1 of 2

সমস্যা গুরুতর

সমস্যা গুরুতর

নার্সের এগিয়ে দেওয়া পোশাকের গায়ে মনোযোগ দিয়ে আঙুল চালাল বিপুল শর্মা। বুঝল, পোশাকের কাপড়টা রেয়ন। অর্থাৎ, পোশাকটা ওর নিজের নয়।

নার্স, আপনার হয়তো ভুল হয়েছে।—বিরক্ত স্বরে বলল বিপুল, এ-ড্রেস আমার নয়।

ঠিকই ধরেছেন।—সুরেলা গলায় নার্স জবাব দিল, কারণ, আপনার জামাকাপড় ওই অ্যাকসিডেন্টে বিশ্রীভাবে ছিঁড়ে যাওয়ার জন্যে নতুন ড্রেস দিতে হয়েছে। আপাতত এগুলো পরেই আপনাকে কাজ চালাতে হবে।

ও।—বিপুল শর্মার স্বর কিছুটা শান্ত হল: কিন্তু আমার চোখের এই ব্যান্ডেজটা কবে খোলা হবে?

আজ। মেজর দত্ত এলেই। উনি এখুনি এসে পড়বেন।

যাক—বাঁচা গেল।—হাঁপ ছাড়ল বিপুল, বলল, তা হলে ড্রেসগুলো এখন থাক। চোখের ব্যান্ডেজ খোলা হলে পর ওগুলো দেখেশুনে পরে ফেলব, কী বলেন?

সে আপনার খুশি।—নার্স হেসে বলল।

সুতরাং আবার বিছানায় হেলান দিয়ে শরীর এলিয়ে দিল বিপুল।

দুর্ঘটনার ব্যাপারটা ওর এখনও স্পষ্ট মনে আছে। আজ সকালে, একটু বেলার দিকে ইরাদের বাড়ির পিছনের খোলা মাঠ ধরে সে যাচ্ছিল। উদ্দেশ্য ছিল একটা, কিন্তু অসহ্য গরম, আর একটু আগেই গলায় ঢেলে দেওয়া আট পেগ জিন, এই দুইয়ের ধকল বিপুল শর্মার শরীর সামলে উঠতে পারেনি। তা ছাড়া ওর স্বাস্থ্যের যা তিন অবস্থা!

মাঠ থেকে বহুদূরে, জঙ্গলের ঠিক শুরুতেই, ছিল একটা পুরোনো কুয়ো। বিপুল কুয়োর দিকেই যাচ্ছিল। বহুদিন ধরে ব্যবহার না হওয়ায় কুয়োটা শুকিয়ে হেজে গেছে। সুতরাং নিরাপদ জায়গা ভেবে ওই কুয়োতেই ও সব টাকা লুকিয়ে রেখেছিল—আজ থেকে প্রায় মাসতিনেক আগে। একটা টিনের বাক্সে টাকাটা ভরে ও রেখে দিয়েছিল কুয়োর নীচে, শুকনো খটখটে আগাছায় ভরা জমিতে। এই গোপন জায়গাটার কথা ও ইরাকে পর্যন্ত বলেনি।

বিপুলের হাতে তখন ছিল একটা তারের হ্যাঙার। সেটাকেই টেনে লম্বা করে ও একটা হুকের মতো করেছিল। তারপর তার একপ্রান্তে দড়ি বেঁধে বাঁকানো মুখটা সরসর করে নামিয়ে দিয়েছিল কুয়োর ভেতরে। ঠিক যেমন করে লোকে ছিপ ফেলে বঁড়শিতে মাছ গাঁথে।

ওর উদ্দেশ্য ছিল দড়িটা ঠিকমতো দুলিয়ে কুয়োর নীচে পড়ে থাকা টিনের বাক্সের হাতলে হুকটাকে আটকানো। তারপর টেনে তুললেই হুকের সঙ্গে সহজেই উঠে আসত বাক্স—সেইসঙ্গে তিরিশহাজার টাকা।

কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি। তার আগেই ঘটে গেছে এই হতচ্ছাড়া দুর্ঘটনা। তাই বিপুল শর্মা এখন নার্সিং হোমে।

কুয়োর পাড়ে পৌঁছনোর পরই বিপুলের মাথাটা হঠাৎ কেমন ঘুরে গেছে। বোধহয় আট পেগ জিনের পর এই প্রখর রোদে খোলা মাঠে পথ হাঁটাটা ওর দুর্বল শরীর সইতে পারেনি। জ্ঞান হারানোর আগে ওর আবছা-আবছা যেটুকু মনে আছে তা হল কুয়োর বাঁধানো পাড়ে ওর মাথাটা বিশ্রীভাবে ঠুকে গিয়েছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই।

নার্সিং হোমের দরজার ওপরে টাঙানো সুদৃশ্য দেওয়াল-ঘড়িতে ঢং-ঢং করে পাঁচবার ঘণ্টা বাজল। পাঁচটা বাজে। অর্থাৎ, এরই মধ্যেও প্রায় ছ’ঘণ্টা সময় নষ্ট করে ফেলেছে। ইরাকে ও বলেছিল, বেলা বারোটা নাগাদ হাওড়া স্টেশনে বড় ঘড়িটার নীচে অপেক্ষা করতে। ও হয়তো এখনও অধৈর্যভাবে পায়চারি করছে। হয়তো ভাবছে বিপুল প্রেমিকাকে ফাঁকি দিয়ে সমস্ত টাকা একাই নিয়ে কেটে পড়েছে। যদি শেষ পর্যন্ত ও ভেবে বসে বিপুল ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তা হলে ও নির্ঘাত পুলিশে খবর দেবে, ফোন করে বলে দেবে বিপুল কোথায় আছে—ব্যস।

না, এখান থেকে ওকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরোতে হবে। টাকাটা নিয়েই ও সোজা রওনা দেবে হাওড়া স্টেশনের দিকে। তারপর ইরাকে সঙ্গে নিয়ে…।

কিন্তু ততক্ষণ ইরার ধৈর্য করে থাকবে তো?

নার্সকে উদ্দেশ করে বিপুল বলল, আমি এই নার্সিং হোমে কী করে এলাম বলতে পারেন?

একজন পাখি শিকারি আপনাকে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দ্যাখে। সে-ই আপনাকে টেনেটুনে গাড়িতে তোলে। ওই করেই তো আপনার জামা-কাপড়গুলো সব ছিঁড়েছে! তারপর গাড়ি করে সে আপনাকে এই নার্সিং হোমে নিয়ে আসে।

ও, লবণ হ্রদে লোকে তা হলে এখনও পাখি শিকার করতে যায়? ভাবল বিপুল। শিকারি বাবাজীবনকে ধন্যবাদ দিতে হয়—একইসঙ্গে সে বিপুল শর্মা এবং তিরিশহাজার টাকাকে বাঁচিয়েছে বলে। আর ভাগ্যিস ওর পকেটে হাজারখানেক টাকা ছিল। ওটা থেকে নিশ্চয়ই নার্সিং হোমের খরচ মেটানো যাবে।

পুরোনো ঘটনা বিপুলের মনের পরদায় ছায়া ফেলে যায়। ও এখন বেশ বুঝতে পারছে, কীভাবে শুরু থেকেই ও মারাত্মক সব ভুল করে চলেছে। অবশ্য সে-ভুল শোধরানোর সময় এখনও আছে। তিরিশহাজার টাকা এখনও অপেক্ষা করছে ওই কুয়োর গর্তে—ওরই জন্য। ওই টাকার খোঁজ বিপুল ছাড়া আর কেউ জানে না।

ইরার সঙ্গে বিপুল শর্মার পরিচয় একটু অদ্ভুতভাবেই। ভি.আই.পি রোডে একটা অ্যাক্সিডেন্টে পড়েছিল বিপুল। তেমন বিপজ্জনক কিছু নয়—ছোটখাটো দুর্ঘটনা। তখন সেখানে হাজির দর্শকদের গায়ে-পড়া উপদেশ হজম করে ও চলেই যাচ্ছিল, কিন্তু তখন ইরা ওকে পিছু ডেকেছে। ওর পরনের সাদা শাড়ি জানিয়ে দিচ্ছিল ইরা বিধবা। কিন্তু তারপরই ইরা যে-প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে বিপুল অবাক না হয়ে পারেনি। ও ওকে প্রথমে ওর বাড়িতে যাওয়ার জন্য—পরে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকার প্রস্তাব দিয়েছে।

কথাবার্তায় বিপুল আগেই জানিয়েছিল কলকাতায় ও নতুন। সেইজন্যই ওই পেয়িং গেস্ট হওয়ার প্রস্তাব। কেন জানি না, রাজি হয়ে গেছে বিপুল। তারপর যতই দিন গেছে ততই ও ইরার মতলব টের পেয়েছে।

ক্রমে-ক্রমে একদিন মতলবটা খুলেই বলল ইরা। সব শোনার পর বিপুলের মনে আর কোনও সন্দেহ থাকেনি। ইরা যে একজন সহকর্মীর আশাতেই সেদিন ওইরকম উপযাচক হয়ে ওকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, সেটা বুঝতে আর বাকি থাকেনি।

ইরার কথা অনুযায়ী জনৈক হোঁদলকুতকুত ব্যবসায়ী প্রতি শনিবার ভোর ছ’টায় এই ভি.আই. পি রোড ধরে অ্যামবাসাডার হাঁকিয়ে যায়। সঙ্গে থাকে প্রায় পঁচিশ-তিরিশ হাজার টাকা। তার কোম্পানির লেবারদের সাপ্তাহিক মাইনে। এই টাকাটা বরাবর সে নিজেই নিয়ে যায় ফ্যাক্টরিতে। ব্যবসায়ীর নাম দুলিচাঁদ আগরওয়ালা। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি কোথায় যেন তার লোহালক্কড়ের কারখানা আছে।

সব শুনে কাজটা তেমন কঠিন মনে হয়নি বিপুলের। এই কাজের সাফল্যের পক্ষে কতকগুলো জোরদার পয়েন্ট রয়েছে। প্রথমত দুলিচাঁদের বয়েস প্রায় ষাট। অর্থাৎ, কোনও আক্রমরকারীকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। আর দ্বিতীয়ত, সে অ্যামবাসাডারে একাই যাতায়াত করে—অর্থাৎ, নিজেই গাড়ি চালায়। আর সর্বশেষ পয়েন্ট, ভোর ছ’টা নাগাদ ভি.আই.পি রোড একেবারে নির্জন থাকে—তার ওপর সময়টা শীতকাল।

পরিকল্পনার সঙ্গে-সঙ্গে একটা পুরোনো বন্দুক বের করে বিপুলের হাতে দিয়েছিল ইরা। বিপুল অবাক হয়ে গিয়েছিল। তারপর সামান্য খোঁজখবর করে জেনেছিল ইরার ইতিহাস। ওর স্বামী ছিল এক দাগি আসামি। বছরখানেক আগে সে এনকাউন্টারে মারা গেছে। হয়তো স্বামীর কাছ থেকেই অস্ত্রটা একসময় ইরার হাতে এসেছে।

কিন্তু সব জেনেও বিপুলের কিছু করার ছিল না। কারণ, তখন ইরার সঙ্গে ও মনে-মনে জড়িয়ে গেছে।

কাজের প্ল্যানটা ভাবতে শুরু করেছিল বিপুল। ইরার মত অনুযায়ী এ-কাজে পরিশ্রম খুব সামান্যই। দূর থেকে যখনই সেই অ্যামবাসাডারটাকে বিপুল আসতে দেখবে তখনই ও বন্দুকটা সঙ্গে নিয়ে রাস্তার মাঝখানে মড়ার মতো শুয়ে পড়বে। বুড়ো আগরওয়ালা গাড়ি থামাবেই। এবং যেই সে গাড়ি থেকে নেমে বিপুলের কাছে এগিয়ে আসবে তখনই বিপুল বন্দুকটা তার কোমরে চেপে ধরবে। তার পরের কাজ অতি সামান্যই…।

টাকার ব্যাগটা নেওয়া হয়ে গেলে বিপুল সোজা গিয়ে উঠবে ইরার ঝরঝরে অস্টিনটায় (যেটা শতখানেক গজ দূরে আগে থেকে পার্ক করা থাকবে)। সোজা গাড়ি ছোটাবে হাওড়া স্টেশেন লক্ষ্য করে। ইরাও সময়মতো সেখানে গিয়ে বড় ঘড়ির তলায় অপেক্ষা করবে। বিপুল পৌঁছলেই ওরা দুজনে ট্রেনে চেপে চম্পট দেবে।

কিন্তু আসল কাজের সময় হিসেবের বাইরে একটা ব্যাপার ঘটে যাওয়ায় বিপুলের সমস্ত প্ল্যান বানচাল হয়ে গেল। ওরা জানত না, বুড়ো আগরওয়ালা নিরাপত্তার খাতিরে নিজের সঙ্গে রিভলভার রাখত। সুতরাং সেই বিশেষ মুহূর্তে বিপুল ও দুলিচাঁদ, দুজনেই রিভলভার ব্যবহার করল। ফল দাঁড়াল, দুলিচাঁদ প্রায়-নিহত এবং বিপুল আহত। তাই টাকা নিয়ে বিপুল আর হাওড়া যেতে পারেনি। সোজা ফিরে গেছে ইরার ডেরায়। ইরা ফেরার আগেই টাকাটা সে পরিত্যক্ত কুয়োর ভেতরে লুকিয়ে ফেলেছে।

ও ভেবেছিল, দুলিচাঁদ বোধহয় মরেই গেছে। তাই আঘাতটা পেল অনেক দেরিতে। ইরা আহত বিপুলের সেবায় মগ্ন। হঠাৎই রেডিওতে শোনা গেল বিশেষ ঘোষণা।

হ্যাঁ, দুলিচাঁদ মারা গেছে ঠিকই, তবে বিপুলের চেহারার একটা বিবরণ না দিয়ে নয়। সে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেঁটে এবং মোটা লোক। এক কোটি লোকের মধ্যেও সে জলহস্তীর মতো চোখে পড়বে। কারণ, তার চেহারা ঠিক একটা নাদুসনুদুস, গোল বেলুনের মতো। এককথায় জীবন্ত ফুটবল!

বিবরণ শুনে ভীষণ ভয় পেয়েছে বিপুল। কারণ ও জানে, ওর ফুটবলমার্কা চেহারায় যে-কেউই ওকে একপলকে চিনে ফেলবে। তাই ও ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তখন লবণ হ্রদ ছেড়ে শহরতলির কোথাও সরে পড়তে ইরাই পরামর্শ দিয়েছে।

শেষে ওরা ঠিক করেছে, না, শহরতলি নয়, একেবারে দেশান্তরী হবে বিপুল। তারপর দিনের-পর-দিন উপোস করে নিজেকে রোগা করবে। যাতে লোকে ওকে আর চিনতেই না পারে। তাই ইরাকে নিয়ে বর্ধমান চলে গিয়েছিল ও। দীর্ঘ চারমাস ও প্রায় অনশন করে কাটিয়েছে। বাড়ির কোটর ছেড়ে দিনের আলোয় একটিবারের জন্যও বেরোয়নি। অবশেষে যখন ওর দেখা মিলেছে, তখন ওকে চেনে কার সাধ্যি? কে বলবে, এ ফুটবল বিপুল? তার বদলে হাড়জিরজিরে হাড়ের ওপর চামড়া জড়ানো চেহারা। যেন কবর থেকে সদ্য কোনও কঙ্কালকে তুলে আনা হয়েছে।

সেই অবস্থাতেই কলকাতায় ফিরে এসেছে বিপুল শর্মা। ইরাও সঙ্গে এসেছে—তবে ওই স্টেশন পর্যন্তই। বিপুল ওকে বলেছে হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ির নীচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে। ও একা গিয়ে ইরার বাড়ির পিছনের সেই মাঠের কুয়ো থেকে টাকাটা তুলে আনবে।

কিন্তু কঙ্কালসার বিপুল কয়েকটা ভুল করেছিল। প্রথমত ওই শীর্ণ শরীরে ঝোঁকের মাথায় আট পেগ জিন টেনে ফেলেছিল। আর দ্বিতীয়ত, দুপুরের রোদ মাথায় করে মাঠ ভেঙে হেঁটে গিয়েছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। মাথা ঘুরে কুয়োর পাড়ে পড়ে গিয়ে ও এক দুর্ঘটনা বাধিয়ে বসেছে। তারপর জ্ঞান ফিরতেই এই নার্সিং হোম।

খাটের ওপর পাশ ফিরল বিপুল শর্মা। রুগ্ন শরীরে জিন খাওয়া তার উচিত হয়নি। তার ওপর আট পেগ, আর ওদিকে ইরা ওর জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করছে। হয়তো শেষ পর্যন্ত অধৈর্য হয়ে ও পুলিশেই—।

নার্সকে লক্ষ করে বলল, আচ্ছা, এখান থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় আমাকে কি কোনও কাগজপত্রে সই করতে হবে?

না, তার কোনও দরকার নেই।—নার্স জবাব দিল, আপনার শরীর এখন সুস্থ। আশা করি, আপনার মাথার চোটটাও সেরে গেছে—ও, এই তো মেজর দত্ত এসে গেছেন।

উঠে এসে খাটের কিনারায় বসল বিপুল। পা দুটো ঝুলিয়ে দিল মেঝেতে। একটা আশ্বাসের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে-সঙ্গে ও কাঁধের ওপর অভিভাবকের স্পর্শ অনুভব করল: কেমন আছেন এখন?

বিপুল তখন রেয়নের পোশাকটাকে দু-হাতে নেড়েচেড়ে দেখছে।

ডক্টর, ও বলে উঠল, ড্রেসটা দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ। কিন্তু আর একটু মাপমতো ড্রেস তো দিতে পারতেন—

খুব একটা বেঠিক মাপের হবে বলে তো মনে হয় না।—মেজর দত্ত হেসে জবাব দিলেন।

আপনি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন, ডক্টর?—বিপুলের গলা একটু রাগী এবং কঠিন নাকি এই পোশাকটা আপনার পোষা হাতির গা থেকে খুলে এনেছেন?

মানে—ব্যাপারটা কী জানেন, জ্ঞান হারালেও খাওয়া-দাওয়াটা কিন্তু আপনি একটুও কমাননি—।

তার মানে? আমি তো মাত্র আজ সকালেই অজ্ঞান হয়ে—।

বিপুল অনুভব করল মেজর দত্ত ওর চোখ থেকে ব্যান্ডেজ খুলে দিচ্ছেন এবং একইসঙ্গে বলে চলেছেন, এবার আপনি যে আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন না, সেটা আমার প্রশ্ন করার পালা।—হাসলেন মেজর দত্ত, বললেন, আজ মে মাসের কুড়ি তারিখ। আর আপনাকে এই নার্সিং হোমে ভরতি করা হয়েছে গত মার্চ মাসে। সেই অ্যাক্সিডেন্টের পর আপনি কোমায় চলে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে একজন মহিলা ছাড়া আর কেউ আপনাকে দেখতে আসেনি।

নিশ্চয়ই ইরা! ভাবল বিপুল।

সমস্ত ব্যান্ডেজ খোলা হয়ে গেলে মেজর দত্ত উঠে দাঁড়ালেন। বিপুল শর্মাও ধীরে-ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর সামনে চোখ রেখে সাবধানী পায়ে এগিয়ে চলল ঘরের অন্যপ্রান্তে রাখা একটা লম্বা আয়নার দিকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ খুলে পরিপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকাল নিজের শরীরের দিকে। তাকিয়েই রইল।

ও শুনতে পেল পিছন থেকে মেজর দত্ত বলছেন, আপনি এখন স্বাধীন। যেখানে খুশি যেতে পারেন আপনি। আপনাকে এখুনি ডিসচার্জ করে দেওয়া হবে।…আপনি শুধু বিলটা সেটল করার ব্যবস্থা করুন।

প্রচণ্ড খোঁজাখুঁজি করেও নিজের গলার স্বর খুঁজে পেল না বিপুল। ওর শরীরের বিপুল মেদভার এক অজানা উত্তেজনায় অথবা আতঙ্কে কাঁপতে লাগল। পাঁচ ফুট ব্যাসের ফুটবলমার্কা জলহস্তী চেহারার চর্বির থাকে ওর জলে ভেজা চোখ দুটো বুঝি হারিয়ে গেল। বিপুলের মনে হল, দুলিচাঁদ আগরওয়ালা যেন বাঁধানো দাঁত বের করে ওর দিকে চেয়ে হাসছে।

ও আয়নার সামনে থেকে কয়েক পা পিছিয়ে আসতে চেষ্টা করল। কিন্তু নিষ্ফল আক্ষেপে ওর হাত-পা কাঁপতে লাগল। নিঃশব্দ চিৎকারে ও বলতে চাইল, না—না—না…।

অত্যন্ত শান্ত মুখে মেজর দত্তের দিকে ফিরে তাকাল বিপুল। বলল, ডক্টর, আমাকে একটু বিষ দিতে পারেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *