পরাজয়
দূরে যেখানে ধলেশ্বরীর সাথে এই রাঙাধারের ঢালা এক হয়ে মিশেছে, সে-সঙ্গমস্থানের বিস্তীর্ণ জলরাশি হঠাৎ ঝলমল করে উঠল : মেঘের ফাঁকে সকালবেলার সূর্যালোক ঝলকে পড়েছে সেখানে। এবং ঠিক সেই মুহূর্তে ক্ষুদ্র কোটরগত অথচ উজ্জ্বল চোখ দুটি দূরে নিবদ্ধ করে মজনু ঠোঁটের প্রান্তে একটু হাসল, তারপর সবল হাতে লগি দিয়ে তীর হতে গভীর জলে নৌকা ঠেলে সে বলে উঠল :
—হেই গো, মোদের নাও ভাসল।
মাথায় তার জড়ানো লাল গামছা, সাদার ওপরে নীল চেকের আধময়লা লুঙ্গিটি কোঁচামেরে পরা, এবং দেহের বাকি সমস্ত অংশ অনাবৃত। লগি ছেড়ে হাল ধরে বাইতে শুরু করলে তার সুগঠিত পেশিবহুল কঠিন-কালো দেহের প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চঞ্চল হয়ে উঠল, যেন তার সমগ্র দেহ উল্লাসে ঝলমল করে উঠল ওই রৌদ্রকরোজ্জ্বল বিস্তৃত জলরাশির মতো।
ছইয়ের ভেতর থেকে কালু কথা কয়ে উঠল :
—তার নাও তো ভাসল, মোর কল্কেয় আগুন ধরে কই?
মজনু উত্তর দিলে না। ওপাশ দিয়ে হলদে রঙের তালি-দেয়া ছোট পাল উড়িয়ে একটা নৌকা যাচ্ছিল; তার হালের কাছে উবু হয়ে বসে রয়েছে কুঁজোমতো একটি বুড়ো মাঝি, তাকে উদ্দেশ করে ঘাড় হেলিয়ে মজনু চিৎকার করে প্রশ্ন করলে :
—কই যায় গো তোমার নাও, অ কেতাঘাটের মাঝি?
বুড়ো তার পানে তাকাল না, শুধু একটু নড়ে বসে গলা উঁচিয়ে জবাব দিলে :
—মামুদপুর।
আড়চোখে সে-নৌকার ছইয়ের ভেতরে তাকাল মজনু : কাঁচা সোনার মতো রঙের কে এক মেয়ে বসে রয়েছে সেখানে। মুখে তার ঘোমটা নেই, পরনে কালো শাড়ি।
নৌকাটি তখন দূরে চলে গেছে, হলদে রঙের পালের তালিগুলো আর নজরে পড়ে না, কালুকে মজনু আস্তে বললে,
—একটা সোনা-মুখ দেখলাম।
—জলকন্যা দেখলা নাকি?
পুব থেকে হাওয়া বইছে, নদীর জলে তাই মৃদু ঢেউ, আর অস্পষ্ট কলকল আওয়াজ। ওধারে আকাশটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, নীল স্বচ্ছ আকাশে পরিপূর্ণ রোদ ঝলমল করছে, আর তারই ছটা লেগেছে অদূরে কাশের বনে। মৃদু হাওয়ায় দুলছে কাশবন, তার ডগাগুলো চিকচিক করছে। নৌকা যখন রাঙাধারের ঢালা থেকে বেরিয়ে ধলেশ্বরীর মাঝামাঝি এসে পড়ল তখন স্রোতের ধারে নৌকা দুলে উঠল। তাছাড়া নৌকা চলছে ঈষৎ কোনাকুনি ভাবে। স্রোতের অনুকূলে ওদিক হতে একটা দৈত্যের মতো গোপালপুরী নৌকা আসছে, পালের রং তার সাদা। পেছনে মাচার ওপর লাল ডোরাকাটা নিশানার তলে বসে রয়েছে নেড়া হিন্দুস্থানি মাঝি, তাছাড়া বাইরে কেউ নেই। মাঝির পানে চেয়ে মজনু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল,
—হেইগো, বাঁয়ে বাঁয়ে।
নৌকা না তো, সত্যিই যেন দৈত্য। তাছাড়া পেতলে বাঁধানো গলুইর পানে তাকালে কিছু শ্রদ্ধাও হয়, আর মনে পড়ে কবে একবার সে দেখেছিল এক মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীকে, যার সামনের দুটো দাঁত ছিল সোনায় বাঁধা।
—অ কালু, হুক্কার পানি কদ্দূর গো? একবার বার হয়ে আস দেখি, নায়ে জবর টান ধরছে।
হুক্কার গুড়গুড় আওয়াজ হঠাৎ থেমে গেল, ছইয়ের গর্ত দিয়ে সশব্দে নদীতে থুতু ফেলে লোকটি বলে উঠল :
—পানিটা কেমুন বোদা-বোদা, গলায় ধরল না।
একটু পরে ছইয়ের পেছন দিয়ে বেরিয়ে এল কালু, হাতে তার হুঁকা। সেটি মজনুর হাতে দিয়ে সে চলে গেল সামনে। দাঁড় বাইতে হবে।
সূর্য তখন অনেকটা উঠে পড়েছে। যেখানে তারা এসে পৌছল সেটা নদীর তীর নয়, নদীর মাঝখানে জলে ডোবা বিস্তীর্ণ চর। ওপাশে ছমিরের মাচাটা নজরে পড়ে, নিচে বাঁধা ছোট ডিঙিটার কিছু অংশও দেখা যাচ্ছে। ছমির তাহলে মাচাতেই রয়েছে। এধারে ধান নেই, শুধু জলের ওপর মাথা উঁচু করে রয়েছে দীর্ঘ ধারালো ছন ও ভাতসোলা। গলুইতে বসে রয়েছে বলে কালুর পিঠ ছড়ে যেতে লাগল ছনের ধারে। জলে ভারি গন্ধ, আর চারধারে কেমন ভাপসা গরম, যেন ওপরে অত বড় বিস্তৃত অনন্ত আকাশ নেই, স্থানটা দেয়ালে আর ছাতে ঘেরা।
উঠে দাঁড়িয়ে কালু লগি টেনে নিল, তারপর কয়েকবার লগি ঠেলে অদূরে মাচাটার পানে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠল :
—কই গো ছমির মিঞার বউ, বার হইয়া দেখ দেখিন্ আইছে কে।
কোনো উত্তর এল না সেখান থেকে। অল্পক্ষণ অপেক্ষা করে কালু হাসল, ঈষৎ ঝুঁকে লগিটা সম্পূর্ণ ঠেলে আবার বললে :
—বউয়ের না হয় লজ্জা হইছে, তোমার মুখে রা নাই ক্যান্ ছমির মিঞা?
—মোরা রাজপুত্তুর গো, এবার মজনুর কৌতুকোচ্ছল গলার আওয়াজ শোনা গেল, সাত-সমুদ্দুরের পার হইতে আসতাছি রাজকইন্যারে দেখবার লাইগা
কাছাকাছি গেলে স্পষ্ট দেখা গেল, মাচার মাঝখানের একমাত্র দরজার সামনে দুই হাঁটু উঁচু করে বসে ছমিরের বউ কুলসুম স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। নিচে নৌকা বেঁধে ওরা দুজন যখন ওপরে উঠে এল, তখনো সে নড়ল না। মাচার কোণে অন্ধকার, সে-অন্ধকারে খড়ের বিছনায় ছমির গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মজনু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল কুলসুমের পানে, তার মুখে ঘোমটা নেই, স্থির চোখে অদ্ভুত স্তব্ধতা। কালো-কালো ডাগর চোখের ছায়ায় ওর মুখটি ভারি স্নিগ্ধ ও কোমল দেখায় বলে মজনু বলে যে, সে কোন অচিন দেশের রাজকন্যা, যার রূপ নীল আকাশের পরীর মতো, চুল মেঘের মতো, আর দেহের রং সোনার মতো। কিন্তু সে-চোখে কী স্তব্ধতা এখন। তবু কৌতুক বোধ করল সে। মাথাটা একটু হেলিয়ে কিছু আড়চোখে কুলসুমের পানে তাকিয়ে এবার সে হাসল, নিচু গলায় সঙ্গোপনে বললে :
—অমন থির হইয়া বইসা ক্যান্ গো রাজকইন্যা, ছোট্ট নাকের ছোট্ট নথটাও যে নড়তাছে না। দুই জনে বুঝি খুব হইছে একচোট?
এবার কুলসুমের স্থির স্তব্ধ চোখ একটু নড়ে উঠল, সে মুখ ফিরিয়ে কয়েক মুহূৰ্ত ভাষাশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মজনুর পানে, তারপর ঝরা শুকনো পাতার মতো অস্পষ্ট শুষ্ককণ্ঠে বলে উঠল :
—কাটি ঘায়ে মরছে সে।
মজনু স্তম্ভিত হয়ে গেল। ওধারে বেড়া ঘেঁষে বসে কালু একটা বিড়ি ধরিয়েছে, এ-আকস্মিক সংবাদে সে-ও হঠাৎ থ হয়ে গেল। সে সামনে ঝুঁকে এল, আর নিচের ঠোঁটটা পড়ল ঝুলে।
ছমিরের দেহ নিশ্চল ও কাঠ-কাঠ। কোণটা অন্ধকার হলেও এবার তার দেহটা বিবর্ণ ও নীল দেখাল। অতি ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে মজনু এগিয়ে গেল সে মৃতদেহের কাছে, কয়েক মুহূর্ত নির্বাক থেকে রুদ্ধ অস্পষ্টকণ্ঠে বললে :
—কী সাপ গো? দেখছিলা?
একটু নড়ে বসে কুলসুম শুধু মাথা নাড়ল : সে দেখে নি। মজনু ফিরে তাকাল কুলসুমের পানে, তারপর চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল বিচিত্রভাবে-স্তব্ধ তার কোমল-কচি মুখটি, শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপতে গিয়ে তার চোখ হঠাৎ সজল হয়ে উঠল।
চরের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তটা অপেক্ষাকৃত উঁচু বলে সে-স্থানটা তেমন জলে ডোবা নয়, কিন্তু অত্যন্ত নরম। সেখানে মাচা বাঁধলে কেমন হয়—তাই ছমির দেখতে গিয়েছিল গতকাল। তখন সন্ধ্যা লেগেছে, নদীর নিস্তরঙ্গ প্রশান্ত বুকে রক্তাভা, আর ওপারের তীররেখা আবছা হয়ে উঠেছে। ডাঙাটা দেখে ছমির ফিরে আসছিল, সাঁঝের ম্লান আলোয় হঠাৎ তাকে সাপে কাটল প্রথমে ভেবেছিল ঢেঁাড়া, মাচায় ফিরতে না ফিরতে তার মুখ দিয়ে উঠল ফেনা, আর দেহ এল অবশ হয়ে। চরের দক্ষিণে ছেরাদের মাচায় আলো মিটমিট করছিল, কিন্তু এ-মাচা আর সে-মাচায় দূরত্ব-তো কম নয়, তাই কুলসুমের ক্ষীণকণ্ঠের আপ্রাণ চিৎকারও ব্যর্থ হল, সে-মাচা থেকে কোনো সাড়া এল না বা কেউ এল না ডিঙি বেয়ে। মাঝরাতে ছমির মারা গেল।
—কিন্তুক এত বেলা তক তুই কোন আশায় বইসা রইছস্ কুলসুম? ক্ষণকাল কুলসুম হয়তো কোনো উত্তর পেল না, তারপর বললে :
—আইতা, তোমরা আইতা। একটু থেমে আবার বললে, কিন্তুক বেলার কথা কি মোর খেয়াল আছিল?
তারপর ওরা নীরব হয়ে রইল। দুঃখী ও গরিব বলে তাদের কাছে মৃত্যু তত অস্বাভাবিক, মর্মান্তিক ও দুঃখজনক নয়; তাদের জীবন মর্মবিলাসে ও সুখের মোলায়েম সুবেদী আবরণে ঘেরা নয় বলে মৃত্যুকে তারা বড় করে দেখে না, বরঞ্চ সেটা যেন তাদের কাছে মুক্তি, অর্থশূন্য একটানা নিষ্ফল শ্রমের অবসান। তাছাড়া ওদের ব্যথার ভাষাও সংকীর্ণ ও সংক্ষিপ্ত বলে ওরা নীরব হয়েই রইল, এবং এত নীরব হয়ে রইল যে মনে হল মৃত ছমির আবার অস্তিত্ব লাভ করছে, আর জীবনের শেষে যে-অনন্ত অজ্ঞাত রহস্য, সে-রহস্যের স্পর্শে তার প্রাণশূন্য নিশ্চল দেহ। ঘরে স্তব্ধ হাওয়ার মাঝে একটা অস্পষ্ট বিচিত্র অনুভূতি প্রকাশ পাচ্ছে।
কিন্তু অনেকক্ষণ পর কুলসুম হঠাৎ কথা কইল। তবে তার কণ্ঠ শোনাল হাওয়ার মতো :
—কলা গাছের ভেলা কইরা অরে তোমরা ভাসাইয়া দেও, আর আমি যামু লগে। বেহুলার কাহিনী কুলসুমের মনের প্রান্তে তুলোর মতো, হালকা সাদা মেঘের মতো নিঃশব্দে উদয় হয়েছে। বেহুলার মতো মৃত স্বামীর দেহ নিয়ে ভেলায় ভেসে সেও যাবে। কিন্তু কোথায়? বেহুলা কোন এক অজ্ঞাত স্থানে গিয়েছিল এবং তার মনস্কামনা সার্থক হয়েছিল এ-কথা সে জানে, কিন্তু তার পথ-তো কুলসুমের জানা নেই। তাই মেঘটা যেমনি ভেসে এল, কথার হাওয়ায় তেমনি আবার মিলিয়ে গেল তার মনের আকাশ হতে। শূন্যতা ও স্তব্ধতা আবার ঘন হয়ে উঠল কুলসুমের দেহ ও চোখে।
.
ওরা ছমিরের দেহ নিয়ে গাঁয়ে ফিরে যাবে। ওদিকে রোদ খরখর করছে, নদীর বিস্তৃত বুক ঝকঝক করছে : সেদিকে তাকানো যায় না। কিন্তু হঠাৎ দিগন্তরেখা পেরিয়ে মেঘ জাগতে লাগল, এবং তারই ছায়ায় নদীর সে-প্রান্ত উঠল ধূসর হয়ে। এধারে এখনো শান্তি আর নীরবতা : নদীর জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে একটা মাছরাঙা উড়ে আসছে এদিকে, আর আকাশে ঘুরে-ঘুরে উড়ছে শঙ্খচিল।
বিড়িতে শেষ টান দিয়ে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে কালু বাইরে তাকাল, তারপর নিচের ফাঁক দিয়ে থুতু ফেলে একবার আড়চোখে তাকাল কুলসুমের পানে। চেয়ে কী যেন হল হঠাৎ— তার চোখে ঘোলাটে ছোঁয়া লাগল, এমন বিস্তীর্ণ জনশূন্যতার মধ্যে কুলসুমের কোমল সুঠাম দেহটি তার কাছে কেমন-কেমন ঠেকল। আরেকবার সে থুতু ফেলল, নিচের দিকে আরেকটু ঝুঁকে আবার সে তাকাল তার পানে।
কোনো কথা নেই, মজনু একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললে, মাথা হতে লাল গামছাটা খুলে একবার মুখটা মুছলে। কেমন ভাপসা গরম : নিচে জলে স্রোত নেই বলে যেন হাওয়ায়ও স্রোত নেই। মজনু ঈষৎ অস্বস্তি বোধ করলে, গা ঝাড়া দিয়ে উঠে হঠাৎ বললে,–নেও, বেবস্থা কইরা ফেলি। অমন কইরা বইসা থাকার কোনো ফায়দা নাই গো রাজকইন্যা।
রাজকন্যা বলেই মজনুর মনে হঠাৎ খচ্ করে উঠল, অন্তরটা এল আর্দ্র হয়ে, কুলসুমের স্থির নথের পানে চেয়ে আবার তার চোখ সজল হয়ে উঠল। কিন্তু কুলসুমের যেন কী হয়েছে। দুই হাঁটু উঁচু করে বসে রৌদ্রোজ্জ্বল দিগন্তের পানে চেয়ে সে যেন অবিরাম স্বপ্ন দেখছে : তার ডাগর টানা চোখ স্বপ্নাবিষ্ট। থেকে-থেকে ঈষৎ নড়ে-চড়ে সে যে কথা কয়ে উঠছে তাতে মনে হচ্ছে গুম-হয়ে-থাকা হাওয়া যেন গুমট ভেঙে বইছে, আর স্বপ্ন দেখার ফাঁকে সে স্বপ্নের কথা কয়ে উঠছে। দূর নীল আকাশে উড়ন্ত শঙ্খচিলটার মতো তার মনের মধ্যে স্বপ্ন কেবলি ঘুরে-ঘুরে উড়ছে, অতি মন্থর নিঃশব্দ তার গতি।
মজনুর মনে-ও অবসাদ নাবছে যেন, তাই আবার সে বললে,–নেও, ওঠ, বেলার খেয়াল নাই?
কালু এবার কথা কইল। অনেকক্ষণ নীরব হয়ে ছিল বলে বলার আগে সে একবার কেশে নিল, তারপর নিষ্প্রভ চোখে চেয়ে বললে :
—আগে কুলসুমেরে কিছু খাইবার দেও। অর্ ভুক লাগছে না বুঝি?
ঠিক বলেছে কালু, কুলসুমের নিশ্চয় খুব ক্ষিধে পেয়েছে। নদী পাড়ি দিতে সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়বে, রাঙাধারের ঢালায় সূর্য অস্ত যাবে, আর গাঁয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে সেই রাত— অতক্ষণ কি কুলসুম অনাহারে থাকতে পারবে?
কালু নেবে গেল নিচে তাদের নৌকায়, খানিক পরে আবার উঠে এল সামান্য চিঁড়া ও গুড় নিয়ে।
ঘুম হতে কুলসুম যেন জেগে উঠল, কালুর কথায় তার হাতের পানে চেয়ে বললে :
-–তোমরাই খাও গো।
—কস্ কী? আমরা খামু ক্যান্? দ্যাখ, কাল রাইত থিকা তুই নিরংবু উপাস। নে, খা।
—মোর ভুক নাই।
মজনু এবার নরম গলায় বললে :
—তর্ পাও ধরি রে রাজকইন্যা, দুইডা মুখে দে।
কুলসুমের চোখে যেন বিরক্তির ছায়া, স্বপ্ন দেখার ব্যাঘাত ঘটেছে বলেই সে-বিরক্তি। তবু এবার মজনুর হাত হতে চারটে চিঁড়া নিয়ে মুখটা ওদিকে আড়াল করে আলগোছে তা মুখে দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলল।
মজনু উঠে পড়ল। তারপর মাচার সামান্য জিনিসপত্র গোছাতে আরম্ভ করলে। দুটো হাঁড়ি, একটি কাঁথা, হুঁকো, কুলসুমের ঘাস-রঙা কিছু ছেঁড়া ময়লা শাড়িটা, আর এটা ওটা। কালু নৌকায় নেবে গেল। সেটা এধারে এনে বাঁধতে হবে যাতে ছমিরের দেহটা নাবাতে সহজ হয়। তাছাড়া ডিঙিটাও নৌকার পাশে বেঁধে নিতে হবে। কিন্তু ওধারে মেঘটা বাড়ছে ক্রমশ। ঝড় হবে নাকি? চোখ ছোট করে কপালে হাত দিয়ে রোদ ঢেকে সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলে মেঘের ঘন কালো রং। ওধারের জলটা এরই মধ্যে আঁধার হয়ে উঠেছে, আর দিগন্তরেখা যেন মুছে গেছে। আবার উঠে এল কালু, হাতে তার থেলো হুঁকো!
—হুক্কাটা আনলা যে? উবু হয়ে বসে মজনু কী যেন করছিল, একবার মুখ তুলে প্রশ্ন করলে। বেড়া ঘেঁষে বসে কেমনতর দৃষ্টিতে কুলসুমের দেহের পানে তাকিয়ে কল্কে সাজাতে শুরু করে কালু বললে :
—ওদিকে একবার চোখ তুইলা চাও। ঝড় আসতাছে।
দূর হতে অস্পষ্ট শোঁ-শোঁ আওয়াজ আসছে। দিগন্তে কোন দৈত্য যেন সহসা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে, তারই দ্রুত ও ঘন শ্বসনের শব্দ আসছে ভেসে। সেখানে নদীতে ঢেউ জেগেছে, মাঝিরা গুটিয়েছে পাল, আর এধারের স্বচ্ছ নীল-রোদ-ঝলসানো আকাশ সংকীর্ণ হয়ে আসছে ক্রমশ।
—ঝড় তো আসলই দেখি। মজনু হতাশ হয়ে বললে।
এসে গেল ঝড়। যে-হাওয়া কুলসুমের চোখের মতো স্তব্ধ হয়ে ছিল, সে হাওয়াই হঠাৎ প্রবল হয়ে উঠল আর নিচে নৌকার পেছনটা ঘুরে গেল শাঁ করে।
কালুর কল্কেয় আগুন ধরেছে, বেড়াতে ঠেস দিয়ে সে নীরবে হুঁকা টানছে। ধুঁয়োর সাথে তার চোখও যেন ধূমাচ্ছন্ন হয়ে এসেছে, এবং বসার ভঙ্গিতে আর নির্বাক নিশ্চলতায় কেমন একটা অস্বচ্ছন্দতা। কতক্ষণ ওপারের ঝাপসা হয়ে ওঠা রেখার মতো তীরের পানে তাকিয়ে থেকে মজনু গামছা আবার মাথায় জড়িয়ে মুখে একটা বিকৃত শব্দ করে হঠাৎ রেগে বলে উঠল :
—শালার মেঘ।
তারপর বৃষ্টি নাবল প্রচুর। বর্ষণের চোটে মাচা যেন ভেঙে পড়বে। তার চারপাশে উন্মত্ত হাওয়ার শব্দ হচ্ছে খুব, থেকে-থেকে এক-একবার দুলে উঠছে সমস্ত মাচাটা। ওপর থেকে একটু পরে জল পড়তে আরম্ভ করল—কিছুটা কোণের দিকটায় আর কিছু কুলসুমের পিঠে। তাই লক্ষ করে মজনু বলে উঠল :
—একটু সইরা আয় রে কুলসুম, পানি পড়ে।
কুলসুমের স্বপ্ন দেখা সাঙ্গ হয় নি এখনো; সেইজন্যে আর বর্ষণের শব্দের জন্যে মজনুর কথা তার কানে পৌঁছল না। তাই মজনু ওর একটা হাত ধরে তাকে এদিকে আকর্ষণ করলে, এবং হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠে কুলসুম তাকাল তার পানে, তারপর আস্তে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে একটু ওধারে সরে বসল, হাতের চুড়িতে উঠল মৃদু ঝংকার। কালু একবার কাশল, একটু ঝুঁকে নিচে থুতু ফেলে আবার কাশল, এবার উঁচু গলায়। তারপর বিশ্রীকণ্ঠে বললে,
—টানবা নাকি, অ মজনু মিঞা?
হাত বাড়িয়ে হুঁকো নিতে গিয়ে মজনু দেখলে যে কালু আড়চোখে তাকিয়ে রয়েছে কুলসুমের পানে। অমন ঘোলাটে ও দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে কেন তার দৃষ্টি, আর ঠোঁটের পাশে যে কৌতূহলের রেখা জেগেছে, সে কিসের কৌতূহল? কালু যেখানে বসে রয়েছে সেখানে কিছু আঁধার, কিন্তু তা, যেন আঁধার নয়, কী একটা অপবিত্র ছায়া।
মাথা নত করে মজনু ঘন-ঘন হুঁকায় টান দিচ্ছে, এমন সময় কুলসুম হঠাৎ মুখ তুলে তার পানে চেয়ে শুধাল :
—মইরা মানুষ কই যায়, কইবার পার মজনু ভাই?
—ওই আকাশে যায়। চোখ উল্টে ওপরের পানে ইঙ্গিত করে উত্তর দিলে মজনু।
—জাণ্ডা নিবার কালে আজরাইল কি জবর কষ্ট দেয়?
—দেয়। একটু থেমে ওর চোখের পানে চেয়ে মজনু আবার বললে, কিন্তুক তরে দিব না।
হাওয়া কমে এসেছে, বর্ষণের প্রাবল্য-ও কমল কিছু। এবং সে-নম্র বর্ষণের আওয়াজের মধ্যে কেমন এক কণ্ঠে কালু হঠাৎ হেসে উঠল, কিছুটা টেনে-টেনে আর কর্কশ সুরে। হাসি থামলে আড়চোখে কুলসুমের পানে চেয়ে সে বললে :
—তর যা রূপ, আজরাইলে পর্যন্ত দেইখা পাগল হইব রে। হগ্গলেই তর লাইগা পাগল। আম্গো মজনু মিঞা—
থেমে গিয়ে তেমনি কণ্ঠে আবার সে হাসতে লাগল। তার যেন নেশা পেয়েছে, ছোট ঘোলাটে চোখে ঘোর লেগেছে।
কেউ কিছু আর বললে না, শুধু মুখ ফিরিয়ে কুলসুম একবার কালুর পানে তাকাল : তার শান্ত স্তব্ধ ডাগর চোখে কিছুটা বিস্ময়ের ছায়া। মজনু মুখ তুলল না, নীরবে ধুঁয়ো ছাড়তে থাকল। তবু থেকে-থেকে গলায় বিকৃত আওয়াজ করে কালু হেসে উঠতে লাগল, আর বারে-বারে কুলসুমের পানে তাকাতে তাকাতে একবার জিহ্বা দিয়ে ঠোঁটটা চেটে নিল। শেষে একসময়ে বললে :
—তরে—বুঝলি—তরে মজনু এইবার বিয়া করব। সেই আশাতেই তো সে আছিল এ্যাদ্দিন—
—কী বক্ শুরু করছস তুই কালু? এবার চাপা ক্রুদ্ধকণ্ঠে গর্জে উঠল মজনু, তারপর হুঁকাটা নাবিয়ে কুসুমের পানে একবার চেয়ে সে আবার বললে : ভালো হইব না কিন্তু ক কইয়া দিলাম—
কালু আর কথা কইল না বটে, তবে নাকে শব্দ করে খিকখিক শব্দ করে পরম পুলকে হাসতে লাগল, এবং তাইতে তার নোংরা কদর্য দাঁতগুলো আরো বিশ্ৰী দেখাল।
কমে আসা হাওয়া আবার প্রবল হয়ে উঠল হঠাৎ, মেঘ ডেকে উঠল কবার, তারপর জোর বৃষ্টি নাবল। কালুর কথায় আর হাসিতে মাচার মধ্যে যে-বিসদৃশ অস্বচ্ছন্দ হাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে মজনুর সুগঠিত কঠিন দেহ যেন সংকুচিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু কুলসুমের স্বপ্নাবিষ্ট স্থির চোখে এখনো কোনো ভাবান্তর ঘটে নি। একটু পরে মাথাটা ঈষৎ হেলিয়ে সে মজনুর পানে তাকাল, তাকিয়ে বললে :
—তোগো দুইজন রে খোদা আমার কাছে পাঠাইছে, নইলে আইবা ক্যান?
হাওয়ায় যেন হঠাৎ মেঘ উড়ে গেল : কিসের ভারে মজনুর মনটা যে ভারি হয়েছিল এতক্ষণ, সে-ভার যেন সরে গেল, মাথা সোজা করে সে সোজা হয়ে বসল, চোখ স্বচ্ছ হয়ে এল সারল্যে। কুলসুমের পানে সে শুধু তাকালই, কোনো কথা এল না মুখে : সে যে তাকাতে পেরেছে এটাই তার কাছে বড় বলে মনে হল, সে যে দেখল কুলসুমের চোখে কৃতজ্ঞতার নম্রতা—এতেই সে মুগ্ধ হল। তার মুখ ঝলমল করে উঠল, ঠোটের প্রান্তে ফুটল হাসি, তবু হাসি চেপে মুখটাকে বিকৃত করে আকাশের পানে তাকাল, তারপর তিক্তগলায় বললে :
—শালার মেঘ! শালা কমু না তো কমু কী?
—ক্যান, শালীও তো কইবার পার, মুচকে হেসে কালু বললে, শালীর মাথার চুলে ভারি তুফান লাগছে গো।
কিছুক্ষণ পর কী হল, সোজা দৃষ্টিতে না তাকিয়ে মজনু আড়চোখে তাকাল কুলসুমের পানে, তারপর বুকের কোনো এক নিভৃত অংশ একটু কেঁপে উঠল, চোখে সরলতার স্থানে আবছা কুয়াশা জমে উঠল যেন, আর তাইতে জড়িয়ে এল দৃষ্টি : সে শুধু তাকালই, চোখের কুয়াশার মধ্যে দিয়ে কুলসুমের মুখ স্পষ্ট দেখতে পেল না। সে জোর করে, চোখ নত করলে তবু তার অজ্ঞাতে আবার কখন তাকিয়ে ফেললে তার পানে। কিন্তু তাকালে চোখের প্রান্ত দিয়ে, মুখ তুলবার সাহস নেই। কী সে দেখলে কে জানে, তবে তার ভেতরটা একটু-একটু জ্বালা করে উঠল, হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুততর হল। তারপর অন্তরে এক রঙের ছোঁয়া লাগল, একটা শিহরন বয়ে গেল সারা দেহে, কুয়াশাচ্ছন্ন দৃষ্টি হঠাৎ স্বচ্ছ হয়ে এল, এবং স্পষ্ট হয়ে ওঠা কুলসুমের মুখ কেমন বিচিত্রভাবে আকর্ষণীয় ঠেকল বলে অব্যক্ত উত্তেজনার ঢেউ জাগল অন্তরে—যার কোমল আঘাতে আগের সে-জ্বালা আর কম্পন ধুয়ে-মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। কালুর পানে তাকিয়ে সে অতি নির্ভয়ে এবং অকারণে চোখ টিপে মুচকে হাসল।
বাইরে ঝরঝর করে অবিশ্রান্ত যে-বর্ষণ হচ্ছে, তারই অবিরাম একটানা সুর এই জনহীন স্থানে বিচিত্র শোনাচ্ছে কানে : এ যেন কোনো অভিমানী সুন্দরীর সজলকণ্ঠের কোমল গান নির্মক্ষিক নির্জনতায় কে যেন মনের কামনার বল্গা ছেড়ে কার অপেক্ষায় নাচছে নূপুরের বিলম্বিত ঝংকার তুলে, আর দেহের ঘর্ষণে তার শাড়ি খসখস করছে।
বেড়া হতে কালু সরে এল কুলসুমের কাছে। এবং মজনুর মন নূপুরের ঝংকারে মত্ত বলে তার এ-সরে-আসাটা খারাপ ঠেকল না, বরঞ্চ ওর-ও অদম্য বাসনা হল কালুর মতো সরে গিয়ে কুলসুমের অনাবৃত বাহুটা চেয়েচেয়ে দেখতে।
কিন্তু কুলসুম তার স্তব্ধ স্বপ্নাবিষ্ট চোখদুটি মজনুর মুখের ওপর ন্যস্ত করে অতি আশ্চর্য প্রশান্ততায় তাকাল, তাকিয়ে একটু নড়ল-চড়ল বলে চুড়ি বাজল মৃদু ঠুনঠুন আওয়াজ করে। তারপর নিঃশব্দতা। নতুন প্রশ্ন নিয়ে মজনু তাকাল কালুর পানে। কালু গলায় কেমন আওয়াজ করে উঠল।
—কী হইল তোমাগো?
কোনো উত্তর নেই। এবং এ-নিরুত্তর নীরবতার মধ্যে কুলসুমের চোখে হঠাৎ বন্যার মতো এল জাগতিক চাঞ্চল্য, তারপর ভয়ে উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠল তার দৃষ্টি।
—তোমরা এমন কইরা চাও ক্যান? না, না, মোর ভয় করে
কোনো উত্তর নেই, ওরা শুধু নীরবে চোখ ফিরিয়ে নিল। কিন্তু কুলসুমের চোখে এখনো উদ্ভ্রান্তি, অদ্ভুত আশঙ্কা। তারপর কী হল, কুলসুম হঠাৎ ভয়চকিত কণ্ঠে আচমকা কেঁদে উঠে ঝুঁকে সরে এসে মজনুর পা ছুঁতে লাগল ঘন-ঘন।
.
কখন বৃষ্টি হঠাৎ ধরে গেছে। ধানের শিষ কাঁপিয়ে নদীতে ঢেউ তুলে জোর শীতল হাওয়া বইতে শুরু করেছে—যে-মেঘগুলো এখনো জমাট হয়ে রয়েছে সেগুলো নিয়ে যাবে ঝেঁটিয়ে, আর এধারে আবার ঝলমল করে উঠবে সূর্যালোক।
মজনু নেবে গেল নিচে, কালুও উঠে পড়ল। দুজনার মুখই কাঠের মতো নিস্পন্দ।