ভয়
০১.
রেলপথ ও বাসরাস্তা থেকে অনেক ভেতরে যেখানে গোরুর গাড়ি কিংবা সাইকেল ছাড়া যাওয়া রীতিমতো কষ্টসাধ্য, সেসব গ্রামে এখনও এমন সব অলৌকিক ঘটনা ঘটে যা প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া আর কেউ জানে না। খবরের কাগজে বা কোনো লেখকের কলমে সত্য ঘটনা বলে তা ছাপা হয় না।
নদীয়া জেলার এমনি একটি গ্রাম মুকশিম পাড়া। ঝোপ-জঙ্গল, বাঁশঝাড়, ভাঙাচোরা বাড়ি, পুরনো মসজিদ, জীর্ণ কবরখানা আর গোটা দশেক পুকুর ছাড়া আর কিছু নেই। তবু এখানেই বংশানুক্রমে বাস করে চাষাভুষো, মিস্ত্রি-মজুর আর মধ্যবিত্ত মানুষ।
গ্রামে একটা মারাত্মক প্রবাদ–না শুধু প্রবাদ নয়, বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে গ্রামে কোনো অপঘাত মৃত্যু হলে গভীর রাতে একটা অদ্ভুত হাড়-কাঁপানো ডাক শোনা যায়। সে ডাক যে কিসের আজ পর্যন্ত কেউ তা বলতে পারেনি। কেউ বলে কোনো পাখির ডাক, কেউ বলে অন্য কিছুর। পাখির ডাক যদি হবে তাহলে কেবল ঐ অঘটন ঘটার দিনেই? পাখির এমন অলৌকিক ক্ষমতা?
যাই হোক এ ডাকের রহস্য ভেদ করার সাহস আজ পর্যন্ত কারো হয়নি। সবাই ভাবে একটা কথাই-কী দরকার?
শুধু এইটুকুই নয়–ঐ ডাক শোনা গেলে সে বছর গ্রামে তিনটে অপঘাতে মৃত্যু হবেই। তার মধ্যে দুজন মানুষ, একটা প্রাণী।
যেবার হরেকেষ্ট কামারের বৌটা শাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া করে, এক ক্রোশ পথ হেঁটে গিয়ে লাইনে মাথা দিল, সেবারও রাতের অন্ধকারে বন-বাদাড় কাঁপয়ে ঐ ডাক শোনা গিয়েছিল। আর তার তিন মাস পর জনার্দন চক্রবর্তীর ছোটো ছেলে সন্ধ্যেবেলায় কাটোয়া থেকে তার ঘোড়া ছুটিয়ে আসতে আসতে পোলের ওপর উঠেই মুখ থুবড়ে পড়ল। আর উঠল না। ঘোড়া আর ঘোড়সওয়ার দুজনেই শেষ। অথচ ঘোড়াটা ছিল যেমন তেজি, ছেলেটাও ছিল তেমনি জোয়ান। সে রাত্রেও নাকি ঐ ডাক শোনা গিয়েছিল। চমকে উঠেছিল গ্রামের লোক– আবার কে গেল? চমকাননি শুধু জনার্দন চক্রবর্তী। বাড়িতে বসে হঠাৎ অসম্ভব কিছু একটা দেখেছিলেন। না, চোখের ভ্রম নয়। তখন ঠিক সন্ধ্যে। ইজিচেয়ারে শুয়ে তিনি তামাক খাচ্ছিলেন। হঠাৎ বাইরে শুনলেন ঘোড়ার খুরের শব্দ। সে শব্দ তার চেনা। বুঝলেন কাটোয়া থেকে ছেলে দেখা করতে আসছে। আনন্দে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। শব্দটা এগিয়ে আসছে বাইরে থেকে দেউড়ির ভেতর। কিন্তু কী আশ্চর্য ঘোড়াটা দেখা যাচ্ছে না। শব্দটা আরও এগিয়ে এল–আরও। থামল দরজাটার সামনে।
তারপর যেন দেখলেন একটা কালো ঘোড়া দাঁড়িয়ে। তার চোখ দিয়ে জল অর মুখ দিয়ে ফেনা গড়িয়ে পড়ছে।
তিনি হাঁকলেন–ভৈরব! সোমশঙ্কর কোথায়? তুমি একা কেন?
উত্তরে কাঁপতে কাঁপতে ভৈরব মাটিতে পড়ে গেল।
চিৎকার করে উঠেছিলেন জনার্দন চক্রবর্তী। আলো নিয়ে ছুটে এসেছিল বাড়ির লোকজন। কিন্তু কাছেপিঠে ঘোড়ার চিহ্নমাত্র নেই।
এই গ্রামেরই একটা ঘটনা শুনেছিলাম আমার প্রতিবেশীকন্যা রুমার মুখে। আমার বাড়ি বর্ধমান জেলার একটা মহকুমা শহরে। রুমা সেবার পার্ট টু পরীক্ষা দিয়ে তার মামার বাড়ি ঐ মুকশিম পাড়ায় গিয়েছিল দিন পনেরোর জন্যে। গ্রামের ওসব কাহিনী তার জানা। মাথা ঘামায় না বিশেষ। মামীমাকে বলে–এত বার আসি, একবারও ঐ ডাক শোনার সৌভাগ্য হলো না।
মামীমা বলে ওঠেন–সে ডাক শুনে কাজ নেই মা। থাকো শহরে, লেখাপড়া, গানবাজনা নিয়ে। তুমি কি করে বুঝবে কী ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতে হয় আমাদের! একটা অপঘাত মৃত্যু আর তারপরেই ঐ মরণডাক! তারপরেই আবার একটা, হয় মানুষের নইলে কোনো পোষা জন্তুর মৃত্যু।
এ বাড়িতে রুমার মামা-মামী ছাড়া আছে দুই মামাতো ভাই–নান্টু আর পিন্টু। নান্টু রুমার চেয়ে বছর দুএকের বড়ো। বয়েস বছর বাইশ। পিন্টু তিন বছরের ছোটো। মাধ্যমিক পড়ে।
নান্টু কাটোয়া কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করে গ্রামেই থাকে। চাকরি-বাকরির আশা নেই। বেকার জীবন। তাই পরোপকার করে বেড়ায়।
মামার আছে প্রচুর ধানজমি, বাঁশবাগান, পুকুর। এর আয়েতেই সংসার চলে। কয়েকমাস হলো তিনি গম ভাঙার মেশিন কিনেছেন। ইচ্ছে–পরে ছেলেরা যদি ওটা চালিয়ে যায়।
রুমা এখানে এলে ওর যত গল্প নান্টুদার সঙ্গে। যত ভাব তত ঝগড়া। হাজার হোক পিঠোপিঠি ভাই-বোন তো!
কিন্তু নান্টুদাকে বাড়িতে বেশিক্ষণ পাওয়া যায় না। দুপুরে সেই যে খাওয়া-দাওয়া করে বেরিয়ে যায়, ফেরে রাত নটা-সাড়ে নটায়।
ওর আড্ডা দেবার জায়গা অন্য পাড়ায়। সেটা প্রায় বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে। আসলে সেই পাড়াটাই এই গ্রামের যাকে বলে প্রাণকেন্দ্র তাই।
অত রাতে যখন সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরে তখন বাড়ির লোকের দুর্ভাবনার শেষ থাকে না। কেন না তাদের বাড়ির কাছাকাছি জায়গাটা শুধু নির্জনই নয়, কেমন গা-ছমছমে। ঐ যে বাঁশবন, ঐ যে ভেঙে পড়া বাড়িগুলো, ঐ যে জোড়া পুকুর–মনে হয় ওরই আশেপাশে কী এক অজানা রহস্য ঘাপটি মেরে বসে আছে। কখন কার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে কেউ তা জানে না।
এ অঞ্চলে ছিঁচকে চোরের উৎপাত থাকলেও বড়ো ধরনের চুরি-ডাকাতি বা খুন-খারাপি হয় না। খুন-খারাপি না হলেও এখানে অপঘাত মৃত্যু খুব বেশি। এ যেন গ্রামের ওপর একটা অভিশাপ।
বাড়ির লোকের ভয় করলেও, নান্টুর ভয়-ডর বলে কিছু নেই। বর্ষার সন্ধ্যায় অন্য পাড়ায় কেউ মরেছে। গরিব-দুঃখীর ঘরের মড়া। ফেলবার লোক নেই। সেই রাত্তিরেই দু তিনটে ছেলে নান্টুকে খবর দিয়ে যায়। বাড়ির আপত্তি নান্টু শোনে না। একটা গামছা কাঁধে ফেলে চলে মড়া ফেলতে। তাও শ্মশানটা কি কাছেপিঠে? তারপর আবার পল্লীগ্রামের শ্মশান জনমানবশূন্য।
তাই রুমা নান্টুকে বেশিক্ষণ পায় না। সকালে নান্টু ওঠে একটু বেলা করে। চা-মুড়ি খেয়েই আবার বেরিয়ে যায়।
তবু ওরই মধ্যে রুমা নান্টুকে আটকে দেয়। বলে–কত দিন পর এলাম। সামনের সপ্তাহে চলে যাব। তুই কি আমার সঙ্গে গল্পও করবি না?
তখন হয়তো নান্টু একজন রোগীকে ভালোভাবে দেখবার জন্যে হেলথ-সেন্টারের ডাক্তারকে চিঠি লিখছে। হেসে বলে–আমার কোনো গল্প নেই।
রুমা ঐ ডাকের কথাটা জিজ্ঞেস করে। নান্টু বলে–ও নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। বলেই আবৃত্তি করে–জন্মিলে মরিতে হবে/অমর কে কোথা কবে। পড়েছিস তো?
তা পড়েছি। তার সঙ্গে ঐ ডাকের সম্পর্ক কি?
যে মানুষ উপলব্ধি করতে পারে মৃত্যু আছে তা সে স্বাভাবিক হোক আর অপঘাতই হোক সে কোনো কিছুতেই ভয় পায় না।
কিন্তু ঐ যে ডাকের কথা সবাই বলে? রুমা তার পয়েন্ট থেকে সরে আসতে চায় না।
নান্টু বলে–বললাম তো ডাক নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।
আবার তুই এড়িয়ে যাচ্ছিস। তুই মাথা ঘামাতে না পারিস, ডাকটা তো শোনা যায়?
তা যায়!
রুমা যেন একটু শিউরে উঠল। তার এই দুর্দান্ত দুঃসাহসী দাদাটিও তাহলে স্বীকার করে ডাক শোনা যায়।
তুই শুনেছিস?
তা একবার-দুবার শুনেছি।
কোথায়?
এখানে-ওখানে। রাত্তিরবেলায় ডাকে। কে আর তার খোঁজ করতে যায়?
কিসের ডাক বলে তোর মনে হয়?
কোনো পশু-পক্ষী হবে। কত বন-জঙ্গল তো কাটা হচ্ছে। কিছু দুর্লভ পশু-পাখি হয়তো কোথাও ছিল। এখন প্রাণ বাঁচাতে এখানে-এখানে ছটকে পড়েছে।
রুমা যেন এই যুক্তিতে খুশি হলো না। বলল–তাহলে কেবল বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রেই তোর ভাষায় পশু-পক্ষীটি ডাকবে?
নান্টু বিরক্ত হয়ে বলল–অতশত আমি জানি না। জানতে চাইও না। একটু চা কর দিকি।
তা করছি। কিন্তু তুই একটা সত্যি কথা বল, এই যে এত রাত্তিরে একা একা বাড়ি ফিরিস, ভয় করে না?
নান্টু এদিক থেকে ওদিক মাথা নাড়ল। বলল–নাঃ।
কখনো ভয় পেয়েছিস?
নান্টু একটু হাসল। তারপর যেন অনেক দিন আগের কোনো স্মৃতি হাতড়ে নিয়ে। বলল–তা একবার পেয়েছিলাম।
বল বল।
আগে চা নিয়ে আয়।
.
চা খেতে খেতে নান্টু যে ঘটনাটা শোনাল তা এইরকম–
একবার ও পাশের গ্রামে গিয়েছিল এক বিয়ে উপলক্ষে। তবে নেমন্তন্ন খেতে নয়, বরপক্ষ যাতে দরিদ্র কন্যাদায়গ্রস্ত বাপের ওপর জুলুম না করে তার ব্যবস্থা করতে। ওর দলবল আছে, দুষ্টু লোকে তাই খুব ভয় পায় ওকে।
বিয়েবাড়ি থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়েছিল। একটা সাইকেল করে আসছিল। পল্লীগ্রামের নির্জন পথ। দুপাশে ঝোপ-ঝাড়। নিস্তব্ধ পরিবেশ। হঠাৎ সাইকেলের চেনটা গেল খুলে।
সাইকেল থেকে নেমে ও অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে চেনটা লাগাল। তারপর সাইকেলে উঠতে যাবে হঠাৎ সামনের দিকে তাকাতেই চমকে গেল। কি ওটা?
দেখল বাঁ দিকের বটগাছের ডাল থেকে সাদা কাপড় জড়ানো কি যেন ঝুলছে। বেশ লম্বা। দুটো পা-ও যেন দেখতে পেল। ওর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে কাঁধের ঝুলি থেকে টর্চটা বের করে জ্বালল। দেখল সাদা কাপড় জড়ানো একটা দেহ। বাতাস নেই। তবু দুলছে। যেন বলছে–এই যে আমি।
ও বুঝল কেউ গলায় দড়ি দিয়েছে। কিন্তু লোকটা কি গলায় দড়ি দেবার জন্যে গ্রাম ছেড়ে এত দূরে এসেছিল? আর মুখটাই বা কাপড় জড়ানো কেন?
ওর বদ্ধমূল ধারণা হলো, লোকটাকে খুন করে কয়েকজনে মিলে এখানে ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছে।
ও মশাই! দাঁড়ালেন কেন? বেশ তো যাচ্ছিলেন, যান না।
চমকে উঠেছিল ও। গলার স্বরটা যেন কেমন জড়ানো।
তখনই টর্চের আলো ফেলল শব্দ লক্ষ্য করে। দেখল রাস্তার উল্টোদিকে একটা তেঁতুল গাছের তলায় জনা পাঁচেক লোক শুয়ে রয়েছে।
এই পর্যন্ত বলে নান্টু থামল। বলল–ঐ একবারই গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। হ্যাঁ, কেমন যেন ভয় পেয়েছিলাম।
রুমা বললে, তারপর কি হলো?
কি আর হবে? সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। রাত তখন দুটো।
কিন্তু লোকগুলো?
নান্টু হেসে বললে–ওরা দূর গ্রাম থেকে মড়া নিয়ে আসছিল। ক্লান্ত হয়ে পড়ায় মড়াটা রেখে গাছতলায় একটু শুয়ে ছিল। শেয়াল-কুকুরে খাবে তাই মড়াটা গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল।
ওঃ এই! রুমা যেন হতাশ হলো। কিন্তু নান্টু কেমন একরকম গলার স্বর করে বলল তবে একটা জিনিস, কিছুতেই বুঝতে পারলাম না একটা মড়া কি ভাবে অত উঁচু ডালে ঝোলানো সম্ভব হলো? কথাটা মনে হলো আরো খানিকটা এগিয়ে এসে। আর, তখনই যেন স্পষ্ট শুনতে পেলাম–বলো হরি হরি বোল। সেই সঙ্গে অনেকগুলো পায়ের শব্দ। আর আশ্চর্য ঠিক আমার সাইকেলের পেছনে।
এত তাড়াতাড়ি মড়া নামিয়ে কি করে আমার ছুটন্ত সাইকেলের পিছনে এসে পড়তে পারে ভেবে পেলাম না।
রুমা কি বলতে যাচ্ছিল এই সময়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল তিনটে ছেলে।
নান্টুদা, গিরি গয়লানী হরিপদর ছেলেটার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। শীগগির এসো।
নান্টু লাফিয়ে উঠে বললে–মাথা ফাটিয়েছে কেন?
গিরির গাছের দুটো আম পেড়েছিল। তাই
দুটো আম পেড়েছিল বলে ও মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে! ওর তো বড় বাড় বেড়েছে।
ও একমাত্র তোমাকেই ভয় করে। তুমিই ওকে শায়েস্তা করতে পার।
তার আগে ছেলেটার ব্যবস্থা করি। হ্যাঁ রে, খুব রক্ত বেরোচ্ছে?
হ্যাঁ। অনেকটা কেটে গেছে।
তাহলে তো এখুনি কাটোয়া হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। মা, আমি বেরোচ্ছি। কখন ফিরব ঠিক নেই। বলেই নান্টু ওদের সঙ্গে বেরিয়ে গেল।
রুমা নিজের মনেই বলে উঠল–ব্যস! নান্টুদার খাওয়া-দাওয়া এ বেলার মতো হয়ে গেল।
গিরি গয়লানীর কথা রুমা অনেক বার শুনেছে। একবার দেখেও ছিল। কালো মোটা। চোখগুলো গোল গোল। ঠোঁটটা পুরু। ঝুলে পড়েছে। মাথার চুলে জট। ভয়ানক বদমেজাজী। এমনিতে ওর হাতটান আছে। কারো বাড়িতে ঢুকলে ঘটিটা-বাটিটা হাতিয়ে নেয়। সেইজন্যে কেউ ওকে বাড়ি ঢুকতে দেয় না। একবার পাড়ার একটা বাচ্চা ছেলেকে চুরি করে বাইরে পাচার করার চেষ্টা করেছিল। নান্টু তার দলবল নিয়ে ছেলেটাকে উদ্ধার করে। সেই থেকে নান্টুর ওপর তার বেজায় রাগ। একবার তো ওকে কাটারি ছুঁড়ে মেরেছিল। একটুর জন্য নান্টু বেঁচে গিয়েছিল। আবার এই নান্টুই তাকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। সাবধান করে দিয়ে বলেছিল–ফের যদি চুরি-চামারি কর তাহলে গাঁ থেকে তোমায় তাড়াব। কেউ ঠেকাতে পারবে না।
গিরি গয়লানী সেদিন নান্টুর মৃত্যু কামনা করে শাপশাপান্ত দিয়েছিল। তাই শুনে নান্টুর মা কেঁদেকেটে বলেছিল–কেন তুই ডাইনিটাকে ঘাঁটাতে যাস? তোকে গাল-মন্দ করে। আর আমার বুক কাঁপে।
নান্টু মায়ের কথায় কান দেয় না। শুধু হাসে।
সেই গিরি আজ একটা ছেলের মাথা ফাটিয়েছে। নান্টু তো ছুটল। আবার কি অনর্থ। বাধায় কে জানে!
রুমার মনটা খারাপ হয়ে গেল।
.
০২.
রুমা আমায় তার এবারের অভিজ্ঞতার কথা বলেছিল।জেঠু, সব ঘটনাটা শোনার আগে আমার মামার বাড়িটা কিরকম জানতে হবে।
বলে একটা কাগজ টেনে নিয়ে একটা ঘর আঁকল। ঘরটা বেশ বড়ো। পাশেই একটা ছোটো ঘর। বড়ো ঘরের পেছনে লাগোয়া রান্নাঘর। উল্টোদিকে বাথরুম।
দুটো ঘরের সামনে অনেকখানি উঠোন। উঠোনের মাঝখানে ধানের মড়াই। ডানদিকে গোয়াল। তার পাশেই ধান কোটার চেঁকি। উঠোনের পাশ দিয়ে বাইরে যাবার দরজা। দরজাটা বেশ মজবুত। সমস্ত উঠোন ঘিরে উঁচু পাঁচিল। যাতে চোর পাঁচিলে উঠতে না পারে।
আর এই দরজা দিয়ে বেরিয়েই বাঁ দিকে বাঁশঝাড়। ওপাশে পুকুর। এবার বাড়ির পেছন দিকটা দেখুন।
বলে একটা দোতলা বাড়ি আঁকল। তারপর বলতে শুরু করল–এটা বহুদিনের পুরনো বাড়ি। কিন্তু মাঝে মাঝে মেরামত হয় বলে এখনও টিকে আছে। দোতলার ঘরের জানলাগুলো সব বন্ধ। দোতলার ঐ দিকের বারান্দাটা দেখুন ভেঙে পড়েছে। তাই বারান্দার দিকের দরজাটা পেরেক দিয়ে আঁটা। অন্যমনস্ক হয় কেউ খুলতে পারবে না। এত বড়ো বাড়ি কিন্তু লোকজন নেই। দরজায় দরজায় তালা। এটা দত্তবাবুদের বাড়ি। তারা কলকাতায় থাকেন। শুধু পুজোর সময়ে মাসখানেকের জন্যে আসেন। নিচে বিরাট পুজো-দালান। এখনো সে আমলের ঝাড় লণ্ঠন ঝোলে। এ বাড়িতে দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো ছাড়া দীপান্বিতার রাতে হয় ছিন্নমস্তার পুজো। সে বড়ো সাংঘাতিক পুজো। গাঁয়ের লোকে বলে ঐ পুজোয় একটু খুঁত হলে নাকি রক্ষে নেই। দুবার বলি বেধে গিয়েছিল। সেই দুবারই এবাড়ির দু-দুটো জোয়ান ছেলে মরেছিল। একজন জলে ডুবে আর একজন সাপের কামড়ে। শুনেছি সেবারও সেই ডাক নাকি শোনা গিয়েছিল। এই পুজো যে কত কালের তা কেউ বলতে পারে না। পুজো-দালানের এক কোণে যে বিরাট হাঁড়িকাঠটা রয়েছে সেটা দেখলেই বোঝা যায় এক সময়ে এখানে মোষ বলি হতো।
আমি অবাক হয়ে রুমার কথা শুনছিলাম। ও বলতে লাগল–মামার বাড়ির বড়ো ঘরের এই জানলাটা দিয়ে দত্তবাবুদের পুজো-দালানটা স্পষ্ট দেখা যায়। মামীমা বলেন কত রাত্রে ঐ নির্জন দালানে ঘণ্টা বাজতে শোনা গেছে। কখনও বলিদানের বাজনা বেজে ওঠে।
এসব আমি অবশ্য বিশ্বাস করি না। আসলে বহুদিন ধরে একই জায়গায় থাকতে থাকতে, নানা কাহিনী শুনতে শুনতে মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো সেইসব ব্যাপারে সহজেই বিশ্বাসে সজাগ হয়ে থাকে। মামীমাদেরও তাই হয়েছে আর কি।
একটু থেমে বলল–যাক ও কথা। এই বড়ো ঘরে মামা-মামী শোন। অন্য দিকটায় একটা চৌকি পাতা আছে। কেউ এলে ঐ চৌকিতে শোয়। যেমন আমি শুই। চৌকির ধারেই জানলা। যে জানলা দিয়ে রাস্তার ধারের বাঁশঝাড়টা দেখা যায়।
পাশের ছোটো ঘরটায় ওরা দুভাই শোয়। সেখানেও জানলা দিয়ে যেমন বাঁশঝাড় দেখা যায় তেমনি অন্য জানলা দিয়ে ঐ পুজো-দালানটাও দেখা যায়। এছাড়া ঐ পাশে একটা ছোট্ট ঘর আছে। সেখানে পুরনো জিনিসপত্তর থাকে। এই ঘরেরই দেওয়ালে টাঙানো আছে কাপড় জড়ানো একটা তরোয়াল। তরোয়ালটা কার ছিল, কবে থেকে আছে তা কেউ জানে না। তবে বাড়ির সবার কাছে তরোয়ালটা খুব পবিত্র।
জেঠু, বাড়ির পজিশানটা আপনার কাছে ক্লিয়ার হলো তো?
যদিও খুব পরিষ্কার হয়নি তবু বললাম হ্যাঁ, হয়েছে। এবার ঘটনাটা বলো।
রুমা এবার যা বলে গেল তা এইরকম–
পাড়ায় নান্টুর এক বন্ধুর বোনের বিয়ে। দরকারি কিছু জিনিস কেনাকাটার দায়িত্ব পড়েছিল নান্টুর ওপর। নবদ্বীপ থেকে বেলাবেলি কিনে আনতে হবে। সকালবেলায় বেরিয়ে গেল ও। বলে গেল বেলা একটার মধ্যে ফিরবেই।
জিনিসপত্তর কিনে বিয়েবাড়িতে রেখে একটার মধ্যে ফিরতেই হবে। কেন না বাড়ি ফিরে স্নান করে প্রস্তুত হয়ে আবার বিয়েবাড়ি যেতে হবে। ওখানেই দুপুরের খাওয়া। তারপর বিয়েবাড়ির তদারকি, বরযাত্রী আসবে, তাদের আপ্যায়ন করা। নষ্ট করার মতো সময় নেই।
কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল নান্টু ফিরল না। বাড়ির সবাই ভাবল নিশ্চয় নবদ্বীপ থেকে ফিরতে দেরি হয়েছে, তাই বিয়েবাড়িতেই স্নানটান সেরে নিয়েছে। একেবারে সব কাজকর্ম মিটিয়ে সেই রাতের বেলা ফিরবে।
রাত যখন এগারোটা তখন পিন্টু বাড়ি ফিরল একা।
সবাই অবাক।–দাদা কোথায়?
পিন্টু বলল–জানি না। সন্ধ্যেবেলা দাদাকে একবার ওখানে দেখেছিলাম। তারপর আর দেখিনি! বোধহয় খায়ওনি। সবাই খোঁজাখুঁজি করছিল। শেষে সবাই ভাবল বোধহয় বাড়ি চলে এসেছে। সারা দিন খুব খাটুনি গেছে তো।
সে আবার কী! জলজ্যান্ত ছেলেটা গেল কোথায়? যদি অন্য কোথাও যায়ই, বিয়েবাড়িতে তো বলে যাবে।
সে রাত্রে বাড়িতে কারো গলা দিয়ে ভাত গলল না। বিছানায় শুয়ে যে যার মতো চিন্তা করতে লাগল। আর কান পেতে রইল দরজায় কখন কড়া নাড়ার শব্দ শোনা যাবে।
রুমারও ঘুম আসছিল না। দেখল পিন্টুও ঘুমোয়নি। এপাশ-ওপাশ করছে। ও পিন্টুর কাছে গিয়ে বসল। রাত তখন দেড়টা। ঘরের এক কোণে ওদের পোষা বেড়ালটা চোখ বুজিয়ে ঝিমুচ্ছে। অনেক দিনের বেড়াল। খুব ভীতু। হুলো দেখলেই পালায়। কিন্তু চেনা মানুষের কাছে খুব সহজ।
রুমা জিজ্ঞেস করল–বিয়েবাড়িতে নান্টুদাকে কখন দেখিছিলি?
তখন ফার্স্ট ব্যাচ বসেছে। এই ধর রাত আটটা।
ও কি করছিল?
পরিবেশন করছিল।
তারপর?
তারপর মনে হলো বাইরে থেকে দুজন লোক এসে ওকে ডাকল।
দুজন লোক ডাকল?
হ্যাঁ।
চেনা লোক?
আমি চিনি না।
তারপর?
তারপর পরিবেশন করা রেখে তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেল। আর দেখিনি।
বেড়ালটা আস্তে আস্তে রুমার কোলে এসে বসল।
রুমা অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না। শেষে বলল–এ কথাটা তো এতক্ষণ বলিসনি?
বলে কি হবে? সবার দুর্ভাবনা আরো বাড়বে। শেষে আমাকেই এত রাতে খুঁজতে বেরোতে হবে। একটু থেমে বলল–বেরোতে আমি এখনি পারি। কিন্তু কোথায় খুঁজব? পিন্টু আবার একটা থামল। তারপর রুমার হাত দুটো চেপে ধরে বলল–কী যে ভয় করছে রুমাদি!
ভয় কিসের? এখানে তো ওর কোনো শত্রু নেই।
তা হয়তো নেই। তবে ওকে যে সবাই ভালোবাসে, সবার উপকার করার জন্যে ছুটে যায়–এটা হয়তো কারও কারও ভালো লাগে না। হিংসে করে। তাছাড়া গোপন রাগও থাকতে পারে।
.
০৩.
বিয়েবাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াতেই লোক দুটো বলল–নান্টু, একজন স্টোভ বাস্ট করে পুড়েছে। এখানে কিছু করা যাবে না। বিচ্ছিরিভাবে পুড়েছে–কেউ এগোচ্ছে না। ওকে কাটোয়ার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তুমি না নিয়ে গেলে ও আর বাঁচবে না।
নান্টু তখনই ওদের সঙ্গে চলে গেল। প্রায় একরকম দৌড়তে দৌড়তেই গেল। তাতেও প্রায় মিনিট পনেরো লাগল। গিয়ে দেখল এক জায়গায় বেশ কিছু লোক জড়ো হয়েছে। জায়গাটা দেখেই নান্টু হকচকিয়ে গেল। ভাবতেও পারেনি এই গিরি গয়লানীর বাড়ি। লোকগুলো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে শুধু গোঙানি।
কে পুড়েছে?
ওর সঙ্গের একজন এতক্ষণে বলল-গিরি।
আমায় আগে তো বলনি?
লোকটা কঁচুমাচু হয়ে বলল–বলিনি ইচ্ছে করেই। যদি তুমি না আস। গিরি যে তোমায় কী চক্ষে দেখে তা তো আমরা জানি।
ভিড় ঠেলে নান্টু ঘরের মধ্যে ঢুকল। ঢুকতেই কেরোসিন তেল আর পোড়া চামড়ার উৎকট গন্ধ। দেখল ঘরের এক জায়গা কেরোসিন তেলে ভিজে গেছে। ভাঙা স্টোভের টুকরোগুলো ছড়িয়ে। মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে গিরি। তার চুলগুলো পুড়ে গেছে, মুখের চামড়া পুড়ে কালো হয়ে গেছে। গলার কাছে দগদগ করছে যেন পুরনো ঘা। সে বীভৎস দৃশ্য দেখা যায় না।
নান্টু তখনই একজনকে জিপ আনতে পাঠাল।–আমার নাম করে বলবি। এখুনি দরকার।
জিপ এল প্রায় এক ঘণ্টা পরে। গিরির সেই বিরাট বপুর অনেক জায়গাতেই পুড়ে গিয়েছিল। তাই কলাপাতায় জড়িয়ে ধরাধরি করে জিপে তোলা হলো।
তোমরা কে কে যাবে?
এত রাত্রে এরকম একজন রুগীকে নিয়ে কাটোয়া পর্যন্ত যেতে কেউ রাজী হলো না। ছলছুতো করে সরে পড়ল। নান্টু একবার ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকাল। তারপর একাই অত ভারী দেহটা নিজের কোলের ওপর শুইয়ে নিয়ে চলল।
রাত একটা বেজে গেছে। বিশ্রী রাস্তা। জিপটা ঝকানি খেতে খেতে চলেছে। গিরি অসহ্য যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে তো গোঙাচ্ছেই।
জনপ্রাণীশূন্য রাস্তা। দুপাশে রেনট্রিগুলো অন্ধকারকে আরও যেন ভয়াবহ করে তুলেছে। মাঝে মাঝে দুপাশে ধানক্ষেত। বাবলা গাছের লাইন চলেছে তো চলেছেই। গাড়ির হেডলাইট অন্ধকারের বুক চিরে খানিকটা পথ করে নিচ্ছে। তার পিছনেই আবার জমাট অন্ধকার।
গিরি গয়লানীর বয়েস পাঁচের কোঠায়। শরীর বেশ ভারী। প্রায়ই নান্টুর কোল থেকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। তখনই আর্তনাদ করে উঠছে। নান্টু প্রাণপণ শক্তিতে গিরির পা দুটো সীটের ওপর তোলবার চেষ্টা করছে। কিন্তু পা দুটো যেন শক্ত আর বেঁকে গেছে। নান্টু ভাবল–মহা মুশকিল, এখনও অর্ধেক পথ আসেনি। এইভাবে কতক্ষণ নিয়ে যাওয়া যায়? তারপর পোড়া দেহ থেকে রস গড়িয়ে তার জামা-প্যান্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে। দুহাতে বুঝি রসই লেগেছে। তাই চটচট করছে। শুধু তাই নয়। গিরির সারা গা থেকে বিশ্রী পোড়া গন্ধ ছাড়ছে। বমি আসছে।
এদিকে ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে তো চালাচ্ছেই। সেও যদি দুটো কথা বলে তা হলেও একটু অন্যমনস্ক হওয়া যায়। কিন্তু এমনই কর্তব্যপরায়ণ ড্রাইভার যে একবারও পিছু ফিরে তাকাচ্ছে না।
হঠাৎ গাড়িটা ঝকানি দিয়ে থেমে গেল। ড্রাইভার ব্রেক কষেছে।
নান্টু ঝুঁকে পড়ে দেখল একটা লোক একেবারে সামনে পড়ে গেছে। অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে।
কিন্তু লোকটার ভ্রূক্ষেপ নেই। একবারও পিছন ফিরে তাকাল না। হন হন করে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলল।
ড্রাইভার আবার গাড়ি চালাতে লাগল। হর্ন বাজিয়েই চলেছে। কিন্তু লোকটা পথ থেকে সরছে না। গাড়ি যতই এগোচ্ছে লোকটা ততই জোরে হাঁটছে।
আশ্চর্য!
এতক্ষণে নান্টু দেখল লোকটা বেজায় লম্বা। প্রথম যখন গাড়ির একেবারে সামনে দেখেছিল তখন এত লম্বা মনে হয়নি। কিন্তু এখন
ড্রাইভার হর্ন বাজিয়েই চলেছে। তারপর হঠাৎই ড্রাইভার স্পিড তুলে দিল। নান্টু চেঁচিয়ে উঠল–করছ কী! চাপা পড়বে, গাড়ি থামাও। কিন্তু ড্রাইভার শুনল না। যতটা সম্ভব স্পিড তুলে গাড়িটাকে মাঝ পথ দিয়েই উড়িয়ে নিয়ে গেল।
না, লোকটা আর নেই। চাপাও পড়েনি। পাশে সরেও যায়নি। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
নান্টুর কপালে মিনমিন করে ঘাম ফুটে উঠল। ড্রাইভারকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল আর তখনই মনে হলো গিরির জ্ঞান ফিরে এসেছে। তার মুখের দিকে তাকাতেই দেখল গিরি গোল গোল চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু তাকিয়ে থাকা নয়, যেন দুচোখ বিস্ফারিত করে তাকে চেনবার চেষ্টা করছে। যে মুহূর্তে চিনতে পারল তখনই তার চোখের ভাষা বদলে গেল। চোখের মণি দুটো আগুনের আঁটার মতো ঘুরতে লাগল। উঃ! কী ভয়ংকর সে চাউনি! নান্টু তাড়াতাড়ি অন্যদিকে মুখ ফেরাল। বুঝতে পারল গিরি তার চিরশত্রুকে যেন এত দিন পর হাতের মুঠোয় পেয়েছে।
কষ্ট হচ্ছে? সাহস করে নান্টু কথা বলতে চাইল। গিরি উত্তর দিল না। গোঙানিটা থেমে গেল। কিন্তু তার হিংস্র দৃষ্টি নান্টুর মুখ থেকে সরল না।
ভয় নেই। তোমায় কাটোয়া হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি বেঁচে যাবে।
গিরি তবু নিরুত্তর। একবার উঃ করে উঠল।
লাগছে? বলে নান্টু তাড়াতাড়ি তার পোড়া পিঠের নিচ থেকে হাতটা সরিয়ে নিল।
গিরি এবার চোখ বুজল।
নান্টু ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল কাটোয়া আর কতদূর ভাই?
অগ্রদ্বীপ পেরোয়নি এখনও।
ও বাবা! এখনও মাঝে দাঁইহাট আছে।
এদিকে সে আর পা ঠিক রাখতে পারছে না। গিরির দেহটা ক্রমেই তার পা থেকে সীটের নিচে নেমে যাচ্ছে। নান্টু ঘাড় নিচু করে গিরির দেহটা তুলতে যেতেই হঠাৎ গিরি দুহাত দিয়ে নান্টুর গলাটা আঁকড়ে ধরল।
নান্টু ভাবল বুঝি পড়ে যাবার ভয়ে গিরি ওর গলাটা ধরেছে। কিন্তু–একী! গিরির দুটো হাত যে ক্রমেই তার কণ্ঠনালীর দিকে এগিয়ে আসছে। নান্টু এক ঝটকা মেরে ঘাড়টা সরিয়ে নেবার চেষ্টা করল। পারল না। কী শক্ত গিরির হাত দুটো। সেই শক্ত হাত দুটো হঠাৎ টিপে ধরল নান্টুর গলা টিপে ধরেই গিরি তার শেষ শক্তি দিয়ে উঠে বসবার চেষ্টা করল যাতে ওর মরণ টিপুনির থেকে নান্টু গলা বাঁচাতে না পারে।
নান্টু আর দয়া-মায়া না করে বাঁচবার জন্যে তার হাত দুটো জোর করে ঠেলে দিল। দুহাতে গলিত কুষ্ঠের মতো চটচটে রস লেগে গেল। একটা আর্তনাদ করে গিরি কোলের ওপর এলিয়ে পড়ে ক্রমাগত গোঙাতে লাগল।
শয়তান কোথাকার! মরতে বসেও শয়তানি যায় না। বজ্জাত গয়লানী, তুই ভালো হয়ে ফিরে আয়। এবার তোকে জেলে পুরব। নইলে আমার নাম নান্টু নয়।
.
ভোরবেলায় চিপ কাটোয়া হাসপাতালে ঢুকল। গিরিকে ভর্তি করিয়ে নাম-ঠিকানা লিখে ডাক্তারদের বলে এল–এ গরিব মানুষ বলে অবহেলা করবেন না। এর নিজের কেউ নেই। কিন্তু জানবেন আমি আছি। বলে দৃপ্ত পায়ে গটগট করে জিপে এসে বসল।
জিপে বসতেই তার শরীরটা কিরকম করে উঠল। গা গুলোতে লাগল। শরীরে কেমন কাঁপুনি।
ড্রাইভার ভাই, একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে দাও। শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছে।
.
০৪.
বেলা প্রায় নটার সময়ে নান্টু বাড়ি ঢুকল। সবাই বসে আছে তার পথ চেয়ে। এমনকি বিয়েবাড়ি থেকেও দু-একটা ছেলে ছুটে এসেছে খবর নিতে। নান্টুকে ফিরতে দেখে সবাই নিশ্চিন্ত।
রুমা ছুটে গিয়ে বলল–তোর আক্কেল কিরে নান্টুদা?
নান্টু উত্তর দিল না। সোজা নিজের ঘরের দিকে চলল। নান্টুর আদরের বেড়ালটা ল্যাজ তুলে নান্টুর পায়ের কাছে ঘুরছিল। নান্টু এক লাথি মেরে সরিয়ে দিল। এমন নিষ্ঠুর আচরণ সে কখনো করেনি।
এতক্ষণে বাড়ির সকলের লক্ষ্য পড়ল নান্টুর দিকে।
ইস! এ কী অবস্থা! চুল উস্কখুস্ক, চোখ নেশাখোরের মতো লাল, উদভ্রান্ত দৃষ্টি। জামায় এখানে-ওখানে বিশ্রী ছোপ।
সারা রাত কোথায় ছিলি? কি হয়েছে?
পরে বলব। আগে একটু শোব।
কোনোরকমে জামাটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্যান্ট পরেই সে মেঝেতে শুয়ে পড়ল। প্যান্টটা ছাড়ারও দরকার ছিল। কিন্তু পারেনি।
আধঘণ্টা পর সে উঠে বসল। তখন সবাই তার পাশে বসে। বার বার জিজ্ঞেস করায় সে শুধু সংক্ষেপে গিরি গয়লানীকে কাটোয়া হাসপাতালে ভর্তি করে দেবার কথা বলল। আর কিছু বলল না।
মামীমা বললেন–কিছু খাবি? সারারাত তো কিছু খাসনি।
নান্টু মাথা নাড়ল।
খাবিনে কেন?
খেতে ইচ্ছে করছে না।
তবে একটু চা করে দিই খা।
রুমা তখনই চা করে এনে দিল। চায়ের সঙ্গে চিড়ে ভাজা।
চিড়ে ভাজা ছুঁলো না। চা-টা মুখে দিতে গিয়ে নামিয়ে রাখল।
কি হলো? চা খাবি না?
না। পোড়া গন্ধ।
পোড়া গন্ধ! সবাই অবাক হয়ে তাকাল।
তোমরা এখন বিরক্ত কোরো না। বলে গুম হয়ে বসে রইল।
হঠাৎ নান্টুর কি যে হলো কেউ বুঝতে পারল না।
যা চান করে নে গে।
নান্টু তেল মেখে বাঁশবাগানের ধারের পুকুরে ডুব দিতে গেল। কিন্তু ডুব দিল না। ফিরে এল।
চান করলি না?
বাড়িতে করব।
কেন পুকুরে স্নান করবে না সে কথা জিজ্ঞেস করতে কারও সাহস হলো না। বাড়িতে স্নান করে খেতে বসল। কিন্তু খেতে পারল না। বলল–পোড়া গন্ধ।
তারপরই বিছানায় শুয়ে পড়ল।
সবাই বুঝল গিরির পোড়া দেহটা অতদূর নিয়ে গিয়েছিল, সেই গন্ধটাই লেগে রয়েছে।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠল। এখন অনেকটা স্বাভাবিক। রুমা ওর কাছে-কাছেই রয়েছে। খুব ইচ্ছে সারা রাত নান্টুদা একা ঐ মুমূর্ষ মেয়েটাকে নিয়ে কীভাবে গেল সব কথা শোনার। গিরিকে কেউ পছন্দ করে না। বিশেষ করে নান্টুদার ওপর গিরির কীরকম রাগ সকলেই তা জানে। সেই গিরিকে বাঁচাবার জন্যে একমাত্র তার নান্টুদাই ছুটল এ কী কম কথা! তবু এই মুহূর্তে ওকে জিজ্ঞেস করতে সাহস পাচ্ছিল না।
বেড়ালটা অভিমান ভুলে নান্টুর গা ঘেঁষে বসল। নান্টু আদর করতে লাগল।
সকালে তুই ওকে এমন লাথি মারলি–রুমা বলল।
লাথি মেরেছিলাম নাকি?
বাঃ! এরই মধ্যে ভুলে গেলি?
মনে পড়ছে না তো।
অন্য দিন পুকুরে সাঁতার কাটিস। আজ পুকুরে গিয়েও ফিরে এলি কেন?
এ কথার উত্তর দেবার আগেই নান্টু হঠাৎ বেড়ালটার গা থেকে হাতটা টেনে নিল।
কি হলো?
বেড়ালটার মুখে কালো দাগটা দেখেছিস?
হ্যাঁ। ও দাগ তো ওর জন্ম থেকে।
নান্টু একটু গম্ভীর হয়ে বলল–বোধহয় কোনোদিন পুড়ে গিয়েছিল।
পুড়ে গিয়েছিল! তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে নান্টুদা। কেবলই পোড়া দেখছিস।
নান্টু চুপ করে রইল। তারপর বলল–আমিও বোধহয় পুড়ে মরব কোনো দিন।
কী যে বলিস!
পোড়া যে কী ভয়ংকর তা না দেখলে বুঝতে পারবি না।
খুব পুড়েছে?
না। তেমন নয়। শুধু মুখের অর্ধেক, গলা, পিঠের খানিকটা।
তবে হয়তো বেঁচে যাবে।
নান্টু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–নাঃ বাঁচবে না।
কেন?
আমি বুঝতে পারছি।
তুই ডাক্তার না গণৎকার?
ওসব কিছু নয়। কিন্তু আমি জানি।
রুমা আর কিছু বলল না। সবই যেন তার হেঁয়ালি বলে মনে হচ্ছে।
নান্টু হঠাৎ যেন নিজের মনেই বলতে লাগল–একটা ঢ্যাঙা মতো লোক গভীর রাতে রাস্তার মাঝখান দিয়ে যাচ্ছে। একটা গাড়ি বার বার হর্ন দিচ্ছে, কিন্তু সে পথ ছাড়বে না। রাস্তার মাঝখান দিয়েই হাঁটছে লম্বা লম্বা পা ফেলে। ড্রাইভার আর কি করবে, চোখ বুজিয়ে টপ স্পিডে সোজা গাড়ি চালিয়ে দিল। কিন্তু লোকটা চাপা পড়ল না। পাশেও সরে যায়নি। অথচ তাকে আর দেখা গেল না।
কথা শেষ করে নান্টু কেমন একরকম ভাবে পিছনের পুজো-বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল।
এমনি সময়ে বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। রুমা দরজা খুলে দিল। ফিরে এসে বলল-নান্টুদা, তোকে ডাকছে।
যেন চমকে উঠে নান্টু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল।
মিনিট দুই পরে রুমা শুনল নান্টুদা রেগে উঠে বলছে–না, আমি পারব না। তোরা যা।
যারা এসেছিল তারা অবাক হয়ে ফিরে গেল।
কি বলছিল ওরা? রুমা জিজ্ঞেস করল।
গিরি আজ সকালে মরেছে। বডি নিয়ে আসতে হবে। না, না, আমি পারব না। বলে নান্টু ঘরে ঢুকে পড়ল।
যে ছেলে দুপুরে খেয়েদেয়ে বেরিয়ে যেত আর ফিরত রাত নটায়, সেই ছেলেই সেই যে ঘরে এসে ঢুকল আর বেরোল না।
সবাই লক্ষ্য করল নান্টুর গোটা মুখ কিরকম কালো হয়ে গেছে। নিজের ঘরে চৌকির ওপর বসে আছে উবু হয়ে। একেবারে চুপ। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ও ভয় পেয়েছে।
বাড়ির মধ্যে একমাত্র রুমাই নান্টুর মেজাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সাহস করে কথা বলতে পারে। তাই ওই সাবধানে বলল–কি হয়েছে তোর? একটু বাইরে থেকে ঘুরে আয় না। আমিও না হয় তোর সঙ্গে যাচ্ছি।
তুই যাবি? তবে চল।
দুজনে বেরোতে যাচ্ছিল, নান্টু বলল–তুই থাক, আমিই যাচ্ছি। বলে টর্চটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
পিছন থেকে রুমা বলল–আজ যেন রাত করিস না।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল নান্টু।–কেন?
এমনি বললাম। কাল ধকল গেছে। আজ ভালো করে খাসনি—
ঠিক আছে। বলে নান্টু বেরিয়ে গেল।
কিন্তু দশ মিনিটের মধ্যে ফিরে এল। অবাক রুমা জিজ্ঞেস করল–এরই মধ্যে বেড়ানো হয়ে গেল?
নান্টু উত্তর দিল না। শুধু বলল–সদর দরজাটা বন্ধ করে দে। আর দ্যাখ তো কেউ ওখানে ঘুরছে কিনা।
কোথায় ঘুরছে?
দেখলাম কেউ যেন বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে আমার পিছু পিছু এসে পুজো-বাড়িটার দিকে চলে গেল।
সে আবার কী! আচ্ছা, দেখছি। বলে রুমা টর্চ নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, পিন্টু বলল– দাঁড়া রুমাদি। আমিও তোর সঙ্গে যাব।
পনেরো মিনিট পরে দুজনেই ফিরে এল। রুমা বলল–দূর! কেউ কোত্থাও নেই।
নান্টু গম্ভীর মুখে বলল–সে কি আর তোদের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকবে? সে আমাকেই চায়।
রাত্রে শোবার সময়ে মাকে বলল–মা, আজ রাত্রে তোমাদের ঘরেই শোব। মামীমা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন–বেশ তো শুবি। ওরে রুমা, তোর নান্টুদার বিছানাটা আমাদের ঘরে করে দে।
রুমা বিছানাটা করতে যাচ্ছিল, নান্টুর বুঝি লজ্জা হলো। বলল–থাক। আমার ঘরেই শুই। কি আর হবে!
মামী বললেন–হ্যাঁ হ্যাঁ, কিসের কি হবে? তা ছাড়া পিন্টুটা একা শোবে?
ও ঘর থেকে পিন্টু বলে উঠল–একলা শোব তোকি হবে? ভূতে ধরবে?
পিন্টুর এই সামান্য কথায় নান্টু যেন চমকে উঠল। কিন্তু কিছু বলল না। শুতে চলে গেল।
ঘণ্টাখানেক পর। রাত প্রায় এগারোটা। রুমা ডাকল-মামীমা!
হুঁ।
আমার মনে হচ্ছে যে কোনো কারণেই হোক নান্টুদা খুব ভয় পাচ্ছে। নইলে ওর মতো সাহসী ছেলে–ও এ ঘরে শুলেই পারত।
তবে ডাক।
রুমা মশারি থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে নান্টুকে ডাকতে গেল। দেখল এই গরমে ও ঘরের সব জানলা বন্ধ। নান্টুদা ঘুমোয়নি। খাটে বসে এক মনে গায়ত্রী জপ করছে যা সে কখনো করে না। পাশে পিন্টু নিশ্চিন্তে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে।
নান্টুদা এমন একাগ্র মনে গায়ত্রী জপ করছে যে তার ধ্যান ভাঙাতে ইচ্ছে হলো না। রুমা পা টিপে টিপে নিজের ঘরে ফিরে এল।
এটা ছিল সোমবার। গিরি গয়লানীর মারা যাবার প্রথম দিন।
.
০৫.
মঙ্গলবার।
আজ বন্ধুর বোনের বৌভাত। কাছেই শ্বশুরবাড়ি। ওরা বিশেষ করে এদের দুভাইকে যেতে বলেছে।
বিকেল পর্যন্ত নান্টু টানা ঘুম দিয়েছে। শরীরটা এখন বেশ ঝরঝরে।
মা বলল–বৌভাতে যাবি। তাড়াতাড়ি সেজেগুজে নে।
মুহূর্তে নান্টুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বলল–না, আমি যাব না।
মা অবাক হয়ে বলল–কেন?
তুমি বুঝতে পারছ না মা, আমার সামনে ভয়ানক বিপদ।
কিসের বিপদ?
তা আমি বোঝাতে পারব না।
তুই কি সত্যি ভয় পেয়েছিস?
হ্যাঁ।
রুমা কান খাড়া করে রইল। এবার যদি ও সব ঘটনাটা বলে।
কিসের ভয়?
তা জানি না। শুধু এইটুকু বলতে পারি কাল সন্ধ্যে থেকে কেউ যেন আমাকে লক্ষ্য করছে–আমাকে ডাকছে একটা ভয়ংকর কালো মুখ।
ওসব মনের ভুল।
মনের ভুল নয় মা। তুমি তো জান আমি আজ পর্যন্ত কত মড়া নিয়ে গিয়েছি, পুড়িয়েছি, সারা রাত জেগে ঐ সদানন্দ স্যাকরার মড়া আগলেছি। তখন তো এমন ভয় পাইনি।
এখনই বা ভয় কিসের? বিয়েবাড়ি গেলেই পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলে সব ভুলে যাবি।
তা হয়তো যাব। কিন্তু তারপর? ফেরার সময়ে ঐ গিরি গয়লানীর বাড়ির কাছ দিয়েই তো ফিরতে হবে। বৌভাত তো গিরির পাড়াতেই। অন্ধকারের মধ্যে ওর শেকলতোলা শূন্য ঘর আর আম গাছটা দেখলেই–নান্টুর শরীরটা কেঁপে উঠল।
মা তবুও অভয় দিয়ে বলল-ওদিক দিয়ে না এসে একটু ঘুরে যমপুকুরের পাশ দিয়ে আসবি। তাছাড়া পিন্টুও তো তোর সঙ্গে থাকবে।
তাই যা নান্টুদা। নে–নে দেরি করিস না।
অগত্যা পিন্টুকে নিয়ে নান্টু বেরিয়ে পড়ল।
রাত প্রায় এগারোটা। দুভাই নির্জন রাস্তা দিয়ে হনহন করে আসছে। পাশেই যমপুকুর। গভীর কালো জল। নান্টুর মনে হলো–পুকুরটার ঐ রকম বিশ্রী নাম রাখা হলো কেন?
অদ্ভুত ব্যাপার। এই গ্রামেই তার জন্ম। এই পুকুরের পাশ দিয়ে ও কতবার গিয়েছে। কোনো দিন এইরকম কৌতূহল হয়নি। হঠাৎ আজই।
কি রে দাদা, কথা বল কিছু?
কথা? কথা যোগাচ্ছে নারে। আচ্ছা যমপুকুর নাম হলো কেন? নিশ্চয় অনেক লোক ডুবেছে। তুই কি বলিস?
হতে পারে।
অপঘাতে মৃত্যু তো।
তাছাড়া কি।
নান্টু চুপ করে হাঁটতে লাগল। তারপরই হাঁটার বেগ বাড়িয়ে দিল।
কি রে দাদা, অমন করে ছুটছিস কেন?
গন্ধ পাচ্ছিস না? একটা মানুষ-পোড়ার চিমসে গন্ধ?
নিশ্বাস টেনে পিন্টু বলল-কই না তো?
তবে হয়তো আমারই মনের ভুল।
হঠাৎ পাশের ঝোপটা যেন জোরে নড়ে উঠল। নান্টু চাপা উত্তেজনার চেঁচিয়ে উঠল– কে? কে ওখানে?
সঙ্গে সঙ্গে পিন্টু টর্চের আলো ফেলল। ঝোপঝাপ দুলিয়ে কিছু যেন একটা পুকুরের দিকে চলে গেল।
দেখতে পেলি?
পিন্টু বলল– না।
কি মনে হয়?
বোধহয় শেয়াল।
শেয়াল! শেয়াল এখন আর আছে নাকি?
দু-একটা থাকতে পারে। তুই হাঁট তো।
সারা পথ আর কেউ কথা বলেনি। বাড়ি যখন পৌঁছল রাত তখন বারোটা বাজে।
.
০৬.
বুধবার।
আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। একটা শোঁ শোঁ করে বাতাস ক্রুদ্ধ অপদেবতার নিশ্বাসের মতো বাঁশঝাড়ের পাতা কাঁপয়ে দাপাদাপি করছিল।
ঘুম থেকে উঠল নান্টু। বেজার মুখ। চা খেল। কিন্তু কারো সঙ্গেই কথা বলছিল না।
সবাই ঘরে বসেছিল। একসময়ে নান্টু বলল কাল রাতে কোনো পুজো ছিল?
রুমা বলল–এখন পুজো থাকার তো কথা নয়। তবে এখানে এসময়ে কোনো বিশেষ পুজো হয় কিনা জানি না। কেন?
নান্টু বলল কাল অনেক রাতে ঢাকের শব্দ পাচ্ছিলাম। অনেকগুলো ঢাক বাজছিল। ঠিক যেন বলিদানের বাজনা!
নান্টুর মা ধমক দিয়ে বলল–তুই ওঠ তো। বুড়োদের মতো সকাল থেকে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে ঢাকের শব্দ শুনছে।
নান্টু উঠল না। কেমন অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে রইল সেই পুজোবাড়ির দিকে। অস্বাভাবিক আতংকে ভরা চোখ।
রুমা বলল–নান্টুদা, তুই একটু ও পাড়ায় যা। আজ হাটবার। কিছু বাজার করে আন তো।
দূর বাজার! তোরা যাস। বলেই মাটিতে শুয়ে পড়ল।
বেলা এগারোটা।
এই একটা জিনিস রুমা লক্ষ্য করছে আজ নান্টুদা খুবই অনমনস্ক। সবসময়েই কি যেন ভাবছে আর যেখানে-সেখানে শুয়ে পড়ছে।
মামীমা অধৈর্য হয়ে বললেন–তোর কী হয়েছে বল তো? কি ভাবছিস? ওরকম ঢিস ঢিস করে শুয়ে পড়ছিস কেন?
সে কথার উত্তর না দিয়ে নান্টু যেন আপন মনেই বলল–অপঘাতে মৃত্যু। তিনদিন হলো। আজ ওর ঘাট।
তাই নিয়ে তোর ভাববার কী আছে?
তারও কোনো উত্তর না দিয়ে নান্টু বলতে লাগল–গভীর রাত। নির্জন রাস্তা। একটা গাড়ি ছুটছে। সামনেই একটা লম্বা মতো লোক। রাস্তার ঠিক মাঝখান দিয়ে হাঁটছে…পাশেও সরে যায়নি..তাকে আর দেখা গেল না। তারপরেই একটু মুমূর্য রুগী কটমট করে তাকাল..দুহাত দিয়ে গলাটা টিপে ধরল…
বলেই নান্টু ধড়মড় করে উঠে পড়ল–কেউ কড়া নাড়ছে না?
রুমা বলল–তুই বোস। আমি দেখছি।
ভালো করে দেখে খুলবি। বলেই সে একছুটে ঘরে গিয়ে ঢুকল–যেন লুকোতে চাইল।
দরজা খুলে রুমা দেখল নান্টুর দুই বন্ধু। তারা জিজ্ঞেস করল–নান্টু কোথায়?
রুমা ইতস্তত করে বলল–ঘরে আছে। শরীর ভালো নেই।
কেন? ওর আবার কী হলো?
বলতে বলতে ওরা ঘরে ঢুকে পড়ল।
জানিস নান্টু, তাজ্জব ব্যাপার। আজ সকালে দেখলাম গিরি গয়লানীর ঘরের সামনে ভিড়। তার অত সাধের আমগাছটার একটা শক্ত ডাল ভেঙে পড়েছে। কি করে ভাঙল কে জানে! কাল তো ঝড়ও হয়নি।
অন্য বন্ধুটি বলল–আরও অবাক কাণ্ড–ওর ঘরে শেকল তোলা ছিল। দেখা গেল দরজাটা হাট করে খোলা।
নান্টুর ভয়ার্ত উদভ্রান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে রুমা তাড়াতাড়ি বলল–ও কিছু নয়। চোরটোর ঢুকেছিল।
চোর! বন্ধুরা বলে উঠল–ওর ছিল কী যে চোর চুরি করতে ঢুকবে? তাছাড়া গিরির জিনিস চুরি করে কেউ রেহাই পাবে মনে করেছ? পেত্নী হয়ে ঘাড় মটকাবে। যার ওপর ওর একবার রাগ হবে, মরেও তাকে রেহাই দেবে না। বেরোবি নাকি?
নান্টু মাথা নাড়ল।–না। শরীর খারাপ।
ওরা চলে গেল।
দুপুরে খেয়েদেয়ে নান্টু টেনে ঘুমল। এমন নিশ্চিন্ত ঘুমল যেন তার মনে আর ভয় নেই। বিকেলবেলা প্যান্ট আর হাওয়াই শার্টটা পরল।
নান্টুর মা খুশি হয়ে বলল–বেরোচ্ছিস?
হ্যাঁ। দেখি কি হয়।
হওয়া-হওয়ির আবার কী? যা ঘুরে আয়।
রুমা বলল–আমিও যাব?
না। তুই আর কতদিন পাহারা দিবি? পাহারা দিয়েও কি আমায় ধরে রাখতে পারবি?
বলেই বেরিয়ে গেল। কিন্তু পনেরো মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল।
কি রে, এর মধ্যেই ফিরে এলি?
নান্টু উত্তর দিল না।
রুমা জিজ্ঞেস করল কতদূর গিয়েছিলি?
এদিক থেকে ওদিক।
মানে?
একদিকে বাঁশঝাড়, অন্যদিকে দত্তদের পুজো-দালান। দুটোই দেখলাম।
হঠাৎ কি দেখতে গিয়েছিলি?
আমার বিপদটা কোনদিক থেকে আসবে। সেই রাস্তার ওপর অশরীরী মানুষটা আমায় বুঝিয়ে দিয়েছিল গিরি বাঁচবে না। ঠিক তখনই গিরি আমার গলা টিপে মারতে গিয়েছিল। তার অর্থ ওর হাতেই আমার মৃত্যু আছে। কাল রাত্তিরে পুজো-দালানে বলির বাজনা আমায় জানিয়ে দিল–আমার মাথার ওপর খাঁড়া ঝুলছে।
নান্টুর মার মুখ শুকিয়ে গেল। রুমা আঁৎকে উঠল। এসব কথা কি কোনো সুস্থ ছেলের লক্ষণ? একি শুধুই একটা অলৌকিক ভয়, না আরও কিছু?
তখন সন্ধ্যেবেলা।
মা বলল–ছানাটুকু খেয়ে নে।
নান্টু উদাসভাবে বলল-দা-ও। খেয়েনি।
এমনভাবে বলল যেন শেষ খাওয়া খেয়ে নেবে।
খানিকটা খেয়ে বললউঃ! পোড়া গন্ধ।
বলে বাকিটা ফেলে দিল। বেড়ালটা বসে ছিল কাছে। চেটেপুটে খেয়ে নিল।
ঘরে টি.ভি. চলছিল।
বড়ো ঘরে বসে সবাই টিভি দেখছিল। এই ঘরেরই উত্তর দিকে জানলা দিয়ে দেখা যায় সেই রহস্যময় পুজো-দালানটা। একসময়ে যেখানে বলি বেধে গিয়ে সর্বনাশ হয়েছিল। আজও নাকি মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঢাক বাজে, ডিম ডিম করে। অনেকেই শুনেছে। দক্ষিণ দিকের জানলা দিয়ে দেখা যায় এবাড়ির উঠোনের ওপর মস্ত ধানের গোলাটা। তারই পাশ দিয়ে দুপা গেলেই সদর দরজা।
ঘরের মেঝেতে সবাই বসে। পিন্টু শুয়ে আছে খাটে। নান্টু বসে আছে খাটে দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে। বেড়ালটা রয়েছে মেঝেতে। সবাই টি.ভি. দেখছে। কিন্তু নান্টু দেখছে না। সে অন্যমনস্ক। তার চোখ ছুটছে একবার এ জানলার দিকে, একবার অন্য জানলা দিয়ে দরজার দিকে। বাইরে জমাট অন্ধকার। সে যেন সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছে।
ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত আটটা বাজল। দূরে জঙ্গলের মধ্যে কি একটা জন্তু ডেকে উঠল–যেন বড়ো কোনো সাপ কিছু ধরেছে।
হঠাৎ ঝন ঝন করে শব্দ। শব্দটা এল দরজার দিক থেকে। নান্টু চমকে উঠল। রুমাও।
নান্টুর চোখ দুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে। অথচ অন্যেরা একমনে টি.ভি. দেখছে। বোধ হয় তারা শুনতে পায়নি।
কিসের শব্দ হলো? নান্টু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল।
ও কিছু না। সাহস দিয়ে রুমা বলল–গোয়ালে বালতি ছিল, বোধহয় গরুর পায়ে লেগে–
কিন্তু শব্দটা তো দরজার দিক থেকে এলো।
ঠিক আছে। আমি দেখছি।
না-না, তুই যাসনে। মামার বাড়ি দুদিনের জন্যে বেড়াতে এসে কেন প্রাণটা খোয়াবি?
তুই চুপ কর তো।
বলে রুমা টর্চটা নিয়ে উঠে পড়ল।
পিন্টু বলল–কিরে রুমাদি?
কিছু না। কিসের যেন একটা শব্দ হলো।
দাঁড়া আমিও দেখি।
ওরা দুজনে চলল। নান্টুর কি মনে হলো সেও পিছু পিছু চলল।
দরজা বন্ধই ছিল। খিল খুলে পিন্টু আর রুমা বাইরে বেরিয়ে তন্নতন্ন করে দেখল। কিছু চোখে পড়ল না। অথচ রুমা নিজেও শব্দটা শুনেছে। আর তা এই দরজার বাইরেই।
ঘরে ফিরে এল তিনজনেই।
হঠাৎ নান্টু তাড়াতাড়ি প্যান্ট ছেড়ে গামছাটা পরে নিল।
ওর মা বলল–গামছা পরছিস কেন? পায়খানা যাবি?
হ্যাঁ, শরীরটা কেমন করছে।
লণ্ঠনটা নিয়ে যা। আর পিন্টু না হয় দাঁড়াক।
পায়খানা একটা বাড়ির ভেতরে আছে। আর একটা বাইরে। নান্টু ভেতরের পায়খানায় যেত না। বলত–ওটা মেয়েদের জন্যে। রাত দুপুরেও কত দিন একা একা বাইরের পায়খানায় গিয়েছে। কিন্তু আজ দরজার খিল খুলেও যেতে পারল না।
তবে ভেতরের পায়খানায় যা।
নান্টু উত্তর না দিয়ে ওর ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। পায়খানা গেল না।
এ ঘরে আয় না।
নান্টু এল না।
রাত সাড়ে দশটা। সবাই খেয়ে নিল। নান্টু খেল না। বলল–শরীর খারাপ করছে।
কি হচ্ছে?
আমি জানি না মা-জানি না।
আজ আমাদের ঘরে শো।
একটু পরে।
হঠাৎ ভয়ংকর একটা শব্দ ভেসে এল। ঠিক কোন দিকে থেকে এল বোঝা গেল না। মনে হলো কিছু একটা শূন্যে ভাসতে ভাসতে ডেকে গেল। পাখির ডাক কি এইরকম হয়?
কিন্তু ডাকটা ঐ মুহূর্তের জন্যে। রুমা নিজে কানে শুনেছে। এই কি সেই মরণডাক? নান্টুদা শুনতে পায়নি তো?
বিছানা পাতা হয়ে গেছে। মশারি টাঙানো হচ্ছে..বাইরে চাপা অন্ধকারের মধ্যে অটুট স্তব্ধতা যেন স্থির হয়ে চেপে বসে আছে।
রুমা উত্তরের জানলা দিয়ে পুজো-দালানটার দিকে তাকিয়ে ভাবছিল ঝনঝন করে যে শব্দটা একটু আগে সে নিজেও কানে শুনেছিল আর এখনি যে বিকট শব্দটা শুনল সে দুটো কিসের শব্দ হতে পারে!
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে হলো চারিদিক যেন কেমন থমথম করছে যেমন ঝড়ের আগে হয়। এতক্ষণ ঝোপেঝাড়ে দুএকটা ঝিঁঝি ডাকছিল, সে ডাকটাও হঠাৎ থেমে গেল। গাছগুলোর পাতা একটু একটু নড়ছিল, তাও যেন থমকে গেল। আর–এ কী! নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কেন? শুধু কি তারই না সকলের?
হঠাৎ বাঁশঝাড় কাঁপিয়ে যমপুকুরের দিক থেকে একটা অদ্ভুত হাড়-কাঁপানো শব্দ ভেসে এল–ওঁওঁওঁ…হু-হুঁ-হুঁ
শব্দটা ক্রমেই এই বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে…
যাতে নান্টু শুনতে না পায় সেইজন্যে রুমা এক ঝটকায় জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে ছুটে গেল পাশের ঘরে। দেখল নান্টু চৌকিটা চেপে ধরে থরথর করে কাঁপছে।
মামীমা…মামা..পিন্টু..শীগগির এসো।
কিন্তু কে আসবে? সেই ভয়ংকর অপার্থিব শব্দে সবাই নিস্পন্দ হয়ে গেছে। তারা জানে এই সেই মরণডাক। এই ডাক শোনা যায় তখনি গ্রামের কেউ একজন অপঘাতে মরবে। তারপর মরবে আর একজন মানুষ–পুরুষ কিংবা স্ত্রী, শিশু কিংবা বৃদ্ধ। তারপর কোনো গৃহপালিত জীব।
নান্টু-নান্টু, কি হয়েছে? মা পড়িমরি করে ছুটে এল।
মা-মা, ও আমায় নিতে এসেছে। তুমি আমায় বুকের মধ্যে চেপে ধরো। আমায় যেতে দিও না।
নান্টুর মা অতবড়ো ছেলেকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে রইল।
শব্দটা যেন শূন্য থেকে নেমে এবাড়ির দক্ষিণ দিকের বন্ধ জানলায় ঝাঁপটা মেরে পুজো দালানের মধ্যে দিয়ে মিলিয়ে গেল।
.
একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে নান্টু মায়ের বুক থেকে মাটিতে ঢলে পড়ল।
ও মা! কী হলো গো! আর্তনাদ করে উঠল নান্টুর মা।
একটু জল জল নিয়ে আয় পিন্টু।
পিন্টু ছুটে গিয়ে এক ঘটি জল নিয়ে এল। জলের ঝাঁপটা দিতে দিতে নান্টুর জ্ঞান অল্প অল্প ফিরে এল। কিন্তু তারপরেই শুরু হলো পেটের যন্ত্রণা। পেটের যন্ত্রণা থেকে মাথার যন্ত্রণা, মাথার যন্ত্রণা থেকে পিঠ।
ও মা! এ আমার কী হলো?
স্থাণুর মতো চৌকির ওপর বসে আছেন নান্টুর বাবা।
রুমা উত্তেজিতভাবে বলল–মামা, এখুনি ডাক্তার ডাকা দরকার।
বিহ্বল গলায় মামা বলল–এত রাত্রে ডাক্তার কোথায় পাবে?
এদিকে নান্টুর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। অথচ কেউ বুঝতে পারল না একটা সুস্থ সবল ছেলে, হঠাৎ তার কী হলো?
তবু ডাক্তারের খোঁজে তো যেতে হবে। ঐ দেখুন গোটা মুখটা কিরকম ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।
যাচ্ছি। বলে প্রৌঢ় মামা গায়ে পাঞ্জাবি চড়িয়ে, টর্চ লাঠি নিয়ে বেরোতে যাচ্ছিলেন, পিন্টু বললে–তুমি শোওগে। আমি যাচ্ছি।
চমকে উঠল রুমা।–তুই ছেলেমানুষ। এত রাতে একা যাবি?
যেতেই হবে। দাদাকে তো বাঁচাতে হবে।
বলে তাড়াতাড়ি জামা-প্যান্ট পরে নিয়ে কোণের ছোট্ট ঘরে গিয়ে দাঁড়াল।
নানা পরিত্যক্ত জিনিসের মধ্যে দেওয়ালে ঝুলছে তরোয়ালটা। ধীরে ধীরে সেটা পেড়ে নিল। কাপড়ের ঢাকাটা খুলে ফেলতেই তোয়ালের ইস্পাতটা ঝকঝক করে উঠল। সাইকেলটা নিয়ে পিন্টু বেরিয়ে পড়ল। রুমা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। দুহাত জোড় করে মনে মনে বলল–ঠাকুর, রক্ষে কোরো।
.
অন্ধকার, শুধু অন্ধকার। তারই মধ্যে দিয়ে দুচোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে সাইকেল চুটিয়ে চলেছে পিন্টু। বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরেছে হ্যাঁন্ডেল। ডান হাতে খোলা তরোয়াল। তরোয়ালটা ঘোরাচ্ছে বাঁ দিক থেকে ডান দিক। যেন সমস্ত পার্থিব-অপার্থিব বাধা কাটিয়ে পথ করে নিচ্ছে।
রাস্তার ধারের দোলা আমগাছটার একটা ডাল ঝুঁকে পড়েছিল রাস্তার ওপর। হঠাৎ কী যেন মাথার ওপর পাখা ঝাঁপটে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে পিন্টু তরোয়ালের উল্টো পিঠ দিয়ে ডালে আঘাত করল। আর তখনই এক ঝাঁক বাদুড় জাতীয় কিছু পাখা জাপটে তার মাথার ওপর উড়তে লাগল।
পিন্টু জোরে সাইকেলটা চালাতে লাগল। কিন্তু সেগুলো যেন তার মাথা লক্ষ্য করেই এগিগে আসতে লাগল। পিন্টু এবার মাথার ওপর তরোয়ালটা ঘোরাতে লাগল।
এক মাইল দূরে ডাক্তারের বাড়ি। কেমন যেন আত্মভোলা হয়ে গিয়েছিল পিন্টু। বুঝতে পারছিল না কতদূর এসেছে।
হঠাৎ কাছেই জলের ওপর ঝপ করে কিছু পড়ার শব্দ শুনেই ডান দিকে তাকাল।
যমপুকুর।
হায়! এতক্ষণে যমপুকুর! তখনই সে একটা শব্দ শুনে চমকে গেল। কেউ যেন পুকুরটায় ডুব দিচ্ছে আর উঠছে।
আশ্চর্য! এত রাতে কে পুকুরে স্নান করছে?
পিন্টু সেদিকে তাকাল না। সোজা সাইকেল চালিয়ে চলল।
.
সত্যিই যে এত রাত্রে ডাক্তার আসবেন কেউ ভাবতে পারেনি। পরিচিত ডাক্তার। নান্টুর অসুখ গুরুতর শুনে না এসে পারেননি। তখনই ওষুধের ব্যাগ আর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন।
পিন্টুর হাতে খোলা তরোয়াল দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন–ও যে সত্যিকারের তরোয়াল! হঠাৎ তরোয়াল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছ।
পিন্টু বলল–সুভাষদা, এত রাতে একা আসতে ভয় করছিল। এ তরোয়াল আমাদের পূর্বপুরুষের। এর কোনো মহিমা আছে কিনা জানি না। তবে এটা হাতে তুলে নিতেই প্রচণ্ড সাহস পেলাম।
সুভাষ ডাক্তার নান্টুকে পরীক্ষা করে গম্ভীর হয়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি দুটো ইনজেকশন দিলেন। তারপর বসে রইলেন নান্টুর মাথার কাছে।
সারা রাত কাটল এইভাবে। ভোরর দিকে নান্টুর নিশ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল।
সুভাষ ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–আর ভয় নেই। একটা জোর ধাক্কা খেয়েছিল। সেটা সামলে গেছে। তবে পিন্টু আমাকে ডেকে না নিয়ে এলে ওকে বাঁচানো যেত না।
চা খেয়ে হাসিমুখে সুভাষ ডাক্তার ভোরবেলা বেরিয়ে এলেন।
হঠাৎ উনি চমকে উঠলেন–ইস্! এ কী!
সবাই দেখল এতদিনের বেড়ালটা দরজার পাশে মরে পড়ে আছে। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত।
কেউ যেন গত রাত্রে প্রচণ্ড আক্রোশে ওটাকে গলা টিপে মেরেছে।
[আষাঢ় ১৪০৫]
সত্যিই এই গল্পটি পড়ে আমার অসম্ভব ভালো লেগেছে এবং পছন্দ হয়েছে