খুনী
চর আলেকজান্দ্রার সোনাভাঙা গ্রামের ঘাটে এখনো নৌকার ভিড়। কত নৌকা আসছে, যাচ্ছে : বালাম, সাম্পান, কিছু সোরঙ্গ-ও। চালের মরসুম এখনো সরগরম। অথচ এদিকে চৈত্রের শেষাশেষি। গাঁয়ের পশ্চিমে নারকেল-বন পেরিয়ে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা প্রান্তরের ধারে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে : উদ্দাম হাওয়ায় সে-প্রান্তরময় ধুলো উড়ছে। পেছনে নারকেল-বনে অশান্ত মর্মরধ্বনি, আর সামনের জনশূন্য প্রান্তরে কেবল ধুলো উড়ছে আর উড়ছে, কখনো ঘূর্ণি হয়ে ঊর্ধ্বে উঠে, কখনো আকাশের বুক থেকে তির্যক গতিতে নিচে নেবে আসে, আবার কখনো মাটি ছুঁয়ে তীরবেগে দূরান্তে মিলিয়ে গিয়ে। আর, যে-পথটা গ্রাম থেকে বেরিয়ে কিছু এঁকেবেঁকে সোজা পশ্চিমে চলে গেছে, সে পথ স্থানে স্থানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সে-ধুলোর মধ্যে : যেন শূন্যে মিলিয়ে গেছে উদ্দাম হাওয়ার তীব্র মায়ায়।
এমনি এক সময়ে এক ভরা দিনে রোদ খরখর করছে, তার মধ্যে ফজু মিঞাদের বাড়ির ও মৌলবীদের বাড়ির দু ছেলের মধ্যে কী একটা সামান্য বিষয় নিয়ে হঠাৎ খুনোখুনি হয়ে গেল; ফজু মিঞাদের ছেলের প্রাণ গেল, আর মৌলবীদের ছেলে তারপর সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, সোনাভাঙা গ্রামের কেউ আর তার কোনো সন্ধান পেল না। চর অঞ্চলে খুনোখুনি লেগে-ই থাকে, তাই চরবাসীদের জন্যে এটা এমন নতুন কিছু নয়। এবং মাস কাটতেই তারা প্রায় ভুলে গেল সে-কথা।
.
উত্তরবঙ্গের কোনো এক মহকুমা শহর। আবেদ মিঞার দর্জির দোকানটা ফৌজদারি আদালতের পাশে এক বিরাট পঞ্চবটি গাছের তলে। ওধারে ট্রেজারি। কাঁটাতারের বেড়ার দু কোণে উজ্জ্বল আলো; সে-আলোর খানিকটা এসে পড়ে তার দোকানের সামনে। কেউ-বা কখনো ভুল করে, বা পথ সংক্ষিপ্ত করবার জন্যে ট্রেজারির সামনে দিয়ে যেতে-ই পাহারাদার তীক্ষ্ণ ও কর্কশ গলায় হেঁকে ওঠে, তাছাড়া এ-স্থান ভরে প্রগাঢ় অবিচ্ছেদ্য নীরবতা। সারাটা দিন ভরে এ-স্থান জনতার কোলাহলে তীব্রভাবে মুখর হয়ে থাকে বলে সন্ধ্যার পর এ-নির্জনতার নীরবতা অত্যন্ত জমাট মনে হয়, আর পাথরের মতো ভারি ঠেকে যেন। এবং পঞ্চবটির তলে ঘাসশূন্য পরিষ্কার স্থানে থেকে-থেকে যে-শুকনো ঝরা পাতা দমকা হাওয়ায় মর্মরিয়ে ওঠে, সে-মর্মরকে মনে হয় দিনের কোলাহলের আবছা, অস্পষ্ট স্মৃতির মতো।
আবেদ দর্জি বৃদ্ধ। তার সেলাইয়ের কলটিও ঝুনো, চলতে গিয়ে সেটা আওয়াজ করে বেশি, আর কেমন থরথরিয়ে কাঁপে। অনেকক্ষণ তার ওপর হাত রেখে কাজ করলে হাতে ঝিঁঝি ধরে যায়, মনে হয় সেখানে-ও কল চলছে।
সে-কলটা এখন নীরব। নাকে চশমা দিয়ে ওপরে টাঙানো লণ্ঠনের আলোয় আবেদ রিফু করছে। সহকারী দর্জি দু-জন সন্ধ্যার পরেই বাড়ি চলে গেছে। এক সময়ে হাতের কাজ নাবিয়ে সে বিড়ি ধরাল, তারপর চশমার ফাঁক দিয়ে ওধারে তাকিয়ে দেখলে যে সিধু ময়রার দোকান এখনো খোলা, আর তার পাশে টিউবওয়েলে পানি তোলার ঘসঘস আওয়াজ হচ্ছে। সে চোখ নাবালে। তারপর দমকা হাওয়ায় হঠাৎ সামনের পাতা মর্মরিয়ে উঠল শুনে আবার সে চোখ তুলল, তুলে সামনের পানে তাকাল। ট্রেজারির আলো : শুকনো পাতা নড়ছে : আর ওদিকে কিছু-ভাঙা টুলটা। কিন্তু সে-টুলে কে যেন বসে রয়েছে না?
কয়েক মুহূর্ত চেয়ে-চেয়ে দেখল আবেদ, তারপর শুধাল,
—কেডা বাহে?
কোনো উত্তর এল না। ওদিকে চেয়ে লোকটি মূর্তির মতো নিশ্চল।
আবেদ আবার ডাকলে, এবারো কোনো সাড়া এল না। এবং তাই একটা অদম্য কৌতূহল জাগল দর্জির মনে। সে দ্রুতভঙ্গিতে উঠে পড়ল, উঠে হুক থেকে লণ্ঠনটা নাবিয়ে খড়ম পায়ে দিলে, তারপর টুলটির কাছে গিয়ে লোকটার মুখের সামনে আলো তুলে ধরল। দেখল, অপরিচিত এক লোক, বয়স বেশি নয়। তার চুল উষ্কখুষ্ক, পরনের জামা ময়লা ও ছেঁড়া; দেহে প্রাণহীনতার স্তব্ধতা, আর চোখে শূন্যতার বীভৎসতা।
—কেডা তুমি?
লোকটি এবার চোখ ফিরিয়ে তাকাল তার পানে, কিন্তু তার চোখের সে-বীভৎসতা চোখে ঠেকাল বলে দর্জি চোখ সরিয়ে নিল, কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে দৃঢ় গলায় বললে,
—তুমি কেমন কাগো, কথা কও না ক্যা?
অল্পক্ষণ লোকটি নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল দর্জির পানে, এবং দেখলে এক বৃদ্ধ যার মুখে সাদা দাড়ি, মাথায় আধা ময়লা কিস্তি টুপি, আর মুখের নিচের চামড়া ঝুলে পড়েছে। এবং হাতে তার লণ্ঠন, ‘ পেছনে অন্ধকার। যেন অন্ধকার থেকে বৃদ্ধ হঠাৎ উঠে এসেছে, এবং এসেছে নির্ভরশীল নিঃসঙ্গতায়। এধারে কেউ নেই, আর তার ম্লান চোখে কৌতূহল থাকলেও তাতে সন্দেহ নেই, হিংস্রতা—ও নেই। সে কি এমনি অন্ধকারাচ্ছন্ন নির্জনতায় এমনি একটি লোককে-ই খুঁজছিল না, যার কাছে মনের বোঝা নাবিয়ে হালকা হতে পারে, তারপর বাঁচতে পারে মনের সে-দুরারোগ্য ক্ষত থেকে, যে ক্ষত তাকে দিনের পর দিন অসহ্য যন্ত্রণা দিচ্ছে, আর স্থান হতে স্থানান্তরে কেবল তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে?
হঠাৎ লোকটি উঠে দাঁড়াল। তারপর অস্পষ্টপ্রায় কণ্ঠে দ্রুতভাবে বললে,
—আঁর নাম রাজ্জাক। আঁই আলেকজন্ডর চরের সোনাভাঙা গেরামের মৌলবীর বাড়ির ফোলা। চৈত্ মাসে একদিন দুফর ওক্তে ফজুমিঞা’গর বাড়ির ফইন্যার মাথা ফাডাইলাম, ফাডাই জানের ডরে দেশ ছাড়ি ফলাইলাম। তারপর তুন—এই বলে হঠাৎ সে কী একটা নিদারুণ ভয়ে থেমে গেল, তার চোখ দুর্জয় ভয় ও শংকায় কেমন হয়ে উঠল; তারপর তার দেহ দুর্বল হয়ে উঠে এক সময়ে সে ঝুপ্ করে পড়ে গেল দর্জির পায়ের কাছে।
এখানে মাটি : এখানে ভয় নেই; বরঞ্চ এখানে মিশে গেলে দেহে গলগলিয়ে শান্তি আসবে, এবং সে-দুরারোগ্য ক্ষত ভেসে যাবে তাতে। কিন্তু তবু রাজ্জাক মাথাটাকে টেনে নিয়ে বুড়োর পায়ের ওপর রাখলে, আর দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলে তার দু-পা। যাকে সে একবার ক্ষতের কথা বলেছে, তাকে আর ছাড়া যায় না। তারপর তার সারা অন্তর আকুল হয়ে উঠল কাঁদবার জন্যে, কিন্তু আশ্চর্য, কান্না এল না। সারা অন্তরে ঝড় উঠল কান্নার, কিন্তু চোখে অশ্রু ছুটল না, সে-চোখ শুষ্কই রইল : এবং সে-শুষ্কতা থেকে তার দেহ ক্রমে-ক্রমে কাঠের মতো হয়ে উঠল। তারপর কাঠ হয়ে ওঠা শক্ত দেহ হতে মন হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, শূন্যতায় ভেসে গেল শূন্য হয়ে, যে-শূন্যতায় কোনো কথা নেই। শূন্যতার শেষে সে দেখলে সোনাভাঙা, যে-সোনাভাঙায় আর কোনো শংকা নেই; তার ঘাটে বালাম ও সাম্পান নৌকা নিরুপদ্রব শান্তিতে বাঁধা, কেবল নারকেল-বনের পেছনে সে-প্রান্তরে ধুলো উড়ছে। ধনু গাইকে-ও দেখল। গাইয়ের চোখে স্নেহ, এবং স্নেহের শান্তিতে সে বাছুরের গা চাছে।
দর্জি স্তম্ভিত। লোকটি শুধু পায়ে মুখ গুঁজে রয় নি, জিহ্বা দিয়ে তার পা-ও চাছে। ভীত হয়ে সে তার পা দুটো ছাড়াতে চাইল, কিন্তু লোকটার বাহুবদ্ধ সে-পা ছাড়াতে পারল না। পাশে চেয়ে দেখল যে, সিধু ও তার দোকানের ছোকরা-টা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
কেডা—দর্জি মিঞা?
দর্জি সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দিলে না। কিন্তু তারপর বললে,
—মোর ছেইলা।
সিধু ময়রা প্রথমে বিস্মিত হল, তারপর মনে পড়ল, প্রায় এক যুগ আগে দর্জির বার বছরের এক ছেলে হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, এবং তারপর থেকে তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি।
বুড়োর ছেলে এতকাল পরে ফিরেছে—আনন্দের কথা। সে-সম্পর্কে সিধু দুয়েক কথা বলছিল, এমন সময় লোকটি হঠাৎ উঠে বসল, উঠে তীব্র সন্দেহে তাকাল ময়রার পানে, এবং দর্জি লক্ষ করলে যে আবার তার চোখ দুর্জয় শংকায় কেমন হয়ে উঠছে। সিধু তাকে চেয়ে-চেয়ে দেখছিল, হঠাৎ শুধাল,
—ওর নাম কী মিঞা?
—মোমেন।
রাজ্জাক প্রথমে কিছু বললে না, তারপর এধার-ওধার চেয়ে দেখলে, মনে হল, এখানে রাজ্জাক নামে কেউ নেই।
.
আবেদ দর্জির বাড়িতে রাজ্জাক আশ্রয় পেল। তবে রাজ্জাক নামে নয়, মোমেন। নামে বাড়ির লোক ছাড়া সবাই প্রথমে জানলে যে এক যুগ আগে পালিয়ে যাওয়া দর্জির ছেলেটি আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু সত্যটা সূর্যালোকের মতো স্বচ্ছ বলে তা মিথ্যায় ঢাকা গেল না, একে-একে সবাই জেনে ফেললে : ছড়ানো কথা সত্য নয়, এ-ছেলে আসলে মোমেন নয়; তবে পরকে ঘরে ডেকে আপন ছেলে বলে প্রচার করার মিথ্যায় লোকে অন্যায় কিছু দেখলে না, বরঞ্চ দর্জির প্রতি শ্রদ্ধায় তাদের অন্তর ভরে গেল।
কিন্তু সে যে খুনী—এ কথা দর্জি তার বিবিকে পর্যন্ত বললে না।
দর্জির বিবি ক-দিন রাজ্জাকের সামনে পর্দা করল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখলে যে, ছেলেটি শান্ত, ধীর ও স্বল্পভাষী স্বভাবের; আর তাছাড়া, ছেলে নয় জেনে-ও যাকে আপন ছেলের নামে ঘরে ডেকে আনা হয়েছে, তার সামনে পর্দা করা চলে না বলে তারপর থেকে তাকে দেখা দিতে লাগল।
রাজ্জাক আবেদ দর্জির কাছে সেলাই শিখতে লাগল। চর আলেকজান্দ্রা ত্যাগ করার পর থেকে যে-ভীতি তার অন্তর ক্ষত-বিক্ষত করছিল, সে-ভীতি থেকে অনেকটা মুক্তি পেয়ে শীঘ্র সুস্থ হয়ে উঠল বটে, কিন্তু তার পূর্বের চরিত্র আর ফিরে এল না : সে যেন আবার নবজীবন লাভ করল, ভিন্ন দেশে এক নতুন পরিবারের মধ্যে সে সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে রইল, কেবল দূর আলেকজান্দ্রার স্মৃতি অতি অস্পষ্টভাবে রয়ে গেল মনের দূর প্রান্তে।
.
এখন চৈত্র মাস!
রাজ্জাক মাথা নিচু করে এক মনে কাজ করছিল। ওধারে কাছারি-প্রাঙ্গণ ভরে লোক; তাদের কোলাহল কখনো মনের অস্পষ্টতায় অস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
একসময়ে সে হঠাৎ চোখ তুলে ওধারে তাকাল। আদালতের সামনে নদী; সে-নদীর এক অংশ নজরে পড়ে দোকান থেকে। এধারে উঁচু খাড়া পাড়, কিন্তু ওপারে বিস্তৃত বালুর চর ধু-ধু করে, চিকচিক করে সূর্যালোকে। সে চরের পানে তাকিয়ে সে দেখলে, সেখানে হাওয়ায় ধুলো উড়ছে, দেখে তার মন হঠাৎ ছুটতে শুরু করলে। যে-মন বহুদিন ধরে স্তব্ধ হয়ে ছিল, অদ্ভুতভাবে স্থবির হয়ে ছিল, সে-মন আজ হঠাৎ আবার দিশেহারা হয়ে ছুটতে লাগল, এবং ছুটতে ছুটতে এক স্থানে বালির বাঁধে আছড়ে পড়ল : এবং গভীর নীল পানির জন্যে মন তৃষ্ণায় আকুল হয়ে উঠলেও সে-বাঁধের ওধারে যেতে পারল না। শুষ্ক বালুর চরে স্নেহমমতা নেই।
দর্জি আর তার বিবি তাকে ভালোবাসে, কিন্তু সে-ভালোবাসা তার অন্তর স্পর্শ করে নি, যদিও স্তব্ধ-স্থবির মন সে-সম্বন্ধে নিস্পৃহভাবে সজ্ঞান। কিন্তু আজ ওপারে বালুর চরে ধুলো উড়তে দেখে হঠাৎ চর আলেকজান্দ্রার কথা মনে হল, এবং সে আকস্মিকভাবে অনুভব করল যে, দূরে কোথাও স্নেহমমতার জোয়ার বইছে, কিন্তু এখানে কেবল কালো মাটি, যে-কালো মাটির বুকে বাস করছে এক নকল রাজ্জাক এবং বাস করছে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ হয়ে, আর তার মন আবদ্ধ হয়ে রয়েছে অর্থহীন স্থবিরতায়।
তারপর থেকে অদ্ভুত শূন্যতা তাকে পেয়ে বসল, এবং থেকে-থেকে কালো মাটির দুঃসহ পেষণ অনুভব করতে লাগল। এমন সময়ে হঠাৎ সামান্য এক ঘটনা ঘটল। সামান্য বটে সে-ঘটনা, কিন্তু সে-ঘটনা থেকে তার অন্তরে প্রাণের জোয়ার এল, হঠাৎ মনের সে-শূন্যতা কাটল।
জরিনা বিবির সঙ্গে কখনো তার কথা হয় নি; তাকে ভালো করে কোনোদিন চেয়ে-ও দেখে নি। কেবল জানে যে, সে বিধবা, এবং তার স্বামী ছিল আবেদ দর্জির বড় ছেলে, যে মারা গেছে আজ দু-বছর হল। তাছাড়া, দর্জির বিবি যে তাকে অত্যন্ত স্নেহ করে, সে-কথাও কখনো-কখনো অনুভব করেছে।
সে-দিন দোকানে যাবার আগে বাড়ির ভেতর কুয়োটার ধারে রাজ্জাক জামা কাচছে, এমন সময় দক্ষিণ ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জরিনা তাকে ডাকলে, ডেকে বললে,
—একটা কথা আছে—এখান হয়া যাইয়ো ভাই।
কাপড় কাচা সাঙ্গ করে সে দক্ষিণ ঘরে গেল। ঘরের কোণে বড় জালার মুখে উবু হয়ে জরিনা কী যেন করছিল, সাড়া পেয়ে সরে এসে বিছানা থেকে একটা সাদা কাপড়ের টুকরো তুলে তার হাতে এনে দিলে। বললে,
—ওটা দিয়ে একটা জামা বানায়া দেও।
রাজ্জাক নীরবে কাপড়টি পরীক্ষা করে দেখলে, তারপর বললে,
—মাপ? একটু থেমে আবার বললে, আপনার একটা জামা দেন।
জরিনা হঠাৎ হেসে উঠল চাপা গলায়, এবং হাসির ফাঁকে-ই বললে,
—মাপ ছাড়া জামা হয় না—এই বুঝি খইফ্যগিরি?
কিন্তু তক্ষুনি সে গম্ভীর হয়ে উঠল, তারপর কেমন গলায় শুধাল,
—গোস্বা করল্যা ভাই? কিন্তু আমার যে জামা নেই
রাজ্জাক একবার চোখ তুলে তাকাল তার পানে। ওর দৃষ্টিটা যেন কেমন। কিন্তু চোখ নাবিয়ে কাপড়ের টুকরোটা ভাঁজ করে আস্তে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
তৈরি জামা যে-দিন তাকে দিলে, সে-দিন সে জরিনাকে আরো ভালো করে চেয়ে দেখল। দেখল, ওর মুখটা কেমন চপলতায় টলমল, দেখে তার অন্তরে কী যেন টলমল করে উঠল।
হঠাৎ জরিনা শংকিত হয়ে উঠল, রুদ্ধনিশ্বাসে প্রশ্ন করলে,
—এটি বাপজান কি দেখেছে ভাই?
হ্যাঁ, দেখেছে বৈকি। এবং এ-সম্বন্ধে আবেদ দর্জি তাকে প্রশ্নও করেছিল। সে ক্ষীণ গলায় উত্তর দিলে,
—হ্যাঁ
কিন্তু তার বুকের ভেতরটা অনুশোচনায় কেমন করে উঠল।
চৈত্র শেষ হলে গেল, বৈশাখ এল, কালবোশেখি ঝড় শুরু হল। এবং রাজ্জাকের মনে যে-ঝড় শুরু হল, সে-ঝড়ের উদ্দামতা কালবোশেখির চেয়ে কম নয়। কখনো সে তাকিয়ে দেখে, তীব্র হাওয়ায় গাছের পাতা ছিন্ন হয়ে উড়ে গেল, মিলিয়ে গেল কোথায়, দেখে তারও মনে প্রবল বাসনা জাগে—কাকে ঠিক এমনিভাবে ছিন্ন করে নিয়ে আসে নিজের কাছে, তারপর ভেসে পড়ে দু-জনে। চৈত্র মাসে একদিন নদীর ওপারে বালুর চরে ধুলো উড়তে দেখে হঠাৎ তার মনে পড়েছিল চর আলেকজান্দ্রার কথা, এবং তার মন নিষ্করুণ শুষ্কতার মধ্যে জেগে উঠে দিশাহারা হয়ে ছুটতে ছুটতে বালির বাঁধে আছড়ে পড়েছিল, আর আকুল হয়ে উঠেছিল গভীর নীল পানির তৃষ্ণায়। কিন্তু আজ বালির বাঁধ যেন ভেঙে গেছে সে-নীল পানিরই বন্যায়। সে-নীল পানি বয়ে যাচ্ছে তার অন্তরের ওপর দিয়ে, অথচ এখনো তৃষ্ণা মেটে নি। সে-তৃষ্ণা মেটাতে হবে।
অবশেষে ঠিক করলে, কাউকে দিয়ে দর্জির বিবির কাছে কথা পাড়াতে হবে, যে, সে জরিনাকে বিয়ে করতে চায়। এই তো তার বাড়ি, তার ঘর : তবু এতে তার মন ভরছে না, জীবন পূর্ণাঙ্গ ঠেকছে না
কিন্তু কথাটি পাড়াবার আগে-ই একটা চিন্তা তাকে ভাবিয়ে তুললে। বারে বারে সে ভাবলে, তবু মীমাংসায় পৌছতে পারলে না। সে খুনী : তার কি বিয়ে করবার অধিকার আছে?
সেদিন দোকানের ঝাঁপ যখন দিলে, তখন বেশ রাত। সহকারী দর্জিরা অন্যপথে বাড়ি চলে গেল; আবেদ ও রাজ্জাক ফিরে চলল নদীর ধার দিয়ে। আগে আবেদ, পেছনে লণ্ঠন হাতে রাজ্জাক। মফস্বল শহর এর মধ্যে একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, এবং সে-নিস্তব্ধতার মধ্যে রাজ্জাকের সারা অন্তর একটি বেদনার্ত প্রশ্নে দোলায়িত। আজ সে স্পষ্টভাবে জানতে চাইছে : খোদা তার গুনা কখনো মাপ করবেন কি না। নিজের অন্তরে এ-প্রশ্নের উত্তর যখন মিলল না, তখন একবার ভাবলে বৃদ্ধ দর্জির কাছে জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু দর্জির নীরবতায় এমন কাঠিন্য যে আওয়াজ করতে সাহস হল না।
নদীর পাড়টি খাড়া; বর্ষায় সেটি ভাঙে। একস্থানে নিচে ক-টা নৌকা বাঁধা, এবং তারই একটির মধ্যে থেকে একতারার আওয়াজ ভেসে আসছে। কিছু স্বপ্নের মতো কিছু রহস্যের মতো সে-আওয়াজ ঠেকল রাজ্জাকের কানে, এবং তারই মধ্যে হঠাৎ মনটা দূরে আবছা হয়ে গেল বলে একসময়ে সে কাশল, তারপর আস্তে বললে,
—বাপজান, একটি কথা।
দর্জি কোনো কথা কইল না, কেবল মুখটা একটু ফেরাল।
কিন্তু রাজ্জাক বলে-ও বলতে পারলে না কথাটা। এবং বলতে পারল না এই ভয়ে যে : যদি উত্তর আসে, তার গুনার কখনো মাপ হবে না।
আস্তে সে বললে,
—না, কিছু না বাপজান। খালি মনটা থাকি-থাকি কেমন করে।
আবেদ দর্জি কিছু কইল না।
তারা বাড়ির প্রাঙ্গণে পা দিতেই মনে হল ঘরের মধ্যে একটা গোলমাল যেন চলছে। কে সরু গলায় কাঁদছে, আর কে যেন মোটা গলায় কথা কইছে। দর্জি থমকে দাঁড়িয়ে রাজ্জাকের পানে তাকিয়ে কতক্ষণ শুধু স্তম্ভিত হয়ে রইল, তারপর দ্রুতভাবে ভেতরে প্রবেশ করল। পেছনে-পেছনে রাজ্জাক-ও গেল। ভেতরে গিয়ে দেখলে, বাইরে রোয়াকে একটা কুপি; অল্প দূরে থাম ধরে দাঁড়িয়ে-থাকা জরিনার হাতে একটা লণ্ঠন। আর এদিকে পিঠ দিয়ে মাদুরে বসে একটি অপরিচিত লোক ভারি গলায় কথা কইছে, এবং পাশে বসে দর্জির বিবি কাঁদছে।
একটু পরে বৃদ্ধ দর্জি এক বিস্ময়কর গলায় চেঁচিয়ে উঠল,
—কে?
শুনে দর্জির বিবির গলা একটু চড়ল, আর সে-অপরিচিত লোকটি নির্বাক হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে রইল। একটু দূরে দর্জির ভাইস্তা মকেম যে উবু হয়ে বসে ছিল, সে কেবল অনুচ্চ গলায় বললে,
—মোমেন ভাই গো চাচা।
রাজ্জাক শুনলে। তবে ঐ লোকটা মোমেন, যে-মোমেনের মিথ্যা অভিনয় সে করছে এখানে। এবং এবার তার অভিনয়ের পালা শেষ হল। তারপর অকস্মাৎ রাত্রির কালো আকাশে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো তার অন্তরময় ঝলকে উঠল তীক্ষ্ণ বেদনা : এবং সে-বেদনা হঠাৎ-ঘটিত সব-শূন্যতার বেদনা। গাইয়ের বাছুর মরলে গাইয়ের দুধের জন্যে সে-মরা বাছুরের খোলে খড় ভরে একটি প্রাণশূন্য মূর্তি তৈরি করা হয় : এবং এ-বাড়িতে যেন সে-খড়-ভরা বাছুরের মতো ছিল সে। এবং এ-জ্ঞান থেকে সে যেন সে-প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেল, যে-প্রশ্ন আজ সারাটি সন্ধ্যা তাকে ভাবিয়েছে। না, খোদা তাকে ক্ষমা করেন নি, এবং এ-জীবনে কখনো করবেন না। নীল পানি সে শুধু কল্পনাই করতে পারবে, বাস্তবে তার সন্ধান পাবে না।
সকলের অলক্ষ্যে সে আস্তে বেরিয়ে এল। ঘুরতে-ঘুরতে নদীর ধারে এসে তার শূন্য তীরে সে শূন্য হয়ে বসে রইল। হঠাৎ মনের প্রান্তরে ধুলো উড়তে শুরু করেছিল, নীল পানির বন্যা বইতে শুরু করেছিল, কিন্তু এখন সেখানে শূন্যতা। তবু একটা মেঘলা দিনের কথা মনে পড়ে। তখন সন্ধ্যা। ঘাট ছেড়ে একটি বালাম নৌকা চলে গেল পুব অভিমুখে : কোথায় সে জানে না। সে-কথা মনে পড়ল, আর শূন্য অন্তর কেঁদে উঠল। কেঁদে উঠল কার জন্যে? কেঁদে উঠল তার-ই জন্যে, যার কথা এক মুহূর্তের জন্যেও মনের কোণে সে স্থান দেয় না, যার কথা স্মরণ হলে-ই তার সারা দেহ মুষড়ে ওঠে ভীত হতাশায়। সেই ফজু মিঞাদের বাড়ির ফইন্যার জন্যে আজ তার অন্তর কাঁদল, এবং আশ্চর্য, রাত্রির অন্ধকারে চোখ দিয়ে অশ্রু ছুটল। অপরাধী সে, কিন্তু অপরাধীর কি অন্তর থাকে না? খোদা তাকে কখনো মাপ করবেন না-এ -কথা সে জেনেছে, তবু ওর জন্যে তার হৃদয় ব্যথায় গুমরে গুমরে উঠবে না কেন? ফইন্যাকে কি সে ভালোবাসত না? বাসত, কিন্তু মানুষের শরীরে যে ক্রোধের আগুন রয়েছে : সে আগুন একবার দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠলে তখন সবকিছুই সম্ভব, প্রিয়তম কারো আস্ত হৃদয় যদি কেউ এনে দেয় তবে সে-হৃদয়ও তখন মানুষ কেটে টুকরো-টুকরো করে ফেলতে পারে। এবং কারো কারো দেহে সে-ক্রোধের আগুন একটু বেশি মাত্রায় থাকে বৈকি।
শেষে একটি কথা ভেবে শান্তিতে তার কান্না শান্ত হল। যে-লোক খুন হয়, সে বেহেশতে যায়। ফইন্যা বেহেশতে যাবে। খোদা কখনো তাকে ক্ষমা না করুন, কিন্তু ফইন্যার বেহেশত-লাভের কথা তাকে চিরদিন শান্তি দেবে।
.
সকালবেলায় মোমেনের সঙ্গে রাজ্জাকের দেখা হল। উজ্জ্বল সূর্যালোক, তার মধ্যে চেয়ে দেখলে : সবল ও দীর্ঘ তার দেহ; বড় চোখ বড় চেহারা, আর বাঁকা গোঁফ। গায়ে শৌখিন পোশাক : দেহের ভঙ্গিতে কিছু ঔদ্ধত্য। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে রাজ্জাককে আপাদমস্তক চেয়ে দেখলে, তারপর বললে,
—তুমি বুঝি মোমেন সেজেছ?
তার প্রথম কথাই ভালো লাগল না, তাই কোনো উত্তর দিলে না। মোমেন আবার প্রশ্ন করল,
—নাম কী?
—রাজ্জাক। বলে থামতেই কী একটি উত্তেজনায় তার ঠোঁট কেঁপে উঠল, কয়েক মুহূৰ্ত চুপ থেকে অদ্ভুত কঠিন গলায় বললে,
—আমার নাম আবদুর রাজ্জাক। আলেকজন্ডর চরের সোনাভাঙা গেরামের ফজুমিঞাদের বাড়ির ফইন্যারে আমি খুন করছি—গত চৈত্ মাসে।
মোমেন কয়েক মুহূর্ত বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থেকে দ্রুত পায়ে চলে গেল, গিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে হইচই বাধিয়ে তুলল চিৎকার করে।
কিন্তু তার আগে-ই রাজ্জাক বাইরে চলে এল—এবং এল চিরদিনের জন্যে। বেরোবার আগে একবার সে দক্ষিণ দিকের ঘরের পানে তাকাল, দেখলে, দরজার কাছে পা মেলে জরিনা কাঁথা সেলাই করতে-করতে হঠাৎ মোমেনের চেঁচামেচি শুনে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তার পানে।