আগস্ট আবছায়া – ২.২

২.২

বাড়ির বাইরে পা দিয়েই আমি মনস্থির করে ফেললাম, এ মুহূর্তে আর অন্য কোথায়ও না, স্রেফ ইবরাহিমের ওখানে যাব-আজিমপুরে, নিউমার্কেটের একদম কাছে, এক ভয়ংকর সরু গলির মধ্য দিয়ে ইবরাহিমের লাল ইটে বানানো চোঙামতো একতলা বাড়িটাতে। ১৪ আগস্ট এবং এর সবকিছু, নেপোলিয়নের একগাদা যুদ্ধ ও এর সবকিছু, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে কোপ খেতে খেতে একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলা লুনার বাবার ছোট শরীর ও এর সবকিছু, ক্যানসারে আজ সকালে মাসুম হায়াতের মৃত্যু ও যেকোনো মৃত্যুর যেকোনো ধরনের সম্ভাবনার সবকিছু মিলে আমার নিজেকে মনে হলো আদি পিতা ইবরাহিম এ শহরে থাকতে—আর সেই আদি পিতা ইবরাহিম আবার আমার মোটামুটি ভালো বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও—আমার এই সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় এখানে ঘোরাফেরা ও জীবনযাপনের কোনো মানে হয় না। আমি হাঁটতে হাঁটতে বারিধারার মোড়ের মাথায় এসে, গুলশান-২ ও বারিধারার মাঝখানের সেতু পার হয়ে একটা সিএনজি বাহন যখন আজিমপুর যাওয়ার জন্য ভাড়া করলাম, তখন সন্ধ্যা নামতে আর বেশি বাকি নেই, তখন—এতক্ষণে— মাসুম হায়াত ওপরের পৃথিবীতেও আর নেই নিশ্চিত, এবং নিচের পৃথিবীতে শুয়ে তার যে আমার মতো এই এক দিগ্‌ভ্রান্ত বন্ধুর কথাও আর মনে নেই, সে ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত। সিএনজির ভেতরে বসে ইঞ্জিনের উৎকট শব্দের মধ্যে আমি কুলকুল করে ঘামতে লাগলাম আগস্টের গরমে। সেই গরম থেকে সাময়িক ও মানসিক এক মুক্তি পেতেই যেন আমার মন চলে গেল বহু বছর আগে শ্রীমঙ্গলের এক অপার্থিব সৌন্দর্যে ভরা স্থানে, যেখানে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর দিনে মিলাদের ঠিক শেষে এক সন্ধ্যায়, চা-গাছে ভরা এক উপত্যকাজুড়ে, বৃষ্টি ও রক্তের বন্যা বয়েছিল। 

সিএনজি চলছে। আমার মন বলল, লুনাও আমার মতো আজ আর মাসুম হায়াতদের বাসায় যাবে না সদ্য বিধবা হওয়া বান্ধবী ফারজানাকে দেখতে। নিজের স্নেহময় বাবার মৃত্যু এবং অর্ধমাচরণকারী মায়ের আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা যার আছে, তার কাছে প্রাক্তন স্বামীর বন্ধুর মৃত্যু পত্রিকায় শোকবার্তা পড়ার চাইতে খুব বেশি আর কী হতে পারে? জানি না। হয়তো রাতে ওই বাসায় যাবে লুনা, হয়তো আজ ফারজানাকেও সে বলবে তার নিজের রক্ত জল হওয়া অতীতের কথা, যাতে করে ফারজানা বুঝতে পারে সামনে যা আসছে, তার মধ্যে নির্দ্বিধায় মাথা ঢুকিয়ে দেওয়ার নামই জীবন। জানি না আমি। 

ভাবলাম, লুনাদের বাড়ির ওই কেতাদুরস্ত হাউস কেয়ারটেকার ফরিদকে চলে আসার সময় কোথায়ও দেখিনি। মনে হলো ওদের ওই বৃদ্ধ গার্ড ও ফরিদ লোকটা মিলে কত অনায়াসে জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিতে পারে ও বাড়ির, ওই বংশের শেষ দুটো মানুষের—তিনতলার এক একাকী বৃদ্ধা, যিনি এখনো সম্ভবত জমিদারপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার দুঃখ থেকে আর বাঁচতেই চান না, আর দোতলার সুন্দরী লুনা, যে পিতামাতা-স্বামী সব হারিয়ে ভাবছে যে তার নিজের ছয়-সাত বছরের মেয়েটাই তার কাছে এখন জীবনের সব। আর সেই মেয়েও এখন কোথায় আছে, তা কি জানে লুনা? আমি জানি না। আজ এই ছুটির দিনে এতক্ষণ ওই বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও বাচ্চা মেয়েটাকে আমি কোথায়ও দেখিনি, তার কোনো আওয়াজও পাইনি একবার। সব কি ভেঙে যাচ্ছে তাহলে, বের হয়ে যাচ্ছে নিজের হাতের আঙুলের ফাঁক গলে? সবকিছু ঠিকভাবে গুছিয়ে আনা বলতে কি কিছুই নেই বাস্তবে? বাস্তব কি তুর্কমেনিস্তানের স্তেপে চড়ে বেড়ানো তেজি এক বিরাট ষাঁড়সদৃশ বুনো ঘোড়া যে ঠিক করেই রেখেছে যে তার সহিসের কোনো কথা সে শুনবে না কোনো দিন, কারণ যদি সে তা শোনে তো তার আর বুনো ঘোড়া থাকাই হয়ে উঠবে না? কীভাবে আমরা চাই বাস্তবকে নিয়ন্ত্রণ করতে, বাস্তবের চতুর্মুখী হাওয়ায় সব লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়াকে বাগে আনতে, আর সামান্য ধোঁকার আনন্দ পাওয়ার পরই আবার পরদিন ভোরে কীভাবে ঘুম থেকে উঠে দেখি যে বাস্তব ফের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে খাপ থেকে তরবারি খুলে এবং তা আমারই বুকের মাঝখানে তাক করে। কীভাবে চলে যাচ্ছে একেকটা দিনের পর দিন, এই সব অনেক বড় বড় হার ও অনেক ছোট ছোট কিছু জিতের মধ্য দিয়ে 

র‍্যাংগসের মোড়ে প্রায় এসে গেল সিএনজি। আমি নিজের সঙ্গে নিজে একটা পলাপলি খেললাম। যদি সিএনজি ড্রাইভার সোজা বাংলামোটর, শাহবাগ, টিএসসি হয়ে আজিমপুরে যায় তো আমি ঢাকা মেডিকেলে নেমে যাব মজনুকে দেখতে, কারণ, আজ যেহেতু পৃথিবীব্যাপী অসংখ্য মৃত্যুর দিন, অসংখ্য কবর খোঁড়ার ঠিক আগের দিন, এমনকি মাসুম হায়াতেরও সদ্য মৃত হওয়ার দিন এটা, তাই কে জানে মৃত্যুর বন্ধুবৎসল, সামাজিক হাওয়া মজনুকেও তার গলায় পিন ঢুকে বসে থাকার অজুহাতে এ পৃথিবী থেকেই উড়িয়ে নিয়ে গেল কি না। ভয় হলো আমার বাচ্চা ওই কিশোর ছেলেটার জন্য। মনে পড়ে গেল তার বাবা কাউছারের ক্রোধপ্রবণ কিন্তু ভয়বিহ্বল চোখ, আর মজনুর চোখ-মুখের ত্রাস, যা রক্ত হয়ে তার গলায় ও দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে বারবার উঠে উঠে আসছিল। 

আর পলাপলির দ্বিতীয় ধাপ এটা, এমনও আমি ঠিক করলাম যে সিএনজি ড্রাইভার যদি র‍্যাংগসের মোড় থেকে বিজয় সরণি, মিরপুর রোড হয়ে নিউমার্কেট-আজিমপুরের দিকে যায় তো মজনু প্রসঙ্গ ঝেড়ে ফেলব আমি, ড্রাইভারকে কিছুই বলব না, কোনো পথনির্দেশনা দেব না, স্রেফ মজনুকে ইরেজ করে ফেলব আমার স্মৃতি থেকে—জীবনভর অসংখ্য স্মৃতির কাঁটা তোলার মতোই মজনু নামের আরেকটা কাঁটা সেখান থেকে তুলে ফেলে। এ চিন্তা করতেই—অর্থাৎ মজনু সি-ড্রাইভের স্রেফ এক ছোট ফাইল মাত্র, ডিলিট করে ট্র্যাশ বক্সে ফেলে দেওয়ার মতো এক সাধারণ ওয়ার্ড ফাইল, একটা সামান্য জেপিইজি ইমেজ – আমার নিজেকে সাক্ষাৎ শয়তান বলে মনে হলো, যার মধ্যকার শেষ মানবিকতার ব্যাপারটুকুও তছনছ করে দিয়েছে বিশাল কসমিক কম্পিউটারের এক অদ্ভুতদর্শন মাদারবোর্ড। 

সিএনজি বিজয় সরণির দিকেই মোড় নিল। অতএব, এক শয়তান এখন চলেছে ইবরাহিম নামের আরেক শয়তানের বাড়ির দিকে, যাকে আমি ঠাট্টা করে ‘আদি পিতা’ বলে ডাকি। এখন আর আমাকে পৃথিবীর তথাকথিত শুভের পথে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো বাহন নেই, আমার মতো আরেক দ্বিপদী মানুষের দুটো পা-ও নয়। সিএনজি থামতেই আমি গলিপথে সামান্য হেঁটে ইবরাহিমের রোমহর্ষক চোঙার মতো লাল ইটের দালানে ঢুকলাম। 

নোংরা-ময়লা কলবেলটা টিপতেই সেটা এডভার্ড মুংকের স্ক্রিম ছবির মতো মুখের সর্বস্ব খুলে হা-হা চিৎকার দিয়ে উঠল যেন। দরজা খুলল ব্যস্ত-ত্রাসিত চেহারার ইবরাহিম, তার মুখে অন্তত তিন দিনের না কামানো দাড়ি-গোঁফ। এক ঝটকায় আমাকে ভেতরে টেনে নিল সে, খাড়া করিয়ে দিল দেয়ালে ঝোলানো জিম ফ্রিটজপ্যাট্রিকের আঁকা চে গুয়েভারার বিখ্যাত টু-টোন পোর্ট্রেটের এক বিরাট পোস্টারের নিচে—ওটার ব্যাকগ্রাউন্ড লাল, চের মাথার ক্যাপ, দাড়ি-গোঁফ-চোখ-সব কালো এবং মুখটার আদল সাদা, সেই সঙ্গে ক্যাপের মাঝখানে একটা হলুদ তারার মতো, সহিংস বিপ্লবের প্রতীক ওই তারা। সেই ভয়ংকরদর্শন কিন্তু রমণীমোহন ‘চলো পৃথিবী বদলে দিই’ ধরনের চেহারার সামনে দাঁড়িয়ে আমার নিজেকে আরও বেশি অসহায় বলে মনে হলো যেই না ইবরাহিম হা-হা করে গলার ভেতর থেকে শ্বাস টেনে এনে জোরে বলল, ‘অধ্যাপক-অধ্যাপক-অধ্যাপক তুই এখানে? এদ্দিন পরে? কী কাজ?’ 

আমি সরাসরি মূল কথায় চলে এলাম, বললাম, ‘একটা পিস্তল লাগবে। রিভলবার না। পিস্তল।’ 

ইবরাহিম জিজ্ঞাসা করল, ‘ক্যান?’ 

আমি আবারও যেন যন্ত্রের মতো সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম, ‘আমার নিজের সেফটির জন্য। কাউরে মারার জন্য। দুটোই। আজ ১৪ আগস্ট, মানে পনেরোই আগস্ট অ্যাপ্রোচিং।’ 

ইবরাহিম তার বিরাট শরীর সাৎ করে নুইয়ে নিজের দুই হাঁটুতে দুহাত দিয়ে বাড়ি মেলে বলল, “ওহ্ হো। আগস্ট। এখন তো তোর আগস্ট। আমি তোরে অনেক পছন্দ করি, তুই জানস। কারণ, তুই একটা উন্মাদ, তোর পিস্তল দরকার নাই, চিকিৎসার দরকার।’ 

তখনো সে এভাবেই একদম রুকুর ভঙ্গিতে দুই হাঁটুতে হাত রেখে নুয়ে আছে আমার সামনে। আমি জোরে আমার নিজের হাঁটু দিয়ে ওকে ধাক্কা দিলাম একটা। সে সোজা উল্টে পড়ে গেল ঘরের মেঝেয়, তবে আমার মনে হলো তার এই পড়ে যাওয়া ইচ্ছাকৃত, সে আসলে না পড়ে নিজেকে চাইলে সামলে নিতে পারত। এবার সে শুয়ে থাকল তার পিঠের ওপরে, চোয়াল শক্ত করে ছাদের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, ‘হে অধ্যাপক, তুই আমারে আদি পিতা বইলা আজকে ডাকস নাই। বুকে জড়াইয়াও ধরস নাই। তোর এগুলিন খালি খেয়াল। তোর সবকিছু চিরকাল খেয়াল। মেহেরনাজ খেয়াল, আমি খেয়াল, তোর দুই বন্ধু নূর ও মাসুমও তোর খেয়াল, তোর নেপালের ভান্ডারি-ভট্টরাই-গুরুং-তামাং না জানি কী যেন, ওইটাও তোর খেয়াল। আমি তোর কারণে হজরত ইবরাহিম ক্যান আমাদের আদি পিতা তার সবটি পইড়া ফেলছি। ওই দ্যাখ বইগুলা’-বাঁ হাত তুলে ঘরের শেষ মাথার একদিকে রাখা এক শোকেসের দিকে দেখাল সে; আমি এখান থেকে বইগুলোর কিছু দেখতে পেলাম না, কারণ, শোকেসের কাচে সন্ধ্যার লাল আলো পড়েছে দৃষ্টিবিভ্রম জাগিয়ে—’আর এই দ্যাখ আমার পেটে কত বড় গুলির দাগ’-এবার সে তার নিজের হাফশার্ট তুলল বুক পর্যন্ত, এক ঝটকায়; দাগটা আমার অনেক দিনের চেনা’এই হইল পিস্তল-পিস্তল খেলা, আর এই দ্যাখ হাঁটুর ওপর’—এবার আরেক ঝটকায় নিজের প্যান্ট টেনে নামিয়ে তার ডান হাঁটুর ওপরটা দেখাল সে, সেখানে বড় একটা তেলতেলে গর্তমতো, যেন পুরোনো যুগের রোমান সম্রাটদের ব্রোঞ্জের কয়েন রাখার কোনো গোপন সিন্দুক; এটাও আমার শতবার দ্যাখা-‘এই হইল পিস্তল-পিস্তল খেলার পরিণাম। সারাটা জীবন আমার গেল রে, অধ্যাপক। দাগ দুইটা ছাড়া ধইরা রাখতে পারলাম না কিছুই। এখন শুধু একটাই ডুয়েল খেলা বাকি, কার সাথে তা তোরে মইরা গেলেও বলতাম না আমি। আমি ওই ডুয়েলেই মারা যামু, কারণ, অপনেন্ট ঝাঁৎ কইরা আমাকে গুলি করবে প্রথমে আমার বুক বরাবর, ধোঁকা দেবার জন্য, তারপর সোজা মাথায় কপালের ওপরে। উহ্। আর তুই হারামি, সেই পিস্তল নিতে আসছস এই চোঙা দালানে? আগস্ট লাগছে তোর? আবার?’ 

.

আমি ওর নোংরা আন্ডারওয়্যারের দিকে তাকালাম, সেটার নিচে আদৌ কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে বলে আমার মনে হলো না, এতই ফ্ল্যাট লাগল জায়গাটাকে। আমার আর শুনতে ইচ্ছা করল না ওর এই প্রতিবারের নাটক, প্রতিবারই দেখাসাক্ষাতের শুরুতে এই বীভৎস দাগ দুটো দেখানো। ইদানীং বছরে দুবছরে মোটামুটি একবার হবে আমি আসি এখানে। আগে তো ওর ঝিগাতলার বাসায় বসত আমাদের সাপ্তাহিক আড্ডা, সপ্তাহে কখনো কখনো দুবার। কিন্তু কিছু একটা ছিল আজকে আমাকে এই ভর সন্ধ্যায় তার লাল আন্ডারওয়্যার দেখানোর মধ্যে, যাতে করে আমার মনে হলো ইবরাহিম বদলে গেছে, সে আর এখন এই পৃথিবীর মানুষ ইবরাহিম নেই, হয় সে মিথ হয়ে গেছে, পৌরাণিক কোনো চরিত্র যেমন অ্যাপোলো, পসাইডন বা কোনো ভিনগ্রহের কেউ, যার নামের শুরু স স স ধ্বনি দিয়ে আর শেষ বল্ বা গ্লাজ্জ্বল মতন কোনো শব্দবিহীন পিছল আওয়াজে। 

আমি এক ধমকে তাকে বললাম, ‘ইবরাহিম।’ তারপর আবার : ‘ওঠ, শুয়োরের ছাওয়াল।’ এটা আমাদের সেই দূর অতীতের, এখনকার হারিয়ে যাওয়া গ্রুপটার, প্রিয় গালি। ইবরাহিম উঠতে পারল না। আমার গালি খেয়ে সে মুখ বিরাট ফাঁক করে গোঁ গোঁ শব্দ করল কয়েকবার। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি দেয়ালে হেলান দিয়ে, তাকে উঠতে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছি না। কারণ, আমি জানি সে সাহায্যের কোনো মানে নেই, জানি যে এখন ইবরাহিম যে করেই হোক কিছু একটা ম্যানেজ করে নেবে। এবার সে ক্রল করা শুরু করল, যেভাবে ডিওএইচএস-সংলগ্ন সৈনিক ক্লাবের পাশের মাঠে আর্মির এনসিওরা সকালে ক্রল করে শারীরিক শক্তিমত্তার অসংশয় প্রমাণ রেখে। ওভাবেই সে ভেতরের ঘরে গেল। আমিও ঢুকলাম সেখানে। ঘরের বাতি জ্বালাতে গেলেই ইবরাহিম বুঝতে পেরে চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘না, অধ্যাপক।’ 

আমি সন্ধ্যার আলো-আঁধারির মাঝখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। ইবরাহিম হাঁচড়ে-পাঁচড়ে একটা মোড়ায় উঠে বসল এবং অনবরত বলতে লাগল, ‘খানকির ছাওয়াল, সব খানকির ছাওয়াল।’ সে আরও বলল, প্রায় বিড়বিড় করে, এতটাই যে ঠিকমতো তার কথা শোনার জন্য আমাকে তার আরও কাছে চলে যেতে হলো, বলল, ‘দুবার জেল খাটছি, দুবার পুলিশ আমারে অনেক মারছে।’ 

তার পরের খানিকক্ষণ বিরতি এবং তার পরের কথাগুলো দীর্ঘ এক অনুচ্চস্বর বক্তৃতার মতো। ‘একবার শুইয়া পড়লে আমার উঠতে অনেক কষ্ট হয়, কেউ দ্যাখে না, কেউ দ্যাখার নাই। এতিম আমি। বাবা-মা খোঁজ নেয় না, বাবা-মা নাই। ভাইবোনেরা খোঁজ নেয় না, যারা জানে না আমি কোথায় কোন মুল্লুকে থাকি। এইখানে খালি কত কত লোক আসে আর্মস কিনতে। পুলিশ আসে। কালেক্টররা আসে। পয়সাওয়ালা আর্মস কালেক্টর। আমি শালা আজকাল শুইয়াই থাকি, উঠি না। তোরা তো আর আসস না। তয় চেঞ্জ একটাই হইছে, এখন পিস্তল বেচি নগদ টাকায়, বাকির মধ্যে আর আমি নাই। কিন্তু অধ্যাপক, প্রফিট মার্জিনও আর আগের মতো নাই, অনেক কইমা গেছে, মনোপলি শ্যাষ। ঢাকা শহরেই রিভলবার-পিস্তল-গুলি বেচার লোক এখন পনেরোজনের মতো। বিশ্বাস হয়? ওই দুইটা, খালেক আর মুনশি দুই কুত্তার বাচ্চা আমার আর্জেন্টিনার বারসা মডেল 323 নিয়া পালাইছে, ভারতে গেছে গা, জানস তো? নাকি জানস না? কোনো বিচার নাই। ওরায় একদিনে নিয়া গেছে সিঙ্গেল-অ্যাকশন এসিপি ক্যালিবার বারসা 323 দুইটা, নোরিনকো 59 দুইটা–সোভিয়েত মাকারভের কপি, তোরে আর মাসুম হায়াতরে দেখাইছিলাম আমি, আর গেছে চেক ডুসেক ডুয়ো দুইটা, ১৯০৬-এর ব্রাউনিং একটা। কোনো বিচার নাই। দুঃখও নাই আমার। ওগুলা এখন আর বিক্রিও হয় না। সবাই সস্তা পিস্তল খোঁজে, দশ হাজার, পনেরো হাজার, বিশ হাজার টাকার মধ্যে পিস্তল। শালা, একটা ঠেলাগাড়ির দামের সমান পিস্তলের দাম খোঁজে এহন কাস্টমাররা। জার্মানগুলার কাস্টমার তো একটাও নাই। মাউসার কে কেনবে এখন, দুই-চারটা গুলশান-বনানী-বারিধারার কালেক্টর ছাড়া? এক লোক আসল গত পরশু, কইল সরকারের অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি, মাউসার HSC চাইল একখান, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারে গোয়েরিংয়ের এয়ারফোর্স ব্যবহার করত ওইটা। আমি বললাম, আপনার মতো লোক ঢাকা শহরে এখনো আছে? বসেন, চা বানাই দেই আপনারে। কাস্টমার নাই, ওই মাল আমি তাই আর আনি না, এক লাখ টাকার অ্যাডভান্স দিয়া যান, বার্মা-থাইল্যান্ড থিকা আনাই দিব। আগে, তোরা যখন পাঁচ বছর আগেও আমার ঝিগাতলার বাসায় আইতি, আমার কাছে সাউয়ার 38-H ছিল পাঁচটা, পাঁচটাই বেচছি, সব পলিটিক্যাল পার্টির সেকেন্ড জেনারেশনের পয়সাওয়ালাগো কাছে। প্রধানমন্ত্রীর এসএসএফের লেফটেন্যান্ট কর্নেল আসছিল ওই ঝিগাতলার বাসায়, জিগাইল, হিমলারের এসএস বাহিনীর সেপ ডিয়েট্রিশের পার্সোনাল পিস্তল পাওয়া যাবে একখান? আমি কইলাম, ওইটাই তো সাউয়ার 38 -H, পাঁচটা বেচছি, এখন একটাও নাই। বলল, দুই লাখ টাকার অ্যাডভান্স দিব, আনাইয়া দেন এক পিস। আমি ভাবি, কী দিন ছিল সেইগুলা।’ 

থামল ইবরাহিম। মোড়ায় বসে সামনের দিকে অস্বাভাবিক ঝুঁকে আছে সে, দেখতে মনে হচ্ছে বড় এক সরীসৃপ, যার কোনো মেরুদণ্ড নেই। 

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আলো জ্বালাই?’ ‘না, নো, না, নো, না, নো, না, নো, না, নো’, মোট পাঁচবার করে প্রতিটা না আর প্রতিটা নো বলল সে মন্ত্রপাঠের মতো। আমি বুঝলাম, তার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। অবাক হলাম তার কথা এতখানি অসংলগ্ন হয়ে গেছে দেখে। বললাম, “ঠিক আছে, আমাকে একটা পিস্তল দে, চলে যাচ্ছি। তোর আর কথা বলতে হবে না।’ 

ইবরাহিম উত্তরে বলল, “খানকির পোলা, আমার পিছে দাঁড়াইয়া একটু ঘাড় টিপ্‌পা দে। বড় ব্যথা। উহ্‌হ্‌হ্।’ 

আমি হেঁটে ওর পেছন দিকে গিয়ে দাঁড়ালাম, ওর ঘাড়ে হাত রেখে যত্ন করে টিপে দিতে লাগলাম, অনুভব করলাম ওর সারা শরীর কাঁপছে বড় বৃদ্ধ ঘোড়াদের মতো। বুড়ো বয়সে বুদ্ধিবৈকল্য হলে মানুষের শরীর এমনভাবে কাঁপে অতীতের অনেক বুদ্ধিজ্ঞান সব হারিয়ে যাওয়ার দুঃখ থেকে। 

বললাম, ‘ইবরাহিম, আদি পিতা, তুই বুড়া হয়ে যাচ্ছিস।’ 

সে বলল, ‘তা-ও ভালো যে আমার আদি পিতা নামটা ভোলোস নাই। বয়স আমার এখন পঁয়ষট্টি, শালা। তুই আমার ছেলের বয়সী। ভুইলা গেছস?’ তারপর আবার, ‘আগে আমি কথা শেষ করব, তারপর দেখব তোরে পিস্তল দেওয়া যায় কি না।’ এরপর নীরবতা। 

আবার আমি তার ঘাড় টিপে যাচ্ছি, আর দাঁড়িয়ে নয়, এবার মেঝের ওপরে হাঁটু দিয়ে বসে। আগস্টের গরমের ঘাম তার ঘাড়ের দুই পাশ একসঙ্গে তালি-তাপ্পি দিয়ে রেখেছে শ্লথভাবে, তাতে আমার দুহাত ভিজে যাচ্ছে দ্রুত। কোনো ব্যাপার না। ইবরাহিমের গলার স্বর ঘাড় মালিশ পেয়ে বেড়ে গেছে যেন একটু। সে বলল, ‘এক মেয়ে গত মাসে এইখানে আইসা ওয়ালথার চাইছিল একটা। তোর ওই যে শেখ কামাল, তার বউ যে সুলতানা কামাল, ওই তার মতো অ্যাথলেট টাইপের মাইয়া। আমি বুঝলাম, ভালো মেয়ে, কিন্তু মনে হয় হাজবেন্ডরে মারবে, নাইলে তোর মতো কোনো ভার্সিটির টিচাররে-ছাত্রীদের জ্বালাস তোরা, তোদের মারাই উচিত। আমি বললাম, ওইটা তো ক্ল্যাসিক ওয়ালথার, নাইন এমএম ক্যালিবার, ফোর পয়েন্ট নাইন ফাইভ ইঞ্চি ব্যারেল, ওইটা আমি কোথায় পাব বোইন? ওরে বোইন বইলা ডাকলাম আমি। সে হাসল। আমি বললাম, ওয়ালথার কেনার লোকের দিন শেষ। ওয়ালথার বাদ দেন, ইতালির একটা বেরেটাও আমার নাই আর, মেক্সিকোর ওবরেগন আছে একখান? চলবে? সে ওইটা দেখল, সাথে সাথে নগদে কিইনা নিল। পিস্তল চেনে ওই মেয়ে। হাতে নিয়াই বলল ওবরেগন…হুহু…চলবে। এই রকম। তারপর ঠিক এক দিন পরেই ফেরত আসল সে। আমারে বলে, ওবরেগনে চলবে না, মিসফায়ার হওয়ার চান্স আছে, অন্য কিছু থাকলে দেন। আমেরিকার কোল্ট আছে আপনার কাছে? কোল্ট।903 পকেট পিস্তল থাকলে দেন, নাইলে দয়া করে টাকা ফেরত দেন। আমি তারে গালি দিলাম, খুব খারাপ গালি। গালির পরে বললাম, ফাজলামি করেন? টাকা আমি কাউরেই ফিরত দিই না। কিন্তু তারে দিয়া দিলাম, কারণ, সে ভয় পাইয়া কানছিল, গালি দিছি যে, নিতে পারে নাই। কোল্ট, গ্রেনডেল, এসেক্স, রেমিংটন—এই সব কার জন্য আনব আর? দুঃখে বুক ফাইটা যায়। যে দেশে পিস্তলের সমঝদার নাই, সে দেশে আর্ট-কালচার অসম্ভব। আমরা হইছি খালি ভাত খাওয়া লোকেদের দেশ। তোরে আমি বুঝাইতে পারব না পিস্তলের রুচির সাথে একটা দেশের আসল ডেভেলপমেন্টের কত বড় রিলেশন। পিস্তলের রুচি যে দেশে নিচের দিকে, সেই দেশের মানুষের বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসলে রান্নাঘরের মসলার গন্ধ, টয়লেটের গন্ধ—এই সব ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যাইত না।’ 

থামল ইবরাহিম। আমি উঠে দাঁড়ালাম। আগস্টের গরমে আমার মাথা ঘুরছে। একই সঙ্গে সহ্য হচ্ছে না এই অন্ধকার ঘরে কর্মহীন বসে থাকা, ওর কাছ থেকে নানা দেশের নানা পিস্তলের টেকনিক্যাল ডিটেল শোনা। কী লাভ এতে আমার? কী লাভ এতে তার? কেন আমি পিস্তল নিয়ে এসব মেশিন টুলস মার্কা বকবকানি শুনতে যাব। আর পারছি না এ রকম বোধ হলো আমার। 

পিস্তল-রিভলবার-অন্য ফায়ার আর্মস সম্বন্ধে আমি যেটুকু জানি, তা সব এই ইবরাহিমের কাছ থেকে, এত বছর ধরে শুনে শুনে। টেকনিক্যাল বিষয়গুলোতে ওর চেয়েও ভালো ছিল ওর পার্টনার, জুনিয়র পার্টনার মুনশি। তখন খালেক ছিল ফরেন পেমেন্টের দায়িত্বে, মুনশি ইনভেনটরি ম্যানেজমেন্টের, আর ইবরাহিম দেখত সেলস। এমনও দিন গেছে, ওদের ঝিগাতলার বাসায় যেদিন মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, আমরা-আমি, নূর, মাসুম, ইকবাল ও আলমগীর—সবাই ইবরাহিমের অসমবয়সী বন্ধু, আমাদের প্রত্যেকের থেকে সে বয়সে কমবেশি পনেরো-বিশ বছরের বড়-পুরো ঘুরে আসতাম পিস্তলশিল্পের ছোটখাটো ইতিহাসের মধ্য দিয়ে, একদম ধাপে ধাপে ডেভেলপমেন্ট হাতে ধরে, দেখে। পোল্যান্ডের একটা পিস্তল রাদোম, যার ওজন গুলি ছাড়া ছিল আড়াই পাউন্ড, হাত থেকে হাতে ঘুরত ওটা, ইবরাহিম চিৎকার করত ‘বোঝ বোঝ বোঝ এবার পিস্তল কারে বলে’, আর মুনশি বলত, ‘দ্যাখ এইটা VIS-35’। সে কথার মানে কী, তা আমাদের আর জিজ্ঞাসা করা হতো না। একবার গ্রেনডেল P30 দেখেছিলাম চার-পাঁচটা। অদ্ভুতদর্শন পিস্তল, চকচকে কালো রং, মাথা পেনিসের মতো। ইবরাহিম বলত, ‘এইটা কিনবে সেক্সুয়াল পারভারটেরা।’ আমরা হাসতাম। ২ ইঞ্চি ব্যারেল লেংথের একটা ফিনিক্স পিস্তলের সৌন্দর্য দেখে একবার ইবরাহিমের মনে হলো এক্ষুনি অনেক গাঁজা টানতে হবে, না হলে ওর রূপের মূল সার মাথায় ঢুকবে না। 

অসুস্থ সময় ছিল সেগুলো, গগনবিহারী ভাবোন্মেষে ভরা সময়। কিন্তু আজ এত বছর পরে এসব একটুও ভালো লাগল না আমার। কারণ, পিস্তল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির মধ্যে যে ইবরাহিম অমরত্ব খুঁজত, তার আজকের ভাঙচুর হয়ে যাওয়া শরীর আমাকে জানিয়ে দিল যে কত অর্থহীন ছিল তার সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা। আমি তাকে বললাম, ‘বন্ধু, আদি পিতা, আমার ভালো লাগছে না তোর এই সব গল্প। তুই আমাকে একটা পিস্তল দে, আমি যাই। 

ইবরাহিম রাগে গরগর করে উঠল। মোড়া থেকে উঠতে চেষ্টা করে আবার বসে পড়ল মোড়াতেই, তারপর মোড়া থেকে গড়িয়ে মেঝের ওপরে, হাঁটু পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দুহাতে মাথার দুপাশ আঁকড়ে ধরে। চিৎকার করে উঠল সে, ‘আমার কথা তোরে শুনতে হবে, অধ্যাপক। আমি ক্যান এই সব বলতেছি, তা পরে বুঝবি, আমি বলব মূল কথা। কিন্তু তার আগে তোরে জানতে হবে বাঙালি এখন কী কী চিপ পিস্তল কেনে। সবকিছুর কানেকশন পরে বুঝাব তোরে, শালার পুত। আমার কথা শুনতে হবে।’ আমি উপায়ান্তর না দেখে বললাম, ‘বল।’ 

ইবরাহিম আবার শুরু করল তার অত্যাচার, তবে প্রথমে একবারে অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে। সে বলল, ‘খালেক আর মুনশি, দুই কুত্তারবাচ্চাই ফিনিশ। কলকাতার সিঁথির মোড়ের এক বাসায় এই মার্চ মাসে গলা কাটা হইছে ওদের দুইজনের, একসাথে। আমাগো এই ব্যবসায় চোগলখুরির কোনো জায়গা নাই। হা-হা।’ 

আমি খালেক ও মুনশির পালিয়ে যাবার কথা জানতাম, এটাও জানতাম যে তারা ভারতের হায়দরাবাদে আছে। মনে আছে হায়দরাবাদের কথাটা আমাকে বলেছিল মাসুম হায়াত। কিন্তু ওরা যে এখন মৃত, ইবরাহিম যে শেষমেশ তার প্রতিশোধ নিয়ে ছেড়েছে, তা আমার জানা ছিল না। আমি দুটো লোকের এক অজানা দেশের অজানা শহরের অচেনা গলির এক না-চেনা বাসায় ভরদুপুরে কিংবা ভরসন্ধ্যায় গলা কাটা হচ্ছে, লোক দুটোকে পাশাপাশি মাটিতে শুইয়ে, ওরা দেখতে পাচ্ছে একই ধারালো রামদা বা বঁটি এগিয়ে নেমে আসছে ওদের গলার দিকে, এই দৃশ্য কল্পনা করে কিছুক্ষণের জন্য ঝিমধরা-কম্পনরহিত হয়ে রইলাম, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘ভালো। বেইমানি করলে ওইটাই হওয়া ভালো। 

কথাটা শুনে ইবরাহিম আমার চোখের দিকে কেমন করে যেন তাকাল। ঘর অন্ধকার, তবু বাইরে মাগরিবের নামাজের পরের সময়টার অনির্ভরযোগ্য ও বিয়োগান্ত আলো আছে বলে ঠিকই মোটামুটি দেখা যাচ্ছে সব। এটুকু অন্তত স্পষ্ট বোঝা গেল যে ইবরাহিমের চোখ ঠায় তাকিয়ে রয়েছে আমার চোখের গভীরে ভীম কানাড়ার ধুয়ো তুলে। আমি অবাক হলাম। ইবরাহিম আমাকে কী বোঝাতে চাইছে? বেইমানির সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? আমার জীবনের মূল লড়াইটাই তো কিছু বেইমানকে নিয়ে, কিছু বেইমানের বিরুদ্ধে। ইবরাহিম জানে সে কথা। সে জন্যই কি? তার দৃষ্টি কি আমাকে সমর্থনের, নাকি সমালোচনার? নাকি কোনো কারণে আমাকে ভুল বোঝার? 

আমি বললাম, “ইবরাহিম।’ সে চোখ নামাল, একনাগাড়ে বলে গেল—আমার মনে হলো প্রসঙ্গ পাল্টে—বাঙালি এখন দুই শ-তিন শ ডলারের মধ্যে কী কী সস্তা পিস্তল খোঁজে, সেগুলোর নাম। ‘কোবরা আর্মস ফ্রিডম .380, হাই পয়েন্ট C9, ডাবল ট্যাপ টু-শট ডেরিংগার স্টাইল, চিয়াপ্পা M922, সেঞ্চুরি নাইন এমএম M88, এনএএ 22LR— দাম শালার পনেরো হাজার টাকা, সেঞ্চুরি P64— মনে হয় সব কটির পাছার মধ্যে ঢুকাইয়া দিব, কেল-টেক P32, রিয়া M200 পয়েন্ট থ্রি এইট—রাবিশ, রাবিশ।’ আমি আর নিতে পারছিলাম না, বললাম, ‘ইবরাহিম থাম। আমার জানার কোনো দরকার নাই এসব। আমি যাব।’ 

আমি বকা শেষও করতে পারিনি, হঠাৎ ভোজবাজির মতো অন্ধকারের কোথাকার কোন গর্ভ থেকে ইবরাহিম একটা পিস্তল টেনে এনে তার দুই হাঁটু সেকেন্ডের মধ্যে সামনের মেঝেয় ফেলে তারপর আমাকে আঁকড়ে ধরে সোজা গিরগিটির মতো আমার শরীর বেয়ে উঠে দাঁড়াল এবং সরাসরি পিস্তলের মাজল ঠেকাল আমার কপালের পাশে, অসম্ভব ঠান্ডা মাজল, আমি শুনলাম তার ঠাস করে ম্যাগাজিনটা অন্য হাত দিয়ে ফ্রেমের ভেতরে জায়গামতো ঢোকানোর শব্দ। আমি থতমত খেয়ে, ভয় পেয়ে নয়, ওকে বললাম, ‘ইবরাহিম, স্টপ ইট।’ সে যেভাবে দ্রুত মাটি থেকে উঠে আমাকে বেড় দিয়ে ধরেছিল, সেভাবেই তৎক্ষণাৎ নেমে গেল আমার গায়ের ওপর থেকে, কিন্তু যাবার আগে আমাকে ধাক্কা দিল একটা। আমি সামনের দিকে পড়ে যেতে যেতে সামলে নিলাম নিজেকে। কিছুক্ষণের জন্য চারপাশে তাকিয়ে এরপর আমি ঠাহর করেই উঠতে পারছিলাম না ইবরাহিম কোথায়। 

‘শালা, তুই একটা ফালতু, ওর গলার আওয়াজ পেতেই সেদিকে তাকিয়ে বুঝলাম সে হেলান দিয়ে আছে একটা আলমারির গায়ে। ‘পনেরোই আগস্ট নিয়া তোর সেন্টিমেন্ট সস্তা, চিপ, বুঝিস তুই? তোর শুধু খারাপ লাগে এক রাতের মধ্যে বঙ্গবন্ধু মারা গেল বউ-ছেলে-মেয়ে সব নিয়া কিছু বেইমানের হাতে সেই ব্যাপারটাই, মানে অ্যান্থনি মাসকারানহাস তোদেরে যেমনে বলছে, যেভাবে বলছে সিনেমার মতো যে একটা পিতা মারা গেল স্ত্রী-পুত্র-সব সাথে নিয়া, প্রায় ঘুমের মধ্যে ভোররাতে গেরস্ত বাসায়, সেই সব খারাপ লাগে, তোর তাই প্রত্যেক আগস্টে দুঃখ করতে করতে, ওনার সিঁড়িতে বইসা থাকা লাশের ছবি দেখতে দেখতে, ওনার বউয়ের দোতলা জুইড়া কান্নাকাটি দৌড়াদৌড়ির গল্প শুনতে শুনতে, শেখ রাসেলের মৃত্যুর পার্টটা বারবার পড়তে পড়তে তোর দুঃখ, তোর ব্যথা এখন হইছে গিয়া তোর জিদ, হইছে রাগ, বেইমানগুলারে নিয়া কী করা যায় সেই ফালতু রাগ। শেষে এইবার তুই আসছিস পিস্তল কিনতে? তোর নিজেরই তো হারামের পয়সা, শালা। কী পড়াস তুই বিশ্ববিদ্যালয়ে? কিসের অধ্যাপক তুই? দুই-চাইরটা-দশটা বই পইড়া পরীক্ষার খাতায় বমি করলে যে কেউ অধ্যাপক হইতে পারে, একটা পান দোকানদারও। তারপর শালা চুতিয়া ঘুরতে থাকো ভার্সিটির মেয়েদের পিছে পিছে, বিছানায় নাও নিজের ছাত্রীদেরে, ক্লাস করার এনার্জি নাও ছাত্রীগুলার বুকের দিকে তাকাইয়া তাকাইয়া -সামান্য ক্যারেকটারও নাই তোগো আর তোরা শিখাস অ্যারিস্টটল-প্লেটো-কান্ট। কান্ট মানে জানোস? ওই কান্টের পিছে গেল তোদের অধ্যাপক জীবন। আবার এখন আসছস পনেরোই আগস্টের শোধ নিতে, পিস্তল কিইন্যা লাইফের মিনিং ঠিক করতে? শুধু এক গাদা বই-ই তো পড়ছিস—নিৎশে, কাফকা, পুশকিন, ফ্লবেয়ার, তুর্গেনেভ, মধুসূদন, বিভূতিভূষণ এই সব বালছাল। তোর মার্সেল প্রুস্ত— হোমোসেক্সুয়াল, ফাউল। তোর ভিতরে তো আল্লাহর ঠান্ডাটুকুও নাই। তাই তোর মধ্যে খালি গরম, তোর মধ্যে শুধু হিংসা, প্রতিহিংসা, অ-ধ্যা-প-ক।’ 

আমি ইবরাহিমকে এবার দেখলাম আলমারির মাথায়। কোনো টিকটিকির মতো, কোনো চেলা কিংবা তেলাপোকার মতো ইবরাহিম কথা বলতে বলতে অবলীলায় উঠে গেছে আলমারি বেয়ে এবং এখন সে ঝুলে ঝুলে দোল খাচ্ছে শূন্যে, শরীরের বড় অংশটা আলমারির ছাদে রেখে। আবার বলা শুরু করল সে : 

‘আমি শালা কী কারণে খালেক আর মুনশির গলা কাটাইছি, তা আমি জানি, আর তুই তো চুতমারানি জানোস না কার জন্য পনেরোই আগস্টের ৪০ বছর পর, কারণ নাই, কারণের আগামাথা নাই, বেমক্কা তুই পিস্তল হাতে নিতে চাইস। গাজীপুর শালবনে দেখছি তো তোর পিস্তল হাতে ধরা, ট্রিগার টিপা ছাড়া তুই জানসটাই বা কী? ফ্রন্ট সাইট আর রিয়ার সাইটের কানেকশনটাই তো তোর জানা নাই। ক্লাস নেওয়ার আগে বইয়ে চোখ বুলানের মতো—যে, এইটা পিস্তলের হ্যামার – বুঝলাম, এইটা স্লাইড স্টপ—বোঝা গেল, এইটা ব্যারেল-ওকে, এইটা গ্রিপ প্যানেল—ফাইন। হইয়া গেল? তাও যদি ক্লাসটাও ঠিকঠাক নিতি তোরা। কাউরে কিছু পড়াস তোরা কোনো দিন? কোনো ছাত্রছাত্রীর জীবনে তোগো কোনো কন্ট্রিবিউশন সিরিয়াসলি আছে? কম্প্রোমাইজ করা শিখানো ছাড়া অন্য কোনো কন্ট্রিবিউশন? আমাগো তো তবু ডাইরেক্ট কন্ট্রিবিউশন আছে মানুষের মরণে। কে কারে ক্যান মারল, সেইটা তাদের ব্যাপার, আমাদের না, এই সব হিসাব আমাগো সাফ সাফ, স্ট্রেইটফরোয়ার্ড—ইংলিশ ঠিক হইল? জানি না। স্ট্রেইটফরোয়ার্ড কন্ট্রিবিউশন। আর তোর? পঁচাত্তরের কত্তগুলা কনফিউশনে তোর মাথা ভরা। তোর সমস্যা রুচির।’ 

কিছুক্ষণ সব নিস্তব্ধ। ঘরের অন্ধকার বাড়ছে, যদিও আমার চোখের দৃষ্টিক্ষমতাও বেড়ে চলেছে, অন্ধকার সহ্য করা অর্থে। আমি বুঝলাম ইবরাহিম আর আলমারির ছাদে নেই। কোথায় আছে সে? একটা ঠাস্ শব্দ পেলাম সামনে ডান দিকে, অন্য ঘরে যাওয়ার ওদিকটায়। বুঝে ফেললাম, খাট উঁচুতে তুলে ধরা হয়েছে এবং ইবরাহিম এখন খাটের নিচে ঢুকে পড়ে ছেড়ে দিয়েছে তার হাত। আশ্চর্য। আবার ইবরাহিম : 

‘সস্তা ফারুক-রশিদের সাক্ষাৎকার পড়তে পড়তে আর কিছু তোগো পড়া-জানা হয় নাই, কারণ, ওইগুলা পইড়াই বঙ্গবন্ধুর জন্য মায়ায় তোগো চোখে পানি আইসা গেছে, আর অন্য কিছু দেখতেও পাস নাই চোখ দিয়া, মাথা দিয়া। কী আছিল অবস্থা তখন, চুতিয়া? চুয়াত্তর সালে আওয়ামী লীগ মিছিল ডাকলে একটা মিছিল হয় না, পল্টনে একটা জনসভা হয় না, আর জাসদ মিছিল ডাকলে খালি মানুষ আর মানুষ। বঙ্গবন্ধু বোঝে নাই যে মানুষ চুয়াত্তর থিকাই তার ওপর থিকা মুখ ফিরাইয়া নিছে। বাকশাল নিয়া শেখ ফজলুল হক মণির ঢাকঢোল চলছে, মণি সবগুলা সিনিয়ররে সাইজ কইরা ঘরে পাঠাইয়া রাখছে, যুবলীগের প্রেসিডেন্ট সে, বঙ্গবন্ধুরে বুঝাইয়া বাকশাল করছে। মানুষ যা আশা করছিল, তার কিছুই হয় নাই, আর মানুষ যা আশা করে নাই, তার সবই হইছিল। মেজর ফারুক কইছিল বঙ্গবন্ধু নিজেরে গড ভাবতেন। আমি জানি তা উনি কখনোই ভাবতেন না, কিন্তু এইটা কেমনে অস্বীকার করবি যে ওই চাইর বছরে একটা সিস্টেম দাঁড়ায় নাই, একটা ইনস্টিটিউশন দাঁড়ায় নাই, যে চায় গিয়া হাজির হয় ৩২ নম্বরের বাসায়, যে চায় গিয়া তারে বলে কী লাগবে তার, বলে কেডা কেডা ভালো, কেডা কেডা খারাপ, যে কুনো কথা। কোনো সিস্টেম উনি দাঁড়া করাইতে পারেন নাই চাইর-চাইরটা বছরে। একটা অফিসের টাইপরাইটার কেনাতেও দেশের প্রেসিডেন্টের সই লাগবে, এইটা কেমন কথা? শেখ মণিরে গিয়া লোকজন মার্চ মাসেই কইছিল, বঙ্গবন্ধুরে মারার প্ল্যান চলতেছে। কিছু করছেন উনি? কইছেন, বাকশাল নিয়া আমরা ব্যস্ত। বাকশাল। কোনো সিস্টেম হইল ওইটা? মানুষ দলে দলে যোগ দিতেছে বাকশালে। কী কাণ্ড।’ 

খাটের নিচে সরসর শব্দ হতে লাগল। আমি বুঝলাম ইবরাহিম খাটের তলার পুরোটা জুড়ে গড়াচ্ছে, তার গড়ানোর শব্দটা শোনাচ্ছে কোনো মোটা টেপ কোনো শক্ত সারফেস থেকে জোরে হঠাৎ টেনে ওঠালে যে রকম শব্দ হয় তেমন-ছারররর। ইবরাহিম বলতে লাগল। 

‘পনেরোই আগস্ট ঢাকা ভার্সিটিতে টিচারদেরও বাকশালে যোগ দিবার কথা ছিল। জানস তুই, অধ্যাপক? তাজউদ্দীন-কোরবান আলী-সামাদ আজাদ কামারুজ্জামান-সৈয়দ নজরুল ইসলাম-মনসুর আলী, ইনাগো পাওয়ার, অথরিটি, কাজ করার ক্ষমতা, স্বাধীন চিন্তা—এই সব ছিল কোনো? মাওলানা ভাসানী, ওইটার কোনো কালার নাই, অয় পনেরোই আগস্টের পরে কী কইল বাদ দে, কিন্তু আওয়ামী লীগের ফাউন্ডারদের একজন আতাউর রহমান খান কইলেন, পনেরোই আগস্ট নাজাত দিবস, পার্লামেন্টের স্পিকার আবদুল মালেক উকিল কইলেন, জাতি ফেরাউনের কবল থিকা মুক্তি পাইছে, বাকশালের আরেক টপ লিডার মহিউদ্দিন খোন্দকার মোশতাকের পক্ষে চিঠি নিয়া গেলেন মস্কো। এমনে এমনে? লন্ডনের বাংলাদেশের হাইকমিশনে দুই শ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙতে গেল। কেন? কে দুঃখ করল? খালি ইন্দিরা গান্ধী আর রাশিয়া। ইন্দিরা গান্ধী ভয় পাইল রাজীব গান্ধীর ছেলে রাহুলরেও না ভারতে এমনে মারা হয়, উনি পোলা সঞ্জয় গান্ধী আর ওনার রুমের মাঝখানের দরজা খোলা রাইখা ঘুমাইতে যাওয়া শুরু করলেন। আর রাশিয়ানরা কইল, কসাইরা মুজিব ও তার ফ্যামিলিরে মারছে। ওরা তো কসাই ছিলই। কিন্তু এগোরে কসাই বানাই ছিল সিস্টেম, মানে সিস্টেমের না থাকা। ওই ফারুক-রশিদ-শাহরিয়ার-ডালিম-হুদা-নূর—সব কয়টা কসাই ছিল, আর লগে ছিল কর্নেল তাহের, যারে হিরো বানানো হইতেছে। আর্মিরা বঙ্গবন্ধুরে না মারলে লেফটিস্টরা মারতই।’ 

আমি আমার কপালের ওপরে কী একটা ভেজা ভেজা টের পেলাম যেন। ভেজা না, হালকা ঠান্ডা, হালকা এক টানে সরে যাওয়া তুলির কোনো আঁচড়, বাতাসের কোনো দৈবশাসিত গমনাগমন—একবার বাঁ থেকে ডানে, আরেকবার ডান থেকে বাঁয়ে। তারপর সবকিছু আগের মতো, আগের মতোই আমি ভরা অন্ধকারের এক জমাট ফেনার মধ্যে ঘূর্ণায়মান-স্থির কিন্তু ইবরাহিমের বারবার এদিক থেকে ওদিক ছুটে ছুটে চলার কারণে ঘূর্ণায়মান। 

‘উনি আর্মিদের আদর দিয়া কইতেন আমার সেনাবাহিনী। আদরের ওই দুইটা শব্দ কইলেই সব হইল? আর্মির লোকেদের উপরে অবহেলা কম হইছিল? কয়টা মাত্র অফিসার মাত্র পাঁচ-ছয় শ সোলজার নিয়া পুরাটা ঘটাইয়া ফেলল এক রাতের মইধ্যে? এমনেই? আর্মির টপ টপ লোকগুলা ওদেরে সাপোর্ট দিছে। তাহের যেমন ক্যান্টনমেন্টে লিফলেট বিলি করতে করতে সব জানত, তেমনেই আর্মিতে সব জানত জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, দিল্লিতে থাকা এরশাদ, এমনকি মঞ্জুরও। এত খেপছিল কেন আর্মি? ওই রক্ষীবাহিনী করতে গেল বঙ্গবন্ধু, আর্মির তো রিফর্ম হইলই না, মাঝখান থিকা প্রেসিডেন্টের গার্ড, প্রেসিডেন্টের গোয়েন্দা, প্রেসিডেন্টের নিজের আর্মি—সব হইল গিয়া রক্ষীবাহিনী। এক রক্ষীবাহিনীর উপরে খেইপাই সেনাবাহিনী কইল, দাঁড়া, দেখাইতেছি। আর বঙ্গবন্ধু তখনো বইলাই যাইতেছেন, আমার দেশবাসী আমারে ভালোবাসে, আমার সেনাবাহিনী আমারে ভালোবাসে, আমি তাদেরে ভালোবাসি। এইটারে কয় দেশ চালানো? আর আর্মির বাইরে আছিল তাহের, জলিল, ইনু—এরা। এরায় আর্মিরে সাহস দিছে, 

গণবাহিনী সঙ্গে আছে কইছে, আর্মিরে মোশতাক-তাহের ঠাকুর-জিয়াউদ্দিন-আকবর হোসেন-শাজাহান ওমর এগোর খোঁজ দিছে। সফিউল্লাহ আর্মি চিফ হইয়াও ছিল একটা কান্দইনা বুড়া। সে সব জানত। কিন্তু সে খালি কাঁপছে আর কানছে, জুনিয়র পোলাপানগো সামনে কানছে। এরে কয় আর্মি চিফ? শাফায়াত জামিলের কথা আমি জানি না। বিডিআর চিফ সব জানত। তিনখান দল ছিল।’ 

কোত্থেকে কোন বাড়ির আলো জ্বলে উঠল কোনো এক দিকে। আমি আগের চেয়ে একটু হলেও বেশি দেখতে পাচ্ছি সবকিছু, এবং এই প্রথম বুঝে উঠতে পেরেছি যে কেন এতক্ষণ আমার মনে হচ্ছিল ইবরাহিমের গলার আওয়াজ আসছে আমার সমতলের সামান্য উঁচু থেকে। আমি দেখলাম একটা বস্তু, ইবরাহিম, হয় সে শজারু, না হয় টোঁড়া সাপ, কিংবা নিদেনপক্ষে বিরাট এক তুঁতপোকা, আমার সামনের দিকের জানালার সবচেয়ে উঁচু গ্রিলটায় চড়ে বসে কেমন ছলাৎ ছলাৎ করছে নদীর ঢেউয়ের মতো করে। হঠাৎ গলার জোর বাড়াল সে, আবার বলল : 

‘শুনছস, ব্যাটা? দল আছিল মোট তিনখান। এক দল জানত যে কী হইতে যাইতেছে—সেইটায় আছিলো জিয়া, খালেদ মোশাররফ, সফিউল্লাহ, ওসমানী, দিল্লির এরশাদ, মঞ্জুর, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, মাহবুবুল আলম চাষী, মইনুল হোসেন, ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম, আর এগো মইধ্যে ওসমানী ছিল একটা আস্তা ঘোড়েল। কিন্তু এরা ডাইরেক্ট কিছু করে নাই সেই রাইতে, অন্যে ঘটনা ঘটাইছে আর গ্যালারিতে বইসা খেলা দেখতে দেখতে এরা মজা নিছে। আরেক দল সব জানত আর প্ল্যানমতো ঘটনা ঘটাইছে—মোশতাক, তাহের ঠাকুর, জিয়াউদ্দিন, সিরাজুল আলম খান, ফারুক, রশিদ, নূর, শাহরিয়ার, হুদা, ডালিম, দুই মহিউদ্দিন, কর্নেল তাহের, তার ভাই আনোয়ার হোসেন-এরা ডাইরেক্ট অংশ নিছে যার যার কাজের মধ্য দিয়া। আর থার্ড দল, তারা সব জানত না কিন্তু এইটুক জানত যে একটা কিছু ঘটবই ঘটব, হয় আর্মি ঘটাইব না হয় লেফটিস্টরা, না হয় অন্য কেউ। তারা খালি তারিখটা জানত না। তয় জানত যে, যেদিকে গেছে আওয়ামী লীগ আর যা করতেছে যুবলীগ, যা করতেছে রক্ষীবাহিনী, যা করতেছে লাইসেন্স-পারমিট-ব্যাংক লোন পাওয়া লোকজন, তাতে শেষটা আসতে বাকি নাই, জানত তারা—এনারাই পঁচাত্তরের নীরব পক্ষ, এনারা তাদের নেতারে বাঁচান নাই, জোর দিয়া বলেন নাই যে আপনার ও আপনার ফ্যামিলির উপর বিপদ আসতেছে, আপনারে এই বাড়ি ছাড়তে হবে, গণভবনে বঙ্গভবনে গিয়া উঠতে হবে, আপনার সিকিউরিটি সাজাইতে হবে, আপনার নিশ্চিত কিলিং ঠেকাইতে হবে। এই দলে আছে কারা জানস? এক্কেবারে তাজউদ্দীন, কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম থিকা নিয়া শেখ মণি পর্যন্ত। আমি শুনছি এদের মধ্যে কারও কারও কাছে তো প্রস্তাবই গেছিল ডালিমদের কাছ থিকা। এনারা নাকি রাজি হন নাই, তারপর খুনিরা গেল মোশতাক ব্যাটার কাছে। মোশতাক বইসাই ছিল রাজি হওয়ার জন্য। কিন্তু আমার কথা হইল, এনাদের তো আন্দাজ ঠিকই ছিল যে, মোশতাকরা, পাকিস্তানপন্থীরা, পাকিস্তান ভাঙার শোধ নিবার জন্য কী করতে পারে। তাজউদ্দীন সাহেবই খালি বঙ্গবন্ধুরে বলছিলেন যে, মুজিব ভাই, চক্রান্ত চলতেছে, সাবধান। অন্যরাও বলছিলেন কি না, আমি জানি না। তয় এরা যে তাগো মুজিব ভাইরে ভালোবাসতেন, সেটা নিয়া আমার কোনো সন্দেহ নাই। আমার খালি আফসোস, আসল কাজের কাজ এনারা কেউই করেন নাই। এরা টের পাইতেছিলেন মোশতাক, আর্মির ফারুক-রশিদরা আর চাষী মিইল্যা কুমিল্লার কোথায় বসতেছে, এই সব। তো এনারা বড় বড় নেতা, চাইলে এনারা কি দল বাইন্ধা ওই পাকিস্তানিগুলারে অ্যারেস্ট করাইয়া, পিটাইয়া সব চক্রান্তের নাড়ি-নক্ষত্র বাইর করতে পারতেন না? তাইলে না হইত কাজের কাজ করা। এরাই পরে মারা গেলেন জেলখানায়। মানুষ ভালো ছিলেন এনারা, কিন্তু বঙ্গবন্ধু যেমনে দেশ চালাইতেছিলেন, এনারা না পারছেন ওনারে বাঁচাইতে, না পারছেন নিজেদেরে বাঁচাইতে। তো শেখ মণিরে মারল কেন ওরা ওই রাইতে? 

প্রশ্নটা আমাকে করেই ইবরাহিম লাফ দিয়ে পড়ল জানালার গ্রিল থেকে। এবার সে গড়াচ্ছে মেঝেতে, যেভাবে অন্ধ-লুলা ভিখিরিরা আমার ছোটবেলায় গড়িয়ে চলত বরিশালের নুড়ি ওঠা রাস্তাগুলো বেয়ে, চিৎকার করে গানের সুরে বলতে বলতে : ‘আমার আল্লা নবীজির নাম…’, সেভাবে এক নিয়মিত শারীরিক ছন্দে মেঝেজুড়ে গড়িয়ে চলেছে ইবরাহিম। এ কারণেই একবার তার কথাগুলো মনে হচ্ছে ভেসে আসছে দূর থেকে, পরক্ষণে কাছ থেকে। একবার দূর, যখন তার শরীর আমার উল্টো দিকে, একবার কাছ, যখন তার গড়াতে থাকা শরীর আমার দিকটায়। অসহ্য এক স্বরবিক্ষেপ, অবর্ণনীয় এক অবস্থা। বলতে লাগল ইবরাহিম : 

‘মাত্র ৩৬ বছরের একজন, এত এত সিনিয়র নেতা থাকতে তারা এই বাচ্চা লোকটার বাসায় গেল ক্যান ট্যাংক নিয়া? প্ল্যান ছিল পনেরোই আগস্ট ঢাকা ভার্সিটিতে সংবর্ধনার সময় বঙ্গবন্ধুরে করা হবে আজীবন রাষ্ট্রপতি, তার সেজ বোনের স্বামী সেরনিয়াবাতরে প্রধানমন্ত্রী, তার মেজ বোনের বড় ছেলে শেখ মণিরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আর তার নিজের বড় ছেলে কামালরে যুবলীগ প্রধান। আমি শুনছি। আমার শোনায় ভুল আছে বইলা আমার মনে হয় না। থাকতেও পারে। আসলে মণি নিজেরে গুছাইতেছিল শেখ কামালরে টপকানোর জইন্য। হ্যায় ছিল মিসগাইডেড, মিসলেড। ইংলিশ ঠিক আছে আমার? আর শালা, মাঝখান থিকা মরল শেখ কামাল, বয়স তার মাত্র ২৬ বচ্ছর। চিন্তা করতে পারস? তোর মতো আমার যদি সেন্টিমেন্টের দিক থিকা একটা লোকের জন্যও খারাপ লাগে তো সেইটা শেখ কামালের জইন্য। ওর মতো ভালো, ভদ্র ছেলে ছিল না আর একটাও। ২৬ বছর বয়স। ওই বয়সে সে কিনা আবাহনী বানাইছে, স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী করছে, ওরা আধ্যাত্মিক গান বাজাইত, ঢাকা থিয়েটার বানাইছে, কাকলী বিদ্যালয় করছে, সেইটাও গানের। ২৬ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে। ওর অর্গানাইজিং—ইংলিশ ঠিক কইলাম?—ক্ষমতা দেখছস? সবাইরে সম্মান দিয়া চলত সে, পকেটে দু-চারটা টাকা থাকত তা দিয়াই চলত, মার কাছ থিকা ধার নিয়া চলত, বিয়াও করল যারে ভালোবাসত তারেই-অ্যাথলেট সুলতানা খুকিরে। সে সেতার বাজাইত, তার ছোট ভাই গিটার বাজাইত। কী একটা রুচি ছিল ওই দুই ভাইয়ের, যেইটা তোগোমতো বাইরে পড়া ভার্সিটি টিচারদেরও আইজ নাই। একটা অর্গানাইজেশন তোরা কেউ এই সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ বছর বয়সেও গড়তে পারছস? আর কামাল আবাহনীর মতো ক্লাব বানাইয়া ফেলল। টাকা মারার হাওয়া ভবন, এই সব বালছাল ভবনের ধারেকাছে দিয়া সে যায় নাই। কিন্তু তুই দ্যাখ, ওই কামাল-জামাল-সুলতানা-রোজী-রাসেল—সব কয়টায় বাচ্চা বাচ্চা, আজ আটচল্লিশে বুঝস তো ২৬, ২১, ২৪, ১৯, ১১ এই সব কত্ত বাচ্চা বয়েস, কত্ত ইনোসেন্ট বয়েস। এত্তগুলা বাচ্চা পোলাপাইন, মাইয়া আর সরলসোজা ছোট ভাই নাসের এই সবগুলারে নিয়া কেমনে, তুই দেখ, কেমনে মরল দেশের প্রেসিডেন্ট-পঁয়তাল্লিশ মিনিট এদিক-ওদিক ফোন ঘুরাইল যারা খুনি পার্টির লোক তাদেরে ফোন কইরা, আর যারা অকম্মা, জানত যে একটা কিছু হইব কিন্তু কোনো প্রস্তুতি নেয় নাই খুন ঠেকানোর, তাদেরও ফোন কইরা। কী জঘন্য, তিনি মারা গেলেন নিজের বাসায়, একটা মিডল ক্লাস বাসায়, এক্কেরে আনাড়ির মতো, মারা গেলেন তিনি আর তাঁর বাসার সবাই। এইটা একটু ভাবছস কোনো দিন? এইভাবে মরে কোনো প্রেসিডেন্ট তাঁর বউ-ছেলে-মেয়ে-ভাই-ছেলের দুই বউ, সবতেরে নিয়া? এ-ই-ভা-বে এত্ত সহজে?’ 

আমি কোনো ফণা তোলা সাপের ফোঁস ফোঁস না, একটা বাস্তুসাপের ক্ষীণ নিশ্বাসের শব্দ শুনলাম যেন, একটা মৃদু শিস, না, তা নয়, একটা সামান্য শু..শু-শব্দ। মনে হলো কোথায়ও কয়লা পুড়ছে, আর কে যেন একটা একটা করে পোড়া কয়লায় দুফোঁটা করে পানি ঢালছে, আর তখনই শব্দটা হচ্ছে—শু… ছ্যাৎ…শু…ছ্যাৎ। ইবরাহিমকে আমি আর দেখতে পাচ্ছি না কোথায়ও, তবে মনে হচ্ছে মেঝের নিচ থেকে, নিচের মাটির গর্ভ থেকে আওয়াজটা আসছে-ছেঁদা-ছিদরি থেকে, খোঁড়ল-খোন্দল থেকে চাপে পিষ্ট তার গলার আওয়াজ। 

‘এইডার মানে কী জানস? দেশেরে যেমন উনি চার বছরেও কোনো সিস্টেম দিতে পারেন নাই; তেমন নিজের আর বাড়ির কারও জন্য কোনো সেফটি দিতে পারেন নাই। ওনার মরণের স্টাইলের মধ্যেই বোঝা যায়, সুইসাইডের মতো ছিল ওইটা। চুয়াত্তর সাল থিকা তিনি সুইসাইড সুইসাইড খেলছিলেন নিজেরে নিয়া, নিজের ফ্যামিলি নিয়া। উনি কইতেন, এক পরিবারের এক ভাই যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের দালালি করছে তো আরেক ভাই করছে মুক্তিযুদ্ধ। সব পরিবারেই অনেকে ভুগছে। আমি তাগো ভোগান্তি আর বাড়াইবার চাই না। এই কথার মানে বুঝস তুই? কী ডেঞ্জারাস কথা। তাঁর কাছে লোকে আইল, কানল জেলে থাকা স্বামীরে মুক্তি দিতে বইলা, আর তিনি তা দিয়া দিলেন বারবার, চিন্তাও করলেন না দেশবিরোধী দালালদেরে ক্ষমা দেখাইয়া তিনি কেমনে জাতির ক্ষতি করতেছেন। তাঁর নেতারা তাঁরে নিয়া কইত, বঙ্গবন্ধু এইটা কী করলেন? তিনি কইতেন, থাক, মহিলার পরিবারে তার স্বামী ছাড়া আয়-ইনকামের আর কেউ নাই। নেতারা ভাবতে লাগলেন, বাব্বা, ভালো কথা, তাইলে চোর খুনি যা-ই হউক, পরিবারে উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তি হইলেই শাস্তি নাই, দণ্ড নাই। হায়রে, তিনি এইটা বুঝলেন না যে তিনি এহন আর মুজিব ভাই নাই, তিনি দেশের নেতা, ক্ষমাশীল না হইয়া নেতারে হইতে হবে ন্যায়পরায়ণ, তাঁর এই অল্প কয়জনের জন্য দয়ার আসল মানে যে বিরাট সংখ্যার মানুষের জন্য অন্যায়। এই সবের কিছু বুঝেন নাই উনি। এই জন্যই তো লোকে কইত বাংলাদেশ মানে শেখের রাজত্ব। মুজিব কইতেন, তোমরা আমারে ভুল বুঝতেছ। আমি জাতির পুনরেকত্রীকরণ করতেছি। যারা দেশটাই চায় নাই, তাদের লইয়া পুনরেকত্রীকরণ? মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের দালালগুলারে ক্ষমা কইরা তিনি কি ভাবছিলেন যে তারা ওনার অনুগত হইয়া যাবে? কী বিরাট ভুল, কী বিরাট ভুল। আনুগত্য, বিশ্বস্ততা ওই সব জিনিস এই দালালেরা জানত?’ 

জন্তুটা, সরীসৃপটা এবার আকস্মিক আমার মুখের সামনে। আলো-আঁধারির অপার্থিব সে মুহূর্তে নিজের ঘামে ভেজা গাল দিয়ে, কিংবা তার হাতের আঙুল, কিংবা তার কনুই, কিংবা তার পেট বা বুক দিয়ে—আমি সত্যি জানি না তার শরীরের কোন অংশ দিয়ে-আমার ডান গাল ছুঁয়ে দিল ইবরাহিম, এবং আমার একেবারে মুখের উপরে তার মুখ এনে আমাকে এবার এক সম্পূর্ণ অন্য রকম কণ্ঠে, নানী-দাদীদের গল্প বলার গলায়, বলতে লাগল : 

‘শোন, আমি নিজে এক পুলিশ অফিসাররে চিনতাম। আমার আব্বার বন্ধু। হালায় ছিল বিরাট পাকিস্তানপন্থী। গাবতলীর দিকে কম কইরা হইলেও দশটা বাঙালির মৃত্যুর জন্য ওই পুলিশ দায়ী ছিল। তো হ্যায় গেল বঙ্গবন্ধুর কাছে, আমার আব্বারে লইয়া। যে কেউ যাইতে পারত বঙ্গবন্ধুর বাসায়, মানুষ খেতের পটোল, উইচ্ছা, রান্না করা মুগ ডাল লইয়াও ওনার বাসায় যাইত, তো সে কইল, বঙ্গবন্ধু আমারে বাঁচান, মুক্তিবাহিনীর লোকেরা আমারে মারতে চায়। বঙ্গবন্ধু তারে কইলেন, তোমারে আমি চিনি, তোমার কাছ থিকা এর চাইতে ভালো কিছু আমি আশাও করি নাই। যাও, আমি বইলা দিতাছি, কেউ তোমারে মারবে না। হুহ্। কী মনে করতেন উনি নিজেরে—যিশু খ্রিষ্ট? তোরে কী কই, আমি একটা সাফ সাফ কথা কই যে ওই মরণের রাতটারে মিনিট বাই মিনিট দ্যাখ, এক্কেবারে রাত আটটা থিকা ভোর ছয়টা পর্যন্ত, তাহলে বুঝবি, ক্লিয়ার বুঝবি যে কী উনি চাইলেও আর করতে পারতেন না ওই রাইতে। অন্যদিকে যে কেউ একটু ম্যানেজারিয়াল হইলেই কী করতে পারত, আর উনি কী কইরা ছাড়ছিলেন, সব বুঝবি। উনি যেমনে মারা গেছেন, ওনার বউ উপরে চিৎকার করতেছে, ওনার ছেলেরা গুলি ফুটাইতেছে ঘরের ভিতর থিকা, ওনার ঘরের বাকি সবাই যেমনে খাটের পাশে লুকাইয়া কাঁপতেছিল, কাঁপনেরই কথা, আর উনি যেমনে আবার সেই সেন্টিমেন্টাল কথা খুনিগো বলতেছিলেন যে “আমার দেশের মানুষ আমারে ভালোবাসে, তোরা কারা?” যেইভাবে আবার এইটাও কইতেছিলেন যে, “তোদের এত সাহস, পাকিস্তানি আর্মি আমারে মারতে পারে নাই, আমি জাতির পিতা, আমি বাঙালি জাতিরে ভালোবাসি, বাঙালি আমারে ভালোবাসে,” যেইভাবে হুদারে, পাকিস্তানি মেন্টালিটির ভুয়া বাঙালিগুলারে উনি ওই কথা কইতেছিলেন, যে সময়ে যে গলায় কইতেছিলেন, ওই পুরাটা একটু ভাইবা দ্যাখ, তাইলে তোর আর কিচ্ছু ভাবন লাগব না, তুই ওর মইধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমানরে চিনতে পারবি, মানে আমি কী কইতে চাই তা বুঝাইয়া আর কইতে পারতেছি না, তোরে বুইঝা নিতে হবে, যে এই পুরাটার মইধ্যেই আছে উনি ক্যান অত সহজে, ওইভাবে, দল বাইন্ধা মারা গেলেন দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও। আমার খালি দুঃখ লাগে এক্কেবারে শুরুতে কামাল যেমনে মারা গেল বীরের মতো, সেইটা লইয়া। সে মারা গেছিল গুলি করতে করতে। সোনার ছেলে যদি কেউ থাকে, তো সেইটা কামাল ছিল। এত নিষ্ঠুর অকাল মরণ তার মতো এত কম বয়সের এত বড় প্ল্যানার অর্গানাইজার ডুয়ারের প্রাপ্য ছিল না। বাপের একরোখামিতে, হ, আমি মনে হয় এইটাই কইতে চাইছিলাম এতক্ষণ, বাপের সিচুয়েশন পড়তে না পারার ভুল থিকা মারা গেল কামাল, মরল অন্য সবাই। বুঝাইতে পারলাম তোরে চুতিয়া?’ 

থামল ইবরাহিম। 

ঘর এখন আশি ভাগ অন্ধকার। আমার প্রতিপক্ষের চেহারা যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তা বাইরের বাড়িঘরের আলো এবং আকাশের বিগত হয়ে যাওয়া রঙের অদৃষ্টিগোচরতায় মাত্র। আমার কাছে তার এই দীর্ঘ বক্তৃতার পর এই ছায়া-অন্ধকারকেই বরং কাঙ্ক্ষণীয় বলে মনে হতে লাগল। রাজনীতি নিয়ে ইবরাহিমের নিজের বিশ্লেষণ আমি আগেও অনেক শুনেছি। অন্য সবার সঙ্গে তর্ক করলেও কখনো আমি ওর সঙ্গে ওর বলা কথাবার্তা নিয়ে, বিশেষ করে রাজনৈতিক কথা যদি হয় সেগুলো, তর্ক করি না; এর কারণ সম্ভবত এটাই যে ও যা-ই বলুক, ভুল বা ঠিক, তা আমার কাছে প্রায় সময়েই অরিজিনাল বলে মনে হয়, সেটা আমার অজ্ঞতা থেকেই হোক আর নিজের না জানার ওপরে অনাস্থা থেকেই হোক। অরিজিনাল জিনিসের ত্রুটিটুকু মানুষ স্বভাববশতই দেখতে পায় না—বিষয়টা সে রকম একটা কিছু হবে হয়তো। 

আর আমি কে ওর মতামতকে জাজ করার? তা-ও একটা বড় প্রশ্ন। যদিও আমি মানুষকে জাজ করতেই পছন্দ করি। অন্যকে জাজ করা ঠিক কাজ নয়, এটা অনেক বাজে কথা। পৃথিবীতে যত রকম হিপোক্রেসি চালু আছে, তার একেবারে প্রথম সারির একটা হলো এই বলা যে, ডোন্ট জাজ। আমার ধারণা, ইবরাহিম দ্যাখে তার নিজের জায়গা থেকে—সারা দিন তো পলিটিশিয়ানদের সঙ্গেই ওঠবস করে কাটে তার, এতগুলো বছর ধরে সেটাই করছে সে। সেই দীর্ঘ অভিজ্ঞতারও মূল্য নিশ্চয় কিছু আছে আর আমি আসলেই কে তার সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার (১৯৭৫ সালে তার বয়স পঁচিশ, যখন কিনা আমার মাত্র পাঁচ-ছয়) দিগন্তকে মিথ্যা ছাপচিত্র বলে রায় দিয়ে দেওয়ার? তারপরও, তারপরও, তার আজকের কথাগুলোর অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণতা ও তীব্রতার কারণে এবং যেহেতু সময় এখন সন্ধ্যা, অর্থাৎ আর মাত্র দুই ঘণ্টা পরেই যেহেতু ট্যাংকগুলো বের হচ্ছে অসমাপ্ত কুর্মিটোলা বিমানবন্দরের টারমাকের পথে, আমার মনে হলো ইবরাহিমের এই অসম্ভব ধৃষ্টতামাখা অগণন রায় ঘোষণার শাস্তি আমার ওকে দিতেই হবে। সে আমার পিস্তল চালনা নিয়েও কথা বলেছে। আমি জানি, আমি পিস্তল শুটিংয়ে কত ভালো, আমার বন্ধুরাও তা জানে, ইবরাহিম নিজেও জানে। ওই মেশিনটার টেকনিক্যাল নলেজই যদি সব হতো, তাহলে ছন্দবিশারদেরাই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় কবি হয়ে যেতেন। হাহ্, আমার পিস্তল সামলানোর দক্ষতা নিয়েও ইবরাহিম প্রশ্ন তুলেছে আজ সন্ধ্যায়। আ-জ স-ন্ধ্যা-য়! ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায়? 

আমি আলমারির অন্ধকারের দিকে একটা বড়সড় বস্তুর উপস্থিতি লক্ষ করে বললাম, ‘তোর এতগুলো কথার মূল কথাটা কী, তা যদি আমাকে তুই অতি সংক্ষেপে ডাইরেক্টলি অ্যান্ড কনভিনসিংলি বলতে পারিস তো ভালো, আর যদি না পারিস তো আজ এই রুমেই আমার সঙ্গে পিস্তলের ডুয়েল লড়তে হবে তোকে, হারামির ছাওয়াল।’ 

হা-হা করে হাসল বস্তুটা। তার হাসিতেই স্পষ্ট আমার ডুয়েল লড়ার প্রস্তাবে তার ভয় নেই কোনো। হতে পারে মৃত্যু বিষয়টা নিয়েই তার কোনো ভয়ডর নেই, অতএব তার কাছে হয় আমি মৃত্যুর অছিলা, না হয় একটা ঠাট্টা। সে আমার কথার দ্বিতীয় অংশটা সুতরাং স্বাভাবিকভাবে ধর্তব্যেই নিল না। বলল, ‘ডুয়েল রাখ, দেখা যাবে। প্রথম কথাটার উত্তর দিই আগে।’ আমি বললাম, ‘দে।’ 

অন্ধকারের বস্তুটা এবার ওখান থেকে সরে গিয়ে কোন দিকে যেন চলে গেল, আমি ধরে উঠতে পারলাম না। দৃষ্টিবিভ্রম এর নাম। হঠাৎ শুনি আমার ঠিক কানের পেছনে তার শ্বাসের ফোঁস ফোঁস শব্দ, যেন জাদুতে দণ্ডায়মান এক পাইথন সাপের। আমার কানের ভেতরেই ঢোকাল সে তার কথা, তার শ্বাসের দুর্গন্ধসহ। 

‘আমার সামারি এই। আমি বলতে চাইতেছি, চিপ লোকেরাই এখন পিস্তল কেনে, কারণ, সব পিস্তলই এখন চিপ পিস্তল। তাই তোর এই আজকের দিনে আমার কাছে আসাটাই প্রমাণ যে তুই একটা চিপ মিসগাইডেড লোক, আর তোর দৃষ্টিভঙ্গিটাও খালি আবেগ দিয়া ভরা। চুয়াত্তর-পঁচাত্তরে যত মানুষ মারা গেছে, ধর তোর বরিশালের বানারীপাড়ার যে ফ্যামিলির তিনটা লোকের জান গেল রক্ষীবাহিনীর হাতে, এইটা সত্যি গেছিল, আর ধর যে সিরাজ শিকদার মারা গেল, তুই এইগুলা নিয়া কিচ্ছু বলবি না? এইগুলা তোরে নাড়া দিবে না? এইডারে কয় মিসডাইরেক্টেড চিন্তা, রোমান্টিক চিন্তা, না হইলে হিংসাভরা ফ্যাসিস্ট চিন্তা। ক্লিয়ার? পনেরোই আগস্ট ঘটছে সিস্টেম আছিল না তাই। খুনিরা ওই সিস্টেম না থাকার সুবিধা নিয়া খুন ঘটাইছে। বঙ্গবন্ধু পুরাপুরি সিস্টেম আনতে পারেন নাই বইলাই কয়েকজন ডাকাইত, কয়েক শ ডাকাইত সেইটা আনতে চাইছিল দেশে, ষড়যন্ত্রকারীদের লগে হাত মিলাইয়া। বুঝস সেইটা? শেষ। আমার কথা শেষ। এখন তোর ডুয়েল তুই লড় গিয়া তোর নিজের লগে, খালি আমারে জ্বালাইস না। তোর মতো চিপ লোকের সাথে আমি ইবরাহিম ডুয়েল লড়ি না। আমি ঢাকার ইবরাহিম, তোর পুশকিনের ইবরাহিম না। বহুবার তুই আমারে বলছস তার কথা। ওইটা ফেইক পুশকিনের ফেইক ইবরাহিম, আমি রিয়াল ইবরাহিম। আমি তো তোরে কইছিই, আমি মাত্র আর একটা ডুয়েল খেলুম জীবনে। কিন্তু সেইটা কার সাথে তা তোরে কমু না। সেইটা ধইরা রাখ কারও সাথেই না, তোর সাথে তো না-ই।’ 

ততক্ষণে আমি অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি সব বিড়ালের মতো করে, আফ্রিকান ওয়াইল্ডক্যাটের মতো করে, যে বিড়াল রাতের অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায় মৌরিতানিয়া থেকে জিবুতি পর্যন্ত এবং জাঁকাল হিংস্রতায় নিজের গায়ের লোম খাড়া করে মিথ্যা মিথ্যা নিজের আকার বড় করে আতঙ্কিত করে তোলে তাদের শিকারকে, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইঁদুর, ছুঁচো, পাখি, সরীসৃপ ও এক হাতের তালুসমান বড় পোকাদের ওপরে, সবই অন্ধকারে। ইবরাহিম তাহলে তাদেরই একজন, যারা পনেরোই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের প্রতি উদাসীন। কারণ, তারা মনে করে ‘৭১ থেকে ‘৭৫ পর্যন্ত দেশ শুধু পিছিয়েই যাচ্ছিল, অতএব পনেরোই আগস্টের ‘ত্রাতারা এসে দেশটা বাঁচিয়েছে। 

আমি জানি, এই গোত্রের প্রাণীগুলোকে যদি জেরার পর জেরা করা যায়, যেমনভাবে বোরিং মেশিন শুষ্ক মাটিতে ঘুরে ঘুরে মাটির গভীরে ঢুকে গিয়ে একসময় মাটি থেকে ঠিকই পানি বের করে আনে, এদের যদি সেভাবে নিংড়ে নিয়ে জেরা করা যায় তো দেখা যাবে ওরা একপর্যায়ে ঠিকই স্বীকার করবে, বলবে যে, আমরা আসলে বলতে চাইছি যে, আদতে বলতে চাইছি যে, ১৯৭১ এসেই বরং দেশটা পিছিয়ে গেছে। মূলে গিয়ে তারা আসলে বলতে চাইছে যে, পাকিস্তান থাকাটাই বরং ভালো ছিল। আমি দেখি পুরো বাংলাদেশে, স্বাধীনতার এত বছর পরও, মূল বিভাজনরেখা ওই একটাই, কিন্তু তা নানা শব্দে, নানা বিতর্কে, নানা যুক্তিতে, নানা রঙে, নানা ঢঙে, নানা রূপে সাজানো এমনভাবে যে আপনি ধোঁকা খেয়ে যাবেন, ভাববেন, কত বড় এক দেশপ্রেমিক দেশের জন্য কত মায়া করে বলছেন তার এই কথাগুলো, ভাববেন দেশে তাহলে শিক্ষিত, অবজেকটিভ সমালোচকও আছে আজকাল, কিন্তু সত্য হচ্ছে, সবটাই ভণ্ডামি, সবটাই কথা বলার একটা ভড়ং, ওই নানা শব্দ-বিতর্ক-যুক্তি-রং-বলার ঢঙের রুপালি পর্দাটার ওপাশে সত্য একটাই যে এ দেশের মূল বিভাজনরেখা মাত্র একখানই : হয় আপনি আজও পাকিস্তানপন্থী, না হয় আপনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের। 

আমি ভাবলাম, যার নামের ওপর দাঁড়িয়ে এই দেশটার জন্ম হলো, সেই মানুষটা হাজারো ষড়যন্ত্র ও অব্যবস্থাপনার মধ্যে পড়ে বিভ্রান্ত হয়ে যেতে পারেন, বিপথেও যেতে পারেন সাময়িক ও তাৎক্ষণিক বিচারে, কিন্তু দেশ যেহেতু চিরকালীন, জাতি যেহেতু শাশ্বত, তাই তার ওপরে করা ওই সাময়িক ও তাৎক্ষণিক বিচারটাই নির্মম, আক্রোশপরায়ণতার ঝালে ভরা। আর উনি কিনা নিজের বাড়িতে বউ-ছেলে-মেয়েসহ মারা যাবেন আচমকা এক রাতে, ঘুমচোখে, জানবেন যে তাঁর বড় ছেলে এরই মধ্যে মরে পড়ে আছে সে বাড়িরই নিচতলায়, আর বউ-বাচ্চা-ভাই-কাজের লোকগুলো এখন উন্মুক্ত তাঁর ছেলের ওপর চালানো ওই বুলেটগুলোরই সামনে, জানবেন যে তাঁর নিজের মৃত্যুর পরই মৃত্যু আসছে এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষেরই—এটা হয় না। ওই মৃত্যুকে আমি হাজার বানারীপাড়ার হাজার মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করেও একই ভর ও ওজনের মৃত্যু বলে সিদ্ধান্তে আসতে পারি না, বৃহত্তর রাজনৈতিক তাৎপর্যের বিচারে তো নয়ই, যদিও কোনো সন্দেহ নেই যে বিচারহীন পরিবেশে ঘাতকের হাতে মৃত্যু কারোরই কাম্য নয় এবং প্রতিটা মানুষের মৃত্যুই যার যার আপনজন ও পরিবারের কাছে একই রকম তাৎপর্য বহন করে। 

ইতিহাসের হিসাবগুলো, যেভাবে দেখাতে চাইল ইবরাহিম, যদি এত সোজাই হতো তো মানুষের ইতিহাস বলে কিছু থাকত না। নেতা নেতাই, এবং অনুসারী অনুসারীই—পৃথিবী এত দূর যে এসেছে তা প্রথম থেকে ওই নিয়ম মেনেই। অন্তরের মূল কথা যদি হয় যে পাকিস্তানই ভালো ছিল, তাহলে দেশশাসনে অনভিজ্ঞ একজন মাত্র লোকের ওপরে তাকে খাড়া হতে না দেওয়ার ষড়যন্ত্রনির্ভর অবিচার হবেই—তা-ই হয়েছিল চারটা বছর। আর যাদের অন্তরের মূল কথা ছিল পাকিস্তান চাইনি, বাংলাদেশকেই চেয়ে এসেছি, তাই স্বাধীন দেশের এই দুর্দশা আর বেশি সহ্য করতে পারিনি, তাদের তো উচিত ছিল আরেকটু ধৈর্য ধরা, অধৈর্য হয়ে পাকিস্তানপন্থীদের হাত আরও শক্ত করে না বসা। 

পনেরোই আগস্ট নিয়ে ইবরাহিমের মমতাশূন্য যুক্তি ও চিন্তা আমাকে বিরাট এলোমেলো করে দিল। আমি অন্ধকারে আফ্রিকান ওয়াইল্ডক্যাট হয়ে মোড়াটা দেখতে পেলাম, দুই পা হেঁটে ওটায় বসলাম, খুঁজলাম আমার কানের মধ্যে ওই কথাগুলো বলে পরে ইরিত্রিয়া সুদানের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া ইবরাহিমকে। 

মোড়ায় বসে মাথার পেছনে দুহাত আঙুলে আঙুলে হরাইজন্টাল বেঁধে সামনের অনন্ত অন্ধকারের দিকে চোখ মেলে আমার মনে হলো, এই পৃথিবীতে কীভাবে সত্য ও সত্যি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো একদিকে এবং যুক্তি ও চিন্তা অন্যদিকে; কীভাবে থিওরি ও প্র্যাকটিসের মধ্যে কত অমিল; কীভাবে বাসনা ও প্রাপ্তি কোনো দিনই মেলে না; কীভাবে সত্য ও সত্য হিসেবে প্রতীয়মানের মধ্যে মহাসাগরের আয়তনসমান দূরত্ব; কল্পনা ও বাস্তব কীভাবে আসলে বিপরীতমুখী ধেয়ে যাওয়া দুটো রেলগাড়ি। কত রহস্যময় এই জীবন, মাথা কত ভুল জানা দিয়ে ভরা আমাদের বন্ধুদের, একই দিনে কীভাবে হঠাৎ দেখা যায় দুটো আগের জানা মানুষ, লুনা ও ইবরাহিম, তাদের যা জানতাম তা থেকে কত আলাদা-জানাগুলো সব ভ্রমে ভরা, পূর্বাভাসগুলো ভরা অব্যবস্থাপনার পাঠ দিয়ে, দৃশ্যমান বিষয়গুলো ভরা তাদের পেছনের গোপন অন্ধকারে, বোধগুলো জানে শুধু লোভ দেখিয়ে ঠকাতেই আর সামনে চলার আলো যাতে আছে বলে ভাবা হয়, তা মূলত ইলিউশন। 

জীবনের বৃহত্তম চমকটাই সবচেয়ে বড় ধোঁকায় পূর্ণ : নিশ্চয়তা। প্রকৃতিতে যেহেতু পদে পদে নিশ্চয়তা দৃশ্যমান-যে, সূর্য কাল সকালে আবার উঠবেই, দিনের পরে রাত আসবেই, সমুদ্রের পানিতে লবণ থাকবেই, মিঠাপানি খাওয়া যাবেই, বীজ ছড়ালে ফসল ফলবেই, সন্ধ্যার আকাশে সন্ধ্যাতারা থাকবেই, অমাবস্যার পরে পূর্ণিমা হবেই, উত্তপ্ত মরুভূমি রাতে শীতল হবেই, শীত চলে গেলে বসন্ত আসবেই, আজকের বৃষ্টি কালকে থামবেই, আবার রোদ উঠবেই–প্রকৃতি যেহেতু এই নিশ্চয়তাগুলো দেয় হাজার হাজার মুঠোভরে লাখো আকারে ও প্রকারে, তাই আমরা ভেবে বসি, জীবনও যেন তেমনই হবে, সবকিছুই ঘটবে যেন আমাদের পূর্বপরিকল্পনামতো, পূর্বাভাসনির্ভরতার ডানায় চড়ে। তারপর বাস্তবে গিয়ে আমরা দেখি মানবজীবন চলছে প্রকৃতির উল্টো পথে—সেখানে রূপ ও জঘন্যতা কোনো ব্যাকরণ না মেনে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে আমাদের, নিয়ম ভেঙে চলছে তাদের ধারাবাহিকতা, নামগুলো পারছে না তাদের বস্তুর মূল সারকে তুলে ধরে রাখতে, শব্দগুলো পারছে না বস্তুকে ব্যাখ্যা করতে, প্রত্যাশাগুলোকে জীবন দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে বৈপরীত্য ও বিশৃঙ্খলা দিয়ে, ধারণা ও স্মৃতি প্রতিমুহূর্তে সরে সরে যাচ্ছে পরস্পরের থেকে আরও দূরে দূরে, অতএব শেষে গিয়ে এত আছাড়-পাছাড় খেয়ে মনে হচ্ছে নিয়তিই সব, কিছুই করার নেই কারও, আমরা বেঁচে থাকছি আমাদের যার যার অভিজ্ঞতানির্ভর চেতনা নিয়েই, এক অগভীর ও ক্ষণকালীন চেতনা, যে চেতনার ব্যাপারে সচেতন থাকার উপায় নেই কোনো-আমরা বেঁচে থাকছি ওই তথাকথিত চেতনার গভীরে অচেতন থেকেই। 

আমি অন্ধকারে অদৃশ্য ইবরাহিমকে বললাম, ‘থ্যাংক ইউ। আমি আসি ইবরাহিম।’ আবারও জাদুর মতো কোত্থেকে হাজির হলো সে। ততক্ষণে আমি মোড়া থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি আর সে এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক আমার সামনে। 

সে বলল, ‘যাস না।’ 

নীরবতা। 

সে আবার বলল, ‘আমারে জড়ায়ে ধর, অধ্যাপক।’

আমি নিশ্চল, স্থাণু। ইবরাহিম জড়িয়ে ধরল আমাকে। চিৎকার দিয়ে উঠল ‘অ-ধ্যা-প-ক’ বলে। এত জোরে চিৎকার দিয়ে এত জোরেই ওর বাহুর আলিঙ্গনে সে আমাকে পিষে ফেলতে চাইল যে আমার প্রায় প্রস্রাব এসে গেল। 

আমি কীভাবে যেন আন্দাজ করে একটা দরজার দিকে গেলাম, দেয়ালে প্রায় অনুমানে প্রায় দেখে না-দেখে হাত চালিয়ে সুইচ টিপলাম একটা—আলো জ্বলে উঠল বাথরুমের ভেতরে। আমি ঢুকলাম। দরজা না আটকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে পেশাব করলাম। ইবরাহিম বাথরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল, বলল, ‘তোর নুনুটা দেখা।’ আমি বললাম, ‘পাগল নাকি?’ ইবরাহিম বলল, ‘ওকে’, তারপর আমার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল সে পঙ্গুদের মতো বাঁকা হয়ে কমোডের ভেতরে প্রায় পড়ে গিয়ে, তার প্যান্টের চেইন খুলে। এবার চোখ বন্ধ করল সে, ব্যথায় শিস দিয়ে উঠল, ব্যথায় ডেকে উঠল ও-ও-মা-মা করে এবং আমি দেখলাম একই কমোডে আমার পেশাব হলুদমতো আর ওরটাতে তাজা রক্তমাখা। 

ইবরাহিম যন্ত্রণায় প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘কিডনির সমস্যা। তুই পিস্তল কিনলে সেই টাকা দিয়া ডাক্তার দেখামু, থাইল্যান্ড চইলা যামু কদিনের মইধ্যে। তোর কাছে পিস্তল বেচব না আমি, ভাড়া দিমু এক মাসের জন্য। তোর যা কাজ, তা এক মাসের মইধ্যে শেষ করা লাগব। আমি তোরে যে পিস্তল দিমু, তার দাম তুই দিয়া সারতে পারবি না, তাই এক মাসের জন্য ভাড়া নিবি এক লাখ টাকায়, ওকে?’ 

আমি বললাম, ‘ওকে। 

সে তখনো রক্ত ঝরিয়ে পেশাব করে যাচ্ছে কুঁতে কুঁতে আর আমি আমার চিকিৎসার জন্য বড় ভাইয়ার আমাকে দেওয়া টাকাটা থেকে ওকে দিলাম পঞ্চাশ হাজারের দুটো বান্ডিল, তক্ষুনি—পুরো এক লাখ। সকাল থেকেই আমি জানতাম আজ মানবজাতির আদি পিতা ইবরাহিমের সঙ্গে আমার এই লেনদেনটা হবে। 

ইবরাহিম এক হাতে তার পুরুষাঙ্গ ধরে, অন্য হাতে আমার দেওয়া টাকাটা নিল। বলল, ‘এত্তগুলা টাকা পকেটে নিয়া ঘুরতেছিস? ভালো তো।’ আরও বলল, ‘থাইল্যান্ড চল আমার সাথে, সারা দুনিয়ার সব পিস্তল দেখামু তোরে, অল ওয়ার্কস অব আর্ট। ওইগুলা দিয়া সারা দুনিয়ার লোক মাইরা তুই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করিস। যাবি থাইল্যান্ড?’ 

এতক্ষণের অন্ধকার ঘর এখন বাল্বের হলদেটে আলোয় ভরপুর। ধীরে চলা ফ্যানের রেগুলেটর ঘুরিয়ে তিরচিহ্নের মোটা পাশটার প্রান্তে নিয়ে গেলাম আমি। গরম বাতাসের ঝড় উঠল। প্যান্টের বেল্ট-বোতাম সব খোলা ইবরাহিম এবার ঢুকল এই ঘরে, ঘামছে সে রক্তাক্ত প্রস্রাব করার বিপর্যস্ততা থেকে। এবার সে পলিথিনের একটা ব্যাগ বের করল আলমারির পাল্লা খুলে, তার আগে আমাকে সরে যেতে বলল আলমারির ত্রিসীমানা থেকে। তারপর ‘আমি তোর চিন্তাভাবনা কিচ্ছু বুঝি না, অধ্যাপক’ বলতে বলতে ইবরাহিম আমার হাতে তুলে দিল একটা স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন 39।4। বলল, ‘অনেক কষ্টে পাইছিলাম এইটা। অ্যালয় ফ্রেম, ব্লু কার্বন-স্টিল স্লাইড, দ্যাখ শুধু জিনিসটা, সাপের গায়ের রং, নাইন এমএম, ম্যাগাজিন আট রাউন্ড, ভরা আছে, ইউ ক্যান টেক দিস, ইউ মে টেক দিস, কোনটা ঠিক ইংলিশ–মে না ক্যান, ক্যান না মে?’ 

আমি আবার বললাম, ‘থ্যাংক ইউ।’ ততক্ষণে ছোট ব্যারেলের, মেটালের মধ্যেই অন্য রং মেটাল জড়ানো, সবটা নিলে অপার্থিব নীল পিস্তলটার সেই সৌন্দর্য দেখে আমার মূর্ছা যাবার দশা। মেটালের, রুইশ মেটালের এক অক্ষয়-অব্যয় রূপের সামনে দাঁড়িয়ে, ওই রূপ হাতে ধরে ওজন নিয়ে, এক হাতে আবার দুই হাতে নাড়াচাড়া করে ভাওয়ালের শালবনে বহু বছর আগে শুটিং প্র্যাকটিসের স্মৃতি মনে করে, আবার অ্যালয় ফ্রেমটার দিকে মুগ্ধতাভরা চোখে খানিক তাকিয়ে আমার মনে হলো, আমি এমনকি ইবরাহিমের নির্মম ও জঘন্য ধৃষ্টতাভরা আগের পনেরোই আগস্ট নিয়ে বলা কথাগুলোকেও ক্ষমা করে দিয়েছি উল্টো আমার বরং খারাপ লাগছে এ কথা ভেবে যে ইবরাহিম তার জীবনের শেষ ডুয়েলটা লড়বে তাহলে তার নিজের সঙ্গেই, অর্থাৎ নিজের বুকে বা মাথায় গুলি চালিয়ে একদিন আত্মহত্যা করে এই জীবনের ইতি টানার কথাই ভাবছে সে, এই উদ্ধতচারী-পাগলাটে বৃদ্ধ, যাকে তার পলায়নপর জীবন ও পুলিশের নির্যাতন একদম অচল বানিয়ে ছেড়েছে সামান্য চৌষট্টি-পঁয়ষট্টি বছর বয়সেই। 

আমি যখন ওর বাসা থেকে বেরিয়ে আসছি, তখন ইবরাহিম স্টিল আলমারির গায়ে লাগানো শরীরসমান আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মাথার চুল নৃশংসভাবে টেনে ধরে একবার তার হলুদ-লাল জিব, আরেকবার চোখের নিচের দিকটা নিচমুখী টেনে টেনে তার চোখের মণির সাদাটা দেখছে সেই আয়নায়; এ তিনটে কাজ সে করে যাচ্ছে, একই ক্ৰম মেনে বারবার—চুল টানো, জিব বের করো, চোখের মণির নিচের সাদা দৃশ্যমান করো। আমি বেরোতে গিয়েও ওর এই কাণ্ড থেকে দরজায় আটকে গেলাম, তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে, স্থির। একবার মনে হলো, যাই, ওকে থামাই, করছেটা কী সে? আবার মনে হলো, ওকে যদি এই মুহূর্তে দেয়ালের প্লাস্টার নখ দিয়ে তুলে তুলে খেতে দেখতাম, তাতেও অবাক হতাম না আমি। ওর বোতাম-চেইন না লাগানো প্যান্ট কোমর থেকে পড়ে দলা হয়ে আছে পায়ের যে জায়গায় মানুষের মোজা থাকে, সেখানে। আমাকে দেখল সে ভাবশূন্য দৃষ্টিতে, বলল, ‘সাবধানে যাস। রাস্তায় পুলিশ ধরলে বলবি আমি (এখানে একজন বিখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতার নাম বলল সে) সাহেবের লোক। পুলিশ তখন তোরে বড় পুলিশের কাছে নিয়া যাবে, ওনারে ফোন দেবে, উনি তোরে ফোনে চাইবে, তখন ওনারে বলবি আমি আদি পিতা ইবরাহিমের কাছ থিকা আসতেছি। বোঝা গেল? আদি পিতা কথাটা বলতে হবে কিন্তু। ওইটাই আমার পাসওয়ার্ড। আমার পাসকোড।’ 

আমি নিশ্চুপ। এবার সে তার নিজের মাথার চুল অবিশ্বাস্য নির্মমতায় টেনে ধরে, যেনবা মাথার পুরো ক্র্যানিয়াম খুলে হাতে চলে আসাটুকুই বাকি, রোমহর্ষভাবে জিব পুরো বের করে আবার জিজ্ঞেস করল, জোরে ধমক দিয়ে, ‘বোঝা গেল?’ ওর ধমকে আমার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। ওর জাত আমার চেনা হয়ে গেছে আজ। আমি বললাম, ‘আমি তো ভাবছিলাম তুই জামায়াতে ইসলামীর কারও নাম বলতে বলবি। হয় জামায়াতের কারও নাম, না হলে পাকিস্তান পুলিশের আইজির নাম। হা-হা।’ 

বিদ্যুতায়িত হয়ে গেল যেন ইবরাহিম, থেমে দাঁড়িয়ে গেল চুল থেকে হাত সরিয়ে, জিব ভেতরে ঢুকিয়ে, তারপর তেড়ে এল আমার দিকে, থেমে গেল মাঝপথে, দাঁড়াল মাদাম তুসোর মোমের মূর্তির মতো, নিজের রাগ দমন করল মেঝেতে এক পায়ে ঠাক-ঠাক-ঠাক তিনটা বাড়ি মেরে, বলল, ‘ভালো। দিলি তাইলে একটা দলে ফালাইয়া। পঁচাত্তর নিয়া নিজের মনের কথা বললাম, সাথে সাথে হইয়া গেলাম একটা দলের লোক। কু-ত্তা-র বা-চ্চা, তুই আমার সামনে থিকা যা, ‘ চিৎকার করে উঠল সে, ‘আমার সামনে থিকা যা, নাইলে আমি পিস্তল ফিরায়া নিমু। ভাগ, শুয়ার।’ 

ওর গালি বা ধমক খেয়ে খেয়ে নয়, আমি এমনিতেই বেরিয়ে গেলাম দরজাপথ দিয়ে, যেভাবে ড্রেনের পানি নেমে যায় রাস্তার নিচের পৃথিবীতে, বিনা আয়োজনে। আমি বের হচ্ছি, বেরিয়ে গেছি আর ইবরাহিম চিৎকার করেই যাচ্ছে : ‘ভাড়ায় দিলাম তোরে। এক মাস।’ 

আমার পেছনে দরজা বন্ধ হলো দড়াম করে, আমিই করলাম, বুঝতে পারিনি যে ভুলে এত জোরে দরজায় টান দিয়ে ফেলেছি। বিশাল শব্দে নিজেই বিব্রত হলাম, জিব কাটলাম, তারপর মাথা নিচু করে কোমরের মধ্যে পিস্তলটা ঢুকিয়ে ইন করা জামা উঠিয়ে তা দিয়ে সবটা ঢেকে চলতে লাগলাম অস্থির পায়ে, এলোমেলো ওই গলিপথ ধরে, প্রায় টলতে টলতে এবং ভাবতে ভাবতে যে কেন আমাকে সস্তা পিস্তলের অতগুলো গল্প শোনাল ইবরাহিম, তারপর কেনই-বা আবার দুর্লভ ও অনেক দামি পিস্তলটা দিল আমাকে, আর কেনই-বা আমি তাকে সব বলেও বললাম না মাসুমের আজ সকালে মারা যাওয়ার কথাটা। নাহ্, পুশকিন মাথায় এসে ঢুকল আমার। ইবরাহিম বলেছে পুশকিনের কথা। পুশকিনের ইবরাহিমের কথা। অতএব পিস্তলের বাঁটে হাত ছুঁয়ে না রেখে পারলাম না আমি। পুশকিন। কী এক আবেগমথিত, উজ্জ্বলবর্ণ নাম, আর কী দুর্বোধ্যতা, কী বিপত্তি ও গূঢ়ৈষণায় ভরা। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *