মৃত্যু-যাত্ৰা
অন্ধকার নিবিড় হলেও তবু আবছা-আবছা নজরে পড়ে ঘাটে বাঁধা ছইশূন্য ভারি খেয়া নৌকাটা। ‘ভাঙা পাড়টা খাড়া ও উঁচু, শুধু এক জায়গায় পথটা নেবে গেছে ঢালু হয়ে, এবং তার প্রান্ত থেকে জোড়া লাগানো দুটো শক্ত কাঠ নৌকার গলুইর কাছাকাছি নদীর জলে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এধারে তীরে, বুড়ো বটগাছের তলে গুটি চারেক ছনের ছোট-ছোট ঘর। তিনটিতে এখন ঝাঁপ দেয়া; শেষটির দুপাশে দেয়াল নেই। একটি ময়রার দোকান, একটি হোটেল, এবং তৃতীয়টিতে থাকে খেয়ার মালিক শুকুল কাহার। খোলা ঘরটাতে মাঝিরা ঘুমোচ্ছে। অন্ধকারে সেখানে দৃষ্টি চলে না, শুধু রাতের স্তব্ধতায় সে-অন্ধকার থেকে নাকডাকার ভারি একটানা আওয়াজ ভেসে আসছে এদিকে—যেখানে একদল মেয়ে-পুরুষ জড়োসড়ো হয়ে বসে রয়েছে নিশ্চলভাবে। তারা ঘাটে এসে পৌঁছেছে ঘণ্টাখানেক আগে। থেয়া এখন বন্ধ, ভোর না হলে তাদের পার হবার উপায় নেই। বসে থেকে-থেকে কারো চোখ ভরে উঠেছে ঘুমে, কারো চোখ অবসাদে বোজা, আর যাদের চোখ খোলা—রাতের অন্ধকারে তাদের সে-চোখের পানে তাকালে মনে হবে, মৃত্যু যেন তাকিয়ে রয়েছে কালো জীবনের পানে।
উবু-হাঁটুতে মুখ গুঁজে তিনু হয়তো ঘুমিয়ে ছিল—ওদের মধ্যে কার কচি ছেলে একটা, হঠাৎ কঁকিয়ে কেঁদে উঠল বলে সে চমকে জেগে প্রথমে ভাবল, বুঝি পাখি ডাকল – প্রভাত হল, কিন্তু পর-মুহূর্তে চারপাশের অন্ধকারের দিকে চেয়ে মনটা তার কালো হয়ে উঠল, এবং সে-কালো মনের কাছে আকাশের নিবিড় স্তব্ধতার মধ্যে শিশুর এ-কান্না বিস্ময়কর, বিচিত্ৰ লাগল তার।
শিশুর কান্না থামল। আবার নিস্তব্ধতা, এবং এ-নিস্তব্ধতার মধ্যে নদীর ছলছল আওয়াজ মুখর হয়ে উঠতে তিনু ভালো করে চোখ মেলে তাকাল বাঁধা নৌকাটার দিকে। কিন্তু নিরাশা সেখানে থমকে আছে। ওপারের দিকে সে তাকাবার চেষ্টা করল, কিন্তু সেখানেও পথশূন্য নিরাশার কালো ঘন বিস্তৃতি। অবশেষে তিনু তাকাল মাঝিদের খোলা ঘরের পানে। সেখান থেকে এখনো নাকডাকার আওয়াজ ভেসে আসছে—তেমনি ভারি ও একটানা। নিরাশা সেখানে যেন আরো দুর্বোধ্য ভাষায় কথা কইছে। নৌকার দিকে আবার তাকিয়ে তিনুর হঠাৎ মনে হল, ঘাটের কিনারে দেহ ছেড়ে এসে নৌকার প্রাণ ঘুমোচ্ছে ওই ঘরে—ওই অন্ধকারে।
পাশে বসে করিম। তিনুর সাড়া পেয়ে মুখ তুলে সে একবার গলা সাফ করলে, তারপর আকাশের পানে চেয়ে তারা লক্ষ্য করে রাত ঠাহর করবার চেষ্টা করে নিশ্চিত গলায় বললে, কমন পরীর চুলে কাঁপন লেগেছে গো—রাত পোয়ায়ে এল বলি।
তিনু কিছু বললে না। হঠাৎ কী হয়েছে তার—নদীর অপর তীর দেখবার জন্যে তার মনটা আকুল হয়ে উঠেছে। তার আশঙ্কা হচ্ছে—মহাসাগরের তীরে যেন বসে রয়েছে। পথ ভুল করে কি তারা সীমাহীন মহাসাগরের তীরে এসে বসেছে মরণের পারে যাবে বলে?
—কত বড় নদী গো? এক সময় তিনু আস্তে-আস্তে জিজ্ঞেস করল।
করিম হয়তো তন্দ্রায় ঝিমিয়ে পড়েছিল, চমকে উঠে এমনভাবে কথা কইলে—যেন সে জেগেই ছিল,
—তা ওপারে বড় গাঁ, চাল পাওয়া যাবি নেশ্চয়
তিনু নীরব হয়ে রইল।
হঠাৎ কে যেন গোঙিয়ে উঠল। কিছু দূরে মতি নাপিতের বউ কমলি বাঁকা হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। বয়স তার অল্প, আর দেহটা রুগ্ণ। ক-দিন হল মতি উধাও হয়ে গেছে গাঁ থেকে, এবং তার খোঁজে সে এদের সঙ্গ নিয়েছে। তা ছাড়া গাঁয়ে যে-রকম বীভৎস আকাল লেগেছে, সেখানে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত। কমলির রুগ্ণ দেহ এ-ধাক্কায় আরো নেতিয়ে পড়েছে, এবং ঘুমটা একটু পাতলা হয়ে এলে অমনি করে সে গোঙাতে থাকে। বিশ্রী সে-গোঙানোর আওয়াজ, তার বুকে যেন নোংরা কুৎসিত যত জীব বাসা বেঁধেছে—থেকে থেকে আর্তনাদ করে ওঠে।
রাত্রি এত নিস্পন্দ যে, সে-গোঙানির আওয়াজে তিনুর মনটা শিরশির করে কাঁটা দিয়ে উঠল, কিন্তু মনটাকে সে জমাট করে ভাবল, নদী শিরশির করছে—তীর ঘেঁষে নদী শিরশির করে বয়ে যাচ্ছে। পরক্ষণে আরেকটা কথা জাগল তার মনে, কিন্তু অত সন্তর্পণে কেন? যেন অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে নদী পালিয়ে যাচ্ছে—তাদের ব্যর্থতার শুষ্কতীরে রেখে পালিয়ে যাচ্ছে। আর যাচ্ছে সেই দেশে—যে-দেশে নদী চওড়া হয়ে দু-তীরের মাঠভরা দিগন্তবিস্তৃত ফলন্ত ফসল ছোয়—ছোঁয় করে নিবিড় আহলাদে। নদীর ওপর নীল আকাশ আর সোনালি সূর্য ঝক্ঝক্ করে, তার টলমল জলে নানা রঙের পাল উড়িয়ে বড়-বড় ধানের নৌকা ভাসে, আর পশ্চিমা মাঝিরা ঝিমোয়—শুধু ঝিমোয় পরম সুখে। তা ছাড়া হালের মাথায় ডোরাকাটা নিশান পত্পত্ করে, আর মাঝিদের দেহাতি গান ঢেউয়ের মাথায় ভাঙে, ভাঙতে ভাঙতে ভেসে চলে দূরে…
কিন্তু এখানে অন্ধকার, মরা নদীর খোলস, আর স্তব্ধতা। অবশেষে হাঁপিয়ে উঠে তিনু শুধাল—
—ঘুমোয় পড়লি?
সশব্দে করিম জেগে উঠল। তারপর ওপারের পানে চেয়ে কিছু দেখল কি না কে জানে, কিন্তু খুশিতে উছলে উঠে বললে,
—কলমন পরী এবার গা মোড়ামুড়ি দিতে নেগেছে গো—
আবার চুপচাপ। একটু পরে কান খাড়া করে কী যেন শুনে তিনু বললে,
—নাও যায় নাকি উতি দিয়ে?
—নাও-ই বটে। একটু থেমে করিম আবার বললে, বিনেবাতিতে কেমন ভূতের মতোন চলেছে—
—তেল কুতি যে বাতি দিবে?
শুধু যে তাদের গাঁয়ে নয়, সর্বত্র আকাল ও অনটন লেগেছে—এ-কথা খেয়াল হয় না।
একটু পরে ঘরগুলোর পাশে হঠাৎ পাতা-মাড়ানো পায়ের আওয়াজ জাগল, এবং কয়েক মুহূর্ত পর একটা অস্পষ্টপ্রায় দীর্ঘকায় দেহ আড়াল থেকে বেরিয়ে এগিয়ে এসে এদের মধ্যে চুপ করে নিঃশব্দে বসে পড়ল। তিনু তাকাল সেদিকে, হাঁকল ‘কে’ বলে, কিন্তু কেউ উত্তর দিল না। তবু সে আন্দাজ করলে, আসগর বোধহয়।
—আসগর যেন কুতি গিয়েছিল—
—রেখে দেও তার কথা! তাচ্ছিল্যভরে অথচ ফিসফিসিয়ে বললে করিম।
তবু তার কথা সহজে রেখে দেয়া যায় না, কারণ বিচিত্র ছেলে এই আসগর। চেহারা তার রুক্ষ এবং স্বভাবটাও রুক্ষ। সর্বক্ষণ চোখ দুটো জ্বলে ধক্কক্ করে এবং এমন একটা অমঙ্গল তার সে-চাহনিতে যে, মানুষের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। ঝাঁকড়া চুল নেড়ে জ্বলন্ত চোখ ঘুরিয়ে সে বলে যে, খোদাদ্রোহী ইবলিশ শয়তানের চেলা সে, তাই খোদার চেলারা সব তার আজন্ম শত্রু। মানুষের বন্ধুত্বে প্রীতিতে সে যেন মরে যায়, জীবন্ত হয়ে ওঠে শুধুমাত্র হিংস্র শত্রুতায়।
একটু থেমে করিম আবার বললে,
—ওর নাম নিলি পরে দশবার তওবা কাটতি হয়—মৌলবী সাহেব কয়েছেন।
কিন্তু এ-দুর্ভিক্ষের নির্মম ঝড়ে তার সে-জ্বলন্ত দৃষ্টি কেমন দুর্বলভাবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে, শাণিত শত্রুতা ভাঙা-তলোয়ারের মতো পঙ্গু হয়ে উঠেছে। তাই এখন তার সান্নিধ্যে ভেতরটা তেমন কাঁটা দিয়ে ওঠে না। হয়তো খোদার গজব নাজেল হয়েছে তার ওপর এবং এবার সে ধ্বংস হবে, নিশ্চিহ্ন হবে, খোদার দুনিয়ায় লোকেরা আবার শান্তিতে বাঁচবে।
—শালার ব্যাটা এবার কুত্তার মতো লেজ গুটোয়েছে—আবার বললে করিম।
কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় লাল পশ্চিম দিগন্তের দিকে চেয়ে সে হিংস্রভাবে চেঁচিয়ে উঠেছিল, বলেছিল যে, তাদের খোদাও নাকি শয়তান, তবে নকল শয়তান। আর শয়তানের সঙ্গে নাকি কখনো শয়তানি চলে না। শুনে করিমের কিন্তু ভয় করেছিল : তার সে কী কথা, আর সে কী বিদ্যুৎ ঝল্কানো উদ্ধত হাসি। আশ্চর্য কিন্তু, খোদার সৃষ্টির সঙ্গে মিশে থাকে শয়তান, যাতে শয়তানকে ধ্বংস করতে গেলে খোদার সৃষ্টিও ধ্বংস হয়। ওর জন্যে কি ওরাও ধ্বংস হবে, নিশ্চিহ্ন হবে? তাহলে বাঁচবে কারা খোদার দুনিয়ায়?
এরপর অনেকক্ষণ নীরবতা জমাট হয়ে থাকল বলে তিনুর মনে হালকা কুয়াশার মতো— দূর থেকে শোনা কথার মতো তন্দ্রা নাবল, আর সে-তন্দ্রার মধ্যে ময়নার নিটোল হাসির কথা তার মনে জাগতে লাগল। ময়নার সে-হাসি যেন সাবলীল স্রোত, এবং তিনুর মন মাছরাঙা হয়ে থেকে-থেকে তাতে ডুব দিচ্ছে। ময়না প্রথমে জানতে পারে নি। কিন্তু যখন টের পেল, তখন সে রাগ করল বলে সে-স্রোত হঠাৎ জমাট বেঁধে মেঘ হয়ে গেল—কী থমথমে কালো রং তার। তিনুর অন্তর শুকিয়ে গেল ভয়ে, ভাঙা গলায় সে বলতে লাগল, রাগ করেছিস ময়না? কিন্তুক মোর যে বড্ড ক্ষিদে নেগেছে, কদ্দিন মুই পেট ভরি খাতি পাই না
তারপর তিনু কাঁদল, স্বপ্নে কাঁদল। তাতে ময়নার রাগ পড়ল কি? হয়তো। চোখ মুছে সে তাকিয়ে দেখল যে, মেঘ কেটেছে, ওধারে আলো। ওধারে, আকাশে আলো—অতি ক্ষীণ হালকা দূর পথের আলো।
প্রভাত হল।
.
মৃত্যু-যাত্রা শুরু হয়েছে। তাদের সে-যাত্রা আশায় দোলায়িত, অথচ নিরাশায় জর্জরিত। চলার পথ ধূলিধূসর, নিষ্ঠুরতায় রুক্ষ, আর যেন অন্তহীন; প্রতিটি মুহূর্ত বেরিয়ে আসছে অজানার কালো গহ্বর হতে, এবং বেরিয়ে আসছে একঘেয়ে বৈরিতায়। তবু নিঃশব্দ পথগুলো নীরবে চলছে ধ্বংসের পানে।
এ-মৃত্যু-যাত্রায়ও বাধা রয়েছে। তিনুদের দলে হাজুর বাপ ও মা নামে দুটি অতি বুড়ো-বুড়ি সঙ্গ নিয়েছিল। সেদিন দুপুরের দিকে বুড়িটা কেমন-কেমন করতে লাগল বলে ওরা থামল, থেমে প্রান্তরের শেষে একটি বিস্তৃতশাখা পল্লবঘন বৃহৎ বৃক্ষের তলে বসলে। বুড়িকে শোয়ানো হল, আর বুড়ো গিয়ে বসলে গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে, বসে চোখ বুজে নিশ্চল হয়ে রইল। তারপর শুরু হল অপেক্ষা, নির্বাক অপেক্ষা!
ওদের মধ্যে ধীরে-ধীরে অধৈর্য যখন চাপা অস্থিরতায় প্রকাশ পেতে লাগল—এমন সময় একটা কান্নার রোল উঠল মেয়েদের মধ্যে। বুড়ি মরল অবশেষে। মেয়েরা কাঁদল, আর পুরুষরা কিছু খাঁটি কিছু ভান-করা দুঃখে নীরব হয়ে রইল। তারপর এক সময়ে তিনুরা আস্তে উঠে পড়ে কাছাকাছি একটা জায়গা খুঁজে নিলে। কিন্তু খুঁড়বে কী দিয়ে?
—দা দিয়ে হবি না? হালুর মা তার ঝুলি থেকে একটা দা বের করলে।
হবে হয়তো : মাটিটা ঝুরো।
হাত ভরে মুঠো-মুঠো যখন কোপানো মাটি তুলে ফেলছে, তখন করিম একবার আড়চোখে তাকাল তিনুর পানে। হাত ভরা মাটি—হাত ভরা ভাতের মতো মাটি, অথচ ভাত নয়। তিনু একবার মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখলে করিমের পানে, দেখলে তার চোখে লালাঝরা লোলুপতা, দেখে হয়তো আহত হয়ে চোখ সরিয়ে আবার কোপাতে লাগল।
করিম লজ্জা পেল, তাই ঈষৎ দুর্বল গলায় হঠাৎ শুধাল :
—কী জায়গায় গো ওই গাঁ?
—সোনাভাঙ্গা বোধায়।
—মতিগঞ্জ কি খুব দূর হবি?
তিনু একটু ভাবল, ভেবে বললে, তা এখন রওনা দিলি পরে সন্দের পর পৌঁছন যেত— একটি মুশকিল হল! ওপরটার মাটিটা ঝুরো, কিন্তু ভেতরে শক্ত, ভাগ্যের মতো কঠিন।
—কী হবি তালে।
তিনু কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। করিমের বুকের পাঁজরের পানে একবার চেয়ে, আরেকবার ধু-ধু করা প্রান্তরের পানে চেয়ে সে ভাবল, কিন্তু উপায় খুঁজে পেল না। অবশেষে গাছের তলে বুড়োর কাছে গিয়ে দাঁড়াল, দাঁড়িয়ে ডাকলে,
—অ হাজুর বাপ্। শুনতিছ গো—হেই!
বুড়ো চোখ মেলে তাকাল একবার, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো সাড়া এল না। এখনো তার দেহে প্রাণ-কম্পন রয়েছে বটে, তবে তার মনের মৃত্যু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।
শেষে একজন বললে গাঁয়ে যেতে, গিয়ে কারো কাছে চেয়ে একটি কোদাল নিয়ে আসতে।
—তা দিলি তো কোদাল?
কিন্তু দেবে-ই না বা কেন। প্রত্যেকের-তো মৃত্যু আছে—ধনী-দরিদ্র কেউ-তো একে এড়াতে পারবে না। ঠিক কথা। তিনু ও করিম যাবে গ্রামে। বাকি লোকদের যাবার কোনো প্রয়োজন নেই।
শেষ পর্যন্ত কিন্তু নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা অর্ধমৃত লোকদের মধ্যে অনেকেই যাবার জন্যে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল : একটা তীব্র আশায় তাদের চোখ চক্চক্ করে উঠেছে।——তোরা যাবি কী কত্তি? তিনু ঝংকার দিয়ে উঠল। কোনো উত্তর এল না। যে-জন্যে তারা যাবার জন্যে উন্মুখ, তা মুখ ফুটে বলবার মতো নয়। একটু ইতস্তত করে অভুক্ত লকলকে দেহগুলো আবার হেলে পড়ে মিশে গেল মাটিতে।
প্রান্তরে রোদ ঝরছে। ধুলো আর ধুলো। কখনো হঠাৎ দমকা হাওয়া বয়ে এসে নাক জ্বালিয়ে দিচ্ছে, আর ধুলোয় আঁধার করে তুলছে সব। তারপর একটা প্রগাঢ় নীরবতা। এবং অনেকক্ষণ পর এ-জমাট নীরবতার মধ্যে কালু গোয়ালার দশ বছরের মেয়েটা হঠাৎ—হঠাৎ এই স্তব্ধ প্রান্তরের প্রান্তে কেমন করে কেঁদে উঠল। আশ্চর্য। ফুসফুস যেন হাপর, আর কান্না যেন হাপরে-বাজনা।
কাঁদিস কেনে লা, কাঁদিস কেনে? তার মা খনখন করে উঠল, চোখ দুটো জ্বলছে হিংস্রভাবে। অন্যকে কাঁদতে দেখলে হিংসে হয়, বুকটা জ্বলে ওঠে। কান্না হল অন্তরজ্বালার উপশম, পরের এ-আরামটুকুও সয় না যেন।
দলছাড়া হয়ে একটু দূরে আনুটা হাঁটুতে মুখ গুঁজে নীরবে বসে রয়েছে। তাকে দেখে বোঝবার উপায় নেই যে, ও কি ঘুমিয়ে না জেগে। সে জেগেই রয়েছে বৈকি, তবে তার সে-জাগ্রতচেতনা একটু বিচিত্র ধরনের। মেয়েরা যে দীর্ঘশ্বাস ফেল্ছে থেকে-থেকে—তা-ও তার কানে যাচ্ছে, অথচ কেমন একটা ধুমোল স্বপ্নে তার মনের ভেতরটা সমাচ্ছন্ন। কখনো হয়তো সে-মনে কথা নেই, শধু মেঘের মতো কালো-কালো ছায়া ঘুরে-ঘুরে ফিরছে, আবার কখনো শুধুমাত্র একটা ডাক বা কথা বা ছবি ঘনায়মান সে-ছায়া কাটিয়ে জেগে উঠছে বারে বারে। গত কয়েক মুহূর্ত ধরে একটা অত্যুজ্জ্বল অথচ কোমল দুপুর সমস্ত ছায়া অপসারিত করে ভেসে-ভেসে উঠছে কেবল। সারা আকাশ মেঘশূন্য সূর্যালোকে প্রদীপ্ত, স্বচ্ছ-নির্মল নীলিমায় উজ্জ্বল। আর সে-আকাশ বেয়ে প্রখর রোদ ঝরছে অবিরাম, অথচ কোনো তাপ নেই তাতে। কী একটা যেন ঝিকমিক করছে, কী ওটা? একটা সজনে গাছ। এবং তার তলে সে-ই শুয়ে রয়েছে দেহ এলিয়ে। ভরা পেট, তাছাড়া মৃদু-মৃদু হাওয়া; ছায়ায় শুয়ে জাবর-কাটতে-থাকা গরুটার চোখে যেমন আরামসিক্ত ঘুম আসছে, তার চোখ ভরে-ও আসছে তেমনি ঘুম তারপর কে যেন আসছে। হ্যাঁ, লকলকে সাঁকো বেয়ে কে একটি মেয়ে এদিক পানে আসছে-সারা পিঠময় তার ছড়ানো ভেজা চুল ঝিকমিক করছে প্রখর সূর্যালোকে। এবং পেট ভরে প্রচুর—প্রচুর খেয়ে এসেছে কিনা, তাই ঝলমল করছে তার সারা দেহ….
কিন্তু ওধারে হালুর মা জোরে-জোরে কথা কইতে শুরু করেছে। বলতে-বলতে হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল। প্রথমে আনু কিছু বুঝলে না। কাঁদবার কী আছে : সজনে গাছের ছায়া, মৃদু-মৃদু হাওয়া, আর ওই মেয়েটি—কিন্তু আহা, হালুর মা যে হালুকে হারিয়েছে আজ মোটে চার দিন হল। হঠাৎ কী হল, ভেদবমি হয়ে মারা গেল সে—অমন বড়সড় ছেলে। তা এধারে হালু মারা গেল, ওধারে রব্বি মিঞার বউ ও দুটো ছেলে মারা গেল পরপর, তাছাড়া সারা গাঁয়ে আরো কত লোককে রাখে তার হিসাব। আনুর হিসাবের বুদ্ধি নেই। যার পেটে যত ভাত তার পেটে তত হিসাবের বুদ্ধি …..
একটু পরে আনু আবার সজাগ হয়ে উঠল। কারা যেন খেই-খেই করছে। কিছু না। কালু গোয়ালার বউ ও হালুর মায়ের মধ্যে ঝগড়া লেগেছে।
—পেত্নী বললি?
—বলব না? পেত্নীর মতো কাঁতি লেগিছো, বলব না পেত্নী?
ভালো হবি না, ভালো হবি না—
কিন্তু কালুর বউয়ের গলা বড় খনখনে, হালুর মায়ের কান্নায় ভেজা নরম গলা ডুবিয়ে তার সে—গলা যেন খাই-খাই করছে। তবে হালুর মায়ের দেহে শক্তি বেশি, তাই তখুনি লেগে গেল হাতাহাতি, চুল-টানাটানি, এবং তা দেখে নিস্তেজ অর্ধমৃত লোকদের মধ্যে চাঞ্চল্য এল, তাদের স্রোতোহীন রক্ত উঠল টগবগিয়ে।
আনুর ছায়াময় মন কিন্তু হঠাৎ কাঁটা-কাঁটা হয়ে উঠল। মুখ তুলে সে আস্তে একবার ধু-ধু-করা প্রান্তরের পানে তাকাল। সেখানে দেখবার কিছু নেই, শুধু বহুদূরে একটা ঘূর্ণি উঠেছে দীর্ঘ হয়ে। হাওয়া যেন ধরণীর বুকে কী খুঁজে-খুঁজে ব্যর্থ হয়ে হঠাৎ ঊর্ধ্বে উঠে উন্মত্ত হয়ে বলছে : নেই নেই, কিছু নেই গো কোথাও
কালো মনে সে হাঁটুতে আবার মাথা গুঁজল।
কিন্তু তিনুদের এত দেরি হচ্ছে কেন? এবার আনুর মনে একটা সন্দেহ পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে উঠতে লাগল। যে-গাঁয়ে তিনুরা গেছে সে-গাঁয়ে কি এমন দুয়েকটা ঘর নেই যাদের কাছে একান্তভাবে চাইলে চারটে ভাত মিলবে না?
একটু পরে কে একজন চেঁচিয়ে উঠল। চেঁচিয়ে উঠল তোতা। বললে—যত সব কুত্তা। আমাদিগ কেলা দেখায়ে খুব মারতিছে শালারা—
তাহলে সন্দেহটা শুধু একা আনুর মনেই পেঁচিয়ে ওঠে নি। তোতার কথায় এবার সবার মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠল—বিষাক্ত গুঞ্জন। আনু মুখ গুঁজেই পড়ে থাকল, কোনো কথা কইল না। কইবার-ও নেই কিছু, অন্তরময় যে-একটা আলোড়ন হচ্ছে তা ভাষাতীত, এবং তার চোখ বেয়ে যে হঠাৎ অশ্রু ঝরতে শুরু করেছে, সে-অশ্রুসিক্ত মুখটিও কাউকে দেখানো যায় না।
অবশেষে দেখা গেল, দূরে বাঁশঝাড় ও তেঁতুলগাছের আড়াল হতে তিনটে মূর্তি বেরিয়ে এল—কড়া রোদে ঝলকাচ্ছে তাদের দেহ। কালুর বউ এবার হঠাৎ কেমন একটা বিকৃত ফুল্লতায় নোংরা দাঁত বের করে অদ্ভুত হাসি হেসে উঠল। মেয়ের গা ঠেলে শুধাল,
—তেঁতুল খাবি লা?
আসল কথা, একটা আশা হঠাৎ ঝিলিক মেরে উঠেছে তার মনে। শুধু তার মনে কেন, চাপা স্তব্ধতা থেকে বোঝা যাচ্ছে এদের সবার মনেই একটা জোরালো আশা অন্ধ সাপের মতো কিলবিল করে উঠেছে। তবু সব চুপ। কথাটা এত স্পষ্ট যে ঘোষণা নিরর্থক। অথবা, হয়তো সবুরে মেওয়া ফলবে।
ওরা এল, শ্রান্ত দেহ তাদের খড়ের মতো হয়ে উঠেছে। কিন্তু হাতে তাদের কিছুই নেই। এতগুলো কনীনিকা চোখের কোণ দিয়ে ঠিকরে ঠিকরে ব্যর্থই হল : না, কিছুই আনে নি তারা। আবার একটা গুঞ্জন উঠল ওদের মাঝে, এ তাকায় ওর পানে, ও এর পানে। তোতা প্রথমে অস্পষ্টভাবে কী যেন বিড়বিড় করে বললে, তারপর হঠাৎ মুখটাকে ভয়াবহ করে তুলে ক্যানেস্তারার জোর আওয়াজের মতো ঝনঝন করে উঠল,
—শালা সব বেইমান, সব বেইমান!
তিনুর মুখ রোদে ও ঘামে এমনিতে কালো দেখাচ্ছে, সে-কালো মুখ আরো কালো হয়ে উঠল। ব্যাপারটা সে বুঝলে না কিছুই। মাটি খুঁড়বার অস্ত্র আনতে গেছিল তারা, কিন্তু তাদের যাওয়া যে এদের মনে অন্য একটা আশা সৃষ্টি করেছে—তা কী করে সে বুঝবে? তাই সে গর্জে উঠল,
—কেনে মোরা বেইমান?
কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিত স্তব্ধতা। কেউ কোনো উত্তর দিলে না। মনের দীনতা কে-ই বা প্রকাশ করতে চায়? কিন্তু তিনু ছাড়বে কেন, উত্তর না পেয়ে লাফিয়ে এসে তোতার ঘাড় ধরে ফেটে পড়ে জিজ্ঞেস করল,
—বল, বল্ কেনে বেইমান মোরা?
উত্তরে এবার তোতা-ও হয়তো মনের দীনতা ঢাকবার জন্যেই লাফিয়ে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনুর ওপর, এবং তাইতে লেগে গেল ভয়ঙ্কর হাতাহাতি। প্রথমে সবাই অতি আগ্ৰহে উপভোগ করলে এ-দৃশ্য, কিন্তু তোতার নাক বেয়ে যখন ম্লান রক্ত ঝরতে শুরু করল, তখন কেউ-কেউ এগিয়ে এল, এসে অতিকষ্টে ছাড়িয়ে দিল তাদের। অবস্থাটা যখন কিছু শান্ত হয়েছে তখন কার যেন দৃষ্টি পড়ল বুড়ির বীভৎস মুখের ওপর।
—কোদাল পেলা না?
তিনু তখনো ফুঁসছে, তাই কোনো উত্তর দিল না। শুধু নিরীহ করিম নত মাথায় ক্ষীণগলায় বললে,
—কুতি পাব? কেউ দিলি না—বলে সে ব্যগ্র হয়ে হাঁটুর ধুলো ঝাড়তে লাগল।
—তো কী হবি?
—কী আবার হবি, মাথা হবি, মুণ্ডু হবি। তিনু এবার গর্জে উঠল। এবং হয়তো তার সে-জ্বলন্ত ক্রোধকে চাপা দেবার জন্যেই করিম উঠে গিয়ে বুড়ির ছিন্ন ময়লা আঁচল দিয়ে তার বীভৎস মুখটা ঢাকা দিয়ে এল। তারপর কে যেন রসিকতা-ও করলে,
—সবুর কর্, বুড়োটা মরলি পরে দুটোকে এক সাথ গোর দেয়া যাবি–
গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে এখনো বুড়ো তেমনিভাবে চোখ বুজে নিশ্চল হয়ে রয়েছে।
ক্রমে ক্রমে একটি অধৈর্যের চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়তে লাগল সবার মধ্যে। একটি মাত্র মৃতদেহের জন্যে তাদের এই আগ্রহাতিশয্যময় যাত্রা ঠেকে থাকছে, অথচ এদিকে শূন্য পেট করাত-কাটা হচ্ছে। মন তাদের ছুটছে গঞ্জে-গঞ্জে, না-দেখা শহরের আনাচে-কানাচে, কল্পিত খাদ্যে রসালো হয়ে উঠেছে জিহ্বা। বেঁচে থেকে-ও ঝুনো বুড়ি তাদের পদে-পদে জ্বালিয়েছে, মরেও যেন মুক্তি দিচ্ছে না।
হঠাৎ হাঁটু থেকে মুখ তুলে উজ্জ্বল-আলোয় সংকুচিত চোখে আনু বুড়ির ঢাকা-দেয়া মুখের পানে তাকাল, তাকিয়ে কেমন একটা আকস্মিক ভয়ে শীতল হয়ে উঠল তার ভেতরটা। সে-আবৃত মুখে কী যেন একটা ভীষণ সংকল্প। যেহেতু মহাবুভুক্ষা নিয়ে সে মরেছে, সে জন্যেই কি সে তাদের খেতে দেবে না, তাদের-ও কি মরতে হবে তেমনি করালভীষণতায়? ভয়ে ভেতরে কুঁকড়ে গিয়ে সে ত্রস্তদৃষ্টিতে তাকাল বুড়োর পানে। সেখানে-ও সে-ই একই কথা। তার নিশ্চল-নিথর দেহে দৃঢ় কঠিন সংকল্প, সেখানে সমবেদনার কোনো কম্পন নেই। এবার আনু হঠাৎ কী যেন চাইতে লাগল, সারা অন্তর দিয়ে মনের ঘন অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে কী যেন খুঁজে বেড়াতে লাগল। সে কি মায়ের বুক খুঁজছে? ছেলেবেলায় ভয় পেয়ে যেমন আকুলভাবে মায়ের বুক খুঁজত-আজ এতদিন পরে তেমনিভাবে সে কি খুঁজছে মায়ের বুক? কিন্তু ওধারে উলঙ্গ প্রান্তর ধু-ধু করছে খররোদে, আর এধারে এদের মনে বিষ, বৈরিতা। জীবন কি জীবন্ত-কবর, জীবন কি এতই ভয়াবহ?
অসহ্য হয়ে উঠছে ক্রমশ। ওদের দেহের মন এখন সমাজের কথা ভুলেছে, অথচ মনে দেহ এখনো সমাজের শৃঙ্খলে বন্দি। মহাবুভুক্ষার অভিযানের পথে সামান্য তুচ্ছ মৃতকের বাধা কাটিয়ে যাবার সাহস তাদের নেই। এবং এ-ভীরুতায় তারা যে-মাহাত্ম্য প্রকাশ করছে, তা অতি আশ্চর্য ও বিস্ময়কর।
তবু সবকিছুরই একটা সীমা রয়েছে। তোতা এবার বসা—গলায় বললে,
—থাক্ বুড়ি, থাক্ বুড়ি পড়ি এখানটিতি, মোরা চল যাই—
কেউ কোনো সাড়া দিলে না।
এমন সময় দেখা গেল দূরে বাঁশঝাড় ও তেঁতুলগাছের আড়াল হতে কারা যেন হঠাৎ বেরিয়ে এল—কাঁধে তাদের খাটের মতো কী। এবং আশ্চর্য, তারা এদিক পানেই আসতে লাগল। অবশেষে তারা এদের কাছে এসে বললে যে, গাঁ থেকে খবর পেয়ে ওরা কাফন ও মুর্দার খাট নিয়ে এসেছে, মুর্দাকে গাঁয়ে নিয়ে গিয়ে দাফন করবে। তারা ক-জন উৎসাহী দরদী যুবক, মানুষের এ-দুঃসময়ে পরের সেবা করে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু ওদের কাছে নেই কিছু। কাফন ও মুর্দার খাট ছাড়া কিছুই তারা আনে নি। তা, মৃতের সেবার-ও প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এরা কি জানে কারা জীবিতের সেবা করছে, কোথায় গেলে পাওয়া যাবে তাদের?
—জানাজা হবি না? তিনু আস্তে শুধাল।
ওদের মধ্যে কে একজন হাসল। কাফনে—যা আসলে একটা ছেঁড়া অথচ ধোয়া কাপড়—বুড়ির দেহ জড়াতে জড়াতে বললে যে, না, জানাজা হবে না, খোদা মাপ করে দেবেন সব। একটু থেমে সে এবার একটা বিস্ময়কর কথা বললে। বললে যে, এরা শহীদ : যারা দুর্ভিক্ষের সাথে সংগ্রাম করে প্রাণ দিচ্ছে তারা শহীদ গো, শহীদ।
তিনুরা তাদের সাথে আবার চললে গাঁয়ের দিকে। এবার পুরুষদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া সবাই গেল : তাদের প্রাণে আশা আবার জ্বলতে শুরু করেছে ধিকিধিকি। এদিকে মেয়েরা পা ছড়িয়ে বসল, আর শুষ্ক মরাগলায় বিনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদতে লাগল মরাকান্না।
তাদের কান্নার আওয়াজে হাওয়া—ঘুমন্ত হাওয়া হঠাৎ জেগে উঠল কি? হয়তো। কোথেকে হঠাৎ দমকা হাওয়া এসে ধুলো উড়িয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল প্রান্তরময়। ঐ কথাই কি সে-হাওয়া বললে, নেই, নেই নেই?
.
ওরা ফিরে আসতে-আসতে প্রায় সন্ধে—দিগন্তরেখার কাছাকাছি তখন রক্তাক্ত নীরব সূর্য। তারা এসে পৌঁছুতে মেয়েদের মধ্যে আরেকবার কান্নাটা উঠল : দুঃখ ছাড়িয়ে তাদের মধ্যে এখনো সামাজিক রীতি অটুট। কিন্তু কান্না থামতে দেরি হল না, এবং থামতে-ই এবার একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল তাদের মধ্যে। অভিযানের পথে বাধা তাহলে সত্যি-সত্যি কাটল।
যাত্রার আয়োজনে সবাই সতেজ ও শতমুখ হয়ে উঠেছে—এমন সময় তিনু হঠাৎ গলা ঝেড়ে বললে,
—কুতি যাবা আজ? সন্দি নাগে-নাগে, গঞ্জে পৌঁছুতি অনেক রাত হয়ি যাবে। তার চাইতি চল মোরা গাঁয়ে যাই। এক চৌধুরী সায়েবের কথা শোনলাম, পায়ে ধরি পড়লি পরে দুটি খাতি দেবেন না কি?
গাছের তলাটা আবার তীব্র কোলাহলে মুখর হয়ে উঠল। কে একজন দ্রুতপায়ে এগিয়ে এল বুড়োর কাছে, এসে অস্থির গলায় বললে,
—হেই গো হাজুর বাপ, ওটো ওটো—
তারপর অনেকেই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল,
—অ হাজুর বাপ!
—উটবা না গো হাজুর বাপ, যাবা না গো খাতি?
ওদের মধ্যে আশাটা এরই মধ্যে এত দৃঢ় হয়ে উঠেছে যে তা নির্ভুল সত্যে পরিণত হয়ে গেছে। গাঁয়ের চৌধুরী সাহেবের বাড়ি থেকে যেন দাওয়াত এসেছে।
—কই গো বাপু, নাহ্। বুড়িটা তো জ্বালায়ে জ্বালায়ে অবশিষি মরে বাঁচালে মোদিগ, কিন্তুক বুড়োটা হাড়ে-মাসে জ্বালাবি
করিম একটু ঝুঁকল। কী হয়েছে?
বুড়োর ধড়ে প্রাণ নেই।
কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধতা। তারপর সবাই অসহ্য বিরক্তিতে একসাথে কথা কয়ে উঠল : এত অপেক্ষার পর সদ্যমুক্তিলাভেই আবার নতুন বাধার সৃষ্টিতে ওরা এবার যেন ক্ষেপে উঠেছে।
—থাক পড়ি বুড়োর লাশ—। রেগে তোতা বললে। কিন্তু হালুর মা বললে,
—আহা, মোরা তো গাঁয়েই যাচ্ছি—ওই যে কারা সেবা করতি এসেছিল, তাদিগ খবর দেয়া যাবিনি খন পানে।
এ-প্রস্তাবে কেউ কোনো আপত্তি তুলল না। এবং কলরব চরমে তুলে ওরা চলল গাঁয়ের পানে।
.
তারপর সন্ধ্যা হল, হাওয়া থামল, ক্রমে ক্রমে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে উঠল। এবং প্রান্তরের ধারে বৃহৎ বৃক্ষের তলে তার গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বুড়োর মৃতদেহ বসে রইল অনন্ত তমিস্রার দার্শনিকের মতো।