দ্বিতীয় দিন – বিকাল

বিকাল ৪টা ১৫ 

বাইরে বেশি সময় কাটাইনি। মাথায় শুধু একটা চিন্তাই ঘুরছিল। পুরোনো বন্ধুকে না আবার হারিয়ে ফেলি। স্টেক খেতে খেতে অনেক সময় পার করেছি। এখন সিগারেট ধরানো কিংবা গাড়ির জানালা খোলার মত ভুল করা যাবে না। কিন্তু সত্যিই যদি আসার ইচ্ছা থাকে রাভিচের, তাহলে এতো দেরি কেন? এদিকে আমি একদম ক্লান্ত। 

ওকে ধরার জন্য স্বর্গ নরক উলটে পালটে ফেলছে পুলিশ। তাই এখানে আসা শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার। 

শয়তানের নাম নিতেই, এ কার মুখ দেখলাম আমি? এ তো আমার পুরোনো বন্ধু ডুসান। ঘাড় বলতে কিছু নেই, পেটানো শরীর আর সার্কাসের ক্লাউনের মত বড় বড় পা তার। 

মূল দরজা থেকে প্রায় ত্রিশ মিটার দূরে গাড়িতে বসে আছি। তবে ডুসান আমার থেকে প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কে জানে কেবলই কোনো ছুকরির সাথে আনন্দ ফুর্তি করে এলো কি না। তবে চেহারা দেখে সুবিধার মনে হচ্ছে না। 

পরনে দশ বছরের পুরোনো এক কোট, পায়ে ছেড়া জুতো। বোঝাই যাচ্ছে, একদম কপর্দকশূন্য অবস্থায় দিন পার করছে। 

আর, এটা খুবই খারাপ লক্ষণ। 

গত জানুয়ারির কাজের পর ভাগের অংশ ঠিকমতোই পেয়েছিল ডুসান। পকেট ভর্তি থাকার পর তো এমন অবস্থা হওয়ার কথা না। কারন ওর যা স্বভাব, সেই হিসাবে জ্বলজ্বলে স্যুট, হাওয়াই শার্ট আর চকচকে জুতো পরে ঘোরার কথা। কিন্তু এখন তো ভবঘুরের মত লাগছে। 

একটা খুন আর চারটা ডাকাতির অভিযোগ কাঁধে নিয়ে ঘোরা সহজ কথা নয়। নিজের চলাফেরার পরিধিও অনেক সীমিত হয়ে গেছে ওর। 

হয়তো কেউ বেঈমানি করেছে ওর সাথে। ঠিক আমার সাথে যেমনটা হয়েছে। অবশ্য এমনটা হওয়ারই কথা। কিন্তু এমন চিন্তাভাবনা আমাকে হতাশ করে তোলে। তাই নিজের ভেতরেই চেপে রাখতে হয়। 

প্লাইউডের দরজা এমনভাবে টেনে ধরলো রাভিচ, আরেকটু হলে খুলে আসতো। ধৈর্য্য নামক কিছুর অস্তিত্বই ছিল না ওর মাঝে। সত্যি বলতে, আগে থেকেই এমন বেপরোয়া প্রকৃতির। 

ওর এই মাথায় গরম স্বভাবের জন্যেই আজ পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। জানুয়ারিতে যদি গোলাগুলিটা না করতো, তাহলে… 

রাভিচ ওই নরকে ঢোকার কয়েক সেকেন্ড পর পিছু নিলাম আমি। ডান দিক থেকে থপথপিয়ে চলার শব্দ কানে এলো। এমন আওয়াজ একমাত্র বড় বড় পা ফেলে হাঁটার সময়েই হয়। সিঁড়িতে আলো প্রায় নেই বললেই চলে। করিডোর একটা বাতি টিমটিম করে জ্বলছে। পা টিপে টিপে নিচ থেকে তিন তলা পর্যন্ত উঠলাম। হায় ঈশ্বর! প্রসাবের কটু গন্ধ থেকে শুরু করে হ্যামবার্গার, গাঁজা, কিসের গন্ধ নেই এখানে। যেন আস্ত একটা ময়লার ভাগাড়। দরজায় টোকা দেয়ার আওয়াজ পেয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। আগে বুঝতে হবে ভেতরে কয়জন আছে। উপস্থিত মানুষের উপর নির্ভর করবে কাজটা কত কঠিন হবে। 

দরজা বন্ধ হওয়ার পর এগিয়ে গেলাম আমি। দরজায় মান্ধাতা আমলের এক তালা লাগানো। এটা খুলতে দুই সেকেন্ডও লাগবে না। কাঠের দরজায় কান পাতলাম-রাভিচের কর্কশ কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। অনেকদিন পর এই আওয়াজ শুনে একটু অন্যরকম লাগছে আমার। ওকে খুঁজে বের করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। 

রাভিচকে খুব একটা খুশি মনে হল না। ভেতর থেকে ভাঙচুরের শব্দ আসছে। শেষমেশ এক নারীর আওয়াজ কানে এলো। নরম সুরে কথা বলছে আর গুঙিয়ে কাঁদছে। মনোযোগ হারালাম না আমি। রাভিচের কথা শোনা যাচ্ছে। ঘরের ভেতর মাত্র দুইজন কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। আরো কিছুক্ষণ একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজ হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকানির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ঠিক আছে। মোটামুটি নিশ্চিত আমি, ভেতরে দুজনই আছে। মাথায় ক্যাপ চাপিয়ে, হাতে গ্লাভস পরে নিলাম। তালা খোলার সময় ওয়ালথারটা বাম হাতে রাখলাম। শেষ পিনটা খুলতেই দরজা হা হয়ে গেল। একটু নিচু হয়ে কিছু খুঁজছে দুজন। বুঝতে পারছে, তাদের পেছনে কেউ আছে। তাই সোজা হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো দুজন। মেয়েটার বয়স পঁচিশের কাছাকাছি হবে। ঘন কালো চুল, দেখতে একদম কুৎসিত। 

…আর মৃত। কেননা, চোখ বরাবর একটা বুলেট ঠুকে দিয়েছি আমি। এরপর চোখটা এমন বড় হয়ে গেল, যেন কেউ তিনগুণ পারিশ্রমিকের প্রস্তাব দিয়েছে। যেন নিজ ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার 

পকেটের দিকে হাত বাড়াতেই রাচিভের বাম পায়ে গুলি চালালাম। এমনভাবে লাফাতে লাগলো, যেন গরম ইটে পা পড়েছে। এরপর হাঁটু ভাঁজ করে গোঙাতে শুরু করলো ও। 

কুশলাদি বিনিময় যেহেতু শেষ, এখন গুরুত্বপুর্ণ আলোচনায় আসা যাক।

পুরো রুম জুড়ে জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একদম নোংরা অবস্থা। 

“তোর এই মেয়ে তো একদম অপরিষ্কার।”

বুলেটটা আঘাত করার সাথে সাথে মেয়েটা ময়লা ম্যাট্রেসে লুটিয়ে পড়েছে। অস্থিসার হাতের শিরাগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, শিরাগুলো কোনো গুপ্তধনের পথ বাতলে দেবে। পা ধরে টান দিতেই দেখি, নিজের মৃত্যুশয্যা আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছিল মেয়েটা। এতো বুদ্ধিমতী মেয়ে আজকাল পাওয়াই যায় না। মৃত শরীরের নিচে বাহারি রকমের কাপড় আর একটা কম্বল। আমার কষ্ট অনেকটা কমে গেল। চোখ দুটো এখনো খোলাই আছে। তবে শুরুর দিকের সেই অবাক করা চাহনি আর নেই, যেন ভাগ্যের সাথে মীমাংসা করে শান্তিতে আছে এখন। 

অন্যদিকে, রাভিচ এখনো গোঙাচ্ছে। শরীরের এক পাশে ভর দিয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। এক পা সামনে সামনের দিকে ছড়ানো। বাম পা রক্তের সাগরে ডুবে আছে। একটু পর পর চিৎকার করে গালি দিচ্ছে আমাকে। অবশ্য এই শব্দ আশেপাশে কারো কানে পৌঁছানোর সম্ভাবনা একদমই নেই। কিন্তু সার্বিয়ান বন্ধুর পূর্ণ মনোযোগ দরকার আমার। যাতে করে মন খুলে দুই একটা কথা বলতে পারি। 

“যাই হোক, তোমার এই ‘ছুকরি’ মারা যাওয়াতে ভালোই হয়েছে। তোমাকে এই অবস্থায় দেখলে, আরো বেশি কষ্ট পেতো বেচারি।” 

হয়তো মেয়েটাকে সত্যিকারে ভালোবাসতো না রাভিচ। কিংবা অন্য কোনো কারনও থাকতে পারে। মেয়েটার এমন পরিণতিতে রাভিচকে খুব একটা চিন্তিত মনে হলো না। এখন একমাত্র নিজের কথাই ভাবছে সে। রক্ত আর বারুদের গন্ধে বাতাসটা কেমন ভারি হয়ে আছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আমার। তাই জানালা খুলে দিলাম। সম্ভবত বেশ কম দামেই অ্যাপার্টমেন্টটা বাগিয়েছে ও। বাইরে কংক্রিটের দেয়াল ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। 

ওয়ালথারের বাঁট দিয়ে রাভিচের মুখ বরাবর দুই এক ঘা লাগালাম। কোনো রাগ থেকে নয়, শুধু মনোযোগ আকর্ষণের জন্য। বিকট চিৎকার দিয়ে উঠলো রাভিচ। না, আর ভরসা করা যাবে না। মেঝে থেকে একটা টি-শার্ট নিয়ে বলের মত গোল করে, ওর মুখে গুঁজে দিলাম। কোনো বাঁধা যাতে না তাই একটা হাতও বেঁধে দিচ্ছি। এবার কথা বলা যাবে শান্তিমত। রাভিচ মেঝেতে পড়ে থাকার কারণে আমাকে একটু ঝুকতে হলো। এ তো দরদর করে ঘামছে। ঠিকমতো বসতেও পারছে না, একটু পর পর শরীর মোচড়াচ্ছে। মুখে কাপড় থাকা সত্ত্বেও আবোলতাবোল বলার চেষ্টা করছে। চুলের মুঠি ধরে কাছে টেনে আনলাম। 

“এখন, মনোযোগ দিয়ে শোন, সারারাত এখানে কাটানোর জন্য আসিনি আমি। তাই কথা বলার জন্য একটা সুযোগ দিচ্ছি। জীবনের মায়া থাকলে আমাকে সাহায্য করবি। আশা করি, কথাটা বুঝতে কোনো সমস্যা হয়নি। আজকে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে পারবো না। গত দুইদিন ধরে এক ফোঁটাও ঘুমাইনি। যদি নিজের জীবনের মায়া থাকে, তাহলে আমার প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিবি। এরপর আমরা সবাই ঘুমাতে যাবো। আমি, তুই, তোর ছুকরি, ঠিক আছে?” 

রাভিচের ফ্রেঞ্চ বরাবরই জঘন্য। কথাবার্তার বেশিরভাগ অংশে ব্যাকরণজনিত ভুলসহ আরো ভুল থাকে। তাই ওর সাথে কথা বলার সময়, এদিকে খেয়াল রাখতে হয়। সহজ শব্দের সাথে হালকা ইশারাও প্রয়োজন। তাই শব্দ বাছাইয়ে সতর্ক হওয়ার সাথে সাথে, বাম পায়ের ক্ষতে ধীরে ধীরে চাকুর আগা ঢুকিয়ে দিলাম। চাকুটা নতুন আর ধারালো। একটু পরই তা রাভিচের গোড়ালি ভেদ করে মেঝে অবধি পৌঁছে গেল। মুখে কাপড় থাকা সত্ত্বেও, চিৎকার করতে সক্ষম হয়েছে রাভিচ। মৃগী রোগির মত কাঁপছে। আর হাত দুটো প্রজাপতির মত ছড়িয়ে দিয়েছে। 

আমার মনে হয়, এতোক্ষণে পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করছে পেরেছে ও। তবুও চিন্তা ভাবনার জন্য আরো কিছু সময় দিলাম। যাতে আর কোনো ভুল না করে। 

“আমার যা মনে হয়, তুই আর হ্যাফনার মিলে, শুরু থেকেই আমার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র করছিলি। ওর মতো, তোরও মনে হয়েছিল দুইভাগের সুযোগ থাকতে তিনভাগ কেন হবে। আর দুইভাগে তো বেশিই পাওয়া যাবে। এ ব্যাপারে আমিও একমত।” 

আমার দিকে তাকিয়ে আছে রাভিচ। পানিতে টলমল করছে ওর চোখ—তবে সেখানে দুঃখের চেয়ে ব্যথার পরিমাণ বেশি—কিন্তু এতোটুকু বলতে পারি, একদম জায়গা মত ঢিল মেরেছি আমি। 

“হায় ঈশ্বর! তোর মাথায় একটুও ঘিলু নেই, ডুসান! গাধার বাচ্চা গাধা, তোর কী মনে হয়? হ্যাফনার তোকে কেন বেছে নিলো? কারন, তুই একটা আস্ত গাধা। তোর মাথায় কি ঢুকছে কিছু?” 

খিঁচুনি শুরু হলো রাভিচের। 

“তো, হ্যাফনারের সাথে মিলে আমাকে বোকা বানাতে চেয়েছিলি…তারপর তোকেও বোকা বানালো হ্যাফনার। তোকে প্রথমবার দেখার পর, কী বলেছিলাম মনে আছে? একদম ঠিকই বলেছিলাম : তুই একটা আমড়া কাঠের ঢেঁকি।” 

এই মুহূর্তে নিজের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত না রাভিচ। আপাতত নিজের স্বাস্থ্য আর অক্ষত অঙ্গ কীভাবে রক্ষা করা যায়, তা নিয়েই ভাবছে সে। অবশ্য এমন ভাবনা যুক্তিযুক্ত। যত বেশি কথা বলছি, রাগের পরিমাণ তার দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। 

“আমার মনে হয়, এরপর হ্যাফনারকে খুঁজে বের করিসনি। ওর সাথে বোঝাপড়া করার মতো সাহসও তোর নেই। তাছাড়া, খুনের অভিযোগও আছে তোর বিরুদ্ধে, তাই গর্তে থাকার সিদ্ধান্ত নিলি। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, হ্যাফনারকে খুবই প্রয়োজন আমার। আর এইকাজে, আমাকে সাহায্য করবি তুই। তার জন্য হ্যাফনার সম্পর্কে যা যা জানিস, সব বলবি। ঠিক আছে?” 

আমার দিকে থুতু মারলো রাভিচ। 

পরিস্থিতি বিবেচনায় এমন প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক। তবুও, আমার সাথে এমন আচরণ! এতো অমার্জনীয় অপরাধ। 

এতে করে অবশ্য একটা লাভ হলো। এতোক্ষণ যে ভুলে পথে এগুচ্ছিলাম, তা বুঝতে পারলাম। ভদ্র আচরণের মাধ্যমেই বিষয়টা মীমাংসা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রাভিচ তো নির্বোধ। এইটুকু বোঝার মতো ক্ষমতা ওর নেই। আমাকে বাঁধা দেয়ার মত কোনো অবস্থাতেই নেই ও। মাথায় উপুর্যপুরি কয়েকটা লাথি মেরে মেঝেতে শুইয়ে দিলাম। এরমাঝে পা থেকে চাকুটা তোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো রাভিচ। 

মেয়েটার লাশ বিছানায় পড়ে আছে। আশা করি কিছু মনে করবে না। লেপের এক কোণা ধরে হ্যাঁচকা টান মারলাম। সাথে সাথে মেয়েটা উল্টে গেল। স্কার্ট উপরে উঠার ফলে, মেয়েটার শুকনো পা নজরে এলো। হাঁটুর পেছন দিকে অসংখ্য সুঁইয়ের দাগ। আমি না মারলেও খুব বেশিদিন বাঁচতো না এই মেয়ে। 

আমি ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলাম, গোড়ালি থেকে চাকুটা বের করে এনেছে রাভিচ। বাহ! ওর গায়ে তো খ্যাপা ষাঁড়ের মত শক্তি। তাই দেরি না করে গাধাটার হাঁটুতে আরেকটা বুলেট ঠুকে দিলাম। এই ধাক্কা আর সহ্য করতে পারলো না ও। যন্ত্রণায় পুরো শরীর ছুঁড়ে দিলো বাতাসে, বিকট শব্দে গোঙাতে থাকলো। আর কিছু করার আগেই ওর শরীরটা উল্টে দিয়ে লেপটা ছুড়ে মারলাম। এখন সিংহাসনে আরোহণের সময়। অবশ্য আমার সিংহাসন রাভিচের শরীর দিয়ে তৈরি। বসার জন্য উপযুক্ত জায়গা বের করলাম; আমি চাই না ও দম বন্ধ হয়ে মারা যাক। প্রশ্নের দিকে মনোযোগ দেয়া দরকার। কিন্তু তার আগে রাভিচের চিৎকার থামাতে হবে। 

হাতটা টেনে কাছে নিয়ে আসলাম। ছোট আঙুল দিয়েই কাটাকাটি শুরু করতে হলো। সচরাচর, আঙুলের গিঁট বরাবর সুন্দর করে কাঁটতে ভালো লাগে আমার। কিন্তু রাভিচের মত কারো ক্ষেত্রে শিল্পচর্চা করার দরকার নেই। শুধু শুধু সময় নষ্ট। 

এক কোপে কাজ সারলাম, যা আমার মত সৌন্দর্যের পূজারির কাছে রীতিমতো অপমানজনক। 

বাজি ধরে বলতে পারি, আর পনেরো মিনিটের মাঝেই তোতাপাখির মত সব বলবে রাভিচ। আমি একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছি। কিন্তু এখনো পূর্ণ মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছি না। 

তাতে অবশ্য দমে যাইনি আমি। কাজ এখনো চলছে, তর্জনী পর্যন্ত চলে এসেছি-কী কষ্টই না করছে বেচারা। হাসপাতালে কথা মনে পড়লো আমার। 

হিসাবে যদি কোনো ভুল না করে থাকি, তাহলে কিছুক্ষণের মাঝেই আমার সার্বিয়ান বন্ধু পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবে। সেক্ষেত্রে হাসপাতালের ওই মহিলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। এতোক্ষণে তো সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত থাকার কথা তার। 

আশা করি, তাই যেন হয়। আরেকটা জীবন নেয়ার কোনো ইচ্ছা আপাতত নেই। 

.

বিকাল ৫টা 

“ভেরহোভেন?” 

ন্যূনতম সম্মানসূচক “কম্যান্ড্যান্ট”ও বলল না। রাগে ফুঁসছে কমিশনার। অতিরিক্ত কোনো কথা বলল না। এতোকিছু বলার আছে যে কোথা থেকে শুরু করবে, বুঝে উঠতে পারছে না মিচার্ড। 

“সম্পূর্ণ রিপোর্ট লাগবে আমার…” 

বিশেষত্বহীন মানুষ আমলাতন্ত্রে শেষ আশ্রয় খুঁজে নেয়। 

“তুমি বলেছিল নির্দিষ্ট কিছু জায়গায়’ অপারেশন চলবে। এছাড়া ‘সন্দেহভাজন তিনজনের গল্প শোনালে আমাকে, কিন্তু, তুমি তো পুরো শহরে তোলপাড় চালাচ্ছো। তুমি কি ইচ্ছা করেই এমন করছো?” 

টেলিফোনের অপর পাশে থাকা ক্যামিল কিছু বলার চেষ্টা করলেও, তাকে থামিয়ে দিলো মিচার্ড। 

“সত্যি বলতে, এসবে আমার কিছুই যায় আসে না। কিন্তু, তুমি এখনই সবাইকে ফিরতে বলো, কম্যান্ড্যান্ট। তোমার এই খেলা বন্ধ করো। সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না।” 

পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। হতাশায় চোখ বন্ধ করলো ক্যামিল। একদম শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল সে। এমন সময় পেছন থেকে কেউ যেন তাকে টেনে ধরলো। পাশেই দাঁড়ানো লুইস মুখ ঘুরিয়ে নিলো। হাত দিয়ে ইশারা করে অপারেশন বন্ধ করার কথা জানালো ক্যামিল। সাথে সাথে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো লুইস। ক্যামিলের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এরপর কী হবে তা সে ভালোমতোই জানে। শহর জুড়ে কর্মরত অফিসাররাও হতাশায় মাথা ঠুকবে। আগামীকাল ঝাড়ি শোনার প্রস্তুতি নিয়ে গাড়িতে উঠলো সবাই। কিন্তু এই সল্প সময় বেশ উপভোগ করেছে তারা। 

কথাগুলো হজম করার জন্য, ক্যামিলকে সময় দিচ্ছে কমিশনার। কিন্তু তার এই বিরতি একইসাথে অতিনাটকীয় এবং ভীতিকর। 

*** 

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অ্যানি। এমন সময়ে একজন নার্স আসলো। ফ্লোরেন্স, বয়স খুব বেশি না। অ্যানির চেয়ে ছোটই হবে। কিন্তু বয়স কমানোর নিদারুণ চেষ্টার কারণে, আরো দশ বছর বেশি বয়স্ক লাগে তাকে। 

“সবকিছু ঠিক আছে তো?” 

আয়নার দুজনের মুখ দেখা গেল। অ্যানির দিকে তাকিয়ে চওড়া হাসি দিলো নার্স। আর কখনো স্বাভাবিকভাবে হাসতে পারবে না, এই ভেবে কিছুটা বিমর্ষ হলো অ্যানি। 

“সবকিছু ঠিক আছে তো?” 

আবারো একই প্রশ্ন। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না অ্যানির। বিশেষ করে ফ্লোরেন্সের সাথে তো আরো না। তখনি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার ছিল। তবুও মনকে মানাতে পারছে না। বের হয়ে যাবার মতো, থাকবারও অসংখ্য কারন আছে। 

আর, এরপর আছে ক্যামিল। 

ক্যামিলের কথা মনে পড়লেই, তার সারা শরীর কাঁপতে শুরু করে। একা একা কিছুই করতে পারবে না ক্যামিল। পারলেও, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে। 

*** 

জাম্বিয়ের রোড। ইতোমধ্যে রওনা দিয়েছে কমিশনার। পনেরো মিনিটের মাঝেই, তার সাথে দেখা করবে ক্যামিল। 

কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না আসলেও, অপারেশন ভেরহোভেন একদম ব্যর্থ হয়নি। একদণ্ড শান্তির খোঁজে কিংবা বেঁচে থাকার তাগিদে-সব সার্বিয়ান মিলে রাভিচকে খুঁজতে শুরু করে। এই খোঁজ যেন ছেলেখেলায় পরিণত হয়। অজ্ঞাতনামা একজন ৪৫, জাম্বিয়ার রোডের ঠিকানা দেয়। জীবিত উদ্ধারের আশা করেছিল ক্যামিল; হতাশ হতে হলো তাকে। 

সাইরেনের শব্দ শুনে প্রাপ্তবয়স্ক সবাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। কোনো সাক্ষী নেই, কাউকে জেরাও করা যাবে না। কেউ কিছু দেখেনি কিংবা শোনেনি। শুধু বাচ্চারা রইলো। ভয়ের কিছুই নেই, এতে বরং আরো লাভ হলো। প্রাপ্তবয়স্করা ফিরে আসার পর এই বাচ্চারাই সব বলতে পারবে, কী কী ঘটেছে। আপাতত পুরো জায়গা ঘিরে রেখেছে পুলিশ। বাচ্চারা খুবই উত্তেজিত আর কৌতুহলী, হাসছে আর খেলছে। এসবই তাদের খেলারই অংশ। 

অ্যাপার্টমেন্টের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কমিশনার। হাত দুটো এমনভাবে রেখেছে, মনে হচ্ছে প্রার্থনা করছে। ফরেনসিক টিম আসার আগ পর্যন্ত ভেরহোভেন ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেবে না সে। আসলে এই চেষ্টা এখন বৃথা। ইতোমধ্যে অনেক লোকজন চলাফেরা করেছে। ফরেনসিকের লোকজন কমপক্ষে পঞ্চাশজনের আঙুলের ছাপ, চুলসহ আরো অনেক নমুনা পাবে। 

ক্যামিল পৌঁছানোর সাথে সাথে রুমে ঢুকলো কমিশনার। একবার ঘুরেও তাকালো না। সতর্কভাবে পা ফেলছে, কোনো প্রমাণ যাতে নষ্ট না হয়। তাকে অনুসরণ করলো ক্যামিল। পুরো রুমটা নীরবে পর্যবেক্ষণ শুরু করলো দুইজন। কয়েকটা বিষয়ে একদম নিশ্চিত হওয়া গেল। মেয়েটা-মাদকাসক্ত এবং পেশায় বেশ্যা, আগে মারা গেছে। দেয়ালের দিকে মুখ করে উল্টো হয়ে শুয়ে আছে। রাভিচের শরীরে থাকা লেপটা, মেয়েটার নিচ থেকেই হ্যাঁচকা টানে বের করা হয়েছিল। যার ফলে এমন হয়ে আছে মেয়েটার লাশ। ফ্যাকাশে এই লাশটায় ইতোমধ্যে রিগর মর্টিস শুরু হয়ে গিয়েছে। এমন দৃশ্য এর আগে না হলেও, আরো একশ বার দেখেছে উপস্থিত দুইজন। এমন পরিস্থিতিতে হাজারো বেশ্যা মারা যায়। কিন্তু ঘটনাস্থলে আরেকটা লাশ আছে। যা একদমই ভিন্ন গল্প বলছে। 

ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল কমিশনার। রক্তের ছোটখাটো পুকুরের চারপাশ জুড়ে হাঁটতে থাকলো সে। পা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন গোড়ালিটা ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে অল্প একটু ছেড়া চামড়া। ছোট ছোট হাড়ের টুকরো ছড়িয়ে আছে পায়ের কাছে। কুপিয়েছে? নাকি চাকুর আঘাত? চশমাটা চোখে দিয়ে আরেকটু নিচু হলো ক্যামিল। মেঝেতে কিছু একটা খুঁজছে। শেষমেশ বুলেটের ছিদ্র খুঁজে পেল। এরপর গোড়ালির দিকে মনোযোগ দিলো সে। চাকুর আঘাতের চিহ্ন আছে হাড়ে। ছোট কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। সম্ভবত ড্যাগার। আরো নিচু হলো ক্যামিল, অনেকটা ইন্ডিয়ানদের মত যেন শত্রুর আগমনের শব্দ শুনছে। কল্পনায় পুরো ঘটনা সাজানোর চেষ্টা করলো ক্যামিল। প্রথমে গোড়ালি, তারপরে আঙুল। 

হিসাব করা শুরু করলো কমিশনার। মোট পাঁচটা আঙুল কাটা হয়েছে। তবে একেকটা একেক দিকে ছড়ানো। সবগুলো একইভাবে কাটা হয়েছে। রক্তশূন্য হাত বিছানায় পড়ে আছে। চাদরটা কালো রক্তে পরিপূর্ণ। সতর্কভাবে, একটা বলপয়েন্ট কলম দিয়ে হাতটা সরালো কমিশনার, যাতে রাভিচের মুখটা দেখা যায়। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মৃত্যুর আগে কী পরিমাণ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে তার। 

মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যোগ হয়েছে গলার পেছনের দিকে একটা বুলেট। 

“শুরু করো এবার…” বলল কমিশনার। তাকে বেশ উল্লসিত মনে হচ্ছে; 

ভালো কোনো খবরের আশায় আছে সে। 

“আমার যা মনে হয়,” শুরু করলো ক্যামিল, “লোকটা এসেই… 

“এইসব ছেলেভুলানো গল্প আমাকে শোনাতে হবে না, কম্যান্ড্যান্ট। এখানে কী ঘটেছে, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি জানতে চাইছি, তুমি এসব কী শুরু করেছো।” 

*** 

ক্যামিল কী করছে? মনে মনে ভাবলো অ্যানি 

নার্স চলে গেছে। দুজনের মাঝে খুব বেশি বাক্য বিনিময় হয়নি। অ্যানির কিছুটা আক্রমণাত্মক ছিল। তবে ফ্লোরেন্স তা দেখেও না দেখার ভান করেছে। 

“কিছু লাগবে আপনার?” 

না, কিচ্ছু না। মাথা নাড়লো অ্যানি। কিন্তু তার মন পড়ে আছে অন্য কোথাও। আয়নার নিজের বিধ্বস্ত চেহারা দেখেও কিছু করতে পারে না সে। তার অসহায়ত্ববোধ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্স-রে আর এম.আর.আই স্ক্যানের রিপোর্ট হাতে চলে এসেছে। আর এক মুহূর্তও থাকতে চাইছে না সে। হাসপাতালের এই রুম তার মনটা আরো বিষিয়ে তুলছে। 

এখন থেকে পালাতে হবে তার। 

ছোটবেলার দৌড়ে পালানোর কথা মনে করলো সে। ওই শক্তিটা আবার নিজের মাঝে ফিরিয়ে আনতে চাইছে। 

ক্যামিল কী করছে? মনে মনে ভাবলো সে। 

*** 

খুব সতর্কভাবে পা ফেলে বেরিয়ে এলো কমিশনার মিচার্ড। ঢোকার সময় যেখানে যেখানে পা ফেলেছিল, বের হওয়ার সময় ঠিক তাই করলো। ঠিক সেই পথেই ঢুকলো ফরেনসিক টিম। যেন খুব সাজানো গোছানো ব্যালে নৃত্য চলছে। দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালো কমিশনার। এরপর ক্যামিলের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলো, “তো, এখন সব খুলে বলো আমাকে।” 

“জানুয়ারির ওই ডাকাতির ঘটনার যে দল জড়িত, তাদের নেতা ভিনসেন্ট হ্যাফনার। আর রাভিচ ওই দলেরই সক্রিয় এক সদস্য।” আঙুল দিয়ে পেছনে থাকা রুমের দিকে ইশারা করলো ক্যামিল। মাথা নাড়ল কমিশনার। “এটা সবাই জানে, বলতে থাকো।” 

“হুট করে আবারো আলোচনায় আসে ওই দল। গতকাল গ্যালারি মনিয়েরের এক জুয়েলারি দোকানে ডাকাতি করে। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু একটাই সমস্যা। অ্যানি ফরেস্টিয়ে নামে এক ক্রেতা উপস্থিত ছিল সেখানে। ওদের মুখ ছাড়া আর কী দেখেছিল সে, তা আমি জানি না। তবে কিছু একটা তো হয়েছিল। শারীরিক অবস্থা মাথায় রেখে তাকে জেরা করছি আমরা। এখনো পুরো ঘটনা জানতে পারিনি। কিন্তু ব্যাপারটা অনেক গুরুতর, সেটা ঠিকই বোঝা যাচ্ছে। নইলে তো আর ভিক্টিমকে খুন করার জন্য এতো উঠেপড়ে লাগতো না হ্যাফনার। হাসপাতাল পর্যন্ত চলে এসেছিল…হ্যাঁ, জানি, আমি জানি! ওটা যে হ্যাফনার ছিল, এমন কোনো শক্ত প্রমাণ নেই।” 

“ডাকাতির ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে জানতে চেয়েছে জুজ?” 

গ্যালারি মনিয়েরে দেখা হওয়ার পর, তার সাথে আর যোগাযোগ করেনি ক্যামিল। এতোদিনে অনেক কথাই জমে গেছে। তাই সঠিক সময়ের অপেক্ষায় আছে সে। 

“এখনো না,” আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল ক্যামিল, “কিন্তু সবকিছু এতো দ্রুত ঘটে যাচ্ছে, আমি নিশ্চিত যে…” 

“তারপর বলো, এখানকার কাহিনী কী? ডাকাতির ভাগ থেকে রাভিচকে বঞ্চিত করতে এসেছিল হ্যাফনার?” 

“সেটা ঠিক বলতে পারবো না। তবে কোনো না কোনো বিষয়ে, রাভিচের মুখ খোলা দরকার ছিল ওর। হয়তো সম্পদের ব্যাপারে…” 

“এই কেসে একের পর এক প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি, কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন। তবে কোনোটাই তোমার অস্বাভাবিক আচরণের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।” 

হাসি দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলো ক্যামিল; এখন যে কোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত সে। 

“হয়তো একটু বেশিই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম…” 

“উত্তেজিত? একের পর এক নিয়ম ভেঙেছো তুমি। নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় অপারেশনের কথা বলে অনুমতি নিয়েছিলে। আর করলে কী? পুরো শহরে তোলপাড় চালালে। এমনকি এর জন্য ক্ষমা পর্যন্ত চাইলে না।” 

সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে কমিশনার 

“তুমি তো ক্ষমতার অপব্যবহার করেছো।” 

এমন সময় যে আসবে, তা ভালোমতোই জানতো ক্যামিল। কিন্তু এতো দ্রুত আসবে, ভাবতেও পারেনি । 

“আর তোমার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে, এখনো কোনো রিপোর্ট পাইনি আমি। তুমি তো মুক্ত স্বাধীন পাখির মত আচরণ করছো। কারো কাছে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। নিজেকে কী মনে করো, কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন?” 

“আমি তো শুধু নিজের দায়িত্ব পালন করছি।”

“ঠিক কোন দায়িত্বটা পালন করছো শুনি?” 

“রক্ষা আর সেবা করাই তো আমাদের মূল উদ্দেশ্য, তাই না? তাই র- ক্ষা আর সে-বা করছি।” 

মিচার্ডকে গলা টিপে ধরার ইচ্ছা দমন করে, তিন কদম পিছিয়ে এলো ক্যামিল। এখন মাথা গরম করা যাবে না। 

“এই কেসটা আপনি একেবারেই ভুল দিক থেকে দেখছেন,” বলল ক্যামিল। “এটা শুধু আহত হওয়া ওই নারীকে দিয়ে বিবেচনা করলে হবে না। ভয়ংকর এক দলের খোঁজে নেমেছি আমরা। সশস্ত্র এই ডাকাত দল গত জানুয়ারিতে কী করেছে, তা আপনি ভালোমতোই জানেন। এদেরকে মোটেও হালকাভাবেনেয়া যাবে না। দলের নেতা ভিনসেন্ট হ্যাফনার, ঝানু অপরাধী। আর তার সহযোগী সার্বিয়ানরাও দুধে ধোঁয়া তুলসি পাতা না। আমি জানি না কেন, কিন্তু এই কেসের একমাত্র সাক্ষীকে হত্যার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে হ্যাফনার। এটাও জানি, এই কথা আর শুনতে চান না আপনি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ওইদিন শটগান হাতে হাসপাতালে হ্যাফনারই গিয়েছিল। যদি এই সাক্ষীকে কেউ মেরে ফেলে, তাহলে অনেকেরই জবাবদিহি করতে হবে। আর সেই তালিকার প্রথমে আপনিই থাকবেন!” 

“ঠিক আছে, তোমার মতে কেসের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই নারী। তার জীবনের হুমকি আছে। এখন পর্যন্ত যার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণও দিতে পারোনি, কম্যান্ড্যান্ট। ভিত্তিহীন এক বিশ্বাস নিয়ে তুমি বেলগ্রেড থেকে সারায়েভোতে জন্ম নেয়া সকল লোককে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে। মাথা ঠিক আছে তোমার?”  

“সারাজেভো তো বসনিয়ায়, সার্বিয়ায় না।”

“কী বললে?” 

চোখ বন্ধ করলো ক্যামিল। 

“ঠিক আছে,” স্বীকার করলো সে, “আমি নিয়মের বাইরে কাজ করেছি। একটা রিপোর্ট লেখা উচিত ছিল, আমার…” 

“থাক, এসব বলে আর লাভ নেই, কম্যান্ড্যান্ট।” 

ভ্রূ কুঁচকে গেল ক্যামিলের। কমিশনার চাইলে এখন কী করতে পাওে, তা সে ভালোমতোই জানে। রাভিচের লাশের দিকে ইশারা করলো কমিশনার। 

“তোমার মস্তিষ্কপ্রসূত এই অপারেশনের মাধ্যমে রাভিচকে তো ঠিকই বের করেছো, কম্যান্ড্যান্ট। সত্যি বলতে, খুনির জন্য কাজটা আরো সহজ করে দিয়েছো।”

“এমনটা আপনি নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন না। আপনার এই বক্তব্য প্রমাণের মত কিছুই নেই।” 

“তা হয়তো নেই, কিন্তু ভুল কিছু তো বলিনি। আর বিশেষ এক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এই অপ্রত্যাশিত অভিযান, তাও আবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের না জানিয়ে। নিজ ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা নাই বা বললাম। কোনো নাম আছে নাকি এই অপারেশনের, কম্যান্ড্যান্ট?” 

এমন প্রশ্ন কল্পনায়ও আশা করেনি ক্যামিল। ফ্যাকাশে হয়ে গেল তার মুখ। 

“জাতিগত শুদ্ধিসাধন।” 

এই বলেই চোখ বন্ধ করে ফেলল ক্যামিল। পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। 

*** 

কী করছে ক্যামিল? সামনের ট্রেতে থাকা খাবার স্পর্শও করলো না অ্যানি। রুমে উপস্থিত বয়স্ক নার্স একটু দূরে সরিয়ে রাখলো ট্রে। “তোমার তো খেতে হবে, মা, এভাবে খাবার নষ্ট করা ঠিক না।” সহানুভূতি জানানো সবার প্রতি, হুট করেই তীব্র ক্রোধ অনুভব করলো অ্যানি। 

সকাল বেলা আরেক নার্স বলে গিয়েছে, “একটু ধৈর্য ধরুন, সব ঠিক হয়ে যাবে…” 

সাথে সাথে তুড়ি মেরে জবাব দিয়েছে অ্যানি, “হ্যাঁ, সবকিছু একদম পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি!” 

অ্যানির প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে চেয়েছিল নার্স। এমন অবস্থায় বেশিরভাগ মানুষ এটাই আশা করে। আরো কিছু বলার চেষ্টা করলেও, কোনো জবাব দিলো না অ্যানি। 

“খুব নির্দয়ভাবে মেরেছে আপনাকে, তাই তো? লাথি, ঘুসিও মেরেছে, এমনকি হত্যারও চেষ্টা করেছে? কিন্তু সবসময় কি এমন হয়? হয় কি? কথা বলুন, আমি নিশ্চিত মন খুলে কথা…” 

কোনো জবাব না পেয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল ফ্লোরেন্স। সাথে সাথে তাকে ডাক দেয় অ্যানি। পানিতে টলমল করছে তার চোখ। 

“আমি দুঃখিত,” বলল সে। 

হাত নাড়লো নার্স। যেন বলতে চাইছে এসব কোনো ব্যাপার না। এসব কথা শুনে অভ্যস্ত তারা। 

*** 

“এই কেসটা তুমিই চেয়েছিল। এক ইনফর্মারের কথা বলেছিলে, যার অস্তিত্ব সম্পর্কে, যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার। তাই একটা কথা স্পষ্ট করে বলো, ডাকাতির খবর তোমার কাছে কীভাবে এলো?” 

“গোরিনের কাছ থেকে।” 

হুট করেই নামটা বলে ফেলল ক্যামিল। তার মাথায় প্রথম এই নামই এসেছে। অনেক চিন্তাভাবনা করেও কোনো কারন খুঁজে পেল না। তাই ঈশ্বরের উপর ভরসা রেখে এই পথ বেছে নিলো। কিন্তু ইশ্বরের উপর ভরসা অনেকটা হোমিওপ্যাথির মত, যদি বিশ্বাস না থাকে… তাহলে এর চেয়ে বড় বোকামি আর হয় না। এখন গোরিনকে কল করতে হবে। কিন্তু বলির পাঁঠা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে, কোনো সাহায্যই সে করবে না। কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত কমিশনার। 

“আর গোরিন কীভাবে জানলো?” 

কথা শেষ হয়নি তার। 

“মানে বলতে চাইছি, এতো লোক থাকতে, তোমাকেই কেন জানালো?” 

পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা বেশ ভালোমতোই বুঝতে পারছে ভেরহোভেন। কিন্তু নাচতে যেহেতু নেমেই গেছে, এখন আর ঘোমটা দিলে চলবে না। শুরু থেকেই এই কাজ করতে হচ্ছে তার। 

“সেটা তো আমি জানি না…” 

মাথা কাজ করছে না ক্যামিলের। ব্যাপারটায় বেশ কৌতুহলী মনে হচ্ছে কমিশনারকে। এই কেস থেকে ক্যামিলকে সরানো হতে পারে। কিংবা এরচেয়ে খারাপ কিছু। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। 

নিজের প্রকাণ্ড পশ্চাৎদেশ দুলিয়ে হাঁটতে শুরু করলো কমিশনার। এদিকে চিন্তায় মশগুল ক্যামিল। 

তবে কমিশনারের সাথে কিছু বিষয়ে একমত সে : অপারশনের কারণেই রাভিচকে খুঁজে পেয়েছে খুনি। এই সম্ভাবনা একেবারে বাদ দেয়া যায় না। কিন্তু এছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না। গ্যালারি মনিয়েরের ঘটনার পর নিজের সহযোগী আর সাক্ষী, সবাইকে দুনিয়া থেকে বিদায় করার চেষ্টায় আছে হ্যাফনার। তাই দ্রুত কিছু করা দরকার ছিল। রাভিচ, অ্যানি, হয়তো অন্যান্য সহযোগীও… 

তবে যাই হোক, হ্যাফনারই এই কেসের মূল চাবিকাঠি। 

আই.জি.এস., কমিশনার, তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট-সময়মত সবার সাথেই কথা বলবো ক্যামিল। আপাতত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো অ্যানিকে রক্ষা করা। 

ড্রাইভিং স্কুলের এক শিক্ষকের কথা মনে পড়লো ক্যামিলের : যখনই তুমি কোনো মোড় এড়িয়ে যাবে, তখন তোমার সামনে দুইটা পথ খোলা থাকবে। তখন ব্রেক করাটা বোকামী হবে। সেক্ষেত্রে রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আপাতদৃষ্টিতে পাগলামী মনে হলেও, সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হচ্ছে, গতি আরো বাড়িয়ে দেয়া। কিন্তু তার জন্য নিজের সাথেই লড়াই করতে হবে, কেন না তোমার ভেতর থেকে আওয়াজ আসবে গাড়ি থামানোর জন্য। 

তাই গতি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলো ক্যামিল। 

এই বিপজ্জনক মোড় থেকে মুক্তি পাওয়ার একটাই পথ খোলা। তবে মাত্রাতিরিক্ত গতি খাদেও ফেলতে পারে। আপাতত, এই চিন্তা দূরে সরিয়ে রাখলো। 

তাছাড়া, খুব বেশি পথও খোলা নেই তার সামনে। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *