আগস্ট আবছায়া – ১.১

১.১

আগস্ট মাসের বাজে গরমের এক সন্ধ্যায় আমি আমার বসুন্ধরার বাসার নয়তলার বারান্দায় বসেছি ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডের কাজ নিয়ে, যতটা না মনের টানে, তার চেয়ে বেশি প্রকাশকের কাছ থেকে দুবছর আগে যে অগ্রিম টাকা নিয়েছি, সেই অপরাধবোধ থেকে। আরও বড় কথা, এই খণ্ডের প্রধান গল্প ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না’–বোরহেসের হিসেবে কাফকার সেরা গল্প—আমাকে আগস্টের দুর্বিষহ ঘটনাটার মধ্যখানে ঠেলে দিয়েছে ভণিতাহীন ও সরাসরিভাবে। তাই কাফকা আমাকে টেনে ধরে রেখেছে আরও বেশি করে। 

এ গল্প আমার আগেই পড়া অনেকবার, নানা ইংরেজি অনুবাদে। প্রথম বাক্যটার বাংলা করতে সময় লাগল না মোটেই : ‘চীনের মহাপ্রাচীরের কাজ শেষ হয়েছে এর সবচেয়ে উত্তর দিকের অংশটায় এসে’; তারপর দ্বিতীয় বাক্য : ‘দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রাচীরের দুই ভাগ এসে মিলেছে ওখানটায়’–ঠিক আছে; তারপর তৃতীয় : ‘প্রাচীর নির্মাণের ক্ষেত্রে এই খণ্ডে খণ্ডে কাজ করার পদ্ধতি একইভাবে মানা হয়েছে নির্মাণশ্রমিকদের দুই বিশাল বাহিনীর বেলায়ও—পুবের বাহিনী ও পশ্চিমের বাহিনী’। 

তিনটে বাক্যই আমি সাদা কাগজের ওপরে সাজিয়ে ফেললাম পরপর, বাক্য তিনটে পড়তে গিয়ে তিন দফা অধৈর্য হয়ে চেষ্টা করলাম কাফকার লেখক-আত্মার সঙ্গে আমার আগস্টের ভাগ ভাগ, ছেঁড়া ছেঁড়া মনকে মেলানোর। কিন্তু দেখলাম, না, আমার মন চলে যাচ্ছে গল্পের আরও কিছু পাতা পরে, যেখানে সম্রাটের মৃত্যু নিয়ে কাফকা—কোনো কসাইয়ের পশুর গর্দানে কোপ মারার ধরনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের এক নির্মম ধারাভাষ্য ফুটিয়ে তুলেছেন। আমার মনে হলো, আমি বরং মাঝখানের পাতাগুলো টপকে গল্পের ওই গা-ছমছম জায়গাটারই মোকাবিলা করি। সেলো পয়েন্টেক ০.৫ জেলপেন খাপে ভরলাম, সাদা রুলটানা কাগজগুলো ফোল্ডারে রাখলাম, তারপর পেঙ্গুইন মডার্ন ক্লাসিকসের কাফকা, এভরিম্যানস লাইব্রেরি এডিশনের কিছুটা বড় ছাপার কাফকা, শোকেন বুকসের একটা বড় ও একটা ছোট কাফকা, মোট চারটা ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না’ সামনে মেলে ওই অংশটা বাংলায় মাথার মধ্যে দাঁড় করালাম পরের দীর্ঘ এক সময় ধরে : 

সম্রাটের চারপাশে সারাক্ষণ থিকথিক করছে মেধাবী কিন্তু শয়তানিতে ভরা রাজন্যের দল। চাকর ও বন্ধুর বেশ ধরে তারা তাদের বদমায়েশি ও শত্রুতাকে ঢেকে রেখেছে। সম্রাটের ক্ষমতার বিপরীতমুখী শক্তি তারা, বিরামহীন চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের বিষমাখা তির দিয়ে কীভাবে সম্রাটকে তার আসন থেকে সরানো যায়। সাম্রাজ্য অবিনশ্বর, কিন্তু কোনো ব্যক্তি সম্রাট ঠিকই সিংহাসনের উঁচু থেকে নিচুতে পড়ে যেতেই পারেন, এমনকি শেষে পুরো রাজবংশেরও ভরাডুবি হয়ে যেতে পারে, এক একযোগের মৃত্যুচিৎকারে বংশের সবাই ছাড়তে পারেন তাদের শেষনিশ্বাস। এই সব সংগ্রাম ও যাতনার কথা সাধারণ মানুষ কোনো দিন জানতে পারে না; তারা দেরিতে আসা লোকদের মতো, কোনো শহরে ঢোকা আগন্তুকদের মতো, লোক গিজগিজ গলিপথগুলোর শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে থেকে চুপচাপ চিবুতে থাকে দেশের বাড়ি থেকে আনা তাদের খাদ্যখাবার, যখন কিনা তাদের সামনের দিকে, দূরে, শহরের মাঝখানের মার্কেট স্কোয়ারে দেখা যায় এগিয়ে চলেছে তাদের নেতাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর কাজ। 

.

এরপর আধা ঘণ্টা হবে আমি তাকিয়ে আছি ফোল্ডার থেকে বের করা সাদা এ-ফোর সাইজের কাগজগুলোর দিকে, আঙুলের ফাঁকে জেল পেনটা নিয়ে খেলছি। অপরাধবোধ নেগেটিভ অনুভূতির একটা, যেমন দুঃখ, যন্ত্রণা, শোক, একাকিত্ব। আমি দেখলাম, এ বছর আগস্টের গোড়া থেকে—মাসের শুরুর কয়েকটা দিন ভারতে ছিলাম আমি, সেখানে এবার আমাকে সাক্ষী হতে হয়েছে বিশ্রী এক ঘটনার-—আমাকে এই বোধগুলো তো পেয়ে বসেছেই, তা ছাড়া সেই সঙ্গে হচ্ছে অনেক উদ্বেগ ও ক্ষোভও। আগস্ট মাস এলে মনের নেগেটিভ অনুভূতি আমাকে অস্থির করবেই, অতএব আলাদা আলাদাভাবে এর কোনোটা এবার নতুন বলে মনে হলেও সামগ্রিকভাবে যে একটা বোধ, যার কোনো উপযুক্ত বাংলা শব্দ আমার ভান্ডারে নেই, তা আমার জন্য নতুন নয়। আর মাস যত মাঝামাঝির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, তত দেখা যায় প্রতি সকালে বিছানা থেকে উঠতে গেলে মনে হচ্ছে বরং কোনো একটা কাঁথা নিয়ে, চোখ না খুলে, ওই চাদর বা কাঁথার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারলেই ভালো হতো, বাইরের পৃথিবীর আপাত দৃষ্টিশোভন রূপটার ভেতরের মালিন্য ও সৌষ্ঠবহীনতাকে দেখতে হতো না। 

সন্ধ্যা নেমে গেল ঘন হয়ে। মাগরিবের আজান শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ, কিন্তু তার হারানো সুরে এখনো থিরথির করছে হাওয়া, আর বহু পাখি উত্তর দিকের বালু নদের ওদিক থেকে এসে বসছে বড় বড় সব দেবদারু, শিরীষ ও কাঁঠালের ডালে, ঝগড়া করছে তারা। আমি জানালার কাচের এ পাশ থেকে গোধূলি-উত্তর জবরজং অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে নিবিড় চেষ্টা করলাম পাখিগুলোর জাত চেনার, কিন্তু এই একবার মনে হলো যে ওরা পাঁচ-ছ রকমের বুলবুলের দল, তো পরক্ষণেই না, ওরা সব বনশালিক-ধলাচোখ-ফুটকি জাতের ছোট পাখি। কেবল একটাকেই চিনতে পারলাম স্পষ্ট করে। কারণ, ওটা একা, আস্তে, ল্যান্ডিং করল আমার দশতলার ছাদ থেকে কোনাকুনি নিচের দিকের এক বড় গাছে। উচ্চতায় আমার থেকে বেশ নিচে ওই গাছের মাথা, কিন্তু পাখিটাকে চিনবার জন্যই আমি বারান্দা থেকে ঝুঁকে তাকিয়েছি, দেখতে চেষ্টা করছি ওর ফ্লাইট পাথ কোথায় গিয়ে শেষ হয়। একটা কপারস্মিথ বারবেট, যার বাংলা নাম আমার জানা নেই, বাংলা একাডেমির ডিকশনারিতে আছে বলেও মনে হয় না, সে তার কামারের ধাতব টুং-টুং-টুং শব্দে সব কাঁপিয়ে দিচ্ছে, দূরের এক দেরিতে শুরু হওয়া আজানের শেষ ডাক ছাপিয়ে এখন শোনা যাচ্ছে তার গলা থেকে বেরোনো এই হাতুড়ির বাড়ির আওয়াজ। এমনিতে চিরন্তনের লাল-ময়ূরকণ্ঠী নীল-সবুজ-হলুদ সব মাখানো তার সারা গায়ে, কিন্তু এই অন্ধকারে কীভাবে সে রংশূন্য হয়ে মিলিয়ে গেল তার ছোট অন্ধকার গর্তের ভেতরে! আমার মনও হারিয়ে যাওয়ার ব্যথায় কেমন করে উঠল। 

দেয়ালের গায়ে লাগানো ছোট একটা বাতি এত বড় অন্ধকার বারান্দাকে এখন আর আলো দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না, তাই বলতে গেলে আর পড়াই যাচ্ছে না এভরিম্যানস এডিশনের কিছুটা বড় ছাপার কাফকাও। কালো রঙের টানা টানা লাইন, তাতে শত শত অক্ষর, বোঝাই যাচ্ছে না কোনটা অক্ষরগুলোর ওপরের দিক, আর কোনটা নিচের, বাঁ থেকে তাকাতে হবে ওগুলোর দিকে, নাকি ডান থেকে—সব অক্ষর অন্ধকারে জট পাকিয়ে এতটাই দুর্গতিপূর্ণ এক অবস্থা। মনে হলো সবকিছুর ওপরে যেন অন্ধকার এক সিল্কের পর্দা টানা, এবং তাই বোধ হয় টবে রাখা গোল্ডেন বল ক্যাকটাসটাকে দেখাল জরাজীর্ণ এক টেনিস বলের মতো, যার মাঝখানে মাঝখানে কিনা, খেলতে খেলতে, ছোপ ছোপ পশম উঠে গেছে। আরেকটা টবে অ্যাডেনার সাদা ফুল, সেগুলোকে লাগছে অঙ্গারমলিন; এবং অন্য দুই টবের সেঞ্চুরিপ্ল্যান্ট ও পাথরকুচির সুচালো অগ্রভাগ তাদের পুরু মাংসল পাতাসহ মনে হচ্ছে যেন সিল্কের আড়ালে লুকানো কোনো ড্যাগারই হবে। খেয়াল করলাম, শুধু আমার গোল লেখার টেবিল ও বারান্দাজুড়েই যে নিষ্প্রভতার এ আস্তরণ তা নয়, মাত্র আকাশে যে একটা ধূমকেতু এ পাশ থেকে ও পাশে যেতে দেখা গেল আর হালকা মেঘের ফাঁকে বিমানবন্দর থেকে উঠে আসা প্লেন যে আলো ছড়াচ্ছিল এই খানিক আগে, ওদেরও লাগল টিমটিমে, তমসাচ্ছন্ন, যেন পৃথিবীতে অস্পষ্ট আবছায়াই বড় কথা, যেন আলো-আঁধারির সুযোগে ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে কোথায়ও, যেন আমার মনের ভেতরের অসন্তোষ থেকে জন্ম নেওয়া অনুজ্জ্বলতা পুরো আকাশ ও মাটিকে একটানে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে রং ও দৃঢ়তার বিচারে। 

স্মৃতির পীড়ন-জ্বালাতন কিছুতেই আমাকে আর মন বসাতে দিল না কাফকায়। মানুষের মন একবারে এক নির্দিষ্ট অঙ্কের দুঃখই ধারণ করতে পারে, তার থেকে বেশি নয়; এবং কারও মৃত্যুর বাস্তবতাকে পরিপূর্ণভাবে মেনে নেওয়ার জন্য কখনো কখনো দেখা যায় অনেক বছরও যথেষ্ট নয়। ‘স্মৃতির পীড়নের সঙ্গে যোগ আছে হৃদয়ের অনিয়মিত, থামা-থামা বিরতির’, আমার মনে পড়ল মার্সেল প্রুস্তের এই কথা। সাত খণ্ড ইন সার্চ অব লস্ট টাইম-এর ঠিক কোথায় প্রস্ত বলেছিলেন এটা তা মনে করে উঠতে পারলাম না। উপন্যাসের নামই প্রুস্ত একসময় রাখতে চেয়েছিলেন ‘ইন্টারমিটেনসিস অব দ্য হার্ট’-অনুভূতিগুলো হৃদয়ে থেমে থেমে আসে, হারিয়ে যায়, আবার আসে, স্মৃতি ওভাবেই কাজ করে মনে-মস্তিষ্কে, হঠাৎ হঠাৎ অনেক দুঃখ লাগে চলে যাওয়া সময়গুলোর দিকে তাকিয়ে, হারিয়ে যাওয়া মানুষদের কথা মনে করে, যারা হারিয়ে গেছে এই সময়ের গহ্বরেই এবং আমাদের মন তখন বুঝতে পারে, তা-ও সেই হঠাৎ হঠাৎ, যে ‘সময়ের’ চাইতে বড় কোনো শব্দ হয় না কোনো ভাষাতেই। জন্মদিন, বয়স, মুগ্ধতা, মোহ, ঈর্ষা, হিংসা, সবই সময়ের সাপেক্ষে বিচার্য, যে সময় কখনো গভীর, কখনো অগভীর, কখনো উদার, কখনো পাশবিক বা এর সবকিছু মিলেই একটা কিছু, কিন্তু আদতে যে নিষ্ঠুর-শব্দহীন ও ভ্রুক্ষেপহীনভাবে বহমান বলেই বরং আরও নিষ্ঠুর। 

আমি ভেতরে হেঁটে আমার পড়ার ঘরে গিয়ে হাতে তুলে নিলাম গ্রুস্তের উপন্যাসের চতুর্থ খণ্ড সডোম অ্যান্ড গমোরাহ। কয়েক সেকেন্ড লাগল মার্সেলের সমুদ্রতীরের শহর নরমান্ডির বালবেকে দ্বিতীয়বার বেড়াতে যাওয়ার অংশটা খুঁজে পেতে। এই ছোট শহরে মার্সেল এবার এসেছে তার মা ও বাড়ির বাবুর্চি মহিলা ফ্রাঁসোয়ার সঙ্গে, গরমের দিনগুলো সমুদ্রের পাশে কাটিয়ে স্বাস্থ্যের যত্ন নেবে বলে। কিন্তু যা কিছু স্বপ্ন ছিল তার এবারের বালবেক আসা নিয়ে, যা কিছু রোমান্টিক আশা এক মাদমোয়াজেলের বিখ্যাত সহচরীর সঙ্গে প্রেম করার, সব মিলিয়ে গেল হোটেলে প্রথম রাতেই। মার্সেল বলছে : 

আমার পুরো সত্তাজুড়ে যেন খিঁচুনি উঠল। প্রথম রাতেই, বুকব্যথার ক্লান্তিতে তখন ভুগছি আমি, যেই না আমি ধীরে ও সাবধানে নুয়ে আমার বুট জুতো খুলতে গেছি, চাচ্ছি যে ওই কাজটা করতে করতে ব্যথা কিছু কমুক, তখন, জুতোর প্রথম বোতামটায় হাত রেখেছি মাত্ৰ, তখনই আমার বুক স্ফীত হয়ে উঠল, তা ভরে গেল এক অজানা, দৈব কিছুর উপস্থিতিতে, আমি কেঁপে কেঁপে উঠলাম ফোঁপা কান্নায়, দুচোখ বেয়ে নেমে এল পানি।…স্মৃতিতে তখনই অনুভব করলাম, ক্লান্তিতে নুয়ে থেকে দেখতে পেলাম আমার মাতামহীর মায়াভরা, উদ্বিগ্ন, হতাশ মুখটাকে, বালবেকে আমাদের সেবার বেড়াতে আসার প্রথম সন্ধ্যায় তার সেই মুখ। যতক্ষণ আমরা আমাদের চিন্তার মধ্যে বাস্তবতাকে ফের তৈরি করে উঠতে না পারছি, ততক্ষণ আমাদের জন্য আসলে বাস্তবতা বলে কিছু নেই…আর তাই নানির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবল বাসনা থেকে, বাসনার ঠিক ওই সময়টাতেই—তাকে কবর দেবার আজ এক বছরের বেশি সময় পরে—আমি সত্যিকার অনুভব করে উঠতে পারলাম যে তিনি আর নেই, তিনি মৃত। 

আগস্টের মৃত্যুগুলো নিয়ে আমার এই হতোদ্যম ভাবপ্রবণতা, আগে সম্ভবত বলেছি, এ বছরই নতুন নয়। প্রুস্তের এত বিশাল উপন্যাসের সবচেয়ে দুঃখের এই অংশে যেমন মার্সেলের প্রিয়তম মানুষটার—তার মাতামহীর—চিরকালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার বাস্তবতা এবং তার মৃত্যুর অপরিবর্তনীয় সত্যটুকু আজ মার্সেলের সামনে হঠাৎ এসে হাজির হলো সামান্য এক জুতোর বোতাম খোলার পুরোনো এক স্মৃতির ওপর ভর করে, হঠাৎ, তেমনই আমি বোঝার চেষ্টা করলাম কী কারণে আমার প্রতিবছরের আগস্ট-কেন্দ্রিক বিষাদ এসে এ বছর একেবারে চিত্তবৈকল্যের রূপ নিয়েছে। আর হঠাৎই, গ্রুস্তের উপন্যাসের এ খণ্ডের প্রচ্ছদের পাউডার পার্পল-পাউডার ব্লু রঙের অদ্ভুত দুই ফুলের দিকে চোখ রাখতেই (তাদের মাঝখানে আবার দেখলাম মোট পাঁচটা রক্তরং পুংকেশর) আমি খুঁজে পেলাম কারণটা—দুদিন আগে ভারতের মুম্বাই-পুনে-মুম্বাই এক্সপ্রেসওয়ে ধরে আইয়ার নামের এক দক্ষিণ ভারতীয় ড্রাইভারের সঙ্গে আমার দুই দীর্ঘ ট্যাক্সিযাত্রার মধ্যেই ঘটে গেছে যা ঘটার। 

.

এ মাসের শুরুতে মুম্বাই যেতে হয় আমাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে। খুব জটিল কোনো কাজ না, আবার খুব সহজ, তা-ও না। কাজ বলতে এই : বসুন্ধরায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমি শিক্ষক—নর্থ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি—তার সঙ্গে মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কিছুর কোলাবরেশন ও বিনিময়ের চুক্তি শেষ করা, যতটা না চুক্তি স্বাক্ষর, তার চেয়ে বেশি আলোচনা; আর যতটা না আলোচনা, তারও বেশি চুপচাপ বসে থাকা, ঘোরাঘুরি। ঢাকায় আমার প্রকাশকের চাপে এরই মধ্যে মুম্বাইতে ‘পেঙ্গুইন র‍্যানডম হাউস’ প্রকাশনার অফিসেও গেলাম একবার, তাদের বোঝাতে যে পেঙ্গুইন ইমপ্রিন্ট থেকে বাংলাদেশে বাংলা বই বের করলে তা দুই বাংলাতেই ভালো চলবে; এবং আরেকবার গেলাম আমাজনের অফিসে, তাদের বলতে যে আমার বাংলা কাফকা ও হোমারের ইলিয়াড, দুটোই আমাজন অনলাইন বুক স্টোরে ভালো চলবে যদি তারা এদিকে একটু মন দেয়। আমাজন ইন্ডিয়ার উচ্চপদস্থ এই কর্মকর্তা, বাড়ি পাঞ্জাবে, আমার বড় বড় সাইজের বই দুটো হাতে নিয়ে বেশ প্রশংসা করলেন এদের প্রকাশনার মানের, বললেন যে ভেতরের লেখা নিয়ে তিনি কিছু বলতে অক্ষম। কারণ, বাংলা তিনি বোঝেন না। তারপর বললেন আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার মতো ঝামেলার কাজের পরেও এই নয় শ পৃষ্ঠার হোমার বের করতে পেরেছি, এটা তাকে অবাক করে, তাকে সব সময়ই অবাক করে যে লেখকেরা কীভাবে লেখেন, কারণ তিনি নিজে লেখক নন, তবে তার অবাক হওয়ার মূল কারণ হলো তিনি ভাবেন যে লেখকেরা নিশ্চয়ই তাদের জীবনের অর্থ খুঁজে পান, নতুবা তারা এত পরিশ্রমের কাজটা করবেন কেন? আমি ভদ্রলোককে বললাম, আমি তার কথা মানি, জীবনের যে একটা অর্থ আছে, তা স্পষ্ট না হলে এসব বড় সাইজের ও জটিল কাজ মানুষের পক্ষে হাতে নেওয়া সম্ভব হতো না। উনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং আমার প্রতি তার খুশি প্রকাশ করেন। তিনি খুশি যে অন্তত আজকে তিনি একজন মানুষের দেখা পেলেন, যার কাছে জীবনের সত্যি কোনো অর্থ আছে। আমি তার খুশি ভাঙাতে চাইলাম না জীবনের অর্থ নিয়ে আমার মনের সত্যিকারের একটা অনুভূতি প্রকাশ করে যে, যখনই জীবন আমার কাছে মনে হয়েছে অর্থপূর্ণ, মনে হয়েছে আমি আমার জীবনের কোনো একটা অর্থ খুঁজে পেয়েছি, তখনই দেখেছি বদলে দেওয়া হয়েছে সেই অর্থ। 

মুম্বাইয়ের কাজ শেষে, কয়েক দিন ধরে কোটি মানুষের জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার ভয়ংকর লড়াই দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে, আমি রওনা দিলাম পুনের উদ্দেশে, বিশ্ববিদ্যালয় শহর পুনে, সেখানকার সিমবায়োসিস ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সঙ্গে দুটো ছোট মিটিং সারব বলে। 

সিমরান ট্র্যাভেলসের এক ট্যাক্সি ভাড়া করে সকাল নয়টায় মুম্বাই-পুনে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে আমাদের যাত্রা, ওই পথেই রাতে আবার মুম্বাই ফিরব। ট্যাক্সির ড্রাইভার চেন্নাইয়ের, সজ্জন ভদ্রলোক, সুন্দর সাদা কমপ্লিট স্যুট পরা, বয়স ষাট বাষট্টি কিছু হবে অনুমান, চেহারা রুক্ষ-কঠিন নো-ননসেন্স গোছের, কিন্তু চোখের দিকে একটু ভালো করে তাকালে বোঝা যায় ওটা দক্ষিণ ভারতের কালো চেহারার আপাত রুক্ষতা মাত্র, বাইরের জিনিস, ভেতরে তিনি আর সব মানুষের মতোই—ভীত, শৈশবকাতর, ক্লান্ত। গাড়ি ছাড়তে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কী করি। বললাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বললাম লেখক, বললাম এখন কাজ করছি একটা উপন্যাস নিয়ে। তিনি কী নিয়ে আমার উপন্যাস তা জানতে চাইলেন। বললাম, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নিয়ে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ইত্যাদি। 

তিনি জানালেন যে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে চেনেন, তাঁর মৃত্যুর সময়কার কথা তার মনে আছে, ভারতে তখন জরুরি অবস্থা চলছে, তার বাবা কংগ্রেস করতেন কিন্তু ওই সময় থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে ঘৃণা করা শুরু করেন—সব তার মনে আছে। আইয়ার বললেন, তাদের বাড়ি চেন্নাইয়ের উপকণ্ঠে শ্রীপেরুমবুদুরের ভাল্লাকোট্টাই মুরুগান টেম্পল থেকে বারো কিলোমিটার দক্ষিণের এক গ্রামে। তিনি বললেন, শেখ মুজিবুর রহমান মারা যাওয়ার দিনটার কথা তার স্পষ্ট মনে আছে। তখন তার বয়স বিশ-বাইশ হবে, তিনি শ্রীপেরুমবুদুরের একটা প্রাচীন বড় মন্দিরের পুকুরে দুপুরে গোসল করছিলেন, গোসল থেকে উঠে শোনেন লোকজন বলাবলি করছে যে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে মেরে ফেলা হয়েছে পুরো পরিবারসহ, মোট ২৫ জনের মতো মারা গেছে, এই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর খুব ভালো সম্পর্ক, আর ইন্দিরা যেদিকে যাচ্ছে, সামনে ইন্দিরারও একই দিন আসবে। কারা এসব বলছিল, তা তার কিছুই আর মনে নেই, তবে সম্ভবত এলাকার বয়স্করা হবেন। তার আরও মনে আছে যে ওই প্রথম তিনি ‘অ্যাসাসিনেশন’ শব্দটা শোনেন এবং সামনের এক-দুদিন, সারা দিন ওটা আওড়াতে থাকেন। কারণ, “শব্দটা অসাধারণ’। 

তিনি বললেন, তিনি অনেক ভয় পেয়েছিলেন যেভাবে লোকেরা এক বাসাভর্তি নারী-পুরুষ সবার ঘুমের মধ্যে খুন হওয়ার গল্প করছিল। ভয়ংকর ছিল তাদের সেই বর্ণনা, আরও ভয়ংকর ছিল তারা যেভাবে ইন্দিরা গান্ধীরও একই পরিণতির কথা বলছিল রক্ত-খুন-রেপ ইত্যাদি কথা তাদের ভবিষ্যৎ-বর্ণনায় লাগিয়ে লাগিয়ে। পরে আইয়ার বললেন কীভাবে ওই ঘটনার সাত-আট বছরের মাথায় খুন হলেন ইন্দিরা গান্ধী এবং তার আবার সাত বছর পরে রাজীব গান্ধী মারা গেলেন তাদের সেই শ্রীপেরুমবুদুরে, আর এবারের অ্যাসাসিনেশনের-অ্যাসাসিনেশন কথাটা টেনে টেনে বললেন তিনি—দিনেও ‘আমি সেই একই জায়গায়, সেই মন্দিরের পাশে যে পুকুর তার পাশে একটা গাড়ি সারাইয়ের দোকানে, আমার মনে আছে তখন রাত দশটার মতো হবে, আমি গাড়ি কারখানার বিরাট বিরাট সব আওয়াজের কারণে বোমার শব্দ শুনিনি, কিন্তু দেখলাম “রাজীব গান্ধীকে মেরে ফেলেছে”, “রাজীব গান্ধীকে মেরে ফেলেছে” বলে লোকজন সব দৌড়ে এদিক-ওদিক ছুটে যাচ্ছে।’ 

এরপর আমার সঙ্গে আজ তার দেখা হওয়াটাকে অলৌকিক ঘটনা বলে অভিহিত করলেন তিনি। দুটো অ্যাসাসিনেশন, দুবারই তিনি শ্রীপেরুমবুদুরে, একটাকে নিয়ে তার গাড়ির আজকের যাত্রী উপন্যাস লিখছেন, এবং আরেকটা নিয়ে তার আতঙ্ক আজও যায়নি; এখনো তার মনে পড়ে কীভাবে রাজীব গান্ধী মারা যাওয়ার পরের অনেক রাত তারা ঘুমাতে পারেননি পুলিশের ভয়ে, কীভাবে ভয়ংকর পুলিশি তল্লাশি শুরু হলে তাদের এলাকার বাসায় বাসায়, বিশেষ করে রাতের বেলায়, পুলিশ ঘরে ঘরে ঢুকে খোঁজা শুরু করল এলটিটিই সংশ্লিষ্ট যুবকদের, কীভাবে তার দুই ফুপাতো ভাইকে একসঙ্গে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো একদিন রাত তিনটায় সন্দেহভাজন তামিল গেরিলা হিসেবে, এবং কীভাবে এদের মধ্যকার বড়টাকে আর কোনো দিনও খুঁজে পাওয়া গেল না, ফিরে পাওয়া গেল না। প্রথমটার সময়ে, তিনি বললেন, শেখ মুজিবের অ্যাসাসিনেশনের সময়ে তার বাবা বেঁচে ছিলেন, তিনি তাদের বলেছিলেন শেখ মুজিবের খুনের কারণে অনেক ঘাবড়ে গেছেন ইন্দিরা গান্ধী, ভদ্রমহিলা রাতে ভয়ে এমনকি ঘুমাতে পারেন না, একটু পরপর ছেলের ঘরে গিয়ে দেখে আসেন সব ঠিক আছে কি না। তিনি বলতেন, তার নাতি রাহুল মুজিবের ছেলের সমান বয়সী, কাল তার অবস্থাও তো এমন হতে পারে। ইন্দিরা নাকি বলতেন, বললেন আইয়ার, ‘তারা তো মনে হয় আমাকে ও আমার পরিবারকেও শেষ করে দেবে। আমি এক ঘরে ঘুমাই, সঞ্জয় ঘুমায় পাশের ঘরে, আমি দরজা খোলা রেখে ঘুমাই, যদি কিছু ঘটে যায় ওকে তো ডাকতে পারব।’ একটু চুপ থেকে আবার বললেন আইয়ার, ‘আমার বাবা তখন ইমার্জেন্সির হাজার নিপীড়নের কারণে ইন্দিরাকে অনেক অপছন্দ করা শুরু করেছেন। তিনি যখন শেখ মুজিবের এই রকম ঝাড়ে-বংশে মৃত্যুর কথা ভেবে মহিলা কী ভয়ে রাত কাটাচ্ছেন সেসব বলতেন আমাদের, আমি স্পষ্ট বুঝতাম যে বাবা চান ওই মহিলাও ওভাবে মারা যাক তার সরকারি বাসভবনে, কোনো রাতে। পরে, রাজীব গান্ধী মারা যাওয়ার পরে, একই অবস্থা হলো মায়ের। তিনি সারা রাত, একটু পরপর, আমাদের ঘরে এসে দেখে যেতেন আমরা তার চার ছেলে ঠিকঠাক আছি কি না। 

আমার মনে হলো, এই পুরো আলোচনায় আসলে একটা জিনিসই ঘটল আমি আইয়ারকে মনে করিয়ে দিলাম তার বাবার কথা, তার মায়ের ও ভাইদের কথা, তার হারিয়ে যাওয়া, পুলিশি নির্যাতনে মারা যাওয়া ফুপাতো ভাইটার কথা। 

এভাবেই খুন ও ক্ষতির গল্পের মাধ্যমে শুরু হলো আমাদের পুনের পথে যাত্রা। মুম্বাই শহর শেষ হতে এল পাহাড়ি প্যাচানো রাস্তা এবং সময়ের সঙ্গে আমি ধীরে ধীরে জানতে পারলাম যে জনাব আইয়ারের আসল নেশা প্রকৃতি—তিনি সব গাছের ও পাখির নাম জানেন। আমি মুগ্ধতা নিয়ে শুনে যেতে লাগলাম সবুজ এই ডেক্কান অঞ্চলের গাছগাছালির নাম; স্পষ্ট ইংরেজিতে তিনি আমাকে চেনাতে লাগলেন গাছের পর গাছ—অশোক, নিম, ছাতিম, বার্ডচেরি। ‘বার্ডচেরির অন্য নাম চায়নিজ চেরি’, বললেন আইয়ার, ‘ওর লাল লাল চেরি ফলে একটা টক বাসি গন্ধ থাকে যার টানে পাখিরা আসে, তাই নাম বার্ডচেরি, ভারতে নতুন এসেছে আমেরিকা থেকে, তামিলনাড়ুতে আমাদের ওখানে এই গাছ নেই। 

রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে আমাকে দাঁড়াতে হলো প্রাকৃতিক প্রয়োজনে। ফিরে আসতে দেখলাম আইয়ার গাড়ি থেকে কিছু দূরে একটা উঁচু গাছে হাত রেখে আমাকে ডাকছেন। কাছে যেতেই বললেন, ‘কামানের গোলার মতো এর ফল, তাই এর নাম ক্যানন বল, আমরা বলি নাগলিঙ্গম, এর ফুল এখন দেখা যাচ্ছে না, ফুলের গন্ধ মধুর মতো।’ আমি একটা ক্যানন বলে হাত রাখতে যাব, দেখি আইয়ার ‘হুপু’, ‘হুপু’ বলে চিৎকার করে নেমে যাচ্ছেন রাস্তার পাশ দিয়ে। সেই আমার বহু বছর পরে আবার কোনো মোহনচূড় পাখি দেখা—রাস্তার পাশে, নিচে, মাঠের মধ্য দিয়ে হাঁটছে একটা গাঢ় বাদামি রং হুপু, তার দুই তরবারির মতো লম্বা ঠোঁট ও মাথায় সুন্দর-গোছানো এক লাল-বাদামি চূড়া, তাতে আবার কালো-সাদা ছোপ টানা। ‘এরিস্তোফানিসের গ্রিক কমেডি দ্য বার্ডস-এ পাখির রাজা এই হুপু’, আমি আইয়ারকে বললাম, কিন্তু আমার কথার কোনো অর্থ ধরে উঠতে পারলেন না তিনি। আমি তাকে দেখলাম পাখিটার দিকে আঙুল তুলে মৃদুস্বরে কেবল বলে যাচ্ছেন, ‘হুপু, হুপু’ এবং তার মাতৃভাষা তামিলে কী একটা শব্দ। তার চোখের দিকে চোখ গেল আমার, কারণ তার কণ্ঠস্বরে একটা কিছু টের পাচ্ছিলাম আমি 

মাঠের মধ্যে পোকামাকড়ের খোঁজে হেঁটে বেড়ানো একটা হুপু পাখি দেখে কারও চোখে পানি আসতে পারে, এটা হঠাৎ বিশ্বাস করা কষ্ট। আমি আইয়ারের শৈশবের চেনা পাখি দেখার আনন্দ ও কষ্ট দুটোই বুঝতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু তাকে কোনো প্রশ্ন করে তার ঘোর ভাঙাতে চাইলাম না। আনন্দ ও কষ্ট যখন একসঙ্গে একই সময়ে ঘটে, তা এক অসাধারণ বোধের এক অবিশ্বাস্য সময়। ওই দুইয়ের সম্মিলিত বোধ কীভাবে ষাটোর্ধ্ব এক মানুষকে ব্যাকুল করতে পারে, তা আমি অনুমান করতে পারি—একান্তই ব্যক্তিগত এক আকুলতা, যা আবার একান্তই ব্যক্তিগত কোনো অন্তিম ইচ্ছা দিয়ে মোড়া। 

আমি আইয়ারের কাঁধে হাত রাখলাম। তিনি আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন যে তার ছোটবেলায়, তামিলনাড়ুর গ্রামে, মাঠে ও জঙ্গলের দিকে অনেক হুপু পাখি আসত, কী সব সময় ছিল সেগুলো, কীভাবে সময়গুলো শাঁ করে শেষ হয়ে গেল, কী রকম একটা বাসা ছিল মোট নয়জনের, মা-বাবা-চার ভাই-তিন বোন, আর কীভাবে সবাই হারিয়ে গেছে, সবাই—বাবা-মা দুই ভাই মারা গেছেন, চলে গেছেন, এখন পৃথিবীতে আছেন তারা মাত্র পাঁচজন কিন্তু তারা সবাই এত কষ্টে আছেন, এতটা দারিদ্র্যের মধ্যে আছেন যে কারও সঙ্গে কারও যোগাযোগের আর বিশেষ কোনো অর্থ নেই। ‘অনেক গরিব লোকজনের কোনো আত্মীয় থাকে না,’ বললেন আইয়ার। তিনি আরও বললেন, এটাই সম্ভবত তার জীবনের শেষ হুপু, শেষ মোহনচূড় পাখি দেখা, বললেন নাগলিঙ্গম গাছে লম্বা সাপের ফণার মতো অজস্র মঞ্জরি থাকে, তাতে গোলাপি-লাল-হলুদ উজ্জ্বল সব ফুল ফোটে, যে ফুলগুলো তার স্মৃতিতে আজও স্পষ্ট। 

আমরা গাড়িতে ঢুকতে যাব, আইয়ার বললেন, ‘স্যার জীবন অনেক কষ্টের, অনেক। বেঁচে থাকা একটা ভার, একটা বোঝা। ষাটের পরে শরীরে যে কী সব শুরু হয়, তা কাউকে বোঝানো যাবে না যদি না তার বয়সও ষাট হয়ে থাকে। কিন্তু শুধু শরীরের অনেক ব্যথা-অসুখ-কষ্টই না, ব্যাপারটা সে রকম না মোটেই। মনের বিমর্ষতা, সার্বিক উদ্যমহীনতা ও মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা, মৃত্যুর ইচ্ছা, প্রতিদিন চাওয়া যে সব শেষ হয়ে গেলে কত ভালো হতো—ষাটের পরের এই পৃথিবী ভয়ানক, স্যার।’ 

আমার শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠল স্বয়ংক্রিয়ভাবে। মনে হলো কোনো একটা ওজন আমার ঘাড় থেকে গলা বেয়ে উঠতে লাগল একটা নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে, পাঁচ-সাত সেকেন্ডের এক টাইমটেবিল মেনে মেনে, থেকে থেকে। আমি দেখলাম আইয়ার চোখ মুছলেন তার জামার হাতায়, গাড়ির কাচের ওপরের ধুলোমাটি তাড়ানোর জন্য ওয়াইপার অন করলেন। অনেকক্ষণ কোনো কথা নেই, গাড়ি পরপর দুটো লম্বা অন্ধকার টানেল পার হলো। আমি আমার আইফোনে ‘ডিজার’ নামের গানের অ্যাপ চালিয়ে, সাদা ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে শুনতে লাগলাম PJ Harvey-এর গান ‘This Mess We Are In,’ যেটার সন্ধান পেয়ে আমার কাঠমান্ডুবাসী বান্ধবী সুরভি ছেত্রি আমাকে পাগলের মতো তিন-চারটা মেসেজ পাঠিয়েছিল গত মাসে, বারবার বলেছিল, ‘পৃথিবীর সেরা গান এটা’ : 

And thank you 
I don’t think we will meet again 
And you must leave now 
Before the sun rises over the skyscrapers 
And the city landscape comes into being.
Sweat on my skin 
Oh, this mess we are in. 

গান ছাপিয়ে হঠাৎ কানে এল আইয়ারের গলা। আমি গান বন্ধ করে, ইয়ারফোন খুলে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম তিনি আমাকে কিছু বলছেন কি না। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমাদের দেশে গ্রেট করমোরান্ট আছে নাকি নেই? আমি বুঝতে পারলাম না। পরে বুঝলাম গ্রেট করমোরান্ট একধরনের হাঁস। তামিলনাড়ুর ওই হাঁসগুলোর নীল চোখ নাকি সূর্যের আলোয় জ্বলতে থাকে, আর এই এখন হুপু পাখি দেখার পরে আইয়ারের মনে হচ্ছে, আমাকে বললেন তিনি, ‘ঘন সবুজ তামিলনাড়ুতে দুপাশে জঙ্গলঘেরা নদীগুলোয় কত কত রকমের হাঁস থাকত, লিটল গ্রেবে’–যার তামিল নাম আমি ধরে উঠতে পারলাম না, কিন্তু পরে, ইন্টারনেটে, খুঁজে দেখলাম বাংলায় একে বলে ছোট ডুবুরি—’ওই হাঁসগুলো আরেকবার দেখার জন্য তামিলনাড়ু ফিরে গিয়ে না খেয়ে মরাও ভালো।’ 

‘তাহলে যান না কেন?’ জিজ্ঞাসা করলাম আমি। ‘কী আছে এখানে, মুম্বাইতে, যে দেশের বাড়ি চলে যাওয়া যায় না?’ 

কোনো উত্তর দিলেন না আইয়ার। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘কিছুই নেই। এখানে কিছুই নেই দিনে দুই ঘণ্টার ঘুম ছাড়া। আমাদের জীবনটা কী রকম, জানেন স্যার?’ আইয়ার বলতে শুরু করলেন তার জীবনের কথা। 

প্রতি রাত সাড়ে এগারোটায়, কখনো কখনো বারোটায়, মুম্বাইয়ের ঘাটকোপারে সিমরান ট্রাভেলসের গ্যারেজে তাকে মালিকের এই গাড়ি বন্ধ করতে হয়, তারপর দেড় ঘণ্টার ট্রেন নিয়ে ঘাটকোপার থেকে পৌঁছাতে হয় কালইয়ান। কালইয়ান স্টেশন থেকে রাত একটা-দেড়টায় বাসায় যেতে হয় টানা আধা ঘণ্টা জোরে পা চালিয়ে, বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বাজে রাত দুটো, তারপর গোসলের পরে ভগবানের জন্য মিনিট পাঁচেকের পুজো ও চুপচাপ সামান্য রাতের খাবার খেয়ে নেওয়া, এরপর দুই ঘণ্টা ঘুম, প্রায়ই মাত্র দেড় ঘণ্টা, কারণ ঘুম থেকে উঠে পড়তে হয় ভোর চারটা, সোয়া চারটায়, এরপর সিমরান ট্রাভেলসের দেওয়া দুই সেট ইউনিফর্মের একটা গায়ে চাপিয়ে সেই ভোরে দৌড়, দৌড়ে আধা ঘণ্টাখানেকের রাস্তা পার হয়ে ফের কালইয়ান স্টেশন, ফের দেড় ঘণ্টার ট্রেন জার্নি এবং সকাল সোয়া ছয়টা, সাড়ে ছয়টায় ঘাটকোপারে কোম্পানির গ্যারেজে পৌঁছে গাড়ির চাবি নেওয়ার জন্য হাজিরা। 

এই তার প্রতিদিন, প্রতি রাত, এভাবেই চলে গেছে পেছনের আট-দশটা বছর। ‘এত কষ্ট করে এই মুম্বাইয়ে বেঁচে থাকে মানুষ’, বললেন আইয়ার, ‘আপনি চোখে না দেখলে বুঝবেন না প্রাইভেট ট্যাক্সির কত কত হাজার ড্রাইভার এই রুটিনেই বেঁচে আছে, প্রতিদিন মাত্র দুই ঘণ্টার ঘুম, সপ্তাহে এক দিনও ছুটি ছাড়া, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। আমরা ঘুমকে জয় করে ফেলেছি স্যার’, বললেন তিনি, ‘তবে এত আত্মবিশ্বাসী হওয়ার কিছু নেই, যেকোনো দিন আমার মনে হয় কোনো এক্সপ্রেসওয়েতে, কোনো হাইওয়েতে কিছু একটা ঘটে যাবে আমার; আমি এই ট্যাক্সি নিয়ে আছড়ে পড়ব কোনো চলন্ত ট্রাকের নিচে, কিংবা শত ফুট নিচে গিয়ে পড়ব রাস্তার রেলিং টপকে। আর তখনই সব শ্বেতচন্দন দেখার’–দূরে একটা দ্রুত সরে যাওয়া গাছের দিকে আঙুল তুলে বললেন তিনি— শেষ হয়ে যাবে।’ 

কীভাবে কারও পক্ষে সম্ভব দিনের পর দিন এ রকম দুই ঘণ্টা ঘুমিয়ে বেঁচে থাকা? আইয়ারের লাল পাথরের মতো চোখ কল্পনা করে আমার মনে হলো কাচে বানানো একটা মানুষের মাথা ওটা, সামান্য টোকা মারলেই ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে। নিশ্চয়ই তার এই চাকরিতে বেতন ও ওভারটাইম অন্য দশটা চাকরির থেকে ভালো এবং সে জন্যই আইয়ার এই জীবন মেনে নিয়েছেন অন্য সামান্য কম আয়ের জীবনের বদলে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম না কিছু, জানতে চাইলাম না কেন তাকে এ জীবনই বেছে নিতে হলো, কেন তাকে কালইয়ান স্টেশন থেকে আধা ঘণ্টা হাঁটা পথের দূরত্বের এক বাসাতেই থাকতে হবে, ঘাটকোপারের আশপাশের বাসা ভাড়া থেকে কত কম ভাড়ার তার এই বাসা, এসব। যার যার অঙ্ক তার তার কাছে, আমার পক্ষে সম্ভব না আইয়ারের জুতোয় নিজের পা ঢোকানো, তারপরও প্রতিদিন মাত্র দিনে দুই ঘণ্টা ঘুমের যে জীবন, তাকে নিষ্ঠুর বিবেচনা করার আমার অধিকার আছে বলেই মনে হলো। আমি মানুষের জীবনযাপনের এতটা অবিশ্বাস্য কষ্টের কাহিনি কোনো দিন শুনব বলে আশা করিনি। ঘুম আসলে জয় হয়নি তার, ওটা ধোঁকা মাত্র। ঘুমঘোরে একদিন গাড়ি দুর্ঘটনায় তার প্রাণ যাবে, সেটা জেনেও তিনি গাড়ি চালাচ্ছেন, এটাই সত্য। আমরা এর নাম দিয়েছি জীবনসংগ্রাম, বলছি এই সংগ্রামে তোমাকে জিততে হবে, জেতার ওই চেষ্টাটাই তোমার জীবনের মানে। কমিউনিস্টরা তখন এসে বলেছে, না জীবনের মানে ওটা না, জীবনের মানে হচ্ছে তাদের উৎখাত করা যারা তোমাকে এই ভয়ংকর সংগ্রামের মধ্যে পুড়ে নিঃশেষ হতে বাধ্য করছে। তখন ধর্ম এসে বলছে, না মারামারি কোরো না, খোদার প্রতি ভরসা রাখো এবং সংগ্রাম চালিয়ে যাও, কষ্ট তাহলে অনেক কম হবে, দেখো। আমার মনে পড়ল নবোকভের কথাটা : ‘শিশু বয়সের দোলনাটা দুলছে এক অতল গহ্বরের ওপরে। জীবনের দীর্ঘ দাগটার দুপাশে দুই অন্ধকার—জন্মের আগে অন্ধকার, এবং মৃত্যুর পরে আবার অন্ধকার। আমাদের বেঁচে থাকাটা দুই প্রান্তের এই দুই অনন্ত অন্ধকারের মাঝখানে এক আলোর সামান্য ঝলকানি মাত্র।’ আইয়ারের দৈনন্দিন জীবনের এই গল্প শুনে মনে হলো, নবোকভ ভুল। দুই প্রান্তের দুই অন্ধকারের মাঝখানে যে জীবন সেটার আলোটুকুও আমাদের চোখের ওপরে এত নিষ্ঠুরভাবে ধরা যে সেই আলো, চোখধাঁধানো এক বর্বর আলো, আদতে অন্ধকারই। 

এসব এলোমেলো, অসংলগ্ন ভাবনার মধ্যে পুনের সামান্য কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় আবার আমরা রওনা দিলাম উল্টো পথে—পুনে থেকে মুম্বাইয়ের দিকে। রাতের অন্ধকারে প্রায় সাড়হীন অবস্থায় আমি পার হলাম চার-পাঁচটা লম্বা, আঁধার ঘনিয়ে আসা টানেল। গাড়ির সিটে বসে অস্থির পা নাচাচ্ছি, আমরা ঢুকে যাচ্ছি মুম্বাইয়ের শহরতলিতে, এমন সময় আইয়ার আমাকে বললেন বাইরে বাঁয়ে তাকাতে, বললেন ‘এটা পাম বিচ রোড, বাঁয়ে বিশাল কালো তরল কয়লার মতো ক্রিক, চোরাবালি ভরা ম্যানগ্রোভ খাঁড়ি, যা এখন মুম্বাইতে স্রেফ মানুষ খুন করে লাশ ফেলার জায়গা।’ 

আমি নড়েচড়ে বসলাম, বাঁয়ে অন্ধকারের দিকে তাকালাম, অপেক্ষা করছি আইয়ার আমাকে কোনো চাঞ্চল্যকর খুনের গল্প বলবেন, যেমনভাবে আমি তাকে বিস্তারিত বলেছি ১৯৭৫-এর ১৪ আগস্ট ঢাকার রাত কীভাবে ধেয়ে গিয়েছিল ১৫ আগস্ট ভোরের দিকে ওই ভয়াবহ ঘটনাটা ঘটাতে। কিন্তু তিনি ওসব খুনখারাবির দিকে না গিয়ে আমাকে বলতে লাগলেন কীভাবে এই পাম বিচ ক্রিকে এসে জড়ো হয় দুই কোটি লোকের এ শহরের সব আবর্জনা, এবং তাতে করে কীভাবে মাত্র এক বছরের মধ্যে হারিয়ে গেছে জলাভূমির হাজারো মদনটাক, কানি বক, বড় বগা ও ওপেনবিল স্টর্কের মতো (সব কটি নামই ইংরেজিতে বললেন তিনি, যা পরে হোটেলে ইন্টারনেট হাতড়ে ঠিকঠাক বুঝে নিতে হয়েছিল আমাকে) পাখিগুলো। 

গাড়ি চলছে। একটু পর পর নির্দিষ্ট দূরত্বে যেতেই রাস্তার প্লেটে বাড়ি খেয়ে ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে চাকায়। পাখিদের জন্য আইয়ারের মায়ার কথা ভাবলাম আমি এবং বাইরে অন্ধকারে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম যা এখন আর নেই বলে জানালেন তিনি। আইয়ার বললেন, ‘পাখিদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের জায়গায় এখন এসেছে লাশ, মানুষের। প্রতি সপ্তাহে, দু-তিন দিন পরপরই এখন লাশ মিলছে ক্রিকের থকথকে কাদায়। এই শহরে সবাই এখন অন্য সবাইকে মেরে ফেলতে চাইছে, মানুষ মেরে ফেলাটাই এখন এখানকার কর্মবিধি। স্যার, আমার চোখের সামনে কীভাবে বদলে গেল মুম্বাই, কত নৃশংস হয়ে উঠল মানুষ, যেন আরেকজনকে মারতেই হবে আমার বেঁচে থাকার জন্য। কদিন পরপর স্যার, কদিন পরপরই এই ক্রিকে মিলছে গলা কাটা, পেট কাটা, স্তন কাটা, হাত-পা কাটা, আগুনে পোড়ানো, আগুনে ঝলসানো লাশ। 

অন্ধকারের মধ্যে ক্রিকে ম্যানগ্রোভের ধারালো শ্বাসমূল চোখে পড়ল না আমার। শুধু মনে হলো—গাড়ি ওভাবে ধীরে এক ধারাবর্ণনার মধ্য দিয়ে চলছিল বলেই হয়তো—এ রকম একদম জনমানবশূন্যতার মাঝখানে অনেক ছায়া ছায়া অশরীরীর উপস্থিতি টের পাচ্ছি আমি গাড়ির বাঁয়ে, ডানে, ছাদে, সামনে ও পেছনে। যেন গাড়ির বুটের মধ্যেই লুকিয়ে শুয়ে আছে কোনো অশরীরী আত্মা। ডান দিকে দেখলাম একটা ‘ক্যাফে কফি ডে’ দোকান। আইয়ারকে বললাম থামতে, জিজ্ঞেস করলাম তিনি কফি খাবেন কি না। না-বোধক মাথা নাড়লেন আইয়ার। আমি দ্রুত গাড়ি থেকে বের হয়ে কফিশপে না ঢুকে গেলাম একটা জেনারেল স্টোরে, হোটেল রুমের জন্য বড় পানির বোতল এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের সাধারণ একটা বডি লোশন কিনব বলে। 

দোকানের সামনে দিয়ে, কয়েকটা কাঠের বাক্স পার হয়ে ভেতরে ঢুকতে যাব, তখনই দেখলাম একটা সুস্থ সাধারণ কিশোরের মতো মুখের এক লোক, সম্ভবত উত্তর প্রদেশের আরও উত্তর থেকে আসা কোনো পাহাড়ি কেউ হবে, গায়ে কালো জামা, পায়ে আরও কালো এক গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট, সে আমার দিকে ঝট করে তাক করল এক দীর্ঘ ব্যারেলের রিভলবার, গত শতাব্দীর—স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন আর্মি রিভলবার মডেল টু। আমি লোকটাকে বাদ দিয়ে রিভলবারটার শীতল-কালো সৌন্দর্যের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি, নড়ছি না একটুও, ভাবছি এটাতে ছয় রাউন্ডের বাঁশির আকার সিলিন্ডার আছে, এর চেম্বারে ঢোকে .৩২ রিমফায়ার বুলেট, এটার উৎপাদন বন্ধ তো সেই উনিশ শতকের শেষভাগেই—তাহলে এই দেরাদুন বা মসৌরির মন্ত্রগম্ভীর কিশোরমুখ লোক এটা পেল কোত্থেকে? 

এসব টেকনিক্যাল চিন্তা খেলে গেল কেবল আমার মাথার বাইরের দিকেই। ভেতরে তখন আমার হাড়গোড় সব নাড়া দিচ্ছে এক কলঙ্কময় ভীতি, যার গভীরতা হাতসমান কিন্তু বিস্তার এক আলোকবর্ষ দীর্ঘ। আমি স্টোরটায় না ঢুকে ঘুরে গিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম, কিন্তু দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে এসে ওই তরুণ আমার ঘাড়ে হাত রাখল। আমি তার চোখে চোখে তাকাতেই সে মৃদু হেসে ফেলল, আমার হাতের মুঠোয় একটা কাগজের টুকরো পুরে দিয়ে বলল যে এটাতে তার ফোন নম্বর আছে, কখনো আমার যদি কাউকে মেরে পাম বিচ ক্রিকে লাশ ফেলে দিতে ইচ্ছে হয় তো আমি যেন তাকে ফোন করি। ‘আমার সার্ভিস রাউন্ড-দ্য-ক্লক,’ বলল সে। 

গাড়িতে ঢুকে আমি আইয়ারকে সবটা খুলে বললাম। তিনি বললেন, ‘ফোন করুন ওই নম্বরে, দেখি।’ আমি কাগজের টুকরোটা গাড়ির আলোতে মেলে ধরে আমার ফোন থেকে কল করলাম ৮৬৫২৪ ৩৪৫×× নম্বরে। আইয়ারের ফোন গাড়ির ভেতরেই বেজে উঠল, জোরে। আইয়ার হেসে আমাকে বললেন সবটা আমার মনের ভুল, কাগজে তার ওই নম্বর তো তিনিই আমাকে লিখে দিয়েছিলেন আমি যখন পুনের সিমবায়োসিস বিশ্ববিদ্যালয়ে গাড়ি থেকে নামছিলাম তখন, মানে আজ দুপুরে। 

আমার আতঙ্ক কাটল না। আমি গাড়ির ভেতরে রীতিমতো কাঁপতে লাগলাম শক থেকে। আইয়ার হা হা করে হাসলেন আমার মাথা খারাপ হয়ে যাওয়া নিয়ে। আমি চেষ্টা করতে লাগলাম ব্যাপারটার একটা লজিক্যাল ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর। এই গা-ছমছমে রাত এগারোটার পাম বিচ রোড ধরে ধীরে চলা গাড়ি এবং আইয়ারের বলে যাওয়া মাথা কাটা, পেট কাটা লাশের গল্প, এসব মিলে কি আমার ক্ষেত্রে তাহলে ঘটেই গেল সেই ঘটনা? জীবনে প্রথমবারের মতো ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন হলো আমার? 

একবার ভাবলাম হয়তো গাড়ির বাইরেই যাইনি আমি, ক্লান্ত হয়ে গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু আইয়ার জোর দিয়ে বললেন, তিনি গাড়ি পার্ক করেছিলেন এবং আমি একসময় উদ্ভ্রান্তের মতো ছটে গাড়িতে ফিরে এসেছি। মিথ্যা বলেছেন আইয়ার? মজা করছেন আমাকে নিয়ে? কেন তা করবেন তিনি? তাকে আমি ১৪-১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের যে গা-ছমছমে ঘটনার কথা বলেছি, তাতে কি আইয়ারের মনে হলো যে আমাকে নিয়ে অতিপ্রাকৃতের একটা ফাজলামি করে দেখা যাক? কেন তা মনে হবে তার, তার মতো সংবেদনশীল, ভদ্র একজন মানুষের, রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর স্মৃতিচারণা যাকে তার মৃত বাবা-মায়ের কথাই মনে করিয়ে দিতে পারে শুধু, কোনো ঐতিহাসিক ক্ষোভের কথা নয়? 

তাহলে কী হয়েছিল আমার? একেই বলে মেন্টাল ডিস্টারবেন্স? সাইকোসিস? নিউরাল ডিজঅর্ডার? ঘুমের ঘাটতির ভয়ংকর কনসিকোয়েন্স? সাড়ে তিন শ বছর আগে স্যার টমাস ব্রাউন প্রথম লেখেন ‘হ্যালুসিনেশন’ শব্দটা, অন্য আরও সাত-আট শ ইংরেজি শব্দের পাশাপাশি। কোলরিজ, অ্যালান পো, কনরাড, বোর্হেস পড়তে গিয়ে স্যার টমাস ব্রাউনকে আমি চিনেছিলাম অনেক দিন হয়—’সুইসাইড’, ‘হলোকাস্ট’, ‘ইনসিকিউরিটি’, ‘আলটিমেট’, এই শব্দগুলোর স্রষ্টা হিসেবে। ‘হ্যালুসিনেশন’ও তার তৈরি করা ধ্বনিবহুল, লাবণ্যময় এক শব্দ, যার গ্ল্যামারের কথা আগেও ভেবেছি আমি, অন্য সময়ে, অন্য পরিস্থিতিতে। সেই হ্যালুসিনেশনই কি বাস্তবে ভর করল আজ আমার কাঁধে? সেই শব্দই কি অবচেতন থেকে উঠে এসে ঘটাল ঘটনাটা? শব্দের শক্তি এত বড় হওয়া সম্ভব? 

এ ছিল এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা—অপার্থিব বুদে ভরা ও যথেচ্ছাচারী, যা কিনা মানুষকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়ার, এমনকি শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলার জন্যও যথেষ্ট। ‘কোমা’ শব্দটাও স্যার টমাস ব্রাউনের সৃষ্টি। আমার হঠাৎ মনে হলো, গাড়ি তখন এই এত রাতেও ব্যান্দ্রা-কুরলা কমপ্লেক্সের কাছে ট্রাফিক জ্যামে পড়েছে, বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, একটা মানুষও দেখা যাচ্ছে না কোনো দিকে, শুধু হেডলাইটের আলো ফেলে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি আর গাড়ি, সেই আলোতে অতি চকচকে, অতি বিচ্ছুরিত বৃষ্টির রেখা অনবরত কাচগুলোর ওপরে ঠিকরে পড়ছে তো পড়ছেই, আমরা ঘাটকোপার পার হয়ে এসেছি কিছু আগে, ঘাটকোপার, আমাকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে যেখানে গাড়ি রাখতে ফেরত যাবেন আইয়ার, তারপর আরও দুই ঘণ্টা ট্রেনে চেপে ও হেঁটে বাড়ি পৌঁছাতে হবে এই দরিদ্র ও নির্ঘুম মানুষটাকে, যার মুখ এই মুহূর্তে আমি দেখলাম উল্টো দিকের এক গাড়ির হেডলাইটের আলোয় এবং যাকে দেখামাত্র আমার মনে হলো চারপাশের গাড়িগুলোয় বসা সব মানুষই অসুস্থ এবং তাদের সেই অসুস্থতা দেখতে দেখতে আমি চলে যাচ্ছি কোমার ভেতরে। 

তো এই তাহলে সেই জায়গা যেখানে মানুষ থাকতে আসে। আমার কাছে লাগছে তো এখানে তারা আসে কেবল মরতে। আমি বাইরে গিয়েছিলাম। দেখলাম—অনেক হাসপাতাল। দেখলাম একটা লোক পড়ো পড়ো করে চলেছে, তারপর পড়েই গেল। দেখলাম এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলা। তিনি একটু একটু করে ভারী পায়ে হেঁটে চলেছেন একটা উঁচু, রোদে উষ্ণ দেয়ালের পাশ ধরে, মাঝেমধ্যে দেয়াল ছুঁয়ে দেখছেন এই নিশ্চয়তাটুকু পেতে যে, দেয়ালটা এখনো আছে। হ্যাঁ, আছে ওটা, এখনো। আর দেয়ালের পেছনে? ম্যাপে খুঁজে পেলাম জায়গাটা : ‘হাউজ অব ডেলিভারি।’ খুব ভালো কথা। ওনার বাচ্চার ডেলিভারি হবে—ওই কাজে তো ওরা পাকাই। আরও সামনে এগোলে, স্যাঁ-জ্যাক রোডে, একটা ছোট গম্বুজওয়ালা বড় দালান। ম্যাপ বলছে : “ভাল-দ্যু-গ্রাহাস মিলিটারি হাসপাতাল।” ওই তথ্য জানার আমার কোনো দরকার নেই, কিন্তু—ঠিক আছে। রাস্তার সব পাশ থেকে গন্ধ আসছে। যদ্দুর বুঝলাম আয়োডিনের গন্ধ, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই করার সস্তা চর্বি আর ভয়ের গন্ধ। গ্রীষ্মকালে সব শহর থেকেই দুর্গন্ধ বেরোয়।…আর কী? একটা থেমে থাকা প্রামে এক বাচ্চা, মোটা, সবুজ রং, কপালে ভালোই এক ঘা মতো, পরিষ্কার যে ঘা-টা শুকাচ্ছে, আর জ্বালাপোড়া নেই। বাচ্চাটা ঘুমে, তার মুখ খোলা হাঁ করে, সে শ্বাসে নিচ্ছে আয়োডিন, সস্তা চর্বি আর ভয়। এ রকমই ব্যাপারগুলো। আসল কথা হচ্ছে জীবিত থাকা, ওটাই আসল কথা। 

তো, এই তাহলে সেই শহর যেখানে মানুষ বাঁচতে আসে। আসলে তারা এখানে আসে মরতে। রিলকের ওই প্যারিস, প্রাগ, মুম্বাই, ঢাকা—সবই এক, সব শহরই মানুষকে গ্রাস করে নেবার এক দুর্গন্ধযুক্ত হাঁ। আমি মুম্বাইয়ের বৃষ্টিভেজা, স্যাঁতসেঁতে শত শত দালান ও দোকানপাট পার হয়ে, হাসপাতাল, হ্যাঁ, লীলাবতী হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে দিয়ে একসময় বাঁয়ে শাহরুখ খানের বাড়ি ও ডানে সমুদ্র রেখে আইয়ারের ট্যাক্সিতে এসে থামলাম আমার হোটেলের দোরগোড়ায়। রাত প্রায় বারোটা। কড়া সিকিউরিটি চেকের মধ্যে দিয়ে যেতে হলো আমাদের ট্যাক্সিকে। আমি গাড়ির ভেতরে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছি, ওরা টর্চের আলো ফেলে আমার চেহারা দেখে নিচ্ছে। দুজনের হাতে দেখলাম দুটো হেকলার অ্যান্ড কোচ এমপিফাইভ, কিংবা হতে পারে এমপিফাইভ-কে, ক্যালিবার ৯ মিলিমিটার, ব্যারেল ৮.৯ ইঞ্চি। এই এলিট ফোর্সের মারণাস্ত্র নিয়ে এরা কী করছে এখানে? সামান্য হোটেল পাহারা দেওয়া বলে একে? শহরগুলোর ওপরে মৃত্যুর যম তাহলে সওয়ার হয়েছে এভাবে, এ রকম লাজলজ্জাহীনভাবে? 

গাড়ি থামতে আমি আমার সিটজুড়ে পড়ে থাকা এটা-ওটা জিনিস ধীরে গোছাতে লাগলাম, তারপর আইয়ার পেছন ফিরে বিল এগিয়ে দিতেই গুনে গুনে তা পরিশোধ করে বিলটা ভাঁজ করে ব্রিফকেসে রেখে গাড়ি থেকে বের হতে যাব, আইয়ার বললেন আমি তাকে টিপস দিইনি, এবং চকিতে, শাঁ করে, কীভাবে যেন তাকালেন আমার মানিব্যাগের দিকে। 

কী এক দৃঢ় স্বরভঙ্গি ছিল তার, এতখানি দৃঢ়তা কারও স্বরেই থাকার কথা নয়, এতখানি নিশ্চিতি পৃথিবীর কোনো কিছুতেই, কোনো ট্রানজেকশনেই নেই, আর বাইরে দৃঢ়চেতা মারণাস্ত্রগুলো তখনো চিকচিক করছে আমার চোখের কোনার দিকে। ভালো লাগল না আমার আইয়ারের অভিযোগটুকু। এমনিতে সারা দিন ডিউটির শেষে ছয় হাজার রুপি বিলের সঙ্গে হাজারখানেক রুপি টিপস তার প্রাপ্যই বলা যায়, অন্য কোনো সময় হলে আমি তা নিজ থেকেই দিয়ে দিতাম, চাওয়াও লাগত না। এ ছাড়া আমি বুঝতেও পারছি যে টিপসের ওপরেই তার জীবনের অনেক কিছু নির্ভরশীল, তাই আজকের সারাটা দিন সে বিচারে মাটি হয়ে যাচ্ছে দেখে আইয়ার অসহিষ্ণু হয়ে অমনটা করেছেন—গলায় কেমন এক নালিশের আর্তনাদ, এবং তার চোখের দৃষ্টিতে আমার মানিব্যাগ কেড়ে নেওয়ার ঝটিকা ইঙ্গিত। আমার ঠিকই মায়া হলো আইয়ারের জন্য, কিন্তু কী এক অনুভূতি আমাকে হঠাৎই মহা স্বার্থপর ও প্রতিশোধপরায়ণ বানিয়ে তুলল। আমি সোজা তার মুখের ওপরে বলে দিলাম, ‘নো, থ্যাংক ইউ।’ মনে হলো, আমি জিতলাম। 

আমার কথা শুনে আইয়ারের মুখে একঝলকের মতো ঝলকে উঠল কনরাডের লর্ড জিম-এর নাবিক জিমের মুখ— ডুবন্ত জাহাজের যাত্রীদের ফেলে জঘন্য কাপুরুষতা দেখিয়ে নিজের জীবন বাঁচানো জিম। পাশেই মুম্বাইয়ের সমুদ্র। তো, আমাদের এই গাড়িই সেই ‘পাটনা’ জাহাজ, আর আইয়ার জিম এবং আমি ক্যাপ্টেন ব্রিয়ারলি, জিমের বিচার করছি—সমুদ্র নাবিকের ‘কোড অব অনার’ ভাঙার অপরাধে দুষ্ট সে, লজ্জাজনক এক কাজ ঘটিয়ে ফেলেছে ডুবন্ত জাহাজের যাত্রীদের ফেলে ভেগে গিয়ে, ভয়ংকর সাহসহীনতার উদাহরণ দেখিয়ে। আর আমি? জিমের বিচার করতে বসে ওর মধ্যে আমি কি আমার নিজের লজ্জারই ছায়া দেখতে পেলাম? ওর কাপুরুষতা ধরা পড়ে গেছে, আর আমারটা পড়েনি—পার্থক্য কি এটুকুই? আমরা আসলে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ? না, হলো না। দরিদ্র এক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে টিপস না দেওয়া আমার অপরাধ হতে পারে (নিশ্চয়ই হবে, না হলে এত কিছু থাকতে আমার লর্ড জিম-এর কথা মনে হলো কেন?), কিন্তু আইয়ারের কী অপরাধ? কেন সে জিম হতে যাবে আমার চিন্তার এই দাবাখেলায়? সারা দিন আমাকে অশ্রু-আতঙ্ক-কষ্টে জারিত করে এমনকি হ্যালুসিনেশনের শিকার হওয়ার মতো অসুস্থ করে তুলেছে সে; না, শুধু তা-ই নয়, পরে আমি তাকে টিপস না দেওয়ায় তার চোখের দৃষ্টি দিয়ে সে এটাও বুঝিয়ে দিয়েছে যে আমার মানিব্যাগ কেড়ে নেওয়ার নৈতিক অধিকারও তার আছে। আমার হিসেবে এই ধৃষ্টতাই কি তার অপরাধ? বেঁচে থাকার যে লজ্জাটা এত নগ্নভাবে আমি কোনো দিন দেখতে চাইনি, সেটাই দিনে দুই ঘণ্টা ঘুমানোর কথা বলে আমাকে দেখিয়ে দেওয়াই কি তার দোষ? 

না, হলো না। এর কোনো কিছুই সে পরিকল্পনামাফিক আমাকে এক্সপ্লয়েট করার জন্য করেছে বলে মনে করি না আমি। তার প্রকৃতিপ্রেম, তার শৈশবের স্মৃতিকাতরতা, তার দুচোখ ভরা জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়ার অশ্রু, এসব মিলে সে আমার মানবাত্মার ভিতই নাড়িয়ে দিয়েছে। তার ওই দৈনিক দুই ঘণ্টা মাত্র ঘুমাতে পারার গল্পই পৃথিবীর পুরো সিস্টেমকে, জীবনের আয়োজনকে উপহাস বানিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমি আজ বুঝে গেছি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে আত্মা, তা ধ্বংসকামী শক্তি দিয়ে ভরা, এবং সেই শক্তি বাছবিচারহীন ও এলোপাতাড়ি প্রায়শই একে ওকে ধরে বসে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলার জন্য। আইয়ার সেই তাদেরই একজন যাকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আত্মা বেছে নিয়েছে তার তরফে কোনো দোষ, কোনো অপরাধ ছাড়াই, এ জীবনে তাকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে ভেঙেচুরে টুকরো করবার অভিপ্রায় থেকে। জিমের মতো অপরাধী সে নয়, ক্যাপ্টেন ব্রিয়ারলির মতো হতভাগ্য সে। এই জীবন থেকে তার আর পাওয়ার কিছু নেই, মুক্তির আস্বাদ পাওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই এবং কারোরই কিছু করার নেই তার জন্য, তা সে টিপস দিয়ে হোক কিংবা দুবেলা পাশে বসিয়ে খাইয়েই হোক। ‘রাতের ঘন্টার ভুল সংকেতে একবার সাড়া দিয়েছ কি, সেই ভুলের মাশুল দেওয়া শেষ হবে না কোনো দিন।’ 

হাহ্। আমাদের শেষটা হলো তাহলে পৃথিবীর অধিকাংশ সম্পর্কের মতোই বিষাক্ত এক পর্যায়ে গড়িয়ে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, আইয়ার যেমন কিছুই শেখেননি তার জীবন থেকে, সে যেমন এত দিনেও বোঝেননি যে তাকে সাহায্য করার মতো কেউ এই পুরো পৃথিবীতে নেই, কারণ তার পেছনে লেগেছে স্বয়ং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আত্মা, তেমন আমিও তার সঙ্গে সারা দিন একত্রে কাটিয়ে শেষমেশ কিছু শিখিনি তার থেকে, একটুও পরিবর্তিত হইনি কোনোভাবে—ওই একই ধ্বংসাত্মক শক্তি তার নির্বিচার পক্ষপাত দিয়ে আমাকে বানিয়ে রেখেছে দাম্ভিক এক আগ্নেয়াস্ত্র করে, আর সেসব আগ্নেয়াস্ত্র গুঁড়িয়ে দিচ্ছে সব আইয়ারকে, নিত্যদিন। সে অর্থে আমার কোনো কাজের জন্য আমি দায়ী নই, যেমন আইয়ারও দায়ী নয় তার কোনো ব্যবহারের জন্য। 

এ রকমই এক স্বার্থপর, নিহিলিস্ট সান্ত্বনা নিয়ে গাড়ির বাইরে এক পা ও ভেতরে শরীর রেখে, প্রায়ান্ধকার এই পরিবেশে অনতিদূরে সমুদ্রের গর্জন, বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি—আমি একঝলকে বুঝে গেলাম আমার ও আইয়ারের মধ্যকার এই টিপস দেওয়া না দেওয়া নিয়ে গুলিবিনিময়ের ভেতরকার সত্য। আমাদের এ লড়াই ছোট স্কেলে অন্ধকার বনাম আলোর লড়াই, যার ফলাফল বলে কিছু নেই, বৃহত্তর স্কেলের দিক থেকে দেখলে যা বিশাল এক রঙ্গমঞ্চের অতি ক্ষুদ্র কিনারে ঘটে যাওয়া এক তামাশামাত্র। খুব বেশি হলে কোনো বিচারকের পক্ষে এখানে এটুকুই শুধু বলা সম্ভব যে পরিবেশের একটা হাত আছে এতে, যা চিরকালই থাকে। পরিবেশ : অন্ধকার রাস্তা, হ্যালুসিনেশন, হেকলার অ্যান্ড কোচের ঝলকানি, লীলাবতী হাসপাতাল, পাম বিচ ক্রিকের লাশ, ঘাটকোপার, শ্রীপেরুমবুদুরের গা-ছমছম রাত, রাত দুটোর কালইয়ান স্টেশন, অস্ত্রধারী গার্ডদের টর্চের আলো, এবং গাড়ির ভেতরের বদ্ধ স্পেস। পরিবেশ। রোদ বেশি ছিল তাই গুলি চালিয়েছি, লিফট অন্ধকার ছিল তাই পাশের লোকটা বেশি কাছে চলে আসতেই তাকে গালি দিয়েছি, ঠান্ডা অনেক পড়েছিল তাই বিড়ালের গায়ে গরম পানি ঢেলে দিয়েছি, বহুদিন ধরে অনবরত বৃষ্টি পড়ছিল তাই ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছি, গোরস্থানের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম তাই ভিক্ষুকের থালা পা দিয়ে মাড়িয়ে দিয়েছি। পৃথিবীর নিত্যদিনের চিত্র এটা—এই নৈরাজ্য, এই বাইরের প্রাকৃতিক শক্তির টানাপোড়েন থেকে ঘটা বিশৃঙ্খলা। আমি আর নিতে পারলাম না গাড়ির ভেতরের ছোট স্পেসের বিভীষিকাকে। নিয়তির প্রতি আমার এই জঘন্য আস্থার কারণে একসময় আমার নিজেকে মনে হতে লাগল আমি সেই দরবেশ যে ‘তার সব প্রার্থনা ফেলে রেখে তাকিয়ে দেখছে তার বালুঘড়িটাকে … এবং একসময় সে শুনতে পেল সময়ের বিপর্যয়।’ আমার পক্ষে নিজের লজ্জা আর বাড়তে দেওয়া সম্ভবপর মনে হলো না। আমি যত তাড়াতাড়ি পারা যায় এই আইয়ার, এই মানুষের-মরতে-আসা রিলকের জঘন্য, জঘন্য প্যারিস শহর থেকে নিজেকে আগলে রাখবার ইচ্ছায় দ্রুত গাড়ি ছেড়ে হোটেলে ঢুকে পড়লাম। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *