ম্যাকবেথের তরোয়াল

ম্যাকবেথের তরোয়াল

দুপুর রাতে কলিংবেল

অনেক রাতে সুধীনবাবুর ঘুমটা আচমকা ভেঙে গেল। কলিংবেল বাজছে–কিরিং-কিরিং কিরিং। নিঝুম গোয়ালপাড়ার বিরাট বাঁশবাগানের শুকনো পাতা আর রাতজাগা পাখিজাগা চমকে দিয়ে শব্দটা যেন দূরে মাঠের দিকে মিলিয়ে গেল। পাশের ঘর থেকে জুলি আর তার মাও এসে পড়েছে। বেলটা ততক্ষণে থেমে গেছে। অন্য একটা ঘর থেকে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বেরিয়ে এল অভিজিৎ।

কেউ বেল বাজাচ্ছিল না?

 সুধীনবাবুই উত্তর দিলেন, হ্যাঁ।

এত রাত্তিরে কে আসবে? বললেন অভিজিতের মা।

যে-ই আসুক দেখতে তো হবে। বললেন সুধীনবাবু।

বেলটা তো আর বাজছে না। দরজা খেলার দরকার কি?

এতক্ষণ জুলি একটা কথাও বলেনি। গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়েছিল। এবার বলল, বেল আর বাজবেও না।

বোনকে ধমক দিয়ে অভিজিৎ তার বাবার মতোই বললে, তবু তো দেখতে হবে।

তা দেখো গে না। কাউকেই দেখতে পাবে না। থমথমে মুখে বলল জুলি।

অভিজিৎ পা-জামাটা টাইট করে পরে দরজার দিকে এগোচ্ছিল, মা বললেন, খালি হাতে যাসনে। ঐ লাঠিটা নিয়ে যা। বলা যায় না তো

অভিজিৎ মায়ের কথা শুনল না। লাইট জ্বেলে শুধু টর্চ হাতে দরজার দিকে এগোল। পিছনে সবাই। দরজাটা খুলতেই একটা হাওয়া ঢুকে দরজার পর্দাটাকে দুলিয়ে দিলো।

নাঃ কেউ নেই।

অভিজিৎ টর্চ জ্বেলে বাঁশপাতা মাড়াতে মাড়াতে বাগানটা দেখতে যাচ্ছিল, জুলি বলল, ফিরে আয় দাদা, কাউকে পাবি না।

তবু সে বাঁশবাগানের মধ্যে ঢুকে টর্চের আলো ফেলে দেখল, নারকেল গাছগুলোর মাথাতেও টর্চ ফেলল। শেষে হতাশ হয়ে ফিরে এল।

বাড়িতে ঢুকে ভালো করে খিল বন্ধ করে সবাই বসল সুধীনবাবুর ঘরে। সবার মুখে একটাই কথা, এত রাতে কে বাজাল বেলটা?

অভিজিৎ আলিস্যি ভেঙে বলল, কোনো চোর-ছচোরের কাজ। একবার ধরতে পারলে

জুলি গম্ভীর হয়ে বসেছিল। এবার বলল, চোরই হোক বা যে-ই হোক পালাতে গেলে তো শুকনো পাতা মাড়াবার শব্দ হবে। কোনো শব্দ পেয়েছ কি?

কেউ এর উত্তর দিতে পারল না।

 জুলিই ফের বলল, আমি জানি কে বেল বাজিয়েছে।

 কে? বাবা-মা দুজনেই ব্যস্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন।

বেলটা কবার বেজেছিল মনে আছে?

সুধীনবাবু বললেন, বোধহয় দুবার।

না তিনবার।

 জুলির মাও বললেন, হ্যাঁ তিনবার।

জুলি বলল, পর পর তিনবার কে বাজাতে পারে?

সবাই চুপ।

 জুলি বলল, এরই মধ্যে ভুলে গেলে?

অস্ফুট স্বরে জুলির মা বললেন, চঞ্চল।

জুলি বলল, তোমরা আরও ভুলে গেছ গত তিন বছরের মধ্যে গভীর রাতে আরও দুবার এমনিভাবেই বেল বেজেছিল। আর আমার যদি ভুল না হয়–

বলতে বলতে জুলি পাশের ঘরে চলে গেল। তারপরই চাপা উত্তেজনা-ভরা গলায় ডাকল, মা, দেখে যাও।

সুধীনবাবু আর জুলির মা ছুটে পাশের ঘরে ঢুকলেন।

 দ্যাখো।

দুজনেই অবাক হয়ে দেখলেন, আলমারির মধ্যে চঞ্চলের যে বাঁধানো ছবিটা ছিল তার কাচটায় চিড় ধরেছে।

ও মা! আঁৎকে উঠলেন জুলির মা। বললেন, এর আগেও তো দুবার ছবির কাচ এইভাবেই ফেটে গিয়েছিল।

জুলি বলল, আর সেই দুবারই আমরা কিভাবে বিপদের মুখ থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম মনে আছে তো? ঘটনার আগে এমনিভাবেই বেল বাজিয়ে চঞ্চল দুবারই সাবধান করে দিয়েছিল।

একটু থেমে জুলি বলল, আজ আবার তিনবার বেল বাজল। জানি না নতুন কোন বিপদ থেকে সাবধান করার জন্যে চঞ্চল এসেছিল।

জুলির কথায় সকলের মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেল।

.

চঞ্চল, ঠাকুরমশাই কথা

জায়গাটার নাম গোয়ালপাড়া। কালনা থেকে নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর কিংবা পূর্বস্থলী, চুপি যাবার বাসরুটে ছোট্ট একটা স্টপেজ এগোলেই সমুদ্রগড় রেল বাজার।

গোয়ালপাড়া গ্রামই বলা যায়। জুলিদের একতলা বাড়িটার পিছনেই বিশাল বাঁশবাগান। তার পিছনে মাঠ। মাঠের ধারে দাঁড়ালে কাটোয়া লাইনের ট্রেন দেখা যায়। জায়গাটার এখন উন্নতি হয়েছে। ইলেকট্রিক লাইট এসেছে, দু-একটা অবস্থাপন্ন বাড়িতে টেলিফোনও বসেছে। কিন্তু ঢের আগে যখন সন্ধে হলেই বাঁশবাগানে শেয়াল ডেকে উঠত, চোর-ডাকাতের ভয়ে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে দরজায় দরজায় খিল পড়ত, ভূতের ভয়ে সবাই তটস্থ হয়ে থাকত সেই সময় এখানে বাস করতেন সুধীনবাবুর বাপ-ঠাকুর্দা। সুধীনবাবুরা অবশ্য বেশির ভাগ সময় থাকতেন কলকাতায়। অভিজিৎ আর জুলির পড়াশোনা কলকাতাতেই। এখন রিটায়ার করে সুধীনবাবু বাড়িটা হাল ফ্যাশানের করে নিয়ে এখানেই থাকেন। অনেকগুলো ঘর, ভালো বাথরুম। পাড়াগাঁয়ের এই সবুজ গাছ-গাছালি, খোলা মাঠের হাওয়া, শান্ত পরিবেশ সুধীনবাবুর খুব ভালো লাগে। কিন্তু জুলি আর তার দাদা অভিজিৎ বেশির ভাগ সময়েই থাকে কলকাতায় মামার বাড়িতে।

জুলি এম. এ-পরীক্ষা দিয়েছে। খুব স্মার্ট, বুদ্ধিমতী আর সাহসী। চাকরি করার জন্যে কলকাতার বাইরে যে কোনো জায়গায় তো বটেই, সুযোগ পেলে আমেরিকা পর্যন্ত যাবার ইচ্ছে। অভিজিৎ কলকাতায় থেকে খবরের কাগজে শখের সাংবাদিকতা করে। মাঝেমাঝে চলে আসে গোয়ালপাড়ায় নিজেদের বাড়িতে।

এদের বাড়ি থেকে অল্প দূরে চঞ্চল থাকত তার এক পিসেমশাইয়ের কাছে। বি. এ. পাশ করে বসে ছিল। চাকরি-বাকরি পায়নি। তার মা ছিল না, বাবা ছিল না। পিসেমশাই, পিসিমা বেকার ছেলেটার ওপর খুব চটা ছিল। কিন্তু এই আশ্রয়টুকু ছেড়ে সে যেতই বা কোথায়?

গোয়ালপাড়ায় চঞ্চলের একমাত্র আনন্দের জায়গা ছিল অভিজিৎদের বাড়ি। অভিজিৎ এর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল। অভিজিৎ ছাড়াও এ বাড়ির সকলে চঞ্চলকে খুব ভালোবাসত।

চঞ্চলের মস্ত গুণ ছিল গল্প বলা–বিশেষ করে ভূতের গল্প। জুলি কলকাতা থেকে এখানে এলেই ডেকে পাঠাত চঞ্চলকে। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় চঞ্চল এ বাড়িতে এসে ভূতের গল্প শোনাত। ও বলত সবই নাকি ওর নিজের দেখা ঘটনা। সত্যি-মিথ্যে ভগবান জানেন। কিন্তু বানিয়ে বানিয়ে এমনভাবে গল্প বলত, মনে হতো যেন সত্যিই তা ঘটেছে। শুনতে শুনতে জুলির মতো মেয়েও ভয়ে কাটা হয়ে যেত।

যদি কেউ জিজ্ঞেস করত, সত্যি ঘটনা? চঞ্চল গম্ভীরভাবে বলত, আলবাৎ। এ তো আমার নিজে দেখা।

ব্যস, এর ওপরে আর তর্ক চলত না।

কত কথাই মনে পড়ে জুলির। কম সাহসী ছিল ছেলেটা!

একবার হলো কি, গোয়ালপাড়া থেকে মাইল সাত-আট দূরে এক বাড়িতে এমন ভূতের উপদ্রব হলো যে ভাড়াটে বিধবা মহিলা তার মেয়েকে নিয়ে সে-বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়ির সন্ধানে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কথাটা চঞ্চলের কানে এল। কালনা তো রীতিমতো শহর। সেখানে তিন-চারটে স্কুল আছে, কলেজ আছে, সাবডিভিশনাল পুলিশ অফিসার আছে– সেখানে ভূতের উপদ্রব! চঞ্চল ঠিক করল ব্যাপারটা জানতে হবে। জুলির মা বার বার নিষেধ করলেন। কিন্তু চঞ্চল শুনল না। সে কালনায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে সেই বিধবা মহিলার সঙ্গে দেখা করল। ওদের কাছে সেই ভয়ংকর ঘটনার কথা শুনে চঞ্চল এক রাত্তিরের জন্যে সেখানে থাকতে চাইল।

সে একা থাকবে শুনে তারা বারণ করল। কিন্তু চঞ্চল শুনল না। ওদের কাছ থেকে চাবি নিয়ে সন্ধে থেকেই রয়ে গেল সেই ঘরে।

পরের দিন চঞ্চল ফিরে এল গোয়ালপাড়ায়। এসেই পিসেমশাইয়ের বাড়ি না গিয়ে সোজা চলে এল জুলিদের বাড়ি। তাকে নিরাপদে ফিরতে দেখে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে তার! দুচোখ লাল, চুল উস্কোখুস্কো, মুখে কথা নেই। সবাই তার অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইল। কিন্তু আশ্চর্য যে ছেলে এত গল্প করে সে একটি কথাও বলল না। বার বার জিজ্ঞেস করার পর সে শুধু একটা কথাই বলল, ও কিছু না।

সবাই বুঝল ও যেন অনেক কিছু চেপে যাচ্ছে।

এরপর চঞ্চলের মধ্যে কেমন একরকম পরিবর্তন দেখা দিল। উদাস হয়ে পুকুরপাড়ে না হয় খাঁ খাঁ মাঠে একা বসে থাকে। ক্রমে সবাই ওকে এড়িয়ে চলতে লাগল কী জানি বাবা!

একমাত্র ও জুলিদের বাড়ি যায়। জুলিরা ওকে আদর করে বসতে দেয়। আগের মতোই গল্প করে। কিন্তু চঞ্চলের গল্প বলা হঠাৎই যেন বন্ধ হয়ে গেছে।

চঞ্চলের আর একটা খেয়াল জাগল এ বাড়ির সবাইকে নিয়ে প্ল্যানচেট করা। এই প্ল্যানচেট নিয়ে ওদের বাড়ির কৌতূহলের সীমা ছিল না। শুধু জুলির মা বলতেন, কী দরকার বাপু ওসব আত্মাতাত্মাকে ডেকে! ওরা যেখানে শান্তিতে আছে সেখানেই থাকুক।

তারপর এই যে কলিংবেল–যা নিয়ে আজ গভীর রাতে এত দুর্ভাবনা সেটার ব্যবস্থা তো ঐ চঞ্চলদাই করেছিল।

ঘুম আসছিল না জুলির। চোখ বুজিয়ে কেবলই সেইসব কথা মনে পড়ছিল।

তখন সবে গোয়ালপাড়ায় ইলেকট্রিক এসেছে। চঞ্চল হাঁকডাক করে বাড়ি ঢুকল।

কী ব্যাপার? জুলির মা জিজ্ঞেস করলেন।

আর চেঁচামেচি, কড়া নাড়া, শেকল নাড়ার দরকার নেই মাসিমা। বোতামটা বাইরে থেকে টিপবে আর ভেতরের লোক জানলা দিয়ে উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করবে–কে?

জুলির মা হাসলেন। বললেন, এত পাগলামিও তোমার মাথায় আসে!

পাগলামি কেন বলছেন মাসিমা? জানলা থাকলে যেমন পর্দার দরকার, দরজা থাকলেই কলিংবেলের দরকার।

জুলির মা বললেন, কোনো দরকার ছিল না।

হ্যাঁ, ছিল। আমি লাগিয়ে দিচ্ছি। কেউ না বাজাক, আমিই বাজাব।

এরপর চঞ্চল যখন-তখন আসে আর কলিংবেল টেপে। ছেলেমানুষের মতো তার কী আনন্দ!

কয়েক মাস পরে এ বাড়িতে যারাই আসে তারাই বেল বাজিয়ে ঢুকতে লাগল। এটা আবার চঞ্চলের বিশেষ পছন্দ হলো না। সবার মতো সে বেল বাজাবে না। জানিয়ে দিল সে যখন বেল টিপবে একসঙ্গে তিনবার।

এই এমনি করে, বলে তিনবার বেল টিপল। ব্যস আপনাদের আর জিজ্ঞেস করতে হবে না। বুঝে নেবেন আমি এসেছি।

এরপর থেকে চঞ্চল যখনই আসে ঐভাবে বেল বাজায়। সবাই বুঝতে পারে আর কেউ নয় চঞ্চল এসেছে।

রাত এখন প্রায় তিনটে বাজে। গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে বাঁশবাগানটা স্তব্ধ বিভীষিকার মতো থমথম করছে। দূরের মাঠ আর আকাশ যেন অন্ধকারে এক হয়ে গেছে। বাড়ির সকলে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছে। এই যে হঠাৎ আজ রাত-দুপুরে কলিংবেলটা তিনবার বেজে উঠল, কে বাজাল তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। কিন্তু জুলি অত সহজে ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। সে জানে এটা একটা অশুভ সংকেত। কিছু একটা ঘটবেই। তাই তার চোখে ঘুম নেই। কেবলই চঞ্চলের কথা মনে পড়ছে।

জুলির মনে পড়ে সেদিনের কথা। চঞ্চল পুরনো ইংরিজি পত্রিকার একটা ছেঁড়া পাতা কোথা থেকে নিয়ে এল।

জুলি–জুলি দেখে যাও।

না জানি কী মহামূল্যবান জিনিস মনে করে জুলি চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতেই এসে দাঁড়াল।

 একটা ছবি।

অদ্ভুত ছবিটা। গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটা বিশাল দোতলা বাড়ি। জানলাগুলো বন্ধ। বাড়িটা পুরনো। চারিদিকে পাঁচিল ঘেরা। ভেতরে নানারকম বড়ো বড়ো পাথরের মূর্তি। কিন্তু বাড়িটার সামনের দিকে দোতলার জানলার ঠিক নিচে বোধহয় পাথরেরই একটা ভয়ংকর মুখ। সে মুখ মানুষের তো নয়ই, গল্পে-পড়া রাক্ষস-দৈত্য-দানবেরও নয়। ছবিতেও মনে হয় সেটা কোনো অলৌকিক জীবের মুখ।

চঞ্চলের দারুণ উৎসাহ। ছবিটা দেখতে দেখতে তার মুখচোখ কেমন হয়ে যাচ্ছিল।

জুলি জিজ্ঞেস করল, এই বাড়িটা কার? মুখটাই বা অমন কেন?

চঞ্চল হতাশ হয়ে বলল, এর ইতিহাস সবই লেখা ছিল। কিন্তু ছিঁড়ে গেছে। ইস কিছুই জানা গেল না।

পত্রিকাটা তুমি পেলে কোথায়?

চঞ্চল বলল, কলকাতায় গিয়েছিলাম। রিপন স্ট্রিটে একটা কাগজের দোকানে পুরনো পত্রিকা বিক্রি হচ্ছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল। ওটা চাইলাম, তা দিল না। বলল, এক টাকা লাগবে। কী আর করি! এক টাকা দিয়ে ছবিটা কিনে ফেললাম।

তুমি কী চঞ্চলদা!

চঞ্চল অবাক হয়ে বলল, কেন?

নেহাৎই একটা পুরনো ছবি। ইংরিজি ম্যাগাজিনে অমন কত ছবি বেরোয়। তা নিয়ে এত মাতা ঘামাবার কি আছে?

চঞ্চল একটু হাসল। বলল, এ ছবিটা সাধারণ ছবি নয় জুলি। এই যে বাড়িটা–দেখলেই বোঝা যায় এর মধ্যে কোনো অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে। নয় কি?

জুলি বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আর্টিস্টরা তাদের খেয়ালমতো ছবি আঁকে। তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার কি আছে?

চঞ্চল বলল, আছে। মনে রাখতে হবে এই ধরণের ছবি একজন আর্টিস্ট শুধু শুধু কল্পনা করে আঁকে না। হয় কোনো এক সময়ে বাড়িটা দেখেছিল কিংবা কারও কাছ থেকে বাড়িটার কথা শুনেছিল। ব্যাপারটা তার মনে এমনই গেঁথে গিয়েছিল যে, সে একজন আর্টিস্ট বলেই ছবিটা না এঁকে পারেনি। আর বাড়িটা ও তার কাহিনি একজন ইংরেজ সম্পাদকের এতই ভালো লেগেছিল যে তিনি সেই কাহিনি ছবিসুদ্ধ না চেপে পারেননি। আমার দুর্ভাগ্য, ছবিটুকুই পেলাম, কাহিনিটা পেলাম না। সেটা ছিঁড়ে গেছে।

জুলি বলল, একটা পুরনো বড়ো বাড়ি ছাড়া এর মধ্যে আর কী আছে তা তো বুঝতে পারছি না। হ্যাঁ, বাড়িটা অবশ্য একটু অন্য ধরনের। ছাদটা কচ্ছপের পিঠের মতো ঢালু হয়ে গেছে। এই পর্যন্ত। এর বেশি বোঝবার দরকারও নেই। আর্টিস্টের খেয়াল।

চঞ্চল বলল, দেখলে মনে হয় বহু পুরনো এই বাড়িতে কেউ থাকে না।

জুলি বলল, এই পুরনো বাড়িতে কে থাকবে? বন্ধ জানলাগুলো দেখলেই তা মনে হয়।

চঞ্চল হাসল একটু। বলল, সব জানলাই বন্ধ নয়। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখো বাঁদিকে একটা জানলা খোলা। দেখেছো।

হ্যাঁ।

হঠাৎ একটা জানলা খোলা কেন?

 জুলি বলল, ঝড় বাতাসে খুলে যেতেই পারে।

 ঝড় বাতাসে দুপাটই এমন সমানভাবে ভোলা থাকে? ভালো করে দেখো।

জুলি বলল, তা বটে। কেউ যেন ইচ্ছে করে একটা জানলা খুলে রেখেছে।

এই কথাটাই তোমাকে এতক্ষণ বোঝাতে চাইছিলাম। ছবিটা যে এঁকেছিল কী অসাধারণ তার হাতের কাজ। শুধু তাই নয় জুলি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস আর্টিস্ট নিজে কোনো দিন বাড়িটা দেখেছিল। একটু থেমে বলল, তাছাড়া দেখো, বাড়ির সামনে আবার সার সার সুপুরি গাছ– যেন বাড়িটাকে আড়াল করে রেখেছে। সব কিছু মিলিয়ে বাড়িটা কেমন রহস্যময়, তাই নয় কি?

তাই তো মনে হচ্ছে।

সবচেয়ে রহস্যজনক মনে হচ্ছে এ বাড়িতে কেউ একজন থাকে। আর সে থাকে দোতলার একটা ঘরে। কিন্তু সে কে? কেন ঐরকম বাড়িতে একা থাকে?

এই বলে চঞ্চল ছবিটার উপর ঝুঁকে পড়ে নিবিষ্ট মনে আরও কী যেন দেখতে লাগল।

কী দেখছ অমন করে? জুলি জিজ্ঞেস করল।

দেখছি বাড়িটা কোথায় হতে পারে?

 জুলি বলল, বাড়িটার গঠন দেখে মনে হচ্ছে সে আমলের সাহেবদের বাড়ি।

তা ঠিক। কিন্তু জায়গাটা কোথায়? পেছনে দেখো আবছা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। আর্টিস্ট জঙ্গলের মধ্যে পাইন গাছ দেখাতেও ভোলেননি। আমার মনে হয় দার্জিলিঙের কাছাকাছি কোনো জায়গায়।

কিন্তু দার্জিলিঙের কাছে হলে তো আরও পাহাড় দেখা যেত।

ঠিকই বলেছ। তবে নর্থ বেঙ্গলের কোনো জায়গা হতে পারে। ঐ বাড়িটা দেখতে আমাকে যেতেই হবে।

না-না, নর্থ বেঙ্গল নয়। ছবির কোণে ছেঁড়া জায়গাটা ভালো করে লক্ষ্য করো। কি দেখছ?

জুলি ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগল।

হা হা, এই যে As….. N…..ar….।

 চঞ্চল বলল, তাহলে বলো কোন জায়গার প্রথম কথাটা As দিয়ে।

জুলি বলল, প্রথমেই তো আসাম নামটা মনে হয়।

 ঠিক বলেছ। তার পর N–আচ্ছা ওটা থাক। শেষেরটা ধরো ar। কী হতে পারে?

জুলি তখনই আসামের ম্যাপটা খুলে দেখতে লাগল।

নাঃ একটাই জায়গা পাচ্ছি কাছাড়।

 চঞ্চল উৎসাহে লাফিয়ে উঠে বলল, ব্যস, ঠিকানা মিল গয়া। কাছাড় নর্থ কাছাড়।

জুলি হেসে বলল, তুমি সত্যিই পাগল। বাড়িটা আছে কিনা তার ঠিক নেই, হয়তো আর্টিস্টের সবটাই কল্পনা আর তুমি তাই খুঁজতে বেরোবে!

চঞ্চল হাসল না। গম্ভীরভাবে বলল, আমি বুঝতে পারছি ও বাড়ি আর্টিস্টের কল্পনা নয়। সত্যি সত্যিই আছে। আর আমি তা খুঁজে বের করবই।…

তারপর একদিন চঞ্চল ছবিটা বাঁধিয়ে নিয়ে এল। জুলির হাতে দিয়ে বলল, এটা তোমায় দিলাম।

জুলি অবাক হয়ে বলল, আমাকে কেন?

চঞ্চল গম্ভীরভাবে বলল, এই ছবিটা নিয়ে সব আলোচনা শুধু তোমার সঙ্গেই হয়েছে। এর মর্ম আর কেউ বুঝবে না।

অগত্যা জুলিকে ছবিটা টাঙিয়ে রাখতে হলো। আর কিছু না হোক পুরনো বাড়ি হিসেবে একটা আকর্ষণ আছে। তাছাড়া এতই সুন্দর ছাপা যে বাড়িটা পুরনো হলেও চকচক করছে।

এ ঘটনা কালনার সেই ভুতুড়ে বাড়ি দেখতে যাবার আগে। কালনার সেই বাড়িতে এক রাত্তির কাটিয়ে আসার পর থেকে চঞ্চলদা কেমন যেন হয়ে গেল। উদ্ভ্রান্ত, অন্যমনস্ক। তাদের বাড়িও কম আসত। যে জুলি তার বোনের মতো, বন্ধুর মতো, তার সঙ্গেও কম কথা বলত।

সে একরকম ভালোই হয়েছিল। দিনরাত শুধু ভূত-ভূত-ভূত আর প্লানচেট করা, এসব তার মায়ের মতো জুলিরও ভালো লাগত না।

আগে জুলি কলকাতায় মামার বাড়ি চলে গেলে চঞ্চল রোজ খবর নিয়ে যেত কবে গোয়ালপাড়া আসবে, কিন্তু এবার যখন গেল, চঞ্চল একবারও খোঁজ নেয়নি। ভালোই।

মাস তিনেক পর জুলি গোয়ালপাড়ায় ফিরে এসে শুনল চঞ্চল কোথায় চলে গেছে নিরুদ্দেশ। ওর পিসেমশাই একদিন নাকি এ বাড়িতে খোঁজ করতে এসেছিলেন জুলির মা বাবাকে কিছু বলে গেছে কি না।

সেই যে চঞ্চল নিরুদ্দেশ হয়ে গেল আর ফেরেনি আজ পর্যন্ত। কি হলো ছেলেটার? অন্তত জুলি খুব ভাবত ওর কথা। তারপর ধীরে ধীরে চঞ্চল সবার মন থেকে দূরে সরে গেল।

হঠাৎ একদিন রাত দুপুরে কলিংবেলটা বেজে উঠল। পরপর তিনবার। সেদিনও চমকে উঠেছিল সবাই। চঞ্চল ফিরে এসেছে তাহলে।

তারপর যখন দরজা খুলে কাউকে দেখতে পেল না তখনই এ বাড়ির সকলের বুকটা হাহাকার করে উঠল। বুঝল, চঞ্চল আর এ জগতে নেই। কোথায় কোন অজানা জায়গায়, নিঃস্ব অবস্থায় ঘুরতে ঘুরতে বেঘোরে প্রাণটা হারিয়েছে।

চঞ্চল এদের এতই ভালোবাসত যে নিজের একটা ছবি বাঁধিয়ে রেখে গিয়েছিল। বলেছিল, যেদিন আমি থাকব না, তখনও যদি আমার কথা মনে পড়ে তোমরা আমার এই ছবিটা দেখো। আমি তোমাদের কাছেই থাকব।

সেদিন সকালবেলায় জুলি বিমর্ষ মনে যখন চঞ্চলের কথা ভাবছিল, হঠাৎ লক্ষ্য পড়ল চঞ্চলের ছবিটার দিকে। কাচটা কিরকম চিড়ে গেছে। ও খুব আশ্চর্য হয়েছিল আলমারির ভেতরে রাখা ছবির কাচ ভাঙল কি করে?

তারপর জুলির কি মনে হলো, প্ল্যানচেট করতে বসেছিল। এ বিদ্যেটা শিখেছিল চঞ্চলের কাছ থেকেই।

চোখ বুজিয়ে একমনে চঞ্চলের কথা ভাবতে ভাবতেই প্ল্যানচেটের চাকাটা সাদা কাগজের ওপর নড়তে শুরু করল। পেন্সিলে বড়ো বড়ো অক্ষরে একটা লেখা ফুটে উঠল যেও না।

আশ্চর্য! জুলিদের যে এবার পুজোর ছুটিতে গ্যাংটকে যাবার ঠিক হয়েছে, চঞ্চল জানল কি করে?

যে ভাবেই জানুক এই যে প্ল্যানচেটে স্পষ্ট যেতে বারণ করা হয়েছে তাই নিয়ে বাড়ির সবাই দুর্ভাবনায় পড়ল। অভিজিৎ বলল, ও সব গাঁজাখুরি কথা ছাড়া তো। চঞ্চলের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, এখন ভূত হয়ে এসে কলিংবেল বাজাবে–প্ল্যানচেটে সাবধান করে দেবে।

কাজেই যেতে হলো। কিন্তু গ্যাংটক থেকে গাড়িতে ছালেক দেখতে গিয়ে কীভাবে যে খাদে পড়তে-পড়তে বেঁচে গিয়েছিল তা আজও ভাবলে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে।

এর কিছুকাল পরে আবার একদিন রাতে তিনবার কলিংবেল বেজেছিল। অথচ দরজা খুলে কাউকে দেখা যায়নি। আবার ছবির কাচে চিড়। আবার প্ল্যানচেট নিয়ে বসা। আবার নিষেধভুল করছ … বিপদ…।

সেবার জুলি কয়েকজন বান্ধবীর সঙ্গে একটা চাকরির জন্যে চণ্ডীগড়ে ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছিল। বাড়িতে সবাই বাধা দিয়েছিল। চাকরি হলে তো সুদূর চণ্ডীগড়ে থাকতে হবে। একজন অল্পবয়সী মেয়ের পক্ষে মা-বাবাকে ছেড়ে বিদেশে একলা থাকা সম্ভব? কিন্তু জুলি অন্য প্রকৃতির মেয়ে। বড্ড বেশি সাহসী আর জেদী। সে বলল, গিয়েই দেখি না। তেমন বুঝলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসব।

কেবল দাদাই বলল, যদি এখনই চাকরি করতে চাস তাহলে না হয় ঘুরেই আয়। পশ্চিমবাংলায় পড়ে থাকলে কোনোদিন চাকরি হবে না। তাছাড়া অ্যাডভেঞ্চার হবে। একলা একলা স্বাধীন জীবন–দারুণ!

যাওয়া যখন স্থির তখন হঠাৎ জুলির কিরকম মাথা ঘুরতে লাগল। উঠতে গেলেই মাথা ঘুরে পড়ে যায়। শুয়ে শুয়েও মনে হয় ছাদটা যেন দুলছে। কিছুক্ষণের জন্য অনেকেরই মাথা ঘোরে। কিন্তু এরকম সারাদিন

ডাক্তার ওষুধ দিয়ে গেলেন। বলে গেলেন, বাড়ির বাইরে যাওয়া এখন দু-তিন দিন বন্ধ। অথচ আজ পর্যন্ত জুলির কোনোদিন মাথা ঘোরেনি। এ যেন যাওয়াটা পণ্ড করার জন্যই হঠাৎ এই রোগ।

যাওয়া হয়নি, মঙ্গল। যে কম্পার্টমেন্টে জুলিদের রিজার্ভেশন ছিল সেই কম্পার্টমেন্টেই বড়ো রকমের ডাকাতি হয়ে গেল। জুলির বন্ধুরা কাঁদতে কাঁদতে কোনোরকমে বাড়ি ফিরে এসেছিল।

দু-দুবার এরকম হওয়ায় এই অলৌকিক ব্যাপারে জুলির কেমন বিশ্বাস জন্মে গেছে। তার মনে হয় চঞ্চল সত্যি তাদের ভালোবাসে বলেই মৃত্যুর পরও ভুলতে পারেনি। বিপদের ঝুঁকি থাকলে সাবধান করে দেয়।

এইবার তৃতীয় বার।

এবারও ছবির কাছে চিড় ধরা। চিড় ধরা কেন? এটা কি সবাইকে জানানো যে, সে সত্যি এসেছিল?

সারারাত ঘুম হলো না জুলির। ভোরবেলা একটু ঘুম এসেছিল, মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। অনেক বেলা হয়ে গেছে। ওঠ। চায়ের জল চড়িয়েছি।

জুলি হাতমুখ ধুয়ে চা খেল। কিন্তু সারা রাত যে ঘুমোয়নি সে কথা প্রকাশ করল না। কাল রাতেও যে চঞ্চল এসেছিল তাতে আর সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন? আবার কোন বিপদের জন্যে সাবধান করতে চাইছে? আশ্চর্য! এ নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামাচ্ছে না।

জুলি তাড়াতাড়ি স্নান সেরে দরজা বন্ধ করে প্ল্যানচেট নিয়ে বসল।

আবার লেখা ফুটে উঠল–ওর কাছ থেকে সাবধান।..ব্যস্ত এইটুকু। ওটা কে? কিছুই বোঝা গেল না। এ বাড়িতে তো কতজনই আসে। এই তো সেদিন কলকাতা থেকে তার দু বন্ধু এল। নবদ্বীপ, শান্তিপুর, কৃষ্ণনগর, কালনা ঘুরে বেড়াল। একটা নতুন ঝি রাখা হয়েছে। সে তো দুবেলা আসে। খুব গল্প করে মায়ের সঙ্গে। এত গল্প কিসের? ওর কাছ থেকেই কী সাবধান হতে বলছে?

জুলি আবার কয়েকদিনের জন্যে কলকাতায় গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখে একজন অপরিচিত লোক বাইরের ঘরে সোফার ওপর দিব্যি পা তুলে বসে আছে। খালি-গা, গলায় ধবধবে পৈতে, পরনে মোটা সুতোর ধুতি, কাঁধে গামছা। কুচকুচে কালো রঙ। নাকটা বসা।

এমন একজন লোককে তাদের বাড়িতে দিব্যি বসে থাকতে দেখে জুলি তো অবাক।

লোকটা উঁচু উঁচু দাঁত বের করে হেসে বলল, কি খুকি, কলকাতা থেকে এলে? বড়ো হয়েছ, কোথায় শাড়ি পরবে, তা নয় ওসব কী পরেছ? তা ছাড়া একা একা কলকাতায় যাওয়া-আসা করা ঠিক নয়। তোমার বাবা-মা বারণ করতে পারে না? যাও ভেতরে যাও।

লোকটার কথা শুনে জুলির সর্বাঙ্গ রাগে জ্বলে উঠল। কোনো কথা না বলে গটগট করে ভেতরে চলে গেল।

মাকে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, লোকটা কে?

