খণ্ড চাঁদের বক্রতায়

খণ্ড চাঁদের বক্রতায় 

শেখ জব্বারকে ধনী বলতেই হবে। তার দুটি গাড়ি, দুটি ঘোড়া, জন আটেক চাকর, আর চিকে-ঘেরা অন্দরমহলে চারটি বিবি। আয়-ব্যয় যদি ধনীর লক্ষণ হয়ে থাকে, তবে সে-ধারণা যথার্থ : আয়ের দিকে রয়েছে দুটি ঘোড়ার গাড়ি, এবং ব্যয়ের দিকে রয়েছে চার জন বিবি। 

যে-পাড়ায় শেখ জব্বারের বাস, সে-পাড়ায় শুধু গাড়োয়ান আর ঘোড়া। ঘোড়ার নাদে পরিপূর্ণ রাস্তাটির ধারে একটি লম্বা আস্তাবল : আস্তাবলের প্রান্তে ক’টা স্যাঁতস্যাতে চায়ের দোকান ও হোটেল, তারপর কতগুলো বস্তি। সর্বশেষ বস্তিটি শেখ জব্বারের। 

যদিও এখন রাত দুটো, তবু আজ বস্তিতে কারো চোখে ঘুম নেই। সমস্ত বস্তিময় তীব্র উল্লাস চলছে। চারিধারে কোলাহল, বিচিত্র সম্মিলিত জনরব; কেউ-বা ভারি কর্কশ গলায় উর্দু কালোয়াতি টানছে, কোথাও একদল হৈ-হট্টগোল বাধিয়ে নোংরা আলাপ করছে, আবার কোথাও তাসের ঊনত্রিশের সভা বসেছে। তবে ভিড় জমেছে সবচেয়ে বেশি শেখ জব্বারের বস্তির সামনে। সেখানে একটা চোঙওয়ালা জীর্ণ গ্রামোফোনে দ্রুত ও নাকী চিকন গলায় কোন্ অজ্ঞাত অখ্যাত বাইজীর খ্যাটা নাচের গান চলছে। রাস্তার ওপর এক-পা-ভাঙা তিন পায়ে দণ্ডায়মান একটি ছোট কেরোসিন কাঠের টেবিলের ওপর গ্রামোফোনটা রাখা হয়েছে; ওপরে বস্তির নিচু ছাদ হতে বেরিয়ে-থাকা কাঠের বিমে একটা ডে-লাইট ঝুলছে, আর সে-আলোতে গ্রামোফোন হতে অল্প দূরে সেই ছেলেটা—যে-ছেলেটা রোজ ঘোড়াদের ঘাস ভুসি ইত্যাদি দেয় সে ঘাগরা ও ওড়না পরে পায়ে ঘুঙুর দিয়ে তোফা নাচ জমিয়ে তুলেছে। পায়ের ঘুঙুরে অতি আওয়াজ করে সে কেবল শীর্ণ কোমর ভেঙে ভেঙে নাচছে আর নাচছে, এবং অর্ধচক্রাকারে দণ্ডায়মান যত দর্শক সব থেকে-থেকে উচ্ছ্বসিত হয়ে অশ্লীল কথা বলে উঠছে। রেকর্ডে গান ফুরাল তো নাচ ফুরাল না, শেখ জব্বার মুচকে হেসে মোটা গোঁফের সরু আগায় আলগোছে একটা চাড়া দিয়ে ফের রেকর্ডটা ঘুরিয়ে সাউন্ডবক্স চাপিয়ে দম কষতে লাগল,—বাইজীর গলা আবার ককনিয়ে উঠল। 

এ-বস্তিতে আজ এই যে এত আনন্দ ও কোলাহল, এর মূলে রয়েছে শেখ জব্বারের চতুর্থ বিবির আগমন। আজ সকালে জব্বার নিজে তাকে নিয়ে এসেছে। বিয়ে হয়েছে দু বছর বটে, তবে বিবি বয়সে কচি ছিল বলে এতদিন তাকে বাপের বাড়িতেই রাখা হয়েছে। 

জব্বারের আজ আনন্দের সীমা নেই। রাত এগারটায় সে বস্তির সবাইকে বিরানি খাইয়েছে, এবং তার আনন্দের আগুন সারা বস্তিতে যেন ছড়িয়ে পড়েছে। আজ সে সেজেছেও ভালো,—পরনে লাল টকটকে বর্মি লুঙি, গায়ে মুর্শিদাবাদি সিল্কের সাদা পাতলা পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবির বুকপকেটে ফুলতোলা ঝালরওয়ালা রুমাল, তাতে দিশী সেন্টের কড়া গন্ধ। মাথায় বাবরি চুলে সুগন্ধ তেল জবজব করছে, কিন্তু ঘাড়ে একগাদা পাউডার। আর পায়ে চীনাবাজারের পেটেন্ট চামড়ার চকচকে পাম্প-সু। শেখ জব্বারের মুখটি বিরাট, বড়-বড় লালচে চোখ, মোটা নিচু জুলপি, আর কালো ঠোঁটের ওপর বুনেদী মার্কা গোঁফ। 

ছোকরাটির নাচ দ্রুত তালে উঠেছে, বাইজীর নাচও দুলে উঠেছে, আর এদিকে জমায়েতের মুখ ইতরভাষায় মুখর হয়ে উঠেছে, কিন্তু শেখ জব্বারের গোঁফের তলায় শুধু মুচকি হাসি। ছোকরাটির মুখভরা ঘাম হলেও বিড়ি-টানা-কালো ঠোঁটে সে কী হাসি, আর ঈষৎ টেরা ঘোলাটে চোখে সে কী চাহনি; কোমরে বাঁ হাত রেখে ডান হাতে মুখের ওড়না টেনে ঘুরে-ঘুরে নেচে সে সবাইকে জবর মাত করে ফেলেছে। 

এবার জব্বারের মুখ খুলল; বললে : 

—ওয়াহওয়া, কেয়া নাচনা। এই ভাই জামাল, এইসা নাচ দেখা কভি?…জামাল মিঞা! কাঁহা জামাল মিঞা?…

শেখ জব্বারের অন্তরঙ্গ বন্ধু জামাল মিঞা তখন এক কোণে অন্ধকারে বুঁদ হয়ে পড়ে রয়েছে, পেটে ক’বোতল পড়ে রয়েছে কে জানে! 

.

এদিকে চিকে-ঘেরা অন্দরমহলে তিন বিবির মুখে তিন রকম কথা। নতুন বিবির বয়স অতি অল্প; হয়তো বার। ছোট মুখ, আর ছোট দেহ। অলঙ্কার ও জামাকাপড়ের তলে দেহ আছে কি না সন্দেহ। তার নাকে নোলক, চুলে রুপোর সিঁথি, কপালের একপাশে সে-সিঁথির মিনে করা রুপোর চক্র। হাতে চুড়ির বোঝা, পায়ে মল, কোমরে চন্দ্রহার। ছয়টি ঘোড়া আর ছয়টি মানুষ প্রতিদিন রোদে ঘেমে পানিতে ভিজে যে-অর্থ এনেছে, তার অনেকটাই হয়তো এ-ক্ষুদ মেয়েটির দেহে অলঙ্কাররূপে গিয়ে চড়েছে। 

মেয়েটির ঠোঁট অদ্ভুতভাবে নিষ্কম্প, কিন্তু তার চোখের আর বিশ্রাম নেই, শুধু সারা ঘরময় ক্ষণে-ক্ষণে দশদিকে ঘুরছে। এবারে বড় বিবির মুখের পানে, ওবারে মেজো বিবির হাতনাড়ার পানে, অন্যবার সেজো বিবির ঠোঁট-বাঁকানোর পানে, আবার তিন বিবির কুটিল চোখের ঝকমকির পানে। বেচারির ঠোঁটে কোনো কথা নেই, কিন্তু চোখ কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে, এক মুহূর্ত স্থির নেই। 

তিন বিবির মুখই তার সম্বন্ধে মুখর; এবং তাদের প্রতিটি অক্ষর এবং প্রত্যেকটি দেহভঙ্গি সে নীরবে হজম করে ফেলছে; ওর পাশে গা ঘেঁষে বসেছে তৃতীয় বিবি। মনে তার রূপের অহঙ্কার, তাই নবাগতার পাশে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তাকে, দেখছে আর থেকে-থেকে মুখ ফিরিয়ে আর আর বিবিদের পানে চেয়ে চোখ টিপে কিছু-একটা মন্তব্য করছে। এবার ভালো মানুষের মতো তার পানে চেয়ে সে দেহ দিয়ে তার দেহ ঠেলে প্রশ্ন করল : 

—এ্যাদ্দিন যে তোর সোহরকে ছেড়ে ছিলি, মনে কষ্ট হয় নি? 

মেয়েটি শুধু চোখ ফিরিয়ে চাইলে তার পানে, কিছু বললে না। কিন্তু তাতে কিছু এসে গেল না, কারণ যথাসময়ে যথা-উত্তর দিল দ্বিতীয়া। 

–মনে করিয়ে দিয়ে আর ওকে বেচায়েন করিস্ না; এখন তো ওর সুখের দিন। একটু পরে তৃতীয়া বিবি ফের তার দেহে ঠেলা দিয়ে শুধাল : 

—ও নয়া বিবি; জেরা হা কর তো দেখি? 

—কেন, দাঁত দেখবি? 

—না জিব! 

কয়েক মুহূর্ত পরে হাসির হুল্লোড় পড়ল তাদের মধ্যে। শেষে প্রথম বিবি বললে : তাই তো, বোবা লাচার নাকি নয়া বিবি? দেখি, জেরা হা কর তো? মেয়েটির নিষ্কম্প ঠোঁট তেমনি রইল, চোখ কেবল ঘুরছে। 

প্রথম বিবি কিছুটা আশ্বস্ত হল, কিন্তু কিসে কে জানে। চোখ টেনে বললে : 

—নয়া বিবির বড় খাওফ মালুম হচ্ছে। তাই না বিল্কিচ বহিন? 

—বিবি! বিবি কেয়া, বোল্‌না বেগম! দ্বিতীয়া হঠাৎ সবাইকে ধমকে উঠল। 

—হাঁ ভাই, বেগম! বাদশাকা বেগন! 

—ঘোড়েকা বাদশা—ইয়ে ভী এয়াদ রাখা! 

—আহ্, তৃতীয়া বিরক্ত হবার ভান করল, আদবসে বাত করনা! 

—হাঁ হাঁ, আদব্‌সে বাত করনা। ঘোড়েকা বাদশা, উনকা পেয়ারা বেগম, উনকী সাথ আদবসে বেয়াদবি কর্না ঠিক হ্যায়। হ্যায় না গুলবহিন? —আর গুলবহিনের! গুলবহিনের মুখে তখন হাসির পেশোয়ারি-গুল ফুটেছে। 

.

বাইরে আনন্দের আগুন জ্বলছে, এখানে জ্বলছে হিংসার আগুন। হিংসা বিদ্বেষ এদের ধর্ম, এবং এরই উত্তাপে তারা বেঁচে থাকে : তাদের দেহে-তো সূর্যের আলো পৌঁছয় না। প্রত্যেকের ঠোঁটে কুটিল হাসি, সে-হাসির তলে জ্বালা, এবং এ-জ্বালা সঞ্জীবনী। পয়লা বিবি আস্তে বললে : 

—বিবি কী খুবসুরৎ, যেন আসমানের তারা! 

—হাঁ বহিন, বেহেশতকা হুরী, বিলকুল সাচ্চ বাত।

দ্বিতীয়া আবার তার দেহে ঠেলা দিলে। বললে : 

—বাতচিৎ কিছু কর তো…. ঘোড়েকা বাদশাকে খুউব পছন্ হয়েছে কি? 

তৃতীয়া হঠাৎ যেন বিরক্ত হয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল : 

—আহ, ওকে দিক করিস্ না বহিন। ঘোড়েকা বাদশার জন্যে দিলের মধ্যে সব মহব্বতের বয়েত বাংলে নিতে দে…. 

এরা মেয়েটিকে তেমন তীক্ষ্ণ কিছু বলছে না, কিন্তু বলছে অনেকক্ষণ ধরে, আর বলছে তিন জন মিলে। তাই হঠাৎ এবার দপ করে আগুন জ্বলে উঠল—ক্রোধের আগুন। মেয়েটির চোখ জ্বলে উঠল, মুখও খুলে গেল। সে হঠাৎ তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে তৃতীয়া বিবির অনাবৃত বাহুতে সজোরে তার ইঁদুরের মতো দাঁত বসিয়ে দিলে। 

এ-জন্যেই এরা হয়তো এতক্ষণ ধরে উন্মুখ হয়েছিল। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল বস্ত্রসার ক্ষুদ্র মেয়েটির দেহের ওপর, তারপর চুল টানাটানি হাতাহাতি এবং তার সঙ্গে কুৎসিত অশ্রাব্য গালাগাল অবিরাম চলতে থাকল : তাদের দাঁত ও চোখ বাঘিনীর মতো ধারালো ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। 

.

আকাশে মহারাত্রি; দূর তারকার দেশে মহানীরবতা ও নিষ্কলঙ্ক ম্লান দীপ্তি। সেখানের হাওয়াশূন্য পবিত্রতায় এই ধরণীর কলঙ্ককালিমা পৌঁছয় না, এবং সেখানের অকলঙ্ক নির্মলতাও এ-ধরণীকে স্পর্শ করে না। এ-দুটি পরস্পরের পানে হয়তো-বা কখনো চোখ তুলে চেয়ে দেখে, কিন্তু সে তাকানো নিষ্ফল হয় এই কারণে যে, তাদের মাঝে মহাদূরত্বের ব্যবধান। এবং হয়তো এই ব্যবধানই সৃষ্টির রহস্য ও অর্থ। 

তাই এরা জিঞ্জির চায়, মুক্তি চায় না। 

.

বাইরে তখনো উদ্দাম উল্লাস চলছে। সবার বাহবা পেয়ে ছোকরাটির মনে ও দেহে জোশ এসে গেছে, সে নাচছে আর নাচছে। লোকদের চোখ ঘোলাটে; কখনো-বা সে-ঘোলা চোখ গান ও ঘুঙুরের আওয়াজের মাদকতায় ও রাতের অন্ধকারের স্পর্শে যে-কামনা মানুষের হৃদয়ে প্রবলতম হয়ে ওঠে—তার ছোঁয়ায় জ্বলজ্বল করে উঠছে,–পাতালের না দেখা নারীরা কল্পনা হয়ে এসে তাদের রক্তদীপ্ত বুকে তৃপ্তিহীন বাসনা জাগিয়ে তুলছে,–এ রাতকে তারা শেষ হতে দেবে না। শেখ জব্বারের চোখ কিসের নেশায় এমন ঢুলছে? কে জানে। তার চোখ হয়তো অন্ধকারে ঘনিয়ে উঠেছে, যে-অন্ধকারে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম বেদনাকে হেসে উপেক্ষা করা যায়। তারপর এক সময়ে সে সবার অজ্ঞাতে উঠে ধীরে-ধীরে চলে গেল অন্দরমহলের দিকে হয়তো অন্ধকারের পথ পিচ্ছিল ও সুগম করতে; আর তার পেছনে চোঙওয়ালা গ্রামোফোনে মোহনগলায় মোহনসুরে অজ্ঞাত নারীর কণ্ঠ ককনিয়ে বাজতে থাকল। বাজুক—যত গান আছে যত রূপসীদের সোনালি ঠোঁটে সব আজ বাজুক, ওধারে আস্তাবলে ঘোড়াগুলো লাথালাথি করুক, সেদিকে কারো কান দিয়ে কাজ নেই। ঘোড়ার গায়ের ও নাকের গন্ধ এখানে নেই : এখানে ছড়িয়ে রয়েছে শেখ জব্বারের সেন্টের কড়া ঝাঁঝালো গন্ধ। কে কোথায় খেতে পাচ্ছে না, কার ঋণের বোঝা দ্বিগুণ হয়েছে, কার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে দারুণ যন্ত্রণায়, এখন তা স্মরণ করে লাভ নেই : সে-সব স্মরণাতীত। এই মুহূর্তে ক্ষমা কর সেই সওয়ারীকে, যে ভাড়া দিতে গিয়ে জোচ্চুরি করেছে, ভুলে যাও কে কবে তোমাকে কুষ্ঠ পায়ে লাথি মেরেছিল : এখানে এখন মোহনকণ্ঠে গান ও উত্তাল ঘুঙুরের শব্দের প্রভুত্ব। 

অন্দরমহলে ঢুকবার আগে শেখ জব্বার একবার ভাঙা টুলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে গুম-হয়ে-বসা জামালের নিস্তব্ধ দেহের কাছে ঘেঁষে এসে তাকে প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দিলে, অস্ফুটগলায় তাজ্জব হয়ে বললে : 

—এ ভাই জামাল মিঞা, দুনিয়াদারি কেয়া চিজ হ্যায়… 

জামাল মিঞা নাক দিয়ে গোঁ-গোঁ করে উঠল, তারপর অতিকষ্টে আবেশাচ্ছন্ন চোখ কিছুটা ফাঁক করে শেখ জব্বারের কাঁধে বাঘা-থাবা মেরে গোঙিয়ে বলে উঠল : 

—আরে বিবি কী গায় আর কী নাচে…দিল কত—ল্…সহসা সে চমকে জেগে উঠে চোখ মেলে চাইল, নেশা-জড়ানো গলায় এক গাল হেসে বললে : 

—আমার মুমে ঘোড়ার লাথি! এ তো বিবি নয়, বিবির বাপ! 

ওধারে কারা তাসের জুয়া খেলতে বসে হঠাৎ দাঙ্গা বাধিয়েছে। লাগুক, আজ দাঙ্গা লাগুক শতবার, রক্ত ফেনিয়ে উঠুক রাত্রির তমিস্রায়, এ রাতকে হেলা করা চলে না : উষ্ণ রক্তের সম্ভাষণ তাকে জানাতে হবে। শেখ জব্বারের চোখে শিখা, সে-শিখায় চেঙ্গিস খাঁর দুর্বার লোলুপতা,—ধু-ধু-করা মরুভূমি পদানত করবার প্রাসাদাকীর্ণ রাজধানী জ্বালিয়ে ছারখার করবার উদ্দাম লোলুপতা। সে দুনিয়াকে ডরায় না, এ মিট্রিকা পৃথিবীর মুখে শত ঘোড়া চার শ লাথি মারুক, তাহলে সে প্রাণ খুলে হাসতে পারে। 

.

মহাকলরবের পর একি মহানীরবতা! চিকে-ঘেরা অন্দরমহলে প্রগাঢ় স্তব্ধতা — মহারাত্রির মতো বিরাট শূন্য নীরবতা। 

সে-স্তব্ধতা নয়া বিবির চেতনাহীনতার স্তব্ধতা 

.

নতুন বিবির আগমনোপলক্ষে যে-আনন্দোল্লাস জেগে উঠছে এ-বস্তিতে, সে-আনন্দোল্লাস তার চেতনাহীনতায় ম্লান হল না। সামান্য দেশলাইর কাঠি যে-বিরাট অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে তোলে, দেশলাইর কাঠি পুড়ে ছাই হলে সে-অগ্নিকুণ্ড কি কখনো ম্রিয়মাণ কিংবা সমবেদনায় দীপ্তিহীন হয়? 

নয়া বিবির অলঙ্কার ছিঁড়ে গেছে, কিছু খসে গেছে; তার দাঁতে দাঁত লেগেছে, এবং যে-চোখ অবিরত সেকেণ্ডের কাঁটার মতো দ্রুত নড়ছিল কেবল, সে-চোখ এখন নিমীলিত তার দেহ হিংসার অনলে বিধ্বস্ত। 

পয়লা বিবি কেঁদে উঠল : 

—এয়া খোদা, মেরি বেটিকী ক্যা হাল হুয়া? 

সেই বহু বছরের কথা, হয়তো দশ, হয়তো চৌদ্দ, – পয়লা বিবির তখন প্রথম মেয়েটি জন্মেছিল। সে মেয়ে আর নেই, এখন শুধু তার স্মৃতি আঁকা রয়েছে মায়ের বুকে। তার ঠোঁটটা কি এমনি ছিল, এই নয়া বিবির ঠোটের মতো? আর চিবুকটা, কপালটা ঠিক যেন তেমনি ঝাউবনে অকস্মাৎ ঝড় উঠল, হু-হু করে বইতে থাকল হাওয়া। পয়লা বিবির অন্তর ঝিরঝির করে উঠল—অসার্থক ও অপূর্ণ মাতৃত্বের বেদনা ও স্মৃতির ভারে। 

—এ খোদা, তুনে কেয়া কিয়া….। 

খোদা কী করবে? 

.

বাইরে গ্রামোফোনে এবার একটি পুরুষের ভারি গলা গোঙিয়ে উঠল। ঘুঙুরের আওয়াজ থেমেছে; লোকদের হল্লা বেড়েছে দ্বিগুণ। গনি মিঞা গ্রামোফোনকে উপেক্ষা করে মহব্বতের গান ধরেছে। কিসের রসে তার অন্তর টলমল? হয়তো সারা আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ আঙ্গুরের মহব্বৎ ঝুলছে। …. 

চিকে-ঘেরা অন্দরমহল, ভরা স্তব্ধতা সেখানে এবং সে-স্তব্ধতার বিপুলকণ্ঠে এবার শেখ জব্বার-ঘোড়েকা বাদশা শাহি-গলায় বজ্রনিনাদ করে উঠল। সে-আওয়াজে ভাষা নেই, শুধু তাতে টাটকা গরম খুন টগবগ করছে। 

সে-রক্তমাতানো আওয়াজ বাইরেও ভেসে এল। আওয়াজ ভেসে এল বটে তবে কোলাহলের ঘূর্ণিপাকে তলিয়ে গিয়ে কথা হয়ে ভেসে এল ওপরে। কবে কোথায় ফয়েজ মিঞা থিয়েটার দেখেছিল, তারই একটা কথা হয়তো তার মনে পড়ে গেল। শরাবের খরস্রোত বইছে তার ধমনিতে, তা-ই নেশায় ঝুঁকে-থাকা দেহটা হঠাৎ টান করে কঠিন ও দরাজগলায় হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল : শশীর! সব শশীর লেকে খাড়া হো যাও ভাই! … 

আকাশে হয়তো গুচ্ছ-গুচ্ছ আঙ্গুর ফল ঝুলছে, তার প্রত্যেকটি মহব্বতের রসে ভরা। কেন অত আঙ্গুর, কেনই-বা ঝুলছে?—ঝুলছে শুধু নারীর দেহে ঝরঝর করে ঝরে পড়বার জন্যে। জয় হোক নারীর দেহের আর গুচ্ছ-গুচ্ছ আঙ্গুর ফলের, গনি মিঞাকে তোমরা সবাই বাহবা দাও, হাততালি দাও। 

আকাশে অন্ধকার, বস্তিতে পৃথিবীর মানুষের প্রাণের কোলাহল : মানুষের প্রাণ যেন বেলে মাছের মতো কালো ধরণীর বুকে কিলবিল করছে। কোলাহলের মাঝে আবার একটি কণ্ঠ আর্তনাদ করে উঠল : শশীর, নাঙ্গা শশীর লেকে খাড়া হো যাও! 

কিন্তু আকাশে খণ্ড চাঁদ এরা দেখেছে, তলোয়ার দেখে নি। ওপরে আকাশময় গুচ্ছ-গুচ্ছ আঙ্গুর ঝুলবে, ঝুলবে চিরকাল, ঝুলবে ওই খণ্ড চাঁদের বক্রতায়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *