অলৌকিক ক্যালেন্ডার

অলৌকিক ক্যালেন্ডার

লোকটিকে প্রথম থেকেই আমার বেশ মজার লেগেছিল। কুচকুচে কালো রঙ। একমাথা রুক্ষু চুল। লম্বা নাক। চোখ দুটো জ্বলজ্বলে। পাতলার ওপর গড়ন। দেখলে মনে হয় গম্ভীর প্রকৃতির। কিন্তু আলাপ হয়ে গেলে বেশ সহজ মানুষ বলেই মনে হয়।

এই মানুষটির সঙ্গে কিন্তু যে অবস্থায় আলাপ হয়েছিল তা বেশ সুখকর ছিল না।

সেবার পুজোর ছুটিতে দাক্ষিণাত্য ভ্রমণে গিয়েছিলাম। রামেশ্বরম, মহীশূর, কন্যাকুমারিকা দেখে শেষে তিরুপতি দর্শনে এসেছিলাম। বেশ উঁচু উঁচু পাহাড়। পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি হয়েছে। সেই আঁকাবাঁকা পথে বাসে করে পাহাড়ে উঠতে হয়। পাহাড়ের ওপর উঠেই অবাক! রীতিমতো শহর। যাই হোক এখান থেকে কিছুদূর হাঁটলে বা রিকশায় গেলে তিরুপতির মন্দির।

বেজায় ভিড়। দর্শনপ্রার্থীদের লম্বা লাইন। পুজো দিতে দিতে বিকেল হয়ে গেল। তারপর জায়গাটা ভালো করে দেখতে লাগলাম। পশ্চিম বাংলা থেকে এত দূর আসা তো আর বার বার হয় না। হয়তো এই প্রথম–এই শেষ।

দেখতে দেখতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি নামার জন্যে বাসস্ট্যান্ডে এলাম। কিন্তু হায়! লাস্ট বাস পাহাড় থেকে নেমে গিয়েছে। আজ আর নিচে নামার উপায় নেই।

মহা দুশ্চিন্তায় পড়লাম। কী করব এখন? এদিকে আলো জ্বলে উঠেছে। কিন্তু ওদিকে–অর্থাৎ পাহাড়ের দিকে জমাট অন্ধকার। ঐ অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ নেমে গিয়েছে। দুপাশে পাহাড়ী জঙ্গল। দেখলেও ভয় করে।

তাহলে? বললাম বটে জায়গাটা শহরের মতো, কিন্তু গেরস্তবাড়ি বিশেষ নেই। দোকানপাট, ব্যাঙ্ক, পোস্টাপিস এই সবই বেশি।

গেরস্ত লোক যদি বা থাকে তাহলেও কি এই অজানা অচেনা একজন বাঙালিকে কেউ আশ্রয় দেবে?

কী করব ভাবছি। এই সময়ে ঐ মানুষটির আবির্ভাব। ও যেন দেখেই আমার অবস্থা বুঝতে পেরেছে। হেসে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, বাস ফেল করেছেন?

এই রকম একটা জায়গায় ঐ রকম চেহারার মানুষের কাছে বাংলা কথা শুনব আশা করিনি। বিনীতভাবে বললাম, হ্যাঁ। লাস্ট বাস কখন জানতাম না।

–তা হলে এখন কি করবেন ভাবছেন?

–কিছুই তো ভেবে পাচ্ছি না।

 লোকটি হাসল।–তবে চলে আসুন এই গরিবের কুটিরে।

তাই যেতে হলো।

কুটিরই বটে! চারিদিকে পাহাড় আর জঙ্গল। তারই মধ্যে পাথর দিয়ে ঘেরা ঘরের মতো। মাথা গোঁজার আস্তানা। ভেতরে পিলসুজের ওপর মস্ত এক পেতলের প্রদীপ জ্বলছে। তারই ঘোলাটে আলোয় গুহাটা দেখলাম। একপাশে একটা খাঁটিয়া। একটা কম্বল আর তেলচিটে বালিশ। একটা দড়ি টাঙানো। তাতে গোটা দুয়েক ময়লা প্যান্ট–একটা ছেঁড়া তোয়ালে।

গুহার ওদিকে একটা কালো পর্দা টাঙানো–যেন থিয়েটারের স্টেজের স্ক্রিন।

লোকটি বলল, তিরুপতি তো দর্শন করলেন। আমার ঠাকুর দেখবেন না?

বলে পর্দাটা সরিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে যা দেখলাম তাতে আমার গা শিউরে উঠল। ফুল-পাতা ভরা একটা পুরনো কাঠের গামলার মধ্যে একটা মড়ার খুলি বসানো। খুলিটা সিঁদুরে সিঁদুরে লাল হয়ে গেছে।

এই রকম সিঁদুরমাখা খুলি আমি সাধুসন্ন্যাসীদের কাছে অনেক দেখেছি। এর জন্যে গা শিউরে ওঠেনি। শিউরে উঠেছিল অত বড়ো খুলি কখনো দেখিনি বলে।

এ কি মানুষের খুলি?

 লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।

–কি ভাবছেন?

 –এত বড়ো খুলি কোথায় পেলেন? এ কি মানুষের?

 লোকটি আবার হাসল। বলল, দানিকেন পড়েছেন তো? সেই অতিমানবের কথা?

আশ্চর্য হলাম। এ লোকটা দানিকেনও পড়েছে।

মুখে বললাম, হ্যাঁ, ওঁর সব কখানা বইই আমার পড়া।

লোকটি বলল, আমিও ওঁর মতে বিশ্বাসী। তা ছাড়া এই খুলিটাই তো একটা মস্ত প্রমাণ। নয় কি?

–এটা পেলেন কোথায়?

 এবারও এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে বলল, তবে দানিকেনের চেয়ে আমি আরো কিছু গভীর তত্ত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছি। বলে মৃদু হেসে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। আমিও আর কৌতূহল দেখালাম না।

সেদিন পাহাড়ের গুহায় কলা, চিড়ে আর দুধ খেয়ে খাঁটিয়ায় শুয়ে রাত্রিবাস হলো। বেশ ভালো করেই আলাপ জমল। লোকটির নাম কেশব রাও। জন্ম অনন্তপুর জেলায় পেনুকোণ্ডা শহরের কাছে। দীর্ঘকাল দেশ ছাড়া। এখন বাস তিরুপতির এই পাহাড়ে। লোকটির বিষয়ে আমি প্রথমে বলেছিলাম বেশ মজার লোক কিন্তু পরে মনে হয়েছে লোকটা বোধহয় একটু বিশেষ ধরনের পাগল।

প্রায় সারা রাত ধরে সে এমন সব কথা শোনালো যা পাগলামো ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না।

সে বললে, দানিকেনের মতে বহু সহস্র বছর আগে ভিন গ্রহ থেকে যে অতিমানবেরা পৃথিবী প্রায় আবিষ্কার করেছিল, এক সময়ে তারা আবার তাদের নিজেদের গ্রহেই ফিরে গিয়েছিল। এটা আমার মতে অ্যাবসার্ড–অসম্ভব।

কেশব রাও একটু হাসল। তারপর বলল, আমি মনে করি তারা কেউ ফিরে যায়নি। পৃথিবীতেই ছিল–পৃথিবীতেই আছে যে কোনো আকার নিয়ে।

তারপর ও বলল, তার এখন অনেক কাজ। সারা পৃথিবী ঘুরতে হবে। এইরকম খুলি আর কোথায় পাওয়া যায় দেখতে হবে।

একটু থেমে বলল, শুধু খুলি বা কঙ্কাল নয়। আমি বিশ্বাস করি তাদের আত্মাও এখনো বিশেষ বিশেষ জায়গায় আছে।

আমি আবার শিউরে উঠলাম।

এরপর সে যেন নিজের মনেই বলল–সবচেয়ে আগে যাওয়া দরকার ইস্ট ইউরোপে। কার্পাথিয়ান রেঞ্জ ট্রানসিলভেনিয়া–মোন্ডাভিয়াবুরো ভিনা—-বিসট্রিজ

এ সব কথা শুনতে আমার মোটেই ভালো লাগছিল না। তবু কিছু বলা উচিত মনে করেই বললাম–জায়গাগুলোর নামও তো শুনিনি।

কেশব রাও সরু করে হেসে বলল, ড্রাকুলা পড়েননি? ব্রাম স্ট্রোকারের ড্রাকুলা? সেই যে রক্তপায়ী পিশাচ যারা কত কাল ধরে–অ-মৃত অবস্থায় কবরে থাকে। কিন্তু রাত হলেই মানুষ-শিকারে বেরোয়।

 আমি বললাম, হ্যাঁ পড়েছি। কিন্তু সে তো গল্প।

–গল্প! কেশবের চোখ দুটো গোল গোল দেখালো।–আমি যদি তার প্রমাণ দেখাতে পারি?

সর্বনাশ! বললাম, না-না, প্রমাণে দরকার নেই।

–সেসব জায়গায় আমায় যেতে হবে। কিছু যে একটা আছে তা খুঁজে বের করতে হবে।

আমি নীরবে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। কোনো কৌতূহল প্রকাশ করলাম না।

এইভাবে সেই পাথরের গুহায় রাত কাটল। আমি খাঁটিয়ায় আর কেশব মাটিতে একটা বহু পুরনো বাঘছাল পেতে শুয়ে রইল।

সত্যি কথা বলতে কি সারা রাত বেশ ভয়ে ভয়েই কেটেছে। ভয়টা কেশবকে না তার ঐ অদ্ভুত ঠাকুরটিকে না অন্য কিছুতে বুঝতে পারিনি।

ভোর হলে প্রথম বাসটাই ধরার জন্যে যখন বিদায় নিচ্ছি তখন ভদ্রতার খাতিরে কেশবকে বললাম, যদি কখনো কলকাতায় আসেন তো দয়া করে আমার বাড়িতেই আতিথ্য গ্রহণ করবেন।

কেশব তখনই বলল, হ্যাঁ, কলকাতায় একবার আমায় যেতে হবে। বলে ঠিকানাটা দুর্বোধ্য ভাষায় লিখে নিল।

.

অনেক দিন কেটে গিয়েছে, কেশবের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন আমাদের সবার বাড়িতে কেশব এসে হাজির। ওকে দেখে প্রথমটা চিনতেই পারিনি। কি করে চিনব? কুচকুচে কালো রঙ, মুখে চাপ দাড়ি আগে ছিল না–পরনে দিব্যি শাট ও ট্রাউজার–চোখে বিস্কুটে কালো সানগ্লাস। বাঁ হাতে একটা বড়ো পুঁটলি আর ডান হতে সুটকেস। কেশব রাও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাসছে।

যখন ও পরিচয় দিল তখন আমি সত্যিই খুশি হলাম। আমার মনে পড়ল সেই রাত্রে আশ্রয় দেওয়ার কথা। আশ্রয় না পেলে কী হতে বলতে পারি না। সেই আশ্রয়দাতা আজ এসেছে আমার অতিথি হয়ে। এ কী কম সৌভাগ্য!

তা ছাড়া তিরুপতি থেকে ফিরে এসে এই কেশবের কথা বাড়িতে সবার কাছে গল্প করেছিলাম। ভাইপো-ভাইঝিরা তো কেশবের কথা শুনে রোমাঞ্চিত। কবে কেশব আসবে তার জন্যে পথ চেয়ে থাকত। এত দিন পর শেষ পর্যন্ত সে সশরীরে হাজির।

ছেলেমেয়েরা বেশ আগ্রহ করেই ওর সঙ্গে আলাপ করতে এল। কিন্তু কী জানি কেন ওকে দেখে প্রথমেই ছেলেমেয়েরা কেমন ভয় পেয়ে গেল। সে কি ওর কুচকুচে কালো রঙের জন্য না কি ওর বিস্কুটে চশমাটার জন্যে?

যাই হোক দিন দুয়েকের মধ্যেই ছেলেমেয়েরা ওর সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলল। ভাবটা ওদের সঙ্গে এমন জমল যে আমাকে যেন আর ওর দরকারই হয় না।

তবু দরকার হতো।

একদিন বলল, কলকাতায় পার্ক স্ট্রীট বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে নাকি খুব পুরনো কালের কবর আছে?

সর্বনাশ! এখানে এসেও যে কবরখানার খোঁজ করে!

মুখে বললাম, হ্যাঁ, তা আছে। তবে খুব আর কি পুরনো? মাত্র শ দু আড়াই বছর আগের।

–তাতেই হবে। আপনি একদিন নিয়ে চলুন।

অগত্যা কেশবকে নিয়ে একদিনযা কখনো করিনি তাই করলাম। কবরখানায় ঢুকলাম। সার্কুলার রোড আর পার্ক স্ট্রীটের মোড়ে গাছপালায় ঢাকা সেই পুরনো কবরখানা। ঢুকতেই গা ছমছম করে উঠল। কিন্তু কেশবের এসব কিছুই হলো না। সে মহা আনন্দে বাঁধানো কবরগুলো দেখতে লাগল। তারপর একটা খুব পুরনো ভাঙাচোরা কবরের কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ দাঁড়াবার পর ও উবু হয়ে বসল। তারপর তার হাতের লাঠিটা চালিয়ে দিল কবরের মাটির নিচে। এক সময়ে লাঠিটা সরিয়ে নিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল।

আমি তো ভয়ে কাঁটা। সাপে কামড়াবে যে! পাগল আর কাকে বলে?

 কিছুক্ষণ কবরের মাটি হাতড়াবার পর ও উঠল। আমার দিকে তাকিয়ে খুশ মেজাজে বলল, ঠিক হ্যায়।

কি ঠিক হ্যায় তা আর জিজ্ঞেস করার প্রবৃত্তি হলো না।

এরপর সে জানতে চাইল পুরনো কবরখানা আর কোথায় আছে। হুগলিতে ডাচেদের সময়ের অনেক কবর আছে শুনে সেখানে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল।

এদিকে বাড়িতে যেন কেমন একটু গোলমাল শুরু হয়েছে। ছেলেমেয়েদের তো পড়াশোনা মাথায় উঠেছে। তারা কেশবকে আঙ্কেল বলে ডাকে। আর গল্প শোনে। সবই ভূতের গল্প। কেশব লোকটার এই একটা গুণ–নির্জন পাহাড়ে দেশের লোক হলেও সে বেশ মিশতে পারে। ছেলেদের সঙ্গে এই মেশবার ক্ষমতা কোথা থেকে পেল কে জানে! গুহায় বাস করে এমন শার্ট-প্যান্টই বা পায় কোথা থেকে কে বলবে!

যাই হোক রোজ সন্ধ্যের সময়ে ছেলেমেয়েরা ওকে ঘিরে ধরত।–গল্প বললো আঙ্কেল। ভূতের গল্প। তোমার নিজের চোখে দেখা ভূতের গল্প।

আঙ্কেল অমনি গল্প শুরু করে দিত। এক-একদিন শুনতাম দানিকেন-ড্রাকুলাও এসে পড়েছে। মনে মনে হাসতাম।

কিন্তু নিছক হাসির ব্যাপার যে ছিল না তা সপ্তাহ খানেক পর থেকেই টের পেতে লাগলাম।

আমার ঘুমটা বরাবরই খুব পাতলা। একটু শব্দেই ঘুম ভেঙে যায়।

কদিন থেকেই রাত দুপুরে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। আর শুতে পাচ্ছি নিচের যে ঘরে কেশব থাকে সেই ঘরে টুন টুন্ করে কিসের যেন শব্দ। ঠিক যেন কে ঘণ্টা নেড়ে পুজো করছে।

একদিন দিদিমাও সেই শব্দ শুনলেন। পরের দিন সকালে বললেন, তোর ঐ কেশবের ঘরে ঘণ্টা বাজাচ্ছিল কে?

আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম।–ধ্যেৎ, অত রাতে খামকা ঘণ্টা বাজাতে যাবে কে?

উড়িয়ে দিলাম বটে কিন্তু মনে খটকা বিঁধে রইল। কেশবই কি গভীর রাতে পুজো করে? কার পুজো? তবে কি ও ওর ঠাকুর–সেই বিকট খুলিটা এখানে নিয়ে এসেছে।

ভাবতেও গা শিউরে উঠল। কিন্তু এসব কথা কেশবকে জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। ও বলবে না। উল্টে চটে যাবে।

সেদিন আর এক কাণ্ড! দুপুরবেলা বাড়িতে কেউ ছিল না। কেশবের ঘরে তালা বন্ধ। ওকে নিয়ে হুগলির একটা গ্রামে গিয়েছিলাম। বলা হয়নি–ইদানিং ও ধরেছিল গ্রাম দেখবে। গ্রাম দেখবে না ছাই! খুঁজবে গ্রামের পুরনো কবরখানা।

যাই হোক, বাড়িতে কেউ নেই। ছেলেমেয়েরাও ইস্কুলে। নিচে নামছিলেন। দিদিমা তো ঘুমোচ্ছেন। কেশবের ঘরের কাছে আসতেই উনি থমকে দাঁড়ালেন। স্পষ্ট শুনলেন সেই বন্ধ ঘরের মধ্যে খট্ খট্ করে কী যেন চলে বেড়াচ্ছে।

মায়ের মুখে এ কথা শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

আমার স্থির বিশ্বাস হলো কেশব সেই খুলিটা এখানে নিয়ে এসেছে।

পরের দিনই–কেশব যখন স্নান করতে গিয়েছে তখন চুপি চুপি ওর ঘরে ঢুকলাম। আমার সন্দেহ ছিল ওর পুঁটলিটায় কিছু আছে। সেটা খুলে ফেললাম। দেখলাম ভেতরে কালো কাপড়ে জড়ানো কী রয়েছে। আমার হাত কেঁপে উঠল। কোনো রকমে পুঁটলিটা বেঁধে বেরিয়ে এলাম।

তারপর মনে মনে কেবলই চিন্তা করতে লাগলাম লোকটা কবে এখান থেকে যাবে।

আমি ওর চলে যাবার জন্য ব্যস্ত হলে কী হবে? ছেলেরা ওকে ছাড়তে চায় না। ওরা কেবল জেদ ধরে–আঙ্কেল, সত্যি ভূত বলে কিছু আছে? সত্যি তুমি ভূত দেখেছ? তা হলে আমাদের ভূত দেখাও।

এই ভূত দেখাবার কথা হলেই ওদের আঙ্কেল কিন্তু সত্যি সত্যি চটে যায়। ধমকে উঠে বলে, ছেলেমানুষি নাকি? ভূত দেখাব বললেই দেখানো যায়? নাকি দেখব বললেই দেখা যায়?

কথাটা একটু ধমকানির সুরেই বোধহয় বলেছিল যার জন্যে আমার যে ভাইঝিটি ওকে সবচেয়ে ভালোবাসত সে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। বলে গেল, আঙ্কেল, তোমার সঙ্গে আড়ি-জন্মের মতো আড়ি। আর কখনো তোমার কাছে গল্প শুনব না।

আচ্ছা জেদী মেয়ে এই রুণা। তারপর কতবার কেশব সাধ্যসাধনা করেছে, ও আর আঙ্কেলের কাছে আসেনি। ভূত দেখতেও চায়নি।

এর কদিন পরেই কেশব হঠাৎ বলল, চললাম।

আঃ! এর চেয়ে সুখবর বুঝি আর কিছু হয় না!

মুখে বললাম, এরই মধ্যে যাবেন কেন?

কেশব বললে, অনেক দিন তো থাকলাম। আর নয়।

–কোথায় যাবেন? ইস্ট ইউরোপ?

না, আগে নেপাল।

কেন হঠাৎ নেপাল যাবেন তা আর জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না।

যাবার দিন বিদায়ের পালা। ছেলেমেয়েদের চোখ ছলছল। রুণাও এসেছে। কেশব ওকেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত। তাই একটু আদর করল। ওর চোখেও জল। রুণা কাদো কাঁদো হয়ে বলল, আঙ্কেল, তুমি আবার আসবে তো?

কেশব তার স্বভাব মতো হাসল–আমার ওপর রাগ পড়েছে তো দিদিমণি?

বা, তুমি তো ভূত দেখালে না?

 কেশবের মুখটা শুকিয়ে গেল। বিমর্ষ হয়ে পড়ল। ভূত কি কাউকে দেখানো যায়? এ কি সম্ভব?

আমি রুণাকে একটু বকলাম। রুণা মুখ ভার করে রইল।

–আবার আসবে তো? ছেলেরা জিজ্ঞেস করল।

কেশব কি ভেবে বলল, কথা দিচ্ছি না। তবে আসবার চেষ্টা করব যদি মরে না যাই।

আমার ভাগ্নেটি একটু ভেঁপো। বলে উঠল–তুমি মরে গেছ কিনা জানব কি করে? আমরা তো তোমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকব।

কেশব কী ভাবল। তারপর হঠাৎ ঘরে গিয়ে পুঁটলি খুলে কি একটা গোল করা কাগজ এনে আমার হাতে দিল। সেটা খুলে দেখি একটা ক্যালেন্ডার। ক্যালেন্ডারের ছবিটা অদ্ভুত। ছাপা নয়। কেশবই বোধহয় নিজে হাতে গোটাকতক ছক কেটে ক্যালেন্ডারের সঙ্গে এঁটে রেখেছে।

ক্যালেন্ডারটা হাতে নিয়ে আমি বললাম, এটা নিয়ে কি করব?

ও বলল, দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখবেন। যেদিন দেখবেন ক্যালেন্ডারটা উল্টে গেছে সেদিন বুঝবেন আমি আর নেই।

এ আবার কী কথা! অবাক হব, না হাসব, না ভয় পাব বুঝে উঠতে পারলাম না।

.

বছর দুই-তিন কেটে গেছে। কেশবের কথা ভুলেই গেছি। ছেলেমেয়েরাও ইতিমধ্যে বেশ বড় হয়ে গেছে।

সেদিন সন্ধ্যেবেলায় বাইরের ঘরে ওরা পড়াশোনা করছে। আমি একটা ম্যাগাজিন পড়ছি। হঠাৎ মনে হলো কে যেন দরজার সামনে নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে। চমকে তাকিয়ে দেখি–কেশব রাও। দরজায় দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।

ওকে প্রথমে চিনতে পারিনি। সেই কুচকুচে কালো রঙ আর নেই। কেমন যেন ফ্যাকাশে। মুখটা শুকনো। ঘন কালো দাড়ির বদলে পাতলা পাতলা বিবর্ণ দাড়ি ঝুলছে। চুল এলোমেলো। সবচেয়ে অবাক হলাম–ওর হাতে সুটকেসও নেই–সেই পুঁটলিটাও নেই।

–রাও সাহেব না?

কেশব রাও একটু হেসে আমায় নমস্কার করল।

–আসুন–আসুন। স্বাগতম।

 ছেলেমেয়েরাও আনন্দে লাফিয়ে উঠল–আঙ্কেল এসেছে–আঙ্কেল এসেছে

 তারপরই ওরা ধরল–আঙ্কেল গল্প–অনেক গল্প

আমি ওদের ধমকে শান্ত করলাম।

–আজ উনি ক্লান্ত। দেখছ না ভালো করে দাঁড়াতেও পারছেন না। আসুন মিস্টার রাও।

যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম–আপনি কি এখন নেপাল থেকেই এলেন?

কেন জানি না রাও তার কোনো উত্তর দিল না।

তারপর কেশবকে সেই ঘরে নিয়ে এলাম। বললাম, খাওয়া-দাওয়া করে আজ বিশ্রাম করুন। কাল সবাই মিলে গল্প শুনব।

কেশব কিন্তু কিছুই খেতে চাইল না। বলল, আমি একটু ঘুমোতে চাই।

আমি ওখানেই ওর শোবার ব্যবস্থা করে দিলাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে অবাক। কেশব নেই। ঘর খালি। কিরকম হলো? এত সকালে গেল কোথায়?

বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলাম–যেমন ফর্সা চাদর পেতে দিয়েছিলাম তেমনই আছে। কেউ যে শুয়েছিল তা মনে হয় না। গেলাসে জল দিয়েছিলাম। সেটাও ঠিক তেমনি ঢাকা পড়ে আছে। অর্থাৎ ঘরে যে কেউ ছিল তার চিহ্নমাত্র নেই।

মনে মনে যেমন অবাক হলাম তেমনি দুঃখও পেলামকেশবের এমনি ভাবে পালিয়ে যাওয়াটা ঠিক হয়নি।

এমনি সময়ে কে যেন এসে আমায় দ্বিগুণ অবাক করে দিয়ে বলল, পালিয়ে যাবে কি বাইরের দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধই রয়েছে।

এইবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে আবার কী?

এ রহস্যের মীমাংসা আমরা কেউ করতে পারলাম না। তবে সেইদিনই খবরের কাগজের এক কোণে একটা ছোট্ট খবর ছিল। পার্ক স্ট্রীটের পুরনো কবরখানায় এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির মৃতদেহ পাওয়া গেছে। তার সঙ্গে ছিল একটা পুঁটলি। পুটলির মধ্যে পাওয়া গেছে একটা অস্বাভাবিক মড়ার মাথার খুলি! মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। পুলিশ তদন্ত করছে।

আমার হাত থেকে কাগজটা পড়ে গেল। বুঝতে বাকি রইল না অজ্ঞাতপরিচয় মানুষটি কেশব রাও ছাড়া আর কেউ নয়। তার বডি পাওয়া গেছে কাল সকালে। তাহলে কাল রাত্তিরে আমার বাড়ি কে এল?

তবে কি ও নেপাল থেকে ফিরে কলকাতাতেই ছিল? তাহলে

কেনই বা শুধু এক রাত্তিরের জন্যে এল? আর–আর তার মৃত্যু হঠাৎ কবরখানাতেই বা হলো কেন?

সবই রহস্যময়। তখনই কী মনে হলো ছুটলাম পাশের ঘরে। দেখি রুণা কখন এ ঘরে এসে ক্যালেন্ডারটার দিকে জলভরা চোখে তাকিয়ে রয়েছে। ক্যালেন্ডারটা এত দিন পর কে যেন উল্টে দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *