আগস্ট আবছায়া – ১.৯

১.৯

বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত দুটো পাঁচ বাজল। জামাকাপড় খুলে স্রেফ হাফপ্যান্ট পরে খালি গা হতে হতে দুইটা নয়। এক কাপ রং-চা বানাতে বানাতে দুইটা চৌদ্দ এবং চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আমার লেখালেখির টেবিলে বসে মাসুম হায়াত-মজনু—কদিন আগের ঢাকা এয়ারপোর্টে দাঁতে পোকা ধরা চার গ্রাম্য চীনা স্মাগলার আর ঠিক এ মুহূর্তে কী করছে মেহেরনাজ, কোথায় কার বিছানায় কীভাবে শুয়ে আছে—এ কটা জিনিস ভাবতে ভাবতে দুইটা ষোলো। ২:১৬। ২১৬। আমার ক্যাডেট নম্বর। মনে পড়ে গেল, ছয় বছরের অতগুলো দিন ও অতগুলো রাত একসঙ্গে কাটানো বন্ধুদের কথা। ২১০-রেজাউল মজিদ। ২১১-রুহুল আলম। ২১২-সামাদ। ২১৩ -সানোয়ার। ২১৪ —শরিফ। ২১৫ –সিদ্দিকী। ২১৬—আমি। ২১৭ – মাহফুজ। ২১৮-তরিকুল। ২১৯-তৌহিদ। ২২০—ইউসুফ। ২২১ — জাহিদ। ২২২-জুলফিকার। এ রকম। 

কে কোথায় হারিয়ে গেছে ওরা এই তেত্রিশ বছরের মহাপ্লাবনে? ২৩৫ -মাহবুব। একমাত্র তার ঠিকানাই পরিষ্কার জানি আমি, যেহেতু সামরিক বাহিনীর কমান্ডো ট্রেনিংয়ে, কলেজ থেকে বেরোনোর মাত্র কয় বছরের মাথায়, সিলেটের এক জঙ্গলে গ্রেনেড হাত থেকে পড়ে অসময়ে পিন খুলে গিয়ে সে ছিন্নভিন্ন হয়ে গাছের পাতায় পাতায়, কাণ্ডে, ঘাসে ছড়িয়ে গিয়েছিল নিজেকেই—মিলি সেকেন্ডের জন্য—তুমুল অবাক করে দিয়ে। আমি শুনেছি, লেফটেন্যান্ট মাহবুবের চারপাশ ঘিরে ছিল জায়ফলের গাছে। তাদের সবুজ কালো মসৃণ বাকল ও গোল গোল ঝুলে থাকা হালকা সবুজাভ সাদা অসংখ্য ফল সব মেখে গিয়েছিল তার এক মাথা ভরা মগজ ও এক শরীর ভরা হাড়ের গুঁড়ো দিয়ে, গুমোট এক রঙিন চুনকামে। ক্যাডেট কলেজে থাকতে আমরা এক বিশেষভাবে ছবি আঁকাকে বলতাম স্প্রে পেইন্টিং। কাগজ কেটে একটা ফুল বা নকশা বানাও, তারপর সেটা রাখো সাদা কাগজের ওপরে, এবার টুথব্রাশে রং লাগিয়ে পাকা হস্তশিল্পীর মতো ব্রাশটা নাড়তে থাকো সামনে-পেছনে, আঙুল দিয়ে। জায়ফল বাগানের গাছে, ঘাসে, কাণ্ডে, ফলে সেই স্পে পেইন্টিং হয়ে গিয়েছিল বাইশ বছরের মাহবুব। 

গলায় পিন গেঁথে প্রায় মরতে বসা মজনু এবং গ্রেনেডের পিন খুলে জায়ফলগাছের জঙ্গলকে রঙের নকশায় ডুবিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া আমার বন্ধু মাহবুব-এ দুজন আমার চোখকে মার্বেল বানিয়ে বসিয়ে দিল ফোনের ডিজিটাল ক্লকটার ওপরে। আমি দেখলাম, সময় স্থির হয়ে আছে 2:16-তে, সে কোনোভাবেই আর 2:17 হচ্ছে না, 2:18 -ও না। কারণ, সে চাচ্ছে আমি দাঁড়িয়ে থাকি আমার নিজের ক্যাডেট নম্বর ২১৬-তেই এবং মাথায় হাত দিয়ে এই টেবিলে বসে ভাবতে থাকি তেত্রিশ বছর আগের কলেজ ক্যাম্পাস থেকে উড়ে আসা হাওয়া এরই মধ্যে কতটা তেড়ে বেরিয়ে গেছে অনন্ত সময় পথের ফাঁকা ছিদ্রপথগুলো দিয়ে, আমার জন্য শুধু এক মতিভ্রান্তের সামান্য হিতাহিতজ্ঞানটুকু রেখে—কোনো উন্মাদের রাস্তা পার হবার জ্ঞান বা ড্রেনে না পড়বার জ্ঞান। 

ওটুকু জ্ঞান মাথায় নিয়েই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এখন ঘুমাতে যাব না, কাফকার কাজে হাত দেব, পরে রাত চারটার দিকে দেখব ঘুম আসে কি না। কাল শুক্রবার হওয়ার কারণে এমনিতেই ক্লাস নেই, পরপর দুদিনের ছুটি। আমি অনেকগুলো বই থেকে বেছে নিলাম ফ্রানৎস কাফকা দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না অ্যান্ড আদার স্টোরিজ। বইটার মূলে না গিয়ে পড়তে লাগলাম অতি ক্ষুদ্র ফন্টে লেখা ইনার, যেখানে সব পাবলিকেশন ডেটা থাকে। দেখলাম লেখা আছে : “ট্রান্সলেশন কপিরাইট (ম্যালকম প্যাসলি,।973 /অল রাইটস রিজার্ভড/ফ্লিমসেট ইন লেসারকম্প এহরহার্ট/দিস ট্রান্সলেশন ফার্স্ট পাবলিশড আন্ডার দ্য টাইটেল/শর্টার ওয়ার্কস’, ভলিউম ওয়ান বাই মার্টিন সেকার অ্যান্ড ভারবুর্গ।973।’ তারপরে পেঙ্গুইন বুকসের নানা দেশের নানা অফিসের ঠিকানা এক সারিতে সাজানো, এর মধ্যে সাউথ আফ্রিকার অফিস দেখলাম Rosebank নামের এক জায়গায় — Penguin Books (South Africa) (Pty Ltd, 24 Sturdee Avenue, Rosebank 2196, South Africa। 

‘রোজব্যাংক’ শব্দের ধ্বনিমাধুর্য, রং ও গোলাপের গন্ধের মধ্যে আমি আটকে থাকলাম বেশ দীর্ঘ সময়, তাকিয়েই থাকলাম শব্দটার দিকে, যতক্ষণ না শব্দটা আকারে বড় থেকে বড় হতে হতে একসময় পৃষ্ঠার ওপর থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে ভেসে আসতে লাগল আমার চোখের দিকে, তারপর আমার চোখের পাতাকে সামান্য স্পর্শানুভূতি দিয়ে ঢুকে গেল কর্নিয়ার ভেতরে, ঢেউ হয়ে মিশে গেল মাথার বিশাল ইঞ্জিনটার কোথায়ও। 

বইটা পাশে সরিয়ে রেখে আমি ল্যাপটপের ইন্টারনেটে গুগল সার্চ দিলাম ‘জোসেফ সেভেরন’। ‘ইমেজেস’ অপশনে গিয়ে সেভেরনের সেল্ফ পোর্ট্রেটের পাশে—যেখানে তার মুখের একটা পাশ দেখা যাচ্ছে, মুখ সামান্য খোলা সম্ভবত, চেহারা মাত্র গোসল সেরে আসা এক বালকের, মাথার কোঁকড়ানো চুলের মধ্যে ভেজা ভেজা একটা ভাব, জামা কোনোভাবে রেখা টেনে টেনে আঁকা এবং চোখের দৃষ্টি কোনো ছাত্রের-সেভেরনের নিজের আঁকা এই সেলফ পোর্ট্রেটের পাশেই পেলাম ১৮১৯ সালে সেভেরনের আঁকা কবি জন কিটসের বুকের স্পন্দন থামিয়ে দেওয়া এক পোর্ট্রেট। কিটসের চুল তিনি করেছেন সোনালি আভা মেশানো কালো, মূলত সোনারং, আর কিটস তাঁর বাঁ গালে হাত রেখে, ডান হাত টেবিলের ওপরে বসিয়ে, ডান হাতের আঙুলগুলো ভাঁজ করে একটা কাগজের ওপরে রেখে, ডান গালে চোখের নিচে হালকা এক লালিমা নিয়ে, ঠোঁটে গোলাপির এক স্পষ্ট দ্যুতি ছড়িয়ে, তাঁর দুই নীল চোখের মণিতে বিস্ময় ও জিজ্ঞাসা ভরে তাকিয়ে আছেন সামনের কোথায়ও, সম্ভবত বদ্ধ কোনো ঘরের দেয়ালের দিকে, কোনো ছবি বা লেখার দিকে, কোনোভাবেই উন্মুক্ত কোনো বিস্তারের দিকে নয়, যেমন সমুদ্র, সমতল, পাহাড়; আবার একই সঙ্গে ২৪ বছর বয়সের এই তরুণের তাকানোর মধ্যে এটাও স্পষ্ট যে তাঁর এই চোখ, মৃত্যুর মাত্র দুবছর আগের এই চোখজোড়া, অমরত্ব খুঁজছে বদ্ধ এক ঘরে বসেই-হয় অমরত্ব, না হয় ফ্যানি ব্রঅনকে কাছে পাবার পথ 

না, অমরত্ব বা গ্রহণযোগ্য এক বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকার গ্যারান্টি না, আমার মনে হলো তাঁর দুই চোখ বরং ফ্যানি ব্রঅনকেই খুঁজছে এখানে, তাই চোখ দুটো এত উজ্জ্বল হওয়া সত্ত্বেও কোথায় যেন বোঝা যাচ্ছে তাঁর বুকের কষ্ট তাঁর দৃষ্টিকে ঘোলা করে দিয়েছে সামান্য হলেও। ছবিটা যখন সেভেরন এঁকেছেন তত দিনে, আমার ধারণায়, কিটসের বোঝা হয়ে গেছে যে ঈশ্বর কত বড় এক ঠাট্টা-শিল্পী, তিনি কীভাবে অযোগ্য (আশা করবার যোগ্যতাহীন অর্থে) এক প্রাণীর মধ্যে অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা ঢুকিয়ে দিয়ে সেই প্রাণীটাকে বসিয়ে দিয়েছেন এক নশ্বরতার বাক্সে, যেন এই প্রাণী, মানুষ নাম, তার তীক্ষ্ণ সচেতনতা ও বুদ্ধি থাকার কারণে বাক্সের চারপাশে ছুটে বেড়াতে থাকে পাগল হয়ে যাওয়া ইঁদুরের মতো করে। ঠিক এ কারণেই কিটসের মতো তুখোড় মেধার এক তরুণের অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা দুই চোখে ভরে তাকিয়ে থাকার কথা নয়। 

বরং এটাই স্বাভাবিক যে ছবিটা আঁকার সালে, ১৮১৯ সাল, কিটস যেহেতু তাঁর নিজের যক্ষ্মারোগের খবর জেনে গেছেন এবং মৃত্যুর ছায়ার নিচে দাঁড়িয়েই প্রেমে পড়েছেন ফ্যানি ব্রঅনের (যে প্রেম পূর্ণতা পায়নি কোনো দিন), তাই এটাই হবে হয়তো যে এই ছবিতে কিটসের দৃষ্টির মধ্যে আছে প্রেম ও মৃত্যুর এক পরস্পরবিরোধী সহাবস্থান, যা বিধিশাস্ত্ৰ মেনেই, চরিত্রে ঘোলাটে। 

ইন্টারনেটে এই ছবির ব্যাপারে তথ্য খুঁজতে খুঁজতে আমি পেয়ে গেলাম ১৩ অক্টোবর ১৮১৯-এ ফ্যানিকে লেখা কিটসের একটা চিঠি : ‘আমার প্রেম আমাকে স্বার্থপর বানিয়ে দিয়েছে। আমি তোমাকে ছাড়া আমার অস্তিত্বের কথা ভাবতে পারি না-তোমাকে আবার দেখার ব্যাপারটা ছাড়া বাকি সব আমি ভুলতে রাজি—আমার জীবন থেমে গেছে ঠিক ওই জায়গাটাতেই—আমি এর বেশি কিছু দেখতে পারছি না। তুমি আমাকে শুষে নিয়েছ। ঠিক এ মুহূর্তে আমার অনুভূতি এমন যে আমি যেন দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছি—তোমাকে শিগগির দেখবার আশাটুকু না থাকলে কী রকম ভয়ানক দুর্দশায় পড়ব আমি…মানুষ যে ধর্মের জন্য শহীদ হতে পারে, তা ভেবে আমার অবাক লাগে—ওই ভাবনা আমাকে আমূল কাঁপিয়ে দেয়—কিন্তু আর আমি কাঁপি না তাতে—আমি আমার ধর্মের জন্য শহীদ হতে রাজি-প্রেম আমার ধর্ম—ও জন্য আমি মরতে পারি—তোমার জন্য আমি মরতে পারি। 

এই চিঠি লেখার এক বছর চার মাস দশ দিনের মাথায় মারা গেলেন কিটস, জোসেফ সেভেরনের দুই বাহুর মধ্যে শুয়ে রক্ত ও কফের ঢেউ তুলে। রোম থেকে লন্ডনে ফ্রান্সেস (ফ্যানি) ব্রঅনের কাছে সেই খবর পৌঁছাল এক মাস পর। ফ্যানি তাঁর প্রতি কিটসের ভালোবাসা ও কিটসের চোখে মৃত্যুর মেলানো মেশানো দোটানাভাব দৃষ্টির কথা স্মরণ করে শোক করলেন ছয় মাস, তারপর নিজেকেই অবাক করে দিয়ে বিয়ে করে তিন সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকলেন আরও চল্লিশ বছর। 

টিং করে শব্দ হলো আমার ফোনে। মেহেরনাজের এসএমএস। এসএমএস হিসেবে আকারে বিশাল, প্রায় ই-মেইলের মতো। রাত আড়াইটায় মেহেরনাজ লিখেছে আমাকে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক, কারণ শত ব্যস্ত এই মেয়েকে আমি কখনো দেখিনি রাত জেগে এসএমএস ইত্যাদি লিখে প্রেম করতে। তার কাছে জীবন অনেক ধরনের অনেক কাজে ভরা এক বাস্তবতা, যেখানে রাতের ঘুম নষ্ট করে প্রেম-ট্রেম স্রেফ শিশুতোষ কিছু। 

আমি এক টানে পড়ে ফেললাম তার কথাগুলো, ইংরেজিতে, যা বাংলা অনুবাদে দাঁড়ায় এ রকম: ‘মুখের মধ্যে অনেক তিক্ততার স্বাদ নিয়ে আজ তোমার বাসা থেকে এসেছি। তোমার বরফশীতলতা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে এতটা কাল আমি তোমার হৃদয়হীন খেলার চক্করে পড়ে তোমার কাছে এক্সপ্লয়েটেডই হয়েছি শুধু। আজ রাতে আমাকে দেওয়া তোমার এই বিয়ের প্রস্তাবের মধ্যে না ছিল আন্তরিকতা, না কোনো প্রত্যয়। ওই কথাটা তোমার সব কথার মতোই হঠাৎ বলা, আবেগ দেখানো ও চমকে দেওয়ার তোমার যে চিরাচরিত ঝোঁক, তারই এক উদাহরণ। আমি আজ তোমাকে বলেছি আমার ব্যক্তিগত জীবনের অনেক গোপন কিন্তু সত্যি কিছু কথা, বলেছি কেন আমি বিয়ের ধাঁচে গড়া নই। কিন্তু সত্য হচ্ছে, তুমি আমার চাইতে অনেক বেশি বিয়ে-সংসারের উল্টো পথের মানুষ। তুমি বেসিক্যালি স্বার্থপর ও অমানবিক চরিত্রের এবং তুমি খুব ভালোভাবে জানো উদাসীনতা ও নীরবতা দিয়ে, বইয়ের জগতের চরিত্রগুলোর সাহায্যে নিজের চারপাশে দেয়াল তুলে, কী করে তোমার নিজের অমানবিকতা ও স্বার্থপরতার দোষটুকু অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায়। শেষ মুহূর্তে, আমার চলে আসার শেষতম মুহূর্তে, আমাকে যে রকম নির্লিপ্তভাবে তুমি নিৎশের স্মৃতিচারণার ওই অর্থহীন গল্পটা শোনালে, তাতেই আমার কাছে পরিষ্কার যে আমাকে কোনো দিন বোঝোনি তুমি, আমার জন্য সামান্য কমিটমেন্টও তোমার নেই, পৃথিবীর কারও জন্যই তোমার কোনো কমিটমেন্ট নেই, না আমি, না সুরভি, না তোমার মা-ভাই-বোন, কারও জন্যই। তাই আমি সর্বান্তঃকরণে চাচ্ছি আমাদের মধ্যে আর কোনো দিন দেখাসাক্ষাৎ না হোক। রিগার্ডস, মেহের।’ 

কী উত্তর দিতে পারি আমি এই মেসেজের? আমার মনের ভেতরের এক সমুদ্র বিষণ্ণতা ও ঘৃণা থেকে জাগা অন্তঃসারশূন্যতার বোধ আমাকে মেহেরনাজের প্রতি আজ উদাসীন করে তুলেছিল, এটুকু ছাড়া আর কিছু মনে করতে পারলাম না। আর কী অন্যায় আচরণ করেছি আমি তার সঙ্গে? বুঝলাম না, কিছুই বুঝলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম, তার এই মেসেজের কোনো উত্তরই দেব না। মাসুম হায়াত ও মজনু পার হয়ে সেভেরন-কিটস্ -ফ্যানি ব্রঅনের এই অধ্যায়ের পর এমনিতেও কোনো অর্থ হয় না তার মেসেজের উত্তর দিতে চাওয়ার, এটুকু পরিষ্কার। ফোন বন্ধ করলাম, সুইচ অফ করা যাকে বলে, তারপর ইভান তুর্গেনেভের মতো আঙুল নাড়িয়ে, হাত মাথার ওপরে তুলে ‘স্লাভ কুয়াশা’ তাড়িয়ে আবার ইন্টারনেটে ফিরলাম রবার্ট ক্লপস্টককে জীবনে প্রথমবারের মতো দেখব, তাই। 

.

চশমা পরা চল্লিশোর্ধ্ব এক যুবকের বিষণ্ণ মুখ, ছবির রং সেপিয়া, চেহারা প্রায় হতভাগ্য এক রোমান্টিকের, যে কিনা আবার জীবনের প্রতি আলগোছে ঝুলে থাকা এক একাগ্রতায় মগ্ন। এ রকমই মনে হলো আমার ক্লপস্টককে দেখে—সত্যনিষ্ঠ ও কপটতাহীন, দীর্ঘদেহী, চওড়া, লাল-গালের একজন ভালো মানুষ। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার ১৬ জুন ১৯৭২ তারিখের শোকবার্তা পড়লাম, লেখা: ‘রবার্ট ক্লপস্টক, বক্ষবিষয়ক সার্জন। ড. রবার্ট ক্লপস্টক, খ্যাতনামা ফুসফুস সার্জন, গতকাল নিউইয়র্কের কর্নেল মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালে মারা গেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭২। তিনি থাকতেন ওয়েস্ট ফিফটি সেভেন্থ স্ট্রিটের ৬০ নম্বর বাড়িতে। ডক্টর ক্লপস্টক এ বছরের শুরুতে তাঁর অবসরে যাওয়ার আগে ব্রুকলিনের ভেটেরানস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন হাসপাতালের বক্ষব্যাধি সার্জারির প্রধান ছিলেন… ফুসফুসের সার্জারিতে তিনি ছিলেন এক অগ্রদূত, মেডিকেল জার্নালগুলোয় লিখেছেন প্রচুর। ১৯২০ সালে ডক্টর ক্লপস্টকের সঙ্গে এক যক্ষ্মারোগীদের স্যানাটরিয়ামে দেখা হয় ফ্রানৎস কাফকার, তাঁরা দুজনেই ছিলেন রোগী। যখন কাফকার স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়া শুরু করে, ডক্টর ক্লপস্টক তখন বার্লিনে তাঁর চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়াশোনায় বিরতি দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি উৎসর্গ করেন কাফকার সেবাযত্নে। ১৯২৪ সালের ৩ জুন তারিখে ভিয়েনার কাছের এক স্যানাটরিয়ামে কাফকা ড. ক্লপস্টকের হাতের ওপরে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ড. ক্লপস্টকের জন্ম হাঙ্গেরির ডোমবোভারে; তিনি পড়াশোনা করেছেন প্রাগ, কিয়েল ও বার্লিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি আমেরিকা আসেন ১৯৩৮ সালে…।’ 

আমি একমনে তাকিয়ে থাকলাম কাফকার এই বন্ধুর দিকে। আমাদের মধ্যে পৃথিবীর অন্তঃসারকে সবচেয়ে স্পষ্ট করে চিনে ফেলা এই লেখকের মৃত্যুর মুহূর্তের রবার্ট ক্লপস্টকই, নিশ্চিতভাবে, ছিলেন একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী, যেহেতু এমন অনুমান আছে যে মৃত্যু ঠিক যখন কাফকার কোল ঘেঁষে আসে, সে ক্ষণটায় তাঁর বান্ধবী ডোরা ডিয়ামান্ট সম্ভবত পাশের ঘরে গিয়েছিলেন কিছু একটা আনতে। ফ্রানৎস কাফকার সেবায় বার্লিনে নিজের পড়াশোনা ছেড়ে চলে আসা, তাঁর মৃত্যুমুহূর্তের একমাত্র সাক্ষী হয়ে থাকা এবং পরে ১৯৩৮ সালে নাৎসিদের থাবা থেকে পালিয়ে আমেরিকা এসে এত বড় মাপের ডাক্তার হয়ে ওঠা—এ তিন মিলে বোঝা গেল কেন নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতো পত্রিকা তাঁর মৃত্যুতে শোকবার্তা ছেপেছে। 

কাফকার মৃত্যুর চুয়ান্ন দিন পরে, কাফকার আদেশমতোই, ক্লপস্টক বার্লিনে ফিরে গিয়েছিলেন ডাক্তার হতে—বন্ধুর মৃত্যুতে বুকচাপা কান্নায় বাকরুদ্ধ হয়ে। আর এ ঘটনারই চৌদ্দ বছর পর, তত দিনে তিনি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত এক সার্জন, তাঁকে জার্মানি ছাড়তে হলো, আবারও রুদ্ধবাক স্তব্ধবাক, গ্যাস চেম্বারে কিংবা স্রেফ মাথার পেছনে গেস্টাপোর একটা গুলিতে প্রাণ হারানোর ভয়ে। তিনি পালাচ্ছেন অচেনা আমেরিকার দিকে, ধরা পড়লেই কুকুর-বিড়ালের মতো মৃত্যু অবধারিত, না, স্রেফ কোনো মশা বা মাছির মতো, হাতের থাপ্পড়ে বা বুটের তলায়, আর তাঁর মনে পড়ছে কাফকার কথা, নিঃসহায় পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার যাতনা নিয়ে কাফকার সংশয়ভরা বড় চোখের দৃষ্টির কথা, কীভাবে মানুষের মৃত্যু দেখে কাফকা অবাক হয়ে যেতেন জন্ম ব্যাপারটা নিয়েই, সেসব। 

বহু বছর পরে একদিন দূর অতীতের স্মৃতিগুলো মনে করে রবার্ট ক্লপস্টকের কপালের দুপাশ বেয়ে ঘাম ঝরতে লাগল নিউইয়র্কের শীতের ভোরবেলায়। তুমুল হাহাকার করে উঠল তাঁর বুকের গহিনে, অবোধ্য এক ব্যথাসহ, যখন তিনি মনে করলেন কাফকার একটা ছোট কাগজের স্লিপের কথা, যেখানে কাঁপা কাঁপা হাতে মৃত্যুগামী মানুষটা লিখেছেন : ‘রবার্ট, তোমার হাতটা একটু এক মিনিট আমার কপালের ‘পরে রাখো, তাহলে সাহস পাব।’ এতটা মৃত্যুভয় ঘিরে ধরেছিল এই জীবন-মৃত্যুর দুপাশ সম্বন্ধে এতখানি বোদ্ধা ও আত্মজ্ঞ মানুষটাকেও? 

ঠিক তখনই রবার্ট ক্লপস্টকের মনে পড়ে গেল, এতক্ষণ যেটা মনে করতে চাইছিলেন তিনি নানাভাবে কিন্তু যা কিনা তাঁর স্মৃতিতে ধরা দিচ্ছিল না, শুধু তাঁকে নিয়ে যাচ্ছিল স্বপ্ন মনে করার সংগ্রামের এদিক-ওদিকে। তাঁর মনে পড়ল তন্দ্রা থেকে জেগে ওঠার আগে কী স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি কাফকাকে নিয়ে, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের এক বাস্তব ঘটনার স্বপ্নরূপ। কাফকা তাঁকে স্যানাটরিয়ামের গেটের সামনে একদিন হঠাৎ তাঁর কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন প্রায় ম্রিয়মাণ এক স্বরে : ‘দ্যাখো রবার্ট, ফুলগুলো কী সুন্দর! লাইলাক ফুল-মরে যাচ্ছে সে, দ্যাখো এটাকে, তবু কীভাবে পানি শুষে চলেছে, কী সুন্দর শিশিরের পানি গিলছে ঢক ঢক।’ তারপর আচম্বিতে তাঁর কাঁধের ভেতরে যেন ঢুকে বসে গেল কাফকার লম্বা আঙুলগুলো, তিনি রীতিমতো আঁকড়ে ধরলেন তাঁকে কোনো এক প্রণোদনা থেকে এবং মৃদু কিন্তু জেদি এক খেপা স্বরে বললেন : ‘যে পৃথিবী থেকে আমি চলে যাচ্ছি রবার্ট, তোমাদেরও পালাতে হবে সেখান থেকে। ইহুদি পাড়াগুলোর রাস্তাঘাট কত নোংরা!’ 

.

আজ স্বপ্নে সেই অবিকল দৃশ্যটা দেখে, তারপর ১৯৩৮ সালে নাৎসি খাঁচার ভেতরে আটকে পড়া এক ইঁদুরের মতো কোনোভাবে সামান্য একটা ফোকর, একটা সামান্য ফাটল খুঁজে নিয়ে পালানোর কথা মনে করে, পেছনে ইহুদি ঘেটোর অন্ধকার ও জার্মান প্যানজার ট্যাংকের রোটেটিং টারেটে ঘোরা ২০ মিলিমিটার গান ও মেশিনগানের রাস্তা কাঁপানো দানবিকতা থেকে ছুটে, ড্রেনের আবর্জনা ইঁদুরেরই মতো গায়ে মেখে বেঁচে থাকার জন্য ছোটার কথা মনে করে আকস্মিক মূর্ছা গেলেন তিনি। সোজা পড়ে গেলেন ধুম করে চেয়ার থেকে ঠান্ডা মেঝেয়। ‘কী হয়েছে, কী হয়েছে?’ বলে চিৎকার করতে করতে ঘরের এদিকটায় ধেয়ে এলেন তাঁর সন্তানহীনা স্ত্রী গিসেল ডিউটশ। 

ততক্ষণে আমি ঘোরগ্রস্ত, বাহ্যজ্ঞানহীন। একবারও আমার মনে হলো না রাত কটা বাজে। চারটে বাজলেই কী! 

হ্যাঁ, ঘড়িতে দেখলাম ৪টা বেজে ৯ মিনিট। ল্যাপটপ স্ক্রিনে তখন ঘোর অন্ধকার। কি-বোর্ডে চাপ দিতেই উদ্ভাসিত হলো রবার্ট ক্লপস্টকের প্রবোধদায়ী মুখ, যেন সে আমাকে বলতে চাইছে যে আমি পালিয়ে বেঁচেছি ঠিকই, তবু বাঁচতে পারিনি; আমার চেহারার সেপিয়া-রং বিষণ্ণতার মধ্যে তুমি মৃত্যুভয়কে দেখতে পাচ্ছ নিশ্চয়ই, কিন্তু মৃত্যুকামনা ও সেখানে লুকিয়ে আছে দ্যাখো। যোগ্য, অযোগ্য, সুন্দর, কদাকার, সংস্কৃতমনা কিংবা গাড়ল, সচ্চরিত্র কিংবা দুর্নীতিগ্রস্ত—সবাই ধুলো হয়ে যাবে একদিন এবং তাদের মধ্যে যদি কারও সৃষ্টিকর্ম থেকে থাকে তো— হোক তা ছেলেমেয়ে কিংবা বই-পেইন্টিং-সংগীত—সেগুলো ধুলোয় মিশবে বেশি দিন পরে নয়, সম্ভবত তাদের আগেই আর একসময় তুমি দেখবে যে কিছু ভাববাচক বিশেষ্য ছাড়া পৃথিবীকে তার কক্ষপথে ধরে রাখবার মতো আর কিছু হাতে নেই তোমার, স্রেফ কিছু ভাববাচক বিশেষ্য, যেমন : জীবনের সত্য, আত্মার মুক্তি, নৈতিক যুক্তি, প্রাণের সারবত্তা, বিশ্বাস ও প্রত্যয়, সত্যের পথ, মানবিকতা, সমঝোতা, আমাদের ঐক্যবদ্ধতা, পবিত্রতা। ভালো। 

আমার প্রচণ্ড হাসি পেতে লাগল ভাষার এসব তামাশাকে মানুষ কত ভালোবাসে, তা চিন্তা করে। 

অবশেষে বহু পথ হেঁটে এসে, নিজের প্রতি কিছু ভাববাচক বিশেষ্য ছুড়ে দিয়ে—যেমন ওয়াদা, দায়িত্ববোধ ও ঔচিত্য—আমি আবার, রাত ৪টা ১২ মিনিটে, ১৪ আগস্ট ২০১৫ তারিখে প্রস্তাবিত ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড বইয়ের অনুবাদ নিয়ে বসলাম। 

.

কাফকার দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না। চীনের মহাপ্রাচীর। বোর্হেসের হিসেবে কাফকার সবচেয়ে সেরা গল্প এটাই—ছাড়া ছাড়া, আপাতত সংহতিহীন, আপাত-অ্যাবসার্ড এক আবহ, কিন্তু একই সঙ্গে পুরো পৃথিবীর ও পৃথিবী নিবাসী মানুষের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যকে যুক্তিপূর্ণ করে তোলার প্রকল্পগুলো বিষয়ে তীক্ষ্ণ এক নিরীক্ষণ, এবং আমার সংকীর্ণ হিসেবে পনেরোই আগস্টের কালরাতের এক রাত আগে দাঁড়িয়ে আমার কাছে এ গল্প বিশাল পৃথিবীর পাশাপাশি বাংলাদেশের এক প্রচণ্ড অধ্যায়ের নিগূঢ়ার্থ ধরে রাখা এক প্রতিবেদন দ্রুত পড়তে লাগলাম গল্পটা। 

গল্পের মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছে গেছি, হঠাৎ বাধা পড়ল। ফজরের আজান দিল কাছের মসজিদে। এখন কত কত মানুষ ঘুম ছেড়ে উঠে যাবেন ওখানে যাওয়ার জন্য, কত কত মানুষ বাসায় অজু করে জায়নামাজে দাঁড়াবেন। আমার আবার মনে হলো, কীভাবে আমরা মানুষেরা ব্যাখ্যা ও সান্ত্বনা চাই এক অদৃশ্য শক্তির। আমি দুটো কথা ভাবি এখানে, দুই প্রান্তের দুটো কথা। আমাদের মানবতাবাদী চেতনা মানুষকে জন্তুর থেকে উচ্চতর স্থানে দেখার এক চেতনা, আর ওই জায়গাটাই এসেছে ধর্মীয় বোধ থেকে। প্রত্যেক ব্যক্তিমানুষ পবিত্র এক সত্তা এবং জন্তুর থেকে অনেক উচ্চ স্তরের তার ভেতরকার শাঁস, এ রকম বোধটাই এসেছে আরও গোঁড়ার ধর্মবিশ্বাস থেকে যেখানে বলা হচ্ছে চির-অনন্ত আত্মার কথা। অবিনশ্বর আত্মা ও সেই আত্মার স্রষ্টা খোদার কথা না বললে, আমার কাছে পরিষ্কার যে আমরা ব্যক্তিমানুষকে তার মহিমান্বিত স্থানে বসাতেই পারতাম না। মানুষ, যার ঘাড়ের ওপরে মাথা বসানো ধুম করে, সামনে ঝুঁকে থাকা যার স্বভাব ও কাঠামোর অন্তর্গত, এবং যার দুই হাত শরীরের চলার সঙ্গে সামনে-পেছনে ছোটে, যার দুই পায়ের মাঝখানে এক ক্ষুদ্র জননাঙ্গ ও অণ্ডকোষ ওভাবে ঝুলতে থাকে এবং যে কিনা রোজ দুর্গন্ধযুক্ত মল ত্যাগ করে মূত্রত্যাগের পাশাপাশি আর নারী হলে যাকে প্রতি মাসে মুখোমুখি হতে হয় এক বিশ্রী রক্তপাতের—আমাদের জন্য খুব বিব্রতকর ও কঠিন হয়ে যেত সেই মানুষকে অনন্ত আত্মার ধারণায় না সাজিয়ে তার ওই জন্তুর অবস্থান থেকে ওপরে তুলে আনার চেষ্টা করাটা। এরই বিপরীতে আমার মনে হয়, ধর্ম না থাকলে নৈতিকতার ধারণা আসত কোত্থেকে? সামাজিক কাঠামোই তো ভেঙে যেত তাহলে। বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিক শ্রেণির বাইরেও, একেবারে সমাজের নিম্নস্তর পর্যন্ত, যদি সবাই জেনে যেত যে ধর্ম নেই, তাহলে প্রথম কথাই তো উঠত যে আমাকে ভালো ব্যবহার বা সদাচরণ করতে হবে কেন? 

চেয়ার থেকে উঠলাম, সামান্য হেঁটে সাদা দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ভয়ানক অস্থিরতা হচ্ছে ভেতরে। মানুষ যা, ধর্ম কি মানুষকে তার চাইতে বেশি ভালো করে? আর ধর্ম না থাকলে মানুষ কি সে যা তার চাইতে আরও খারাপ হয়ে যায়? আমার মনে হলো, মাত্র এই একটা কথার যদি অবজেকটিভ উত্তর পাওয়া যেত, যে উত্তর কারও বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের নাড়ি দিয়ে কোনোভাবে মোড়ানো নয়, তাহলে আমাকে এই পৃথিবীতে আর অনিদ্রা ও বিষণ্ণতায় ভুগতে হতো না। 

আজান শেষ হয়েছে। আমি লেখা বন্ধ করে তাকিয়ে আছি মাত্র কদিন আগে অনুবাদ করা এই গল্পের গা-ছমছমে অংশটার দিকে : 

সম্রাটের চারপাশে সর্বক্ষণ থিকথিক করছে মেধাবী কিন্তু শয়তানিতে ভরা রাজন্যের দল, চাকর ও বন্ধুর বেশ দিয়ে তারা তাদের বদমায়েশি ও শত্রুতাকে ঢেকে রেখেছে, তারা সম্রাটের ক্ষমতার বিপরীতমুখী শক্তি, বিরামহীন চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের বিষমাখা তির দিয়ে কীভাবে সম্রাটকে তাঁর আসন থেকে সরাবে। সাম্রাজ্য অবিনশ্বর, কিন্তু কোনো ব্যক্তি সম্রাট ঠিকই সিংহাসনের উঁচু থেকে নিচুতে পড়েই যেতে পারেন; এমনকি পুরো রাজবংশেরও শেষে গিয়ে ভরাডুবি হতে পারে, এক একযোগের মৃত্যুচিৎকারে বংশের সবাই তাঁদের শেষনিশ্বাস ছাড়তে পারেন। এই সব সংগ্রাম ও যাতনার কথা সাধারণ মানুষ কোনো দিন জানতে পারে না; তারা দেরিতে আসা লোকদের মতো, কোনো শহরে ঢোকা আগন্তুকের মতো, লোক-গিজগিজ গলিপথের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে থেকে চুপচাপ চিবুতে থাকে দেশের বাড়ি থেকে আনা তাদের খাদ্য খাবার, যখন কিনা তাদের সামনের দিকে দূরে শহরের মাঝখানের মার্কেট স্কোয়ারে দেখা যায় এগিয়ে চলেছে তাদের শাসককে ফাঁসিতে ঝোলানোর কাজ। 

বিশ্বাসঘাতকতা ও বেইমানি মানুষের মজ্জাগত। রাজাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে এবং প্রজারা যার যার বিছানা-বালিশে শুয়ে হাই তুলছে, এটা ইতিহাসে ততটাই স্বাভাবিক, যতটা স্বাভাবিক ঐতিহাসিক সত্যগুলোর ভেতরে মিথ্যা থাকা। আমি আর চিন্তা করতে পারলাম না। মানুষের ছোট একটাই মাথা। মনে হলো, গত চব্বিশ ঘণ্টায় যা কিছু গেছে আমার এই মাথার ওপর দিয়ে, ভেতর দিয়ে, তা যথেষ্ট আমার মাথা দেয়ালে বাড়ি মেরে ফাটিয়ে ফেলতে চাইবার জন্য। ভোর পাঁচটার কাছাকাছি একসময়ে আমি বিছানায় প্রথমে টানটান শুয়ে, তারপর মায়ের পেটের আট মাস বয়সী বাচ্চার অসিপিটো-পোস্টেরিয়র পজিশনে নিজেকে কুঁকড়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করলাম, কিন্তু একটু পরে বাইরে দিন শুরু হওয়ার অসংখ্য আওয়াজ ধারাবাহিক বাড়তে থাকলে আরও বালিশ মাথার এদিকে-ওদিক দিয়ে, কান বালিশে চাপা দেওয়ার প্রয়াস নিতে নিতে তলিয়ে গেলাম ঘুমের অতলে। শেষ মনে আছে গাছে গাছে জেগে ওঠা অসংখ্য পাখির ডাকের কথা, যা কোনোমতেই কোনো আর্তনাদের মতো লাগছিল না, তাই সম্ভবত আমার মস্তিষ্ক তার শেষ জাগ্রত অবস্থার সুন্দর স্মৃতির ছাপ পুরো মগজ ও স্নায়ুজুড়ে ছড়িয়ে দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে পারল পৃথিবীর বাস্তবতা থেকে সাময়িক ডুব দেওয়ার কাজে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *