সেই পৃথিবী

সেই পৃথিবী 

দেখতে লোকটা বেঁটেখাটো। চওড়া শক্ত হাড়, ছোট ঘাড়, টান পিঠ, আর লোমশ দেহ। রঙটা এমন যে মনে হয় কালোর ওপরে-ও কালোর একটা পোঁচ, অথচ সেটা আবলুশ কালো নয়। রঙটায় একটা বৈশিষ্ট্য আছে; এবং আরেক বৈশিষ্ট্য তার বড়, ভাসন্ত ও টেরা চোখ দুটিতে। তার চোখের পানে চেয়ে কখনো মনে হয় কী সোজা কী বোকা সে, আবার কখনো মনে হয় সমস্ত কুটিলতা ঘোলাটে হয়ে পাক খাচ্ছে সেখানে। দারোগার সামনে স্থির হয়ে বসে নিথর দৃষ্টিতে যখন চেয়ে থাকে, তখন বাইরের কেউ তাকে গদাইলস্কর ছাড়া আর কিছু ভাববে না, আবার বন্ধুদের আড্ডায় কিছু না কইতে-ই চোখে যে-সব কথা ভাসে, তার তুলনা মেলা ভার। 

তবু, লোকটার অন্তর আছে। মানুষের নাকি অন্তর আছে, এর-ও আছে তা। ওর লোমশ নোংরা কালো দেহের অন্তরালে কোথায়, কে জানে, একটা নরম কোমল অন্তর লুক্কায়িত, এবং এর পরিচয়ে অবাক হবার-ই কথা। 

কিন্তু এ-ও সত্যি কথা যে, তার পরিচয় পাওয়াও ভার। কালো মুখে আরো কালো ছায়া ঘনিয়ে ওঠা–ই স্বাভাবিক। তার পরিবেশ তার কর্ম বলে : আরো ঘোলাটে হও, কাদায় আবর্তিত হও, দেহ থেকে আরো কুটিল কালো করে তোলো তোমার ভেতরটা—নইলে জীবনের অর্থ কী? 

কিন্তু বহুকাল পৃথিবীর ভাঙা জংলা ঘাটে নোংরা জল খেয়ে খেয়ে ইদানীং আশ্চর্যভাবে নতুন ভোল এসেছে তার জীবনে। বর্তমানে জনকল্যাণের জন্যে যে-সব চাকরি পথে-ঘাটে লুটোচ্ছে, তারই একটা কী করে তার কপালে এসে লেগেছে : সে খাকি-প্যান্ট-শার্ট, মোজা-জুতো পরতে শুরু করেছে। একটা চাকরি : মাসে-মাসে মাইনে আসবে হাতে,—এর অনুভূতি ওর পক্ষে অনাস্বাদিতপূর্ব, তাই বিচিত্র। চাকরি পাওয়ার প্রথম ঝোঁকটা তাকে চোখের জলে ও বিকৃত আনন্দে (তার জীবনে সুস্থ অনাবিল আনন্দ আবার কোথায়? রক্ত গলানো কাশির উপশমের মতো-ই নয় কি তার আনন্দ?) সামলাতে হয়েছে। চাকরি যেন একটা দুনিয়ার পরম বিস্ময় : মাসে-মাসে, নিয়মমতো নির্দিষ্ট কটা টাকা আসবে হাতে, এতে শঙ্কা-ভয় নেই, রাতের আঁধারে হৃৎপিণ্ডের কম্পন নেই, পাশবিক ক্রোধে মাথা ফাটাফাটি নেই। কী অদ্ভুত কথা : এ-টাকা সে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়েও বুক টান করে গুনতে পারে, চলতে-চলতে রেজুকি বাজাতে পারে ঝুনঝুন করে, সূর্যালোকের তলে সদর রাস্তায় কেনাকাটা করতে পারে নির্বিবাদে। 

যেদিন সে প্রথম মাইনে পেল, সেদিন তার ভাসন্ত টেরা চোখদুটি কেমন কোমল হয়ে উঠল, শুধু কোমলই হয়ে উঠল। তীব্র আনন্দে আত্মহারা না হয়ে সে যে শান্ত—আবার এত শান্ত হয়ে উঠবে এ-কথা কল্পনাও করতে পারে নি। শুধু শান্তই নয়, মনে হল ভার দেওয়া জালের মতো সে নদীর বুকে বিস্তৃত, তাকে ধুয়ে ধুয়ে স্রোত বয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে, আর কখনো-কখনো চকচকে মাছের মতো নানারকম কথা এসে আটকাচ্ছে সে জালে। ভারি মনে হচ্ছে নিজেকে, এবং ভারিত্ব দামের। কে যেন তাকে দাম দিল। এ-বিশাল পৃথিবীতে অগণিত মানুষের মাঝে আর মুক্ত আকাশের তলে তারও দাম আছে, এবং এ-কথা সে উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করতে পারে, এ নিয়ে শিশুর মতো ধুলোয় লুটিয়ে গড়াগড়ি দিয়ে মাতামাতি করতে পারে। কিন্তু কিছুই সে করবে না, কারণ তার দাম আছে। 

তবু আড্ডায় না গিয়ে উপায় নেই। ইয়ার-বন্ধুদের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল, রঙিন আশায় ওদের চোখে রক্ত টগবগ করে উঠল : টাকার লোভে শত হাত যেন লিকলিক করছে ফণার মতো। কালু রসালো গলায় শুধু ডাকলে : সাদু! 

সাদেক একবার হাসলে কোনো কথা না করে, তারপর ঝাঁপ-মুক্ত জানালা দিয়ে অর্থহীনভাবে বাইরের পানে তাকাল। সেখানে আঁধার; আরো ওপরে আকাশে তারা। কী একটা কথা মনে জাগছে বারে বারে, এবং বাইরে অন্ধকারের পানে তাকাতে আস্তে মনের মধ্যে একটা ছবি খেলে উঠল। বহুদিন আগের কথা। খেলার মাঠের প্রান্তে শিমুল গাছটার ধারে যে বাংলো ধাঁচের বাড়ি—সে-বাড়িতে একবার সে চুরি করতে গিয়েছিল। দেয়ালের ফুটো দিয়ে যে-ঘরে উঁকি মারলে, সেটা ছিল শোবার ঘর। ঘরের এক কোণে একটা লণ্ঠন জ্বলছিল নিস্তেজ আলো ছড়িয়ে। সে-আলোয় নজরে পড়ল খাটের ওপর ঘুমন্ত একটি মেয়ে, মিষ্টি তার মুখ, আর তার পাশে একটি শিশু, সে-ও ঘুমন্ত। 

কিছুক্ষণ সাদেক চেয়ে-ই ছিল। ঘুমন্ত মেয়েটির মাধুর্য যে তাকে আকৃষ্ট করছিল তা নয়; যে-জন্যে সে ফুটো থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছিল না—সেটি হল মেয়েটির একটি স্তন। একটু আগেও হয়তো শিশুকে মাই দিয়েছিল, এখনো সেটি অনাবৃত। 

তারপর শিশুটি হঠাৎ কেঁদে উঠল। মেয়েটিও উঠল জেগে, আর ক্ষণেকের জন্যে সদ্য ঘুম-ভাঙা মুখে বিরক্তির ছায়া ঘনিয়ে উঠে মুহূর্তে তা আবার স্নেহে কোমল ও স্নিগ্ধ হয়ে উঠল। তারপর সে শিশুর মুখে মাই দিলে, দিয়ে ঘুম-জড়ানো গলায় মৃদুস্বরে সুর করে কী যেন গাইতে লাগল, এবং গাইতে-ই থাকল… 

আজ এতদিন পরে মেয়েটির ঘুম জড়ানো কণ্ঠের কেমন সে-সুর থেকে-থেকে সাদেকের কানে ভেসে উঠতে লাগল। সেদিনের মতো অত গভীর না হলেও এখন রাত তো বটে, এবং ওই অন্ধকার থেকে আর বহু দূর থেকে সেই মৃদু গান যেন ভেসে আসছে… 

কিন্তু এধারে ইয়ার-বন্ধুদের চোখ জ্বলছে। রক্তলোলুপ তাদের রক্ত; রক্ত তাদের রক্ত চায়। এস্পার কি ওস্পার—এমনি একটা তীক্ষ্ণতা তাদের চোখে। দুপাশে ধার-দেয়া ছুরির মতো তাদের দৃষ্টি। 

—এই শালা লবেজান! (লবেজানটা সাদেকের পেয়ারা নাম ) 

লবেজানের চোখে এখনো তন্দ্রা। ধীরে-ধীরে এতদিন পরে অনুতাপ জাগছে, তাকে বিধতে শুরু করেছে কাঁটার মতো। আহা, ঘুমে ও সন্তানস্নেহে কোমল-স্নিগ্ধ মুখে কেন সে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল? 

কালুর কথা ঠাস্ ঠাস্ ছোটে। এবার সে সাদেকের কাঁধ ঝেঁকে বললে : 

—কোথায় মাল মেরেছিস শালা? 

—দ্যাখ, কেমন ঢেঁকি উল্টে আছে, দ্যাখ্! আরে এই লবেজান! ছুনু মিঞা আদর করে ডাকল, বাতটাত তো কুছ কর্– 

সাদেক নিঃশব্দে নোটের তাড়া বের করে দিল—লাল সুতোয় বাঁধা কটা এক টাকার নোট। ওদের চোখ চকচক করে উঠল, বিশ্বাসও হয় না যেন। চমরু মিঞা কসাই-দৃষ্টি হেনে কেড়ে নিল তাড়াটা। স্বভাবগত ভয় তাদের, গেল বুঝি গেল বুঝি—কেড়ে নে ধা করে। টাকা করায়ত্ত করে দাঁতের ফাঁকে কেমন করে হাসল চমরু, তারপর বললে : 

—সব দিলি সাদু? 

হঠাৎ কোনো কথা নেই, সাদেকের চোখ ছলছল করে উঠল। সে-ছলছল চোখে কী এক জোশের মাথায় চেঁচিয়ে উঠল সে : 

—নে শালা, দিলাম। আমার কি আর দিল্ নাই? 

হ্যাঁ, তার অন্তর আছে বৈকি। অন্য মানুষের যদি অন্তর থাকে তবে তোর লোমশকালো দেহেরও অন্তরালে অন্তর আছে বৈকি। এবং সে-অন্তর এখন কতদিন আগেকার একটা অপরাধের অনুতাপে নীল-নীল হয়ে উঠছে। সে-রাত কি কোনোদিন আসবে না, কোনোদিন সে দেখা পাবে না সে-মেয়ের? যদি দেখা পেত সে-মেয়ের, তবে তার পায়ে মাথা গুঁজে সে কাঁদতে পারত, অন্তরের যত অপরাধ যত গ্লানি যত বেদনা—সব ঢেলে কাঁদতে পারত প্রবল প্রচুর, এমন-কি বুক চিরে রক্ত বের করে ঢেলে দিতে পারত তার শুভ্র-কোমল পা-দুটিতে। ওর মন হঠাৎ ডাকল আস্তে : মাগো। তারপর আকুল হয়ে ডাকল : মাগো, ওমা। মাগো, ওমা…. 

ওরা বলে যে দিল্ নেই! বলে দিল্‌ নেই। বলে যে, দিল্ নেই ওর। সাদেক মাথা ঝেঁকে সোজা হয়ে বসে হঠাৎ বুকে এক বিরাট চাপড় বসিয়ে বুকের মধ্যেই যেন গোঙিয়ে বললে : 

—কোন্ শালা বলে দিল্ নেই, কোন্ শালা বলে…? ওর ভাসন্ত চোখ আরো ভাসছে, আর মানবতা যেন অমানুষিকতার বিরুদ্ধে হিংস্রকুটিল হয়ে উঠেছে; প্রতিহিংসার জ্বালায় পাক খাচ্ছে অবিরত। 

তার সে-চোখ দেখে কারো ভয় হল না। কে হাসল যেন। চমরু হাসল চোখ টিপে। ঠোটের প্রান্তটা হঠাৎ সরিয়ে হাওয়ায় কেমন আওয়াজ করল, করে আবার চোখ টিপে বললে : 

—পেটে মাল ওগলাচ্ছে—কিন্তু তক্ষুনি সে জিভ কেটে নরম গলায় শুধু বললে : ছি:—

ওদের ফেউ নবাব ততক্ষণে টাকা ঢেঁকে উধাও হয়েছে মদের সন্ধানে। আজ আর তাড়ি নয়, দিশী মদ মারা যাবে। মদ আসছে, আসছে—এতেই তারা এত চাঙা হয়ে উঠেছে যে সবার মুখ দিয়ে অবিরত খই ফুটছে। হঠাৎ সবার গলা ছাড়িয়ে কালু হাঁকল : 

—শোন্ শালারা— 

সব চুপ। 

—রতনবিবি বাদ পড়ে কোন্ কারণে? 

কোনো কারণেই বাদ পড়ে না। কথার মতো কথা বলেছে বটে কালু। আসর আরো দ্বিগুণ গরম হয়ে উঠল; এত গরম হয়ে উঠল যে, কে একজন নিজের ঊরুতে বিকট চড় বসিয়ে চেঁচিয়ে উঠল : আগুন, শালা আগুন! তারপর সে কী হাসি— 

কিন্তু সাদেক এখনো নীরব, শান্ত। কোন্ মাল পেটে ওগলাচ্ছে যে ঢেঁকি উল্টে সে বুঁদ হয়ে আছে? নিজেকে তার ভারি ভারি ঠেকছে এখনো, তবে তলায় অনেক নোংরা জমেছে। জীবনে যে সে নোংরাই ঘেঁটেছে তা নয়, তার মধ্যেও নোংরা জমে উঠেছে ঢের, আজ তাই চেতনায় জেগে নিজেকে ভারি বোধ হচ্ছে। পৃথিবীতে এখন না আর আঁধার জমেছে? এই আঁধারে কত নিষ্পাপ মায়েদের মন শিশুদের কল্যাণ কামনায় মুখর হয়ে উঠেছে, বাইরে আকাশের তারাদের কাছে কি তার আভাস পাওয়া যাবে? ওমা, মাগো…। আবার যদি আসত সেদিন, অথবা যদি সে মেয়েটির দেখা পেত সে শুধু এক মুহূর্তের জন্যে শুধু এক মুহূর্তের জন্যে, কছম করে বলছি আমি মুছলমানের বাচ্চা, যদি এক মুহূর্তের জন্যে পেতাম তাকে তবে বুক চিরে শুধু রক্ত ঢেলে দিতাম তার পায়ে, কইতাম না কিছু। এ-মুখে আবার কথা কী?— এবার হাসল সাদেক, হাসল আস্তে। 

মধুমারা গা ঠেলে দিল চমরুর। চমরু সায় দিল। 

—শালা কম নয়! ফিসফিস করে কথা কইবার চেষ্টা করল কালু, কিন্তু তার যা গলা। ঘরে সামান্য আলো; সে—আলোতে সাদেকের ভাসন্ত চোখ চকচক করছে যেন। ওতে জল। কিন্তু তাতে ওদের কিছু আসে যায় না, নেশার উৎকট রূপও তাদের নিত্যকার ব্যাপার। তাই অন্য এক বিষয়ে আসর সরগরম হয়ে উঠল। বিষয়টি হচ্ছে : সেই লম্বাপানা মেলেটারিটা খাসা মাল চাইছে, দিতে পারলে পকেটটা..। কিন্তু মুশকিল হল এই যে, কোথায় বাবা খাসা মাল? 

—রতনাকে একবার সাজিয়ে-গুছিয়ে? 

—চোপ্‌ শালা, বকিসনে মিছিমিছি। ওটা কুত্তা আছে, শুঁকে ধরে ফেললে শালা বুটের গুঁতোয়—। আর তাছাড়া রতনা নিজের ব্যবসা নিজে জানে, ওদের ট্যাকে তা হলে আসবে কানাকড়ি। 

কিন্তু, সাদেকের চোখে একটা আঁকাবাঁকা পথ ভাসছে যেন থেকে-থেকে, তারপর ক্রমশ সেটি স্পষ্ট হয়ে উঠল। রোদ খাঁখাঁ করছে; মাসটা বোশেখ কি জ্যৈষ্ঠ। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় ধুলো উড়ছে। একটু আগে-আগে যাচ্ছে একটা গরুর গাড়ি, আর ধুলো খেতে-খেতে রোদ-মাথায় পেছনে-পেছনে চলছে সাদেক; চোখে তখন এমন ভাব যে আস্ত একটা গদাইলস্কর সে। কিন্তু খেয়াল তার গাড়ির ভেতরের পানে। ছইয়ের তলে একটি ছোট পরিবার : স্বামী-স্ত্রী আর দুটি ছেলে। স্বামী-স্ত্রী কথা কইছে অনবরত; কোলের বাচ্চাটা থেকে-থেকে আধো-আধো কী সব বকছে, বড়টি উপুড় হয়ে শুয়ে ওর হাত নিয়ে খেলা করছে আপন মনে। আশা নেই কিছু—এ-কথা জানে সাদেক, তবু অভ্যাসমতো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখে নিল কটা চুড়ি হাতে, আংটি আছে কি না, গলার হার কী রকম—কিন্তু আসলে কী যে দেখেছিল, সে-কথা সে তখন বোঝে নি, এতদিন পরে এমন অদ্ভুত পরিবেশে সে-কথা বুঝতে পারছে যেন—অস্পষ্ট ছায়ার মতো বুঝতে পারছে যেন, এবং তাতেই থেকে-থেকে তার সারা অন্তর উদ্বেলিত তরঙ্গিত হয়ে উঠছে। 

ওপরে তো আকাশ, যেখানে ওঠে সূর্য, ওঠে তারা, কিন্তু নিচে এই ধরণীর বুকে শান্তি আছে, স্নেহ-ভালোবাসা আছে। এই ধরণীর বুকে। কিন্তু কোথায়? পৃথিবীর মধ্যেও যেন কোথায় আবার রূপকথার দেশ — 

তারপর সে রূপকথার দেশের স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেল। ঈষৎ আলোকিত দুর্গন্ধময় ঘরে ইয়ার-বন্ধুদের হইচই ওর কানে কিছু ঢুকছে, কিছু ঢুকছে না। যেটুকু-বা ঢুকছে সেটুকু বহু নিচু থেকে, অতল থেকে আসছে যেন ভেসে, সে রয়েছে ঊর্ধ্বে, উঁচু স্তরে। ভাপসা গরমে ওর দেহ-মুখ ঘামে ভরে উঠেছে, তাই অনাবৃত অংশ চকচক করছে আলোয়, আর ওর ভাসন্ত চোখ আরো ভাসন্ত হয়ে উঠেছে। কোন্ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছে সে? সে-পৃথিবী কি বেহেশত? যে-পৃথিবী ভরা সূর্যালোক-ও মুক্তি, যে-পৃথিবীতে শিশুরা কাঁদে ও দম্পতিরা হাসে, যে-পৃথিবীময় শুধু টলমল স্নেহ, সে-পৃথিবীই বেহেশত? 

কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যে যদি সে মেয়েটির দেখা পেত সে—শুধু এক মুহূর্তের জন্যে….তারপর ইয়ার-বন্ধুদের চিৎকারে সে চমকে উঠল, কল্পনায় ঘন-বিস্তৃত জাল গেল ছিঁড়ে। মদ এসেছে, ওদের কোটরাগত চোখ জ্বলজ্বল করছে ক্ষুরধার তীক্ষ্ণতায়। ঝাঁপমুক্ত জানালা দিয়ে সাদেক আস্তে বাইরের পানে তাকাল। 

কিন্তু চমরু এল লাফিয়ে : ওঠ শালা, বোতল আ গ্যয়া, আর রতনাশালী বোলাচ্ছে।

সাদেক নিস্পন্দ। 

কালুও একবার হেঁকে উঠল কর্কশ-তীক্ষ্ণ গলায়, তবু সে নিঃসাড়, স্থির। হঠাৎ, কেন কে জানে, একটা প্রচণ্ড ভীতি তার টুটি টিপে ধরেছে। ইয়ার-বন্ধুদের ভয় করবে না, কিন্তু তাদের সঙ্গে কোথাও যেতে ভয় করছে তার। কোন্ অন্ধকার পিচ্ছিল সুড়ঙ্গ দিয়ে তারা যাবে, যাবে পিছলে পিছলে গড়াতে গড়াতে আর হাসবে উঁচু তীক্ষ্ণ গলায়; কুৎসিত কথা কয়ে-কয়ে বিকটভাবে হেসে হেসে আরো নেবে যাবে, যাবে আর যাবে….সাদেক স্তব্ধ। 

কালু আবার ফিসফিস করে কথা কইবার চেষ্টা করল : 

—থাক্, ব্যাটা থাক্, থাক্ বুঁদ হয়ে। শালা বেইমান, চুপি-চুপি পেটে মাল ঢুকিয়ে—এবং একটু পরে ঘরময় অসম্ভব শান্তি। সেই পৃথিবীর শান্তি যেন। সাদেক তাকাল চারধারে : নিষ্প্রভ আলোয় বীভৎস ঘরটা আশ্চর্যভাবে শূন্য, কেউ নেই। 

সাদেকও রাস্তায় এসে দাঁড়াল। বাইরে রাতের অন্ধকারে স্তব্ধ নীরবতা, আর সে-নীরবতায় দূরে কোথায় একটা শিশু কঁকিয়ে কঁকিয়ে কাঁদছে। আহা, শিশু কাঁদছে, রাতের বিপুল অন্ধকারে আর গভীর নীরবতায় শিশু কাঁদছে, সেই পৃথিবীর শিশু…. 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *