খুনী

খুনী 

চর আলেকজান্দ্রার সোনাভাঙা গ্রামের ঘাটে এখনো নৌকার ভিড়। কত নৌকা আসছে, যাচ্ছে : বালাম, সাম্পান, কিছু সোরঙ্গ-ও। চালের মরসুম এখনো সরগরম। অথচ এদিকে চৈত্রের শেষাশেষি। গাঁয়ের পশ্চিমে নারকেল-বন পেরিয়ে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা প্রান্তরের ধারে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে : উদ্দাম হাওয়ায় সে-প্রান্তরময় ধুলো উড়ছে। পেছনে নারকেল-বনে অশান্ত মর্মরধ্বনি, আর সামনের জনশূন্য প্রান্তরে কেবল ধুলো উড়ছে আর উড়ছে, কখনো ঘূর্ণি হয়ে ঊর্ধ্বে উঠে, কখনো আকাশের বুক থেকে তির্যক গতিতে নিচে নেবে আসে, আবার কখনো মাটি ছুঁয়ে তীরবেগে দূরান্তে মিলিয়ে গিয়ে। আর, যে-পথটা গ্রাম থেকে বেরিয়ে কিছু এঁকেবেঁকে সোজা পশ্চিমে চলে গেছে, সে পথ স্থানে স্থানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সে-ধুলোর মধ্যে : যেন শূন্যে মিলিয়ে গেছে উদ্দাম হাওয়ার তীব্র মায়ায়। 

এমনি এক সময়ে এক ভরা দিনে রোদ খরখর করছে, তার মধ্যে ফজু মিঞাদের বাড়ির ও মৌলবীদের বাড়ির দু ছেলের মধ্যে কী একটা সামান্য বিষয় নিয়ে হঠাৎ খুনোখুনি হয়ে গেল; ফজু মিঞাদের ছেলের প্রাণ গেল, আর মৌলবীদের ছেলে তারপর সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, সোনাভাঙা গ্রামের কেউ আর তার কোনো সন্ধান পেল না। চর অঞ্চলে খুনোখুনি লেগে-ই থাকে, তাই চরবাসীদের জন্যে এটা এমন নতুন কিছু নয়। এবং মাস কাটতেই তারা প্রায় ভুলে গেল সে-কথা। 

.

উত্তরবঙ্গের কোনো এক মহকুমা শহর। আবেদ মিঞার দর্জির দোকানটা ফৌজদারি আদালতের পাশে এক বিরাট পঞ্চবটি গাছের তলে। ওধারে ট্রেজারি। কাঁটাতারের বেড়ার দু কোণে উজ্জ্বল আলো; সে-আলোর খানিকটা এসে পড়ে তার দোকানের সামনে। কেউ-বা কখনো ভুল করে, বা পথ সংক্ষিপ্ত করবার জন্যে ট্রেজারির সামনে দিয়ে যেতে-ই পাহারাদার তীক্ষ্ণ ও কর্কশ গলায় হেঁকে ওঠে, তাছাড়া এ-স্থান ভরে প্রগাঢ় অবিচ্ছেদ্য নীরবতা। সারাটা দিন ভরে এ-স্থান জনতার কোলাহলে তীব্রভাবে মুখর হয়ে থাকে বলে সন্ধ্যার পর এ-নির্জনতার নীরবতা অত্যন্ত জমাট মনে হয়, আর পাথরের মতো ভারি ঠেকে যেন। এবং পঞ্চবটির তলে ঘাসশূন্য পরিষ্কার স্থানে থেকে-থেকে যে-শুকনো ঝরা পাতা দমকা হাওয়ায় মর্মরিয়ে ওঠে, সে-মর্মরকে মনে হয় দিনের কোলাহলের আবছা, অস্পষ্ট স্মৃতির মতো। 

আবেদ দর্জি বৃদ্ধ। তার সেলাইয়ের কলটিও ঝুনো, চলতে গিয়ে সেটা আওয়াজ করে বেশি, আর কেমন থরথরিয়ে কাঁপে। অনেকক্ষণ তার ওপর হাত রেখে কাজ করলে হাতে ঝিঁঝি ধরে যায়, মনে হয় সেখানে-ও কল চলছে। 

সে-কলটা এখন নীরব। নাকে চশমা দিয়ে ওপরে টাঙানো লণ্ঠনের আলোয় আবেদ রিফু করছে। সহকারী দর্জি দু-জন সন্ধ্যার পরেই বাড়ি চলে গেছে। এক সময়ে হাতের কাজ নাবিয়ে সে বিড়ি ধরাল, তারপর চশমার ফাঁক দিয়ে ওধারে তাকিয়ে দেখলে যে সিধু ময়রার দোকান এখনো খোলা, আর তার পাশে টিউবওয়েলে পানি তোলার ঘসঘস আওয়াজ হচ্ছে। সে চোখ নাবালে। তারপর দমকা হাওয়ায় হঠাৎ সামনের পাতা মর্মরিয়ে উঠল শুনে আবার সে চোখ তুলল, তুলে সামনের পানে তাকাল। ট্রেজারির আলো : শুকনো পাতা নড়ছে : আর ওদিকে কিছু-ভাঙা টুলটা। কিন্তু সে-টুলে কে যেন বসে রয়েছে না? 

কয়েক মুহূর্ত চেয়ে-চেয়ে দেখল আবেদ, তারপর শুধাল, 

—কেডা বাহে? 

কোনো উত্তর এল না। ওদিকে চেয়ে লোকটি মূর্তির মতো নিশ্চল। 

আবেদ আবার ডাকলে, এবারো কোনো সাড়া এল না। এবং তাই একটা অদম্য কৌতূহল জাগল দর্জির মনে। সে দ্রুতভঙ্গিতে উঠে পড়ল, উঠে হুক থেকে লণ্ঠনটা নাবিয়ে খড়ম পায়ে দিলে, তারপর টুলটির কাছে গিয়ে লোকটার মুখের সামনে আলো তুলে ধরল। দেখল, অপরিচিত এক লোক, বয়স বেশি নয়। তার চুল উষ্কখুষ্ক, পরনের জামা ময়লা ও ছেঁড়া; দেহে প্রাণহীনতার স্তব্ধতা, আর চোখে শূন্যতার বীভৎসতা। 

—কেডা তুমি? 

লোকটি এবার চোখ ফিরিয়ে তাকাল তার পানে, কিন্তু তার চোখের সে-বীভৎসতা চোখে ঠেকাল বলে দর্জি চোখ সরিয়ে নিল, কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে দৃঢ় গলায় বললে, 

—তুমি কেমন কাগো, কথা কও না ক্যা? 

অল্পক্ষণ লোকটি নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল দর্জির পানে, এবং দেখলে এক বৃদ্ধ যার মুখে সাদা দাড়ি, মাথায় আধা ময়লা কিস্তি টুপি, আর মুখের নিচের চামড়া ঝুলে পড়েছে। এবং হাতে তার লণ্ঠন, ‘ পেছনে অন্ধকার। যেন অন্ধকার থেকে বৃদ্ধ হঠাৎ উঠে এসেছে, এবং এসেছে নির্ভরশীল নিঃসঙ্গতায়। এধারে কেউ নেই, আর তার ম্লান চোখে কৌতূহল থাকলেও তাতে সন্দেহ নেই, হিংস্রতা—ও নেই। সে কি এমনি অন্ধকারাচ্ছন্ন নির্জনতায় এমনি একটি লোককে-ই খুঁজছিল না, যার কাছে মনের বোঝা নাবিয়ে হালকা হতে পারে, তারপর বাঁচতে পারে মনের সে-দুরারোগ্য ক্ষত থেকে, যে ক্ষত তাকে দিনের পর দিন অসহ্য যন্ত্রণা দিচ্ছে, আর স্থান হতে স্থানান্তরে কেবল তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে? 

হঠাৎ লোকটি উঠে দাঁড়াল। তারপর অস্পষ্টপ্রায় কণ্ঠে দ্রুতভাবে বললে, 

—আঁর নাম রাজ্জাক। আঁই আলেকজন্ডর চরের সোনাভাঙা গেরামের মৌলবীর বাড়ির ফোলা। চৈত্ মাসে একদিন দুফর ওক্তে ফজুমিঞা’গর বাড়ির ফইন্যার মাথা ফাডাইলাম, ফাডাই জানের ডরে দেশ ছাড়ি ফলাইলাম। তারপর তুন—এই বলে হঠাৎ সে কী একটা নিদারুণ ভয়ে থেমে গেল, তার চোখ দুর্জয় ভয় ও শংকায় কেমন হয়ে উঠল; তারপর তার দেহ দুর্বল হয়ে উঠে এক সময়ে সে ঝুপ্ করে পড়ে গেল দর্জির পায়ের কাছে। 

এখানে মাটি : এখানে ভয় নেই; বরঞ্চ এখানে মিশে গেলে দেহে গলগলিয়ে শান্তি আসবে, এবং সে-দুরারোগ্য ক্ষত ভেসে যাবে তাতে। কিন্তু তবু রাজ্জাক মাথাটাকে টেনে নিয়ে বুড়োর পায়ের ওপর রাখলে, আর দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলে তার দু-পা। যাকে সে একবার ক্ষতের কথা বলেছে, তাকে আর ছাড়া যায় না। তারপর তার সারা অন্তর আকুল হয়ে উঠল কাঁদবার জন্যে, কিন্তু আশ্চর্য, কান্না এল না। সারা অন্তরে ঝড় উঠল কান্নার, কিন্তু চোখে অশ্রু ছুটল না, সে-চোখ শুষ্কই রইল : এবং সে-শুষ্কতা থেকে তার দেহ ক্রমে-ক্রমে কাঠের মতো হয়ে উঠল। তারপর কাঠ হয়ে ওঠা শক্ত দেহ হতে মন হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, শূন্যতায় ভেসে গেল শূন্য হয়ে, যে-শূন্যতায় কোনো কথা নেই। শূন্যতার শেষে সে দেখলে সোনাভাঙা, যে-সোনাভাঙায় আর কোনো শংকা নেই; তার ঘাটে বালাম ও সাম্পান নৌকা নিরুপদ্রব শান্তিতে বাঁধা, কেবল নারকেল-বনের পেছনে সে-প্রান্তরে ধুলো উড়ছে। ধনু গাইকে-ও দেখল। গাইয়ের চোখে স্নেহ, এবং স্নেহের শান্তিতে সে বাছুরের গা চাছে। 

দর্জি স্তম্ভিত। লোকটি শুধু পায়ে মুখ গুঁজে রয় নি, জিহ্বা দিয়ে তার পা-ও চাছে। ভীত হয়ে সে তার পা দুটো ছাড়াতে চাইল, কিন্তু লোকটার বাহুবদ্ধ সে-পা ছাড়াতে পারল না। পাশে চেয়ে দেখল যে, সিধু ও তার দোকানের ছোকরা-টা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। 

কেডা—দর্জি মিঞা? 

দর্জি সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দিলে না। কিন্তু তারপর বললে, 

—মোর ছেইলা। 

সিধু ময়রা প্রথমে বিস্মিত হল, তারপর মনে পড়ল, প্রায় এক যুগ আগে দর্জির বার বছরের এক ছেলে হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, এবং তারপর থেকে তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি। 

বুড়োর ছেলে এতকাল পরে ফিরেছে—আনন্দের কথা। সে-সম্পর্কে সিধু দুয়েক কথা বলছিল, এমন সময় লোকটি হঠাৎ উঠে বসল, উঠে তীব্র সন্দেহে তাকাল ময়রার পানে, এবং দর্জি লক্ষ করলে যে আবার তার চোখ দুর্জয় শংকায় কেমন হয়ে উঠছে। সিধু তাকে চেয়ে-চেয়ে দেখছিল, হঠাৎ শুধাল, 

—ওর নাম কী মিঞা? 

—মোমেন। 

রাজ্জাক প্রথমে কিছু বললে না, তারপর এধার-ওধার চেয়ে দেখলে, মনে হল, এখানে রাজ্জাক নামে কেউ নেই। 

.

আবেদ দর্জির বাড়িতে রাজ্জাক আশ্রয় পেল। তবে রাজ্জাক নামে নয়, মোমেন। নামে বাড়ির লোক ছাড়া সবাই প্রথমে জানলে যে এক যুগ আগে পালিয়ে যাওয়া দর্জির ছেলেটি আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু সত্যটা সূর্যালোকের মতো স্বচ্ছ বলে তা মিথ্যায় ঢাকা গেল না, একে-একে সবাই জেনে ফেললে : ছড়ানো কথা সত্য নয়, এ-ছেলে আসলে মোমেন নয়; তবে পরকে ঘরে ডেকে আপন ছেলে বলে প্রচার করার মিথ্যায় লোকে অন্যায় কিছু দেখলে না, বরঞ্চ দর্জির প্রতি শ্রদ্ধায় তাদের অন্তর ভরে গেল। 

কিন্তু সে যে খুনী—এ কথা দর্জি তার বিবিকে পর্যন্ত বললে না। 

দর্জির বিবি ক-দিন রাজ্জাকের সামনে পর্দা করল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখলে যে, ছেলেটি শান্ত, ধীর ও স্বল্পভাষী স্বভাবের; আর তাছাড়া, ছেলে নয় জেনে-ও যাকে আপন ছেলের নামে ঘরে ডেকে আনা হয়েছে, তার সামনে পর্দা করা চলে না বলে তারপর থেকে তাকে দেখা দিতে লাগল। 

রাজ্জাক আবেদ দর্জির কাছে সেলাই শিখতে লাগল। চর আলেকজান্দ্রা ত্যাগ করার পর থেকে যে-ভীতি তার অন্তর ক্ষত-বিক্ষত করছিল, সে-ভীতি থেকে অনেকটা মুক্তি পেয়ে শীঘ্র সুস্থ হয়ে উঠল বটে, কিন্তু তার পূর্বের চরিত্র আর ফিরে এল না : সে যেন আবার নবজীবন লাভ করল, ভিন্ন দেশে এক নতুন পরিবারের মধ্যে সে সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে রইল, কেবল দূর আলেকজান্দ্রার স্মৃতি অতি অস্পষ্টভাবে রয়ে গেল মনের দূর প্রান্তে। 

.

এখন চৈত্র মাস! 

রাজ্জাক মাথা নিচু করে এক মনে কাজ করছিল। ওধারে কাছারি-প্রাঙ্গণ ভরে লোক; তাদের কোলাহল কখনো মনের অস্পষ্টতায় অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। 

একসময়ে সে হঠাৎ চোখ তুলে ওধারে তাকাল। আদালতের সামনে নদী; সে-নদীর এক অংশ নজরে পড়ে দোকান থেকে। এধারে উঁচু খাড়া পাড়, কিন্তু ওপারে বিস্তৃত বালুর চর ধু-ধু করে, চিকচিক করে সূর্যালোকে। সে চরের পানে তাকিয়ে সে দেখলে, সেখানে হাওয়ায় ধুলো উড়ছে, দেখে তার মন হঠাৎ ছুটতে শুরু করলে। যে-মন বহুদিন ধরে স্তব্ধ হয়ে ছিল, অদ্ভুতভাবে স্থবির হয়ে ছিল, সে-মন আজ হঠাৎ আবার দিশেহারা হয়ে ছুটতে লাগল, এবং ছুটতে ছুটতে এক স্থানে বালির বাঁধে আছড়ে পড়ল : এবং গভীর নীল পানির জন্যে মন তৃষ্ণায় আকুল হয়ে উঠলেও সে-বাঁধের ওধারে যেতে পারল না। শুষ্ক বালুর চরে স্নেহমমতা নেই। 

দর্জি আর তার বিবি তাকে ভালোবাসে, কিন্তু সে-ভালোবাসা তার অন্তর স্পর্শ করে নি, যদিও স্তব্ধ-স্থবির মন সে-সম্বন্ধে নিস্পৃহভাবে সজ্ঞান। কিন্তু আজ ওপারে বালুর চরে ধুলো উড়তে দেখে হঠাৎ চর আলেকজান্দ্রার কথা মনে হল, এবং সে আকস্মিকভাবে অনুভব করল যে, দূরে কোথাও স্নেহমমতার জোয়ার বইছে, কিন্তু এখানে কেবল কালো মাটি, যে-কালো মাটির বুকে বাস করছে এক নকল রাজ্জাক এবং বাস করছে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ হয়ে, আর তার মন আবদ্ধ হয়ে রয়েছে অর্থহীন স্থবিরতায়। 

তারপর থেকে অদ্ভুত শূন্যতা তাকে পেয়ে বসল, এবং থেকে-থেকে কালো মাটির দুঃসহ পেষণ অনুভব করতে লাগল। এমন সময়ে হঠাৎ সামান্য এক ঘটনা ঘটল। সামান্য বটে সে-ঘটনা, কিন্তু সে-ঘটনা থেকে তার অন্তরে প্রাণের জোয়ার এল, হঠাৎ মনের সে-শূন্যতা কাটল। 

জরিনা বিবির সঙ্গে কখনো তার কথা হয় নি; তাকে ভালো করে কোনোদিন চেয়ে-ও দেখে নি। কেবল জানে যে, সে বিধবা, এবং তার স্বামী ছিল আবেদ দর্জির বড় ছেলে, যে মারা গেছে আজ দু-বছর হল। তাছাড়া, দর্জির বিবি যে তাকে অত্যন্ত স্নেহ করে, সে-কথাও কখনো-কখনো অনুভব করেছে। 

সে-দিন দোকানে যাবার আগে বাড়ির ভেতর কুয়োটার ধারে রাজ্জাক জামা কাচছে, এমন সময় দক্ষিণ ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জরিনা তাকে ডাকলে, ডেকে বললে, 

—একটা কথা আছে—এখান হয়া যাইয়ো ভাই। 

কাপড় কাচা সাঙ্গ করে সে দক্ষিণ ঘরে গেল। ঘরের কোণে বড় জালার মুখে উবু হয়ে জরিনা কী যেন করছিল, সাড়া পেয়ে সরে এসে বিছানা থেকে একটা সাদা কাপড়ের টুকরো তুলে তার হাতে এনে দিলে। বললে, 

—ওটা দিয়ে একটা জামা বানায়া দেও। 

রাজ্জাক নীরবে কাপড়টি পরীক্ষা করে দেখলে, তারপর বললে,

—মাপ? একটু থেমে আবার বললে, আপনার একটা জামা দেন।

জরিনা হঠাৎ হেসে উঠল চাপা গলায়, এবং হাসির ফাঁকে-ই বললে, 

—মাপ ছাড়া জামা হয় না—এই বুঝি খইফ্যগিরি? 

কিন্তু তক্ষুনি সে গম্ভীর হয়ে উঠল, তারপর কেমন গলায় শুধাল, 

—গোস্বা করল্যা ভাই? কিন্তু আমার যে জামা নেই 

রাজ্জাক একবার চোখ তুলে তাকাল তার পানে। ওর দৃষ্টিটা যেন কেমন। কিন্তু চোখ নাবিয়ে কাপড়ের টুকরোটা ভাঁজ করে আস্তে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

তৈরি জামা যে-দিন তাকে দিলে, সে-দিন সে জরিনাকে আরো ভালো করে চেয়ে দেখল। দেখল, ওর মুখটা কেমন চপলতায় টলমল, দেখে তার অন্তরে কী যেন টলমল করে উঠল। 

হঠাৎ জরিনা শংকিত হয়ে উঠল, রুদ্ধনিশ্বাসে প্রশ্ন করলে, 

—এটি বাপজান কি দেখেছে ভাই? 

হ্যাঁ, দেখেছে বৈকি। এবং এ-সম্বন্ধে আবেদ দর্জি তাকে প্রশ্নও করেছিল। সে ক্ষীণ গলায় উত্তর দিলে, 

—হ্যাঁ 

কিন্তু তার বুকের ভেতরটা অনুশোচনায় কেমন করে উঠল। 

চৈত্র শেষ হলে গেল, বৈশাখ এল, কালবোশেখি ঝড় শুরু হল। এবং রাজ্জাকের মনে যে-ঝড় শুরু হল, সে-ঝড়ের উদ্দামতা কালবোশেখির চেয়ে কম নয়। কখনো সে তাকিয়ে দেখে, তীব্র হাওয়ায় গাছের পাতা ছিন্ন হয়ে উড়ে গেল, মিলিয়ে গেল কোথায়, দেখে তারও মনে প্রবল বাসনা জাগে—কাকে ঠিক এমনিভাবে ছিন্ন করে নিয়ে আসে নিজের কাছে, তারপর ভেসে পড়ে দু-জনে। চৈত্র মাসে একদিন নদীর ওপারে বালুর চরে ধুলো উড়তে দেখে হঠাৎ তার মনে পড়েছিল চর আলেকজান্দ্রার কথা, এবং তার মন নিষ্করুণ শুষ্কতার মধ্যে জেগে উঠে দিশাহারা হয়ে ছুটতে ছুটতে বালির বাঁধে আছড়ে পড়েছিল, আর আকুল হয়ে উঠেছিল গভীর নীল পানির তৃষ্ণায়। কিন্তু আজ বালির বাঁধ যেন ভেঙে গেছে সে-নীল পানিরই বন্যায়। সে-নীল পানি বয়ে যাচ্ছে তার অন্তরের ওপর দিয়ে, অথচ এখনো তৃষ্ণা মেটে নি। সে-তৃষ্ণা মেটাতে হবে। 

অবশেষে ঠিক করলে, কাউকে দিয়ে দর্জির বিবির কাছে কথা পাড়াতে হবে, যে, সে জরিনাকে বিয়ে করতে চায়। এই তো তার বাড়ি, তার ঘর : তবু এতে তার মন ভরছে না, জীবন পূর্ণাঙ্গ ঠেকছে না 

কিন্তু কথাটি পাড়াবার আগে-ই একটা চিন্তা তাকে ভাবিয়ে তুললে। বারে বারে সে ভাবলে, তবু মীমাংসায় পৌছতে পারলে না। সে খুনী : তার কি বিয়ে করবার অধিকার আছে? 

সেদিন দোকানের ঝাঁপ যখন দিলে, তখন বেশ রাত। সহকারী দর্জিরা অন্যপথে বাড়ি চলে গেল; আবেদ ও রাজ্জাক ফিরে চলল নদীর ধার দিয়ে। আগে আবেদ, পেছনে লণ্ঠন হাতে রাজ্জাক। মফস্বল শহর এর মধ্যে একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, এবং সে-নিস্তব্ধতার মধ্যে রাজ্জাকের সারা অন্তর একটি বেদনার্ত প্রশ্নে দোলায়িত। আজ সে স্পষ্টভাবে জানতে চাইছে : খোদা তার গুনা কখনো মাপ করবেন কি না। নিজের অন্তরে এ-প্রশ্নের উত্তর যখন মিলল না, তখন একবার ভাবলে বৃদ্ধ দর্জির কাছে জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু দর্জির নীরবতায় এমন কাঠিন্য যে আওয়াজ করতে সাহস হল না। 

নদীর পাড়টি খাড়া; বর্ষায় সেটি ভাঙে। একস্থানে নিচে ক-টা নৌকা বাঁধা, এবং তারই একটির মধ্যে থেকে একতারার আওয়াজ ভেসে আসছে। কিছু স্বপ্নের মতো কিছু রহস্যের মতো সে-আওয়াজ ঠেকল রাজ্জাকের কানে, এবং তারই মধ্যে হঠাৎ মনটা দূরে আবছা হয়ে গেল বলে একসময়ে সে কাশল, তারপর আস্তে বললে, 

—বাপজান, একটি কথা। 

দর্জি কোনো কথা কইল না, কেবল মুখটা একটু ফেরাল। 

কিন্তু রাজ্জাক বলে-ও বলতে পারলে না কথাটা। এবং বলতে পারল না এই ভয়ে যে : যদি উত্তর আসে, তার গুনার কখনো মাপ হবে না। 

আস্তে সে বললে, 

—না, কিছু না বাপজান। খালি মনটা থাকি-থাকি কেমন করে। 

আবেদ দর্জি কিছু কইল না। 

তারা বাড়ির প্রাঙ্গণে পা দিতেই মনে হল ঘরের মধ্যে একটা গোলমাল যেন চলছে। কে সরু গলায় কাঁদছে, আর কে যেন মোটা গলায় কথা কইছে। দর্জি থমকে দাঁড়িয়ে রাজ্জাকের পানে তাকিয়ে কতক্ষণ শুধু স্তম্ভিত হয়ে রইল, তারপর দ্রুতভাবে ভেতরে প্রবেশ করল। পেছনে-পেছনে রাজ্জাক-ও গেল। ভেতরে গিয়ে দেখলে, বাইরে রোয়াকে একটা কুপি; অল্প দূরে থাম ধরে দাঁড়িয়ে-থাকা জরিনার হাতে একটা লণ্ঠন। আর এদিকে পিঠ দিয়ে মাদুরে বসে একটি অপরিচিত লোক ভারি গলায় কথা কইছে, এবং পাশে বসে দর্জির বিবি কাঁদছে। 

একটু পরে বৃদ্ধ দর্জি এক বিস্ময়কর গলায় চেঁচিয়ে উঠল, 

—কে? 

শুনে দর্জির বিবির গলা একটু চড়ল, আর সে-অপরিচিত লোকটি নির্বাক হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে রইল। একটু দূরে দর্জির ভাইস্তা মকেম যে উবু হয়ে বসে ছিল, সে কেবল অনুচ্চ গলায় বললে, 

—মোমেন ভাই গো চাচা। 

রাজ্জাক শুনলে। তবে ঐ লোকটা মোমেন, যে-মোমেনের মিথ্যা অভিনয় সে করছে এখানে। এবং এবার তার অভিনয়ের পালা শেষ হল। তারপর অকস্মাৎ রাত্রির কালো আকাশে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো তার অন্তরময় ঝলকে উঠল তীক্ষ্ণ বেদনা : এবং সে-বেদনা হঠাৎ-ঘটিত সব-শূন্যতার বেদনা। গাইয়ের বাছুর মরলে গাইয়ের দুধের জন্যে সে-মরা বাছুরের খোলে খড় ভরে একটি প্রাণশূন্য মূর্তি তৈরি করা হয় : এবং এ-বাড়িতে যেন সে-খড়-ভরা বাছুরের মতো ছিল সে। এবং এ-জ্ঞান থেকে সে যেন সে-প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেল, যে-প্রশ্ন আজ সারাটি সন্ধ্যা তাকে ভাবিয়েছে। না, খোদা তাকে ক্ষমা করেন নি, এবং এ-জীবনে কখনো করবেন না। নীল পানি সে শুধু কল্পনাই করতে পারবে, বাস্তবে তার সন্ধান পাবে না। 

সকলের অলক্ষ্যে সে আস্তে বেরিয়ে এল। ঘুরতে-ঘুরতে নদীর ধারে এসে তার শূন্য তীরে সে শূন্য হয়ে বসে রইল। হঠাৎ মনের প্রান্তরে ধুলো উড়তে শুরু করেছিল, নীল পানির বন্যা বইতে শুরু করেছিল, কিন্তু এখন সেখানে শূন্যতা। তবু একটা মেঘলা দিনের কথা মনে পড়ে। তখন সন্ধ্যা। ঘাট ছেড়ে একটি বালাম নৌকা চলে গেল পুব অভিমুখে : কোথায় সে জানে না। সে-কথা মনে পড়ল, আর শূন্য অন্তর কেঁদে উঠল। কেঁদে উঠল কার জন্যে? কেঁদে উঠল তার-ই জন্যে, যার কথা এক মুহূর্তের জন্যেও মনের কোণে সে স্থান দেয় না, যার কথা স্মরণ হলে-ই তার সারা দেহ মুষড়ে ওঠে ভীত হতাশায়। সেই ফজু মিঞাদের বাড়ির ফইন্যার জন্যে আজ তার অন্তর কাঁদল, এবং আশ্চর্য, রাত্রির অন্ধকারে চোখ দিয়ে অশ্রু ছুটল। অপরাধী সে, কিন্তু অপরাধীর কি অন্তর থাকে না? খোদা তাকে কখনো মাপ করবেন না-এ -কথা সে জেনেছে, তবু ওর জন্যে তার হৃদয় ব্যথায় গুমরে গুমরে উঠবে না কেন? ফইন্যাকে কি সে ভালোবাসত না? বাসত, কিন্তু মানুষের শরীরে যে ক্রোধের আগুন রয়েছে : সে আগুন একবার দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠলে তখন সবকিছুই সম্ভব, প্রিয়তম কারো আস্ত হৃদয় যদি কেউ এনে দেয় তবে সে-হৃদয়ও তখন মানুষ কেটে টুকরো-টুকরো করে ফেলতে পারে। এবং কারো কারো দেহে সে-ক্রোধের আগুন একটু বেশি মাত্রায় থাকে বৈকি। 

শেষে একটি কথা ভেবে শান্তিতে তার কান্না শান্ত হল। যে-লোক খুন হয়, সে বেহেশতে যায়। ফইন্যা বেহেশতে যাবে। খোদা কখনো তাকে ক্ষমা না করুন, কিন্তু ফইন্যার বেহেশত-লাভের কথা তাকে চিরদিন শান্তি দেবে। 

.

সকালবেলায় মোমেনের সঙ্গে রাজ্জাকের দেখা হল। উজ্জ্বল সূর্যালোক, তার মধ্যে চেয়ে দেখলে : সবল ও দীর্ঘ তার দেহ; বড় চোখ বড় চেহারা, আর বাঁকা গোঁফ। গায়ে শৌখিন পোশাক : দেহের ভঙ্গিতে কিছু ঔদ্ধত্য। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে রাজ্জাককে আপাদমস্তক চেয়ে দেখলে, তারপর বললে, 

—তুমি বুঝি মোমেন সেজেছ? 

তার প্রথম কথাই ভালো লাগল না, তাই কোনো উত্তর দিলে না। মোমেন আবার প্রশ্ন করল, 

—নাম কী? 

—রাজ্জাক। বলে থামতেই কী একটি উত্তেজনায় তার ঠোঁট কেঁপে উঠল, কয়েক মুহূৰ্ত চুপ থেকে অদ্ভুত কঠিন গলায় বললে, 

—আমার নাম আবদুর রাজ্জাক। আলেকজন্ডর চরের সোনাভাঙা গেরামের ফজুমিঞাদের বাড়ির ফইন্যারে আমি খুন করছি—গত চৈত্ মাসে। 

মোমেন কয়েক মুহূর্ত বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থেকে দ্রুত পায়ে চলে গেল, গিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে হইচই বাধিয়ে তুলল চিৎকার করে। 

কিন্তু তার আগে-ই রাজ্জাক বাইরে চলে এল—এবং এল চিরদিনের জন্যে। বেরোবার আগে একবার সে দক্ষিণ দিকের ঘরের পানে তাকাল, দেখলে, দরজার কাছে পা মেলে জরিনা কাঁথা সেলাই করতে-করতে হঠাৎ মোমেনের চেঁচামেচি শুনে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তার পানে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

খুনী

খুনী

খুনী

দেবব্রত চৌধুরী মানুষটি এতই নিরীহ ভালোমানুষ যে বাইরের লোক আড়ালে আর তার ছেলেমেয়েরা মুখের সামনেই ভীতু বলে হাসাহাসি করে। দেব্রতবাবুর অবশ্য তাতে কিছু এসে যায় না। নিজের কাজটুকু নিয়মমতো মুখ বুজে করেই তার শান্তি। নিজের কাজ মানে অফিস ছাড়া জপ-তপ, সন্ধ্যা-আহ্নিক ইত্যাদি। আর ছোট্ট বাগানটির দিকে সকাল-সন্ধ্যা নজর রাখা।

বীরভূম জেলায় বোলপুরের কাছে এঁর আদি বাড়ি। সেখানকার ইস্কুল থেকে ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাস করে সেই যে কলকাতায় এসে পড়াশোনা আরম্ভ করেন সেই থেকেই তিনি একেবারে কলকাতার মানুষ হয়ে গেছেন। সায়েন্স নিয়ে তিনি কলেজে পড়েন। উঠতি বয়েসে–বোধহয় সায়েন্স পড়ার গুণেই খুব বিজ্ঞানভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। ফলে কোনো সংস্কার, অলৌকিক ঘটনা, তাগা-তাবিজ-মাদুলির গুণাবলী নস্যাৎ করে দিতেন। এই নিয়ে হোস্টেলের ছেলেদের সঙ্গে তার প্রায় রোজই তর্ক বাধত।

মানুষের জীবনে কত আশ্চর্য পরিবর্তনই না ঘটে। সেই তার্কিক মানুষই এখন রিটায়ার করার মুখে ঠাকুর-দেবতা, জপ-তপ, সন্ধ্যা-আহ্নিক সবই করেন। আর এতে পরম শান্তি পান। মাঝখানে তো তার এক অদ্ভুত খেয়াল হয়েছিল-পরলোকচর্চা। মৃত্যুর পর মানুষ–অর্থাৎ মানুষের আত্মা কোথায় যায়–কি বা তার পরিণতি–এসব তত্ত্ব জানার জন্যে তিনি দেশী বিদেশী অনেক বইও পড়ে ফেলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্ল্যানচেট পর্যন্ত করতেন। প্ল্যানচেটে আত্মাকে ডেকে কিছু কিছু প্রশ্নও করতেন। পরে অবশ্য স্ত্রী অপছন্দ করায় বাধ্য হয়ে প্ল্যানচেট করা ছেড়ে দেন।

এখন তাই বড়ো বড়ো ছেলেমেয়েরা যখন হাসতে হাসতে তাঁকে বলে, বাবা, তুমি এক নম্বর ভীতু তখন তিনি গম্ভীর হয়ে যান।

তাঁকে ভীতু বলার যেটা সবচেয়ে বড়ো কারণ সেটা হচ্ছে–তিনি বাড়ি করলেন কলকাতার একপ্রান্তে এমন জায়গায় যেখানে ট্রামবাসের শব্দটুকুও শোনা যায় না।

এমন জায়গায় বাড়ি করলেন কেন? প্রপার কলকাতায় ভালো জায়গা পাননি? তা নয়, আসলে সেই উনিশ শ ছেচল্লিশ সাল থেকে মধ্য কলকাতায় থাকার সময়ে এত দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ট্রাম-বাস পোড়ানো, পুলিশের নির্মম গুলি চালানো, খুন-খারাপি, অ্যাক্সিডেন্ট দেখেছেন যে এখন তিনি আর সেসব সহ্য করতে পারেন না। আর ওসব ব্যাপার তো থেমে যায়নি। বরঞ্চ এখন যেন বেড়েই চলেছে। কাজেই এই নিরিবিলি জায়গা বেছে নিয়েছেন।

–অথচ এই তুমিই নাকি প্ল্যানচেট করতে? প্রশ্ন করে এম. এ পাস বড়ো মেয়ে।

–হ্যাঁ, তা করতাম।

—তখন ভয় করত না?

না, ভয় বলে জিনিসটা আমার কোনোদিন ছিল না। আজও নেই। তবে ঐ সব দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুন-খারাপি দেখলে মনের ওপর কেমন চাপ পড়ে।

–এখনও তুমি প্ল্যানচেট করতে পার? মেজো ছেলে কানু জিজ্ঞেস করে।

–পারি বৈকি। তবে আগে যেমন প্ল্যানচেটে কাঠের ছোট টেবিল ছিল–এখন তো আর সেসব পাওয়া যায় না। তবু একটা কাপ আর একটা চকখড়ি পেলেই কাজ হয়ে যায়।

–একটা কাপ আর চকখড়ি!

–হ্যাঁ, হা, সাধারণ চায়ের কাপ।

ছেলেমেয়ে দুজনেই বলে উঠল–একবার প্ল্যানচেট কর না।

দেবব্রত স্ত্রীর ভয়ে অনেক দিন প্ল্যানচেটে বসতে পারেননি। আজ একবার ইচ্ছে হলো, কিন্তু কানুর মা শোনামাত্র একেবারে অগ্নিমূর্তি হয়ে এসে সবাইকে ধমক দিয়ে বললেন না, এ বাড়িতে ওসব আত্মাটাত্মা নিয়ে ছেলেখেলা চলবে না।

ব্যাস! হয়ে গেল। প্ল্যানচেট পর্ব ঐখানেই শেষ।

কিন্তু

দেবব্রত জানতেন না এই বয়েসে খুব শীগগিরই তাকে অন্তত একদিন প্ল্যানচেট নিয়ে আবার বসতে হবে। অফিসের একটা কাজে হঠাৎ তাকে একদিনের জন্যে যেতে হলো বর্ধমান জেলার এক মহকুমা শহরে। সেখান থেকে আবার রিকশা নিয়ে মাইল তিনেক দূরে এক গ্রামে।

এ এমন জায়গা যেখানে হোটেল-টোটেলের বালাই নেই। রাতে থাকবেন কোথায়? অফিসেরই এক ভদ্রলোক সেই গ্রামের তার পরিচিত এক ভদ্রলোককে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন, যেন এক রাত্তিরের জন্যে তার এই অফিসের সহকর্মটিকে থাকতে দেওয়া হয়। দেবব্রতবাবুকে অবশ্য একটা কথা বলে দেওয়া হয়েছিল, ওখানে গিয়ে যেন বাড়ির কর্তার কথা না জিজ্ঞেস করেন। কেননা বৃদ্ধ ভদ্রলোকের একটি ছেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার পর থেকে তিনি শোকে একেবারে পাগল হয়ে গেছেন। তাকে একটা ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হয়। সেই হতভাগ্য ছেলেটির কথা উঠলে সবাই নতুন করে দুঃখ পাবে, তাই।

দেবব্রত ভাবলেন, ওসব ফ্যামিলি ম্যাটারে যাওয়ার তার কি দরকার? চুপচাপ কোনোরকমে একটা রাত কাটিয়ে দিতে পারলেই হলো।

.

পরিবারটি সত্যিই ভদ্র। শুধু ভদ্রই নয়, যথেষ্ট আধুনিক। বাড়ির যিনি বড়ো ছেলে তার নাম বিনয়বাবু। ষাট ছাপিয়ে গেছে। তার বড় ছেলেটি রাউরকেল্লায় কাজ করে। ছুটিতে বাড়ি এসেছে। মেয়ে সুষমাও কয়েকদিনের জন্য বাপের বাড়িতে এসে রয়েছে। সেও এম. এ. পাস। বড়ো ছেলের ভালো নাম জানা গেল না, তবে ডাকনাম ব্রত। এ বাড়ির যিনি বড়ো বৌ অর্থাৎ বিনয়বাবুর স্ত্রী–তিনিও খুব প্রগতিশীল মহিলা। একজন বাইরের ভদ্রলোকের সামনে বেরিয়ে তিনি স্বচ্ছন্দে আলাপ করলেন। বলাই বাহুল্য, আদর অভ্যর্থনার কোনো ত্রুটি এঁরা করেননি।

বাড়িটা টিপিক্যাল যেমন গ্রামের পুরনো বাড়ি হয়। একতলা বাড়ি। পলস্তরা খসে পড়েছে। মোটা মোটা কড়ি। জানলাগুলো ছোটো। ফলে প্রায় সব ঘরগুলোই কেমন অন্ধকার। আর সঁতসেঁতে গন্ধ। ঘরের বাইরে মস্ত উঠোন। সেখানে ধানের মরাই, ধানভানার চেঁকি থেকে গোয়ালঘর পর্যন্ত সবই আছে। তবু কোথায় যেন ওঁদের সবার মনে একটা চাপা দুঃখের ভাব। সেটা হয়তো পুত্রশোকে পাগল ঐ বন্দী বৃদ্ধের জন্যেই।

রাত্রে খাওয়ার পর গল্পের আসর বসল। সবার সঙ্গে বিনয়বাবুর স্ত্রীও বসলেন পানের ডিবে নিয়ে।

নানা পরিচয়পর্বের পর গল্প জমে উঠল। গ্রামের সুখ-সুবিধে, পুজো-পার্বণ থেকে শুরু করে গ্রাম্য পলিটিক্স পর্যন্ত। শেষে ভূতও এসে পড়ল। কথায় কথায় সুষমা বলল কাকাবাবু, আপনি কখনো ভূত দেখেছেন?

দেবব্রত হেসে বললেন কলকাতায় আর ভূত কোথায় পাব মা? এত লোডশেডিং এর সুবিধে তবু তেনারা এখন আর দেখা দেন না।

সুষমা বললে কিন্তু আমাদের এখানে ভূত আছে। আর এই বাড়িতেই। বলে হেসে মায়ের দিকে তাকাল।

–জানেন, মা এ বাড়িতে প্রায়ই ভূত দেখে।

বিনয়বাবুর স্ত্রী কিছুমাত্র লজ্জিত না হয়ে মুখে আর একটা পান গুঁজে বললেন–ভূত কিনা জানি না, তবে অন্ধকারে এ-ঘর ও-ঘর করার সময়ে মাঝে মাঝে কি যেন ছায়ার মতো সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর হঠাৎই মিলিয়ে যায়।

দেবব্রত ভয় পাওয়া তো দূরের কথা বেশ পুলকিত হলেন। বললেন–তা একবার প্ল্যানচেট করে দেখতে পারেন।

–প্ল্যানচেট! নাম শুনেছি বটে, কিন্তু কখনো দেখিনি। ব্রত বলল।

দেবব্রত বিজ্ঞের মতো হেসে বললেন–ও আর এমন কী ব্যাপার! আমিই এক সময়ে প্ল্যানচেট করে কত আত্মা নামিয়েছি।

–আপনি প্ল্যানচেট করতে পারেন?

দেবব্রত গোঁফের ফাঁকে একটু হাসলেন। বললেন–একটা কাপ আর একটা চকখড়ি নিয়ে এসো। দেখিয়ে দিচ্ছি।

সুষমা মহা উৎসাহে বলে উঠল–কিরকম কাপ?

–অতি সাধারণ চা খাবার কাপ। তবে ভালো করে ধুয়ে মুছে এনো৷

সুষমা তখনই এরকম ছুটে গেল আর একটু পরেই একটা পরিষ্কার সাদা কাপ আর চকখড়ি নিয়ে এল। তারপর দেবব্রতর নির্দেশে মসৃণ জায়গা দেখে (পুরনো বাড়ি তো) ভালো করে গঙ্গাজল দিয়ে মুছে ফেলা হলো। জায়গাটা শুকোলে এবার দেবব্রত বেশ গম্ভীরভাবে এগিয়ে এসে খড়ি দিয়ে বেশ বড়ো করে একটা গোল গণ্ডি টানলেন। তারপর সেই গণ্ডির ডান দিকের মাথা থেকে A, তার নীচে B তার নিচে C, এমনি করে Z পর্যন্ত লিখলেন। দেখে মনে হলো গণ্ডিটা যেন কতকগুলো ইংরিজি অক্ষরের মালা গলায় পরে রয়েছে। তারপর সেই বড় গণ্ডির ঠিক মাঝখানে ছোটো একটা গোল গন্ডিও টানলেন। তারপর সেই ছোটো গণ্ডির মধ্যে কাপটি উপুড় করে রাখলেন।

ব্যাস্! এবার বড় আলোটা নিভিয়ে দিয়ে ডিম আলোটা জ্বালো।

ব্রত তখনই উঠে গিয়ে বড়ো আলোটা নিভিয়ে নীল আলোটা জ্বেলে দিল।

-বেশ। ধূপ আছে?

 –আছে। নিয়ে আসব?

–হ্যাঁ। মানে জায়গাটা যতদূর সম্ভব পবিত্র করা আর কি!

করে গঙ্গাজল খড়ি দিয়ে কে তার নীচে

ধূপদানীতে দুটো ধূপও জ্বেলে দেওয়া হলো। মুহূর্তে ঘরের হাওয়াটাই বদলে গেল।

এবার তোমাদের দু-একটা কথা আগে বলে নিই। দুজনকে বসতে হবে কাপের দুদিকে একটা করে আঙুল শুধু ছুঁইয়ে। যে দুজন বসবে তারা এমন কাউকে স্মরণ করবে যিনি দুজনেরই চেনা। একাগ্র চিত্তে ভক্তিভরে স্মরণ করবে। তারপর যখন দেখবে কাপটা নড়ছে তখন তাকে জিজ্ঞেস করবে–কে এসেছেন? তারপর তোমাদের যা প্রশ্ন থাকবে, আত্মা ঐ কাপ দিয়েই ইংরিজি লেটারগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে ইংরিজিতেই সংক্ষিপ্ত উত্তর দেবেন। এবার তাহলে তোমরা ঠিক করো কাকে ডাকবে আর কে দুজন বসবে।

কৌতূহল যেমন আছে তেমনি ভয় ভয়ও করছে। শেষ পর্যন্ত সুষমা আর ব্রত দুরু দুরু বক্ষে এসে বসল।

কাকে ডাকবে ঠিক করেছ?

এ আর কঠিন কি! কত চেনা-জানা লোকই তো এর মধ্যে মারা গেছেন।

–ধীরু গাঙ্গুলিকে ডাকলেই তো হয়।

–ধীরু গাঙ্গুলি! ঐ সুদখোর-বদমাশ! নানা, ওকে ডেকে কাজ নেই।

ব্ৰত একটু ভেবে বলল–তবে ঘোষেদের হরেন দাদু?

ও রে ফাদার! ঐ রাগী লোককে?

না না, কক্ষনো না। উনি তো ঝগড়া করতে করতেই হার্ট ফেল করেছিলেন।

 –তাহলে?

–মা, তোমার সই গঙ্গাজলকে–

বাপু, সে ছিল বেজায় শুচিবাইয়ে। দেখতে না আমাদের ঘরে এসে বসতে চাইত না। আজ মরে গিয়ে তো আরও

–মহা মুশকিল। তা হলে ডাকা যায় কাকে? বেশ একজন ধীর, স্থির, ভদ্র, নম্র মানুষ হলেই ভালো হয়।

–হ্যাঁ, সেইরকমই কারো কথা তোমরা ভাব। নইলে তেমন স্পিরিট হলে বড্ড বিরক্ত হয়। দেবব্রত গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন।

হঠাৎ সুষমা বলে উঠল–ছোটো কাকাকে ডাকলে হয় না?

ছোটো কাকার কথা উঠতেই এক মুহূর্তে সবার মুখে দুঃখের ছায়া নেমে এল। এতক্ষণে বিনয়বাবু কথা বললেন–কিন্তু সে যে মারাই গেছে–তা তো আজ পর্যন্ত সাব্যস্ত হয়নি। বলে তিনি দেবব্রতর দিকে তাকালেন।

–ঐ একটা আমাদের ফ্যামিলি ট্র্যাজেডি। সে আজ প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। আমাদের ছোটো ভাই। কলকাতায় কলেজে পড়ত হস্টেলে থেকে। একদিন ওরা কয়েকজন বন্ধু মিলে মধুপুর, গিরিডি বেড়াতে গেল। তিন-চারদিন পর ফিরল সবাই। ফিরল না শুধু আমার ছোটো ভাই আর ওর এক বন্ধু। জানা গেল ওরা দুজনে গিরিডি থেকে দূরে উশ্রী ফলস্ দেখতে গেছে। দুদিন পরে বন্ধুটি ফিরল একা। তাকে জিজ্ঞেস করা হলে সে তো অবাক। বলল, ও তো শেষ পর্যন্ত উশ্রী দেখতে যায়নি। কলকাতায় ফিরে এসেছিল। বন্ধুটি জোর দিয়ে বলল, সে নিজে ওকে ট্রেনে তুলে দিয়েছিল। কিন্তু ভাই আর ফেরেনি।

এই পর্যন্ত বলে বিনয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

দেবব্রত কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে বললেন–যদি তিনি মারা গিয়েও থাকেন তা হলে কিভাবে সম্ভব মনে করেন?

বিনয়বাবু সহজ সুরেই বললেন–অ্যাকসিডেন্ট। ট্রেন থেকে পড়ে কিংবা ঐ ধরনের কিছু–এ ছাড়া আর কি হতে পারে?

-খুনও হতে পারে। সবইকে চমকে দিয়ে কথাটা বলে উঠলেন বিনয়বাবুর স্ত্রী।

দেবব্রত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন–খুন! কে খুন করবে? তার মোটিভ–মানে উদ্দেশ্যই বা কি?

–আমার ধারণা খুনের উদ্দেশ্য একটা ছিল। ওর হাতে একটা বিশেষ আংটি ছিল। আমরা একবার নেপাল বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে একজন লামার সঙ্গে আমার দেওরের আলাপ হয়। লামা তাকে একটা আংটি দিয়ে বলেছিল–এটা পরে থাকলে নাকি কোনোদিন কোনো বিপদ ঘটবে না। সেইসঙ্গে সাবধানও করে দিয়েছিল–যেন সে কথা কাউকে না বলে। বোকা ছেলেটা আংটিটা সব সময়েই পরে থাকত আর সবাইকে বলে বেড়াত।

–তা থেকে কী প্রমাণ হয়? একজন ঝানু গোয়েন্দার মতো প্রশ্ন করলেন দেবব্রত।

–প্রমাণ কিছুই হয় না, তবে মনে হয় ঐ আংটির লোভেই ওর সঙ্গে যে ছেলেটা ছিল সে-ই খুন করেছে।

দেবব্রত একটু গম্ভীর হয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন পুলিশ কিছু করতে পারল না?

বিনয়বাবু সংক্ষেপে মাথা নাড়লেন।

না। কে একটা ছেলে হারিয়ে গেল বা মরল তা নিয়ে বিহার পুলিশের বা কলকাতা পুলিশের তেমন মাথাব্যথা ছিল না।

দেবব্রত আবার কিছুক্ষণ ভাবতে লাগলেন। তারপর বললেন–মৃত্যু হয়েছেই এমন যখন সিদ্ধান্ত নয় তখন অন্য কাউকে ডাকলেই হয়।

কিন্তু সুষমা বলে উঠল–না, ছোটো কাকাকেই ডাকা হোক। তিনি মরে গিয়ে থাকলে নিশ্চয় আসবেন।

–বেশ, তাই ডাকো।

 ওরা ভাই-বোনে তখন মুখোমুখি বসল।

–ও হো! দেবব্রত বাধা দিলেন–তোমরা তো ওঁকে দেখইনি তা হলে স্মরণ করবে কি করে? একটু হেসে বললেন–ওঁর একটা ছবি আছে?

এ ওর মুখ চেয়ে সবাই মাথা নাড়ল। না, খুব পুরনো একটা ছবি বোধহয় আছে অ্যালবামে। তাও সেটা ট্রাঙ্কের মধ্যে।

–তবে তোমরা ওঠো। তোমাদের বাবা মাকে বসতে দাও।

বিমর্ষ মনে ওরা উঠে পড়ল। বসলেন বিনয়বাবু আর তার স্ত্রী।

ঘরে হালকা নীল আলো জ্বলছে, ধূপের গন্ধে ঘর ভরপুর। ওঁরা দুজনে কাপের ওপর আঙুল ঠেকিয়ে চোখ বুজিয়ে একমনে এ বাড়ির ছোটো ছেলেটির কথা ভাবতে লাগলেন।

গোটা ঘর স্তব্ধ। কারও নিশ্বাস ফেলার শব্দটুকুও যেন শোনা যাচ্ছে না। শুধু কড়িকাঠের আড়ালে একটা টিকটিকি টিটি করে ডেকে উঠল।

দু মিনিট–তিন মিনিট করে দশ মিনিট কেটে গেল। কিন্তু কাপ একটুও নড়ল না। সবাই চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু দেবব্রতর কোনও চাঞ্চল্য নেই। বরঞ্চ কেমন খুশি খুশি ভাব।

খুশির ভাব তো হবেই–ছেলেটা নিশ্চয় তাহলে বেঁচে আছে।

–যাক নিশ্চিন্ত। উনি মৃত নন। এবার ইচ্ছে করলে আপনারা অন্য কাউকে

কথা শেষ হলো না। সবাইকে চমকে দিয়ে কাপটা হঠাৎ নড়ে উঠল। সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে কাপটার দিকে তাকিয়ে রইল।

কাপটা প্রথমে ছোটো বৃত্তের মধ্যে ঘুরল। তারপর হঠাৎ ছিটকে ছোটো বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে এসে এদিক ওদিক করতে লাগল।

দেবব্রত ফিসফিস্ করে বললেন–জিজ্ঞেস করুন কে এসেছেন?

ওঁরা কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

এসব ক্ষেত্রে কাপটা ইংরিজি এক একটি অক্ষরের কাছে গিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সেরকম কিছু ঘটল না। কাপটা শুধু বৃত্তের মধ্যেই ঘুরতে লাগল। এত দ্রুত ঘুরতে লাগল যে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে রাখা দায় হলো।

এমন অদ্ভুত ব্যাপার দেব্রত নিজেও কখনো দেখেননি। তিনিও যেন কেমন ভয় পেলেন। বলে উঠলেন–আপনারা আঙুল সরিয়ে নিন।

ওঁরা তাই করলেন। সঙ্গে সঙ্গে কাপটাও একেবারে নিশ্চল হয়ে গেল।

–এ কোনো অশুভ আত্মার কাজ। ক্ষতি করার জন্যে হঠাৎ এসে পড়েছিল। একটু থেমে বললেন–অনেক রাত হয়েছে। আর কাউকে ডেকে কাজ নেই।

সকলেরই গা ছমছ করছিল। দ্বিরুক্তি না করে সবাই উঠে পড়ল।

.

দরজায় কি কেউ কড়া নাড়ছে?

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল দেবব্রতর। অন্ধকার ঘর। প্রথমটা বুঝতেই পারলেন না কোথায় আছেন। কিন্তু ভেবে ওঠার আগেই দরজায় এবার জোরে কড়া নাড়া।

–শুনছেন! শীগগির একবার আসুন।

ধড়মড় করে উঠে দেবব্রত আলো জ্বেলে দরজা খুলে দিলেন। দেখলেন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বিনয়বাবু আর তার স্ত্রী। ভয়ে তাদের মুখ সাদা।

–একবার এ ঘরে আসুন।

দেবব্রত তখনই তাদের সঙ্গে চললেন। এটা সেই ঘর যেখানে কয়েক ঘণ্টা আগে প্ল্যানচেট করা হয়েছিল। বিনয়বাবু সভয়ে বললেন–আমরা পাশের ঘরে শুই। অনেকক্ষণ থেকেই এ ঘরে কিরকম একটা ঠুক্ ঠুক্ করে শব্দ হচ্ছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম ইঁদুর-টিদুর। কিন্তু শব্দটা অন্যরকম। উঠে এসে দেখি–সেই কাপটা মিটসেফের ওপর নড়ছে। কিন্তু এখন

দেবব্রত বললেনকই নড়ছে? হেসেই বললেন–ঘুমের ঘোরে নিশ্চয়ই ভুল দেখেছিলেন। একটা কাপ কখনো এমনি নড়তে পারে না।

তবু একটু অপেক্ষা করে ওঁরা ফিরে যাচ্ছিলেন–এমনি সময়ে শব্দ-খুট খুট খুট।

সবাই চমকে উঠে দেখল কাপটা যে শুধু নড়ছে তা নয়, সেটা এগিয়ে এসেছে মিটসেফের ধার পর্যন্ত।

ভয়ে দেব্রতর মাথার চুল পর্যন্ত খাড়া হয়ে গেল। জীবনে তিনি অনেকবার প্ল্যানচেট করেছেন, কিন্তু এমন দৃশ্য কখনো দেখেননি।

–কি হবে দেবব্রতবাবু?

দেবব্রতবাবু বললেন–স্পিরিট দেখছি এখনও যায়নি। বোধহয় কিছু বলতে চায়। ঠিক আছে, আবার বসুন আপনারা।

কিন্তু বিনয়বাবুর স্ত্রী এবার আর কিছুতেই বসতে চাইলেন না। দেবব্রতবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, ঠিক আছে আমিই বসছি। আপনার বসতে তো ভয় করছে না?

ভয় করলেও বিনয়বাবুকে বসতে হলো। যথারীতি খড়ি দিয়ে গণ্ডি কেটে তার মধ্যে কাপটা বসিয়ে দেবব্রতবাবু বললেন–নিন রেডি?

বিনয়বাবু কিন্তু দেবব্রতবাবুর দিকে তাকিয়ে কিছু যেন ভাবছিলেন। এবার ইতস্তত করে বললেন–আপনি বসবেন, কিন্তু আপনি তো আমার ভাইকে দেখেননি।

দেবব্রতবাবু একটু যেন থমকে গেলেন। বিরক্ত হলেন। বললেন–সে আমি বুঝব। বলেই কাপের ওপর আঙুল ছোঁয়ালেন। সঙ্গে সঙ্গেই কাপটা ছোটো গণ্ডি থেকে তীব্র গতিতে বেরিয়ে এসে বড়ো গণ্ডির মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল।

দেবব্রতবাবুর ইঙ্গিতে বিনয়বাবু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন–আপনি কে এসেছেন দয়া করে জানাবেন?

মুহূর্তমাত্র দেরি না করে কাপটা প্রথমে এগিয়ে গেল R অক্ষরটির কাছে, তারপর তরতর করে উঠে এল A অক্ষরের কাছে, তারপর নেমে ঘুরে গেল M-এর কাছে–সেখান থেকে E তারপর N-এর কাছে গিয়ে থেমে গেল। সকলে ফিসফিস করে উঠল–র-মেন!

রমেন কে? ভুরু কুঁচকে দেবব্রত জিজ্ঞেস করলেন।

–আমার ছোটো ভাই। বলে ফুঁপিয়ে উঠলেন বিনয়বাবু।

কাপটা ততক্ষণে আবার ঘুরতে শুরু করেছে। যেন কিছু বলার জন্যে ছটফট করছে।

–রমেন ভাই আমার! কেমন আছিস? কি করে তোর এই সব্বনাশ হলো? কে করল?

এত সব প্রশ্নের উত্তর কোনো স্পিরিটই একসঙ্গে দিতে পারে না। রমেনের আত্মাও দিল না। কাপটা শুধু এবার ধীরগতিতে এগিয়ে গেল M-এর কাছে। তারপর U-র কাছে–তারপর R, তারপর D, তারপর E, ফের R…

কাপ নড়ে নড়ে নয়, ছুটে চলেছে বৃত্তের একপ্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। বিনয়বাবু আঙুল ঠেকিয়ে রাখতে একেবারে ঝুঁকে পড়েছেন কাপের উপর আর আশ্চর্য–দেবব্রতবাবুর হাতটা কাঁপছে থরথর করে।

এ পর্যন্ত একটি কথাই স্পষ্ট হয়েছে MURDERER-তারপর আরও কটি কথা–WITH YOU.

হঠাৎই দেবব্রতবাবু আঙুলটা তুলে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কাপ নিশ্চল হয়ে গেল।

–এটাও নিশ্চয় কোনো খারাপ স্পিরিট। ভয় দেখাতে চায়। বলেই তিনি উঠে একেবারে নিজের ঘরে গিয়ে খিল দিলেন।

.

টর্চের আলোয় রিস্টওয়াচটা দেখলেন একবার। রাত সাড়ে তিনটে। ব্যাগটা তুলে নিয়েই জুতোর সামান্যতম শব্দটুকুও না করে চুপি চুপি বেরিয়ে পড়লেন দেবব্রতবাবু। তিন মাইল রাস্তা হাঁটতে হবে–হয়তো ছুটতে হবে। তারপর যে দিকের যে ট্রেন পাওয়া যায়

রমেনের বাড়ি যে এটাই তা কি আর জানতেন? ওর কথা তো ভুলেই গিয়েছিলেন। আগে মাঝে মাঝে ভাবতেন। ভাবতেন, উশ্রী ফক্স দেখতে না গেলেই হতো। ওঁরই আগ্রহে তো রমেনকে যেতে হয়েছিল।

..বড্ড অহংকারী ছিল রমেনটা। আংটিটা সবাইকে দেখিয়ে বলত–এ জিনিস রাজার ভাগ্যেও জোটে না। এ আংটি পরা থাকলে কোনো বিপদ কাছে ঘেঁষতে পারে না।

বিজ্ঞানের ছাত্র দেবব্রত এসব কথা বিশ্বাস করতেন না। এই নিয়ে বহুবার ওর সঙ্গে তর্ক ঝগড়া হয়েছে……..

উশ্রী প্রপাতের একদম ধারে একটা পাথরের ওপরে দাঁড়িয়ে আবার সেই তর্কের শুরু।

রেগে গিয়ে দেব্রত বললেন–তাহলে ঐ যেখানে তোড়ে জল পড়ছে সেখানে ঝাঁপ দে। দেখি কি করে বাঁচিস?

রমেন আংটিটার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল–তা পরি।

এ কথা বলেও রমেন একটু যেন ইতস্তত করছিল। একটু নাকানি চোবানি খাওয়াবার জন্যে হঠাৎ দেবব্রত সামান্য একটু ঠেলা দিলেন। রমেন ছিটকে পড়ল দু পা দূরে আর একটা পাথরের কাছে যেখানে মোটে হাঁটু জল। কিন্তু জায়গাটা বোধহয় খুব পিছল ছিল। আর তার পরেই….

…সে সব আজ কতদিনের কথা বয়েস তখন কতই বা, আঠারো-উনিশ?

দেবব্রতবাবু তখন প্রাণপণে ছুটছেন। স্টেশন এখনও অনেক দূর।

[শারদীয়া ১৩৯৭]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *