আগস্ট আবছায়া – ১.৬

১.৬

সুন্দরবন কুরিয়ারের অফিস থেকে টাকা নিয়ে ফিরছি, ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। না আলো, না আঁধারির এই সন্ধ্যা খুবই ঘোট পাকানো এক বিষয়—এতে স্পষ্টতা বলতে কিছু নেই, আবার দুর্বোধ্যতা মাত্রাধিক। সন্ধ্যার এই বিভ্রান্তিকর চেহারার চাইতে এমনকি ঘন রাত নামাও প্র্যাকটিক্যাল অর্থে ভালো। উত্তরা থেকে বের হওয়ার পথে ওই সন্ধ্যার আবছায়া প্রহেলিকার মধ্যেই আমি এক বিরাট ট্রাফিক জ্যামে পড়ে গেলাম। 

এতগুলো ক্যাশ টাকা আমার কাছে, দেড় লাখের বেশি, আর গাড়ির চারপাশে ঘোরাফেরা করছে সন্দেহজনক চেহারার লোকজন। আমি বেশি মাত্রায় সচেতন ও টানটান হয়ে থাকলাম, গাড়ির ডানে-বামে সামনে ও রিয়ারভিউ মিররে চোখ রেখে রোবটের মতো দেখতে লাগলাম অসংখ্য দ্বিপদী মানুষের গতিবিধি। মানুষের চার পা থেকে দ্বিপদী হয়ে ওঠার বিবর্তনবাদী তত্ত্ব আমার কিছু পড়া। ওই তত্ত্বগুলোর সবটা মনে নেই, তবে মানুষ যে বেকায়দা চেহারার এক দ্বিপদী প্রাণী এবং তা যে আসলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখার মতো এক বিষয়, সেটা আমার মাথায় গেঁথে গেছে ওগুলো পড়েই। সে জন্য আমি প্রায়শ মানুষ দেখলে, বিশেষ করে পেছন দিক থেকে মানুষ দেখলেই, ভাবি আমাদের শরীরের এই আকৃতি, এই ছাঁচ কেমন অসম্পূর্ণ, কেমন এক বর্ণনা-অযোগ্য বেজুতের—এক অর্থে বিস্ময়জাগানো এই আকার, যা আবার কিছুটা অর্থ নিয়ে ধরা দেয় দৌড়ানো অবস্থার মানুষ দেখলে, আবার সেই অর্থই গোলমেলে হয়ে যায় হাঁটতে থাকা মানুষের পেছন ভাগের দিকে তাকালে। ওই যে মানুষের পিঠ, তার ওপরে বসানো কাঁধ, কাঁধের ওপরে ঘাড়, তার ওপরে চুলে ভরা একটুখানি মাথা, পিঠের নিচে কোমরের নিচ দিক দিয়ে পাছার নেমে যাওয়া এবং তারপর শরীরের ভার বহন করা দুই পা, সরু সরু—এই পেছন ভাগের পুরো দৃশ্যটা কেমন গৌরবহীন ও ফাঁকা আওয়াজ দিয়ে ভরা। 

গাড়ির পাশ দিয়ে আমি দেখলাম হেঁটে যাচ্ছে একজন গেঞ্জি পরা মানুষ, দিনমজুর গোছের, সে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে হাঁটছে এক ত্রস্ত চেহারা নিয়ে। একই ভাব তার সামগ্রিক বডি ল্যাঙ্গুয়েজে। তার গেঞ্জি ঘামে ভেজা, চকচক করছে তার খোলা দুই কাঁধ, এবং তার গলা থেকে কাঁধ, আরও ফোকাস করে দেখলে তার মাথা থেকে কাঁধ পর্যন্ত বিষয়টার মধ্যে আছে কিছুটা হলেও স্থিরতা ও সাবলীলতা, কিন্তু তারপর ওটাই কেমন হঠাৎ নিচের দিকে পিঠে পড়ে গেছে যেন ঝাঁকুনি দিয়ে। এটুকু তবু তর্কের খাতিরে যাহোক মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু যেই না এর সঙ্গে যোগ হয় তার মাথা, মাথার চুল, যে চুল বিস্তৃত হয়ে নেমেছে ঘাড়ের পেছন বেয়ে কাঁধের গোড়া পর্যন্ত আর সেই বিস্তৃতির দুপাশে দেখা যাচ্ছে লকলক করে ঝুলছে তার দুহাত—তখনই পুরো দৃশ্যটা হঠাৎ উপহাস্য কিছুর বদলে হয়ে যায় কুটিল কিছু যেন। 

চার্লস ডারউইন এই ঝুলতে থাকা, আঁকড়ে ধরতে প্রয়াসী দুই হাত নিয়ে বলেছিলেন : ‘মানুষের যদি এই হাত দুটো না থাকত, তাহলে সে কখনোই পৃথিবীতে তার বর্তমানের প্রবল কর্তৃত্বময় অবস্থানে আসতে পারত না, আর দেখুন মানুষের ওই দুই হাত কী অবাক করা ভঙ্গিতে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে তার ইচ্ছার পুরো অনুগত হয়ে চলবার জন্য।’ আমার হাত তো আমার ইচ্ছার অনুগত হয়েই চলবে, এতে আর এমন বিস্ময়ের কী আছে? আসলে বিষয়টা হাত নিয়ে নয়, এটাকে কাঁধ ও পিঠের সামগ্রিক অতি স্বচ্ছন্দ ও সবল আকারের পরিপূরক হিসেবে, শক্তির এক হাস্যকর চেহারা নেওয়ার কৌশলী আয়োজন হিসেবে দেখতে হবে। 

ইতিহাস সাক্ষী দেবে মানুষের পেছন দিককার এই গঠন, তার শক্ত কাঁধের আকৃতিকে ডিজাইনের জড়তা থেকে বাঁচানো দুই হাত মিলে এই সামগ্রিক পেছন দিকের গঠন এ অর্থেই কৌশলী যে মানুষ তা দিয়েই পরিষ্কার জানান দেয় : আমি যতটা না নরম-সরম, তার চেয়ে বেশি ভায়োলেন্ট-দ্যাখো আমার চওড়া কাঁধ, এবার তার সঙ্গে মিলিয়ে দ্যাখো আমার প্রশস্ত পিঠ, যাতে কার্যকরী এক মেরুদণ্ডের ছায়া মেশানো, আর এই দ্যাখো আমার হাত দুটো ঠিক ওদেরই দুপাশে, এবার আসো আমি তৈরি তোমাকে খামচে দেব বলে। আবার আপনি পেছনের এই অমিতাচারিতার চেহারাটা দেখে নিয়েছেন তো ( পাছার গড়ন ও অবস্থান তাতে মিশিয়ে নিয়ে), সঙ্গে সঙ্গে সামনে চলে আসুন, দেখবেন পেছনের তাৎপর্যের সঙ্গে মিল রেখেই সামনের দুটো ত্রস্ত চোরাচোখ যারাও কিনা, মুখের পেশি নড়াচড়ার মধ্য দিয়ে তো আরও বেশি, সাক্ষী দিচ্ছে সেই ভায়োলেন্সের। 

কীভাবে হাঁটে মানুষেরা—দুই পায়ে ভর দিয়ে; কীভাবে দৌড়ায় তারা—দুই পায়ে ভর দিয়ে। আমি ভাবি, এর বদলে মানুষ যদি চার পায়ে চলত, তাহলে একদিকে মাটির সঙ্গে অনুভূমিকভাবে—হরাইজন্টালি—কত সংগতিপূর্ণ লাগত তার সেই আকৃতি ও গড়ন, এবং একই সঙ্গে মানুষের শরীরটা কত বর্তমানের থেকে নিচ দিকে মাটির কাছাকাছি এক জায়গায় থাকত, বুক, পেট, মুখটাও থাকত মাটির কত নিকটবর্তী আর তখন পৃথিবীর ইতিহাসই হতো কত অন্য রকম। আমার ধারণায় সেই মানুষ হতো গাছে গাছে চার পায়ে ঝোলা মানুষ, আর যেখানে গাছ কম, সেখানে মাটিতে চার পায়ে লাফিয়ে বেড়ানো এক কম নিপীড়নকারী প্রাণী। শুধু সেভাবে পৃথিবীর চেহারাটাও গ্রামীণ থেকে এত বিশাল তোড়জোড়ের সঙ্গে আরবান হতো না, এবং মানুষের থাকার ঘর, ঘরের উচ্চতা, দেয়াল, তাদের ব্যবহারের জিনিসপত্র ইত্যাদি সব আকারে কতই না ছোট হতো এখনকার থেকে। বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানীরা বলেন, চার পা থেকে মানুষ দুই পায়ে গেছে পরিবেশের চাপে। আগে জঙ্গলেই থাকত তারা, ঝুলত-লাফাত গাছে গাছে, দূরত্ব পার হতো শাখা থেকে শাখায় লাফিয়েই এবং চারপাশের ওই ঘন গাছগাছালির প্রাথমিক কালের পৃথিবীতে তাদের এমনিতেও দূরে তাকানো লাগত না। কিন্তু পরে তৃণভূমিতে যেই এল তারা, এসে দেখল উঁচু ঘাসের ওপাশে কী আছে, তা দেখবার জন্য তাদের খাড়া হতে হচ্ছে পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে, চোখ মেলে অনেক দূরে তাকিয়ে দেখে নিতে হচ্ছে ঘাসের জঙ্গলের ওপাশে শত্রু প্রাণী আছে কি না কিংবা শিকার করে খাওয়ার মতো পশু আছে কি না কোনো। ওই জীববিজ্ঞানীরা বলেন, ঠিক এ কারণেই তৃণভূমিতে এসে খাড়া হলো আগের চার পায়ের শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাংসদৃশ বৃক্ষবাসী মানুষেরা : মারতে, এবং নিজে যেন না মরে, সেই মারামারিটা ভালোভাবে রপ্ত করতে। 

এর সঙ্গে আমি জানি আরও তত্ত্ব আছে যে, চার পায়ে থাকলে মানুষের শরীর সূর্যের তাপের কাছে বর্তমানের দুই পায়ের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ উন্মুক্ত থাকত বর্গইঞ্চির হিসাবে, তখন তার শরীরের শক্তির ভান্ডার নিঃশেষিত হতো আরও বেশি করে। আবার এ তত্ত্বও আছে যে চার পায়ে চললে বেশি হলে এ জঙ্গল থেকে ও জঙ্গলেই যেতে পারত মানুষ, দীর্ঘ দীর্ঘ পথ অনায়াসে পাড়ি দেওয়া হয়ে উঠত না তার, যা কিনা কেবল সম্ভব দুই পায়ে তিরের বেগে জোরে হেঁটে কিংবা দুপায়ে দৌড়িয়েই। আর সেটাই যদি না পার ত মানুষ, তাহলে জনপদের পরে জনপদ, পৃথিবীর এ অংশের পরে ও অংশ এসব দখল-ধ্বংস-নির্মাণ কে করত মেরেকেটে, দল বেঁধে উৎপীড়ন চালিয়ে, ঘর থেকে অন্যকে বের করে সেই ঘর নিজের বানিয়ে? 

কিন্তু, এত সব কিছুর পরে আমার ধারণা (এ বিষয়ক পড়াশোনা আত্মস্থ করে খাড়া করানো এক ধারণা অবশ্যই) যে, মানুষ দ্বিপদী হয়েছে মূলত দখলদারির হিংস্রতা এবং পুরুষের পুরুষত্ব দেখানোর স্বার্থেই—দুই পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াও, আরেকটু উঁচু থেকে দূরকে দ্যাখো চোখ পিটপিট করে, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে, দুহাত চোখের ওপরে দিয়ে সূর্যের আলোর প্রকট ঝামেলাকে সহনশীল করো, তারপর খোলা দুহাতে তুলে নাও অস্ত্র, এবার অস্ত্রসহ দুহাত দিয়ে বাড়ি মারতে থাকো বুকের ওপরে, ধুমধাম, আর সেই সঙ্গে মাথা ভরা চুল তো আছেই চেহারাকে আসুরিক রূপ দেবার জন্য, আর এবার চিৎকার করতে থাকো গলা ছেড়ে, চিৎকার নয়, পশুর গর্জন এবং তোমার সঙ্গের গোত্রসঙ্গীরা, যাদের হাতে অস্ত্র নেই, তবে আছে ঢোল বা ড্রাম, তারাও তোমার গর্জনের সঙ্গে সংগতি দিয়ে পেটাতে থাকুক ওগুলো, জেগে উঠুক ঘোর দামামা আর এবার দুপায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে তুমি অস্ত্র উঁচুতে তুলে ধরে অঙ্গভঙ্গিমা করতে থাকো আক্রমণের, এবার অন্য পক্ষ যত কাছে এসে যাচ্ছে, তত তুমি নিচের দিকে নামাচ্ছ অস্ত্রগুলো, ভঙ্গি করছ ওদের গলা কেটে দেবার, বল্লম সোজা পেটে বা বুকে ঢুকিয়ে দেবার; এরই সঙ্গে পুরুষেরা, যারা আক্রমণভাগে আছ তারা, একই সঙ্গে নারীদের দেখাতে থাকো তোমাদের উন্মুক্ত পুরুষাঙ্গ—তোমার শরীরের সামনের দিক তো অবশ্যই চারপদী হওয়ার থেকে অনেক বেশি হাঁ করে খোলা হয়েই আছে। 

আমার নিজেকে হঠাৎ মনে হলো আমি শার্ট-প্যান্ট পরা এক নিখাদ-নিরেট পশু, যার চিন্তা ও কল্পনার ফ্যাকাল্টি তাকে অন্য পশুদের শাসন করার ক্ষমতা দিয়েছে ঠিকই কিন্তু সেই আধিপত্য থেকেই তাকে পাশবিকতার সৃজনশীল চর্চায় সক্ষম এক বড় পশুই বানিয়েছে—দুহাতে ঘুষি মারা ও খামচাখামচির শক্তি রাখা, প্রয়োজনে মারাত্মক অস্ত্র হাতে তুলে ধরা এবং দুপায়ের ফাঁকে শক্তপোক্ত ধর্ষণসক্ষম পুরুষাঙ্গ বহন করা এক পশু। 

জ্যাম ভাঙল। আমি গাড়ি চালাতে লাগলাম ধীরে। আমার শরীর লজ্জায় কাঁপছে তখন। মানুষগুলো বিশৃঙ্খলভাবে তখনো রাস্তা পার হচ্ছে একবার লাফিয়ে, আরেকবার দৌড়ে, আবার জোরে হেঁটে এবং তাদের সবারই জামা-গেঞ্জি পরা কাঁধ থেকে শরীর কেমন শুরু হয়েই নেমে গিয়ে দুপায়ের ওপরে দাঁড়িয়েছে ক্রূর এক তেলতেলে ব্যাকৃতিতে। আমার ভীতি হঠাৎই আরও বেড়ে গেল। মনে হলো আমি যেন ঢাকা নামের কোনো শহরে নেই, আছি মিলিয়ন বছর আগের খোলা সাভানায়, উন্মুক্ত তৃণ প্রান্তরে, যখন দেখলাম দুজন ট্রাফিক পুলিশ তাদের এতক্ষণের গোলমতো উঁচু চত্বরে বসা অবস্থান থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন দুপায়ে, একজন আমার দিকে মুখ করে, আরেকজন আমাকে পিঠ দেখিয়ে। আমি ভায়োলেন্সের সামনের পাশ ও পেছনের পাশ, দুই পাশই একযোগে দেখতে পেলাম সন্ধ্যার অর্ধপরিস্ফুট আলোতে—গাড়ির হেডলাইট, রাস্তার বাতি এবং আকাশের শেষ আভা মিলিয়ে যাওয়ার একসঙ্গে মেশানো খিচুড়ি ছায়া ছায়ায়। পেছনের পাশ : শক্তির মোহিনী প্রকাশের নিচে হঠাৎ সামনে গাঁ গাঁ করে ঝাঁপিয়ে পড়ার দেহভঙ্গিতে ভরা; সামনের পাশ : চোরাচাহনিতে, অণুবিজ্ঞানীদের মতো মুখ ও কপালের পেশিগুলো নাচিয়ে-বাঁকিয়ে দেখা যে কীভাবে ঠিক ঠিক মারতে হবে কাকে 

ভাবলাম আজ সকালে, হাসপাতালে, বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীতে আবহমান কাল ধরে মানুষ ও প্রকৃতির যে পরস্পরসংলগ্নতার কাহিনি পড়লাম, তার পরে কিনা আজই আমার সন্ধ্যা নামল এমনভাবে যে আমার মনে হচ্ছে মিষ্টি কথার আড়ালে, নানা ভাববাচক বিশেষ্যর আড়ালে এটা আদতে রক্তাক্ত হওয়ার ও করারই আবহমানতা? বসুন্ধরার প্রাসাদোপম বাড়িটাতে প্রস্তের হোর্থন ফুল দেখে, মার্সেলের গিলবার্তের প্রেমে পড়ার অবিস্মরণীয় মুহূর্তগুলো মনে করে মানবজীবন বিষয়ে যে ইতিবাচক অনুভূতিগুলো আমাকে নাড়া দিয়েছিল মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে, তারই শেষে কিনা মানুষের প্রতি এতখানি বিশ্বাস হারালাম আমি? এই একই দিনের মধ্যে কী করে সম্ভব এ রকম পুরো বৈপরীত্যময় বোধের মুখোমুখি হওয়া? সকালে অ্যাপোলো হাসপাতালের নিচতলায় দাঁড়িয়ে রোগীদের মৃত্যুপথযাত্রার মিছিল দেখেছি বলেই কি হলো এটা? কিন্তু তারা তো আত্মীয়-পরিজনের মায়া-ভালোবাসায় পরিবেষ্টিত ছিলেন? এমনকি তখন যে কাফকা নিয়ে ভাবছিলাম আমি, তারও তো মৃত্যুমুহূর্তে পাশে ছিলেন ডোরা ও রবার্ট ক্লপস্টক, আর কিটসের ছিলেন সেভেরন? তারপরও কী করে আমার মনে হচ্ছে যে রাস্তায় এখন যত লোক দেখছি, তাদের সবাই নীচ-হীন, নিষ্ঠুর ও খুনি? তবে কি আর এক রাত পরের পনেরোই আগস্ট, যা আমার স্মৃতিতে প্রতি মুহূর্তে চেতনে ও অবচেতনে ফেনিয়ে-ঘনিয়ে আসছে তেজকটালের বান হয়ে, তবে কি সেটার জন্যই এসব মনে হচ্ছে আমার? সুরভির ই-মেইলের শেষে বলা ‘বিশাল ষড়যন্ত্র’র কথা ভূমিকম্পে কাঠমান্ডু শহরের গুঁড়িয়ে যাওয়ার উল্লেখের সঙ্গে মিলে আমাকে বিচলিত করেছে খুব বেশি? 

আমি কি এটাই ভাবছি যে, যে পৃথিবীতে আমার নিজের বিশ্বস্ত মানুষগুলোও অবলীলায় আমাকে হত্যায় উন্মুখ লোকদের সবুজ সংকেত দিয়ে দেয় আমাকে পরিবার-পরিজনসহই মেরে ফেলবার, এবং যেখানে প্রকৃতিও মানুষকে বাঁচায় না, বরং তাকে বউ-ছেলে-মেয়ে-বালিশ-কাঁথা-কম্বলসহ তুলো তুলো করে দেয় ভূমিকম্পের চেহারা নিয়ে, সেখানে না থাকে মনুষ্যত্ব, না প্রকৃতির আশ্রয়, অতএব সেই পৃথিবীতে দ্বিপদী মানুষদের নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করে অসহায়ত্ব ও আধিপত্য দেখানো ছাড়া অন্য পথ আর কী থাকে? 

এসব ভাবতে ভাবতে মনে হলো একগাদা মানুষ তাদের চেহারা লুকিয়ে, বুক চিতিয়ে এবং অণ্ডকোষ ঝোলাতে ঝোলাতে যেন ধেয়ে আসছে আমার গাড়ির দিকে, তারা যেন জেনে গেছে এই গাড়ির ভেতরে দেড় লাখের ওপরে ক্যাশ টাকা আছে, সুতরাং এ গাড়ির চালক মানুষটাকে, প্রয়োজনে পুলিশের সহায়তা নিয়েই, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলা একটা অতি যুক্তিযুক্ত কাজ হবে। আমি ত্রাসিত ও প্রায় অশ্রুরুদ্ধ এক অবস্থায় স্নায়ুবিকারের উদ্ভ্রমের মধ্যে পড়ে দ্রুত গাড়ি ছোটালাম বসুন্ধরা অভিমুখে—ট্রাফিক সিগন্যাল সোজা উপেক্ষা করে—বেপরোয়ার মতো, মানুষের যে বেপরোয়া ও আত্মহনন-অভিলাষী ভাবের আজকেই আবার পরিচয় পেয়েছিলাম মধুসূদনের ওই শ্বাসরুদ্ধকর চিঠি পড়ে। 

বাসার গেটে পৌছে দেখি অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার মাহমুদ আনসারি সাহেব তার গাড়ি বের করছেন, সামনের সিটে বসা তার বোরকাপরা স্ত্রী। আমি গাড়ি থেকে নামলাম, ব্রিগেডিয়ার সাহেবও নামলেন মুখে স্মিত হাসি নিয়ে। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, জিজ্ঞাসা করলেন আমি এখন কেমন আছি এবং আজকে হাসপাতাল থেকে এসেই এভাবে একা গাড়ি নিয়ে বের হয়েছি কেন? ওনার আন্তরিকতামাখা প্রশ্নগুলোর ঠিক ঠিক উত্তর দিলাম আমি, চেষ্টা করলাম উত্তরের মধ্যে যতটা সম্ভব আবেগ আনার, কারণ সেটাই নিয়ম, এবং সে নিয়ম মেনে তাকে মন খুলে ধন্যবাদ দিলাম সেদিন আমাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তিনি জানালেন, তিনি আবার ১১ আগস্ট তারিখ আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন এবং আমার কেবিনের সামনেই তার দেখা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, আমার কিছু কলিগ ও কজন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে, তবে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম বলে তাদের কারও সঙ্গে সম্ভবত দেখা হয়নি আমার। এতগুলো লোক আমাকে দেখতে এসেছিল তাদের বুকভরা শুভাশিস নিয়ে, এ কথা জেনে আমার চেহারার মধ্যে কতটা খুশি ও কৃতজ্ঞতার ভাব দেখাব, তা বুঝে উঠতে পারলাম না। শুধু বললাম, ‘তাই? আমি তো এর কিছুই জানি না, পরে হাসপাতালের ওরাও তো আমাকে কিছু বলেনি।’ 

এরপর অস্বস্তিকর এক নীরবতা। আমি ব্রিগেডিয়ার সাহেবকে বললাম, ‘আপনি যান। পরে সময় করে বাসায় আসেন, গল্প করব।’ তিনি, তার মুখ দেখে মনে হলো, আমার প্রস্তাব শুনে উদ্বেগের মধ্যে পড়ে গেলেন, একরকম ভয়ই পেলেন যে আমার সঙ্গে কথা হলে যদি আবার আমি পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের বাস্তুঘুঘুদের প্রসঙ্গ তুলি? আমি ব্রিগেডিয়ার সাহেবের চোখের দিকে তাকালাম, তার দুচোখে দেখলাম বয়সকালের গোধূলি এবং আমার সে রাতের প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর দিতে না পারার অপরাধবোধ, অন্যদিকে তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত দেখলেন যে আমার দৃষ্টিতে রয়েছে শুধু প্রতিশোধের নেশা, ইতিহাসের এই অংশটুকুর দেনা-পাওনার অঙ্ক সমান সমান করে দিয়ে পৃথিবীতে জীবনের সংজ্ঞাকে সহনশীল করে তুলবার এক রোখ-চাপা আকুতি। 

তিনি যদি আমার দৃষ্টিতে ওসব না-ই দেখবেন তো কেন শেষমেশ আমার কাছে জানতে চাইলেন যে হাসপাতালের ইমার্জেন্সির বেডে আমি কী সব কথা বলেছি ১৯৭৫ নিয়ে, বসুন্ধরা সোসাইটির চেয়ারম্যানকে ব্যক্তিগত এক আঘাত করা নিয়ে, সেসব কি আমার মনে আছে আদৌ? ভাসা-ভাসা সব মনে আছে আমার, এবং মনে না থাকলেও এখন একই কথাগুলো আন্দাজ করে নিতে সমস্যা কোথায়? ভাবলাম আমি, কিন্তু তাকে বললাম, ‘না, তেমন কিছু মনে নেই, তবে মনে আছে যে আমি বলছিলাম বাস্তুঘুঘুদের কথা।’ 

তিনি হাসলেন, ভালো রকম হাসলেন এবং আমাকে বললেন যে, সেদিন আমার শরীরের ওই অবস্থায় এত বড় প্রসঙ্গ নিয়ে আমাকে কিছুই বলেননি তিনি, কারণ তিনিও ডাক্তার মানুষটার মতো করে ঠিক দেখতে পাচ্ছিলেন যে আমি আমার রক্তপাত দেহের বাইরে নয়, ভেতরে ঘটাচ্ছি, আর সেটা স্বাস্থ্যের জন্য, শরীর ও মন দুয়ের জন্যই, কোনো ভালো কথা নয় এবং একইভাবে ভালো কথা না এ পৃথিবীকে শয়তানের বাসরঘর বলে ভাবা, আর সেই বাসরঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার প্রতিশোধ-ইচ্ছা তো আরও খারাপ জিনিস। আমি দেখলাম ব্রিগেডিয়ার সাহেবেরও তাহলে তার আপাত-নির্বিরোধী চেহারাটার পেছনে কিছু বলবার আছে। 

আমার ভালোই লাগল এটুকু ভেবে যে তিনি তবে শাকপাতার মানুষ নন, তার নিজের অভিমত বলেও কিছু রয়েছে দেখা যাচ্ছে। মনে মনে বললাম, “চলবে আপনার সঙ্গে ব্রিগেডিয়ার সাহেব। ১৯৭৫-এর সামরিক বাহিনীর ওই ধড়িবাজ বাস্তুঘুঘুদের নিয়ে হিসাব মেলানোর খেলা আপনার সঙ্গে ভালোই জমবে বলে মনে হচ্ছে এই একই ছাদের নিচে, কোনো দিন, যদি কপালে থাকে।’ আর মুখে তাকে, আমাকে দেওয়া তার জ্ঞানের উত্তরে—এই জ্ঞান যে, পৃথিবী শয়তানের বাসরঘর নয়, এবং কেউ সেই বাসরঘর আবিষ্কার করে ফেললেও ধর্মীয় বা নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা এক অশুভ ইচ্ছা—শুধু কড়া কথায় এটাই ফিরিয়ে দিলাম যে, ‘অত কিছু মনে নেই আমার ব্রিগেডিয়ার সাহেব। তবে কিছু মনে করবেন না যদি বলি, আমার শুধু মনে আছে যে ইসিজির ওখানে বসে আপনার চোখ দুটো দেখতে আমার কাছে লাগছিল কোনো পুরুতঠাকুরের চোখের মতো।’ তিনি হেসে ফেলে নিজের সম্মান বাঁচালেন কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে লাল হয়ে উঠল তার মুখ, তাই আরও বেশি করে হাসলেন তিনি হা-হা হাসি। ‘ভালোই বলেছেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া মানুষকে সোজা হিন্দুদের পুরুতঠাকুর বানিয়ে দিলেন? কাবুলের মসজিদের ইমাম বানালে তা-ও একটু হজম করতে পারতাম, হা-হা।’ 

চলে গেলেন তিনি। তিক্ততা আর আমি বাড়াতেও চাইনি, তাই ভালোই হলো যে তিনি গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। আমার শান্তি বোধ হলো এটা ভেবে যে, কেন যেন মুম্বাই ঘুরে আসার পর থেকে আমি দুর্মতি ফক্কড়গুলোকে ফক্কড় হিসেবেই সহজে চিনে ফেলতে পারছি, যেমন মুম্বাই এয়ারপোর্টে চিনেছিলাম মানুষের জীবন উত্থিত করতে পারা ও হাওয়ায় গুঁড়ো গুঁড়ো করে মিলিয়ে দিতে পারা ওই পাওয়ার কোম্পানির বস লোকটাকে, কিংবা আমার বিভাগের কোর্স কো-অর্ডিনেটর চির-নতজানু বৃদ্ধ ইলিয়াস সাহেবকে বা বসুন্ধরা সোসাইটির সরফরাজ সাহেব, আখলাকুর রহমান এদের, এমনকি নূর হোসেনের স্ত্রী লুনাকেও (যে কথা আমি কাউকেই বলিনি)। 

শেষে মনে এই অনুভূতি নিয়ে আমার নয়তলার লিফটে উঠলাম যে, সুবোধ বালক ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে তাহলে আমাকে তুখোড় ছকেই খেলতে হবে ১৯৭৫-এর টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট এবং প্রথম বেঙ্গল ল্যান্সার ট্যাংক রেজিমেন্টের কার্যকলাপের, সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ও ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার শাফায়াত জামিলের, ডেপুটি চিফ জিয়াউর রহমান ও সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের এবং বাকিদের যার যার উচ্চমার্গের জ্যামিতির অঙ্ক মেলানোর খেলা। ভালো। 

ইতিহাসবিদেরা এই খেলাটা দেখাতে চেয়েছেন তাদের মতো করে। আমার কোনো আগ্রহ নেই তাতে। আমি চাই ঔপন্যাসিকের মতো করে দেখাতে। ঔপন্যাসিকের লেখা এবং ইতিহাসবিদের বিবরণ, এ দুয়ের মধ্যে প্রথমটাই জীবন-অভিজ্ঞতার বেশি বাস্তবসম্মত আখ্যান, বলেছিলেন জোসেফ কনরাড। ‘লেখকের লেখা গল্পই ইতিহাস, মানুষের ইতিহাস, না হলে তা কিছুই না।’ এটুকু বলে থামেননি তিনি, আরও যোগ করেছিলেন, ‘গল্প-উপন্যাস ইতিহাসের চেয়েও বেশি কিছু; ইতিহাস তো স্রেফ ডকুমেন্টনির্ভর, সেকেন্ড-হ্যান্ড পাওয়া কিছু অনুভূতি, আর সাহিত্যিকের লেখার ভিত সে তুলনায় কত বেশি শক্ত।’ ইতিহাসবিদ তত দূরেই যান যত দূর তার সোর্স তাকে তথ্যভিত্তিক নিয়ে যায়, আর সাহিত্যিক যান মনের ভেতরে, তথ্যের ওপারে। চিঠি-ডায়েরি-ডকুমেন্ট-রেকর্ড ঘেঁটে জানা যায় কী ঘটেছিল, কিন্তু কী ঘটেছিল তা জানার পর কী বোঝা গেল তার বিবরণ কেবল সাহিত্যিকই দিতে পারেন কারণ যে বা যাদের নিয়ে ঘটেছিল ঘটনাটা, সাহিত্যিকই পারেন সোজা তার বা তাদের চিন্তা-অনুভূতি এসবের মধ্যে ঢুকে উপরিতলের সত্যের ভেতরকার সত্যগুলো বের করে নিয়ে আসতে। কী ঘটেছিল, তা ঘটনায় নেই, সেটা আছে আমি কী বুঝতে পারলাম তার মধ্যে। 

১৯৭৫-এর পনেরোই আগস্টের ঘটনাগুলোর কোনো সাহিত্যিক বয়ান আজও চোখে পড়েনি আমার; আমি পড়েছি শুধু কিছু ফ্যাক্টস আর ডকুমেন্টস, যার কারণে আমার কাছে সে রাতের অনেক কিছু আজও অধরা। যা জেনেছি, পড়েছি, শুনেছি, তাতে শুধু বুঝেছি যে বিশ্বাসঘাতকতা ও নৃশংসতার এক রাত ছিল সেটা, কিন্তু সেই খুনের পরে খুনের ধারাভাষ্যের মধ্যে কিছুই পাইনি, যা বোঝাতে পারে নিহত সেই রাষ্ট্রপতির জানার আড়ালেই ঘটে যাওয়া পৃথিবীর বদলকে—যে পৃথিবীতে তিনি দেশ স্বাধীনের পরে সরকারপ্রধান হন, সেই পুরোনো পৃথিবীর রুলবুকই বদলে গিয়েছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার চার বছরের মধ্যে, ওদিকে নতুন কোনো রুলবুকও লেখা হয়ে ওঠেনি তখন পর্যন্ত। এ রকম পিচ্ছিল ও নিজস্ব চরিত্রহীন এক সময়ে দেশ স্বাধীন করা রাষ্ট্রপতি নিজেই পরাধীন হয়ে গিয়েছিলেন তার চাইতেও বড় অনেক শক্তির দুলুনি ও টগবগানির হাতে। ওটুকু বোঝা গেলেই বোঝা যায় কেন সে রাতে শিকারির ভূমিকায় থাকা মানুষগুলো ছিল প্রচণ্ড স্থিরমতি ও কর্মনিপুণ, এবং তাদের শিকার যারা ছিলেন, তারা কেন ছিলেন পুরো অপ্রস্তুত, পুরো আলগা। 

আমি কল্পনা করতে পারি দুই নতুন বউ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল সে রাতে কতটা জোরে চিৎকার করতে করতে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে দুজনেই গা হিম হয়ে আসা নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে শুধু চিৎকারই করে যাচ্ছিলেন—জগৎ-সংসারের বধির আত্মার কানে যেন তাঁদের চিৎকার পৌঁছায়, তত জোরের একটানা, বিরতিহীন, আপত্তিজ্ঞাপক চিৎকার ছিল সেটা, আর তাঁদের দুজনের সে মিলিত চিৎকার কীভাবে বলতে চাচ্ছিল যে, আমরা একজন এ বাসায় এসেছি মাত্র ত্রিশ দিন, আরেকজন মাত্র সাতাশ, এ রাতের মুখোমুখি হওয়ার জন্য আমরা অপ্রস্তুত; বলতে চাচ্ছিল যে, নিয়তি তুমি অনেক শক্তিশালী জানি, কিন্তু তুমি এতটা নগ্ন হয়ে সে শক্তি যদি একবার দেখাও তো সামনের দিনে এই নিখিলবিশ্বের ব্যবস্থা কী করে টিকিয়ে রাখবে তুমি? 

আমি আরও কল্পনা করতে পারি, ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কথা, যিনি একবার তাঁর ঘর ও পরক্ষণে সিঁড়িঘরের বারান্দার মধ্যে বারবার ছোটাছুটি করে স্রেফ একটা কথাই ভাবছিলেন যে, এই মাত্র সেদিন, ২৪ জানুয়ারি, কামাল তাঁকে বলেছিলেন কোনো অবস্থাতেই তাঁরা ধানমন্ডির বাসা ছেড়ে বঙ্গভবনে যাবেন না, আর তিনি নিজে পরের দিন, ২৫ জানুয়ারি, যেদিন তাঁর স্বামী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিলেন, সেদিন স্বামীর ওপর প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে স্বামীকে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, ‘পে-সিডেন্ট হও আর যা-ই হও, আমি এ বাড়ি ছেড়ে তোমার সরকারি রাষ্ট্রপতি ভবনে যাচ্ছি না।’ এখন সিঁড়ির ওপরে, স্বামীর এইমাত্র খুন হওয়া দেহ একঝলকে দেখে নিয়ে, ‘ওরে তোদের আব্বাকে ওরা মেরে ফেলেছে রে’ বলতে বলতে তিনি যখন ছুটে যাচ্ছেন বেডরুমের দিকে, তখন মনের গহিন জায়গাটায় তাঁর এ স্মৃতি দুটোই ঢেউ তুলছিল বারবার যে বিশাল রাষ্ট্রপতি ভবনে চলে গেলে নিশ্চয়ই এড়ানো যেত আজকের এ রাতের বিশাল শরীরে ভর দেওয়া দানবটার থাবাকে। তিনি ফের ছুটে গেলেন সিঁড়িঘরের দিকে, অর্ধেক পথ গিয়ে তাঁর মনে হলো কাল সকালেই এ বাড়ি ছেড়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে চলে যেতে হবে বাচ্চাগুলো নিয়ে আর স্বামীর মৃতদেহটা তখন নিশ্চয়ই জাগানো যাবে কোনো এক প্রক্রিয়ায়, স্রেফ একটু সময় দরকার সব ফের ঠিক করে নিতে, স্রেফ একটু শান্ত-স্থির চিন্তার মুহূর্ত, যখন কিনা স্টেনগানের এই ট্যারর আওয়াজ তাঁর চিন্তাকে বিঘ্নিত করবে না। তা ভেবে এবার তিনি দৌড় থামিয়ে গুনে গুনে পা ফেলে রওনা দিলেন তাঁদের বেডরুমের দিকে, শেষবারের মতো। 

ইতিহাসবিদেরা বলবেন, মহিষটা মানুষের ভিড়ের দিকে ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু এইটুকু ইতিহাসে চলছে না আমার। আমি, ঔপন্যাসিকের টুপি পরে, একই কথা বলতে চাই এভাবে যে মহিষটা ভুগছিল এক বিরাট মাথাব্যথায়, তার মাথাব্যথা ছিল পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব না রাখা নিয়ে এবং তাই একধরনের গোসসা ও ভাবনার একঘেয়েমি থেকে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সে ছুটে গিয়ে আছড়ে পড়েছিল মানুষের ভিড়ের মধ্যে। 

ঘরে ঢুকে কোনো আলো জ্বালালাম না। বারান্দার অন্ধকারে গিয়ে বসলাম, তারপর কমপক্ষে বিশবার হবে যে বারান্দা ও ঘর, পড়ার ঘর ও শোবার ঘর করতে লাগলাম অস্থির হয়ে। ঠিক করলাম, এখনই ল্যাপটপ খুলে রবার্ট ক্লপস্টক ও জোসেফ সেভেরনের কথা পড়ব, তাঁদের চেহারা দেখব, ঠিক করলাম সুরভির ই-মেইলগুলো পড়ে তাকে অন্তত একটা উত্তর হলেও লিখব, ঠিক করলাম ফোন করব মেহেরনাজকে এবং তাকে চলে আসতে বলব, টাকাটা শোধ করব। 

কিন্তু ওসব বাদ দিয়ে দেখলাম আমি ডকুমেন্টের পর ডকুমেন্টের পাহাড় সরিয়ে পনেরোই আগস্ট রাতটার ভেতর দিয়ে কীভাবে রূপকের পিঠে চড়ে ঘুরে আসা যায়, তা নিয়ে ভাবছি, আমার হাতে তখন ধরা প্রুস্তের বিশাল উপন্যাসের প্রথম খণ্ড সুয়ানস ওয়ে। স্থাণুর মতো বইয়ের প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে আছি বই বন্ধ করে, দেখছি অনুবাদকের নাম সি. কে. স্কট মনক্রিয়েফ, ভাবছি কীভাবে তিনি উপন্যাসের মূল নাম বদলে দিয়েছিলেন অবলীলায়, সজ্ঞানে, অর্থাৎ কীভাবে জ্ঞান তাহলে ষড়রিপুর বাইরের কোনো অবজেকটিভ আলাদা সত্তা নয়, কীভাবে তা আমরাই নিয়ন্ত্রণ করি তাকে মানুষের ইচ্ছা-খুশিমতো ব্যাখ্যার বশবর্তী করে। অরাজকতার পুরোটা আসে নিজের মনমতো দাঁড় করানো যুক্তির জায়গা থেকেই, ‘নিজের বিশ্বাস’ নামের ধারণা থেকেই সূত্রপাত ঘটে স্বেচ্ছাচারিতা, অহং ও বিশৃঙ্খলার-আমার ভালোবাসার এ বইটাতে মনক্রিয়েফের ঘটানো তুমুল স্বেচ্ছাচারিতার দিকে তাকিয়ে আরও একবার মনে হলো এ কথা। 

এমন সময় বেজে উঠল কল বেল। দরজা খুলে দেখলাম মেহেরনাজ দাঁড়িয়ে। তার চেহারার ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গি দেখে আমার কেবল একটা কথাই মনে হলো, আকাশে উড়ে বেড়ানো মুক্ত ডানার বিশাল এক পাখি সামান্য খানিকের জন্য কোনো হ্রদের পাড়ে একটু পানি খেতে নেমেছে। আমাকে একরকম ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঘরে ঢুকে গেল মেহের, তারপর আমাকে টেনে আনল ঘরে ঢোকার মুখটাতে মাত্র জ্বালানো বাতির নিচে, তাকিয়ে থাকল আমার মুখের দিকে চার-পাঁচ সেকেন্ড, বলল, ‘দেখে তো মনে হয় অসুখ সারেনি।’ 

আমি তার মায়াভরা কিন্তু দৃঢ়চেতা চেহারার দিকে তাকালাম। পরিষ্কার দেখতে পেলাম এক নারী চে গুয়েভারার মুখ, কোনো পরিব্রাজক বা নারী পর্বতারোহীর কোমল-কাঠিন্য ভরা মুখ, যে চেহারায় মৃত্যুভয়ের বা কোনোরকম কোনো ভয়ের ছিটেফোঁটাও নেই। ওয়াসফিয়া নাজরীন এভারেস্ট জয় করেছেন ঠিকই কিন্তু তাঁর চেহারার দিকে তাকালে মনে হয় না খিলগাঁওয়ের কাঁচাবাজারে দাঁড়িয়ে পুরো বাজারকে তিনি এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। অন্যদিকে মেহেরনাজকে দেখলে মনে হয় আইসক্রিম খেতে খেতে এভারেস্ট বিজয় করে এসেই ওই কাঁচাবাজারের মাঝখানে বসে সে সামলাতে পারবে প্রত্যেক মাছ বিক্রেতার প্রতিটা অন্যায্য দর হাঁকানো, প্রত্যেক সবজিওয়ালার প্রতিটা দাবি এবং—এমনকি প্রত্যেক ক্রেতার বুকে পণ্যের দাম দেখে জেগে ওঠা প্রতিটা কষ্টও। একমাত্র তাকে দেখলেই আমার মনে হয় না মানুষ বাইপেডাল, কাঁধ ও মাথা একটু সামনে ঝুঁকানো দ্বিপদী কোনো প্রাণী, বরং তার মেরুদণ্ড অত টানটান সোজা করা দাঁড়ানোর ভঙ্গির কারণে তাকে দেখলেই আমি ভাবি কোনো জায়ান্ট সেকুইয়া বৃক্ষের কথা—একটুও নোয়ানো না, একদম উচ্চশির, খাড়া। 

আমি তার দুই কাঁধে হাত রাখলাম। দ্বিধাহীনভাবে—সবকিছুতেই দ্বিধাহীন সে—আমার বুকে বুক মিশিয়ে কাছেরও অনেক কাছে চলে এল মেহের, ঝট করে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন সে হাসপাতালের বিল দিয়ে দিয়েছে আমাকে লুকিয়ে? মেহের বলল, ‘সামর্থ্য আছে, তাই।’ 

এই উত্তরের জন্য একটুও প্রস্তুত ছিলাম না আমি। সবচেয়ে সত্যি উত্তর তো এটাই চট্টগ্রামের এক বড় জাহাজ ব্যবসায়ীর একমাত্র মেয়ে সে, বাবার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের টাকা তার ইচ্ছাধীন, সেটা আমার জানা। কিন্তু খেয়াল করলাম, এটাই পুরোপুরি সত্য উত্তর হতে পারে না। সামর্থ্য তো অনেকেরই আছে, তার মানে তো এই না যে যে কারও হাসপাতালের বিল শোধ করে দেবে অর্থে সামর্থ্যবান যে কেউ। উত্তরের মধ্যে আমার প্রতি ভালোবাসা ও মায়ার ব্যাপারটা ইচ্ছা করেই এড়িয়ে গেল মেহেরনাজ, আবার একই সঙ্গে এটাও আমাকে জানিয়ে দিল যে আমার নিজের সামর্থ্য নেই অত বড় এক বিল পরিশোধের। এখন তার উত্তরের মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসা এই বাস্তব সত্যটা আমার ভালো না লাগলে তার কিছু করার নেই। আর ভালোবাসার যে ব্যাপার আছে এই বিল পরিশোধের মধ্যে, সেটা মেহেরনাজ আমাকে মুখে বলে বোঝাবে না কোনো দিন, এবং তার এই না-বোঝানো নিয়ে আমার যদি আপত্তি থাকে কোনো, তাতেও তার করার কিছু নেই। আদেশকর্ত্রী মেহেরনাজ, হুকুমনামা জারি করা অপ্রতিরোধ্য মেহেরনাজ। আমি তাকে জানালাম, আমার বড় ভাইয়ার কাছ থেকে টাকা এসে গেছে, বেডরুমে রাখা আছে সেটা, যাওয়ার সময় যেন সে তা অবশ্যই নিয়ে যায়। মেহেরনাজ একমুহূর্ত কী চিন্তা করল, তারপর আমাকে বলল, “টাকা ফেরত নেওয়ার জন্য আমি দিইনি। যা দেওয়া হয়ে গেছে, তা দেওয়া হয়ে গেছে। এখন আপনি যদি জোর করে তা ফেরত দেন তো আমি সেটা কড়াইল বস্তির বাচ্চাগুলোকে দিয়ে বাসায় চলে যাব।’ তার এই ভানভণিতাহীন বলা প্রকৃত হুমকির মধ্যেই তার তরফ থেকে আমাকে স্পষ্ট বলা আছে ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি’ কথাটা। তার হিসেবে, এখন সেটা আমার দায়িত্ব বুঝে নেওয়া, তার পক্ষ থেকে এর চেয়ে বেশি ভালোবাসার উচ্চারণ সম্ভব নয়। 

আমি তাকে চুমু খেতে লাগলাম। হিংস্র হয়ে উঠল সে হঠাৎ, আমাকে টেনে ফেলে দিল সোফার ওপরে। তারপর আপাদমস্তক আগে আমাকে নগ্ন করল, পরে ঘরের ওই আলোর নিচেই নিঃসংকোচে নিজেকে এক এক করে খুলতে খুলতে বলল, ‘আজ আমি অনেকক্ষণ ধরে করতে চাই।’

তার মুখে এ রকম আপাত-লাজহীন কথা আমি আগেও শুনেছি, এর চাইতে ভয়ংকর শব্দবিন্যাসেও শুনেছি তা, তাই অবাক কিছু খুঁজে পেলাম না আমি তার এই কথায়। আমাকে সোফার ওপরে ওভাবে ফেলে রেখে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়েই স্বাচ্ছন্দ্যে সে হেঁটে গেল আমার বেডরুমের দিকে তারই রেখে দেওয়া নির্দিষ্ট জায়গা থেকে জন্মনিরোধী জিনিসটা নিয়ে আসবার জন্য। এর সবকিছু কেমন বিজনেসওমেন ধরনের। এটাতেও যদি আমার আপত্তি থাকে কোনো, তাতে তার কিছুই করার নেই; তার ওই ‘আজ আমি অনেকক্ষণ ধরে…’ কথাটার মধ্যে যদি আমি কোনো অর্থ খুঁজে বের করি যে, তাহলে কাল বুঝি অন্য কারও সঙ্গে সে স্বল্পক্ষণ কিছু করেছিল, সেটা আমার ইচ্ছা, আমার সে ভাবনার কোনো তোয়াক্কা সে করে না; এবং পুরুষের অহং থেকে যদি আমি সে কারণে তার সঙ্গে বিছানায় যাওয়া বন্ধ করে দিই তো তাহলে সে আমাকে অন্তর থেকে চিরদিনের মতো ‘গুড বাই’ বলে দিতে একমুহূর্ত দ্বিধা করবে না। অতএব, ব্যাপারটা এমন দাঁড়াচ্ছে যে এই সম্পর্কের সব কটি সুতো কেবল মেহেরনাজের হাতে, আমার হাতে সেসব সুতোর একটাও নেই এবং তার আচরণ থেকে এটাও স্পষ্ট যে সেই সুতোগুলোর একটাও আমি কোনো দিন হাতে পাব না। ভালো। 

ঝড় শেষ হলো, কখনো চোখ খুলে আর মূলত চোখ বুজে আমাকে রীতিমতো শুষে নিল সে, তারপর ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে আমার বুকের ওপরে শুয়ে পড়ল। আগুন শেষ, এখন সে ছাই-ভস্ম, কিন্তু আপাত-নিভে যাওয়া কয়লার নিচে ফুঁ দিলেই দেখা যাচ্ছে আগুন জ্বলছে এখনো—কামের আগুন নয় সেটা, তার প্রাণোচ্ছল ব্যক্তিত্বের স্বেচ্ছাবিহারী এক ধিকিধিকি আগুন। 

হাঁপ ছেড়ে, শান্ত হয়ে একসময় আমার ওপরে উঠে বসল মেহেরনাজ, আমার পেটের একপাশে এক পা, অন্য পাশে আরেক পা রেখে মেরুদণ্ড সেকুইয়া বৃক্ষের মতো খাড়া করে। অতএব আমাকে তাকাতে হলো অনুভূমিক নয়, উল্লম্ব। তার মুখের রেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি মুহূর্তের মধ্যে মনে মনে তৈরি হয়ে নিলাম ওই মুখ থেকে কঠিন কোনো কথা শুনব বলে। সে বলল, ‘আপনি স্যার এখানে নেই। আমার মনে হলো আমি মরা লাশের সঙ্গে সেক্স করলাম।’ কথাটা শুনে চুপ করে থাকলাম আমি। কথাটা আমার পৌরুষের শক্তি নিয়ে বলেনি সে, বলেছে আমার মনের চারপাশে ঘিরে থাকা চীনের প্রাচীরকে লক্ষ করে। ‘কী হয়েছে আপনার?’ জিজ্ঞেস করল সে, ‘এ রকম ডিপ্রেশনে থাকলে তো আবার হাসপাতালে যাওয়া লাগবে। মনে হচ্ছে আপনার বড় ভাইয়ার টাকাটা হাসপাতালকে দেওয়ার জন্য উতলা হয়ে আছেন?’ 

আমি তাকে কিছুই বলতে পারলাম না, ইচ্ছা হলো না যে কিছু বলি, ইচ্ছা হলো না যে এতগুলো ঘটে যাওয়া ঘটনা তাকে ব্যক্ত করি। প্রথমত, বিষয় অনেকগুলো, তাই এত কথা বলতে হবে বলে একটা ভয় আছে আমার; দ্বিতীয়ত, অনীহা, কোনো কিছু ব্যাখ্যা করবার, কোনো কিছুর জবাবদিহি করবার অনিচ্ছা। শুধু চুপচাপ তাকিয়ে থাকলাম আমি তার দিকে, ভাবতে লাগলাম অনেক কথা, অনেক শব্দের পরে শব্দ, যারা আমার মনকে অন্য কোথায়ও ঠেলে দিয়েছে বলেই তার বুদ্ধিমান চোখে ঠিকই ধরা পড়েছে যে আমার মন রয়েছে অন্য কোনো চরাচরে, স্থাবর-জঙ্গমের অন্য এক ভূগোলে। মেহেরনাজ বেশ জোরের সঙ্গে ঝাঁকি দিল আমাকে, বলল, ‘বলেন। আমাকে বলে মন হালকা করেন।’ 

আমি তাকে বললাম না কিছু, শুধু মন্ত্রপাঠের মতো আমার মন, আমার স্মৃতি বলে চলল আমাকে : রিলকের জঘন্য প্যারিস শহর-মুম্বাই—অস্ত্রধারী হোটেলের প্রহরী—হুপু পাখির হেঁটে যাওয়া—পাম বিচ ক্রিকের লাশ—ঘাটকোপার স্টেশন—লর্ড জিম—কনরাডের লর্ড জিম-মর্নিংগ্লোরি ফুলগুলো—এক পাওয়ার কোম্পানির বস, ভয়ংকর এক বস—ছুটে চলা মহিষের দল—গাছের ডালে এক একাকী পাখির ঠক ঠক আওয়াজ—সোসাইটির চেয়ারম্যানের ন্যাংটো শরীর—আমার ঔদ্ধত্য—হোর্থন ফুলের বাগান—মার্সেলের প্রথম প্রেম—গিলবার্তের লাল চুল ও শিশু মুখ—স্কট মনক্রিয়েফের স্বেচ্ছাচারিতা – পনেরোই আগস্ট রাতে রোজী জামাল ও সুলতানা কামালের চিৎকার—বেগম মুজিবের শেষ মুহূর্তের আক্ষেপ—সিঁড়িতে পড়ে থাকা রাষ্ট্রপতির মৃতদেহ — সন্ধ্যার অন্ধকারে পাখিদের ঘরে ফেরা—হাসপাতালে দেখা সেই অন্তঃসত্ত্বা মহিলা আর তাঁর দুই পা বেয়ে গড়িয়ে পড়া রক্ত-কাফকার মৃত্যু—কিটসের মৃত্যু-শেলির মৃত্যু—আমার অসহায় প্রতিশোধস্পৃহা-সুরভির ই-মেইলে এক অজানা ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত—আমাদের প্রথম পরিচয় নিয়ে সুরভির নিরেট ভুল স্মৃতিচারণা—মাইকেল মধুসূদনের ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করবার ইচ্ছা—’মিউ’ ব্যান্ডের গানের অদ্ভুত রহস্যময় লাইন ‘good kids are messing up’– হ্যাঁ, এক দানব বসে আছে এই পৃথিবীর আত্মা হয়ে, এক বিশাল দানব, যার নাম আমরা দিয়েছি নিয়তি; না, আমি আর পারলাম না, দুহাতে মুখ ঢাকলাম, মেহেরনাজকে শুধু বললাম মোটামুটি এই কথাগুলোই, বইয়ের ভাষার মতো শোনাল আমার কথা, সে লজ্জা মাথায় রেখেই বললাম : প্রুস্তের দেওয়া সুয়ানস ওয়েনামটার যদি দুই অর্থ থাকতে পারে তো পনেরোই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের তলটার কাছেও আমি যেতে পারিনি আজও, সেই ক্ষমতাই আমার নেই মেহেরনাজ, ওদিকে পৃথিবী ঘুরেই চলেছে দিগন্তরেখায় প্রতিদিন একেক রঙের আঁচড় ফেলে, পথের পাঁচালীতে তার অনাবিল আবহমানতার ছাপ দেখে বুঝেছিলাম এটাই সময়ের অর্থ, স্থান-কাল সময়কে ভর করে বৃত্তাকার ঘুরতে থাকা জগৎ-সংসারের অর্থ, কিন্তু না, দেখলাম কাফকা অনুবাদের প্রয়োজন যতই বড় হয়ে উঠছে, ততই নিৎশের কথাগুলো সত্য হয়ে উঠছে, ততই পনেরোই আগস্ট রাতও এগিয়ে আসছে, ততই নিৎশে দেখিয়ে দিচ্ছেন মহিষগুলোর একরোখা ছুটে যাওয়াকে, ততই জুলিয়াস সিজারের খুনে মাখা ছুরি নিচের দিকে পড়ছে সিঁড়িতে বাড়ি খেয়ে ঝনাৎ শব্দ তুলবে বলে, আর ততই দেখা যাচ্ছে নিৎশে রুশো এঁরা মিলে এটাকে এক ক্রোধের পৃথিবী বানিয়ে রেখে গেছেন, প্রাচুর্য ও নিঃস্বতার মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে সব, উৎসব ও নির্যাতনের মধ্যে, ক্ষমতা ও শক্তিহীনতার মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে সব, যে বাস্তবতা মেনে নিয়েছি আমরা, তাকে এখন বাতিল করে দিতে হবে, কারণ মানুষ ক্ষুধার্ত, ন্যায়বিচার বলে সামান্য কিছু নেই, ক্ষমতা যার, বিচারের রায় সাজানোর ক্ষমতাও তারই, দারিদ্র্য সব শেষ করে দিচ্ছে, বাচ্চাগুলো ঘুরছে অন্ধকার থেকে অন্ধকারে, আর ক্ষমতাশালীরা ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে নিচ্ছে গোপনীয়তা, ষড়যন্ত্র, অর্থ ও সন্ত্রাসের সাহায্য নিয়ে, সততাকে তাচ্ছিল্য করছে তারা, কাজকে শাস্তি দিচ্ছে ও নীতিহীনতাকে দিচ্ছে ঢালাও পুরস্কার, আমাকে থামাও মেহের, একই কথা আমি বলেছিলাম হাসপাতালের ডাক্তারকেও, আমাকে থামাও, না হলে সারা রাত বলে যাব আমি এবং বলতে বলতেই মাথা ঘুরে চক্কর খেয়ে বমি করে একাকার করে ফেলব সব, আমাকে থামাও। 

প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠছিলাম আমি, মেহেরনাজ তার হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরল। তার খোলা স্তন—আমার মুখেরই একদম একদম কাছে—আমার কাছে লাগল চরিত্রহীনা মাদাম বোভারির বা লুনার এই পাগল পৃথিবীকে আরও পাগল করে দেবার এক সুকৌশলী অস্ত্র যেন। আমি চোখ বন্ধ করলাম। মেহেরনাজের হাত বন্ধ করল আমার মুখ, চেপে ধরে। 

মেহেরনাজ বলল, ‘স্যার, আমাদের হয়তো খুব খারাপ মানুষ করেই বানানো হইছে, কিন্তু আমরা তবু শেষ হয়ে যাই নাই এখনো। ক্ষমতার এই ব্যবস্থা কোনোভাবেই অনন্তকালের নয়। কী বলেন এসব আপনি? আমাদের দুজনের সম্পর্কের ওয়ার্ম নিয়ে ভাবলেই তো বোঝা যায় সব।’ 

কী বলল সে তা বুঝলাম না আমি। শুধু বুঝলাম, আশার কথা শুনিয়েছে সে। আমি তাকে অন্য অনেকবারের মতো একই কথা জিজ্ঞেস করলাম আবার, ‘কেন তুমি আমাকে আজও স্যার ও আপনি আপনি করে বলো?’ 

সে নিজেকে অনেক সাবধানে আলাদা করল আমার ও তার শরীরের এক হয়ে মিশে যাওয়ার স্থানটা কেন্দ্র করে, এবং মুচকি হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি আর আপনাকে আপনি করে ও স্যার বলে বলব না, যদি আপনি এ রকম এক সময়ে, এ রকম এক সময়ে আমাকে ব্যবহার করে পুরো পৃথিবীর ইতিহাসে ঘুরে আসা বন্ধ করেন তো। হা-হা।’ 

তারপর সামান্য বিরতি, তার নিজেকে গুছিয়ে নেওয়া একটুখানি এবং আবার আমাকে বলা : ‘সেটা যেহেতু আপনি কোনো দিনও করবেন না জানি, তাই আপনি স্যার ও আপনিই থাকছেন আমার কাছে, জনাব।’ আমি তার চেহারার ভেতরের দুষ্টু হাসিটা লক্ষ করলাম। এটাই তার চরিত্রের সবচেয়ে অসতর্ক ও খোলা মুহূর্ত। আমি সেই মুহূর্তটাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহারের কোনো সুযোগ নিতে চাইলাম না, কিন্তু তারপরও, প্রায় না বুঝেই, তাকে বলে বসলাম দুপুরবেলা আমাকে বলা নূর হোসেনের কথাটা। 

তাকে প্রস্তাব রাখলাম : ‘আমাকে বিয়ে করো। তারপর আপনি বা স্যার বললেও আমি আড়ষ্ট হব না।’ 

কী ছিল আমার কণ্ঠের মধ্যে জানি না, শুধু জানি তাকে এত সৎভাবে ও স্পষ্ট করে এ রকম অন্তরঙ্গ মুহূর্তে এ-জাতীয় কোনো কথা আমি এর আগে বলিনি কোনো দিন; সেটা সে-ও যে জানে বা বুঝতে পেরেছে, তা-ও আমার জানা। 

মেহেরনাজ এক মুহূর্তই দেরি করল মাত্র, তারপর আমার বুকের ছোট লোমগুলোর মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে আমাকে আচমকা বলে দিল : ‘আপনার জন্য আমার মায়াই বেশি, ভালোবাসা কম। বিয়ের কোনো কিছুর ভেতরে আনন্দের কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না, এমনকি বিয়ের পরের সেক্সের মধ্যেও না। আপনার কি কোনো ধারণা আছে আমি মোট কয়জনের সঙ্গে বিছানায় যাই? অনেক না, কিন্তু চার-পাঁচের কমও না। আর এই নাম্বারের আদৌ কি কোনো ঠিকঠিকানা থাকে একটা জীবনে? বিয়ের ধাঁচে গড়া মানুষই না আমি। হাহ্।’ 

আমি মেহেরনাজের চোখ থেকে আমার চোখ সরিয়ে নিলাম, তাকালাম সাদা সিলিংয়ের দিকে। সেখানে কোনো রেখা, কোনো রং চটে যাওয়া, কোনো দাগ চোখে পড়ল না। নিরীহ-নিখুঁত এক সিলিং, তার মাঝখানে ঝুলছে একটা ফ্যান, জোরে ঘুরছে সেটা এ মুহূর্তে, অতএব পাখার সংখ্যা শুধু অনুমান করেই নিতে হচ্ছে যে, তিন। মানুষ একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নের বাইরে চিন্তা করার ধাঁচে তৈরি নয়, অতএব তার অনুমানগুলোও প্রায়শই নির্দিষ্ট, যেমন আমার মন তৈরি নয় একটা পঁচিশ বছরের বাচ্চা মেয়ে একের অধিক মানুষের সঙ্গে বিছানায় যাচ্ছে সেই সত্য অনুধাবনের জন্য। 

এই সেই একই সিলিং যার দিকে রাখা শূন্যদৃষ্টি আমাকে একটু আগে বাঁচিয়েছিল মেহেরনাজের সঙ্গে চলতে থাকা ভালোবাসার খেলার ঝোড়ো নির্যাতন থেকে। তার প্রচণ্ড আওয়াজ-নিশ্বাস-ব্যগ্রতা ও কামনার আগুনের মধ্যে কথা ছিল আমার পুড়তে থাকার, কিন্তু বিষাদের অনুভূতি এমনভাবে মনকে উদাসীন ও শরীরের পেশিগুলোকে স্তিমিত করে রেখেছিল যে আমি যথেষ্ট অনিচ্ছায় স্রেফ আমার বংশদণ্ড খাড়া করে রেখেছিলাম মাত্র, যেন আমাকে পৌরুষের খোঁটা শুনতে না হয় তার মতো ঠোঁটকাটা এক মেয়ের কাছ থেকে। শরীর তার হাতে ছেড়ে দিয়ে এই সিলিংয়ের দিকে তাকিয়েই আমি খানিক আগে ভাবছিলাম ওসব কথা-আইয়ার থেকে নিয়ে নিহত রাষ্ট্রপতি, অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে নিয়ে বাইপেডাল মানুষ, ফ্লবেয়ার থেকে নিয়ে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম ছাত্রের ওপরে র‍্যাগিং ইত্যাদি, আর প্রবল বেগে ঘুরতে থাকা পাখার স্থির, একক সাদার দিকে তাকিয়ে—স্রেফ হাত দুটো মেহেরনাজের স্তনে চেপে রেখে, যাতে করে সে আমার অনাগ্রহ বুঝতে পেরে বিরক্তি থেকে উঠে না যায়—মনে করছিলাম প্যারিসে, উনিশ শতকের সত্তরের দশকে ফ্লবেয়ার, তুর্গেনেভ, গোকুর, এমিলি জোলাদের নিয়মিত ডিনারের গল্প যেখানে আড্ডার ছলে, হাস্য-কৌতুকের সঙ্গে এই চার-পাঁচ বড় লেখক নিয়মিত আলোচনা করতেন মৃত্যু বিষয়ে, সবার সম্মিলিত আগ্রহ থেকে। তাঁরা সবাই ছিলেন মৃত্যুভয়ে ভীত মানুষ কিন্তু মৃত্যুকে এড়ানোর মতো অবাস্তব চিন্তাবর্জিত যাঁর যাঁর মাপের দার্শনিক। ফ্লবেয়ার সেখানে একদিন, তাঁর পালা এলে, বলেছিলেন, “আমাদের মানুষদের ধর্ম হওয়া উচিত ছিল নৈরাশ্য ধর্ম। মানুষকে তার নিয়তির সমান হওয়া উচিত, উচিত নিয়তিরই মতো নিরাবেগ-নির্বিকার হওয়া। “জীবন এমনই!” “জীবন এমনই!” এটা বলতে বলতে যদি আমরা আমাদের পায়ের কাছের, পায়ের নিচের কালো অন্ধকার গর্তটার দিকে তাকিয়ে থাকা শিখে যাই একদিন, তো সেদিন থেকেই শান্ত থাকার কায়দাটা রপ্ত করে ফেলব!’ 

মারাত্মক এই কথা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য আমার মনে হচ্ছিল হয় এই জীবনে আমাদের পায়ের নিচের মাটি সরে যাওয়া গর্তটা দেখা শিখে নিতে হবে, না হয় চিত হয়ে শুয়ে ওপরে ছাদের সাদা বিস্তৃতির অসারতার দিকে একমনে তাকিয়ে থেকে বুঝতে হবে নৈরাশ্য-ধর্মের মূল কথা। 

আমি সিলিংয়ে চোখ রেখেই অস্ফুট উচ্চারণে মেহেরনাজকে বললাম, ‘ঠিক আছে। অসুবিধা নেই।’ 

মেহেরনাজ সম্ভবত খেপে গেল আমার হঠকারী কথায়। সে আশা করেনি তার পছন্দের মানুষকে বলা সম্পর্কের ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার মতো বিধ্বংসী কথার জবাবে আমি এমন বিচারমূঢ় কোনো উত্তর দিতে পারি। আমি তার খেপে যাওয়া টের পেলাম এবার তার ভড়-ভড় করে বলা ইংরেজি ভাষণ থেকে। আমি জানি অনেক খেপে গেলে চট্টগ্রামের বিখ্যাত ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া স্কুলের ও-লেভেল, এ-লেভেল শেষ করা মেহেরনাজ কথা বলে এই বিদেশিদের ভাষায়। সে আমাকে বলল, ‘সি, আই লাইক ইউ আ লট, অ্যান্ড সো আই কান্ট পসিবলি সি ইউ ফিনিশিং ইওরসেলফ অব দিস ওয়ে, ইন দিস স্টেট অব ডিসপেয়ার। উড ইউ প্লিজ ওয়েক আপ অ্যান্ড গিভ আ শে‍ইক ইওরসেলফ, ইউ মিস্টার কনফিউজড ম্যান?’ 

আমি কথা বললাম না কোনো। ডিপ্রেশনের নয় স্তরের কথা ভাবতে লাগলাম এবার, আবারও ওই অন্তঃসারশূন্য সিলিংয়ের দিকে চোখ রেখেই। প্রথম দিকে সারা দিনের ডিপ্রেসড মুড, তারপর অনিদ্রা, ঘোর অনিদ্রা, তারপর নিজেকে মূল্যহীন ভাবার অনুভূতির শুরু, তারপর বারবার মৃত্যুচিন্তা ও একসময় সেই চিন্তার আকর্ষণে পড়ে যাওয়া এবং শেষে আত্মহত্যাকে যৌক্তিক কাজ বলে ভাবতে থাকা। এ রকম 

নয়টা মনে পড়ল না আমার। ছ-সাতটা হলো সম্ভবত। বাকি গেল কোন দুই বা তিনটা, তাহলে? তুর্গেনেভ তাঁর বিরাট রাশিয়ান হাত সামনে ঝাঁকিয়ে, আঙুলগুলো তুমুল নাড়াতে নাড়াতে বলতেন এই হাত ঝাঁকানোটাই বাঁচবার পথ, ডিপ্রেশন ও মৃত্যুচিন্তাকে ‘ধুর’! বলে দূরে সরিয়ে রাখার পথ। তার ভাষায়, ‘হতাশা-মৃত্যুচিন্তা এসব “স্লাভ কুয়াশা”, রাশিয়ানরা সে কুয়াশা ওভাবেই তুড়ি মেরে সরায় এবং বাঁচে।’ 

সুন্দরী, মেদহীন শরীরের কামনাময়ী মেহেরনাজ সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বসে আছে আমার পাশে। এই জিনিসটারও তো বিশেষ তাৎপর্যময় অর্থ আছে কোনো, নারী ও পুরুষের এই একসঙ্গে অসংকোচ নগ্ন হয়ে থাকার। মেহেরনাজের হিসেবে এটা প্রয়োজনীয়তা, শরীরের চাহিদা মেটানোর বেসিক প্রয়োজনীয়তা। আমি ভাবতে চাইলাম, এটা তুর্গেনেভের মতো হাত ও আঙুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জীবনের প্রতি নির্বেদের বোধকে দূরে সরিয়ে রাখার সহযোগী এক প্রয়াস। আমি মেহেরনাজের নগ্নতাকে কোনোভাবেই দেখব না মতো করে সাদা সিলিংয়ের আয়তনটুকুর দিকে এক হাত তুলে তুর্গেনেভের ‘স্লাভ কুয়াশা’ তাড়ানোর ভঙ্গিমা নকল করলাম। মেহেরনাজ দেখল সেটা। নিশ্চয় সে জানতে চাইছে, দূর দূর করে রাস্তার নেড়ি কুকুর বা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থেকে যন্ত্রণা করতে থাকা ভিখিরি তাড়ানোর মতো হাত-ভঙ্গিমা করে এ মুহূর্তে এটা কী করলাম আমি? কিন্তু তার রূপক-সংকেতের বাইরে দাঁড়িয়ে খাড়া সেকুইয়া বৃক্ষ হয়ে থাকার অভ্যাস তাকে এ নিয়ে মাথা ঘামাতে দিল না। একটু পরই সে তার আগের বলা—’আমরা তো তারপরও শেষ হয়ে যাই নাই আজও’—আশার বাণীর সঙ্গে স্ববিরোধিতা ঘটিয়ে আমাকে বলল, আবারও ইংরেজিতে : “ইউ আর অ্যাজ গুড অ্যাজ এভরিওয়ান, অ্যান্ড ইউ, আই, অ্যান্ড এভরিওয়ান এলস আর অ্যাজ গুড অ্যাজ এভরিওয়ান এলস। উই আর, স্ট্রিক্টলি স্পিকিং, নাইদার গুড, নর ব্যাড। উই আর হোয়াইট উই আর। পিপল। হিউম্যানস।’ 

মেহেরনাজের এই কোনো পজিশন না নেওয়া, তার এই সব-ভালো আবার সব-খারাপ জাতীয় আদতে তাৎপর্যশূন্য বাক্য, এই বেড়া ধরে বসে থাকা বেড়ার এ পাশেও যাচ্ছি না, ও পাশেও যাচ্ছি না আমি, কারণ আমি জেনে গেছি মধ্যপন্থাই সবচেয়ে ভালো পন্থা, ওটাই এক নন-জাজমেন্টাল নির্বিরোধী জীবন কাটানোর জন্য সবচেয়ে মোক্ষম উপায়—তার এই হঠাৎ শিশুতোষ ও সুবিধাবাদী অবস্থান আমার মনে যথেষ্ট বিরক্তির কারণ ঘটাল। পৃথিবী নিয়ে আমার যে আশা ছিল তা-ও যেন গুঁড়িয়ে দিল তার শেষ বাক্যগুলো। আমার নিজেকে মনে হতে লাগল, কত বাস্তববাদী সে (সুবিধাবাদী অর্থে) আর আমি কত অবাস্তব ঘরানার এক রোমান্টিকতা ভরা কবি। 

আমি আমার পেট উঁচু করে শরীর একবার বামে একবার ডানে হালকা মুচড়িয়ে তাকে যথেষ্ট ভালোভাবেই ইঙ্গিত দিলাম যে, আমি চাইছি সে এখনই উঠে যাক আমার কাছ থেকে আর চলে যাক এই বাসা ছেড়ে। আরেকবার, ব্যক্তি মেহেরনাজকে উদ্দেশ না করে বরং গড়পড়তা সুবিধাবাদী মানুষগুলোর বেড়া ধরে বসে থাকা প্রবণতার প্রতি আমার অপছন্দ জানিয়েই আমি আমার হাত নাড়িয়ে, এবার বাঁ হাত, আরেকবার তুর্গেনেভের নকল করলাম। এবার আরও জোরে, আরও ভায়োলেন্ট ঝাঁকুনি দিয়ে। 

কী ঘটে গেল তা ভালোভাবে উপলব্ধি করবার শক্তিও দেখলাম আমার নেই, ইচ্ছাও নেই। আমার তরফ থেকে আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, মেহেরনাজ এভাবে চলে যাচ্ছে, এত তাড়াতাড়ি, তাতে আমার কষ্ট হচ্ছে ঠিকই কিন্তু যেহেতু এ মুহূর্তে আমার মনকে দখল করে আছে আরও বড় কষ্ট ও বিমর্ষতার বোধ, তাই মেহেরনাজের চলে যাওয়া খুব বেশি বুকের মধ্যে আঘাত হানছে না আমার। আমি তাকে—এই বিষণ্ণ মনমানসিকতার মধ্যেও—বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি, এবং সে তাতে বেশ রূঢ়ভাবেই তার না জানিয়েছে, এমনকি আমাকে প্রথমবারের মতো এটাও বলেছে যে তার আরও শয্যাসঙ্গী আছে। কিন্তু সেটাই সবচাইতে বড় কথা হতে পারে না। এই একই মেহেরনাজ আজ সকালে আমার হাসপাতালের পুরো বিল শোধ করে দিয়েছে এবং এমনকি টাকাটা ফেরত নিতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বড় কথা এটাই যে, এই সবকিছু মিলে আমি হয় তাকে চিনতে পারছি না, সে দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে আমার কাছে, না হয় যে চিরাচরিতের ছাঁচে ফেলে তাকে চিনতে চাচ্ছি আমি, সে ছাঁচটাই ভুল এখনকার এই পৃথিবীতে এসে। 

মেহেরনাজের দিক থেকে আমার অনুমান, এটা বলা যায় যে তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়ার আমার আজকের অনীহাটা সে ধরে ফেলেছে, এটা তাকে ব্যথাও দিয়েছে এবং কে জানে সেই ব্যথা আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই হয়তো সে ওভাবে বাতিল করে দিয়েছে আমার বিয়ের প্রস্তাব, হয়তো সে কারণেই আমাকে শুনিয়ে দিয়েছে তার গোপনতম ব্যক্তিগত কথাও, যা শুনলে সে জানে আমার নিজেকে উপেক্ষিত-অবহেলিত লাগবে। সে হয়তো চেয়েছে যে সেটাই লাগুক আমার, কারণ আমার তরফ থেকে তার প্রতি একই উপেক্ষা ও অবহেলা সে আগে লক্ষ করেছে সোফার ওপরের আমাদের অন্তরঙ্গ সময়টুকুতে। 

মেহেরনাজ বাথরুম থেকে বের হলো, একটা কথাও বলল না আমাকে, আমিও বললাম না কিছু। সে যখন তার পায়ের স্যান্ডেল পরছে দরজার এ পাশে দাঁড়িয়ে, তখন হঠাৎ আমার মনে হলো আমরা দুজনেই আসলে ভুগছি বোরডম ও অ্যাকশনহীনতায়, আমরা দুজনেই তাড়িত সেই বোধে, যার কারণে আমাদের একে অন্যকে বলার মতো কথা তেমন একটা নেই কোনো—আমাদের একের উদ্দেশে দেখানো অন্যের নীরবতা এভাবেই কোনো অদৃশ্য পোকার মতো মাঝখানে ঢুকে গিয়ে আলগা করে দিতে পেরেছে আমাদের সম্পর্কের সুতো। কিংবা কে জানে, এমন অদ্ভুত একটা সম্পর্কই হয়তো আমার সঙ্গে চায় মেহেরনাজ, এবং তা হয়তো খুব সচেতনভাবেই চায়। তোমার সঙ্গে আমি মিশব, বিছানায় যাব, তোমার প্রয়োজনে বড় অঙ্কের টাকাও হাতে তুলে দেব ফেরত নেওয়ার ইচ্ছা ছাড়াই, আবার অন্য তিন-চারজন পুরুষের সঙ্গেও শোব ইচ্ছে হলে, কিন্তু তাতে কোনো আপত্তি করতে পারবে না তুমি, কারণ তোমাকে বুঝতে হবে যে আমাদের এটা সাধারণ স্বাভাবিক ভালোবাসাবাসির-যার শেষ হয় সাধারণত বিয়েতে গিয়ে—কোনো রুটিন সম্পর্ক নয়। 

সে স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল হালকাভাবে, যেনতেন প্রকারে। আমার মনে হলো, মেহেরনাজের দিক থেকে দেখলে আমার তরফ থেকে দেখা ব্যাখ্যাটা হয়তো পুরো সত্য বলছে না। সে হয়তো এর সঙ্গে যোগ করবে এ কথাটাও যে, আমাকে যদি এতই ভালোবাসো যে বিয়েও করতে চাও, তাহলে অন্তত শারীরিক ভালোবাসাবাসির ও রকম প্রগাঢ় মুহূর্তে মানসিকভাবে আমার থেকে অত দূরে থাকলে চলবে না, অন্তত আমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে, কী তোমার বিমর্ষতার কারণ। না হলে আমি বুঝব তোমার ভালোবাসাও অত সত্য নয়, এবং তোমার কাছে আমার মূল্যও বড় নয় তত। 

দরজা খুললাম আমি নিজ হাতে। একমুহূর্তের জন্য মনে হলো তাকে চলে যেতে না করি, একটু আগের ভয়ংকর অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলোর সঙ্গে তার এই একটু পরের চলে যাওয়া খুব নিঠুর ও বিসদৃশ ঠেকছে। পরক্ষণে মনে হলো, যাক সে, আমার সম্ভবত একা থাকতেই এখন ভালো লাগবে। মেহেরনাজ দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই আমাকে বলল, ‘কাফকা অনুবাদটা শুরু করেন, প্লিজ।’ আমি উত্তরে তাকে বললাম নিৎশের একটা ছোট স্মৃতি। —ইতালির জেনোয়াতে একদিন সন্ধ্যা নামছে। বিষণ্ণ এক সূর্যাস্ত ছিল সেটা। নিশে শুনলেন শহরের কোনো এক টাওয়ার থেকে ঘণ্টার শব্দ—অলিগলিগুলো থেকে আসা নানা আওয়াজ ছাপানো একটানা, বিরতিহীন ঘণ্টাধ্বনি, সন্ধ্যার পুরো আকাশ ও সাগর থেকে আসা সব বাতাস কাঁপিয়ে দেওয়া ঘণ্টার আওয়াজ, ভয়ংকর এবং একই সঙ্গে শিশুতোষ বিরাট বিষণ্ন ঢং ঢং ঢং। তখন নিৎশে মনে করলেন প্লেটোর একটা বাণী এবং বাণীটার সত্যতা উপলব্ধি করতে পারলেন নিজের অন্তরের মধ্যে : ‘সবটা মিলে বললে, মানুষের কোনো কিছুই বেশি সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই, তারপরও… 

মেহেরনাজ কোনো কিছুই বলল না কাহিনিটা শুনে, শুধু আমাকে শোনাল আমার প্রিয় কথাটাই, যা আমি প্রায়ই বলে থাকি তার ও অন্যদের কথা শেষ হলে : ‘ভালো।’ 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *