রক্ত

রক্ত 

সন্ধ্যা থেকে পানের দোকানটার সামনে একটা টুলে স্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছে আবদুল। মনে অদ্ভুত শূন্যতা, এবং সে-শূন্য মনে পাশের হোটেলের কোলাহল অতি বিচিত্র ও রহস্যময় ঠেকছে। কখনো পানওয়ালাটা হঠাৎ ছাড়া গলায় তীক্ষ্ণস্বরে হেসে উঠলে সে চমকে উঠছে, বিস্তৃত শূন্যতার মধ্য থেকে তার মন বিহ্বল হয়ে বেরিয়ে আসছে, তারপর কী যেন খুঁজে খুঁজে না পেয়ে আবার শূন্য হয়ে উঠছে। 

রাস্তার ওপাশে গুদামের মতো একটা বন্ধ ঘর; তার এধারে গ্যাসপোস্টের তলে ধোঁয়ার মতো রহস্যময় ক্ষীণ আলো। সেদিকেই আবদুলের ভাষাশূন্য চোখ নিবদ্ধ হয়ে ছিল। এবার হঠাৎ তার সে চোখ কেঁপে উঠল—কিছুটা ভয়ে কিছুটা বিস্ময়ে। ওধারের ফুটপাথ দিয়ে একটি কালো ছায়া আবছা অন্ধকারে মিশে নিঃশব্দে গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে, আর তাকে ঘিরে রয়েছে প্রেতাত্মার মতো বীভৎস সংগোপনতা। শীতল ভয়ে স্তব্ধ হয়ে এল তার দেহ, এবং তাই প্রাণের উষ্ণতার সন্ধানে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাল ওধারে, দেখলে উজ্জ্বল আলো, চকচকে আয়না, আর সঙ্গীর সাথে কথা কইতে কইতে হাসতে থাকা পানওয়ালাকে। 

শান্ত হয়ে আবদুল আবার ওধারে তাকাল, তাকিয়ে এবার বুঝলে যে, নুলোটা গেল। ওদিকে কোথাও হয়তো নুলো লোকটার মাথা গুঁজবার আস্তানা রয়েছে, দিনান্তে সেখানেই সে ফিরে গেল। রোজই এমনি সময়ে সে যায় এদিক দিয়ে। 

হঠাৎ বিড়ির কড়া গন্ধ নাকে লাগল। মুখ ফিরিয়ে আবদুল চেয়ে দেখলে একটি লোক তার পাশে টুলের ওপর বসে ঝুঁকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তার পানে। ও তাকাতেই সে শুধাল : 

—খালাসি? 

আবদুল মাথা নেড়ে জানালে, হ্যাঁ। 

—চুক্তি মিতিছে না? 

কয়েক মুহূর্ত আবদুল কিছু উত্তর দিলে না, তারপর আস্তে-আস্তে বললে, না। এ কথা বললে না যে চুক্তি সে এখন পাবে না, খারাপ স্বাস্থ্যের জন্যে তাকে বরখাস্ত করে দিয়েছে। এবং এ-জন্যেই কেমন একটি ব্যর্থতা তার বুকে এসে বিঁধছে, আর সে-ব্যর্থতা থেকে ছড়িয়ে পড়ছে শূন্যতা। হঠাৎ সামনে যেন পথের সন্ধান মিলছে না, ধূসর মরুর মতো শূন্যতা ধু-ধু করছে। 

কিন্তু এবার হঠাৎ মনের সে-শূন্যতা কাটতে লাগল। একটু আগে পঙ্গুকে যেতে দেখছে সামনে দিয়ে, তাই বিশ্বাস জমতে লাগল ধীরে-ধীরে। এবং একটু পরে হাওয়ায় ভেসে শামি কাবাবের গন্ধ নাকে এসে লাগলে সে স্বচ্ছন্দ মনে উঠে পড়ল, তারপর হোটেলে ঢুকে ভিড়ের মধ্যে এক ফাঁকে বসে পড়ে শীঘ্র জীবনের কোলাহল ও প্রাণের স্পন্দনের মধ্যে ডুবে গিয়ে অদূরে তার জীবনের তীর দেখতে পেলে। 

খাওয়া শেষ করে আবার বাইরে এল সে, দেখল, তখনো সেই লোকটি তেমনিভাবে টুলের ওপর বসে। আবদুল যখন এখানে বসেছিল, তখন শূন্যতার দীনতা তাকে ঘিরে ছিল বলে লোকটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তার পানে, কিন্তু এখন নীরব উপেক্ষায় সে আত্মকেন্দ্রিক বলে লোকটা তার পানে চেয়ে সন্দিগ্ধ ও দুর্বলভাবে হাসল। উত্তরে আবদুল না-হাসার মতো হাসলে, অথচ তাকে পান খাওয়াল, বিড়ি দিল। 

—নাম কী?

—আক্কাস। 

মনে পড়ে জাহাজের কাপ্তানের উদ্ধত দৃষ্টি। এবার তাকাতে গিয়ে আবদুল সে-রকম দৃষ্টি অনুভব করলে নিজের চোখের মধ্যে, এবং আক্কাসের চোখে দেখল স্পষ্ট অসহায়তা। তাকে অনুসরণ করতে বলে দ্রুতপায়ে হাঁটতে শুরু করলে। 

সে আস্তানায় গেল না। হোটেল থেকে কিছু দূরে একটি খোলা জায়গার ধারে এসে রাস্তা থেকে নেবে ঘাসের ওপর বসলে, আক্কাসকেও বসতে বললে। ওর দ্রুতগতির রেশ ধরে চলে-চলে আরো দুর্বল হয়ে উঠেছে লোকটা, পাশে সে বসল বটে কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। দীর্ঘ সাত বছর বিশাল সমুদ্রের বুকে বাস করেছে আবদুল, এবং জাহাজের ক্ষুদ্র দুনিয়ায় নিবিড়ভাবে অনুভব করেছে সর্বশক্তিমান কাপ্তানের ব্যক্তিত্ব আর শক্তিত্ব, জেনেছে সারেঙ্গ—টেণ্ডলের পদস্থ-ক্ষমতা। এবং জাহাজের ক্ষুদ্র জগতে লস্কর হিসেবে তা অনুভব করেছে ও জেনেছে বলে স্পষ্ট-হয়ে ওঠা একটি বাসনা অতৃপ্ত রয়ে গেছে। কিন্তু আক্কাসের দুর্বলতায় তার সে-বাসনা যেন রক্তের স্বাদ পেল। 

হঠাৎ আবদুল হাসল। বললে : 

—আমাদের সেখানে মানুষে নাকি টেকা লুভূতেছে— 

সে শুনেছে সাদা মানুষ ও খাকি পোশাকে তাদের দেশ ভরে গেছে, আর অর্থোপার্জনের অসংখ্য পথ খুলে গেছে, এবং মানুষ অজস্র টাকা লুটছে। অন্যের অর্থ লাভের কথায় শাণিত ঈর্ষায় হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে থাকে, কিন্তু দেশে গিয়ে সে-ও টাকা লুটতে পারে বলে অক্ষম আক্কাসের কাছে সহজে সে-কথা শোনাতে পারছে, এবং নির্মল হাসিও হাসতে পারছে। তাছাড়া বঞ্চিতের কাছে সাফল্যের কথা শোনানোতে যে এক লোনা স্বাদ, সে-স্বাদও লাগছে ভালো। 

—টেকা পেলেই আমি দেশে চলে যাব 

তার শরীর ভেঙে গেছে বলে তাকে বরখাস্ত করে দিয়েছে বটে, কিন্তু জাহাজী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আগাম মায়না পাবে কিছু। পেতে তা নিয়ে সে দেশে যাবে, গিয়ে—আবদুল একটু থামল। গিয়ে টাকা লুটবে? কিন্তু বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা কথা মনে হল। এ-কথাও সে শুনেছে যে দেশের খামার শূন্য, দেশে মানুষ মরছে, মুহূর্তে-মুহূর্তে কুকুরের মতো মরছে, আর মৃতের স্তূপের ওপর বাকি লোক অর্থের স্তূপ গড়ছে। কিন্তু আবার তার মনে উষ্ণ রক্তের ঝলক এল, তীক্ষ্ণ গলায় হেসে সে যেন নিজেকে নিরপরাধ ঘোষণা করলে : 

—গিয়ে আমিও টাকা লুডব আর কী-

আক্কাস নীরব। বিড়ির তৃষ্ণায় তার ভেতরটা খাঁখাঁ করে উঠলেও মুখ ফুটে আবদুলের কাছে বিড়ি চাইতে সাহস হচ্ছে না। কিন্তু আবদুল হঠাৎ কাশতে শুরু করলে তার দৈহিক দুর্বলতার মধ্যে আক্কাসের মুখে কথা এল, আস্তে সে বিড়ি চাইল। 

আবদুল তাকে বিড়ি দিলে, নিজেও একটা ধরাল। তারপর অনুভব করলে, মনে উষ্ণতা থাকলেও দেহে কেমন শীত-শীত লাগছে, হঠাৎ একটু দুর্বলতাও ঠেকছে। গ্রীষ্মের শেষ, হয়তো হিম পড়তে শুরু করেছে। 

—চা খাবে? 

বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে আবদুল উঠে দাঁড়াল। 

চায়ের দোকানে আলোয় এবার ওরা পরস্পরের পানে তাকাল। আক্কাসের চোখের দীনতা, আবদুলের চোখে ঈষৎ ক্লান্তির ছায়া থাকলেও আত্মবিশ্বাসের স্থিরতা, কিছু ঔদ্ধত্য। আক্কাস দৃষ্টি সরিয়ে নিলে আস্তে। কিন্তু ওর চোখের দীনতা থেকে নিজের মনে কেমন দৃঢ়তা বোধ হয় বলে আবদুল তার পানে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। তারপর শুধাল : 

—আর কিছু খাবে? 

শুনে আক্কাস চোখ তুলে চেয়ে কিছু ইতস্তত করলে, তারপর হঠাৎ ক্ষুধার তীক্ষ্ণতায় তার চোখ ধারালো হয়ে উঠল। সে আস্তে বললে : 

—আজ রাতে কিছু খাই নি– 

কিছু খাবার দিতে বললে আবদুল। কিন্তু তার ভেতরটা কেমন শক্ত হয়ে উঠল। মানুষের ওপর কর্তৃত্ব করতে আত্মপ্রসাদ রয়েছে, কিন্তু নিঃস্বর ঘনিষ্ঠতায় অন্তরে কালো ছায়া পড়ে। একটু পরে, হাসিতে সে সহজ হতে চেষ্টা করলে, করে বললে, 

—আমি উপাস থাকতে পারি, কিন্তু চা না খেয়ে থাকতে পারি না। 

খাবার নিয়ে আসছে। আক্কাসও সহজভাবে হাসতে পারল না। 

ও যখন খেতে শুরু করলে তখন তার মুখে কেমন একটা কুৎসিত আওয়াজ হতে লাগল। সে-আওয়াজ ঢাকতে গিয়ে আবার হাসল আবদুল, হেসে বললে : 

—শুনেছি, ষোল টেকায় মুরগি বিকা যাচ্ছে আমাদের দেশে। তাজ্জব কথা! 

কুকুর হিংস্র স্বার্থপরতায় খেতে-খেতে পাশের বঞ্চিতরাখা কুকুরের ওপর হঠাৎ খেঁকিয়ে না উঠে হেসে উঠল। যেহেতু আবদুল তাকে খাওয়াচ্ছে, সেহেতু খেঁকিয়ে না উঠে হাসলে আক্কাস। আবদুল এবার নীরব হয়ে রইল। 

কিন্তু চায়ে চুমুক দিতে-দিতে সে সহজ হয়ে উঠল। একবার আস্তে শুধাল : 

—বউ আছে? ছেলেপুলে? 

—না। 

ছোট সংক্ষিপ্ত উত্তর। আবদুল কি অসন্তুষ্ট হল। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে সেই ভালো গো—বলে আক্কাস হাসল। আবদুল আড়চোখে তাকাল তার পানে, দেখলে যে তার হাসিতে বিস্ফারিত মুখের মধ্যে চোখ দুটি হাসিশূন্য নিষ্কম্প : অন্তরঙ্গতার তলে বৈরিতা যেন দৃঢ় হয়ে রয়েছে। 

আবার তারা পথে নাবল। নেবেই আবদুলের সর্বপ্রথম চোখে পড়ল বাইরের অন্ধকার স্বচ্ছ হয়ে এসেছে। তার মনে ছায়া ঘনিয়েছে, আর বাইরে অন্ধকার কিছু কেটেছে, আকাশে কৃষ্ণপক্ষের ভগ্ন চাঁদ উঠেছে। কিছু পরিবর্তন, আর সে-পরিবর্তন আকাশময় বলে মন ঘনায়মান ছায়া থেকে দূরান্তের অন্য কোনো ছায়ায় উড়ে গেল। দীর্ঘদেহ আক্কাস দীর্ঘ পদক্ষেপে পাশে হাঁটছে, আর অর্থহীন কথা কইছে অনবরত। তবে ডান ধারে যে তাদের মিলিত ছায়া পড়েছে, সে-ছায়ার পানে আড়চোখে চেয়ে আবদুল ভাবতে লাগল অন্য কথা। একটা স্মৃতি যেন পাশে-পাশে ছায়া ফেলে চলতে শুরু করেছে, আর আবদুলের মনের চোখের দৃষ্টি সেদিকে। চলা থেকে চলার কথা মনে পড়ছে। সাত বছর আগে সে যখন লস্কর হবে বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে, তখন তার মা চুল দিয়ে তার মুখ মুছিয়ে দিয়েছিল—যাতে কোনো বিপদ তাকে স্পর্শ না করতে পারে। 

না, কোনো বিপদ তাকে স্পর্শ করে নি, শুধু আজ তার দেহে ব্যাধির ক্লান্তি। কিন্তু তার মা আজ বেঁচে নেই বলে বাঁচার কথা নূতনভাবে মনে জাগল। সে বাঁচবে? কাকে এই প্রশ্ন করবে, কে দেবে এর উত্তর? পাশে তো হাঁটছে আক্কাস, কিন্তু এখন সে নীরব হয়ে রয়েছে বলে পদধ্বনি ছাড়া তার আর অন্য কোনো অস্তিত্ব অনুভূত হচ্ছে না, আর সে পদধ্বনিও বিগত দিনের অস্পষ্ট পদধ্বনির মতো ঠেকছে। তবু ভালো, মানুষের হৃদয়ে স্মৃতি আঁকা থাকে। আর তবু ভালো, সে-স্মৃতির কথায় শীতলতা না এসে বরঞ্চ বেদনায় ভরে গেল মন। কিন্তু এ-বেদনাও কেমন অস্পষ্ট, ধোঁয়াটে, আর নিঃশব্দ : হয়তো এ-বেদনার প্রতিকার নেই বলে তা কাছে আসছে না, স্পষ্টতায় ধরা দিচ্ছে না, দূর দিগন্তে আবছা হয়ে উড়ছে। 

নিঃস্ব শূন্যতায় আবদুলের মন ভরে উঠছে এমন সময় আক্কাসের গলা শোনা গেল। 

—ওই যে—ওটা আমার ঘর। আবছা অন্ধকারে ঢাকা বস্তিগুলোর পানে আঙ্গুল দেখিয়ে সে আবার বললে, বিবি নিয়ে থাকি সে ঘরে। ছেলেপুলে নেই। 

হঠাৎ অন্য জগৎ থেকে একটা নতুন কথা কানে এসে লাগল যেন। আবদুল থমকে দাঁড়াল। 

—বসবে? একটু থেমে আক্কাস গলা ক্ষীণ করে আবার বললে, ঘর মোটে একটি, তাই ঘরে বসাতি পারব না। একটা দড়ির খাটিয়া আছে, সেইটে বার করে দিচ্ছি—। গরমির রাত, আর জোছনাও উঠেছে—বসবে গো? 

আবদূল দেহে ক্লান্তি বোধ করল আবার। তাই রাজি হল, আস্তে বললে, আচ্ছা। 

খাটিয়া বের করলে আক্কাস। বসতে গিয়ে আবদুল শুয়েই পড়ল, দেখে আক্কাসের মন আরো সহজ হয়ে উঠল। সেও আস্তে শুয়ে পড়ল পাশে। 

—জানো গো দোস্ত, এই খাটিয়া আমাকে পেরাই বার করতি হয়। বিবির সঙ্গে ভাব থাকলি তো ভালো, নইলে এটি নিয়ে এসে আমি এখানেই শুই। তা, বিবির মেজাজ আজকাল চালের বাজার হয়ে উঠেছে, ছোঁয়া যায় না গো। একটু থেমে এবার কেমন পিচ্ছিল পুলকে ফিসফিস করে বললে, বিবির মেজাজ আজকে কিন্তুক বড্ড মিঠে। তা মিছিমিছি কি খাট্টা হয় দোস্ত, খেতে না পেলি পরে—বলে হঠাৎ এমনভাবে থেমে গেল যেন ব্যথা উপচে পড়ল। 

আবদুল নীরব হয়েই রইল। তবে তার ভালো লাগল, আর আক্কাসের গায়ের স্পর্শের উষ্ণতা থেকে ধীরে-ধীরে অন্তরঙ্গতা জমতে লাগল। আক্কাস নিঃস্ব নয়, তার সংসার রয়েছে জীবনে। 

রাত্রি অনেক হয়েছে। দূরে কোথায় এত রাতেও কী একটা কল চলছে, তার একটানা আওয়াজ ছাড়া চারধারে প্রগাঢ় নীরবতা। এবং এ-নীরবতার মধ্যে আবদুলের সারা অন্তর ভরে এল, ভরে এল রাত্রির মতো। থেকে-থেকে আক্কাস কথা কইছে, তার কিছুটা কানে আসছে, কিছুটা আসছে না, আবার কিছুটা তার মনের বিস্তৃত শান্তিতে ভেসে যাচ্ছে। 

—বিবিকে ঠেঙ্গাই বটে, কিন্তুক বল দেখিনি দোস্ত, বুকে কি লাগে না? 

আবদুল এবারো নীরব। তবে এবার শান্তির বুক থেকে জেগে উঠে সারা অন্তর বিদ্রোহীর মতো কইতে চাইল, যে, একদিন তার মমতার হৃদয় ক্ষত হয়ে সে-ক্ষত দিয়ে রক্ত ঝরেছিল—রক্ত। কিন্তু এখন—যেন সারা আকাশ বেয়ে স্নেহ ঝরছে, স্নেহ। 

অবশেষে আক্কাসও পূর্ণ নীরবতায় ডুবে গেল, এবং তারপর হঠাৎ এক ঝলক হাওয়া বইল বলে আবদুলের মনে হল সে-হাওয়ায় আক্কাস ভেসে গেল, রইল শুধু বিস্ময়কর নির্বাক চাঁদ। 

অনেকক্ষণ পর আক্কাস আবদুলের দেহে কনুই দিয়ে ঈষৎ ঠেলা দিলে, প্রথমে আস্তে, সাড়া না পেয়ে তারপর জোরে। 

–কী? 

একটা কথা।

—কী কথা? 

— আচ্ছা গো দোস্ত, তুমি তো গোটা দুনিয়া ঘুরেছ। বল দেখিনি, কোন্ দেশের মেয়েছেলে সবচেয়ে খোবসুরত? 

আবদুল ভাবল। কিন্তু তার অন্তরে ভাষাশূন্যশান্তি সাগরের মতো বিশাল বলে তা অতিক্রম করে বন্দরে-বন্দরে পৌঁছতে মনের সময় লাগল। তারপর অনেক বন্দর সে খুঁজলে, কিন্তু সঠিক উত্তর পেল না। কামনায় অন্ধ হয়ে সে বন্দরে নেবেছে, তখন রূপ নজরে পড়ে নি। অবশেষে কার মুখে শোনা কথা চালিয়ে দিলে : 

—মিছরের। 

—কেমন দেখতে? 

আবার আবদুল ভাবল, কিন্তু এবারো সঠিক উত্তর পেল না। তাই বললে : 

—হুরের মতোন। 

হুরের রূপ আক্কাসের জানার কথা। তাই না জানা সত্ত্বেও আর কিছু বললে না এ-সম্বন্ধে, কেবল রসগ্রহণের প্রমাণস্বরূপ দাঁতের ফাঁকে একবার আওয়াজ করে নীরব হয়ে গেল। তারপর দুজনেই নির্বাক। 

কিন্তু আক্কাসের কথা আবদুলের ভেতরটা হঠাৎ ঝলকিয়ে দিয়ে গেল। প্রথমে তার মনে ধূসরতা ঠেকল, আর তা তীররেখাশূন্য সাগরের বুকে জাহাজীদের মধ্যে শুষ্ক নীরস অথচ কামনাকাতর দিনগুলোর ধূসরতার মতো, তারপর মনে যে-ধোঁয়া লাগল, সে-ধোঁয়ার মধ্যে গাঢ় হয়ে জমতে লাগল উত্তেজনা। পূর্বের কথা মনে পড়ে। জাহাজ পুরুষ : সাগরে নারী নেই। কিন্তু এখানে সাগর নেই : এখানে নারী রয়েছে। আড়চোখে সে একবার আক্কাসের আবছা বন্ধ ঘরের পানে তাকাল। সে-ঘরে অন্ধকারে একটা নারী হয়তো পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। 

—এই, আবদুল ওর গায়ে ঠেলা দিলে। কিন্তু আক্কাস হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছে। ওই ঘরে তার স্ত্রী রয়েছে, তাই সে ঘুমোতে পারে। 

আবদুল তাকে আর ডাকলে না, একাকী বিড়ি ধরাল। কিন্তু তার মনে দুঃস্বপ্নের মতো কথা ঘুরতে লাগল, নিবিড়ভাবে অথচ দ্রুতভাবে, আর ঝাঁঝালো অনুভূতিতে দেহ উষ্ণ হতে উষ্ণতর হতে লাগল। 

রাত্রি তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, আর আবহাওয়া কেমন শীতল হয়ে উঠেছে। আবদুল ঘুমিয়ে পড়েছিল, হঠাৎ কাশতে কাশতে জেগে উঠল। প্রথমে সে কাশির মধ্যে হঠাৎ জোরে কেশে উঠে ধমকটা থামাতে চাইল, কিন্তু তা অদম্য হয়ে উঠল, সে কাশতে থাকল প্রচণ্ডভাবে। কাশতে কাশতে গলা শুকিয়ে এল, আওয়াজটা কর্কশ ও কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে উঠল, আর কেমন চেতনাশূন্য হয়ে উঠল দেহের ওপরের অংশ। অবশেষে কাশির ধমক যখন থামল তখন দেহভাঙা অপরিসীম ক্লান্তির মধ্যে সে হঠাৎ অনুভব করলে, উষ্ণ তরল পদার্থ গলা বেয়ে মুখে উঠে গালের দু পাশ দিয়ে নীরবে ঝরছে। কী? রক্ত? ক্লান্তির ওপর একটা চরম অসহায়তার শীতলতায় শ্রান্ত বুক জমে গেল। সভয়ে সে চোখ খুললে, দেখলে মুখের ওপর কী একটা অস্পষ্ট আলো উপুড় হয়ে রয়েছে। তারপর বুঝলে, চাঁদ, আকাশের বুকে এখনো নীরবে ভাসছে চাঁদ। 

অনেকক্ষণ সে অসাড় হয়ে রইল। বিরাট সৌধ কোথায় যেন গড়ে উঠেছিল, হঠাৎ ধূলিসাৎ হয়ে ব্যর্থ-রক্তে গড়িয়ে পড়ল : এরপর আর কিছু নেই। এমন সময় আক্কাস একটু নড়ল, হয়তো পাশ ফিরতে চায়। আবদুল তাকে ক্ষীণ গলায় ডাকলে। 

কেন গো দোস্ত? 

জীবনের প্রায়ুর্যে উচ্ছলকণ্ঠের সে-প্রশ্নের উত্তর আবদুল সঙ্গে-সঙ্গে দিতে পারলে না। কয়েক মুহূর্ত পরে অচেনা এক গলায় আস্তে বললে, 

খুন, খুন! 

প্রথমে আক্কাস কিছু বুঝলে না, তারপর ধড়মড়িয়ে উঠে দেশলাই জ্বালালে, জ্বালিয়ে তার আলোতে দেখলে মানুষের মৃত্যু হয়েছে, শুধু নীরব সাফল্যে চকচক করছে কাঁচা রক্ত। কিন্তু মানুষের চোখে এখনো পাণ্ডুর প্রাণের বীভৎসতা দেখে দ্বিতীয়বার সে ধড়মড়িয়ে উঠল, উঠে হাঁকাহাঁকি করে ঘরের দরজা খোলালে, কুপি জ্বালালে, পানি নিয়ে আবার বাইরে এসে তার মুখ ধুইয়ে দিলে, তারপর তাকে ঘরে নিয়ে গেল ধরাধরি করে। 

বহুক্ষণ চেতনাহীনের মতো পড়ে থেকে একসময়ে আবদুল চোখ মেলে তাকাল, দেখলে বিস্মৃতির মতো আবছা অন্ধকার ঘন হয়ে রয়েছে চারধারে, আর ওপরে কী যেন ঝুলছে। 

—আমার বিবি। তোমাকে হাওয়া করছে। 

একটা ক্ষীণ আওয়াজ এল বহুদূর থেকে। তবু সে সেদিকে তাকাল, তাকিয়ে দেখলে পরিচয়ের পাথরে গড়া একটা মুখ, আর সে-মুখে একজোড়া চোখ তীক্ষ্ণ গতিতে কালের মধ্যে দিয়ে স্নেহের উৎসের সন্ধানে ছুটছে। 

আবদুল চোখ বুজলে। কিন্তু কোথায় স্নেহের উৎস? শ্রান্তপায়ে মস্তিষ্কের অলিগলিতে মন হাঁটছে খুঁজতে-খুঁজতে, কোথাও দেখলে, নদী রয়েছে বটে তবে নিষ্করুণ শুষ্কতায় ধু-ধু করছে দিগন্তব্যাপী, কোথাও—বা অনাত্মীয় নিঃসঙ্গতা তীররেখাশূন্য নীল সাগরের মতো বিস্তৃত হয়ে রয়েছে। আবার কেউ কোথাও মাকে ডাকলে, কিন্তু তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, ওপারে ঘন অন্ধকার নেবেছে, আর এধারে খেয়াঘাটে লোকও নেই নৌকাও নেই। ওধারে একদল লোক ঝুড়ি-ঝুড়ি অর্থ নিয়ে গেল—তাই দিয়ে নাকি তারা সাতমহলা বাড়ি তুলবে। শেষে এক জায়গায় দেখলে একটি মিছরের মেয়ে উলঙ্গ হয়ে শুয়ে চোখ বুজে হাসছে, অথচ একটা ক্ষ্যাপা কুকুর মানুষের মতো ছুটে আসছে তাকে কামড়াবার জন্যে, এবং দেহের কোন্ অংশে কামড়ায় সে—তা দেখবার জন্যে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে একদল খালাসি ঝুঁকে তাকিয়ে রয়েছে ফেনায়িত ঢেউয়ের পানে। কিন্তু কোথাও বিবিকে দেখতে পেলে না সে। 

আবার আবদুল চোখ খুললে, দেখলে তেমনি কী যেন ঝুলছে ওপরে। 

—কেমন লাগছে দোস্ত? 

–বিবি—তোমার বিবি কই? 

কোনো উত্তর এল না। দূরে নীরবতা। 

এখানেও তাহলে বিবি নেই। কিন্তু কোথায়? আবার মনের যাত্রা শুরু হল : ক্লান্তিতে ও ব্যর্থতায় ভেঙে-ভেঙে পড়ছে, তবু, চলছে, চলছে। একবার শুনেছে যে সে আছে, তাই এত ক্লান্তিতেও দৃঢ় আশা যে মিলবে, শুধু পরিশ্রম করে আরেকটু পথ চলতে হবে। কিন্তু এবার চলতে গিয়ে দেখলে সারেঙ্গের চোখ রোষায়িত, আর খররোদের তলে ডেক ধুতে ধুতে তার পিঠ কন-কন করছে ব্যথায়। 

আবার চোখ মেলে তাকাল আবদুল, এবার তার চোখে হিংস্র ক্রোধ। 

—কই, কই? 

—কী দোস্ত?

–বিবি? 

সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর এল না। তারপর শোনা গেল : 

—দেখতি পাচ্ছ না? ওই যে সে শিয়রেতে বসি হাওয়া দিচ্ছে! 

সমস্ত শক্তি দিয়ে এবার আবদুল তাকাল ওপরের ঝুলন্ত ছায়ার পানে, দেখলে, কী একটা কালো মতো ঘোড়ার ক্ষুরের ঢঙে পেঁচিয়ে রয়েছে, আর পাখা নড়ছে। তারপর দেখলে কালো অর্ধবৃত্তের মধ্যে একটা মুখ, চোখ, ঠোঁট। নাক-ও, আর সে-নাকে নাকছাবি। 

কিন্তু সেখানে সে বিবিকে পেলে না। না পেয়ে এবার সে মৃতের মতো চোখ বুজলে, আর একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে যেন প্রাণের মতো কেঁপে-কেঁপে বেরিয়ে গেল জীবনের শেষ আশা : শুধু জমাট হতাশায় সে স্তব্ধ হয়ে রইল। কিন্তু তীক্ষ্ণতম ব্যর্থতায় এবার তার হৃদয়ে যে-ক্ষত হল, সে–ক্ষত দিয়ে ঝরতে লাগল রক্ত, ঝরতে লাগল গলগলিয়ে, এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন অন্তর তার চেয়ে আরো অন্ধকার ভবিষ্যৎকে প্রদীপের শেষ-কম্পনের মতো শুধাল : এমন দিন কি কখনো আসবে যখন নিবিড় স্নেহমমতায় ডুবে গিয়ে সে বলতে পারবে যে, বিগত কোনো একদা স্নেহভালোবাসাশূন্য শুষ্ক প্রান্তরে তার নিঃস্ব রিক্ত হৃদয় দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত ঝরেছিল, রক্ত? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *