে অপরকে একই বিছানায় আবিষ্কার করে। 

প্রতিদিনের মত ক্রিমিনাল ব্রিগেডের কাজ শেষে বের হয় ক্যামিল। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিল অ্যানি। তাকে দেখেও না দেখার ভান করে হাঁটতে থাকে ক্যামিল। কিছুদূর যেয়ে ঘুরে তাকাতেই খেয়াল করে অ্যানি সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এমন একগুঁয়েমিতে হাসি পেল ক্যামিলের। ধরা পড়ে গেছে সে। 

এরপর একসাথে ডিনারে যায় দুজন। নিতান্তই সাদামাটাভাবে সময় পার করে। একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ আর নারীর প্রথম দেখায় বলার মত কী থাকতে পারে? ক্যামিলের প্রতি দায়বদ্ধতার চিন্তায় মগ্ন অ্যানি। পরিবেশটা কেমন যেন গুমোট হয়ে আছে। কেউই সময়টুকু উপভোগের দিকে নজর দেয়নি। একে অপরের দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা ছোট করে অ্যানিকে জানায় ক্যামিল, মায়ের কথাও বলে, মঁড… 

“আমার মনে হয়…উনার আঁকা কিছু ছবি আমি দেখেছি,” অ্যানির জবাবে ক্যামিলকে বিস্মিত মনে হলো। 

“মন্ট্রিয়েল?” দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল সে। 

অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ক্যামিল। 

লিওতে নিজের ফেলে আসা জীবনের কথা জানায় অ্যানি। জানায় তার স্বামীর কথা, 

ডিভোর্সের পর কীভাবে নতুন জীবন শুরু করেছে সে। স্বামীর সাথে তার সম্পর্কের ব্যাপারে আরো জানতে ইচ্ছা করলো ক্যামিলের। নারী জাতির মনের গহীন কুঠুরিতে ঢোকার অদম্য কৌতুহল সামলানোর সাধ্য কোন পুরুষের আছে? 

অ্যানির কাছে জানতে চাইলো, রেস্টুরেন্ট ম্যানেজারকে এখনই থাপড়াতে চায়, না কি বিল দেয়ার পর। অ্যানির উজ্জ্বল হাসি সবকিছু বদলে দিলো। 

এদিকে শেষ কবে নারীসঙ্গ পেয়েছিল তাও ভুলে গেছে ক্যামিল। কিন্তু অ্যানির হাসির কাছে সবকিছু হার মানলো। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই ক্যামিলের মন জয়ে করে নিলো সে। 

আবার কবে দেখা করবে, সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তও নেয়নি দুজন। কিন্তু তাই বলে নির্দিষ্ট সময় পরপর ঘুরতে যাওয়া বন্ধ হয়নি। একটা প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসেবে কাজ করে অ্যানি। চাকরির সুবাদে বেশিরভাগ সময় নানান জায়গায় যেতে হয়। সপ্তাহের দুইদিন তাকে প্যারিসে পাওয়া মুশকিল। এতো জায়গায় যাওয়া আসার মাঝের সময়ে ক্যামিলের সাথে দেখা হয়, যেন ভাগ্যক্রমেই মিলিত হচ্ছে দুজন। শুরু থেকেই এক উদ্ভট সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তারা, যার আগাগোড়া নিজেরাও বুঝে উঠতে পারেনি । একসাথে দেখা করা, ঘুরতে যাওয়া আর দিনশেষে একই বিছানায় ঘুমানো। আর এখান থেকেই সবকিছুর শুরু…. 

ক্যামিলের অজান্তেই জীবনের বড় একটা অংশ দখল করে নিয়েছিল অ্যানি। কবে কীভাবে এসব ঘটলো তা মনে করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সে। 

আইরিনের মৃত্যুর দগদগে স্মৃতিতে প্রলেপ বুলিয়ে দিচ্ছিল অ্যানি, শুধু এটুকুই মনে আছে ক্যামিলের। তার মাঝে নতুন এক স্বত্তার উপস্থিতি টের পাচ্ছিল। যে স্বত্তা আইরিনকে ছাড়া বেঁচে থাকার পথ দেখাচ্ছিল। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু ভুলে যাওয়াটাই সব সমস্যার সমাধান নয়। 

অ্যানির সাথে যা ঘটেছে, তাতে মানসিকভাবে ভেঙে পরেছে ক্যামিল। নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে তার। তবে যা ঘটেছে তার জন্য নয়। যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সামনে যা ঘটবে তার জন্য চিন্তিত সে। সবকিছু নির্ভর করছে তার শক্তি, বুদ্ধিমত্তা আর বিচক্ষণতার উপর। একটা ভুল সিদ্ধান্ত সব কিছু শেষ করে দিতে পারে। 

দুদুশের ম্যাও ম্যাও শব্দ থেমে গেছে, তার মানে ঘুমিয়ে পড়েছে। সোফা ছেড়ে উঠলো ক্যামিল। ডেস্কের দিকে এগিয়ে নিজের স্কেচপ্যাড তুলে নিলো। আরো কয়েকটা স্কেচপ্যাড এদিক সেদিক ছড়িয়ে আছে। একটা সময় অগনিত স্কেচপ্যাড আর নোটবুকের সমারোহ থাকতো এখানে। সবটা জুড়েই আইরিনের অসংখ্য স্কেচ। একদিন রাগের মাথায় বেশিরভাগ জিনিস পুড়িয়ে ফেলে। হাতে থাকা প্যাডটা মেলে ধরলো ক্যামিল। হাস্যোজ্জ্বল আইরিন টেবিলে বসে আছে। কয়েক পাতা উল্টিয়েই রেখে দিলো ক্যামিল। আইরিনকে ছাড়া বিগত চারটা বছর দুর্বিষহ কেটেছে তার। একটা মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারেনি প্রিয়তমা স্ত্রীকে। চলে গিয়ে যেন আরো কঠিন মায়ায় বেঁধে ফেলেছে তাকে। অতীতকে পেছনে ফেলতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে সে। আইরিনের সাথে তেমন কোনো মিলই নেই অ্যানির। শত আলোক বর্ষ দূরে থাকা দুই নক্ষত্র যেন এক বিন্দুতে মিলিত হচ্ছে। দুজনের মাঝে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে, অ্যানি এখনো তার পাশেই আছে কিন্তু আইরিন নেই। 

একবার তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল অ্যানি, যদিও পরবর্তীতে ফিরে আসে সে। সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে ক্যামিলের। আগস্ট মাসের সুন্দর এক সকাল। সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় হাত গুটিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল অ্যানি। ক্যামিলের দিকে না তাকিয়েই বলল, “সব শেষ, ক্যামিল। আমি আর পারছি না।” এরপর কোনো কথা না বলেই জামাকাপড় পরে নেয়। কোনো উপন্যাসে হলে হয়তো এক মিনিটেই কাপড় পরা হয়ে যেতো। কিন্তু বাস্তব জীবনে ভাবনার চেয়েও বেশি সময় লাগে। চুপচাপ বসে রইলো ক্যামিল। দেখে মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণ আগেই তার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। ভাগ্যের কাছে হার মেনে নিয়েছে সে। 

এমন সময়েই অ্যানি চলে যায়। 

তাকে থামানোর কোনো চেষ্টাই করলো না ক্যামিল। এভাবে চলে যাওয়ায় বেশ কষ্ট পেয়েছে সে। কিন্তু একদিন যে এমন কিছু হবে, তা আগে থেকেই জানতো। এজন্যে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুতও রেখেছিল সে। এমনটা হবেই। কোনোভাবেই তা থামানো সম্ভব ছিল না। নিজ অক্ষমতার অনুভূতি তার কাছে নতুন কিছু নয়। তাই সোফায় হেলায় দিয়ে বিষণ্ন মনে বসে রইলো সে। 

ওই মুহূর্তে কী ঘটেছিল তা কখনোই জানতে পারবে না ক্যামিল। 

অ্যানি চলে যাওয়ার এক ঘণ্টারও বেশি সময় পার হয়েছে। হুট করেই উঠে দাঁড়ালো ক্যামিল। এরপর কোনো কারন ছাড়াই দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলতেই চোখে পড়লো, সিঁড়িতে বসে আছে অ্যানি। 

কিছু সময় পর ক্যামিলকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলো অ্যানি। ওই অবস্থাতেই দেয়ালের দিকে মুখ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। 

সে কাঁদছে। আইরিনের সময় থেকেই এমন পরিস্থিতির সাথে পরিচিত ক্যামিল। 

.

সকাল ৬টা ৪৫ 

বিল্ডিংটা বাইরে থেকে দেখতে খুব একটা খারাপ লাগে না, কিন্তু ভেতরে ভগ্নপ্রায় দশা। অ্যালুমিনিয়ামের লেটারবক্সগুলোতে জং ধরে গেছে। প্রথম সারির একদম শেষের বাক্সে লেবেল সাঁটা ‘৬ষ্ঠ তলা : অ্যানি ফরেস্টিয়ে’। নামের শেষাংশ পড়তে বেশ কষ্ট হয়। জায়গা সংকটে শেষের দুটো অক্ষর একে অপরের সাথে মিলে গেছে। আর পুরো বাক্স জুড়ে মাকড়শার ঝুলের কথা না বললেই নয়। 

লিফটে চড়ার ঝামেলায় গেল না ক্যামিল। 

এখনো সাতটাও বাজেনি। অ্যানির প্রতিবেশীর অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় নক করলো ক্যামিল। 

সাথে সাথে দরজা খুলে গেল, যেন কারো জন্য অপেক্ষা করছিল অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা। অ্যানির অ্যাপার্টমেন্টের মালিক ম্যাডাম রোমান, ক্যামিলকে চিনতে পারলো। তার আকৃতির এই এক সুবিধা। একবার দেখলে কেউ সহজে ভুলতে পারে না। গুছিয়ে মিথ্যা বলা শুরু করলো সে। 

“একটা জরুরি কাজের জন্য বেরিয়েছে অ্যানি। তাড়াহুড়োর কারণে গোছগাছ করারও সময় পায়নি। আর কিছু দরকারি জিনিস নিতেও ভুলে গেছে।”

এই কথা শুনে ভ্রূ কুচকে গেল ম্যাডাম রোমানের। কিছুক্ষণ পর চাবি এনে ক্যামিলের হাতে দিলো। 

“কোনো সমস্যা হয়নি তো?” 

“না, না। (চওড়া এক হাসি উপহার দিলো ক্যামিল।) তেমন কিছুই না। (চাবির দিকে ইশারা করলো সে।) অ্যানি ফিরে আসা পর্যন্ত এটা আমার কাছেই থাকবে…” 

ক্যামিলের মুখভঙ্গি দেখে বোঝা অসম্ভব, এটা কি প্রশ্ন ছিল না কি অনুরোধ; ম্যাডাম রোমানও দ্বিধান্বিত। এই সুযোগে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিলো ক্যামিল। 

*** 

ছোট্ট রান্নাঘরটা একদম ঝকঝকে তকতকে। অ্যাপার্টমেন্টের সবকিছু খুব যত্ন নিয়ে গোছানো। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে নারীরা সবসময় সংবেদনশীল। লিভিং রুমটা ভাগ করে একাংশ বেডরুম বানানো হয়েছে। সোফার ভাঁজ খুললেই ডাবল বেডে পরিণত হয়, মাঝখানে তৈরি হয় হা করা মুখের মত গভীর এক খাঁদ। যার ফলে প্রায়ই এক অপরের উপর শুতে বাধ্য হয় দুজন। অবশ্য এর জন্য বেশ কিছু সুবিধাও ভোগ করেছে তারা। বুকশেলফ ভর্তি প্রায় একশটার মত পেপারব্যাক। তবে প্রথম দেখায় জায়গাটা কিছুটা দমবন্ধকর লাগলো ক্যামিলের। আর তা অ্যানিকেও বলতেও দ্বিধা করলো না। 

“আমার হাত একদম খালি ছিল,” বলল অ্যানি। “তাছাড়া, আমি তো ভালোই আছি।” 

ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করলো ক্যামিল। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিলো অ্যানি।

“ডিভোর্সের মূল্য এভাবেই চুকাতে হচ্ছে।” 

যখন কোনো গুরুতর বিষয়ে কথা বলতে শুরু করে অ্যানি, তখন আপনার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকবে যেন কোনো সম্মুখযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। 

“লিও ছাড়ার সময় সব ফেলে এসেছি। ওখান থেকে কিছু আনার প্রয়োজন বোধ করিনি। এই আসবাবপত্র, গয়নাগাটি সবকিছুই প্যারিসের পুরোনো দোকান থেকে কেনা। আমার এইসব আর ভালো লাগে না। একদমই না। হয়তো কোনোদিন সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে। আপাতত এখানে আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।” 

এই জায়গাটা সাময়িক—এটা অবশ্য অ্যানির কথা। অ্যাপার্টমেন্টটা সাময়িক, এমনকি তাদের সম্পর্কও অস্থায়ী। ঠিক এই কারণেই দুজনের সম্পর্ক খুব ভালো চলছিল। 

“ডিভোর্সের পর নতুন করে জীবন সাজানোটাই সবচেয়ে কঠিন।” 

অ্যানির গায়ে থাকা হাসপাতালের নীল গাউন স্ট্রেইট জ্যাকেটের মত দেখাচ্ছে, তাই কিছু জামাকাপড় নিয়ে এলো ক্যামিল। তার ধারণা এতে করে কিছুটা হলেও খুশি হবে অ্যানি। এমনকি সবকিছু ঠিকঠাক হলে হয়তো করিডোরে হাঁটতে বের হবে অ্যানি, কিংবা নিচতলায় থাকা দোকানেও ঢু মারতে পারে। 

মনে মনে একটা তালিকা তৈরি করলেও, হাসপাতালে ঢোকার সাথে সাথে সব ভুলে গেল ক্যামিল। ওহ, মনে পড়েছে : গাঢ় রক্তবর্ণের ট্র্যাকস্যুট। এরইমাঝে জগিংয়ের জুতার কথা মনে পড়লো তার। তবে জুতার তলায় বালির স্তুপ জমে আছে। আর কী ছিল? 

আলমারি খুলল ক্যামিল। অ্যানির কাপড়চোপড় বেশ কম। এক জোড়া জিনস, একটা টি-শার্ট আর মোটা জাম্পার বের করলো সে। এরপর একটা ব্যাগে এগুলোর সাথে কয়েকটা অন্তর্বাসও নিয়ে নিলো । 

অ্যানির কাগজপত্রের কথা মনে পড়লো তার। 

ডেস্কের দিকে এগিয়ে গেল ক্যামিল। পাশেই একটা বিবর্ণ আয়না, দেখে মনে হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক আমলের। আয়নার এক কোণায় অ্যানির ভাই নাথানের ছবি লাগানো। ছবিতে তাকে পঁচিশ বছর বয়সি যুবকের মত লাগছে, মুখ হাসি। চেহারা মোটেও আকর্ষণীয় নয়। ক্যামিলের কাছে ভিনগ্রহের এক প্রাণি বলে মনে হচ্ছে। হয়তো জানাশোনা কম বলেই এমনটা লাগছে। পেশায় সে বিজ্ঞানী। খুবই অগোছালো জীবনযাপন করে। কিছুদিন পর পর ঋণের বোঝায় পড়ে। আর প্রতিবারই তা শোধ করার দায়িত্ব নেয় অ্যানি, একদম মায়ের মত। “সত্যি বলতে ওর কাছে আমি ঠিক তাই, এমনটাই বলেছিল অ্যানি। ছায়ার মত ভাইয়ের পাশ থেকেছে সে। ভার্সিটির ফি, ঘুরতে যাওয়ার খরচ সহ যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেছে অ্যানি। ছবিতে নাথান যে চত্বরে দাঁড়িয়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে ইতালির কোথাও হবে, মাথায় উপর জ্বলজ্বল করছে সূর্য। সবার পরনে শার্ট। 

ডেস্কের জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলো ক্যামিল। ডান দিকের ড্রয়ার পুরোপুরি খালি। বাম পাশেরটায় কয়েকটা ছেঁড়া খাম, কাপড়ের দোকানের রিসিট আর ট্রাভেল এজেন্সির কাগজপত্র। তবে যা খুঁজছে তা পেল না। অ্যানির মেডিকেল ইনস্যুরেন্স কার্ড, মিউচুয়াল ইনস্যুরেন্স পলিসি। এগুলো হয়তো ওর হ্যান্ডব্যাগে ছিল। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরেকবার খুঁজে দেখলো ক্যামিল। ব্যাংক স্টেটমেন্ট, টেলিফোন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিলের কাগজ কিছুই পেল না। এগুলো তো থাকার কথা, মনে মনে ভাবলো সে। তার মাথায় একটা চিন্তা ঢুকলো। পুরো ঘরটা খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো। আর্টিস্ট হওয়ার সুবাদে তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অসাধারণ। দ্রুতই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছালো সে। 

অ্যাপার্টমেন্টে কেউ এসেছিল। 

ডান পাশের ড্রয়ারটা আবার খুলল। এটা খালি। কেউ অ্যানির ব্যাক্তিগত কাগজপত্র নিয়ে গেছে। দরজার সামনে গিয়ে তালার দিকে নজর দিলো। ভাঙার কোনো চিহ্নই নেই। তার মানে ওই দলের কেউ অ্যানির হ্যান্ডব্যাগ থেকে ঠিকানা পেয়েই এখানে এসেছিল। আর চাবি তো ব্যাগেই ছিল। 

হাসপাতালের ওই লোকটাই কি এসেছিল না কি অন্য কেউ? 

অ্যানিকে খুঁজে বের করার জন্য এতো প্রচেষ্টা খুবই অদ্ভুত মনে হচ্ছে, বিশেষ করে এমন একটা কেসে। কিছু একটা এড়িয়ে যাচ্ছি আমরা, মনে মনে ভাবলো ক্যামিল। তবে এমন ভাবনা এই প্রথম না, এই কেসে কোনো 

না কোনো ঘাপলা আছে। 

অ্যানির ব্যক্তিগত সব তথ্যই ওদের হাতে আছে। হয়তো এতোক্ষণে তার সম্পর্কে সব কিছুই জেনে গেছে। আগে কোথায় ছিল, এখন কোথায় আছে, কোথায় কাজ করে সবই জানে। এমনকি কোথায় লুকাতে পারে তাও বোধহয় জেনে গেছে। 

ওদের হাতে যে পরিমাণ তথ্য আছে, তাতে অ্যানিকে খুঁজে বের করা এখন ছেলের হাতের মোয়া হয়ে গেছে। 

আর খুন করা তো সময়ের ব্যাপার। 

হাসপাতালের বাইরে পা রাখার সাথে সাথেই অ্যানিকে মেরে ফেলবে। 

এদিকে অ্যাপার্টমেন্টে তল্লাশির কথাও কমিশনারকে বলত পারবে না ক্যামিল। সেক্ষেত্রে আগে অ্যানির সাথে সম্পর্কের কথা স্বীকার করতে হবে তার। আর শুরু থেকে যে মিথ্যা বলেছে, তাও ধরা পরে যাবে। গতকালকেও এটা সন্দেহে বৈ কিছু ছিল না। আজকে সেই সন্দেহ আরো গাঢ় হলো। তার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই মেনে নিবে না। ফরেনসিক টিম পাঠানো যেতে পারে। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে লড়ছে, এরা কোনো প্রমাণ ফেলে যাবে বলে মনে হয় না। 

সমস্যার শেষ এখানেই না। কোনো সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়াই এখানে ঢুকেছে ক্যামিল। মিথ্যা বলে চাবি নিয়েছে। এখানে তার সচরাচর আসার ব্যাপারেও জানে ম্যাডাম রোমান। তাই জবানবন্দিতে… 

মিথ্যার পাল্লা ক্রমশই ভারি হচ্ছে। কিন্তু এতে মোটেও বিচলিত নয় ক্যামিল। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা অ্যানিকে নিয়ে ভাবছে সে। এদিকে কিছু করতেও পারছে না। 

.

সকাল ৭টা ২০ 

“না, সমস্যা নেই। বলো তুমি।”

সকাল সাতটায় ফোন দেয়ার পর যখন কোনো সহকর্মী এমন জবাব দেয়, এরপরে আর প্রশ্ন না করাই ভালো। বিশেষ সেই সহকর্মী যদি কমিশনার হয়, তাইলে তো কথাই নেই। 

কেসের ব্যাপারে আপডেট দিতে শুরু করলো ক্যামিল। 

“তোমার রিপোর্ট কই…” জিজ্ঞেস করলো কমিশনার।

“কাজ চলছে।”

“তারপর…?” 

প্রথম থেকে আবারো বলতে শুরু করলো ক্যামিল। প্রত্যক্ষদর্শীকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। আর হাসপাতালে অস্ত্রসহ একজনের ঢোকার প্রমাণ মিলেছে। সম্ভবত সাক্ষীকে হত্যার উদ্দেশ্যেই ঢুকেছিল। 

“এক মিনিট, কম্যান্ড্যান্ট, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। সাক্ষী বলতে তুমি ম্যাডাম ফরেস্টি…” 

“ম্যাডাম ফরেস্টিয়ে।” 

“ওই তো, একটা হলেই হলো। সাক্ষীর ভাষ্যমতে সে কাউকে রুমে ঢুকতে দেখেনি, তাই তো? (ক্যামিলকে কিছু বলার সুযোগই দিলো না সে। ) আর নার্সের ভাষ্যমতে, কাউকে দেখেছে সে। কিন্তু এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি নিশ্চিত না, ঠিক তো? তাহলে এই ‘অজ্ঞাত লোকটা’ কে? আর যদি ওই দলের কেউ হয়েও থাকে, সে কি রুমে ঢুকেছিল?” 

মিচার্ডের জায়গায় এখন লা গুয়েন কমিশনার থাকলেও কোনো লাভ হতো না। মানুষ ভিন্ন হলেও প্রশ্নের ধরন বদলাতো না। যখন থেকে কেসটা নিজ হাতে চেয়েছে ক্যামিল, তখন থেকেই সবকিছু তার বিরুদ্ধে যাচ্ছে। 

“বিশ্বাস করুন, ওই লোকই এসেছিল!” জোর গলায় বলল ক্যামিল। “এক ঝলকের জন্য শটগানের ব্যারেল চোখে পড়েছিল ওই নার্সের।” 

“ওহ, তাই নাকি। এ তো অসাধারণ ব্যাপার!” কমিশনারের কণ্ঠে পরিহাসের সুর। “তো ‘এক ঝলকেই’ শটগান চিনে ফেলল নার্স, তাই তো? ঠিক আছে, বুঝলাম। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো রিপোর্ট করেছে?” 

কথাবার্তা শুরু থেকেই ক্যামিল জানতো, শেষ পর্যন্ত এই কথোপকথন কোথায় গড়াবে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও, নিজের অবস্থান ভুলল না সে। নিজের বসের সাথে আগুন নিয়ে খেলার মত বোকামি এখন তার শোভা পায় না। নিজ যোগ্যতায় কমিশনার পদে উন্নিত হয়েছে মিচার্ড। আর লা গুয়েনের সাথে বন্ধুত্বের সুবাদে এই কেসে পেলেও খুব বেশিদিন এভাবে চলবে না। সত্যি বলতে, হিতে বিপরীত হতে পারে। 

“না, কোনো রিপোর্ট করেনি। ( মাথা ঠাণ্ডা রাখো। একদম উত্তেজিত হওয়া যাবে না। যতটা সম্ভব ভদ্র আচরণ করো। মনে মনে বলল ক্যামিল। ) কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস করুন, ওই লোকটাই এসেছিল। অস্ত্র নিয়ে হাসপাতালে ঢুকতে দ্বিতীয়বার ভাবেনি সে। নার্সের বর্ণনা অনুসারে, হয়তো ডাকাতিতে ব্যবহৃত ওই শটগান নিয়েই ঢুকেছিল।” 

“এটা তো অন্য কিছুও…” 

“আমাকে বিশ্বাস করছেন না কেনো?” 

“হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো অভিযোগ জানায়নি। ছোটখাটো এক ডাকাত দলের কেউ হাসপাতালে সাক্ষীকে হত্যা করতে এসেছে। এক নার্সের কথার উপর ভিত্তি করে, এই তোমার অনুমান। তাই এই পুরো বিষয়টাই আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে!” 

“ছোটখাটো ডাকাতি?” ক্যামিলের কণ্ঠে বিস্ময়ের ছাপ। 

“ঠিক আছে। মানলাম যে একটু সহিংস ছিল ওই দল, কিন্তু…”

“একটু সহিংস?” 

“কম্যান্ড্যান্ট, তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো যে আমি যা বলবো তাই পুনরাবৃত্তি করবে? প্রত্যক্ষদর্শীর জন্য তুমি যেভাবে পুলিশের নিরাপত্তা চাইছো, তাতে মনে হচ্ছে কোনো মাফিয়ার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী সে।”

কিছু বলার জন্য মুখ খুলল ক্যামিল। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। “আমি একজন অফিসার পাঠিয়ে দিবো। শুধুমাত্র দুইদিনের জন্য।”

খুবই দায়সারা গোছের জবাব। যদি কাউকে দিতে অস্বীকৃতি জানাতো, তাহলে তারই বিপদ। সাক্ষীর কিছু হলে তাকেই জবাবদিহি করতে হবে। তাই নিজের গা বাঁচানোর কাজ সেরে রাখলো। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কোনো খুনির জন্য নিরস্ত্র পুলিশকে পাঠানো আর বিচ উইন্ডব্রেকার দিয়ে সুনামি ঠেকানোর চেষ্টা একই কথা। 

“ম্যাডাম ফরেস্টিয়ে এই লোকগুলোর কী ক্ষতি করেছে, মঁসিয়ে ভেরহোভেন? আমি যতটুকু জানি সে শুধু ডাকাতির ঘটনাই দেখেছে, কোনো হত্যাযজ্ঞ না! এতোক্ষণে হয়তো ওরা এটাও জেনে গেছে ম্যাডাম ফরেস্টিয়ে বেঁচে আছে-এতে তো আরো নির্ভার হওয়ার কথা ওদের।” 

শুরুতে তাই মনে হচ্ছিল। কিন্তু এই কেসে কিছু একটা ঠিক মিলছে না। “তা, তোমার ওই ইনফর্মারের কী খবর? নতুন কিছু জানতে পারলে?” মাঝে মাঝে কোনো কিছু চিন্তাভাবনা না করেই আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, যার কোনো উত্তর আমাদের কাছে থাকে না। কিন্তু এর পেছনের কারন বড়ই রহস্যময়। ঠিক কোন মুহূর্তে নিজেদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সচেতন হই? ক্যামিলের এই উত্তরের পেছনে মনের অবচেতন অংশের ভূমিকা কতটুকু, তা জানা অসম্ভব। কিন্তু নির্দ্বিধায় জবাব দিলো ক্যামিল। 

“মলুদ ফাউই।”

নামটা উচ্চারণ করার সাথে সাথে ক্যামিলও শিউরে উঠলো 

কেমন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হলো তার। যেন কোনো রোলারকোস্টারে উঠেছে সে। আর তা তীব্র গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেয়ালের দিকে। তার ধ্বংস অনিবার্য। 

“তার মানে ফাউই প্যারোলে আছে?” 

ক্যামিল কিছু বলার আগেই শুনতে পেল, 

“আর এই কেসের সাথে ওর কী সম্পর্ক?” 

দারুণ প্রশ্ন। ডাক্তারদের মত অপরাধীদেরও আলাদা আলাদা ক্ষেত্র আছে। একেক বিষয়ে অভিজ্ঞ একেকজন। সশস্ত্র ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, জালিয়াতি, বাটপাড়ি। কেউ কারো পথ মাড়ায় না। মলুদ ফাউই মাগির দালাল। তাই সশস্ত্র ডাকাতিতে তার জড়ানোর কথা না। 

ক্যামিলও যে তাকে খুব ভালোমতো চেনে, তা নয়। দুই একটা কেসের খাতিরে যা জেনেছে তাই। তবে এই ধরনের ডাকাতি ওর দ্বারা সম্ভব না। নিজের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য চূড়ান্ত নৃশংসতার আশ্রয় নেয় স্যাডিস্ট ফাউই। কয়েকটা হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। তবে অসম্ভব রকমের ধূর্ত হওয়ায় বেশিরভাগ সময়ই অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়েছে সে। শেষমেশ এক মিথ্যা মামলায় ফেঁসে যায়। ব্যাগভর্তি মাদকদব্য আর ব্যাগজুড়ে হাতের ছাপ সহ ধরা পড়ে। একদম চিরাচরিত উপায়ে ফাঁসিয়েছে কেউ। যদিও বারবার কসম কেটে বলেছে, ওই ব্যাগ জিমে ব্যবহার করতো। তবে শেষ রক্ষা হয়নি তার। তীব্র আক্রোশ বুকে চেপে জেল খেটেছে। 

“দুঃখিত, ঠিক বুঝলাম না?” 

“ফাউই! এই কেসের সাথে ওর কী সম্পর্ক? আর তুমি বললে ও তোমার আত্মীয়? বাহ, নতুন কিছু জানলাম…”

“না, কিসের আত্মীয়! দেখুন…ব্যাপারটা একটু জটিল। এটা অনেকটা ‘সিক্স ডিগ্রি অফ সেপারেশন’ এর মত, আপনি বুঝতে পারছেন কী বলতে চাইছি…” 

“না, পারছি না। কষ্ট করে বোঝানোর দায়িত্বটা নাও।”

“দেখুন, আপাতত বিষয়টা আমি দেখছি। খুব শীঘ্রই আপনাকে সব বুঝিয়ে বলবো।”

“তুমি…তুমি বিষয়টা দেখবে?” 

“আপনি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে আমি যা বলবো তাই পুনরাবৃত্তি করবেন?” 

“আমার সাথে চালাকির চেষ্টা করবে না, কম্যান্ড্যান্ট!” চিৎকার করে উঠলো মিচার্ড। একটু বিরতি নিয়ে প্রশ্ন করলো, 

“তোমার সমস্যাটা কী?” 

“দেখুন, প্রথমত, এটা ‘আমার’ সমস্যা না। আর দ্বিতীয়ত, এখন সকাল সাতটা বাজে। আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারলে আমারও ভালো লাগবে। কিন্তু এর জন্য তো সময় দিতে হবে…” 

“কম্যান্ড্যান্ট…(এই বলে থেমে গেল কমিশনার।) আমি জানি না কী করছো তুমি। বুঝতেও পারছি না। (রাগ কিছুটা কমেছে তার।) কিন্তু আজকে সন্ধ্যার মাঝে আমার টেবিলে রিপোর্ট চাই, বোঝা গেল?” 

“পেয়ে যাবেন। কোনো ব্যাপারই না।” 

সকালবেলায় আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা হলেও দরদর করে ঘামছে ক্যামিল। তার পিঠ বেয়ে ঘামের শীতল স্রোত নামছে, যেমনটা আইরিনকে খুঁজে বের করার সময় হয়েছিল। ওইদিন তার চোখে যেন পর্দা পড়েছিল। ভেবেছিল একাই সামাল দিতে পারবে…না! এমনটা মোটেও ভাবেনি। তার ব্যবহারে মনে হচ্ছিল, সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা শুধু তারই আছে। কিন্তু আদতে সেটাই ছিল ভুল পদক্ষেপ। যতক্ষণে আইরিনকে খুঁজে পেল, ততক্ষণে লাশ হয়ে গিয়েছিল তার স্ত্রী। 

অ্যানির কী হবে? 

অনেকে বলে, যে পুরুষ একবার তার প্রিয়জনকে হারায়, বারবার একই উপায়ে হারায়। এই ভাবনাটাই ক্যামিলকে আতঙ্কিত করে তোলে। 

.

সকাল ৮টা 

তুর্কি ভ্রাতৃদ্বয় জানেও না ওরা কী হারালো। পেটমোটা দুটো ব্যাগভর্তি মূল্যবান অলংকার। এমনকি এর অর্ধেক পেলেও কোনো দিক থেকেই কম হতো না। সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ীই এগুচ্ছে। আর ভাগ্যের একটু ছোঁয়া পেলেই এগুলো দিয়ে বড় কিছু করা সম্ভব। 

যদি সব ঠিক মতো চলে। 

আর যদি না চলে, তাহলে দুই একটা খুনখারাবি তো হবেই। 

পরিকল্পনা সফল করার জন্য আপনাকে সুশৃঙ্খল হতে হবে। দৃঢ় প্রতিজ্ঞাও অত্যাবশ্যক। 

এরইমাঝে, শহরটাকে আলোকিত করা যাক। খেলা শুরু! লা পারিসিয়েন। পৃষ্ঠা তিন। 

সেইন্ট-উয়েনে আগুন। 

আহ! এই সংবাদের অপেক্ষায়ই তো ছিলাম। এখন গরম এক কাপ কফি হলে খুব জমতো। কিন্তু এতো সকালে তো পাওয়া যাবে না, তাই ড্রাম রোল দিয়েই সন্তুষ্ট হতে হবে। 

*** 

সেইন্ট-উয়েন 
রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডে দুইজনের মৃত্যু 

গতকালকের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সকলকে জরুরি বৈঠকের জন্য ডাকা হয়েছে। প্রথমে আগুন লাগলেও কিছুক্ষণ পর ভয়াবহ এক বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়া যায়। দমকল কর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও বেশ কয়েকটা ওয়ার্কশপ আর গ্যারেজ একদম পুড়ে গেছে। আগুন লাগার ঘটনা বেশ রহস্যজনক কারণ সংস্কার কাজের জন্য ওই এলাকা অনেকদিন ধরেই পরিত্যক্ত। 

ইট পাথরের জঞ্জালের মাঝে আগুনে পোড়া একটা পোরশে আর দগ্ধ দুটো লাশ পাওয়া গেছে। বিস্ফোরণের সূত্রপাত এখান থেকেই হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। সেমটেক্সের উপস্থিতির প্রমাণ পেয়েছে ফরেনসিক দল। ঘটনাস্থলে কিছু ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির টুকরোও পাওয়া গেছে, তাই তাদের ধারণা দূর থেকে রিমোটের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। 

এত তীব্র বিস্ফোরণের কারণে, লাশ দুটোর পরিচয় সনাক্ত করা বেশ কষ্টসাধ্য। যাবতীয় প্রমাণ বিশ্লেষণ করে খুব সহজেই বলা যায়, পূর্ব পরিকল্পিত ভাবেই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। আর এমনভাবে করা হয়েছে যাতে শনাক্তকরণও অসম্ভব হয়ে পরে। বিস্ফোরণের সময় ভিক্টিম দুজন কী জীবিত ছিল না কি মৃত, তা বের করার চেষ্টা করছে তদন্তকারী কর্মকর্তারা… 

*** 

খেল খতম, পয়সা হজম। 

“তদন্তকারী কর্মকর্তারা বের করার চেষ্টা করছে… আমাকে আর হাসাবেন না! বাজি লাগতে আমার কোনো আপত্তি নেই। যদি পুলিশের লোকজন ওই তুর্কিদের সম্পর্কে একটা তথ্যও বের করতে পারে, তাহলে ওদের ভাগের অর্ধেক ইউরো এতিমখানায় দান করে দেবো। 

বিপরীত পেশার লোকজন কীভাবে বসবাস করে, তা দেখতে ভালোই লাগে। ওরা এতোটা বোকার হদ্দ না হলে, এতোদিনে ওদের দলেই যোগ দিতাম। 

একটা স্কুলের বাইরে গাড়ি দাঁড় করলাম। তেরো বছর বয়সি মেয়েরা যে জামাকাপড় পরে বের হচ্ছে, তার দাম শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতনের প্রায় তেরো গুণ হবে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মসবার্গটা দিয়ে সামাজিক সমতা বিধানে কাজ করি। কিন্তু আফসোসের বিষয়, এর কোনো অনুমোদন নেই। 

স্কুলকে পাশ কাটিয়ে ডানে মোড় নিলাম। আশেপাশের বাড়িঘর থেকে এই বাড়িটা ছোট কিন্তু প্রতি বছর এখানে চুরি ডাকাতির যে পরিমাণ মালামাল আদানপ্রদান হয়, তাতে বেশ কয়েকটা আকাশচুম্বী ভবন অনায়াসেই তৈরি করা যাবে। এ বাড়ির মালিক বেশ সতর্ক। কাজের ব্যাপারে তার জুড়ি মেলা ভার। ইতোমধ্যে তার এক লোককে গা দু ন স্টেশনে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওখানের এক লকারেই আমার ব্যাগগুলো রাখা। 

এক জায়গা থেকে মালামাল তোলা হয়, যাচাই বাছাই হয় আরেক জায়গায়। এমনকি বিক্রি হয় ভিন্ন ভিন্ন স্থানে। 

আর এই পুরো কাজের জন্য বেশ বড় একটা অংশ তার পকেটেও ঢোকে। 

.

সকাল ৯টা ৩০ 

এখন অ্যানিকে প্রশ্ন করতে পারলে ভালো হতো, ক্যামিলের মনে এই চিন্তা ঘুরছে। গ্যালারিতে কী দেখেছিল ও? এদিকে চিন্তিত মুখ নিয়ে অ্যানির সামনে যেতেও ইচ্ছা করছে না তার। অ্যানি যদি জানতে পারে ওর জীবন এখনো ঝুঁকির মুখে, তাহলে আরো ভয় পেয়ে যাবে। আদতে ওর মানসিক অবস্থা আরো খারাপ হবে। 

তবুও প্রশ্ন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই ক্যামিলের। 

“কী?” গুঙিয়ে উঠলো অ্যানি। “কী দেখেছি মানে? তুমি আসলে কী চাও?” 

রাতটা ঘুমিয়েও কোনো লাভ হয়নি অ্যানির। গতকালকের চেয়ে আজকে আরো বেশি বিধ্বস্ত লাগছে তাকে। মেজাজটা আরো খিটখিটে হয় গেছে, যে কোনো সময় কেঁদে ফেলবে এমন অবস্থা। কথা বলার সময় তার গলা কাঁপছে। তবে আজকে বেশ স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারছে। 

“আমি জানি না। যে কোনো কিছু। যে কোন জিনিস।”

“মানে?” 

হাতটা বাড়িয়ে দিলো ক্যামিল। ।

“তোমার ভালোর জন্যই তো বলছি। বুঝতে পারছো না?”

চোখ বন্ধ ওই মুহূর্তের কথা মনে করার চেষ্টা করলো অ্যানি।

“ওদের কোনো কথা বলতে শুনেছো?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।

অ্যানির মুখভঙ্গি দেখে বোঝা সম্ভব না, প্রশ্নটা বুঝেছে কি না। 

“সার্বিয়ান হতে পারে…” 

বিদ্যুৎ গতিতে দাঁড়িয়ে গেল ক্যামিল । 

“সার্বিয়ান? তুমি কি সার্বিয়ান ভাষা জানো না কি?” 

ইদানীং প্যারিসে ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে স্লোভেনিয়ান, সার্বিয়ান, বসনিয়ান, ক্রোয়েশিয়ান। এদের নিয়েই কাজ করতে হয় ক্যামিলের। এতো সময় পরেও কোনটা কার ভাষা তা বলতে পারবে না সে। 

“না,আমি ঠিক নিশ্চিত না…”

হাল ছেড়ে দিয়ে বালিশে মাথা রাখলো অ্যানি। 

“আর একটু কষ্ট করো। বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।” 

কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে অ্যানির। 

“পাজ…সম্ভবত এটাই বলছিল।” 

ক্যামিলের বিশ্বাসই হচ্ছে না। যেন হুট করেই আবিষ্কার করলো, জুজ পেরেইরার পিয়ন অনর্গল জাপানিজ ভাষায় কথা বলছে। 

“পাজ? এটা সার্বিয়ান?” 

মাথা নাড়লো অ্যানি। যদিও সে পুরোপুরি নিশ্চিত না। 

“এর মানে হচ্ছে ‘থামো।” 

“আরে…তুমি এটা কীভাবে জানলে?” 

আবারো চোখ বন্ধ করলো অ্যানি। যেন একই কথা বারবার বলতে বলতে সে বিরক্ত। 

“তুমি নিশ্চয়ই জানো আমি ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করেছি। তিনটা বছর শুধু পূর্ব ইউরোপের ট্যুর সাজানোর দায়িত্বে ছিলাম…” 

এটা ক্ষমার অযোগ্য। এর আগে কমপক্ষে হাজারবার এই কথা বলেছে অ্যানি। ট্রাভেল এজেন্সিতে মোট পনেরো বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা তার। পরবর্তীতে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে ঢুকেছে। অনেকটা সময় পুরো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ট্যুর সাজানোর কাজ করেছে। পোল্যান্ড থেকে আলবেনিয়া পর্যন্ত ছিল তার কাজের পরিধি। 

“সবাই কি সার্বিয়ান ভাষায় কথা বলছিল?” 

মাথা নাড়লো অ্যানি। কিন্তু, এতে কাজ হবে না। ক্যামিলের সামনে সব কিছু বিস্তারিত বলতে হয়। 

“শুধু একজনের কথা শুনেছি…টয়লেটে। অন্য লোকটার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত না…(তার কথা একটু অস্পষ্ট শোনালেও পুরোপুরি বোধগম্য। ) 

এদিকে ক্যামিলের সন্দেহই সত্য প্রমাণিত হলো। গোলাগুলি করা, ডিসপ্লে কেস ভাঙা আর সহযোগীকে ধাক্কা দেয়া-সবকিছুই এই সার্বিয়ানের কাজ। তার মানে পুরো ঘটনার নেতৃত্বে ছিল ভিনসেন্ট হ্যাফনার। 

ঘটনাস্থলে অ্যানিকে মেরেছে সে। হাসপাতালে ঢুকে হত্যাচেষ্টাও তার কাজ। হয়তো অ্যাপার্টমেন্টেও সে ঢুকেছিল। আর ওর কথায় আঞ্চলিকতার কোনো ছাপও নেই। 

রিসেপশনিস্ট ঠিকই বলেছিল। 

ভিনসেন্ট হ্যাফনার 

*** 

এম.আর.আই স্ক্যান করতে যাওয়ার সময় একজোড়া ক্রাচ চাইলো অ্যানি। তার কথা বাকিদের বুঝতে বেশ অসুবিধা হলো, তাই ক্যামিল বুঝিয়ে বলল। সে হেঁটে যেতে চায়। এ কথা শুনে বিস্ময়ে নার্সের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। জোর করে হুইলচেয়ারে উঠানোর চেষ্টা করতেই চিৎকার শুরু করলো অ্যানি। ধাক্কা দিয়ে নার্সকে সরিয়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে রইলো। 

এবার আর কোনো সন্দেহ নেই। উপস্থিত নার্স তার সহকর্মী ফ্লোরেন্সকে ডাক দিলো। অ্যানির সামনে এসে সুদৃঢ় কণ্ঠে বলল, “এসব কী করছেন ম্যাডাম ফরেস্টিয়ে? উপরের তলায় নিয়ে যাবো স্ক্যানের জন্য, বেশি সময় লাগবে না।” এই বলে কোনো জবাবের অপেক্ষা না করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল ফ্লোরেন্স। তার আচার আচরণে ভদ্রতার লেশমাত্র নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সকালের ঘুম ঠিকমতো হয়নি, তাই রোগির শিশুসুলভ দাবিদাওয়া পূরণের সময় তার নেই। কিন্তু দরজার পৌঁছানোর আগেই অ্যানির চিৎকার তার কানে গেল। তার উচ্চারণ একটু অস্পষ্ট হলেও, সারমর্ম বুঝতে কোনো সমস্যা হলো না : কোনোভাবেই না। হয় আমি হেঁটে যাবো, নইলে কোথাও যাবোই না। 

দরজা থেকে ফিরে এলো ফ্লোরেন্স। অ্যানির বিষয়টা আরেকবার ভেবে দেখার অনুরোধ জানালো ক্যামিল। কিন্তু ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে নার্স। এই বামনটা এতো কথা বলে কেন? সরে দাঁড়ালো ক্যামিল । একইসাথে অ্যানিকে মানানোর শেষ সুযোগটাও হারিয়ে ফেলল নার্স। 

হুট করেই হাসপাতালের দ্বিতীয়তলা চিৎকারের শব্দে কাঁপতে শুরু করলো। উৎসুক মুখগুলো এদিক ওদিক উঁকি দিচ্ছে। নার্সরা শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টায় রত। এদিকে উপস্থিত ডাক্তাররাও এগিয়ে আসছে, এরইমাঝে ওই ইন্ডিয়ানও উদয় হলো। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে হাসপাতালেই দেখা যায়। নামের মতই বিশাল তার কাজের পরিধি। মনে হয় না ক্লিনারের চেয়ে খুব বেশি বেতন পায়। অ্যানির দিকে ঝুঁকে গেল সে। অ্যানি কী বলতে চাইছে তা শোনার চেষ্টা করলো। এরপর অ্যানির ক্ষতের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলো; এখনই ভয়াবহ দেখাচ্ছে, তবে সময় যত যাবে অবস্থা আরো খারাপ হবে। অ্যানিকে বোঝানোর চেষ্টাও করলো সে। নার্সরাও বুঝতে পারছে না, সে কী করছে। এম.আর.আই স্ক্যানের সবকিছু প্রস্তুত করা আছে, আর দেরি করা যাবে না। এদিকে ডাক্তারের আবার কিছু সময়… 

উপস্থিত নার্সরা অধৈর্য্য হয়ে পড়লো। কিন্তু ডাক্তার একটু সময় নিয়েই রোগি দেখছে। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে অ্যানির দিকে চেয়ে হাসি দিলো। এরপর নার্সকে অনুরোধ করলো ক্রাচ এনে দিতে। এতো কিছুর পর আসলে প্রতারিত বোধ করছে নার্সরা। 

খুব ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো অ্যানি। নিজ পায়ে দাঁড়িয়েছে সে। 

.

সকাল ১০টা 

“এটা পুলিশ কমিশনারের কোনো অফিস না যে…” 

অফিসটার একদম জগাখিচুড়ি অবস্থা। লোকটা পেশায় সার্জন। আশা করা যায়, তার মাথার ভেতরের অবস্থা অফিসের মত না। 

হিউবার্ট ডেইনভিল, ট্রমা ইউনিটের প্রধান। গতকালকেই ক্যামিলের সাথে দেখা হয়েছে তার। অবশ্য ক্যামিল তখন অদৃশ্য আততায়ীর খোঁজে পাগলের মত ছুটছে। ওই সল্প সময়ের দেখায় লোকটাকে চির তরুণ লাগলেও, আজকে অবশ্য পঞ্চাশ বছর বয়সি পুরুষের মত দেখাচ্ছে। মাথার সামনে একগোছা ধূসর চুল, যা তার বয়স জানান দিচ্ছে। অবশ্য এটা নিয়ে তার গর্বিত হওয়ার কথা। হাতের নখগুলোও সুন্দর করে কাটা। কিছু লোক থাকে যারা সাদা কলারওয়ালা নীল শার্ট পরে আর স্যুটের পকেটে রুমাল রাখতে পছন্দ করে। এই লোকও তাদের দলে। বুড়ো ভাম একটা। হয়তো ইতোমধ্যে অর্ধেক কর্মচারীকে জ্বালিয়ে মেরেছে। কর্মক্ষেত্রে দুই একটা সাফল্য থাকলেও তা নিতান্তই ব্যতিক্রম। পরনের সাদা কোটটা নিখুঁতভাবেইস্ত্রি করা। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় যেভাবে হাঁপাচ্ছিল, এখন আর সেই অবস্থা নেই। অপরদিকে তার বিশাল শরীরের কথা না বললেই নয়। হাঁটতে হাঁটতে ক্যামিলের সাথে কথা চালিয়ে গেল যেন যা হওয়ায় হয়ে গেছে, এখন আর নষ্ট করার মত সময় তার নেই। 

“আমারও নেই,” উত্তর দিলো ক্যামিল। 

“বুঝলাম না?” 

“বললাম যে, আমারও নেই…নষ্ট করার মত সময় আমারও নেই,” বলল ক্যামিল, “বুঝতে পারছি যে আপনি অনেক ব্যস্ত, আমিও বসে বসে মাছি মারার কাজ করি না। আপনার যেমন দায়িত্ববোধ আছে, তেমনি আমারও।” 

মুখ তুলে তাকালো ডেইনভিল, ক্যামিলের কথায় তাকে বেশ অসন্তুষ্ট মনে হলো। কিছু না বলে কাজে মনোযোগ দিলো সে। কিন্তু এখনো দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা অফিসার বোধহয় বুঝতে পারেনি, তার আর কিছু বলার নেই। 

“রোগির এখন সম্পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন,” বিড়বিড় করে বলল ডেইনভিল। “ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণার মাঝ দিয়ে যাচ্ছে সে। তার বর্তমান অবস্থা খুব অবাক করার মতন। কোমায় যেতে পারতো সে। এমনকি মৃত্যুর সম্ভাবনাও ছিল।” 

“বাসায়ও থাকতে পারতো। কিংবা অফিসে। এমনকি নিজের শপিং শেষ করে ফিরতে পারতো। কিন্তু সমস্যাটা হলো, এমন লোকের খপ্পরে পড়েছে যার হাতে নষ্ট করার মত সময় নেই। ঠিক আপনারই মত। যার কাছে নিজের মতামত অন্য সবার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।” 

ক্যামিলের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ডাক্তার। ডেইনভিল এমন একজন মানুষ, যার সবচেয়ে নিরীহ কথাবার্তাও বাকবিতণ্ডা ছাড়া সম্পন্ন হয় না। এমনিতেই কলহপ্রিয়তায় তার বেশ সুখ্যাতি আছে। আর তা চালিয়েও যেতে পারে অনেকক্ষণ। ক্যামিলের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলো আরেকবার। 

“আমি বুঝতে পারছি পুলিশের ধারণা তারা যে কোনো জায়গায় যেতে পারে। কিন্তু হাসপাতালের রুম জেরা করার জায়গা না কম্যান্ড্যান্ট। এটা হাসপাতাল, আপনি যাকে তাকে অপমান করে বেড়াতে পারেন না। করিডোরে ঘুরে ঘুরে আমার কর্মচারীদের হেনস্থা করার অনুমতি আমি দেবো না…”

“আপনার কি ধারণা নিজেকে ফিট রাখার জন্য করিডোর জুড়ে হেঁটে বেড়াই আমি?” 

ক্যামিলের কথায় পাত্তাই দিলো না ডেইনভিল। 

“এখানে যদি রোগির জীবনের এতোই ঝুঁকি থাকে, তাহলে তাকে নিরাপদ কোথাও সরিয়ে নিন। দয়া করে এসব ফালতু আলাপ বাদ দিয়ে আমাকে কাজ করতে দিন। এক রোগি নিয়ে পড়ে থাকলে তো আমাদের চলবে না।” 

“আপনাদের মর্গে কি জায়গা খালি আছে?” 

এই কথা শুনে চমকে উঠলো ডেইনভিল। 

“এমনি জিজ্ঞেস করলাম আর কী। কারন প্রত্যক্ষদর্শীকে জেরা করতে না পারলে তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট অন্য কোথাও সরানোর অনুমতি দেবে না। এদিকে নিশ্চিত না হয়ে আপনিও কিছু করবেন না; অনেকটা পুলিশের মতই। আর আমাদের দুজনের প্রায় একই সমস্যা। যত দেরিতে ব্যবস্থা নেবেন বিপদ ততই বাড়বে।” 

“আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না, কম্যান্ড্যান্ট।” 

“ঠিক আছে। বুঝিয়ে বলছি। প্রত্যক্ষদর্শীকে খুন করার জন্য একজন খুনি আপনার হাসপাতালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার কাজে যদি বাঁধা দেন, তাহলে হাসপাতালে তুলকালাম ঘটে যাবে। সেক্ষেত্রে আপনাকে দুটো সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে। প্রথমত, আপনার মর্গে যথেষ্ট খালি জায়গা থাকবে না। দ্বিতীয়ত, রোগি প্রশ্নের জবাব দেয়ার মত অবস্থায় থাকলেও আপনার বাঁধার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। সেহেতু পুলিশের তদন্ত কাজে বাঁধা প্রদানের অভিযোগ আনা হবে।” 

ডেইনভিল একটু অদ্ভুত ধরনের মানুষ; তার আচার আচরণ অনেকটা লাইটের সুইচের মত হয় বিদ্যুৎ আছে কিংবা নেই। এর মাঝমাঝি কোনো অবস্থান নেই। হুট করে যেন বিদ্যুৎ চলে এলো। বিস্ময়ের দৃষ্টিতে ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো সে। একইসাথে তার চকচকে সাদা দাঁতও দেখা গেল। কথা কাটাকাটি যেন আরো জমিয়ে তুলতে চাইছে ডা. ডেইনভিল। হয়তো সে কিছুটা উগ্র, অভদ্র আর একগুঁয়ে, গোলমাল তার পছন্দের জিনিস। আক্রমণাত্মক আর তর্কপ্রবণ হলেও, ভেতরে ভেতরে হেরে যেতেই পছন্দ করে সে। এমন অনেক লোকের দেখাই পেয়েছে ক্যামিল। এরা আপনাকে মেরে আলু ভর্তা বানাবে। আবার দিনশেষে ব্যান্ডেজও লাগিয়ে দেবে। 

তার মধ্যে মেয়েলি একটা ব্যাপার আছে। 

একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে দুইজন। ডেইনভিল একইসাথে বুদ্ধিমান এবং সংবেদনশীল। 

“ঠিক আছে। এবার কাজের কথা আসা যাক,” সুস্থির কণ্ঠে বলল ক্যামিল ।

.

সকাল ১০টা ৪৫ 

“অপারেশন লাগবে না।” 

অ্যানির কথা হজম করতে একটু সময় নিলো ক্যামিল। আনন্দে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করলেও, তা দমন করলো সে। 

“তাহলে তো বেশ ভালো…” উত্তেজিত কণ্ঠে বলল ক্যামিল। তার চোখেমুখের এই আনন্দের ছাপ অ্যানির নজর এড়ালো না। 

এক্স-রে আর এম. আর. আই স্ক্যান রিপোর্ট দেখে তাই বলেছে ডাক্তার। যদিও দাঁতের আলাদা সার্জারি লাগবে, কিন্তু বাকি ক্ষত সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে। ঠোঁটে আর বাম গালে হয়তো কিছু দাগ থেকে যাবে। ‘কিছু দাগ থেকে যাবে’ মানে, ডাক্তার কী বোঝাতে চাইলো? কতটুকু থাকবে? পুরোপুরি থেকে যাবে না তো? নিজের মুখটা আয়নার ভালোমতোই দেখেছে অ্যানি; তার ঠোঁটের অবস্থা এতোটাই খারাপ, এখনই বলা সম্ভব না দাগ কি আদৌ যাবে কি না। আর বাম গালের যে গভীর ক্ষত, সেলাই না খোলা পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ বোঝা যাবে না। 

“দেখুন, কিছুটা সময় তো লাগবেই,” এমনটাই বলেছিল ডাক্তার। 

অ্যানির মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে একথা সে একদমই বিশ্বাস করেনি। আর ক্যামিলের হাতে সেই মহামূল্যবান সময়টাই নেই। 

বিশেষ একটা কাজেই সকাল সকাল এসেছে ক্যামিল। আপাতত দুইজন একা। একটু বিরতি নিয়ে বলতে শুরু করলো ক্যামিল। 

“আশা করি তুমি লোকগুলোকে চিনতে পারবে…” 

অ্যানি এমনভাবে মাথা নাড়লো, যার হাজারো মর্মার্থ সম্ভব। 

“যে লোকটা গুলি চালিয়েছিল, তুমি বলেছিল সে বেশ লম্বা। লোকটা দেখতে কেমন ছিল?” 

অ্যানির কাছে এখন সবকিছু জানতে চাওয়ার ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর। তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবার শুরু থেকে সব বলতে হবে তার। আর এখন বেশি জোর দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। 

“বেশ সুদর্শন,” স্পষ্টভাবে বলল অ্যানি। 

“কী…’সুদর্শন’ বলতে তুমি কী বোঝাচ্ছো?” খেই হারিয়ে ফেলল ক্যামিল। 

চারপাশে তাকালো অ্যানি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না ক্যামিল। কেবলই মৃদু এক হাসি উপহার দিলো অ্যানি। এর ফলে তার ঠোঁট দুটো ভেতরে ঢুকে যাওয়ায় ভাঙা দাঁত দেখা গেল। 

“সুদর্শন…তোমার মত…” 

আরম্যান্ডকে অনেক দিন ধরে ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখেছে ক্যামিল। এরকম অনেক মুহূর্তের সাক্ষীও হয়েছে : উন্নতির এক ছিটেফোঁটাও দেখা গেলে, আশার জোয়ারে লাগাম দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। কেবলই অ্যানিকে হাসতে দেখলো। এখনই রিসেপশনে ছুটে গিয়ে ছাড়পত্র নিয়ে আসতে ইচ্ছে করছে ক্যামিলের। কিন্তু আশা অনেক সময়ই গুড়ে বালিতে পরিণত হয়। 

ক্যামিলেরও হাসতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু অপ্রস্তুত অবস্থায় তাকে ধরে ফেলল অ্যানি। তোতলানো শুরু করলো ক্যামিল। আবারো চোখ বুজলো অ্যানি। তবে আশার বিষয়, এখন স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারছে সে। আবারো প্রশ্ন শুরু করবে, এমন সময় অ্যানির ফোন বেজে উঠলো। ফোনটা এগিয়ে দিলো ক্যামিল। নাথান ফোন করেছে। 

“তোকে কোনো দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাইনি…” চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গেল তার। মুহূর্তেই মাঝে শত কষ্ট সহ্য করা বোনের ভূমিকা নিলো সে। নাথানের কণ্ঠে আতঙ্কের ছাপ সুস্পষ্ট। 

“যা বলার ছিল, তা তো ম্যাসেজেই বলে দিয়েছি…” কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার নিদারুণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অ্যানি। ভাইকে বোঝানোই এখন তার মূল লক্ষ্য। 

“না, আর কোনো খবর নেই,” তার কণ্ঠে আনন্দের ছাপ। “তাছাড়া, এখানে আমি একা না। এতো চিন্তার কিছু নেই।” 

ক্যামিলের দিকে তাকালো অ্যানি। নাথানকে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছে। 

“না, একদমই না! শোন, আমাকে এখন এক্স-রে এর জন্য যেতে হবে, পরে ফোন করবো। আমিও তোকে অনেক ভালোবাসি…” 

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোবাইলটা ক্যামিলের দিকে এগিয়ে দিলো অ্যানি। নিজের প্রাপ্ত সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দিলো ক্যামিল । আরো কিছু কথা বাকি আছে তার। 

“অ্যানি…তোমার কেসে জড়ানো উচিত হয়নি আমার। বুঝতে পারছো, আমি কী বলতে চাইছি?” 

মাথা নাড়লো অ্যানি। 

“সত্যি বুঝতে পারছো তো?” 

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ক্যামিল। অ্যানির মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, তার খারাপ লাগছে। 

“আমি আসলে বুঝতেই পারলাম না, কী থেকে কী হয়ে গেল। আর তারপর…” 

অ্যানির হাত ধরলো ক্যামিল। তার হাত তুলনামূলক ছোট হলেও, শিরাগুলো বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়। আর সবসয়ই তা গরম থাকে। কী বলে অ্যানির মন ভালো করা যায় তাই ভাবতে লাগলো ক্যামিল। 

না বলাই ভালো। যে নরপশু তোমাকে নৃশংসভাবে মেরেছে, তার নাম ভিনসেন্ট হ্যাফনার। তোমাকে হত্যারও চেষ্টা চালিয়েছে। আমি নিশ্চিত ও আবার আসবে। 

তার চেয়ে বলা যায়, তোমার পাশেই আছি আমি। আর কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না তোমার। 

ভুলেও বলা যাবে না, কমিশনার আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করে না। কিন্তু, আমি জানি ঠিক পথেই এগুচ্ছি আমি। লোকটা বদ্ধ উন্মাদ, অসীম সাহসী। 

এটা বলা ভালো, খুব দ্রুতই লোকটাকে ধরে ফেলবো আমরা। তখন আর কোনো বিপদ থাকবে না তোমার। কিন্তু এর জন্য তোমার সাহায্য প্রয়োজন। 

ভুলেও বলা যাবে না যে সারাদিন তোমার রুমের বাইরে একজন অফিসার থাকবে। কিন্তু, আমি ভালোমতোই জানি এতে কোনো লাভ নেই। যতক্ষণ ওই লোকটা ধরা না পড়ছে, তোমার জীবন সংকটাপন্ন। কোনো বাঁধাই সে মানবে না। 

এরই মাঝে তার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে কেউ একজন ব্যক্তিগত সব কাগজপত্র নিয়ে গেছে। একথা বলার সময় এখনো আসেনি। এমনকি এখনো ক্যামিলের হাতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো সূত্রও নেই। 

এতো ভাবনা চিন্তার পর ক্যামিল বলল, “সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। নিশ্চিন্তে থাকো তুমি।” 

“আমি জানি…” 

“সবকিছু ঠিক করতে, তুমি তো আমাকে সাহায্য করবে, তাই না, অ্যানি?” 

মাথা নাড়লো সে। 

“আর আমরা যে একে অপরের পরিচিত একথা কাউকে বলবে না, মনে থাকবে?” 

সায় জানালো অ্যানি। তবুও তার চোখেমুখে বিষণ্নতার ছায়া। পুরো ঘর জুড়ে অস্বস্তিকর এক নিরবতা নেমে এলো। 

“আমার রুমের বাইরে পুলিশ অফিসার কেন?” 

করিডোরে তাকে হাঁটাহাঁটি করতে দেখেছে অ্যানি। এই প্রশ্নে একটু অপ্রস্তুত বোধ করলো ক্যামিল। মাঝে মাঝে নিখুঁতভাবে মিথ্যা বলে সে। কিন্তু অ্যানির সামনে, আট বছরের বাচ্চার মত লজ্জাবনত মুখ নিয়ে তোতলাতে শুরু করে। 

“আ…মি …” 

অ্যানির মত বুদ্ধিমতী কারো জন্য এই একটা শব্দই যথেষ্ট। ক্যামিলের মুখভঙ্গি দেখে যা বোঝার বুঝে গেল সে। 

“তোমার মনে হয়, ওই লোকটা এখানে আসবে?” 

জবার দেয়ার সময় পেল না ক্যামিল। 

“আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছো?” 

উত্তর দেয়ার আগে একটু দ্বিধায় ভুগলো ক্যামিল। এরইমাঝে নিজের ধারণা যে সঠিক তা বুঝে ফেলল অ্যানি। এমন সময়ে একে অপরের পাশে থাকা উচিত। কিন্তু খুব অসহায় বোধ করছে ক্যামিল। ওই লোক আরেকবার সুযোগ পেলে কী করতে পারে এই ভেবে শিউরে উঠলো অ্যানি। 

“ওই লোক এখানে এসেছিল, তাই না?” 

“সত্যি বলতে, আমি জানি না।”

ক্যামিলের চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারলো অ্যানি। কিছু একটা লুকাচ্ছে সে। হুট করেই অ্যানির ঘাড় কাঁপতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে সেই কাঁপুনি হাত অবধি বিস্তৃতি লাভ করলো। দরজার দিকে তাকালো অ্যানি। পুরো রুমটা এমনভাবে দেখতে লাগলো, যেন এটাই তার শেষ দেখা। হাসপাতালের এই বিছানাই যেন তার মৃত্যুশয্যা। কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না ক্যামিল। 

“আমার উপর বিশ্বাস রাখো। কেউ তোমাকে ছুঁতেও পারবে না এখানে।” 

আর সহ্য করতে পারলো না অ্যানি। জানালার দিকে ঘুরে কাঁদতে শুরু করলো। 

*** 

অ্যানির এখন পরিপূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন। একইসাথে মানসিক শক্তিও ফিরে পাওয়া দরকার। এখন এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর এই বিষয়েই জোর দিচ্ছে ক্যামিল। যদি ছবি দেখে অ্যানি কাউকে শনাক্ত করতে না পারে, তাহলে তদন্ত এখানেই থেমে যাবে। কিন্তু ছোট কোন সূত্রও যদি দিতে পারে সে, ক্যামিলের পূর্ণ আত্মবিশ্বাস আছে নিজের উপর। 

প্রয়োজন হলে খড়ের গাদা থেকে সুই খুঁজে বের করবে।

এ কোন পরীক্ষায় ফেলেছে নিজেকে? 

শেষটাই বা কেমন হবে? 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *