ওরা চলেছে নিঃশব্দে
ট্রেনে নতুন সঙ্গী
হিমালয় আমাকে বরাবর টনে। সেই টানে আমি কখনও গিয়েছি দার্জিলিং, কখনও শ্রীনগর। শ্রীনগর থেকে সোনমার্গ, গুলমার্গ, পহেলগাঁও। আবার এদিকে হিমালয়ে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু। এসব জায়গায় যাওয়ার অসুবিধে ছিল না। পাহাড়ের বুক চিরে ঝকঝকে তকতকে রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে যাত্রীবোঝাই বাস নির্বিঘ্নে পৌঁছে দেয় নির্দিষ্ট জায়গায়। খাওয়া-দাওয়ার কোনো অসুবিধে নেই। মাঝে-মাঝেই হোটেল। চা-কফি থেকে ভাত-ডাল-রুটি-মাংস সবই পাওয়া যায়।
কিন্তু এবার হিমালয়ের যেখান দিয়ে যাচ্ছি সে পথ খুবই বিপদসংকুল। সংকীর্ণ পথ, একজন কোনোরকমে পা ফেলে চলতে পারে। তাও পাহাড়ের একেবারে গা ঘেঁষে। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী। নাম জানতে পারিনি। তবে স্রোতের গতি দেখলেই বুক কঁপে। একবার পা ফসকালে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এ দুর্ভোগে পড়তে হবে কে ভেবেছিল! মাঢ়িতে টাটা সুমো থেকে নেমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে, কেউ আলু-পরোটা, কেউ ব্রেড-বাটার-ওমলেটের সঙ্গে গরম চা কিংবা কফি খেয়ে ফের গাড়িতে উঠে পড়েছিলাম নিশ্চিন্ত মনে। রাস্তা বলে কিছু নেই। কখনও শুকনো নদীখাতে, কখনও বা পাথরের ওপর দিয়ে ডাইনে, বাঁয়ে টাল খেতে খেতে গাড়ি এগিয়ে চলছিল। আমাদের গন্তব্যস্থল লে। লাদাখের রাজধানী। লাদাখ নাম হল কেন? কোন বই-এ যেন পড়েছিলাম লা শব্দটার মানে গিরিবর্ক্স বা পাহাড়ি রাস্তা। আর দাখ মানে দেশ। লাদাখ মানে তাই গিরিবক্সের দেশ।
সোলাং পেরিয়ে এসেছি। রাস্তার ধারে দেবদারু আর ওক গাছ। বরফঢাকা চুড়ো কখনও সামনে কখনও পিছনে। সামনে চড়াই। … এইভাবে চলতে চলতে প্রায় পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে একটুকরো সমতল ভূমি মাঢ়িতে এসে পৌঁছেছিলাম। এরপর টানা চড়াই প্রায় ষোলো কিলোমিটার। কিন্তু এ অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য স্থান রোটাং গিরিপথের মুখে গাড়িটা খারাপ হয়ে গেল। গাড়ির আর দোষ কী? যা লম্ফঝম্ফ!
কিন্তু স্বল্পভাষী গাইডটি অস্পষ্ট হিন্দিতে নিজের মনেই বিড় বিড় করে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায়–হঠাৎ গাড়ি খারাপ হওয়া লক্ষণটা ভালো নয়।
একপক্ষে ভালোই হল। সেই কখন মানালি থেকে রওনা হয়েছিলাম। একঘেয়ে গাড়ির মধ্যে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। একেবারে খাস হিমালয়ের বুকে পা রেখে একটু চলাফেরা করে হাত-পা ছাড়িয়ে নেওয়া মন্দ কী!
গাড়ির ড্রাইভার ছাড়া আমি, আমার কলকাতার বন্ধু বিভাস, একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী থুমি সামভোতা, আর একজন গাইড জিগমে। জিগমে জোয়ান মরদ। তিব্বতী। চওড়া চোয়াল, ছোটো ছোটো চুল। চ্যাপ্টা মুখ। ফ্যাকাশে রঙ। মানালিতে যে হোটেলে ছিলাম, দুই বাঙালি আনাড়ি বন্ধু হিমালয় ভ্রমণে (ভ্রমণ নয়, একরকম রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার) যাচ্ছি জেনে সেই হোটেলের বাঙালি ম্যানেজার অনুগ্রহ করে তার চেনা এই তিব্বতী ছেলেটিকে গাইড হিসেবে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, জানি গাড়ি নিয়ে যাবেন। কিন্তু কোথাও কোথাও হাঁটতেই হবে। হাঁটার অসুবিধে যে কোনো মুহূর্তে ভুল পথে চলে যাওয়া। তা ছাড়া কোথায় খাবার পাবেন, কোথায় পানীয় জল পাবেন, কোন ফুল দেখতে সুন্দর কিন্তু বিষাক্ত–সে সব এর নখদর্পণে। তারপর কোন জায়গাটা কতখানি দূরে তা আপনারা আন্দাজও করতে পারবেন না।
আপত্তি করিনি। কেননা এই অচেনা, অজানা দুর্গম পাহাড়ি পথে, দুবেলা খেতে দেওয়া আর রোজ হিসেবে পাঁচ টাকা দিলেও লাভ বই লোকসান নেই।
বিভাস আমার সঙ্গে কলকাতার একই মেসে থাকে–একই ঘরে। আমারই মতো চাকুরে। মনের মিলও খুব। তবে আমার চেয়ে ওর স্বাস্থ্য অনেক ভালো। আর স্বাস্থ্য ভালো বলেই সাহসও বেশি। তবে দুজনের হবি দুরকম। আমি পছন্দ করি ঘরে বসে লিখতে, দেশ বিদেশের ওপর লেখা বই পড়তে। আর ওর নেশা ভ্রমণের। দুর্গম পথে। মাঝে মাঝে দুঃখ করে, এদেশে যদি আফ্রিকার জঙ্গলের মতো দুর্ভেদ্য জঙ্গল থাকত। কিংবা ক্ষ্যাপা সমুদ্রে ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে সাঁতার কেটে কোনো অজানা নির্জন দ্বীপে গিয়ে অসভ্য জাতির মতো প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে পারতাম!
সত্যি কথা বলতে কি, হাওড়া থেকে দিল্লি-কালকা মেলে চেপে ভোরে চণ্ডীগড়। তারপর মানালির বাস। তারপর মানালি থেকে রোটাং পাস। সম্ভব হলে আরও উঁচুতে ওঠার গোটা পরিকল্পনাটাই বিভাসের। মন থেকে আমার বিশেষ সায় ছিল না। কিন্তু বিধির ব্যবস্থা কী তা আগে কে জানতে পারে। নইলে দিল্লি কালকা মেলের একটা কামরায় হঠাৎই বা যোগাযোগ হবে কেন থুমি সামভোতার মতো একজন জ্ঞানতপস্বীর সঙ্গে? বয়েস ষাটের কাছে হলেও শরীর মজবুত। কোনোরকম রোগের লক্ষণ নেই। বিভাস ওঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। তারপর ফিসফিস করে বলেছিল, তিব্বতী ভদ্রলোক। নিশ্চয় যোগব্যায়াম বা প্রাণায়াম জাতীয় কিছু করেন। নইলে এই বয়সে অত সুন্দর চেহারা হয় কী করে?
ফর্সা রঙ। ন্যাড়া মাথা। গেরুয়া রঙের কাপড়ের টুপি। পরনে গেরুয়া আলখাল্লা, গায়ে মেটে রঙের ফতুয়া আর বুক, পিঠ, জানু ঘিরে আড়াআড়ি ভাবে হলুদ চাদর। রিজার্ভড সিটে গা এলিয়ে নিশ্চিন্তভাবে তিনি পড়ছিলেন একটা ইংরিজি বই–History of Mongolians. মোঙ্গল জাতির ইতিহাস। বইটি যে বিদেশে প্রকাশিত তা মলাটের জৌলুস আর পরিচ্ছন্নতা দেখলেই বোঝা যায়।
ভদ্রলোকের শান্ত, সৌম্য, গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারা। দেখলে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে।
তিনি যে শুধু ইতিহাসই চর্চা করেন তা নয়। তাঁর সঙ্গে আলাপ করে বুঝলাম তিনি রীতিমতো একজন পণ্ডিত লোক। জ্ঞানের গভীরে যেন ডুবে রয়েছেন। কথায় কথায় যখন জানতে পারলাম সংস্কৃত থেকে তিব্বতী ভাষায় পুঁথি অনুবাদ করেছেন তখন শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেল। তিনি যে একজন তিব্বতী মাত্র নন, প্রতিবেশী দেশগুলি যেমন চিন, ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ প্রভৃতির সঙ্গে রীতিমতো সাংস্কৃতিক যোগ রাখেন তা তার কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে বুঝতে পারলাম। আর তিনি যখন জানালেন যে, কলকাতায় শুধু এবারই নয়, অনেকবার এসেছেন তখন তার মুখে বাংলা কথা এত সহজে সরে কী করে তার কারণ বুঝতে বাকি রইল না।
তারপর যখন আর একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম তখন জিগ্যেস করতে সাহস হল, কী জন্যে তিনি সুদূর তিব্বত থেকে বার বার কলকাতায় ছুটে আসেন? উত্তরে তিনি শুধু একটু মুখ টিপে হাসলেন। তারপর একটু যেন ভেবে বললেন, আপনাদের কলকাতার সবচেয়ে মূল্যবান অ্যাসেট কী বলুন তো?
বিভাস জিগ্যেস করল, আপনি কী দর্শনীয় স্থানের কথা বলছেন?
ধরুন তাই।
এবার আমরা ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম। কলকাতাতেই থাকি তবু কি কলকাতা শহরটা ভালো করে দেখতে পেরেছি? কত ঐতিহাসিক জায়গা আছে–
বাধা দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, কলকাতার মিউজিয়ামটা আপনারা দেখেছেন নিশ্চয়ই?
কোনোরকমে মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম। (সত্যি কথা বলতে কি কবে কোন ছোটবেলায় একবার কি দুবার দেখেছিলাম, তারপর যাদুঘরের পাশ দিয়ে হাজার বার গেলেও ভেতরে ঢোকার ইচ্ছে বা সময় হয়নি)।
তিব্বতী মানুষটি খুশি হয়ে বললেন, দেখেছেন নিশ্চয়ই। কলকাতার কোনো মানুষ যাদুঘর দেখেনি তা হতেই পারে না। তা কবার দেখেছেন?
বিভাস তড়বড় করে বলল, তা অনেকবার।
বেশ। সব ঘরে ঢুকেছিলেন?
হ্যাঁ, তা তো নিশ্চয়ই। টিকিট কেটে যখন যেতে হয়েছিল তখন সবকিছুই তো দেখব।
ঘুরে ঘুরে সব দেখতে কতক্ষণ সময় লেগেছিল?
বিভাসকে বলতে না দিয়ে আমিই বললাম, তা অনেকক্ষণ।
শুনে ভদ্রলোক মুচকে একটু হাসলেন।
মমি দেখেছিলেন?
বাবাঃ! মমি দেখার জন্যই তো যাওয়া। দেখলে গায়ের মধ্যে কেমন শিরশির করে ওঠে। কত যুগ আগের বাসি মড়া।
সামভোতা মুখ টিপে একটু হাসলেন। বললনে, ঐ মমি দেখার জন্যেই আমি কলকাতায় ছুটে আসি।
শুধু মমি দেখার জন্যে এতবার কলকাতায় আসেন! অবাক হয়ে আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম। এ আবার কীরকম কথা!
হ্যাঁ, শুধু মমি দেখার জন্যেই বার বার আসি। তোমাদের সঙ্গে তফাত এই যে, তোমরা মমি দেখতে আস আর আমি মমির কাচের কেসের মধ্যে কিছু খুঁজতে আসি।
কিন্তু ওরা আপনাকে কি কেসের গায়ে হাত দিতে অ্যালাউ করে?
করে না বলেই তো বারবার আসতে হয়।
কেসের মধ্যে কী খোঁজেন?
সেটা এখনই এই ট্রেনের মধ্যে বলা যাবে না। পরে বলব। এখন বলো তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
আমরা দুজনে আবার পরস্পরের দিকে তাকালাম। অর্থাৎ বলে ফেলা উচিত হবে কিনা। গোপনীয়তা কিছুই নেই। উদ্দেশ্যও তেমন নেই। হয়তো বিচক্ষণ লোকটি হাসবেন। তবু বলেই ফেললাম, এমনি পাহাড়ে ঘুরতে।
সামভোতা আবার একটু হাসলেন। বললেন, ভারতবর্ষে কি পাহাড়ের অভাব আছে? তা হলে উত্তর দিকেই কেন? কোথায় যাবে?
বললাম, আমার এই বন্ধুটি, বিভাস, অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসে। দুর্গম নির্জন পাহাড়ি জায়গাই ওর পছন্দ। তাই ওর কথামতোই আপাতত আমরা যাব মানালি। সেখান থেকে গাড়ি পাই তো ভালোই। না হলে হিমাচল পর্যটনের বাস। সেই বাসে বিখ্যাত রোটাং পাস। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
সামভোতা উৎসাহ দিয়ে বললেন, খুব ভালো। রোটং পাসেই থেমে যেও না। গাড়ি যদি পাও, মানালিতে টাটা সুমো, টয়োটা কোয়ালিস এসব আধুনিক গাড়ি পেয়ে যাবে, তাহলে আরও উঁচু গিরিব পার হয়ে চলে যেও লাদাখ পর্যন্ত।
একটু থেমে বললেন, তা তোমরা এই পথটা ধরলে কেন? অন্য পথও তো ছিল শ্রীনগর থেকে। সেখান থেকে বাসে সোনমার্গ হয়ে জোজিলা গিরিপথ পেরিয়ে কার্গিলে। সেখানে রাত্রিবাস করে পরের দিন ভোরে রওনা দিয়ে সন্ধ্যায় লে। আমার তো মনে হয় এ পথটা অনেক কম হত। শত্রুপক্ষের গোলাগুলি ছাড়া অন্য ভয় নেই।
অন্য ভয়? চমকে উঠলাম দুজনেই। জিগ্যেস করলাম, অন্য ভয় বলতে?
প্রাজ্ঞ মানুষটি শান্তভাবে বললেন, পথটা তো দুর্গম। তাছাড়া বহুকাল আগের বহু ঘটনার সাক্ষী। কিন্তু–না, তোমারা ভালো সিদ্ধান্তই নিয়েছ। এখন আমার ইচ্ছে করছে আমিও তোমাদের সঙ্গে যাই।
অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, সত্যিই আপনি যাবেন? অবশ্য শুধু শুধু কষ্ট করে, পয়সা খরচ করে কেনই বা যাবেন?
সামভোতা এতক্ষণ নিজের সিটে গা এলিয়ে বই হাতে বসেছিলেন। এবার সোজা হয়ে উঠে বসলেন। বললেন, ঐ পথে এর আগে আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু যেজন্য গিয়েছিলাম তা সফল হয়নি। আরও যেতে হবে। হয়তো বার বার।
সাহস করে বললাম, আপনি বিরক্ত না হলে বলি ঐ রাস্তার এমন কী আকর্ষণ আছে। যে আপনাকে আবার যেতে হবে?
পণ্ডিত ব্যক্তিটি অল্পক্ষণ চুপ করে চোখ বুজিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ঐখানেই সেই বহু যুগ আগের পথ–যাকে বলা হত প্রাচীন সিল্করুট। ঐ পথ দিয়েই তো যাতায়াত করত হুন উপজাতির দল। সেই পথটা খুঁজে পাবার পর আরও অনুসন্ধান করার জায়গা আছে…এটা কোন স্টেশন এল?
আজিমগঞ্জ জংশন।
এতক্ষণে আজিমগঞ্জ।
হেসে বললাম, তবু তো বেশ তাড়াতাড়ি এসেছি। আপনার সঙ্গে গল্প করতে করতে আমাদের মনে হচ্ছে সময় কোথা দিয়ে কেটে গেল। কিন্তু পুরনো পথ ছাড়াও আর কী খুঁজতে চান?
আসল কথা হচ্ছে, আমার ওপর বরাবর কর্তৃত্ব করে এসেছে ইতিহাস। আর সে ইতিহাস শুধু ভারতের বা ইউরোপের নয়, মধ্য এশিয়ার মোঙ্গোলীয়দের নিয়ে। আর আমার ইতিহাসের নায়ক হচ্ছে চেঙ্গিস খান যাঁর আসল নাম ছিল তেমুচিন। পরে যখন মোঙ্গল জাতির প্রধান হয়ে উঠলেন তখন ওঁর নাম হল চিঙ্গীজ খান। চিঙ্গীজ কথার অর্থ অসাধারণ শক্তিশালী আর খান বলতে বোঝায় নেতা। কালে বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিভিন্ন ধরনের উচ্চারণের ফেরে চেঙ্গীজ খান শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় চেঙ্গিস খান। তোমরা চেঙ্গিস খানের নাম শুনেছ তো?
আমরা দুজনেই বলে উঠলাম, নিশ্চয়ই। চেঙ্গিস খান, তৈমুরলঙ্গ এঁরা ইতিহাসের কলঙ্ক। ওঁদের অত্যাচারের কথা কেউ ভুলবে না।
থুমি সামভোতা বললেন, চেঙ্গিস খান শুধু একজন মহা যোদ্ধা বা অত্যাচারী ছিলেন না, তাঁর মৃত্যু ও পারলৌকিক ক্রিয়াকলাপও ছিল রহস্যময়।
রহস্যময়!
হ্যাঁ। কিন্তু সেই রহস্যের কথা এখুনি বলব না। তবে জেনো যতদিন সামর্থ্য থাকবে ততদিন সেই রহস্য সমাধান করার চেষ্টা করে যাব।
সেইজন্যেই কি আমাদের সঙ্গে যেতে চাইছেন?
হ্যাঁ। বুঝতেই পারছ ওসব জায়গায় একা যাওয়া যায় না। যেতে হয় দলবদ্ধ হয়ে।
আপনাকে যদি সঙ্গে পাই তাহলে খুব খুশি হব।
বিভাস আরও একটু যোগ করল, শুধু খুশি হওয়াই নয় স্যার, আমরা উৎসাহ পাব, বিপদে পড়লে আপনার মতো ধীর শান্ত বিচক্ষণ মানুষের পরামর্শ উপদেশ পাব। তা ছাড়া রহস্য আমরাও ভালোবাসি।
বিচক্ষণ মানুষটি এ কথায় খুশি হলেন বলেই মনে হল। কেননা ভদ্রলোক এখটু চাপা স্বভাবের। উচ্ছ্বাস নেই। প্রাণ খুলে হাসেন না। তবু লোকটি ভালো।
বিভাসের কথা শুনে তিনি হাই তুলে, আলিস্যি ভেঙে বলে উঠলেন, বেশ তাহলে তোমাদের সঙ্গে যাওয়াই স্থির করলাম।
টিকিট?
বললেন, ভেব না। আপাতত চণ্ডীগড় পর্যন্ত টিকিট আছে। তারপর তো বাস। বাসে মানালি। তোমাদেরও তো সেইরকম ব্যবস্থা?
হ্যাঁ।
উনি যেন একটু ভেবে বললেন, আমি একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মাত্র। সুযোগ পেলে বৌদ্ধ তীর্থগুলিতে যাই। আর যাই বহু পুরনো গোম্ফাগুলোতে। সম্ভব হলে রাত কাটিয়ে দিই। কিন্তু ঐ রাত কাটানোই। ঘুম হয় না।
কেন?
ঠিক জানি না। বহু পুরনো জায়গা তো। কেমন যেন মনে হয়। যাক, ওসব কথা বাদ দাও। অনেক রাত হল। কিছু খাবার সঙ্গে থাকলে খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ো।
কী জানি কেন এই মানুষটির কথায় আমরা বেশ উৎসাহ পেলাম।
আপনি কী খাবেন? জিগ্যেস করলাম সবিনয়ে।
আপেল আর মিষ্টি আছে। আমি সন্ন্যাসী মানুষ। স্বল্পাহারী।
.
অশরীরী অরোহী
গাড়ি থেকে আমরা চারজনে নামলাম। তার মধ্যে হাঁড়িমুখো গাইডটিও আছে। নেমেই সে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। যেন পথ চেনবার চেষ্টা করল। আমরাও রাস্তায় নেমে নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচলাম। একবার আকাশের দিকে তাকালাম। ভাবলাম যদি নীল আকাশ একটু দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু পাশের কালো কালো উঁচু উঁচু পাহাড় আর পাহাড়ের গায়ে লম্বা ফার, আর চিনার গাছগুলো যেন আকাশটাকে আড়াল করে রেখেছে।
ড্রাইভার ততক্ষণে ইঞ্জিনের বনেট খুলে ঝুঁকে পড়ে কলকজা পরীক্ষা করছে। জিগ্যেস করলাম, কত দেরি হবে?
ড্রাইভার বললে, দেখি। আপনারা এক কাজ করুন। এই পথ ধরে বেড়াতে বেড়াতে এগিয়ে যান। গাড়ি সারানো হলেই আপনাদের ধরে ফেলব।
এই প্রস্তাবে আমরা সকলেই খুশি। সন্ন্যাসী ভদ্রলোকের দুচোখ খুশিতে উৎসাহে চকচক করে উঠল। উনি যেন হাঁটতেই চাইছিলেন। আমরা যে পাশাপাশি হাঁটব, তেমন সুবিধে নেই। রাস্তাটা পাহাড়ের গা ঘেঁষে। ইচ্ছে করেই বাসরাস্তা ছেড়ে এসেছি। বাসরাস্তায় এত নুড়ি ছড়ানো যে পা হড়কে যাবার ভয়।
আমাদের গাইড বোধহয় তার কাজ দেখাবার জন্যে এগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। তিন-চারটে সরু পাহাড়ি পথ হেলেসাপের মতো হিলবিল করে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে। সে রকম একটা পথ ধরে আমাদের উঠতে ভালোই লাগছিল।
অনেকক্ষণ থেকে বাতাসে একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছিল। গাইডকেই জিগ্যেস করলাম, কিসের গন্ধ হে? গাইড ছোকরা তার উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করল না। সে যেন মেন অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিল। আর ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক দেখছিল। কিসের এত ভয় তা তো বুঝি না।
আমার কথার উত্তর পিছন থেকে দিলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ঠাকুর। বললেন, গন্ধটা বন গোলাপের।
আমি মুগ্ধ হয়ে তখন দেখছিলাম পাইন গাছের বনগুলি। দেখছিলাম পাহাড়ের সবুজ চাদরে সাদা ফুলের ছিট। অপূর্ব!
আর ঐ দ্যাখো নাগলিলি। ঠিক যেন সাপের ফণা। আর কেশরগুলো যেন সাপের জিব। দেখতে খাসা কিন্তু সাপের মতোই বিষাক্ত।
বাসরাস্তা নীচে ফেলে আমরা ওপরে উঠছি তো উঠছিই। মনে হচ্ছে এই ভাবে পাহাড়টা পার হলে নতুন কোনো জায়গায় পৌঁছে যাব। কিন্তু আশ্চর্য, আমাদের কেউ একবারও ভাবল না, ইতিমধ্যে গাড়ি সারানো হয়ে গেলে ড্রাইভার আমাদের খুঁজে পাবে কী করে?
গাইডকে জিগ্যেস করা বৃথা। সন্ন্যাসী মশাইকে জিগ্যেস করলাম, শেষ পর্যন্ত বাসরাস্তায় ফিরে যেতে পারব তো?
উনি একবার একটা বড় পাথরের উপর দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখে কিছু একটা হিসেব করে বললেন, নিশ্চিন্ত থাকো।
তারপর সার সার পাহাড়ের উপর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার অনুমান যদি ভুল না হয় তা হলে আর অল্পক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ের ওপারে আরও একটা রাস্তা পাব।
আমি ভীতু শান্ত প্রকৃতির মানুষ। মনে মনে বললাম, নতুন রাস্তা পেয়ে কাজ নেই। তখন সন্ন্যাসী মশাই বললেন ঐ রাস্তা ধরে এগিয়ে গিয়ে নীচের রাস্তায় নামবেন। তিনি এ কথা বললে বিভাসও লাফিয়ে উঠবে। কিন্তু আমি তা চাই না। এখন গাড়িটা সারানো হয়ে গিয়ে থাকলে উঠে বসতে পারলে বাঁচি।
হঠাৎ দেখি আমাদের গাইড খুব ভয় পেয়ে ইশারায় আমাদের নীচে নেমে যেতে বলছে। নিজেও দাঁড়িয়ে থাকল না। এক-এক লাফে পাথর ডিঙিয়ে নীচের দিকে ছুটছে।
কী ব্যাপার? কী হয়েছে জিগমে?
ও অস্ফুট স্বরে কোনোরকমে বলল, বক্সী-বক্সী–
বক্সী! সে আবার কী? ভুটানিরা নাকি ভূতকে বক্সী বলে। এরাও কি বলে?
যদি সত্যিই ভূত বোঝাতেই ও বকসীবী বলছে তাহলে এখানে ভূত কোথায়?
আমি তিব্বতী মানুষটার দিকে তাকালাম।
দেখি তিনিও যেন কীরকম অন্যমনস্ক হয়ে গেছেন।
হঠাৎ এই সময়ে নিস্তব্ধ পাহাড়ের উপরে থেকে একটা শব্দ শোনা গেল। টানা শব্দ। অনেকটা যেন ঘোড়ার খুরের মতো–খটাখটখটাখটখটাখট–যেন অনেকগুলো ঘোড়া পাহাড়ের ওপর দিয়ে ছুটে আসছে।
শব্দটা সবাই শুনেছিলাম। তাই সকলেই থমকে গিয়েছিলাম।
পাহাড়ের ওপর এত ঘোড়া এল কোথা থেকে? যেন নিজের মনেই প্রশ্ন করল বিভাস।
এর উত্তর দিতে পারে একমাত্র আমাদের গাইড জিগমে গ্যাসো আর তিব্বতী পণ্ডিত থুমি সামভোতা। কিন্তু গ্যাটসো যেন কেমন হয়ে গেছে আরআর–আশ্চর্য, সন্ন্যাসী মশাই এর মুখ ফ্যাকাশে।
আশ্চর্য! তিব্বতী প্রবীণ জ্ঞানী মানুষটিও ভয় পেলেন নাকি? কিসের ভয়?
ততক্ষণে খুরের শব্দ দূর থেকে দূরান্তরে মিলিয়ে গেছে।
কী ব্যাপার পণ্ডিতজি?
উনি বিমর্ষ মুখে জোর করে হাসি টেনে বললেন, যা শুনলে তা নিয়ে আলোচনা করতে নেই। তবে আমি খুশি, যে পথটা সন্ধান করার জন্যে ইতিপূর্বে আসতে হয়েছে, আজ দৈবের বশে সে পথের সন্ধান বোধহয় পেয়ে গেলাম।
সে পথটা কোথায়?
আরও ওপরে।
ঘোড়াগুলো কোথা থেকে এল? ঘোড়সওয়ারই বা কারা?
শুনে ঘাবড়ে যেও না, ঘোড়ার অস্তিত্ব নেই, ঘোড়সওয়ারও নেই। থাকলেও চোখে দেখা যায় না।
চমকে উঠলাম। বললাম, সে আবার কী? অতগুলো ঘোড়া পাহাড়ের ওপারে রাস্তার ওপর দিয়ে ছুটে গেল, কাছে থাকলেও দেখতে পেতাম না?
কাছে থাকলে চোখ মেলে দেখবার সময় পেতে না। ততক্ষণে ধড় থেকে মাথা খসে পড়ত।
আমাদের গাইড যখন প্রাণের ভয়ে পাহাড় থেকে নীচে নামতে যাচ্ছিল, বিভাস তখন ঘোড়াগুলোকে দেখবার জন্যে সামনের উঁচু পাহাড়টার দিকে ছুটছিল। শব্দটা আর শোনা না যেতে সে নেমে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। তিব্বতী সন্ন্যাসীর কথা শুনে দুহাত মাথায় চেপে ধরে বলে উঠল, হে ভগবান! এই বিজ্ঞানের যুগে এও বিশ্বাস করতে হবে? সামভোতার দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, এসব কথা কি আপনার মস্তিষ্ক প্রসূত?
বিভাসের জিগ্যেস করার টোনটা এতই উগ্র ছিল যে ভেবেছিলাম সামভোতা বুঝি রেগে যাবেন। কিন্তু আশ্চর্য, তিনি এতটুকু রাগলেন না। একটু হেসে বললেন, না, আমার মস্তিষ্ক প্রসূত নয়। এটা তো ঠিক–ঘোড়া ছুটিয়ে যারা গেল তারা আজকের মানুষ নয়। আজকের মানুষ ঐরকম দুর্গম পাহাড়ের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে পারে না। ওরা সাধারণ অশ্বারোহী নয়। কোনো ত্রিভুবনজয়ী নৃপতির দুর্ধর্ষ অশ্বারোহী সৈন্য। অথচ সে নৃপতি জীবিত ছিলেন সম্ভবত আটশো-নশো বছর আগে। হাজার বছরও হতে পারে। কাজেই তাদের চর্মচক্ষুতে দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমায় সাহায্য করেছে বই। বই পড়েই আমি জানতে পেরেছি। যেমন জানতে পেরেছি সিন্ধুসভ্যতার যুগে দুটি শহর হরপ্পা আর মহেঞ্জোদাড়োর অনেক কথা।
ভয় পেলাম। এইবার বুঝি তিব্বতী পণ্ডিতমশাই শুরু করেন সেই হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়োর ধ্বংসাবশেষের ইতিহাস। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলাম না। বিভাস অবশ্য চঁচাছোলা কথা বলে। সোজাসুজি বলল, খুব সংক্ষেপে যদি বলেন শুনতে পারি।
না শুনলেও আমার কোনো ক্ষতি নেই। উত্তর দিলেন সামভোতা। তবে তোমরা বুঝতে পারতে এই অদৃশ্য ঘোড়সওয়ারদের সূত্র কোথায়?
তাহলে বলুন।
এসো, তবে এই পাথরটার ওপর বসা যাক।
সামভোতা বলতে শুরু করলেন, খ্রিস্টপূর্ব প্রায় তিন হাজার বছর আগে সিন্ধুসভ্যতার বিকাশ। তোমারা জান কিনা জানি না ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এক বাঙালি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দয়ারাম সহানী আর ঐ বিভাগের অধ্যক্ষ স্যার জন মার্শালের উদ্যোগে সিন্ধুনদের অববাহিকার কয়েকটি জায়গায় খননকার্য শুরু করা হয়। তার ফলে আবিষ্কৃত হল মহেঞ্জোদাড়ো আর হরপ্পা নামে দুটি প্রাচীন উন্নত নগরী। খননকার্যের ফলে সিন্ধুদেশবাসীর সেদিনের জীবনযাত্রার কিছু কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। তা থেকে সে সময়ের পথঘাট, সমাজব্যবস্থা, ধর্ম, উপাস্য দেবতা প্রভৃতি অনেক কিছুর সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন সম্প্রতি চণ্ডীগড়ে পাওয়া গিয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগের সীলমোহর। সেগুলির গায়ে খোদাই করা ছিল ষাঁড়, মোয, হাতি, গণ্ডার প্রভৃতি মূর্তি। অর্থাৎ সিন্ধুসভ্যতার যুগে প্রধানত এই সব জন্তুর প্রাধান্য ছিল।
হরপ্পা আর মহেঞ্জোদাড়ো দুটি নগরীই বেশ শান্তিতে দিন কাটাচ্ছিল। তারপর একদিন শুরু হল বহিঃশত্রুর আক্রমণ। তারা আসত পশ্চিম আর উত্তর দিক থেকে। এদের গায়ের রঙ ছিল গৌরবর্ণ, উন্নত নাক–আর্য সম্প্রদায়ের মানুষ। দুর্ধর্ষ তাদের শক্তি। তারা আক্রমণ করত দ্রুতগামী ঘোড়ার পিঠে চড়ে। এদের দেশেও ঘোড়ার অভাব ছিল না। কিন্তু এরা কখনও ঘোড়াকে বশ করে তার পিঠে চড়ত না।
কেন? ভয় করত যদি ঘোড়া থেকে পড়ে যায়? খানিকটা ব্যঙ্গের সুরেই জিগ্যেস করল বিভাস।
না। আসলে এরা বিশ্বাস করত একমাত্র অশরীরী আত্মারাই ঘোড়ায় চেপে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে দাপাদাপি করে বেড়ায়। অর্থাৎ ঘোড়া মাত্রই অশরীরী আত্মার বাহন।
ফলে আক্রমণকারীরা যখন চোখের সামনেই ঘোড়া ছুটিয়ে এসে লুঠপাট করে ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে পালাত তখন এরা উটের পিটে চড়ে ওদের পিছনে ধাওয়া করত। কিন্তু দ্রুতগতি ঘোড়ার সঙ্গে উট পেরে উঠত না।
এই ভাবেই একদিন হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়ো পিছিয়ে পড়ল। প্রভুত্ব করতে এগিয়ে এল আর্যরা।
সামভোতা একটু থামলেন। তারপর বললেন, সিন্ধুসভ্যতা কী করে ধ্বংস হয়ে গেল সে সব কথা বলার সময় এখন নয়। শুধু এইটুকুই জানাতে চেয়েছিলাম, খ্রিস্টপূর্ব তিন সহস্র বছর আগেও হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়োর লোকেরা ঘোড়া দেখে ভয় পেত। তারা অনুমান করতে পারত এক একটি ঘোড়ার ওপর এক একটি অপদেবতা বসে চারিদিকে লক্ষ রাখছে। অথচ তাদের দেখা যায় না।
এখন, এই কিছুক্ষণ আগে যে ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের শব্দ আমরা শুনলাম, সেসব ঘোড়ার পিঠে যারা সওয়ার তারা কেউ জীবন্ত মানুষ নয়, প্রেতাত্মা। আর ঘোড়াগুলোও তাই।
বিভাস বলল, না হয় তাই হল। এখন আমার দুটো প্রশ্ন। এক–আপনি বলেছিলেন কলকাতার মিউজিয়ামে বারে বারে গিয়েছিলেন মমির কেসের মধ্যে কিছু খুঁজতে। কী খুঁজতে বলেননি। আজ বলবেন?
সামভোতা বললেন, যথাসময়ে বলব। এখন তোমার দ্বিতীয় প্রশ্ন কী?
বিভাস বলল, ঐ যে অদৃশ্য ঘোড়সওয়াররা ঘোড়া ছুটিয়ে গেল। কোথা থেকে এল বা কোথায় গেল বলে মনে করেন?
সামভোতা হাসলেন। বললেন, অন্তত আট-ন শ বছর আগে এই বিদেহীরা কোন জাতির দেহ ধারণ করে সৈনিকবৃত্তি নিয়েছিল, কোন রাজার সৈনিক কোন রাজ্য আক্রমণ করতে চলেছে এসব কি আমার মতো সামান্য একজন মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব? একজন খুব উঁচুদরের ইতিহাসবিদও এর উত্তর দিতে পারবেন না। কারণ ইতিহাসবেত্তারা মানুষ নিয়ে গবেষণা করেন, প্রেতাত্মাদের নাগাল পান না। তবে
সামভোতা একটু থামলেন।
তবে কী?
আমি সন্ন্যাসীই হই বা যাই হই মনে-প্রাণে আমি একজন ইতিহাসপ্রেমী। শুধু ইতিহাসপ্রেমী নই, প্রাচীন কালের মানুষদের সমাজ, তাদের সংস্কার, তাদের ধর্ম, তাদের ক্রিয়াকলাপ সব নিয়ে গবেষণা করতে ভালোবাসি। সারা জীবন আমি ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমি তিব্বতী। তিব্বত আমার দেশ। ওখানকার প্রতিটি ধূলিকণায় কত না প্রাচীন সংস্কার লুকিয়ে আছে–আমি সেসবের সন্ধান করেছি। ওঁ মণিপদ্মে হুম এই শাস্ত্রীয় কথাটার মধ্যে যে কী যাদু আছে তা পৃথিবীর অন্য কোনো জাতির মানুষকে বোঝাতে পারব না। এই কথাটা উচ্চারণ করলেই আমার সর্বশরীর রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। তিব্বতের কত প্রাচীন গোস্যায় গোম্ফায় আমি ঘুরে বেড়িয়েছি–শুধু চোখের দেখার জন্যে নয়, ঠিক কী খুঁজে পেতে চেয়েছি তা আমি নিজেও জানি না। বৌদ্ধদের দেবদেবীর শেষ নেই।
গিয়েফাং থেকে জোখাং মন্দিরে এগারো মাথা হাজার হাতযুক্ত অবলোকিতেশ্বর বুদ্ধ বা ঢেং রেজি–সবই আমি দেখেছি। দেখেছি দু-চার বার নয়, বহু বার। কিন্তু যা খুঁজতে চাই তা পাই না। বলে তিব্বতী সন্ন্যাসী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
শুনতে ভালোই লাগছিল। কিন্তু হাতি-ঘোড়া কী যে খুঁজে পাচ্ছেন না তা বুঝতে পারলাম না।
একটু থেমে তিনি ফের বলতে লাগলেন, আমি কিছুকাল ধরে মোঙ্গলদের কথা পড়ছি। মোঙ্গলদের দেশ হচ্ছে মোঙ্গলিয়া। এটা কোথায় জান তো?
আমরা লজ্জায় পরস্পরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
সামভোতা একজন যোগ্য শিক্ষকের মতো গম্ভীর গলায় বললেন, শুধু এক ফালি পশ্চিমবঙ্গ, বড়োজোর ভারতবর্ষের ম্যাপটা মনে রাখলে চলবে না। চোখের সামনে রাখতে হবে গোটা পৃথিবীর মানচিত্র। যাই হোক এশিয়ার মানচিত্রটা একবার খুলে দেখো। চিনের ঠিক ওপরেই মোঙ্গোলিয়া। মোঙ্গোলিয়ার মাথার ওপরেই সোভিয়েত রাশিয়া। আর অনেক নীচে চিনের গায়ে গায়ে আমাদের দেশ তিব্বত। আর তিব্বতের গায়ে তোমাদের ভারতবর্ষ।
বিভাসটা সত্যিই তড়বড়ে। পণ্ডিত ব্যক্তিটি সবে একটু কথা বলতে শুরু করেছেন অমনি বিভাস বলে উঠল, কোথায় ভারতবর্ষ, কোথায় তিব্বত আর কোথায় মোঙ্গোলিয়া! পৃথিবীতে এত দেশ থাকতে হঠাৎ মোঙ্গোলিয়াকে নিয়ে পড়লেন কেন?
সামভোতা বিরক্ত না হয়ে বললেন, অধৈর্য হচ্ছ কেন? এই মোঙ্গোলিয়ার সঙ্গে এমন একটি ইতিহাস জড়িয়ে আছে যা সন্ধান করতে আমি মরিয়া হয়ে উঠেছি। এখন–এ কী! এখুনি অন্ধকার হয়ে আসছে কেন? আমার ঘড়িতে তো সবে সাড়ে তিনটে। তোমাদের?
আমরাও দেখলাম আমাদের কারও ঘড়িতে তিনটে পঁচিশ, কারও কয়েক মিনিট বেশি।
পাহাড়ে ঘেরা চারিদিক তো। তাই বেলা যতই থাক সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে গেলেই দিনের আলো কমে আসে। নাও, ওঠো। আর দেরি হলে পথ খুঁজে পাব না। বলতে বলতে আকাশের দিকে আর একবার তাকিয়েই অদ্ভুত ব্যস্ত হয়ে পাহাড় থেকে নামতে লাগলেন।
আপনি যেন একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। সেই কথাটা শুনিয়ে দিন।
সামভোতা বললেন, শুধু সেই একটুকরো কথা শুনলে তোমরা কিছুই বুঝতে পারবে না। তবু বলছি, আমি নিশ্চিত যে, মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উর্গা বা উলানবাটোর থেকে খারজম (Khawrizm), সমরখন্দ, বোখারা, আফগানিস্তান, হিরাট, গজনী হয়ে অন্তত পেশোয়ার পর্যন্ত একটা রাজপথ ছিল। যেমন রোটাং গিরিপথই বহু কাল ধরে লাহুল, স্পিতি, লে, লাদাখ এবং মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যপথ হয়ে আছে। কত যুগ ধরে কত বণিকের দল উট, ঘোড়া কিংবা গাধার পিটে মাল চাপিয়ে বরফ-পড়া শীতে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেছে। কতজন পথশ্রম আর হিমপ্রাহ সহ্য করতে না পেরে মাঝপথেই প্রাণ হারিয়েছে। সেই সব মৃতদেহ পড়ে থেকেছে তুষারধবল পাহাড়ের নীচে কিংবা ভাগ্য ভালো হলে পাহাড়ি ঝর্নার জলে হয়েছে সলিলসমাধি। ফিরে তাকাবার বা শোক করবার বা ভয় পেয়ে পা গুটিয়ে বসে থাকার উপায় নেই। মাইলের পর মাইল তাদের হাঁটতে হবে-১৩০০০/১৪০০০ ফুট চড়াই ভেঙে। প্রকৃতির এই ভয়ঙ্কর পরিবেশে ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে তাদের চলে না।
বিভাস বলল, না হয় বুঝলাম এইখানেই কোথাও আদ্যিকালের সেই পথটা আছে। কিন্তু সে পথটা খোঁজার জন্যে আপনার এত আগ্রহ কেন? সারা পৃথিবীর স্থলভাগে আদিকাল থেকে কত পথই না ছড়িয়ে আছে। তার মধ্যে অনেক পথ হয়তো ধসে চাপা পড়ে গেছে কিংবা পাহাড়ি নদী গ্রাস করে ফেলেছে। তাহলে একটা বিশেষ পথের জন্যে মাথা ঘামানো কেন?
আমার মন ছটফট করছিল। গাড়িটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে সারানো হয়ে গেছে। আপাতত গাড়িতে গিয়ে বসতে পারলে বাঁচি।
সামভোতার যেন কোনো দুর্ভাবনা নেই। পাহাড় থেকে নামতে নামতে এক জায়গায় একটু দাঁড়িয়ে পাশের পাহাড়ের পথে হাঁটতে লাগলেন। বিভাসের কথার উত্তরে বললেন, আমার ধারণা সেই পথ দিয়েই ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে অর্থাৎ ১২২১ সাল নাগাদ মোঙ্গোলীয় যোদ্ধা চেঙ্গিস খাঁ সসৈন্য দিগ্বিজয়ে যেতেন।
আমি অবাক হয়ে বলালম, তার মানে প্রায় আটশো বছর আগে!
বিভাস বিদ্রুপের সুরে বলল, রাজা বা সেনাপতিরা যুদ্ধ করতে সসৈন্য রাজপথ দিয়েই যাবে। আর রাজপথ যদি একটি থাকে তাহলে সেই পথেই যাবে। এতে আর ভাবনার কী আছে!
সামভোতা বললেন, যে রাজপথের কথা বলছিলাম সেই পথ দিয়েই যদি কফিনও নিয়ে যাওয়া হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে সেই পথ পরে ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল।
কথা বলতে বলতে আমরা এক একটা পাহাড়ি পথ অতিক্রম করছিলাম। কেবলই ভাবছিলাম পাশের ঐ পাহাড়টা দিয়ে এগোলে হয়তো তাড়াতাড়ি নামা হবে।
আগে আগে যাচ্ছিলেন সামভোতা। পাহাড়ের বাতাসে তার গায়ের র্যাগ গরম কোট থেকে বারে বারে ঝুলে যাচ্ছিল। তিনি বারে বারেই সামলাচ্ছিলেন। আর হনহন করে হাঁটছিলেন। তার হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল তিনি কিছু ভাবতে ভাবতে হাঁটছেন।
হঠাৎ পিছন ফিরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে আমাদের উদ্দেশে বললেন, গাইড ছোঁড়াটা গেল কোথায়?
তাই তো!
আমরা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম। কোথাও নেই।
তাই তো! ছোকরা গেল কোথায়?
আমি বললাম, কিছুক্ষণ আগে দেখলাম ও মাথা নিচু করে এগিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল যেন আমাদের এড়িয়ে তাড়াতাড়ি চলে যেতে চাইছিল।
সামভোতা গম্ভীরভাবে বললেন, গাড়ি খারাপ হওয়ার সময় থেকেই ওর মুখে চোখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখেছিলাম। তারপর ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনার পর থেকে ও যেন কেমন ভয় পেয়ে গেল। ও যেন অশুভ কোনো ঘটনার গন্ধ পাচ্ছিল। হাজার হোক ও তো এসব অঞ্চলের লোক। অনেক কিছুই জানে।
বিভাস বলল, ওসব কিছু নয়। যতক্ষণ গাড়ি ছিল, বেশ আরামে ছিল। তারপর পাহাড়ে উঠতে ভালো লাগছিল না। আমার মনে হচ্ছে ও কেটে পড়েছে।
কী পড়েছে? সামভোতা চলতি বাংলা কথাটা বুঝতে পারলেন না।
বললাম, এটা আমাদের এখনকার চলতি কথা। কেটে পড়েছে মানেনা বলে চলে গেছে।
ও আচ্ছা। তা যাক। কিন্তু আমার ভয় পথ হারিয়ে না ফেলে।
বলেই তিনি হন হন করে হাঁটতে গেলেন কিন্তু জোরে হাঁটতে পারছিলেন না। কারণ প্রথমত পাহাড়ি পথ, সর্বত্র পাথর ছড়ানো। দ্বিতীয়ত কিছুক্ষণ ধরে একটা ঝোড়ো বাতাস শুরু হয়েছে। সেই বাতাসটা আসছে সামনের দিক থেকে। ফলে বাতাস ঠেলে এগোনোই মুশকিল। এ অবস্থা আমাদের দুজনেরও। তাই তো, জিগমে গ্যাটসোটা কোথায় গেল? ও কি সত্যিই পালিয়ে গেল? না কি পথ হারাল?
যদি পথ হারায় তো সব্বনেশে কথা। যে হোটেল থেকে ওকে এনেছিলাম সেখানে তো পৌঁছে দিতে হবে।
একেই তো পাহাড়ের ওপর আমার বিন্দুমাত্র ভালো লাগছিল না। তার ওপর এই এক দুশ্চিন্তা।
হিমালয়ের রাজত্বে এসে পর্যন্ত এখনকার আবহাওয়ার মর্জি বুঝতে পারছি না। কখনও মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, কখনও বৃষ্টি, কখনও দমকা হাওয়া, কখনও তুষারঝড়। কখনও ধূলিঝড়। শীতে হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়। তা ছাড়া হঠাৎ হঠাৎ কুয়াশা তো আছেই। পথ হাঁটাই যায় না।
এখন আমার শীতের পোশাকের বর্ণনা একটু দিই। মোটা গেঞ্জি। তার ওপর দুটো ফুলহাতা সোয়েটার। তার ওপর উইন্ডচিটার। তার ওপর মোটা ওয়াটার প্রুফের কোট। পরনে উলের প্যান্ট। মাথায় মাঙ্কি টুপি। হাতে উলেন দস্তানা। পায়ে নাইলনের মোজা, তার ওপর উলেন মোজা। জুতোর কথা নাই বললাম।
কলকাতায় বসে তোমরা যখন এই উপন্যাস পড়বে তখন আমার এই পোশাক শুনে এখানে শীতটা কেমন কল্পনা করার চেষ্টা কোরো।
বিভাসের সব তাতেই বাড়াবাড়ি। আমার পোশাকের বহর দেখে হেসেই খুন। বললে, আস্ত একটা ক্লাউন। ও বলতেই পারে। কারণ তার গায়ে একটা হাফহাতা সোয়েটার, তার ওপর একটা ফুলহাতা সোয়েটার, তার ওপর উইন্ডচিটার। পরনে নাইলনের প্যান্ট, হাতে গ্লাভস। মাথায় টুপি। ওর টুপির বাহার দেখে ওকেই ক্লাউন বলে মনে হচ্ছিল আমার।
খুব সিমপল অথচ ফিটফাট লাগছিল তিব্বতী সন্ন্যাসীটিকে। যেমনই হোক তিনি সন্ন্যাসী। তাঁর আলখাল্লার আড়ালে পুরু সোয়েটার আর একটা গরম কম্বল আড়াআড়ি ভাবে জড়ানো। মাথায় সেই গেরুয়া টুপি। ফোলা ফোলা চোখ। ঠান্ডায় যেন আরো ফুলে উঠেছে। কাঁধে একটা বড়ো ব্যাগ। তার মধ্যে নিশ্চয় রাত্রে গায়ে দেবার কিছু কম্বল-টম্বল আছে।
কিন্তু জিগমে বেচারি গরিব। তার গায়ে একটা ফুলহাতা সোয়েটার আর মাথায় পাগড়ির মতো জড়ানো একটা মাফলার …।
সত্যি ছেলেটা গেল কোথায়? গাইড হিসেবে ওকে আনা আমাদের ভুল হয়েছে। এখন মানে মানে ওকে সেই হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারলে বাঁচি।
উতরাই ধরে অল্প একটু নামতেই হঠাৎ সামভোতা দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁর চলার গতির মধ্যে হঠাৎ ব্রেক কষা দেখে আমরা বুঝলাম নিশ্চয় সামভোতা এমন কিছু দেখেছেন–
দ্রুত পায়ে তাঁর কাছে যেতেই তিনি আঙুল তুলি দেখালেন, Look!
দেখলাম। পাহাড়ি ঝোপের এক জায়গায় দাঁড়িয়ে জিগমে পটাপট করে কী সব লতাপাতা ছিঁড়ছে। আর নিজের গলায়, মাথায়, বাহুতে জড়াচ্ছে।
সামভোতা কয়েকবার তার নাম ধরে ডাকলেন। কিন্তু জিগমে সাড়া দিল না। একটু উঁচুতে একটা ফুল ফুটেছিল। সেটা নেবার জন্যে লাফালাফি করেই চলল।
সামভোতা এগিয়ে গেলেন। দেখলেন জিগমের চোখমুখ ভয়ে বসে গিয়েছে। কাটার আঁচড়ে তার কপাল, হাত ছড়ে গিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে।
ঐ ফুলটা তোমার চাই?
জিগমে মাথা দোলাল। দীর্ঘদেহী সামভোতা ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে ফুলটা পেড়ে দিলেন। তাতে জিগমে কতটা খুশি হল বোঝা গেল না। তবে নিশ্চিন্ত হল।
এবার সে কিছু কিছু লতাপাতা আমাদের তিনজনের কব্জিতে বেঁধে দিল।
সামভোতা জিগ্যেস করলেন, এগুলো দিয়ে কী হবে?
জিগমে পাহাড়ি ভাষায় যা বলল সামভোতা বাংলা করে বুঝিয়ে দিলেন। জিগমে নিশ্চিত এই অঞ্চলে অপদেবতার ভয় আছে। গাড়িটা যখনই খারাপ হল তখনই ও নাকি বুঝতে পেরেছিল অদ্ভুত ঘটনা ঘটবেই। তারপর যত সবাই পাহাড়ে উঠতে লাগল ততই ও নাকি নিশ্চিত হয়েছিল জায়গাটা খারাপ। তাই এগোতে চাইছিল না। তারপর সেই অদৃশ্য ঘোড়া আর খুরের শব্দ ….
ও আরও বলল, এ কহানি তার জানা আছে।
থিবস–থিবস– বলে জিগমে হঠাৎ চিৎকার করে উঠেছিল।
থিবস! চমকে উঠলেন সামভোতা।
বোঝা গেল এই নাম তিনি জানেন।
থিবস্ কোথায় জিগমে?
ও উত্তর দিতে পারল না। শুধু সামনের একটা উঁচু পাহাড় দেখিয়ে দিল। বুঝিয়ে দিল যেখান দিয়ে ঘোড়াগুলো ছুটছিল সেখানেই আছে থিবস্–অতি ভয়ংকর …
এই বিশেষ ধরনের লতাপাতা ফুল গায়ে জড়ানো থাকলে প্রেতাত্মারা নাকি কোনো ক্ষতি করতে পারে না।
.
পাহাড়ে আতঙ্ক
জিগমের মতো একজন পাহাড়ি ছেলের ভয়-সন্ত্রস্ত মুখে যখন থিস্-এর কহানি উচ্চারিত হল তখন বিভাস খুব কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে এসেছিল সব ঘটনাটা শুনতে। কিন্তু জিগমে আর একটি কথাও খরচ করল না। জোরে জোরে পা ফেলে এগিয়ে চলল।
তার ভাবখানা এমনই যেন একমাত্র প্রেতাত্মা ছাড়া আর কারও পরোয়া করে না।
সামভোতার মুখটা ক্রমশই গম্ভীর হয়ে উঠছিল। কিছু একটা বুঝে তিনি তিব্বতী ভাষায় জিগমেকে আস্তে আস্তে চলতে বললেন। কিন্তু জিগমে কারো কথা শোনার পাত্র নয়। শুধু পিছনের পাহাড়টার সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গটা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েই জোরে হাঁটতে লাগল।
আমরা তিনজনেই সেই উঁচু চুড়োটার দিকে তাকালাম। বাদুড়ের পাখা ঝাঁপটানোর গতিতে ধোঁয়াটে অন্ধকার একটা আকার ধারণ করে ক্রমশ এই দিকে এগিয়ে আসছে … এছাড়া আর কিছু দেখা গেল না।
বুঝলাম জিগমে ঐ অন্ধকারটাকেই ভয় পাচ্ছে।
আবার আমাদের পাহাড়ি পথে হাঁটা। কোথায় যাচ্ছি তা জানি না। জিগমে তো জানেই না। এমনকি মনে হচ্ছে সামভোতাও কেমন দিশেহারার মতো হাঁটছেন।
আমি তো আগেই বলেছি আমার বন্ধুটি যেমন দুঃসাহসী তেমনই বেপরোয়া। পরিবেশ পরিস্থিতির প্রতি খেয়াল না রেখেই সময় সময় এমন এক-একটা মন্তব্য করে বসে যা শুনে আমারই লজ্জা করে। যেমন এখন নানারকম দুশ্চিন্তার জন্যে তাড়াতাড়ি পাহাড় থেকে নামার সময়ে ও হঠাৎ সামভোতাকে জিগ্যেস করল, আচ্ছা সন্ন্যাসীজি, (সামভোতাকে কী বলে সম্বোধন করবে বিভাসের তা ঠিক থাকত না। আর যাই হোক অত বড়ো পণ্ডিত মানুষটি যিনি বাপ কাকার বয়সী তাকে তো মিস্টার সামভোতা বলা যায় না। সেদিন ট্রেনে মোঙ্গলদের কথা বলছিলেন, এরাই কি ইতিহাসের মোগল?
সামভোতাকে ভালো করে এখনও চেনা হয়ে না উঠলেও এইটুকু বুঝেছি উনি আমাদের মতো অর্বাচীন ছোকরাদের যেমন-তেমন কথাবার্তায় বা মন্তব্যে রেগে যান না, বিরক্তও হন না। বাইরের শান্ত ধীর, সৌম্য মূর্তির মতোই তাঁর অন্তঃকরণটাও যেন অমলিন, স্বচ্ছ, সুন্দর।
বললেন, এইরকম একটা সময়েও তোমার জানার আগ্রহ ভালো লাগল। না, মোঙ্গলরাই মোগল বা মুঘল নয়। তবে পরে–অন্তত একশো বছর পরে দুর্ধর্ষ মোঙ্গলদের অনেকেই তুর্কি জাতির সঙ্গে মিলে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে অনেকখানি সভ্য হয়ে ওঠে। তারাই পরে ইতিহাসে মুঘল নামে পরিচিত হয়।
একটা প্রশ্নের উত্তর পাবার সঙ্গে সঙ্গে গুরুতর পরিস্থিতির কথা মনে না রেখেই আমার বেপরোয়া বন্ধুটি ফের জিগ্যেস করল, স্যার, এইমাত্র আপনি বললেন তুর্কি জাতির সঙ্গে মিলে আর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মোঙ্গলরা অনেকখানি সভ্য হয়ে উঠল। তা হলে কি মোঙ্গলরা অসভ্য ছিল?
সামভোতা একটা ছোটোখাটো পাথরের চাই লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে পাশের ঢালের দিকে পা বাড়িয়ে বললেন, মোঙ্গল কথাটির উৎপত্তি হয়েছে মোঙ শব্দ থেকে যার মানে হচ্ছে নির্ভীক। তারা ছিল মধ্য এশিয়ার যাযাবর জাতি। তারা বেশিরভাগই ছিল সুদক্ষ অশ্বারোহী, নিষ্ঠুর আর দুর্ধর্ষ সৈনিক। তাদের হাতে থাকত বাঁকা তরোয়াল আর বর্শা। চেঙ্গিস খানের বাহিনীর বেশির ভাগই ছিল দুর্ধর্ষ অশ্বারোহী এই মোঙ্গল যাযাবররা।
এই রণোন্মাদ রক্তপিপাসু সৈন্যদের সাহায্যে তিনি পিকিং অধিকার করেন। আর এক বছরের মধ্যেই চিনের উত্তর ভাগ দখল করে নেন। মোঙ্গোলিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে যে বিশাল খোয়ারদাম সাম্রাজ্য তাও চেঙ্গিসের পদানত হয়। তারপর বুখারা, সমরখন্দ, বা এমনকি আফগানিস্তানের হিরাট প্রভৃতি শহরগুলি শুধু অধিকার করা নয়, ধ্বংস করে ফেলা হয়।
আর এইসব মোঙ্গলদের চেহারা কেমন ছিল শুনবে? শোনো
যা বলব তা আমার শোনা কথা নয়। বিখ্যাত কবি আমীর খসরু একবার এই মোঙ্গলদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন। একে কবি মানুষ। ঝগড়াঝাটি, অশান্তি মোটেই পছন্দ করেন না। সেপাই-শাস্ত্রী, কারাগারের কথা ভাবলে ভয় পান। ঘটনাচক্রে তিনিই মোঙ্গলদের জালে পড়েন। তার জন্যে তার দোষ ছিল না। কিন্তু কে শুনবে তাঁর কথা? মোঙ্গলরা কবি টবির ধার ধারে না। আমীর খসরু তো মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হচ্ছেন, কিন্তু কী ভাবে যে তাঁর মুক্তি হল সে ইতিহাস অন্তত আমার জানা নেই। তবে তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এই মোঙ্গলদের যা বর্ণনা দিয়েছেন তা এই রকম–তাদের পশমের পাগড়ি বাঁধা লাল টকটকে মুখ দেখলে মনে হত পশমগুলো যেন জ্বলছে। তাদের মাথা ন্যাড়া। পাথরের গায়ে সরু ফাটলের মতো ছিল তাদের ক্রুর চোখ। তাদের সকলেরই শরীর থেকে পচা মৃতদেহের গন্ধ বেরোত, যে গন্ধ তাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। বিশাল জয়ঢাকের চামড়ার মতো খসখসে তাদের গায়ের চামড়া। তাদের নাকের গর্ত দুটো ছিল এ গাল থেকে ও গাল পর্যন্ত চওড়া। নাকের গর্ত সব সময়ে ভিজে থাকত। আর তা থেকে নর্দমার গন্ধ বেরোত। বড়ো বড়ো দাঁত দিয়ে তারা কুকুর-শুয়োরের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেত। জল খেত নালা-নর্দমার। আস্বাদহীন ঘাস ছিল তাদের আর এক ধরনের প্রিয় খাদ্য।
সামভোতা এই পর্যন্ত বলে সকলকে নির্দেশ দিলেন, ওহে নওজোয়ানরা আরও একটু জোরে হাঁটতে হবে। মনে রেখো এখনও পর্যন্ত যেখানে আমরা রয়েছি তা সুখকর নয়।
কথাটা শুনে আমার খটকা বাধল। কী বলতে চাইছেন উনি–সুখকর নয়, না নিরাপদ নয়।
একবার চারিদিকে তাকালাম। পাহাড়ের পর পাহাড়। পাহাড়ের ওপর লম্বা লম্বা ফার, পাইন আর চিনার গাছ।
ইতিমধ্যেই আমার নাছোড়বান্দা বন্ধুটি ফের ঝাঁপিয়ে পড়েছে
আচ্ছা স্যার, চেঙ্গিস খানের চেহারা পোশাক-পরিচ্ছদ কীরকম ছিল?
সামভোতা হেসে বললেন, সত্যিই তুমি অদ্ভুত। পাহাড়ে যখন ভয় দেখা দিয়েছে, আমরা যখন নামার জন্য ব্যস্ত তখনও তোমার যেন কোনো দুশ্চিন্তাই নেই। অবশ্যই এটা তোমার একটা গুণ।
একটু থেমে বললেন, প্রাচীন তিব্বতী গ্রন্থে এক জায়গায় বলা হয়েছে–দাঁড়াও পড়ে শোনাচ্ছি। বলে ঝুলি থেকে একটা বাঁধানো জীর্ণ বই বের করে পড়তে লাগলেন–একটু আগে ছোটো ছোটো বন্দি শিশুদের খাবারের লোভ দেখিয়ে ডেকে এনে পাহাড়ের ওপর থেকে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাততালি দিয়ে হেসে উঠেছিলেন মোঙ্গলদের ভয়ংকরদর্শন অধিপতি কটা দাড়িওয়ালা চেঙ্গিজ খান স্বয়ং।… তারপর তাঁর বাদামি রঙের তেজি ঘোড়ায় চেপে খান-ই খানানা আনন্দে শিস দিতে দিতে নিজের হলুদ রঙা তাঁবুতে ফিরে গেলেন। …।
আর এক জায়গায় …দীর্ঘদেহী চেঙ্গিজ খান স্বর্ণ সিংহাসনের ওপর পা গুটিয়ে বসেছিলেন। তাঁর কালো ভয়ংকর মুখে তামাটে রঙের দাড়ি। তাতে পাক ধরেছে, মাথায় গোলাকার কালো মুকুটের ওপর বিশাল পান্না বসানো। মুকুট থেকে কাঁধের ওপর ঝুলছে তিনটে শেয়ালের লেজ।
দাঁড়ান, দাঁড়ান। অবাক সুরে বিভাস বলে উঠল, শিয়ালের ন্যাজ!
হ্যাঁ।
কী বীভৎস!
আরও শোনো। তার চোখ দুটো ছিল পাহাড়ি বেড়ালের চোখের মণির মতো ঈযৎ সবুজ। সে তো মানুষের চোখ নয়, প্রেতের চোখ।
কথা বলতে বলতে ওরা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। পথ কি ফুরোবে না? আমি ছটফট করছি কখন গাড়িতে গিয়ে বসব। এতক্ষণে নিশ্চয় গাড়ি সারানো হয়ে গেছে। অ্যাডভেঞ্চারের শখ মিটেছে। এখন পালাতে পারলে বাঁচি।
কিছুক্ষণ আগে থেকে একটা অস্পষ্ট গুমগুম শব্দ কানে আসছিল। পাইন গাছের ঘন। জঙ্গলটাকে বাঁ দিকে রেখে ডান দিকে ফিরতেই শব্দটা স্পষ্ট হল। আমরা পরস্পরকে জিগ্যেস করলাম, কিসের শব্দ?
সামভোতা মুখে কিছু বললেন না। দাঁড়িয়ে পড়ে শুনতে লাগলেন।
তোমরা আমার পিছু পিছু এসো। মনে হচ্ছে কোনো খরস্রোতা নদীর শব্দ। কিন্তু নদী এল কোথা থেকে? যেন নিজের মনে প্রশ্ন করলেন সামভোতাজি।
বিভাস বলল, পাহাড়-পর্বতে নদী থাকাটা কি অস্বাভাবিক? দাঁড়ান দেখছি। বলে সে একছুটে একটা ছোটো পাহাড়ের দিকে অনেকখানি চলে গিয়েছিল, সামভোতা লাফ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে খপ করে বিভাসের হাত ধরে টেনে নিলেন।
চোখ মেলে দেখো।
সবাই দেখলাম মাত্র কয়েক হাত দূরে পাহাড়ের আড়ালে গভীর খাদ। আর তারই ধার ঘেঁষে ঘুরপাক খেতে খেতে ছুটছে সরু একটা খরস্রোতা নদী।
ইস্ এখুনি কী সব্বোনাশ হত! বললাম আমি।
কিছুই হত না। ঠিক সামলে নিতাম। কী বলুন সামভোতাজি! তা ছাড়া পাহাড়-পর্বতে খাদ থাকবেই। আমি তা ভালো করে জানতাম বলে সাবধানও ছিলাম।
ঘোড়ার ডিম ছিলে। চালবাজির একটা সীমা থাকা উচিত। কথাটা আমি মনে মনে বললাম।
সামভোতা বোধহয় কোনো কথাই শুনছিলেন না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবছিলেন।
কী ভাবছেন? জিগ্যেস করলাম উদ্বেগের সুরে।
যাবার সময়ে অর্থাৎ পাহাড়ে ওঠার সময়ে তো কোনো খাদ বা নদী-নালা দেখিনি।
চমকে উঠলাম। তাই তো!
বিভাস কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল, তা হলে নির্ঘাৎ আমাদের পথ ভুল হয়ে গেছে। ভালোই হল স্যার, অন্ধকার পথে অজানা ঠিকানার উদ্দেশে অ্যাডভেঞ্চারটা বেশ জমবে।
সামভোতা কোনো উত্তর দিলেন না। আকাশের দিকে উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তখন অন্ধকার চরিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, দোষ আমারই। দিক ঠিক করতে পারিনি।
জিগমে একটা পাথরের ওপর বসে একমনে গাছের সেই লতাপাতাগুলো জড়াচ্ছিল। বিভাস ধমকে উঠে বলল, তুই তো গাইড। ভুল পথে এলি কেন?
উত্তরে ও যা বলল সামভোতা তা বুঝিয়ে দিলেন। ও বলতে চাইছে প্রথম থেকেই পাহাড়ে ওঠায় ওর আপত্তি ছিল। তারপর অশরীরী ঘোড়সওয়ারগুলোর ঘোড়ার খুরের শব্দ ও …. তো পালিয়েই আসছিল–আমরাই দেরি করলাম।
বাঃ! খাসা জবাব।
তা বাবা, এখন কোন দিকে গেলে আমাদের গাড়ির টিকি দেখা যাবে বলতে পার?
জিগমে নিঃশব্দে এবং নির্ভীকভাবে মাথাকে শুধু এদিক থেকে ওদিকে নাড়ল। অর্থাৎ সে জানে না।
সামভোতা গম্ভীর মুখে বললেন, এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। যে রাস্তার ওপর আমাদের গাড়িটা রয়েছে তারই সমান্তরাল কোনো পথ আন্দাজে ঠিক করে এগোতে হবে। গাড়িটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে সারানো হয়ে গেছে, আর বোধ করি বুদ্ধিমান ড্রাইভার সেই পথ ধরে এগিয়ে গেছে আমাদের খোঁজে।
আমার বন্ধুটি যেন ব্যঙ্গ করে বলল, সেরকম হলে তো ভালোই হয়। কিন্তু আন্দাজে নতুন পথ ধরে যেতে যেতে সেই অশরীরী ঘোড়াদের রাস্তায় গিয়ে পড়ব না তো?
দেখা যাক। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে সামভোতা হাঁটতে শুরু করলেন।
হায় রে, ভেবেছিলাম এতক্ষণে কোথায় গাড়ির গদিতে পা ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজিয়ে পড়ে থাকব। তা নয় অন্ধকার অজানা পথে চলেছি পাথরে ঠোক্কর খেতে খেতে।
সামভোতা পঁধের ঝুলি থেকে টর্চ বার করলেন। নতুন তেজি ব্যাটারি। বোতাম টিপতেই আলোর ছটা অনেক দূর গিয়ে পড়ল। কিন্তু তাতে মোটেই উৎসাহ পেলাম না। সামনে শুধুই কালো কালো পাহাড় আর পাহাড়ের গায়ে বিরাট বিরাট গাছ যেন পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে।
হতচ্ছাড়া বিভাসের দুর্ভাবনা, দুশ্চিন্তা বলে ব্যাপারগুলোই নেই। এই প্রবল ঠান্ডায় অন্ধকার অজানা বিপদসংকুল পথে চলতে চলতে যখন ভয়ে আমার বুক কাঁপছে তখন ও কিনা সামভোতাকে সোজাসুজি বললে, এটাই কিন্তু স্যার, সবচেয়ে ভালো পরিবেশ যখন পথের ক্লান্তি ভোলার একমাত্র উপায় ভূতের গল্প শোনা।
রাগে আমার শিরাগুলো দপদপ করতে লাগল। ইচ্ছে করল সকলের সামনেই বিভাসটার কান দুটো আচ্ছা করে মুলে দিই। বিন্দুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান থাকলে কি কেউ এই দুঃসময়ে দুর্গম পথে ভূতের গল্প শুনতে চায়? কয়েক ঘণ্টা আগে ঘোড়ার খুরের শব্দর কথা কি ভুলে গেছে? সত্যিই তারা অশরীরী কিনা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি ঠিকই, তবু পাহাড়ের পর পাহাড়ের রাজ্যে এতগুলো ঘোড়া ছোটা কি বাস্তবে সম্ভব? কোন যুগের কোন দেশের কোন রাজা কোন রাজ্য দখল করতে ছুটল কে বলতে পারে? তা ছাড়া এ যুগে অশ্বারোহী সৈন্য পাঠিয়ে রাজ্য জয়ের কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। এই অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার দেখার পরও এখন আবার ভূতপ্রেতদের ডাকা কেন?
সামভোতা কিন্তু একটুকুও বিরক্ত হলেন না। বললেন, তোমার সাহস দেখে আমি খুশি হচ্ছি। কিন্তু তিব্বতের মতো জায়গায় বাস করেও ভূতের ঘটনা বিশেষ জানি না। বরঞ্চ তুমি কিছু বলো।
বিভাস বললে, দূর! কলকাতায় ভূতটুত নেই। কাজেই ভূতের গল্প আমি জানি না। আমার প্রশ্ন–চেঙ্গিস খানের মতো ভয়ংকর নেতা ভূতটুত কি মানতেন? সে তো আজকের ব্যাপার নয়, প্রায় আটশো বছর আগের কথা। তখন ভূত-প্রেতরা বেশ জাঁকিয়েই রাজত্ব করে গেছে। তাই না?
সামভোতা এ কথার উত্তর না দিয়ে হয়তো নিছক সময় কাটাবার জন্যেই বললেন, আমি চেঙ্গিস খানের ওপর নানা ইতিহাসবিদের নানা বই পড়েছি। চেঙ্গিস খান যে কখনও ভূতের মুখোমুখি হয়েছিলেন এমন কথা পড়িনি। তবে উনি সংস্কার, গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব মানতেন, কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটলে তার কারণ না জানা পর্যন্ত স্বস্তি পেতেন না। আর এই কারণ খোঁজবার জন্যে নিজের বুদ্ধি, বোধশক্তি, বিচার-শক্তি খাটাতেন না। বৈজ্ঞানিক চিন্তার কোন ব্যাপারই ছিল না। কারণ জানার জন্যে তাঁর সাম্রাজ্যের সব বড়ো বড়ো গণৎকার, জ্যোতিষীদের ডেকে পাঠাতেন।
একবার শিকারে বেরিয়ে একটা বন্য বরাহর পিছনে ধাওয়া করতে গিয়ে তার ঘোড়া হোঁচট খায়। খান মাটিতে পড়ে যান। ঘোড়া ছুটে পালায়। বরাহটি খানের কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু খানের কোনো ক্ষতি না করে ধীরে ধীরে নলখাগড়ার বনে চলে যায়। নির্ঘাৎ মৃত্যুর হাত থেকে এই বেঁচে যাওয়াতেও দুশ্চিন্তায় তাঁর ঘুম হল না। মনের ভেতর ঘোরাফেরা করতে লাগল একটাই কথা–কে তাকে বাঁচাল? এতে অমর-লোকের কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা।
এই প্রশ্নের মীমাংসার জন্যে তার অধিকৃত চিনের উত্তর ভাগ থেকে ঐ দেশের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী চানচুকে ডেকে আনালেন। সব শুনে সেই চৈনিক শাস্ত্রজ্ঞানী শুধু এই কথাই বলেছিলেন যে, মহামান্য খানের অনেক বয়স হয়েছে। স্বর্গীয় নির্দেশ–তিনি যেন শিকার করাটা এখন কমান।
চেঙ্গিস খান এ কথায় সন্তুষ্ট হননি। কারণ শিকারে যাওয়া তিনি বন্ধ করতে পারবেন না।
সুদূর চিন থেকে সহস্র লি [চিনা ভাষায় দূরত্বের পরিমাপ ও এক লি = প্রায় ২ কিলোমিটার।] পথ অতিক্রম করে আসা এই মহাজ্ঞানী তাপস চানচুকে কাছে পেয়ে খান আরও জিগ্যেস করেছিলেন, আচ্ছা আমাকে বুঝিয়ে বলুন দেখি বজ্র জিনিসটা কী? ওঝারা আর শামানদের সর্দার বেকি আমাকে বলে, মেঘলোকের ওপারে স্বর্গলোকে যে দেবতারা থাকেন তারা যখন মানুষের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে গর্জন করেন তখনই নাকি বজ্রপাত হয়। এ কথা কি সত্যি? তারা আরও বলে, লোকে যখন নিয়মমতো কালো রঙের প্রাণীর বদলে অন্য কোনো রঙের প্রাণী কুরবানি দেয় তখনই তিনি রুষ্ট হন, এ কথাও কি সত্যি? এছাড়াও লোকেরা আমাকে ভয় দেখায় গরমকালে স্নান করা বা নদীতে কাপড়-জামা ধোওয়া উচিত নয়, কম্বল বোনা কিংবা ব্যাঙের ছাতা তোলাও উচিত নয়। তাতে দেবতারা রুষ্ট হয়ে মানুষকে শাস্তি দেবার জন্যই বজ্র ও বিদ্যুতের সন্ত্রাস করেন।
বৃদ্ধ শাস্ত্রজ্ঞানী মানুষটি চেঙ্গিস খান-এর দিকে তাকিয়ে একটু হেসেছিলেন।
চেঙ্গিস খান তখন স্বর্ণসিংহাসনে সাদা পশমী গদির ওপর দুটি পা গুটিয়ে বসেছিলেন। মাথায় তার গোল মুকুট। মুকুটে লাগানো শেয়ালের কালো লেজ তাঁর মুখের ওপর ছায়া ফেলেছিল। স্বর্ণসিংহাসনের দুপাশের উঁচু উঁচু বাতিদানে জুলছিল মোটা মোটা মোমবাতি। শিবিরের মধ্যে কেউ ছিল না। থাকার মধ্যে গালিচার ওপরে বসে মোঙ্গল ও চিনাভাযায় দক্ষ তাঁর দুই দোভাষী।
পুণ্যবান চৈনিক শাস্ত্রজ্ঞানী বয়েসের কারণে দুর্বল কণ্ঠে শুধু বললেন, হে সম্রাট, আমি একজন সামান্য বুনো পর্বতবাসী। প্রাচীন পুঁথিপত্রে পড়েছি যে, মানুষের বিভিন্ন রকমের তিন হাজার অপরাধের মধ্যে ঘৃণ্যতম অপরাধ হল পিতা-মাতার উপর অশ্রদ্ধা। আর যিনি প্রজাপালক তার বাঁকা তরোয়ালে রক্তের ছোপ লাগা। আপনার রাজ্যে এসে দেখেছি প্রজারা নিজেরা ভোজসভায় মাতামাতি করে। অন্যদিকে বৃদ্ধ পিতা-মাতা, পিতামহ-পিতামহীকে শুকিয়ে মারে। এমনকি তাড়াতাড়ি ঘর খালি হওয়ার জন্যে তাদের মৃত্যু কামনা করে; সেবাশুশ্রূষা করা তো দূরের কথা। সম্রাট অন্য কোনো কারণে নয়, শুধু এই দুটি কারণেই স্বর্গের দেবতারা অসন্তুষ্ট হয়ে নরাধমদের ধ্বংস করার জন্যে বজ্রবিদ্যুৎ নিক্ষেপ করেন। …সামনে আবার খাদ। সাবধান! বলে সামভোতা টর্চের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফেলতে লাগলেন।
তবে চেঙ্গিস খানের স্ত্রী অশুভ আত্মায় বিশ্বাসী ছিলেন। তার প্রমাণ পুঁথিপত্রে পেয়েছি। একবার চেঙ্গিস খান পর্বতে বাস করছিলেন। সেখানে তাঁর স্ত্রী কুলান খাতুন আর চেঙ্গিসের শিশুপুত্র কুলকানও ছিলেন। তারা দুজনেই অসুস্থ হয়ে রেশমী গদির ওপর পশুলোমের চাদর জড়িয়ে শুয়ে জ্বরের ঘোরে ছটফট করছিলেন। সেই পার্বত্য অঞ্চলে যতটুকু সম্ভব চেঙ্গিস খান চিকিৎসার ত্রুটি করেননি। কিন্তু রোগ সারার কোনো লক্ষণ নেই। হতাশ কুলান খাতুন কাঁদতে কাঁদতে স্বামীকে বললেন, যেভাবে আমার চিকিৎসা করছ, তা যতই যত্ন নিয়ে হোক, তবু আমরা সেরে উঠব না। এ হল এখানকার পাহাড়ি ভূত-প্রেতের কাণ্ড। এই অভিশপ্ত জায়গায় যে থাকবে ওনারা তাকেই কষ্ট দেবেন।
একটু থেমে বললেন, খাদের তলা থেকে কেমন কুয়াশা ওঠে দেখেছ? তোমার নিজের এবং তোমার ফৌজের হাতে যে সব কচি বাচ্চার প্রাণ গেছে এ হল তাদেরই আত্মা। আমি আর ছোট্ট কুলকান এখানেই মারা যাব। বাঁচাতে গেলে নিজের দেশ মোঙ্গলস্তেপে আমাদের ফিরে যেতে দাও।
চেঙ্গিস খান রেগে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, এখান থেকে অন্য কোথাও যাবার কথা মুখে আনবে না। আমাকে আগে দুনিয়ার বাকি অর্ধেকটা জয় করতে হবে। তারপর অন্য কথা।
কুলান খাতুন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, একটার পর একটা রাজ্য জয় করে, নিরাপরাধদের রক্তে হাত রাঙিয়ে আর কত গুনাহ বাড়িয়ে তুলবে? তানগুত-সম্রাট বুখানের বিকলাঙ্গ ছেলেটাকে তুমি কী নির্মমভাবে খুন করেছিলে সে কথা তো ভুলে যাওনি?
হু! বিকলাঙ্গ হলে কি হবে, ও ব্যাটা ছিল সাক্ষাৎ শয়তানের বাচ্চা। যে আমাকে মারবার চেষ্টা করবে তাকে আমিই আগে শেষ করে দেব। এটাই আমার নীতি।
তা কি তুমি পারতে যদি না তোমার অনুগত পদলেহী কিছু সাধারণ মানুষ মিথ্যের ফাঁদ পেতে বিশ্বাসঘাতকতা করে ওকে তোমার তরোয়ালের মুখে ঠেলে দিত?
সামভোতা আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন হঠাৎ পাহাড়ের নিচু অংশের শালগাছগুলোর মধ্যে একটা ঝোড়ো হাওয়া উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে কী একটা ভারী বস্তু বিকট শব্দ করে পাশের পাহাড়ের গাছগুলোর ওপর লাফিয়ে পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে সামভোতা টর্চের বোতাম টিপলেন। এদিক-ওদিক আলো ফেললেন। তারপর বললেন, ও কিছু না, বাঁদর। এখানকার পাহাড়ে পাহাড়ে বাঁদররা রাতে লাফালাফি করে।
কিন্তু স্যার, হঠাৎ বলে উঠল জিগমে, টর্চের আলোয় আমি যে দেখলাম বাঁদর নয়। অন্য কিছু। বাঁদরের তো ল্যাজ থাকবে।
অন্য কিছু! চমকে উঠলাম আমরা তিনজনেই।
ঠিকঠাক বলো তো বাছা, অন্য কিছু বলতে কী বোঝাচ্ছ?
একটা বড়োসড়ো মোটাসোটা কালো ল্যাড়কা। ল্যাড়কা–কিন্তু গায়ে লোম। হ্যাঁ, আর যেন মনে হল তার মাথাটাই নেই।
.
অন্ধকার গুহায় কিছুক্ষণ
দুর্ভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে আমরা জনমানবশূন্য পথে হেঁটে চলেছি। কোথায় কোনদিকে যাচ্ছি কিছুই জানি না। পাঁচ-দশ মিনিট অন্তর আমরা প্রত্যেকেই হোঁচট খাচ্ছি। টর্চ থাকায় অবশ্য পাহাড়ি রাস্তায় সামান্য এক চিলতে পায়ে চলা পথের সন্ধান পাচ্ছি–এইটুকুই রক্ষে। শুধু চলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সামভোতা বলতে চান রাতের মতো একটা মাথা গোঁজার জায়গা চাই-ই। আকাশে মেঘের ঘনঘটা–বিদ্যুতের চমকানি। পাহাড় কাঁপিয়ে গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছে। এ যেন প্রলয়ের পূর্বাভাস! বৃষ্টি নামল বলে। তা হলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে হবে। এই প্রবল শীতে বৃষ্টিতে ভিজলে, তারপর ভিজে জামা-প্যান্ট পরে রাত কাটালে মৃত্যুর ঘণ্টা বাজবেই।
আমার মাথায় তখনও ঘুরছিল সেই অন্যকিছু বস্তুটার কথা। সামলোমশাই বললেন, পাহাড়ি বাঁদর। বেশ কথা। তার না হয় একটা মানে আছে। কিন্তু হতভাগাটা যা বলল সে তো অদ্ভুত কথা। একটা জলজ্যান্ত ল্যাড়কা অর্থাৎ ছেলেমানুষ-বড়োসড়ো খোকা, মোটাসোটা, গায়ে লোম, আবার নাকি মাথাটাই নেই!–সে বস্তুটি কী?
টর্চের আলোয় চকিতের মধ্যে এমন বস্তুটি শুধু শ্রীমান জিগমের চোখেই পড়ল, আর কারও নয়!
আশ্চর্য, কারও মনে কোনোরকম খটকাই বাধল না? সন্ন্যাসীজি তো চুপ করেই গেলেন। মুখে যেন রুমাল গুঁজে আছেন।
আমি নিচু গলায় বিভাসকে জিগ্যেস করলাম, খোকাটিকে কী মনে হল শুনে?
তৎক্ষণাৎ বলল, নাথিং। স্রেফ ইলিউশন! চোখের ভুল!
ব্যস! তাহলে তো সমস্যার সমাধান হয়েই গেল। এদিকে জিগমে এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে যেন ভয় পেয়ে আমাদের মাঝখানে থাকতে চাইছে। তবু এক এক সময় দলছুট হয়ে যাচ্ছে। একে গাঢ় অন্ধকার। তার ওপর কালো রঙ। মনে হল অন্ধকারে বুঝি মিশেই গেল।
জিগমে! স্তব্ধতা খান খান করে আমরা হাঁক দিই। দেখা তো নেই, সাড়াও নেই। তারপরই হঠাৎ ও যেন মাটি খুঁড়ে ওঠে।
কী বলছ?
কোথায় গিয়েছিলি?
ঐ যে কে একজন ডাকল আমায় ঐ পাহাড়টার দিকে …
কে ডাকল? আমরা তো ডাকিনি।
নির্লিপ্ত স্বরে বলল, তা হলে … কি জানি।
সামভোতা বললেন, ঐ পাহাড়ের পাশে খাদ আছে। শেষ হয়ে যেতে। খবরদার, স্বয়ং চেঙ্গিস খান ডাকলেও আমাদের কাছ থেকে কোথাও যাবে না। মালুম?
ও সুবোধ বালকের মতো উত্তর দিল, জি হাঁ।
তবু সে বেশ কিছুক্ষণ ধরে বোঝাতে চাইল ইচ্ছে করে সে ওদিকে যায়নি। কেউ ওকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
মরুক গে। এসব অদ্ভুত কথা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।
কড়কড়কড়াৎ করে হঠাৎ বাজ পড়ল। বিদ্যুতের চোখ ধাঁধানো ঝিলিক ছুটে গেল সামনের পাহাড়টার দিকে। একটা দেবদারু গাছের মাথা জ্বলে উঠল। কতকগুলো পাথর গড়িয়ে পড়ল খাদের নীচে। পাহাড়ে এমন বজ্রপাত এই প্রথম দেখলাম।
তারপরই শুরু হল বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি। এই ভয়টাই করছিলাম আমরা। একটু আশ্রয়ের জন্যে সামভোতা টর্চের আলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ফেলতে লাগলেন।
চলো ঐ দিকে। ঐ পাহাড়টার নীচে। মনে হচ্ছে ওখানে মাথা গোঁজা যাবে।
ছুটতে ছুটতে আমরা পাহাড়টার নীচে এসে পৌঁছলাম। পাহাড়ের এই অংশ ছাদের মতো খানিকটা বাইরের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ভিতরটা ফাঁকা। এখানে চারজনে ঘেঁষাঘেঁষি করে কোনোরকমে দাঁড়াতে পারব। সামভোতা টর্চের আলো ফেলে চারিপাশটা একবার দেখে নিলেন। গুহাটার চারিপাশে বুনো লতাপাতার ঝোপ। সাপখোপ চোখে পড়ল না। চোখে না পড়লেও আড়াল থেকে একটি নিঃশব্দ ছোবল হানতে কতক্ষণ। কিন্তু ভেবে লাভ কী?
জোর বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির সময় কলকাতার রাস্তায় পথ চলতে চলতে আমরা যেমন ছুটে গাড়িবারান্দার নীচে আশ্রয় নিয়ে হাঁট থেকে রেহাই পাবার জন্যে কেবল পিহোতেই থাকি, তেমনি এই সংকীর্ণ গুহায় ঢুকেই বুদ্ধিমানের মতো যতটা সম্ভব পিছিয়ে একেবারে পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম। এমন জায়গায় নিশ্চিন্ত হয়ে দাঁড়ালাম যে বৃষ্টির ছাঁট লাগা তো দূরের কথা, বাইরে যে শীতল প্রবাহ বইছে তার থেকেও রক্ষা পেয়ে যাচ্ছি।
সবাই যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, আমি তখন উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠলাম, বসবার জায়গা যদি থাকত তাহলে এখানে বসেই বাকি রাতটুকু নিরাপদে কাটানো যেত।
বিভাস দাবড়ে উঠে বলল, রাতটুকু মানে? এখন কটা বেজেছে জান?
কটা?
স্যার, টর্চটা একবার জ্বালুন তো।
টর্চটা জ্বেলেই সামভোতা বললেন, দশটা পনেরো মিনিট।
মাত্র দশটা। আমি মুষড়ে পড়লাম, তা হলে তো বৃষ্টি থামলেই আবার হাঁটতে হবে। তাও যদি জানা একটা নির্দিষ্ট জায়গা থাকত! আচ্ছা, আমরা কোথায় চলেছি? তিব্বতী সন্ন্যাসী তো বলছিলেন কোন একটা বহু প্রাচীন রাস্তার খোঁজ করছেন। সে রাস্তা নাকি ভয়ংকর! আচ্ছা, পাগল না হলে কেউ এইরকম পাহাড়ে-পর্বতে ঐরকম ভয়ংকর রাস্তা খুঁজে বেড়ায়? সে রাস্তাটা খুঁজে পেলে নাকি একটা ঐতিহাসিক আবিষ্কার হবে। কী জানি! ওসব ব্যাপার বুঝি না।
আর আমরা কোথায় যাচ্ছি? গন্তব্যস্থল ছিল লাদাখের রাজধানী লে। কিন্তু গাড়ি খারাপ হয়ে যাবার পর ভুল রাস্তায় পড়ে এখন যে কোথায় এসে পড়েছি তার ঠিক নেই। তাই ঠিক করা গেছে যতটা সম্ভব পাহাড়ের পথ ধরে এগিয়ে যাব। তারপর? পথের শেষ কোথায় কে জানে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ভারী হয়ে যাওয়ায় পাথরের গায়ে হেলান দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলাম। যে জিনিসটা আমার গায়ে ঠেকল সেটা কিছুতেই পাহাড়ের খসখসে পাথর নয়, অন্য কিছু। শরীর বাঁকানো দূরের কথা, জায়গাটা এত সংকীর্ণ যে ঘাড় ফেরানোও কষ্টকর। সেই অন্যকিছুটা যে গুহা-ভেদ-করে-ওঠা কোনো গাছ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না তা জানতাম, তবু ঘাড় না ফিরিয়ে দু হাত দিয়ে জিনিসটা কী বোঝবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারলাম না। গাছ নয়, এটা ঠিক। তাহলে? হাত বোলাতে বোলাতে মাঝে মাঝে ফাঁকে ফাঁকে আঙুল ঢুকে যাচ্ছিল। সেইভাবেই দুটো হাত আরও একটু উপরে তুললাম। গোলমতো একটা কিছু হাতে ঠেকল। একটা ফুটোর মধ্যে দুটো আঙুল ঢুকে গেল স্বচ্ছন্দে। জিনিসটা যেন একটু নড়ে উঠল। তার পর….তার পর দুটো সরু সরু গাছের ডালের মতো কিছু যেন আমার গলার চামড়া ছুঁল। আমি শিউরে উঠলাম। হাঁকপাক করে বললাম, স্যার, একবার টর্চটা জালুন তো।
আমার গলার স্বরে নিশ্চয় ভয় ফুটে উঠেছিল তাই সাপটাপ ভেবে উনি চমকে উঠে টর্চটা জ্বাললেন।
অন্ধকার ঘুটঘুঁটে সেই গুহার কিছুটা অংশ আলোকিত হল। সেই আলোতেই দেখলাম।
দেখলাম যেটার গায়ে হেলান দিয়ে এতক্ষণ নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটা একটি নরকংকাল। ঘাড়টা কাত হয়ে বুকের কাছে ঝুলছে। যে হাত দুটো উঠে আমার গলার দিকে এগিয়েছিল, এখন সেই হাড্ডিসার হাত দুটো তারই রক্তমাংসশূন্য গায়ের পাশে হাওয়ায় দুলছে। আর
আর দেখা গেল কবেকার সেই কংকালটি লতাপাতায় শক্ত করে বাঁধা। সেটি ঝুলছে গুহার ছাদের উপর থেকে।
তারপর কী করে যে সবাইকে ঠেলে দুই লাফে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম তা আমিই জানি।
আবার হাঁটা শুরু হয়েছে। কারও মুখে কথাটি নেই। আমার গা-টা কেমন ঘিন ঘিন করছে। কবেকার একটা কংকাল….
কিন্তু অন্ধকার গুহার মধ্যে মরল কী করে? আমাদের মধ্যে কেউ বলছে নির্জন জায়গা পছন্দ করে দড়ির অভাবে লতাপাতা জড়িয়ে ঝুলে মরেছে। কেউ বলছে খুন করে গুহার ভেতর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিভাস প্রতিবাদ করে বলল, খুনটুন বাজে কথা। এখানে কে কাকে খুন করবে? খুন হয়েছে তার প্রমাণও নেই।
আমি বললাম, খুলিটা দেখেছিলে? কাঁধের উপর লটকে পড়েছিল না? আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি ও বেচারিকে ঘাড় মটকে মারা হয়েছে। তারপর শক্ত লতা দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু মারলটা কে?
এবার সামভোতা বললেন, ও তর্ক করে লাভ নেই। টর্চের আলোর যতটুকু লক্ষ করেছি তাতে বুঝেছি কংকালটা ঝুলে আছে বহুদিন। কংকালের গায়ে ছাতলা পড়ে গেছে। চটা উঠে গেছে।
এরপর কেউ আর কোনো কথা বলল না। কথা বলতে বলতে হাঁটলে ভয় থেকে দূরে থাকা যায়। কিন্তু কেউ কথা না বললে একা একা কি কথা বলা যায়? ফলে নিজেদের জুতোর শব্দ শুনে অন্তত আমি চমকে উঠছিলাম–কেউ পিছনে আসছে না তো?
সামভোতার মতো এক প্রবীণ ঋষিতুল্য তিব্বতী মানুষ কখন যেন আমাদের অভিভাবক হয়ে উঠেছেন। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে তিনিই এগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। টর্চের আলো ফেলে ফেলে পথ দেখে নিচ্ছেন।
সহজ হবার জন্যে একসময়ে তিনি আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, তুমি তো বেশ সাহসী ছেলে। দিব্যি একটা ঘাড়-মটকানো কংকালের গায়ে গা লাগিয়ে সময় কাটাচ্ছিলে।
সাহস আর কী স্যার, আমি যদি জানতাম গায়ের কাছে আস্ত একটা কংকাল ঝুলছে তাহলে কি ওখানে দাঁড়াতাম। তবে লোকটা কোনো এক কালে খুন হয়েছিল এ কথা ভাবতেও কষ্ট হয়। হয়তো লোকটা নিরপরাধ ছিল। তবে যদি খুনটা ভূতে করে থাকে তাহলে বলার কিছু নেই।
সামভোতা বললেন, আমার দেশে তিব্বতে প্রেতচর্চা চলে নিষ্ঠার সঙ্গে। অনেক প্রাচীন পুঁথিপত্র ঘাঁটা হয়। এইসব আলোচনাচক্রে আমিও বহুদিন ছিলাম। একটা সত্য জেনেছি ভূত মাত্রই মানুষের ক্ষতি করে না। অকারণে মানুষ মারে না। কিন্তু সে নিজে যদি অত্যাচারিত হয়ে খুন হয়ে থাকে তাহলে সে প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করে। চেঙ্গিস খান কতখানি নিষ্ঠুর ছিলেন প্রাচীন পুঁথিপত্র তার সাক্ষ্য দেয়। তার নিজের হাতে বা তার ফৌজের হাতে কত নিরীহ মানুষ খুন হয়েছে তার হিসেব নেই। সেইসব ক্ষুব্ধ প্রেতাত্মা যদি তার বা তার পরিজনদের ওপর প্রতিশোধ নেয় তাহলে বলার কিছু নেই। এ কথা তিনিও বুঝতেন। তাই তিনি কী করলে মঙ্গল হবে, কী করে ফেললে ক্ষতি হবে সে বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্যে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর নির্ভর না করে শামান, ওঝা, বৈদ্য, ফকিরদের ডাকতেন।
একবার তার খেয়াল হল চুলে পাক ধরেছে। চুল পেকে যাওয়াটাকে তিনি খুব ভয় পেতেন। মনে হত এবার বৃদ্ধ হয়ে পড়বেন, তারপরেই মৃত্যু।
মৃত্যু ব্যাপারটা তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। অথচ সব মানুষকেই নাকি মরতে হবে–এ তো বড় অদ্ভুত কথা। যদিও তাঁর উপযুক্ত ছেলে ছিল জাগাতাই, পৌত্র ছিল মুতুগান–যে মুতুগানই ঠিক হয়েছিল সমস্ত মুসলিম দুনিয়ার ভাবী খাই-খানা, তবু তার হাতে গড়া বিরাট সাম্রাজ্য।
বাধা দিয়ে বিভাস জিগ্যেস করল, তার সাম্রাজ্য কতদূর পর্যন্ত ছিল?
তা ধরো উত্তরে সাইবেরিয়া থেকে দক্ষিণে জর্জিয়া আর পুবে চিন থেকে পশ্চিমে রাশিয়া।
বাবাঃ! এ তো বিশাল সাম্রাজ্য!
হ্যাঁ, তাই। আর একটার পর একটা রাজ্য জয় করেছিলেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজে সৈন্য পরিচালনা করে। তাঁর দুর্ধর্ষ অশ্বারোহী সৈন্য ছিল শত্রুদের ত্রাস। যেমন ধরো এ যুগে য়ুরোপ-কাঁপানো হিটলারের ট্যাঙ্ক বাহিনী। আর তার সেই বিশাল সাম্রাজ্য ভেবে রেখেছিলেন তিনিই শাসন করে যাবেন চিরকাল ধরে।মৃত্যু বলে ব্যাপারটা কোনোরকমেই বাধা না হয়ে দাঁড়ায়।
মন্ত্রীদের, পণ্ডিতদের তো মাথায় হাত। এই পৃথিবীতে জীবজন্তু তরুলতা মানুষ কেউই অমর নয়। অমর হওয়া সম্ভব নয়।
চেঙ্গিস খান শোনবার পাত্র নন। তাঁকে অমর হতেই হবে। তাও বিছানায় পড়ে থেকে নয়। রীতিমতো শাসনদণ্ড হাতে নিয়ে। তখন তিনি তার বিশাল সাম্রাজ্যের যত নামকরা বৈদ্য, ওঝা, কবিরাজ, হেকিমদের ডেকে পাঠালেন। এমন কিছু ওষুধ তৈরি করো যাতে অমর হওয়া যায়।
এই অসম্ভব আদেশ শুনে তাদের তো থুতনি ঝুলে গেল। এ কী করে সম্ভব?
চেঙ্গিস খান কোনো কথা শুনতে চান না। সাত দিন সময় দিলেন। সাত দিনের মধ্যে তার ওষুধ চাইই।
নির্দিষ্ট দিনে চারজন বৈদ্য অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন পানীয় নিয়ে হাজির হলেন। সন্দিগ্ধস্বভাব, অবিশ্বাসী খান মুখে পাথরের ফাটলের মতো সরু হাসি হাসলেন। বললেন, যাক, তোমরা তাহলে দাওয়াই তৈরি করতে পেরেছ?
চারজনেই বলল, আজ্ঞে হাঁ সম্রাট।
বেশ তা হলে তো তোমাদের পুরস্কৃত করা উচিত।
আজ্ঞে সে আপনার মর্জি।
তখন তিনি ঐ সব বৈদ্যদের যার যার নিজের আবিষ্কৃত দাওয়াই পান করার হুকুম দিলেন। তার পরদিন তিনি তাদের বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে নিজে হাতে শিরোচ্ছেদ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ করতে থাকেন তারা সত্যিই মরে গেছে কিনা।
তারা কেউ বেঁচে ওঠেনি। তাই দেখে চেঙ্গিস খান মনে মনে গর্জে উঠেছিলেন–দুনিয়ার সবাই তাকে ঠকাতে চায়। সবাই শক্ত।
শেষে তার প্রধান অমাত্য ও জ্যোতিষী ইয়েলিও-এর পরামর্শে চিন দেশের শ্রেষ্ঠ গুণী মহাস্থবির চানচুকে সাদরে তার রাজসভায় আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি ত্রিকালদর্শী মহাসাধক। তিনি ধ্যান করেন কখনও মৃতদেহের মতো নিশ্চল হয়ে বসে; কখনও সারাদিন গাছের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েই থাকেন। তিনি তার দীর্ঘ জীবনে অনেক কিছু দেখেছেন। বহু প্রাচীন পুঁথি পড়েছেন। তিনি বহু কষ্টে পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে এলেন। তিনিই চেঙ্গিস খানকে বোঝাতে পেরেছিলেন, এ জগতে কেউ অমর হতে পারে না।
তারপর সামভোতা পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বললেন, নিরপরাধ মানুষকে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না দিয়েই খেয়ালের বশে তিনি কতজনের প্রাণ সংহার করেছেন। এইসব ক্ষুব্ধ আত্মা সুযোগ পেলে কি সম্রাটের ক্ষতি করবে না?
ক্ষতি কি চেঙ্গিস খানেরও হয়নি? বালতান দুর্গের লড়াইয়ে শত্রুপক্ষের ছোঁড়া বর্শার আকারের এক বিশাল তীর এসে বেঁধে চেঙ্গির খানের বড়ো আদরের পৌত্র মুতুগানের বুকে। তাতেই সে শেযশয্যা গ্রহণ করেছিল। বেদনাহত, ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ চেঙ্গিস তখনই গণৎকারদের ডেকে এনে এত বড়ো দুর্ঘটনার কারণ জিগ্যেস করলেন। কিন্তু কেউ সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি। শুধু একজন বৃদ্ধ গণৎকারই বলেছিল, এটা কোনো ক্ষুব্ধ আত্মার প্রতিহিংসা।…..
শুনতে শুনতে আমরা অনেক দূর চলে এসেছিলাম। হঠাৎ মনে হল আমাদের দলটা যেন হাল্কা হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সামভোতা টর্চ জ্বেলে সঙ্গীদের হিসেব নিয়ে নিলেন। জিগমে নেই। চমকে উঠে বার বার তার নাম ধরে ডাকা হল। কিন্তু সাড়া পাওয়া গেল না।
হয় তো অন্ধকারে অন্যমনস্ক ভাবে চলতে চলতে পথ হারিয়ে ফেলেছে।
আমি কতকটা নিজের মনেই বলে উঠলাম, আচ্ছা সেই কংকালের গুহা থেকে আমরা যখন সবাই হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসি তখন ও-ও বেরিয়ে আসতে পেরেছিল তো?
এর উত্তরে আমরা শুধু নিঃশব্দে মুখ-চাওয়া-চাওয়ি করেছি। উত্তর দিতে পারিনি।
.
আঁধারে প্রদীপ জ্বলে
জিগমের কথা মনে করে আমরা সকলেই এমন ভারাক্রান্ত হয়ে আছি যে হাঁটার ক্লান্তিকে ক্লান্তি বলেই মনে হচ্ছে না। কতকগুলো যান্ত্রিক মানুষ যেন দম দেওয়া পুতুলের মতো এগিয়ে চলেছে দুর্ভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে। অথচ কোন নিরুদ্দেশের পথে, কোন মৃত্যুপুরীর ঠিকানায় চলেছি তার ধারণাটুকুও নেই।
হঠাৎ ডান দিকের পাহাড়ের গাছগুলো কেঁপে উঠল। আমরা চমকে উঠলাম। আবার কি সেই মনুষ্যাকৃতি লোমশ জন্তুটা–হ্যাঁ, তাই।
বেঁটেখাটো একটা প্রাণী অন্য একটা গাছে লাফিয়ে পড়ে তার ডাল ধরে ঝুলতে লাগল। আমরা ভয়ে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু তারপর যা ঘটল–
সামভোতা হঠাৎ টর্চ-এর আলো ফেললেন জীবটার দিকে। চমকে উঠলাম। মনুষ্যাকৃতি একটা বামন। লোমে ভরা তার ছোট্ট দেহটা। বীভৎস তার মুখ। ক্রোধে ঝকঝক করছে চোখ দুটো। দেহের তুলনায় হলদে দাঁতগুলো বড় বড়ো। সেই দাঁতে চেপে আছে একটা ছোরা। আশ্চর্যের বিষয় তার মাথাটা ঠিক ঘাড়ের ওপর নেই। কাঁধের পাশে লেগে রয়েছে।
মুখের ওপর আলো পড়তেই ও মুখটা আরও ভয়ংকর করে গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ল আমাদের সেই পাহাড়ি রাস্তার ওপর। তারপর দুহাত দোলাতে দোলাতে গুটগুট করে আমাদের সামনে সামনে এগিয়ে চলল। কাটা মাথাটা কাঁধের ওপর দুলতে লাগল।
গভীর রাতে নির্জন পাহাড়ি পথে এমন একজন বামনকে দুহাত দুলিয়ে বীরবিক্রমে হাঁটতে দেখব কল্পনা করিনি। এই কি জিগমের ভাষায় সেই থি?
কে উত্তর দেবে?
অল্পক্ষণের মধ্যেই বামনটি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
তারপর আরও কিছুক্ষণ হাঁটা–কিছুক্ষণ পথের ধারে পাথরের ওপর বসে বিশ্রাম। আবার চলা। আশ্চর্য, কেউ কোনো কথা বলছে না। কোন অদৃশ্য শক্তি যেন আমাদের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়েছে। অবশ্য কী কথাই বা বলা যাবে? এ তো বেড়াতে যাওয়া নয়? সবাই নিজের মতো করে রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা করছি। জিগমের কথা ছাড়াও আমার ভাবনা হচ্ছিল আমাদের ড্রাইভারকে নিয়ে। সে এই ভয়ানক জায়গায় একা গাড়ি নিয়ে কোথায় কত দূরে পড়ে আছে কে জানে!
হঠাৎ সামভোতা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। টর্চের আলো এদিক-ওদিক ফেললেন।
ইস! একী!
রাস্তার দুপাশে কংকালের পর কংকাল পড়ে আছে। তাদের কোনোটারই মাথা নেই।
হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে সামভোতা চাপা গলায় বলেছিলেন, সাবধান! আর এগিয়ো না। ঐ দ্যাখো।
সবাই দেখলাম। না, চোখের ভুল নয়। স্পষ্ট দেখলাম, পাহাড়ি যে রাস্তা দিয়ে আমরা এতক্ষণ হাঁটছিলাম সেই রাস্তাটা যেখানে অপেক্ষাকৃত চওড়া রাস্তায় এসে মিশে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে তারই কিছুদূরে কয়েক জন একটা কফিন কাঁধে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। তাদের একহাতে ভোলা তরোয়াল। শুধু চারজন শববাহকই নয়, তাদের সামনে-পিছনে জনা দশেক লোক নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে। প্রত্যেকের হাতে বর্শা।
এত রাতে এই অন্ধকার নির্জন পথে ওরা কারা? কফিনে করে কার শব নিয়ে যেন অতি গোপনে অতি সন্ত্রস্তভাবে এগিয়ে চলেছে। আরও খানিক দূর এগিয়ে শবযাত্রীর দল হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সামভোতা আমাদের একটা বড় পাথরের আড়ালে বসে পড়তে ইশারা করলেন। আমরা তার নির্দেশ পালন করলাম।
অভিজ্ঞ সামভোতা ঠিকই বুঝেছিলেন শবযাত্রীর দল এবার একবার পিছন ফিরে তাকাবেই। তাকালও। বোধহয় দেখতে চাইল কেউ তাদের দেখছে কিনা।
তারপর তারা পথ ছেড়ে ডান দিকের গভীর জঙ্গলের মধ্যে চলে গেল। রাতচরা একটা মস্ত শেয়াল জাতীয় পশু এত লোকজন দেখে ভয় পেয়ে ছুটে পালাচ্ছিল, শববাহী দলের সামনে যারা ছিল তাদেরই একজনের হাতের বর্শায় নিরপরাধ পশুটা দুবার ঘুরেই পড়ে গেল। শববাহীর দল খুব গোপনে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দশ-পনেরো মিনিট পরে আমরা উঠে দাঁড়ালাম। তারপর ফের এগিয়ে যাওয়া। আমার দুঃসাহসী বন্ধুটির ভাষায় যতই চোখের ভুল হোক না কেন, তবু আমরা, যেখান থেকে শববাহীর দল ডান দিকের জঙ্গলের পথ ধরেছিল সাবধানতার জন্যে সেই পথটুকু ছেড়ে দিয়ে একটু ঘুরপথ ধরে এসে আবার সেই অপেক্ষাকৃত চওড়া রাস্তা ধরলাম।
একটার পর একটা ঘটনায় আমরা বিমূঢ়, শ্রান্ত। আমাদের ব্রেন যেন আর কাজ করতে চাইছে না। রাত কটা বেজেছে? নিজের হাতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকাতেও ইচ্ছে করছে না। কী হবে কপ্রহর রাত হয়েছে জেনে? এ রাত কি কোনোদিন সূর্যের মুখ দেখবে? এ পথ কি কোনোদিন ফুরোবে?
এর পরেই আবার একটি আকস্মিক ব্যাপার!
সূর্যের মুখ কবে দেখতে পাব বা কোনোদিনই দেখতে পাব কিনা জানা না থাকলেও কিছু দূরে সেই জনমানবশূন্য অন্ধকার পথে হঠাৎ একটা বিন্দুর মতো আলো দেখা গেল।
আলো! আনন্দের আতিশয্যে আমাদের মুখ থেকে একটা চাপা উচ্ছ্বাস বেরিয়ে এল। যেন আমরা কত যুগ পরে আলো দেখলাম।
কিন্তু এই অন্ধকারের রাজ্যে ওটা কিসের আলো, আনন্দে উৎসাহে তা ভেবে দেখার অবকাশই পাইনি। তিব্বতী প্রৌঢ়টির দিকে তাকালাম। তার মুখে কোনো উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনার চিহ্নমাত্র নেই।
জিগ্যেস করলাম, ওটা কিসের আলো?
উনি বিরক্ত হয়ে বললেন, এখান থেকে কী করে বলব? আমি গণৎকার নই। ওটা আলো নাও হতে পারে। চলো, সাবধানে এগোনো যাক।
না, আলোই। মরীচিকা বা অন্য কোনোরকম অলৌকিক চোখ-ভোলানো ব্যাপার নয়।
আমরা সবাই আলোটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। একটা মস্তবড়ো পাথরের প্রদীপে তেল জাতীয় কিছুতে সলতে জ্বলছে। আর তা থেকে সুগন্ধ বেরোচ্ছে।
আরে! ঐ দ্যাখো, সামনে রাস্তার ধারে ধারে আরো কটা পিদিম জ্বলছে।
কাছে গিয়ে দেখা গেল একই রকমের প্রদীপ।
কিন্তু এগুলো এত যত্ন করে জ্বালাল কে? কেনই বা জ্বালিয়ে রেখেছে? পথিকদের সুবিধের জন্যে?
তা হলে কি সত্যিই আমরা এতক্ষণে অন্ধকার থেকে আলোর জগতে এসে পৌঁছলাম?
সামভোতা মুখ ভোঁতা করে বললেন, আমাকে তোমরা ক্ষমা করো। আমার মাথা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। এভাবে পথের ধারে ধারে এত সুন্দর দীপাধারে কারা আলো জ্বেলে রেখেছে? কেন রেখেছে? অথচ দ্যাখো কাছেপিঠে লোকজনের চিহ্নমাত্র নেই। আচ্ছা, গাছগুলোর আড়ালে ওটা কী?
উনি টর্চের বোতাম টিপলেন। একটা বহু পুরনো ভাঙা পোড়ামাটির ইটের বাড়ি।
এই দীর্ঘ পাহাড়ের রাজ্যে, হোক ভাঙা তবু, এই প্রথম একটা বাড়ি চোখে পড়ল। তাহলে?
দাঁড়াও-দাঁড়াও মনে পড়ছে। ইতিহাস….সিন্ধুসভ্যতা….মাটির নীচ থেকে তুলে আনা প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগের দুটি গোটা নগরী হরপ্পা আর মহেঞ্জোদো! পোড়া ইটের বাড়ি, রাস্তার মাঝে মাঝে আবর্জনা ফেলার জায়গা, জল-নিকাশি ব্যবস্থা, নগরের বাইরে উঁচু উঁচু টিলার ওপর বড়ো বড়ো ট্যাঙ্কের মতো জলাধার, যাতে বৃষ্টি আর নদীর জল ধরে রাখা হত নগরবাসীর প্রয়োজন মেটাবার জন্যে! প্রধানত পুরোহিত আর ধনী সামন্ত বণিকরাই শাসন করত নগরবাসীদের। এই সময়ে এখানেই দেখা গেছে পথিকের সুবিধের জন্য রাস্তায় রাস্তায় প্রদীপ জ্বেলে রাখবার ব্যবস্থা। পূর্ণিমা শুক্লপক্ষ ছাড়া। বাড়ির আলো রাস্তায় পড়ত না। কেননা রাস্তার দিকে বাড়ির কোনো জানলা থাকত না। কেন থাকত না কে জানে!
সাড়ে তিন হাজার বছর আগের সিন্ধুসভ্যতার ধারার এক চিলতে আলো কি আজও ধরে রেখেছে এই অঞ্চলের মানুষ?
কিন্তু মানুষজন কই?
.
রহস্যময় চৈনিক মহাজ্ঞানী
আপনারা দেখছি সারা রাত জেগে, পথ চলে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছেন। যান, অনুগ্রহ করে আপনাদের জন্যে নির্দিষ্ট কক্ষে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করুন।
সকাল তখন নটা। পাহাড়ের অন্ধকার রাজ্য পার হয়ে একটা সমতলভূমিতে আমরা এখন এসে পৌঁছেছি। এখানে লোকজন, বাড়িঘর, ঘোড়ায় টানা টাঙা সবই আছে। হোটেল আছে কিনা ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে একজনকে জিগ্যেস করতেই সে একজন চ্যাপটা মুখ, হলদে রঙের ছোকরার হাতে আমাদের তুলে দিল। ছেলেটার শুধু চ্যাপটা মুখই নয়, মুখের তুলনায় বড়ো বড়ো কান। হাসলে মুখটা হাঁ হয়ে প্রায় কানের লতি ছোঁয় আর কি। দেখলে ভয় করে। মোঙ্গল নাকি?
এটা হোটেল?
ছোকরাটি উত্তর না দিয়ে মাথা দুলিয়ে সায় দিল।
তুমি এখানে কাজ কর?
ছোকরাটি আবার নিঃশব্দে সায় দিল।
এখানে দু-একটা দিন থাকা যাবে?
শুধু মাথা দুলিয়ে এবারও জানাল, হ্যাঁ।
হোটেলটি পুরনো। একতলা বাড়ি। দূরে পাহাড়ের শ্রেণি। ঐ সব পাহাড়ের কোনগুলির মধ্যে দিয়ে কাল সারা রাত্রি হেঁটেছি এখান থেকে তা অনুমান করার সাধ্য নেই।
ভেতরে ঢুকতেই কাজের লোকদের গলা পাওয়া গেল। সেই সঙ্গে রান্নার সুগন্ধ। মনটা শান্ত হয়ে হল। মনে হল কত দিন এরকম ব্যস্তসমস্ত মানুষের গলা শোনা যায়নি। যদিও তাদের ভাষা আমাদের কাছে অজানা।
এরপর পীত বর্ণের কারুকার্য করা পর্দা সরিয়ে যে ঘরে আমাদের আনা হল সে ঘরটি বেশ সাজানো। দেওয়ালে দেওয়ালে চিনদেশীয় ছবি। ছবিগুলির মধ্যে অনেকগুলি পাহাড় পর্বতের। মাঝখানের ছবিটি ধ্যানস্থ বুদ্ধদেবের। একটা সাধারণ কার্পেটের ওপর পুরু ভেড়ার লোমে ঢাকা আরামকেদারায় দুপা গুটিয়ে শুয়ে শুয়ে দীর্ঘ সট্রা ঠোঁটে চেপে যে বৃদ্ধটি ভুরুক ভুরুক করে গড়গড়া টানছিলেন তাঁকে দেখে আমরা দুই বন্ধু যতটা অবাক হয়েছিলাম তার থেকে ঢের বেশি স্তম্ভিত হয়েছিলেন সামভোতা।
চিনদেশীয় বৃদ্ধটি এতই বৃদ্ধ যে তার বয়েস অনুমান করা যায় না। এই বয়েসে মুখের চামড়া হাতের মুঠোয় মোড়া কাগজের মতো অজস্র ভঁজে কুঁকড়ে গেছে। তা হলেও ফর্সা মুখখানায় লালচে আভা। থুতনির কাছে কয়েক গাছা পাকা দাড়ি। মাথায় চিন দেশের ধর্মগুরুদের মতো টুপি। মুখে স্নিগ্ধ হাসি।
ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে কথাগুলি বললেন তা কলকাতার চিনেপট্টির চৈনিকদের মুখে বাংলা ভাষার মতো। স্বচ্ছন্দ নয়, দুর্বোধ্যও নয়। থুমি সামভোতা হঠাৎ কেন যে কার্পেটের ওপর নতজানু হয়ে বৃদ্ধ চিনাটিকে শ্রদ্ধা জানালেন বুঝতে পারলাম না। দেখাদেখি আমাদেরও ঐভাবে নত হতে হল। একজন হোটেলের মালিককে এতখানি শ্রদ্ধা জানাবার কারণ প্রথমে বুঝতে পারিনি। একটু পরেই বুঝলাম।
সামভোতা হাত জোড় করে বললেন, আপনি কী করে জানলেন আমরা সারা রাত জেগে পথ হেঁটে এসেছি?
হাসলেন বৃদ্ধ চৈনিক। বললেন, শুধু এইটুকুই? আর সারা রাত কত ভয়ংকর ব্যাপার কাটিয়ে এসেছেন তাও কি আমি জানি না?
হঠাৎ আমার মনে হল–কে এই চৈনিক বৃদ্ধ? কোথায় এঁকে দেখেছি?
না, কোথাও দেখিনি। দেখা সম্ভবও নয়। তবে এঁর কথা শুনেছি সামভোতার মুখে। যে বর্ণনা শুনেছিলাম তাতে মনে হয় প্রায় আটশো বছর অতিক্রম করে সুদূর চিন দেশ থেকে এখানে এসে অবস্থান করছেন সেই মহাস্থবির গুণী–যিনি ধরণী ও আকাশের সমস্ত রহস্য উদঘাটন করেছেন এমনকি অমরত্ব লাভের পরশপাথর তান্-এরও নাকি সন্ধান জানেন–যাঁকে একদিন ডেকে পাঠিয়েছিলেন স্বয়ং চেঙ্গিস খান–যাঁর নাম চানচু।
কিন্তু তা সম্ভব কী করে? সুদূর চিন থেকে চেঙ্গিস খান-এর আহ্বানে তিনি পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। তা বলে সেই মানুষ আটশো বছর বেঁচে থাকবেন। তিনি কি তা নামে সেই পরশপাথর সত্যিই আবিষ্কার করে ফেলেছেন?
বিভাসকে বলতেই ও ক্ষেপে গেল। বলল, যত আজগুবি ধারণা তোমাদের মাথায় আসে? একজন অতি বৃদ্ধ চিনা লোক হলেই কি তিনি আটশো বছর আগের চানচুন্ হবেন?
ইতস্তত করে বললাম, তা ঠিকই তবে সামভোতার মতো মানুষ হঠাৎ ওঁকে নতজানু হয়ে প্রণাম করলেন কেন? কী করেই বা ঐ বৃদ্ধ আমাদের গত রাত্রের কথা বলে দিলেন? তা ছাড়া ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছ কেমন একটা দৈব অভিব্যক্তি!
এমনি সময়ে একটি বিচিত্র ইউনিফর্ম পরা ব্যক্তি বাইরে থেকে এসে দাঁড়াল। দুর্বোধ্য ভাষায় লোকটি কিছু বলল। সঙ্গে সঙ্গে গায়ের চাদরটি জোব্বার ওপর ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বৃদ্ধ সবিনয়ে আমাদের বললেন, হোটেল চালানো ছাড়াও আমার ছোটোখাটো একটি নার্সিংহোম আছে। এই সময়টা একবার পেশেন্টদের দেখে আসি। আপনারা ততক্ষণ বিশ্রাম করুন। অবশ্য ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে যেতেও পারেন। গেলে খুশিই হব।
সারারাত্তির দুর্ভোগের পর আর রুগি দেখতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম প্রায় শত বছর বয়েসের ভার মাথায় নিয়ে কী উৎসাহে বৃদ্ধ স্বচ্ছন্দে রোগিরও সেবা করে যাচ্ছেন!
যেতে যেতে বোকার মতো বলেই ফেললাম, হোটেল চালাচ্ছেন, সে তত কম ঝামেলা নয়, তার ওপর আবার নার্সিংহোমের ব্যবসা।
বৃদ্ধ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সরু আকারের চশমার কাচটা একটু তুলে ধরে মিনিটখানেক আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, অপরিচিত মানুষের সঙ্গে না বুঝে কথা বলা ঠিক নয়। হোটেল চালানোটা আমার জীবিকা কিন্তু আমার কোনো ঝামেলা নেই। আমার একদল দায়িত্ববান কর্মচারী আছে। তারাই সব ঝামেলা কাঁধে নিয়ে আছে। বিশ্বাসভঙ্গের কথা তারা ভাবতেই পারে না।
আর নার্সিংহোম? ওটা ব্যবসার জন্যে নয়। মানুষের সেবা করার জন্যে। শুধু মানুষের সেবা করাই নয়, পশুপাখির জন্যেও আমার নিরাময় কেন্দ্র আছে। দুদিন যদি থাকেন দেখাব। আমরা যে সম্প্রদায়ের মানুষ, সেবাই হচ্ছে তাদের একমাত্র ধর্ম–একমাত্র কর্ম। আপনাদের স্বামী বিবেকানন্দর মতো
হ্যাঁ, এমন মানবপ্রেমী
বিভাসকে থামিয়ে দিয়ে বৃদ্ধ বললেন, তিনি শুধু মানবপ্রেমী নন, জীবপ্রেমীও…..
যাই হোক, প্রথম আলাপেই বৃদ্ধটিকে খুব ভালো লাগল। আর তার নার্সিংহোমে গিয়ে যে লাভ হল তার জন্যে ভগবানকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা নেই।
একটি বেডের কাছে গিয়ে প্রাজ্ঞ বৃদ্ধটি বললেন, দেখুন তো একে চেনা মনে হচ্ছে কিনা?
আমরা তিনজনেই আনন্দে চমকে উঠলাম।
এ কী! জিগমে!
হ্যাঁ, আজ ভোরে একে ঐ পাহাড়টার নীচে অচৈতন্য অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। জ্ঞান ফিরলে ও সব কথা বলে। জিগ্যেস করেছিলাম, তা দল ছেড়ে কী করে ওদিকে গেলে? ও যা বলল তা অদ্ভুত। বলল, কে নাকি ওকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। খাদের ধারে গিয়েও গাছের শেকড় আঁকড়ে ধরে বেঁচে যায়।
এর আগেও ওকে অমনি কে ডেকে খাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কে অমন মরণডাক দিয়েছিল আপনি কি বলতে পারেন?
বৃদ্ধটি একটু হাসলেন। বললেন, পারি। এখন আপনারা হোটেলে ফিরে গিয়ে খেয়ে নিয়ে বিশ্রাম করুন। সন্ধেবেলা বলব।
জিগ্যেস করলাম, জিগমের সুস্থ হতে কত দিন লাগবে?
আপনারা তো দুদিন আছেন। দুদিন রেস্ট পেলেই ও ঠিক হয়ে যাবে। একসঙ্গে ফিরবেন।
.
সন্ধেবেলা।
সেই ঘরটিতে সাদা পশমী গদির ওপর বসে আছেন বৃদ্ধ চৈনিক জ্ঞানী মানুষটি। তাকে যেন এখন কেমন কুঁজো কুঁজো লাগছে। দুপাশে রুপোর উঁচু উঁচু বাতিদানে জ্বলছে মোটা মোটা মোমবাতি। তিনি ভাঙা ভাঙা গলায় সামভোতাকে জিগ্যেস করলেন, প্রথমেই আপনার কথা জানতে ইচ্ছে করছে। তিব্বতের পুণ্যভূমিতে আপনার জন্ম। সংসার করেননি। তবু সারা জীবন কিসের খোঁজে নানা দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?
সামভোতা বললেন, আমি জানি আপনি সর্বজ্ঞ। তবু বলি–খাতায় কলমে বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসের ডিপ্লোমা না পেলেও আমি মনে-প্রাণে একজন ইতিহাসবিদ। পৃথিবীর যত প্রাচীন প্রখ্যাত পুরুষ, তাদের প্রকৃত জীবনকাহিনি, লুপ্তপ্রায় প্রাসাদ, জন্মভিটে, তাদের স্থাপত্যকীর্তি আমি খুঁজে বেড়াই। শুধু ছাপার বই নয়, প্রাচীন পুঁথিপত্রও কম পড়িনি।
একটু থেমে সামভোতা ফের শুরু করলেন–মহাযোদ্ধা রক্তলোলুপ চেঙ্গিস খানের কথা যতই পড়েছি ততই অবাক হয়েছি। তার কোনো মহৎ গুণের কথা কোথাও পাইনি। তবু নৃশংস সাম্রাজ্যবাদী একজন যোদ্ধা হিসেবে তিনি ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন। তার সম্বন্ধে আরও কিছু জানতে ইচ্ছে করে।
চৈনিক বৃদ্ধটি বললেন, আপনি যথার্থই ইতিহাসপ্রেমী।
সামভোতা বিনয়ে প্রণাম করে বললেন, আমার আর একটি কৌতূহল আছে। মমির অনুসন্ধান করা। মমিগুলি সম্বন্ধে ভালো করে জানা। তিন হাজার-চার হাজার বছরের পুরনো মমি–আমাকে বিহ্বল করে দেয়।
চৈনিক বৃদ্ধটি বললেন, আজ পর্যন্ত মিশরে প্রায় একশোটি মমি আবিষ্কৃত হয়েছে—
মার্জনা করবেন, সামভোতা বললেন, সংখ্যাটি বোধহয় আশির বেশি নয়।
তাই না হয় হল। কিন্তু ঐ আশিটি মমি পরীক্ষা করা কি সম্ভব? আর কী বা জানবেন?
সামভোতা বিনীতভাবে বললেন, সম্প্রতি মাত্র আঠারো বছর বয়স্ক রাজা তুতেনখামেনের মমি পরীক্ষা করে তার মৃত্যুরহস্য জানা গেছে। তার গায়ের একটা ক্ষতচিহ্ন থেকে শল্যবিা জানিয়েছেন তিনি নাকি ক্যানসারে মারা গিয়েছিলেন। তখন ক্যানসার নাম ছিল না। হয় তো অন্য নাম ছিল। এই থেকেই আমার এখন ইচ্ছে করে কলকাতার মিউজিয়ামে রক্ষিত মমি দুটোর মৃত্যুর কারণ সন্ধান করি।
সে কাজ কি সম্ভব হবে? কে আপনাকে সাহায্য করতে পারবে?
এখনও পর্যন্ত কোনো আশা দেখছি না। তবে কলকাতায় এলেই একবার করে যাই যদি কোনো ক্লু পাই।
চৈনিক বৃদ্ধটি বললেন, চেঙ্গিস খান সম্বন্ধে আপনার আগ্রহ শুনলাম। কিন্তু কতটা জানেন?
কিছুই না। টুকরো-টাকরা ইতিহাস পড়ে যেটুকু জানা যায় আর কি।
চৈনিক বৃদ্ধটি এই সময় যেন একটু অন্যমনস্ক হলেন। যেন কারও নিঃশব্দ উপস্থিতি টের পেলেন। তারপর থেমে থেমে বলতে লাগলেন, চেঙ্গিস খান দুবার বড়ো আঘাত পেয়েছিলেন। না, অস্ত্রাঘাত নয়, হৃদয়ে শোকের আঘাত। তাঁর পিতা ছিলেন আঞ্চলিক প্রধান। তাতারদের হাতে তার মৃত্যু হয়। প্রতিশোধ নেবার জন্যে তিনি তার সহ মোঙ্গলদের সব শত্রুদের নির্মমভাবে নিধন করে মোঙ্গোলিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি হন। রক্ত নিয়ে খেলার এই হল শুরু। দ্বিতীয় আঘাত পান–
হ্যাঁ, আগে বলে নিই চেঙ্গিস খানের চার পুত্র। জুচি, জানাতাই, উগেদেই আর তুলি খান। জাগাতাই-এর পুত্র, মোঙ্গল খানের বড়ো আদরের নাতি মুতুগান বালতান দুর্গের লড়াইয়ে নিহত হন। সেই খবর পেয়ে মোঙ্গল খান যাঁকে তোমরা চেঙ্গিস খান বল, ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে বালতান ধ্বংস করে দেন।
সামভোতা বিনয় সহকারে বললেন, এটা আমার জানা।
খুব ভালো। একটা কথা জানো তো, যত দেশ জয় করা হবে, যত অত্যাচার করা হবে ততই শত্রু বাড়বে। মোঙ্গল খানের শত্রুদের মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছে তার আত্মীয়-স্বজন, উত্তরাধিকারীরা যারা তার রক্তমাখা বিপুল সম্পত্তি গ্রাস করার জন্যে ওৎ পেতে ছিল।
তারপরই ছিল তার পুরনো শত্রু তানগুতে সম্রাট বুখান। যাকে তিনি কিছুতেই হটাতে পারেননি। উল্টে বুখানের একটি বিকলাঙ্গ ছেলে মোঙ্গল খানকে খুন করার জন্যে বারেবারে চেষ্টা করেছিল। তার একটা সুবিধে ছিল সে ছিল বেঁটে বামন। খুব সহজেই গাছের ডাল থেকে ঝুলে, কিংবা গুঁড়ি মেরে বাগিচার মধ্যে দিয়ে গিয়ে চেঙ্গিস খানের প্রাসাদের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারত। কিন্তু তবু মোঙ্গল খানের সতর্ক সশস্ত্র প্রহরীদের জন্যে খুন করবার সুযোগ পায়নি।
চেঙ্গিস খান বুর্খানের এই বামন ছেলেটাকে ধরবার অনেকরকম ফাঁদ পেতেছিলেন। কিন্তু প্রতিবারই সে তার ছোটখাটো দেহ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। তার নাম ছিল থিবস্–
থিবস! চমকে উঠলাম আমরা। নামটা যেন জিগমের মুখে শোনা!
চেঙ্গিস খানকে হত্যা করার জন্যে থিস্ গোপনে ষড়যন্ত্রীদের নিয়ে একটি দল করেছিল। তারা তাকে পালাবার সময়ে সাহায্য করত। একবার থিবস্ পালাতে গিয়ে পাবলিকের হাতে ধরা পড়ল। যে পাবলিকের হয়ে থিবস্ অত্যাচারী সম্রাটকে খুন করার ব্রত নিয়েছিল, তারা মোটা পুরস্কারের লোভে বিশ্বাসঘাতকতা করে থিবসকে সোজা তুলে দিল চেঙ্গিস খানের হাতে। পাবলিকের এই বিশ্বাসঘাতকতায় সে রাগে দুঃখে কাতর হয়ে পড়েছিল। চেঙ্গিস খান নিজে হাতে তাকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করেন।
তারপর থেকে…..সব মানুষই থিবসের ক্রুদ্ধ আত্মার শিকার হয়ে পড়ল।
হঠাৎ এই সময়ে একটা দমকা হাওয়া ঘরের দরজা-জানলা কাঁপিয়ে দিল। বাতিগুলো নিভে গেল। হোটেলে আর যারা ছিল ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল। শুধু শান্ত হয়ে বসে রইলেন চৈনিক বৃদ্ধটি।
একটু পরেই সব শান্ত হল। আলো জ্বালা হল।
সামভোতা জিগ্যেস করলেন, এটা কী হল?
চৈনিক বৃদ্ধটি এবার হাসলেন না। শুধু বললেন, ও যে এখানেও এসে পড়েছে, তা জানান দিল।
কে?
থিবস্।
থিবস!
হ্যাঁ।
এখানেও!
মানুষমাত্রই ওর শত্রু। সবাইকে নিধন করতে চায়। বিশেষ করে কোনো ক্ষতি না করেও আমি তার শত্রু।
কেন?
এই যে ওর কথা আমি তোমাদের কাছে বলে দিলাম। যাই হোক, আজ রাতটা সাবধানে থাকতে হবে।
বিভাস বলল, আপনার আশ্রয়ে আমরা নিশ্চয় নিরাপদ।
বৃদ্ধ বললেন, আমরা সকলেই কিন্তু মানুষ। অতএব মৃত্যুর অধীন।
এরপর অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে গেল। বৃদ্ধটি আগের মতোই রাত্রের অভিজ্ঞতার কথা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর গড়গড়ার সট্রা ঠোঁটে চেপে নিঃশব্দে ধূমপান করতে লাগলেন। তারপর একসময়ে বললেন, তোমাদের সৌভাগ্য সব বিপদ কাটিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছ।
আমি বললাম, সবই তো হল। কিন্তু আমাদের গাড়িটা আর ড্রাইভারের দশা কী হল কে জানে।
বৃদ্ধ বললেন, ড্রাইভারকে নিয়ে চিন্তা কোরো না। গাড়ি সারানো হয়ে গেলে নিশ্চয় প্রচণ্ড ঠান্ডায় সারা রাত তোমাদের অপেক্ষায় পাহাড়-জঙ্গলের নীচে গাড়ির মধ্যে বসে থাকবে না। সে ফিরে গেছে।
আমরা ফিরব কোন পথে?
তোমরা তো লাদাখের দিকে যাবে?
হ্যাঁ।
কাছেই। তার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
এর পর আমাদের কৌতূহল নিবৃত্তি করে চৈনিক বৃদ্ধটি চেঙ্গিস খানের জীবনের শেষ পর্বটি আমাদের জানালেন। আশ্চর্য, তার বলার ভঙ্গি, বক্তব্যের দৃঢ়তা দেখে মনে হল একশো বছরেরও ঢের বেশি বয়স্ক এই বৃদ্ধ যেন চেঙ্গিস খানের মৃত্যুসময়ে নিজে উপস্থিত ছিলেন। তিনি এই বলে শুরু করলেন, এ কথাটা সবাই জানেন যে, সিন্ধুসভ্যতার যুগে নয়, তার ঢের পরে মাত্র আটশো বছর আগেও চেঙ্গিস খান নির্বোধের মতো জরা-মৃত্যুকে এড়িয়ে যাবার জন্যে নানা উপায় খুঁজছিলেন। পাননি।
তর তরুণী পত্নী কুলান খাতুনের মৃত্যুর তিন বছর পরেই চেঙ্গিস খান বুঝতে পেরেছিলেন তারও দিন ফুরিয়ে এসেছে।
মোঙ্গল খান বুঝতে পারছেন তার অন্তিম কাল আসন্ন। শ্বেত কম্বলের শয্যায় শায়িত। মাথার নীচে কৃষ্ণসার চর্মের নরম বালিশ। একটা কালো কম্বলে তার পা ঢাকা। তার দীর্ঘ শীর্ণ দেহটিকে অসম্ভব ভারী বলে মনে হচ্ছিল। নাড়াচাড়া করতে পারছিলেন না। তিনি তার মাত্র কয়েকজন বিশ্বস্ত কাজের মানুষকে ডেকে পাঠালেন। তারপর নিচু গলায় কয়েকটি মূল্যবান পরামর্শ দিলেন। তার মধ্যে একটি এইরকম–
আমি মারা গেলে আমার মৃত্যুসংবাদ যেন কোনোভাবে প্রকাশ না পায়। কান্নাকাটি বা বিলাপের রোল তুলো না। শত্রুরা জানতে পারলে তারা শুধু খুশি আর উৎসাহী হবে তাই নয়, তোমাদের শোকপালনের সুযোগ নিয়ে হঠাৎ আক্রমণ করে বসতে পারে। আমার চিরশত্রু তানগুতের রাজা আর রাজ্যের লোকজন যখন ভেট নিয়ে দুর্গের তোরণ থেকে বের হবে তক্ষুনি তাদের ওপর আক্রমণ করবে। দ্বিধা করবে না। তাদের ধ্বংস করবে….।
তিনি আরও বললেন, আমার নিকট আত্মীয়দের কাছ থেকে হুঁশিয়ার থেকে। আমার সেদিনের সেই জমজমাট ভোজসভার মাত্র তিন দিন পরেই হঠাৎ আমার সুস্থ প্রিয়তমা পত্নী কুলানের মৃত্যু হল। সে মৃত্যুর কারণ আর কেউ না জানলেও আমি অনুমান করতে পারি। তাকে হত্যা করেছিল আমারই নিকটতম আত্মীয়জন। প্রমাণ পাইনি। তাই তাদের প্রাণদণ্ড দিতে পারিনি।
তারপরই হঠাৎ সভয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠে বসবার চেষ্টা করে বলে উঠলেন, সেই গলাকাটা বামনটা আমার চারদিকে ঘুরঘুর করছে কেন? ওকে তাড়িয়ে দাও। আমি সহ্য করতে পারছি না।
বলতে বলতে চেঙ্গিস খানের মুখ বিকৃত হল। ডান চোখ দীপ্তি হারিয়ে ঘোলাটে হয়ে গেছে। তিনি বিছানায় পড়ে গেলেন। তারপর সব শেষ।
চেঙ্গিস খান অনেক দিন আগে থেকেই একখণ্ড ভারী কাঠের খোল বানিয়ে রেখেছিলেন। ভেতরে সোনার পাত মোড়া একটা শবাধার। সেটা গোপনে তার কাছেই থাকত যাতে হঠাৎ মৃত্যু হলে লোকজানাজানি হবার আগেই সেই শবাধারে তার মৃতদেহটি ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।
আজ সেটা কাজে লাগল। গভীর রাত্রে সম্রাটের ছেলেরা শবাধারটি ঘরের মাঝখানে এনে রাখল। সামরিক বর্ম গায়ে পরিয়ে যোদ্ধার বেশে তাঁর মৃতদেহটি সযত্নে শবাধারে রাখা হল।
বুকের ওপর ভাঁজ করা দুটো হাত মুঠো করে ধরিয়ে দেওয়া হল তার কারুকার্য করা নিজস্ব তরোয়ালটি। মাথায় আটকানো ইস্পাতের কালো শিরস্ত্রাণ তার বোজানো চোখ আর মুখের ওপর একটা বিশ্রী ছায়া ফেলেছে। শবাধারে তার দুপাশে রাখা হল তীর-ধনুক, ছুরি, আগুন জ্বালাবার চকমকি পাথর আর সোনার পানপাত্র। চেঙ্গিস খানের আদেশমতো সেনা নায়করা তাঁর মৃত্যুর খবর গোপন রাখল। তানগুতরা যখন শহরের ফটক থেকে বেরিয়ে এসে চেঙ্গিস খানের দ্রুত আরোগ্য কামনা করে সন্ধি প্রার্থনা করল তখন চেঙ্গিস খানের সেনা-নায়করা তারই নির্দেশমতো অতর্কিতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেলেবুড়ো নির্বিশেষে সকলকে হত্যা করল। তারপর একটি শত্রুরও চিহ্ন না রেখে চেঙ্গিস খানের শবাধার কম্বলে জড়িয়ে বারোটি ষাঁড়েটানা দু চাকার গাড়িতে চাপিয়ে নির্দিষ্ট গোপন জায়গার দিকে এগিয়ে চলল। পাছে কেউ মোঙ্গল খানের শবদেহবাহী শকট যাচ্ছে বলে সন্দেহ করে তাই দুপাশের কী মানুষ কী জন্তু-জানোয়ার যে কেউ চোখে পড়েছিল তাদের সকলকেই তারা হত্যা করেছিল।
এক সময়ে তিনি বুরখান খালদুনের পাহাড়ে শিকার করতে গিয়েছিলেন। পাহাড়ের ঢালুতে নির্জন জায়গায় একটা আকাশে ছোঁওয়া উঁচু দেবদারু গাছের নীচে তিনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন। সেই শান্ত নির্জন বনভূমি আর দেবদারু গাছটি তার খুব পছন্দ হয়েছিল। সঙ্গের বিশ্বস্ত লোকদের তিনি বলেছিলেন, একান্তই যদি মরতে হয় তাহলে এই গাছটার নীচেই আমাকে চিরশান্তিতে থাকতে দিও। হ্যাঁ, গাছটা চিনে রেখো।
চেঙ্গিসের সেনানায়করা জঙ্গলের মধ্যে সেই দেবদারু গাছটি খুঁজে বের করে সেখানকার মাটির নীচে অনেক গভীরে তাদের প্রিয় খানের কফিনটা নামিয়ে দিল। তারপর মাটি চাপা দিয়ে তার ওপর এমনভাবে বুনো গাছ বসিয়ে দিল যে, কেউ যেন বুঝতে না পারে এখানে এক বিরাট পুরুষের দেহ রক্ষিত আছে।
বৃদ্ধ চৈনিক প্রাজ্ঞ ব্যক্তিটির মুখে সব কথা শুনে আমরা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলাম।
একটা জিনিস লক্ষ করছিলাম, রাত যতই বাড়ছিল, বৃদ্ধটি ততই বাসি ফুলের মতো ম্লান হয়ে পড়ছিলেন। অথচ তিনি নিয়মিত রাত জেগে বসে থাকতেন। ঘুম আসত না। আর আজ এখন তো সবে রাত আটটা।
বিনীতভাবে সামভোতা বললেন, সেই কবরস্থানে লোকে যায়? সেখানে নিশ্চয় নাম লেখার পাথর গাঁথা আছে বাঁধানো সমাধির ওপরে?
কথা বলতেও বোধহয় কষ্ট হচ্ছে বৃদ্ধর। তিনি শুধু মাথা নাড়লেন। সে সমাধিস্থান আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বাঁধানো তো নয়ই, বুনো গাছপাতার আড়ালে কোথায় লুকিয়ে আছে। এমনটাই তিনি চেয়েছিলেন।
এইটুকুই বলে বৃদ্ধ হাঁপাতে লাগলেন। তারপর নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হলে তিনি বললেন, তা ছাড়া সেখানে পাহারা দিচ্ছে বেশ কিছু ভয়ংকর অশরীরী প্রেতাত্মা। ওখানে কেউ গেলে মৃত্যু নিশ্চিত। ছাগল-গোরুও ওখানে ঘাস খেতে যায় না।
সামভোতা বললেন, যে রাস্তা দিয়ে খানের শবদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই রাস্তাটা ঠিক কোথায় জানি না। তবু দেখবার সাধ ছিল।
বৃদ্ধ হাসবার চেষ্টা করে বললেন, কাল রাত্রে অজ্ঞাতে তোমরা ঐ পথ দিয়েই এসেছিলে।
কথা শেষ করেই তিনি সবাইকে শুভরাত্রি জানিয়ে শুতে চলে গেলেন। বলে গেলেন, আজ রাতটা সাবধানে থেকো। ও এখানেই ঘুরছে। কারও ক্ষতি করবেই।
.
খুব ক্লান্ত ছিলাম। এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত। একটা মোটামুটি ভালো হোটেল। বড়ো একটা ঘরেই তিনটে বেড পেয়েছিলাম। চৈনিক বৃদ্ধটি বারে বারে সাবধান করায় একটু যে ভয় করছিল না তা নয়। তবে যেহেতু ত্রিকালদর্শী বৃদ্ধটি এখানেই আছেন সেইজন্যে খুব ভয় পাইনি। তা ছাড়া অ্যাটাচড বাথরুম। বাইরে বেরোবার দরকার হবে না।
বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুম।
অকাতরেই ঘুমোচ্ছিলাম। তারপরে অনেক রাত্রে মাথার দিকের বন্ধ জানলার বাইরে কেমন একটা চাপা শব্দ। শব্দটা সাপের গর্জনের মতো। জানলায় দুবার ঠক্ঠক্ করে শব্দ হল। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, কে? উত্তর পাওয়া গেল না। শুধু হোটেলের কম্পাউন্ডের মধ্যে একটা গাছের ডাল ভেঙে পড়ার শব্দ। তার পরেই এমন কিছু ইঙ্গিত পেলাম যা বোঝাতে পারব না, কিন্তু নিজে বুঝলাম–যে এসেছিল সে কাজ শেষ করে চলে গেল।
কাল রাত্রেই ঠিক করা হয়েছিল আজই রওনা হব। হোটেলের বয় ট্রেতে করে চা আর টোস্ট আমাদের তিনজনকে দিয়ে গেল নিঃশব্দে।
এখানে দেখছি প্রায় সবাই কম কথা বলে।
ব্রেকফাস্ট শেষ হতেই একজন ইউনিফর্মপরা কর্মচারী এসে জানাল, আপনাদের লাদাখে পৌঁছে দেবার জন্যে গাড়ি এসে গেছে।
বাবাঃ! এ যে ঘড়ির কাঁটা ধরে কাজ!
গাড়ির ব্যবস্থা করতে কে বললেন?
থমথমে মুখে কর্মচারীটি চোখ বুজিয়ে হাত জোড় করে বলল, কাল রাত্তিরেই তিনি আদেশ দিয়েছিলেন।
ব্যস্! আর কিছু বলার নেই।
পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা বেরিয়ে এলাম।
কিন্তু আমাদের আর একজন? পেশেন্ট–
তিনি আগেই গাড়িতে উঠে পড়েছেন। বলল কর্মচারীটি। তাকে যেন খুব ব্যস্ত মনে হল। আমাদের জন্যে সময় নষ্ট করতে চাইছিল না। মানে মানে বিদেয় করে দিতে পারলেই যেন বাঁচে।
সামভোতা বললে, যাবার আগে একবার তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
এ কথায় কর্মচারীটিকে বিব্রত লাগল। ইতস্তত করে বলল, দেখা করবেনই? তবে আসুন।
গত রাত্রে তাঁর সেই ঘর নয়। শোবার ঘর দেখলাম লোকে ভর্তি। সবাই মাটিতে বসে রয়েছে ধ্যানে বসার মতো। নিঃশব্দে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। বিছানায় শুয়ে যে মানুষটি, ফুলের মালার অন্তরালে তাঁর সর্বাঙ্গ ঢাকা পড়ে গেছে।
কী ব্যাপার?
কর্মচারীটি বিমর্ষ বেদনায় শুধু বলল–কাল রাত্রে হঠাৎই উনি দেহ রাখলেন। রাত তিনটের আগে আমরা কিছু বুঝতে পারিনি।
ওঁকে শেষ প্রণাম জানিয়ে আমরা গাড়িতে এসে উঠলাম। কাল রাত আটটার পর থেকেই তার শরীর খারাপ করছিল। কিন্তু এমন কী হল যে রাতটুকুও কাটল না?
.
[চেঙ্গিস খানের জীবনের অনেক ঘটনা জেনেছি ভাসিলি ইয়ান রচিত চেঙ্গিস খান উপন্যাস থেকে।]
[শারদীয়া ১৪১২]