অপারেশান ভারচুরিয়্যালিটি
অনেকক্ষণ ধরে ফোন করব কি করব না ভেবে শেষ পর্যন্ত নম্বরটা ডায়াল করেই ফেলল অভিলাষ।
কয়েক সেকেন্ড পার হতে-না-হতেই ও-প্রান্তে রিং বাজতে শুরু করল। অভিলাষের বুকের ভেতরে ধুকপুক শুরু হয়ে গিয়েছিল। লাইনটা কি এখনই কেটে দেবে? নাকি…।
না, না—লাইন কাটার কী দরকার! একটু কথাবার্তা বললে খোঁজখবর করলে ক্ষতি কী? আসল কাজে না এগোলেই হল।
‘হ্যালো—’ একটি মেয়ের গলা।
‘এটা কি ”এন্ড গেম”-এর অফিস?’ প্রশ্নটা করতে গিয়ে অভিলাষের গলা কেঁপে গেল।
‘হ্যাঁ—বলুন…।’ রোবটের মতো গলায় মেয়েটি বলল।
‘আ-আমি কয়েকটা ইনফরমেশান চা-চাই…।’
‘এর জন্যে আপনাকে আমাদের অফিসে এসে কোনও একজন এক্সিকিউটিভের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমাদের অফিসটা হল থারটি ফাইভ গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউ। ”দ্য টাওয়ার্স” বিল্ডিং-এর সেভেনটিনথ ফ্লোর। উই আর ওপেন টুয়েন্টিফোর ইনটু সেভেন।’একটু দম নিয়ে মিষ্টি গলার মেয়েটি জিগ্যেস করল, ‘মে আই নো হু ইজ মেকিং দিস কল?’
কয়েকবার ঢোঁক গিলে অভিলাষ বলল, ‘মানে…আপনাদের একটা এসএমএস দেখে আ-আমি কল করেছি। আই মিন…।’
‘ইটস ও. কে., স্যার। ইমপরট্যান্ট পারসনসদের মোবাইল ফোনে কনট্যাক্ট করাটা আমাদের অ্যাড ক্যামপেইনেও খুব হেলপ করে। আমাদের কোম্পানির মরাল হচ্ছে, ”আ ক্লায়েন্টস সিক্রেট ইজ অলওয়েজ আ সিক্রেট।” ক্লায়েন্টদের সব ব্যাপার আমরা গোপন রাখি। ফর এক্স্যাম্পল, এই যে আপনি আমাদের ফোন করেছেন, এটা কেউ জানতে পারবে না। ইভন দ্য পুলিশ ক্যান নট ট্রেস দিস কল। বিকজ মোবাইল ফোন সার্ভিস প্রোভাইডারের সঙ্গে আমাদের স্পেশাল এগ্রিমেন্ট আছে। উই পে দেম বিগ মানি। সো এভরিথিং ইজ হাশ-হাশ।’ একটু থামল মেয়েটি। বোধহয় অভিলাষকে সাহস জোগানোর সময় দিল। তারপর: ‘আই হোপ ইউ আর স্যাটিসফায়েড, স্যার। নাউ মে আই নো হু ইজ কলিং?’
অভিলাষ ঘামতে শুরু করেছিল। ওর দম যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। ও তাড়াতাড়ি লাইনটা কেটে দিল।
ব্যাপারটা শুরু হয়েছে কাল সকাল থেকে। ঘুম থেকে উঠেই চায়ের টেবিলে রঙ্গনার সঙ্গে প্রবল খটাখটি হয়ে গেল। ইস্যুটা খুবই সামান্য: অভিলাষের একটা নীলচে ফুলহাতার শার্ট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেটা রঙ্গনাকে জিগ্যেস করতেই ও ঠোঁট উলটে বলে বসল, ‘তো আমাকে কী করতে হবে?’
তাতে বিরক্ত হয়ে অভিলাষ বলেছে, ‘কেন, তোমাকে জিগ্যেস করাটা কি অন্যায় হয়েছে?’
‘অন্যায় না হলেও ন্যায়ের বেসিসটাও তো খুব একটা খুঁজে পাচ্ছি না। শার্টটা নিয়ে কি আমি বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি?’ ভুরু উঁচিয়ে একটু তেরছা হাসি ছুড়ে দিয়েছে রঙ্গনা। তারপর: ‘তুমি তো জানো, আমার ভাইয়েরা এত কম দামি শার্ট পরে না। দে অলওয়েজ গো ফর সুপারব্র্যান্ডস…।’
ব্যস, শুরু হয়ে গেল।
ওদের বিয়েটা প্রেম করে হয়েছিল ঠিকই, তবে রঙ্গনা একমুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারে না ওরা ব্যাপক বড়লোক। বিয়ের প্রথম তিন-চার বছরে সেরকম কোনও সমস্যা হয়নি। সমস্যা শুরু হয়েছে পাঁচে পা দেওয়ার পর। ওদের মধ্যে কোনওরকম ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট হলেই দু-চার লাইন কথা চালাচালির পর রঙ্গনা ওর সেই গোরু রচনায় ফিরে আসে। অভিলাষকে মনে করিয়ে দেয় যে, ওরা টগবগে বড়লোক।
তো সকালের ঝগড়ার প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টা পর অভিলাষের মোবাইলে এসএমএস-টা আসে।
অভিলাষ তখন অফিসে। ল্যাপটপ কম্পিউটারের কিবোর্ডে ওর আঙুল চলছিল। মোবাইল ফোনটা রাখা ছিল একটা পেন ড্রাইভের পাশে। হঠাৎই এসএমএস-এর রিং বেজে ওঠায় কাজ থামিয়ে ও মেসেজটা দ্যাখে। অচেনা নম্বর থেকে আসা এক অদ্ভুত এসএমএস:
Harassed with any nagging problem? Call us, the PROBLEM
SOLVER. We’re the best.—END GAME (9832100051)
এসএমএস-টার মানে প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেনি অভিলাষ। যে-কোনও ঘ্যাপচানো সমস্যায় ব্যতিব্যস্ত হলে ‘এন্ড গেম’ সব সমস্যার সমাধান করে দেবে? যে-কোনও সমস্যা বলতে…ওদের সমস্যার এলাকাটা ঠিক কতটা বড়? গ্যাসট্রিক আলসার থেকে কিডন্যাপিং বা মার্ডার পর্যন্ত কি?
বলতে গেলে ঠিক তখনই রঙ্গনাকে খুন করার ব্যাপারটা প্রথম ওর মাথায় আসে।
ওদের বিয়েটা ঘাঁটতে-ঘাঁটতে এখন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে অনায়াসেই বলা যায়, সম্পর্কটা উচ্ছে, পলতা পাতা, চিরতা, কালমেঘ, কি নিমপাতা—সবাইকেই ছাড়িয়ে গেছে।
অভিলাষ মুখে তেতো স্বাদ পেল। এইভাবেই কি কাটবে বাকি দিনগুলো? নাকি…।
হঠাৎই দেখল সুমিতি ওর টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে।
সুমিতির সঙ্গে জ্যামিতির যে একটা গাঢ় সম্পর্ক আছে সেটা ওর চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। শরীরের ঠিক-ঠিক জায়গায় ঠিক-ঠিক মাপের বৃত্ত, উপবৃত্ত আর ত্রিভুজ বসানো রয়েছে।
সুমিতির পরনে হালকা গোলাপি শাড়ি। তার সঙ্গে হালকা ছাই রঙের ব্লাউজ। গলায় একটা সাধারণ কালো পুতির মালা—কিন্তু অসাধারণ লাগছে। ওর লম্বা কাঠামোর সঙ্গে বিদেশিনী মডেলদের মিল। গায়ের রং-ও সেইরকম। এমনভাবে অভিলাষের দিকে হেঁটে আসছে যেন মাটিতে পা পড়ছে না—ভেসে আসছে।
সুমিতি সিস্টেমস রিসার্চ ডিভিশানের প্রজেক্ট লিডার—এবং কোম্পানির অ্যাসেট। ওকে মনে-মনে অনেকেই চায়, কিন্তু মুখে বলার সাহস নেই। কারণ, ওর ব্যক্তিত্ব সহজে ভেদ করা যায় না।
অভিলাষের সঙ্গে কাজের কথা বলতেই এসেছিল সুমিতির। আলতো নরম গলায় ও কথা বলছিল। হালকা পারফিউমের গন্ধ অভিলাষকে স্বপ্ন দেখাচ্ছিল।
কাজের কথা শেষ করে চলে যাওয়ার ঠিক আগে সুমিতি বলল, ‘আপনাকে একটা রিকোয়েস্ট করব…?’
‘কী?’
‘মুখটাকে এরকম প্যাঁচার মতো করে রাখবেন না। যদিও এত হ্যান্ডসাম প্যাঁচা আমি আগে কখনও দেখিনি—।’
সুমিতি ঠোঁটের কোণে হেসে চলে গেল।
অভিলাষের সঙ্গে মাঝে-মাঝে এরকম হালকা মজা করে সুমিতি। হয়তো অভিলাষকে ও কিছুটা পছন্দও করে। কিন্তু শত সাধ থাকলেও অভিলাষ কখনও পা বাড়ায়নি, নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করেনি।
কারণ রঙ্গনা। অভিলাষ জানে, ওকে ডিভোর্সের কোনও প্রস্তাব দিলে ও সেটাকে এ-পাড়া থেকে শুরু করে বাপের বাড়ি পর্যন্ত রাষ্ট্র করে ছাড়বে। কথার খোঁচায় অভিলাষকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে। কিন্তু ডিভোর্স দেবে না।
রঙ্গনা এইরকম। কারণ, ওর লোভ—অর্থ আর শাসনের। অভিলাষের যা-কিছু আছে তার ওপরে দখল রাখতে রঙ্গনা ভালোবাসে, আর অভিলাষের ওপরে দখল রাখতে তার চেয়েও আরও অনেক বেশি ভালোবাসে।
এই দখলদারির বেড়া ভাঙতে চাইছিল অভিলাষ। তা হলেই ও অনেক স্বপ্ন দেখতে পারবে। এমনকী সুমিতিকে নিয়েও।
আরও আধঘণ্টা চিন্তাভাবনার পর অভিলাষ ঠিক করল 9832100051 নম্বরটায় ও ফোন করবে।
অভিলাষ ফোনটা করেছিল এসটিডি বুথ থেকে, যাতে কলার আইডি দেখে ‘এন্ড গেম’ ওকে ট্রেস করতে না পারে। কিন্তু সেই নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও অভিলাষ যেভাবে ঘেমে নেয়ে উঠল তা রীতিমতো লজ্জা পাওয়ার মতন। রঙ্গনা এ-দৃশ্য দেখলে খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ত। আর সেই হাসির এক-একটা কণা ধারালো ছুঁচের ডগা হয়ে ওকে রক্তাক্ত করত।
রঙ্গনা আপাদমস্তক আকাঙ্ক্ষাময় যুবতী। অভিলাষ ওকে কখনওই ঠিকমতো সন্তুষ্ট করতে পারেনি—না দিনে, না রাতে। ওর ছোটখাটো চেহারা আর ছোটখাটো প্রত্যঙ্গ নিয়ে কম খোঁটা দেয়নি রঙ্গনা। অতৃপ্ত অবস্থায় স্বামীর কাছ থেকে বিযুক্ত হওয়ার পর রঙ্গনা প্রায়ই ওকে ‘খোকা মেশিন’ বলে ব্যঙ্গ করত। বলত, ‘…একে তোমার খোকা মেশিন, তাতে আবার আধখানা গুলি ভরা আছে!’
অভিলাষের বুকের ভেতরটা জ্বলতে লাগল। ও ধীরে-ধীরে বুঝতে পারল, ওর ভেতরে একটা খুনি জন্ম নিচ্ছে।
মোবাইল ফোনের এসএমএস-টা বারবার দেখতে লাগল অভিলাষ। আচ্ছা, ন্যাগিং প্রবলেম সলভ করতে ‘এন্ড গেম’ ঠিক কত টাকা নেয়?
টুয়েন্টি সেকেন্ড সেঞ্চুরিতে এ ধরনের একটা অফিস ঠিক যতটা আধুনিক হওয়া সম্ভব ‘এন্ড গেম’-এর অফিস ঠিক ততটাই আধুনিক।
মোলায়েম ঠান্ডা পরিবেশ। চারিদিকে ধবধবে সাদা আলো—তবে লুকোনো লুমিনেয়ারগুলো চোখে পড়ছে না। মসৃণ আলোর দীপ্তি থাকলেও বিরক্তিকর চোখধাঁধানো ব্যাপার নেই। গোটা অফিসটাই কাচ আর আয়না দিয়ে সাজানো। ফলে অবজেক্ট আর ইমেজ মিলেমিশে এক অদ্ভুত ইলিউশান তৈরি হয়েছে।
রিসেপশান থেকে প্রায় পুরো অফিসটাকেই দেখতে পাচ্ছিল অভিলাষ। টেবিল, চেয়ার, ফাইলিং ক্যাবিনেট, ল্যাপটপ কম্পিউটার, হলোগ্রাম ক্যালেন্ডার, আরও কত কী!
কাচ আর আয়না ঘেরা সরু-সরু অলিপথ ধরে তরুণ-তরুণীরা ব্যস্তভাবে যাতায়াত করছে। তবে কে যে অফিসের স্টাফ আর কে যে ক্লায়েন্ট সেটা একটুও বোঝার উপায় নেই।
হঠাৎই অভিলাষের মনে হল, ‘এন্ড গেম’-এর যা ব্যবসা তাতে এই ব্যাপারটা যত গুলিয়ে যায় ততই ভালো। ক্লায়েন্টদের সেফটি আরও জোরালো হবে। তা ছাড়া নানান জায়গায় নানান অ্যাঙ্গেলে দাঁড় করানো আয়নার জন্য সব মানুষের চলাফেরার গতিপথ ঠিকমতো ঠাহর করা যাচ্ছে না। কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
গতকাল রাতে আরও দুবার ‘এন্ড গেম’-এর অফিসে ফোন করেছিল অভিলাষ। দুবার-ই ও মাঝপথে ফোন কেটে দিয়েছে। কিন্তু তৃতীয়বারে সাহস করে মেয়েটির সঙ্গে অনেকক্ষণ কথাবার্তা চালাতে পেরেছে।
অভিলাষকে একজন এক্সিকিউটিভের নাম আর মোবাইল নম্বর দিয়েছে মেয়েটি। বলেছে, ‘এখন থেকে হি উইল বি ইয়োর ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। ইউ মাস্ট ডিপেন্ড অন হিম। উই উইল গিভ ইউ ভ্যালু ফর মানি…।’
‘এন্ড গেম’এর অফিসে ঢুকে সেই এফপিজি—মানে, ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইডকে ফোন করল অভিলাষ। সঙ্গে-সঙ্গে আশ্বাসের হাসি, সুপ্রভাত, আর ‘কোনও চিন্তা নেই’-এর বন্যা বয়ে গেল। একইসঙ্গে গাইড্যান্সও পাওয়া গেল।
মোবাইল ফোনে পরের পর নির্দেশ দিয়ে অভিলাষকে গাইড করতে লাগলেন তিনি। আয়না আর কাচের গোলকধাঁধায় অভিলাষ অন্ধের মতো পথ খুঁজতে লাগল। বারবার ধাক্কা খেতে লাগল কাচে অথবা আয়নায়। নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে ধাক্কা এড়াতে গিয়ে বেশ কয়েকবার নাকাল হল। তারপর, বহু ধস্তাধস্তির পর ও কিউব- ১১০১১-এ পৌঁছতে পারল।
তখনই ও ওর এফপিজি-কে প্রথম দেখতে পেল।
বেঁটে চেহারার মোটাসোটা মানুষ। ফরসা, গালে সাহেবদের মতো লালচে আভা। মাথার প্রায় পুরোটাই টাক। চোখে চৌকো কাচের শৌখিন চশমা। চোখজোড়া গোল-গোল। তাতে সবসময়েই একটা অবাক ভাব। নাকের নীচে ছোট চওড়া গোঁফ। আর থুতনির নীচে গলকম্বল।
গোটা অফিসটা এসি হওয়া সত্ত্বেও ভদ্রলোকের কপালে আর টাকে বিনবিনে ঘাম। পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বের করে ঘন-ঘন ঘাম মুছছেন।
এফপিজির চেহারা অভিলাষকে হতাশ করল। এ যে দেখছি বোকা-বোকা একটা জোকার! যার সঙ্গে বুদ্ধির বা আই. কিউ-র কোনও সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অভিলাষ। ভদ্রলোককে কয়েকবার জরিপ করল।
না, ভদ্রলোকের পোশাক বেশ স্মার্ট। ঘিয়ে রঙের ফুলশার্ট। গাঢ় নীল রঙের টাই। আর গাঢ় নীল টেরিউলের প্যান্টের ওপরে সরু-সরু সাদা স্ট্রাইপ।
এফপিজির নাম কমলপাণি। অভিলাষের সঙ্গে হাতমোলানোর সময় শুধু প্রথম নামটাই বললেন তিনি। তারপর ওকে নিয়ে কাচ আর আয়নায় ঘেরা একটা কিউবিকল-এ বসলেন।
অভিলাষ আগেই লক্ষ করেছিল, কিউবিকলগুলোর নম্বর ডেসিম্যাল নাম্বারে না লিখে বাইনারিতে লেখা। ও যখন এর কারণ ভাবছিল তখন কমলপাণি হাতে হাত ঘষে একটু খসখসে গলায় ওকে জিগ্যেস করলেন, ‘বলুন, স্যার, আপনার ন্যাগিং প্রবলেমটা কী? আপনাকে এটুকু অ্যাশিয়োর করছি, নেচার অফ প্রবলেম যা-ই হোক না কেন, উই উইল সলভ ইট ফর গুড।’
অভিলাষ আর দেরি করল না। সমস্যাটা ও বলতে গেলে কমলপাণির মুখের ওপরে উগরে দিল।
‘সমস্যাটা আমার ওয়াইফ। আই ওয়ান্ট টু বাম্প আর অফ—ওকে একেবারে খতম করতে চাই…।’
‘গুড!’ কমলপাণি চাপা হেসে মাথা নাড়লেন ‘আপনার ওয়ে অফ এক্সপ্রেশান আমার ভালো লেগেছে, স্যার। বি ডায়রেক্ট অ্যান্ড টু দ্য পয়েন্ট। সেভস টাইম।’ কাচের টেবিলে আলতো করে আঙুলের টোকা মারতে শুরু করলেন কমলপাণি। সাদা সিলিং-এর দিকে কয়েক লহমা তাকিয়ে রইলেন। আস্তে-আস্তে বললেন, ‘ওয়াইফকে…খুন…করতে…চান। তাই তো?’ চোখ নামালেন অভিলাষের দিকে ‘মোস্ট কমন প্রবলেম। হ্যাঁ, সলভ হয়ে যাবে। তবে মার্ডার করতে চান কোন মোডে—ভারচুয়াল মোড, না রিয়েল মোড?’
‘তার মানে?’
‘দেখুন, আমরা মার্ডার করি দু-ভাবে—ইন ভারচুয়ালিটি, অ্যান্ড ইন রিয়েলিটি…।’
অভিলাষ ফ্যালফ্যাল করে কমলপাণির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর মাথায় তখনও ভালো করে কিছু ঢুকছিল না। ভারচুয়াল? রিয়েল? এসব কী বলছে ওর এফপিজি! তাছাড়া মানুষটা মার্ডার করার ব্যাপারটা এমন মামুলিভাবে উচ্চারণ করেছে যে, অভিলাষের স্পাইনাল কর্ড বেয়ে বরফজলের হিমস্রোত নেমে গেল।
কমলপাণি যতই কথা বলছিলেন অভিলাষ ততই বুঝতে পারছিল বোকা-বোকা জোকার-জোকার ভাবটা ওঁর ছদ্মবেশ। ক্ষুরধার বুদ্ধি না থাকলে ‘এন্ড গেম’-এর এক্সিকিউটিভ হওয়া যায় না।
‘…ব্যাপারটা আপনাকে বুঝিয়ে দিই, স্যার…’ দু-হাত নেড়ে বললেন কমলপাণি, ‘ধরুন, আপনাদের কনজুগাল লাইফ একদম ঘেঁটে গেছে। মানে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা একেবারে বিষিয়ে গেছে—মিউচুয়াল হেট্রেড ছাড়া আর কিছু বাকি নেই। তখন, ধরুন, আপনি ডিসাইড করলেন যে, আপনার ওয়াইফকে মার্ডার করবেন—এই যেমন আপনি ডিসাইড করেছেন।
‘আমাদের সাইকোলজি ডিভিশান স্টাডি করে দেখেছে যে, এরকম কেস-এ প্রায় এইটিথ্রি পারসেন্ট মানুষের বেলায় রিয়েল মার্ডারের দরকার হয় না। ভারচুয়াল মার্ডার করলেই কাজ হয়ে যায়। মানে, য়ু গেট ইয়োর হেট্রেড আউট অফ ইয়োর সিস্টেম। তখন স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর রিলেশানটা আবার রিপেয়ার হয়ে যায়। এভরিথিং এন্ডস ওয়েল। ঠিক আছে?’
‘ভারচুয়াল মার্ডার মানে?’ হতবাক অভিলাষ জিগ্যেস করল।
কমলপাণি হাসলেন, ওঁর ভুঁড়ি হাসির দমকে কেঁপে উঠল আঙুলের ডগা খুঁটতে-খুঁটতে তিনি বললেন, ‘ভারচুয়াল মার্ডার মানে নকল খুন। কিন্তু আপনি ভাববেন আসল খুনই হয়েছে। ব্যাপারটা আমাদের কোম্পানির ইনভেনশান—ইন্টারন্যাশনাল পেটেন্টও নেওয়া আছে। এর ডিটেইল-এ এখন যাচ্ছি না—পরে আপনি দেখতেই পাবেন—যদি অবশ্য আপনি ভারচুয়াল মোডে যান।
‘আমাদের কোম্পানির নিয়ম হল, ভারচুয়াল মার্ডার হলে সেটা অবশ্যই ক্লায়েন্টকে নিজের হাতে করতে হবে। আর…ইফ এনিবডি গোজ ফর রিয়েল মোড, ”এন্ড গেম” টেকস কেয়ার অফ এভরিথিং। ক্লায়েন্টকে কোনও ঝামেলা ঘাড়ে নিতে হবে না। বরং আমরা ক্লায়েন্টকে জবরদস্ত অ্যালিবাই তৈরি করে দেব—পুলিশের বাবাও তাকে সেই মার্ডারের সঙ্গে জড়াতে পারবে না। তা ছাড়া মার্ডারটা আমরা এমনভাবে কমিট করব যে, সেটা একটা পারফেক্ট অ্যাক্সিডেন্টের মতো দেখাবে। এই ধরুন কার অ্যাক্সিডেন্ট, কিংবা মালটিস্টোরিড বিল্ডিং থেকে পড়ে যাওয়া—এই টাইপের। অ্যাবসোলিউটলি নো উয়ারিজ ফর দ্য ক্লায়েন্ট। ক্লায়েন্টকে শুধু আমাদের প্রপার ফি-টা ক্রেডিট কার্ডে জমা করতে হবে। ব্যস…।’
ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় ধরে অভিলাষকে সব বুঝিয়ে দিলেন কমলপাণি। তারপর ওকে একপৃষ্ঠার একটা ফর্ম ফিল-আপ করতে দিলেন। বললেন, ‘শুনুন স্যার, একটা রিকোয়েস্ট আপনাকে করব। তাড়াহুড়ো করে কোনও ডিসিশান নেবেন না। গো হোম। রিল্যাক্স। আপনার স্ত্রী যখন আপনার প্রেমিকা ছিল—আই হোপ শি ওয়াজ—সেইসব মিষ্টি দিনগুলোর কথা ভাবুন। ভাবুন আরও মিষ্টি রাতগুলোর কথা। ওহ! দৌজ ওয়ান্ডারফুল নাইটস!…এখন তো হতেই পারে, ওসব কথা ভাবতে-ভাবতে একসময় আপনার মনে হবে, ইউ ডোন্ট নিড আস অ্যাট অল।
‘একটা কথা আপনাকে বলি, স্যার—উই ডোন্ট বেগ ফর বিজনেস। যদি আপনি আমাদের হেলপ না নেন, তা হলে আমরাই সবচেয়ে বেশি খুশি হব। কিন্তু যদি তিনদিন পর আপনি আবার আমাদের কাছে ফিরে আসেন তা হলে বুঝতে হবে আপনার ডিসিশানটা জেনুইন। তখন আপনিই ঠিক করবেন কোন মোডে আপনি কাজটা করতে চান—ভারচুয়াল, না রিয়েল। যদি ভারচুয়াল অপারেশানে যান, তা হলে ওয়াইফকে আবার ফিরে পাবেন। আর যদি রিয়েল অপারেশানই আপনার ডিমান্ড হয়, তা হলে…ওয়েল শি উইল বি গন ফর গুড।’ একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লেন কমলপাণি: ‘তা হলে বাড়ি যান…ভাবুন…তিনদিন পর আমাদের দেখা হবে। সি য়ু…।’
ফর্মটা ফিল-আপ করার সময় মোডের জায়গায় ‘ভারচুয়াল’ লিখল অভিলাষ।
গত তিনদিন ধরে অনেক ভেবেছে ও। কমলপাণির কথাগুলো ওকে বেশ নাড়া দিয়েছে। কমলপাণি বলেছেন মিষ্টি দিনগুলোর কথা ভাবতে—যখন রঙ্গনা ওর প্রেমিকা ছিল। মিষ্টি দিন। আরও মিষ্টি রাত।
প্রথম যেদিন ওরা সবচেয়ে কাছাকাছি আসে সেদিন রঙ্গনা কী বলেছিল আজও অভিলাষের মনে আছে।
অভিলাষের ফ্ল্যাটে ওরা দুজনে সন্ধেটা কাটাচ্ছিল। অভিলাষ একটা সোফায় গা এলিয়ে বসেছিল। একটু আগেই ওর তৃতীয় পেগ শেষ হয়েছে। মাথায় ঝিমঝিম ভাব, মনের মধ্যে নানান রঙের স্বপ্নের ওড়াউড়ি। মিউজিক সিস্টেমে রঙ্গনার ফেবারিট জিমি এক্স-এর ‘ক্লোজ টু ইয়োর হার্ট’ বাজছিল। আর রঙ্গনা বসেছিল অভিলাষের হাতের নাগালে।
সুতরাং হাত হাতের কাজ করছিল, মন মনের।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই রঙ্গনা এসে গিয়েছিল অভিলাষের বুকের ওপরে। তারপর, দু-চার প্রস্থ আদরের পর, রঙ্গনা অভিলাষের বুকে মুখ গুঁজে মিনমিনে জড়ানো স্বরে বলেছিল, ‘তোমার নামের মানে জানো?’
‘হ্যাঁ—জানি।’ নীচু গলায় জবাব দিয়েছিল অভিলাষ।
‘তা হলে আর দেরি করছ কেন?’
‘না, আর দেরি করেনি অভিলাষ।
সেইদিন, আর তার পরের দিনগুলো! নাম অনুযায়ী কাজ করে চলেছিল।
ভাবতে-ভাবতে নরম হয়ে যাচ্ছিল অভিলাষ। আচ্ছা, রঙ্গনা কি নিজেকে একটু বদলে নিতে পারে না? দরকার হয় অভিলাষও নিজেকে একটু-আধটু বদলাবে।
সুতরাং, রঙ্গনার সঙ্গে কথাবার্তায় বা ব্যবহারে সচেতন হয়ে উঠল অভিলাষ। ওর সঙ্গে অতিরিক্ত মোলায়েম সুরে কথা বলতে লাগল, সংঘর্ষ এড়াতে নিজে হার মানল বহুবার। রঙ্গনা বেশ অবাক হয়ে ওকে দেখতে লাগল। একসময় তো বলেই বসল, ‘কী ব্যাপার বলো তো? কোনও ট্যাবলেট-ফ্যাবলেট খেয়েছ নাকি? তোমাকে ভারি পিকিউলিয়ার লাগছে…।’
অভিলাষ তাও চেষ্টা চালিয়ে গেছে। আর ওর মনটা ধীরে-ধীরে পালটাতে শুরু করেছে। মনে হয়েছে, রঙ্গনাকে আর-একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। দেখাই যাক না!
তাই কমলপাণির কাছে এসে ফর্মে মোডের জায়গায় ও লিখেছে, ‘ভারচুয়াল।’
খুব তাড়াতাড়ি সবরকম ফর্মালিটিজ কমপ্লিট করে দিলেন কমলপাণি। চোখ তুলে দেখলেন অভিলাষের দিকে, বললেন, ‘ইট ওয়াজ আ গুড ডিসিশান, স্যার। ইউ উইল ফাইন্ড দ্য ভারচুয়াল মোড নো লেস এফেকটিভ দ্যান দ্য রিয়েল মোড…।’
অভিলাষ শুনল, কিন্তু কোনও কথা বলল না। শুধু মনে-মনে ও ভারচুয়াল মার্ডারের এফেকটিভনেসটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল।
কমলপাণি অভিলাষের ফ্ল্যাটের ঠিকানা এবং মোটামুটি লোকেশান জেনে নিলেন। তারপর হাতঘড়ির ডায়ালে তারিখ দেখে অভিলাষকে সাতদিন পরের একটা তারিখ আর সময় জানালেন, বললেন, ‘আরও সাতদিন সময় হাতে পেলেন। কিপ ইয়োর কুল। ওইদিন ঘড়ি ধরে চলে আসুন। কমিট দ্য ক্রাইম অ্যান্ড বি হ্যাপি। ও. কে?’
‘ও. কে.—’ বলল অভিলাষ।
অন্ধকার ঠান্ডা ঘরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে রঙ্গনাকে দেখছিল অভিলাষ।
ওর পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন এফপিজি কমলপাণি।
ওদের সামনে একটা বিশাল কাচের জানলা। জানলার ওপাশেই একটা আলো-ঝলমলে বেডরুম—অভিলাষের বেডরুম।
সুন্দর করে সাজানো বেডরুমের মোলায়েম বিছানায় আলুথালুভাবে চিত হয়ে শুয়ে রয়েছে রঙ্গনা। একহাতে ধরা একটা ইংরেজি পেপারব্যাক।
রঙ্গনার গায়ে লেসের কাজ করা গোলাপি রঙের একটা নাইটি। পোশাকটা ঠিকঠাক ওর গায়ে নেই। একটা পা ভাঁজ করা—পোশাকটা উঠে গিয়ে হাঁটু এবং ঊরুর খানিকটা দেখা যাচ্ছে। মাথার চুল বালিশের ওপরে ছড়ানো। বাঁ হাতে কোমরের কাছটা চুলকোচ্ছে।
কমলপাণি ফিসফিস করে বললেন, ‘স্যার, এটা আপনার বেডরুমের হলোগ্রাফিক লাইভ টেলিকাস্ট। আপনি যা দেখছেন সবটাই হলোগ্রাফিক ইমেজ—মানে মায়া। আমাদের ক্যামেরা এখন থেকে প্রতিমুহূর্তে আপনার ওয়াইফকে ফলো করবে। এই মুহূর্তে আপনার স্ত্রী ফ্ল্যাটে যা-যা করবেন তার প্রতিটি কণা আমাদের থ্রি-ডি ক্যামেরা সিস্টেম লাইভ টেলিকাস্ট করে আপনাকে দেখাবে…।’
অভিলাষের তাজ্জব লাগছিল। কারণ, ওরা ওর ফ্ল্যাট থেকে অনেক দূরে ‘এন্ড গেম’-এর অফিসে একটা স্পেশাল রুমে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
কমলপাণি বোধহয় অভিজ্ঞতা থেকেই অভিলাষের অবাক হওয়াটা টের পেলেন। চাপা গলায় বললেন, ‘আপনি যা দেখছেন, পুরোটাই ভারচুয়াল রিয়্যালিটি। কিন্তু আপনার মনে হচ্ছে, আপনার স্ত্রীকে আপনি যেন সত্যি-সত্যি লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখছেন। আসলে যে-কোঅর্ডিনেটে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এগজ্যাক্টলি সেই কোঅর্ডিনেটে আপনার ফ্ল্যাটের বেডরুমে একটা জানলা আছে— ফ্রস্টেড গ্লাস লাগানো জানলা। আমরা যেন সেই জানলার কাচ সরিয়ে আপনার ওয়াইফের প্রাইভেসিতে ইনভেড করছি। ইটস সো-ও-ও রিয়েল!’ হঠাৎই কথা থামিয়ে অন্ধকারে অভিলাষকে ছুঁলেন কমলপাণি। চাপা গলায় বললেন, ‘নিন—এটা ধরুন….’
জিনিসটা কমলপাণির হাত থেকে নিল অভিলাষ।
একটা রিভলভার।
আন্দাজে বুঝল, অস্ত্রটার ওজন প্রায় কেজিখানেক হবে।
‘এটা আপনার মার্ডার ওয়েপন। মডার্ন। ইমপোরটেড। স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন, মডেল ফোর জিরো জিরো সিক্স। জিরো পয়েন্ট ফোর জিরো ক্যালিবার। ডাবল-অ্যাকশান। এর ম্যাগাজিনে এগারো রাউন্ড বুলেট আছে। এই হ্যান্ডগানটার নল-টল সব স্টেইনলেস স্টিলের—আর গ্রিপটা ব্ল্যাক, সিনথিটিক। প্রথম কয়েকটা শটে আপনার স্ত্রীকে মিস করলেও এগারোবার তো আর মিস করবেন না! নিন, এবার রেডি হোন…।’
অভিলাষ রিভলভারটা উঁচিয়ে রঙ্গনার দিকে তাক করল। ও অ্যামেচার হলেও এত ক্লোজ রেঞ্জে রঙ্গনাকে মিস করা প্র্যাকটিক্যালি অসম্ভব।
রঙ্গনার সমস্ত খোঁচা, উপহাস আর ব্যঙ্গগুলো মনে পড়ল ওর। খোকা মেশিন…আধখানা গুলি ভরা…। আর এখন। অভিলাষের হাতে একটি পূর্ণাঙ্গ মেশিন—তাতে এগারোখানা গুলি ভরা আছে।
‘কাচ সরিয়ে দিলাম কিন্তু! গেট রেডি!’ কমলপাণির গলা।
অভিলাষের হাত কাঁপছিল। ও মুঠো শক্ত করল বাঁটের ওপর।
‘সড়সড়’ শব্দ করে কাচের প্যানেল সরে গেল।
অভিলাষের মাথার মধ্যে খতমের সুর বাজছে।
ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কমলপাণি বললেন, ‘ওয়ান, টু, থ্রি—ফায়ার!’
অভিলাষ ট্রিগার টিপতে শুরু করল। ফায়ারিং-এর শব্দে ওর কানে তালা লেগে গেল।
প্রথম বুলেটটা রঙ্গনার কোমরে গিয়ে লাগল। ওর হাতের বইটা ছিটকে পড়ল মেঝেতে। ও চমকে ফিরে তাকাল জানলার দিকে…অভিলাষের দিকে। ওর অবাক হওয়া মুখটা পলকে ব্যথায় কুঁচকে গেল। কোমর থেকে চুঁইয়ে-চুইয়ে রক্ত বেরিয়ে এল গোলাপি নাইটি লাল হতে লাগল। বিছানার চাদরও।
অভিলাষ কিন্তু থামেনি। চোখ বুজে পাগলের মতো ফায়ার করেই চলল। রঙ্গনার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত দেখে ওর খুনে মেজাজ যেন আরও চড়ে গেল। ও ভুলে গেল, এটা ভারচুয়াল মার্ডার।
বুলেটের ধাক্কায় রঙ্গনা বিছানা থেকে পড়ে গিয়েছিল। মেঝেতে পড়ে থাকা ওর চিতপাত শরীর আর রক্ত দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, ও আর বেঁচে নেই।
অভিলাষের মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। ও হঠাৎই টলে পড়ে গেল মেঝেতে। কমলপাণি তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়লেন ওর ওপরে। নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখলেন, নাড়ি দেখলেন। তারপর পকেট থেকে নিমপাতার মতো ছোট্ট আর পাতলা একটা মোবাইল ফোন বের করে কথা বললেন, ‘আমি ক্লায়েন্ট নাম্বার ট্রিপল ওয়ান ট্রিপল জিরো ডাবল ওয়ানকে নিয়ে ভারচুয়াল মার্ডার এক্সিকিউশান রুমে আছি। ভদ্রলোক সাডেন ট্রমায় সেন্সলেস হয়ে গেছেন। হেলপলাইনকে অ্যাকটিভ হতে রিকোয়েস্ট করছি।’
অভিলাষ সুস্থ হয়ে উঠল আধঘণ্টার মধ্যেই। ও শুধু রঙ্গনার কথা ভাবছিল। জ্ঞান ফেরার পর কমলপাণি ওকে বারবার আশ্বাস দিয়েছেন যে, রঙ্গনার কোনও ক্ষতি হয়নি। ইট ওয়াজ ওয়ান হান্ড্রেড পারসেন্ট আ ভারচুয়াল মার্ডার।
শি ইজ পারফেক্টলি সেফ অ্যান্ড সাউন্ড। অভিলাষ ইচ্ছে করলে এখনই ওর স্ত্রীকে ফোন করতে পারে।
কিন্তু তবুও অভিলাষের যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না।
তাই রঙ্গনাকে ফোনই করল অভিলাষ।
‘রঙ্গনা—।’
‘হু ইজ দিস?’
‘আমি—অভি। তুমি ঠিক আছ তো?’
‘ক’ পেগ খেয়েছ?
আহ! একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল অভিলাষ। এটাই তো রঙ্গনার ক্যারেক্টারিস্টিক আনসার! দিস প্রূভস শি ইজ অ্যালাইভ অ্যান্ড ও. কে.।
‘রঙ্গনা, আই লাভ ইউ, বেবি—।’
‘কখন বাড়ি ফিরছ?’
ঘড়ি দেখল অভিলাষ, বলল, ‘এই ধরো সাড়ে দশটা নাগাদ—।’
‘সাড়ে দশটাই কোরো। তার চেয়ে বেশি দেরি যেন না হয়…।’
এই কথায় প্রেমিকা রঙ্গনার ছায়া দেখল অভিলাষ। কমলপাণিকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল। কারণ, তিনিই প্রথম ভারচুয়াল মার্ডারের সাজেশান দিয়েছিলেন।
রাস্তায় নেমে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ বসল অভিলাষ। গাড়ি ছুটিয়ে দিল। রাতের বাতাস ওর গালে কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল।
রাতটা কী সুন্দর! আকাশের চাঁদটাও।
অভিলাষ যখন ওদের বাড়ির সামনের বড় রাস্তায় এসে পড়ল তখনই একটা মালবোঝাই ফুল পাঞ্জাব ট্রাক পাগলাঘোড়ার মতো ছুটে এল ওর দিকে।
প্রবল সংঘর্ষের শব্দে নিঃস্তব্ধ রাত থরথর করে কেঁপে উঠল।
ট্রাকটা একটুও না থেমে উদ্দামগতিতে ছুটে অন্ধকারে উধাও হয়ে গেল।
অভিলাষের গাড়িতে আগুন ধরে গেল। তার একটু পরেই প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ।
অ্যাকশান ছবির দৃশ্যের মতো অভিলাষের গাড়িটা শূন্যে ছিটকে উঠল, আবার আছড়ে পড়ল রাস্তায়।
রঙ্গনা টেনশানে পায়চারি করছিল। হঠাৎই ওর মোবাইল ফোন বেজে উঠল।
দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকাল রঙ্গনা। দশটা চল্লিশ।
তাড়াতাড়ি বোতাম টিপে ‘হ্যালো’ বলতেই ও-প্রান্ত থেকে রোবটের গলায় একজন মহিলা বলে উঠল, ‘ম্যাডাম, ”এন্ড গেম” থেকে বলছি। আপনার কাজটা হয়ে গেছে। যেমন বলেছিলাম, ইট ওয়াজ আ পারফেক্ট রোড অ্যাক্সিডেন্ট…। একটা ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কায়…।