1 of 2

তৃতীয়, রাকেশ

তৃতীয়, রাকেশ

প্রথম খুনটা শুনতে পেল রাকেশ, স্বচক্ষে দেখল দ্বিতীয়টা, এবং তৃতীয়টা আর-একটু হলে নিজেই হয়েছিল।

দিনটা ছিল শনিবার। অফিস ছুটি হয়ে গেছে দুটোর সময়। বাড়িতে ফিরে অফিসেরই কিছু হিসেবনিকেশের কাজ করছিল রাকেশ। সঙ্গী কেবল ওপরের ফ্ল্যাটের পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলেটা—বাম্বি। ওর মা, ললিতা, বাম্বিকে রাকেশের কাছে রেখে একটু কেনাকাটায় বেরিয়েছে। সুতরাং আজকের শনিবারটা গত বেশ কয়েকটা শনিবারের মতোই।

বাম্বি একটা বিস্কুট হাতে চোখ গোল-গোল করে টিভি দেখছিল। ভিলেনকে লক্ষ্য করে নায়কের গুলি চালানোর একঘেয়ে শব্দ রাকেশেরও কানে আসছিল। ছেলেটা মায়ের সঙ্গে সিনেমা দেখে-দেখে হিন্দি ছবির পোকা হয়ে গেছে। জানলার পাশে টেবিলে কাজে ব্যস্ত থাকলেও টেলিভিশনের পরদায় বাম্বির চোখজোড়া যে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেঁটে আছে সেটা রাকেশের নজর এড়ায়নি।

আচমকা একটা গুলির শব্দে রাকেশের হিসেবি চিন্তা ঝটকা খেল। শব্দটা টিভির গুলির আওয়াজের তুলনায় অনেক বেশি জোরালো। সুতরাং রাকেশের কৌতূহলী চোখ তিনতলার জানলা দিয়ে নজর মেলে দিল নীচের অশোকা রোডে। রাস্তার ওপারেই বিলানি টেক্সটাইলস—এ-অঞ্চলের অভিজাত শাড়ির দোকান। একটা লোক উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেরিয়ে এল সেই দোকান থেকে। লোকটার ডানহাতে একটা খোলা রিভলভার। ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে কয়েক মুহূর্ত ফুটপাথে দাঁড়িয়ে রইল লোকটা। কিন্তু তারপরই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হল।

সারা রাস্তা জুড়ে তখন হইচই। সকলে দিশেহারা হয়ে ছুটছে। কেউ-কেউ বাড়ির দরজা লক্ষ করে, কেউ বা রাস্তায় পার্ক করা গাড়ির পিছনে লুকোনোর আশায়। পার্লামেন্ট স্ট্রিট থেকে অশোকা রোডে মোড় নেওয়া একজন পুলিশ সার্জেন্টকে কে যেন চেঁচিয়ে ডাকল। সার্জেন্ট তক্ষুনি ছুটে এলেন লোকটার দিকে—ছুটন্ত অবস্থাতেই কোমরের হোলস্টার থেকে রিভলভার বের করার চেষ্টা করতে লাগলেন। লোকটা পিস্তল উঁচিয়ে ধরল। গুলি করল: পরপর তিনবার। দু-পাশের দেওয়ালে সাড়া তুলে ভয়ঙ্কর তিনটি শব্দের প্রতিধ্বনি ক্রমে মিলিয়ে গেল। বার-দুয়েক হোঁচট খেয়ে ফুটপাতের ওপরেই মুখ থুবড়ে পড়লেন অফিসার। তাঁর ছড়িয়ে থাকা হাত-পায়ের ভঙ্গি যেন নিঃশব্দ চিৎকারে বলছে, আমরা আর বেঁচে নেই।

লোকটা আর সময় নষ্ট করল না। রাস্তা পার হয়ে ছুটে এল রাকেশদের ফ্ল্যাটবাড়ি লক্ষ্য করে। রাকেশের জানলার ঠিক নীচে ফুটপাথের ওপরে ঘুরে দাঁড়াল। বিপরীতদিক নিশানা করে আরও দুবার গুলি করল। তারপর ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতরে।

ঘটনাটা এতই আকস্মিক, অবিশ্বাস্য ও ভয়ঙ্কর যে, সেটাকে কাল্পনিক দৃশ্য বলে ভাবতে ভালো লাগে। অতএব রাকেশ বরফের মূর্তির মতো স্থিরভাবে চেয়ারে বসে রইল, ওর অপলক চোখ তখনও রাস্তার দিকে।

কিন্তু দৃশ্যপট থেকে লোকটা অদৃশ্য হওয়ামাত্রই বাস্তবের গুরুত্ব বুঝতে পারল রাকেশ। না, গুলির শব্দগুলো মোটেই কাল্পনিক নয়। ফুটপাথে পড়ে থাকা অফিসারের মৃতদেহটাকেও কেউ মরীচিকা বলবে না। এবং সবচেয়ে বড় কথা, রিভলভার হাতে লোকটা এখন রয়েছে এই বাড়িতেই। সামনেই রাকেশের ঘরের দরজা প্রায় হাট করে খোলা। যেন সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা কাউকে সহাস্যে বলছে, ‘সুস্বাগতম’।

রাকেশ চকিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বাম্বিকে পাশ কাটিয়ে তিরবেগে ছুটে চলল দরজা লক্ষ্য করে, কিন্তু লোকটার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসার গতিবেগ বোধহয় আরও বেশি ছিল—কারণ, রাকেশ দরজার দূরত্বের অর্ধেক পেরোনোর আগেই দেখল, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে হাতে সেই রিভলভার।

কয়েক মুহূর্ত অপলক চোখাচোখির পর লোকটা ঘরের ভেতর পা রাখল। সশব্দে বন্ধ করে দিল দরজাটা। ভেতর থেকে ছিটকিনি এঁটে দিল। তারপর ব্যস্ত দৃষ্টিতে চট করে ঘরটা দেখে নিল।

—আপনি আর বাচ্চাটা ছাড়া ঘরে আর কে আছে?

ব্যাপারটা কী বলুন তো?—বিরক্তির সুরে জানতে চাইল রাকেশ।

বিশাল অটোমেটিকটা অধৈর্যভাবে নড়ে উঠল।

—কথা কম বলুন স্যার। আমার হাতে ন্যাকামো করার টাইম নেই! ঘরে আর কে-কে আছে?

রাকেশ আড়চোখে দেখল পাঁচবছরের বাম্বির দিকে। ওর বিস্ফারিত চোখ টিভির পরদা ছেড়ে এখন আগন্তুকের দিকে। হাতের বিস্কুট কখন যেন মেঝেতে পড়ে গেছে।

না—আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। উত্তর দিল রাকেশ।

লোকটা ওকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। শোওয়ার ঘর, রান্নাঘর এবং বাথরুমে নিজে চোখ বুলিয়ে তারপর নিশ্চিন্ত হল। এবার খুব সাবধানে এগিয়ে গেল খোলা জানলার দিকে, পরদার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে উঁকি মারল।

—শালা, লাকটাই আজ খারাপ…।—বিড়বিড় করে সে মন্তব্য করল। রাস্তার দুদিক থেকে তখন পুলিশের গাড়ি ছুটে আসছে। শোনা যাচ্ছে ছুটন্ত পায়ের শব্দ, ব্যস্ত চিৎকার।

হাতে কার যেন ছোঁওয়া পেল রাকেশ। চোখ নামিয়ে দেখল, বাম্বি। ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।

—এই লোকটা কে, চাচু?

লোকটা চোখ ফিরিয়ে তাকাল ছেলেটার দিকে।

—তোমার চাচাজির দোস্ত, বাচ্চু। এখন লক্ষ্মীছেলের মতো চুপটি করে থাকো দেখি।

—ওই পুলিশ অফিসারকে আপনি গুলি করেছেন—আমি নিজের চোখে দেখেছি। বলল রাকেশ। তারপর ছোট্ট করে প্রশ্ন করল, কেন?

—প্রথমে কাপড়ের দোকানের উজবুক ক্যাশিয়ারটাকে গুলি করেছি। শালা ঘণ্টি টিপতে যাচ্ছিল। এত দরদ, যেন ক্যাশের টাকাটা ওর বাপের!—জানলা ছেড়ে রাকেশের দিকে এগিয়ে এল লোকটা। তীক্ষ্ন চোখে রাকেশকে জরিপ করতে চাইল: আর পুলিশটার কথা বলছেন? ওকে না মারলে ওর জায়গায় এতক্ষণে আমি পড়ে থাকতাম।

—রাস্তার লোকরা আপনাকে এ-বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এখানে আসবে।

লোকটা এগিয়ে গেল জানলার দিকে। উঁকি মারল রাস্তায়।

—এর মধ্যেই শুয়োরের বাচ্চারা রাস্তা ছেয়ে ফেলেছে।—ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। রিভলভার ধরা অবস্থাতেই এগিয়ে এল বাম্বির কাছে। হাঁটুগেড়ে বসল।

—তোমার নাম কী, খোকা?

ছেলেটা জিজ্ঞাসার চোখে রাকেশের দিকে একবার দেখল, তারপর বলল, বাম্বি।

লোকটা ওর হাত ধরল, টেনে নিয়ে গেল জানলা থেকে দূরে একটা চেয়ারের কাছে। নিজে চেয়ারটায় বসল। তারপর বাম্বির দিকে দু-হাত বাড়িয়ে বলল, এসো, বাম্বি, আমার কোলে এসো। লক্ষ্মীছেলে।

ওদের দিকে এক-পা এগিয়ে গেল রাকেশ।

—বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিন! ওকে কিছু করবেন না!—আশা নিয়ে সামনের দিকে হাত বাড়াল রাকেশ।

রিভলভারের নলটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঁচু হল। লোকটা একচোখে তাকাল রাকেশের ভয়ার্ত মুখ লক্ষ্য করে।

—লোকের মুখ থেকে ‘না’ শুনতে আমি একদম ভালোবাসি না। ‘না’ বলে রাস্তার মালগুলোর কী হাল হল দেখলেন তো! বলা যায় না, আপনারও একই হাল হতে পারে।

—দেখুন, বাচ্চাটাকে ওর মা আমার কাছে রেখে একটু দোকানে গেছে। ও এ-ফ্ল্যাটেই থাকে না।

—আপনিই তো বললেন, পুলিশ জানে, আমি এ-বাড়িতে আছি। তা হলে এ-ফ্ল্যাটে আসতে ওদের বেশি দেরি হবে না।—রিভলভারের নলটা রাকেশের দিক থেকে ঘুরে গেল, হালকাভাবে স্থির হল বাম্বির রগে।—তাই আমার কথা ওদের মানতেই হবে। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’-‘না’-র কোনও কেস নেই।

এই প্রথম দাঁত বের করে হিংস্রভাবে হাসল আগন্তুক।

বাম্বির জীবনে রাকেশ শেষাদ্রি ঢুকে পড়েছে বছর-দেড়েক। আর বাম্বির মা, ললিতা চারির জীবনে মাস-ছয়েক। বছর-দুয়েক আগে প্লেন দুর্ঘটনায় মারা যান অম্বিকানাথ চারি—বাম্বির বাবা। না, তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করতে রাকেশ তখন এগিয়ে আসেনি। বাম্বির বয়স তখন ছিল মাত্র তিন। তা ছাড়া, ব্যাবসার কারণে অম্বিকানাথ বেশিরভাগ সময়েই ঘরছাড়া থাকতেন। সুতরাং শূন্যস্থান টের পাওয়ার মতো বয়েস বা সুযোগ বাম্বির হয়নি।

দেড়বছর আগে প্রথম ললিতা চারি ছেলেকে রাকেশের দায়িত্বে দিয়ে যায়। বলতে গেলে সেদিন থেকেই বাম্বি এবং রাকেশ ভালোবাসার টানে জড়িয়ে গেছে। ফ্ল্যাটবাড়িতে আরও অনেকে ছিল যারা বাম্বিকে রাখতে রাজি হত, কিন্তু ললিতা বুঝেছিল বাম্বির একজন পুরুষের সান্নিধ্য দরকার। এর পরের সপ্তাহ-মাস-বছরগুলো নীরব ভালোবাসার স্বপ্নঘেরা ইতিহাস। রাকেশের দৌলতে চিড়িয়াখানা, বিড়লা মন্দির, কুতবমিনার, হায়াৎ বক্স গার্ডেন, সব বাম্বির দেখা হয়ে গেছে। এক-একসময় ললিতাও ওদের সঙ্গী হয়েছে।

মাস-ছয়েক আগের একটা ঘটনা রাকেশের মনে হঠাৎই জায়গা করে নিয়েছে।

সেদিনটাও ছিল শনিবার। দশেরার আগেই উৎসবের কেনাকাটা সেরে বাম্বিকে নিতে এসেছিল ললিতা। নানান বাক্সে ওর দু-হাত জোড়া। ফরসা মুখে সূর্যের তাপ লালচে আভা তৈরি করেছে। সাদা শিফনের শাড়িতে প্রশান্তি। কপালে এলিয়ে পড়া একগুচ্ছ কালো চুলে কোমল আকর্ষণ। সেই মুহূর্তেই সর্বনাশ হল রাকেশের। ও ভালোবেসে ফেলল ললিতাকে। নিরুচ্চার এই ভালোবাসাকে মনে-মনে মেনে নিল রাকেশ শেষাদ্রি। আর তারপর থেকেই বাম্বিকে আরও বেশি করে ও ভালোবাসতে শুরু করেছে।

বাম্বি যে ওর কত বড় দায়িত্ব, সেটা এই মুহূর্তে, এখন, উপলব্ধি করল রকেশ। পিস্তলের নলটা ওর ছোট্ট মাথা স্পর্শ করামাত্রই রাকেশের হৃৎপিণ্ডের টাল-মাটাল দৌড় শুরু হয়ে গেছে। তিরিশ বছরের জীবনে শুধুমাত্র নিজের কাছে ছাড়া আর কারও কাছে রাকেশকে দায়িত্ববোধে অবহেলা করার জন্য জবাবদিহি করতে হয়নি। কিন্তু এখন, বন্দুকধারীর শেষ শব্দগুলো প্রতিধ্বনি তুলতেই ও বুঝল, এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির জন্য ও নিজেই দায়ী।

বাম্বির বাবা বেঁচে থাকলে এ ক্ষেত্রে কী করতেন? স্বাভাবিক বিবেচনা অনুযায়ী, রাস্তার ঘটনা দেখামাত্রই তিনি ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতেন। অথবা রিভলভার হাতে লোকটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঘটনার চূড়ান্ত মোকাবিলা করতেন।

সেই স্বাভাবিক বিবেচনা রাকেশ দেখাতে পারেনি। এবং ওর কোনও রিভলভারও নেই—কোনওদিন ছিলও না। রিভলভার সম্পর্কে ও একেবারেই অনভিজ্ঞ।

দরজায় ধাক্কা দেওয়ার প্রচণ্ড শব্দে রাকেশ চমকে উঠল।

—দরজা খুলুন! পুলিশ!

রাকেশ হতবুদ্ধি চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল। সে কী করে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। রাকেশ দেখল, লোকটার চোখে বিন্দুমাত্রও ভয়ের ছোঁয়া নেই—অন্তত এখনও।

দরজায় আবার ধাক্কা পড়ল: ভেতরে কে আছেন? দরজা খুলুন!

কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপর প্রচণ্ড আঘাতে শৌখিন দরজা থরথর করে কেঁপে উঠল। ওরা দরজা ভাঙতে চেষ্টা করছে।

রাকেশ চটপট কেশে গলা পরিষ্কার করল। চেঁচিয়ে বলল, আপনারা—আপনারা ভেতরে আসবেন না।—নিজের বিকৃত ভাঙা স্বরে ও নিজেই অবাক হল।

—মিস্টার শেষাদ্রি? আমি গুপ্তা বলছি।—হর্মেশ গুপ্তা রাকেশের নীচের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। তিনি বললেন, বাইরের রাস্তায় একটু আগে ভীষণ গোলমাল হয়েছে। দুজন খুন হয়েছে। পুলিশ বলছে, খুনি নাকি আমাদের বাড়িতেই ঢুকেছে। ওরা গোটা বাড়িটাকে ঘিরে ফেলেছে। আর এখন প্রত্যেকটা ফ্ল্যাট সার্চ করে দেখছে।

প্রথম লোকটির গলা দরজার ও-পিঠ থেকে ভেসে এল আবার, তাড়াতাড়ি খুলুন, মশাই! আমাদের হাতে সময় নেই!

আমি—আপনারা ভেতরে আসতে পারবেন না। লোকটা এখানে রয়েছে। যাকে আপনারা খুঁজছেন। ওর হাতে রিভলভার। আর একটা বাচ্চা ছেলে রয়েছে আমার ঘরে।—রাকেশের গলা কেমন শুকিয়ে গেল।

বাইরে থেকে কিছু গুঞ্জন শোনা গেল। অবশেষে, সবার গলা ছাপিয়ে ভেসে এল এক নারীকণ্ঠ, রাকেশজি, বাম্বির কিছু হয়নি তো?

ললিতা চারি।

রাকেশ যেন স্পষ্ট দেখতে পেল ললিতার নরম মুখ, দেখতে পেল ওর গভীর দু-চোখে আতঙ্কের বিদ্যুৎ।

না, বাম্বি ঠিক আছে, ললিতা।—ও চেঁচিয়ে বলল।

আমাকে ভেতরে আসতে দিন! আমি ওর কাছে থাকব! প্লিজ…।

কেউ একজন বলল, আপনি নীচে যান, মিসেস চারি। ইন্সপেক্টর, আপনি এঁকে একটু নীচে পৌঁছে দিন।

না! রাকেশজি দরজা খুলুন! বাম্বিকে আমি দেখব। ওঃ ভগবান, আমার ছেলের যেন কিছু না হয়।—ললিতার স্বরে কান্না ক্রমশ জায়গা করে নিচ্ছে।

হঠাৎ বন্দুক হাতে লোকটাকে আমল না দিয়েই রাকেশ বলে উঠল, কোনও ভয় নেই, ললিতা। বাম্বির কিচ্ছু হবে না—আমি তো আছি।

শব্দগুলো উচ্চারণ করার সময় রাকেশের মনে হল ওর কথাগুলো কী ফাঁপা। বন্দুকধারীর চোখে বিদ্রুপের চকিত ঝিলিকও ওর নজরে পড়ল।

বাইরের বারান্দায় লোকজনের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন এবং জনতার চিৎকার ছাপিয়ে ঘরের ভেতরে রাকেশের স্পষ্ট কানে আসছে টিভির কথাবার্তা—সঙ্গে নিজের হৃৎপিণ্ডের হাতুড়িপেটা ঢিপঢিপ শব্দ!

ঠিক আছে। বলো তোমার কী চাই?—একজন পুলিশ চেঁচিয়ে প্রশ্ন করল।

উত্তরে খেঁকিয়ে উঠল লোকটা, পালাতে চাই। আমার সঙ্গে কোনওরকম চালবাজি করতে গেলে এই লোকটা আর এই বাচ্চাটাকে খতম করে দেব! আমাকে একটা গুলিভরা পিস্তল দাও, আর একটা গাড়ির ব্যবস্থা করো। গাড়িটা বাড়ির দরজায় দাঁড় করিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে বলো। আমি, এ-বাচ্চাটা, আর এই লোকটা—আমরা একসঙ্গে গাড়িতে উঠব!

পরিণতিটা এতক্ষণে স্পষ্ট হল রাকেশের কাছে। এইরকম বিপজ্জনক পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। পুলিশ এই খুনিকে কখনওই ছেড়ে দেবে না—দিতে পারে না।

ললিতা ওর স্বামীকে হারিয়েছে। রাকেশ ওকে কথা দিয়েছে ওর ছেলের কোনও ক্ষতি হবে না। তা হলে এখন কী হবে?

বাইরে থেকে সেই পরিচিত স্বর আবার শোনা গেল, তোমার শর্তে রাজি হওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। পুলিশ কমিশনারের পারমিশান না নিয়ে কিছু করা সম্ভব নয়। তাতে সময় লাগবে।

—তোমাকে পাঁচমিনিট সময় দিলাম, অফিসার। পাঁচমিনিটের মধ্যে আমরা রওনা হচ্ছি—নীচের দিকেই হোক আর ওপরদিকেই হোক!—লোকটা দাঁত বের করে হাসল।

রাকেশ লক্ষ করল, ও শূন্য দৃষ্টিতে টেলিভিশন-পরদার দিকে তাকিয়ে আছে।

লোকটার হাতে বন্দুক যদি নাও থাকত, রাকেশ তার সঙ্গে শক্তিতে পেরে উঠত না। কারণ, লোকটা রাকেশের তুলনায় অনেক বেশি লম্বা-চওড়া। সুতরাং ওর ললিতাকে দেওয়া কথা নিছক কথা ছাড়া আর কিছু নয়।

একমিনিট গড়িয়ে গেল। দু-মিনিট। ছোট্ট পরদায় অজেয় নায়ক পরপর গুলি ছুঁড়ে চলেছে! গুন্ডাদলের একজন বুকে গুলি খেয়ে বারান্দা থেকে ছিটকে পড়ল নীচে। বুক খামচে ধরা আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। রাকেশ অবাক হয়ে ভাবল, গুলি খেতে কীরকম লাগে? সত্যি, বড় জানতে ইচ্ছে করছে…।

বন্দুকের অবিরাম শব্দ টেলিভিশনের পরদায় ফেটে পড়তে লাগল।

বুদ্ধিটা রাকেশের মাথায় তখনই ঝলসে উঠল। যেন মুখোমুখি সংঘর্ষের একটা প্রচণ্ড ধাক্কা ওকে সঠিক পথে নিয়ে এল। রাকেশের চোখ গেল একটু দূরে চেয়ারে টান-টান হয়ে বসে থাকা উৎকণ্ঠিত আগন্তুকের দিকে। বাম্বি চুপচাপ তার কোলে বসে হয়তো ভাবছে, এটা একরকম খেলা এবং সেই কারণেই এতটা নিশ্চিন্ত রয়েছে।

নাঃ, প্রচণ্ড ঝুঁকি থাকলেও কাজটা অসম্ভব নয়, ভাবল রাকেশ। একেবারে অসম্ভব নয়।

ও মনে-মনে হিসেব করতে শুরু করল।

বিলানি টেক্সাটাইলস-এ একজন পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে তিনটে, আর সবশেষে রাস্তার এপারে এসে দুটো। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটেছে যে, তখন কোনও সময় পাওয়া সম্ভব নয়। আর ফ্ল্যাটে ঢোকার পর লোকটা একবারও রাকেশের নজরের আড়ালে যায়নি।

কিন্তু রাকেশের ভুল হলে চলবে না। ও আবার হিসেব করল। না, ভুল ওর হয়নি। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁটজোড়া চেটে নিয়ে ও লম্বা শ্বাস নিল।

তিনমিনিট হয়ে গেল! লোকটা বাইরের পুলিশ অফিসারকে উদ্দেশ করে চেঁচিয়ে উঠল, আর দু-মিনিট বাকি, অফিসার!

রাকেশ তার দিকে এক-পা এগিয়ে গেল, বলল, আপনার ভুল হচ্ছে।

ও শুনতে পেল ওর গলার স্বর কী অদ্ভুত শান্ত, মসৃণ।

রাকেশ বলল, তোমার সময় শেষ হয়ে গেছে।

লোকটার চোখের পাতা নড়ে উঠল।

—তার মানে?

রাকেশ আরও এক-পা এগিয়ে গেল।

—তার মানে, সময় শেষ হয়ে গেছে। এবার আমার একদিন কি তোমার একদিন।

—সাবধান, রাকেশবাবু।—দরজার ওপার থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন অফিসার, নিজে থেকে কিছু করতে যাবেন না—।

—তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?—অচঞ্চল হাতে বন্দুকের নলটা বাম্বির মাথা থেকে সরিয়ে রাকেশের মুখোমুখি ধরল লোকটা। তীক্ষ্ন কণ্ঠে খেঁকিয়ে উঠল, যা, শিগগির ফিরে যা নিজের জায়গায়!

রাকেশ কোনও উত্তর দিল না—ও আরও এক-পা এগিয়ে গেল। রিভলভারটা ক্রমশ ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল, হাঁটু দুটো যেন হঠাৎই রবারের তৈরি বলে মনে হল। যদি আমার ভুল হয়ে থাকে…ভাবল রাকেশ যদি…রাকেশ মাথা নাড়ল। এখন আর ফিরে যাওয়ার সময় নেই। খেলা খতম ওকে করতেই হবে।

—তোকে শেষবারের মতো বলছি, গান্ডু, এখনও ফিরে যা—।

লোকটার চোখে একটা নতুন ছায়া সেই মুহূর্তে রাকেশের নজরে পড়ল। ছায়াটা ও সহজেই চিনতে পারল, কারণ এতক্ষণ এই ছায়া চোখে নিয়েই ও দাঁড়িয়ে ছিল: অন্ধ আতঙ্কের ছায়া।

একরাশ নিরাকার তেজ যেন রাকেশের শরীরে কেউ ঢুকিয়ে দিল। হাঁটুজোড়া ফিরে এল আগের সুস্থ অবস্থায়। এই মুহূর্তে রাকেশ শেষাদ্রি যেন অপরাজেয় হয়ে উঠেছে। ও জানে, ভুল ওর হয়নি।

এইবার! বলে প্রাচীন যোদ্ধাদের মতো এক বিকৃত চিৎকার করে রাকেশ বন্দুকবাজকে লক্ষ্য করে ছুটে চলল।

বারো ফুট দূরত্বের ফুট পাঁচেক পেরিয়েই এক প্রচণ্ড লাফ দিল রাকেশ। এখন আর ভুল হলে চলবে না, এবং ভুল যে ওর হয়নি সেটা লোকটার ভয়ের দৃষ্টিতেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

একটা বিকট শব্দ, মালগাড়ির সঙ্গে তীব্র সংঘাতের অনুভূতি, একমুহূর্তের বুক-ভরা জ্বলন্ত যন্ত্রণা এবং অবশেষে অন্ধকার।

—এতক্ষণে ভদ্রলোকের জ্ঞান ফিরে এসেছে, ইন্সপেক্টর।—কেউ একজন বলল।

রাকেশ শেষাদ্রি চোখ খুলল। ওর মনে হল, ও যেন ভুলে যাওয়া, সুদীর্ঘ, ক্লান্তিকর এক ভ্রমণ শেষে ফিরে আসছে। তারপর ওর মনে পড়ল বাম্বির কথা।

—বাম্বি—বাম্বি কোথায়?

—ওর জন্যে চিন্তা করবেন না। ও ভালো আছে।

তিনটে মুখ ভেসে বেড়াচ্ছে রাকেশের চোখের সামনে, শূন্যে। সাদা পোশাক পরা একজন বয়স্ক লোক, তার পাশে সাদা পোশাক পরা একটি মেয়ে—ললিতা নয়। তৃতীয় ব্যক্তির মুখে অভিজ্ঞতা এবং প্রতিজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু চোখে-মুখে, পোশাকে, কেমন একটা ক্লান্তির ছায়া।

—আমি ইন্সপেক্টর চিরিমার।—তৃতীয় ব্যক্তি বললেন, আপনি যখন লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন তখন বাইরের বারান্দায় আমিও ছিলাম। আপনি বড় বোকার মতো কাজ করেছেন, মিস্টার শেষাদ্রি। তবে আপনার সাহসের প্রশংসা করতে হয়।

—সেইসঙ্গে ভাগ্যেরও প্রশংসা করুন।—সাদা পোশাক পরা প্রৌঢ় হাসিমুখে মন্তব্য করলেন। সম্ভবত তিনিই ডাক্তার।—ডানদিকে আর ইঞ্চিখানেক গেলেই আমরা এতক্ষণে আপনার শ্রাদ্ধশান্তির তারিখ নিয়ে আলোচনা করতাম।

—লোকটা এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে, গুলিটা সোজাসুজি করতে পারেনি।—ইন্সপেক্টর বললেন।

—কিন্তু আমি ভালো করে গুনে দেখেছি।—রাকেশ বলল, এক-এক করে হিসেব করেছি…। তা হলে হয়তো আমার হিসেবে ভুল হয়ে থাকবে।

—কীসের হিসেব?

—গুলির। আমি গুনে-গুনে দেখেছি, লোকটা ছ’বার গুলি করেছে।—জানি না, আমাকে ফাঁকি দিয়ে লোকটা আবার কখন গুলি ভরল—।

—দাঁড়ান, একমিনিট!—মাথার টাকে ধীরে-ধীরে হাত বোলালেন অফিসার। তারপর অবাক সুরে বললেন, তা হলে লোকটার বন্দুক খালি ভেবেই আপনি ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন?

রাকেশ সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল। যন্ত্রণার ছুরির তীক্ষ্নতা বাহু আর কাঁধে টের পেল।—হ্যাঁ, আমি ভেবেছিলাম ওর ছ’বার গুলি করা হয়ে গেছে। সেইজন্যেই—।

অফিসার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

—হিন্দি ছবি দেখে-দেখে আপনার মাথাটা গেছে। না, গুনতে আপনার ভুল হয়নি। মুশকিলটা হল, আমাদের শ্রীমানের হাতে ছ’ঘরা রিভলভার ছিল না, ছিল একটা অটোমেটিক। এর এক-একটা ক্লিপে সাতটা করে গুলি থাকে। ওই শেষ গুলিটাই আর-একটু হলে আপনাকে শেষ করে দিয়েছিল। গুলির শব্দ পেয়েই আমরা দরজা ভেঙে ফেলি। আমরা ভেবেছিলাম লোকটা হয়তো বাচ্চাটাকে গুলি করেছে।

সাতটা গুলি…কিন্তু তবুও, ভাবল রাকেশ, যদি ও নিশ্চিত জানত পিস্তলে আরও একটা গুলি রয়েছে, তা হলেও ওই একই পথ ওকে বেছে নিতে হত। কারণ, বাম্বির দায়িত্ব পুরোপুরি রাকেশের।

ইন্সপেক্টর চিরিমার বলে চললেন, ডাক্তারবাবু বলেছেন, এখন খবরের কাগজের লোকেদের সঙ্গে দেখা করাটা আপনার শরীরের পক্ষে ঠিক হবে না। তবে দু-একজন পরিচিতের সঙ্গে কথা বললে আপনার হয়তো ভালোই লাগবে।

সাদা পোশাক পরা নার্স হাসল: একজন মহিলা, আর একটা বাচ্চা ছেলে আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

ললিতা। ভাবল রাকেশ।

ইন্সপেক্টর দিকে চেয়ে সে হাসল, বলল, অফিসার, ওই গুলির ব্যাপারটা ভদ্রমহিলাকে এখনই আর বলবেন না, কেমন?

একটু হেসে বেরিয়ে গেলেন চিরিমার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *