1 of 2

ছকের বাইরে (নভেলেট)

ছকের বাইরে (নভেলেট)

প্রাকবিবাহকালে ইলার প্রেমিকের সংখ্যা কত ছিল বিয়ের পর সে নিয়ে আমি একেবারেই মাথা ঘামাইনি। অবশ্য ইলাও যে আমার ভূতপূর্ব প্রেমিকার সংখ্যা নিয়ে গবেষণা করছে, এমন নয়। অথচ এই ব্ল্যাকমেল সংক্রান্ত ব্যাপারটা যে আমাদের অতীত জীবনের প্রেমিক-প্রেমিকাকে জড়িয়েই, তা বুঝতে আমার অসুবিধে হল না। তবুও বোকা-বোকা, ন্যাকা-ন্যাকা চোখ মেলে সামনে বসে থাকা শকুনটার দিকে তাকিয়ে আধো-আধো স্বরে বললাম, কই, আমি তো কিছু জানি না।

লোকটা একটু অপমানিত বোধ করল। রুমাল জড়িয়ে খড়গ নাকটাকে পাকড়ে ধরে সশব্দে নাক ঝাড়ল। তারপর কাচের মতো স্বচ্ছ দৃষ্টি মেলে ধরল আমার দিকে, তাই বুঝি?

এবার অপমানিত হওয়ার পালা আমার। কারণ, কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে ওর হাড়জিরজিরে হাতটা বাড়িয়ে আমার থুতনিটা ঈষৎ তুলে ধরেছে লোকটা।

একঝটকায় ওর হাত ছাড়িয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, কী, কী চান আপনি?

ট-এ আকার, ক-এ আকার—টাকা।—নিঃশব্দে হাসল লোকটা। বাইরে চুপ করে থাকলেও মনে-মনে পরিস্থিতির গুরুত্ব ওজন করলাম। একদিকে আমার সুনাম, সামাজিক মর্যাদা, আর অন্যদিকে টাকা, হয়তো বিশাল অঙ্কের টাকা। আর যদি এই অর্থপিশাচের কথার প্রতিবাদ করি তা হলে অনিবার্যভাবেই ও সব ফাঁস করে দেবে। রাস্তার লোকে আমার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে বেড়াবে, ওই যে বৎসগণ, যে-ব্যক্তিটি তোমাদের চর্মচক্ষুর সম্মুখ দিয়া ছন্দোময় পদবিক্ষেপে উত্তরদিক অভিমুখে চলিয়াছেন, তিনি একজন নিরীহ নাগরিকের বিবাহিতা স্ত্রীকে পুনরায় বিবাহ করিয়া উক্ত নাগরিককে বাধিত এবং দেশের জনসাধারণকে আহ্লাদিত করিয়াছেন। অতএব বৎসগণ…।

নাঃ, আর ভাবতে পারছি না। শেষে কি প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক শ্রীঅমিত সান্যাল মুখে চুনকালি মেখে সং-এর নাচ নাচবেন? অসম্ভব।

আপনার নামটা জানতে পারি?—শকুনমুখো লোকটার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলাম।

অবশ্যই। আমারই নাম প্রাণকান্ত সমাদ্দার।

মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল। জলে ভেসে থাকা নৌকোর মতো দুলে উঠল গোটা ঘরটা। কোনওরকমে উচ্চারণ করলাম, আপ—আপনিই?

আজ্ঞে হ্যাঁ।—সলজ্জ নম্র স্বরে উত্তর দিল প্রাণকান্ত সমাদ্দার, আমিই সেই হতভাগ্য, আপনার স্ত্রীর ভূতপূর্ব স্বামী। ইলার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আইনত ছেদ হয়েছে বলে আমার তো মনে পড়ে না।

বিয়ের পর ইলার অতীত ভুলে গিয়ে (সেইসঙ্গে আমার অতীতটাও ভুলেছিল ইলা) আমি ওকে মেনে নিয়েছিলাম। আরও প্রাঞ্জল করে বলতে গেলে আমরা পরস্পরকে গ্রহণ করেছিলাম দূর অস্ত সুখের প্রাসাদের পাসপোর্ট হিসেবে। তখন বুঝিনি ইলা প্রেম, ভালোবাসা ছাড়াও বিবাহজাতীয় একটা বিরক্তিকর জিনিস আগেভাগেই সেরে বসে আছে। জানলে কি আর ওই ভুল করি!

ইলাকে ভালোবাসার পর আমার জীবনে এসেছে সাফল্যের ঝাপটা। যে আমি রোজ নতুন জুতো কিনে পাবলিশারদের বাড়ি-বাড়ি ধরনা দিতাম, সেই আমাকেই চাকরি দিল বিখ্যাত বাংলা দৈনিক ‘চলাচল’। তাও আবার সাতশো টাকা মাইনের। সুতরাং ইলা সমাদ্দার আমার কাছে হয়ে দাঁড়াল জীবন্ত পরশপাথর। তার পরেই আমার কোন এক দূরসম্পর্কের কাকা না জ্যাঠা পরলোকগমন করে আমাকে করে দিয়ে গেল লাখপতি। জানি না ভদ্রলোক সুস্থ মস্তিষ্কে ছিলেন কি না। নইলে আপনারজন ছেড়ে একেবারে পরেরজন এই অধমকে কেনই-বা সব বিষয়সম্পত্তি দিয়ে যাওয়া!

আমার সেই স্বর্ণযুগের সময়েই ইলা হঠাৎ বলে বসেছিল, অমিত, আমাকে বিয়ে না করলে তোমার সঙ্গে আমার এই বোধহয় শেষ দেখা।

কারণ জিগ্যেস করায় বিষণ্ণ হাসি হেসে ইলা বলেছে, তোমার যা-যা পাওয়ার তা তো তুমি পেয়েই গেছ, আমাকে আর কী দরকার? কিন্তু সেটা তো আমি মুখ ফুটে বলতে পারি না। তুমি যাতে আমাকে একেবারে ছেড়ে দাও, সেইজন্যে ওই বিয়ের কথা বললাম।

ইলার কথার প্রতিটি শব্দ মিছরির ছুরির মতো আমার পুরুষত্বের ওপরে কেটে বসেছে। মাথা ঝাঁকিয়ে অট্টহাসি হেসে ইলাকে বুকে টেনে নিয়েছি। এতদিনকার মিথ্যে আশ্বাসকে সত্যে পরিণত করে ওকে বিয়ে করেছি। অর্থাৎ, জীবনযুদ্ধে অভিজ্ঞ এবং অভিজ্ঞা দুই নরনারীর মিলন সংঘটিত হয়েছে। এবং স্বাভাবিকভাবেই এ বিয়েতে আমাদের দুজনেরই কোনও আপশোস ছিল না।

বিয়ের পর আমাদের পাঁচ বছর কেটে গেছে। খ্যাতি আর সাফল্যের চুড়ায় পৌঁছে আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এখন প্রশমিত। আজ অমিত সান্যাল নামটা প্রায় প্রতিটি পাঠকের পরিচিত। আমার ছবি ছাড়া কোনও সংস্কৃতি-সংবাদ প্রকাশিত হয় না। যে-কোনও পুরস্কার বিবেচনার আগে সবার মনে পড়ে আমার নামটার কথা। ‘চলাচল’ পত্রিকা ও অমিত সান্যাল আজ এক ও অভিন্ন।

উপরোক্ত ইত্যাদি-ইত্যাদির ফলস্বরূপ ভবানীপুরে দেড়লাখ টাকা দিয়ে কিনেছি এই ফ্ল্যাট। যে-ফ্ল্যাটে বসে এখন আমাকে কথা বলতে হচ্ছে এক ব্ল্যাকমেলারের সঙ্গে।

কারণ, পাঁচবছর নির্বিঘ্ন দাম্পত্যজীবনের পর গতকাল রাত বারোটার সময় হঠাৎ একটা ফোন এল।

ওয়াল ক্লকের রাত বারোটার সংকেত ঘরের চারদেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে ঝনঝন করে বেজে উঠেছে ঘরের টেলিফোন। ইলা অঘোরে ঘুমিয়ে রয়েছে বিছানায়। সুতরাং ওর যাতে ঘুমের ব্যাঘাত না হয়, সেইজন্যে সাততাড়াতাড়ি লেখার টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে রিসিভার তুলে নিলাম, হ্যালো, অমিত সান্যাল স্পিকিং।

অধম আপনাকে একটা সামান্য সংবাদ দিতে চায়।—ও-প্রান্ত থেকে নরম, মিঠে স্বর ভেসে এল।

কীসের সংবাদ?—রূঢ় স্বরে প্রশ্ন করলাম। লোকটা খবর শোনানোর আর সময় পেল না।

আপনার স্ত্রী বিগ্যামির অপরাধে অপরাধিনী। সে আপনার সঙ্গে বিবাহের পূর্বে একজন ব্যক্তির সহিত বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়।

ব্যাটা দেখি সাধু ভাষায় কথা বলে! একটা খিস্তি দিয়ে বলে উঠলাম, কে আপনি?

শান্ত স্বরে উত্তর এল, আপনার স্ত্রী ইলা সমাদ্দারের প্রথম স্বামীর নাম শ্রীপ্রাণকান্ত সমাদ্দার। আইনত সেই ব্যক্তির সঙ্গে শ্রীমতী ইলার সম্পর্ক আজও অটুট। যদি অনুমতি দেন তবে আমি আগামীকাল সন্ধে সাতটায় আপনার বাড়িতে উপস্থিত হতে চাই। মনে হয় আমাদের মধ্যে একটা আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এবং স্বভাবতই সে-আলোচনার সময় আপনার স্ত্রী অনুপস্থিত থাকাই বাঞ্ছনীয়।

কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনার পর লোকটার কথায় রাজি হলাম, ঠিক আছে। আগামীকাল সন্ধে সাতটায়।

ভারাক্রান্ত মনে রিসিভার নামিয়ে আবার লিখতে বসলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ নিষ্ফল চেষ্টার পর আলো নিভিয়ে ইলার পাশে এসে শুয়ে পড়লাম।

অতএব গতকাল রাতের এই টেলিফোনের পরিণতি হিসেবে আজ সন্ধে সাতটায় এই কালান্তক সাক্ষাৎকার।

ছ’টা নাগাদ ইলাকে বলে-কয়ে প্রায় জোর করেই শপিং-এ পাঠিয়েছি। কেন জানি না, যে-ইলা কোনওদিন আমার কথার অবাধ্য হয়নি, সে-ই হঠাৎ কেমন বেঁকে বসেছে। ওর নাকি শরীর খারাপ। মন ভালো নেই। তা ছাড়া কেনাকাটার কীই-বা আছে! এইসব নানান কথা বলেছে। কিন্তু আমিও নাছোড়বান্দা। যতরকম উপায় সম্ভব, সবক’টাই প্রয়োগ করে শেষ পর্যন্ত ওকে বাড়িছাড়া করেছি।

সাধারণত ইলার কাছে আমি কোনও কথাই গোপন করি না। কিন্তু ভেবে দেখলাম, এ ব্যাপারটা ভালো করে তলিয়ে না দেখে ওকে কিছু বলে বসা ঠিক হবে না। তাই সেই অচেনা আগন্তুকের প্রতীক্ষা করেছি।

ঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে ঢং-ঢং করে সাতটা বাজতেই দরজায় কারও নক করার শব্দ হল, ঠকঠক—।

উৎকণ্ঠার চরম সীমায় পৌঁছে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। তাই চার-পাঁচ লাফে সোফা ও দরজার দূরত্বটুকু পার হয়ে ঝটিতি দরজা খুলে দাঁড়িয়েছি। সামনেই হাড়ের ওপর চামড়া জড়ানো একটা লোক। ফরসা রং সূর্যদেবের অনুগ্রহে তামাটে হয়ে গেছে। তোবড়ানো গালে বয়েসের ভাঁজ। সম্ভবত অকালবার্ধক্য। ছোট-ছোট ভুরুর নীচে ক’টা চোখ দুটো দু-টুকরো ফসফরাসের মতো জ্বলছে। কিন্তু মাঝে-মাঝে সে-চোখে ভেসে উঠছে এক প্রশান্ত স্বচ্ছ দৃষ্টি। মাথার চুল পরিপাটি করে পাতা কেটে আঁচড়নো। পাতলা ঠোঁটের ওপর ঝাঁটা গোঁফটার মতো খড়গ নাকটিও ভীষণভাবে বেমানান।

লোকটির পরনে ঢোলা হাওয়াই শার্ট ও একটি সুতির প্যান্ট। দুটোরই রং আকাশ-নীল। কিন্তু যত্নের অভাবে অনেক জায়গায় রং জ্বলে গেছে।

সব মিলিয়ে একটা ডানাকাটা শকুন যেন আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

লোকটা সরু-সরু কাঠির মতো হাত দুটো এক করে নমস্কার করল, নমস্কার, আমিই কাল রাত বারোটায় আপনাকে ফোন করেছিলাম।—একটু থেমে লোকটি আবার বলল, অপেক্ষাকৃত নীচু স্বরে, ইলা বাড়িতে নেই তো।

ভেতরে আসুন। একটা অজানা ভয়ে হাত-পা সিঁটিয়ে উঠল। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন উত্তাল হয়ে উঠল।

লোকটা ঘরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে দিলাম। ইশারায় সোফায় বসতে বললাম। তারপর এগিয়ে গিয়ে বসলাম শকুনটার মুখোমুখি। বললাম, আমিই অমিত সান্যাল।

আজকাল আমার নিজের নামটা উচ্চারণ করতে বেশ ভালো লাগে। যেন সকলকে ডেকে বলছি, আমিই আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট।

লোকটি কিন্তু এতে একটুও প্রভাবিত হল না। শুকনো স্বরে জবাব দিল, নামটা আমি জানি বলেই তো মনে হচ্ছে।

রাগ হলেও মুখে সে-ভাব প্রকাশ করলাম না। লোকটা কতটা জানে, সেটা আগে আমার জানা দরকার।

ইলার ব্যাপারটা আমি আপনার কাছ থেকে খোলাখুলিভাবে জানতে চাই।

সেটা বলব বলেই তো এসেছি।—একটু থেমে আবার বলল সে, ইলা আপনাকে বিয়ে করার সময় অলরেডি বিবাহিতা ছিল।

তা হলে সে-কথা আপনি আমাকে পাঁচবছর আগে জানাননি কেন?—উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলাম, এখন কেন এসেছেন এ-কথা বলতে?

চেঁচাবেন না, স্যার।—হাত তুলে শকুনপাখি বাধা দিল আমাকে, আপনার তো আবার হার্টের রোগ আছে।

আপনি—আপনি সেটা জানলেন কেমন করে?

আমাদের জানতে হয়।—শান্ত স্বরে শকুন উত্তর দিল, যাকগে, আপনি জিগ্যেস করছিলেন আমি পাঁচবছর কেন অপেক্ষা করলাম, তাই তো? তার কারণ কুমারী গাই কখনও দুধ দেয় না। পাঁচটি বছর ধৈর্য ধরে আমি অপেক্ষা করেছি আপনার শ্রীবৃদ্ধির জন্যে। তারপর আজ যখন আপনার গর্ভবতী, উন্নতির চরম ধাপে, তখনই আমি আমার দোহনপর্ব শুরু করতে চাইছি। পাঁচ বছর আমার নষ্ট হয়েছে ঠিক কথা, কিন্তু এখন কাজটা আমার পক্ষে অনেক সোজা হয়ে গেছে।

আমার অসহায়তা লোকটি পরিষ্কার বুঝতে পারল, তাই মুচকি হেসে বলে চলল, জানি না, ইলা কেন ব্যাপারটা আপনার কাছে চেপে গেছে, তবে এটা সত্যি যে, ওর ভূতপূর্ব স্বামী এখনও বহাল তবিয়তে বেঁচে রয়েছে। তার নাম প্রাণকান্ত সমাদ্দার…সে তো কালই আপনাকে ফোনে জানিয়েছি।

ইলার মতো কোনও বুদ্ধিমতী মেয়ে যে কখনও এরকম বোকার মতো কাজ করে বসতে পারে, তা আমি কল্পনাও করিনি। আমিও তো অনেক মেয়ের সঙ্গে প্রাকবিবাহজীবনে অনেক লটরপটর করেছি, কিন্তু কই, এত বড় ভুল তো করিনি!

এবার লোকটিকে বোকার মতো বলেছি, কই, আমি তো কিছু জানি না!

তারপর যখনই লোকটি বলেছে, সে-ই ইলার প্রথম স্বামী, তখন অবাক হয়ে হাঁ করে তার মুখের দিকে চেয়ে থেকেছি।

পরিস্থিতির ঝটকা সামলে নিয়ে বললাম, কত টাকা চান আপনি?

আপাতত হাজার-দুয়েক।—কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই লোকটা প্যান্টের পকেট হাতড়ে কিছু কাগজপত্র বের করল, টাকা দেওয়ার আগে আমার কথা সত্যি কি না পরখ করে নিন। এই যে আমাদের বিয়ের পর তোলা ফটো। আর এটা হল ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশান সার্টিফিকেট।

প্রাণকান্তর কথা যে আমি অবিশ্বাস করেছি, তা নয়। তবু একবার ক্ষীণ আশা নিয়ে আমার চোখের নজর ঝাঁপিয়ে পড়েছে কাগজগুলোর ওপরে, এবং আমার বিশ্বাস আরও মজবুত হয়েছে।

সুতরাং অকারণে সময় নষ্ট না করে উঠে গিয়ে পাশের ঘর থেকে চেকবই নিয়ে এলাম। প্রাণকান্তর সামনেই পেন বাগিয়ে ধরে লিখতে শুরু করলাম।

স্যার!

লেখা বন্ধ করে মাঝপথে মুখ তুলে তাকালাম।

স্যার, আমি ইংরেজি পড়তে জানি না, তবে মা-বাবার অনুগ্রহে এক-দুইটা জানি। তাই বলছিলাম, চেকের বদলে ক্যাশটাকা দিলে আমার পক্ষে নিতেও সুবিধে, পরখ করতেও সুবিধে।

প্রাণকান্তর মিছরিমাখা স্বরে টের পেলাম ধরা পড়ে গেছি। নাঃ, লোকটা নেহাত বোকা নয়। নগদনারায়ণের কারবারে যে কোনও দুশ্চিন্তা নেই, সেটা ও ভালোই জানে।

সুতরাং চেকটা ছিঁড়ে ফেলে পেন বুকপকেটে গুঁজে ফেললাম, বললাম, তা হলে আমার পক্ষে এখন ক্যাশটাকা দেওয়া সম্ভব নয়। দিনকয়েক সময় চাই।

প্রাণকান্ত কিছুক্ষণ কী ভাবল, তারপর বলল, ছোটবেলায় সময়ানুবর্তিতা রচনায় আমি ক্লাসে হায়েস্ট নম্বর পেয়েছিলাম। তাই ওই সময়-টময়ের ব্যাপারগুলো আমি নিখুঁতভাবে মেনটেন করি! আগামী শুক্রবার রাত ন’টার সময় আসব। দেখবেন স্যার, টাকাটা যেন পাই।

একটু হেঁ-হেঁ করে হাত কচলে উঠে দাঁড়াল সমাদ্দার। এগিয়ে চলল দরজার দিকে। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে ধরলাম। এবং খেয়াল করলাম, আমার সাহিত্যজীবনে এই প্রথম এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আমি এক নিখুঁত খুনের প্লট চিন্তা করে চলেছি। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রীঅমিত সান্যাল জীবনে সর্বপ্রথম এক যুগান্তকারী গোয়েন্দা উপন্যাস লেখায় হাত দেবেন।

কিন্তু দরজা ছেড়ে বেরোনোর সময়ও প্রাণকান্ত আমার মনের পরোপকারী চিন্তাধারার কথা টের পেল না। কারণ, আমার মুখের অমায়িক হাসিটা ওকে ভাববার সুযোগ দিচ্ছিল, আমি ভয় পেয়েছি।

ইলার ফিরতে যে খুব বেশি দেরি হবে না, তা জানতাম। তাই ওর স্নায়ুর ওপর যাতে হঠাৎ চাপ সৃষ্টি করা যায়, সেইজন্যে দৃশ্যসজ্জায় চটপট মনোযোগ দিলাম। ফ্ল্যাটের দরজা হাট করে খুলে রাখলাম। নিভিয়ে দিলাম ঘরের সব ক’টা আলো। তারপর বসবার ঘর ছেড়ে শোওয়ার ঘরে গেলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে চেয়ারে বসলাম—দরজার ঠিক মুখোমুখি। তারপর আমার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে থাকা শেড দেওয়া টেবল-ল্যাম্পটাকে জ্বেলে দিলাম। অর্থাৎ, দরজার সামনে থেকে দেখলে আমার শরীরের সিলুয়েট ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়বে না। আর দেখা যাবে শুধু জ্বলন্ত সিগারেটের অগ্রভাগটুকু।

প্রতীক্ষা শুরু করার মিনিট-দশেকের মধ্যেই সদর দরজার কাছ থেকে কানে এল একটা অস্ফুট চাপা আর্তনাদ। তারপরেই ইলার কাঁপা স্বর, অমিত, অমিত।

আমি নীরব।

অমিত, তুমি কোথায়?

আমি তবুও নীরব। সিগারেটের ধোঁয়ার কালো ছায়া ঘুরে বেড়াতে লাগল ঘরের দেওয়ালে।

এবার ওর হালকা পায়ের শব্দ এগিয়ে আসতে লাগল শোওয়ার ঘরের দরজার দিকে, যে-ঘরে আমি বসে আছি।

দরজার কাছে আসামাত্রই আমি উঠে দাঁড়ালাম। এবং একইসঙ্গে ঘটে গেল তিনটে ঘটনা।

এক, কিনে আনা জিনিসপত্রের বাক্সগুলো ইলার হাত থেকে স্খলিত হয়ে পড়ে গেল।

দুই, ওর ভোক্যাল কর্ড ভীষণভাবে কেঁপে উঠল। ওর গলাফাটানো চিৎকারে গমগম করে উঠল গোটা ঘরটা।

আর শেষ ঘটনাটা যেমন চমকপ্রদ তেমনি আকস্মিক। ইলা ঘুরে দাঁড়িয়েই উন্মাদের মতো ছুটতে শুরু করল।

আমিও আর দেরি না করে ক্ষিপ্রগতিতে ওকে অনুসরণ করলাম। সিগারেটের টুকরোটা বসবার ঘরের টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলাম। তারপরই ফ্ল্যাটের খোলা দরজা লক্ষ্য করে দৌড়তে শুরু করলাম।

বাইরে বেরোতেই করিডরের অলোয় কিছুক্ষণের জন্যে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হল না, ইলা সিঁড়ি ধরে দৌড়চ্ছে। সুতরাং আমিও সিঁড়ি ভেঙে দুদ্দাড় করে ছুটলাম।

তিনতলার সিঁড়ির কাছাকাছি এসেই ইলাকে ধরে ফেললাম। এবং ও চিৎকার করবে বুঝতে পেরেই বাঁ-হাতের তালু দিয়ে ওর মুখটা চেপে ধরলাম। ও বোবা আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে লাগল। আমি পেছন থেকে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, ভয় নেই, ইলা। আমি—আমি অমিত।

ইলা ঘুরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ল আমার বুকে। ওকে ধরে ধীরে-ধীরে ওপরে নিয়ে চললাম। আমার এই সাজানো পরিবেশ যে ওর মনে এতটা আতঙ্কের সৃষ্টি করবে, তা ভাবতেই পারিনি। ইলার এই আকস্মিক ভয় পাওয়ার কারণ আমাকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলল। তা হলে কি…?

ওনারশিপ ফ্ল্যাটগুলোর একটা সুবিধে আছে। এরা কেউই কারও ব্যাপারে নাক গলায় না। এমনকী কারও সঙ্গে কারও আলাপ-পরিচয়ও তেমন নেই। তা ছাড়া বহু ফ্ল্যাটে এখনও লোক আসেনি। তাই এত গন্ডগোল সত্ত্বেও কেউ যে দরজা খুলে বেরিয়ে এল না, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমার উলটোদিকের ফ্ল্যাটে যে-পাঞ্জাবি ভদ্রলোক থাকেন, তিনি যখন প্রত্যেকদিন রাত বারোটা-একটার সময় টলটলায়মান অবস্থায় ফিরে এসে একাদিক্রমে তার ফ্ল্যাটের দরজা এবং তার দজ্জাল গৃহিণীর সঙ্গে পানিপথের চতুর্থ এবং পঞ্চম যুদ্ধ বেশ উৎসাহ সহকারে শুরু করেন, তখন আমি আর ইলা বন্ধ দরজার পেছন থেকেই সে-যুদ্ধের ধারাবিবরণী শুনি। ভুলেও দেখতে যাই না যুদ্ধের ফলাফল।

সুতরাং বিন্দুমাত্রও বিচলিত না হয়ে ইলাকে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকলাম। আন্দাজে হাত বাড়াতেই হাতে ঠেকল আলোর সুইচ। আলো জ্বেলে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে দিলাম।

ইলার ফোঁপানি বন্ধ হয়ে গেলেও ওর দেহটা এখনও ফুলে-ফুলে উঠছে। ওকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিলাম, বোসো। তোমার সঙ্গে কথা আছে।

ইলা একবার মুখ তুলে আমাকে দেখল, তারপর চোখ নামিয়ে বসে পড়ল সোফায়।

আমি ছড়িয়ে পড়া জিনিসপত্রের বাক্সগুলো গুছিয়ে রেখে ইলার মুখোমুখি এসে বসলাম। ওর জলে ভেজা মুখটা কি আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে পাঁচ বছর আগে দেখা ইলাকে। ফরসা মুখে টানা-টানা গভীর জীবন্ত কালো চোখ। হাতছানি দেওয়া স্বপ্নিল ঠোঁটের নীচে সৌন্দর্যের পরিপূরক ছোট্ট তিলটা যেন শিল্পীর হাতের নিখুঁত পরশ।

ইলা একটা সামান্য ব্যাপার তুমি আমাকে জানাতে বোধহয় ভুলে গিয়েছিলে। তাই প্রাণকান্ত সমাদ্দার এসে সেই কথাটা আজ আমাকে জানিয়ে দিয়ে গেছেন।

ইলা কাপড়ের খুঁট নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল, আমার কথা শোনামাত্রই দু-হাতে আঁকড়ে ধরল সোফার হাতল। ভাবলেশহীন কঠিন মুখে আমার দিকে তাকাল। গভীর কালো চোখে ফুটে উঠল অনুচ্চারিত বিস্ময়, আতঙ্ক।

সমাদ্দার আমাকে সবই বলেছেন, ইলা। কোনওকিছুই জানতে আমার আর বাকি নেই। সুতরাং ব্যাপারটা সত্যি কি না সেটা তোমার মুখ থেকে আমি শুনতে চাই।

ইলা প্রথম ভয়টাকে এতক্ষণে অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে। ও নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল, বলল, হ্যাঁ অমিত, সত্যি।

এবার তা হলে সমস্যাপূর্ণ আসল চ্যাপ্টারটা তোমাকে আমি খুলে বলতে চাই। প্রাণকান্ত আমাকে ব্ল্যাকমেল করছে। সামনের শুক্রবার রাত ন’টায় ও আসবে প্রথম কিস্তির দু-হাজার টাকা নিতে। মনে রেখো, প্রথম কিস্তি। তারপর ব্যাপারটা চলবে—চলতেই থাকবে। একদিকে আমার সম্মান, সামাজিক মর্যাদা, আর অন্যদিকে টাকা, শুধু টাকা। জানি না, এভাবে কতদিন ওর মুখ আমি বন্ধ রাখতে পারব। আর এইরকম চলতে-চলতে আমরা হব রাস্তার ভিখিরি। শুধু আমার বইয়ের রয়্যালটির টাকায় কোনওরকমে দিন চলবে। কারণ ‘চলাচল’-এর চাকরি বজায় রাখা আমার পক্ষে আর সম্ভব হবে না—শুধু ওই প্রাণকান্তর জন্যে।

ওকে খুন করলে কেমন হয়?

এবার চমকানোর পালা আমার। বোবা বিস্ময়ে ইলার নিটোল নিষ্পাপ মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। ও বলে কী! তা হলে আমাদের মানসিক বোঝাপড়া কি এতই নিখুঁত? প্রাণকান্তকে খুন করার কথা মনে-মনে চিন্তা করলেও, সে সর্বনাশা-চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সাহস বা শক্তি কোনওটাই আমার নেই। কিন্তু এখন ইলার প্রস্তাব পেয়ে উল্লাসের শিহরণ বয়ে গেল আমার শরীরের শিরা-উপশিরায়। কিন্তু মনের ভাব মনেই লুকিয়ে রেখে মুখে বললাম, খুন? মানে, সেটা কি ঠিক হবে?

কেন হবে না?–ইলার সপ্রতিভ স্বর ঝাঁঝিয়ে উঠল, ওই লোকটা আমার লাইফের সব আনন্দ, সুখ কেড়ে নিয়েছিল। আজ থেকে সাত বছর আগে একটা ইমোশনাল ঝোঁকে বাড়ির সকলের কথা না শুনে আমি ওকে বিয়ে করি। কিন্তু প্রাণকান্তর অবস্থা ছিল ভীষণ গরিব। তাই বেশিদিন আমরা সুখে থাকতে পারিনি। তার ওপর ওর স্বভাব-চরিত্র ক্রমশই গড়িয়ে চলেছিল নীচের দিকে। বিয়ের ক’মাস পরেই আমাকে ছেড়ে ও বেপাত্তা হয়ে যায়। তখন আমি দিশেহারা হয়ে পড়লাম। তারপর…তারপর একদিন বহু পুরুষের পর এলে তুমি। কেন জানি না, এবারের পরিচয়টাকে আমি হালকাভাবে নিতে পারিনি। পরের ঘটনা তো তুমি সব জানো। আজ এতদিন পর প্রাণকান্ত আমার অবস্থার সুযোগ নিতে এসেছে। তাই বলছি অমিত, ওই লোকটাকে খুন করার মধ্যে কোনও পাপ নেই, কোনও অন্যায় নেই।

ইলার শেষ কথাগুলোর রেশ আমার কানের পরদায় ঘুরে-ফিরে বাজতে লাগল: কোনও পাপ নেই, কোনও অন্যায় নেই।

ইলা, তা হলে একটা প্রশ্নের আমি সোজাসুজি উত্তর চাই।—নিষ্পলকে ইলার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলাম, আমাদের এই বিবাহিত জীবনে তুমি কী অসুখী?

এই আচমকা প্রশ্নে ইলা বেশ অবাক হয়ে গেল। আমার কথার জবাব না দিয়ে ও পালটা প্রশ্ন করল, কেন, হঠাৎ এ-কথা জিগ্যেস করছ কেন?

কারণ আছে, ইলা। আমি জানতে চাই তোমার কাছে কার দাম বেশি? আমার, না প্রাণকান্তর?

প্রাণকান্তকে আমি ঘৃণা করি।—দাঁতের ফাঁক দিয়ে হিসহিস করে কুটিল স্বরে জবাব দিল ইলা।

আমার মুখে হাসি ফুটে উঠল। ইলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঝুঁকে পড়ে চুমু খেলাম ওর কোমল গালে। মৃদু স্বরে কানে-কানে বললাম, প্রাণকান্ত সমাদ্দারকে আমিও ঘৃণা করি।

প্রাণকান্তর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই ভীষণভাবে মাথা ঘামাতে শুরু করলাম। ইলার হাবভাবে কোনও পরিবর্তন দেখতে পাই না, কিন্তু জানি, ও চুপচাপ বসে নেই। প্রাণকান্তকে খতম করার ব্যাপারটা নিয়ে ইলাও যথাসাধ্য ভাবছে।

আমি কী অফিসে, কী বাড়িতে, সবসময়েই বিদেশি গোয়েন্দা গল্পের বই নিয়ে পড়ে থাকি। ভাবতে থাকি প্রাণকান্তকে খুন করার সহজ অথচ নিখুঁত উপায়। সবার আগে আমাকে ঠিক করতে হবে সমাদ্দারের মৃত্যুটাকে পুলিশের কাছে কীভাবে উপস্থিত করব। অ্যাক্সিডেন্ট? সুইসাইড? না স্বাভাবিক মৃত্যু? বেশ কিছুক্ষণ চিন্তার পর শেষ সম্ভাবনাটা মন থেকে মুছে ফেললাম। কারণ, এ পৃথিবীর কোনও লোকই পরের ফ্ল্যাটে এসে স্বাভাবিক উপায়ে মারা যায় না। সুতরাং হাতে রইল দুই। অর্থাৎ, হয় অ্যাক্সিডেন্ট না হয় সুইসাইড। আপনারা হয়তো হাসছেন দ্বিতীয় সম্ভাবনাটার কথা ভেবে। তা হাসারই কথা। এমন কোনও সুস্থমস্তিষ্ক মানুষ কি আছে, যে পরের ফ্ল্যাটে এসে আত্মহত্যা করে? অতএব, শেষ সম্ভাবনাটা মনে আঁকড়ে প্রস্তুতিপর্বের কথা ভাবতে শুরু করলাম।

হঠাৎই মনে পড়ল একটা বিদেশি ছবির কথা। জানি না ছবিটা আপনারা দেখেছেন কি না, তবে আমি আর ইলা দুজনেই দেখেছি। সেটা আলফ্রেড হিচককের বিখ্যাত ছবি ‘ডায়াল এম ফর মার্ডার’। তাতে এক বিশিষ্ট ব্যক্তির ঘরে একটি অপরিচিত লোকের মৃতদেহ পাওয়া যায়। সেই মৃত লোকটির পকেটে পুলিশ একটি মারাত্মক সূত্র পায়: একটা চাবি। যে-ঘরে লোকটি মারা যায় সেই ঘরের চাবি। তখন পুলিশ সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গৃহস্বামীকে গ্রেপ্তার করে। কারণ, ওই চাবিটি ছিল ওঁরই। তিনিই ওটা মৃত লোকটিকে দিয়েছিলেন ঘরে ঢোকার জন্যে।

ওই ছবির গল্পটাকে কাজে লাগালে কেমন হয়? অবশ্য গল্পের শেষটা হবে একটু অন্যরকম। মৃত প্রাণকান্ত সমাদ্দারের পকেটে যে-চাবিটা পাওয়া যাবে, তা আমাদের ফ্ল্যাটের হলেও আমার বা ইলার চাবি নয়। সেটা হবে সম্পূর্ণ নতুন একটা তৃতীয় নকল চাবি—চাবিওয়ালার হাতে তৈরি।

পরিকল্পনাটা যতই ভাবতে লাগলাম, ততই ওটা স্পষ্ট চেহারা নিতে লাগল। তাই বৃহস্পতিবার রাতে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ার পর পাশে শুয়ে থাকা তন্দ্রাচ্ছন্ন ইলাকে ডাকলাম, ইলা, ইলা?

উঁঃ।—পাশ না ফিরেই ও অস্ফুটে জবাব দিল।

সমাদ্দারের ব্যাপারটা আমার ভাবা হয়ে গেছে।

এবারে ইলা পাশ ফিরল। মাথার কাছে জানলা দিয়ে ঠিকরে আসা মরা চাঁদের আবছা আলোয় ওর চোখদুটো দেখতে পেলাম। সে-চোখে নীরব প্রশ্ন।

দ্যাখো, ব্যাপারটা হবে ঠিক এইরকম।—হাত নেড়ে ইলাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। আগামীকাল প্রাণকান্ত এলে ওকে ওর পাওনা দু-হাজার টাকা আমি দিয়ে দেব। তারপর ও স্বাভাবিকভাবেই আরও টাকা চাইবে। তখন ওকে বলব আগামী সপ্তাহে বুধবার আসতে। বুধবার আসতে বলার একটা কারণ আছে। তা হল, ওই দিন থেকে অফিসে আমার রুমে যে অন্য আর-একটা ছোকরা কাজ করে, সে সোমবার পর্যন্ত ছুটি নিচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা খুলে বললেই সব বুঝতে পারবে। যা হোক, প্রাণকান্ত কাল টাকা নিয়ে চলে যাওয়ার পর আমি আমার কাজ শুরু করব। প্রথমে বাথরুম থেকে সাবানটা নিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা থেকে চাবির ফুটোর ছাপ নেব। তারপর সেই সাবান নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অচেনা এক চাবিওয়ালার কাছ থেকে দরজার একটা নকল চাবি তৈরি করব। চাবি তৈরি হয়ে গেলে সোমবার সকালে থানায় গিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটে চুরি হয়েছে বলে একটা ডায়েরি করব। আর ইতিমধ্যে তোমার কাজ হবে, সেই ছাপ নেওয়া সাবানটাকে বাথটাবে রেখে জলে পুরোপুরি গলিয়ে ফেলা এবং ওটার হাত থেকে নিখুঁতভাবে নিষ্কৃতি পাওয়া। তারপর ঘরের গোটাকয়েক ড্রয়ার-টয়ার খুলে রেখে আর কাগজপত্র কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে মঞ্চসজ্জার কাজ সম্পূর্ণ করে রাখবে। পুলিশ তদন্তে এলে ভালোই হবে। ওদের এক্সপার্টরা যখন দেখবে দরজা ফোর্স করা হয়নি, তখন স্বাভাবিকভাবেই ওদের নজর পড়বে চাবির ফুটোর দিকে। ওরাই আমাদের জানাবে, চোর এসেছিল নকল চাবি দিয়ে দরজা খুলে। আমরা সবাই যেন সাবধানে থাকি—কিছু হলেই যেন ওদের খবর দিই ইত্যাদি, ইত্যাদি। অর্থাৎ নকল চাবির ব্যাপারটা পুলিশের মনে আমরা গেঁথে দেব।

ইলা বোধহয় এতক্ষণে আমার এই প্রাথমিক পরিকল্পনার তাৎপর্য বুঝতে পারল। ও চোখ গোল-গোল করে শুনতে লাগল।

প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত হল। এইবার শুরু হবে প্রাণকান্ত-সংহার পালার দ্বিতীয় অধ্যায়।

বুধবার বিকেল পাঁচটা একুশের ট্রেনে আমরা দুজনে বাইরে যাচ্ছি।

কেন?—বাধা দিয়ে জানতে চাইল ইলা।

দরকার আছে, তাই। যাকগে, শোনো। সেইদিন ঠিক পৌঁনে পাঁচটার সময় প্রাণকান্তর সঙ্গে আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করব। ওকে প্রচুর টাকার লোভ দেখাব, তা হলে ও ঠিক সময়মতোই আসবে। এদিকে অফিস থেকে পাঁচটা বাজতে পঁচিশের সময় আমি বেরিয়ে পড়ছি। কিন্তু আমার সহকর্মী সমর জানবে আমি বেরুলাম ঠিক পাঁচটায়—পাঁচটা বাজতে পঁচিশে নয়। কারণ, বুধবার আমার রুমের দেওয়াল-ঘড়ির কাঁটা সমরকে লুকিয়ে আমি পঁচিশ মিনিট এগিয়ে দেব। এগিয়ে দেব আমার হাতঘড়ির কাঁটাও। এবং সমরের হাতঘড়ির কাঁটাও যে করে হোক আমাকে সরাতে হবে। মোটমাট পাঁচটা বাজতে পঁচিশ মিনিটের সময় অফিস থেকে বেরিয়ে আমি সোজা বাড়িতে আসছি।

এখন ভালো করে শোনো তোমাকে কী করতে হবে। ঠিক পাঁচটা বাজতে পঁচিশের সময় তুমি রেডি হয়ে বাইরে বেরোবে—অবশ্য বেরোনোর আগে তোমার ঘড়ির কাঁটা পঁচিশ মিনিট এগিয়ে নেবে। যাতে সময় তখন পাঁচটা বলে মনে হয়। ফ্ল্যাটের বাইরে বেরিয়েই তুমি অরোরাদের (আমাদের উলটোদিকের ফ্ল্যাটের সেই পাঞ্জাবি ভদ্রলোকদের কথা বলছি) ফ্ল্যাটের দরজায় আস্তে নক করবে। নক করেই চট করে এসে ঝুঁকে দাঁড়াবে আমাদের ফ্ল্যাটের দরজায়। বেশ ‘খটাং-খটাং’ করে চাবি ঘোরাবে। তবে দরজার পাল্লায় সামান্য ফাঁক রেখে দেবে যাতে ঘরের ভেতরের শব্দ বাইরে থেকে শোনা যায়। এদিকে তোমার পেছনে অরোরাদের ফ্ল্যাটের দরজা ততক্ষণে খুলে গেছে। আর সেই দরজায় দাঁড়িয়ে মিসেস অরোরা বেশ কৌতূহলে তোমাকে লক্ষ করছেন (যেহেতু মিস্টার অরোরা রাত বারোটার আগে কোনওদিনই বাড়ি ফেরেন না)। তখন তোমার কাজ হবে ওর সঙ্গে কথা বলা। নকল চাবি দিয়ে যে আমাদের ফ্ল্যাটে গত রবিবার চোর ঢুকেছিল, সে-কথা ওঁকে চটাপট জানিয়ে দেবে। তুমি যে আমার সঙ্গে পাঁচটা একুশের ট্রেনে বাইরে যাচ্ছ সে-কথাও বলবে এবং রোববার পর্যন্ত, অর্থাৎ, যে-ক’দিন আমরা থাকব না, ওঁকে আমাদের ফ্ল্যাটের দিকে একটু নজর রাখতে রিকোয়েস্ট করবে। বলা তো যায় না, সেই চোরটা কখন আবার এসে নকল চাবি দিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে? মিসেস অরোরা নজর রাখতে পারুন আর না-ই পারুন, একগাল হেসে নজর রাখবেন বলে তোমাকে আশ্বাস দেবেন এবং আমিও সেটাই চাই। কারণ, পরে প্রাণকান্তর ডেডবডি পাওয়ার পর মিসেস অরোরা ওঁর নজর রাখার কাজে গাফিলতি করেছেন বলে নিজেই আপশোস করবেন। ইস, কেন তিনি ভালো করে নজর রাখলেন না! নয়তো ওই চোরটি কি কখনও ঢুকতে পারত?—যাক, আশা করি ব্যাপারটা তুমি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছ? হ্যাঁ, এইবার কথার ফাঁকে তোমার ঘড়িতে যে পাঁচটা বাজে (অর্থাৎ, প্রকৃতপক্ষে সময় তখন পাঁচটা বাজতে পঁচিশ মিনিট) সেটাও বেশ কায়দা করে জানিয়ে দেবে ওঁকে। আর ঠিক সেইসময় তুমি কাঁটা এগিয়ে দেওয়ার ফলে আমাদের দেওয়াল-ঘড়িতেও ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজবে। সুতরাং ভবিষ্যতে মিসেস অরোরা যদি কোনওদিন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের সামনে পড়েন, তখন তিনি শপথ করেই বলবেন যে, ঠিক পাঁচটার সময় তুমি ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে গেছ। ব্যস, তারপর মিসেস অরোরার চোখের সামনে দিয়েই চাবি ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে তুমি লিফটে চড়ে নামতে শুরু করবে।

এইবারই শুরু হচ্ছে পরিকল্পনার সবচেয়ে জটিল এবং কুটিল অংশ। লিফট চলতে শুরু করামাত্রই তুমি চোখে একটা গগলস লাগিয়ে নেবে, চুলের কায়দা সামান্য পালটে নেবে। এবং আমাদের ফ্ল্যাটের ঠিক নীচের তলাতেই লিফট থামিয়ে লিফট থেকে নেমে পড়বে। তুমি লিফটের বোতাম এমনভাবে টিপবে যাতে তুমি নেমে পড়ার পর খালি লিফট চলে যায় একতলায়। কারণ, ঠিক সেইসময়ে আমি একতলায় সানগ্লাস পরে লিফট নামার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি।

লিফট নেমে যাওয়ামাত্রই তুমি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করবে। লক্ষ রাখবে, যেন কেউ তোমাকে দেখতে না পায়। তুমি ফিরে এসে চাবি দিয়ে দরজা খুলে আবার ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়বে। নিঃশব্দে বন্ধ করে দেবে ফ্ল্যাটের দরজা। তারপর তোমার হাতঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে ঠিক জায়গায় নিয়ে আসবে। দেওয়াল-ঘড়ির কাঁটার ব্যাপারটা আমিই ভাবব, তোমাকে ভাবতে হবে না। এবার তুমি সোফায় বসে আমার জন্যে ওয়েট করবে।

পৌনে পাঁচটার মধ্যেই (অফিস থেকে বাড়িতে আসতে আমার মিনিট-দশেকের বেশি লাগবে না। কারণ, অফিস আমার বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়) আমি ফ্ল্যাটে চলে আসছি। তারপর আমরা দুজনে মিলে প্রাণকান্তর জন্যে ওয়েট করব। আমাদের ফ্ল্যাটে আসার সময় প্রাণকান্তকে যদি কেউ দেখতে পায়, তবে কোনও ক্ষতি নেই। কারণ, পরে সেই ব্যক্তিই আমাদের ফ্ল্যাটে মৃত প্রাণকান্তকে সনাক্ত করে বলবে, ও সেই আগন্তক। অর্থাৎ, নকলচাবি নিয়ে হানা দেওয়া রাতের চোর।

আমি থামতেই ইলা আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরল ওয়ান্ডারফুল, অমিত, ওয়ান্ডারফুল!—ফিসফিস করে ও বলল, আমাদের কেউ ধরতে পারবে না। প্রাণকান্তর হাত থেকে খুব সহজেই আমরা ফ্রি হয়ে যাব।

কিন্তু এখনও কিছুটা বাকি আছে, ইলা।

অন্ধকারেই ইলা মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে।

পরের কাজগুলোর কথা তোমাকে বলা হয়নি।

কী কাজ?

প্রাণকান্ত পৌনে পাঁচটায় আসার পর আমরা ওকে খুন করব। ওর প্যান্টের পকেটে গুঁজে দেব আমার বানানো সেই নকল চাবিটা (পুলিশ সেই চাবিওলাকে কোনওদিন খুঁজে পাবে না বলেই আমার ধারণা)। ততক্ষণে দেওয়াল-ঘড়িতে প্রায় পাঁচটা কুড়ি হবে (অর্থাৎ, আসলে ঠিক পাঁচটা)। তখন আমি দেওয়াল-ঘড়ির কাঁটা ফিরিয়ে নিয়ে যাব ঠিক কুড়ি মিনিট পেছনে। এবং দেওয়াল-ঘড়ির নিয়ম অনুযায়ী, ঘড়িতে ঘণ্টা বাজার ঢং একই থাকবে। অর্থাৎ, সাড়ে পাঁচটার সময় আবার একটা ঘণ্টাই বাজবে—তার বেশি নয়। এবার তুমি আর আমি ফ্ল্যাটের দরজায় বাইরে থেকে তালা দিয়ে চুপিসাড়ে বেরিয়ে পড়ব পাঁচটা একুশের ট্রেন ধরার জন্যে।

বুধবার রওনা হয়ে আমরা ফিরে আসব রবিবার। এবং ডেডবডি আবিষ্কার করার জন্যে আমাদের তৈরি থাকতে হবে। স্টেশন থেকে বাড়িতে ফেরার পথে আমি অফিস হয়ে আসব। জানিয়ে আসব আমি কলকাতায় ফিরেছি। আর সেই সুযোগে আমার চেম্বারে গিয়ে দেওয়াল-ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে সময় শুধরে দেব। তোমাকে আগেই বলেছি, সমর বুধবার থেকে সোমবার পর্যন্ত ছুটি নিচ্ছে। তাই ও কাজে লাগার আগেই ঘড়ির ব্যাপারটা আমি ঠিক করে ফেলতে চাই।

কিন্তু সময়ের ঘড়িটার কী করবে?

সেটা আমি ভেবে রেখেছি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।—ইলাকে আশ্বাস দিয়ে বলে চললাম, আমাদের শেষ কাজটা হবে প্রাণকান্তর বডি আবিষ্কার করে পুলিশে খবর দেওয়া। পুলিশ তদন্ত করে জানবে ঠিক পাঁচটার সময় বেরিয়ে পাঁচটা একুশের ট্রেনে আমরা বাইরে গেছি (দরকার পড়লে ট্রেনের পাঞ্চ করা টিকিটগুলোও ওদের দেখাব)। আর আমাদের কথা সাপোর্ট করবে যথাক্রমে সমর এবং মিসেস অরোরা। অর্থাৎ, আমরা দুজনেই হব নিটোল অ্যালিবাইয়ের মালিক। তখন সেই রহস্যময় চোরের ভূমিকা মরা প্রাণকান্তের ঘাড়ে গিয়েই পড়বে। পুলিশ প্রাণকান্তর পকেটে পাবে সেই নকল চাবি, যা সাবানের ছাপ তুলে কেউ তৈরি করিয়েছে বলে পুলিশের সন্দেহ। তখন চাবি পরীক্ষা করে তাতে শুধু প্রাণকান্তরই আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে (পাওয়া যাতে যায়, সে বিষয়ে আমি বিশেষ যত্ন নেব)। অর্থাৎ, ‘ডায়াল এম ফর মার্ডার’-এর নায়কের মতো আমি আর চাবির প্যাঁচে পা দিচ্ছি না। সমস্ত ব্যাপারটা পুলিশের কাছে সহজ-সরল বলে মনে হবে। প্রাণকান্তর হাত থেকে আমরা চিরদিনের জন্যে মুক্তি পাব।

কিন্তু—কিন্তু প্রাণকান্তকে আমরা খুন করব কেমন করে?—অস্ফুট স্বরে জানতে চাইল ইলা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলাম, কী করে খুন করব জানি না। তবে ওর মৃত্যুটা অ্যাক্সিডেন্ট বলে মনে হওয়াটা খুব দরকার। সেই স্টাইলটা জানতে পারলেই আমার কাজ শেষ হবে।

ওটা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও।—ইলা বলল, তুমি যখন এত বুদ্ধি করে সমস্ত কিছু সলভ করতে পেরেছে, তখন ওই খুনের ব্যাপারটা আমিই বুদ্ধি করে বের করতে পারব। আমাকে এত বোকা ভাববেন না, মশাই।

প্রাণকান্তকে কীভাবে খুন করা যায় শুধু সেইটুকু ভাবতে-ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমোনোর আগে ব্যাপারটা যতই ভাবতে লাগলাম, ততই একটা কনফিডেন্স টের পেতে লাগলাম। মনে হল, পুলিশকে আমি বোকা বানাতে পারবই।

ইলাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সে-রাতের মতো নিশ্চিন্তে আর কোনওদিন ঘুমিয়েছি বলে মনে পড়ে না।

শুক্রবার দিন ঠিক করা সময়ের কিছু আগেই প্রাণকান্ত এসে হাজির হল। দরজা বন্ধ করে আগের দিনের মতোই সোফায় ওর মুখোমুখি বসলাম। কথাবার্তা শুরু করার আগে প্রাণকান্ত একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর শোওয়ার ঘরে বন্ধ দরজার দিকে ইশারা করল, ইলা নেই তো?

না—নেই।—নির্জলা মিথ্যে বেশ মোলায়েম করে ওকে শুনিয়ে দিলাম। কারণ, শোওয়ার ঘরের বন্ধ দরজার ওপিঠেই কান পেতে অপেক্ষা করছে ইলা। ওর কাছে যখন কিছুই আর অজানা নেই, তখন ওর এই ছেলেমানুষি প্রস্তাবে আর ‘না’ বলিনি।

তা স্যার, আমার টাকাটা—।

এই যে।—পকেট হাতড়ে দুটো দশটাকার নোটের বান্ডিল বের করে ওর হাতে দিলাম।

থ্যাঙ্কস।—হাড়জিরজিরে পাঁচ আঙুলে বান্ডিল দুটো খামচে ধরল প্রাণকান্ত। একবার যেন ওজন করে দেখল টাকাটা। এবং পরমুহূর্তেই বান্ডিল দুটো চালান করে দিল আকাশ-নীল প্যান্টের পকেটে।

মিস্টার সমাদ্দার, একটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে, ইতস্তত করে বলেই ফেললাম কথাটা, মানে, ভবিষ্যতে আপনার আবার টাকার দরকার হবে কি না সেটা জানা থাকলে—।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।—হায়েনা হাসির সঙ্গে-সঙ্গে ওঠ-বোস করল প্রাণকান্তর প্রকট কণ্ঠা, লাগবে বইকী!

কত?—স্থির চোখে শকুন সমাদ্দারের দিকে চেয়ে জানতে চাইলাম।

ভবিষ্যতের কথা কি কেউ বলতে পারে, মিস্টার সান্যাল? প্রয়োজন অনুসারে আমার দাবির পরিমাণও ফ্লাকচয়েট করবে।

ওসব বাজে কথা রেখে কাজের কথায় আসুন।—রুক্ষ স্বরে বললাম, আমি আপনাকে একসঙ্গে একটা মোটা টাকা দিয়ে আপনার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাই। বিশ হাজার টাকায় কি আপনার আপত্তি আছে?

সঙ্গে-সঙ্গে প্রাণকান্তর উসুখুস ভাবটা উবে গেল। ঝুঁকে পড়া শিরদাঁড়াটা টান-টান করে স্বচ্ছ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। চেষ্টা সত্ত্বেও মুহূর্তের জন্যে ওর মুখে ফুটে উঠল বিস্ময়ের ভাব। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আমি কি ভুল শুনছি?

না, ঠিকই শুনছেন। আমি সোজাসুজি উত্তর চাই। হ্যাঁ কি না?

অবশ্যই হ্যাঁ। কিন্তু টাকাটা পাচ্ছি কবে?—প্রাণকান্তর স্বর এবার অর্থলালসায় উৎসুক।

আগামী বুধবার বিকেল পৌনে পাঁচটার সময়! তবে মনে রাখবেন, ঠিক পৌনে পাঁচটায়। কারণ আপনার ওই সময়ানুবর্তিতা রচনায় আমিও একবার হায়েস্ট নম্বর পেয়েছিলাম, হেঁ, হেঁ, হেঁ।—প্রাণকান্তকে ব্যঙ্গ করে উঠে দাঁড়ালাম।

বিদায় দেওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত। সোফা ছেড়ে চটপট দরজার দিকে পা বাড়াল সমাদ্দার।

দরজা বন্ধ করে ফিরে দাঁড়াতেই শোওয়ার ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল ইলা। ওর চোখে-মুখে ঘৃণা উপচে পড়ছে।

কী, প্রথম স্বামীদেবতার মধুর কণ্ঠস্বর শোনার সাধ মিটেছে?

লোকটা…লোকটা একটা পিশাচ!—ঘৃণাভরা স্বরে জবাব দিল ইলা।

নিঃসন্দেহে পিশাচ। কিন্তু মনে রেখো, ইলা, ওকে খুন করার প্ল্যানটা আমরা এখনও ঠিক করতে পারিনি।

কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ইলা জবাব দিল, কে বলল পারিনি? প্রাণকান্ত সমাদ্দার মারকিউরিক ক্লোরাইডের সলিউশান খেয়ে মারা যাবে।

তার মানে?—স্তব্ধ বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম ইলার দিকে।

হ্যাঁ। তুমি বোধহয় ভুলে গেছ, অমিত, আমরা যে অ্যান্টিসেপটিক ব্যবহার করি সেটা মারকিউরিক ক্লোরাইড। বাথরুমে বাদামি রঙের বোতলে যে-কাচের দানার মতো বস্তুটা রয়েছে, আমি ওটার কথাই বলছি। সেই মারকিউরিক ক্লোরাইড জলে মিশিয়ে আমরা প্রাণকান্তকে খাওয়াব। ব্যস আর দেখতে হবে না—প্রাণকান্ত চিরকালের জন্যে একেবারে কাত হয়ে যাবে।

কিন্তু সেটা তো আর দুর্ঘটনায় মৃত্যু হবে না, ইলা।—চিন্তান্বিত স্বরে জবাব দিলাম, অথচ…।

তুমি আমার কথা ঠিক পুরোপুরি বুঝতে পারোনি, অমিত। তুমি বোধহয় জানো না, মারকিউরিক ক্লোরাইড ইদুর মারার কাজেও ব্যবহার করা যায়। সুতরাং, বাইরে যাওয়ার আগে ইঁদুর মারার জন্যে আমরা এই টেবিলের (ইশারায় টেবিলটা দেখাল ইলা) ওপর এক গ্লাস জল খোলা রেখে যাব। আর টেবিলের ওপর থাকবে তোমার পুরোনো, নতুন, গোছা-গোছা পাণ্ডুলিপি। আর পাণ্ডুলিপির পাহারায় রেখে যাচ্ছি ওই এক গ্লাস জল। শুনতে ব্যাপারটা অত্যন্ত হাস্যকর ঠেকছে, তাই না, অমিত? কিন্তু ভেবে দ্যাখো তো, প্রাণকান্ত খুন হওয়ার পর এই ঘরের দৃশ্য ঠিক কীরকম হয়ে উঠবে? পুলিশ এসে দেখবে, তোমার পাণ্ডুলিপির বেশ কিছুটা জলে ভেজা। টেবিলের কাছে মরে পড়ে আছে প্রাণকান্তর বিকৃত মৃতদেহ। আর তার পাশেই ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে পড়ে রয়েছে একটা কাচের গ্লাস, তার গায়ে শুধুমাত্র প্রাণকান্তরই হাতের ছাপ। তখন জলটা আমরা কী জন্যে রেখে গিয়েছিলাম, সে প্রশ্নটা পুলিশের কাছে আর তেমন জরুরি বলে মনে হবে না, তাই না?

ইলার যুক্তি শুনে অবাক হয়ে গেলাম। আনন্দে ওর হাত চেপে ধরলাম: ইলা, আমরা দুজনে মিলে এই শতাব্দীর মোস্ট পারফেক্ট মার্ডার কমিট করব। অতএব এরপর থেকে সব চলবে প্ল্যানমাফিক। ডান।

ডান, সম্মতি জানিয়ে আমার কাঁধে মাথা রাখল ইলা।

বুধবার অফিসে যাওয়ার আগে গত ক’দিনের ঘটনাগুলো আরও একবার যাচাই করে দেখলাম, আমি ভুল করিনি। সাবানের ছাপ, নকল চাবি থেকে আরম্ভ করে পুলিশে ডায়েরি করা পর্যন্ত সমস্ত কাজই নির্বিঘ্নে শেষ হয়েছে। পুলিশ এবং আমার বাড়ির অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের শেষ পর্যন্ত এই বিশ্বাসই হয়েছে যে, আমার ফ্ল্যাটে এসেছিল এক অদৃশ্য চোর। কিন্তু আমার ধারণা মতো পুলিশ সরেজমিনে তদন্ত করতে একবারের জন্যেও আসেনি। অর্থাৎ, এত কষ্ট করে সাবানের ছাপ তুলেছি, সেটা ওরা আর দেখল না। অবশ্য এতে চিন্তার কারণ খুব একটা নেই। কারণ, আগামী রবিবার প্রাণকান্তর ডেডবডি আমার ফ্ল্যাটে পাওয়া গেলে, পুলিশ দরজার চাবির ফুটো থেকে শুরু করে প্রাণকান্তর পকেটে পাওয়া নকল চাবি, সবই পরীক্ষা করে দেখবে। তখন প্রমাণগুলো জোরদার হবে।

কিন্তু ইলার ইঁদুর মারার ব্যাপারটা কেমন হালকা ঠেকছে না! পুলিশ কি ওতে ভুলবে? তার চেয়ে পুলিশের কাছে অন্য একটা ব্যাখ্যা দিলে কেমন হয়? যদি বলি, ওই মারকিউরিক ক্লোরাইড মোশানো জল ব্যবহার করব বলে ইলা তৈরি করেছিল, কিন্তু পরে ভুলে যাওয়ায় ওই এক গ্লাস বিষাক্ত জল টেবিলেই থেকে গেছে।…যাকগে, ও নিয়ে পরে ভাবার অনেক সময় পাওয়া যাবে। আপাতত এখনকার কাজ নিয়ে ভাবি।

অফিসের দেওয়াল-ঘড়িতে সোয়া চারটে বাজতেই সোজা হয়ে বসলাম। তাকিয়ে দেখি সমর চৌধুরী সকাল থেকে সেই একইভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে কী যেন লিখছে। না, আর দেরি নয় এখনই কাজ শুরু না করলে বিপদে পড়তে হবে। সুতরাং চট করে কাজের টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লাম। বড়-বড় পা ফেলে এগোলাম অ্যাটাচড বাধরুমের দিকে। কাঁটা ঘুরিয়ে আমার হাতঘড়িটা খুলে রাখলাম বেসিন স্ট্যান্ডে। তারপর চোখে-মুখে জল দিয়ে ফিরে এলাম কাজের জায়গায়। রুমাল বের করে হাত মুছতে-মুছতে সমরকে লক্ষ করে বললাম, সমর, আমি আজ বিকেল পাঁচটা একুশের ট্রেনে বাইরে যাচ্ছি।

কোথায় অমিতদা?—লেখা থেকে মুখ তুলে প্রশ্ন করল সমর।

লিলুয়া—সঙ্গে মিসেসও যাচ্ছেন। শুনলাম তুমিও নাকি আজ থেকে কয়েক দিনের জন্যে ছুটি নিচ্ছ?

হ্যাঁ, সোমবার পর্যন্ত। মায়ের শরীরটা ভালো নয়, তাই।

ভূমিকা ছেড়ে এইবার আসল কথায় এলাম।

কী লিখছ সেই সকাল থেকে, দেখি?—হাতটা বাড়িয়ে দিলাম সমরের দিকে। ওর হাত থেকে লেখাটা নিয়ে চোখ বোলাতে লাগলাম। তারপর হঠাৎ যেন খুব দেরি করে ফেলেছি এমনি ভাব দেখিয়ে বলে উঠলাম, নাঃ, আর দেরি করলে বোধহয় ট্রেন ধরতে পারব না।—বলে ক্যাসুয়ালি একবার আমার হাতঘড়ির দিকে তাকালাম: আরে, কোথায় গেল ঘড়িটা? নীচে ফেলে আসিনি তো। সমর, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, প্লিজ, একবার দেখো না, ঘড়িটা আমি সুকান্তর কাছে ফেলে এসেছি কি না?

আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।—প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল সমর। বেচারা অনেক উন্নতির আশা রাখে, তাই বসকে অখুশি করতে চায় না।

সমর বেরিয়ে যেতেই আমি তৎপর হয়ে উঠলাম। একলাফে হাজির হলাম দেওয়াল-ঘড়ির সামনে। দেওয়াল-ঘড়িতে তখন চারটে বেজে একুশ মিনিট। সুতরাং কাঁটা ঘুরিয়ে সাড়ে চারটের জায়গায় নিয়ে গেলাম। ঢং করে একটা ঘণ্টা বাজতেই মিনিটের কাঁটাটা এগিয়ে দিলাম। ৪-৪৬ মিনিটের জায়গায়। বাথরুমে আমার হাতঘড়ি ফেলে আসার সময় ঘড়ির কাঁটা পচিশ মিনিট এগিয়ে দিয়েছিলাম। অতএব এখন বাকি শুধু সমরের ঘড়িটা।

এবার বাথরুমে গিয়ে ঘড়িটা হাতে পরে বেরিয়ে এলাম। অফিস রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে সমরের অপেক্ষা করতে লাগলাম।

মিনিট-পাঁচেক পরে দোতলায় সারা অফিস চষে ও ফিরে আসতেই বললাম, তোমাকে শুধু-শুধু বিরক্ত করলাম। ঘড়িটা ভুল করে বাথরুমেই ফেলে এসেছিলাম।—আমি দরজা আগলে এমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম, যাতে সমর ভেতরে ঢুকে দেওয়াল-ঘড়ির সময় না দেখে ফেলে।

ঘড়ির কথা ওঠায় একটা কথা মনে পড়ে গেল, সমর।

সমর জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল আমার দিকে।

আমাকে একটা ঘড়ি কিনতে হবে, এক রিলেটিভের জন্যে। এই ধরো একশো-সোয়াশোর মধ্যে (সমর আগে একদিন বলেছিল, ওর ঘড়িটার দাম একশো তিরিশ টাকা। ভাগ্যিস কথাটা মনে ছিল)। এখন কী ঘড়ি দিই ভাবছি।

কেন, অ্যাংলো সুইস দিন না।

আচ্ছা দেখি, তোমার হাতটা দেখি। —বলতে-বলতে সমরের ঘড়িসুদ্ধ বাঁ-হাত টেনে নিলাম আমার বুকের কাছে। আমার বুড়ো আঙুলের ডগা এমন নিখুঁতভাবে ওর হাতঘড়ির ডায়াল ঢেকে রইল যে, সমরের পক্ষে তখন সময় দেখা সম্ভব হল না।

তোমার ঘড়িটা কী ঘড়ি?—এবং এবার কথা শেষ হতে-না-হতেই সমরের হাতঘড়ি আমি খুলে নিয়েছি, নিয়ে ডায়ালটা আমার দিকে ফিরিয়ে দেখতে শুরু করেছি।

অ্যাংলো সুইস।—আমার ব্যবহারে একটু অবাক হলেও সমর নির্বিকার।

তা হলে এইরকম একটা ঘড়িই কিনে দেওয়া যেতে পারে।—ঘড়িটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে-দেখতে বললাম, কত দাম তোমার ঘড়িটার? দেড়শোর বেশি হলে আমার পক্ষে…।

না, না, ওটার দাম মাত্র একশো তিরিশ টাকা।

সমরের কথা শেষ হতে না হতেই ওর হাতঘড়িটা আমার আঙুলের আওতা ছাড়িয়ে (অথচ আমি জানি, কতখানি কুশলী হলে সমরের চোখের সামনে ওইরকম কায়দা করে ঘড়িটাকে মেঝেতে ফেলা যায়!) মেঝেতে ছিটকে পড়ল, এবং অনিবার্যভাবেই ঘড়ির ডায়ালের কাচ তখন ভেঙে গেছে।

সমর অস্বস্তিভরে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।

সমর, এক্সট্রিমলি সরি। রোববার দিন আমি ফিরছি। কথা দিচ্ছি, তোমার ঘড়িটা মেরামত করিয়ে সোমবার দিনই তোমাকে দিয়ে দেব। —বলে অচল ঘড়িটা নির্বিবাদে পকেটে ভরে ফেললাম।

না, না, অমিতদা, তার কোনও দরকার নেই…। আমিই ওটা সারিয়ে নেব’খন। সমর ইতস্তত করে বলে উঠল।

কিন্তু ও কী করে জানবে আমার মনের কথা। সুতরাং ওর সদিচ্ছায় ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়ে বললাম, আমি যদি ঘড়িটা সারিয়ে দিই, তবে কি তোমার আপত্তি আছে, সমর? আফটার অল দোষটা যখন আমারই।

সমর নিশ্চুপ। বস বলে কথা!

যাও, লেখাটা শেষ করে ফ্যালো গিয়ে—বেশ জমেছে। আমি এখন হাতের কাজটা সেরে নিই। ওদিকে তোমার বউদির সঙ্গে একেবারে স্টেশনে গিয়ে দেখা করতে হবে। টিকিট অবশ্য আগেই কাটা আছে।—বলতে-বলতে সমরের লেখাটা ফেরত দিলাম। তারপর ধীরেসুস্থে আমার টেবিলে গিয়ে বসলাম।

যাক, ঘড়ির ব্যাপারটা অনেক কষ্টে কায়দা করা গেছে। ওদিকে ইলা কী করছে কে জানে। ওকে যথাসম্ভব প্রাঞ্জল করে সময় চুরির পরিকল্পনাটা আমি বুঝিয়ে দিয়েছি। এরপর ও যদি ঠিকমতো মিসেস অরোরাকে বোকা বানাতে না পারে, তো সমস্ত কিছুই ওলটপালট হয়ে যাবে।

লেখা নিয়ে ব্যস্ত সমরের দিকে একপলক চোখ বুলিয়ে আয়েস করে একটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেটের ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মধ্যে যেন ইলার গতিবিধি আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম।

আসল সময় অনুযায়ী ঠিক পাঁচটা বাজতে চব্বিশ মিনিটের সময় ইলা সান্যাল ফ্ল্যাট ছেড়ে বাইরে এল। কিন্তু ওর হাতঘড়ি, এবং ঘরের দেওয়াল-ঘড়ি দুটোতেই পাঁচটা বাজতে এক মিনিট। অর্থাৎ ওর স্বামীর কথা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেছে ইলা। বাইরে বেরিয়ে ও দরজা ভেজিয়ে দিল, কিন্তু সামান্য ফাঁক রেখে দিল। চারপাশে একবার তাকাল। তারপর টুক করে করিডরের কার্পেট মোড়া প্রস্থটুকু নিঃশব্দে পার হয়ে অরোরাদের দরজায় আস্তে নক করেই নিজের জায়গায় আবার ফিরে এল, ঝুঁকে পড়ল দরজার কাছে। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটি চাবি বের করে লকের ভেতর গলিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে খটাং-খটাং শব্দ করতে লাগল।

ঠিক এইসময় ইলার পিছনে অরোরাদের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে গেল, ভেসে এল ভরাট গম্ভীর পুরুষ কণ্ঠ, আপনি কি দরজায় নক করেছিলেন?

ভীষণভাবে চমকে উঠল ইলা। মিসেস অরোরার গলা তো এত গম্ভীর নয়! দরজায় চাবি ঘুরিয়ে চাবি ভ্যানিটি ব্যাগে ভরল ইলা।

ততক্ষণে আরও একবার ‘আপনিই কি একটু আগে নক করছিলেন?’ জিগ্যেস করা হয়ে গেছে।

এবার দুরুদুরু বুকে ঘুরে দাঁড়াল ইলা: কই, ন-না, না তো!

তা হলে আমারই বোধহয় শুনতে ভুল হয়েছে।—মিস্টার অরোরা দরজা বন্ধ করতে যেতেই বেপরোয়া হয়ে ইলা বলে উঠল, শু-শুনছেন!

(ইস, এভাবে যে হুমদো বুড়োটা বেরিয়ে আসবে কে জানত! অমিত বলেছিল, মিস্টার অরোরা রাত বারোটার আগে ফেরেন না। কিন্তু…।)

কী?—অরোরার ভুরু ঊর্ধ্বমুখী হল।

মিসেস অরোরা আছেন? ওঁর সঙ্গে একটু কথা ছিল।—ইতস্তত করে বলল ইলা।

কী দরকার আমাকেই বলুন না।—আলাপের আগ্রহের সুরে বললেন অরোরা। এমনিতে মহিলাদের সঙ্গে আলাপে ওঁর কোনও আপত্তি নেই, বরং ভালোই লাগে। আর এখন ইলাকে দেখে ওঁর মনে হচ্ছে, আ বিউটি ইন ডিসট্রেস। মরিয়া হয়ে ইলা মিসেস-এর পরিবর্তে মিস্টারের সঙ্গেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ছক বাঁধা কথা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল।

আপনি বোধহয় শুনেছেন, লাস্ট সানডে আমাদের ফ্ল্যাটে চোর এসেছিল?

হ্যাঁ, ভারি অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না?

হ্যাঁ। বলছিলাম, আজ পাঁচটা একুশের ট্রেনে আমি আর উনি বাইরে যাচ্ছি। এ ক’টা দিন সুযোগ-সুবিধে মতো যদি আমাদের ফ্ল্যাটের দিকে একটু নজর রাখেন, তা হলে বড় উপকার হয়।

কেন, দরজায় তালা দেননি বুঝি?—অরোরার কণ্ঠে বিস্ময়ের সুর।

(এই রে! গবেটটা লক্ষই করেনি কত কায়দা করে আমি দরজায় তালা দিলাম। নাকি ব্যাটা নকল চাবির কথা জানে না?)

হ্যাঁ, দরজায় চাবি দিয়েছি। কিন্তু আপনি বোধহয় জানেন না, চোর নকল চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুকেছিল, তাই।

তা হলে এক কাজ করুন না, আমি কড়া আর শেকল দিয়ে দিচ্ছি—ছুতোরমিস্তিরি ডাকিয়ে শেকলটা লাগিয়ে নিন, আর তাতে একটা তালা লাগিয়ে দিন।—অরোরা ঘুরে দাঁড়িয়ে এগোতে গেল। সম্ভবত শেকল আর কড়া আনার জন্যে। আর ঠিক তখনই ইলা দেখতে পেল অরোরার হাতে কোনও ঘড়ি নেই।

ও নিশ্চিন্ত হয়ে অরোরাকে বাধা দিল, না-না, আপনার কষ্ট করার দরকার নেই। বাইরের ঘরে আমরা তেমন কিছু রেখে যাইনি। তা ছাড়া এখন তো আর সময়ও নেই। পাঁচটা বাজে—। বলে নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাল ইলা। আর একইসঙ্গে বন্ধ দরজার ওপিঠ থেকে ওদের দেওয়াল ঘড়ির চাপা ঢং-ঢং শব্দ ভেসে এল।

অনেকটা স্বস্তি পেল ইলা। বলল, ওই পাঁচটা বাজল। আর দেরি হলে ট্রেন ফেল করব। তা ছাড়া উনি স্টেশানে ওয়েট করছেন।

তা হলে এক কাজ করুন। আমাদের যে-বাচ্চা চাকরটা আছে, ওটাকে বলে দিই, এ ক’টা দিন আপনাদের ফ্ল্যাটেই ও রাত কাটাক। চোর-টোরের ভয় তা হলে আর থাকবে না।

(ড্যাম ইউ) না, না, শুধু-শুধু একটা বাচ্চাকে কষ্ট দিয়ে লাভ কী? আপনি একটু নজর রাখলেই হবে। থ্যাংক ইউ।

অরোরার দিকে চেয়ে একটুকরো মিষ্টি হাসি জুড়ে দিল ইলা। তারপর হনহন করে এগিয়ে গিয়ে লিফটে উঠল।

ইলার পিছনটা জরিপ করতে-করতে ‘ফ্যান্টাবুলাস!’ বলে শিস দিয়ে উঠলেন অরোরা। তারপর দরজা বন্ধ করে, নিজের দজ্জাল বউকে বিয়ে করে যে কী ভুল করেছেন সে-কথা ভাবতে-ভাবতে ডিক্যান্টারের দিকে এগিয়ে গেলেন।

সকলের চোখ এড়িয়ে নিজের ফ্ল্যাটে যখন পৌঁছলাম, তখন পাঁচটা বেজে ন’ মিনিট (অর্থাৎ, আসল সময় পাঁচটা বাজতে চোদ্দো মিনিট)। দরজা ঠেলতেই নিঃশব্দে খুলে গেল। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। দেখি ঘরের সোফায় ইলা বসে রয়েছে। আমাকে দেখেই ও ঘাড় হেলিয়ে জানাল সবকিছুই ঠিক আছে। তার মানে, পরিকল্পনার কোথাও কোনও চেঞ্জ হয়নি।

মারকিউরিক ক্লোরাইড মেশানো জলের গ্লাসটা কোথায়?—চাপা গলায় ওকে প্রশ্ন করলাম।

রান্নাঘরে।—আস্তে জবাব দিল ইলা।

ঠিক এইসময় দরজায় সামান্য শব্দ হতেই আমি ছুটে দরজার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম। ‘ম্যাজিক আই’ দিয়ে তাকিয়ে দেখি, বাইরে নির্বিকার ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে প্রাণকান্ত সমাদ্দার। অতএব সঙ্গে-সঙ্গে দরজা খুলে ওকে ভেতরে টেনে নিলাম। তারপর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলাম। প্রাণকান্ত সোফায় এসে বসতেই আমি তিরিশটা দশটাকার বান্ডিল টেবিলের ওপর অবহেলা ভরে ছুড়ে দিলাম। প্রাণকান্ত স্থির লোভাতুর চোখ মেলে নোটের বান্ডিলগুলোর দিকে চেয়ে রইল।

আমি এইবার আসল কথাটা উচ্চারণ করলাম, মিস্টার সমাদ্দার, মোট তিরিশহাজার আছে, দশহাজার টাকা বোনাস। আমাদের আপনি মুক্তি দিন।

প্রাণকান্ত কাঠ হয়ে বসেই রইল। লম্বা জিভটা বের করে শুকনো ঠোঁটে একবার বুলিয়ে নিল।

ইলা, মিস্টার সমাদ্দারের বোধহয় গলা শুকিয়ে গেছে।

ইলা বুঝল আমার ইঙ্গিত। ও চট করে রান্নাঘরে চলে গেল।

একটু পরে ও যখন জলভরা গ্লাসটা এনে সমাদ্দারের সামনে ধরল, সমাদ্দার স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো যান্ত্রিকভাবে গ্লাসটা নিয়ে পুরো জলটাই খেয়ে নিল। ওর স্বচ্ছ দৃষ্টি তখনও ওই টাকার স্তূপের দিকে।

বিপর্যয় ঘটল কয়েকসেকেন্ড পরেই।

প্রাণকান্ত মেঝেতে উলটে পড়ল। তারপর শুরু হল ওর ছটফটানি। দু-হাতে গলা খামচে ধরে সমাদ্দারের দেহটা ওলটপালট খেতে লাগল।

সেই মুহূর্তে শুরু হল আমার আর ইলার কাজ।

এক: দেওয়াল-ঘড়ির কাঁটা ঠিক করলাম।

দুই: নোটের বান্ডলগুলো আবার সিন্দুকে ঢুকিয়ে চাবি দিয়ে সিন্দুকের দরজা বন্ধ করে দিলাম।

তিন: ইলা রান্নাঘর থেকে আরও কিছুটা মারকিউরিক ক্লোরাইড মেশানো জল নিয়ে এসে টেবিলে রাখা আমার কয়েকটা পাণ্ডুলিপির ওপর সেই জল ছিটিয়ে দিয়ে বাকি জল টেবিলে ঢেলে দিল।

চার: প্রাণকান্তর জল খাওয়া গ্লাসটা রুমালে ধরে টেবিল থেকে তুলে মেঝেয় ফেলে দিলাম। গ্লাসট সশব্দে ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গেল।

প্রাণকান্তর অবস্থা তখন ভয়ংকর। দু-হাতে ও হাওয়া আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে। দেহটা ক্ষণে-ক্ষণেই খিঁচুনি মেরে কেঁপে উঠছে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সাদা গ্যাঁজলা। চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে।

শেষ মুহূর্তের প্রতীক্ষায় বিষাক্ত প্রাণকান্তকে রেখে আমি আর ইলা চটপট ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে এলাম (তার আগেই নকল চাবিটা প্রাণকান্তর পকেটে গুঁজে দিয়েছি)। দরজায় চাবি দিয়ে সকলের চোখ এড়িয়ে আমরা এগিয়ে চললাম সিঁড়ির দিকে।

আমার উত্তেজিত হৃৎপিণ্ড তখন আতঙ্কে ধুকপুক করছে। উত্তেজনা কমানোর জন্যে পকেট থেকে একটা ট্যাবলেট বের করে মুখে পুরে দিলাম। নিজেকে ভীষণ ক্লান্ত মনে হল। বেশি বয়েসে এত ঝক্কি পোয়ানো বোধহয় ঠিক হয়নি। সামনের রোববারের কথা ভেবে নাড়িভুঁড়ি যেন উলটে এল। নাঃ, অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রাণকান্তর বরফশীল বিকৃত মৃতদেহটা আমাদেরই আবিষ্কার করতে হবে।

ইলার দিকে একবার তাকালাম। ও কী ভাবছে, কে জানে! কিন্তু ওর মুখে আতঙ্কের লেশমাত্র ছায়াও কাঁপতে দেখলাম না।

রবিবার দিন অফিসের দেওয়াল-ঘড়ির সময় শুধরে যখন বাড়ির কাছে পৌঁছলাম, হাতঘড়িতে (এখন ঘড়ি ঠিক সময় দেখাচ্ছে) তখন রাত আটটা। অফিসে গিয়ে সমর ফেরেনি দেখে আরও নিশ্চিন্ত হয়েছি। কারণ, আমার চেম্বারের দুটো চাবির একটা থাকে আমার কাছে, আর অন্যটি থাকে সমরের কাছে। সুতরাং ঘড়ির কারসাজি যে কেউ ধরে ফেলেছে এমন সম্ভাবনা নেই।

লিফটে উঠতে-উঠতে পাশে দাঁড়ানো ইলার দিকে তাকালাম। কী আশ্চর্য! ওর এতটুকু ভয়ডর নেই? সুখের আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে ওর চোখে-মুখে।

ইলা, দরজা কি আমিই খুলব—?—ওকে জিগ্যেস করলাম। মনে ক্ষীণ আশা, যদি ও দরজা খুলতে রাজি হয়।

কেন, তোমার কি ভয় করছে?—ব্যঙ্গের সুরে জানতে চাইল ইলা।

এ কোন নতুন ইলা? একটু অবাক হলাম।

যতই লিফট উঠছে দুদ্দাড় করে বেতালা ছুটে চলেছে হৃৎপিণ্ড। কখনও কি থামবে না এর অশান্ত গতি? নাকি ট্যাবলেট খেয়ে নেব একটা?

লিফট থামতে দুজনে করিডরে পা রাখলাম। পকেট হাতড়ে ফ্ল্যাটের চাবি বের করে বাগিয়ে ধরলাম। করিডরের আলো সোজা গিয়ে পড়েছে আমাদের ফ্ল্যাটের দরজায়।

চাবি ঢোকাতে গিয়ে অবাধ্য ডানহাত বারকয়েক কেঁপে গেল। আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ইলা। দরজায় ওর ছায়া এসে পড়েছে।

কী হল, খোলো?—পেছন থেকে ইলার অধৈর্য স্বর ভেসে এল। কোনওরকমে চাবি ঘোরালাম। খট করে লকটা সরে গেল।

হাতের চাপে ধীরে-ধীরে খুলতে শুরু করল সেগুন কাঠের বার্নিশ করা দরজা।

ভেতরটা কালো অন্ধকার।

দরজা যতই খুলছে, করিডরের আলোর ফলা ততই চওড়া হচ্ছে ঘরের ভেতরে।

দরজা পুরোটা খুলতেই যে-দৃশ্য দেখলাম তাতে…।

অন্ধকার ঘরের আলোছায়ায় পড়ে রয়েছে প্রাণকান্ত। কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করছে ওর দেহটা। দু-চোখ বিস্ফারিত। ধীরে-ধীরে ও উঠে দাঁড়াল। দু-হাতের দশ আঙুল শকুনের নখের মতো বাঁকিয়ে ঘৃণাভরে কুটিল চোখ নিয়ে টলতে-টলতে ও এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকে। নিষ্ফল আক্রোশে হাওয়া আঁকড়ে ধরছে ওর হাত। জীবন্ত শীতল মৃতদেহের মতো অনিশ্চিত পদক্ষেপে ও এগিয়ে আসছে। এগিয়ে আসছে রক্তপিপাসায়। কাছে—আরও কাছে…।

বুকের খাঁচায় হৃৎপিণ্ডটা ভীষণভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। লাফিয়ে উঠল গলা দিয়ে। মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছেয় শেষবারের মতো উন্মাদ হয়ে এসে আঘাত করল টাকরয়।

সেই মুহূর্তে পেছন থেকে এক প্রচণ্ড ধাক্কা দিল কেউ। হুমড়ি খেয়ে ছিটকে গেলাম প্রাণকান্তর আওতায়। ওর বাঁকানো নখসুদ্ধ দশ আঙুল আঁকড়ে ধরল আমার গলা…।

পুরো ব্যাপারটার একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা ভেবে ওঠার আগেই আমার রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ডটা যেন মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসে বাইরে ছিটকে পড়ল। তারপর নিশ্চল হয়ে পড়ে রইল মেঝেতে।

অন্ধকার ঘরের ভেতর অমিত সান্যালের প্রাণহীন দেহটা লুটিয়ে পড়তেই ইলা ঘরের দরজা বন্ধ করে আলো জ্বেলে দিল। তারপর কাছে এগিয়ে গিয়ে প্রাণকান্তর প্রসারিত হাতের বাঁধনে ধরা দিল: বিজন—বিজন!

ইলার মাথায় হাত বুলিয়ে বিজন বলল, ভয় পেয়ো না, ইলু সোনা। আমরা দুজনে মিলে এইমাত্র এই শতাব্দীর নিখুঁততম খুন এক্সিকিউট করেছি। ডাক্তার অমিত সান্যালকে হার্ট ফেলিয়োর কেস বলেই রায় দেবে, তাই না?

ইলা বিজনের বুক থেকে মুখ তুলল: তুমি এখন চলে যাও, নয়তো বিপদে পড়বে। আমি এদিকে ডাক্তার ডেকে ব্যাপারটার একটা শেষ ফয়সালা করে ফেলি।

হ্যাঁ, যাচ্ছি।—বলে বিজন সোফায় বসল: এই তিনদিন একটা বন্ধ ফ্ল্যাটে কাটাতে আমার ভীষণ বোর লেগেছে। অবশ্য তুমি যে রান্নাঘরে খাবারের স্টক রেখে যাবে, সেটা জানতাম।

ইলা হাসল: জানো, যখন তুমি শুধু জল খেয়ে পড়ে গিয়ে অভিনয় করতে শুরু করলে, তখন অমিত ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

তা তো পাবেই। তবে আমি একটু ওভারঅ্যাকটিং করে ফেলেছি।

বিজন সেন এবার ওর পকেট থেকে একটি ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশান সার্টিফিকেট বার করে ইলার দিকে এগিয়ে দিল: এই নাও, তোমার হতভাগা প্রথম স্বামীর কাগজখানা ফেরত নাও। কে জানত ছ’বছর আগে যে প্রাণকান্ত সমাদ্দার মারা গেছে, তার সঙ্গে তোমার বিয়ের কাগজখানা এতদিন পরে হঠাৎ কাজে লাগবে! তবে ইলা, আমাদের একসঙ্গে তোলা এই ফটোখানা কিন্তু আমি ফেরত দিচ্ছি না।—বলে বিজন সেটা ইলাকে দেখাল।

রেখে দাও, কোনও ক্ষতি নেই। কিন্তু ওই ফটোটাকে প্রাণকান্ত আর আমার বলে চালাতে কে শিখিয়ে দিয়েছিল, স্যার?

হেসে ইলাকে কাছে টেনে নিল বিজন। ওর গালে একটা চুমু খেয়ে বলল, অমিত সান্যাল একটি গর্দভ। তোমার নতুন প্রেমিকের খোঁজ ও রাখেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *