1 of 2

আসুন, এদিকেই নরকের দরজা

আসুন, এদিকেই নরকের দরজা

এবার এদিকে আসুন…দেখবেন, মাথার দিকে খেয়াল রাখবেন, নইলে ঝুলে থাকা পাথরে যে-কোনও সময় চোট পাবেন। বুঝতেই তো পারছেন, ১৭০০ সালের দুর্গ এর চেয়ে আর কত ভদ্র হবে! সিঁড়ির ধাপগুলো নড়বড়ে হলেও তেমন ভয় নেই, কাঠগুলো দিব্যি মজবুত আছে। আমার আটবছরের চাকরিতে এ-সিঁড়ি ভেঙে কেউ কখনও পড়ে যায়নি। আসুন—ধীরে-ধীরে নেমে আসুন আপনারা। হ্যাঁ, এই যে—এটাই শেষ কুয়ো, যেখানে বিশ্বাসঘাতিনী নাফিসা বেগমকে জীবন্ত কবর দিয়েছিলেন বাহাদুর শাহ। না, না, পুরো ইতিহাস আমি কী করে জানব? সবই আমাদের শোনা কথা। লোকমুখে যুগ-যুগ ধরে চলে আসছে। আর, এই যে বিশাল পাথরে বাঁধানো উঠোনটা দেখছেন, এখানেই বিকেলে বেড়াতেন বেগমরা। যাতে বাইরের কেউ তাদের দেখতে না-পায়, সেইজন্যে চারধারে রয়েছে পনেরো ফুট উঁচু পাথরের পাঁচিল। কী বলছেন, হারেম? উঁহু, এটাকে আপনারা দুর্গও বলতে পারেন, আবার ফষ্টিনষ্টির কারখানাও বলতে পারেন। ব্যস, এ-ই সব—আর দেখানোর কিছু নেই। কারও কোনও প্রশ্ন থাকলে বলুন। নেই? তা হলে আপনারা এবার আস্তে-আস্তে ফিরে যান। যান, যান, কোনও ভয় নেই; যে-পথ দিয়ে এসেছেন, সেই পথ ধরেই ফিরে যান। এটা তো আর নবাব-বাদশাদের ‘ভুলভুলাইয়া’ নয়, বেরোতে কোনও অসুবিধেই হবে না—।

এ কী, স্যার, আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন যে? কী বলছেন, আমি সবকিছু আপনাদের দেখাইনি? তাই কি কখনও হয়? এই দেখানোটাই যে আমার চাকরি! আপনারা যদি স্যাটিসফাইড না হন, তা হলে কালই মিস্টার সেনগুপ্ত আমার চাকরি খেয়ে নেবেন। এ-দুর্গের দেখাশোনার ভার ওঁর ওপরেই আছে কিনা। কুয়ো? কুয়োটা তো আপনারা দেখলেন, ওই তো! কী বলছেন? ওটা নয়? অন্য আর-একটা কুয়ো? যেখানে—যেখানে তিতু সরকার, মানে তিতির সরকার নামে কচি মেয়েটা আত্মহত্যা করেছিল?

শ-শ-শ-শ! আস্তে, স্যার, আস্তে বলুন! দেখছেন তো, এখনও জনাকয়েক ট্যুরিস্ট ওপাশটায় ঘোরাফেরা করছে। তা ছাড়া, মিস্টার সেনগুপ্ত যদি একবার এসব কথা শুনতে পান, তা হলে আর রক্ষে থাকবে না। তিনি চান না, দশবছর আগেকার ওই ঘটনা নিয়ে কেউ আর কোনওরকম ঘাঁটাঘাঁটি করুক।

হ্যাঁ, কুয়োটা আমি চিনি। কিন্তু ওই যে বললাম, মিস্টার সেনগুপ্তের বারণ আছে। না, স্যার, তা আমি পারি না। তা হলে আমার চাকরিটাই চলে যাবে।…আচ্ছা, আপনি যখন এত করে বলছেন—তা ছাড়া আপনার কাছ থেকে বকশিশ নেওয়ার পর তো আর আপনাকে ফিরিয়ে দিতে পারি না! কুয়োটা আপনি সত্যিই দেখতে চান? কিন্তু হঠাৎ এ-কুয়ো দেখার সাধ হল কেন বলুন তো? ও, মেয়েটা মারা যাওয়ার পর যে-সব রিপোর্টার এসেছিল, আপনি তাদের মধ্যে ছিলেন? তাই বলুন! কী যেন নাম বললেন মেয়েটার, তিতির সরকার?

না, তখন এ-চাকরি আমি করতাম না। কিন্তু আর-সবাইয়ের মতো খবরের কাগজগুলো খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পড়েছিলাম। তা হলে স্যার আপনি একমিনিট অপেক্ষা করুন, আমি অন্য ট্যুরিস্টদের বেরোনোর রাস্তাটা দেখিয়ে দিই। তা ছাড়া পাঁচটা প্রায় বাজে, বন্ধ করার সময়ও হয়ে গেছে…।

নিন, এবার বলুন—এখন আর কোনও ভয় নেই। ওঃ, সারাটা দিন যা ধকল গেছে! শেষ দলটাকে বের করে দিয়ে এবার নিশ্চিন্তি! না, আর কেউ এখানে আসবে না। বাইরের জং ধরা ভারি দরজাটায় আমি খিল এঁটে দিয়ে এসেছি। না, না, বাইরের কোনও শব্দই এখানে শোনা যায় না, আর সেইজন্যেই আমাদের কথাও বাইরের কোনও প্রাণীর কানে যাবে না—অবশ্য নিশাচর প্যাঁচাদের কথা আলাদা। এই অন্ধকার ঠাসা দুর্গেই ওদের রাজত্ব। তা ছাড়া সন্ধেও তো হয়ে এল।

আপনি ওই কুয়োটা তা হলে দেখতে চান? যেখানে তিতির সরকার নামে মেয়েটা ডুবে মারা গিয়েছিল? কিন্তু কাজটা করা আমার ঠিক হচ্ছে না। মিস্টার সেনগুপ্ত যদি একবার জানতে পারেন, তা হলে ভীষণ রেগে যাবেন। না, আপনি ঠিকই বলেছেন, তাঁকে জানানোরই—বা দরকার কী? হাঃ-হাঃ-হাঃ…।

আসুন, স্যার, এদিক দিয়ে আসুন। এই বড় হলঘরটা পেরিয়ে আমাদের যেতে হবে। আমাকে আপনার পেছন-পেছন আসতে বলছেন? আমার কিন্তু অবাক লাগছে, না বলতেই ঠিক রাস্তাটা আপনি চিনলেন কী করে! দেখবেন, সাবধান, এখানকার পাথুরে মেঝেটা ভীষণ এবড়োখেবড়ো।

দশবছর আগেকার ওই ইতিহাস নিয়ে কেউ আবার নতুন করে চর্চা করুক, সেটা মিস্টার সেনগুপ্ত পছন্দ করেন না। কেন জানেন? কারণ, ওই ঘটনা ওঁর মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল। মিস্টার সেনগুপ্তকেই গ্রামের লোকেরা তিতির সরকারের লাভার বলে সন্দেহ করেছিল। ওই লাভারই মেয়েটাকে ধীরে-ধীরে ঠেলে দিয়েছিল মৃত্যুর দিকে। সন্দেহ করার কারণও অবশ্য ছিল। মানে মেয়েটা ছিল মিস্টার সেনগুপ্তের কারখানার ফোরম্যানের বউ। ওরা ওঁর বাড়ির কাছাকাছিই থাকত। ফলে সরকারদের সঙ্গে ওঁর বেশ মেলামেশা ছিল। আর চুপিচুপি বলি স্যার, তিতির সরকারকেও সেনগুপ্তসাহেবের মনে ধরেছিল। বলতে গেলে তিনি ওদের পরিবারেরই একজন হয়ে গিয়েছিলেন। ফলে মেয়েটা ওভাবে মারা যাওয়ার পর ওঁকেই যে লোকে সন্দেহ করবে এ আর বেশি কথা কী! উনি যদি একবার জানতে পারতেন কারা ওঁর নামে এইসব বাজে কথা রটাচ্ছে, তা হলে আর দেখতে হত না—তাদের কোর্ট পর্যন্ত দৌড় করিয়ে ছাড়তেন। একবছর ধরে তো ওঁর সংসারে অশান্তি লেগে ছিল। বউয়ের সঙ্গে দিনরাত উনি ঝগড়া করে গেছেন। বারবার বলেছেন, ওঁর কোনও দোষ নেই। আমরা ভেবেছিলাম, মিসেস বোধহয় ওঁকে ছেড়েই চলে যাবেন…যাক সে-কথা, এখন ওঁরা বেশ সুখে আছেন, তা ছাড়া দশবছর সময়টাও তো নেহাত কম নয়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এখন যদি আবার সেই পুরোনো কাসুন্দি নিয়ে জিভ চালাচালি হয়, তা হলে আমার অবস্থাটা কী হবে! না স্যার, আপনার কথা আমি বলছি না, আপনি সেরকম লোকই নন। তাই যদি ভাবতাম, তা হলে আপনাকে এত সব কথা বলতামও না, আর ওই কুয়োটা দেখাতাম না।

লোকে বলে, মেয়েটা নাকি আশ্চর্যরকম সুন্দরী ছিল। বয়েসও ছিল খুব কম—মাত্র একুশ। গায়ের রং ছিল যেন দুধে-আলতা। লোকে বলে, খবরের কাগজে মেয়েটার যে-ছবি ছাপা হয়েছিল, তার চেয়ে অন্তত একশো গুণ সুন্দরী ছিল ও। চোখ ছিল কালো হিরের মতো উজ্জ্বল, চকচকে। কী বলছেন, কালো নয়? একটু কটা চোখে? কী জানি, হবে হয়তো। কারণ সবই আমার শোনা কথা, আর আপনি নিজে তো রিপোর্টার হিসেবে স্পটে হাজির ছিলেন। দেখবেন, সিঁড়ির শেষ ধাপটা খেয়াল রাখবেন—ওটা খানিকটা ভাঙা আছে। কিন্তু…কটা চোখ বলছেন? না, স্যার, এ নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে তর্ক করতে চাই না। শুধু ভাবছি আপনার কী স্মৃতিশক্তি!

যাকগে, মোটের ওপর মেয়েটা ছিল অল্পবয়েসি, অসম্ভবরকম সুন্দরী, নিষ্পাপ, আর কিছুটা সরল প্রকৃতির—সাধারণত গ্রামের মেয়েরা যা হয়ে থাকে। ওর বাবা মিস্টার সেনগুপ্তের বাগানেই মালির কাজ করত। আপনি হয়তো ওকে কখনও দেখেননি। না, না, খবরের কাগজওলাদের দেওয়ার মতো নতুন কোনও খবর ওর কাছে ছিল না। তবে লোকটা ভীষণ ধাক্কা খেয়েছিল। তারপরই তো ওর স্ট্রোক মতন হল। তখন মিস্টার সেনগুপ্ত ওকে টাকাকড়ি দিয়ে কাছাকাছি একটা চাকরিতে লাগিয়ে দেন। তারপর…দেখবেন, চৌকাঠে হোঁচট খাবেন না যেন। এইখান থেকেই শুরু হল অন্দরমহল। একটু দাঁড়ান, হ্যারিকেনটা জ্বেলে নিই। মাঝে-মাঝে সন্ধের পর আমি এদিকটায় আসি, তাই একটা হ্যারিকেন সবসময়েই এই দরজার পাশটায় রাখা থাকে। কী বললেন? কেন আসি? হুঁঃ—সে একমাত্র ঈশ্বরই জানেন! কেমন যেন নেশার মতো হয়ে গেছে।…দেশলাই আছে আপনার কাছে? আমারটা দেখছি একেবারে খালি! হ্যাঁ, এই—ই—ব্যস! নিন, এবার চলুন—।

আরে, ভয় পেলেন নাকি? হ্যাঁ, তা ভয় পাওয়ারই কথা। যেভাবে মূর্তিটা বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে, দেখে একেবারে জীবন্ত বলে মনে হয়। বর্শার ফলাটা দেখেছেন? একটু বাঁকানো। কেমন যেন অদ্ভুতরকমের, তাই না? কেন বানানো হয়েছিল মূর্তিটা? কী করে জানব বলুন! সবই রাজা-বাদশাদের খেয়াল। তবে মনে হয়, অন্দরমহলের যাদের ঢোকার হুকুম নেই, তাদের সাবধান করে দেওয়ার জন্যেই এটাকে তৈরি করা হয়েছিল। তা যে জন্যেই তৈরি হয়ে থাকুক, বাচ্চারা কিন্তু এটা দেখে ভীষণ মজা পায়। সত্যি কথা বলতে কী, যখন সব ট্যুরিস্টদের ফোর্ট দেখানো শেষ করে আমি সন্ধের পর জায়গাটা টহল দিতে বেরোই, তখন এই বাঁকানো ফলার বর্শাটা আমার সঙ্গে নিই। ওটাকে আমার কেমন বন্ধু বলে ভাবতে ভালো লাগে। এক হাতে হ্যারিকেন, এক হাতে বর্শা নিয়ে যখন মহল থেকে মহলে ঘুরে বেড়াই, তখন আমার নিজেকেই ১৭০০ সালের প্রেত বলে মনে হয়। অন্ধকারে এই জায়গাটা যেন ধীরে-ধীরে জেগে ওঠে। যদি আপনার আপত্তি না থাকে, স্যার, তা হলে বর্শাটা আমি সঙ্গে নিচ্ছি। দেখেছেন তো, এতদিনের জিনিস হলেও এখনও কেমন ঝকঝক করছে! আসলে আমিই এটাকে শান দিয়ে পালিশ করে নতুনের মতো করে রেখেছি—এইজন্যেই মূর্তিটার টান বাচ্চাদের কাছে অনেক বেড়ে গেছে।

…হ্যাঁ, এটাই সেই অভিশপ্ত কুয়ো। সেই ঘটনার পরই এই লোহার ঢাকনাটা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপনার নিশ্চয়ই ভেতরটা দেখতে ইচ্ছে করছে? কী বলছেন, আমার আপত্তি না থাকলে? না, না, আমার আবার আপত্তি কীসের! দেখানোটাই যে আমার কাজ। ওই তো, ঢাকনার মধ্যিখানে যে-আংটাটা লাগানো রয়েছে, এই বর্শার হাতলটা ওর ফাঁকে ঢুকিয়ে চাড় দিলে ঢাকনাটা সহজেই খুলে যাবে। তা ছাড়া এটা খোলা আমার অভ্যেস আছে…এই নিন, এবার দেখুন…।

দেখছেন, কুয়োর ভেতরের গা বেয়ে জং ধরা লোহার সিঁড়ি কেমন খাড়া নেমে গেছে? আগেকার দিনে এইরকম সিঁড়ি খুব ব্যবহার করা হত।…এই সিঁড়ি বেয়েই তো ভেতরে নেমে গিয়েছিল তিতিরের স্বামী। তুলে এনেছিল কচি বউয়ের ডেডবডি। ভাবা যায় না, তাই না? কিন্তু লোকটা বুঝতে পেরেছিল, ওর জন্যেই ওর বউ সুইসাইড করেছে। সেইজন্যেই হয়তো ওইরকম সাহসের কাজ করতে পেরেছিল।

তিতিরের স্বামীর খবর জিগ্যেস করছেন? কেন, শোনেননি আপনি? ওই ঘটনার পর সে পাগল হয়ে যায়। তখন তাকে পাঠানো হয় পাগলা-গারদে। এখনও সে সেইখানেই খাঁচায় বসে আছে।

যদ্দুর আমি শুনেছি, মেয়েটা অনেকদিন ধরেই স্বামীর আড়ালে ওইসব লটরপটর চালিয়ে যাচ্ছিল—বুঝতেই তো পারছেন…। তারপর একদিন যখন মেয়েটা বুঝল, ওর পেটে বাচ্চা এসেছে, তখন ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল। এত খোলামেলা ভালোবাসার জন্যে নিজেকেই শাপশাপান্ত করতে লাগল। তখন একদিন ও গেল ওর ভালোবাসার লোকের কাছে; জানতে চাইল, এখন ও কী করবে—।’

এবং লোকটা ওকে বোকার মতো কথা বলতে বারণ করল। বলল, এর মধ্যে করাকরির কী আছে? ওর তো জলজ্যান্ত স্বামীদেবতা রয়েছে একটা; তা হলে আবার ভয় কীসের! শুধু ওকে যা করতে হবে, তা হল মুখে কুলুপ এঁটে চুপচাপ বসে থাকা। ব্যস!

কিন্তু সে বুঝল, তার প্রস্তাবটা তিতিরের পছন্দ হয়নি। নিজের স্বামীকে ঠকিয়ে বাচ্চার দায় তার ওপর চাপিয়ে দেওয়াটা ওর মোটেই ভালো লাগছে না। তিতির চেয়েছিল, সেই বিপদের সময় সে এসে ওর পাশে দাঁড়াক; চেয়েছিল, পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে; চেয়েছিল, নিজের স্বামীকে আবার আগের মতো ফিরে পেতে। কারণ, আমার মনে হয়, মেয়েটা ওর স্বামীকে সত্যিই প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত; শুধু ওই লোকটার চটকের কাছে ওর ভালো-মন্দ জ্ঞান কদিনের জন্যে গুলিয়ে গিয়েছিল…।

যাকগে, সে-কথা থাক, আসল কথায় ফিরে আসি। তারপর সেই লাভার ওকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। বলল, কিছুদিন তাকে ভাবার সময় দেওয়া হোক। তারপর তারা এ নিয়ে আবার আলোচনা করবে; দেখবে, কী করা যায়। এবং পরদিন তিতিরকে রেখে সে গ্রাম ছেড়ে সটকে পড়ল—জানি না কোথায়।

না, স্যার, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি তো তখন এখানে ছিলাম না, তাই সব কিছু ঠিক-ঠিক জানাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি শুধু কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা আপনাকে বলছিলাম। হয়তো আসলে ঘটনাটাই ছিল অন্যরকম। না, আপনার কথামতন, মিস্টার সেনগুপ্তই যদি সেই লোক হন, তা হলে তিনি পালাননি—গ্রামেই ছিলেন এবং তাঁকে নিয়ে যথারীতি জঘন্য কাদা ছোড়াছুড়িও হয়েছিল। কিন্তু এখন শুধু আমি নয়, গ্রামের আরও অনেক লোকের ধারণা, মিস্টার সেনগুপ্ত হয়তো সত্যিই নির্দোষ ছিলেন।

যাই হোক, মেয়েটা ওর স্বামীর কাছে গিয়ে সরাসরি সব ঘটনা খুলে বলল—শুধু তার নামটুকু ছাড়া—সে-নাম ও কাউকেই বলেনি। সব শুনে সে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। তা হওয়ারই কথা; কারণ, লোকে বলে, সে নাকি বউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করত, ভীষণ ভালোবাসত ওকে। শুনেছি, তিতিরকে ওই ঘটনার জন্যে সে কোনওরকম বকাঝকা করেনি। শুধু শান্ত নির্বাকভাবে মেয়েটার অবাক চোখের সামনে আস্তে-আস্তে বেরিয়ে গিয়েছিল। এবং যখন জলভরা চোখ নিয়ে মেয়েটা তাকে অনুসরণ করল, পা জড়িয়ে ধরল, তখন সে আর সইতে পারেনি—ঘুরে দাঁড়িয়ে এক চড় মেরেছিল বউয়ের গালে। নিজের কষ্ট-পাওয়া মনের অবস্থাটা সে আর চাপতে পারেনি। বলেছিল, শেষ পর্যন্ত এই আমার পাওনা ছিল?

হ্যাঁ, স্যার, আপনার কথা আমি অস্বীকার করছি না। আমি একটু সিনেমা-টিনেমা দেখতে ভালোবাসি। নইলে বানিয়ে-বানিয়ে ছবির মতো সব বলছি কী করে! আপনি তো জানেন, গাইডদের একটু-আধটু গল্প বানানোর ক্ষমতা না-থাকলে চলে না। তা ছাড়া, আপনি যদি আমার মতো দিনের-পর-দিন, একা, এই নির্জন নিঝঝুম দুর্গে ঘুরে বেড়াতেন, তা হলে আপনিও সমস্ত কিছু ছবির মতো দেখতে পেতেন। জানেন, মাঝে-মাঝে রাতের দিকে আমি ওদের স্পষ্ট দেখতে পাই! হয়তো আমার মনের ভুল। আর কিছু না হোক, বয়েস তো হয়েছে।

জানেন, আমার মনে হয়, এটুকুও সেই অবুঝ মেয়েটার বোঝার ক্ষমতা ছিল না যে, কত দুঃখে, কত হতাশায়, ওর স্বামী ওর গায়ে হাত তুলেছে। ও ভাবল, এই বোধহয় ওদের সম্পর্কের শেষ। আর সে যদি ওকে ছেড়ে চলে যায়, তা হলে জীবনে আর রইল কী! তাই তিতির পারল না অপেক্ষা করতে, পারল না সে আঘাত সইতে, পারল না আশায় বুক বাঁধতে। ও দিশেহারা হয়ে ছুটে এল এই পোড়ো দুর্গে…বুক-ভরা কান্না নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কুয়োর ভেতরে।

তারপর মাত্র পাঁচমিনিট—তার বেশি নয়। সে ফিরে এল ছুটতে-ছুটতে। পাগলের মতো ডাকতে লাগল বউয়ের নাম ধরে—কিন্তু তখন বড় দেরি হয়ে গেছে। যখন সে ওকে কুয়োর ভেতর থেকে তুলে আনল, তখন ও মারা গেছে। ওর একরাশ কালো চুল ভিজে লেপটে রয়েছে মুখের ওপর, সুন্দর উজ্জ্বল কটা চোখজোড়ায় জমে রয়েছে কাদা। তিতিরের বডিটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে ওর স্বামী কান্নায় ভেঙে পড়েছিল।

…ঠিক এইখানটায়, সেখানে এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি। তারপর থেকেই এই ভারী লোহার ঢাকনাটা লাগিয়ে দেওয়া হল কুয়োর মুখে। যাতে সহজে কেউ এটাকে খুলতে না-পারে—শুধু আমি ছাড়া।

কেউ জানে না, এ-কুয়ো কত গভীর। দাঁড়ান, আলোটা আর-একটু তুলে ধরি। নিন, এবার ভালো করে দেখুন। সহ্যের শেষ সীমায় না-পৌঁছলে কোনও মেয়ে কখনও এভাবে প্রাণ দিতে পারে? আপনিই বলুন?

(তিতু—আমার তিতু, সোনামণি, তুই কোথায়?)

না, স্যার, আমি তো কিছু বলিনি। বরং আমার মনে হল, আপনি বোধহয় কিছু বলতে চাইছেন। দাঁড়ান, একমিনিট…।

কী করছি জিগ্যেস করছেন? চাবিটা ঘুরিয়ে দেখছি, তালাটা ঠিকমতো কাজ করছে কি না। এখন তো সব মহলের দরজাতেই চাবি লাগাতে হবে, তাই একবার দেখে নিলাম, যাতে পরে ভুল না-হয়। জানেনই তো, মিস্টার সেনগুপ্ত এই ঘরটা সবসময় বন্ধ করে রাখারই পক্ষপাতী। গত তিনবছরে এ-ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ কখনও আসেনি—অন্তত আজ রাতের আগে। আর আমার মনে হয়, আগামী তিনবছরেও এ-ঘরে কেউ আসবে না; আর যদিও-বা আসে, কুয়োর ঢাকনাটা নিশ্চয়ই কেউ খুলে দেখবে না, কী বলেন? এই সমস্ত মহলের দেখাশোনা আমি নিজেই করি। এ ছাড়া সবকিছু ঝকঝকে তকতকে রাখতে আমি ভীষণ ভালোবাসি—দেখুন না, এই বর্শাটাই দেখুন! কেমন নতুনের মতো ঝকঝক করছে! ফলাটা দেখেছেন, কীরকম ধারালো!

ওঃ, কিছু মনে করবেন না, স্যার, আপনার লাগল নাকি?

পাগল বলছেন, স্যার? না, স্যার, আমি পাগল নই। পাগল তো ছিল তিতিরের স্বামী, এর মধ্যেই ভুলে গেলেন? সে তো এখন বন্দি রয়েছে পাগলা-গারদে। আমার শুধু সামান্য স্ট্রোকমতন হয়েছিল—তাও বছরদশেক আগে। তাতে আমার শরীরের তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি। মিস্টার সেনগুপ্ত কিছু টাকা দিয়ে আমাকে হালকা কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন বটে, কিন্তু এখনও আমার গায়ের জোর দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। সেইজন্যেই বলছি, আমি হলে এই মুহূর্তে এই বর্শাকে ঠেকানোর কথা চিন্তাও করতাম না, স্যার। তাতে আপনার ভালোর চেয়ে খারাপই হবে।

জানেন স্যার, বেশি জানাটাই অনেক সময় মানুষের বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। তিতু সরকার, তাই না? ওই নামটাই তো প্রথমে বলেছেন আপনি? কিন্তু, স্যার, আপনি কি জানেন, মেয়েটার নাম ছিল সুবর্ণা সরকার। ওই নামটাই ছাপা হয়েছিল সব খবরের কাগজে। তিতির ছিল ওর ডাক নাম। তবে চেনাশোনা লোক আর রিলেটিভরা ওকে তিতির নামেই ডাকত। আর আমার কাছে, হয়তো ওর স্বামীর কাছে, হয়তো আরও একজনের কাছে ওর আদরের নাম ছিল তিতু। আর তা ছাড়া, আপনি কী করে জানলেন যে, ওর চোখ ছিল একটু কটা—কালো নয়? রিপোর্টাররা যখন এখানে আসে, তখন ওর চোখজোড়া বোঝাই ছিল। কিন্তু ওর সেই ভালোবাসার লোক জানত।

হ্যাঁ, স্যার, এখন আমি আপনাকে বেশ চিনতে পারছি। সেই সময় আপনি মিস্টার সেনগুপ্তের কাছে প্রায়ই আসতেন— দরকার ছাড়াও আসতেন। হয়তো তিতুর জন্যেই আসতেন। তিতিরের ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আমার কিছু বোঝাপড়া বাকি আছে। ওর স্বামী এখানে থাকলে ভালোই হত—তা হলে আসরটা বেশ জমত, হয়তো বেচারার পাগলামো কিছুটা সারত। যাক, সে যখন নেই, তখন মিছিমিছি তার কথা ভেবে লাভ কী! আসুন, এবার কাজের কথায় আসা যাক…।

ভাবতে অবাক লাগে, তাই না? ভালোভাবে চিন্তা করতে গেলে একে নিয়তির খেলা অথবা ঈশ্বরের লীলা ছাড়া আর কী-ই-বা বলবেন? কে জানত, আপনি এইভাবে, একা পায়ে হেঁটে এখানে আসবেন! এবং এই বর্শা আর চাবিটা আমি বাজি রাখতে পারি যে,—এ দুটো জিনিস আমার কাছে যে কত দামি, তা কি এখনও আপনাকে খুলে বলতে হবে, স্যার?—আপনি কোথায় যাচ্ছেন সে-কথা কাকপক্ষীকেও বলে আসেননি। অথচ এ-জায়গা ছেড়ে চলে যেতেও আপনি পারেননি। হয়তো তিতু আপনাকে দিনের-পর-দিন নিশির ডাকের মতো টেনেছে। আর আমার মনে হয়, আপনি বা আমি কেউই কোনওদিন বুঝতে পারব না, এখানে আসার পেছনে আপনার আসল কারণটা কী।

আপনি কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন, তিতুর বুড়ো বাপ আজ আটটা বছর ধরে শুধু আপনারই অপেক্ষা করেছে? সুতরাং, আমার বিশ্বাস, আমার ইচ্ছেই আজ আপনাকে টেনে নিয়ে এসেছে এই নরকের দরজায়…।

উঁহু, আমি হলে কিন্তু এরকম করে মোটেই চিৎকার করতাম না, স্যার। তাতে শুধু-শুধু আপনার শরীরেরই ক্ষতি হবে। কারণ জানেনই তো, এখানে আপনার চিৎকার শোনার লোক এক আমি ছাড়া আর কেউই নেই। আর আগেই তো আপনাকে বলেছি, এখানকার দেওয়ালগুলো ভীষণ মোটা। বিশ্বাস করুন, সত্যিকারের পাথরের তৈরি—একটুও বাড়িয়ে বলছি না…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *