সুলতানের কবর
দেওয়ালে হাতের ছাপ
কোনো মূল্যবান জিনিস বাড়ি থেকে হঠাৎ কর্পূরের মতো উবে গেলে মানুষ কতদিন তার খোঁজ করতে পারে? বড়ো জোর এক মাস, দুমাস। তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে। মনকে বোঝায় নিশ্চয় ওটা চুরি গেছে। চুরি হয়ে গেলে আর ফিরে পাবার উপায় নেই।
আমার যে জিনিসটা ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল, তা কেমন করে গেল তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনি। জিনিসটা আমার একটা ডায়েরি। বাড়িতে আমি একা। আমার কোনো দিনই এমন বন্ধু-বান্ধব ছিল না যে কাউকে পড়তে দেব। পড়তে দেওয়া দূরের কথা, কাউকে পড়েও শোনাইনি। অথচ ডায়েরিটা উধাও হয়ে গেল।
ডায়েরিটা অন্যের কাছে এমন কিছু মূল্যবান নয়। কিন্তু আমার কাছে ওর মূল্য অপরিসীম। আবার এটাও ঠিক ঐ ডায়েরিতে এমন কিছু গোপন তথ্য ছিল যা পড়লে যে কেউ লুব্ধ হতে পারে। তারপর হয়তো আমাদেরই মতো ছোটোখাটো একটা অভিযান চালাতে গিয়ে
যাক সে কথা।
তা সেই ডায়েরিটার জন্যে সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি, সম্ভব-অসম্ভব কোনো জায়গাই বাদ দিইনি। আর এই কাজ করেছি কয়েক বছর ধরে। তারপর একদিন হতাশ হয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছিলাম।
এরপর সেদিন আমার এই তিরাশি বছর বয়েসে হঠাৎই সেই ডায়েরিটা খুঁজে পেলাম।
কোথায় পেলাম জান? আমার বইয়ের আলমারির ওপর। কেউ যেন এইমাত্র ওটা ওখানে রেখে দিয়ে গেছে। অথচ ঐ জায়গায় আমি কত দিন ধরে কত বার খুঁজেছি!
বুঝতে পারি না আমার ট্রাঙ্কের নিচে যেখানে সেই ১৯৩৫ সালে ওটা রেখে দিয়েছিলাম, তারপর যে কোনো কারণেই হোক ঐ ডায়েরিটা ছুঁতে আর ভরসা পাইনি, সেই ডায়েরিটা ওখান থেকে কে কিভাবে বের করে নিল? আর এতগুলো বছর পর কেই বা সেটা আমার নাকের ডগায় রেখে দিয়ে গেল? রেখে দিয়ে গেল এমন একটা সময়ে যখন দুরারোগ্য রোগে আমি একরকম শয্যাশায়ী। যখন আমি মৃত্যুর জন্যে দিন গুনছি।
ডায়েরিটা কেমন করে উধাও হয়ে গিয়েছিল, সে রহস্য নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না। ওটা যে পেয়েছি এটাই আমার মস্ত বড় লাভ। মৃত্যুর আগে অন্তত আর একবার ডায়েরিটা পড়ে নিতে পারব।
রাতে শোবার আগে রতন আমায় যেমন নিয়মিত ওষুধ আর ঘুমের বড়ি খাইয়ে দেয়, তেমনি খাইয়ে পাশের ঘরে শুতে চলে গেল।
ভেবেছিলাম বহুকাল পরে ডায়েরি ফিরে পাওয়ার আনন্দে নিশ্চিন্তে ঘুমোব। কিন্তু তা হলো না। গভীর রাতে একটা ঘটনা ঘটল।
আমার বিছানার কাছেই একটা ছোটো টেবিলে কিছু দরকারি ওষুধ-পত্তর, টর্চ আর একটা টাইমপিস থাকে। মাঝে মাঝে যখন ঘুম ভেঙে যায় তখন টাইমপিসটা দেখি কটা বাজল। প্রহর গুনি কখন ভোর হবে।
আজ হঠাৎ একটা খসখস শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। রতন কি এ ঘরে ঢুকেছে? মশারির মধ্যে থেকে হাত বাড়িয়ে টর্চটা নেবার আগেই দেখলাম ঘরের মধ্যে একটা দীর্ঘ ছায়ামূর্তি। ক্রমে সেটা মানুষের মতো আকৃতি নিল। পরিষ্কার দেখলাম তার গায়ে রাজপোশাক ঝলমল করছে। কোমরে মস্ত বড়ো তরোয়াল, পায়ে ভেলভেটের নাগরা। মনে হলো বিগত যুগের কোনো সুলতান।
নিশ্চয় ভুল দেখছি মনে করে উঠে বসে দুচোখ রগড়ে নিলাম।
না, ভুল নয়। সত্যিই কোনো সুলতান দাঁড়িয়ে আছেন মাত্র দশ হাত দূরে দেওয়ালের কাছে। তাকিয়ে আছেন আমার দিকে আগুনঝরা চোখে। হঠাৎ দেওয়ালে আঙুল দিয়ে কিছু যেন লিখলেন তিনি। তারপরই ম্যাজিকের মতো অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
আমি উঠতে গেলাম, কিন্তু পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। এত কাল পরে উনি হঠাৎ কেন এবং কি করে গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে উঠে এসে আমার এই গরিবখানায় দেখা দিলেন বুঝতে পারলাম না। তবে উনি যে ক্রুদ্ধ হয়েছেন তা বুঝতে ভুল হয়নি।
সকালবেলা রতন গরম কফি নিয়ে এসে ডাকাডাকি করতে ঘুম ভেঙে গলে। ধড়মড় করে উঠে পড়লাম। তারপর কফি খেয়ে সুলতান যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানে এগিয়ে গেলাম।
কী আশ্চর্য! দেওয়ালে ফারসী ভাষায় কাঁপা কাঁপা হাতে অস্পষ্ট কয়েক ছত্র লেখা।
ফারসী ভাষা কিছুটা শিখেছিলাম তাই পাঠোদ্ধার করে ফেললাম। লেখা হয়েছে–সাবধান! এই ডায়েরির কোনো অংশ কাউকে পড়ে শোনাবে না। এমনকি তোমার কাজের লোকটিকেও না। যদি শোনাও তাহলে তোমার স্বাভাবিক মৃত্যুর আগেই আমার হাতে মরতে হবে। নিচে সই নেই। তার বদলে আছে হাতের ছাপ। আঙুল তো নয় শুধু সরু সরু কয়েকটা হাড়।
.
জেকব অ্যান্টনী
সেই ক্রুদ্ধ, নিষ্ঠুর সুলতানের আত্মা আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন আমি যেন ডায়েরির লেখা কাউকে পড়ে না শোনাই। কিন্তু ডায়েরির গোপন কথা নিয়ে লিখতে পারি কিনা সে বিষয়ে কিছু বলেননি। আর লিখলেও যদি তিনি আমার কোনো ক্ষতি করেন তো করুন। ভয় পাই না। কেন না আমি তো মৃত্যুর দরজায় পা বাড়িয়েই আছি। তাই ডায়েরির কথা শুরু করি।
সুলতান সৈফুদ্দীন হামজা শাহ বা ফিরোজ শাহ ছিলেন গৌড়ের সুলতান। সময় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে। তিনি যে কী নিষ্ঠুর ছিলেন তা পরে বলব। এখন আগের ঘটনায় আসি।
জেকব অ্যান্টনী যার সঙ্গে আমি গৌড়-পাণ্ডুয়ার ধ্বংসাবশেষে গোপন অভিযান চালিয়েছিলাম, সে ছিল একজন খ্রিস্টান পর্যটক এবং প্রত্নতত্ত্ববিদ। যেখানে যত প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ আছে সেখানে সে অভিযান চালাত। বৃটিশ গভর্নমেন্ট তাকে পুরনো জায়গা খোঁড়াখুঁড়ির অনুমতিও দিয়েছিল। তাতে দরকার হলে সে লোকজন নিয়েও অনুসন্ধান চালাতে পারত।
আমি থাকতাম দেশের বাড়িতে। মা-বাবা মারা গেছেন আমার ছোটোবেলায়। আমার কেউ কোথাও ছিল না। ফলে বেশ বেপরোয়া আর দুঃসাহসী হয়ে উঠেছিলাম। বাবার কিছু টাকা ছিল। ছিল মাথা গোঁজবার জায়গা। আর ছিল কিছু ধানজমি। কাজেই একা মানুষের বেশ কেটে যেত।
এছাড়া করতাম গাইডের কাজ। আমাদের এলাকায় অনেক পুরনো মন্দির আছে। আছে বর্ধমান মহারাজাদের রাজবাড়ি। সারা বছর টুরিস্টরা আসত। তাদের আমি খুব আগ্রহভরে সেইসব মন্দির আর রাজপরিবারের ইতিহাস শোনাতাম। অবশ্য বাবার কাছ থেকেই সব শুনেছিলাম। বাবা এক সময়ে রাজ এস্টেটে কাজ করতেন। টুরিস্টরা খুশি হয়ে আমাকে কিছু কিছু দিত। সেটাও আমার লাভ।
আমার নেশা ছিল বনে-জঙ্গলে যেখানে যত ভাঙা মন্দির-মসজিদ আছে সেখানে ঘুরে বেড়ানো। কত কী যে লক্ষ্য করতাম তা লিখে বোঝাতে পারব না।
সেদিনও বাড়ি থেকে একটু দূরে নদীর ধারে ঘুরছিলাম। এখানে লম্বা সার দেওয়া বহু প্রাচীন ইটের গাঁথনি আছে। অনেক জায়গাতেই ইট নেই। হয়তো ভেঙে পড়ে গেছে। কিংবা চুরি গেছে। এখানে বড়ো একটা কেউ আসে না। তাই আমি বেশ একা একা ঘুরে বেড়াই। এই ইটের সারগুলো দেখে আমার কত কী মনে হয় যা কাউকে বলা যায় না। লোকে পাগল বলবে।
হঠাৎ জুতোর মসমস শব্দ শুনে চমকে ফিরে দেখি প্যান্ট-কোট পরা, মাথায় হ্যাট একজন লোক মুখে চুরুট গুঁজে এই দিকে আসছে। তার কাঁধে চামড়ার মস্ত ব্যাগ।
আমাকে দেখে চুরুট সরিয়ে হেসে বলল, What are you doing here young man?
লোকটার গায়ের রঙ কালো। ঠোঁটের ওপর পুরু গোঁফ। বেশ সুস্থ-সবল বেঁটে-খাটো চেহারা। দুচোখে ধূর্ত চাউনি। দেখলেই মনে হয় শুধু কর্মঠই নয়, সাহসীও।
উত্তরে আমি বললাম, আপনি কোথা থেকে আসছেন? আপনাকে তো কখনো দেখিনি।
লোকটা ঝপ করে ঘাসের ওপর বসে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে ঢকঢক করে খানিকটা খেয়ে নিয়ে বলল, আমার নাম জেকব অ্যান্টনী। আপাতত এসেছি কর্ণসুবর্ণ থেকে। কর্ণসুবর্ণ কোথায় জান তো?
বললাম, জানি বৈকি। মুর্শিদাবাদ জেলায়। ঐতিহাসিক জায়গা। এক সময়ে বাংলার রাজধানী ছিল।
ভেরি গুড। তুমি তাহলে হিস্টোরিকাল জায়গাটায়গার খবর রাখ?
হ্যাঁ। ঐতিহাসিক জায়গাগুলো দেখতে আমার খুব ইচ্ছে করে।
ভেরি গুড, ভেরি গুড।
আপনি আমাদের দেশে কী করতে এসেছেন?
জেকব হেসে বলল, বাঃ! আসব না? তোমাদের এই কালনা তো বহু পুরনো জায়গা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে কালনার বানান কি লিখত জান?
আমি মাথা নাড়লাম।
Culna-কুলনা।
আমি অবাক হয়ে গেলাম।
জেকব বলতে লাগল, এখানে মুসলমান আমলের বেশ কয়েকটা ভাঙা মসজিদ আছে। বর্ধমান রাজাদেরও অনেক কীর্তি আছে।
আমি বলে উঠলাম, বর্ধমানের রাজাদের দুটো সমাজবাড়িও আছে। একটা পুরনো সমাজবাড়ি, আর একটা নতুন সমাজবাড়ি।
What? সমাজবাড়ি?
হ্যাঁ। রাজপরিবারের প্রয়াত সদস্যদের অস্থিভস্ম এই দুই সমাজে রাখা আছে।
শুধু হাড় আর ছাই? ওতে আমি ইন্টারেস্টেড নই। আমি চাই কফিনের মধ্যে রাজা রাজড়াদের বড়ি–ডেডবডি।
বলতে বলতে জেকবের দুচোখ ঝকঝক করে উঠল, সেরকম কিছু আছে? মাথা নাড়লাম। বললাম না।
জেকব যেন আমার কথায় হতাশ হলো। এইভাবেই জেকবের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। কথায় কথায় জেকব জানাল, দুদিন আগে সে এখানে এসেছে। উঠেছে একটা হোটেলে। এর মধ্যে পুরনো মন্দির, মসজিদগুলো দেখে নিয়েছে। এখন ঘুরতে ঘুরতে এই নদীর ধারে এসেছে। আমি সেই ইটের সারগুলো দেখিয়ে বললাম, এগুলো কি বলতে পারেন সাহেব?
জেকব দুএকটা ভাঙা ইট পরীক্ষা করে বলল, মনে হচ্ছে কোনো রাজবাড়ির ভাঙা পাঁচিল।
নো-নো সাহেব, এগুলো হচ্ছে নীল চাষের জায়গা। আগে ইটের বড়ো বড়ো চৌবাচ্চা করে নীল গাছ ভিজিয়ে রাখা হতো। নীলকর সাহেবরা আমাদের দেশের গরিব চাষীদের ওপর কত যে অমানুষিক অত্যাচার করেছে তা জান না?
জানি, জানি। শুধু জানতাম না তোমাদের কালনাতেও নীলচাষ হতো।
এরপর আরও দুদিন জেকব আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরল। আমার সৌভাগ্য, আমাকে ওর খুব ভালো লেগেছে। তারপরই সে আমায় সেই লোভনীয় প্রস্তাবটা দিল। বলল, মালদা গিয়েছ? গৌড়-পাণ্ডুয়া দেখেছ?
বললাম, না।
সে কী! গৌড়-পাণ্ডুয়া না দেখলে বাংলার সুলতানদের ইতিহাস জানা যায় না। সারি সারি ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এখনও লুকিয়ে আছে কত ঐশ্বর্য সে তুমি না দেখলে ভাবতে পারবে না।
আমি বললাম, আপনি গৌড়-পাণ্ডুয়া গিয়েছেন?
জ্বলন্ত চুরুটটা দাঁত থেকে সরিয়ে জেকব হেসে বললে, এক-আধবার নয়, থার্টিন টাইমস।
এত বার গিয়েও আবার যাবেন?
হ্যাঁ। তার কারণ আমি শুধু টুরিস্টদের মতো চোখের দেখা দেখি না। আমি কিছু খুঁজে বেড়াই।
কী খোঁজেন?
তা আমি এখন বলব না। তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
আমি সানন্দে বলে উঠলাম, নিশ্চয় যাব।
তবে একটা কথা, আমি যেখানে যেখানে যাব, যা যা করব তা শুধু তুমি দেখে যাবে। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করতে পারবে না। আর কাউকে কোনো দিন বলবে না।
ঠিক আছে।
আর আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে ফল খারাপ হবে মনে রেখো।
বললাম, ঠিক আছে।
তা হলে কালনায় আর থেকে লাভ নেই। কালই বেরিয়ে পড়ব।
কোথায় যাব প্রথমে?
মালদা। সেখান থেকে গৌড়-পাণ্ডুয়া। তারপর একটু থেমে বলল, মালদহ নাম কেন বলতে পার?
মাথা নাড়লাম।
জেকব বলল, কেউ কেউ বলেন মলদ নামে একটি ট্রাইব বা সম্প্রদায় ছিল। ঐ মলদ থেকে নাম হয়েছে মালদহ। আবার কেউ কেউ বলেন, ফারসী মাল আর বাংলা দহ এই দুই শব্দ মিলে হয়েছে মালদহ। মাল শব্দের মানে ধনদৌলত। দহ শব্দের মানে সাগর। তাই মালদহের মানে ধন-সাগর। এই নামই বুঝিয়ে দেয় মালদহের মধ্যে প্রাচীন ঐশ্বর্য এখনও কত লুকিয়ে আছে।
বলতে বলতে জেকবের দুচোখ লোভীর মতো চকচক করে উঠল।
আমার সেটা ভালো লাগল না। যারা টুরিস্ট, যারা প্রত্নতত্ত্ববিদ, যারা মাটি খুঁড়ে প্রাচীন ইতিহাস খুঁজে বেড়ায়, ধন-ঐশ্বর্যের কথায় তারা এমন লুব্ধ হবে কেন?
যাই হোক পরের দিনই আমরা মালদা রওনা হলাম।
.
কাকদর্শন
আজ এই ১৯১৯ সালে যাঁরা গৌড়-পাণ্ডুয়া দেখতে যাবেন তারা কল্পনাও করতে পারবেন না সেই ১৯৩৫ সালে সেখানকার অবস্থা কিরকম ছিল।
চারদিক ফাঁকা। এদিকে-ওদিকে ধু ধু মাঠ। দুধারে বাবলা গাছ। কোথাও বা আমবাগান। কঁচা ধুলোভরা রাস্তা জনমানবশূন্য। মাঠের ওপর দিয়ে দুপুরবেলা হু হু করে গরম বাতাস বয়। মনে হয় যেন কত যুগের মৃত, ক্ষুব্ধ আত্মারা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। যেন বলছে, আর ওদিকে এগিয়ো না। ওখানে শুধু এখন আমাদের রাজত্ব। আমাদের বিরক্ত কোরো না। ভালোয় ভালোয় ফিরে যাও।
গৌড়-পাণ্ডুয়ার মুখে যে কয়েকটা আদিবাসীদের মাটির ঘর ছিল, সূর্য ডোবার আগেই সেসব ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ হয়ে যেত। কেউ আর বেরোত না। একটা অজানা ভয়। সে ভয় কিসের তা কেউ বলতে পারত না। শুধু মনে হতো মৃত নিষ্ঠুর সুলতানদের অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। জীবিত অবস্থায় যেমন তেমনি মৃত্যুর পরও কখন যে কার ওপর তাদের কোপ ও দৃষ্টি পড়বে কেউ তা বলতে পারত না।
জেকব অ্যান্টনী অবশ্য এসব বিশ্বাস করত না। সে বলত ওসব মূর্খ ভীতু মানুষদের মনের ভুল–অন্ধ কুসংস্কার।
আমিও তো তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা ঘটল—
থাক সে কথা। এখন আমার সেই ডায়েরি থেকে লিখি।
.
৫ মার্চ ১৯৩৫
নতুন কিছু দেখার আনন্দে মন নাচছে। আজ রানাঘাট স্টেশন থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জারে উঠে লালগোলায় নামলাম। তারপর লালগোলা ঘাট। সেখান থেকে স্টীমারে পদ্মা পার হলাম। সে কী রোমাঞ্চ! এসব পথে কখনও আসিনি। জেকব একমনে কীসব নোট করছে। আমার সঙ্গে কম কথা বলছে। আমরা নামলাম গোদাগাড়ি ঘাটে। সেখান থেকে মিটার গেজের ট্রেনে মালদা ফোর্ট স্টেশন। আবার জলযাত্রা। এবার মহানন্দা নৌকোয় পার হয়ে এসে পৌঁছলাম মালদা টাউনে।
নামেই টাউন। টাউনের চাকচিক্য কিছু নেই। প্রাচীন ঐতিহাসিক স্মৃতির চাদর জড়িয়ে শহরটা যেন নতুন যুগের মানুষদের অবাক হয়ে দেখছে।
এখানে হোটেল-টোটেল বিশেষ নেই। অথচ হোটেল ছাড়া উঠব কোথায়? সঙ্গে দুজনেরই হালকা বেডিং। আমার কাঁধে একটা ব্যাগ। তাতে টর্চ তো আছেই তা ছাড়া আছে জামা কাপড় চটি-জুতো তেল সাবান গায়ের চাদর দড়ি ছুরি ইত্যাদি।
একজন দোকানদারকে বলতেই সে একটা হোটেলের ঠিকানা দিল। হোটেলটা গোলাপট্টিতে। বিহারী ঠাকুরদের হোটেল। নতুন হয়েছে। এখানে সবচেয়ে পুরনো হোটেল কালীর থানের উত্তর দিকে। সেখানেও জায়গা ছিল। কিন্তু পছন্দ হলো না জেকবের।
.
৭ মার্চ
এখানে আসতে বেশ ধকল গিয়েছিল। তাই জেকব যখন বললে, একটা দিন রেস্ট নাও, তখন খুব খুশি হলাম। কিন্তু সে নিজে রেস্ট নিল না। চা খেয়েই বেরিয়ে গেল, ঘণ্টা চার পরে ফিরল। বললাম, কোথায় গিয়েছিলে?
উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে শুধু বলল, এই একটু
ওর এড়িয়ে যাওয়াটা আমার ভালো লাগল না। বুঝলাম বয়েসে কম বলেই আমকে উপেক্ষা।
মরুক গে। নতুন জায়গা দেখব বলে এসেছি। সেটুকু দেখা হলেই আমি খুশি।
সকালেই চা, টোস্ট আর ডিমের ওমলেট খেয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিলাম। জেকবের পরামর্শে একটা ওয়াটার-বটল কিনে নিয়েছি। জেকব বললে, ওখানে খুব জলকষ্ট। কাছাকাছি এমন কোনো গেরস্থালি নেই যে জল চেয়ে পাওয়া যাবে।
এতক্ষণে জিগ্যেস করতে সাহস পেলাম, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?
উত্তরে সংক্ষেপে বললে, গৌড়।
আর পাণ্ডুয়া?
জেকব তখনই উত্তর দিল না।
বুঝলাম প্রশ্ন করাটা পছন্দ করছে না।
একটু পরে বলল, যদি দরকার বুঝি তাহলে অন্য দিন। গৌড়-পাণ্ডুয়া একসঙ্গে আমরা বলি বটে কিন্তু গৌড় একদিকে, পাণ্ডুয়া অন্যদিকে।
আমি সত্যিই বোকা, তাই একটু আগেই ধমক খেয়েও ফের প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা মালদহর নাম কি ইংরেজবাজার?
উত্তরে জেকব শুধু বললে, গাড়িতে উঠে পড়ো।
ব্যস। আর কথা নয়। গাড়িতে উঠে পড়লাম।
গাড়ি মানে এক্কাগাড়ি। এক ঘোড়ার এক্কাগাড়ি। আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল। উঠে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল।
সময়টা মার্চ মাস। অর্থাৎ ফাল্গুন মাস। শীত নেই। গরমের কষ্টও নেই। আকাশ পরিষ্কার।
সকাল সাতটায় এক্কা ছাড়ল। বেশ তেজী ঘোড়া। মালদহ ছাড়ার একটু পরেই মকদুমপুরে একটা শিবমন্দিরের কোল ঘেঁষে যে রাস্তাটা মোচড় খেয়ে সোজা দক্ষিণে চলে গেছে, সেই দিকে আঙুল তুলে জেকব বলল, ঐ যে শিবমন্দির, ওটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জনৈক রাজা রায়চৌধুরী। এই রাস্তাটার নাম গৌড় রোড। কোম্পানির আমলে এর নাম ছিল নবাবগঞ্জ রোড। আবার নবাব বা সুলতানী আমলে ছিল শাহী সড়ক। আমি তখনই তা নোট করে নিলাম। মনে মনে খুশি হলাম, জেকব অনুগ্রহ করে মুখ খুলেছে।
বেশ যাচ্ছিলাম। সকালের রোদটি মিষ্টি লাগছিল। দুপাশে ধু ধু প্রান্তর। ঝিরঝিরে হাওয়া। জানলাম গৌড়-নগরে ঢুকতে খুব দেরি নেই। পুরনো গড় পার হলেই গৌড় দর্শন শুরু হবে।
এই সময়ে উটকো একটা বিপত্তি শুরু হলো। কোথা থেকে একটা কাক উড়ে এসে আমাদের মাথার ওপর চক্কর কাটতে লাগল। আর বিকট শব্দে ক্যা-ক্যা করতে লাগল।
কাক যে অত বড়ো হয় জীবনে কখনো দেখিনি। পাহাড়ের দেশ হলেও না হয় কথা ছিল। কিন্তু এ তো একেবারে আমাদের সুজলা সুফলা বাংলাদেশ। শুধু বিরাট আকারই নয়, ডাকটাও ভয়ঙ্কর। চোখ দুটো ঘুরছে। মনে হচ্ছিল এখনই ঠোঁট দিয়ে ঠোক্কর মারবে।
গাড়োয়ান দুবার চাবুক তুলে শূন্যে ঘোরাল। কাকটা পালাল বটে কিন্তু একটু পরেই আবার তেড়ে এল।
এ তো আচ্ছা জ্বালা হলো!
কাকটা এবার জেকবের মাথার কাছে ঘুরতে লাগল। জেকব মুখ তুলে ভুরু কুঁচকে কাকটার দিকে তাকাল। কাকটা পালিয়ে গেল।
জোরসে হাঁকাও। জেকব গাড়োয়ানকে হুকুম করল। গাড়োয়ান জোরে চাবুক কষাল ঘোড়াটার পিঠে।
কেন যে জেকব জোরসে হাঁকাতে বলল, কেনই বা গাড়োয়ান গাড়ি ছুটিয়ে দিল তার কারণ বুঝতে পারলাম না। সামান্য কাকের ভয়ে?
কাকটা বোধহয় সামান্য ছিল না। হঠাৎ ঘোড়াটা চিহি চিহি করে ডেকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল সেই বিকটাকার কাকটা জেট বিমানের মতো ডাইভ দিয়ে জেকবের মাথার ওপর নেমে আসছে।
এবার জেকব যা করলে তা ভাবতেও পারিনি। হঠাৎ পকেট থেকে রিভলভার বের করে কাকটাকে লক্ষ্য করে দুবার গুলি ছুড়ল। আমি স্বচক্ষে দেখলাম দুটো গুলিই কাকটার পেটে লাগল। কিন্তু কাকটা মরল না। এক ফোঁটা রক্তও পড়ল না। দিব্যি উড়ে পালাল।
আমারই মতো জেকব অবাক হয়ে উড়ন্ত কাকটার দিকে তাকিয়ে রইল। গাড়োয়ান ফিরেও তাকাল না। সে জোরে গাড়ি ছোটাচ্ছে, যেন তাড়াতাড়ি জায়গাটা পার হতে পারলে বাঁচে।
আমি দুটো জিনিস ভেবে অবাক হলাম–দুদুটো গুলি খেয়েও কাকটা উড়ে পালাল কি করে? আর জেকব সঙ্গে রিভলভার রাখে! এ তো তাহলে সোজা লোক নয়।
আমাকে হতভম্ব হয়ে থাকতে দেখে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যে জেকব আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে চুরুট ধরিয়ে বলল, ভয় কি? আমি তো আছি।
হঠাৎ জেকব ভয়ের কথা কেন বললে তা বুঝতে পারলাম না। সত্যি বলতে কি আমি তো ভয় পাইনি। ভয়ের তো কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমি শুধু অবাক হয়েছিলাম কাকটা দুদুটো গুলি খেয়েও মরল না দেখে।
এক মুখ ধোয়া ছেড়ে জেকব সহজভাবে বললে, তখন তুমি কী যেন জানতে চাইছিলে? ও হ্যাঁ, মালদারই নাম ইংরেজবাজার কিনা। শুনে রাখো ইংরেজরা এদেশে আসার পর মহানন্দা নদীর পশ্চিম পাড়ের জমি কোনো এক রাজা রায়চৌধুরীর কাছ থেকে মাত্র তিনশো টাকায় কিনে নেয়। সেখানে ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে তারা ইংলেজাবাদ শহর গড়ে তুলল মোঘলদের অনুকরণে। ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে গড়ল ইংরেজবাজার। সাধারণ লোকের মুখে মুখে কথাটা দাঁড়াল ইংলেজাবাদ। কথাটা আসলে ইংরেজবাজার। এরই নাম মালদহ।
নীলকুঠির ইংরেজরা এখানে রং তৈরি করত। তাই রং + ইংরেজ + বাজার = রংরেজবাজার হয়ে গিয়েছিল।
আমি নোট করে নিলাম।
এক্কা ছুটছে। খোয়া বের করা গৌড় রোডে একঘেয়ে শব্দ হচ্ছে খটাখট-খটাখট। মাঝে মাঝে খোলা মাঠের ওপর দিয়ে ঈষৎ গরম দমকা বাতাস ধুলো উড়িয়ে আসছে। বাতাসটা যেন কেমন! এ ধরনের বাতাসের সঙ্গে অন্তত আমার পরিচয় নেই। সকালে যে ফুরফুরে বাতাসে আরাম পাচ্ছিলাম, এখন সেই বাতাস আর নেই। এখন শুধু শরীরেই নয়, মনের ভেতরেও যেন কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে আর গিয়ে কাজ নেই, ফিরে যাই। কেন যে এমন মনে হচ্ছে তা বুঝতে পারলাম না।
গৌড় আসতে আর মাত্র কয়েক মাইল। লক্ষ্য করলাম–ঘোড়াটার ছোটার গতি কমে আসছে। গাড়োয়ান বুঝতে পারছে না। সে কেবল চাবুক কষাচ্ছে।
শেষে ঘোড়াটা চিঁহি চিহি করে ডাকতে ডাকতে একেবারে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছুতেই আর তাকে নড়ানো গেল না।
গাড়োয়ান গাড়ি থেকে নেমে ঘোড়াটাকে দেখল। না, কোনো অসুখ করেনি। তেমন ক্লান্তও নয়। তাহলে আর যেতে চাইছে না কেন?
গাড়োয়ান অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু ঘোড়া আর নড়ল না।
গাড়োয়ান তখন নিরুপায় হয়ে বলল, বাবু, ঘোড়া তো আর যেতে চাচ্ছে না।
কেন? বিরক্ত হয়ে জিগ্যেস করল জেকব।
কী জানি। বুঝতে পারছি না। এর আগেও তো ঢের সওয়ার এনেছি। এমন হয়নি।
তারপরই হঠাৎ ওর কি মনে হলো। বলল, বাবু, হাওয়াটা আজ বড্ড ভারী। আপনারাও না হয় নাই গেলেন।
কেন? ফের জিগ্যেস করল জেকব।
গাড়োয়ান ইতস্তত করে বলল, যেখানে যাচ্ছেন সে জায়গাটা তো ভাল নয়। সুলতানদের আমলে কত খুন-জখম হয়েছে। ওখানে তো কবরের পর কবর। তেনারা তো আজও আছেন। ঘুমিয়ে থাকেন। জেগে উঠলে আর রক্ষে নেই।
যত বোগাস কথা! বলে বিরক্ত জেকব চুরুট ধরাল।
তাহলে আমাদের উপায়?
একান্তই যখন যাবেন তখন এ পথটুকু হেঁটেই চলে যান। ঐ তো পিয়াসবারি দীঘি দেখা যাচ্ছে। ঐখান থেকেই তো গৌড়ের শুরু।
তাকিয়ে দেখলাম বহুদূরে অনেকখানি জায়গা জুড়ে জলের মতো কি যেন চিকচিক করছে।
.
ফকির সাহেব
৭ মার্চ বেলা ১১টা
আরও একটা মুশকিল হয়েছে। গাড়োয়ানকে বলা হয়েছিল গৌড়ে দুতিন দিন থাকতে হবে। এর জন্যে ওকে মোটা রকম টাকা দেওয়া হবে। ওকে থাকতে বলার কারণ গৌড় থেকে ফেরার জন্যে কোনোরকম গাড়ি পাওয়া যায় না। গাড়োয়ান টাকার লোভে রাজি হয়েছিল। কিন্তু ঘোড়াটা ঐরকম বিগড়ে যাওয়ায় গাড়োয়ান কিছুতেই থাকতে চাইল না। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, এক্কার মুখ মালদার দিকে ফেরাতেই ঘোড়া দিব্যি ছুটতে লাগল।
জেকবের দিকে তাকিয়ে দেখি ও খুব চিন্তান্বিত। জিগ্যেস করলাম, কি ভাবছেন?
কিছু না। হাঁটো।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা সেই পিয়াসবারির কাছে এসে পৌঁছলাম। স্বচ্ছ টলটলে জল। আমরা দীঘির পাড়ে গিয়ে বসে একটু বিশ্রাম করলাম।
কী চমৎকার জল, না?
জেকব একটা চুরুট ধরিয়ে হেসে বলল, হ্যাঁ, খুবই ভাল জল। নাম পিয়াসবারি।
একটু থেমে বলল, তা বলে খেও না যেন।
কেন?
আবুল ফজল তার আকবরনামায় একটা কিংবদন্তীর কথা লিখেছেন। কিংবদন্তীটি অনুয়ায়ী এই যে জল দেখছ এটা বিষাক্ত। মোগল আমলে মৃত্যুদণ্ডের আসামীদের কয়েক দিন ধরে জল খেতে দেওয়া হতো না। তারপর যখন তেষ্টায় বুক ফেটে যেত, যখন জল জল করে চিৎকার করত তখন তাদের এই দীঘির ধারে এনে ছেড়ে দেওয়া হতো। এই টলটলে জল দেখে তারা উন্মাদ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত জলে। অঞ্জলি ভরে জল খেত। কিন্তু তারপরেই তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত।
ইস! চমকে উঠলাম আমি। এই জল কি এখনও বিষাক্ত?
বলতে পারি না। খেয়ে দেখিনি। তবে আকবর নাকি ঐ নিষ্ঠুর প্রথা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম দীঘিটার দিকে। দীঘির পাড়ের গাছগুলো যেন কেমন শুকনো শুকনো। গরু ছাগল চরছে বটে কিন্তু তাদের জল খেতে দেখলাম না।
বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেয়ে আমরা উঠে পড়লাম।
সেখান থেকে কাছেই আদিবাসীদের গ্রামে নিয়ে চলল জেকব। তেরবার এখানে এসেছে। অনেক আদিবাসীদের সঙ্গেই চেনাজানা অছে। আদিবাসীদের মাতব্বরকে কিছু টাকা দিয়ে আড়ালে তার সঙ্গে কী সব কথা বললে। দুদিনের জন্যে থাকারও ব্যবস্থা হলো। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম আদিবাসীরা জেকবকে দেখে খুশি হলো না।
পিয়াসবারি থেকে গৌড়পথ সোজা এগিয়ে গেছে। ঐ পথ থেকে ডান দিকে আর একটি রাস্তা চলে গেছে। এরই মুখে রামকেলী গ্রাম। বৃন্দাবন যাবার পথে এখানে এসেছিলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব। এখানেই তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন সুলতান হোসেন শাহের দুজন মন্ত্রী দবির খাস ও সাকর মল্লিক। শ্রীচৈতন্যদেবের পুণ্যস্পর্শে মন্ত্রীরা হয়ে গেলেন পরম বৈষ্ণব। নতুন নাম হলো তাদের রূপ ও সনাতন গোস্বামী।
আমরা এগিয়ে চলেছি। জেকব অন্যমনস্ক। তবে আমার প্রতি সদয়। জিগ্যেস করলে মাঝে মাঝে উত্তর দিচ্ছে। এইভাবেই দেখলাম মদনমোহন জীউ-এর মন্দির, সনাতন গোস্বামীর প্রতিষ্ঠিত শ্যামকুণ্ড, রাধাকুণ্ড, ললিতাকুণ্ড, বিশাখাকুণ্ড। দেখলাম রূপ গোস্বামীর তৈরি রূপসাগর। তারপরেই দক্ষিণে কিছুদূর দিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বিশাল এক ভগ্ন প্রাসাদ। এইটিই ইতিহাস-বিখ্যাত বারদুয়ারী।
এর একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে খুব উঁচু প্রাচীর। এর নাম দাখিল দরওয়াজা। শাহী নগরকেন্দ্রের অর্থাৎ রাজবাড়ি প্রবেশের উত্তর দরজা ছিল। বিশাল সে দরজা। অবাক হয়ে দেখতে হয়। ঐ দরজার মাথায় দাঁড়িয়ে গৌড়ের সুলতানরা বিজয়ী সৈনিকদের অভিবাদন গ্রহণ করতেন কান-ফাটানো তোপধ্বনির সঙ্গে।
আমি যখন অবাক হয়ে এইসব দেখছি, জেকব তখন মাটিতে বসে ব্যাগ থেকে খাতা পত্তর বের করে কী সব নকশা দেখছে।
সেলাম আলেকুম!
চমকে চেয়ে দেখি একমুখ পাকা দাড়ি আলখাল্লা পরা দীর্ঘকায় ফকিরের মতো একজন দাঁড়িয়ে আছে।
গাইড? ফকির বললে।
জেকব ভয়ানক বিরক্ত হয়ে বললে, না না, গাইডের দরকার নেই।
ফকির মিনতি করে বললে, সব ভাল করে দেখিয়ে দেব বাবু। যা খুশি তাই দেবেন।
বলছি তো গাইড লাগবে না। তুমি যাও এখন।
ফকির বললে, নিজেরা হয়তো ঘুরে ঘুরে সব দেখবেন। কিন্তু শুধু দেখে কি হবে? বহুৎ কহানী হ্যায়, যা আমি জানি, আপনারা জানেন না। কতজনের কত দুঃখ, চোখের জল, কত খুন…ফিরোজ মিনারের নাম শুনেছেন তো?
ফিরোজ নামটা শুনেই জেকবের দুচোখ ঝকঝক করে উঠল। ওর মাথায় বুঝি কোনো মতলব খেলল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এখানে সুলতানদের কবরগুলো কোথায় আছে বলতে পার?
কত কবর চান? দিলীর খাঁর কবর, ফতে খাঁর কবর, সুলতান হোসেন শাহর কবর, নসরৎ শাহের কবর, তার ছেলেদের কবর, আরও কত খানদানি রাজপুরুষদের কবর। আরও পুরনো কবর যদি দেখতে চান তাহলে বাংলাকোট চলুন।
জেকব উৎসাহিত হয়ে বললে, তুমি আগে ফিরোজ মিনার চলো। সুলতান ফিরোজের কথা জানতে চাই।
বেলা বারোটা বাজে। আমরা দাখিল দরওয়াজাকে ডান দিকে রেখে চলেছি দক্ষিণমুখী। পাশে পরিখা আর গড়। গড়ে চাষ হচ্ছে। দেখলে মনে হয় কী শান্ত নিশ্চিন্ত জীবন!
ফকির তার আলখাল্লা পরা দীর্ঘ দেহ নিয়ে আগে আগে চলেছে আমাদের পথ দেখিয়ে। জেকবের সন্ধানী দৃষ্টি চারদিকে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। একটু পরেই মিনারের মাথা দেখা গেল। আমরা মিনারটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। গাইড যা বলল তা থেকে জানলাম মিনারটির নাম ফিরোজ মিনার। অনেকে মনে করেন এটি বিজয়স্তম্ভ, আবার অনেকের মতে এটি মোঝিনমঞ্চ। মোঝিনমঞ্চ মানে কী আমি তা জানি না। গাইডকে জিগ্যেস করার সময়ও পাইনি। ভয়, বেশি প্রশ্ন করলে জেকব হয়তো বিরক্ত হবে। লোকটাকে এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না। মিনারটা অনেকটা দিল্লির কুতুব মিনারের মতো। তবে অত উঁচু নয়। পাঁচটি থাক। অর্থাৎ প্রায় পাঁচতলা। সবার ওপরে রয়েছে কারুকার্যময় গম্বুজ।
সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ মিনারটি নীল রঙের টালিতে গাঁথা। গাইড জানাল মিনারটি তৈরি করেছিলেন হাবসী বংশীয় সুলতান সৈফুদ্দীন ফিরোজ শাহ। ফিরোজ সাহ অত্যন্ত খেয়ালী ও জাঁকজমকপ্রিয় সুলতান ছিলেন। প্রচুর ঐশ্বর্য ছিল তাঁর।
জেকব এতক্ষণ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে গাইডের কথাগুলো শুনছিল। যেন তার শোনার দরকার নেই। সবই সে জানে। প্রচুর ঐশ্বর্য, খেয়ালী আর জাঁকজমকপ্রিয় কথা তিনটে শুনে সে এবার গাইডের দিকে তাকাল।
আমি এমন বইও পড়েছি যাতে লেখা আছে সুলতান ফিরোজ শাহ নিজের কবরগৃহ কিরকম হবে, কি কি জিনিস দিয়ে সাজানো হবে তার ব্যবস্থা নিজেই করে গিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তুমি কিছু জান ফকির সাহেব?
গাইড মাথা নাড়ল–না।
তবে আর তুমি কি ছাই জান? বলে জেকব অবজ্ঞার দৃষ্টিতে গাইডের দিকে তাকাল।
গাইডের মুখটা অপমানে থমথম করতে লাগল। তবু সে তার কর্তব্য করল। ফিরোজ মিনার নিয়ে যে কিংবদন্তী আছে তা গড়গড় করে বলে গেল। কাহিনিটা এইরকম–
সুলতান ফিরোজ শাহর খেয়াল হলো অবিলম্বে খুব উঁচু একটা মিনার তুলতে হবে। তামাম গৌড়-সুলতানের কীর্তির মধ্যে যেটা শ্রেষ্ঠ দর্শনীয় বস্তু হয়ে থাকবে। আর মিনারের কারুকার্য হবে অসাধারণ।
সঙ্গে সঙ্গে নগরের শ্রেষ্ঠ রাজমিস্ত্রিকে ডাকা হলো। রাজমিস্ত্রি কাজে লেগে পড়ল। এক মাস যেতে না যেতেই সুলতান খবর নিতে পাঠান, কত দূর হলো?
এতো বড়ো মিনার তৈরি করা তো যাদুমন্ত্রের ব্যাপার নয়। সময় তো লাগবেই। কিন্তু অবুঝ অধৈর্য সুলতানের আর তর সয় না। কিসের এত তাড়া কে জানে!
শেষে একদিন রেগেমেগে তাঞ্জামে চড়ে লোকলস্কর নিয়ে নিজেই চলে এলেন। কাজ দেখে তিনি হতাশ হলেন। বড় ধীরে কাজ হচ্ছে।
কেন এত দেরি হচ্ছে? চিৎকার দিলেন সুলতান।
রাজমিস্ত্রি বোঝাতে চাইল, এসব কাজ তাড়াহুড়ো করে হয় না। যে জিনিস বহু যুগ ধরে কীর্তি হয়ে থাকবে তা তৈরি করার সময়ে যথেষ্ট সময় দিতে হবে।
সুলতান রাজমিস্ত্রির এই কৈফিয়তে খুশি হলেন না। তাঁর ভ্র জোড়া কপালে লাফিয়ে উঠল। দুচোখে ক্রোধের বহ্নিশিখা। তিনি হুকুম দিলেন, মিনার যতদূর উঠেছে সেখান থেকে ঐ অপদার্থটাকে ছুঁড়ে ফেলে দাও।
সঙ্গে সঙ্গে রাজমিস্ত্রিকে ওপরে টেনে নিয়ে গিয়ে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হলো। তালগোল পাকিয়ে পড়ে রইল রাজমিস্ত্রির রক্তাক্ত দেহটা।
কতখানি উঁচু হয়ে উঠেছিল মিনারটা তখনই, মিস্ত্রির তালগোল পাকানো দেহটা নিঃশব্দে তা প্রমাণ করে দিল।
সুলতান কিন্তু এসব নিয়ে মাথা ঘামান না। আদেশ করলেন তখনই আরও ভালো রাজমিস্ত্রি নিয়ে আসতে।
এই হলো ফিরোজ মিনারের কাহিনি। কথা শেষ করে গাইড তার পাকা দাড়িতে হাত বোলাতে লাগল।
জেকব গাইডের কাছে এগিয়ে গিয়ে চাপা গলায় বলল, ফকির সাহেব, এই ফিরোজ শাহের কবরটা কোথায় বলতে পার? তোমায় অনেক টাকা দেব।
হঠাৎ গাইডের ভ্রূ জোড়া বেঁকে উঠল। কেন বলুন তো বাবু?
আমি সেই কবরে ঢুকব।
গাইড বলল, ওসব মতলব ছাড়ুন বাবুসাহেব। এইজন্যেই যদি এখানে এসে থাকেন তাহলে বহুৎ ভুল হবে। বাড়ি ফিরে যান।
জেকব তাকে ভেঙচে উঠে বলল, তোমার বিদ্যের দৌড় বোঝা গেছে। এবার কেটে পড়ো। এই নাও, বলে একটা টাকা ওর দিকে ছুঁড়ে দিল।
জেকবের ব্যবহার আমার যে কী খারাপ লাগছিল তা লিখে বোঝাতে পারব না।
গাইড মুখে কিছু বলল না। শুধু কেমন একরকম ভাবে জেকবের দিকে তাকাল। তারপর হুঁশিয়ার বাবুসাব, হুঁশিয়ার বলে হন হন করে এগিয়ে গেল। টাকাটা ছুঁলও না।
হঠাৎ মাথার ওপর বিকট একটা শব্দ কাঁ-কা-কা। চমকে তাকিয়ে দেখি একটা কাক মাথার ওপরে ঘুরপাক খাচ্ছে।
আরে সেই কাকটাই তো!
কাকটা এবার জেকবের মাথা লক্ষ্য করে ঠোঁট উঁচিয়ে নেমে এল। স্পষ্ট দেখলাম কাকটার বুকে ছোটো ছোটো সাদা দাগ। বোধহয় গুলির দাগ।
জেকব তখনই রিভলভার বের করে কাকটাকে মারতে যাচ্ছিল, দূরে দাঁড়িয়ে গাইড হেসে বলল, আপনার গুলিতে কোনো কাজ হবে না বাবু। ওটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখুন।
বলেই ডান হাতটা তুলে একবার শূন্যে ঘোরাল। সঙ্গে সঙ্গে কাকটা দূর আকাশে উড়তে উড়তে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এই যেসব ঘটনা দেখলাম, ডায়েরি লিখতে লিখতে তা মনে করে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি। এখন তো ১৯৩৫ সাল। ইংরেজ আমল। এই যুগেও এমন সব অসম্ভব অলৌকিক ঘটনা ঘটে। কাকটা তো বটেই, কিন্তু ঐ ফকিরই বা কে? তার হাতের ইশারাতেই কাকটা চলে গেল! তা ছাড়া কেনই বা সে জেকবকে বলে গেল–হুঁশিয়ার!
এখনও কিছুই বুঝতে পারছি না।
.
গভীর রাতের বিভীষিকা
৭ মার্চ বেলা দুটো
ফিরোজ মিনার দেখে ঐখানেই বসে আমরা দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। মালদা থেকে লুচি, তরকারি আর মিষ্টি আনা হয়েছিল। রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা অবশ্য আদিবাসীটির ঘরে। জেকব মুর্গির টাকা আগাম দিয়ে দিয়েছে।
খাওয়া শেষ হলে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে জেকব বলল, তোমার সঙ্গে এবার কয়েকটা কথা স্পষ্টাস্পষ্টি বলে নিই।
ওর কথা বলার সুরে আমার বুকটা কেঁপে উঠল।
ও বলতে লাগল–তের বার আমি এখানে এসেছি শুধু গৌড় দেখবার জন্যে নয়। আমি অনেক পুরনো বই খুঁজে খুঁজে পড়েছি। অনেক সুলতানের কবরের কথা পেয়েছি। কিন্তু ফিরোজ শাহের কবরের কথা পাইনি। কোনো কোনো বইয়ে ফিরোজ শাহের কথা থাকলেও তা বিভ্রান্তিকর। এখানকার গাইডরাও সঠিক জানে না কোনটা আসল ফিরোজ শাহের কবর। মৃতের পরিচয় লেখা থাকে যে সব পাথরে, যাকে বলে স্মারকপ্রস্তর, তা এই প্রায় পাঁচশ বছরে ভেঙে পড়ে গেছে। কাজেই প্রকৃত ফিরোজ শাহের কবর কোনটি কেউ তা স্পষ্ট করে বলতে পারে না। কিন্তু আমি খুব পুরনো দুটো ফারসী বইয়ে সেই কবরের হদিস পেয়েছি। তার নকশাও করে এনেছি। খেয়ালী সুলতান নিজেই নিজের কবরগৃহ করে গিয়েছিলেন এক গোপন জায়গায়। কথাটা শুনে রাখ শুধুই কবর নয়–কবরগৃহ। সেখানেই রয়েছে সুলতানের দেহ আর তার প্রচুর ঐশ্বর্য–যেমন মিশরে সম্রাটদের মমির সঙ্গে রাখা হতো।
আমি সেই ঐশ্বর্যের লোভেই এবার এসেছি। তোমাকে এনেছি আমার স্বার্থে। তুমি আমাকে সাহায্য করবে। কেন না ঐ ঐশ্বর্য একা উদ্ধার করা আমার একার সাধ্য নয়। বুঝেছ?
আমি রাগে দুঃখে ভয়ে চুপ করে রইলাম। হায়! শেষ পর্যন্ত একটা চোরের সঙ্গে আমি এখানে এলাম!
চুপ করে থেকো না। জেকব চেঁচিয়ে উঠল। যা বলব তাই শুনবে। নইলে গুলি করে তোমায় মেরে এখানে পুঁতে রেখে যাব। কাক-পক্ষীতেও টের পাবে না। তারপর একটু থেমে বলল, আর যদি আমার কথা শোনো তাহলে যা পাব তার কিছু তোমাকে দেব। তাতে তোমার সারা জীবন ভালোভাবেই কেটে যাবে।
আমি বুঝতে পারছি আমি ঐ চোরটার হাতের মুঠোয় চলে গিয়েছি। আর নিষ্কৃতি নেই। আমি ওর কথামতো চললেও শেষ পর্যন্ত ও এই অপকর্মের সাক্ষীকে কিছুতেই বাঁচিয়ে রাখবে না।
তাহলে? কি করব এখন?
চোখে জল আসছে….আর লিখতে পারছি না।
.
৮ মার্চ সকাল ৮টা
গতকাল রাতে ডায়েরি লিখতে পারিনি। যে সব ঘটনা ঘটে গেল তা এতই অসম্ভব আর আকস্মিক যে কিছু লেখার মতো অবস্থা ছিল না। আজ কিছুটা ধাতস্থ হয়ে তারপর লিখছি।
কাল রাত নটার মধ্যে গরম গরম মুর্গির ঝোল আর ভাত খুব তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে শুয়ে পড়লাম। আদিবাসীদের মোড়ল বা সর্দার মাণ্ডির বৌ খুব চমৎকার মাংস বেঁধেছিল। ওরা থাকে পিছনের দিকে। খুবই গরিব। তাই জেকব টাকা দিয়ে এদের বশ করে নিয়েছে।
আমার আর জেকবের জন্যে পাশাপাশি দুটো দড়ির খাঁটিয়া। মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়লাম। জেকবও শুয়ে পড়েছে। দুপুর থেকে এখনও পর্যন্ত আমার সঙ্গে একটি কথাও বলেনি। খুব গম্ভীর। বোধ হয় মতলব ভাজছে। এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচতাম। কিন্তু উপায় নেই। জেকব জানতে পারলে গুলি করে মারবে।
শরীরের দিক থেকে না হলেও মনের দিক থেকে খুব ক্লান্ত ছিলাম। সেই অদ্ভুত কাকটা, ঘোড়াটার থমকে দাঁড়িয়ে পড়া, বৃদ্ধ ফকির গাইডের কথা, ফিরোজ শাহের নির্মম ব্যবহার, গাইডের হুঁশিয়ারি, সবচেয়ে বেশি জেকবের শাসানি আমার মনটাকে ভেঙে দিয়েছিল। বড়ো অসহায়, বড়ো ক্লান্ত লাগছিল। তাই বিছানায় শোওয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়লাম।
রাত তখন কত জানি না হঠাৎ আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চারদিকে যত মসজিদ ছিল, সব জায়গা থেকেই আজানের ধ্বনি ভেসে আসতে লাগল। আমি শুয়ে শুয়েই টর্চের আলোয় রিস্টওয়াচটা দেখলাম। রাত দুটো। এত রাতে কেউ আজান দেয় নাকি? তা ছাড়া তা ছাড়া এখানে যতদূর ঘুরেছি কোথাও একটা আস্ত মসজিদ চোখে পড়েনি। সবই ধ্বংসস্তূপ। তা হলে আজান কে দিচ্ছে–কোথা থেকে দিচ্ছে?
একবার ভাবলাম জেকবকে ডেকে জিগ্যেস করি। কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলতে প্রবৃত্তি হলো না।
মরুক গে যাক বলে আবার শুয়ে পড়লাম। আজানের ধ্বনিও হঠাৎ থেমে গেল।
সঙ্গে সঙ্গেই চমকে উঠলাম, ঘোড়ার খুরের শব্দ! দুএকটা নয়, কয়েক শো ঘোড়া যেন ছুটে আসছে, খটা খট খটা খট করে। এই গভীর রাত্রে কোথা থেকে যে এত ঘোড়া আসছে ভেবে পেলাম না। তারপরেই শুনলাম চারপাশের প্রান্তর জুড়ে ঘোড়াগুলোর দাপাদাপি সেই সঙ্গে তরোয়ালের ঝনঝনা।
আমি আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। উঠে দরজার কাছে গেলাম। আদিবাসীদের ঘরে বড়ো একটা জানলা থাকে না। তারা নাকি মনে করে অশুভ আত্মারা জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। মোহন মাণ্ডির ঘরেও জানলা নেই। আমি দরজাটা একটু ফাঁক করে শব্দ লক্ষ্য করে তাকালাম। ঘুরঘুঁটে অন্ধকার। তার মধ্যে দিয়েই দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে তাকালাম। দেখলাম এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। গোটা প্রান্তর জুড়ে অসংখ্য ঘোড়ার কালো কালো ছায়া। তাদের পিঠে এক একটা কালো কালো মূর্তি। সারা মাঠ জুড়ে তারা দাপাদাপি করছে।
তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। কী অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম! এ সবই কি চোখের ভুল?
হঠাৎ দুটো ঘোড়ার খুরের শব্দ আমাদের ঘরের দিকে এগিয়ে এল। আমি ভয়ে কাঁটা হয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম। ঘোড়া দুটো যেন কাছেই কোথাও এসে থামল। তারপরেই শুনলাম একটা মর্মান্তিক আর্তনাদ-জহরা অব্ হোনা, জহরা অব্ হোনা–আমি বিপদগ্রস্ত, স্পষ্ট মানুষের গলায়, আমি জালালুদ্দীনের পুত্র শামসুদ্দীন। আমাকে হত্যা করতে এসেছে। আমারই দুজন ক্রীতদাস। আমাকে বাঁচাও।
তারপরেই একটা অস্পষ্ট গোঙানি দুপুর রাতের বাতাসে মিশে গেল।
আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে পড়ে রইলাম। আর কোনো শব্দ নেই। মনে মনে ভাবতে লাগলাম এ রাত কি ভোর হবে না? এসব কী শুনলাম! সুলতান শামসুদ্দীনকে হত্যা করেছিল তারই দুই ক্রীতদাস। সে তো ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ের কথা! এত বছর পর আজ সেই শামসুদ্দীনের মৃত্যুভয়ে আড়ষ্ট গলা শুনলাম! এইরকম গভীর কোনো রাতে তার দুই বিশ্বস্ত ক্রীতদাস কি ঘোড়ায় চড়ে এসে তাকে খুন করে গিয়েছিল?
ছোটিবাবু!
চমকে উঠলাম। একেবারে ঠিক দরজার বাইরে কে যেন ডাকল।
ছোটিবাবু বলে কে কাকে ডাকল?
একটু পরে আবার সেই থমথমে গলা, ছোটিবাবু!
আমাদেরই কাউকে কেউ ডাকছে।
কিন্তু কে ডাকছে?
বরাবরই আমার খুব সাহস। কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে খুব সাহস যে ভালো নয় তা তখনও বুঝিনি।
আমি উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু তখনই দরজা খুললাম না। অপেক্ষা করে রইলাম আবার কেউ ডাকে কিনা শোনার জন্যে।
একটু পরেই আবার সেই গলা। এবার খুব কাছে। মনে হলো যে ডাকছে সে দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। এবার আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে দরজাটা খুলে ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গে একটা ঠান্ডা বাতাস গায়ে ছুঁচের মতো বিধল।
কিন্তু
কিন্তু কই? কেউ তো নেই?
কী করব ভেবে না পেয়ে আমি একবার এদিক-ওদিক দেখে নিলাম।
না, কেউ নেই।
হঠাৎ আবার সেই কণ্ঠস্বর, ছোটিবাবু!
এবার যেন একটু দূরে।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই স্বর লক্ষ্য করে অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে চললাম।
অন্ধকার, শুধু অন্ধকার। জীবনে অন্ধকার ঢের দেখেছি, কিন্তু ওরকম নিচ্ছিদ্র অন্ধকার কখনো দেখিনি। এক হাত দূরেরও কিছু দেখা যায় না। অন্ধ যেভাবে হাঁটে আমি সেইরকমভাবে অনিশ্চিতের পথে এগিয়ে চললাম। মাঝে মাঝে শুধু সেই কণ্ঠস্বর–ছোটিবাবু!
এগিয়ে চলেছি অন্ধকারে সাঁতার কাটতে কাটতে। কিছুক্ষণ আগেও যেখানে এত ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনেছিলাম–অস্ত্রের ঝনঝনা শুনেছিলাম, কোন ভোজবাজির মতো সব থেমে গেছে। তবে কি সবই মনের ভুল? তাই যদি হয় তাহলে এই যে নিশুতি রাতে অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে চলেছি, এও কি মনের ভুল?
হঠাৎ মনে হলো কে যেন আমার গায়ের ওপর গরম নিঃশ্বাস ফেলল। আমি চমকে উঠলাম। তারপরেই মনে হলো কেউ যেন আমার পাশ দিয়ে দৃপ্তভঙ্গিতে হেঁটে গেল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না।
এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সামনে উঁচুমতো ওটা কী একটা একঠেঙে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে?
ঠাওর করে দেখলাম।
আরে! এ তো ফিরোজ মিনার।
এতদূরে এলাম কি করে? কে আমাকে এখানে ডেকে আনল? কেন আনল? যে ডেকে আনল সে গেলই বা কোথায়?
হঠাৎ হু হু করে একটা বাতাস মিনারে ঠোক্কর খেয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল। আমার সারা গা কাটা দিয়ে উঠল। আর তখনই যে দৃশ্যটা দেখে আমি চমকে উঠলাম তা বোঝানো কঠিন। স্পষ্ট দেখলাম বুড়ো মতো লুঙ্গি করা একটা লোক মিনারের গা বেয়ে টিকটিকির মতো তরতর করে একেবারে গম্বুজের মাথায় উঠে গেল আর তারপরেই
ইস! কেউ যেন তাকে পেছন থেকে ঠেলে ফেলে দিল।
ধড়াস করে কী যেন পড়ল আমার পায়ের কাছে। একটা মানুষের ঘেঁৎলানো দেহ। সর্বাঙ্গ থরথর কেঁপে উঠল। আর তখনই কে যেন খুব কাছ থেকে ডাকল, ছোটিবাবু!
দেখলাম আমার সামনে হাত দশেক দূরে যেখানে রাজমিস্ত্রির দেহটা আছড়ে পড়েছিল সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কালকের সেই গাইড। পরনে কালো লম্বা আলখাল্লা। গলায় চকচকে নানারকম পাথরের মালা। লম্বা চুল পিঠ পর্যন্ত ঝুলছে। সব কিছু কালোর মধ্যে সাদা ধবধবে দাড়ি বাতাসে উড়ছে। হাতে একটা লোহার চিমটে।
গাইডই তাহলে আমায় এত দূরে টেনে নিয়ে এসেছে!
গাইড বললে, মাৎ ডরো ছোটিবাবু। ভয় পেও না। এই যা সব শুনেছ, যা দেখলে এসব এখানে হামেশাই ঘটে। কোনো সুলতান বেগম উজির সেনাপতিই খোদার নাম নিয়ে শান্তিতে মরেনি। শুধু কাটাকাটি, খুন, রক্তপাত। এন্তেকাল হবার পরও তাদের আত্মার শান্তি হয়নি।
একটু থেমে সে আবার বললে, কিন্তু যে জন্যে তোমাকে ডেকে এনেছি সে কথা বলি। তুমি ঐ বড়বাবুকে ছেড়ে পালাও। ও মানুষটা ভালো নয়। তোমার ক্ষতি করবে। কাল ও যেখানে তোমাকে নিয়ে যেতে চাইবে তুমি সেখানে কিছুতেই যেও না। সে জায়গা বড়ো সাংঘাতিক।
বললাম, কিন্তু ফকির সাহেব, আমি যদি ওর কথা না শুনি তাহলে ও আমায় মেরে ফেলবে। ওকে আমার বড় ভয়।
ফকির যেন নিজের মনেই বললে, ছোটিবাবু, ভয় কি শুধু ওনাকেই? ভয় যে আরও আছে … ঠিক আছে যদি তোমাকে যেতেই হয় তাহলে আমার এই চিমটেটা তোমার কাছে রাখো। এটা দিয়ে কাউকে আঘাত করতে যেও না।
এই বলে ফকির তার হাতের চিমটেটা আমাকে দিল।
তারপর বলল, তবে তুমি যখন এখান থেকে চলে যাবে, এটা রেখে যেও।
কোথায় রাখব?
ফকির বললে, পিয়াসবারির পাড়ে।
এতক্ষণে জিগ্যেস করলাম, ফকির সাহেব, আপনি এই গভীর রাতে কোথা থেকে এলেন?
ফকির বললে, আমি তো দিন রাত এখানেই থাকি।
দিনরাত কি করেন?
দিনের বেলা গাইড। রাতের বেলা পাহারাদার।
আপনি পাহারা দেন?
ফকির সাহেব হাসল একটু। কালো মুখের মধ্যে থেকে ধবধবে সাদা উঁচু উঁচু দাঁতের সারি ঝিকিয়ে উঠল। আমার গা শিউরে উঠল। কে ও?
সাহস করে বললাম, কী পাহারা দেন? এখানে কিইবা আছে?
তামাম গৌড় সাম্রাজ্য পাহারা দিই। এখানে কী নেই? অনেক কিছু আছে।
কবে থেকে পাহারা দিচ্ছেন?
ফকির বললে, ৯৮৫ আলহিজরা। যেদিন আফগান শূর সুলতান মুজাফফর খানতুরবতিকে হত্যা করা হলো সেদিন থেকে।
আমি চমকে উঠলাম, মুজাফফর খানতুরবতিকে খুন করার সময় যদি ৯৮৫ আলহিজরা হয় তাহলে সেটা ১৫৮০ সালের কথা!
অবাক হয়ে তাকাতে দেখি ফকির অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।
.
কবর-গৃহের সন্ধানে
৮ মার্চ বেলা এগারোটা
বেলা এগারোটা নাগাদ জেকব মোহন মাণ্ডি আর কয়েকজন আদিবাসীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ওদের হাতে কোদাল, শাবল, গাঁইতি। তাছাড়া জেকবের কাঁধে যে ঝোলাটা রয়েছে তার মধ্যেও নিশ্চয় কিছু যন্ত্রপাতি আছে।
জেকব আমাকে আদেশ করল, আমার পাশে পাশে হাঁটো। পিছিয়ে পড়ার চেষ্টা করবে না।
ও ভেবেছে আমি হয়তো পালিয়ে যাবো। পালিয়ে গিয়ে হয়তো ওর মতলব ফাঁস করে দেব।
আমি তাই নিষ্প্রাণ পুতুলের মতো ওর পাশে পাশে চললাম। কোথায় যাচ্ছি কত দূরে যাচ্ছি তা জানি না। মনে পড়ল গত রাতের কথা। ফকিরের সেই কথাগুলো, ছোটিবাবু, বড়বাবু যেখানে নিয়ে যেতে চাইবে সেখানে যেও না।
কিন্তু উপায় নেই। যেতে হচ্ছে। ভরসা শুধু ফকিরের দেওয়া চিমটেটা।
জেকব ব্যঙ্গ করে বলেছিল, ওটা আবার পেলে কোথায়?
বলেছিলাম, মাঠে কুড়িয়ে পেয়েছি।
ঠাট্টা করে বলেছিল, রেখে দাও। সাপ-ব্যাঙ সামনে পড়লে মারতে পারবে।
ক্রমে আমরা ভাঙা প্রাসাদ, মসজিদ ছাড়িয়ে একটা প্রান্তরে এসে পৌঁছলাম। জেকব এগিয়ে চলেছে। যেন ইতিমধ্যেই জায়গাটা চিনে রেখেছে। নির্জন প্রান্তর। দূরে দূরে গরু, মোষ চরছে। এপাশে-ওপাশে দুতিনটে দীঘির মতো পুকুর। এসবই একদিন সুলতানদের কেউ না কেউ তৈরি করেছিলেন। আজ তাদের কথা কেউ জানে না।
ফাল্গুন মাস। এরই মধ্যে রোদের তেজ বেড়ে উঠেছে। জেকব ব্যাগ থেকে একটা টুপি বার করে মাথায় চাপিয়ে নিল। একে তো বেঁটে কালো চেহারা। তার ওপর যখন টুপি মাথায় পরে গটগট করে হাঁটছিল তখন ওকে মনে হচ্ছিল একটা ক্ষুদে শয়তান।
কিছুদূর এগিয়ে একটা ভাঙা পাঁচিল দেখা গেল। বোঝা গেল এক সময়ে অনেকখানি জায়গা ঘিরে মস্ত উঁচু পাঁচিল ছিল। কিন্তু এখন শুধু খানিকটা দাঁড়িয়ে আছে।
আমরা সেই খাড়া পাঁচিলের পাশ দিয়ে মাঠের মতো একটা খোলা জায়গায় ঢুকলাম। জেকব তার নোটবই বের করে দেখে নিল। তারপর ফিতে ফেলে কিছুদূর মাপজোক করল। এবার সে মনের আনন্দে টুপিটা খুলে ফেলল। তারপর আদিবাসীদের একটা বিশেষ জায়গা খুঁড়তে বলল।
আমি তো কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। এ তো সমতল জায়গা। কবরের চিহ্নমাত্র নেই। এখানে খুঁড়ে কি লাভ?
ততক্ষণে আদিবাসীরা গাঁইতি চালাতে আরম্ভ করেছে।
প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলল খোঁড়া। অনেকখানি জায়গা জুড়ে একটা বিশাল গর্ত হলো। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল ধুলো আর ইটের টুকরো।
জেকব কয়েকটা ভাঙা ইট কুড়িয়ে নিয়ে পরীক্ষা করল। তারপর আদিবাসীদের হাতে কতকগুলো টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, আরও টাকা পাবে। গভীর করে খোঁড়ো।
ঝপাং ঝপাং করে গাঁইতির ঘা পড়তে লাগল। একটা মানুষের মতো গভীর গর্ত তৈরি হলো। জেকব সেই গর্তের মধ্যে নেমে পড়ল। কিন্তু প্রতিমুহূর্তেই আমার ওপর ওর সতর্ক দৃষ্টি।
আরো জোরে গাহাত চালাও।
আদিবাসীরা টাকার লোভে জীবন পণ করে গাঁইতি চালাতে লাগল।
এবার মাটি অনেক ঢিলে। গাঁইতির এক এক ঘা পড়ে আর হুড়মুড় করে ইট-মাটির চাঙড় ভেঙে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে কোদালে করে সেগুলো তুলে বাইরে ফেলে দিতে লাগল।
এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ভেতরটা ফাঁকা। ওখানে কিছু আছে।
লক্ষ্য করলাম আদিবাসীদের গাঁইতি চালানো যেন আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে আসছে। ওরা কি ক্লান্ত হয়ে পড়ছে?
কিন্তু না। ওরা বার বার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে।
তারপর হঠাৎই গাঁইতি রেখে দিয়ে ওরা জেকবকে ব্যস্ত হয়ে বলল, আমরা এখন চললাম।
জেকব প্রচণ্ড রেগে বলল, চললে মানে? আর একটু খুঁড়লেই ভেতরে ঢুকতে পারব। এখন চললাম বললে হবে না।
ওরা একসঙ্গে বলল, না। সন্ধে হয়ে আসছে। সন্ধের আগেই আমাদের ঘরে ঢুকতে হবে।
তারপর আকাশের দিকে আঙুল তুলে নিজেদের মধ্যে কী বলাবলি করল।
তাকিয়ে দেখলাম ঘন কালো মেঘ উত্তর-পশ্চিম কোণে জমে উঠেছে। একে তো চারিদিক নিস্তব্ধ, লোকজনের চিহ্নমাত্র নেই। যে গরু-মোষগুলো মাঠে চরছিল তারাও ফিরে গেছে।
আদিবাসীরা শুধু পালাল না, ছুটতে লাগল। সে ছোটা যেমন তেমন ছোেটা নয়, প্রাণভয়ে ছোটা।
অনেক পরে জেনেছিলাম ওদের সংস্কার, ফাল্গুনের বিকেলে যদি মেঘ ওঠে, ঝড় হয় তাহলে তা বিপদের সংকেত।
জেকব ব্যাজার হয়ে বললে, সব ভীতুর একশেষ। একটুর জন্যে কাজটা শেষ হলো না।
এমন সময় মাঠের ওদিক থেকে গোঁ গোঁ করে শব্দ উঠল। আমরা চমকে উঠলাম। প্রচণ্ড ঝড় আসছে।
এই ধু-ধু মাঠের মধ্যে ঝড়ের মুখে পড়লে রক্ষে নেই। তাই আমরাও ঘরমুখো ছুটতে লাগলাম।
.
মৃত্যুগুহা
৯ মার্চ রাত দুটো
সারা রাত ঝড়ের দাপট ছাড়া আর কোনো ঘটনা ঘটেনি। পরশু দিন রাতে যে আজানধ্বনি বা ঘোড়ার ছোটাছুটির শব্দ শুনেছিলাম, গত রাতে সেরকম শুনিনি।
আজ সকালে উঠেও দেখি আকাশের মুখ ভার। জেকবের মুখ ততোধিক ভার। মাঝে মাঝে শোঁ শোঁ করে দমকা বাতাস দিচ্ছে। এ এক অকাল দুর্যোগ।
জেকবকে দেখছি ঘরের মধ্যে ছটফট করছে। খোঁড়ার কাজ অসমাপ্ত পড়ে আছে। এখানকার চোর-ডাকাতদের ভয় নেই। তারা আর যাই হোক মৃতের কবরকে সম্মান করে কিংবা ভয় করে। ভয় বিদেশী চোরদের। এইসব বিদেশী চোর-ডাকাতের অভাব নেই। সন্ধান পেলে তারা ঢুকে পড়বে। আর একবার ঢুকে পড়তে পারলে ফিরোজ শাহের ধনরত্ন সব ফাঁক করে দেবে। তাছাড়া ঝড়ের সঙ্গে যদি বৃষ্টি নামে তাহলে তো সব কাজ পণ্ড। কবরের মুখে জল ঢুকে গেলে বসে থাকতে হবে জল শুকোনো পর্যন্ত। কিন্তু জেকব আর একটা দিনও বসে থাকতে চায় না।
জেকব আমার সঙ্গে একটা কথাও বলছে না। আমি যেন ফালতু লোক। অথচ আমায় ছেড়েও দিচ্ছে না। ছেড়ে দিলে তো আমি বাঁচি।
শেষ পর্যন্ত ঝড় একটু থামলে বেলা তিনটে নাগাদ আবার সকলে রওনা হলাম। আদিবাসীরা কিছুতেই যাবে না। ওরা বলছে, মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে সন্ধে হয়ে যাবে।
জেকব ওদের বোঝাল পাঁচটার আগেই তাদের ছেড়ে দেবে।
পাঁচটার আগেই ওরা চলে গেল। অবশ্য তখন খোঁড়ার কাজ শেষ। ধুলোয় ঢাকা একটা বেঁটে দরজার সামনে এসে আমরা দুজনে দাঁড়িয়েছি। বোঝা গেল সমাধিগৃহে ঢোকবার এটাই দরজা। দরজাটায় চমৎকার কারুকার্য করা। এত বছরেও সেসব কাজ নষ্ট হয়েনি। কিন্তু দরজাটা এত নিচু কেন?
বুঝতে পারলাম এই পবিত্র সমাধিগৃহে যাতে মাথা নিচু করে ঢুকতে হয় তারই জন্যে এই ব্যবস্থা।
জেকব নিজের মনেই যেন বললে, যাক, এখানে আমরাই প্রথম। আজ পর্যন্ত কোনো চোর এ জায়গার সন্ধান পায়নি।
ইতস্তত করে বললাম, এই সন্ধেবেলা আমরা ঢুকব?
জেকব খেঁকিয়ে উঠে বলল, তবে কি চোরেদের জন্যে দরজা খুলে রেখে যাব? টর্চ বের করো।
দরজাটার কড়ার সঙ্গে একটা মোটা শেকল বাঁধা ছিল। জং ধরে গিয়েছিল। জেকব ঝুলি থেকে দুটো যন্ত্র বার করে শেকলে চাপ দিতে লাগল। অনেকক্ষণের চেষ্টায় শেকল ভাঙল না বটে কিন্তু কড়া দুটো উঠে এল।
এবার ওর সঙ্গে আমাকেও দরজা ঠেলতে বলল। দুজনে জোরে ধাক্কাধাক্কি করতেই একটা বিকট শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। একরাশ ধুলোর সঙ্গে একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এসে ঢুকল। আমরা দুজনেই নাকে রুমাল চাপা দিলাম।
মিনিট পাঁচেক পরে আমরা টর্চ জ্বেলে ভেতরে ঢুকলাম। কালো পাথরের টালি দিয়ে গাঁথা মেঝে। ভেতরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।
আমার গা-টা ছমছম করতে লাগল। পাঁচশো বছর পর এ কোন প্রেতপুরীতে আমরা ঢুকছি!
হয়তো ভয়ের কোনো কারণই থাকত না যদি না মাত্র পরশু রাত্রেই আমার সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হতো। এখানে আসার আগে থেকেই আমি কিছু অলৌকিক ব্যাপার প্রত্যক্ষ করেছি। এক নম্বর সেই কাকটা–গুলি খেয়েও যেটা মরেনি। দ্বিতীয় নম্বর কেন এক্কার ঘোড়াটা পিয়াসবারি দীঘির আগেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল? কেন আর এক কদমও এগোল না। তৃতীয়ত ফকির সাহেব। যে নাকি সারা রাত্রি গোটা গৌড় পাহারা দিয়ে বেড়ায়। কাজেই এই কবরগৃহ যে শুধুই একটা পুরনো কবরস্থান তা নাও হতে পারে। এটা যে ভয়ঙ্কর জায়গা, এখানে এলে যে বিপদ অবশ্যম্ভাবী, ফকির সে কথা বলে আমায় সাবধান করে দিয়েছিল।
এসব কথা মনে হতেই আমার পা দুটো অসাড় হয়ে গেল। আর এক পাও এগোতে সাহস হলো না।
জেকব ধমক দিয়ে বললে, হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? তাড়াতাড়ি এসো।
তার সেই কণ্ঠস্বর চাপা ঘরের চার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে গমগম করে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট শুনলাম, কাছেই কোথায় মৃদু শব্দ হলো। শব্দটা শুনে মনে হলো কিছু যেন নড়ে উঠল। কেউ যেন সংকীর্ণ জায়গার মধ্যে পাশ ফিরল।
শব্দটা জেকবও শুনেছিল। দেখলাম সেও কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে পড়ল।
তারপরই যেন নিজের মনেই বলল, ও কিছু না।
আমাকে আদেশ করল, আমার পাশে পাশে এসো।
আমি বললাম, জুতোটা খুলব?
দরকার নেই।
অগত্যা পবিত্র কবরগৃহে জুতো পরেই এগিয়ে চললাম। একটাই ভরসা–ফকিরের দেওয়া লোহার চিমটেটা আমার মুঠোয় শক্ত করে ধরা।
জেকব চারদিকে টর্চের আলো ফেলছে। হঠাৎ ও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
এ কী! এ ঘরে এত কবর!
আমিও অবাক হলাম। দুপাশে সাতটা মাঝারি সাইজের কবর।
কিন্তু তা তো হবার কথা নয়। জেকবের লক্ষ্য কোনো এক ফিরোজ শাহের কবর। তিনি সুলতান ছিলেন। প্রচুর ঐশ্বর্য। অত্যন্ত খেয়ালী। মরার আগে তিনি নাকি কোনো গোপন জায়গায় নিজের সমাধিঘর তৈরি করে রেখেছিলেন। সেখানে নিশ্চয় তিনি শুধুই রাজপোশাক পরে শুয়ে থাকবেন না। সঙ্গে সোনাদানা, ধনরত্নও থাকবে। আর নিশ্চয় সেই কবরগৃহ হবে তাঁর একারই।
তাই যদি হয় তাহলে এই কবরগুলো কাদের? তবে কি এটা সুলতান ফিরোজ শাহের কবর নয়?
জেকব যেন আমার মনের কথা টের পেয়ে বলল, এগুলো হয়তো তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের।
তাহলে সুলতানের কবরটা কোথায়?
জেকব চারদিকে টর্চের আলো ফেলতে লাগল। অন্ধকার এতই জমাট যে টর্চের আলো বেশিদূর যাচ্ছিল না। হঠাৎ চোখে পড়ল দেওয়ালের একদিকে প্রায় চার হাত উঁচুতে একটা ছোটো দরজা। আমরা তাড়াতাড়ি সেইদিকে এগিয়ে গেলাম। হ্যাঁ, দরজাই। তবে এটাকে দরজা না বলে একটা বড় জানালা বলা যেতে পারে। তবে জানালা নয়। জানালা হলে গরাদ থাকত। এতে দরজার মতোই মস্ত দুটো পেতলের কড়া লাগানো আছে। আর কড়া দুটো সিল করা। দরজার গায়ে ফারসীতে কী যেন লেখা আছে। অক্ষর উঠে গেছে। জেকব ভালো করে পড়তে পারল না। তবে সে নিশ্চিত এই ঘরেই সুলতান আছেন।
তখনই সে যন্ত্রপাতি দিয়ে সিল ভেঙে ফেলল। আমার বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল। স্পষ্ট অনুভব করলাম আমার পিছনে কারা যেন নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে। চকিতে পিছন ফিরলাম। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। শুধু একটা তপ্ত হাওয়া আমার শার্টটাকে দুলিয়ে দিয়ে গেল। এই বদ্ধ ঘরে হাওয়া কোথা থেকে আসবে তা বুঝতে পারলাম না। আমি চিমটেটা আরও শক্ত করে ধরলাম।
ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে বার কয়েক ঝকানি দিতেই দরজাটা খুলে গেল। মূর্খটা পকেট থেকে রিভলভার বার করে জুতো পায়েই ভেতরে লাফিয়ে পড়ল। বুঝল না কার জন্যে রিভলভার? কে আছে ঘরে? কে থাকতে পারে তাকে রিভলভার কিছু করতে পারে না।
আমিও টর্চ জ্বেলে ভেতরে ঢুকছিলাম। জেকব কড়া গলায় বললে, তুমি বাইরে থাকো। ডাকলে তবে এসো।
আমি যেন বেঁচে গেলাম। সেই কুঠুরির বাইরে দাঁড়িয়েই আমি ভেতরটা এক ঝলক দেখে নিলাম। সাজানো-গোছানো ঘর। দেওয়ালে দেওয়ালে ফারসীতে কোরানের বাণী। একটা উঁচু বেদীর ওপর স্থাপিত কষ্টিপাথরের মত চকচকে কালো পাথরের বিশাল একটা কবর। কবরের গায়ে নীল, সাদা, হলুদ, সবুজ মিনার কাজ। এ ঘরে ঐ একটিই কবর। কবরের দৈর্ঘ্য দেখলেই বুঝতে অসুবিধে হয় না এখানে যিনি শুয়ে আছেন তিনি লম্বায় ছয় ফিটেরও বেশি।
সমাধির ওপর টাঙানো রয়েছে সাদা সিল্কের সামিয়ানা। জীর্ণ, বিবর্ণ। চারটে লাল থামে সামিয়ানার চার কোণ দড়ি বাঁধা। ঝুলছে সোনার চেন।
লক্ষ্য পড়ল কবরের চারপাশে হাতির দাঁতের ক্যাশবাক্সের মতো বড় বড় বাক্স। দেখলাম জেকব একটা বাক্স ভেঙে ফেলল। তারপরে ভেতর থেকে বের করতে লাগল হীরে, পান্না, চুনি–রাশি রাশি।
তখনই গোটা তিনেক বাক্স ঝুলির মধ্যে ঢুকিয়ে নিল।
এবার সে উঠে একটা হাতুড়ি নিয়ে কবরটার দিকে গেল। ও যে কী করতে যাচ্ছে ভেবে শিউরে উঠলাম। অমন সুন্দর কারুকার্যকরা কবরটা ও হাতুড়ির গায়ে ভেঙে ফেলবে! তার নিচ থেকে টেনে তুলবে কফিন। ওর ধারণা কফিনের মধ্যে মৃতদেহ ধুলো হয়ে গেলেও নিশ্চয় আরো অনেক ধনরত্ন আছে।
জেকব কবরের গায়ে জোরে হাতুড়ির ঘা মারল। আমি সে দৃশ্য দেখতে পারলাম না। ওখান থেকে পিছিয়ে আগের ঘরে এসে দাঁড়ালাম।
অন্ধকার কবরের রাজ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকা যে কী ভয়ঙ্কর তা যে কখনো দাঁড়িয়েছে। সে ছাড়া আর কেউ কল্পনা করতে পারবে না।
ওদিকে হাতুড়ির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। বুঝতে পারছি পাথরের কবর চৌচির হয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ হাতুড়ির শব্দ ছাপিয়ে কাচ করে একটা অস্বাভাবিক শব্দ। আমি চমকে উঠে সেইদিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি যে ঘরে জেকব কবর ভাঙছিল সেই ঘরের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বিকট আর্তনাদ। তারপরেই হাড়-হিম-করা গোঙানি।
এ যে জেকবের গলা তা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হলো না।
কী হলো জেকবের?
আমি ছুটে গেলাম বন্ধ দরজাটার কাছে। প্রাণপণে ঠেলতে লাগলাম। কিন্তু দরজা এতটুকু নড়ল না।
আমি দরদর করে থামতে লাগলাম। কী করব এখন? কি করে জেকবকে বাঁচাব? আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম।
কিন্তু এভাবে এখানে যে একা দাঁড়িয়ে থাকা মোটেই ভালো নয় একথা মনে হতেই টর্চ জ্বেলে বাইরের দরজার দিকে ছুটলাম।
দেখি বাইরের দরজাটাও আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
আমি প্রাণপণে ছুটে যখন দরজার কাছে গেলাম তখন পাল্লা দুটো প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। কোনোরকমে কাত হয়ে আমি বেরিয়ে এলাম।
.
পুলিশকে খবর দেওয়া আমার উচিত ছিল। নইলে জেকবের মৃতদেহ খুঁজে পেলে পুলিশ আমাকেই ধরবে। ভাববে ধনরত্নের লোভে আমিই জেকবকে খুন করেছি।
কিন্তু থানা-পুলিশ করতে সাহস পেলাম না। সেই রাতেই মোহন মাণ্ডিকে সব কথা বললাম।
ও বলল, এমনটা যে হবে তা আমরা জানতাম। কাল ভোরবেলায় গরুর গাড়ি ঠিক করে দেব। আপনি চলে যান।
.
১০ মার্চ বিকেল চারটে
আজ দুপুরে গরুর গাড়ি করে নিরাপদে মালদহর হোটেলে ফিরে এসেছি। তবে একা।
ফকিরের দেওয়া চিমটেটা পিয়াসবারির ধারে রেখে আসতে ভুলিনি।
.
সমাপ্তি
ডায়েরি এখানেই শেষ।
১৯৩৫ সালের লেখা ডায়েরি। ৬৪ বছর পর সেটা খুঁজে পেয়ে নতুন করে কাহিনিটা লিখে ফেললাম।
রতন এক পেয়ালা কফি নিয়ে এল। আমি তখন দেওয়ালের এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কিছু খুঁজছিলাম।
রতন বললে, ওখানে কী খুঁজছেন?
বললাম, কিছু না।
তারপর কফির পেয়ালায় চুমুক দিলাম।
আসলে সুলতানের হাতের লেখাটা খুঁজছিলাম। নেই। অদৃশ্য হয়ে গেছে!
[শারদীয়া ১৪০৬]