মা জিব কেটে বললেন, ছিঃ, ওভাবে বলে না। উনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। তোমার বাবার গুরুদেবের ছেলে।

তা এখানে কেন?

কাছাকাছি তীর্থস্থানগুলো ঘুরবেন।

যেখানে যত খুশি ঘুরুন, কিন্তু আমাদের বাড়ি কেন?

মা শান্ত গলায় বললেন, নবদ্বীপ, শান্তিপুর তো এখান থেকে কাছে। তা ছাড়া তোমার বাবার গুরুদেব ছিলেন ওঁর বাবা। এখানে ছাড়া আর কোথায় উঠবেন?

তা বলে ঐরকম একটা লোক আমাদের বাড়িতে?

 উপায় কি?

 কদিন থাকবে?

মা বললেন, তা কিছু বলেননি। তবে জিনিসপত্রের বহর দেখে মনে হচ্ছে কিছুদিন থাকবেন।

জুলি হাতের ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, আমি তাহলে কালই কলকাতায় চলে যাব।

কিন্তু জুলি কলকাতায় গেল না। ভেবে দেখল, বাড়িতে এইরকম একটা উটকো লোককে রেখে চলে যাওয়া উচিত হবে না।

সত্যিই লোকটা অদ্ভুত। পশ্চিম দিকের একটা ঘর ওঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই ঘরে উনি যত রাজ্যের ঠাকুর-দেবতার ছোটো ছোটো মূর্তি সাজিয়ে রেখেছেন। দেওয়ালে দেওয়ালে দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রীর ছবি। রোজ অনেক দূরে গঙ্গায় স্নান করা চাই। সকালে উঠেই সারা বাড়িতে গঙ্গাজল ছেটান। তারপর ভালোরকম ভোজনপর্ব সেরে কাছেপিঠে মন্দির-টন্দির দেখতে বেরোবেন, ফিরবেন সন্ধের পর। তারপর অনেক রাত পর্যন্ত ঘণ্টা, শাঁখ বাজিয়ে চলবে তার অতগুলো ঠাকুরের পুজো। সারাদিন ধুনোর ধোঁওয়ায় ঘর অন্ধকার। রাতে ঘুমের দফারফা। লোকটার কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। যেন কদিনেই বাড়িটাকে নিজের বাড়ি বলে মনে করে নিয়েছেন। কিছু বলার উপায় নেই। হাজার হোক গুরুদেবের ছেলে! তার ওপর ঠাকুর-দেবতা নিয়ে ব্যাপার। কাজেই মুখ বুজে সব সহ্য করে যেতে হয়।

অভিজিৎ তো লোকটাকে দু চক্ষে দেখতে পারে না, গুজগুজ করে বলে, ওকে আমি তাড়াবই।

এরা ভাই-বোনে যে তাকে দেখতে পারে না, গুরুদেবের পুত্রটি তা ভালো করেই বোঝেন। একদিন জুলির মাকে কথায় কথায় বলেন, বৌমা, তোমরা আমার খুব আদর-যত্ন কর ঠিকই, কিন্তু তোমার ছেলে-মেয়েরা আমায় দেখতে পারে না। ভক্তি-শ্রদ্ধা একেবারে নেই।

সুলেখা তাড়াতাড়ি বলেন, আসলে কী জানেন ঠাকুরমশাই, এরা তো একালের ছেলে মেয়ে। এদের চালচলন, কথাবার্তা একটু অন্যরকম।

ঠাকুরমশাই বিরক্ত হয়ে বললেন, ওরা তো আমার সঙ্গে কথাই বলে না, আমার ঘরের দিকে তাকায় না পর্যন্ত। এত অবজ্ঞা! এরকম হলে আমি থাকি কি করে?

ব্যস্ত হয়ে সুলেখা বলেন, না না, ওরা ছেলেমানুষ। ওদের ব্যবহারে কিছু মনে করবেন না। ক্ষমা করবেন।

এবার ঠাকুরমশাই একটু শান্ত হলেন। বললেন, তাছাড়া বৌমা, আমি যতদিন এ বাড়িতে আছি ততদিন তোমাদের কোনো অমঙ্গল হতে দেব না। আমার এই এতগুলো দেবদেবীর পুজো নিষ্ফল নয় জেনো।

তারপরই নিচু গলায় বললেন, যদি চাও তত তোমার গুণধর ছেলে-মেয়েদের সুমতির জন্যে ছোটোখাটো একটা যজ্ঞ করে দিই। বেশি খরচ পড়বে না।

শুনে তো সুলেখা চমকে উঠলেন। ছেলে-মেয়েদের কানে গেলে রক্ষে থাকবে না। বললেন, ও সব এখন থাক্‌ ঠাকুরমশাই। দরকার হলে বলব।

বলাই বাহুল্য ঠাকুরমশাই মনে মনে চটে গেলেন।

এর পর একদিন ঠাকুরমশাই সন্ধের পর বাড়ির সবাইকে ডাকলেন। বললেন, খুব দরকারি কথা আছে।

জুলি তো যাবেই না। অভিজিৎ-এরও যাবার ইচ্ছে নেই। মা-বাবা বারবার বলায় জুলিকে বললে, লোকটা কী বলে শোনাই যাক না।

ধুনোর ধোঁওয়ায় ঘর অন্ধকার। ধোঁওয়াটা একটু পাতলা হয়ে গেলে সবাই ঢুকল। ঠাকুরমশাই একটা কম্বলের আসনে বসেছিলেন। সামনের মেঝেতে খড়ি দিয়ে আঁক-জোক কাটা। চার কোণে চারটে সুপুরি। মাঝখানে একটা ছোটো কাপড়ের টুকরোয় কী সব বাঁধা।

সবাই মেঝেতে বসলে ঠাকুরমশাই গম্ভীরভাবে বললেন, যে জন্যে ডেকেছি শোনো। তোমাদের এই বাড়িতে প্রেতাত্মা আছে।

মাগো! বলে জুলির মা আঁৎকে উঠলেন।

ঠাকুরমশাই বলতে লাগলেন, এ বাড়িতে এসে পর্যন্ত দেখছি বাতাস বেশ ভারী। এমনটা কেন হলো তা জানবার জন্যে খড়ি পেতে দেখলাম, হ্যাঁ, ঠিক যা ভেবেছি। প্রেতাত্মা দিব্যি ডেরা গেড়ে বসে আছে।

অভিজিৎ বলেন উঠল, তা থাক না। ক্ষতি তো করছে না।

ঠাকুরমশাই বললেন, বল কী বাবা! প্রেতাত্মা বাড়িতে পুষে রেখে দেবে! এখনও পর্যন্ত ক্ষতি করেনি বলে ভবিষ্যতে করবে না জানছ কি করে?

অভিজিৎ যতই বিদ্রূপ করে বলুক, তার মায়ের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। ঠাকুরমশাই তো একেবারে ভুল বলেননি। তার চঞ্চলের কথা মনে পড়ল। যে তিনবার এসেছে সে যে এখানেই এখন বসে আছে কিনা কে জানে।

ঠাকুরমশাই তখন বলছেন, প্রেতাত্মা নিয়ে অবহেলা করা ঠিক নয়। ওদের মর্জি বোঝ ভার। আজ চুপচাপ আছে, কালই হয়তো অঘটন ঘটাতে পারে।

সুধীনবাবু বললেন, তা আপনি কী করতে চান?

ঠাকুরমশাই বললেন, ছোটোখাটো একটা প্রেত তাড়ানো যজ্ঞ। কম খরচেই করে দেব। আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, কিন্তু ভেবে দেখুন তো সত্যিই কি কোনোদিন ভৌতিক ঘটনা ঘটেনি?

হঠাৎ জুলি উঠে চলে গেল। অভিজিৎ হেসে বললে, পাড়ার কার কার কাছ থেকে শুনেছেন বলুন তো!

ঠাকুরমশাই বললেন, তোমাদের যদি একান্তই অবিশ্বাস হয় তাহলে এসব আলোচনা থাক। বলে নিজেই খড়ির ছক মুছে ফেললেন। জুলি পরে একসময়ে হাসতে হাসতে মাকে বলল, বাবার গুরুদেবের ছেলেটি কিন্তু ব্যবসা ভালোই বোঝেন। প্রেতাত্মা নয়, তিনি নিজেই এ বাড়িতে দিব্যি ডেরা গেড়ে বসেছেন। নড়বার নাম নেই।

অভিজিৎ বলল, বাবা নিতান্ত ভালোমানুষ আর গুরুদেবের ভক্ত তাই কিছু বলতে পারেন না। ঠাকুরমশাই সেই সুযোগটাই নিচ্ছেন।

কোনো যজ্ঞই হলো না। তবু ঠাকুরমশাই দিব্যি থেকে গেলেন। শুধু জুলির মায়ের মনটা খচখচ করতে লাগল–ঠাকুরমশাই খুব ভুল তো বলেননি। একটা যজ্ঞটজ্ঞ করলেই হতো। কিন্তু ছেলে আর মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারলেন না। জুলি শুধু ভাবল, চঞ্চলদা কি এই লোকটারই কাছ থেকে সাবধান হতে ইঙ্গিত করেছিল?

.

সাহেবের আবির্ভাব

সমুদ্রগড় রেলবাজারে নাকি একজন পাগলা সাহেব এসেছে। কোথা থেকে এসে জুটেছে কে জানে। কখনো গাছের তলায় কখনো পুকুরপাড়ে বসে থাকে। কী তার উদ্দেশ্য কেউ তা জানতে পারেনি। খাঁটি সাহেব এ অঞ্চলের লোক সিনেমা টি.ভি.তে ছাড়া এর আগে চোখের সামনে দেখেনি। তাই তাদের কৌতূহলের শেষ নেই।

অভিজিৎ কদিন এখানে ছিল না। কলকাতায় গিয়েছিল। তার কানেও সাহেবের কথা। গেল। ভাবল দেখাই যাক কিরকম সাহেব। তেমন হলে সাহেবকে নিয়ে তাদের কাগজে সচিত্র ফিচার লিখবে। তাই ক্যামেরাটাও সঙ্গে নিল।

সমুদ্রগড় রেলবাজারটা গোয়ালপাড়ার কাছেই। ঘুরতে ঘুরতে সাহেবের দেখা পেল নসরৎপুরে একটা ভাঙাবাড়ির কাছে। সাহেব সেই বাড়ির ভাঙা চাতালের ওপর খবরের কাগজ পেতে আপন মনে কী লিখছ। অভিজিৎ দেখে অবাক হলো সাহেব যে কলম দিয়ে লিখছে তা ফাউন্টেন পেন বা ডট পেন নয়, সে কলম মান্ধাতার আমলের বড়ো পালকের কলম। বহুকাল আগে যখন ডট পেন তো নয়ই, এমনকি কালিভরা ফাউন্টেন, কাঠের হ্যাঁন্ডেলে সরু নিবগোঁজা কলমেরও চল হয়নি তখন লোকে লিখত শরের কিংবা পাখির পালক চেঁছে কলম তৈরি করে। এ যুগের একজন সাহেব কেন ঐরকম কলম দিয়ে লিখছে কে জানে!

সাহেব ঝুঁকে পড়ে লিখছিল। পাশেই একটা মস্ত পোঁটলা।

এখন তো কতরকমের বড়ো বড়ো ট্রিব্যাগ বিগশপার বাজারে চল হয়েছে–তার জায়গায় পোঁটলা! এই ধরনের পোঁটলা করে আগে ধোপারা বাড়ি বাড়ি থেকে কাপড় কাচতে নিয়ে যেত। ফেরিওয়ালা মেয়েদের শাড়ি, ব্লাউজ, সায়া এমনিভাবে পোঁটলা বেঁধে হাঁক দিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরত। ট্রেনে গেরস্তরা যেত বাক্স-প্যাটরার সঙ্গে পোঁটলা নিয়ে। আশ্চর্য! মান্ধাতার আমলের সেই পোঁটলা আজ সাহেবের কাছে।

অভিজিৎ-এর খুব ইন্টারেস্টিং লাগল। সে সাহেবের সামনে গিয়ে বলল, গুড মর্নিং।

 সাহেব একবার চোখ তুলে তাকাল। হেসে বলল, ভেরি গুড মর্নিং। বোসো।

তারপরেই ইতস্তত করে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, কিন্তু তোমায় কোথায় বসতে দেব? এ তো ডানকানের রাজপ্রাসাদ নয়।

অভিজিৎ অবাক হয়ে বলল, ডানকান কে?

মাই গড! স্কটল্যান্ডের রাজা ডানকানের নাম মনে নেই? সেই যাকে অকৃতজ্ঞ সেনাপতি ম্যাকবেথ নিজে হাতে খুন করেছিল?

কী সব বলছে সাহেব! অভিজিৎ থতমত খেয়ে গেল। একটু সামলে নিয়ে বলল, কী লিখছ?

সাহেব হেসে বলল, হিস্ট্রি–নয়া হিস্ট্রি।

যাঃ বাবা! ইতিহাস লিখছে! এ তো আচ্ছা পাগল। তা এখানে বসে লিখছ কেন?

সাহেব নিরুপায় গলায় বলল, কী করব? কোথায় থাকব? আমায় কেউ জায়গা দেয় না।

কদিনের জন্যে এসেছ এখানে? ফর এ ফিউ ডেজ। কয়েকদিনের জন্যে। আমি টুরিস্ট। বেশিদিন কোথাও থাকা হয়।

হোটেলে থাকতে পার। টাকাপয়সা নেই?

সাহেব একটু হাসল। তারপর তার লম্বা কোটের বাঁ পকেট থেকে বের করল একটা বড়ো থলি। থলিটা মেঝের উপর উপুড় করতেই ঝনঝন করে পড়ল একগাদা কুইন ভিক্টোরিয়ার মুখওয়ালা খাঁটি রূপোর টাকা। তার মধ্যে আবার অনেকগুলো সোনার গিনি।

অভিজিৎ-এর তো চোখ ট্যারা। এত টাকা পকেটে নিয়ে ঘুরছে।

 কিন্তু সাহেব, এসব তো পুরানো আমলের টাকা। এ তো এখন চলবে না।

এবার সাহেব তার ঢিলে প্যান্টের ভেতরের গোপন পকেট থেকে বের করল গোছ গোছ অশোকস্তম্ভ মার্কা নোট।

এ তো অনেক টাকা। তাহলে হোটেলে থাকছ না কেন?

সাহেব বলল, আমি বিদেশী বলে সবাই এমনকি বয়-বাবুর্চিরাও খুব বিরক্ত করে। কেবল আমার ঘরে উঁকিঝুঁকি মারে। হাসবে দাঁত বের করে।

অভিজিৎ বুঝল বিদেশী বলেই নয়, আসলে পাগলাটে বলেই ওদের এত কৌতূহল।

 তুমি আসছ কোথা থেকে?

সাহেব গম্ভীরভাবে বলল, আমি তো বলেছি আমি টুরস্টি। আমার আসা-যাওয়ার ঠিক নেই। তবে একটা বিশেষ জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছি … বলতে বলতে সাহেব কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।

অভিজিৎ আর ঘাঁটাল না। তবে ওর বেশ পছন্দ হলো সাহেবকে। খুব ইনটারেস্টিং। একে নিয়ে কাগজে লেখা চলে। আরও ভালো হয় যদি ওকে কয়েক দিনের জন্যে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যায়। তাদের বাড়ির দরজা সকলের জন্যেই খোলা। সাতদনি–দশদিন যে কেউ স্বচ্ছন্দে থেকে যেতে পারে।

বাড়ি নিয়ে যাবার প্রস্তাব করতেই সাহেব কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

 তোমাদের বাড়ি আমাকে নিয়ে যেতে চাও? হোয়াই? আমাকে নিয়ে গিয়ে তোমার লাভ?

অভিজিৎ বলল, তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। বাবা-মায়েরও নিশ্চয় ভালো লাগবে। আর আমার একজন খুব সুইট বোন আছে। পড়াশোনা করছে। বিলেত যাবার ইচ্ছে। তোমাকে কাছে পেলে খুব খুশি হবে।

সাহেব বললে, তবে চলো।

এই বলে প্রৌঢ় সাহেব অত বড়ো পোঁটলাটা কাঁধে তুলে নিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে অভিজিৎ-এর সঙ্গে হাঁটতে লাগল।

.

এদিকে ঠাকুরমশাই কেবলই জুলির মাকে চাপ দিচ্ছেন, এ বাড়িতে প্রেতাত্মা আছে। একটা যজ্ঞ করে দিই।

ঠাকুরমশাই দেখেছেন বাড়ির মধ্যে একমাত্র এই মহিলাটিই তার কথা শুনতে চান। তিনিও যেন মনে করেন এ বাড়িতে কেউ থাকে। কিন্তু ছেলে-মেয়ে দুজনেই ভূত তাড়াবার নাম করলেই খেপে ওঠে। ভূতের সঙ্গে নিত্য বাস করতে ভালোবাসে।

আর-একদিন যজ্ঞের কথা বলতেই জুলি তেড়েফুঁড়ে উঠল। গুরুদেবের ছেলের মান-সম্মান না রেখেই বললে, আপনি বার বার ঐ এক কথা বলেন কেন বলুন তো? যজ্ঞট করে বাবার ঘাড় মুচড়ে দুপয়সা বাগাতে চান?

ঠাকুরমশাই তো হাঁ। এ বাড়ির মেয়ের মুখে এমন কথা শুনতে হবে কখনো কল্পনা করেননি। তোতলাতে তোতলাতে বললেন, না–না, তোমাদের ভালোর জন্যেই বলি।

জুলি ফুঁসে উঠে বলল, ভূত থাকে থাক। এ নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না, আপনি যেমন খাচ্ছেন-দাচ্ছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন তেমনি বেড়ান। আপনি গুরুদেবের ছেলে বলেই কেউ আপনাকে যেতেও বলবে না। তবে সব কিছুর একটা সীমা থাকা দরকার। বলে জুলি কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল।

এত অপমান সত্ত্বেও কিন্তু ঠাকুরমশাই বাড়ি থেকে নড়লেন না। তিনি এখন তীর্থদর্শন সেরে এ-বাড়ি ও-বাড়ি পুজো করে বেড়াচ্ছেন। জুলির মা একদিন বিরক্ত হয়ে সুধীনবাবুকে বললেন, ঠাকুরমশাই তো যাবার নাম করেন না। কী উদ্দেশ্য বুঝতে পারছি না। পাকাপাকিভাবে থেকে গেলেন নাকি?

সুধীনবাবু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কী করব? মুখের ওপর যাও তো বলতে পারি না।

.

ঢিলে প্যান্ট, লম্বা কোট, মাথায় হ্যাট, কাঁধে মস্ত পোঁটলা, অস্বাভাবিক মোটা মোটা আঙুল, ঝোলা ঠোঁট, মাথাটা নারকেলের মতো এই মানুষটাকে দেখে ভুরু কোচকান ঠাকুরমশাই। মনে মনে বলেন, এ আপদ আবার কোথা থেকে জুটল।

কিন্তু আর কেউ বিরক্ত হলো না। এ বাড়ির এই একটা গুণ–যে কেউই অতিথি হয়ে আসতে পারে। থাকতে দেবার জায়গার অভাব নেই, খেতে দেবার ক্ষমতাও আছে। এ তো আবার সাহেব। আমাদের এখনও সাহেব-মেমদের প্রতি সমীহভাবটা যায়নি।

জুলি যখন শুনল লোকটার কেউ কোথাও নেই, টুরিস্ট মানুষ–সুদূর স্কটল্যান্ড থেকে ভারতে এসেছে। তারপর দিল্লি, কানপুর, বেনারস, পাটনা হয়ে কলকাতা। তারপর একেবারে এই সমুদ্রগড়ে। তখন দাদার মতোই খুশি হলো। অভিজিৎ-এর উদ্দেশ্য সাহেবকে নিয়ে কাগজে কিছু লেখে। আর জুলি ভাবল লোকটা যদি দু-চারদিন এখানে থাকে তাহলে তার দেশের কথা, বাড়ির কথা–ট্যুরিস্ট জীবনের কথা শোনে।

সাহেব খুশি মনেই থাকল। তার জন্যেও একটা বাথরুমওলা ঘরের ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু কী খাবে? একজন খাস স্কচ সাহেব তো আর ভাত, ডাল, সুক্তো, মাছের ঝোল খেতে পারবে না। তাহলে?

সাহেবই তাদের বাঁচিয়ে দিলো। বলল, আমার খাবার জন্যে ভাবতে হবে না। বাইরে ইচ্ছেমতো খেয়ে নেব। তোমরা যে দুদিনের জন্য থাকতে দিয়েছ এর জন্যে ধন্যবাদ।

শুধু খাওয়াই নয়, সাহেব আলাদা ঘর পেয়ে নিজেই চা বা কফি করে নেয়। ঐ বিরাট পোঁটলার মধ্যে যেমন একগাদা পুরনো বই আছে, কাগজ আছে, কালি কলম আছে তেমনি আছে একটা ছোট্ট বিলিতি স্টোভ, চা, চিনি, গুঁড়ো দুধ, আরও কত কি কে জানে।

একটু সময় পেলেই সে একটা খাতায় কী লেখে!

অভিজিৎ বলে, ও ইতিহাস লেখে।

জুলি নিজেই সাহেবের সঙ্গে ভাব জমাতে লাগল। কোথা থেকে আসছে, কোথায় যাবে, কেন দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নিজের লোক কেউ আছে কিনা, তার সঙ্গে যথেষ্ট টাকা আছে তবু কেন এইরকম লক্ষ্মীছাড়া পোশাক, হাত-পায়ের নখগুলো অত বড়ো বড়ো রেখেছ কেন ইত্যাদি।

সাহেব কিন্তু খুব সংক্ষেপে উত্তর দিয়েছে। সে বলেছে তার দেশ স্কটল্যান্ডে। দেশভ্রমণ করাই তার উদ্দেশ্য। তার নিজের লোক বলতে তেমন কেউ নেই। দেশভ্রমণের মধ্যেও তার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে–এ দেশে খুব পুরনো, পরিত্যক্ত বাড়ির সংখ্যা আর সেগুলোর ইতিহাস সংগ্রহ করা।

জুলি জিজ্ঞেস করেছে, এত দেশ থাকতে বর্ধমান জেলার সামান্য জায়গা এই সমুদ্রগড়ে কেন?

সাহেব বলেছে, তার লক্ষ্যই হচ্ছে গ্রামের পুরনো বাড়ির খোঁজ করা। ইচ্ছে করে সে সমুদ্রগড়ে আসেনি। হাওড়া থেকে নিউ জলপাইগুড়ি এক্সপ্রেসে উঠেছিল নর্থ বেঙ্গলে যাবার জন্যে। কিন্তু সমুদ্রগড়ে এসে ইঞ্জিন খারাপ হয়ে যাওয়ায় সে সমুদ্রগড় স্টেশনে নেমে পড়ে। জায়গাটা ভালো লাগায় এখানেই দুদিন থেকে যাবে ভেবেছিল। এটাও তো বেশ পুরনো জায়গা। সাহেব যা-ই উত্তর দিক জুলির কিন্তু মনে হয়েছে বাইরে সরল হলেও সাহেব খুব চালাক, অনেক কিছু চেপে গেছে। জুলি আর ঘাঁটাতে চায়নি। মরুক গে। হয়তো দিন দুই থাকবে তার পর আবার পোঁটলা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে।

.

সাহেবের এই বাড়িতে থাকার দ্বিতীয় দিন রাতে সামান্য একটা ঘটনা ঘটল।

রাত তখন প্রায় এগারোটা। শহরের মানুষের কাছে রাত এগারোটা এমন কিছু নয়। টি.ভি. দেখতে দেখতেই বারোটা বাজে। কিন্তু গোয়ালপাড়ার মতো জায়গায় রাত এগারোটায় চারিদিক নিঝুম হয়ে যায়।

জুলি দিব্যি ঘুমোচ্ছিল, হঠাৎ যেন চাপা চিৎকার কানে এল। কেউ যেন হঠাৎ কিছু দেখে ভয়ে আঁৎকে উঠল, বাপরে! বলে। ঐ একবারই। তারপর সব নিস্তব্ধ। ঘুমের ঘোরে শোনা। কিছু ভাববার আগেই জুলি আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল।

পরের দিন সকালে ঠাকুরমশাই বোঁচকা-কুঁচকি, বড়ো টিনের সুটকেসটা নিয়ে চলে যাবার জন্যে প্রস্তুত।

সুধীনবাবু অবাক হয়ে বললেন, একি ঠাকুরমশাই, চলে যাচ্ছেন নাকি?

 ঠাকুরমশাই গম্ভীরভাবে শুধু একটি কথাই উচ্চারণ করলেন, হ্যাঁ।

সে কী! হঠাৎ?

তা আমি বলতে পারব না। বললে তো আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। কী দরকার মিছিমিছি অপমান হওয়া।

এতদিন এখানে থেকে ঠাকুরমশাই হঠাৎ যে এমনি ভাবে সত্যি সত্যিই চলে যাবেন কেউ ভাবতে পারেনি। আর যাবার আগে কিছুতেই বলে গেলেন না যাবার কারণটা কী।

শুধু জুলি লক্ষ্য করেছিল, এক রাত্তিরে ঠাকুরমশাইয়ের দুচোখ বসে গিয়েছে, মুখে যেন রক্তের আভাসমাত্রও নেই।

হঠাই জুলির মনে হলো কাল রাতে ঘুমের মধ্যে মনে হয়েছিল কেউ যেন ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছে। সত্যিই তেমন কিছু শুনেছিল কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারল না। ঠাকুরমশাই কি ভয় পেয়ে অমন চিৎকার করেছিলেন?

বেলা তখন দশটা। অন্যদিনের মতো জুলি বাড়ির কম্পাউন্ডের মধ্যে অলসভাবে ঘুরছিল। ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ল বাড়ির পিছন দিকে। এদিকেই এক পাশে সাহেবের ঘর। অন্য পাশে ঠাকুরমশাইয়ের। মনে পড়ল ঠাকুরমশাই আজই সকালবেলায় হঠাৎ নাটকীয়ভাবে চলে গিয়েছেন। ঠাকুরমশাইকে সে মোটেই দেখতে পারত না। কিন্তু লোকটা ঘর শূন্য করে দিয়ে চলে গেছে মনে হতেই জুলি কেমন বিমর্ষ হয়ে গেল। কী উদ্দেশ্যে বলা নেই কওয়া নেই। বাংলাদেশ থেকে এসে দিব্যি এখানে থেকে গেলেন তা যেমন জানা গেল না, তেমনি জানা গেল না হঠাৎ এমন কী ঘটল যে বলা নেই কওয়া নেই চলে গেলেন। এখানে আসার উদ্দেশ্য একটা হতে পারে–বাংলাদেশে হয়তো খাওয়া-পরার কষ্ট হচ্ছিল, তাই এপারে চলে এসে গুরুপুত্রের দোহাই দিয়ে কিছুকাল নিশ্চিন্তে থেকে যাওয়া। কিন্তু এমন করে কেন চলে গেলেন তার কোনো সদুত্তর জুলি খুঁজে পেল না।

এইসব কথা নিজের মনে ভাবতে ভাবতে সে যখন ঘুরছিল তখন হঠাৎ চোখে পড়ল সাহেবের খোলা জানলা দিয়ে দু-তিনটি কাক ঢুকে কী যেন মুখে করে আনছে। তাড়া দিতেই একটা কাকের মুখ থেকে যেটা পড়ে গেল সেটা দেখে জুলি বেশ অবাক হয়ে গেল।

এক টুকরো বড়ো কঁচা মাংস। মাংসের গায়ে রক্ত লেগে রয়েছে।

জুলি প্রথমে ভাবল সাহেব বোধহয় বেঁধে খাবে বলে মাংস কিনে এনে রেখেছিল। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো এ দুদিন তো সাহেবকে রাঁধতে দেখা যায়নি। একটা ছোটো স্টোভ আছে বটে তাতে চা করা যায় কিন্তু মাংস রাঁধা যায় না। তাছাড়া সাহেবের কাছে কড়াই, ডেকচি, হাঁড়ি, এসব আছে বলেও তো মনে হয় না। তাহলে? কাঁচা মাংস আনার কারণ কী?

ভাবতে ভাবতে জুলি বাড়ি এসে ঢুকল। আর ঐ চিন্তাটা মাথা থেকে চলে গেল।

সাহেব সকালেই কোথায় বেরিয়েছিল, এইমাত্র ফিরল একটা ইংরিজি খবরের কাগজ হতে করে। বাইরের ঘরে ছেলেমেয়েদের নিয়ে সুধীনবাবুকে বসে থাকতে দেখে সাহেব টুপি খুলে সবাইকে গুড মর্নিং জানাল।

সুধীনবাবু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, এত সকালে কোথায় বেরিয়েছিলে?

সাহেব বললে, একটা কাজ ছিল। এবার তো যেতে হবে। তাই কাজগুলো চুকিয়ে ফেলছি।

অভিজিৎ মনে মনে হাসল, কাজ যে কত তা জানতে বাকি নেই। পুরনো ভাঙাবাড়ি খুঁজে বেড়ানো। কত রকমের পাগলই না আছে!

জুলির মা এক কাপ কফি তৈরি করে নিয়ে এসে সাহেবের হাতে দিলেন। সাহেব হেসে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ।

মুশকিল হয় সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে গেলে। সে নিজে থেকে যদি কিছু বলে তাহলে শোনা যায়, কিন্তু কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে হয় উত্তর দেয় না, নইলে এলোমেলো উত্তর দেয়। যেমন জুলি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, সাহেব তুমি কি স্নান কর না? দুদিন তো তোমায় স্নান করতে দেখলাম না?

সাহেব উত্তরে বললে, তোমাদের এই জায়গাটা তোমাদের মতোই বড়োই সুন্দর। আমার খুব ভালো লেগেছে। যেখানে যাচ্ছি, সেখান থেকে যদি ফিরে আসতে পারি তাহলে আবার তোমাদের সঙ্গে দেখা করে যাব।

সুধীনবাবু বললেন, ধন্যবাদ। কিন্তু তুমি এখান থেকে কোথায় যাবে?

 সাহেব কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রইল। তারপর বলল, আমার যাওয়ার কি কোথাও ঠিক আছে, বাবু? আমি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছি। যা খুঁজছি তা এখনও পাইনি।

জুলি বলল, তাহলে তুমি ঠিক ট্যুরিস্ট নও। ট্যুরিস্টরা নানা জায়গা দেখবার জন্যেই ঘুরে বেড়ায়। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ঘোরে না। কিন্তু দেখছি তোমার ঘুরে বেড়াবার পেছনে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। তাই না?

সাহেব যেন ধরা পড়ে গেল। তাই গম্ভীরভাবে বলল, তা হয়তো ঠিক।

তোমার উদ্দেশ্যটা আমাদের কাছে বলতে বাধা আছে কি?

হ্যাঁ আছে। অবশ্যই আছে। আর আমার সম্বন্ধে বেশি কৌতূহলটা আমি মোটেই পছন্দ করি না। বলতে বলতে সাহেবের মুখটা চাপা রাগে লাল হয়ে গেল।

সাহেবের কাছ থেকে এইরকম উত্তর কেউই আশা করেনি। সবাই যেন গালে চড় খেলো।

হঠাৎ সাহেবের চোখে পড়ল দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবি। সে বসে বসেই ছবিটি দেখতে লাগল। তার মুখের ভাবের পরিবর্তন হলো। মুগ্ধ স্বরে বলে উঠল, বাঃ, চমৎকার ছবি তো!

বলতে বলতেই সাহেব গৃহকর্তার অনুমতি না নিয়েই ছবিটার কাছে উঠে গেল। তারপর গভীর মনোযোগের সঙ্গে ছবিটা দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে সাহেবের দুচোখ বড়ো বড়ো হয়ে উঠল, গা কঁপতে লাগল। উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করল, এ ছবি তোমরা কোথা থেকে পেয়েছ?

সাহেবের এইরকম উত্তেজনায় সকলেই চমকে উঠল। সুধীনবাবু ভয়ে ভয়ে বললেন, আমাদের একজন ফ্যামিলি ফ্রেন্ড এটা দিয়েছিল।

এ ছবি সে কোথায় পেয়েছিল?

সুধীনবাবুই উত্তর দিলেন, কলকাতার একটা পুরনো কাগজের দোকানে। বিলেতের একটা ইংরিজি ম্যাগাজিনে ছবিটা ছাপা হয়েছিল। ছবির সঙ্গে বাড়িটার ইতিহাসও ছিল। আনফচুনেটলি সেটা পাওয়া যায়নি। ছিঁড়ে গিয়েছিল।

ওঃ মাই গড! বলে সাহেব সেখানেই একটা চেয়ারে বসে পড়ল।

একটু পরে বলল, তোমরা কি প্লিজ তোমাদের সেই ফ্যামিলি ফ্রেন্ডের সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দেবে?

অভিজিৎ বলল, সরি সাহেব, হি ইজ নো মোর। সে আর বেঁচে নেই।

 মুহূর্তে ঘরটায় যেন শোকের ছায়া নেমে এল। সবাই চুপ করে রইল।

জুলিই প্রথমে নীরবতা ভাঙল। বলল, জান সাহেব, তোমার মতো সেও ছবিটা দেখে কেমন হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, ঐ বাড়িটা তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। তারপর সেই যে চলে গেল, আর ফিরল না। কোথায় কিভাবে মরল তা কে জানে!

সাহেব ভুরু কুঁচকে বলল, সে যে মরেছেই তার কোনো প্রমাণ পেয়েছ?

প্রমাণ? কাগজে কলমে প্রমাণ না পেলেও এমন কিছু প্রমাণ এ বাড়ির সকলেই পেয়েছে যা প্রকাশ করে বলা যায় না। সুধীনবাবু শুধু বললেন, বেঁচে থাকলে সে নিশ্চয় এতোদিনে ফিরে আসত।

সাহেব যেন নিজের মনেই বলল, যদি ঐ বাড়িতে গিয়ে থাকে তাহলে কোনোদিনই ফিরবে না। শয়তান ম্যাকবেথের হাত থেকে কারো নিষ্কৃতি নেই। প্রকাশ্যে বলবে, কিন্তু ছবির এই বাড়ি কোথায় তা সে জানবে কি করে?

জুলি ভুল করে ফেলল। বললে, ছবির এক কোণে ছেঁড়া ছেঁড়া কতকগুলো অক্ষর আছে। তাই থেকেই

ছেঁড়া ছেঁড়া অক্ষর? সাহেব লাফ দিয়ে উঠে ছবিটার কাছে গিয়ে অক্ষরগুলো দেখতে লাগল। তারপর হতাশ হয়ে বলল, না, কিছুই বুঝলাম না।

জুলি হেসে বলল, কিন্তু আমাদের সেই ফ্রেন্ডটি বুঝে নিয়েছিল। As for Assam, N for North…….ar for Kachar.

সাহেব উত্তেজনায় ছুটে এসে জুলির হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ থ্যাঙ্ক ইউ। জায়গাটার কত খোঁজ করেছিলাম–কোথায় না গিয়েছিলাম–পাহাড়ে, জঙ্গলে, নদীর ধারে ধারে। এমনও দিন গেছে, খেতে পাইনি, জন্তু মেরে কঁচা মাংস পর্যন্ত খেয়েছি। আজ সে জায়গার সন্ধান পেলাম।

বলতে বলতে হঠাৎ সে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। তারপর একটা কাঠের ছোটো বাক্স হাতে করে চেয়ারে এসে বসল, বাক্সটা খুলে একটা হলদে হয়ে যাওয়া জীর্ণ কাগজ বের করল। তাতে অনেক কিছুই লেখা। কাগজটা সবার সামনে টেবিলের ওপর রেখে বলল, বাড়িটার বর্ণনা এখানে পরিষ্কার দেওয়া আছে। তোমাদের এখানে এসে সেই বাড়ির ছবিটাই নিজের চোখে দেখলাম। কাগজের বর্ণনার সঙ্গে ছবিটা হুবহু মিলে যাচ্ছে। থ্যাঙ্ক ইউথ্যাঙ্ক

জুলি বলল, ও বাড়িতে কী আছে? ওখানে যেতেই বা চাইছ কেন?

সাহেব আবার রেগে উঠল। বলল, বেশি কৌতূহল ভালো নয় মিস। ওটা আমার পার্সোনাল ব্যাপার।

জুলি ঘাবড়াল না। বলল, আমাদের বললে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। ঐ বাড়িটা সম্বন্ধে আমাদের বন্ধুটিরও কৌতূহল ছিল। আর সেই কৌতূহল মেটাতে গিয়েই যে সে মরেছে তাতে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।

সাহেব বলল, হ্যাঁ, যদি সে সত্যিই সেখানে পৌঁছে থাকে তাহলে মরেছেই।

জুলি বলল, এই জন্যেই আমাদের কৌতূহল স্বাভাবিক। তাছাড়া একটু আগেই তুমি বলে ফেলেছ শয়তান ম্যাকবেথের হাত থেকে কারও নিষ্কৃতি নেই। যদি এতই গোপনীয় হয় তাহলে ও কথাটা বললে কেন?

জুলির কথায় সাহেব থমকে গেল। একটু ভেবে বলল, ম্যাকবেথের নাম শুনেছ কখনও?

জুলি বলল, তা শুনব না কেন? ম্যাকবেথ গ্রেট ড্রামাটিস্ট শেক্সপীয়রের একটা বিখ্যাত নাটকের নাম।

সাহেব অবাক হয়ে বলল, তুমি শেক্সপীয়র পড়েছে?

অবশ্যই। শুধু ম্যাকবেথ কেন? রিচার্ড দ্য সেকেন্ড, দ্য টেমপেস্ট, কিং লিয়ার, জুলিয়াস সিজার….কত বলব?

গোয়ালপাড়ার মতো একটা গ্রামের মেয়ে শেক্সপীয়রের এতগুলো বই পড়ে ফেলেছে জেনে সাহেব অবাক হলো। সেই সঙ্গে একটু নরমও হলো।

বলল, ম্যাকবেথকে তোমার কিরকম লাগে?

জুলি বলল, দুনিয়ায় যদি একশো জন লোভী, নিষ্ঠুর আর অকৃতজ্ঞ রাজা থাকে তাহলে ম্যাকবেথ তাদের মধ্যে এক নম্বর।

সাহেব বলল, শুধু লোভী আর অকৃতজ্ঞই নয়, লোকটা ছিল একটা পাক্কা শয়তান। অরণ্য অঞ্চলের এক নির্জন প্রান্তরে যে একদল ভয়ংকর দেখতে গালে দাড়ি ডাইনিরা ঘুরে বেড়াত তাদের সঙ্গে বোন সম্পর্ক পাতিয়ে ম্যাকবেথ তাদের ইচ্ছেতেই দেশের আর নিজেরও সর্বনাশ করেছিল।

জুলি বলল, অথচ ম্যাকবেথের মতো অতবড়ো বীর সেনাপতি যদি না সেদিন রাজা ডানকানের পাশে থাকত তাহলে কিছুতেই নরওয়ের রাজা সোনোর হাত থেকে স্কটল্যান্ডকে রক্ষা করতে পারত না।

থামো! হঠাৎ গর্জে উঠল সাহেব। তুমি দেখছি সেই শয়তানটারই গুণগান করে যাচ্ছ। রাজার আর একজন অতি বিশ্বস্ত বীর সেনাপতি ব্যাংকোর কথা তো বলছ না? আর ম্যাকবেথ যে এত বড়ো যোদ্ধা হয়ে উঠেছিল তা শুধু নিজের ক্ষমতায় নয়, ডাইনিদের মন্ত্ৰপড়া তরোয়ালটার জোরে। তরোয়ালটা সে এক মুহূর্তের জন্যে কাছছাড়া করত না।

জুলি তরোয়ালের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে হেসে বলল, তুমি মিথ্যে রাগ করছ। ম্যাকবেথের কথা তুললে বলেই ম্যাকবেথের কথা বলছিলাম। নইলে ব্যাংকোকে কি উপেক্ষা করতে পারি? আমার তো মনে হয় ম্যাকবেথ নাটকে ব্যাংকোর মতো অত ভালো, অত বিশ্বস্ত, অত হতভাগ্য চরিত্র দুটি নেই।

সাহেব আবার নরম হলো। বলতে লাগল, একবার সেই দৃশ্যটা কল্পনা করো মিস, ম্যাকবেথ আর ব্যাংকোর নেতৃত্বে একদিকে ডানকান-বাহিনী, অন্যদিকে বিদ্রোহী ম্যাকডোনাল্ড আর স্যেনোর নরওয়ে বাহিনী। ফাইডের আকাশ শুধু ঘোড়ার খুরের ধুলোয় ধুলোয় অন্ধকার–বিস্তীর্ণ প্রান্তর রক্তে রক্তাক্ত! সেই অসম্ভব যুদ্ধে জয়ী হলো ঐ ম্যাকবেথটা আর সকলের প্রিয় ব্যাংকো। তারপর

জুলি বলল, তারপর ম্যাকবেথ ফের দেখা করল সেই ছাগলদাড়ি ডাইনি বোনদের সঙ্গে। তারা মুখ টিপে হেসে ম্যাকবেথকে বললে, এবার তুমি রাজা হবে।

ম্যাকবেথ অবাক হয়ে বললে, আমি রাজা হব! কী করে তা সম্ভব? আমি তো সামান্য সেনাপতি। তাছাড়া মহামান্য, মহাপ্রাণ রাজা ডানকানের নিজেরই তো ছেলে আছে।

ডাইনিরা তাকে মন্ত্রণা দিল, একটু বুদ্ধি খরচ করে চেষ্টা করলেই হবে। বলেই ডাইনিরা অদৃশ্য হয়ে গেল।

সাহেব বলে উঠল, আর মনে করে দেখো তখনই ব্যাংকো বন্ধুকে পরামর্শ দিয়েছিল– সাবধান! ডাইনিদের কথায় ভুলো না বন্ধু।

কিন্তু ততক্ষণে ম্যাকবেথের মনে রাজা হবার লোভ জেগে উঠেছে।

জুলি বলল, রাজা ডানকান ম্যাকবেথের ওপর খুশি হয়ে তাকে অন্য একটি জায়গায়– আহা কী যেন নাম–

সাহেব বলল, কডর!

হ্যাঁ, কডরের অধিপতি করে দিলেন। আর সেই অকৃতজ্ঞ লোকটা গোটা স্কটল্যান্ডের রাজা হবার লোভে শেষ পর্যন্ত নিজের হাতে খুন করল রাজা ডানকানকে।

তারপর–তারপর বলো। উত্তেজিত হয়ে উঠল সাহেব। তারপর কী করল শয়তানটা? যেহেতু ব্যাংকো বলেছিল, বন্ধু, ডাইনিদের কথা শুনো না, সেই কারণে ম্যাকবেথ ভাবল ব্যাংকো বুঝি তার সৌভাগ্যে হিংসে করছে, তাই একদিন রাতে, বন্ধুকে নেমন্তন্ন করে ডেকে মাঝপথে লোক লাগিয়ে খুন করে দিলে।–বলতে বলতে সাহেব পাগলের মতো চেঁচিয়ে উঠল, এই অপরাধের কি কোনো ক্ষমা আছে?

জুলি বলল, সে তো জনসাধারণের হাতে ক্ষমা পায়নি। সেও তো খুন হলো।

সাহেব বলল, খুন হয়ে সে কি মনে করেছে পাঁচশো বছর ধরে দিব্যি নিশ্চিন্তে কবরের মধ্যে ঘুমোবে? না, তা হতে দেব না।

সাহেবের এ কথায় সকলেই অবাক হয়ে গেল। এ তো বদ্ধ পাগলের মতো কথা! যে মৃত–কবরের মধ্যে যার হাড়গুলো পর্যন্ত ধুলো হয়ে গেছে, তার ওপর আজ কী প্রতিশোধ নেবে? কেনই বা অতি তুচ্ছ অতি সাধারণ স্কটল্যান্ডবাসী একটা আধপাগলা সাহেব প্রতিশোধ নিতে যাবে?

সে কথাটাও সাহেব ধীরে ধীরে পরিষ্কার করে দিল।

একবার উঠে নিজের ঘরে গেল। তারপর সেই মস্ত পোঁটলা থেকে বের করে আনল পেতলের একটা ছোট্ট ক্যাশবাক্স।

জুলি দেখল ক্যাশবাক্সটার দু হ্যাঁন্ডেলে মোটা সুতো বাঁধা। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এরকম সুতো বাঁধা কেন?

সাহেব গম্ভীরভাবে বলল, আমার পোঁটলার গায়ে এটা সেফটিপিন দিয়ে লাগানো থাকে। বলা তো যায় না কখন কে এটা তুলে নেয়।

কী অমূল্য রত্ন আছে এর মধ্যে? ঠাট্টা করে বলল জুলি।

সেটা দেখাবার জন্যেই তো নিয়ে এলাম। বলে খুব যত্ন করে ক্যাশবাক্সর ডালাটা খুলে তার মধ্যে থেকে একটা শক্ত কাগজের খাম বের করল। তার মধ্যে থেকে বেরুল ঠিকুজি কুষ্টির মতো পাকানো একটা কাগজ। সাহেব গম্ভীর গলায় বলল, আজ পর্যন্ত বাইরের কাউকে আমার সত্যিকার পরিচয় দিইনি। আজ তোমাদের কাছে তাই দেব।

এই পর্যন্ত বলে সাহেব কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, আমি হচ্ছি গ্রেট ব্যাংকোর একমাত্র বংশধর।

এই বলেই সে পাকানো কাগজটা সবার সামনে খুলে দেখাল।

এমন একটা অদ্ভুত কথা শোনার জন্যে কেউই প্রস্তুত ছিল না। সবাই ঝুঁকে পড়ল কাগজটার ওপর। খুব ছোটো ছোটো জড়ানো অক্ষরে অনেকগুলো নামের তালিকা। পড়ার সাধ্য কারো নেই। সাহেব গর্বভরে বললে, এরা সব আমার পূর্বপুরুষ।

জুলি কিছুমাত্র ইতস্তত না করে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ আমি তো তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না।

সাহেব বললে, না বুঝতে পারার কারণ কী? আমি যে মহামান্য বীর ব্যাংকোর বংশধর তার প্রমাণ তো দেখালাম।

জুলি বলল, কিন্তু সাহেবদাদা, ব্যাংকো বলে সত্যিই কি কেউ ছিল? কবিরা ঐরকম কত চরিত্র কল্পনায় সৃষ্টি করে থাকেন।

কখনোই না। পোয়েটগ্রা যা কিছুই সৃষ্টি করে তার অনেকখানিই সত্য। শেক্সপীয়রের অন্য নাটকগুলোর মধ্যে রিচার্ড দ্য সেকেন্ড, জুলিয়াস সিজার, কিং লিয়ার, কিং জন কি সত্যি সত্যি ছিলেন না। কাজেই প্লিজ বাজে তর্ক কোরো না। আমি যে ব্যাংকোর বংশধর তা বিশ্বাস করতে চাও কোরো, না হলে কোরো না। তাতে আমার কিছু আসে যায় না। বলে রাগে গোঁজ হয়ে বসে রইল।

সুধীনবাবু বললেন, বেশ, আমরা মানলাম তুমি সেই ব্যাংকোরই বংশধর। কিন্তু তুমি যে বললে, এতকাল পর ম্যাকবেথের ওপর প্রতিশোধ নেবে, কী করে তা সম্ভব?

অভিজিৎ এতক্ষণ মুখ টিপে হাসতে হাসতে সাহেবের পাগলামির কথা শুনছিল। এবার বলল, তুমি কি মনে কর সাহেব, ম্যাকবেথের মৃতদেহ স্কটল্যান্ডে সমাধি না দিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে আসামে সমাধি দিতে এসেছিল?

ও নো নো মাই ডিয়ার–আমি ম্যাকবেথের ডেডবডির কথা তো বলিনি।

তাহলে ঐ বাড়িতে কী আছে? কি জন্যে ওখানে যেতে চাইছ? কোনো গুপ্তধন?

আই হেট মানি। ধন-দৌলতকে আমি ঘৃণা করি। দেখবে আমার কত টাকা? বলে সাহেব তার লম্বা কোটের–যে কোটটা সে কখনও ছাড়ে না–পকেটে হাত ঢোকাচ্ছিল, অভিজিৎ বলল, থাক। দেখাবার দরকার নেই। আমরা জানি তোমার অনেক টাকা। তুমি শুধু বলো ঐ বাড়িতে কী আছে।

সাহেব এদিক থেকে ওদিক বার দুই মাথা নেড়ে বলল, সে কথা আমি কিছুতেই বলব না। এইটুকু শুধু বলতে পারি, ঐ বাড়ির মধ্যে সুরক্ষিত ভাবে যে জিনিসটি আছে তার খোঁজে পাঁচশো বছর ধরে কত দেশের কত মানুষ পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছে। কেউ তার ট্রেস পায়নি। পেয়েছি শুধু আমি। এই–এই দ্যাখো সেইসব পুরনো পুঁথি–বই।

সবাই ঝুঁকে পড়ল। কিন্তু সেই দুর্বোধ্য লাতিন ভাষা কেউ বুঝতে পারল না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। কেউ কথা বলছে না। জুলি আর অভিজিৎ লুকিয়ে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে হাসছে। আর সাহেব একটা পায়ের ওপর অন্য পা-টা তুলে হাতের ওপর থুতনি রেখে কী যেন ভাবছে।

এবার তাহলে কি করবে? জিজ্ঞেস করলেন সুধীনবাবু।

 সাহেব মনে মনে বোধহয় সেই রহস্যময় বাড়িতে চলে গিয়েছিল। চমক ভাঙল। বললে, আঁ, কি করব? কালই এখান থেকে স্টার্ট করব।

একটু থেমে বলল–এখানে তোমাদের ভালো ব্যবহারের কথা কোনোদিন ভুলব না। আমি স্কচ। যে উপকার করে সে যে দেশের মানুষই হোক তার ওপর কৃতজ্ঞ থাকাই আমাদের ধর্ম। তোমরা প্রত্যেকেই ভেরি গুড। তবে

তবে কি? জুলি জিজ্ঞেস করল।

শুনলে তোমরা দুঃখ পাবে, আমার ঘরের সামনেই যে লোকটি ছিল সে মোটেই ভালো লোক নয়। আমার সম্বন্ধে তার বড্ড বেশি কৌতূহল ছিল। জানই তো বেশি কৌতূহল আমি মোটেই পছন্দ করি না। এই পর্যন্ত বলে সাহেব হঠাৎ থেমে গেল। বলল, ভাবছি কাল সকালেই আমি যাব।

অভিজিৎ হঠাৎ নরম গলায় বলল, সাহেব, একটা রিকোয়েস্ট করব। রাখবে?

 সাহেব কথা না বলে অভিজিৎ-এর দিকে তাকাল।

তুমি যদি আমাকে সঙ্গে নাও তাহলে আমি বড়োই খুশি হই। আর সেই সঙ্গে

কথা শেষ করতে না দিয়েই সাহেব রেগে উঠে বলল, no! আমি কাউকে সঙ্গে নেব না।

অভিজিৎ রাগল না। বলল, সঙ্গে নিতে আপত্তি কী? আমি তো ঐ বাড়িটার ধারে কাছে যাব না। শুধু তোমার সঙ্গে গিয়ে অসমটা দেখা নেওয়া আর কি?

সঙ্গে সঙ্গে জুলি বলে উঠল, হা সাহেব, প্লিজ আপত্তি কোরো না। আমিও তাহলে দাদার সঙ্গে যাব।

সাহেব গম্ভীর গলায় বলল, তোমরা ছেলেমানুষি করছ। যে জায়গার খোঁজে আমি একা একা কত বছর ধরে ঘুরে বেড়িয়েছি, আজ আমি সঙ্গে করে কাউকে নিয়ে যেতে পারি ভাবলে কী করে? সে গোপন জায়গার খোঁজ আমি কাউকে দেব না। এমনকি ওখানে পৌঁছে যদি তোমাদের সেই ফ্যামিলি ফ্রেন্ডকেও দেখতে পাই তাহলে তাকেও তখুনি মরতে হবে। হ্যাঁ, আমার হাতেই মরতে হবে। আমার ক্ষমতা কতখানি তা জান না। আমার পথে বাধা দিতে এসেছিল তিনজন। তিনজনকেই আমি এইভাবে গলা টিপে শেষ করে দিয়েছি। বলে দুহাত তুলে মোটামোটা আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিল।

জুলির মা আঁৎকে উঠলেন।

জুলি বলল, আমরা তোমায় কথা দিচ্ছি যদি ঐ বাড়ি তুমি খুঁজে পাও তাহলে তার ত্রিসীমানাতেই আমরা যাব না। কারণ ঐ বাড়িতে কী আছে আমরা জানি না, জানবার কৌতূহলও নেই।

জুলির কথায় সাহেব একটু নরম হলো। বলল, তাহলে সেই ভয়ংকর জঙ্গলে তোমরা যেতে চাইছ কেন?

অভিজিৎ বলল, শুধু জায়গাটা দেখবো।

জুলি বলল, দেখ সাহেব, তুমি অনেক জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত ঘুরেছ। তোমার সঙ্গে আমরা যদি কদিন থাকতে পারি তাহলে তোমার কাছ থেকে কত গল্প শুনতে পাব। সেটাই আমাদের লাভ। তাছাড়াজুলি একটু থামল।

সাহেব তাকাল।

তাছাড়া এই দুদিনেই তুমিও আমাদের ফ্যামিলির একজন হয়ে গেছ। তোমার সঙ্গে গেলে আমাদের এতটুকু ভয় করবে না।

সাহেব অনেকক্ষণ চুপ করে কী ভাবল। তারপর বলল, বেশ, নিয়ে যাব। কিন্তু কতকগুলো কডিশান আছে।

কী শর্ত বলো।

 সাহেব বলতে লাগল, প্রথমত সেখানে আমি যেখানে থাকব সেখানে তোমরা থাকবে না।

বেশ রাজি।

 দ্বিতীয়ত আমার কাজে কোনো কৌতূহল দেখাবে না। আমি কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি সেদিকে তাকাবে না। সেখানে তোমরা অসুখে পড়লে বা বিপদে পড়লেও আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াব না।

ঠিক আছে। ওখানে আমরা ইনডিপেন্ডন্টলি নিজের নিজের মতো থাকব।

থার্ডলি, তোমরা নিজেরা ইচ্ছে মতো ফিরে আসবে। আমি কবে ফিরব, না ফিরব, কোনদিক দিয়ে ফিরব সে আমার ব্যাপার।

অভিজিৎ বলল, হ্যাঁ অবশ্যই।

ফোর্থলি, আমি আবার বলছি, যদি দেখি তোমরা আমায় ফলো করছ তাহলে তার পরিণতির জন্যে তোমরা দায়ী থাকবে।

হ্যাঁ। রাজি।

ফিফথলি, খরচ সব তোমাদের। তোমাদের জন্যে আমি একটা রুপিও খরচ করব না।

জুলি আর অভিজিৎ দুজনেই হেসে উঠল। বলল, ওর জন্যে ভেবো না সাহেব। আমরা বেগার (begger) নই।

.

খুব বিরক্ত হয়েই সাহেব ওদের নিয়ে অসমের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেল। ওরা চলে গেল আর পরের দিনই কলকাতা থেকে এল গুরুদেবের ছেলের চিঠি। লিখেছে, প্রথমেই জানাই কয়েক দিনের জন্যে কলকাতায় এসেছি। তারপর বাংলাদেশে চলে যাব। পরে জানাই ঐ ভাবে হঠাৎ চলে আসায় আপনারা নিশ্চয় অবাক হয়েছেন। আমার অভদ্রতাও হয়েছে। স্বীকার করি। কিন্তু কেন ঐভাবে চলে আসতে হলো সে কথা সেদিন বলতে ভরসা পাইনি বিশেষ করে আপনার মেয়ের সামনে। আপনার মেয়ে আমাকে দুচক্ষে দেখতে পারে না, অপমান করে। আমার অপরাধ কী, না আমি বলেছিলাম আপনাদের বাড়িতে প্রেতাত্মার যাওয়া আসা আছে। সেই কারণে আপনাদেরই মঙ্গলের জন্যে যজ্ঞশান্তি করতে চেয়েছিলাম। আপনারা আমার কথা তো বিশ্বাস করেনইনি, উল্টে আপনার মেয়ে আমাকে যথেচ্ছ অপমান করে। সেইজন্যেই কী কারণে চলে আসতে হলো বলতে চাইনি। আজ বলছি।

ঐ সাহেবটি আসার পর থেকেই ওর ওপর আমার সন্দেহ হয়। লোকটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। আমার সামনাসামনি ঘর। তাই লক্ষ্য রাখতে লাগলাম। এই গরমেও দুদিনের মধ্যে ওকে স্নান করতে দেখিনি। প্যান্ট-জামা ছাড়তে দেখিনি, কোনোদিন রান্না করতে দেখিনি। শুনেছিলাম ও নাকি বাইরে থেকে খেয়ে আসে। বাইরে থেকে খেয়ে আসে কেন? আপনাদের বাড়িতে তো আদর-যত্নর ত্রুটি নেই। আমি তো আপনাদের কাছে বেশ কয়েকদিন থেকে সেই কথাটাই বুঝে গেলাম। তবে কেন সাহেব খেতে চাইত না?

সেদিন রাত তখন এগারোটা হবে। সাহেবের ঘরে খুটখাট শব্দ হচ্ছিল। ভাবলাম এত রাতে সাহেব কী করছে দেখি তো? উঁকি মেরে দেখলাম সাহেবের ঘরের দরজা ঠেসানো। অন্যদিন ঘরে ঢুকেই খিল দিয়ে দেয়। আজ বোধহয় খিল দিতে ভুলে গেছে। খুব কৌতূহল হলো। পা টিপে টিপে ওর দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজাটা সাবধানে ফাঁক করলাম। অমনি যে দৃশ্য আমার চোখে পড়ল তা দেখে আঁৎকে উঠলাম। দেখলাম সাহেব দুহাতে করে বড়ো বড়ো কাঁচা মাংসের টুকরো খাচ্ছে। মাংসের রক্ত ওর দুকষ বেয়ে গড়াচ্ছে। আর ঠিক তখনই সাহেব আমাকে দেখে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ও সেই রক্তমাখা হাত তুলে মোটা মোটা আঙুলগুলো ফাঁক করে আমার গলা টিপে ধরতে এগিয়ে এল। আমি ভয়ে বারে বলে চিৎকার করে ছুটে ঘরে গিয়ে খিল দিয়ে দিলাম।

এই হলো ব্যাপার। আমি নিশ্চিত ও মানুষ নয়– রাক্ষস কিংবা দানব কিংবা পিশাচ। আপনাদের আবার সাবধান করে দিলাম। যত শীঘ্র পারেন ওকে তাড়ান। নইলে পুলিশে দিন। নতুবা বিপদে পড়বেন…

চিঠি পড়ে সুধীনবাবু অবাক। জুলির মাও পড়লেন। এ কী সম্ভব? লোকটা একটু পাগলাটে আছে ঠিকই কিন্তু ঠাকুরমশাই যা বলছেন তা সত্যি হলে তো মারাত্মক ব্যাপার। আর এই লোকের সঙ্গে ওঁর ছেলেমেয়ে দুটো অজানা অচেনা জায়গায় গেল! কোনো ঠিকানা পর্যন্ত নেই! এখন তো ওদের সাবধান করে দেবারও উপায় নেই। তাহলে? গভীর দুশ্চিন্তায় পড়লেন সুধীনবাবু আর তাঁর স্ত্রী।

.

ম্যাকবেথের তরোয়াল

গভীর বন আর পাহাড়ে ঘেরা অসমের এই অঞ্চলটা। চারিদিকে যেন সবুজের মেলা। অসমের একটি জেলা এই উত্তর কাছাড়। পার্বত্য জেলাটির সদর শহর হাফলং। সামনে হেমপেট্রপেট পাহাড়। দক্ষিণ প্রান্তে বরাইল পর্বতশ্রেণী। মাঠে মাঠে কমলা, আনারস, আর পানের চাষ।

একশো বছরেরও আগে এইসব জনবসতিহীন দুর্ভেদ্য জঙ্গলে বড়ো বড়ো মশা, জোঁক, বিষধর সাপ, হিংস্র দাঁতাল শুয়োর, চিতা আর বুনো হাতির পালের সঙ্গে লড়াই করে জীবনের বড়ো রকমের ঝুঁকি নিয়ে কিছু সাহেব সুদূর ইংলন্ড থেকে এখানে এসেছিল চা-বাগান করতে। তাদের সে প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। অসমের চা-বাগানের চা-এর নাম আজ ভারতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে।

ট্রেন, বাস, কখনও দুর্গম জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বিষাক্ত সাপ আর রক্তচোষা জোঁকের হাত থেকে বাঁচতে বাঁচতে ওরা এক জায়গায় এসে দাঁড়াল। জায়গাটার নাম বোধ হয় দামছাড়া। দুর্গম জঙ্গলে ঢাকা এই দামছাড়া গ্রাম।

সারা পথে সাহেব দূরে দূরে ছিল। ট্রেনে ছিল অন্য কমপার্টমেন্টে। একটি কথাও বলেনি। অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে ছিল। এমন ভাব যেন এদের চেনেই না। তার জন্যে জুলিরা কিছু মনে করেনি। তারা ছিল নতুন জায়গা দেখার আনন্দে বিভোর হয়ে।

এইবার তারা তিনজনে এসে দাঁড়াল একটা ছোটো টিলার ওপরে।

এতক্ষণে সাহেব কাঁধ থেকে পোঁটলাটা নামিয়ে রেখে কথা বলল।

 এখান থেকেই আমরা আলাদা হয়ে যাব।

কিন্তু আমরা থাকব কোথায়?

সাহেব বলল, সেটা তোমরাই ঠিক করবে। তোমরা কোথায় থাকবে তার ব্যবস্থা করা আমার কথা নয়। তবু আমি তোমাদের হেলপ করছি–সোজা চলে যাও কিছু দূর। আমি শিলচরে নেমে জেনে নিয়েছি, বেশ কিছু দূরে লারসিংগার চা-বাগান। সেখানে একটা বাংলো আছে। সেখানেই থাকার ব্যবস্থা করে নাও।

আর তুমি?

সাহেব মুখ কঠিন করে বলল, শর্ত মেনে চলো, নইলে আমার হাতেই বিপদে পড়বে।

অভিজিৎ বলল, সরি সাহেব। তুমি যেখানে খুশি যাও। আর কোনো কথা জিজ্ঞেস করব না।

সাহেব তখনই টিলা থেকে নেমে চলে যাচ্ছিল, জুলি ব্যস্ত হয়ে ডাকল, সাহেব।

সাহেব ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল।

তোমার পোঁটলাটা ফেলে যাচ্ছ।

ওটার আর দরকার নেই।

 জুলি অবাক হয়ে বলল, সে কী! এতেই যে তোমার সব আছে।

সাহেব এবার পায়ে পায়ে এগিয়ে এল এদের কাছে। বলল, হ্যাঁ, এতে আমার অনেক কিছু আছে। কিন্তু তার আর দরকার নেই। আমি ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেছি। শুধু সেই বাড়িটা খুঁজে বার করা বাকি। সে বাড়িতে ঢুকতে গেলে কোনো বাড়তি বোঝা নিয়ে ঢাকা যাবে না।

সাহেবের সব কথাই বরাবর অদ্ভুত। এ কথাটা শুনেও তারা অবাক হয়ে গেল।

সাহেব তার বড়ো হলদে বিশ্রী দাঁতগুলো বের করল। বোধহয় হাসবার চেষ্টা করল। তোমরা কিছু জানতে চেয়েছিলে, তা আগে বলিনি। এখন বলতে পারি। কারণ এই মুহূর্তে নির্জন এই টিলার চারিদিকে জনমানবের চিহ্ন নেই। তোমাদের সঙ্গে আমার আর দেখাও হবে না। কলকাতায় ফিরে তোমরা যদি গোপন জিনিসটির কথা ফাঁস করেও দাও তাহলেও আমার ক্ষতি নেই। ততক্ষণে সেই মহামূল্য জিনিসটি আমার মুঠোয় চলে আসবে।

কী সেই মহামূল্য জিনিসটি বলবে কি? জিজ্ঞেস করল অভিজিৎ।

 শয়তান ম্যাকবেথের মন্ত্রপূত তরোয়াল।

ম্যাকবেথের তরোয়াল! সে তো কবেকার কাহিনি। যদি ম্যাকবেথ নামে সত্যিই কেউ থেকেও থাকে তাহলে তার তরোয়াল এতদিন পর

হ্যাঁ, সম্ভব। ভুলে যেও না এটা ছিল ডাইনিদের মন্ত্রপূত তরোয়াল। ঐ তরোয়াল যার মুঠোয় থাকবে, পৃথিবীতে কোনো শক্তি তাকে মারতে পারবে না। সে তরোয়াল কোনোদিনই নষ্ট হবে না।

জুলি জিজ্ঞেস করল, তাহলে জনতার হাতে ম্যাকবেথ মরল কি করে?

সাহেব বলল, তার আগে তার তরোয়ালটা চুরি করে অন্য তরোয়াল রাখা হয়েছিল। নিরুপায় শয়তানটা নিজের তরোয়াল না পেয়ে বাধ্য হয়ে অন্য তরোয়াল নিয়ে লড়াই করেছিল। তাই তাকে খুব সহজেই মরতে হয়েছিল।

জুলি অবাক হয়ে বললে, আমি খুব ভালো করে শেক্সপীয়র পড়েছি। এসব তো লেখা নেই।

কোনো বইয়েতেই লেখা নেই। আছে শুধু আমার কাছে পুরনো পুঁথিতে। নইলে অকারণে জীবনের সুখ, ঐশ্বর্য, আনন্দ ছেড়ে সেই স্কটল্যান্ড থেকে অসমের এই জঙ্গলে ছুটে আসি?

তুমি কি বলতে চাইছ ম্যাকবেথের সেই তরোয়াল ঐ রহস্যময় বাড়িতেই আছে?

হ্যাঁ, আমার পুঁথি তাই বলছে। আর পুরনো দুষ্প্রাপ্য পুঁথি মিথ্যে বলে না।

জুলি বলল, কিন্তু ম্যাকবেথকে মাটি দেওয়া হলো তার দেশে আর তার তরোয়াল পড়ে রইল অসমে। এ তো অবাক কাণ্ড।

সাহেব বলল, অবাক হবার কিছু নেই। ম্যাকবেথের তরোয়াল আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তারপর তা একজনের হাত থেকে অন্যজনের হাতে হাতে ঘোরে। সে তরোয়াল যোগ্য লোক ছাড়া যার হাতেই যায় তার সর্বনাশ হয়। শেষ পর্যন্ত তোমাদের এই ভারতবর্ষের কোনো সাধুই একজন পাদ্রীকে বলে দেয়, এই তরোয়ালের হাত থেকে বাঁচতে হলে কোথাও গোপনে লুকিয়ে রাখো।

অভিজিৎ বলল, কেন, তরোয়ালটা ভেঙে ফেলে দিলেই হতো?

সাহেব বলল, ও তরোয়াল ভাঙা যায় না, আগুনে পোড়ে না, সমুদ্রে ডোবে না। তাই পাদ্রীর নির্দেশে এটাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। আর ম্যাকবেথের প্রেতাত্মা তার প্রিয় তরোয়ালটিকে আগলে রাখার জন্যে সেই বাড়িতেই আজও রয়েছে। বহুকাল পর আমি আর একবার সেই শয়তানটার মুখোমুখি হতে চাই।

জুলি বলল, তরোয়ালটা যে রাখবে তারই যদি সর্বনাশ হয় তাহলে কোন সাহসে সেটা নিতে চাইছ? ম্যাকবেথের প্রেতাত্মাও কি সহজে তোমায় নিতে দেবে?

দেবে না তা জানি। তবু ম্যাকবেথের সঙ্গে আমাকে শেষ লড়াই করতেই হবে। দেখব আজ সে কি করে আমায় খতম করে। পথের মাঝে অন্ধকারে একলা পেয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করা এক কথা আর মুখোমুখি লড়াই করা অন্য কথা।

এ কথা শুনে জুলি চমকে উঠল। বলে কী লোকটা? অন্ধকারে একলা পেয়ে তোক লাগিয়ে কাকে খুন করিয়েছিল ম্যাকবেথ? সে তো আর এক মহযোদ্ধা রাজা ডানকানের সেনাপতি, ম্যাকবেথেরই একান্ত বন্ধু ব্যাংকোকে!

মুখে বলল, তুমি কার কথা বলছ সাহেব? বইয়েতে পড়েছি ম্যাকবেথ তো ঐভাবে মেরেছিল তারই বন্ধু ব্যাংকোকে?

হ্যাঁ, সেই ব্যাংকোকেই আজ প্রতিশোধ নেবার জন্যে এতদূর ছুটে আসতে হয়েছে মানুষের রূপ ধরে। যদি ম্যাকবেথের দেখা পাওয়া যায় ভালো। লড়াই হবে। যদি দেখা না হয় তার তরোয়ালটা নিয়ে আসব। এইভাবেই প্রতিশোধ

বলতে বলতে হঠাৎ সাহেবের সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে উঠল। তারপর সে যেন কেমন অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হয়ে গেল। তারপর টিলা থেকে নেমে সামনের গভীর জঙ্গলে মিশে গেল।

স্তম্ভিত জুলি কঁপা কাঁপা গলায় বলল, কী দেখলাম রে দাদা? স্বচক্ষেই তো দেখলাম।

অভিজিৎ বললে, এখানে আর এক মুহূর্ত নয়। সন্ধে হয়ে আসছে। তার আগেই বাংলোটা খুঁজে বার করতে হবে।

.

রহস্যপুরী

ব্যাপারটা তাহলে কী হলো? বাংলোর একটা ঘরে বসে জিজ্ঞেস করল জুলি।

ঠিক বুঝতে পারলাম না। কেমন ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল অভিজিৎ।

এই কদিন যে সাহেবটার সঙ্গে এত মিশলাম, এত কথা বললাম, সে তাহলে মানুষই নয়?

অভিজিৎ বলল, তাই তো দেখলাম। কিন্তু এও কি বিশ্বাস করতে হবে? বিশ্বাস করতে হবে একটা জলজ্যান্ত ভূতের সঙ্গে গোয়ালপাড়ায় বাস করেছি? তারই সঙ্গে অজানা অচেনা অসমের এই জঙ্গলে বেড়াতে এসেছি?

শুধু ভূতই নয় দাদা, বলে গেল সে নাকি নিজেই ব্যাংকো! অথচ এর আগে আমাদের বুঝিয়েছে সে ব্যাংকের বংশধর!

যাই হোক এই অসম্ভব ঘটনা জীবনে কোনোদিন ভুলব না।

আসল অসমের চায়ের লিকার থেকে চমৎকার গন্ধ বেরোচ্ছিল। পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে অভিজিৎ বলল, আর এখানে থেকে কী লাভ? চল কালই আমরা বাড়ি ফিরে যাই।

জুলি বলল, বাঃরে! এত খরচ করে এখানে এলাম। কিছু না দেখেই ফিরে যাব? এখানে আসার উৎসাহ তোরই তো বেশি ছিল।

তা ছিল। কিন্তু সাহেবের ঘটনা দেখার পরই মনটা কিরকম হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এখানে আর না থাকাই ভালো।

দাদা, তুই একজন ইয়ং সাংবাদিক! খবর খোঁজার জন্যে কোথায় না যেতে হয় তোকে, অ্যাডভেঞ্চার করতে ভালোবাসিস–তুই কিনা ভয় পেয়ে কালই ফিরে যেতে চাইছিস? আমিও তো তোর পাশে দাঁড়িয়ে ঐ দৃশ্য দেখলাম। কই আমার তো ভয় করছে না? আমি ঠিক করে ফেলেছি, টাকা-পয়সা খরচ করে যখন এতদূর এসেছি, দুদিন ঘুরে বেড়িয়ে তবে ফিরব। চা-টা কী ফার্স্টক্লাস–দাঁড়া বাবুর্চি রাতে কী খাওয়াবে খোঁজ নিয়ে আসি।

বাংলোটা এমনিতে ভালোই। তবে বড় নিরিবিলি। বাংলোর মাঝখান দিয়ে চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলার বারান্দা পর্যন্ত। বারান্দার একপাশ ঘেঁষে সার সার রুম। বেশির ভাগ ঘরই ফাঁকা। নিচে ছোটো ঘরে থাকে বয়-বাবুর্চি-কেয়ারটেকাররা। বাড়ির তিন দিকে গা ছমছম করা ঘন জঙ্গল। দূরে পাহাড়ের হাতছানি।

এত অল্প লোক কেন জিজ্ঞেস করায় বুড়ো কেয়ারটেকার বলল, এখন তো অফ সিজন। অগস্ট থেকে অক্টোবর মেঘ, বৃষ্টি, কুয়াশা আর দুর্যোগের সময়। যখন জাটিঙ্গা উপত্যকায় গভীর রাতে ঝাঁকে ঝুঁকে পাখি এসে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে সেই রহস্যময় দৃশ্য দেখার জন্য কিছু টুরিস্ট আসে এখানে।

জুলি কলকাতায় মামার বাড়িতে জাটিঙ্গার পাখিদের দলে দলে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মরার রহস্যজনক কাহিনি শুনেছিল। কিন্তু এটা তার কাছে নতুন কিছু বলে মনে হয়নি। আমাদের দেশেও কার্তিক মাসে দেওয়ালি পোকারা আলো দেখলেই কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে ঝাঁপ দিয়ে মরে। সেও তো এক রহস্য!

তবু জায়গাটা একবার দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সে তো অক্টোবর মাসের ব্যাপার।

 বুড়ো কেয়ারটেকারের সঙ্গে জুলি খুব তাড়াতাড়ি ভাব জমিয়ে ফেলল। কোথায় কী দেখবার আছে তাও জেনে নিল। কেয়ারটেকার সবশেষে বলল, বেশি জঙ্গলে আর্মস ছাড়া না যাওয়াই ভালো।

রাত নটার মধ্যে গরম গরম মাংস ভাত খেয়ে ওরা শুয়ে পড়ল। পাশাপাশি দুটো সিঙ্গল সিটেড রুম ওরা পেয়ে গেছে। দুজনেই খুব খুশি। বেশ যে যার মতো থাকতে পারবে।

রাত দশটা বাজল। চারিদিক স্তব্ধ নিঝুম। জুলি রাতের পোশাক পরে আলো নিভিয়ে মশারির মধ্যে ঢুকে গেল। মাথার কাছে রাখল টর্চটা। কি মনে হলো আবার উঠল। তারপর অ্যাটাচড় বাথরুমটা ভালো করে দেখে নিয়ে আবার শুয়ে পড়ল।

দাদা, ঘুমিয়ে পড়েছিস নাকি? শুয়ে শুয়েই জুলি জিজ্ঞেস করল।

 পাশের ঘর থেকে অভিজিৎ উত্তর দিলো, না। নতুন জায়গা। ঘুম আসছে না।

বাথরুমটা ভালো করে দেখেছিস?

হ্যাঁ। টর্চটা হাতের কাছে রাখিস।

 একেবারে বালিশের পাশে রেখেছি। তুই ভোরবেলা বেরোবি নাকি?

অভিজিৎ বলল, পাগল! ভোরবেলাতেই তো আসল ঘুম। বলতে বলতে সে যে হাই তুলল সে শব্দটুকুও শোনা গেল।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জুলি টের পায়নি। হঠাৎ একসময়ে ঘুমটা ভেঙে গেল। টর্চ জ্বেলে ঘড়িটা দেখল। রাত দুটো। এরকম মাঝরাতে তার ঘুম ভাঙে না বড়ো একটা। ভেঙেছিল ক মাস আগে বাড়িতে তিনবার কলিংবেলের শব্দে। বেশ কিছুদিন পরে, চঞ্চলের কথা মনে পড়ল যে প্ল্যানচেটে সাবধান করে দিয়েছিল। কোথায় গেল ছেলেটা? সে কি সত্যিই অসমে এসেছিল?

হঠাৎ জুলি চমকে উঠল, কিসের শব্দ?

জুলি কান পেতে রইল। কে যেন খুব জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে। কয়েক মুহূর্তে শব্দটা কাছে এসে পড়ল, একেবারে বাংলোটার কাছে। তারপর শব্দটা এগিয়ে গেল গভীর জঙ্গলের দিকে। ক্রমে মিলিয়ে গেল। অবাক হলো জুলি। এত রাতে ঘোড়ায় চড়ে কে ঘুরে বেড়াচ্ছে জঙ্গলের মধ্যে?

শব্দটা আর শোনা গেল না। জুলি আবার ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে চা খেতে খেতে অভিজিৎকে জিজ্ঞেস করল, কাল রাতে কোনো শব্দ শুনেছিলি?

অভিজিৎ জেলি মাখানো টোস্টে কামড় দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বলল, নাঃ। এক ঘুমে রাত কাবার।

তবে কি তারই শোনার ভুল?

পরে দুপুরবেলা কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করল, কাল রাতে ঘোড়ায় চড়ে এদিকে কে এসেছিল? কেয়ারটেকার তখনই তার উত্তর দিলো না। কয়েক মুহূর্ত জুলির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর শুধু বলল, ও কিছু না।

উত্তরটা শুনে জুলি খুশি হলো না। যেন সত্যিই কেউ এসেছিল। কিন্তু সে কথাটা চেপে গেল।

পরের দিন দুপুরে জুলি অভিজিৎকে বলল, চল, একটু ঘুরে আসি।

অভিজিৎ আলিস্যি ভেঙে বলল, দূর! জঙ্গলের মধ্যে কোথায় ঘুরব? তার চেয়ে ঘুমুলে কাজ দেবে।

অভিজিৎ-এর কথায় জুলি অবাক হলো। এখানে এসে পর্যন্ত দাদার যেন কেমন পরিবর্তন হয়েছে। জায়গাটা তার যেন মোটেই ভালো লাগছে না। শেষে জুলি একাই বেরিয়ে পড়ল।

বেলা দেড়টা। জুলি প্রথমে বাংলোর পিছনের দিকে খানিকটা ঘুরল। তারপর জঙ্গলের পথ ধরল। এ এমন ঘন জঙ্গল যে রোদ পর্যন্ত ঢোকে না। তার লক্ষ্য মাটির দিকে। খুঁজছে। ঘোড়ার খুরের ছাপ চোখে পড়ে কিনা। কিন্তু শুকনো পাতা আর কয়েকটা জোঁক ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। সরু বনপথ ধরে এগিয়ে চলল জুলি। কোথায় যাচ্ছে তা নিজেও জানে না। তার মনে হতে লাগল একটা অদৃশ্য শক্তি তাকে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কেবলই মনে হতে লাগল আর একটু এগোন যাক। আর একটু-তাহলেই দেখতে পাবে ছবির সেই রহস্যময় বাড়িটাকে। আবার মনের জোরে জুলি এগোতে লাগল। হঠাৎ কোথা থেকে আঁকে ঝকে মাছি এসে মাথার ওপর ভন ভন করে উড়তে লাগল। চোখে মুখে ঢুকতে লাগল। এ তো মহাজ্বালা!

অগত্যা ফিরতে হলো। কিন্তু এর মধ্যেই জঙ্গল অন্ধকার হয়ে এসেছে। রিস্টওয়াচটা দেখল। সবে বেলা তিনটে। এরই মধ্যে অন্ধকার হয়ে গেল! তা তো হবেই। একে জঙ্গলের পথ। তার ওপর সূর্য পাহাড়ের আড়ালে নেমে যাচ্ছে। জুলির ভয় করল। পথ চিনতে পারবে তো? তাড়াতাড়ি যেভাবে এসেছিল ঠিক সেই ভাবেই হাঁটতে লাগল।

বাংলোয় পৌঁছল যখন তখন প্রায় সন্ধে। দেখল দাদা বাংলোর সামনের রাস্তায় অধৈর্য হয়ে ঘুরছে। জুলিকে দেখতে পেয়ে ধমক দিয়ে বলল, কোথায় গিয়েছিলি একা একা?

সব বলছি. ওপরে চল।

চা খেতে খেতে অভিজিৎকে সব বলল। তারপর দুজনে গেল কেয়ারটেকারের ঘরে। যেতেই বৃদ্ধ বলল, কোথায় গিয়েছিলে দিদি? একা একা হাতে অস্ত্র না নিয়ে কখনও জঙ্গলে যেও না। এখানে হিংস্র লেপার্ড আছে। তারা ডোরাকাটা বাঘের চেয়েও ভয়ংকর।

কিন্তু জুলি বাঘের কথা শুনতে চায় না। শুনতে চায় অন্য কিছুর কথা–আরও ভয়ংকরের কথা। জানতে চায় কে তাকে আকর্ষণ করে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল–কেন নিয়ে যাচ্ছিল?

এক সময়ে নিরিবিলিতে জুলি কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করল, আংকেল, শুনেছি এখানে কোথায় যেন একটা পুরনো বাড়ি আছে। সেখানে কেউ যেতে সাহস পায় না।

বৃদ্ধ আংকেল চমকে উঠে বলল, চুপ চুপ, ও বাড়ির নাম উচ্চারণ কোরো না।

কেন?

ওখানে ভয় আছে দিদি। কত বিদেশী কত কাল ধরে ও বাড়িটাকে দেখবার জন্যে গিয়েছিল, তারপর তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

কি আছে ওখানে?

লোকে বলে কোনো খুনে সাহেব রাজার প্রেতাত্মা। সন্ধেবেলা ও নাম করতে নেই।

একটু থেমে বলল, তুমি ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনেছ। তা মিথ্যে নয়। সেদিন বলিনি, আজ বলছি, ঐরকম শব্দ প্রায়ই শোনা যায়। লোকে বলে–সাহেব রাজা টহল দিয়ে বেড়ায়। তখন যদি কেউ চোখের সামনে পড়ে তাহলে পরের দিন তার লাশ পড়ে থাকে জঙ্গলের মধ্যে। যাও, তোমাদের ঘরে যাও। আর যত শিগগির পার দেশে ফিরে যাও। একটু থেমে বলল, তুমি কি আজ ঐদিকেই গিয়েছিলে নাকি?

জুলি বলল, বাড়িটা কোন দিকে তা তো জানি না। এমনি হাঁটছিলাম। মনে হচ্ছিল, কেউ যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

হ্যাঁ, সব্বোনাশের পথেই চলছিলে। খুব ভাগ্য আর এগোওনি। রাগ করো না দিদি আসলে তোমাদের বয়েস অল্প, মতিগতি ভালো নয়। বিপদে পড়তে পার।

.

মতিগতি সত্যিই ভালো নয় ওদের। নইলে বুড়ো আংকেলের কাছে সব শুনেও দুই ভাইবোনে পরের দিনই কেন বেরিয়ে পড়বে সেই রহস্যময় বাড়ির সন্ধানে। অভিজিৎ প্রথমে রাজি হয়নি। জুলিই জোর করে ওকে রাজি করাল। বলল, তুই না যাস, আমি একাই যাব।

.

অগত্যা অভিজিৎকেও যেতে হলো।

আজ বেলা দশটার মধ্যে লাঞ্চ খেয়ে ভাইবোনে বেরিয়ে পড়েছে। বুড়ো আংকেলের কথায় বুঝেছে যে পথে গতকাল গিয়েছিল, সেই পথটাই ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবে।

জঙ্গল–তবে এই জঙ্গল সুন্দরবনের জঙ্গল নয়। পাহাড়ি জঙ্গল। পদে পদে পাথরের ঠোক্কর। সূর্য ক্রমশ মাথার ওপরে উঠল। জঙ্গল যেখানে পাতলা, সেখানেই রোদের দেখা মেলে। নইলে অন্ধকার। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একসময়ে জুলির মনে হলো, সে যেন অন্য পথে এসে পড়েছে। কিন্তু এটাও বুঝল সে ইচ্ছে করে অন্য পথে চলে আসেনি। কেউ যেন নিজেকে লুকিয়ে রেখে আগে আগে চলেছে পথ দেখিয়ে। কে নিয়ে যাচ্ছে? কেন নিয়ে যাচ্ছে? কোথায়–কোন সর্বনাশের মুখে টেনে নিয়ে যাচ্ছে? যেই নিয়ে যাক সেই আকর্ষণ থেকে নিজেকে সরিয়ে আনা যে কিছুতেই সম্ভব নয় ওরা তা ভালো করেই বুঝতে পারছে।

আর একটা আশ্চর্যের ব্যাপার–এরা কেউ কথা বলছে না। মুখ যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। শুধু লতাপাতা, বনঝোপ ঠেলে তারা হাঁটছে তো হাঁটছেই। একধরনের বুনো গন্ধ নাকে আসছে। কখনও কোনো ফুলের তিক্ত কষা গন্ধ।

চলতে চলতে তারা একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ল। যেন অন্ধকার থেকে আলোর দেশে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। রোদের রঙ বুঝিয়ে দিলো বেলা এখন দুপুর। একটু দূরেই দেখা গেল নুড়িবিছানো সরু জলস্রোতের ধারা। আর তার ডানদিকে হাতিছড়া, দলু ও দামছড়ার ঘন দুর্ভেদ্য জঙ্গল যেন গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে মাইলের পরে মাইল জুড়ে কালো পাঁচিলের মতো দাঁড়িয়ে। অরণ্যের সেই স্তব্ধ ভয়ংকর চেহারা দেখলে ভয় পায় না এমন মানুষ বোধহয় নেই।

ওরা গোড়ালিডোবা জল স্বচ্ছন্দে পেরিয়ে ওপারে চলে গেল। ঠিকানা জানা নেই, সঙ্গে ম্যাপ নেই তবু ওরা আন্দাজে নাক-বরাবর সোজা এগিয়ে চলল। আবার শুরু হলো বন। তবে এ বন ওপাশের বনগুলোর মতো তেমন গভীর নয়। এখানে ঢুকতেই আশ্চর্য, কেমন হিমেল বাতাস বইতে শুরু করল। বেশ শীত করতে লাগল।

বড্ড শীত করছে না? অভিজিৎ যেন নিজের মনেই কথা বলল।

হ্যাঁ, বোধহয় আমরা মৃতের দেশে এসে পৌঁছলাম।

ঐ দিকটা তাকিয়ে দেখ।

জুলি দেখল বাঁ দিকে পাহাড়ের একটা খাঁজকাটা অংশ যেন খাঁড়ার মতো ঝুলছে। আর তার পিছনে ঘন কুয়াশা। অথচ এখানে কুয়াশার চিহ্নমাত্র নেই। আর একটু জোরে হাঁট বোন। আমরা বোধহয় এসে পড়েছি।

জুলি বলল, আমার পা দুটো অবশ হয়ে যাচ্ছে।

তা হোক। এত দূর এসেছি যখন তখন শেষ না দেখে যাব না।

অভিজিৎ যেন হঠাৎ প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী হয়ে উঠেছে। জুলিও জোরে হাঁটবার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগল।

খাঁড়ার মতো পাহাড়টাকে বাঁ দিকে রেখে মোড় বেঁকতেই ঘন কুয়াশার মধ্যে দেখা গেল অনেকখানি পাঁচিল ঘেরা জায়গা। নামেই পাঁচিল। আসলে জীর্ণ ভাঙা কতগুলো ইট পরপর সাজানো।

ওরা পাঁচিলের কাছে আসতেই দেখল অনেকগুলো দীর্ঘ সুপুরিগাছ–আর তারই আড়ালে দোতলা একটা বাড়িযে বাড়িটার ছাদ দুদিকে এমনই ঢালু যেন মনে হয় কাছিমের পিঠ।

জুলির হাত এমনই কাঁপতে শুরু করল যে যতক্ষণ না অভিজিৎ তার হাতটা নিজের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরল ততক্ষণ কাঁপুনি থামল না।

অভিজিৎ বলল, আমরা তাহলে সেই ছবির বাড়িটা খুঁজে পেলাম। ঐ দেখ–

জুলি দেখল বাড়ির গায়ে সেই একটা বিকট মুখ বসানো। মুখটার মাথার দুপাশে শিং। ভয়ংকর দুটো চোখ–যে দিক দিয়েই দেখ না কেন মনে হবে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। বিকট হাঁ-এর মধ্যে বড়ো বড়ো বাঁকানো দাঁত।

দাদা, ফিরে চল। অনেক পথ হাঁটতে হবে।

অভিজিৎ বলল, এতদূর এলাম। ভেতরটা দেখব না?

বাড়িটা তো দেখা হলো—

কিন্তু ম্যাকবেথের তরোয়াল দেখব না? দেখব না, দোতলায় কে থাকে?

 দাদা, ভেতরে ঢোকা মানেই মৃত্যু। একবার মা-বাবার কথা মনে করে দ্যাখ।

সে কথার উত্তর না দিয়ে অভিজিৎ বলল, ঐ দিকে তাকা। ঐ দ্যাখ জানলার দুপাট খোলা! হুবহু সেই ছবিটা। চলে আয়।

অভিজিৎ বোনের হাত ধরে ভাঙা পাঁচিলের এক পাশ দিয়ে বাড়িটার সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। চওড়া সিঁড়ি। সিমেন্ট বালির চিহ্নমাত্র নেই। তবু ওরা আট ধাপ সিঁড়ি পার হয়ে বন্ধ দরজার সামনে পা রাখল।

দরজাটা ঠেলব? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল অভিজিৎ।

উত্তর না দিয়ে যেন মরীয়া হয়ে জুলি নিজেই দরজাটা ঠেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা উৎকট শব্দ করে বিরাট দরজাটা খুলে গেল।

দুজনেই অবাক হলো। দরজাটা শুধু ভেজানোই থাকে নাকি?

এক পা এক পা করে তারা ভেতরে ঢুকল। কনকনে মেঝে। এত ঠান্ডা যে পা রাখা যায় না।

বিরাট হলঘর। কিন্তু বসার কোনো ব্যবস্থা নেই। জায়গাটা অবশ্য বসার জন্যে নয়। দেওয়ালে টাঙানো নয়, ছাদ থেকে ঝুলছে বিরাট বিরাট জন্তুর কংকাল। কোথাও বাঘের মাথা, কোথাও মোষের বিরাট মাথা। কবে থেকে ঝুলছে কে জানে–কিন্তু দেখলে মনে হয় যেন সেগুলোকে সদ্য বধ করে মুণ্ডুগুলো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অনেকগুলো দরজা। দোতলায় ওঠার একটা বাঁকানো সিঁড়ি। কিন্তু জনপ্রাণীর সাড়া নেই।

ওরা কিছুক্ষণ এ দরজা ও দরজায় উঁকি মেরে দেখল। তারপর অভিজিৎ চেঁচিয়ে বলল, কেউ আছেন?

অভিজিতের গলার স্বর নিস্তব্ধ ঘরে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এল।

 কেউ নেই দাদা, চল ফিরে যাই।

দোতলায় কেউ আছেই। দাঁড়া আর একবার ডাকি। বলে অভিজিৎ ফের ডাকল, কেউ আছেন?

উত্তর নেই। কিন্তু থপ করে একটা মোটা টিকটিকি কোথা থেকে মেঝেতে পড়েই ওদের দিকে তেড়ে এল। অভিজিৎ জুলির হাত ধরে টান দিয়ে এক লাফে সরে দাঁড়াল। টিকটিকিটা সিঁড়ির পাশ দিয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

টিকটিকি আবার মানুষকে তাড়া করে? আর অত মোটা!

 চল ওপরে যাই।

আমার যেতে ইচ্ছে করছে না দাদা।

বাঃ এতদূর এসে দোতলাটা দেখে যাব না? দেখব না সত্যিই ম্যাকবেথের তরোয়ালটা আছে কিনা? কিংবা স্বয়ং ম্যাকবেথের আত্মা সেটা পাহারা দিতে আসে কিনা। সাবধানে আমার পিছু পিছু আয়।

এক ধাপ এক ধাপ করে ওরা উঠতে লাগল। সিঁড়িটা বাঁ দিকে বেঁকে গেছে। বহু পুরনো আমলের নড়বড়ে সিঁড়ি। আর ক ধাপ উঠতেই ওরা দোতলায় এসে পৌঁছল। এটাও নিচের মতোই হলঘর। ওপরেও অনেকগুলো ঘর। ওরা সামনের দিকে এগোচ্ছিল, হঠাৎ দুজনেই কান খাড়া করল, সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে কেউ যেন উঠে আসছে। খসখসখস–কে আসছে? কোথা থেকে আসছে? কেন আসছে? যেই আসুক ঐ পায়ের শব্দ যে কোনো মানুষের নয় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু

সে সব চিন্তার আগে দরকার কোথাও লুকনো। কোথায় লুকনো যাবে? সিঁড়ি দিয়ে নামা যাবে না। কারণ ঐ সিঁড়ি দিয়েই কেউ উঠে আসছে।

হঠাৎ লক্ষ্য পড়ল ওদিকে আর একটা সিঁড়ি রয়েছে। তাড়াতাড়ি ঐদিকে ছুটে গেল তারা। সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। কিন্তু সিঁড়িটা মাঝপথেই একটা ঘরের সামনে শেষ হয়ে গেছে। আর পালাবার জায়গা নেই।

ওদিকে সেই খস খস শব্দ আসছেই–আসছেই–

উপায় নেই দেখে সামনের দরজায় জোরে ধাক্কা দিল অভিজিৎ! দরজা খুলে গেল। জোরে ধাক্কা দেওয়ায় দুজনেই ছিটকে ভেতরে পড়ে গেল। কোনোরকমে উঠে দাঁড়াতেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল তাতে তারা আঁতকে উঠল। পর পর ঝুলছে কংকাল। কোনোটারই মাথা নেই। পশ্চিম দিকের একটা ঘুলঘুলি দিয়ে এক ফালি পড়ন্ত বেলার রোদ এসে পড়েছে একটা কংকালের ওপর। তাতেই দেখা গেল থিক থিক করছে পোকা কংকালটার গায়ে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, ঘরে এক ফোঁটা বাতাস নেই। কিন্তু কংকালগুলো দুলছে। কংকালগুলো কি প্রথম থেকেই দুলছিল, না এদের দেখে দুলতে লাগল?

ঘটনার আকস্মিকতা একটু সামলে নিতে না নিতেই আবার একটা ভয়ংকর দৃশ্য। দেওয়ালে ম্লান অক্ষরে বড়ো বড়ো ইংরেজি হরফে লেখা–SLAUGHTER HOUSE যার বাংলা হলো কসাইখানা। লাল হরফে লেখা–কিন্তু অক্ষর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে–ও কি লাল কালি? না–

উঃ মাগো! এত রক্ত! আর্তনাদ করে উঠল জুলি। পালিয়ে চল দাদা, পালিয়ে চল– দুজনে পালাবার জন্যে পিছু ফিরতেই থমকে গেল। আপাদমস্তক সাদা চাদরে ঢাকা একটা থুথুড়ে বুড়ো–যার পিঠটা কুঁজো হয়ে গেছে বয়সের ভারে, পাকা ধপধপে দাড়ি লুটোচ্ছে। মাটিতে, কুকুতে সবুজ চোখে যার সাপের দৃষ্টি–একটা লাঠি হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে দরজা আগলে।

কে এই বুড়ো? শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই-ই কি বাস করে আসছে এই বাড়ির দোতলার ঘরে? এই কি পাঁচশো বছর আগের মৃত ম্যাকবেথ যার মোকাবিলা করতে চেয়েছিল। সাহেব? সাহেব কি এখানে পৌঁছতে পেরেছে?

দুজনে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সেই বুড়োর দিকে। বুড়ো এগিয়ে এল না, তার ঠোঁট দুটো একটি বারের জন্যেও নড়ল না। শুধু ঘরের বাইরে শকুনের পায়ের মতো তার দুটো বীভৎস পা রেখে কসাইখানার দরজাটা আস্তে আস্তে বন্ধ করে দিল। অভিজিৎ দরজা খোলবার জন্যে পাগলের মতো ছুটে গেল। কিন্তু ততক্ষণে দরজাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অভিজিৎ দরজাটা খোলার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করল। কিন্তু শক্ত কাঠের দরজা এতটুকু ফাঁকও হলো না। অভিজিৎ মেঝের ওপর আছড়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল–হ্যায় ভগবান!

কিন্তু আশ্চর্য স্থির জুলি। সে বিহ্বল। ভয় পাবার ক্ষমতাটুকুও বুঝি তার নেই। এই কশাইখানার বন্ধ ঘরে এর পর তাদের কী ভয়ংকর পরিণতি হবে তা বুঝতে বাকি নেই।

একটা খটাখট শব্দে দুজনেই চমকে উঠল। দেখল সার সার ঝুলন্ত কংকালগুলো যেন মহা উৎসাহে দুলতে দুলতে একটা অন্যের সঙ্গে ঠোকাঠুকি খেলা শুরু করেছে।

এদিকে বেলা পড়ে আসছে। একটি মাত্র ঘুলঘুলি দিয়ে যে এক ফালি রোদ আসছিল সেটুকুও আর নেই। ঘরে অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করেছে।

আর কতক্ষণ তাদের পরমায়ু? কখন কবে তাদের শিরচ্ছেদ হবে? আজ রাত্রেই না কাল সকালে? কোথায় কত দূরে তাদের গোয়ালপাড়া গ্রামে মা-বাবার কথা মনে করে জুলির চোখে জল এল।

এমনি সময়ে দরজাটা নিঃশব্দে একটু একটু করে খুলে যেতে লাগল। ঘাতক আসছে। তাহলে? মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে অভিজিৎ উঠে দাঁড়াল।

দরজাটা খুলে গেল।

না, সেই বুড়োটা নয়, একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি। জুলি আর অভিজিৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ছায়ামূর্তিটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল। অমনি দুজনেই চমকে উঠল–চঞ্চল!

কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে চঞ্চলের! হাড়সর্বস্ব রোগা! মুখটা ঝাপসা। চঞ্চল যেন ইশারায় ওদের বেরিয়ে আসতে বলল। অভিজিৎ আর দেরি করল না, জুলির হাত ধরে টেনে নিয়ে দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল।

তারপর তারা চঞ্চলের ছায়ামূর্তির পিছু পিছু যেতে লাগল। কোন ঘরের কোন গোপন দরজা দিয়ে, কোন সুড়ঙ্গপথ ধরে কি ভাবে যে তারা রাস্তায় এসে দাঁড়াল তা তারা ভেবে পেল না।

ভাবার সময়ও ছিল না, দরকারও ছিল না। সঙ্গে যে রয়েছে বিশ্বস্ত বন্ধু চঞ্চল। তারই। পিছু পিছু তারা চলল মাঠ জঙ্গল পেরিয়ে। তারা কি হাঁটছিল? না উড়ছিল?

একবার অভিজিৎ-এর মনে হলো তারা বোধ হয়, বেঁচে নেই। শরীরমুক্ত আত্মা হয়ে তারা চঞ্চলের পিছু পিছু হাওয়ায় ভেসে চলেছে। নইলে এত জোরে কেউ হাঁটতে পারে?

চলতে চলতেই অভিজিৎ নিজের হাতে চিমটি কাটল। না, বেঁচেই আছে।

জুলি, হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে? এতক্ষণে অভিজিৎ কথা বলল।

না। ছোট্ট উত্তর দিল জুলি। হঠাৎ এক সময়ে তারা দেখল চঞ্চল নেই। চঞ্চল-চঞ্চল চেঁচিয়ে ডাকল অভিজিৎ।–কোথায় তুমি? সাড়া পেল না।

এখন এই সন্ধের মুখে কোন দিকে যাবে? লারসিংগার বাংলোটা কতদূর?

 হঠাৎ জুলি আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, দাদা, রেলস্টেশন।

তাই তো। এগিয়ে গেল তারা স্টেশনের দিকে। শিলচর স্টেশন! যাক তবু এখানে জীবন্ত মানুয আছে।

এখানে যখন এসে পড়েছে তখন আর ভাবনা নেই। একটা ঘোড়ায় টানা টাঙ্গা গোছের গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। তাদের দিকে গাড়োয়ান এগিয়ে এল। অভিজিৎ জিজ্ঞেস করল, লারসিংগার বাংলো কত দূর?

উত্তর দিল গাড়োয়ান–পনেরো মাইল।

ভাড়া যাবে?

গাড়োয়ান গাড়ির দরজা খুলে দিল। গাড়ি চলতে শুরু করল। বরাইল পাহাড়ের মাথার উপর তখন সূর্য ডোবার লালচে আলো চিকচিক করছে।

কি ভাবছিস জুলি?

চঞ্চলদা এখানেও দেখা দিয়ে গেল। বলতে বলতে তার চোখ দুটো জলে ভরে উঠল।

তাহলে সে এখানে এই বাড়িতে পৌঁছেছিল?

জুলি উত্তর দিল না। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। অন্ধকারে ঢেকে যাবে চরাচর।

[শারদীয়া ১৪০৯]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *