আগস্ট আবছায়া – ৪.১

৪.১

সকাল দশটা বাজে। পনেরোই আগস্ট। শব্দটা হওয়ার পরে আমাদের সবার নির্ঘুম কেটে গেছে প্রায় দশ ঘণ্টা। আমি গত রাতের বাকি পুরোটা সময় সব বিশ্রাম, সব নাওয়া-খাওয়া ফেলে ওই শব্দের আকার ও উৎসের পেছনে পার করেছি; পার করেছি অন্ধকার রাত, আলো ফোটা ভোর ও বিষণ্ণ সকাল; এবং এলাকার যার সঙ্গেই কথা বলেছি, সে-ই শব্দটাকে দিয়েছে নতুন নতুন চেহারা। কিসের শব্দ ছিল ওটা, সেই ব্যাখ্যা দেখেছি সংখ্যায় যত কম, কেমন শব্দ ছিল ওটা, সে বিবরণ ততই বেশি। অনেকগুলো, আক্ষরিক অর্থেই অনেকগুলো, বিবরণ পাশাপাশি বসিয়ে আবার দেখেছি যে ঘুরেফিরে তিন ধরনের শব্দের কথাই বলা হচ্ছে বারবার : ওটা ছিল ভোঁতা কিন্তু ধাতব এক আওয়াজ; কোনোভাবেই আওয়াজটা ধাতব ছিল না, ছিল পৃথিবীর সমান সাইজের এক পর্দা ফেড়ে ফেলার ভ্রাত; বিস্ফোরণের বুম বলা যাবে না ওটাকে, বরং বলা যেতে পারে দুটো মহাদেশ আকারের পাথরের একটার সঙ্গে আরেকটার প্রচণ্ড বাড়ি খাওয়ার ঠা-ডা। 

শব্দের স্থায়িত্বকাল নিয়ে বেশি একটা বিতর্ক আমি লক্ষ করিনি কোথায়ও। কারণ সবাই—চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, রিকশাওয়ালা, মসজিদের ইমাম, ঘরের বউ-ছেলে-মেয়ে সবাই—একমত যে খুব বেশি হলে মাত্র তিন-চার সেকেন্ড শোনা গিয়েছিল ওই ঠা-ডা, ওই ভ্রাত, ওই দ্রিম। 

আর শব্দটার উৎসসংক্রান্ত ব্যাখ্যা ঘুরেফিরে এ কথাগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে খেয়াল করলাম : নিঃসন্দেহে ওটা আকাশে আমেরিকান কোনো স্যাটেলাইটের দুই প্লেটে বাড়ি খাওয়ার শব্দ ছিল, যেমন নাকি অনেকেই শুনেছিলেন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ২০০০ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সফরে আসবার আগের দিনে (পত্রিকায়ও তখন সে কথা লেখা হয়েছিল বলে মনে করতে পেরেছেন অনেকে); নিঃসন্দেহে ওটা ছিল এই বসুন্ধরা আবাসিক এলাকারই কোনো (আকাশের নয়) গোপন প্রজেক্টে হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো অব্যাখ্যেয় দুর্ঘটনা; আর ‘জানি না,’ ‘বলতে পারব না,’ ‘ইউএফও হতে পারে, কিন্তু ইউএফও বলে তো কিছু নেই,’ ‘আল্লাহই জানেন, শুধু দোয়া করি এই জীবনে যেন আর কোনো দিন শুনতে না হয় ওই শব্দ’—এসব। 

আমি সবার সব কথা শুনি, কিন্তু শুধু বারবার ফিরে যাই গত রাতের সেই মুহূর্তটায়, যখন আমার জীবনকালে দেখা ও শোনা প্রকৃতির সব সিমেট্রি ওই একবারই এত ভয়াবহ ও লজ্জাজনকভাবে ভেঙে পড়তে দেখেছি। এ পৃথিবীতে কোনো অর্থই হতে পারে না অমন এক আকস্মিক বিকট আওয়াজের, কোনোভাবেই তা খাপ খায় না পৃথিবীর ভোর, পৃথিবীর দুপুর, পৃথিবীর অন্ধকার (বা তারাভরা উজ্জ্বল) রাতের সঙ্গে, এর ঐশ্বর্যশালী বায়ু, এর হিতৈষী সাগরের ঢেউ, এর অভিভাবকসুলভ স্নেহভরা জল ও অগ্নি এবং এর কর্মকুশল ঋতুবদলের সঙ্গে। বরিশালে ছোটবেলায় মাদ্রাসার হুজুরেরা আমাদের তিন ভাইকে মন্ত্রপাঠের মতো শেখাতেন ‘খোদা সর্বশক্তিমান’, ‘খোদা সর্বশক্তিমান’। আমি সেই বাচ্চা বয়স থেকেই বুঝতাম এ-কথার মাধ্যমে তারা এটাই শিশু-কিশোরদের বোঝাতেন যে যা কিছু সম্ভব খোদা তার সবই করতে পারেন। কিন্তু আমরা বাচ্চারা ব্যাপারটা নিয়ে শব্দ ও ভাষার এক অদ্ভুত খেলা খেলতাম মনে আছে। সেই উঠতি বয়সে আমরা তখন একে অন্যকে বলতাম যে, হায়, খোদা তো আর চতুর্ভুজাকার কোনো ত্রিভুজ বানাতে পারেন না; খোদা সব জানেন বটে, যা কিছু জানার যোগ্য, জানার পক্ষে সম্ভব, তিনি তার সবই জানেন, কিন্তু তিনি কি কোনো বন্ধ্যা নারীর সন্তানের নাম জানেন? ‘বাঁজা মাইয়ার পোলাপাইনের নাম জানেন আল্লায়?”, বলত আর হাসত আমাদের নিউ ভাটিখানা রোডের দুষ্টু বড়রা, আমাদের মতো ছোটদের সামনে তাদের স্মার্টনেস-দেখাতে-চাওয়া মুহূর্তগুলোতে। পশ্চিমা মানুষদের ধর্মতত্ত্ব নামের মূলত অবিশ্বাসী চিন্তায় ভরা লঘু ধাঁচের বইগুলোতে বড় হওয়ার পরে পড়া উদ্ভট লজিকের চটুল এই ‘সম্ভাবনাগুলোর কথা তখন আমি ভাবছি বসুন্ধরা এফ ব্লকের এক কোনায় ছোট এক চায়ের দোকানে চায়ের গরম কাপে মুখ দিয়ে; এবং দ্রুত কয়েক চুমুকে চা খাওয়া শেষ হতে বুঝেছি যে, ‘সম্ভাবনা’ কাল ও স্থানের হাতে বন্দী, ‘সম্ভাবনা’ আমাদের সাময়িক অজ্ঞতারই অন্য নাম, আমরা ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে এই অপেক্ষাই করছি যে সময়ের সঙ্গে নিশ্চয়তা এসে সম্ভাবনাকে মুছে দেবে, কোনো সর্বজ্ঞ কিছু বা কিছু না এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব বর্তমান ও সেই বর্তমানে গতিশীল সকল অ্যাটমকে এত ভালোভাবে একদিন জানবে যে পুরো ভবিষ্যৎ তখন আয়নায় তাকালেই স্পষ্ট দেখা যাবে। যেমন আজ আয়নায় তাকালে আমি আমার উল্টো এক প্রতিরূপ দেখি, তেমন একদিন নিশ্চয় আয়নায় আমি দেখতে পাব আমার পঞ্চাশ বায়ান্ন-বাষট্টি বছর বয়স, সব বয়স, সব পরিস্থিতিতে আমার সব চেহারা। 

দোকানদার আমার চায়ের দাম নিলেন না। মধ্যবয়স্ক রোদে পোড়া এই মানুষটা-তাঁর নাম আমি জানি না, কারণ, এর আগে কখনো এ কোনাটায় আসিনি—বললেন, ‘পয়সা নিয়া কী হব, স্যার? পৃথিবীই তো আর টিকতেছে না। কোরআন-হাদিসে কেয়ামতের আগে এই সব আজব কাণ্ডকারখানার কথা লেখা আছে।’ আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম যে তাঁর কী মনে হয়, কতটুকু সম্ভাবনা যে এই শব্দ মানুষের সৃষ্টি আর কতটা সম্ভাবনা যে এর পেছনে আছে কোনো দৈবশক্তি। ‘দৈবশক্তি’ শব্দটাকে ব্যাখ্যা করে বলতে হলো আমার। তিনি চায়ের কেটলি ধুয়ে ফেলছেন, স্টোভের আগুন নিভিয়ে ফেলেছেন, পিরিচের ওপরে জমা টোস্ট বিস্কুটের গুঁড়ো ঝেড়ে ফেলেছেন। আমাকে তিনি বললেন, ‘ভালো লাগতেছে না, স্যার। বাড়ি যামু। আমার বাড়ি কুমিল্লা। বসুন্ধরায় আল্লাহর গজব পড়ছে। এখানে থাকা যাইত না।’ তার মানে এটাই সত্য সম্ভাবনা যে খোদা তাঁর ক্ষমাহীনতার রূপ ধরে পৃথিবীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য পনেরোই আগস্ট তারিখটাকে বেছে নিয়েছেন? খোদার এতটা সুবিচারের প্রশংসায় আমার মন মাত্র আর্দ্র হয়ে উঠেছে, দেখলাম পাশের দালানে মিলাদমতো কিছু একটা শেষ হলো, এক দল মাদ্রাসার সাদা পোশাক পরা ছাত্র হাতে ছোট ছোট মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বের হলেন ওই দালান থেকে। আমি তাঁদের জিজ্ঞাসা করলাম তাঁরা সরফরাজ নওয়াজ সাহেবকে চেনেন কি না। তাঁরা সবাই সমস্বরে হ্যাঁ বললেন, আমি ধরে নিলাম তাঁরা এখানে এসেছেন এই শব্দে প্রচণ্ড ভীত ও ধর্মপরায়ণ কোনো বসুন্ধরাবাসীর কোরআন তেলাওয়াতের আহ্বানে, তাঁরা এসেছেন সরফরাজ নওয়াজ সাহেব যে মসজিদ ও মাদ্রাসা কমিটির প্রধান, সেখান থেকে। 

সামনের দালানে আমার না-দেখা ওই ভীত মানুষটার মতো, ওই চা-বিক্রেতার মতো আমিও বিকট শব্দটার মধ্যে খোদার সন্ধান করছি, ওই শব্দের কারণ ও উৎস অনুসন্ধানে নেমে আমি আসলে রয়েছি ধর্মীয় এক তীর্থযাত্রায়, আমাকে নিয়ে এতখানি আশাব্যঞ্জক কথা কেউ ভাববে না, সেটাই আমার আশা। বিশ্বাসীরা খোদার কাছে কথা বলে, আর অবিশ্বাসীরা খোদাকে নিয়ে কথা বলে। এই এতগুলো ঘণ্টা—শব্দটার বিকটত্ব ও রহস্যময়তার কাছে ধরা খেয়ে—বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার মানুষেরা খোদাকে নিয়ে অনেক কথা বলেছে, যেমন আমি বললাম একটু আগে, কিন্তু তাঁরা খোদার সঙ্গে এ বিষয়ে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে বা বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী বলেছে, সে সাক্ষ্য দেওয়ার আমি কেউ নই। আমি শুধু এটুকু জানি যে আমি শব্দটার আকৃতি-প্রকৃতি-স্থায়িত্ব ও এর পরিণাম (অসংখ্য বাড়ির ভাঙা কাচ, রাস্তাগুলো জুড়ে অসংখ্য গাড়ির কাচ টুকরো হয়ে ছড়িয়ে যাওয়া, রাত থেকেই অসংখ্য শিশুর অসুস্থতা, ভয়ে তাদের মায়ের বুকের দুধও খেতে না পারা, অসংখ্য হঠাৎ গর্ভপাত ইত্যাদি) নিয়ে চিন্তা করে করে চরম অসহায়ত্বের মধ্যে বহুবার খোদার সঙ্গে কথা বলেছি। আমি বলেছি যে, আল্লাহ, জানি তোমার চেয়ে বড় কেউ নেই, তেমন এটা যেন ভবিষ্যতে আমাদের প্রজন্মগুলোকে জানতে না হয় যে, সেই এক পনেরোই আগস্টের রাতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার অব্যাখ্যেয় শব্দটার চাইতে বড় কিছু কোনো দিন ছিল না; আর তুমি যেমন অজানা, অজ্ঞেয় (ফলে তোমাকে আমরা যতভাবে জানতে চাই না কেন, তোমাকে জানা নিয়ে যত রকম হ্যাঁ-বোধক কথাই বলি না কেন, সবই আমাদের বদলাতে হয়, সব ভাষ্যই আবার ফেলে দিয়ে নতুন করে শুরু করতে হয়, কারণ, তোমাকে জানা নিয়ে যা বলি, তাতেই ঘাটতি থেকে যায়), এই শব্দও যেন কোনো দিন তেমন সম্মানের আসন না পেয়ে বসে। 

এ রকম কিছুটা আধ্যাত্মিক (জীবনের মূল অর্থ যদি কিছু থেকে থাকে, তা এই বিকট শব্দে আসমানের খোদা এবং নিচের মাটিতে তাঁর সৃষ্টিসহ নড়ে যাওয়া অর্থে), কিছুটা রাজনৈতিক (পনেরোই আগস্ট রাতেই এই শব্দ হলো অর্থে), আর মূলত এক সামাজিক (মানুষের জন্য মায়া অর্থে) কারণ থেকে আমি নিজের সঙ্গে নিজেই চ্যালেঞ্জ নিলাম যে, এ শব্দের উৎস ও কারণ আমি খুঁজে বের করবই, তাতে যদি আমার জীবনের পুরোটা লেগে যায়, তা-ও। 

প্লেটো বলেছিলেন, ‘সবকিছুই হওয়ার মধ্যে রয়েছে-হওয়ার এবং অদৃশ্য বা ক্ষয় হওয়ার; কোনো কিছুই সত্যিকারের কখনো হয়ে নেই।’ সেটাই আমার অনুসন্ধানের প্রধান দার্শনিক ভরসা ও ভিত্তি, আমার আশা। শব্দটা তিন সেকেন্ডে মরে যায়নি, সে এখনো বর্তমান আছে—আমার স্মৃতিতে, আমার কানের মধ্যে। খোদাকে বুঝতে হলে খোদাকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে, সেটা যৌক্তিক প্রয়োজনীয়তা থেকেই; আর ওই সংজ্ঞায় বলতে হবে যে, খোদা স্থান ও কালের সীমানার ঊর্ধ্বে, যেন দুষ্টু লোকেরা ও অবিশ্বাসীরা খোদাকে এই ব্রহ্মাণ্ডের বাকি অসংখ্য বস্তুর সঙ্গে একই কাতারে ফেলে আরেকটা বস্তু বা সত্তা বানিয়ে খাটো করে ফেলতে না পারে। এই শব্দটাও, আমার ক্ষুদ্র বিচারে, তেমন — স্থান ও কালের ঊর্ধ্বে এর অবস্থান এবং এর সত্তা এখনো আমার ও আমাদের অনেকেরই আতঙ্কগ্রস্ত মাথায় নির্মীয়মাণ। সন্দেহবাদীদের ষড়যন্ত্রে আমরা একে অতীত হতে দেব না, আমি একে ইতিহাস হয়ে যেতে দেব না। 

সে যে এখনো বর্তমান, সে যে এখনো ‘হচ্ছে’, এ রকম এক দৃঢ় বিশ্বাস নিয়েই আমি মেহেরনাজের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম, তাকে বললাম আমার সঙ্গে জলদি দেখা করতে এবং এই মিশনে আমাদের অতীতের সব রাগ-ক্ষোভ, ভুল-বোঝাবুঝি পেছনে ফেলে—আমার সঙ্গী হতে। মেহেরনাজ জানাল, গত রাতে তার এক মিনিটও ঘুম হয়নি এবং আশ্চর্যের ব্যাপার যে সে-ও আমার মতোই এখন বসুন্ধরা আবাসিকের রাস্তা থেকে রাস্তায় ব্যস্ত এ শব্দের পেছনের ‘ষড়যন্ত্র’ (তার হিসাবে এটা একটা ‘ষড়যন্ত্র’, যেমন আমি জানি সুরভির হিসাবে কাঠমান্ডুর সাম্প্রতিক বিশাল ভূমিকম্প একটা ‘ষড়যন্ত্র’) ও এই শব্দ সংঘটনের তলটা খুঁজে পেতে। মেহেরনাজ আমাকে জানাল, কাজ শেষ করে বা কাজ ঠিকভাবে শুরু করে সে দুপুরের পরে কিংবা বিকেলে আমার সঙ্গে দেখা করবে। আমি বললাম, “ওকে’ এবং রওনা হলাম অ্যাপোলো হাসপাতালের দিকে।

অ্যাপোলোর কাছে যেতে যেতে দেখলাম এক রাতের মধ্যে বসুন্ধরার কোনো কিছুই আর আগের মতো নেই—সব বদলে গেছে, সব ওলটপালট হয়ে গেছে। হাসপাতালের ইমার্জেন্সির সামনে লম্বা লাইন, এতই লম্বা যে তার শেষ মাথা এসে ঠেকেছে তামান্না ফার্মেসির কাছ পর্যন্ত, অনেক বাচ্চা অনেক মায়ের কোলে, অনেক প্রবীণ ও বৃদ্ধ লাইনে দাঁড়িয়ে লাঠিতে বা নাতি-নাতনিদের কাঁধে ভর দিয়ে, আর যেদিকেই চোখ যায়, সাংবাদিকদের গাড়ি, যাঁরা গত রাত থেকে এ পর্যন্ত অসংখ্য ফেসবুক পোস্ট, ফোন কল ও এসএমএসের কল্যাণে আজ সকাল থেকে ভিড়ের বাঁধ ভেঙে আছড়ে পড়েছেন এই এলাকায়। 

বিকেল নামেনি। এখনো কড়া দুপুর। এরই মধ্যে দেখলাম তিনটে দৈনিক পত্রিকার সংক্ষিপ্ত ‘বিশেষ সংস্করণ’ বা ‘অপরাহ্ণ সংস্করণ’ বিক্রি হচ্ছে রাস্তাগুলোর মোড়ে মোড়ে। পত্রিকা তিনটেই বসুন্ধরা এলাকায় ছাপা ও মুদ্রণ হওয়া কাগজ—দৈনিক কালের কণ্ঠ, যুগান্তর ও বাংলাদেশ প্রতিদিন। 

কালের কণ্ঠর প্রথম পাতার লাল ব্যানার হেডিং: ‘রহস্যময় শব্দে কেঁপে উঠল বসুন্ধরা’। তারা বসুন্ধরা শব্দের পরে ‘আবাসিক এলাকা’ কথাটা না লিখে খবরের ব্যাপ্তি ও বিশালত্ব বেশ কায়দা করে বাড়িয়ে দিয়েছে, পড়ে মনে হচ্ছে তাদের শিরোনামের ‘বসুন্ধরা’ মানে তারা যা বোঝাতে চেয়েছে, তা-ই, মানে পুরো পৃথিবী, যা কিনা বসুন্ধরা শব্দের আক্ষরিক অর্থ। তারপর তারা পুরো দুই পাতা জুড়ে প্রায় কুড়ি-পঁচিশটা ছবি ছেপেছে উইন্ডশিল্ড ভাঙা গাড়ির মিছিলের, অসংখ্য বাড়ির জানালার ফ্রেমের, যাতে একটাও কাচ টিকে নেই আর, ভয়ার্ত শিশুদের ক্রন্দনরত চেহারার, রাস্তা বন্ধ করে জামাতে দাঁড়ানো প্রার্থনারত মানুষের। একটা ছবিতে স্রেফ একটা কুকুর, তার চেহারায় অপার জিজ্ঞাসা এবং তার গালের এক পাশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। আমি ধারণা করে নিলাম, কোনো না কোনো ছুটন্ত কাচের আঘাতে কেটে গেছে কুকুরটার গাল। কালের কণ্ঠর প্রতিবেদনটা পরে পড়ব বলে রেখে দিলাম হাতের মুঠোয় ভাঁজ করে। 

এরপর চোখের সামনে মেলে ধরলাম দৈনিক যুগান্তর। খুব কাব্যিক এক শিরোনাম করেছে তারা প্রথম পাতার পুরো আট কলামজুড়ে : ‘স্তব্ধ বসুন্ধরা : তিন সেকেন্ডের শব্দ এবং অনন্ত নীরবতা’। এই শিরোনামেও করা হয়েছে একই কাজ, বসুন্ধরা শব্দকে ব্যবহার করা হয়েছে মেটাফরিক অর্থে, এবং শব্দ-পরবর্তী নীরবতার কথা এভাবে লিখে সম্ভবত পৃথিবীর শেষ হয়ে যাওয়ার গা-ছমছমে ইঙ্গিত রাখা হয়েছে এতে। দৈনিক যুগান্তর-এ ছবি কম, লেখা বেশি। লেখাগুলো পড়ার সময় নেই এখন আমার হাতে। শুধু একটা ছবি দেখলাম সরফরাজ নওয়াজ সাহেবের। তাঁর মন্তব্যে চোখ বোলানোরও সময় নেই আমার; তা ছাড়া কীই-বা আর বলবেন তিনি আল্লাহর গজবের কথা বলা ছাড়া? এটাও কিনলাম, কালের কণ্ঠর ভাঁজের মধ্যে ভাঁজ করে রাখলাম। 

এবার বাংলাদেশ প্রতিদিন। তারাই সম্ভবত এ তিনটে পত্রিকার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর কাজটা করেছে। তাদের পত্রিকার প্রথম পাতার মাথায় দেখলাম রক্তলাল রঙে শুধু এ কথাটুকুই লেখা পরপর দু লাইনের ব্যানারে : ‘ডেটলাইন রাত ১২টা ৭ মিনিট পনেরোই আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের প্রথম প্রহরে এ কিসের আওয়াজ?’ আর নিচে বাকি পাতার পুরোটাই ফাঁকা। 

তিনটে পত্রিকাই আমার হাতে। দেখলাম অন্য সব জাতীয় দৈনিক এ খবরটা ছাপানোর মতো সময় করে উঠতে পারেনি। খুব স্বাভাবিক, কারণ, রাত বারোটা নাগাদ তো পরের দিনের পত্রিকা অবশ্যই বেরিয়ে যায়। আমি ভিড় ঠেলে অ্যাপোলো হাসপাতালের নিচতলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। কী করব, কোন দিকে যাব, এখানে আমার কাজ কী, তা বুঝে উঠতে পারলাম না। কাস্টমার সার্ভিসের গোলমতো জায়গার পাশে যে টিভিগুলো চলছে, তাদের পর্দায় তাকালাম অন্য আরও কয়েক ডজন দর্শকের মতোই। ওখানে চারটে টিভি পরপর অর্ধবৃত্তাকারে রাখা, একটা থেকে আরেকটা যথেষ্ট দূরে দূরে। প্রথমটাতে দেখলাম বাংলাদেশের এক চ্যানেলে ওই একটাই খবর দেখাচ্ছে, মনে হলো তারা আমাদের বিল্ডিংটাও দেখাল যেন, এ মুহূর্তে এক শিক্ষিত গৃহবধূ কথা বলছেন ইংরেজির ফাঁকে ফাঁকে বাংলা মিশিয়ে : ‘ইটস লাইক, হরিবল, দিস অ্যান্টিসিপেশন অব থিংস কামিং টু এন এন্ড ইজ লাইক, বলে বোঝানো যাবে না।’ 

পরের টিভিতে ভারতের বিখ্যাত একটা চ্যানেল, তাতে গান গাইছেন কুমার শানু, এবং পর্দার নিচের পুরোটাজুড়ে স্কুলে দেখানো হচ্ছে একটাই কথা : ‘DHAKA BANGLADESH RESIDENTIAL DISTRICT SHUDDERS AT A MYSTERIOUS SOUND-13 KILLED – HUNDREDS INJURED’। 

এমন সময় সুরভির ফোন এল কাঠমান্ডু থেকে। বহুদিন পর আমার কথা হচ্ছে তার সঙ্গে। তার কণ্ঠস্বর রীতিমতো কাঁপছে, সে আমাকে আমি কেমন আছি, ভালো আছি কি না, জিজ্ঞাসা করেই বলল সিএনএন চ্যানেলে চোখ রাখতে, এক্ষুনি। আমি তাকে বললাম যে আমি টিভি পর্দারই সামনে এবং একটা টিভিতে সিএনএন না, বিবিসি চলছে, আর সে যে খবরের কথা বলছে, তা তো দেখাচ্ছে বিবিসি চ্যানেলেও। সে আমাকে জোর করতে লাগল সিএনএন ছাড়ার জন্য। আমি তাকে বললাম যে আমার সে উপায় নেই, কারণ, আমি একটা পাবলিক প্লেসে দাঁড়িয়ে টিভি দেখছি, টিভির রিমোট আমার কাছে নেই। সুরভি তখন বলল, ‘সিএনএন বলছে যে ঢাকার এই অদ্ভুতুড়ে বিকট শব্দের পেছনে এরই মধ্যে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিশ্বস্ত সূত্রের বরাতে এই অনুমান রাখছে যে, এটা আইএসের কাজ।’ সুরভি আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করল, নিশ্চিত হবার স্বার্থেই যে আমার বাসা তো ওই বসুন্ধরা আবাসিকেই, নাকি? আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’। সে জানতে চাইল আমি শব্দটা শুনেছি কি না? আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’। সুরভি তখন বারবার বলতে লাগল, ‘সাবধানে থেকো, সাবধানে থেকো, ফ্রি হলে আমাকে কল দিয়ো, জরুরি কথা আছে।’ সুরভির ফোন রেখে আমি চার নম্বর টিভির দিকে তাকালাম। আল-জাজিরা চলছে। দোহা শহরের উঁচু উঁচু দালানের সামনে বিরাট ঐতিহ্যবাহী এক নৌকার স্থাপত্য ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখানো একটা বিজ্ঞাপনের শেষে তারা ব্রেকিং নিউজ দিল, বাংলাদেশের ঢাকায় ঘটে গেছে এক মহাকাণ্ড। জাতীয় শোক দিবসের গাম্ভীর্যকে খান খান করে দিয়ে সেখানে এমন এক গায়েবি আওয়াজ শোনা গেছে, যা কিনা ব্যাপ্তি ও প্রচণ্ডতার বিচারে আধুনিক পৃথিবীতে এই প্রথম। তারা এ শব্দের সঙ্গে তুলনায় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমায় আণবিক বোমা বিস্ফোরণের শব্দ ও মিত্রবাহিনীর ড্রেসডেন এয়ার অ্যাটাকের শব্দকেও পিছিয়ে রাখছে ‘আনসার্টেইনটি ফ্যাক্টর’ বা ‘অনিশ্চয়তা’র সাপেক্ষে বিচার করে। 

আমি বিবিসির খবর, আল-জাজিরার ব্রেকিং নিউজ ও সুরভির মুখে সিএনএনের কথা শুনে হঠাৎই বুঝে গেলাম, এ মুহূর্তে এই পৃথিবীর অন্যতম প্রধান খবর আমাদের এখানকার এই বিকট শব্দ। বাংলাদেশের চ্যানেলে দেখলাম বলা হচ্ছে দেশের প্রধানমন্ত্রী টুঙ্গিপাড়ায় দোয়া মাহফিল, মোনাজাত এবং তাঁর পিতার কবরে অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আজ বিকেলে ঢাকায় নেমে সোজা বসুন্ধরায় আসবেন। আমার ভয় হলো বঙ্গবন্ধুকন্যার এ কাজটা করা নিরাপত্তার দিক থেকে ঠিক হচ্ছে কি না, সেটা ভেবে। এমন কি হতে পারে না যে তাঁর পিতা-মাতা-পরিবার-পরিজনের এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ দিবসে এই শব্দের ফাঁদ ফেলে তাঁকে বসুন্ধরায় টেনে আনা হচ্ছে ভয়াবহ বিপদে ফেলবার জন্য? যদিও এখন আর ১৯৭৫ সালের মতো দুর্বল ও অর্থহীন নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই, যদিও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা এখন বিশ্বমানের, সত্য, তবু আমার যেমন একদিকে ভয় হতে লাগল যে অন্ধকারের শত্রুরা, যারা এত বড় দুনিয়াকাঁপানো এক শব্দের খবরের জন্ম দিতে পারে, তারা নিশ্চয় ওই নিরাপত্তাবলয়ও ভাঙতে পারবে, অন্যদিকে তেমনই মনে হলো যে এসএফএফ, এনএসআই, ডিজিএফআইকে ধোঁকা দিয়ে কেউ এখানে দিনের বেলায় দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিপদে ফেলবে, সে ভয় আসলে অমূলক। আমি সুরভির বলা জরুরি কথাটা কী, তা জানার নিদারুণ আগ্রহ থেকে (অন্য কোনো সময়ে এই আধা পাগল মেয়েটা এটা বললে আমি এর কোনো তোয়াক্কা করতাম না অবশ্য) অ্যাপোলো হাসপাতালের সীমানাদেয়ালের বাইরে বের হয়ে পেছন দিকের নির্জন কোনো রাস্তার খোঁজে পা বাড়ালাম। 

নির্জন রাস্তা পেয়েও গেলাম একটা। সুরভিকে ফোন করব, তখনই দেখলাম পাঁচ আফ্রিকান যুবক রাস্তার ওপরে এসে পড়েছে ফুটবল নিয়ে। আমি ওদের পেশির টান টান ভাব ও কালো চামড়ায় সূর্যের আলোর চিকচিক দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ওদের একদম কাছে। দলের মধ্যে যে একটু বেশি বয়স্কমতো, সে তার মুক্তোর মতো সাদা দাঁত বের করে বলল, ‘হোয়াট?’ আমি বললাম, ‘নাথিং।’ আবার বললাম, ‘হোয়ার আর ইউ ফ্রম?’ সে উত্তরে বলল, ‘হোয়াট ডাজ দ্যাট ম্যাটার?’ তখন তার পায়ে বল, সে বলে লাথি মারার সময়ে ‘ম্যাটার’ শব্দটা বলেছে বলে কণ্ঠের বিশেষ ইনফ্লেকশনে ওটা শোনাল ‘মাটার’ বা ‘মাদার’-এর মতো। বাকি চারজন আমাকে জলদি জলদি বিদায় করার প্রয়োজন থেকেই যেন বলল, ‘জানজিবার,’ ‘জানজিবার’। 

আমি জানতাম না জানজিবারের ফুটবল খেলোয়াড়েরাও এখন ঢাকার ক্লাবে খেলে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘জানজিবার, মানে তানজানিয়ার জানজিবার?’ 

তারা একসঙ্গে পুতুলনাচের পুতুলদের মতো আমাকে ঘিরে দৌড়াল, বল নিয়ে ড্রিবলিং করল এবং বলতে লাগল, ‘ইয়েস ইয়েস ইয়েস ইয়েস ইয়েস।’ 

আমি কল্পনা করতে লাগলাম জানজিবারের বাওবাব গাছ, তার উপকূলজুড়ে ভারত মহাসাগরের পানির ভেঙে পড়া, ওমান সাম্রাজ্যের আমলে তার ক্রীতদাস বিক্রির হাট, তার দূর গ্রামে আমাদের ব্র্যাক এনজিওর অফিস, তার বড় জাহাজের খোলের মধ্যে বসা হাজার হাজার ক্রীতদাস, যারা বমি করছে, মারা যাচ্ছে, পায়খানা করে দিয়ে তার মধ্যে বসে রয়েছে এবং ভাবছে যে যেন জাহাজ ইংল্যান্ড-আমেরিকা পৌঁছানোর আগেই তাদের সমুদ্রমৃত্যু হয়। আমি জানজিবারের পাঁচ খেলোয়াড়ের টান টান শরীর ও ইয়েস বলার শশশ ধ্বনি খেয়াল করে বুঝলাম, কাল রাতের ওই বিকট শব্দকে তারা দেখছে আমাদের চেয়ে অন্যভাবে, আফ্রিকান হিসেবে এবং সে কারণে—মৃত্যুভয় তাদের কাছে ডালভাত বলেই-তারা এ রকম ফুটবল খেলে যেতে পারছে বিকারহীন পায়ে। 

সুরভি ফোন ধরে বলল, ‘তাহলে আমাকে ফোন করলে শেষমেশ? আমার ই-মেইলগুলো পাওনি? আমার এত দিনের ফোনগুলো পাওনি? একবার মনে হয়নি দ্বিতীয় ভূমিকম্পটার পরে আমি বেঁচে আছি কি না? হোয়াই আর ইউ লাইক সাচ আ বিগ ব্রুটাল অ্যানিম্যাল? হোয়াই?’ 

আমি চুপ। সুরভি কাঁদছে। আমি বুঝতে পারলাম আমি তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, আমার উচিত ছিল ১২ মেতে কাঠমান্ডুর দ্বিতীয় দফা ভূমিকম্পের পরে অন্তত একবার হলেও তার খোঁজ নেওয়া। আমি তাকে ‘সরি’ বললাম, বললাম যে, আমার ভুল হয়ে গেছে। সে কথা শুনে একনিমেষে ঠিক হয়ে গেল সুরভি, সে ঝলমল করে উঠল, অনেক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল আমাকে নিয়ে, বলল যে আমি জানোয়ার ধরনের মানুষ হলেও, মেয়েদের এক্সপ্লয়েট করা আমার প্যাশন হলেও, মানুষ আমি অত খারাপ নই, তবে আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা আমি কনফিউজড, এই পৃথিবীতে আমার পায়ের তলার মাটি এবং হাত দিয়ে ধরা কোনো দেয়াল-লাঠি-ফার্নিচার ইত্যাদির সাপোর্ট সিস্টেম নিয়ে কনফিউজড। 

এবার সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘মেহেরনাজ কেমন আছে? নাকি ইউ আর ডেটিং সাম আদার ফিমেল স্টুডেন্ট অব ইওরস, ইউ ফাকার?’ তারপর তার হা হা হাসি, যার গভীরে আমি টের পাচ্ছি বিরাট বেদনার ছাপ। সে আমাকে আচমকা বলল, সে একটা ভাইব্রেটর কিনেছে, টুকটুকে লাল রঙের, লেংথ মাইক্রোপেনিসের’। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘মাইক্রোপেনিস কী জিনিস?’ সুরভি হা-হা করে হাসল, বলল, “ইউ ডোন্ট নো অ্যানিথিং। ইটস টু পয়েন্ট এইট ইঞ্চেস ইন লেংথ অ্যান্ড ফোর পয়েন্ট সেভেন ইন সারকামফেরেন্স। গট ইট?’ 

তারপর আমরা আরও দুই মিনিট একধরনের সেমি ফোনসেক্স করলাম এই ভরদুপুর ও প্রায় বিকেলে—আমি রাস্তায় হাঁটছি, আমার বাম পাশে আতাফল, নারকেল ও আমগাছ, আমটাকে জড়িয়ে ধরে আছে শেফালি, শেফালির পাতা ছুঁয়ে আছে অনেকগুলো হেলিকোনিয়াকে, যাদের তলার দিকে আবার লাল সোনালু। জানলাম সুরভি তার বেডরুমে—একা। সে স্পষ্ট গোঙানির শব্দ করল। আমি বললাম, ‘থামো।’ 

সুরভি থামল এবং মিলিসেকেন্ডের বিরতি না দিয়ে গড়গড় করে বলে গেল যে সে জানে আমি ঢাকার বসুন্ধরা নামের এলাকাটায় থাকি, আজ সকালে প্রথম বিবিসিতে খবরটা দেখে সে ঘাবড়ে গিয়েছিল, আবার গত রাতে সে আমাকে স্পেশালি মনে করছিল, কারণ আজ পনেরোই আগস্ট শুরু হচ্ছে, মানে আমার চির-অসুখের দিন, তারপর সকালে টিভিতে এই নিউজ, তখন তার একমুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল যে যেহেতু পনেরোই আগস্ট আমার কাছে বিরাট এক ব্যাপার, তাই এ তারিখেই ঘটা এই শব্দ আমাকে কেন্দ্র করেই এবং আমি নিশ্চয় শব্দের তরঙ্গধাক্কায় টুকরো টুকরো হয়ে মারা গেছি। তারপর সে আমাকে ফোন করে করে না পেয়ে, উপায়ান্তর না দেখে মেহেরনাজকে ফোন করে জেনেছে যে আমি বেঁচে আছি। তারই একটু পরে টিভিতে যখন দীর্ঘক্ষণ ধরে বসুন্ধরার রাস্তাঘাটে নেমে আসা আতঙ্কগ্রস্ত পরিবারগুলোকে দেখাচ্ছিল, তখন তার ধারণায়, একঝলকের জন্য হলেও আমাকে সে দেখতে পেয়েছে একটা বড় বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়ানো চার-পাঁচটা লালরং অ্যাম্বুলেন্সের পাশে, আমার গায়ে ছিল কালোরং টি-শার্ট। আমি তাকে বললাম, আসলেই আমি আজ সকালে অ্যাপোলো হাসপাতালের কাছে গিয়েছিলাম এবং সত্যি দু-তিনটে অ্যাম্বুলেন্সের মাঝখানের এক একটু চুপচাপ জায়গায় দাঁড়িয়ে আল-জাজিরা চ্যানেলে ছোট মন্তব্য বা সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলাম, তবে আমার গায়ে তো কোনো কালো টি-শার্ট ছিল না, ছিল নীল এক হাফহাতা জামা। 

সুরভি জানতে চাইল, আল-জাজিরা কেন আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছে এবং তা টিভিতে কখন দেখাবে? 

আমি তাকে বললাম, ‘আল-জাজিরা এবং অন্য অনেক চ্যানেল বসুন্ধরার অনেক মানুষের কাছেই তাদের প্রতিক্রিয়া কী, এসব জানতে চাইছে; আমি জানি না কখন তারা আমাকে দেখাবে। 

সুরভি বলল, ‘কাজটা তুমি ভালো করোনি, বোকার মতো কাজ করেছ। ডোন্ট বি হাই প্রোফাইল ইন দিস সিচুয়েশেন। মেইটেইন আ ভেরি লো প্রোফাইল। ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া হোয়াট ইজ হ্যাপেনিং। ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া হাউ অল দিস আর কানেক্টেড ট ইচ আদার—দিস স্ট্রেঞ্জ সাউন্ড ইন ঢাকা অ্যান্ড দিজ আর্থকোয়েকস ইন নেপাল অ্যান্ড মেনি আদার থিংস।’ 

আমি বুঝতে পারলাম সে তার ই-মেইলে বলা ‘ষড়যন্ত্রে’র দিকে ইঙ্গিত করছে।

আমি তাকে বললাম, “খুলে বলো। ই-মেইলে কী বলছিলে? কিসের ষড়যন্ত্র?’ 

সুরভি জানাল, ‘ইমপসিবল। এগুলো ফোনে বলা যাবে না। সব ফোন প্রোব্যাবলি ট্যাপ করা হচ্ছে। আমার তো মনে হয় আমি আন্ডার সারভেইল্যানস।’ 

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তাহলে কীভাবে বলবা?” 

সুরভি বলল, ‘দেখি, ই-মেইলে লিখব কিংবা ঢাকা চলে আসতে পারি। ডোন্ট টেল মি ইউ লিভ উইথ মেহেরনাজ ইন দ্য সেম হাউস। অবশ্য আমি ঢাকায় এলে ওয়াসফিয়াদের বাসায় থাকব।’ 

আমি বললাম, “আচ্ছা। বাট আই ডোন্ট লিভ উইথ মেহের। মাই ফুট।’ 

সুরভি হাসল। তারপরে বলল, ‘মেহেরনাজ একটা ভালো মেয়ে, অলওয়েজ বিজি, কিন্তু ভালো।’ তবে মেহেরনাজ আজ তাকে নাকি আজব একটা কথা বলেছে। আমি জানতে চাইলাম, কী কথা। 

সুরভি বলল, মেহেরনাজকে সে যখন পীড়াপীড়ি করছিল আমার একটু খোঁজ নিয়ে তাকে জানাতে যে আমি ভালো আছি কি না, সুস্থ আছি কি না, তখন নাকি একপর্যায়ে মেহেরনাজ বলেছে, ‘অনেস্টলি স্পিকিং, আই অ্যাকচুয়ালি ডোন্ট কেয়ার ইফ হি ইজ অ্যালাইভ অর ইজ ডেড।’ 

মেহেরনাজ এমন একটা কথা বলেছে জেনে আমি প্রথমে চুপ হয়ে পরে হেসে ফেললাম। সুরভি বলল, ‘হাসছ কেন? মেহেরনাজের সঙ্গে তোমার ঝগড়া চলছে? কী নিয়ে? ইউ আর নট ফাকিং হার এনাফ? একটা জিনিস খেয়াল করো, আমার সঙ্গে তোমার ঝগড়া চলছে, মেহেরনাজের সঙ্গেও তোমার ঝগড়া চলছে। আমি অ্যাকচুয়ালি তোমাকে হেইট করি, মেহেরনাজেরও যেহেতু তুমি বাঁচো কি মরো তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নাই, তাই বোঝা যায়, সে-ও তোমাকে হেইট করে। তার মানে, জীবনে তোমার কেউ নেই। তার মানে, তোমার সঙ্গে কেউ থাকবে না, কেউ যেমন ছিলও না কোনো দিন। ইটস অল অ্যাবাউট জাস্ট সেক্স উইথ ইউ। ইউ আর লস্ট, ইউ আর ম্যানিপুলেটিভ, অ্যান্ড ইউ আর বেসিক্যালি অ্যান অ্যানিম্যাল।’ 

আমি সুরভির কথা শেষ হলে বললাম, ‘আর কিছু? রাখি এখন। ঢাকা কবে আসবা জানাবা। আই উইল রিসিভ ইউ এট দ্য এয়ারপোর্ট। আর শোনো, ওয়াসফিয়ার বাসায় উঠতে হবে না। আমার বাসায় উঠবা।’ 

সুরভি চুপ। একটা প্লেন চলে গেল আমার মাথার ওপর দিয়ে। প্লেনের বিরাট আওয়াজ শেষ হলে আমি বুঝতে পারলাম সুরভি আবার কাঁদছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হলো? হোয়াই আর ইউ ক্রায়িং? কী বললাম আমি?’ 

সুরভি, সম্ভবত নাক মুছতে মুছতে, জানাল, ‘কিছু না। সো স্ট্রেঞ্জ। ইফ ইউ শো ইভেন আ টাইনি বিট অব অ্যাফেকশন ফর মি, ইভেন আ লিটল বিট অব লাভ ফর মি, আই জাস্ট মেল্ট, আই ক্রাই। সো মাচ আই লাভ ইউ। ইউ উইল নেভার আন্ডারস্ট্যান্ড। ইউ ডোন্ট হ্যাভ দ্য নেসেসারি হার্ট টু আন্ডারস্ট্যান্ড।’ 

আমি তাকে বললাম, ‘আমার সমালোচনা না করলে হয় না?’ 

সে বলল, ‘যাও, করব না। বাট টেল মি দ্যাট ইউ লাভ মি। টেল মি দ্যাট ইউ আর সরি ফর নট বিয়িং ইন টাচ ওভার লাস্ট ফিউ মান্থস।’ 

আমি তাকে ভালোবাসি বললাম, সরি বললাম, বললাম যে আমি চাচ্ছিলাম, আমি সব সময়েই চাই তাকে ফোন করব, এমনকি কাঠমান্ডু যাওয়ারও প্ল্যান করছিলাম এই কয় দিন আগে। 

সুরভি জিজ্ঞেস করল, ‘সিরিয়াস?’ 

আমি বললাম, ‘সিরিয়াস’। 

সুরভি বলল, “বাট ইউ লাই। আই ডোন্ট ট্রাস্ট ইউ।’ 

আমি বললাম, ‘আই অ্যাম নট লায়িং নাউ। 

সুরভি ফোনের মধ্যেই আমার গায়ের দিকে ঘেঁষে এল, আমি তার শরীরের উষ্ণতা, তার চুলের এলোমেলো ছোঁয়ায় আমার গা ঝিমঝিম করে ওঠা, সব টের পাচ্ছি। 

দূরে, এখান থেকে অদৃশ্য এক রাস্তায়, গাঢ় আফ্রিকান উচ্চারণে জানজিবারের একটা ছেলে অন্য কাউকে ডাকছে ‘তাবিথ, তাবিথ,’ বা ‘থাবিথ, থাবিথ’ বলে, কে যেন কোথায় পড়ে গেল ধুম করে, সম্ভবত কোনো বিড়াল কোনো বাড়ির ওপরের ফ্লোর থেকে পড়েছে বাড়ির সামনে বাগানের ঝাড়ের ওপর, আমি সুরভির কান্না শুনছি তো শুনছিই, তাকে বলছি, ‘ডোন্ট ক্রাই,’ সে আমাকে জিজ্ঞেস করছে, তার কাছ থেকে আবার হারিয়ে যাব কি না; আমি বলছি ‘না’; সুরভি জানতে চাইছে কাকে আমি সত্যি ভালোবাসি তাকে, নাকি মেহেরনাজকে? সুরভি জানতে চাইছে কে আমার কাছে বেশি সুন্দর—সে নাকি মেহেরনাজ? সুরভি আরও জানতে চাইছে কে বিছানায় বেশি ভালো পারে-সে, নাকি মেহেরনাজ? আমি একটা প্রশ্নেরও উত্তর না দিয়ে তাকে বলছি, ‘কী সব আজব প্রশ্ন এগুলো, হোয়াই ডু ইউ আস্ক?’ সে বলছে, ‘বিকজ আই অ্যাম বেটার অ্যান্ড আই লাভ ইউ মোর অ্যান্ড আই ওয়ান্ট টু ম্যারি ইউ অ্যান্ড মেহেরনাজ নেভার ওয়ান্টস টু ম্যারি, ইউ টোল্ড মি, ইভেন মেহেরনাজ টোল্ড মি সো।’ 

আমি একটু থামলাম। গুছিয়ে নিলাম যে কী বলতে চাই। তারপর তাকে বললাম, ‘মেহেরনাজের সবকিছু বাস্তবে উল্টো। দেখতে-শুনতে যা মনে হয়, তার উল্টো। যা সে বলে, বাস্তব তার উল্টো। যদি একটা মেয়েও চুপচাপ বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে নিরিবিলি সংসার করতে চায় তো সেটা মেহেরনাজ। সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা কাজ, তখন এক মেহেরনাজ। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকাল আটটা সংসার, তখন আরেক মেহেরনাজ। প্রোব্যাবলি দ্য বেস্ট কাইন্ড অব ওয়াইফ ওয়ান কুড ইমাজিন।’ 

সুরভি আমার কথা শুনে আহত হলো, স্তব্ধ হলো, মুখে বলল, ‘মেহেরনাজের এত প্রশংসা করলে? তা-ও আমার কাছে? দরকার ছিল?’ 

আমি বললাম যে আমি যা ফিল করেছি, তা-ই বলেছি, যেহেতু সে কথা বলছিল মেহেরনাজের বিয়ে করা বা না-করা প্রসঙ্গে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ডু ইউ গাইজ রেগুলারলি টক?’ 

সুরভি জানাল, ‘মাঝেমধ্যে। যখন তোমার খোঁজ নিতে ইচ্ছা করে। ওই ইচ্ছা অবশ্য আমার প্রতিদিনই করে। বাট ইউ সেইড এনাফ অ্যাবাউট মেহেরনাজ। নাউ টেল মি অ্যাবাউট মি।’ 

আমি সমস্যায় পড়ে গেলাম। বললাম, ‘মেহেরনাজেরটা বলেছি তোমার কাছে। তোমারটা বলব মেহেরনাজের কাছে। তোমাকে বলব না।’ সুরভি আমার কথা শুনে হাসল। আমি বললাম, ‘স্টপ।’ 

রাস্তা দিয়ে একদল হুজুর যাচ্ছেন সুরা পড়তে পড়তে। আমি বললাম, ‘সাইলেন্স।’ সুরভি চুপ করল। আমার পাশ দিয়ে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা একটা দশ-বারোজন হুজুরের দল চলে গেল, তারা আরবিতে কী একটা দোয়া বা সুরা পড়ছে, আমি শুধু সেটার একটা লাইন ধরতে পারলাম, লাইনের একটা কোনো অংশ : ওয়া আসিরু কওলাকুম আওয়িঝারু বিহি ইন্নাহু আলিমুম বিজাতিস ছুদুর।’ এ রকম, এ রকম কিছু। হঠাৎ চোখে পড়ল আমাদের বাসার কেয়ারটেকার মান্নান সেখানে। মান্নানের হাত ধরে আমি টান দিলাম। সে আমাকে দেখল, আমি তাকে দেখলাম। তার দুচোখে না ঘুমানোর লাল, তার চেহারায় সব হারিয়ে ফেলার ভয়, তার দুই ঠোঁটের কোনায় সাদা থুতু। আমি সুরভিকে বললাম, 

‘রাখি, পরে করছি।’ সুরভি বলল, ‘অসুবিধা নেই, লাইনে থাকি। প্লিজ।’ আমি লাইন কাটলাম না। আমি ভাবছি মান্নান আবার কখন এ রকম সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে হুজুর হয়েছে? মান্নান আমাকে বলল, ‘স্যার, কেয়ামত আসতেছে। পাপের পথ থিকা সইরা আসেন।’ 

আমি বললাম, ‘মান্নান, কী পড়ছ? জানো তুমি কী পড়ছ?’ 

মান্নান হুজুরদের হেঁটে চলে যেতে থাকা দলটার দিকে তাকাচ্ছে, আবার আমার না কেটে ফেলা ফোনের দিকেও চোখের কোণ দিয়ে দৃষ্টি রাখছে। সে বলল, ‘সুরা আল মুল্ক।’ 

আমি বললাম, ‘ভালো। কী বলছে এই সুরায়?’ 

মান্নান চলে যাওয়ার জন্য অধৈর্য। সে কোনোমতে আমাকে, আমার হাত থেকে তার নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে জানাল, ‘বলছে, যিনি আসমানে আছেন, তিনি আমাদেরে মাটির মধ্যে ধসায়ে দেবেন, হঠাৎ দুনিয়া জোরে ঝাঁকি খাইতে থাকবে, আমরা সেই ভয়টা পাচ্ছি না কেন? যিনি আসমানে আছেন, তিনি আমাদের দিকে পাথরের বৃষ্টিওয়ালা বাতাস পাঠাবেন। আমরা কেউ ভয়টা পাচ্ছি না কেন? বলছে, তখন আমরা জানতে পারব খোদার সাবধানবাণী কেমন।’ 

আমি মান্নানের পড়াশোনার গভীরতা ও স্পষ্টতা দেখে বিমুগ্ধ হয়ে তার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রয়েছি, সুরভি ফোনের ওপাশ থেকে বলছে, ‘হ্যালো’, আমি দেখছি মান্নান সামান্য একটু পথ গিয়ে দৌড়ে ফেরত আসছে আমার দিকে। আমার কানের কাছে এসে সে বলল, “স্যার, মেহের আপা আইসা অনেকক্ষণ নিচে দাঁড়াইয়া ছিল, উপরে যায় নাই।’ 

মান্নান চলে গেল। দূরে আমি দেখলাম সে মিলে যাচ্ছে আরও অনেক সাদা পোশাকের মধ্যে, আর ওদিকে সুরভি জিজ্ঞাসা করল, ‘মেহেরনাজ নিয়ে কে তোমাকে কী বলল?’ আমি সুরভিকে জানালাম, আমাদের বাড়ির কেয়ারটেকার। সে বলেছে মেহেরনাজ বাসার নিচে এসে দাঁড়িয়ে ছিল আমার খোঁজে। আমি এখন বসুন্ধরার অন্য জায়গায়। সুরভি বলল, “আমার ফোন রেখে তুমি মেহেরনাজকে ফোন দাও। ডু দিস। মে বি শি ইজ ইন সাম ডেঞ্জার। তোমাদের ওখানে তো সবাই এখন বিপদে আছে।’ 

আমি সুরভির কাছে জানতে চাইলাম যে কী বিপদে আছি আমরা? কী হয়েছে? সুরভি জানাল, সে সকাল থেকে টিভি নিউজগুলো এবং ইন্টারনেট দেখছে। সে লক্ষ করেছে, অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম বলছে ঢাকার ওই শব্দটা ছিল মুখ চেপে ধরা এক গোঙানির মতো, এর স্থায়িত্বকাল ছিল পাঁচ সেকেন্ড, এটা প্রচণ্ডতায় ছিল আণবিক বোমার বিস্ফোরণে হওয়া শব্দের কাছাকাছি, ঢাকার ওই এলাকায় কমপক্ষে কয়েক হাজার বাড়ির কাচ ভেঙেছে, শত শত গাড়ি চলার অযোগ্য হয়ে গেছে, কারণ, তাদের চারপাশে কোনো কাচ নেই, পুরো বসুন্ধরা এলাকায় এখন একটা পাখিও নেই, পাখির ডাকও নেই, কমপক্ষে তিন শ বাচ্চা ভয় থেকে উৎপন্ন জ্বরে ভুগছে, বড় অনেকেরও ট্রমা থেকে জ্বর এসেছে, সংবাদমাধ্যমগুলো আরও বলছে যে, আশ্চর্যের বিষয়, এই শব্দ ঢাকার অন্য কোথায়ও শোনা যায়নি। এর অর্থ কী হতে পারে, তা নিয়ে আলোচকেরা অনেক অনুমান রাখছেন, তবে সাধারণভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বসুন্ধরা যেহেতু ইউএস এমবাসির খুব কাছে, তাই এমবাসিকে এড়ানোর জন্যই সুচিন্তিত এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সম্ভব করা হয়েছে এই অসম্ভব, শব্দের ব্যাপ্তি একটা নির্দিষ্ট ভূগোলের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে, ‘যারা সেই দাগের ধরো এক ইঞ্চি বা এক হাত বাইরে, তারাও শোনেনি কিছুই। এখন পর্যন্ত তোমাদের ওখানে মৃত্যুর সংখ্যা পনেরো’, সুরভি এ কথাটা বলল যথাযোগ্য ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে। সে আবার বলতে লাগল, মৃত্যুসংবাদের কথা বলার পরের অনুমিত বিরতির শেষে যে, টিভিতে বারবার দেখাচ্ছে বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে এক বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বর-কনে ওই সেন্টার ত্যাগ করবার ঠিক আগে এ শব্দের ধাক্কায় কনেটি মাত্র ২৭ বছর বয়সে মারা গেছে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে, এবং ‘মৃত মোট পাঁচজন তোমাদের অ্যাপোলো হাসপাতালের আইসিইউর রোগী ছিলেন, তাঁরা এমনিতেই মৃত্যুপথযাত্রী ছিলেন, এই শব্দ তাঁদের মৃত্যুকে শুধু ত্বরান্বিত করেছে হিংসাত্মকভাবে। 

সুরভির কথা শেষ হলে আমি তার কাছে জানতে চাইলাম কাঠমান্ডু শহরের পুনর্নির্মাণ প্রজেক্টগুলো সব ঠিকমতো চলছে কি না। সুরভি হেসে বলল, ওই বিশাল দুই ভূমিকম্পে কীভাবে পুরো কাঠমান্ডু শহর তার চরিত্র হারিয়েছে, তা বুঝতে হলে আমাকে কাঠমান্ডু যেতে হবে, এভাবে ফোনে সব শুনে ফেলার চেষ্টা করলে হবে না। আমি তার কথার অশ্লীল ইঙ্গিতটা ধরতে পারলাম, একটু হাসলাম এবং তাকে জানালাম যে আমাদের এখানকার এই শব্দরহস্য বের করার আমি দৃঢ়সংকল্প নিয়েছি, সেটার কিছুটা সমাধান হয়ে যেতেই আমি সেই ‘চরিত্রহীনা’ কাঠমান্ডুতে বেড়াতে আসব। 

সুরভি আবার আমাকে বলল, আমি এমন কিছু কথা বলছি যা ফোনে বলা ঠিক না, আমার নাকি ধারণায়ও নেই যে কত গভীর এক ষড়যন্ত্র চলছে। আমি তাকে এবার জিজ্ঞাসা করলাম যে আন্তর্জাতিক টিভিগুলোয় বাংলাদেশের পনেরোই আগস্ট বিষয়ে কিছু বলা হচ্ছে কি না। সুরভি হাসল, বলল যে সে শুধু দুটো চ্যানেলে শুনেছে এ-সংক্রান্ত কথা, খবরের শুরুর দিকে, যখন বলা হয়েছে রাফলি যে, ‘অ্যাট দ্য স্টার্ট অব দ্য ডে অব মোর্নিং ফর দেয়ার ফাদার অব দ্য নেশন শেখ মুজিবুর রহমান অ্যান্ড হিজ ফ্যামিলি মেম্বারস হু ওয়্যার কিলড এট দ্য আর্লি আওয়ারস অব ফিফটিন্থ অব আগস্ট ইন নাইনটিন সেভেনটি ফাইভ, আ লার্জ ডিস্ট্রিক্ট অব ঢাকা সিটি কলড বাসুনডারা, ব্লাহ্ ব্লাহ ব্লাহ।’

আমি বললাম, ‘ওকে সুরভি, আবার কথা হবে, এখন ফোন রাখি।’ 

সুরভি আমাকে ফোনের মধ্যে কয়েকটা চুমু দিয়ে চলে গেল তার সাহিত্যিক মোড়ে, গলার স্বর পাল্টে গলা গম্ভীর করে কবিতাপাঠের ধরনে বলল, ‘কোনো বিধ্বস্ত নগরীতে-যেমন ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত কাঠমান্ডু, শব্দের পীড়নে বিধ্বস্ত বসুন্ধরা—সেখানকার অধিবাসীদের মনে পাঁচটা জিনিস সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তোলে।’ 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী সেগুলো?’ 

সুরভি বলতে লাগল : ‘এক. হারিয়ে ফেলা কনফিউশনগুলোর জন্য স্মৃতিকাতরতা। দুই. পরিপূর্ণতা না পাওয়া প্রেমগুলোর জন্য দুঃখ। তিন. জীবনে সামান্য স্বাদ পাওয়া সুখ, যার মূল স্বাদের কাছে এখন আর ওখানকার অধিবাসীদের পৌঁছানোর সুযোগ হবে না। চার. প্রকৃতির অন্যায়ের ওপরে ক্ষোভ। এবং পাঁচ. ইউলিসিসের মতো দীর্ঘ নতুন যাত্রা শুরু করার তাড়না।’ 

আমি তার এক থেকে পাঁচ শুনে ও হৃদয়ঙ্গম করে ভাবলাম, সুন্দর। বললাম, ‘সুন্দর। রাখি সুরভি।’ 

সুরভি বলল, ‘রাখবাই তো। কিন্তু বলো তোমার নিজেকে আজ ইউলিসিস বলে মনে হচ্ছে কি না?’ 

আমি বললাম, ‘ওই শব্দের রহস্য উদ্ঘাটনে যে যাত্রা আমি শুরু করতে যাচ্ছি, তার গরিমা ও তাৎপর্যের বিচারে আমার নিজেকে ইউলিসিস বলেই মনে হচ্ছে।’ বুঝলাম আমার কথাটা বেশি অফিশিয়াল, অতএব কিছুটা কমিক্যাল হয়ে গেছে। কিন্তু আমার তাতে কিছু করার নেই। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *