আগস্ট আবছায়া – ১.৮

১.৮

ল্যাপটপ ছেড়ে উঠলাম। মাথা ঘুরছে। এগুলো কি নিছকই ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব নাকি বিন্দুমাত্রও সত্য আছে এতে? নেপালের ভূমিকম্প কি আমেরিকা-ইসরায়েল-ভারত-HAARP মিলে ঘটানো কোনো কাজ? সুরভি কি ভূমিকম্প বিষয়ে ষড়যন্ত্র বলতে আমি এতক্ষণ যা পড়লাম, সেগুলোই বোঝাচ্ছে? আমি জানি না, সুরভি কী বলতে চাইছে, কিন্তু এগুলো পড়ার পর অন্তত এটা মনে হলো যে, সুরভি কিছু একটা বলতে চাচ্ছে, যা পুরোপুরি উপেক্ষা করার মানসিকতা আমার আর থাকা উচিত নয়। 

রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বুঝলাম, এখন ডাল-ভাত রান্না কিংবা পাস্তা বানানো, কোনোটাতেই মন নেই আমার। বসুন্ধরা আবাসিকে ঢোকার মুখের একটা সস্তা পিজার দোকানের উদ্দেশে বের হয়ে গেলাম সে মুহূর্তে, রিকশা ডেকে তাতে উঠলাম। রিকশাওয়ালা বৃদ্ধ আমাকে অবাক করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সারের কি শরীর ভালো এখন?’ আমি বুঝলাম তিনি আমাকে চেনেন, আমাকে হাসপাতালে যেতে বা বের হতে দেখেছেন। এঁরা এই আবাসিকের সিরিয়াল নাম্বার গায়ে চাপানো রিকশাওয়ালা। কোনো বাসাবাড়ির ভেতরকার খবরাখবর এই এলাকায় কত দ্রুত মানুষের মুখ থেকে মুখে ছড়িয়ে যায়, তা ভেবে আশ্চর্য বোধ হলো। পিৎজার দোকানের ছেলেটা—আসলাম তার নাম— আমাকে অনেক খাতির-যত্ন করল, একটা ফানটা টেবিলে দিয়ে বলল যে ওইটার পয়সা লাগবে না। সাধারণ মানুষগুলোর ভালোবাসার প্রকাশ কত স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক। আমি বিল মিটিয়ে উঠতে যাব, এমন সময় নূর হোসেনের ফোন এল : ‘মাসুমের বাসায় চলে যাও জলদি, তার শরীরের অবস্থা হঠাৎ অনেক খারাপ হয়ে গেছে। জলদি।’ 

আমি বাসায় ঢুকে তড়িঘড়ি গাড়ির চাবি নিয়ে ছুটলাম মাসুম হায়াতের বাসা গুলশানের নিকেতনের দিকে। এত তাড়াতাড়ি? চার দিন আগে মাসুমকে দেখে জেনেছিলাম সে আসলে আর বাঁচবে না। তাই বলে এত দ্রুত? জানতাম সামনের কোনো একদিন মাসুমদের বাসার কারও কাছ থেকে একটা ইমার্জেন্সি ফোন পাব, কিন্তু সেই ফোন আজই পেয়ে গেলাম? আকাশে পাখিদের দল বেঁধে ওড়ার বিহেভিয়ারিয়াল মডেলের গণিত ও পদার্থবিদ্যাকে মাসুম ‘অলৌকিক’ বলেছিল সেদিন, তারপর নিস্তব্ধ হয়েছিল টোস্ট বিস্কিট খাওয়ার সময়ে, তার চোখ পানিতে চিকচিক করছিল জীবনের স্বল্পদৈর্ঘ্যের কথা ভেবে, এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যগুলো যে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চিরতরে তার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে, সেটা ভেবে। সে আমাকে আরও বলেছিল আমি পশুর থাবায় মৃত্যুর কথা ও অন্তর্ঘাতে মৃত্যুর কথা আমার ‘মৃত্যুতালিকা’য় রাখতে ভুলে গেছি, একই সঙ্গে ভুলে গেছি আত্মহত্যার কথাও। 

এগুলো মনে করতে করতে আমি মাসুমদের বাসার খোলা দরজা দিয়ে সোজা ঢুকে গেলাম ওদের বেডরুমে। মাসুমের স্ত্রী ফারজানা, যার সঙ্গে আমি ও আমরা যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ ছিলাম জীবনের অন্য এক পর্বে, হিজাব করা শুরু করেছে লক্ষ করলাম। আল্লাহর প্রতি তার এই বিশেষ নিবেদন কি তার স্বামীর কোলন ক্যানসার ধরা পড়ার পর থেকে? মানুষ এত দুর্বল? কেন? বিছানার এক পাশে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হতভম্ব হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে তাদের দুই যমজ পুত্র শাহরিয়ার ও শাহনামা। নিতান্তই বয়সে শিশু তারা, এখনো মৃত্যু, বিশেষত বাবার মৃত্যু, কী জিনিস তা বোঝার বয়স হয়নি। 

চার দিনের মধ্যে মাসুমের এ কী পরিবর্তন? জানলাম কয়েক সাইকেল কেমো দেওয়ার পর থেকে তার লিভার আসলে আর কাজ করছে না। রক্তবমি হচ্ছে, পেটে পানি এসে গেছে, পেট ফুলে যাচ্ছে। Ascites-ডাক্তারি ভাষা। লিভার প্রোটিন তৈরি করতে পারছে না, রক্ত যে পানি ধরে রাখে, সেটা ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে, আর এভাবে মাসুম শকে চলে গেছে, তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, তার প্রেশার ও পালস থাকছে না। আমাকে কারও বলা লাগল না যে, মাসুমের ইন্টারনাল ব্লিডিং ও এক্সটারনাল ব্লিডিং—দুটোই হচ্ছে একসঙ্গে। 

চুপচাপ বিছানায় পড়ে আছে প্রায় সাদা হয়ে যাওয়া মাসুম। আধঘণ্টা আগেই তীব্র শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল তার, তীব্র পেটে ব্যথা। আমার হাত ধরল সে, বলল, ‘শ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হচ্ছে।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হাসপাতালে কেন যায়নি? তার স্ত্রী কান্না শুরু করল। মাসুম হাসপাতালে যেতে চাইছে না ধরনের কিছু একটা বলল সে তার হিজাবে ঢাকা মাথা নাড়তে নাড়তে। মাসুম কথাটার প্রতিবাদ করল যেন, কিন্তু তার জড়িয়ে যাওয়া কথার কিছুই বোধগম্য হলো না আমার। মনে হলো সে সম্ভবত বলছে, ‘হু উইল টেক কেয়ার অব মাই চিলড্রেন?’ (যদিও সেটা আমার নিজের অনুমান থেকে বানানো কিছু হতে পারে)। 

অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে হাজির হলো নূর হোসেন, গন্তব্য গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতাল, সেখানে আমাদের কমন বন্ধু ডাক্তার মুজাফফর হোসেন তাকে দেখবে। আমি মাসুমদের ছোট বেডরুমের বড় বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। পরিষ্কার, ফাঁকা বারান্দা, তাতে মাত্র একটা ইজিচেয়ার পাতা। টবের গাছগুলো চিনতে পারলাম—কিছু সাধারণ ইউফরবিয়া, গোল গোল সবুজ বলের মতো; একটা টবভর্তি সেনেসিও, তাদের শরীর মেদে টইটম্বুর; দুটো টবে দুই বড় কিন্নরী, দুটোতেই ধরেছে অনেক গোলাপি ফুল, চারপাশে সাদা বর্ডার দেওয়া গোলাপি, অন্ধকারে তাদের দেখতে লাগছে তরুণী মেয়েদের ঝলমলে কামিজের মতো; আর একদম কোনায় একটা সব-বাসায় দেখা যায় মতন একানথোক্যারিসিয়াম ক্যাকটাস, যেন সবুজরঙা এক হীরা। মাসুম যে ফুলগাছ এত ভালোবাসে, তা জানা ছিল না আমার। হতে পারে এটা ফারজানার শখ। 

আমি বারান্দা থেকে তাকিয়ে আছি বেডরুমের দিকে। মাসুমের সঙ্গে কথা বলছেন এক ডাক্তার। হাসপাতাল থেকে আসা আরও এক লোক কী সব যেন তাঁর ব্যাগে ভরছেন, মাঝখানের কিছুটা ঘোলা ও অপরিচ্ছন্ন কাচের কারণে বোঝা যাচ্ছে না তা। আমি দেখতে পারছি মাসুমের স্ত্রী মাথা খুব নিচু করে একদম নূর হোসেনের কানের মধ্যে কিছু বলছে। মাসুমকে ধরে তোলা হলো এবার, বিছানা থেকে। বিছানার হালকা ঘিয়েরঙা চাদর, তার মাঝখানে মাঝখানে রডোডেনড্রন ফুল ও উড়ন্ত বলাকার নকশা করা, সেখানে ঘোলা কাচের মাঝখান থেকেই দেখা যাচ্ছে একটা নির্দিষ্ট স্থান বেশ ভরে আছে তাজা রক্তে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম এদিকে। দরজার ওপার থেকে শুনতে পাচ্ছি ফারজানার চাপা কান্নার আওয়াজ-ওহ্হ্হ্ ওহ্হ্হ্, একটানা এক ওহ্হ্হ্ ওহ্হ্হ্ও। 

পুবের আকাশের দিকে তাকালাম আমি। আকাশের তারা দেখা একসময় নেশা ছিল আমার ক্যাডেট কলেজে পড়বার দিনগুলোয়, মানে প্রায় ত্রিশ বছর আগে। কোথায় হারিয়ে ফেলেছি সেই নেশা? শহরের আকাশে তারাই-বা দেখা যায় কয়টা? অধিকাংশ তারার নাম ভুলে গেছি এখন। তবু আগস্টের আকাশে পরিষ্কার চিনতে পারলাম ভেনাসকে, মাঝেমধ্যেই ঠিকরে উঠছে তার আলো, এবং ভেনাসের বেশ বাঁয়ে ক্যাস্টর, ক্যাস্টরের নিচে পোলাক্স। মনে পড়ল রাত দশটা এগারোটার দিকে ভেগা, অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র, পার হওয়ার দিন চলছে এখন। 

কোত্থেকে এসেছি আমরা? এ প্রশ্নের যতগুলো উত্তর আমি পড়েছি এ জীবনে, তার মধ্যে আমার সব থেকে পছন্দের এ ব্যাখ্যাটা যে, আমরা এসেছি তারাদের থেকে। এই কথাটাই কেমন গভীর, রুচিস্নিগ্ধ ও সুন্দর। বলা হচ্ছে, আমাদের প্রত্যেকের শরীরের অধিকাংশ অ্যাটম এসেছে বহু আগে মৃত তারাদের প্রকাণ্ড অগ্নিগর্ভ চুল্লিতে তৈরি হওয়া অতি ক্ষুদ্র পার্টিকেল থেকে, যারা অ্যাটম থেকেও ক্ষুদ্র। বলা হচ্ছে, আমাদের দেহের শুধু গোড়ার সেই মৌল হাইড্রোজেন ভাগটুকু তারাদের থেকে আসেনি, বাকি সবটাই এসেছে, কারণ ওই হাইড্রোজেন অংশের সৃষ্টি তারাদেরও আগে। সে হিসাবে — মহাজগতের হিসাবে—মহাজগতের অ্যাকাউন্টিংয়ের হিসাবে—আমরা ৯০ শতাংশই তারার অবশেষ। বলা হচ্ছে, আমরা যদি মানবদেহের একদম ভেতরে পদার্থবিজ্ঞানীর চশমা পরে তাকাই, তখন এ কথায় কোনো দ্বিমত করা যাবে না যে, সারবত্তার বিচারে আমরা নিউক্লিয়ার ফিউশনেরই এক বাই-প্রোডাক্ট। ওই বিরাট-বিশালাকার চুল্লিগুলোর প্রবল চাপ ও তাপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৌলকণার টুকরোকে একত্রে জড়ো করে আরও ভারী ও বড় কণাতে তাদের রূপান্তর ঘটাচ্ছিল; সেই বড় কণাগুলোই, ফিউজিং শেষ হবার পরে, চুল্লি নিভে গেলে পরে, ছড়িয়ে পড়ে মহাশূন্যের নিঃসীম আয়তনে। বলা হচ্ছে, আমাদের হাড়ের মধ্যেকার সবচেয়ে ভারী অ্যাটমগুলোর সম্ভবত ওই তারার চুল্লিতে বড় সাইজ ও পুরুষ্টু হতে একটা ক্ষুদ্র-অনন্ত চক্রেরও বেশি কাল লেগেছে। তারপর অগণনীয় সংখ্যক ওভাবে তৈরি হওয়া অ্যাটম জমাট বেঁধে জন্ম দিয়েছে এই গ্রহের, এবং জীবন নামের এক অদ্ভুত অস্থিরতা আমাদের নশ্বর সত্তার মধ্যে প্লাবনের মতো ভাসিয়ে ঝেঁটিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে ওই অ্যাটমগুলোকে। আমরা, তাই বলা যায়, একেকজন সংঘবদ্ধ কিছু তারার গুঁড়ো। আর কী অবিশ্বাস্য ও রাজসিক এই রূপান্তর যে সেই আমরাই, তারার গুঁড়ো দিয়ে তৈরি আমরাই, আজ রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে অন্য তারাদের ঝলকানি দেখতে বা উপলব্ধি করতে পারছি। তারাগুলো দেখতে মনে হয় কত দূরে, কত নির্জনে আছে ওরা, কিন্তু সত্যিকার অর্থে—আমরা ওদের অনেক কাছের; যত আলোকবর্ষ দূরেই ওরা থাক না কেন, আমরা ওদের অনেক কাছের। আমি আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জানালার কাচের ওপাশে দেখলাম একজন তারাকে এ মুহূর্তে বিল্ডিংয়ের নিচে নেওয়া হচ্ছে স্ট্রেচারে শুইয়ে, তাকে দেখতে লাগছে এমন যেন তার ভেতরকার অদৃশ্য চুল্লির আগুন নিভে গেছে পুরোপুরি। 

আমাকে ডাকল নূর হোসেন। আমি তার সঙ্গে নিচে নামলাম। নূর জানাল, অ্যাম্বুলেন্সে যাবে ফারজানা ও দুই ছেলে, এবং মাসুমের এক চাচা; আমি যাব নূরের গাড়িতে। আমি বললাম, “আমার হাসপাতালে যেতে ইচ্ছা করছে না, গিয়ে কী করব? আর আমার নিজের গাড়িও তো এইখানে।’ নূর বলল, ‘হাসপাতালে কারও কিছু করার জন্য যেতে হয় না’, তারপর একটু থেমে সিরিয়াস কণ্ঠে জানাল যে ফিরতি পথে সে আমাকে এখানেই নামিয়ে দিয়ে যাবে, আর মূল কথা আমার সঙ্গে তার জরুরি কথা আছে, যা সে আমাকে গাড়িতে যেতে যেতে বলতে চায়। 

গাড়িতে উঠতেই নূর জানাল, এনএসআইতে তার এক ভাই কাজ করে যথেষ্ট উঁচু পদে, সেই ভাইকে ধরেই সে লুনার গ্রামীণফোনের কল রেকর্ড পেয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে গত এক মাসে লুনা আমাকে ফোন করেছে দশবারের মতো। কী চলছে আমাদের? সরাসরি ও সাংঘাতিক এক কণ্ঠস্বরে গাড়ি চালাতে চালাতে আমাকে জিজ্ঞেস করল নূর, আমার দিকে তাকিয়ে। 

যা চলছে তা যত দূর পারা যায় বস্তুনিষ্ঠভাবে তাকে বললাম আমি, সেই সঙ্গে যোগ করলাম আজ রাতের কথাগুলোও যে, লুনা প্রয়োজনে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে তাকে ফাঁসাবে এবং এ সবকিছু, গত এক মাস ধরে আমাকে লুনার আর্জি জানানোর সবটুকু, তাদের ওই এক মগবাজারের ফ্ল্যাটের মালিকানা কেন্দ্র করে। 

একটা রিকশার গায়ে গাড়ি লাগিয়ে দিল নূর। দোষ তারই, রিকশাওয়ালার নয়, কিন্তু গাড়ির কাচ নামিয়ে রিকশাওয়ালা মানুষটাকে গালাগালি দিতে লাগল সে যাচ্ছেতাইভাবে। রিকশাওয়ালা প্রতিবাদ করে যাচ্ছে উচ্চ স্বরে, তার মূল কথা একটাই : ‘গাড়িতে উঠলে আর আপনাগো মনে থাকে না যে, রিকশাওয়ালারাও মানুষ। আল্লাহর গজব পড়বে গাড়িওয়ালাগো উপরে।’ রিকশাওয়ালার মুখ থেকে ক্রোধের ফেনা বেরোচ্ছে, সাদা, জমাটহীন ফেনা, আর নূর তার অনেক গালাগালির পরে হতভম্ব হয়ে গেছে রিকশাওয়ালার এই উত্তরে, একই উত্তর, অনবরত বলতে থাকা একই গজবের কথা। 

রিকশাওয়ালা এপিসোড শেষ হলো। গাড়ি এখন চলছে মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা ধরে। অ্যাম্বুলেন্সটা নিশ্চয়ই অনেক সামনে চলে গেছে, আমরা না দেখছি তার ছাদে ঘুরতে থাকা আলো, না শুনছি তার ওয়া ওয়া আওয়াজ। নূর আমাকে জিজ্ঞেস করল: ‘আর কিছু?’ 

আমি অবলীলায় তাকে বলে দিলাম লুনার আমাকে দেওয়া প্রস্তাবের কথা -নূরকে ফ্ল্যাটের মালিকানা ছেড়ে দিতে আমি রাজি করাতে পারলে বিনিময়ে আমি তার কাছ থেকে যা চাই, যা চাই, যা চাই তা আমাকে দিতে রাজি আছে লুনা। 

কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। তারপর জমাট সেই মৌন ভাঙল নূরের শুষ্ক কণ্ঠস্বরে :

‘তুমি কী বললে প্রস্তাবের উত্তরে?’” 

‘কিছুই বলিনি। কী বলতে পারি?’ 

‘রাজি হলেই পারতে। আমাকে নানাভাবে তুমি বোঝাতে, নানা চাপ দিতে, একসময় আমি রাজি হয়ে যেতাম ফ্ল্যাট ওর নামে লিখে দিতে, তারপর তুমি কী সুন্দর ওকে পেতে বিছানায়।’

সমস্ত আলাপ, আমি লক্ষ করলাম, কেমন এক জংলি ও কুৎসিত দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। আমি আর নিতে পারলাম না, মনে হলো এই আলোচনা থামাতেই হবে, না হলে ন্যাংটো হয়ে সদর রাস্তায় হাঁটা বলতে আর অবাক করা কিছুকে বোঝাবে না। আমি বললাম, ‘বন্ধুর বউ বা বন্ধুর বাচ্চার মায়ের সঙ্গে শোয়ার সামান্য শখ নেই আমার।’ 

এরপর অনেকক্ষণ চুপচাপ। নূর তার হাত রাখল আমার হাতে, আমি বুঝলাম না কেন। হাতে মৃদু চাপ দিয়ে সে বলল, ‘এবার বুঝেছ কেন আমি ওকে এমা বোভারি বলি?’ 

গাড়ি ইউনাইটেড হাসপাতালের একদম কাছে চলে এসেছে। রাস্তার এ জায়গাটায় জমাট অন্ধকার। আমি সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম ডাইনির চেহারার দুটো বড় রেইনট্রি গাছ আর ভাবতে লাগলাম, কীভাবে ফ্লবেয়ার ও তুর্গেনেভ দুজনেই সুখ নামের বস্তুটাকে সন্ধান করে গেছেন তাঁদের লেখাজুড়ে, এবং কীভাবে তাঁরা বারবার একই উপসংহারে এসে ভিড়েছেন যে সুখ অর্জন-অযোগ্য, শুধু তাদের জন্যই নয়, পুরো মানবজাতির জন্যই তা অর্জন-অসম্ভব এক ধারণা, যেমন ব্যক্তিগত জীবনে, তেমনই কর্মজীবন বা সামাজিক পরিমণ্ডলেও। তুর্গেনেভের ছোট লেখা ‘এনাফ!’-এর প্রথম ভাগের বারো খণ্ডাংশের মূল কথা : জীবনের প্রতি প্রবল অনুরাগের শেষেই আছে প্রবল হতাশা, যা এড়ানোর কোনো পথ খোলা নেই; এবং এর দ্বিতীয় ভাগে প্রকৃতি কত শত্রুভাবাপন্ন হতে পারে, সে কথা বলেছেন তিনি বিশদ করে। প্রকৃতি চিরন্তন, সে নিজেকেই নিজে আবার সাজায়, শীতের পরে যেমন গ্রীষ্ম; অন্যদিকে মানুষের জীবন কেবল একবারের, একে নতুন করে আবার সাজানোর কোনো সুযোগ নেই, আর মানুষ তার ভুল থেকে শিখে নতুন করে ঠিকটা করতেও অসমর্থ। দুহাজার বছর আগে অ্যারিস্তোফানিস মানুষকে যে ভুলগুলোর জন্য গালমন্দ করে গেছেন, সেই একই ভুল আমরা করে যাচ্ছি আজও, হ্যামলেটও কিং লিয়ার এর কাছ থেকে কিছুই শিখিনি আমরা, জীবন এত ক্ষণকালের যে সেই শেখা কমবেশি সম্ভবই না; আর ফ্লবেয়ারের শেষ উপন্যাস বুভা অ্যান্ড পেকুশের দুই নায়ক বিরামহীন চৰ্চা করে যাচ্ছে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির, তারা জ্ঞানের প্রায় সব কটি শাখাতেই বিচরণ করে ফেলেছে—কৃষি, বাগানবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, ইতিহাস, দর্শনের ইতিহাস, রাজনীতি, জিমন্যাস্টিকস, অধ্যাত্মবাদ, চৌম্বকতত্ত্ব, অধিবিদ্যা, খ্রিষ্টধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, সব-বারবার তারা গবেষণায় ঢুকছে নতুন নতুন জ্ঞানের শাখার মধ্যে। যত নতুন ও না-জানা জ্ঞান, তত বেশি তাদের জানার তৃষ্ণা ও মোহ, কিন্তু দেখা যায় সবশেষে এত উৎসাহ, এত পরিশ্রমের শেষে তাদের মোহভঙ্গ হলো, জীবন তাদের উপহার দিল শুধু এক পরিষ্কার—ও ব্যতিক্রমহীন—ব্যৰ্থতা। 

ইউনাইটেড হাসপাতালের আলো ঝলমল প্রবেশদ্বারে গাড়ি না রেখে নূর গাড়ি রাখল খানিকটা দূরে। রাস্তার এ জায়গাটায় জমাট অন্ধকার। আমি সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম ডাইনীর চেহারার দুটো বড় রেইন-ট্রি গাছ। নূর গাড়ি থেকে নেমেছে আমার আগে। দেখলাম সে পা বাড়িয়েছে হাসপাতালের দিকে। গাড়ি থেকে নেমে আমিও হাসপাতালের মূল দরজার দিকে পা রাখতে যাব, তখনই আমাকে গাড়ির ওপরে রীতিমতো ঠেসে ধরল নূর, আচমকা। তারপর আমার মুখের কাছে মুখ এনে বলল : ‘লুনা যদি এর পরেরবার ফোন করে একই কথা বলে তো ওকে বলে দিয়ো, ওর অত নাটক করে গায়ে আগুন দেওয়া লাগবে না, কারণ আমি সত্যি সত্যিই শিগগির ওর গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন দিয়ে দেব, একবারে না, ধাপে ধাপে। ফার্স্ট আই উইল বার্ন হার ফেইস, দেন হার ব্রেস্টস, দেন হার পুসি।’ কথাটা বলে আমাকে এক মৃদু ঝটকা দিয়ে—অনেকটা সিনেমার মতো—গাড়ির গায়ে আরও বিদ্ধ করে রাখল নূর। তারপর সে হাঁটা ধরল হাসপাতালের দিকে, একটু এগিয়ে থামল, পেছন ফিরল, এবার আমাকে সঙ্গে নিল আমার কাঁধে হাত রেখে, বন্ধুর মতো। 

তারপর একই দিনের মধ্যে একবার সকালে, একবার রাতে-নরকের দুই রকম দেখতে একই মূল দরজার মাঝ দিয়ে দুবার ভেতরে ঢুকলাম আমি, প্রথমবার অ্যাপোলো হাসপাতালে গাড়ির পর গাড়ি ভরে নামতে থাকা রোগীর ভিড় থেকে বাঁচতে এবং দ্বিতীয়বার এই এখন, ইউনাইটেড হাসপাতালে ক্যানসারে আক্রান্ত প্রিয় বন্ধু তার বিছানা ও বাথরুম তাজা রক্তে ভাসিয়েছে বলে। 

প্রায় আধা ঘণ্টা হয়ে গেছে যে আমাদের কমন বন্ধু ডাক্তার মুজাফফর বলে গেছে মাসুমের অবস্থা বুঝে নিয়ে সে শিগগির আসছে আমাদের কাছে, আমরা যেন এ জায়গাতেই থাকি। আমরা সে জায়গাতেই আছি, মাটি থেকে অনেক উঁচুতে এক খোলা বারান্দায়, আমাদের সঙ্গে চুপ করে বারান্দার দিকে পিঠ ও রাতের শূন্যতার দিকে মুখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে ফারজানা, মাসুমের স্ত্রী। তার মাথা থেকে হিজাবের কাপড় পড়ে গেছে গলার কাছে, বৃত্তাকারে ওখানে পড়ে আছে লন্ডভন্ড অবস্থায়, এবং তার বড় বড় দুচোখের মণির দিকে তাকিয়ে আমি এইমাত্র দেখতে পেলাম তার যমজ দুই সন্তান শাহরিয়ার ও শাহনামা দৌড়ে বেড়াচ্ছে—অন্যের চোখের মণির আয়তনে কোনো কিছু যতটা ক্ষুদ্র দেখা যায়, ততটা ক্ষুদ্র আকারে-হাসপাতালের বারান্দাজুড়ে। 

একসময় ফারজানার দুই বান্ধবী এসে হাজির হলো তার পাশে, তাদের দুজনেরই মমতাভরা মুখ, ব্যাকুল জিজ্ঞাসাভরা চোখ। এদের মধ্যে যে বেশি লম্বা, তাকে ইঙ্গিত করে নূর আমার কানে কানে বলল, ‘লুনার বান্ধবী, ইসমত।’ কী হেরফের হয় এই ইসমত নামের মেয়েটা লুনার বান্ধবী হলে, তা বুঝলাম না। সেটা কি ইসমতকেও কারও অবিশ্বস্ত স্ত্রী বানিয়ে দেয়, নাকি তাতে এমনই বোঝায় যে, দ্যাখো অবিশ্বস্ত ঘরের বউ লুনার আবার কত স্বামীভক্ত ও বিশ্বস্ত বন্ধু আছে? ‘লুনার বান্ধবী, ইসমত’ কথাটায় এ দুই সম্পূর্ণ বিপরীতার্থক সত্যের যেকোনোটা বোঝানো যায়, আবার কথাটার মধ্যে এ দুইয়ের কোনোটা না, বরং তৃতীয় এক অর্থও থাকতে পারে এমন যে, ‘এই দ্যাখো এই মেয়েটা লুনার বান্ধবী, ইসমত নাম, সে যখন ফারজানার পাশে এসে গেছে, তার মানে কিছুক্ষণের মধ্যে লুনাও চলে আসবে এখানে।’ যদি তৃতীয় অনুমান সত্য হয় তো আমার জানতে ইচ্ছা করে, নূর এ মুহূর্তে কিসের মধ্যে আছে—আশা না আশঙ্কা? আশা যে, লুনাকে দেখা হবে বহুদিন পরে এক নজর হলেও? আশঙ্কা যে, লুনাকে সামনে পেলে সিগারেট লাইটার দিয়ে এই খোলা বারান্দায় ওর গায়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো গতি থাকবে না তার? 

হঠাৎ ভূতের মতো এসে আবির্ভূত হলো ডাক্তার মুজাফফর। আমি, নূর, মাসুমের স্ত্রী ফারজানা, তার বন্ধু ইসমত, তার আরেক বন্ধু, যার নাম আমি জানি না, মাসুমের চাচা এবং আরও কারা কারা যেন মিলে আমরা ঘিরে ধরলাম মুজাফফরকে। বিরাট খোলা আকাশের নিচে এক বিচারক জনতাকে তাঁর চূড়ান্ত রায় শোনাবেন। মুজাফফর তাকাল ফারজানার দিকে, অন্য কারও দিকে নয়। আমি খুঁজতে লাগলাম মাসুমের দুই যমজ ছেলেকে, টানা বারান্দার পুরোটাজুড়ে, চোরাচোখে। মুজাফফর বলল, ‘ভাবি, মাসুমের অবস্থা ভালো না। অবস্থা শেষ পর্যায়ে ধরে নিতে পারেন, ভাবি। আমি আর কী বলব জানি না, ভাবি।’ 

আমরা শুধু এটুকু কথায় সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। মাসুমের চাচা বেশ জোরের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ডাক্তার সাহেব, ভালো না মানে কতটা ভালো না?’ আমরা আসলে জানতে চাইছি, আজকের এটা মাসুমের শেষ বিদায়ের জন্য হাসপাতালে আসা, নাকি মোটামুটি এ যাত্রায় বেঁচে গিয়ে বাসায় ফেরার জন্য আসা? আরও নিখুঁত ছক মেনে বললে আমরা আসলে জানতে চাইছি, বাসার বিছানায় যে পরিমাণ তাজা রক্ত দেখা হয়ে গেছে আমাদের সে হিসেবে ডাক্তার তুমি বলো যে মাসুম আর কত ঘণ্টা বাঁচবে? আর আমি যদি এ মুহূর্তে শক্তি না হারিয়ে কথা বলতে পারতাম তো জানতে চাইতাম, মাসুম কি আধুনিক হাসপাতালের ব্যুরোক্রেসির মধ্যে বসে মরবে, নাকি ফিরে গিয়ে তার বাসার ঘরোয়া পরিবেশে মরবে? 

আগের দিনে গ্রামে যখন কেউ মারা যেত, শুনেছি তখন চাষাভুষা লোকগুলো মৃতের তোশক থেকে তুলা-টুলা বের করে পোড়াত, কিন্তু তোশকের কাপড়টা রেখে দিত। শুনেছি হাসপাতালে মৃত্যুর এই যুগের আগের যুগে ইউরোপে মৃতের পরিবারের লোকেরা ঘরের সব আয়না ঢেকে দিত কাপড় দিয়ে, যেন বিদায়ী আত্মা সেই আয়নায় নিজেকে দেখতে পেয়ে কষ্ট না পায়, আবার যেন আয়নার মধ্যে ঘরের প্রিয় আসবাবের প্রতিফলন দেখতে পেয়ে সেই আত্মার এই ঘরেই থেকে যাবার ইচ্ছা না হয়। শুনেছি অনেক সংস্কৃতিতেই ঘরের কারও মৃত্যু হলে সব জানালা-দরজা হাট করে খুলে দেওয়া হয় যাতে করে আত্মা নির্বিঘ্নে ঘর ছেড়ে বাইরে উড়ে যেতে পারে, যাবার পথে কোনো বাধা না পায় এবং সে কারণেই মৃতের ওপরে ঝুঁকে আসা মানা ছিল তখন, পরিবারের কেউ তখন দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না কোনো মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মুখের সামনে। হাসপাতালে মৃত্যু, কাগজ-ফর্ম পূরণ করা মৃত্যু। সই-স্বাক্ষর দিয়ে হাসপাতালের বিল মেটানোর ও দাফন পর্যন্ত ফ্রিজে মৃতদেহ রাখবার চুক্তির আয়োজন করা এই মৃত্যু ওই সব প্রথা ও বিশ্বাসকে চিরতরে মিটিয়ে দিয়েছে, আমলাতন্ত্রের হাতে প্রথার মৃত্যু হয়ে গেছে। 

আমি জানতে চাইছি-যদিও সজোরে না, মনে মনে— মাসুমের ভাগ্যে কি সেই স‍ই-স্বাক্ষর ও নিয়মের মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট সময় পরে লাশ বুঝে নেওয়ার ক্যাটালগ-নির্ভর মৃত্যুই আছে তাহলে আজ রাতে? মুজাফ্ফর কী কী বলল নানাজনের নানা প্রশ্নের উত্তরে, তার কিছু মাথায় ঢুকল না আমার। আমি তখন ঘড়িতে দেখছি যে রাত বারোটা সাত মিনিট। 

১৪ আগস্ট শুরু হলো। সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা এই যে হাসপাতালে মরার এই যুগে রাত বারোটা-একটা এমন সময়গুলোই সাধারণত রোগী মারা যাওয়ার সময় হয়ে থাকে। মৃত্যু এখানে এ রকম এক বিদঘুটে সময়েই ঘটে যে দেখা যায় আগামী দিনের দাফনের প্রস্তুতির স্বার্থে মৃতদেহকে অন্তত একটা পুরো রাত হাসপাতালের ফ্রিজে ফেলে রাখা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা থাকে না। 

উপস্থিত কাউকে কিছু না বুঝতে দিয়ে আমি মুজাফফরের পিছু নিলাম, প্রায় সংগোপনে। বারান্দার বাঁক পার হয়ে তার সামনাসামনি দাঁড়ালাম। সে তখন দাঁড়িয়েছে লিফটের দরজায়। আমাকে দেখে সে চুপ, আমিও প্রশ্ন করলাম না কোনো। দুজনেই লিফটে উঠলাম। মুজাফফর জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছ?’ আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘মাসুম কি খুব মৃত্যুভয়ে আছে? ও বুঝতে পারছে কী হচ্ছে? দেখা করা যাবে?’ মুজাফফর আমার কাঁধে হাত রাখল, বলল, ‘মাসুমের জ্ঞান আছে, সে সব বুঝতে পারছে। ওর অনেক অনেক ব্যথা হচ্ছে। কী রকম ব্যথা তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না, মাই ফ্রেন্ড। দোয়া করো। ওর কষ্ট যেন কম হয়, সেটাই দোয়া করো।’ 

লিফট থামল। আমি তার পাশাপাশি হাঁটছি, সে যেন স্বগতোক্তি করল, ‘মানে হয় না, এর কোনো মানে হয় না।’ আমার মনে হলো সে আমাকে উদ্দেশ করেই কথাটা বলেছে যে, মাসুমকে এ অবস্থায়, তা-ও আবার তাদের হাসপাতালের নিয়মকানুনের মধ্যে ঝামেলা বাধিয়ে আমার দেখতে চাওয়ার কোনো মানে হয় না। আমি থেমে গেলাম। আমার এক কদম সামনে মুজাফফরও থামল, আমার দিকে ঘুরে তাকাল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মৃত্যুভয়? মাসুম অনেক ভয়ে আছে কি না, সেটা আমাকে বললে না কিন্তু।’ আমার প্রশ্নটাকে সম্ভবত আজগুবি এক প্রশ্নের বাস্কেটে ফেলল মুজাফ্ফর। সে উত্তরে আমাকে ভালো থেকো, টেক কেয়ার’ বলে সামনে হেঁটে হারিয়ে গেল এক গলিপথে। 

মৃত্যুভয়, আমার ধারণায়, এ কারণেই ঘটে যে আমরা ভাবি অন্য সবাই মরবে কিন্তু আমি বোধ হয় অন্যদের থেকে আলাদা কিছু হব এ ব্যাপারে—আমি মরব না। ঠিক যেমন আমি নিজে ভাবতাম আমার শৈশব-কৈশোরে, এমনকি ত্রিশের কোঠায় দাঁড়িয়েও। আমাদের সচেতন মন কেন যেন নিজের মৃত্যুকে বিশ্বাস করতে চায় না, সেই মন এমনভাবে আচরণ করে যে আমি যেন অবিনশ্বর, মৃত্যুহীন; এবং এত দিনের সে চিন্তাটাই মৃত্যুর দিনে অবচেতন থেকে চেতনে উথলে পড়ে এই বোধ নিয়ে যে, ওহ্, আমি তাহলে ভুল ভেবেছিলাম, বোকার মতো নিজেকে ভুল বোঝাচ্ছিলাম এতকাল; ওহ্, আমিও আজ তাহলে ধরা খেয়ে গেলাম অন্য আর সবার মতোই, আর তাহলে কোনো উপায় নেই যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আমার জন্য তার পাথরে লেখা নিয়ম বদলাবে, এবং ঠিক যে মুহূর্তে মনে হলো, না, তেমন উপায় নেই, আমার জন্য আর কোনো উপায় নেই এই অনিবার্যতা থেকে পালানোর, তার পরমুহূর্তেই আমার ধারণা মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটার মধ্যে আসে সামান্য ক্ষণিকের গুঙিয়ে ওঠা এক ক্রোধ, জীবন-মৃত্যুর ছককাটা এই মোটা দাগটার ওপরে ক্রোধ, এবং সেই ক্রোধই পরে বদলে যায় মৃত্যুভয়ে। 

এমন। এমনই। এমনটাই। এটাই চিরন্তন নিয়ম। এক ব্যতিক্রমহীন সাফ সাফ অনুভূতির ধারাবাহিক ঢেউ ভেঙে ভেঙে আসা। 

মাসুম নিশ্চয়, নিশ্চয়ই এতক্ষণে জেনে গেছে যে সে এই চক্রের বাইরের কেউ নয়, আর এতক্ষণে ওই অনুভূতিগুলোর ঢেউ নিশ্চয়ই ধাক্কা মারতে শুরু করেছে তার ভাবনাচিন্তার সৈকতজুড়ে। আমি কল্পনা করতে পারলাম মাসুম মুজাফফরের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ওই গলিপথের অসংখ্য দরজার কোনো একটার ভেতরে তার যন্ত্রণার চূড়ান্ত গোঙানিমাখা বিছানায় শুয়ে বা বসে, তার হাত দুটো দিয়ে মাথার চুল বিস্ময়-উত্তর এক বাকহারা ভঙ্গিমায় টানতে টানতে, কিংবা দুই হাত প্লাস্টিকের পুরোনো পুতুলের মতো অস্বাভাবিক বক্রতায় শরীরের দুপাশে ছড়িয়ে ফেলে রেখে শুধু আঙুলগুলো নাড়িয়ে সামলাতে চেষ্টা করছে ওই পাষাণ ঢেউগুলো। হায় অঙ্কের প্রফেসর মাসুম হায়াত, এই তাহলে তোমার ও আমার মৃত্যুগণিত? এই তাহলে তোমার এক জটিল অঙ্কের শেষে এসে দেখা যে এটা এত এক সরল ইকুয়েশন, অপরিবর্তনীয় ও ধ্রুব সমাধান, কিন্তু এতই সহজ সে সমাধান যে অঙ্কটাকে রীতিমতো এক ঠাট্টা ছাড়া অন্য কিছু মনে হওয়ার আর সুযোগ থাকছে না কোনো! 

.

হাহ্! তাহলে ঠকানো হয়েছে আমাদের। এইভাবে পুরো মাথায় বাড়ি মেরে খোলা রাস্তায় ভরদুপুরে বিরাট সূর্যের বিরাট আলোর নিচে প্রকাশ্যে গাছপালা-পশুপাখি-মসজিদ-মন্দির-মিউনিসিপ্যালিটির উঁচু দালান সবকিছুর একেবারে সামনে সরাসরি কৃপাহীন দয়ামায়াহীনভাবে ঠকানো হয়েছে আমাদের। বলা হয়েছে, তোমরা মেধাবী প্রাণী এবং তোমাদের জীবনের, এই আত্মীয়-পরিজন-বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষী পরিবেষ্টিত তোমাদের জীবনের এক বিশাল অর্থ আছে, আর অন্যদিকে বাস্তবে এইভাবে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে যে তোমরা স্রেফ পিঁপড়ামাত্র, তোমরা মাত্র একদিন বাঁচে যেসব কীটপতঙ্গ, তাদের থেকে সামান্য কয় দিন বেশি বাঁচা এক দুদিনের প্রাণী। 

হঠাৎই গায়ের মধ্যে ঝাঁকি দিয়ে উঠল আমার, প্রায় ছমছম করে উঠল চারধার। আমার মনে হলো, এত স্বল্পজীবী প্রাণী, যারা এভাবে লাইন দিয়ে কাতারে কাতারে মরে, যারা এত সাধারণ, এত মামুলি, তারা অনন্তকাল বেঁচে থাকা আত্মার ধারণার সঙ্গে বেমানান। আমাদের আবেগগুলো ক্ষুদ্র, গুণগুলো ক্ষুদ্র, দোষগুলোও ক্ষুদ্র, আমাদের সঙ্গে তাই কেবল মেলে কিছু বড়-ছোট কাজকর্মে ভরা দৈনন্দিন এক ক্ষুদ্র পৃথিবীর ক্ষুদ্র জীবনের ব্যাপারটাই। আত্মার অমরত্বের মতো বিশাল কথা প্রযোজ্যই হতে পারে না সার্বিকভাবে সবকিছুতে এত ক্ষুদ্র ব্যাপ্তির মাপে গড়া আমাদের জন্য। সমারসেট মম লেখক হওয়ার আগে ছিলেন ডাক্তার, তিনি তাঁর ডাক্তারি জীবনে অনেক রোগীর মৃত্যু দেখেছেন, শান্তিপূর্ণ মৃত্যু ও ট্র্যাজিক মৃত্যু, দুটোই। ‘কিন্তু তাদের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোর মধ্যে কোনোভাবেই আমি কোনো দিন এমন কিছু দেখিনি, যাতে মনে হতে পারে তাদের ভেতরকার সত্তা অমর। আমি দেখেছি, মানুষ কেবল কুকুরের মতোই মরে, বলেছিলেন মম। 

এই ওপরের কথাটুকু আমি বারান্দায় স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে যতক্ষণে ভাবলাম, সেটুকু সময়ের মধ্যে পৃথিবী থেকে তিরোহিত হলো প্রায় ১ হাজার ২০০ বা ১ হাজার ৩০০ মানুষ। এখানে প্রতি ঘণ্টায় মরে ৭ হাজার ৩০০, প্রতিদিনে মরে ১৭ হাজার ৫০০ এবং প্রতিবছরে (যুদ্ধ-দুর্ভিক্ষ-দাঙ্গা-প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসব বাদ দিয়ে) মরে প্রায় সোয়া ছয় থেকে সাড়ে ছয় কোটি। এভাবে ঘুরছে যে পৃথিবী নামের ফ্যাক্টরি, মেশিনে কাঁচামাল তুলছে বছরে চৌদ্দ কোটি আর মেশিন থেকে ঝেড়ে ফেলছে সাড়ে ছয় কোটি, সেই পৃথিবীর পক্ষে কীভাবে সম্ভব আমাদের জীবনের জন্য কোনো অর্থ খাড়া করা? 

আমি লিফটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। লিফট আসছে না। কোনো এক ফ্লোরে নিশ্চয় আটকে আছে। হয় কাউকে স্ট্রেচারে ঠেসে ধরে কোনো অপারেশন থিয়েটার নামের কসাইখানায় নেওয়া হচ্ছে, না হয় সেই কসাইখানা থেকে বের করে তাকে লিফটে তুলে দোলনায় চড়ার আনন্দ দেওয়া হচ্ছে। দোলনা। নবোকভের স্পিক, মেমোরির প্রথম লাইন : ‘দোলনাটা দোলে পাতালের অন্ধকারের ওপরে, আর কমনসেন্স বলে যে আমাদের অস্তিত্ব তার দুধারের দুই অনন্ত অন্ধকারের মাঝখানে ক্ষণকালীন এক আলোর সামান্য রেখা মাত্র। ‘ জীবনের দুই প্রান্তের এ দুই অনন্ত আঁধার, বলেন নবোকভ, ঠিক দুই একই চেহারার যমজ, মানুষ কোনো এক নিয়ম মেনে তার জন্মের আগের আঁধারটুকু নিয়ে ততটা বিচলিত হয় না, যতটা সে হয় মৃত্যুর পরের পাতালপুরীর অন্ধকারের ব্যাপারে, যার দিকে জীবনভর এগিয়ে যাওয়াই মানুষের কাজ, প্রতি ঘণ্টার ৪ হাজার ৫০০ হার্টবিটে ওদিকেই এগোয় সে। কিন্তু প্রকৃতি চায় মানুষ যেভাবে মাঝখানের ছোট জীবনটুকুর সব উথালপাতাল ঘটনা অবিচল মেনে নেয়, সেভাবেই সে মেনে নিক তার জীবনের আগের ও পরের নিবিড়-জমাট অন্ধকারে ভরা দুই প্রান্তকেও, দুই শূন্য গর্তকেও। 

লিফটের দোলনায় চড়া হলো না আমার। লিফট এলই না। আমার মনে হলো, নাহ্, নূর হোসেন বা ফারজানা বা অন্য কারও মুখ এখন দেখতে চাই না আমি। তার চেয়ে ভালো সিএনজি-রিকশা নিয়ে চুপচাপ মাসুমদের বাসা পর্যন্ত গিয়ে তারপর গাড়ি নিয়ে নিজের বাসায় ফিরে যাওয়া। 

আমি সিঁড়ি খুঁজতে লাগলাম। কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে সিঁড়িগুলো? আমার পালাবার সিঁড়ি? পেয়ে গেলাম একসময়। দেখলাম এখান দিয়ে নামছে হাসপাতালের দুজন লোক, তাদের দুজনের হাতে লম্বা, সাদা লাঠির মতো দুটো মেডিকেল ইকুইপমেন্ট। একজন আমাকে বলল, ‘লিফট আছে তো।’ আমি উত্তর দিলাম না কোনো, নামতে লাগলাম সিঁড়ি ধরে। সোজা নামা সহজ কিন্তু যখনই বাঁক আসে আমার ভার্টিগোর মতো হয়, তাই বাঁকের পাশে দাঁড়িয়ে আমি থামি, বাঁকের দিকে না তাকিয়ে গতি ধীর করে অন্য পাশে দেয়ালের দিকে চোখ রেখে বাঁক পার হই। তারপর আবার সোজা নামা, আবার কঠিন বাঁক পার হওয়া, আবার মাথার দুপাশে খানিকের জন্য দুহাত চেপে রেখে নিজের ঠুনকো নড়বড়ে ভাবটাকে সামাল দিয়ে সোজা নামতে থাকা। হাহ্, মানুষ কী রকম নড়বড়ে এক যৌগ আর পৃথিবী নিশ্চিতভাবে কী এক নিকৃষ্ট জাতের গ্রহ। কেউ না কেউ বলেছিলেন এই দামি কথাটা। শেষ হচ্ছেই না এমন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আমার মনে হলো অন্য কথা : জীবন না বড়, না ছোট-এর আছে শুধু ক্লান্তিকর, একঘেয়ে এক দৈর্ঘ্য। একসময় শেষ হলো ওই সিঁড়ির দৈর্ঘ্য, আমি রিসেপশন এরিয়া পার হয়ে মূল দরজা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে এসে দাঁড়ালাম। 

বাইরের অন্ধকার আপসহীন। আগস্টের প্রচণ্ড গরম থেকে তাতে তরঙ্গ উঠেছে, মনে হচ্ছে কেউ বিশাল খোলা তরবারি নিয়ে ওই অন্ধকারকে ঘুটিয়ে দিয়েছে অন্যমনস্কতার সঙ্গে। আমি এই অন্ধকারের অগোছালো ভাবটা বুঝলাম জায়গায় জায়গায় স্তব্ধ ও স্পন্দনহীন পড়ে থাকা আলো দেখে, যেমন প্রতিটা লাইটপোস্টের নিচে, দূরে লেকের ওপারে বাসাগুলোর জানালার এ পাশে। সেই আলোর ছোট গোল বা তেকোনা চারকোনা উপস্থিতিটুকুর চারপাশে যেন চুম্বকের আকর্ষণে ছুটে গেছে অন্ধকার, ঘিরে ধরেছে যেটুকু আলো আছে তার সবটাকে। আলোর চারদিকে অন্ধকারের ছুটে যাওয়ার ভেলোসিটি, জমাট আঁধারের স্থিতাবস্থার নিচে পড়ে থাকা গুলশান লেকের দিকে আমি তখন তাকিয়ে, আমাকে বুঝিয়ে দিল অন্ধকার স্বভাবে অনড়, তার ভেতরে জেদের এক দপদপে ভাব বিদ্যমান, কারণ তাকে অনবরত লড়ে যেতে হচ্ছে আলোর শিশুতোষ বেয়াড়াপনার সঙ্গে এবং কেউ একটু ভালো করে উসকে দিলেই সেই অন্ধকার নিজেকে এমনকি নিউক্লিয়ার ফুয়েলেও রূপান্তরিত করে ফেলতে পারবে। 

আমার মনে হলো, আগুনের তাপের চেয়ে শীতের তাপশূন্যতার শক্তি বেশি—অগ্নিদগ্ধ একটা শহরের চেয়ে সীমাহীন তুষারপাতে ডুবে থাকা, জমে পাথর হয়ে থাকা কোনো শহরের চেহারাই বেশি মর্মবিদারক। তেমনি আলো শক্তিতে কম, অন্ধকারের চেয়ে; এবং অন্ধকারই মূল, আলো তার অনুগামী এক পরবর্তী সৃষ্টি মাত্র। সূর্যের আলোর নিচে যখন পৃথিবী ঝলমল করে, তখনো ওই বিরাট পৃথিবীর বিশাল জঙ্গলগুলোর ভেতরটা থাকে অন্ধকার, কিন্তু রাত যখন নামে, তখন আগের আলোকিত অঞ্চলগুলোও অন্ধকার, আবার জঙ্গলগুলোতেও একই অন্ধকার। 

আমি তাকিয়ে আছি লেকের ওপর-নিচ-বাম-ডান সব দিকে ছেয়ে থাকা আঁধারের দিকে। হাসপাতালের মূল গেট থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে লেকের পাশে চলে এসেছি, প্রায় না বুঝে, প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। সেটা বুঝলাম এখন—আমাকে সিএনজিস্টেশনের দিকে না নিয়ে এদিকে টেনে এনেছে হয় লেকের পানির ওপরের এই রুদ্ধশ্বাস অন্ধকার, না হয় আমি এখানে এসেছি লেকের পাড় ধরে লাগানো অস্বচ্ছ অন্ধকার গাছগুলোর টানে। কোনো গাছই চেনা গেল না ভালোমতো স্রেফ কিছু নারকেল ছাড়া, যারা লেকের ওপরে ঝুঁকে পড়েছে নিঃসহায়ের ভঙ্গিতে। আর কিছু আম, কিছু কড়ই ও পাকুড়জাতীয় গাছ, সব একসঙ্গে মিলে লাগছে উঁচু ঝোপের মতো, সন্ত্রাসী চেহারার তবে নিরুদ্বেগ, কারণ হাওয়া নেই কোনো দিকে এবং একই কারণে—সেই সঙ্গে এসি থেকে বেরোনোর জন্য—কুলকুল করে ঘামছি আমি ভেতরে। এইমাত্র অনুভব করলাম আমার পিঠের নিচে মেরুদণ্ড যেখানে শেষ, তার একটু ওপর থেকে ঘামের একটা ঢেউ—মৃদু শামুকের ভঙ্গিতে চলা কিছু বলাই ভালো—নিচে নেমে গেল আমার দুই নিতম্বের মাঝখানের কাটা দিয়ে; তার পরপরই বুঝলাম ঘাড়ের কাছ থেকে আরেকটা ঘামের শামুক নেমে যাচ্ছে ভেদবুদ্ধিহীন, পিঠের দিকে; এর সঙ্গে শুরু হয়ে গেল আমার সর্বব্যাপী জাঁকিয়ে আসা এক ঘামে ভিজে যাওয়া—কপাল, গাল, কানের পেছন দিক, চোখের পাতা, নাকের দুপাশ, গলদেশ, চুল, তলপেট, অণ্ডকোষ, হাতের তালু, বগল, জঙ্ঘা, ঊরু, মলদ্বার, পুরো চামড়া, খসে খাওয়া লেজের গোড়া, আঙুলের ডগা, বুকের ছাতি, দাঁতের মাড়ি এমনকি আলজিবও। 

মনে হলো আমি দৌড়ে চলে যাব হাসপাতালের গেট হয়ে ভেতরে বিল্ডিংয়ের এসির মধ্যে। সে জন্য পেছন ফিরতে যাব, তখনই চোখের কোনা দিয়ে সামনে দূরের আকাশে অস্বাভাবিক এক রঙের ঝলক দেখলাম। তাকালাম সামনে, সোজা হয়ে। যা দেখলাম, তাতে আমার পা গেঁথে গেল মাটিতে, পায়ের নিচের অন্ধকার ফুঁড়ে। দেখলাম সমস্ত বাড়ির ছাদগুলোর একটু ওপরে আঁকাবাঁকা দিগন্তরেখাজুড়ে বলকে বলকে গেজিয়ে উঠেছে এক হলুদবর্ণ আলো। মনে হচ্ছে সমুদ্রের বিশাল ঢেউ হয়ে হলুদ ফ্যাকাশে হলুদ আলো আকাশের ওপর থেকে, দূর থেকে ফেটে পড়ে সামনের দিকে আসছে। আবার মনে হচ্ছে, না, ওরা স্থির, নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘন বৃত্তাকারে কেবল ঘুরছে গোল হয়ে। 

আমি ভয়বিহ্বল তাকিয়ে আছি ওই বর্ণনা-অযোগ্য হলুদ আলোর খেলার দিকে, আর হঠাৎই বুঝলাম এটা ভূমিকামাত্র, যেই না সেই আলোর প্যাঁচানো-ঘোরানো ধোঁয়ার মতো দেখতে মেঘ থেকে দুদ্দাড় করে কাঁধ বাঁকিয়ে সামনে লাফিয়ে লাফিয়ে আসতে লাগল অসংখ্য মহিষ—তাদের পুরো শরীর না, শুধু মুখগুলো দৃশ্যমান করে। আবারও একই রকম—এই মনে হলো মহিষের মুখগুলো ছুটে আসছে গাছের ওপর থেকে, বিদ্যুৎ লাইনের অনেক উঁচু দিয়ে, সব থেকে উঁচু দালানগুলোর ছাদের ওপর দিক ঘেঁষে ছুটে আসছে ওরা ওদের মুখে গেজানো ফেনা, ফেনার রং চুনের মতো, জিংক অক্সাইড, ওদের নাকের ফুটোগুলো আস্ফালনে ভরা আর চোখ লজ্জাহীন বেয়াড়ার গর্বোদ্ধত মদমত্ত মহিষের দল। আবার মনে হলো, না, নড়ছে না ওরা, মহিষগুলো, ওরা বরং ঘুরছে হলুদ আলোর মেঘের মতো করে একই রকম বৃত্তাকারে মুখ সামনে রেখে, হঠাৎ আকাশ থেকে ফুঁড়ে ওরা এগিয়ে আসছে সামনের দিকে, আবার এটুকু সামনে আসবার পরেই ঘুরে পেছনে চলে যাচ্ছে, তখনো মুখ সামনে রেখে ওদের প্রথম অবস্থানে, অর্থাৎ জায়গা থেকে নড়ছে না ওরা, স্রেফ বিরাট হলুদ লংক্লথের বড় জড়াটা বেয়ে ঘুরে চলেছে। গণনার-অযোগ্য সংখ্যক মহিষ, ইউনাইটেড হাসপাতালের সামনের লেক ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে সোজা তাকালে যতটা দিগন্ত দেখা যায়, তার বাম থেকে ডান পুরোটাজুড়ে আকাশে মহিষ আর মহিষ—সংখ্যাতীত, তাল তাল। 

সব কটি মহিষেরই একই রকম শিং নিচের দিকে নামানো, দীর্ঘায়তন মুখ, মোটা মোটা চার পা গাবদা গাবদা, শিং পেছনের দিকে বাঁকানো, পেট বড়, শরীর ছোট, কপাল সমতল, চোখ প্রবল কিন্তু ভাবলেশহীন, শিং নিচে নেমে পেছনে গিয়ে ফের অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে ওপরের দিকে উঠেছে, চোয়াল চওড়া, ঘাড় লম্বা, শিং কপালের সমতলে, আর তাদের চেহারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক তাদের অন্যমনস্কতা—এক আনমনা উদাসীন ভাব, যদিও তাদের ফেনা গেজিয়ে ওঠা মুখের দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট যে ওরা আসলে কমবেশি—তবে সনাতন ও বৈচিত্র্যহীন ভঙ্গিমায় — প্রাণ হন্তারক, ন্যূনতম অর্থে বিনাশক প্রকৃতির। 

আমি ভাবলাম, ঢাকা শহরের আকাশে কী করছে ওরা? একটার মুখ থেকে বোধ হয় কেমন গঁঅঅঅ শব্দ উঠল, ঠিক কোন মহিষটা শব্দ করল, তা বোঝার আমার উপায় নেই কোনো, কিন্তু ওই ডাক আমার চেনা, এশিয়ান ওয়াটার বাফেলোর চিরপরিচিত গড়গড় করে মার্বেলের ওপর দিয়ে গড়িয়ে আসা গ ডাক। কিছুক্ষণ, মাত্র কিছুক্ষণ, তারপরই আকাশ আবার আগের মতো সুস্থির, গরমে কাঁপা, মৌলিক। 

ভুল দেখলাম আমি? আর কেউ কি দেখেছে দিগন্তজোড়া এই অগণন মহিষের রাশি রাশি মুখ, এই টনকে টন মুখের ফেনা, এই এতগুলো ফুলে থাকা নাক এবং এই মাথার দুই পাশের হালকা অর্ধচন্দ্রাকার বঁটির মতো দেখতে অগুনতি শিং? আবার হ্যালুসিনেশন হলো আমার? না। পাণ্ডুবর্ণ দিগন্তজুড়ে তখনো জরদ এক গুঁড়ো ছড়ানো, কোটি কোটি গুঁড়ো। মহিষগুলো চলে গেছে যেন নাটাইয়ের গায়ের ওপর থেকে, কিন্তু ওদের রেখে যাওয়া মত্ত নিশ্বাসে পৃথিবী গুঁড়িয়ে দেওয়ার এক আপাত-অনাকাঙ্ক্ষায় ভরা অবিচল আকাঙ্ক্ষার গুঁড়ো তখনো পুরো মিলিয়ে যায়নি হাওয়া থেকে। 

এ কী ইচ্ছা মহিষগুলোর? যা তারা করতে চায়, ভাবভঙ্গিতে দেখায় তার উল্টোটা? আমার মনে পড়ল সুরভির পাঠানো চৌদ্দটা ই-মেইলের আরও একটার কথা, যেটা আমি ভাবিনি কাউকে জানাব কোনো দিন। ছোট ই-মেইল—চুপ করে পড়েছি, চুপ করে বন্ধ করেছি। যেহেতু ই-মেইলের মূল বিষয় মহিষ, তাই আমাকে মেইলটার সারকথা আমার নিজের ভাষায়, মনে করে করে, বলতেই হচ্ছে এখানে। 

সুরভি লিখেছে এ রকম যে : ‘নাগরকোটে আমরা যেবার বেড়াতে গেলাম ২০১৩-এর মে মাসে, আমার সারা শরীর ব্যথা তোমার রাতভর অত্যাচারে, আমরা সকালে পাহাড় বেয়ে নেমে অনেকক্ষণ গাছপালা ভরা পথে দেখলাম এক দল ইউরোপিয়ান ট্রেকার, তারা মহিষের তাড়া খেয়ে ছুটে আসছে ছত্রভঙ্গ হয়ে ওপরের দিকে, ঢাল বেয়ে, মনে আছে? “মহিষরা তাড়া করে আসছে” কথাটা ওই সাদা লোকগুলোর মুখে শুনে তুমি আমাকে বললে যে তুমি ওই হিমালয়ের নিচের প্রান্তরের বুনো মহিষের দল দেখতে চাও, আর আমি তোমাকে সেই ইচ্ছা থেকে নিরস্ত করলাম নানা কথা বলে বুঝিয়ে, মনে আছে? সেই একই জায়গায় আমি ও আমার দুই বন্ধু গিয়েছিলাম সেদিন, একই হোটেলে ছিলাম আমরা, যেটাতে ছিলাম তুমি ও আমি দুবছর আগে, ঠিক ঠিক করে বললে দুবছর দুমাস আগে। সেই একই হোটেল থেকে সকালে, একই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে, জঙ্গল মাড়িয়ে, কখনো হঠাৎ আমরা সিঁড়ির পর সিঁড়ি বেয়ে, কখনো লাফিয়ে লাফিয়ে একই সমতলে সেদিন নামলাম আমরা তিনজন, তিন বন্ধু। তারপর দেখলাম যেন ভোজবাজি—এক বড় মহিষের দল চুপচাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা খোলা মাঠে, ভ্রুক্ষেপহীন, দল বেঁধে, আবার প্রতিটা মহিষই যে আসলে একা তেমন এক বোধ জাগিয়ে ধীরতার সঙ্গে, শুধু মাঝেমধ্যে মুখে গ-গ শব্দ তুলে কখনো কখনো আমাদের দিকে তাকিয়ে-অন্যমনস্ক ছিল ওরা, চারপাশের বিষয়ে উদাসীন, আর ওদের পালটার মোটামুটি মাঝখানে হঠাৎ আমরা দেখি, আমরা কিছুটা উঁচুতে, সমতল থেকে অল্প উঁচুর এক ঢালে, চুপচাপ সেই ভ্যান্টেজ পয়েন্ট থেকে আমরা দেখলাম একটা চার ফুট উচ্চতার পুরুষ মহিষ, কমপক্ষে এক হাজার কেজি ওজন হবে তার, পুরাণের মহিষাসুর সে, গুরু গোবিন্দ সিংয়ের দশম গ্রন্থের মহিষাসুর সে যাকে দেবী দুর্গা হত্যা করেছিল, সেই দানব মহিষটা আজ আবার জীবিত হয়ে দেখি চড়ে বসেছে এক স্ত্রী মহিষের পিঠে, ওটাও চার ফুটের কাছাকাছি উঁচু, শুধু ওজনে অনেক কম, তাই মহিষাসুরকে কাজটা করতে হচ্ছে প্রায় তার পেছনের দুপায়ের ওপরে দাঁড়িয়েই, সে তীব্র গতিতে নিচের স্ত্রী মহিষটার গায়ে এমন বাড়ি মেরে মেরে চলেছে যে আমাদের মনে হচ্ছিল কোনো একটা কিছু স্ত্রী মহিষটার গায়ে যেন সে খোদাই করে যাচ্ছে এক নির্মম ধারাবাহিকতায়, শব্দ ও গতির ঢেউ তুলে। নিচের নিপীড়িত স্ত্রী মহিষটার চোখ দেখতে পাইনি আমরা, কিন্তু গোঙানি শুনেছি স্পষ্ট, আর ওপরের ওই অসুর মহিষ—এটাই সব থেকে বড় কথা—তার পেশির আড়ষ্ট ভাব থেকেই আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছিল কতটা অনিচ্ছুক সে এই কাজে, কিন্তু এ কাজটা করে যাওয়া ছাড়া তার আর অন্য কোনো গতি নেই সে মুহূর্তে। আমাদের মধ্যেকার একজন—আমার বন্ধু দিপালী—অনেক কাছে চলে যাচ্ছিল ওদের। আমরা বাকি দুজন দিপালীকে থামাইনি, ওকে বিপদের কথা খেয়াল করিয়ে দিইনি, কারণ সম্ভবত আমার মায়া লাগছিল স্ত্রী মহিষটার জন্য নয়, বরং মহিষাসুর পুরুষটার জন্য, এবং মনে হচ্ছিল তোমার কথা যে ক্রূরতা দিয়ে পৃথিবীর নারীদের শাসন করা ব্যতিরেকে তোমাদের পুরুষদেরও অন্য কোনো গতি নেই। মহিষাসুর তুমি, আর তাই তোমাকে বেশি মায়া থেকেই ঘৃণা করি আমি।’ এ রকম। 

এই তাহলে কথা, এই তাহলে ভালোবাসার ভেতরকার সার! এই তাহলে ১৪ আগস্টের শুরুতে দাঁড়িয়ে আমার নিজেকে তৈরি করে নেওয়া পরের সন্ধ্যার জন্য, মাত্র আঠারো-বিশ ঘণ্টা পর যখন টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের কামানবাহী যানগুলো, ১০৫ এমএম কামান টেনে নিয়ে চলা শকটগুলো এবং বেঙ্গল ল্যান্সারের টি-৫৪ ট্যাংকগুলো অজগর সাপের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে যাবে ঢাকা এয়ারপোর্টের বিরান মাঠে একসঙ্গে মিলতে—১৮টা কামান ও ২৮টা ট্যাংক। তাহলে কি একটা ঘৃণার কথা আমাকে বলবার জন্যই সুরভির নাগরকোটের অরণ্যঘেরা মাঠের এতগুলো মহিষের কথা বলা? একটা পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য ৪৬টা সামরিক যানের এত বড় প্রস্তুতি? মাত্র একজন ক্যানসার রোগীর মৃত্যুর পূর্বাভাস জানানোর জন্য দিগন্তজুড়ে এতগুলো মহিষের মুখের গেজা ফেনিয়ে আসা? 

আমি পৌঁছে গেলাম মাসুম হায়াতদের বাসায়, সিএনজির ভাড়া মিটালাম, অন্ধকার রাস্তার পাশে পড়ে থাকা আমার গাড়ির দরজা চাবি দিয়ে খুলে অন্ধকার গাড়ির ভেতরে ঢুকে প্রথমে আলো জ্বালিয়ে, ঘাড় পেছনে ঘুরিয়ে দেখে নিলাম গাড়ির আঁধারের মধ্যে চুপচাপ আমার জন্য কোনো হত্যাকারী অপেক্ষা করে বসে আছে কি না। 

না, কেউ নেই। গাড়িতে আমি একা, নিরাপদ। আমার সঙ্গে আছে শুধু কিছু ভাবনা। তার প্রথমটা এমন যে মাসুম হায়াত নামের মধ্যে আমি মৃত্যুময়তা টের পাচ্ছি। মাসুম হায়াত—এমন কোনো ঘোর লাগানো নাম নয়, যেমন মেহেরনাজ, যেমন অ্যাপোলো হাসপাতালের নার্স লুবনা জাহান, যেমন সোসাইটির চেয়ারম্যানের নাম সরফরাজ। ক্রমানুসারে বললে এ তিনটে নামের মধ্যে আমি এ মুহূর্তে—এগুলো মুহূর্তের বোধই মাত্র, যা আবার সামগ্রিক পরিবেশের ওপরে নির্ভরশীল—এই অর্থগুলো হাজির দেখলাম : মেহেরনাজ—বিট লবণ, টকটক, সিরকার মতো এক অম্লতা; লুবনা জাহান -ছাত্রীনিবাসের পেছন দুয়ার; সরফরাজ—ইলেকট্রনিক এক বাদ্যযন্ত্র, সিনথেসাইজার। আর মাসুম হায়াত? সে হিসেবে এই নামের কোনো পূর্বভাগ নেই, কোনো উত্তরভাগ নেই, সে এক পুরোনো যুগের টাইপরাইটারে লেখা পাঠ্যপুস্তক, শাঁসহীন। 

নিজেই অবাক হলাম দেখে যে এসব কী ভাবছি আমি এই নিঃসঙ্গ মানুষটাকে নিয়ে, যার এ মুহূর্তের একার লড়াইতে সঙ্গে পরিবার বা বন্ধুবান্ধব কেউ পাশে নেই— এ বিশ্বসংসারের একটা মানুষ, একটা ঘাস, একটা পাখি কিংবা একটামাত্র সংগীতের সুর কিছুই তার চারধারের কোথায়ও নেই। তার হায়াত শেষ, সে মাসুম বাচ্চার মতো এ মুহূর্তে সময়ের গর্ভ থেকে হোঁচট খেয়ে বাইরে পড়বার জন্য তৈরি। তার নামের ভেতরকার এই সাদাকালো, এই টানটান, এই রসজ্ঞানহীন মৃত্যুময়তা আমার ভাবনাকে আগাপাছতলা দখল করে নিল। আমি শিরদাঁড়া খাড়া করে গাড়ি চালাতে লাগলাম এমনভাবে যেন আমি একটা ব্যাগপাইপ ধরনের বাদ্যযন্ত্র, কিংবা সাধারণ এক ভায়োলিন, যার টিউনিং পেগগুলোকে শেষ ঘাট পর্যন্ত মোচড়ানো হয়েছে এবং নিচের দিকে টিউনিং অ্যাডজাসটরগুলোও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এমন প্যাচক্ষা এক জায়গায় আনা হয়েছে যে চারটে তারের সব কটাই ফিঙ্গারবোর্ডের ওপরে ব্লাস্ট ফারনেসের টেনশন নিয়ে টানটান আছে শুধু ফেটে-ছিঁড়ে-পুড়ে-কেটে পড়বার জন্যই। 

আমি নীরব-নিশ্চুপ গাড়ির ভেতরে ‘ওহ্ গড, ওহ গড’ বলে উঠলাম এবং তারপরই জন্ম, প্রজনন ও বিনাশ—এই সাধারণ ও সরল ধারাবাহিকতাকে মাথায় রেখে জীবনকে আদৌ সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু আছে কি না, তা ভেবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম, এককথায় হারিয়ে ফেললাম আমার চিন্তার সুতো। ‘জীবন’ সময় কাটিয়ে যাওয়ারই এক নাম, সাধারণ ও সরল এক সত্যকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অসাধারণ করে তোলার এক প্রকল্প-মাসুম হায়াত নামের মধ্যে এখন মৃত্যুর যে আবহ, সেটুকু ভেবে (সেটুকুই শুধু ভাবনার মধ্যে ধরতে পারলাম আমি) এ কথাটাই কেবল সত্য বলে মনে হতে লাগল আমার। এই জীবনের বিষয়ে আমাদের বিরাট সংবেদনশীলতা এবং জীবনের শেষের অন্ধকারকে নিয়ে কোনো সংবেদন ও বোধ না থাকা—কীভাবে সম্ভব এ রকম বৈপরীত্য মেনে নিয়ে আবার হাসা, খাওয়া, প্রেমে পড়া, গল্প বলা, গান শোনা, ঘুমানো, গাড়ি চালানো? অবলীলায় আমি, অবশ্যই না বুঝে, আমার গাড়ি ঢুকিয়ে দিলাম উল্টো দিকের রাস্তায়। 

আমার দিকে আসতে থাকা একটা ট্রাক, বিশ্বরোডে বসুন্ধরার দিক থেকে রামপুরার দিকে যেতে থাকা একটা দ্রুতগামী ট্রাক, আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার গাড়ির সামান্য কয়েক গজ সামনে জোরে ব্রেক কষল, আমিও ব্রেক কষলাম হঠাৎ যেন জেগে ওঠে। ট্রাক ড্রাইভার একরকম দৌড়ে নেমে এলেন তাঁর ট্রাক থেকে, সঙ্গে হেলপার ছেলেটাও। তাঁরা দুজনে আমাকে অনেক কিছু বলতে লাগলেন, কিন্তু আমি দেখলাম তাঁদের কথাগুলো আমার কানে এসেও যেন ঠিকমতো ঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারছে না। এবার ট্রাক ড্রাইভার ঝাঁপিয়ে পড়লেন আমার গাড়ির জানালার ওপরে, তিনি রীতিমতো গালি দিতে লাগলেন আমাকে ‘পাগল নিকি, পাগল নিকি’ বলে। মোটামুটি একটা জ্যাম বেধে গেল আমার গাড়ি ঘিরে। আমার মনে হলো আমি এক জঙ্গলের ভেতরে আটকা পড়ে গেছি, এবং এই ট্রাক ড্রাইভার ও অন্যেরা বুঝতেই পারছেন না যে তাঁরা সেই জঙ্গল শাসন করে বেড়ানো কিছু গরিলা। তাঁরা গরিলা, আর আমি? যৌক্তিক কোনো কারণহীন ও যুক্তিহীন একটা প্রাণী। 

তখনো আমি গাড়ির ভেতরে বসে। পাঁচ-দশজন গরিলা এসে এসে উঁকি দিয়ে গেলেন, দেখে নিলেন যে এই গাড়ি ও তার ঠিক মুখোমুখি দাঁড়ানো এক বীভৎসদর্শন ট্রাকের মধ্যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি, ছোট গাড়ির ভেতরের আমি বেঁচে আছি। বেশ কিছু পথ ব্যাক গিয়ার দিয়ে দিয়ে চলতে শুরু করলাম এবার। আমার সামনে ওই একই ট্রাক, তার চালকের আসনে বসে মাথা বাইরে বের করে চালক লোকটা তখনো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করেই যাচ্ছেন, এবং আমি তখনো ভেবে চলেছি যে, মুক্তি বা নির্বাণের, পরিত্রাণ বা উদ্ধারের কোনো পথই আমাদের জন্য খোলা নেই—জীবন একটা ট্র্যাজেডি কিংবা বেশি হলে এক নির্মম কমেডি, যার শেষ অঙ্কে আছে আবার ট্র্যাজেডি। মৃত্যুর জীবন আগের এক দুরবস্থা। 

আমি দুই রাস্তার মাঝখানের এক ছোট কাটা অংশ দিয়ে গাড়ি নিয়ে আমার জন্য নির্ধারিত রাস্তায় উঠলাম এবার। ফোন হাতে নিলাম নূরকে বা মাসুমের স্ত্রী ফারজানাকে কল দেব বলে। ‘মাসুম কি এখনো বেঁচে আছে?’ এটা জিজ্ঞেস করব তার স্ত্রীকে, যে কিনা আজ আশ্চর্যজনকভাবে হিজাবের আড়ালে মুখ ঢেকে আমার সঙ্গে কোনো কথাও বলেনি? জীবনে কত শতবার কত গল্প হয়েছে ফারজানার সঙ্গে, তাদের বাসায়, আমার বাসায়, বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সের সিনেমা হলে, কত লাঞ্চ ও ডিনারে তিন বা পাঁচ বন্ধ মিলে, যেখানে কেবল আমারই সঙ্গে কোনো বিয়ে করা বউ নেই, তাই কতবার বন্ধুদের ও তাদের স্ত্রীদের হাসিঠাট্টা ও কৌতূহলের পাত্র থেকে গেছি আমি কতভাবে সেসব আড্ডায়। কেন একবারও আজ আমার সঙ্গে কথা বলেনি ফারজানা? আমি পরপুরুষ, তাই? মাসুমের ক্যানসার ধরা পড়বার পর তার জীবনের এই ধার্মিক ও হিজাবপরা বাঁক আমাকে হঠাৎ স্রেফ এক পরপুরুষ বানিয়ে দিয়েছে তার কাছে? আর কেন আমি কথা বলিনি তার সঙ্গে? তার স্বামী মারা যাচ্ছে এবং বিধবা হতে যাওয়া কোনো স্ত্রীকে আসলে বলবার মতো কোনো কথা আমার নেই, তাই? ফোন রেখে দিলাম, আবার হাতে নিলাম, আবার রেখে দিলাম। 

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ঢুকতে দেখলাম মোড়ের ওখানে এখনো অনেক দোকানপাট খোলা, এখনো রাত একটায় বিক্রি হচ্ছে স্টোভের কাঁচা আগুনে বানানো চা, যা কিনা খাওয়ার নিয়ম শক্ত টোস্ট বিস্কুট ভিজিয়ে। দেখলাম ওষুধের দোকানগুলোতে ভিড়, মানুষ হয় খুঁজছে কোনো গ্যাসের ওষুধ, জ্বরের প্যারাসিটামল বা এখনকার সর্বরোগহর অ্যাজিথ্রোমাইসিন, না হয় জরুরি প্রয়োজনের কনডম। দেখলাম সবজিওয়ালারা গোছাচ্ছে তাদের ঝুড়ি, গুনে গুনে রাখছে বিক্রি না হওয়া শাকের আঁটি ও মানকচু, পেঁয়াজের সবুজ লম্বা কলি ও বরবটির ডাঁটা। আমি আসলে গাড়ির ভেতর থেকে, রাস্তার এ পাশ থেকে ও পাশের আলো-আঁধারির দিকে তাকিয়ে আদৌ জানি না ওগুলো বরবটি কি না, শজনে ডাঁটা কি না কিংবা বেঢপ চেহারার কচুই-বা কি না। 

ও পাশের বাজার ঘিরে মানুষের পাতলা হতে থাকা ভিড় ও কাদা এড়িয়ে লাফিয়ে চলা আরও কিছু লোকের হো-হো করতে করতে কোনো একটা দিকে কোনো একটা উদ্দেশ্যে ছুটে যাওয়া এবং দল বেঁধে তিনটে কুকুরের গোল হয়ে, চুড়ির আকার নিয়ে, চলতে চলতে করা আলাপসালাপ—এসব দেখে দেখে এগোচ্ছি আমি বাড়ির দিকে, অতি ধীরে, ঘণ্টায় দশ কিলোমিটারের নিচের গতিতে। এই হো-হো চিৎকার, মানকচু বিক্রি, শোল মাছগুলো অ্যালুমিনিয়ামের কলসিতে ভরে নিয়ে বড় মাছ বেচার থালা এই ছপাৎ ছপাৎ ধোয়া, এই বেকারির দোকান, যেখানে পাউরুটির সাপ্লাই শেষ, কারণ সবাই কয় ঘণ্টা পরের, শুক্রবার ছুটির দিন সকালের নাশতার জন্য এরই মধ্যে কিনে নিয়ে গেছে সব পাউরুটি, এই এক জোড়া তরুণ-তরুণী, যারা জড়সড় ওষুধের দোকানে বিব্রত দাঁড়িয়ে আছে কনডম কিনবার লজ্জা থেকে শেষমেশ ব্রাইলক্রিমের দাম জিজ্ঞাসা করে, এই দিন শেষে কলা বিক্রেতার টাকা গোনা ও খুচরা পয়সাগুলো অন্য কৌটায় রেখে তার কলা, আমলকী, পানিফল বেচার নড়বড়ে তক্তার ফ্রেমটা ভাঁজ করা এবং তারপর ফলের গাড়িটা ঠেলতে থাকা, আর রাস্তার এদিক থেকে ওদিকে হেঁটে যাওয়া এই গাট্টাগোট্টা বিশেষ চেহারার এক লোকের বিশেষ ভাবনার মুখটা দেখে আমার আইয়ারের চেহারা মনে পড়ে যাওয়া, আর এই সর্বোদয় ভান্ডার, এই হারুন সাইকেল স্টোর, থ্রি-স্টার কোচিং সেন্টার, এই ফ্রেশ অ্যান্ড নাইস পিৎজা হাট, যেখানে কাজ করে আমার পরিচিত আসলাম নামের এক ছেলে—এসবের দিকে ধীরে চলা গাড়ি থেকে তাকিয়ে, এটিএম মেশিনগুলোর জ্বলন্ত সাইনবোর্ডের অত্যাচার চোখে সহ্য করে নিয়ে, আমার মনে হলো, আসলেই জীবনকে দেখা অনেক কঠিন এক কাজ, বন্ধুর মৃত্যুর পর তার কবর দেখার চাইতেও কঠিন। 

রাত একটার পৃথিবীরও এত ব্যস্ততা দেখে আমার স্পষ্ট মনে হলো, পৃথিবী এমন এক আয়োজনে সাজানো যে আমাদের পক্ষে একটু সময় নিয়ে এমনটা ভেবে যাওয়া সত্যি কঠিন যে পৃথিবীতে মানুষের জীবন এক কসমিক গন্ডগোল, এ জীবনের মৌলিক কাজ স্রেফ নিজের জিনটুকু পরবর্তী বংশধরদের জন্য রেখে নিজে বিলুপ্ত হওয়া। হঠাৎ দেখলাম তিন আফ্রিকান যুবক, দুজন খুব বড় সাইজের গেঞ্জি পরা ও একজন হাফ-প্যান্ট পরে খালি গায়ে গেঞ্জি কোমরে পেঁচিয়ে হেঁটে যাচ্ছে চারমাথার দিকে। এরা সবাই, দু-চারটে ব্যতিক্রম ছাড়া, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন—এসব দেশ থেকে আসা ফুটবলার, খেলে ঢাকার নানা ক্লাবে, ফুটবল লিগে এবং থাকে বসুন্ধরায়। ভালো। 

আমার নিজের গাড়িও চারমাথার কাছাকাছি পৌঁছেছে, আমি বাঁয়ে মোড় নেব আমার বাসার দিকে, চারমাথা থেকে ডানে অ্যাপোলো হাসপাতাল, ঠিক ওই মোড় ঘুরবার জায়গাটাতে দেখলাম উদভ্রান্ত চেহারার তিন মানুষ-এক বয়স্ক দিনমজুর চেহারার লোক, তার পরনে কিছুটা জীর্ণ রং ওঠা জামা-প্যান্ট, সম্ভবত কোনো বাড়ির ড্রাইভার হবে, সঙ্গে এক মহিলা, চেহারা উদ্বেগে মলিন, মেটেরং মুখ কিন্তু তার ভেতরেই মাতৃসুলভ কমনীয়তার আভা, আর একটা বারো-তেরো বছরের বাচ্চা ছেলে। রাত একটায়? এ রকম তিন বা চারের দল দিনের বেলায় আজকাল খুব দেখা যায় শপিং মল, অফিস বিল্ডিং, হাসপাতাল কিংবা রেলস্টেশনের বাইরে, এরা নিজেরাই লজ্জা-সংকোচের এক ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে কাছে, বলে যে এদের বাড়ি ভোলা কিংবা দিনাজপুরে, জামালপুর কিংবা কুমিল্লায়, কোনো একটা দুর্ঘটনায় সব হারিয়ে ঢাকায় এসে তারা আবারও সব হারিয়েছে, এখন বাড়ি ফিরে যাওয়ার টিকিটের টাকা দরকার কিংবা সঙ্গের একজন ভয়ানক অসুস্থ, টাকা দরকার তাকে হাসপাতালে নিয়ে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু তাই বলে রাত একটায়? 

আমি নিরাপত্তার ভয় থেকে গাড়ি থামালাম না, আস্তে বাঁক নিলাম, তখনো চোখের কোনা থেকে দেখছি এ তিনজনের গতিবিধি। চোখে পড়ল বয়স্ক লোকটার এক হাত আমার গাড়ির দিকে উঠল অনেক কুণ্ঠাভরে, সামান্য উঁচুতে, তারপরই নেমে গেল তা। আমি বুঝলাম, আমাকে গাড়ি থামাতে বলেছেন তিনি এবং সেটা বলতে অসম্ভব দ্বিধা করছেন। এ রকম কারও কাছ থেকে নিরাপত্তার ভয় নেই বলে মনে হলো এবং সেই সঙ্গে একটা কান্নারও সরু আওয়াজ শুনলাম যেন। গাড়ি থামালাম বাঁকের ওপরে, তিনজনই এগিয়ে এল আমার কাছে। গাড়ি থেকে নামলাম আমি, রাস্তার অন্য পাশে ওই তিন আফ্রিকান ফুটবলার চারমাথায় এসে পৌঁছেছে, ওরা কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের চারজনের দলটার দিকে। 

বয়স্ক ভদ্রলোক, নাম কাউছার, দেখা গেল ছেলেটার নাম মজনু—পিতা এবং সঙ্গের মহিলা তার স্ত্রী, যা আমি ভেবেছিলাম। মজনুর মুখ হাঁ হয়ে আছে অস্বাভাবিক রকমের, লাইটপোস্টের ক্ষীণ আলো সেই মুখের ভেতরে পড়তে দেখা যাচ্ছে তার দাঁতগুলোর ফাঁকে ফাঁকে তাজা রক্ত, না, স্রেফ রক্তের দাগ দাগ। কাউছার বললেন, তাঁরা থাকেন নদ্দায়, অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে বাঁ দিকে গেলে যে নিম্নমধ্যবিত্ত ও গরিবের এলাকা, তারই একটার কোথায়ও আর তাঁর ছেলে মজনু ওপর-নিচ দুই দাঁতের ফাঁকে বড় পিন ধরে রাখার আজগুবি খেলা খেলতে গিয়ে হঠাৎ দেখে পিন তার দাঁত থেকে তীব্র বেগে ছুটে গলার গভীরে কোথায় যেন গেঁথে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা দৌড়ে গেছেন কাছের অ্যাপোলো হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে। ডিউটি ডাক্তার টর্চ ফেলে দেখেছেন কয়েক সেকেন্ড, বলেছেন এই পিন বের করার সুবিধা অ্যাপোলোতে নেই, তাঁরা যেন দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে চলে যান, আর ডাক্তারের কথার মধ্যেই হাসপাতাল সিকিউরিটির দু-তিনজন লোক এসে তাঁদের রীতিমতো ‘তাড়াতাড়ি যান, তাড়াতাড়ি যান’, বলতে বলতে হাসপাতাল থেকে বের করে দিয়েছে, তারপর তাঁরা হাসপাতালের গেটে এসেছেন একটু আগে, একটা সিএনজি বা ও রকম কিছু পাননি গেটের ওখানে, সামনে পাবেন এই আশায় হাঁটতে হাঁটতে এই চার মাথায় এসে এখন ভাবছেন হাসপাতালের গেটেই ফিরে যাবেন কি না, আসলে অপেক্ষা করছেন একটা খালি রিকশার জন্য, যেটা পেলে তাঁরা বসুন্ধরায় ঢোকার গেটে গিয়ে সিএনজি নিতে চান। “স্যার, আমি শিক্ষিত লোক, পুরান ঢাকায় একটা বেকারিতে প্রোডাকশনে কাজ করি, দ্যাখেন মজনুর গলা দিয়া কেমন রক্ত বাইর হচ্ছে, আমার ছেলেটারে বাঁচান, স্যার’, বললেন কাউছার। 

আমি তাঁদের গাড়িতে উঠতে বললাম, মজনুর মা এখন কাঁদছেন, মজনু মুখ হাঁ করেই আছে, তার ঠোঁটের দুই কোনায় এখন রক্তের দুটো বড় ফোঁটা মুখ থেকে রাস্তার মাটিতে টপটপ পড়ার অপেক্ষায়। তাঁরা গাড়িতে উঠলেন। আমি বললাম যে তাঁদের সামনের মোড়ে দিয়ে আসব, সেখানে—যেমনটা তাঁরা ভেবেছেন—অটোরিকশা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। 

গাড়ি চলছে। আমি কথা বলছি কাউছারের সঙ্গে। পেছনের সিটে বসে আছে মা ও ছেলে। কাউছার একটা কথাই বলে যাচ্ছেন যে অ্যাপোলো হাসপাতালের মালিকদের মাথার ওপরে ‘ঠাডা’ পড়বে। তিনি একমনে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছেন ওই মালিকদের, ওই ভদ্রবেশী চেহারার ডিউটি ডাক্তারকে (আমি ভাবছি, সে কি ইমার্জেন্সির ওই একই ডাক্তার, যাঁর ওপরে আমি চিৎকারে ফেটে পড়েছিলাম মাত্র কয়েক রাত আগে, মোটামুটি এ রকম এক সময়েই?), আর বলে যাচ্ছেন অ্যাপোলোর সিকিউরিটির গরিব লোকগুলোও বড়লোকের হাসপাতালে চাকরি করতে করতে, অসুখ সংক্রমণ হওয়ার মতো, কী রকম বেরহম হয়ে গেছে, সে কথা। অন্যদিকে আমি একতরফা বলে যাচ্ছি মজনুকে, ‘কী রকম ছেলে তুমি, বাবা? এ আবার কী রকম খেলা?’ মুখের ভেতর পিন নিয়ে, দুই দাতে পিন আটকে ধরার টানটান টেনশন-এ আবার কী অভ্যাস? 

বসুন্ধরার মোড়ে এসে দেখি কোনো সিএনজি-রিকশা নেই, একটাও না। আমার বাঁয়ে ডানে সোজা শুয়ে আছে বিরাট বিশ্বরোড, তাতে শাঁ শাঁ ধেয়ে যাচ্ছে ট্রাক আর আবছায়ার মধ্যে পড়ে থাকা দুপাশের বড় রাস্তাকে দেখতে লাগছে পানাসক্ত। রাস্তার দোষ নেই যে তার মোড়ে এত রাতে জরুরি অবস্থায় পড়া কাউকে হাসপাতালে নেওয়ার মতো বাহন থাকবে না, তারপরও আমি ওই বিবেকদংশনহীন রাস্তাকেই গালি দিতে লাগলাম মনে মনে। একটা অটোরিকশাও নেই দেখে ভয়ে এই প্রথম কেঁদে উঠল মজনু। আমি তাকে বললাম তার মুখ বন্ধ রাখতে। গলায় পিন গেঁথে আছে তো মুখ কেন খোলা থাকবে, ভাবলাম আমি। মজনু মুখ হাঁ করেই থাকল, শব্দ করে কাঁদছে সে, আমি পেছন ফিরে তার দিকে শাসনের চোখে তাকানোর পরেও। 

এই প্রথম কথা বললেন ওর মা—একগাদা কথা, বৃথা রাগে ভরা ও বাষ্পরুদ্ধস্বরে কী বললেন মহিলা, তা ধরতে পারলাম না আমি, এতই জড়ানো তার কথা, চিন্তা-কষ্ট-অভিশাপ-দোয়া—সব মিলিয়ে এমনই দুর্বোধ্য। আমার মনে হলো, স্রেফ এমনিই মনে হলো, তিনি লাটভিয়া বা লিথুয়ানিয়ার ভাষায় আমাকে বললেন, মজনুর জোর ভয়ার্ত কান্না ছাপিয়ে তিনি আমাকে এস্তোনিয়ার তালিন শহরের লোকাল ডায়ালেক্টে বললেন : আপনি নিজে একটু আমাদের ঢাকা মেডিকেলে দিয়ে আসতে পারেন না? এভাবে অটোরিকশার জন্য এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করছেন? মেডিকেলে যেতে-আসতে আপনার গাড়ির তেল কতটা খরচ হবে, তা লিটারের দাম মেপে হিসাবই করে যাচ্ছেন? আর এদিকে আমার ছেলেটার গলায় বড়শি হয়ে বিপজ্জনক গেঁথে আছে এক বড় স্টিলরং পিন? আর এত বড় অ্যাপোলো হাসপাতালে সেই পিন তোলার একটা লম্বা চিমটা-সাঁড়াশি কিছুই নেই? এই পিন তুলতে তাদের কি ওর গলা কাটতে হতো যে তারা গলাকাটার অপারেশনের টাকা আমরা দিতে পারব কি না, সেই ভয়ে আমাদের তাড়িয়ে দিল? তারা হিসাব করল অপারেশনের বিলের আর আপনি হিসাব করছেন গাড়ির তেলের? 

আমি মজনুর মাকে মোটামুটি জোর গলায় কিন্তু স্পষ্ট স্নেহ ও ভালোবাসার স্বরে বললাম, “আপনি চুপ করেন। মজনুকে থামান। আমি আপনাদের ঢাকা মেডিকেলে দিয়ে আসছি।’ কাউছার আমার হাতের ওপরে তাঁর হাত রাখলেন। আমি তাঁকে কাউছার সাহেব না বলে স্রেফ কাউছার নামে ডেকে বললাম : ‘কাউছার, শক্ত হয়ে বসেন, গাড়ি জোরে চালাব।’

অন্ধকার রাস্তা ধরে শাঁ শাঁ করে আমার গাড়ি ছুটছে, মজনু কাঁদছে, তার নিজের ও তার মায়ের হাত নিশ্চয় এতক্ষণে বেশ কিছুটা ভরে গেছে রক্তে, ভালো যে আমাকে পেছন ফিরে সে দৃশ্য দেখতে হচ্ছে না। কাউছারের চোখে পরনির্ভরতার অন্তর্মানি স্পষ্ট। আমি যে আমার চেয়ে পরিষ্কার বয়সে বড় তাঁকে হঠাৎ স্রেফ নাম ধরে ডেকেছি, তাঁর নামের শেষে ভাই বা সাহেব কোনো সম্বোধন লাগাইনি, তা-ও আবার আর্থিক কারণে তাঁর অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে প্রত্যাখ্যাত হবার একই রাতের একই ঘণ্টার ভেতরে-সেটা তাঁর কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছে এ সমাজে, এ পৃথিবীতে তার অবস্থান, হ্যাকস ব্লেড দিয়ে কেটে তাঁকে দেখিয়ে দিয়েছে যে দেখতে সমতল জমিনের ভেতরটা আসলে কেমন খাঁজকাটা, করোগেটেড। 

আইয়ারের কথা মনে পড়ল আমার। মনে পড়ল কীভাবে আইয়ার প্রসঙ্গে আমি মিথ্যা বলেছি মাসুম হায়াত ও নূর হোসেনকে, এমনকি মেহেরনাজকেও, এবং কীভাবে সেই মিথ্যা নিজের কাছেই চেপে গেছি এ পর্যন্ত। মাসুম ও নূরকে আমি সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসুমের রুমে আইয়ার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে, আমার ভেতরকার অপরাধবোধের দহন থেকেই, একগাদা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেছিলাম পাম বিচ রোডের পাশের খাঁড়িতে মানুষ মেরে ফেলে রাখার গল্পের শেষে। আমি বলেছিলাম, ট্যাক্সি ড্রাইভার আইয়ার কত কষ্টে তাঁর জীবন নির্বাহ করেন, আর সারা দিনের ডিউটি শেষে যখন তিনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিলেন, আমি তাঁকে বকশিশ দেওয়ার কথা ভুলে গেছি বলে সে প্রসঙ্গ তুললেন ঠিক বিদায়ের পূর্বমুহূর্তে, তখন আমি কীভাবে আবেগে আপ্লুত হয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে এক হাজার রুপি বকশিশ দিয়েছি, আর মূল ভাড়ার প্রায় অর্ধেক টাকা বকশিশ পেয়ে কীভাবে আইয়ার কৃতজ্ঞতা থেকে কেঁদে ফেলেছিলেন। কথাটা বলার সময়েই বুঝেছিলাম, এটা শুনতে কত অবাক লাগছিল আমার এই দুই বন্ধুর কাছে। তারা নিশ্চয়ই ভাবছিল, পুনে যাওয়ার গল্প প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে হুপু পাখি দেখা কিংবা মুম্বাইয়ের পাম বিচ রোড নামের মৃত্যুপুরীর পাশ দিয়ে রাতের অন্ধকারে গাড়ি করে যাওয়া, এসব গল্প গল্প হিসেবে ঠিকই খাটে, ট্যাক্সি ড্রাইভার ভদ্রলোক যে এ রকম মর্মান্তিক দুর্দশার মধ্যে তাঁর জীবন কাটাচ্ছেন সে কথাও প্রাসঙ্গিক শোনায়, কিন্তু তাই বলে তাঁকে বকশিশ দেওয়ার গল্প কেন আলাদা করে বলতে হবে কাউকে? কেউ কি এত মামুলি বিষয় নিয়ে আবার পরে বন্ধুদের কাছে গল্প করে নাকি? 

একই কাজ আমি ফের করেছিলাম অ্যাপোলো হাসপাতালের কেবিনে, মাসুমদের ওই মিথ্যা কথা বলার পরদিনই সম্ভবত, যখন মেহেরনাজ আমাকে দেখতে এসেছিল আর আমি তাকে বলেছিলাম যে মনে হয় এ বছরের শেষ দিকে আমি আবার মুম্বাই যাব স্রেফ আইয়ারের সঙ্গে দেখা করতে। মেহেরনাজ আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কে এই আইয়ার? ভারতে কী এমন হয়েছিল আমার এই আইয়ারের সঙ্গে? আমি তখন মেহেরকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে প্রায় এক ঘোরের মধ্যে বলেছিলাম, আইয়ার আমার মুম্বাই-পুনে-মুম্বাইয়ের ট্যাক্সি ড্রাইভার, যাকে প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা জার্নি করতে হয় স্রেফ কাজে যোগ দিতে ও কাজ শেষে রাত দুটোয় বাড়ি ফিরতে, এবং যে কিনা আজ দীর্ঘ বছর ধরে কোনো ছুটিছাটা ছাড়াই প্রতিদিন শুধু দুই ঘণ্টা ঘুমিয়ে জীবন কাটাচ্ছে রোবটের মতো, স্রেফ বেঁচে থাকার জন্য। মেহেরনাজ তখন বুঝেছিল, আইয়ারের দারিদ্র্য আমার ভেতরকার মানবিক জায়গাটুকুকে অনেক নাড়া দিয়েছে এবং আইয়ার বিষয়টার কোনো না কোনো অবদান আছে আমাকে ম্যাসিভ ডিপ্রেশন থেকে ঘাড়-বুকের ব্যথা বাঁধিয়ে হাসপাতালে পাঠানোর পেছনে। সে তখন আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে কাছে চলে এসেছিল আমার, হাত রেখেছিল আমার কপালে-গালে, মাথা রেখেছিল আমার বুকে আর তখন মমত্ববোধের দোলপূর্ণিমার আভা খেলে যাচ্ছিল তার সারা মুখে, একধরনের অনুরাগ থেকে, তার কাছের মানুষটার মধ্যে গরিব মানুষের জন্য হিতৈষণা লক্ষ করে। ঠিক ও রকম এক মুহূর্তে আমি, আবারও বুকের ভেতরকার রক্তবর্ণ অপরাধবোধ থেকে, মেহেরনাজকে বললাম আইয়ারকে দুই হাজার রুপি বকশিশ দেবার কথা—মাসুম ও নূরকে যে অঙ্ক বলেছি, তা দ্বিগুণ করে—এবং সেই বকশিশ পেয়ে কীভাবে আইয়ার জামার কলারের আড়ালে তাঁর কান্না লুকাচ্ছিলেন সে গল্প। মিথ্যা গল্প। 

না, কাউছার বা তার ছেলে মজনুকে কোনো মিথ্যা গল্পের শিকার বানানোর দরকার নেই আমার। আমার মন যা চায়, যেটুকু চায়, সেটুকুই করব আমি আজ রাতে। তাদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গেটেই নামিয়ে দেব, সেখানে গাড়ি পার্ক করে ভেতরে দেখতে যাব না যে এই হাসপাতালের কোথায় কীভাবে মজনুর গলা থেকে বেঁধে থাকা ভয়ংকর পিনটা তুলবেন কোনো ডাক্তার। দরকার নেই আমার তা দেখার। এদের আমি যে এই ইমার্জেন্সি সিচুয়েশনে অত দূর ঢাকা মেডিকেল পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে দিয়ে আসছি, তা-ও এত রাতে, সেটাই অনেক বেশি, অন্তত এই পৃথিবীতে যেখানে মায়ামমতা ও ক্রুরতার মাঝখানের দাগ অনেক অস্বচ্ছ। 

গাড়ি প্রায় শাহবাগ মোড়ের কাছে এসে গেছে। কাউছারকে নাম ধরে ডাকার পর থেকে তাঁর মুখে আর কোনো কথা নেই। তাঁর স্ত্রী, আমার অনুমান, যে ধরেই উঠতে পারছেন না কেন একটা হাসপাতাল তাঁর ছেলের গলায় বেঁধে থাকা পিন সামান্য একটু তুলে দেবার কাজটুকু করতে অসম্মতি জানাল। তিনি রণশিঙার ডাক শুনলেন যেন, কেয়ামত এসে যাবার রণশিঙা এবং ওই গগনপ্লাবী ডাকের আওয়াজে এখনো তিনি পাথর হয়ে আছেন। আর তাঁর ছোট্ট ছেলে মজনু সম্ভবত কাউকে বুঝতে না দিয়ে পৃথিবীতে বড় হয়ে উঠল আজ, তার মনের কোনো গোপনকুঠরিতে আজ থেকে জমা হওয়া শুরু হলো বিদ্রোহ ও অরাজকতাকে বৈধ ও যথার্থ বলে ভাবার চার আনা। গুড, মজনু, গুড। আমি চাই তুমি এভাবে বড় হয়ে ওঠো, এভাবেই বোঝো যে ক্ষমতা যার, তার করা অবিচার তার নিজের কাছে বড় কিছু নয়, আর এটা এ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্যগুলোরই একটা। যে ক্ষমতাশালী তার কাছে ক্ষমতাহীনের সাপেক্ষে তার উচ্চতর অবস্থান এতটাই উঁচুতে যে ক্ষমতাহীনের প্রতি তার করা অবিচারগুলো তাকে একদমই বিচলিত করে না। সে ঠান্ডা মাথায়, শীতল এক ভঙ্গিমায়, বিবেককে সংহত রেখেই মন ভরে প্রত্যক্ষ করে যেতে পারে নিজের করা অবিচারগুলো। আমরা মশা-মাছি মেরে বিবেকের যেটুকু দংশন অনুভব করি, তার অনুভূতিও ওই স্তরেরই এক অনুভূতি মাত্র, তার থেকে বেশি কিছু না। আমরা ভাবি, এই ধনী ও প্রতাপশালী লোকটা আমার ওপরে কত বড় অবিচার করল, কিন্তু সে ভাবে—যেহেতু সে নির্ধন ও প্রতাপহীন আমার জায়গায় নিজেকে বসাতে পারে না—এটা করা তার অধিকারের মধ্যেই পড়ে, আর বইপুস্তক-আইনি দলিল-দস্তাবেজে অধিকার প্রসঙ্গে তো সে কথাই লেখা আছে দরাজ ভাষায়। এ দুপক্ষেরই একের বিষয়ে অন্যের বোঝাপড়াটা ভুল, সেই ভুল বোঝাপড়া থেকেই গরিব মানুষেরা, ইতিহাসজুড়ে, ক্ষোভ দেখিয়ে গেছে ধনীর ওপরে, কিন্তু অন্যদিকে ধনীর কাছে সেই ক্ষোভকে তোয়াক্কা করার মতো কিছু বলে মনে হয়নি কোনো দিন। 

কোনো নিষ্ঠুর মানুষই ততটা নিষ্ঠুর নয়, তাকে নির্যাতিত মানুষেরা যতটা নিষ্ঠুর বলে ভাবে। নিষ্ঠুরতা থেকে পাওয়া ব্যথা শুধু নির্যাতিতেরই ব্যথা, নির্যাতনকারীর কারণ থাকে তাকে সেই ব্যথা দেওয়ার। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। দুই পক্ষের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতি এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন ক্যাটাগরির ভাবনা ও অনুভূতি, কিন্তু আমরা নির্বোধ বলেই ভাবি যে প্রতিটা অবিচারের ঘটনায় নির্যাতনকারী ও নির্যাতিত বুঝি একই জিনিস ভাবছে ও অনুভব করছে। এই যে নিজের ব্যথার মাপে অন্যের দোষ মাপা, আমি বলতে চাইলাম মজনুকে, সেটার মধ্যেই আছে পুরো একটা জীবন মিথ্যা চাওয়ায় ডুবে থেকে শোক-হতাশা-ক্ষোভ ও অনুতাপে কাটিয়ে দেওয়া, আর যেই নিজে একদিন উঠে গেলাম ক্ষমতাবানের অবস্থানে, তো সঙ্গে সঙ্গে আবার নিজে একই কাজ করা শুরু করলাম ক্ষমতাহীনদের প্রতি-হাসিমুখে, যৌক্তিকতার ছায়ায় দাঁড়িয়ে। মজনু —বলতে চাইলাম আমি—এটা একটা চক্র, তামাশাও বলতে পারো, আর এ নিয়ে কান্নাকাটি ও ক্ষোভের আসলে কিছু নেই, শুধু যদি পারো তো একদিন স্রেফ নিজের অবস্থানটা বদলে ফেলো, তখন দেখবে যে সবকিছু ঠিকই আছে, আর সবকিছু ঠিকই ছিল চিরকাল। 

হাসপাতালের গেটে পৌঁছে যতজন না রোগী দেখলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি দেখলাম পুলিশ ও ডিবির লোক। পুলিশেরা ইউনিফর্ম পরা এবং তাদের ডিবির বন্ধুরা সাধারণ পোশাকে, তবে তাদের কর্তব্যে বুঁদ হওয়া আসক্ত কিন্তু দ্ব্যর্থহীন চেহারা দেখে ঠিকই বোঝা যাচ্ছে যে তারা পুলিশেরই ভাই। নিশ্চয়ই কোনো দাগি আসামিকে—কোনো ক্ষমতাচ্যুত জারজেসকে, যে কিনা ক্ষমতা হারিয়েও জারজেসই থেকে গেছে এই চাকরিজীবী পুলিশ ভাইদের কাছে—আনা হয়েছে হাসপাতালে, জরুরি প্রয়োজনে চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবার কাজে। চালকের আসনে বসেই মজনুর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে, কাউছারের ‘স্লামালেকুম ভাই, আপনি অনেক করলেন’ কথার উত্তরে ‘ওয়ালাইকুম সালাম’ বলে আমি ভেগে গেলাম ওই অভিশপ্ত জায়গা থেকে, যদিও আমার লোভ হচ্ছিল হাসপাতালের গেটের বাঁ দিকের বড় চায়ের দোকানে থেমে এক কাপ কড়া-পালিশ চা খাওয়ার। যেতে যেতে, গাড়ি ব্যাক গিয়ার দিয়ে পেছনে নিতে নিতে দেখলাম মজনু ছুটে যাচ্ছে মূল বিল্ডিংয়ের দিকে, তার হাঁ করা মুখে নিশ্চয়ই ঢুকে যাচ্ছে মশা-মাছি, তারা খুশি যে মুখের ভেতরটা বেশ রক্তে মাখামাখি এবং তার পেছনে দৌড়ে যাচ্ছেন তার বাবা-মা দুজনই—তার মা দৌড়াচ্ছেন সংকোচের সঙ্গে। কারণ, অনেক ছোটবেলায় গ্রামের মাঠে দৌড়ঝাঁপের পর তাঁর পক্ষে আর দৌড়ানো হয়ে ওঠেনি কোনো দিন, বেকারিশ্রমিককে বিয়ে করে ঢাকার কোনো বস্তিসদৃশ বাসায় উঠে যাওয়ার পর থেকে তো নয়ই। আসলে যার যার ভূমিকায় যার যার আচরণ কী রকম হবে, তা মোটামুটি লেখাই আছে মোটাদাগে, বহু শতাব্দী আগের খাগের কলম দিয়ে। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *