1 of 2

ছলাবউ কলাবউ

ছলাবউ কলাবউ

সত্যি বলছি স্যার, বউটা আমার যাকে বলে একেবারে স্পেশাল ছিল। ‘ছিল’ মানে পাস্ট টেন্স। আমাদের ভগবান লোকটা বড় মজার। একদিনের মধ্যে আমার ডাগর সোমত্ত বউটাকে প্রেজেন্ট টেন্স থেকে পাস্ট টেন্স করে দিল। কী বললেন? না, স্যার—সত্যি বলছি—আপন গড, ঋতুপর্ণাকে আমি খুন তো দূরের কথা, ছুঁইনি পর্যন্ত। ছুঁইনি মানে ক্ষতি করার জন্যে ছুঁইনি। ওই আদর-টাদর করার সময় ছুঁতে হয়েছে। না ছুঁয়ে আবার আদর করা যায় না কি!

দুঃখের কথা কী জানেন? বউটা স্বর্গলোকে গিয়েও আমাকে রেহাই দিল না। ওর জন্যেই আমাকে আপনাদের এই থানায় আসতে হল—থানা দেখতে হল, আবার শ্মশানও দেখতে হবে। সবই আমার কপাল!

ঋতুপর্ণা ছিল ভারি অদ্ভুত। প্রবল ঋতুমতী। পুরুষগুলো বোধহয় ওর গন্ধ পেত। সবসময় ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করত। তবে ও বেশিরভাগ সময়েই লোকগুলোকে পাত্তা দিত না। অবশ্য ওদের একেবারে বিদেয় করতেও চাইত না। কারণ, ওরা চলে গেলেই তো ঋতুর বাজারদর পড়ে যাবে।

যখন ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হয় তখন আমাদের মা-বাবা আত্মীয়-স্বজন সবাই ভেবেছিল, কোষ্ঠীর ছকের কী দারুণ মিল। বিয়ে তো নয়, যেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। বিয়ের পরে-পরেই আমার বিধবা পিসিমা ঋতুকে আদর করে কাছে টেনে নিয়ে বলেছিল, আহা, বউ তো নয়, কলাবউ!

শুনে আমি তো স্যার বেশ তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম। দুগগাপুজোর সময় কলাবউ দেখে আসছি সেই বাচ্চা-বয়েস থেকে। তা কলাবউ বলতে লালপেড়ে সাদা শাড়ি আর একহাত ঘোমটা—শুধু এইটুকুই বুঝি। কাপড় খুললে তো স্রেফ কলাগাছ! ঋতুর সঙ্গে কলাবউয়ের মিলটা কোথায় কে জানে!

তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে-সঙ্গে হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছি ঋতুপর্ণা কী জিনিস। সত্যি, আমার পিসিমা জ্যোতিষী ছিলেন, স্যার। ঋতু তো শুধু কলাবউ ছিল না—একেবারে ছলাবউ কলাবউ। এত ছলাকলা জানে—মানে, জানত। ওরও সেই আধহাত ঘোমটা দেওয়ার অভ্যেস ছিল—গুরুজন বা বাইরের লোকের সামনে—ঠিক যেন কলাবউ। কিন্তু ওই ঋতুই আবার আধহাত ঘোমটার নীচে সাতহাত খ্যামটা নাচত। আর কাপড় খুললে কলাবউয়ের মতো শুধু কলাগাছ তো নয়, একজোড়া মোচা তার সঙ্গে ফ্রি।

তবে ওই মোচাই সার—কলাটলা কখনও হয়নি। সে ওর জন্যে, না আমার জন্যে, তা জানি না। আমার কলাবউ নামেই কলাবউ—ফলের বেলায় কাঁচকলা। কিন্তু স্যার তা নিয়ে কোনও দুঃখ ছিল না আমার। শুধু মাথার ভেতরে মাঝে-মাঝে আগুন জ্বলে উঠত। ঋতুর কাণ্ডকারখানা দেখতাম, একা-একা ঘরময় ঘুরে বেড়াতাম, আর মাথার ভেতর দুনিয়াটা চড়চড় করে জ্বলত, পুড়ত।

এই করে স্যার দশটা বচ্ছর কাটল—দশটা বচ্ছর! আমি অফিস যাই, ফিরে আসি। ঋতু ওর বন্ধুবান্ধব নিয়ে থাকে, আমাকে যেন স্পষ্ট করে দেখতেই পায় না। শুধু মাঝে-মাঝে মাঝরাতে কলাগাছে জ্বালা ধরলে আমার হাত ধরে টানাটানি করে, আঁচড়ে-কামড়ে দেয়। শাস্ত্র আমাদের মিথ্যে বলেনি, ইন্সপেক্টরসাহেব। ঋতু ছিল একেবারে হস্তিনী টাইপের। আর হাতির সঙ্গে কলাগাছের রিলেশান তো সব্বাই জানে।

তো একদিন—তা কতদিন হবে? বোধহয় বছরখানেক আগে—ঋতু বাড়ি ফিরল টিপসি হয়ে। আমি দরজা খুলতেই আমাকে ‘ডার্লিং’ বলে একেবারে জাপটে ধরে ‘চকাৎ’ ‘চকাৎ’ করে হাফডজন চুমু খেল। আমার ভীষণ ঘেন্না করছিল, গা রি-রি করছিল। আর মাথার ভেতরে ধুনিটা তখনও জ্বলছিল।

হঠাৎ করে কী যে হয়ে গেল! সেই ধুনিটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। আগুনের লাল জিভগুলো লকলকিয়ে উঠল। এক ধাক্কা দিয়ে ছিটকে দিলাম ঋতুকে। সত্যি বলছি, ইচ্ছে করছিল তক্ষুনি গলা টিপে ওকে খতম করে দিই। কিন্তু না। আমি নির্বিরোধী ছাপোষা মানুষ। কাউকে খুন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, স্যার। যদি আমিই ঋতুকে কাল রাতে খুন করেছি বলে আপনি ভেবে থাকেন, তবে সেদিনই তো ওকে আমি খতম করে দিতে পারতাম। সত্যি বলছি স্যার, খুনের কথা শুনলেই আমার গা গুলিয়ে ওঠে। তাই সেদিন ঋতুকে কিচ্ছু বলিনি। বড়লোকের ইংরেজি-জানা ফুরতি-ফারতা বাঁজা বউ পার্টি-ফার্টি করে একটু-আধটু মাল খেয়ে ফিরবে এ আর আশ্চর্য কী!

না, ওকে কিছু বলিনি। তবে ওই যে বললাম, মাথার ভেতরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছিল। তাই সেটা নেভানোর জন্যে অন্য একটা কেলেঙ্কারি করে ফেললাম। তার জন্যে মার্জনা চাইছি, স্যার।

হ্যাঁ—হ্যাঁ, বলছি। আমরা—মানে, আমি আর ঋতু—দু-জোড়া বদরি পাখি পুষতাম। না, এখন আর একটাও নেই—সব কটা মরে গেছে। শুধু হা-হা খাঁচাটা পড়ে আছে। তো সেদিন রাতে মুরগির মাংস রান্না করেছিল অতসী—আমাদের রান্নার লোক। ডাইনিং-টেবিলে সুন্দর করে সাজানো ছিল রাতের খাবার। একটা গোলাপি রঙের কারুকাজ করা বড় চিনেমাটির বাটিতে ঢাকা দেওয়া ছিল গরম মুরগির ঝোল। কী বলছেন? মুরগির মাংসের সঙ্গে বদরি পাখির কী রিলেশান? আছে, আছে—আর-একটু বললেই বুঝতে পারবেন।

ঋতুর ওই কাণ্ডের পর আমার মাথার ভেতর কী যেন একটা হয়ে গেল। টেবিল থেকে গরম মাংসের পাত্রটা তুলে নিয়ে চলে গেলাম একটু দূরে, ঘরের এককোণে রাখা বদরি পাখির খাঁচার কাছে। মাংসসমেত গরম ঝোল হুড়হুড় করে ঢেকে দিলাম মাখনরঙের পাখিগুলোর গায়ে। তারপর চিনেমাটির পাত্রটা ধরে মেঝেতে এক আছাড়।

পাখিগুলো কিচিরমিচির করে ছটফটিয়ে উঠল। দুটো পাখি গরম মাংসের ঝোলে স্নান করে নেতিয়ে পড়ল। আর ঋতু ওই টিপসি অবস্থাতেই এক চিৎকার দিয়ে উঠল।

আমি কিন্তু ওকে একটি কথাও বলিনি।

ওর চিৎকারে যখন সামনের ফ্ল্যাটের বনমালীবাবু আর তাঁর হোঁতকা স্ত্রী ছুটে এলেন আমাদের ফ্ল্যাটের দরজায়, তখন আমি বললাম যে, অসাবধানে আমার হাত থেকে মাংসের পাত্রটা পাখির খাঁচার ওপরে পড়ে গেছে। আর ঋতু তো একটু নার্ভাস টাইপের, তাই…।

ওঁরা ভদ্রতা দেখিয়ে দু-চারটে কথা বলে চলে গেলেন।

ব্যস, সেদিন থেকেই আমার প্রতিবাদের শুরু। তবে সবসময় যে ভেবেটেবে কিছু করতাম তা নয়। যেমন একদিন হঠাৎ করে কী খেয়াল চাপল, বাজার থেকে একটা জ্যান্ত মুরগি কিনে নিয়ে এলাম। ওটা দেখে ঋতু ঠাট্টা করে বলল, কী ব্যাপার, বাড়িতে কি পোলট্রি খুলবে নাকি? আমি কোনও জবাব না-দিয়ে শুধু হাসলাম।

তারপর, সেদিন রাতে, মুরগিটাকে আমাদের শোওয়ার ঘরের ড্রেসিং-টেবিলের পায়ার সঙ্গে একটা হাতচারেক লম্বা দড়ি দিয়ে বাঁধলাম। ওটা ঘরের মেঝেতে দিব্যি চরে বেড়াতে লাগল। ব্যাপার-স্যাপার দেখে ঋতু তো রেগে আগুন। বলল, এসব কী পাগলামি শুরু করেছ! আমি বললাম, হানি, আসল পাগলামি তো এখনও শুরু হয়নি। দ্যাখো না, কীরকম মজা হবে। ও হ্যাঁ, আজ ডক্টর আহুজার পার্টি কেমন জমল? ঋতু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের নীচে কী একটা মোলায়েম মলম মাখতে-মাখতে বলল, ইট ওয়াজ আ ফিয়াসকো। একদম গুবলেট।

ওর সঙ্গে কথা বলতে-বলতে আমি যে ঝুঁকে পড়ে খাটের তলা থেকে আমার হকিস্টিকটা বের করে নিয়েছি, সেটা ও প্রথমে ঠিক খেয়াল করেনি। ছেলেবেলায় এই হকিস্টিকটা নিয়ে আমি স্কুলের মাঠে হকি খেলতাম।

তো হকিস্টিকটা আমার হাতে দেখে ঋতু মলম লাগানো বন্ধ করে আয়নার মধ্যে দিয়ে চোখ বড়-বড় করে আমার দিকে তাকাল। বুঝলাম, আমার হকিস্টিক বাগিয়ে ধরার জঙ্গি ভঙ্গি দেখে ও ভয় পেয়েছে।

না, না, ইন্সপেক্টরসাহেব, হকিস্টিক দিয়ে ওকে একটুও মারিনি। আপনিও ঠিক ঋতুর মতোই আমাকে ভুল বুঝলেন। ঋতুকে অবাক করে দিয়ে আমি হকিস্টিক চালাতে শুরু করলাম মুরগিটার ওপরে।

ওটা ডানা ঝাপটে ‘কঁক-কঁক’ শব্দ করে এদিক-ওদিক পালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু পালাবে কোথায়! পায়ে তো দড়ি বাঁধা! প্রথম দুটো হিট আমি মিস করলাম, তবে তিন নম্বরটা সোজা গিয়ে লাগল মুরগিটার পাঁজরে। একটা ‘ওঁক’ শব্দ করে ওটা ছিটকে গেল শূন্যে, কিন্তু দড়িতে টান পড়তেই মুখ থুবড়ে পড়ল মেঝেতে। আর তখন আমি ঋতুর চোখের সামনেই ওটাকে পাগলের মতো পিটতে শুরু করলাম—যেমন করে ধোপারা মুগুর দিয়ে কাপড় কাচে।

ঘরের মেঝেটা একেবারে যা-তা হয়ে গেল। পালক, রক্ত, মাংস, চটচটে নোংরা—সব একেবারে মাখামাখি। আমার মাথার ভেতরে বিকট স্বরে কতকগুলো দাঁড়কাক ডাকছিল। সেইজন্যেই বোধহয় ঋতুর চিৎকার আমি শুনতে পাইনি। আমি ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে লেপটে বসে পড়েছিলাম। অল্প-অল্প হাঁফাচ্ছিলাম। হকিস্টিকটা তখনও হাতে ধরা। সেই অবস্থায় কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আমি ঋতুর দিকে তাকালাম।

ওর মুখচোখ ফ্যাকাসে। বয়েসটা যে ভালো জায়গায় নেই তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ও অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।

একটু পরে ও গালিগালাজের তুবড়ি ছোটাল। আমি যে একটা পাগল, জানোয়ার, অমানুষ—সে-সব বিস্তারিতভাবে আমাকে জানাল। অনেকক্ষণ ধরে ওর মুখ চলল। তারপর যখন বলল, আমাকে পুলিশে দেবে, তখন আমি হেসে বললাম, ডার্লিং, মুরগিটার বদলে যদি তোমার এই হাল করতাম, তবে তুমি—বা অন্য কেউ—পুলিশ ডেকে আমাকে ধরিয়ে দিতে পারতে! মুরগি পিটিয়ে মারলে সেটা দোষের নয়।

আপনিই বলুন, স্যার, আমি কি ভুল বলেছি?

ঋতু সে-রাতে অনেক চিৎকার-চেঁচামেচি করেছিল, যা-নয়-তাই বলে গালিগালাজ করেছিল আমাকে, কিন্তু আমি একটি কথাও বলিনি।

ঘরটা পরিষ্কার করার সময় আঁশটে গন্ধে ঋতু বমি করে ফেলেছিল। আমি তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের চাঁদ-তারা দেখছি, আর ছেলেবেলার কথা ভাবছি।

এখন তো বুঝতেই পারছেন, ইন্সপেক্টরসাহেব, খুন করার হলে সেদিনই ওকে আমি খুন করে ফেলতাম। কিন্তু আপনাকে তো বারবার বলেছি, ঋতুর গায়ে কোনওদিন একটা আঁচড় পর্যন্ত আমি কাটিনি। যা কিছু আঁচড় কেটেছি সবই নিজের গায়ে।

তো এমনি করেই চলতে লাগল। আমি যখন খুশি নিজের গায়ে আঁচড় কাটি, আর ঋতু দ্যাখে। আর তখন থেকেই একটু-একটু করে ও পালটাতে শুরু করেছিল। না, না—ওর পার্টি-ফার্টি ছাড়েনি। পালটাতে শুরু করেছিল মানে আমার সঙ্গে কম কথা বলত। এমনকী মাঝে-মাঝে যে গলা ছেড়ে গান গাইত, সে-ও বন্ধ হয়ে গেল, স্যার।

কী বললেন? আমি আর কী করেছিলাম? দাঁড়ান, বলছি! একগ্লাস জল খাওয়াবেন? ওঃ—এবার শুকনো গলাটা একটু জুড়োল। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, একদিন রাতে—সেদিন ঋতু বাড়ি থেকে বেরোয়নি—ও বিছানায় বসে কী একটা ইংরাজি বই পড়ছিল। ওর কোন এক রীতেনদা আছে—সে নাকি ওকে বইটা পড়তে দিয়েছে। দারুণ বই নাকি। এরকম যে ওর কত ‘দাদা’ আছে!

আমি ঋতুকে জিগ্যেস করলাম, রাতে কী-কী আছে। মানে, অতসী কী-কী রান্না করেছে। বিয়ের পর প্রথম-প্রথম এরকম প্রশ্ন করলে ঋতু বলত, তুমি কী-কী খাবে বলো। ভাত আছে, ডাল, ইলিশমাছ ভাজা—আর আমি। তখন স্যার আমার রাতের খাওয়া-দাওয়ার লিস্টে লাস্ট আইটেম ছিল ঋতু। ওরও তাই। খাওয়া-দাওয়ার পর ওরকম খাওয়া-খাওয়ি চলত। তবে ব্যাপারটাকে ওরাল সেক্স ভাববেন না, স্যার। বরং প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল মরাল সেক্স।

তো সেদিন ও কী-কী বলেছিল আমার মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, লাস্ট আইটেমটা বাদ ছিল।

রাতে খেতে বসেছি, এমনসময় একটা ফোন এল। ঋতু উঠে গিয়ে ফোন ধরল। রীতেনদার ফোন। বইটা কেমন লাগছে? হি-হি-হি-হি। বলেছিলাম না, দারুণ। খুব ডিপ ব্যাপার। আপনিও তো খুব ডিপ মানুষ, রীতেনদা। তো দশ মিনিট ধরে দুজনে মিলে হা-হা-হি-হি করে এইরকম ডেপথ চর্চা চলতে লাগল।

ব্যস। আবার সেই ধুনির আগুন জ্বলে উঠল আমার মাথায়। দাঁড়কাক ডাকতে লাগল ‘কা-কা’ করে। ঋতু ফোন সেরে খাওয়ার টেবিলে ফিরে আসতেই আমি বললাম, এসব খেতে আর ভালো লাগছে না। ও অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে? আমি বললাম, মাংস খেতে ইচ্ছে করছে। ঋতু একইরকম চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, এখন মাংস কোথায় পাব!

ব্যস। আমি চোখে পলকে আমার বাঁ-হাতে এক হিংস্র কামড় বসিয়ে দিলাম। সে যে কী অসহ্য যন্ত্রণা কী বলব, ইন্সপেক্টরসাহেব! কিন্তু আমি কামড় ছাড়িনি। আমার হাতটাকে বোধহয় ঋতুর গলা কিংবা রীতেনের ঘাড় ভেবেছিলাম। আমার মুখ দিয়ে ‘গোঁ-গোঁ’ শব্দ বেরোচ্ছিল। মাথার সবকটা শিরা ছিঁড়ে পড়তে চাইছিল বারবার। তবুও আমি কামড় ছাড়িনি। শেষ পর্যন্ত একটুকরো মাংস ছিঁড়ে এল হাত থেকে। আর একেবারে যাচ্ছেতাই রক্তারক্তি কাণ্ড। আমি মেঝেতে পড়ে গলাকাটা ছাগলের মতো ছটফট করতে লাগলাম আর চিৎকার করতে লাগলাম। ঋতুও চিৎকার করছিল। তারপর ঠিক কী হয়েছে জানি না। আমি তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম, তাই।

এরপর বেশ কিছুদিন ধরে আমার চিকিৎসা চলল। ঋতু দু-তিনরকম ডাক্তার ডেকে নিয়ে এল আমার জন্যে। তার মধ্যে একজন তো স্রেফ ঘুমের ইঞ্জেকশান দিয়ে চলে যেত, আর কাঁড়িকাঁড়ি প্রশ্ন করত। কিছু মনে করবেন না—ঠিক আপনাদের পুলিশি জেরার মতো। তবে ভীষণ উলটোপালটা প্রশ্ন। যেমন, ছোটবেলায় আমি চুপচাপ থাকতাম কিনা। প্রথম ‘ইয়ে’ শুরু করেছি কত বছর বয়েসে। লাল রং পছন্দ করি কি না। একা-একা থাকতে ভালো লাগে, না খারাপ লাগে। এইসব ফালতু প্রশ্ন। আপনিই বলুন, কোনও মানে হয়!

ঋতু একটু-একটু করে মনমরা হয়ে যাচ্ছিল। বাইরে বেরোনোটাও বেশ কমিয়ে দিল। আগের চেয়ে বেশি খেয়াল রাখতে লাগল আমার।

কী বললেন? ঋতুকে ডিভোর্স করিনি কেন? ডিভোর্স করা মানে তো হেরে যাওয়া। আমার মা আমাকে কখনও হারতে শেখায়নি। আর ঋতু আমাকে ছেড়ে চলে যায়নি কেন? হাসালেন। কী করে যাবে! আমার যে অনেক বিষয়-আশয়। টাকার লোভ বড় সাঙঘাতিক জিনিস, স্যার। অনেক মহান মানুষকে দেখেছি টাকার লোভের কাছে কাবু হয়ে যেতে। ঘরে তারা চুরি করে, কিন্তু বাইরের লোকের কাছে পরোপকারী, মহান সেজে ঘুরে বেড়ায়।

যাই হোক, এরপর তিনবার আমি ক্ষুর দিয়ে আমার বুকে-পেটে-পায়ে দাগ টেনেছি। কাটারি দিয়ে বাঁ-হাতের দুটো আঙুলের ডগা উড়িয়ে দিয়েছি। এই তো, দেখুন না। এই যে—এইসব সেলাই আর দাগ দেখছেন, এইগুলো। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, এসবই করেছি ঋতুর চোখের সামনে। না, কেন করেছি জানি না। হয়তো নিজেকে কষ্ট দিয়ে ওকে বদলাতে চেয়েছিলাম। নাকি ওকে ভয় দেখাতে চেয়েছি?

না, স্যার, অতশত ভেবে কিছু করিনি। তবে ওই যে বললাম, আমার মাথার ভেতরে একটা ধুনি জ্বলত সবসময়। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ঋতুকে আমি খুন করিনি। আমার যে কী অবস্থা তা আমি ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না, স্যার। আমি না-পারি মারতে, না-পারি মরতে। এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আমি শুধু ছটফট করেই গেলাম। আমি নিজেই যেন পায়ে দড়ি বাঁধা একটা মুরগি। ভগবানের মুরগি। আড়ালে থেকে কেউ যেন পাগলের মতো আমাকে হকিস্টিক দিয়ে পেটাচ্ছে…পেটাচ্ছে।

স্যার…স্যার…ঋতুকে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে। কোথায় রেখেছেন আমার বউকে? আমার কলাবউকে একবারটি দেখান না, স্যার। একটিবার ওর মরামুখ দেখতে না-পেলে আমি পাগল হয়ে যাব, একফোঁটা শান্তি পাব না। বিশ্বাস করুন, স্যার, সত্যি বলছি…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *