হত্যাকাণ্ড
‘আপনি আপনার ওয়াইফকে খুন করতে চান?’ কাউন্টারে বসে থাকা কালো চেহারার লোকটি জিগ্যেস করল।
‘হ্যাঁ। না…মানে ঠিক খুন…।’
‘নাম?’
‘ওর—না আমার?’
‘আপনার।’
‘দেবতোষ রায়।’
‘ঠিকানা?’
‘পাঁচের এক বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড। কলকাতা।’
যান্ত্রিকভাবে লিখে চলল লোকটির হাত। যেন এরকম নাম ও ঠিকানা সে আগে অসংখ্যবার লিখেছে।
‘আপনার ওয়াইফের নাম?’
‘মালবিকা।’
‘বয়েস?’
‘একত্রিশ।’
তারপরই শুরু হল একের পর এক ধারাবাহিক ও গতানুগতিক প্রশ্নোত্তরের পালা। মালবিকার গায়ের রং, মুখের গড়ন, উচ্চতা, স্বাস্থ্য, ওজন, নাক-মুখ-চোখের বৈশিষ্ট্য, ইত্যাদি কত কী!
‘আপনার কাছে মিসেস রায়ের হলোগ্রাফিক ফটোগ্রাফ আছে? ওঁর ভয়েস রেকর্ড করা আছে?’
‘হ্যাঁ, আছে। এই নিন।’ পকেট থেকে দুটো জিনিসই বের করে দিলাম।
ভালো করে জিনিস দুটো উলটেপালটে দেখল লোকটি। তারপর বলল, ‘আচ্ছা—এবারে শুনুন…।’
দেখতে-দেখতে একটি ঘণ্টা পার হয়ে গেল। টের পেলাম, আমি ঘামতে শুরু করেছি।
‘ব্যস, সব শুনলেন তো? এবার ভেবে দেখুন, শেষ পর্যন্ত আপনার মনের জোর থাকবে তো?’ লোকটি উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। প্রচণ্ড একঘেয়েমি ও বিরক্তির অভিব্যক্তি মুখে ফুটিয়ে তুলল। তার প্রমাণ হিসেবে একইসঙ্গে একটা হাই উঠল।
আমি সবিনয়ে জানালাম যে, আমার মনের জোর থাকবে।
‘তা হলে এখানে সই করুন।’ একটা ফর্ম এগিয়ে দিল লোকটা।
সই করলাম।
‘আপনি জানেন এ-কাজটা বেআইনি?’
‘জানি।’
‘এ-কাজের জন্যে যদি আপনি বিপদে পড়েন তা হলে আমরা কিন্তু একটুও দায়ী হব না!’
এবার বিরক্ত আমিও হলাম। বললাম, ‘ঢের হয়েছে, এবার কাজের কথায় আসুন।’
লোকটি হালকাভাবে হাসল। আমার এই ধৈর্য্যচ্যুতিও ওর বহুদিনের চেনা। তারপর বলল, ‘আপনার ওয়াইফের রিয়েল ইমেজ তৈরি করতে আমাদের ন’ঘণ্টা লাগবে। ততক্ষণ আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন, আরাম পাবেন। ডানদিকের তিন নম্বর মিরার-রুমটা খালি আছে। আপনি ওটায় চলে যান।’
আমি শান্ত পায়ে এগিয়ে চললাম তিন-নম্বর আয়নাঘরের দিকে।
ঘরে ঢুকে নীল রঙের ভেলভেটের বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বিছানায় শরীরের চাপ পড়তেই মাথার ওপরে লাগানো আয়নার সিলিংটা দুরন্ত গতিতে ঘুরতে শুরু করল। আর একটা নরম কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনি তুলে বলতে শুরু করল, ‘ঘুমোও…ঘুমোও…ঘুমিয়ে পড়ো…।’
আমি অস্ফুট কণ্ঠে মালবিকার নাম উচ্চারণ করে চললাম।
মালবিকা, আমি এখানে আসতে চাইনি। তুমিই আমাকে বাধ্য করলে। তুমিই আমাকে দিয়ে এ অন্যায় কাজ করালে। ওঃ ভগবান! কেন যে আমি এখানে এলাম! যদি এই মুহূর্তে ফিরে যেতে পারতাম! ওঃ…আমি তোমাকে খুন করতে চাই না।
ঘুরন্ত আয়নার জটিল আলোর ঝিলিকের কম্পাঙ্ক ক্রমে বেড়ে চলেছে।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি।
স্বপ্নে দেখলাম আমি ফিরে গেছি সেই চল্লিশ বছর বয়েসে। খোলা সবুজ মাঠের ওপর উচ্ছল কিশোর-কিশোরীর মতো ছুটে বেড়াচ্ছি আমি আর মালবিকা। রঙিন তোয়ালের ওপরে পড়ে আছে টিফিন ক্যারিয়ার, ট্রানজিস্টার রেডিয়ো, কোল্ড ড্রিংকস-এর বোতল। একটু দূরেই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রিমিয়ার পদ্মিনী। তার ঝকঝকে সবুজ রং ঘাসের সঙ্গে যেন মিশে গেছে।
মালবিকা হাসছে। ওর একরাশ কালো চুল মুখের ওপরে ঝিলিমিলি হয়ে নাচছে। আমার নাম ধরে ডাকছে ও, ‘দেবতোষ…দেবতোষ…।’
আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। হাতে হাত। ঠোঁটে ঠোঁট। যৌবনে যৌবন। উত্তাপে উত্তাপ। পশ্চিমের আকাশ তখন লাল কালিতে কবিতার পাণ্ডুলিপি শেষ করে সূর্য-বিদায়ের নাটক শুরু করেছে।
দৃশ্য পালটে যায়। কাশ্মীর, নৈনিতাল, দার্জিলিং। আমরা যেন অপ্রাকৃত গতিতে উড়ে চলেছি দেশ থেকে দেশান্তরে। ১৯৯৭ সালের চিরসতেজ বসন্ত।
আর তারপর—যন্ত্রণাময় দুঃস্বপ্ন। মালবিকা ও কিংশুক। স্বপ্নের মধ্যেই এক অজানা অচেনা আবেগ আমার শরীরটাকে আমূল কাঁপিয়ে দিল। কী করে সব জলছবি ওলটপালট হয়ে গেল? কোথা থেকে এসে হাজির হল কিংশুক? কেন এল ও আমার আর মালবিকার ভালোবাসার মৃত্যু পরোয়ানা হাতে নিয়ে? জীবন কেন এত জটিল, কেন এত দুঃখময়? এ কি শুধু বয়েসের তফাত? উত্তাপের পার্থক্য? আমি, পঞ্চাশ ছোঁয়া প্রৌঢ়, আর মালবিকা যুবতী, এত ভয়ংকর যুবতী। কেন, কেন, কেন এমন হল?
নির্ভুল খুঁটিনাটি সমেত চোখধাঁধানো হয়ে দৃশ্যটা ফুটে উঠল। কিংশুক আর মালবিকা বসে রয়েছে এক রামধনু-রং ফুলের বাগানে। ওদের চুম্বনে ব্যস্ত ঠোঁট অনিচ্ছার ভঙ্গিতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মুহূর্তে আমার অনুপ্রবেশ।
সেই থেকে প্রচণ্ড রাগ। নিজের সঙ্গে এক দুরন্ত যুদ্ধ। কিংশুককে খুন করার চেষ্টা।
আরও দিন যায়। সংখ্যায় ও বিষয়বস্তুতে দুঃস্বপ্ন আরও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
অবশেষে মালবিকা—।
ঘুম ভাঙতেই দেখি আমার চোখ জ্বালা করছে। আমার স্বপ্নের কান্না মোটেই স্বপ্ন নয়।
‘উঠুন মিস্টার রায়, আমরা তৈরি।’
অগোছালোভাবে উঠে বসলাম। ওপরের নিঃস্পন্দ শীতল আয়নায় নিজের অপ্রতিভ ছায়া দেখলাম। পঞ্চাশটি ক্লান্তিকর বছরের প্রত্যেকটি যেন আমার অসহায় মুখে স্বতন্ত্র শিলালিপি খোদাই করেছে। ভয়ংকর ভুল করেছি আমি। বহু পুরুষই যুবতী স্ত্রী বেছে নিয়েছে, তারপর জলে আক্রান্ত চিনির দানার মতো তারা উদ্ধত যৌবনের হাতের মুঠোয় অস্তিত্ব ও ব্যক্তিত্বহীন হয়ে গেছে। নিজেকে পরখ করলাম আমি। খুঁতখুঁতে এই জরিপে সূচ্যগ্র মেদিনীর পার্থক্যও ধরা পড়ে। পেটে এখন চর্বির থাক—যারা কখনও রুগ্ন হওয়ার আশ্বাস দেয় না। তেমনই চিবুক। মাথার চুল উদ্বাস্তু হয়ে রওনা হয়েছে কোন দূর অঞ্চলের দিকে। শরীরের প্রতিটি কোষে এক অনিবার্য দুর্বলতার ছায়া।
কালো লোকটি আমাকে অন্য কোনও ঘরের দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।
গন্তব্যে পৌঁছে চমকে উঠলাম আমি: ‘এ তো মালবিকার ঘর!’
‘আমাদের কাজে কোনও খুঁত পাবেন না, মিস্টার রায়।’
‘সত্যিই তাই! এতটুকু তফাত নেই!’
পকেট থেকে দশহাজার টাকার একটা বান্ডিল বের করে লোকটির হাতে দিলাম। সে সামান্য হেসে বিদায় নিল। সেই হাসির অর্থ: আপনার টাকা খরচ সার্থক হবে।
ঘরটা নিস্তব্ধ এবং উষ্ণ। এ কি মালবিকার উষ্ণতা?
একটা সোফায় বসে পকেটে হাত দিলাম। রিভলভারের শীতল স্পর্শ অনুভবে সাড়া দিল। দশহাজার টাকা। কিন্তু এই মানসিক হত্যাকাণ্ড আমাকে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবে। একটা বাস্তব হত্যাকাণ্ডকে এড়াতে গেলে এই খরচের প্রয়োজন আছে। নৃশংস, অথচ নৃশংস নয়। মৃত্যু, অথচ মৃত্যু নয়। হত্যা, অথচ হত্যা নয়।
আমার মনটা হালকা হল, শান্ত হল। লক্ষ করতে লাগলাম ঘরের দরজার দিকে। গত ছ’মাস ধরে দিন-রাত আমি মালবিকাকে খুন করার স্বপ্ন দেখেছি। এখন সেই স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার সমাপ্তি হবে। যে-কোনও মুহূর্তে ঘরে এসে হাজির হবে মালবিকার বাস্তব প্রতিবিম্ব—একটি রোবট যাকে ধরা যায়, ছোঁয়া যায়, অথচ…।
‘দেবু—।’
‘মালবিকা!’
চমকে ঘুরে দাঁড়ালাম: ‘মালা—।’
শ্বাস নিতেও যেন আমার কষ্ট হচ্ছে।
ও দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। পরনে পালকের মতো কোমল কচি-কলাপাতা রং শাড়ি। পায়ে সুদৃশ্য সোনালি চটি। চুলের ঢাল এক অদ্ভুত মেঘলা পটভূমি। চোখ আয়ত। এবং তা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে ভালোবাসাময় দৃষ্টি।
বহুক্ষণ নীরব রইলাম। শুধু ওকে দেখছি। অবশেষে কথা বলার ক্ষমতা ফিরে পেয়ে অবাক সুরে বলে উঠলাম, ‘তুমি কী সুন্দর, মালা—।’
‘সুন্দর কখনও সুন্দর না হয়ে পারে?’ ও হেসে জবাব দিল।
‘দাঁড়াও, তোমাকে দেখি,’ আমার অস্ফুট স্বর কেমন অলৌকিক শোনাল।
ঘুমিয়ে-চলা মানুষের মতো দুটো আচ্ছন্ন হাত সামনে বাড়িয়ে দিলাম। বুকের ভেতরে অবাধ্য দামামা। গভীর জলের তলায় দাঁড়িয়ে এগিয়ে চলার মতো অনিশ্চিত টলোমলো পায়ে ওকে ঘিরে হেঁটে বেড়াতে লাগলাম। মাঝে-মাঝে ওকে স্পর্শ করেও দেখছি।
‘এত বছরেও আমাকে ভালো করে দেখোনি?’
‘এ দেখা কখনও ফুরোয় না।’ আমার চোখে জল।
‘আমাকে ডেকেছ কেন?’
‘প্লিজ, একটু সময় দাও, মালা, একটু সময় দাও আমাকে।’ ওর পাশে শরীর এলিয়ে বসে পড়লাম। কাঁপা হাত দুটো বুকের ওপর রাখলাম উত্তাপের খোঁজে। আমার অবিশ্বাসী চোখ কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না।
‘এ অসম্ভব। নির্ঘাৎ দুঃস্বপ্ন। কী করে ওরা তোমাকে তৈরি করল?’
‘সে-কথা আলোচনা করার অনুমতি নেই। তাতে ঘোর কেটে যায়।’
‘এ কি ম্যাজিক?’
‘না, বিজ্ঞান।’
ওর স্পর্শে উষ্ণতা। নখের পালিশ ও বাঁক নিখুঁত। কোনও জায়গায় কোনও গরমিল নেই। বাস্তব সদবিম্ব। ভালো করে ওকে দেখলাম। মনে পড়ে যায় পুরোনো দিনের কবিতা—যখন প্রতিদিন সূর্য উঠত, অথচ অস্ত যেন না।
‘…সময়ের পায়ে একজোড়া ঘুঙুর থাকলে
অবিকল তার রং হত সবুজ
অনায়াসলব্ধ ঘাসেদের মতন
বেড়ে ওঠা দুরন্ত হিজলের মতো তোমার বুকের সবুজও তখন
ধরা থাকতো না শাড়ির ছোট্ট আঁচলে…’
‘দেবু?’ ওর চোখ কাঁচের মতো। বুকজোড়া কি ধরা থাকবে না শাড়ির ছোট্ট আঁচলে?
‘কী?’ ওকে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।
‘…তুমি গীতোক্ত পুরুষের মতো
উদাসীন হলে আমি লজ্জা পাই…’
‘দেবু।’
একটা আগ্রাসী গুঞ্জন শুরু হল কোথাও। ঘরটা যেন বনবন করে ঘুরছে।
‘একমিনিট, একমিনিট।’ এ গুঞ্জন কি আমার মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে?
‘…তুমি হলুদ সবুজ সাদা প্রজাপতি দেখ
আমি ফড়িং-এর কাঁচপোকা পাখা
তন্ময় তুমি নির্মম হাতে নির্মোক ভাঙো
আমি নির্ঝর
চূণির্ত শিলা যেন…’
‘কী করে ওরা তোমাকে তৈরি করল?’ আমি অবিশ্বাসে ডুবে যেতে-যেতে চিৎকার করে উঠলাম। এত অল্প সময়ে! মাত্র ন’ঘণ্টায়? যখন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম তখন কি ওরা সোনা গলিয়ে ঢালাই করেছে মালবিকাকে? তারপর হিরে-চুনি-পান্না, তরল রুপো আর মেঘের সুতো ব্যবহার করেছে প্রয়োজন মতো? হলদে আগুনকে ছাঁচে ফেলে জমাট বাঁধিয়ে কি তৈরি হয়েছে মালবিকার বরতনু?
‘তুমি এসব কথা জিগ্যেস করলে আমি কিন্তু চলে যাব!’ ও বলল।
‘না, না!’
‘তা হলে কাজের কথায় এসো। তুমি কি কিংশুকের বিষয়ে আমাকে জিগ্যেস করতে চাও?’ মালবিকার স্বর হঠাৎই শীতল হয়ে গেছে। এ-কণ্ঠস্বরও কি গলিত ধাতুর তৈরি?
‘একটু সময় দাও, মালা, বলছি।’
‘না, এক্ষুনি।’
আমার সমস্ত ক্রোধ দ্রবীভূত হয়ে গেছে। মালবিকার উপস্থিতি কাজ করছে সর্বদ্রাবী দ্রাবকের মতো।
‘তুমি আমাকে কেন ডেকেছ? কিংশুকের বিষয়ে কথা বলতে, তাই তো? তুমি তো জানো আমি ওকে ভালোবাসি। তোমার চেয়ে বেশি বা কম ভালোবাসার কোনও ব্যাপার নয়। কারণ, একমাত্র ওকেই আমি ভালোবাসি।’ ওর কণ্ঠস্বর বিষাক্ত হয়ে পড়ছে ক্রমশ।
‘ওঃ—থামো, থামো!’ দু-হাতে কান চেপে ধরলাম আমি।
কিন্তু ও থামল না: ‘এখন তো সবসময় কিংশুকের সঙ্গেই আমি ঘুরে বেড়াই। তুমি আর আমি আগে যেখানে-যেখানে যেতাম, এখন সেখানে কিংশুক আমার সঙ্গী। এই তো গত মাসে ওর সঙ্গে মধুপুরে তিনদিন ঘুরে এলাম। ওঃ, দারুণ! আর কিংশুক যা দুরন্ত কী বলব!’
শুকনো ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম। এগিয়ে গিয়ে মালবিকার হাত ধরলাম একান্ত অনুনয়ে। বললাম, ‘এসব তো তোমার দোষ নয়! তুমি নিষ্পাপ। তুমি পবিত্র। তুমি সেই মালবিকা নও। তুমি আলাদা!’
‘ঠিক তার উলটো,’ রোবট যুবতী বলে উঠল, ‘আমার সঙ্গে মালবিকার কোনও তফাত নেই। আমিই মালবিকা। ও যা-যা করে আমাকেও তাই-তাই করতে হয়। আমরা দুজন সবদিক থেকেই এক।’
‘কিন্তু ও যা পাপ করেছে তুমি তো তা করোনি!’
‘করেছি। সব পাপই করেছি। কিংশুককে আমি চুমু খেয়েছি। ওর সঙ্গে রাতে…।’
‘হতেই পারে না, মালা। কারণ একটু আগেই তোমার জন্ম হয়েছে। তুমি এখনও কোনও পাপ করার সময় পাওনি।’
‘তোমার হৃদয় এবং মালবিকার অতীত থেকে আমার জন্ম।’
আমি ওর দু-কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিলাম: ‘শোনো, মালা—নিশ্চয়ই কোনও-না-কোনও পথ আছে। আমি দরকার হলে আরও—টাকা দিতে পারি। তোমাকে কিনে নিতে পারি। তারপর আমরা দূরে কোথাও চলে যাব। কেউ জানবে না। শুধু আমরা দুজনে—।’
ও হাসল: ‘তা হয় না। আমরা শুধু ভাড়া দেওয়ার জন্যে। বিক্রির জন্যে নয়।’
‘কিন্তু যে-কোনও অঙ্কের টাকা দিতে আমি রাজি আছি।’
‘এ-চেষ্টা যে আগে হয়নি তা নয়! তার পরিণাম মাথার গোলমাল। বললাম তো, এ সম্ভব নয়। এমনকী এটুকুও বেআইনি, সে তো আপনি ভালো করে জানেন। সরকারকে লুকিয়ে-চুরিয়ে আমাদের এসব কাজ করতে হয়।’
হঠাৎ ‘আপনি’ করে কথা বলছে কেন মালবিকা?
‘আমি তোমাকে নিয়ে থাকতে চাই, মালা!’
‘তা হয় না, কারণ আমি সত্যিই মালা, মালবিকা। আমাদের প্রতিটি কণা এক। তা ছাড়া অফিসের বাইরে বেরিয়ে আমরা প্রতিযোগিতায় নামতে চাই না। শরীর কাটা-ছেঁড়া করলে আমাদের সব রহস্যই ফাঁস হয়ে যাবে।…যাক, ঢের হয়েছে, আপনাকে আমি বারবার সাবধান করেছি যে, এ-বিষয়ে আলোচনা করবেন না। তা হলে শুধু-শুধু স্বপ্নের ঘোর কেটে যাবে। আর আপনার টাকা নষ্ট হবে। তার চেয়ে যা করতে এসেছেন তাই করুন। চটপট।’
‘তোমাকে আমি খুন করতে চাই না।’
‘আপনার একটা সত্তা চায়। সেটাকে আপনি চেপে রেখেছেন। এক্সপোজ করতে চাইছেন না।’
পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে নিলাম।
‘আমার সত্যিই ভীমরতি ধরেছে। এখানে আসা আমার উচিত হয়নি। তুমি এত সুন্দর!’
‘আজ রাতে আমি কিংশুকের কাছে যাচ্ছি।’
‘কথা বোলো না, প্লিজ।’
‘রাতে ওখানে থাকব।’
‘আমার কথা কানে যায়নি তোমার!’
মিষ্টি করে হাসল ও। আমার চিবুকটা নেড়ে দিল: ‘আহা রে, আমার মোটকু সোনা! রাতে বিছানায় একা-একা শুয়ে খুব ছটফট করবে। তার চেয়ে বরং একটা কোলবালিশ নিয়ে নিয়ো।’
আমার অভ্যন্তরে একটা অজ্ঞাত আলোড়ন শুরু হল। আমার মুখ কি বিবর্ণ হয়ে গেছে? অনিবার্য কিছু একটা ঘটতে চলেছে। বন্দি ক্রোধ, ঘৃণা আর বিরক্তি চিন্তায় ছুঁচ ফুটিয়ে চলেছে। এবং ওর মস্তিষ্কের টেলিপ্যাথিক নেটওয়ার্ক এই মৃত্যু-স্পন্দন অনুভব করতে পারছে। রোবট। টেলিপ্যাথি। মার্ডার।
‘ভাবতে অবাক লাগে, দেবু, কী করে তোমাকে একদিন ভালোবেসেছিলাম।’ ও হাসল—তাচ্ছিল্যের হাসি।
‘থামো, মালা, থামো।’
‘আমি সবে তিরিশ পেরিয়েছি আর তুমি হয়ে উঠেছ পরিপূর্ণ বৃদ্ধ। তোমার তরল আগুন শুকিয়ে গেছে বয়েসের বাতাসে। কী বোকা তুমি, দেবু? দিনের পর দিন টাকা রোজগার করেছ, অক্লান্ত খেটেছ, আর আমাকে দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়বার সুযোগ দিয়েছ। আচ্ছা, তোমার কি কিংশুককে পছন্দ হয় না?’
অন্ধভাবে রিভলভার উঁচিয়ে ধরলাম আমি।
‘মালা!’
‘ওর মন পবিত্রতম সোনায় তৈরি—’ ও ফিসফিস করে বলল।
‘মালা, এখনও বলছি, চুপ করো!’ আমি চিৎকার করে উঠলাম।
‘ওর চুলের গুচ্ছ ঘন মেঘের মখমলকেও হার মানায়। ওর হাত শুভ্র নিষ্কলঙ্ক গজদন্তের মতো সুঠাম!’
কী করে এসব কথা ও বলছে? এ তো আমার মনের ছায়া, নিছক কল্পনা। তা হলে কেমন করে ওর ঠোঁট উচ্চারণ করছে এইসব অশ্লীলতম শব্দের মিছিল?
‘মালা, ডোন্ট মেক মি শুট ইউ।’ আমার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র কেঁপে ওঠে।
‘কিংশুকের গালে অস্তাচলের সূর্য রক্তিম ছায়া ফেলে রাখে সর্বক্ষণ—’ ওর চোখ বুজে আসে, অস্ফুটে বেরিয়ে আসে কথাগুলো, এবং ও হালকা পায়ে ভেসে বেড়ায় ঘরের সর্বত্র।
‘…ওর পা দুটো যেন তাজমহলের পাথর দিয়ে তৈরি একজোড়া স্মৃতিসৌধ, যেখানে অর্চনা অঞ্জলি কখনও শেষ হয় না। ওর চোখের পাতায় রামধনু রং খেলা করে…।’
‘মালবিকা।’ ভয়ংকর স্বরে চিৎকার করে উঠলাম আমি।
‘ওর ঠোঁট সত্যিই ফুলের মতো…।’
প্রথম গুলি ছুটে গেল।
‘…ও আমার জন্মান্তরের প্রেমিক…।’
দ্বিতীয় গুলি।
ও পড়ে গেল।
‘মালবিকা! মালা—মালবিকা!’
আরও চারবার ওর শরীর লক্ষ্য করে আমি গুলি ছুড়লাম।
ওর পড়ে থাকা দেহ কেঁপে-কেঁপে উঠছে। ওর চেতনাহীন ঠোঁট অভ্যন্তরীণ কোন এক যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নড়ে উঠছে বারবার। বলছে, ‘…জন্মান্তরের প্রেমিক, জন্মান্তরের প্রেমিক, জন্মান্তরের প্রেমিক…।’
আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। কোন এক অস্পৃশ্য নেশা শুষে-নিচ্ছে আমার চেতনা—।
ঘুম ভাঙতেই ভুরুর ওপর ভিজে কাপড়ের ছোঁয়া অনুভব করলাম ভুরুর ওপর।
‘সব শেষ।’ কালো লোকটি বলল।
‘শেষ?’ আমি ফিসফিস করে বলে উঠলাম।
নীরবে সম্মতি জানাল লোকটি।
ক্লান্তভাবে নিজের হাত দুটোর দিকে তাকালাম। দু-হাতে যথেষ্ট রক্তের দাগ ছিল। আবছাভাবে মনে আছে, জ্ঞান হারাবার মুহূর্তে আমি পড়ে গিয়েছিলাম মেঝেতে। এবং সত্যিকারের রক্তের এক ফোয়ারা অবিশ্রান্তভাবে মাথা কুটে মরেছে আমার দু-হাতে।
কিন্তু এখন রক্তাক্ত হাতদুটো অপরাধহীন নিষ্পাপ। কেউ সযত্নে ধুয়ে দিয়েছে।
‘আমাকে এখুনি যেতে হবে।’ অস্পষ্ট গলায় বললাম।
‘পারবেন তো?’
‘হ্যাঁ পারব?’ আমি উঠে বসলাম: ‘মালবিকার সঙ্গে এখন আর কোনও যোগাযোগ রাখতে পারব না?’
‘মালবিকা মারা গেছে।’
‘হ্যাঁ। আমিই ওকে খুন করেছি। ওঃ, রক্তটা একেবারে সত্যিকারের ছিল।’
‘এ জন্যেই তো আমাদের কোম্পানির এত সুনাম।’
ওদের অফিস ছেড়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে। আমার শুধু হাঁটতে ইচ্ছে করছে। ক্রোধ ও প্রতিশোধের দুরন্ত জ্বালা এখন আর নেই। ওই কাল্পনিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে-সঙ্গে বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু সে-স্মৃতি এত ভয়ংকর যে, দ্বিতীয়বার খুন করার ইচ্ছে আমার মোটেও নেই। যদি বাস্তবের মালবিকাও আমার সামনে এসে এখন দাঁড়ায় তা হলে আমি শুধু অচেতন হয়ে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ব। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাব। মালবিকা মরে গেছে। আমার ইচ্ছে পূর্ণ হয়েছে। আমি অন্যায় করেছি, তবে কেউ তা জানতে পারবে না।
মুখের ওপর ছুটে আসা বৃষ্টির ফোঁটা যেন ঠান্ডা বরফের কুচি। এখুনি আমাকে এদেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। নইলে একটু আগে ঘটে যাওয়া নাটকের উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। যদি পুরোনো সুতো ধরেই আবার জীবনের মালা গাঁথব তা হলে দশহাজার টাকার বিনিময়ে ওই নাটকীয় অনুভূতি কেনার কী প্রয়োজন ছিল? সত্যিকারের হত্যাকাণ্ডকে রোধ করতেই কালো লোকটির এতো আয়োজন। মনের মধ্যে খুন করার বা কাউকে যন্ত্রণা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা থাকলে কোনও রোবটের ওপর সেই নৃশংস ভয়াবহ প্রতিজ্ঞা চরিতার্থ হয়।
এখন ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়ে লাভ নেই। সেখানে মালবিকা হয়তো বসে আছে। ওকে আমি আর দেখতে চাই না। আমার কাছে ও মৃত।
ফুটপাথে দাঁড়িয়ে দেখছি চলমান যানবাহন। জীবন গতিময়। বিশুদ্ধ বাতাসে গভীর শ্বাস নিলাম। মন যেন আরও হালকা লাগছে।
‘মিস্টার রায়?’ পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল।
আমি চমকে ফিরে তাকালাম।
পেশাদার ক্ষিপ্রতায় একটা হাতকড়া আমার ডানহাতের কবজির ওপর এঁটে বসল।
‘আপনাকে অ্যারেস্ট করা হল, মিস্টার রায়।’
‘কিন্তু—।’
গম্ভীর স্বরটি নির্বিকার ভঙ্গিতে পাশের লোকটিকে বলল, ‘এসো চক্রবর্তী, ওপরের লোকগুলোকে এবার অ্যারেস্ট করা যাক।’
‘শুধু-শুধু আমাকে আপনারা—।’
আমাকে বাধা দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠস্বর বলে উঠল, ‘শুধু-শুধু নয়, মিস্টার রায়, মার্ডারের জন্যে আমরা কাউকে রেহাই দিই না।’
কালো আকাশে কোথাও বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। বাজ পড়ল সগর্জনে।
রাত প্রায় ন’টা। গত দশদিন ধরে টানা বৃষ্টি পড়ছে। জেলের পাথুরে দেওয়াল বেয়েও গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা। হাত পাতলেই বৃষ্টির ফোঁটা জমা হয়ে ছোট্ট হ্রদ তৈরি করে ফেলছে। আমার হাত কাঁপছে।
দরজার ধাতব শব্দ শোনা গেল। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে জলে হাত ভিজিয়ে চলেছি। আমার উকিল দরজায় এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আর কোনও আশা নেই। আজ রাতেই আপনাকে নিউক্লিয়ার ফার্নেসে যেতে হবে!’
আমি তখনও বৃষ্টির রিমঝিম শুনে চলেছি।
‘ও বাস্তব ছিল না। স্বপ্ন ছিল। আমি ওকে সত্যি-সত্যি খুন করিনি।’
‘কিন্তু আইন তো আর পালটানো যাবে না! জানেন তো, অন্য সবারও কপালে নিউক্লিয়ার ফার্নেস জুটেছে। রাত ঠিক বারোটায় ওই রোবট কোম্পানির চেয়ারম্যানের মৃত্যু হবে নিউক্লিয়ার ফার্নেসে। তিনজন কর্মচারী মরবে রাত একটায়। আর আপনি দেড়টার সময়।’
আমি উত্তাপহীন সহানুভূতির গলায় বললাম, ‘সত্যি, আপনি অনেক করেছেন। আসলে সত্যি হোক আর মিথ্যে হোক, স্বপ্নে হোক বা বাস্তবে হোক, ব্যাপারটা সরকারের চোখে খুন ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, এখানে খুনের ইচ্ছে রয়েছে, রয়েছে মোটিভ। ঠান্ডা মাথার প্ল্যান রয়েছে। সবই আছে। একমাত্র আসল মালবিকা ছাড়া।’
‘ব্যাপারটা কী জানেন, মিস্টার রায়? আপনার কপাল খারাপ যে, এই সময়টাতে আপনি ধরা পড়লেন। দশবছর আগে হলে আপনাকে এ জন্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত না। দশবছর পরে হলেও না। এই কয়েকটা বছরে কাল্পনিক খুনের ব্যাপারটা হঠাৎ করে এমন বেড়ে উঠেছে যে, গভর্নমেন্ট একেবারে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। আর এর ফলে আসল খুনের সংখ্যা কমে যাওয়ার বদলে বরং আশ্চর্যভাবে বেড়ে উঠছে। সুতরাং কড়া শাস্তির ব্যবস্থা না করলে রোবট কোম্পানিও থামবে না, আর আপনার মতো ক্লায়েন্টরাও না। আসলে আপনার হয়তো সত্যিকারের খুন করার বুদ্ধি বা সাহস নেই। কিন্তু দেখা গেছে, এই নকল খুন বারকয়েক করলেই আপনার হাত পেকে উঠছে। বেড়ে উঠছে সাহস, কনফিডেন্স, বুদ্ধি। ফলে আপনারই হাতে ঘটে যাচ্ছে সত্যিকারের খুন। তা ছাড়া, এ জাতীয় রোবটদের সরকারি আইনে ঠিক নিষ্প্রাণ জড়বস্তু বলে ধরা হয় না। কারণ, এরা চিন্তা করতে পারে, যুক্তি দিয়ে ভাবতে পারে। আড়াই মাস আগে ”জীবন্ত রোবট” নামে একটা আইন পাশ করা হয়েছে। আপনি সেই আইনের আওয়তায় ধরা পড়েছেন। নেহাতই কপাল, মিস্টার রায়, নেহাতই কপাল।’
আমি ক্লান্ত স্বরে মন্তব্য করলাম, ‘এখন বুঝতে পারছি, বিচারে গভর্নমেন্ট কোনও ভুল করেনি।’
‘যাক, আপনি যে আইনের যুক্তিটা বুঝতে পেরেছেন, এতেই আমি খুশি। তবে আমিও চেষ্টা নেহাত কম করিনি।’
‘ঠিকই বলেছেন। ”খুন”-কে কখনও মেনে নেওয়া যায় না—হোক সে রোবট, যন্ত্র, কল্পনা। আমি অন্যায় করেছি, তাই শাস্তি পেতে হচ্ছে। আমি সত্যিই খুন করেছি। কারণ, সেই খুনের পর থেকে আমি নিজের কাছে কেমন যেন অপরাধী হয়ে পড়েছি। চেয়েছি আমার শাস্তি হোক। ব্যাপারটা অদ্ভুত—নয়? সমাজ তো এভাবেই সকলকে সাজা দেয়। আপনাকে ভাবতে বাধ্য করে যে, আপনি অপরাধী—যদিও তার কোনও জোরালো কারণ থাকে না…।’
‘আমি তা হলে চলি, মিস্টার রায়। আপনার আর কোনও দরকার থাকে তো বলুন।’
‘না। থ্যাংকু ইউ।’
‘গুড বাই, মিস্টার রায়।’
দরজা বন্ধ হল।
গরাদের বাইরে বাড়িয়ে দেওয়া দু-হাত ভিজে জড়সড়। তবুও এ প্রকৃতির অকৃত্রিম স্পর্শ। হঠাৎই দেওয়ালে একটা লাল আলো জ্বলে উঠল। মাইক্রোফোনে ভেসে এল যান্ত্রিক স্বর: ‘মিস্টার রায়, আপনার স্ত্রী আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’
আমি জানলার গরাদ আঁকড়ে ধরলাম সজোরে।
ও মরে গেছে। ওর কোনও অস্তিত্ব নেই।
‘মিস্টার রায়?’ উত্তরের প্রত্যাশায় যান্ত্রিক স্বর প্রশ্ন করল।
‘ও মারা গেছে। আমি ওকে নিজের হাতে খুন করেছি।’
‘আপনার স্ত্রী পাশের ঘরে আপনার জন্যে ওয়েট করছেন। আপনি কি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান?’
‘আমি ওকে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিয়েছি। ও লুটিয়ে পড়েছে রক্তাক্ত অবস্থায়। আমি নিজের চোখে দেখেছি!’
‘মিস্টার রায়, আপনি এখনও আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি—।’
আমি পাগলের মতো দেওয়ালে ঘুসি মারতে লাগলাম। চিৎকার করে উঠলাম, ‘ও মরে গেছে, ও মরে গেছে, আমি ওকে নিজের হাতে খুন করেছি। আমি ওর কাছে শুধু স্বস্তি চাই, একটু একা থাকতে চাই আমি। আমি ওর সঙ্গে দেখা করব না। ও মরে গেছে, আমি ওকে নিজের হাতে খুন করেছি!’
কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। তারপর আবার যান্ত্রিক গুঞ্জন, ‘ঠিক আছে, মিস্টার রায়।’
লাল আলোটা নিভে গেল।
আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। ঠান্ডা গরাদের গায়ে চেপে ধরলাম আমার উত্তপ্ত গাল। অপেক্ষা করছি। বৃষ্টি পড়ছে। অপেক্ষা করছি।
অনেকক্ষণ পর রাস্তার দিকের একটা দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। বর্ষাতি পরা দুটো শরীর আমার চোখে পড়ল। একতলার অফিস থেকে বেরিয়ে পা দিয়েছে রাস্তায়। একটা ভেপার ল্যাম্পের নীচে ওরা থমকে দাঁড়াল। চোখ তুলে তাকাল আমার দিকে।
মালবিকা। আর ওর পাশে দাঁড়িয়ে কিংশুক।
‘মালা!’
ও মুখ ঘুরিয়ে নিল। কিংশুক ওর হাত ধরল। তারপর দ্রুতপায়ে রাস্তা পার হয়ে দুজনে উঠে বসল একটা কালো গাড়িতে।
‘মালবিকা!’ আমি গরাদের রড ধরে ঝাঁকুনি দিতে চাইলাম। চিৎকার করে চললাম। ঘুসি মারতে লাগলাম পাথরের দেওয়ালে। জানলাটাকে সর্বশক্তিতে উপড়ে নিতে চাইলাম।
‘গার্ড! গার্ড! ও বেঁচে আছে! এইমাত্র আমি ওকে দেখেছি। ও মরেনি, আমি ওকে খুন করিনি, তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও! আমি কাউকে খুন করিনি। সব অভিনয়, স্বপ্ন, কল্পনা। আমি ওকে এইমাত্র দেখলাম, ও বেঁচে আছে! মালা, ফিরে এসো, মালা! ওদের বলো, তুমি বেঁচে আছ! বলো, আমি তোমাকে খুন করিনি! ওরা আমাকে ভুল করে ধরে রেখেছে। মালবিকা, প্লিজ…।’
প্রহরীরা ছুটে এল ঘরে।
‘তোমরা আমাকে আর শাস্তি দিতে পারবে না! আমি কোনও অন্যায় করিনি! মালবিকা বেঁচে আছে—আমি নিজের চোখে দেখেছি।’
‘আমরাও দেখেছি, স্যার।’
‘তা হলে আর আমাকে আটকে রেখেছ কেন? ছেড়ে দাও!’ আমার গলা বুজে এল। প্রচণ্ড কাশির দমকে শরীর বারবার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল বারবার।
‘ট্রায়ালের সময় তো এসব অনেকবার বলেছেন, স্যার—।’
‘না, না, এ ভীষণ অন্যায়! একজন ইনোসেন্ট লোককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া! ছি-ছি—’ আমি জানলায় মুখ উঁচিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম। হিংস্র থাবা দেওয়ালে বসাতে চাইছি ক্ষণে-ক্ষণে।
কালো গাড়িটা দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। ওর ভেতরে রয়েছে মালবিকা আর কিংশুক। ওরা কাশ্মীর, নৈনিতাল, দার্জিলিং, মধুপুর, সব ঘুরে বেড়াবে। ওদের কাছে সারা বছরই বসন্তকাল। প্রেমের কাল। ভালোবাসার কাল। আর আমার কাছে তা কালবসন্ত।
‘মালা, ফিরে এসো মালা। বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে ভালোবাসি! এভাবে আমাকে নিরাশ্রয় করে যেয়ো না, মালা!’
ঠান্ডা বৃষ্টির ফোঁটায় গাড়ির লাল রঙের টেল-লাইট জোড়া হারিয়ে গেল। প্রহরীরা হঠাৎই পেছন থেকে এসে আমাকে সজোরে জাপটে ধরল। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, আমি বিকৃতকণ্ঠে চিৎকার করে চলেছি। *
– – –
* কাহিনির কবিতার অংশ অসিত সরকারের ‘আমরা দুজনে একা’ কবিতা থেকে সংকলিত।